এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • প্রসঙ্গ হিংসা

    বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৭ নভেম্বর ২০০৯ | ১০২০ বার পঠিত
  • প্রথমে একজন অদ্ভুত মানুষের গল্প বলি। ভদ্রলোকের নাম নর্ম্যান কেম্বার, বায়োফিজিক্সের এক নামজাদা অধ্যাপক এবং ক্রিস্টান পিসমেকার টিমের সাথে যুক্ত একজন শান্তিকর্মী। ইরাকের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি দেখতে এবং ইরাকি সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে নর্ম্যান এবং তাঁর তিন সঙ্গী ২০০৫ সালে ইরাকে গিয়েছিলেন। নভেম্বর মাসে একটি অনামী মিলিশিয়া ব্রিগেড তাঁদের অপহরণ করে। তাদের দাবী ছিল সমস্ত ইরাকি বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। তাঁদের মুক্তির জন্য বহু টানাপোড়েন চলে। নোয়াম চোমস্কি এবং অরুন্ধতী রায়সহ বহু মানুষ তাঁদের মুক্তির আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেন। অপহরণের পর একশ দিনের থেকে কিছু বেশি দিন পেরিয়ে গেলে নর্ম্যানের অন্যতম সঙ্গী টম ফক্সের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এর প্রায় দুই সপ্তাহ বাদে কম্যান্ডো বাহিনী তিন বন্দীকে উদ্ধার করে। উদ্ধার করার সময় কোনো গুলি চলে নি, এবং কেউ মারা যায় নি। সামরিক কর্তৃপক্ষ নর্ম্যানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন - এক, তাঁরা নিষেধ সত্ত্বেও অযথা ঝুঁকি নিয়ে ইরাক গিয়েছিলেন এবং দুই, তাঁরা তাঁদের সামরিক উদ্ধারকারীদের যথোচিত কৃতজ্ঞতা জানান নি। "যথোচিত কৃতজ্ঞতা' নিয়ে বিতর্কের পর নর্ম্যান ও তাঁর সঙ্গীরা প্রকাশ্য বিবৃতিতে "রক্তহীন উদ্ধারের' জন্য উদ্ধারকারীদের কৃতজ্ঞতা জানান। এর নয় মাস বাদে যাঁরা অপহরণ করেছিল তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। ইরাকি আইন অনুসারে অপহরণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। নর্ম্যান ও তাঁর জীবিত সঙ্গী প্রেস কনফারেন্স ডাকেন এবং অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন। কারণ তাঁরা প্রতিহিংসামূলক বিচারে অংশগ্রহণে রাজি ছিলেন না।

    ঘটনাটি অনেক অনুচ্চারিত প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং হয় তো বা কিছু উত্তরেরও। তবে সেই সন্ধান পাঠকপাঠিকার মর্জির উপর ছেড়ে মূল বিষয়ে প্রবেশ করা যাক।

    ভায়োলেন্স, মানে হিংস্রতা/হিংসা বেশ গোলমেলে ব্যাপার; মনে হয় আপাতত: অনিবার্যও বটে। আপ্তবাক্যসুলভ ঠেকলে আরও একটু খোলসা করা যায় - হিংসা নিয়ে আমাদের গড়পড়তা চিন্তাধারার মধ্যেই একটা জটিল ধাঁধাঁ রয়ে গেছে। হিংসার নিন্দা কি করি না? করি, অবশ্যই করি কারণ হিংসার নিন্দা আমাদের ভাষার দৈনন্দিন অভ্যাস (অবশ্যই, যতক্ষণ সেই হিংসার কোনো দায় নিজের উপর থাকে না), যার মধ্যে সক্রিয় চিন্তার থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত প্রতিবর্তক্রিয়ার আভাস প্রবলতর। হিংসার বিরুদ্ধে এই শিক্ষা অবশ্যই আমাদের সভ্যতার উজ্জ্বল উত্তরাধিকার, কিন্তু এই নিন্দাবাক্যেরও কিঞ্চিৎ হেরফের থাকে। ব্যক্তিগত হিংসার ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত: নি:শর্তভাবে ক্ষমাহীন, কিন্তু সমষ্টিগত হিংসার নিন্দাবাক্যের পিছনে প্রায় সবসময় একটি নীরব অথচ সম্ভাবনাময় "কিন্তু' লুকিয়ে থাকে। সমষ্টি অর্থে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রবহির্ভূত যে কোনো গোষ্ঠী হতে পারে। নিজস্ব বোধ অনুযায়ী আমরা কোনো একটি সমষ্টির পক্ষ অবলম্বন করি এবং সেই সমষ্টি যখন হিংসার পথ বেছে নেয়, তখন আমরা সেই হিংসার নিন্দা করলেও "ইতি গজ' ঢঙে বিরোধী সমষ্টির হিংসার উল্লেখ করতেও ভুলি না। আমাদের এই "কিন্তু' প্রার্থিত হোক বা অপ্রার্থিত হোক, হিংসার নিজস্ব ব্যাকরণে একটি "স্বাভাবিক' প্রক্রিয়া, কারণ এই ব্যাকরণে কার্যকারণসম্পর্ক সর্বদাই উভমুখী, অর্থাৎ "ক খ'কে মেরেছে কারণ খ ক'কে মেরেছে কারণ ক খ'কে মেরেছে....'। এই অনন্ত ধারাপাতের একটি পর্যায়ে এসে মৃতদেহের গুনতির পারস্পরিক নোট বিনিময় নিরর্থক মনে হয়। কারণ ততদিনে মৃতদেহগুলি তাদের তকমা, আকার ও ইতিহাস হারিয়ে ফেলেছে।

    কিন্তু তাও "কিন্তু'টা থেকে যায়। এই "কিন্তু' একটি বিশেষ নৈতিক যুক্তির স্বাক্ষর। আমাদের যাবতীয় রাজনৈতিক বোধ কিছু নৈতিক স্বত:সিদ্ধের কাঠামোর উপর ভর করে থাকে। সেই অন্তর্লীন স্বত:সিদ্ধগুলিকে প্রশ্ন করা সবসময় স্বস্তিদায়ক অভিজ্ঞতা নয়। তবুও আমাদের রাজনৈতিক ডিসকোর্সে ইদানীং তামাদি হয়ে যাওয়া "নৈতিকতা' শব্দটিকে ঝুল ঝেড়েঝুড়ে নামান ছাড়া আপাতত: এই লেখার কোনো গত্যন্তর নেই। সমষ্টিগত হিংসার পক্ষপাতী নৈতিকতার তিনটি রূপ আছে। প্রথম রূপটি ইউটোপীয়, দ্বিতীয় রূপটি প্রতিশোধকামী এবং তৃতীয়টি আত্মরক্ষার অধিকার দাবী করে। বেশির ভাগ সময় বাস্তবে এই তিনটি রূপই সমষ্টির রাজনৈতিক ভাষায় মিলেমিশে থাকে, এবং একটিকে অন্যটির থেকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। তবে লেখার খাতিরে এই বর্গীকরণকে আপাতত: মেনে নিলাম না হয়।

    যখন প্রত্যক্ষ ছাত্ররাজনীতি করতাম, আমাদের মত অল্পবয়সীদের স্তালিনের গণহত্যা নিয়ে স্বাভাবিক কিছু প্রশ্ন ছিল। তখন গ্লাস্তনস্ত ও পেরেস্ত্রৈকার সময়। আমাদের বলা হত - সংখ্যাগরিষ্ঠের উজ্জ্বলতর ভবিষৎ স্বার্থে বর্তমানকে কিছু বৈপ্লবিক নিধন সহ্য করতে হয়/ মেনে নিতে হয়। অথবা, আগামীদিনের লক্ষ প্রাণের জন্য আজকের দশ হাজার প্রাণ, বা এইরকমই কিছু। এটা ইউটোপীয় নৈতিকতার একটি কেতাবী ও ক্লাসিক উদাহরণ। এই ধরনের নৈতিক যুক্তির গোড়ার গলদটা প্রকট। প্রথম গলদটা কেঠো যুক্তির নিরিখে। যেখানে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত,- অনেক সময় শুধু বাস্তবে নয়, ধারণা ও লেখাপত্রেও অপরিষ্কার - অথচ হিংসা ও প্রাণহানিটা প্রখর বাস্তব এবং নিশ্চিতও বটে, সেখানে হাজার লাশের পাহাড়ের পিছনে স্বপ্নের স্বর্গরাজ্যটা শুধু অলীকই নয়, অদৃশ্যও। ইতিহাসে এইধরনের হিংসার বৈধতার খোঁজ করা যেতেই পারে কিন্তু তা অযৌক্তিক কারণ প্রতিটি শতাব্দীরই, এমন কি প্রতি দশকের আলাদা নৈতিক মানদণ্ড থাকে। এক সময়ের নৈতিকতাকে অন্য আর এক সময়ে অবিকল প্রতিস্থাপন করা যায় না। ফরাসী বিপ্লবের সময় "মানবাধিকার রক্ষার' নৈতিক যুক্তি আদৌ গ্রাহ্য ছিল না, এবং "মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা' তো বহুদূর, মৃত্যুদণ্ড ছিল সর্বজনের নিত্যদিনের অবসর বিনোদন। যদি স্বীকারও করি যে ইতিহাসে সমাজ ও রাজনীতির বড় কোনো পরিবর্তনের সময় হিংসার বারুদ জ্বলে উঠেছে, তাও দুটি বিরুদ্ধ যুক্তি থেকেই যায়। এক, যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া যায় যে হিংসা অমোঘ এবং অনিবার্য, তাহলেও সেই অনিবার্যতা হিংসাকে কোনো নৈতিক বৈধতা দেয় না। দুই, হিংসা নতুন সমাজ সৃষ্টি করে না, নতুন সমাজের জন্মসময়ে আমরা অনেকবার হিংসার সংলগ্নতা দেখেছি। হানা আরেন্টের মত অনেকেই মনে করেন, মাও-এর প্রবাদসুলভ বাক্যবন্ধটি "বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস' মূলত: অমার্ক্সীয়। উল্লেখ্য নতুন সমাজের জন্মের সাথে শিশুজন্মের মার্ক্সীয় উপমাটি। দ্রষ্টব্য "preceded" শব্দের ব্যবহার, এবং "caused" শব্দটির অব্যবহার। অর্থাৎ, জন্মক্রিয়ার অনুষঙ্গে গর্ভযন্ত্রণা হতে পারে, কিন্তু গর্ভযান্ত্রণার কারণে শিশুর জন্ম হয় না। হিংসা এবং যুদ্ধের অন্তিম উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, বন্দুকের একটি লঘিষ্ঠ সাধারণ দর্শন থাকে। মাও যখন গেরিলা যুদ্ধের বই লেখেন, তার অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল সুন-জু লিখিত "আর্ট অফ ওয়ার', যে বইটি আবার ইদানীং কর্পোরেট ম্যানেজমেন্টের অন্যতম প্রিয় বই। সি পি আই (মাওবাদী) নেতা গণপতি ইসলামের সশস্ত্র সন্ত্রাসপ্রধান জেহাদকে সমর্থন জানান। বন্দুকের নিজস্ব দর্শন সমস্ত ঘাতককে নৈতিকভাবে সমবিন্দুতে দাঁড় করাবেই, যদিও সেই সাযুজ্য অনেকসময়ই স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান নয়।

    তাও যুদ্ধ হয়, সময়ের মুখ হিংস্রতর হতে থাকে, এবং আমরা বিচার করি কোনটা "ভালো যুদ্ধ/হিংসা' আর কোনটা "খারাপ যুদ্ধ/হিংসা'। এই ভালো-খারাপ বিচারের যৌক্তিক আয়ুধ যোগায় "প্রতিহিংসা/ আত্মরক্ষার অধিকারের' যুক্তি। "প্রতিহিংসা' বা "আত্মরক্ষার' যুক্তির মাঝখানের সীমারেখা যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অস্পষ্ট। "ক খ-কে আক্রমণ করল এবং খ ক-এর সেই আক্রমণ প্রতিহত করল' - হিংসা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এইটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। হিংসার জ্যামিতি চক্রাকার। হিংসা যখন পুনরাবৃত্ত হতে থাকে, তখন দুই পক্ষই নিজেকে আত্মরক্ষাকারী এবং অন্যপক্ষকে প্রতিহিংসাকামী বলে চিহ্নিত করে। কিন্তু যাবতীয় ধোঁয়াশা সত্ত্বেও এইজাতের নৈতিক যুক্তি "ইউটোপীয় হিংসার' নৈতিক যুক্তির থেকে অনেক বেশি জোরাল এবং সামাজিকভাবে গ্রাহ্য। "প্রতিহিংসার' জায়গায় আমরা অনেক সময় "প্রতিশোধ' শব্দটি ব্যবহার করি কারণ হিংসার গণ্ডি পেরিয়ে "প্রতিশোধ' শব্দটির একটি ব্যাপকতর অর্থ আছে। আমাদের রাজনৈতিক স্লোগানে ও সামাজিক বাক্যভাণ্ডারে এই শব্দগুলির প্রাধান্য লক্ষণীয়।

    শ্রদ্ধেয় দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী "প্রতিহিংসা' নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। পাঠক ও পাঠিকা কৌতূহলী হলে গত বছরের অনুষ্টুপ শারদীয় সংখ্যায় দেখতে পারেন। সেই দীর্ঘ লেখার সামান্য নির্যাস পেশ করব "প্রতিহিংসা'র নৈতিক যুক্তি আলোচনায়। প্রতিহিংসার বিভিন্ন রূপের অন্যতম প্রচলিত রূপ হল "Getting even" বা "Tit for tat" , অথবা ক যদি খ-কে আঘাত করে, তবে খ-এর নৈতিক কর্তব্য ক-কে আঘাত করা। এই যুক্তির দুটি দিক প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত:, এখানে আত্মরক্ষার প্রশ্নটা অবান্তর, যদি না ক-এর পুনরাক্রমণের কোনো সম্ভাবনা থাকে। দ্বিতীয়ত:, খ ক-এর সমান হতে পারে তখনই যদি খ ক-এর মতই আচরণ করে। অর্থাৎ, দুজনেই একই অনৈতিক কাজ করছে, শুধু কেউ আগে করছে এবং কেউ পরে। এই হিংসা যদি চক্রাকার হয় তখন এই সময়ভেদটুকুও থাকে না। দুজনেই প্রতিহিংসাকে তাদের নৈতিক কর্তব্য হিসেবে ভাবছে এবং দুজনেই একই কাজ করে চলেছে। নৈতিকতার মাপকাঠিতে দুজনেই একই বিন্দুতে। মানুষের বিচারব্যবস্থার অন্যতম পোক্ত ভিত্তি হল প্রতিহিংসা। সৌদি আরবের মত অগণতান্ত্রিক দেশে বিচারব্যবস্থার প্রতিহিংসাকামিতা প্রত্যক্ষ, অন্যান্য যে সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশে এখনও মৃত্যুদণ্ড বলবৎ আছে সেখানে কিছুটা পরোক্ষ। তবে শুধু রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থাই নয়, অ-রাষ্ট্রীয় বৈপ্লবিক বিচারব্যবস্থা যখন রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার গাফিলতির অজুহাতে তথাকথিত "গণ আদালতে' মৃত্যুদণ্ড রুজু করে, তখন রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র-হতে-চাওয়া বিচারব্যবস্থার কোনো নৈতিক প্রভেদ থাকে না। প্রতিহিংসাকামী নৈতিকতার মূল আদলটুকু অবিকৃত থাকে, শুধু ক্ষমতার রংচঙে মোড়ক পাল্টে যায়।

    "আত্মরক্ষার অধিকারের' নৈতিক যুক্তি অবশ্যই হিংসার যাবতীয় যুক্তির মধ্যে জটিলতম। এই যুক্তির বহু আলোচিত উদাহরণ হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যদি হিটলারের বিরুদ্ধে কেউ যুদ্ধ না করত, তাহলে হিটলারের সাম্রাজ্যে অহিংসার কোনো স্থান থাকত না। অতএব, অনেক সময় হিংসা রোধ করার জন্যই হিংসাকে ব্যবহার করতে হয়। অথবা আরও ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে, ধরা যাক, কেউ যদি আমাকে মেরে ফেলতে বদ্ধপরিকর হয়, আত্মরক্ষার তাগিদেই আমি তার বিরুদ্ধে হিংসা ব্যবহার করতে বাধ্য। যদিও মনে রাখা দরকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হিংসা সবসময় আত্মরক্ষার অধিকারের মধ্যে সীমিত থাকে নি। সার্বভৌমত্ব ও নাগরিকের আত্মরক্ষার জন্য ড্রেসডেন বম্বিং বা হিরোশিমা নাগাসাকির ঘটনা প্রয়োজনীয় ছিল না। অতএব, আত্মরক্ষার্থে হিংসা অল্প আয়াসেই প্রতিহিংসাকামী হিংসা, এবং পরবর্তী পর্যায়ে আগ্রাসী হিংসায় রূপান্তরিত হতে পারে। আবার ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে আক্রমণ প্রতিহত করতেও আমরা কিন্তু প্রথমেই হত্যার পথ বেছে নিই না। সুযোগ থাকলে হয় আক্রমণকারীকে এড়িয়ে যাই, বা পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করি, এবং শারীরিক মোকাবিলার সম্ভাবনা কোনোভাবেই এড়ানো না গেলে আক্রমণকারীকে নিশ্চল করে দেওয়ার চেষ্টা করি। একই নৈতিক শৃঙ্খলা আমরা আইনরক্ষকদের কাছেও প্রত্যাশা করি। সেইজন্যই কোনো জমায়েত বা মিছিল যদি হিংস্রভাবে পুলিশকে আক্রমণ করে আমরা আশা করি ন্যূনতম প্রাণহানি ঘটিয়ে পুলিশ যাতে এই আক্রমণ ছত্রভঙ্গ করে। অর্থাৎ, আত্মরক্ষার অধিকারের যুক্তিও সরাসরি ব্যক্তিহত্যাকে সমর্থন করে না।

    কিন্তু হত্যাকে সমর্থন না করলেও হিংসার ব্যবহার হয়। যে কোনো আক্রমণ প্রতিহত করতে আমরা তিনটি পথের যে কোনো একটি বেছে নিতে পারি। এক, আক্রমণ এড়িয়ে যাওয়া, দুই, প্রতি আক্রমণ করা এবং তিন, কিছুই না করা। তিন নম্বর পথটি আপাতত: জনপ্রিয় না হলেও অসম্ভব নয়, বা অনৈতিহাসিকও নয়। অহিংস সত্যাগ্রহের সময় আমরা বৃটিশ পুলিশের নির্মম আক্রমণের নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ দেখেছি। কিন্তু মেনে নেওয়াই ভালো এই দুর্গম পথ সবার পথ নয়। আত্মরক্ষার জৈবিক প্রবৃত্তিকে প্রতিহত করার দু:সাধ্য অভ্যাসের ভরসা না রাখাই ভালো। এক নম্বর পথ সবসময় সম্ভব নয়। দ্বিতীয় যুদ্ধই তার ঐতিহাসিক উদাহরণ। অতএব, বহুক্ষেত্রেই মানুষ দুই নম্বর পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। এখানে "বাধ্য' শব্দটা সম্পর্কে সচেতন থাকা দরকার। সচেতন থাকলে আমরা "ন্যায্য হিংসা' ও "প্রয়োজনীয় হিংসার' তফাৎটা বুঝতে পারব। কোনো হিংসাই ন্যায্য নয়, এমন কি আত্মরক্ষার জন্য হলেও। বিরল সময়ে হিংসার ব্যবহারের "প্রয়োজন' হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয়তা এবং নৈতিক বৈধতা সমার্থক নয়। উটা ইন্ডিয়ানদের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রথা প্রচলিত ছিল। যদি এই গোষ্ঠীর একজন আর এক জনকে হত্যা করে, আত্মরক্ষার জন্য হলেও, সামাজিকভাবে প্রত্যাশা করা হয় হত্যাকারী পরে আত্মহত্যা করবে। হিংসার অন্যায্যতা সম্পর্কে এই সামাজিক সচেতনতা দুর্লভ। বরং পৃথিবীতে অনেক সুলভ হিংসার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সামাজিক ঐকমত্য। এই সামাজিক ঐকমত্যের সবটুকু অস্বীকার না করেও বলা যায়, "প্রয়োজনীয়তা' নামক শব্দটি কিন্তু ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে নিষ্ক্রমণে অতীব দক্ষ। প্রয়োজনীয়তা সময়নির্ভর। প্রয়োজনীয়তা/ অপ্রয়োজনীয়তার সংজ্ঞা সময়ের সঙ্গে পাল্টাতে থাকে। অতএব, ১৯৪১ সালে যে যুদ্ধ আমেরিকার কাছে অপ্রয়োজনীয়, সেই আমেরিকার কাছে ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা নাগাসাকি প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। প্রবলভাবে কাল ও পাত্রনির্ভর "প্রয়োজনীয়তার' যুক্তিটি যত কম ব্যবহৃত হয় ততই ভালো।

    শেষে একটা জমিদখলের গল্প বলা যাক। যাদের নিয়ে গল্প তারা যুক্তির এই কচ্‌কচির পরোয়াও করত না। আমরা বীরসার নাম শুনেছি, সিদো-কানুর নাম শুনেছি, কিন্তু টে হুইটির নাম খুব একটা শুনি নি। হুইটি ছিলেন নিউজিল্যান্ডের মাওরি উপজাতির নেতা। উনিশ শতকে তখন শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক মানুষ, যাদের পাকেহা বলা হত, বন্দুকের জোরে মাওরিদের জমি দখল করছে, মাওরিদের খুন করছে এবং মাওরিদের নিজেদের মধ্যেও খুনোখুনি লাগিয়ে দিয়েছে। তখন পারিহাকার মাওরি মানুষরা ভেবেচিন্তে প্রতিরোধের এক উপায় বের করলেন। মাউন্ট টারানাকি নামে এক আগ্নেয়গিরির পাদদেশে তাঁরা শান্তিগোষ্ঠী তৈরি করলেন। শিশুরা ছিল এই গোষ্ঠীর সবথেকে সক্রিয় সদস্য। প্রায় কুড়ি বছর অহিংস প্রতিরোধ করে তাঁরা শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিকদের প্রতিহত করেছিলেন। পারিহাকা হয়ে উঠেছিল মাওরিদের সবথেকে বড় বাসভূমি এবং অভয়ারণ্য। প্রতি মাসের আঠেরো নম্বর দিনে সবাই জমায়েত হয়ে শান্তির কৌশল আলোচনা করতেন ও প্রার্থনা করতেন। ১৮৮১ সালের ৫ই নভেম্বর দেড় হাজার পাকেহা সৈন্য পারিহাকা আক্রমণ করল। মাওরিদের শান্তিব্যুহের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে ছিল দুশো শিশু। তারা নিজেদের মধ্যে খেলছিল, লাফালাফি করচ্ছিল, গান গাইছিল। তারা সেই সৈন্যদের জন্য রুটি আর খাবার নিয়ে এগিয়েও এসেছিল। হাজার হাজার মানুষ কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই সৈন্যদের হাতে গ্রেপ্তার হন। বহু নেতাকে দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, বহু মানুষ সশ্রম কারাদন্ডে দণ্ডিত হন। সব গল্পেরই শেষ থাকে। কোনো একটা সময়ে টে হুইটি মুক্তি পান এবং অহিংস প্রতিরোধের আন্দোলন করতে করতে মারাও যান। আবার কিছু গল্পের শেষ থাকে না। পরবর্তী শতাব্দীতে একজন নয়, অনেকজন টে হুইটি জন্ম নেন। শুধু পারিহাকায় নয়; ভারতে, আমেরিকায়, মায়নমারে।

    http://www.guardian.co.uk/politics/2007/mar/10/iraq.world1

    "The strong Marxist flavor in the rhetoric of the New Left coincides with the steady growth of the entirely non-Marxian conviction, proclaimed by Mao Tse-tung, "Power grows out of the barrel of a gun." To be sure, Marx was aware of the role of violence in history, but this role was to him secondary; not violence but the contradictions inherent in the old society brought about its end. The emergence of a new society was preceded, but not caused, by violent outbreaks, which he likened to the labor pangs that precede, but of course do not cause, the event of organic birth." - Hannah Arendt, Reflections on Violence, New York Review of Books, 27 February, 1969

    "However, "Islamic fundamentalism", in my opinion, is an ally of the people in their fight against market fundamentalism promoted by the US, EU, Japan and other imperialists. The upsurge is bound to raise the anti-imperialist democratic consciousness among the Muslim masses and bring them closer with all other secular, progressive and revolutionary forces. I see the Islamic upsurge as the beginning of the democratic awakening of the Muslim masses despite the domination of fundamentalist ideology and outlook in the Islamic movement at present. Our Party supports the Islamic upsurge and seeks a unity with all anti-imperialist forces." - Interview with CPI-Maoist General Secretary Ganapathy

    ৭ই নভেম্বর, ২০০৯

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৭ নভেম্বর ২০০৯ | ১০২০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন