এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পল্লব হালদার | 51.86.129.244 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৪:২২728527
  • অর্কের সাথে আমার পরিচয় এই পুজো প্যাণ্ডেলেই। দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেছে এই Lagos-এ। সত্যিকথা বলতে বলতে কি Lagos-এর এই বঙ্গীয় পরিষদ না থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই হাঁফিয়ে উঠতাম এই বিদেশ-বিভূঁয়ে। যতই হোক বাঙালীদের কাছে দূর্গাপুজোর টানই আলাদা। তবে কলকাতার পুজোর বিন্দুমাত্র অভাব বোধ করিনি বোধ হয় শুধু মাত্র এই বাঙালী পরিবেশটার জন্যে।
    গতবছর অষ্টমীর দিন। অনেকের সাথেই আলাপ হলো এই প্যাণ্ডেলে। তবে তাদের সবার মধ্যে যাকে আমার সবচেয়ে বেশী মনে ধরলো তিনি হলেন অর্ক সেন। পেশায় ডাক্তার। Lagos-এর একটা নামী হাসপাতালের Consultant Psychiatrist. স্লিম, লম্বা। শাণিত চেহারা। বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ। চোখে একটি কালো ফ্রেমের চশমা। বয়স মনে হয় চল্লিশোর্ধই হবে।
    ভদ্রলোক একাই Lagos-এ এসেছেন। অবিবাহিত। অবশ্য অবিবাহিত বললে ভুল হবে। বছর পাঁচেক হলো স্ত্রীর সাথে divorce হয়ে গেছে। তবে এই ব্যাপারটা আমি অনেক পরে জানতে পেরেছি। ওনার কাছে থেকেই। Lagos-এ এসেছেন তাও প্রায় ওনার বছর তিনেক হয়ে গেলো।
    ওনার সাথে আলাপ আর ওনাকে মনে ধরার কারণটা এইবার বলছি।
    পুজো প্যাণ্ডেলে আলাপ হওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই ভদ্রলোক আমাকে বললেন "চলুন চা খাওয়া যাক।" চা হলো আমার favourite পানীয়। সত্যি বলতে কি অনেকক্ষণ থেকেই মনটা একটু চা চা করছিল। তাই প্রস্তাবটা accept করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলাম না। প্যাণ্ডেলের খুব কাছাকাছেই একটা হোটেল কাম রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানেই বসা হলো।
    পারিবারিক কথা দিয়েই আলাপ শুরু। একটু আলাপ এগোনোর পরেই হঠাৎ অর্ক গম্ভীর মুখে আমাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন "রাতে ভালো ঘুম হচ্ছে না?" বেশ চমকে গেলাম।
    "কি করে বুঝলেন?"
    "আপনার চোখের তলার কালি আর পরিশ্রান্ত মুখ তার প্রমান দিচ্ছে। কথা বলতে বলতে আপনি বেশ কয়েকবার হাই তুললেন। বেশ কয়েকবার অন্যমনস্কও হয়ে গেলেন। তাছাড়া depression, anxiety আর কিঞ্চিত irritation-এর যে লক্ষণগুলো typical insomnia patient-দের মধ্যে থেকে থাকে সেটা লক্ষ্য করেছি আপনার মধ্যে।"
    "Impressive" আমি বললাম "আপনি ঠিকই ধরেছেন। Actually, কয়েকরাত ধরে একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখছি। একই স্বপ্ন বারবার। আর যতবারই স্বপ্নটা দেখছি ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে আর ঘুম আসছে না।"
    "স্বপ্নটা কিরকম জানতে পারি? অবশ্য যদি আপত্তি না থাকে।"
    "না না আপত্তির কি আছে? আসলে প্রতিদিন ভোর রাত্রে দেখছি আমি যেন একটা exam hall -এ বসে পরীক্ষা দিচ্ছি। Maths. Question paper দেখে মনে হচ্ছে আমি সব পারবো, কিন্তু একটাও পারছি না। একটা হতাশা, ছটফটে ভাব যেন গিলে খেতে আসে। আচ্ছা ভাবুন তো সেই কবে school জীবন ছেড়ে এসেছি। কিন্তু এখনো কেন এই স্বপ্ন দেখব? আমি ঘেমে উঠি। ঘুম ভেঙ্গে যায়। তারপর কি রকম একটা ভয় আর অতৃপ্তি পেয়ে বসে আমার মধ্যে। আর ঘুম আসে না।"
    "আগে কখনো এই স্বপ্ন দেখেছেন?"
    "দেখতাম। ছোটবেলায়। প্রায়ই দেখতাম।"
    "Maths-এ কেমন ছিলেন?"
    "ভালই ছিলাম।"
    "সেটাই স্বাভাবিক। আসলে, অনেক ভালো ভালো ছেলেরা-মেয়েরাও এই স্বপ্ন দেখে থাকে। কারণ failure হবার স্বপ্ন তাদের তাড়া করে বেড়ায়। এমনও হতে পারে এই ভয়টাই তাদের ভালো result-এর কারণ।"
    "সে না হয় বুঝলাম। ছাত্রজীবনে এর প্রভাব থাকতে পারে। কিন্তু এখন কেন দেখি?"
    "ফ্রয়েড পড়েছেন?"
    "না।"
    "স্বপ্নতত্ত্বের ওপর ওনার অনেক গবেষণা আছে। আমাদের মনকে উনি তিনটে ভাগ ভাগ করেছেন - unconscious, conscious আর subconscious. আমাদের ঘুম এই তিনটে স্তরের মধ্যে দিয়েই যায়। ঘুমের শুরুর দিকে আর শেষের দিকে আমরা subconscious বা অবচেতন মনে থাকি। আমরা যখন গভীর ঘুমে থাকি তখন আমরা unconscious state -এ চলে যাই। স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করে আমাদের subconscious mind. তবে সবকিছুই যে উনি ঠিক ব্যাখ্যা করেছেন তা আমার মনে হয় না। যেমন উনি বলেছেন স্বপ্ন কখনো রঙ্গীন হতে পারে না। যেসব চরিত্র ও প্রেক্ষাপট আমরা দেখি তা ফ্রয়েডের মতে সাদাকালো। আমার তো মনে হয় স্বপ্ন রঙ্গীন, কি বলেন?" মৃদু হেসে অর্ক জিজ্ঞাসা করলেন।
    "আমারও তাই মনে হয়।" একটু থেমে বললাম "কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না যে।"
    "আপনি কি recently কোনো অফিসের ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন? যেমন ধরুন promotion, lack of job security বা boss-এর সাথে ঝামেলা বা এরকম কিছু?"
    "ঠিকই ধরেছেন। আসলে, কয়েকদিন আগেই boss-এর সাথে একটু ঝামেলা হয়ে গেছে। সারা বছর খাটলাম। কিন্তু appraisal rating ভালো দেয়নি। সেই নিয়ে বেশ একটু ঝামেলাই হয়ে গেছে boss-এর সাথে বলতে পারেন।"
    "আমাদের মন বড় অদ্ভুত। কত রহস্যই যে লুকিয়ে আছে এই মনের ভেতরে তা বোধ হয় কারোর কাছেই জানা নেই। আমরা মনে করি যে আমাদের ছোটবেলার স্মৃতি আমরা ভুলে গেছি। কিন্তু এই subconscious mind-এর ক্ষমতা অসীম। কোথায়, কবে কোন কবর থেকে যে পুরোনো স্মৃতি তুলে ধরবে এই subconscious mind তা কেউ জানে না।"
    "মানে বলতে চাইছেন আমার ছোটবেলার পরীক্ষাভীতি বর্তমানের চাকরিসংক্রান্ত ঝামেলার মাধ্যমে ফিরে এসেছে?"
    "ঠিক তাই।"
    ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম কথা বলতে বলতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। আমি বললাম "আমাকে আবার V.I. ফিরতে হবে নিজেকে drive করে। অনেকটা পথ। আজ উঠি। তবে আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। যোগাযোগ রাখবেন।"
    সেই যোগাযোগটা যে আমাদের মধ্যে এতটাই বন্ধুত্ব স্থাপন করবে তা জানা ছিল না। সত্যি কথা বলতে কি ওনার ওই অপরিসীম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর scientific analysis আমার মনে দাগ কেটে গিয়েছিল। এরপরে আমরা বহুবার দেখা করেছি একে অপরের সাথে; কখনো আমার বাড়ীতে, কখনো অর্কর বাড়ীতে, কখনো বা কোনো cultural program attend করতে গিয়ে। আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা আপনি ছাড়িয়ে তুমিতে আসতে বেশিদিন লাগেনি।
    মাস ছয়েক কেটে গেছে। গত মাস দু'একের মধ্যে অর্কর সাথে আমার দেখা হয়নি। তবে মাঝে ফোনে কথা হয়েছে। আমিও office নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।
    কদিন ধরে দেখছি আমাদের office attendant টা খুব মনমরা হয়ে থাকে। জল চাইলে মুখের দিকে কেমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। আপনমনে সারাক্ষণ আকাশ দেখে। সবসময়ই কেমন যেন অন্যমনস্ক। অথচ এই ছেলেটিকে আমি গত দু'বছর ধরে দেখছি। খুব হাসিখুশি আর প্রাঞ্জল ছেলেটি।
    একদিন Office attendant টিকে ডেকে জিগ্যেস করেই ফেললাম "জেগেডে (Jegede) তোমার কি হয়েছে বলতো? বেশ কিছুদিন দেখছি তুমি অন্যমনস্ক হয়ে থাকো, কাজে মন নেই, কিছু চাইলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকো। ব্যাপারটা কি?" জেগেডে বলল ও কিছু নয়। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম জেগেডে আমার কাছে কিছু এড়িয়ে গেলো।
    আরো কিছুদিন কেটে গেলো। লক্ষ্য করলাম জেগেডের অন্যমনস্কতা যেন বেড়েই চলেছে। কেমন সুন্দর হাসিখুশি ছেলেটি যেন ভেতরে ভেতরে শুকিয়ে যাচ্ছে। একদিন lunch-এর সময় জেগেডেকে আমার কাছে ডাকলাম। বললাম "জেগেডে, boss হিসেবে আমি কেমন?" জেগেডে বললো "ওগা (Master) আপনার মতো boss পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। বিশ্বাস করুন আমার কর্মজীবনে আপনার মতো এত ভালো মানুষ কখনো দেখিনি।" আমি বললাম "মিথ্যে কথা বোলোনা।" জেগেডে বলল "আমি দিব্যি খেয়ে বলছি, আপনার মতো ভালোমানুষ হয় না।" আমি বললাম "হুম, সেই জন্যেই তো তুমি আমাকে তোমার কোনো কথাই বলো না। বহুদিন ধরেই দেখছি তুমি অন্যমনস্ক। কই তুমি তো আমার সাথে তোমার problem share করছ না। এইটা তোমার আমার ওপর আস্থার নমুনা?" কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জেগেডে শিশুর মতো কেঁদে ফেললো। তারপর শান্ত গলায় বললো "ওগা, আমি যেটা বলবো সেটা আপনি বিশ্বাস করবেন?" আমি বললাম "করবো।" এরপর জেগেডে যেটা বললো তার মর্মার্থ হলো এই।
    ইবাদানে (Ibadan) জেগেডের পৈত্রিক বাড়ী। বিয়ে হয়েছে বছর চারেক আগে সোলার (Sola) সাথে। একবছর আগে তাদের একটি ছেলে হয়। কিন্তু জন্মের দশদিনের মাথায় সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। স্থানীয় হাসপাতালে দেখানোও হয়ে থাকে। কিন্তু সেরে ওঠার তিন দিনের মাথায় তাকে গলা টিপে মেরে ফেলা হয়। আমি এই অবধি শোনার পর কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে জিগ্যেস করলাম "কে মেরে ফেললো?" জেগেডে একটু চুপ করে থেকে বললো "সোলা।" আমি চমকে উঠলাম "সেটা কি করে সম্ভব ?" জেগেডে বললো "ও স্বাভাবিক অবস্থায় এটা করেনি। ওর ওপরে spirit ভর করেছে।" তার ধারণা অনুযায়ী কেউ black magic করেই এটা করাচ্ছে। কিন্তু ঘটনার এখানেই শেষ নয়। ছমাস আগে তার মার কাটা দেহ পাওয়া যায় তাদেরই বাড়ী থেকে। নৃসংশ ভাবে তাকে কুপিয়ে খুন করা হয়। আমি বললাম "সোলা ?" জেগেডে চুপ করে থেকে তার সম্মতি জানালো। "ঘটনার আগের দিন মার সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়েছিল একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে। মা রেগেমেগে আমাকে বাড়ী থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিল। সোলা ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। বিশ্বাস করুন ও আমাকে খুব ভালবাসে। সেদিন রাতেই সোলার ওপর spirit-এ ভর করে। রাতের অন্ধকারেই সে মাকে কুপিয়ে খুন করে।" এত অবধি বলেই জেগেডে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। "ওই spirit আমার বাবাকেও মেরে ফেলবে -আমি জানি।" আমি বললাম "কি করে জানলে?" "সোলা বলেছে ভর হওয়া অবস্থায়।" ভয়ে, দুঃখে আশংকায় জেগেডের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আমি জেগেডের হাত দুটো ধরে কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম "ভয় পেওনা। আমি আছি। একটা কিছু ব্যবস্থা ঠিক হবে।" বললাম ঠিকই কিন্তু মন সায় দিলো না।
    সন্ধ্যেবেলা বাড়ী ফেরার পর অনেক দিন বাদে অর্ককে ফোন করলাম। একটু গৌরচন্দ্রিকা করার পরেই জেগেডের ঘটনাটা সবিস্তারে ওকে জানালাম। অর্ক খুব মন দিয়ে শুনলো। সবশেষে শুধু একটা কথাই বললো "Interesting."
    Weekend-এ জেগেডে বাড়ী যায়। লেগোস থেকে ইবাদানের দূরত্বও খুব একটা বেশী নয়। মনটা খুঁতখুঁত করছিল ছেলেটার জন্যে। বারবার মনে পড়ছিল জেগেডের কান্না ভেজা অসহায় মুখটা। রাত দশ'টা নাগাদ একটা ফোন করে ফেললাম। একটা কর্কশ মহিলা কন্ঠ ভেসে এলো "হ্যালো।" জিগ্যেস করলাম "আপনি কি সোলা?" "হ্যাঁ রে scoundrel, আমি সোলা।" বুকটা ধড়াস করে উঠলো। "একটু জেগেডের সাথে কথা বলতে পারি?" উত্তর এলো "তুই জেগেডের বস, তাই বসের মতই থাকবি। বেশী জেগেডের ব্যাপারে মাথা গলাতে এলে ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেবো। আর শোন জেগেডের বাপের দিন ঘনিয়ে এসেছে। কি করার আছে কর। দেখি কি করে বাঁচাস।" আমার রক্ত হিম হয়ে গেলো। ফোনটা কেটে দিলাম। ফোনটা নামিয়েই অর্ককে ফোন লাগলাম আর সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। অর্ক কোনো কথা বললো না। শুধু চুপ করে মন দিয়ে শুনলো। সে রাতে আর ঘুম এলো না। মাথায় এলো না এত ভদ্র ছেলেটার এত বদ্তামিজ, অভদ্র বউ হয় কি করে? অবশ্য ও তো আর স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। জেগেডের মোবাইল সোলার কাছে। জেগেডে ঠিকঠাক আছে তো? জেগেডে এখন কি অবস্থায় আছে সেটা ভেবে ভেবেই সারা রাত কেটে গেলো। অর্কর কাছে থেকে খুব একটা সাহায্য পাব বলে মনে হল না। একটা জিনিস বুঝতে পারলাম সোলা বা সোলার ওপর ভর করা spirit আমাকে ভালো মতই চেনে। অথবা জেগেডে নিশ্চই সোলাকে আমার ব্যাপারে গল্প করেছে।
    ভোরের দিকে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙ্গলো কলিং বেলের শব্দে। ঘড়িতে সকাল সাতটা।ঘুম জড়ানো চোখে গেট খুলেই দেখি অর্ক। ঘরে ঢুকেই অর্ক বললো "জেগেডের address আছে?" আমি বললাম "আছে।" অর্ক বললো "ড্রাইভারকে ডেকে নাও। এতোটা রাস্তা নিজেদের ড্রাইভ করে যাওয়াটা ঠিক হবে না। তাছাড়া একজন লোকাল লোক সঙ্গে থাকাটা খুব জরুরী – safety matters in Nigeria. তাছাড়া address খুঁজে বার করতেও সুবিধে হবে।"
    লেগোস থেকে চার-পাঁচ ঘন্টার রাস্তা ইবাদান। সকাল ন'টায় আমরা start করলাম। ইবাদান পৌঁছতে পৌঁছতে দু'টো বেজে গেলো। Traffic খুব একটা ছিল না ঠিকই তবে রাস্তায় প্রচুর check থাকে। দু'এক কিলোমিটার বাদে বাদেই নাইজেরিয়ান পুলিশ AK-47 হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
    রাস্তা চিনে জেগেডের বাড়ী পৌঁছালাম যখন তখন বাজে আড়াইটে। দোতলা বাড়ী। খুব একটা স্বচ্ছল নয় দেখলেই বোঝা যায়। বাড়ীর দালানেই বসে ছিল জেগেডে। আমাদের দেখে রীতিমত চমকে উঠলো। তারপর আনন্দে তার দু'চোখ বেয়ে জল নেমে এলো। আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে বললো "আপনি আমাদের গরীবের বাড়ীতে আসবেন একথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।" আমি অর্কের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম।
    দু'একটা কথা বলার পরেই অর্ক জিগ্যেস করলো "তোমার বউ-এর সাথে আমাদের পরিচয় করাবে না জেগেডে?" জেগেডে কিছু বলার আগেই আমি কৌতূহল চাপতে না পেরে বললাম "কাল রাতে তোমায় ফোন করেছিলাম কিন্তু..." আমার কথা শেষ হতে না দিয়েই জেগেডে বললো "আমার বউ ধরেছিল নিশ্চই, ও কি আপনাকে অপমান করেছে? গালাগালি দিয়েছে নিশ্চই।" জেগেডের চোখে আশংকা আর লজ্জা ফুটে উঠলো। আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম হঠাৎ অর্ক আমায় ইশারায় চুপ করিয়ে দিয়ে বললো "কাল রাত ১০-টা নাগাদ তুমি কোথায় ছিলে জেগেডে?"
    জেগেডে বললো "আমি সন্ধ্যে ন'টার মধ্যেই খেয়ে শুয়ে পড়ি। কাল অফিস থেকে এতটা journey করে বাড়ি ফিরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই শোবার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ি।"
    "কিছু মনে না করলে বাড়ীর সবার সাথে একটু পরিচয় করিয়ে দেবে? আর তাছাড়া গোটা বাড়িটা আমরা ঘুরে দেখতে চাই।" অর্ক জানালো।
    "আসুন"। নিচের তলায় তিনটে ঘর। আর উঠোনের একদিকে একটা common bathroom. সবার প্রথমে জেগেডে ডানদিকের ঘরটায় নিয়ে গেল। "এইটাতে আমার বাবা থাকে। আগে মাও এই ঘরেই থাকত। কিন্তু গতবছর মা মারা যাবার পর থেকে বাবা একাই থাকে। বিছানা থেকে উঠতে পারে না। মা মারা যাবার কয়েকদিন পরেই বাবার stroke হয়ে একটা সাইড paralysed হয়ে যায়। "
    ঘরটা বেশ অন্ধকার। খুব একটা আলো ঢোকে না দিনের বেলাতেই। রাতের বেলায় কারেন্ট না থাকলে এ ঘর যে ভুতুড়ে চেহারা নেবে তা বলাই বাহুল্য। জেগেডের বাবার বয়স মনে হয় আশির কাছাকাছি হবে। ভালো করে চোখে দেখতে পায়না বলেই মনে হলো। জেগেডের কাছ থেকে আরো জানতে পারলাম যে তার বাবার দু'টো বিয়ে। আগে তার সৎমাও এই ঘরটাতে থাকতো। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে তার সৎমা suicide করে ঘুমের ওষুধ খেয়ে।
    নাইজেরিয়ায় polygamy ব্যাপারটার খুব প্রচলন আছে। Sex, illicit relation, money ইত্যাদির কারণে suicide বা murder-এর ঘটনা এখানে আখ্চার ঘটে থাকে। তবে এই একটা মাঝারি size-এর ঘরে তিনজনে কি ভাবে থাকতো সেটা ভেবে উঠতে পারলাম না।
    জানতে পারলাম জেগেডের বাবার আগের পক্ষের কোনো সন্তান ছিলনা। জেগেডের মায়ের পক্ষের দুই বোন আছে। যদিও তাদের কাউকেই এই মুহূর্তে দেখা গেলো না।
    এবারে জেগেডে নিয়ে গেলো মাঝের ঘরটায়। সেটা এদের drawing-cum-dining-cum-kitchen বলা যেতে পারে। একটাই ছোটো আলো। টিমটিম করে জ্বলছে।
    নিচের তলার এক্কেবারে বাঁদিকের ঘরটায় নিয়ে গিয়ে জেগেডে বললো, "এই ঘরটায় থাকে আমার দুই বোন - কেমি (Kemi) আর টেমি (Temi). কেমি বড়, বয়স ১৮ আর টেমি ছোট - ১৫ বছর।"
    "তাদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না যে।" অর্ক জিগ্যেস করলো।
    "ওগা, টেমি একটা Indian-এর বাড়িতে maid-এর কাজ করে। আর কেমি কাজ করে একটা Lebanese-এর বাড়িতে। আজ শনিবার। তাই বেশিক্ষণ কাজ করতে হবে না। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা চলে আসবে।"
    এইবার জেগেডে আমাদের দোতলায় নিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই দুটো ঘর। আর তার পাশেই একটা বাথরুম। ঘর দুটো বেশ বড় বড়। প্রথম ঘরটায় তালা ঝুলছে। তবে জেগেডে আমাদের প্রথমে নিয়ে গেল খোলা ঘরটিতে। "এইটা আমার ঘর। একাই থাকি।" ঘরটাতে একটাই খাট। যদিও দুটো বালিশ পাতা। "একা থাক মানে? তোমার বউ কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না তো।" অর্ক জিগ্যেস করল।
    জেগেডে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর পাশের তালাবন্ধ ঘরটা দেখিয়ে বললো, "ওই ঘরে।"
    "মানে?" আমি আর অর্ক দুজনে একসঙ্গে বলে উঠলাম। জেগেডে বলল "ওগা, আমি তো আগেই বলেছি। ওর ওপর evil spirit ভর করে। দরজা খুলে রেখে দিলে কি হবে বুঝতে পারছেন? শুধুমাত্র রাতে খাবার দেবার সময় দরজা খুলি।"
    অর্ক আর আমি চুপ করে গেলাম। কিন্তু অর্কের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সে কিছু একটা ভাবছে।
    আধ ঘন্টার মধ্যেই টেমি চলে এলো। ভাগ্যিস, রাস্তায় আসার পথে আমরা একটা রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খেয়ে নিয়েছিলাম। নাহলে খিদেয় পেট জ্বলে যেত। টেমির সাথে আলাপ হতে বেশিক্ষণ লাগলো না। বেশ মিশুকে মেয়েটি। যে Indian বাড়িতে কাজ করে মনে হলো সে South Indian হবে। কারণ বলল সে সম্বর-রসম, ইডলি বানাতে জানে। সে এসেই আমাদের জন্যে চা বানিয়ে ফেলল।
    কিছুক্ষণের মধ্যেই জেগেডে এসে আতিথিয়তার সুরে বলল "ওগা, ইবাদান প্রথমবার এসেছেন যখন একরাত থেকে যান। আমাদের বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে একটা খুব ভালো হোটেল আছে। সেখানে আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেব। কাল সকালে আপনাদের ইবাদান ঘুরিয়ে দেখাবো।" আমি কিছু বলার আগেই অর্ক বলে উঠলো "আমরা তো আজ রাতটা কাটাব বলেই এসেছি জেগেডে। তবে হোটেলে নয়, এই বাড়িতেই কাটাতে চাই আজকের রাতটা।" শুনেই জেগেডে চমকে উঠে বলল "কি বলছেন ওগা? এই গরীবের বাড়িতে আপনারা থাকবেন কি করে? তাছাড়া রাত আটটার পরে এখানে কারেন্ট চলে যায়। আমাদের বাড়িতে জেনারেটারও নেই। আপনারা ঘুমোতে পারবেন না। তাছাড়া রাতে এমন পরিবেশ তৈরী হয় যে তাতে আপনাদের ঘুম আসবেই না।" আমি চাপা গলায় অর্ককে পরিষ্কার বাংলায় বললাম "তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এই ভুতুড়ে বাড়িতে আমি এক মিনিটও থাকতে পারব না। আমার এখনি দম বন্ধ হয়ে আসছে।" অর্ক আমার দিকে তাকিয়ে একটু মৃদু হাসলো। তারপর জেগেডের দিকে তাকিয়ে বলল "আমাদের সব ধরণের পরিবেশেই থাকার অভ্যেস আছে। তাই আমাদের কোনো অসুবিধেই হবে না।"
    প্রস্তাব্টাতে টেমিকে খুব খুশিই মনে হলো। সে বলল "আমাদের ঘরটাতেই আপনারা শোবেন। আমি আর দিদি বাবার ঘরে share করে থেকে যাব।" জেগেডে বলল "আপনারা rest নিন। আমি একটু বাজার হয়ে আসছি।"
    কিছুক্ষণের মধ্যেই টেমির সাথে খুব ভাব জমিয়ে ফেলল অর্ক। সে জানালো Indian বাড়িতে কাজ করে সে Indian আদব-কায়দা কি কি শিখেছে। একটু বাদে অর্ক টেমিকে বলল "অসুবিধে না হলে আমরা দোতলায় তোমার দাদার ঘরটাতেই থাকতে পারি। দাদা তোমাদের সাথে adjust করে থেকে যেতে পারে।" এই কথা শোনার পর টেমি হাঁ হাঁ করে উঠলো "পাগল হয়েছেন? ওই ভুতুড়ে দোতলায় দাদা ছাড়া আর কেউ শুতে পারবে না। আপনি জানেন রাতের বেলায় কি অবস্থা হয় এই বাড়ির? ওই ওপরের বারান্দাতে বৌদি মানে সোলা সারা রাত পায়চারী করে আর অকথ্য ভাষায় গালাগালি দেয়। ওর ওপর spirit ভর করে। থালা বাসন ছোঁড়াছুঁড়ি করে।" "কিন্তু খাওয়া দাওয়া চান করে কখন?" অর্ক জিগ্যেস করলো। টেমি জানালো "কেমিই সোলা আর দাদাকে খাবার দিয়ে আসে। দাদা যখন থাকে না তখন কেমিই সোলার দেখভাল করে। আমি পারতপক্ষে দোতলায় যাই না। রাত আটটার মধ্যেই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ি।" অর্ক জিগ্যেস করলো "তোমার ঘুম হয়?" টেমি জানালো "আগে হত না। তবে এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। তবে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে যায় অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দে, তখন চোখ বুঁজে শুয়ে থাকি।"
    "তোমার বাবার ঘুমের অসুবিধে হয় না?"
    "কে জানে? বাবা কখন ঘুমোয় আর কখন জেগে থাকে সেটা বাবাই জানে।"
    "আমি তোমাদের ওপরের তালা বন্ধ ঘরটা দেখতে চাই। আমার সাথে ওপরে যাবে টেমি?"
    "Please আপনাদের হাত জোড় করছি। ওখানে যাবেন না। জানতে পারলে কেমি আমায় খুন করে দেবে।"
    টেমি কিছুতেই গেল না। আমারও যেতে খুব একটা ইচ্ছে করলো না। তবে অর্ক একা ওপরে গেল আর মিনিট দশেক পরে নিচে নেমে এলো।
    কেমি এলো টেমি আসার প্রায় দু'ঘন্টা বাদে। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যে সাড়ে ছ'টা। জেগেডে বাজার থেকে ফিরে গেছে আধ ঘন্টা আগে। কেমি তার দাদাকে জানালো তার Lebanese ওগা তাকে আজ বেশি খাটিয়েছে।
    জেগেডে আমাদের সাথে কেমির পরিচয় করিয়ে দিল। কেমি বেশ গম্ভীর, কথা কম বলে। চেহারাতেও টেমি বা জেগেডের মত স্লিম নয়। আমাদের থাকার প্রস্তাবে ও খুব একটা খুশি হয়েছে বলে মনে হলো না। যদিও মুখে কিছু বলল না।
    কেমি আর জেগেডে চাপা গলায় ইওরুবাতে কিছু কথা বলল একটু দূরে গিয়ে। মনে হয় দাদাকে জিগ্যেস করছে এই উৎপাত দুটোকে আবার কোথা থেকে ধরে আনলে?
    সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় আমাদের খাবার দিয়ে দিল কেমি। টেমি আমাদের সাথেই খেতে বসে গেল। অর্ক জিগ্যেস করলো জেগেডে, কেমি, সোলা আর তোমার বাবা খাবে না? টেমি জানালো দাদা আর বৌদির খাবার কেমি ওপরেই দিয়ে আসে। বাবা উঠে খেতে আসতে পারে না। তাই কেমিই বাবার ঘরে খাবার দিয়ে আসে।
    দারুন খাবার। ভাত, সম্বর আর কেরালিয়ান style-এ মাছ ভাজা। টেমি জানালো ওই বানিয়েছে আমাদের খাবার।
    ঠিক আটটা নাগাদ কারেন্ট চলে গেল। গোটা বাড়িতে একটা থমথমে ভাব নেমে এলো। তার ওপরে চাঁদের আলো নিচের বারান্দাতে পড়ে এক অদ্ভুত ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আমাদের শোবার ব্যবস্থা করে দিয়ে টেমি বলল "আপনারা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুন। জানলাটা খোলা রাখলাম। হাওয়া আসবে। ঘুম এসে যাবে। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেবেন।"
    রাত বারোটা-একটার আগে ঘুমনোর অভ্যেস আমার নেই। যতদূর জানি অর্করও একই অবস্থা। যদিও প্রাণপনে চেষ্টা করছিলাম যাতে ঘুম এসে যায়। চারদিকে ঝিঁ ঝিঁর ডাক আর দম বন্ধ করা নৈশব্দ গোটা বাড়িতে একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরী করেছে। আমি আর অর্ক বেশ কিছুক্ষণ গল্প করছিলাম। আমি ওর মূর্খতার সমালোচনাই বেশি করছিলাম। "ভালো option ছিল হোটেলে থাকার, এবার সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটাও।" বলতে বলতে কখন দু'চোখের পাতা লেগে গেছিল বলতে পারব না। ঘুম ভাঙলো একটা দরজা খোলার আওয়াজে। মনে হলো শব্দটা দোতলার ঘর থেকেই এলো। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। একবার মনে হলো অর্ককে ঠেলে তুলি। এরপর মনে হলো দোতলার বারান্দা দিয়ে কেউ যেন হেঁটে পায়চারী করছে। খুব মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম। এ কোনো মহিলার পদধ্বনি হবে। আমি অর্ককে ঠেলে তুলতে গিয়ে দেখি, অর্ক পাশে নেই। রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম। তাকিয়ে দেখলাম দরজাটা অল্প করে খোলা। বাইরের চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে। আমি পা টিপে টিপে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম।ওই তো অর্ক। উঠোনের সামনে যে বড় গাছটা আছে সেটার পেছনে লুকিয়ে ওপরের বারান্দার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
    আমি কৌতূহল চাপতে না পেরে উঠোনের ওপরে এসে দোতলার বারান্দার দিকে তাকালাম। তারপর যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। দোতলার বারান্দায় সাদা গাউন পরে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় তার মুখ বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়েছে মনে হলো। হঠাত কর্কশ গলায় পৈশাচিক হাসি হেসে উঠে বলল "এই bastard, তোকে বারণ করেছিলাম জেগেডের ব্যাপারে মাথা গলাতে। সেই গলালি। এবার দেখ কি হয়। ওই বুড়োকে তো আমি শেষ করবই, তার সাথে তোকেও। নিজের ছেলেকে আমি খেয়েছি তুই কি ভাবছিস ওই বুড়ো পার পাবে?"
    অর্ক ছুটে এসে আমার হাত ধরে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। আর ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। "এই গলার সাথে আমি পরিচিত। সোলা।" অর্ক বলল "জানি। কিন্তু তোমায় কে বাইরে আসতে বলেছিল?"
    আমি ভয়ে কাঁপছি। অর্ক বলল "Relax. শুয়ে পড়।" তারপর সারা রাত সোলার পায়চারী আর অকথ্য ভাষায় গালাগালি; কখনো জেগেডেকে, কখনো ওর বাবাকে আর মাঝে মধ্যে আমাকে। মাঝে মাঝে বাসনপত্রের ঝনঝনানি।
    সারা রাত ঘুম হলো না। তবে ভোর রাত্রে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুম ভাঙলো টেমির আওয়াজে। ঘরে ঢুকে এসে আমায় চা দিয়েছে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি আটটা। টেমির দিকে তাকিয়ে বললাম "অর্ক কোথায়?"
    টেমি জানালো " ভোরবেলায় কোথায় যেন বেরিয়েছে। বলেছে আপনাকে জল খাবার খেয়ে রাখতে।" আমি অর্ককে মোবাইলে call করলাম। অর্ক জানালো "আমি বাইরে এসেছি। ফিরতে দেরী হলে তুমি lunch করে নিও।" বলেই ফোনটা কেটে দিল।
    জেগেডে এলো দশটা নাগাদ। মনে হলো ভালো করে ঘুম জেগেডেরও হয়নি। মুখটা নিচু করে বলল "ওগা, ঘুমোতে অসুবিধে হয়েছে, না?"
    অর্ক ফিরল ঠিক দুপুর সাড়ে বারোটায়। আমি চান করে অপেক্ষা করছিলাম। যদিও টেমি আমাকে খেতে বসার জন্যে ডাকছিল। অর্ক বলল "আমাকেও খেতে দাও টেমি, আমি চান করেই দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।" খেতে খেতে অর্ক বলল "খাওয়ার পরে আমি জেগেডে, কেমি আর টেমির সাথে একবার বসতে চাই। একটু কথা বলার আছে।" টেমি খুব অবাক হয়ে জানালো "কেন?" অর্ক একটু রহস্যময় হাসি হেসে বলল "দরকার আছে।"
    সবাই বসেছি আমরা drawing-cum-dinning room-এ। সবার নজরের কেন্দ্রবিন্দুতে অর্ক। সবার মুখেই চাপ চাপ কৌতূহল। তবে কেমির মুখে একটু বিরক্তির ছাপ। প্রথমে টেমির দিকে তাকিয়ে মৃদুহাস্যে অর্ক বলল "কেমন ঘুমলে রাতে টেমি?" টেমি বলল "কাল রাতে সোলা খুবই পাগলামি করেছে। অনেক রাত পর্যন্ত আমিও ঘুমোতে পারিনি। তবে অভ্যেস হয়ে গেছে কিছুটা। তাই মাঝ রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।" "আর কেমি?" রহস্য ভরা চোখে অর্ক কেমির দিকে তাকালো। "আমার কোনো অসুবিধে হয়নি। আমি অভ্যস্ত এই ভৌতিক পরিবেশের সাথে।" বিরক্তি ভরা চোখে কেমি উত্তর দিল। জেগেডের দিকে তাকিয়ে মৃদুহাস্যে জিগ্যেস করলো "তোমার ঘুম কেমন হলো জেগেডে?" মুখটা নিচু রেখেই জেগেডে বলল "ভালই।" অর্ক একটু ব্যঙ্গের সুরে বলল "আচ্ছা? সত্যি করে বলত জেগেডে সোলা কোথায়?"
    "ও ঘুমোচ্ছে। বন্ধ ঘরে।"
    "আমি দেখতে চাই। বন্ধ ঘরের দরজা খোলো। এক্ষুনি।"
    "কিছুতেই নয়।" কেমি চেঁচিয়ে উঠলো।
    "ভয় পাচ্ছো কেমি?"
    জেগেডে শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল "ভয় নয়। আমি তো বললামই ও ঘুমোচ্ছে। ওর ঘুমের দরকার।"
    অর্কও দৃঢ় গলায় বলল "দরজা খোলো।"
    হঠাৎ সুন্দর, শান্ত জেগেডের চোখ মুখ পাল্টে গেলো। সে কি বিভৎস মুখ! কর্কশ মহিলা গলায় বলল "এই scoundrel, বললাম না দরজা খুলবো না। তোকে কুপিয়ে খুন করে ফেলবো। জেগেডের বাপকে খুন করব।"
    "Ohhh My God! এতো সোলার আওয়াজ" টেমি দাদার এই ভয়ানক রূপ দেখে লাফিয়ে সরে গেল। কেমি ছুটে গেল জেগেডেকে শান্ত করতে। অর্ক ধমকের সুরে জোরে চেঁচিয়ে উঠলো "জেগেডে।"
    এই জোর চেঁচানিতে জেগেডে যেন নিজের সম্বিত ফিরে ফেলল। সে হঠাত ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল। কেমি প্রচণ্ড রেগে বলল "ওর ওপর কোনো ধরণের মানসিক চাপ তৈরী করতে পারেন না আপনারা।"
    অর্ক গম্ভীর গলায় জেগেডের দিকে তাকিয়ে বলল "তুমি তো মানসিক রুগী জেগেডে! আমাদের psychology-র ভাষায় একে বলে multiple personality disorder. সোলা তো মারা গেছে একবছর আগে। তোমার বাচ্চার মৃত্যুর দু'দিন বাদেই। ঘটনাটা এবারে আমি বলি? তোমার বাচ্চা নিউমোনিয়াতেই মারা গেছিল। হাসপাতালে। আমি হাসপাতালে গিয়ে সেই রেকর্ড check করেছি। কিন্তু তুমি ভেবেছিলে তোমার বাচ্চার মৃত্যুর জন্যে সোলাই দায়ী। তাই সেই রাতে তুমি সোলার ওপর এমন মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছিলে যে সোলা suicide করতে বাধ্য হয়। হাসপাতালের রেকর্ড থেকে সোলার মৃত্যুর detailsও আমি জোগাড় করেছি জেগেডে। দু' দুটো মৃত্যুর ধাক্কা তোমার মন মেনে নিতে পারেনি। ধীরে ধীরে তোমার অতৃপ্ত মন নিজের ভেতরে আরেক চরিত্রের সৃষ্টি করে যার প্রধান কাজ হলো তোমার অচরিতার্থ বাসনা পূর্ণ করা। জন্ম নেয় সোলা।
    এইবার কেমির দিকে ফিরে অর্ক বলল "কিন্তু এই বাড়ির মধ্যে একমাত্র তুমিই আছ যে জানত যে সোলা বলে কেউ নেই। কিন্তু তুমি কেন তোমার দাদার এই পাগলামিকে প্রশ্রয় দিচ্ছিলে কেমি? কি স্বার্থ কাজ করছিল এর পেছনে?"
    কেমির মুখ এখন শান্ত। সে বলল "আমি দাদাকে ভালোবাসি।" অর্ক বলল "দাদাকে ভালবাসা আর দাদার পাগলামিকে প্ররোচনা করা আর সমর্থন করা অন্য জিনিস। সোলাকে তুমি কখনই পছন্দ করতে না কেমি। এ কথা আমি জানতে পেরেছি তোমার প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে। প্রতিহিংসা এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে যে তুমি দাদার মনকে বিষিয়ে তুলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করনি জেগেডের ছেলের মৃত্যুর পর। কারণ জেগেডের মন নিয়ে খেলায় তুমি ছিলে ছোটবেলা থেকেই পারদর্শী। তাই কল্পনাপ্রবণ জেগেডের মনের মধ্যে সোলার বীজ পুঁততে তোমার বেশি সময় লাগেনি। তোমার অচরিতার্থ মনের বাসনা তুমি জেগেডের তৈরী সোলার মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছো। আর এই কাজ তুমি এত নিপুনতার সাথে করেছ যে না তোমার দাদা, না তোমার বোন সেটা ধরতে পেরেছে।
    টেমি কাঁদছে। তার মুখ রাগে,দুঃখে, প্রতিহিংসায় ভরা। এইবার সে তার দিদির দিকে আক্রোশের সাথে তাকিয়ে জিগ্যেস করলো "কি পেলি তুই এইসব করে? আমার মা তোর কি ক্ষতি করেছিল? আমাকে বেশি ভালবাসত তাই?" কেমি নিঃস্পৃহ গলায় বলল "ছোটবেলা থেকেই তো বাবা-মার ভালবাসা থেকে আমি বঞ্চিত। সমস্ত ভালোবাসাই তো তোর জন্যে। কিন্তু এই বাড়ির সম্পূর্ণ অধিকার যখন তোকে দেবে বলে ঠিক করলো বাবা-মা তখন আমি আর নিজেকে সামলাতে পারিনি।কখনো জানতে চেয়েছিস এই বাড়ি ছাড়া আমার আর আছে কি?"
    "আর সেই কারণেই জেগেডের কান ভরলে তুমি," রেশ ধরে বলল অর্ক "আর জেগেডের কল্পনাপ্রবণ মন তার মাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করলো।" কেমি চুপ করে রইলো।
    "এইবার যে একবার ওপরের বন্ধ দরজাটা খুলতে হবে কেমি!" দোতলায় গিয়ে দরজা খুলতেই দেখা গেল একটা খালি ঘর যার একদিকে আলমারি আর তার পাশে ড্রেসিং রুম। সেই আলমারিতে সাজানো আছে সারি সারি সোলার ড্রেস। আর ড্রেসিং রুমের ওপর পড়ে আছে মেকআপের যাবতীয় সরঞ্জাম। আর আছে মহিলাদের wig. বুঝতে অসুবিধে হয় না রাতের বেলায় এই মেকআপ নিয়েই জেগেডে হয়ে যায় সোলা।
    "আমি পুলিশ কে খবর দিয়েছি। নাইজেরিয়ান পুলিশ আর নাইজেরিয়ান law যা action নেবে নিক। আমাদের কাজ সমাপ্ত।"
    গাড়িতে ফিরতে ফিরতে শুনতে পেলাম অর্ক বিড় বিড় করে বলছে "Dr. Jekyll and Mr. Hyde".
  • avi | 57.15.1.154 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৮:৩৫728528
  • নীহার রঞ্জনের কিরীটি রায় ধরনের লাগলো।
  • Du | 182.58.105.64 | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:৫০728529
  • ঘটনাটা কি সত্যি হয়েছিল? মানে সাইকো দেখে ঠিক বিশ্বাস হয়নি ওরকম হতে পারে। যাস্ট কিউরিয়াস এমনিতে গল্পটা ভালো ই।
  • de | 24.139.119.173 | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১৪:৫৮728530
  • বেশ হয়েছে গপ্পো!
  • ফারিয়া | 103.14.72.146 | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ১৪:৩৮738811
  • শেষ কথাটার মনে কি? কি বোঝালো??
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন