এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • নিষ্কৃতি - একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা

    joldip
    অন্যান্য | ০১ আগস্ট ২০১৪ | ১২৮৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • joldip | 134.125.50.16 | ০১ আগস্ট ২০১৪ ১৫:১২644635
  • নিষ্কৃতি
    ………..

    নীহার

    ******

    পড়ন্ত বিকেলের রোদে তেমন একটা তেজ নেই। তবু চোখে এসে পড়া মাত্র চোখ খুলে গেল নীহারের। চোখের পাতায় পড়ন্ত আলোর রেশ। কয়েকবার চোখ পিটপিট করার পর স্থির হয়ে তাকালো আকাশের দিকে। আলোটা আর তেমন চোখে লাগছে না। রোজ বিকেলে পড়ন্ত রোদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয় না। কোন কোনদিন হয়। যেমন আজ হল। খাটের পাশের জানলাটা নমি মনে হয় আজ বন্ধ করতে ভুলে গেছে। মাঝে মাঝেই ভুল হয়ে যায় নমির। আর সেই দিনগুলোতে পড়ন্ত রোদ তার চোখের পাতায়, গালের খোঁচা দাড়িতে, ফেটে যাওয়া ঠোঁটের ওপরে আলতো করে চুম্বন দিয়ে যায়। সেই মুহুর্তগুলো দারুন ভালো লাগায় ভরে ওঠে। জানলা দিয়ে দূরের আকাশে তখন টুকরো টুকরো মেঘের উড়ে যাওয়া। কোনদিন কালো মেঘ, কোনদিন ধুসর, আবার কোন কোনদিন নীল আকাশে সাদা মেঘ। আজ আকাশটা নীল। তাতে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ ভেসে চলেছে কাগজের নৌকার মত। এটা কি কাল? শরৎ মনে হয়। শরৎকালেই আকাশটা এত সুন্দর লাগে।

    একটু একটু করে রোদ সরে যায় তার মুখের ওপর থেকে। রোদটা এখন ঐ জানলার গরাদের ওপরে টুকরো হয়ে লেগে আছে। কয়েকটা পাখি , মনে হয় কাক উড়ে গেল ডাকতে ডাকতে। দিনের আলো একটু একটু করে নিভে আসবে সুর্যটা অস্ত গেলে। এখান থেকে শুয়ে শুয়ে সূর্যাস্ত দেখা যায় না। সূর্যাস্ত হলেই আকাশে রঙের খেলা। মেঘে মেঘে কত রঙ। ঠিকঠাক মত সবকটা রঙের নামও জানে না ও। মেঘ থেকে মেঘে যেন চুঁইয়ে পড়ে রঙ। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। রোজ দেখে না। মাঝে মাঝে দেখে যেদিন যেদিন খোলা থাকে জানলাটা।

    একটা টিকটিকি টিক টিক করে ডেকে ওঠে। মুখটা ফিরিয়ে তাকায় নীহার। বেশ মোটা একটা টিকটিকি। তারমত হাড়গিলে না। দুটো চকচকে পুঁতির মত চোখে চকচক করে লোভ। কাছে পিঠে কি কোন শিকার দেখেছে? সন্তর্পনে তাকিয়ে আছে এখন, নিঃশব্দে এক পা এক পা করে এগোচ্ছে। মাথাটা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করে। দেখতে পায় না আর টিকটিকিটাকে।

    মুখটা আবার ফেরায় জানলার দিকে। গারাদের ভিতর দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। বিকেলের আলোয় কেমন একটা মড় মড়া ভাব, নিস্প্রাণ। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। টিকটিকিটার জন্য আজ আর তার দেখা হল না মেঘের মাঝে টুকরো রঙের খেলা। আকাশটা ঢেকে যাচ্ছে ধুসরতায়। নিভে আসছে দিনের আলো। হঠাৎ অস্থির হয়ে ওঠে নীহার। দিনটা ফুরিয়ে যাচ্ছে কত দ্রুত অথচ কত কাজ বাকী পড়ে আছে তার। কি করে শেষ করবে সে? সময় বড় অল্প। অস্থির হয়ে বারবার মাথাটা তুলতে চেষ্টা করে সে, মাথাটা একটু উঠেই বার বার পড়ে যায়। জ্বালাটা আবার শুরু হয়ে গেছে। এই জ্বালাটা শুরু হলেই বুঝতে পারে শরীর নামক কিছু একটা তার আছে। সব শারীরিক অনুভুতি মরে গেছে শুধু এই জ্বালাটা আছে। বিকার হয়তো, তবু জ্বালাটা টের পায়। একটা অদ্ভুত জ্বলন। তখন খুব কষ্ট হয়। নমি কোথায় গেলো? একজোড়া কোঠরাগত চোখ প্রাণপণে নমিকে খোঁজে। নমিকে ডাকার চেষ্টা করে কিন্তু কিছু অব্যক্ত গোঙানীর মত শব্দ ছাড়া কিছু বের হয় না। জ্বালাটা আর সহ্য করতে পারছে না সে। চোখ দিয়ে জল নেমে আসে।

    বেয়াল্লিশটা বছর খুব বেশি নাকি? এইতো এই মনে হয় সেদিনের কথা। বাবার হাত ধরে স্কুলে যেত সে। কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট, কালো টাই, পায়ে কেডস, পিঠে ব্যাগ, হাতে ওয়াটার বটল। ঐতো এখনো পরিস্কার দেখতে পায় সে ছেলেটাকে। একমাথা সুন্দর চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। মা আঁচড়ে দিয়েছে। মাকে কতকাল দেখে না সে। না না কোথাও একটা ভুল হচ্ছে, আজকে সকালেও তো মা এসেছিল নাকি কালকে ? মনে করতে পারে না কিছুটেই। জ্বালাটা বাড়ছে। একটু হাত বুলিয়ে দেবে একটু হাত বুলিয়ে? চোখের কোণা বেয়ে জলের ধারা বয়ে যায়। স্বর ফোটে না। ছিটকে ওঠে কিছু গোঙানী। কত কথা বলার আছে কিছুই তো বলা হলো না। মা, মা কি করে সহ্য করবে? আর নমি, নমির খুব কষ্ট হবে। তিয়াসটা বড্ড ভালোবাসে বাবাকে। নমি তিয়াসকে এ ঘরে আসতে দেয় না। কিন্তু মেয়েটা সময় পেলেই চুপিচুপি চলে আসে। অনেক কথা বলে যায় আধো আধো স্বরে। ভারী ভালো লাগে মেয়ের মুখে কথা শুনতে। মাঝে মঝে কত প্রশ্ন করে, নীহার উত্তর দিতে চেষ্টা করে কিন্তু স্বর যে ফোটে না। আর পারছি না নমি। একঘেয়ে একটা গোঙানীর সুর বেরোতে থাকে নীহারের গলা দিয়ে।

    নমিতা

    ******

    কম্পিউটার ক্লাসটা আজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। ভালো হয়েছে। মনটা বসছিলো না। কদিন থেকেই নীহারের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মনটাকে ধীরে ধীরে তৈরি করে নিয়েছে নমিতা। তবু কোথাও যেন একটা একাকীত্ববোধ গ্রাস করে নিচ্ছে। নীহারকে ছাড়া এই পৃথিবীটা যেন শুন্য তার কাছে। চোখ বন্ধ করলেই সেই শুন্যতা গ্রাস করে নেয় তাকে। রাতে ঘুমোতে পারে না। শরীর ক্লান্ত থাকলেও না। নীহার চলে গেলে বাঁচবে কি করে?

    দিদি বাড়ি যাবেন তো? চলুন পৌঁছে দি।

    পাড়ার চেনা রিক্সাওয়ালা। এইটুকু রাস্তা রিক্সা করে যেতে গায় লাগে খুব তবু চেপে বসে সে। আজ যেন কিছু ভালো লাগছে না। সময় এগিয়ে আসছে দ্রুত বুঝতে পারছে সে। আর সময় যত এগিয়ে আসছে কেমন যেন অস্থিরতা চেপে ধরছে নমিতাকে। মাঝে মাঝে ক্লাস থেকে বাড়ি ফিরতে ভয় লাগে। ফিরেই হয়তো দেখবে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। বাড়িটা যত কাছে এগিয়ে আসতে থাকে তত যেন বুকের মধ্যে একটা ধুকপুকানি টের পায় সে, যেন কেউ হাতুড়ী দিয়ে বুকের ভিতরটায় পিটছে।

    অথচ এমনটা সে বছরখানেক আগেও কি ভেবেছিল? কি সুন্দর সুখী দাম্পত্য তাদের। ছোটখাটো মান-অভিমান ছোট ছোট সুখ-দুঃখ নিয়ে বেশ সুন্দর কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো দুটি ফুলের মত মেয়েকে নিয়ে। পিছন ফিরে দেখলে মনে হই এইতো সেদিনের কথা।

    সদ্য হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করে সে কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিল।নবীনবরণের দিন প্রথম লক্ষ্য করেছিল নীহারকে। তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল। বার বার চোখ চলে যাচ্ছিল নীহারের দিকে আর প্রতিবার সেই চোখে বিশেষ কিছু যেন দেখতে পাচ্ছিল সে। জোর করে চোখ সরিয়ে নিলেও অবাধ্য চোখদুটি ওদিকেই চলে যাচ্ছিল। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিল নীহার এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। ছাত্র ইউনিয়নে আসে মাঝে মাঝেই। প্রথম দেখাতেই নীহারকে তার ভালো লেগেছিল। নীহার একদিন এসে সরাসরি তাকে তার বাড়ি কোথায় জানতে চেয়েছিল। তারপর একদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে দেখে নীহার তার মাকে নিয়ে বসে আছে তাদের বাড়িতে। চমকে গেছিল সে। মা খুব হাসি হাসি মুখে বলেছিল এই হল আমার মেয়ে নমিতা।

    বুঝতে আর কিছু বাকী ছিল না। লজ্জায় রাঙা হয়ে গেছিল সে। মা ইশারা করতেই নীহারের মাকে আর উপস্থিত বড়োদের কোনরকমে প্রণাম সেরেই নিজের ঘরে চলে গেছিল এক রকম দৌড়েই। বুকের মধ্যে যেন হাপড় টানছিলো। খুশী মেশানো লজায় বারবার নাকের পাটা কানের পাটা যেন লাল হয়ে যাচ্ছিল।

    নীহার তখন টুকটাক একটা কোম্পানীতে কাজ করত। বাবা আপত্তি প্রথমে জানালেও নীহারের মা বলেছিলেন ভাববেন না, আপনার মেয়ে আমার বাড়িতে সুখেই থাকবে। কোন কষ্ট হবে না। নাহ কোন কষ্ট পায়নি বিয়ে হয়ে অবধি। শ্বাশুড়ী যেখানে জলটি পড়েছে সেখানেই ছাতাটি বাড়িয়ে ধরেছেন।

    কিন্তু কষ্ট কি শুধু আর্থিক হয়? অন্যরকম কষ্ট কি ছিল না? ছিল তবে সেসবকে আমল দেয়নি। সংসার করতে গেলে এমন অনেক কষ্টকে সাথে নিয়ে মূকের মত চলতে হয়। যখন স্বামীর রোজগার হয় অল্প তখন কথা বললেই বিপদ আর সেটা খুব ভালো বুঝেছিল শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সংসারে।

    অন্যমনস্ক হয়ে যায় নমি। নিজের মত করে সে চলতে পারল আর কই? সবাই বলেছিল গ্রাজুয়েশনটা শেষ করতে। কিন্তু নমির ইচ্ছেই ছিল না যে লেখাপড়াটা চালিয়ে যায়। দুচোখে তখন শুধু ভরা সংসারের স্বপ্ন। শ্বশুরবাড়ি থেকে শাশুরী- শ্বশুর কারও আপত্তিই ছিল না। তাও সে লেখাপড়াটা শেষ করল না। আজ মনে হয় সেদিন সবার কথা শুনলে ভালো করত। যায় দিন কি আর ফিরে আসে ?

    অবশ্য কে জানত যে তাকে দুটো পয়সা রোজগারের জন্য একটা সময় গিয়ে ভাবতে হবে। কি করে জানবে নীহারকে এমন এক দুরারোগ্য রোগ চেপে ধরবে। যার শেষ গন্তব্য মৃত্যু।

    দিদি নামুন।

    রিক্সাওয়ালার কথায় সম্বিত ফেরে নমিতার। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়াটা মিটিয়ে দেয়। ছোট দিনের বেলা। সন্ধ্যে হতে না হতেই অন্ধকার হয়ে গেছে। অন্ধকারে বাড়িটাকে যেন জনশূন্য মনে হচ্ছে। একটা ঘরেও আলো জ্বলেনি। কারও গলার স্বরও শোনা যাচ্ছে না। কি যেন এক অশুভ ইঙ্গিত বহন করছে বাড়িটা।

    দরজার চাবি সবার কাছে একটা করে আছে। ডোর বেল বাজানো হয় না পাছে ঘুম ভেঙ্গে যায় নীহারের। দরজা খুলে ওপরে উঠে যায় নমিতা অন্ধকারেই। নীহারের ঘরে আলো জ্বলছে। বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে ওঠে। শরীরটা যেন চলতে চায় না, পা দুটো ভারী। ভারী পা টাকে টেনে আনে ঘরে।ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে পেটটা উঠছে - পড়ছে। স্বস্তি পায়। খাটের পাশে শাশুরী বসে আছেন। নীহারের চোখদুটো বন্ধ। ঘরে তার ছায়া পড়তেই নীচু গলায় বললেন

    আজও জানলাটা খোলা ছিল।

    ইশ একদম ভুলে গেছি মা। তাড়াতাড়ি করে বেরোতে গিয়ে কথাটা শেষ করে না নমিতা অপরাধী মুখ করে চেয়ে থাকে শাশুরীর দিকে।

    কুন্তলা

    *****

    আজকাল রাতে ঘুম আসে না কুন্তলার। সারাটা রাত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে কেটে যায়। মাঝে মাঝে চিলতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান নিস্তব্ধ রাতে নিশাচরের মত। আজও চোখে ঘুম নেই। তাই আজ আর বিছানায় পিঠ ঠেকাননি। সোজাসুজি বিয়াস ঘুমিয়ে পড়তেই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। রাত কত কে জানে। ঘড়ি দেখতে ইচ্ছে হয় না। ধু ধু রাস্তায় হলুদ আলোর বন্যা। সেই আলোতেই কোথাও গাছে বসে থাকা কাকেদের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। কা কা করে ডেকে ওঠে। কাকেদের চিৎকারে বিরক্ত হয়েই মনে হয় ভৌ ভৌ করে একটা কুকুর ডেকে উঠতেই অপর প্রান্ত থেকে সাড়া দেয় আর একটা কুকুর। নিস্তব্ধ রাতের নীরবতা খান খান হয়ে যায়। কিন্তু ঐটুকু শব্দে কারও ঘুম ভাঙ্গে না। সাবাই অতলস্পর্শী ঘুমে তলিয়ে আছে। ফিরে আসেন কুন্তলা বারান্দা থেকে। বিয়াস অকাতরে ঘুমিয়ে। গা থেকে কম্বলটা সরে গেছে। কুঁকড়ে শুয়ে আছে বারো বছরের শরীরটা। কাঠি কাঠি পা, রোগা শরীরটা আরও রোগা হয়ে গেছে এই কদিনে। কম্বলটা টেনে দেন কুন্তলা। কপালের ওপর কুচি কুচি চুল এসে পড়েছে। বাপের মুখটা পুরো তুলে নিয়েছে। একটা আলতো চুমু খায় কুন্তলা বিয়াসের কপালে। মেয়েটা পাশ ফিরে শোয়।

    আবার বারন্দায় গিয়ে দাঁড়ায় কুন্তলা। অনেকগুলো দিন হয়ে গেল ছেলেটা বিছানায়। দুরারোগ্য রোগে ধুঁকছে।ছেলেটা তেমন কোনদিন ভোগেনি ছোট থেকে। জ্বর-জ্বালা বড় একটা পোহাতে হয়নি কুন্তলাকে। একটাই সমস্যা ছিল ছোটবেলা থেকেই মাইগ্রেন। ঠান্ডা-গরমে মাথা নিয়ে ভুগতো। কিন্তু বছরখানেক আগে মাথার ব্যাথায় সেই যে কাবু হয়ে পড়লো, তারপর থেকে ডাক্তার-ঘর চলছেই। শহরের নাম করা নার্সিং হোমে রেখে চিকিৎসা চলল বেশ কিছুদিন। গুচ্ছের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তরপর ধরা পড়ল নীহার আর মাত্র অল্প কিছুদিনের অতিথি।

    একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কুন্তলা। সত্যি আর পারছিল না সে প্রাইভেট নার্সিং হোমের খরচ চালাতে। সংসারের খরচও তো কিছু কম না। এতগুলো প্রাণী তারা, আর সবাই তো তার ওপরেই নির্ভরশীল। স্বামীর পেনশনে সংসার চলে আর জমানো যা কিছু ছিল সে সব তো একে একে খরচা হচ্ছিলো। নিয়ে আসা হল সরকারী হাসপাতালে। ডাক্তাররা বললেন বড্ড দেরী হয়ে গেছে। অপারেট করে লাভ তেমন হবে এমন আশ্বাস ডাক্তাররা দিতে পারলেন না। সেখানে রেখে কিছুদিন কিছু চিকিৎসা চলল ।কিন্তু কিছু উন্নতি হল না। বাড়িতে নিয়ে আসা হল।

    তারপর নিয়ে যাওয়া হল ভিনরাজ্যে। কোথাও কিছু উন্নতি হল না। ডাক্তার একপ্রকার জানিয়ে দিলেন কিছু করার নেই। বাড়ি নিয়ে যান। তখন একটা সাইড পড়ে গেছে। ফিরে এলো। জড়িয়ে গেল কথা। তারপর আর একটা দিকও পড়ে গেল। এখন কথা বললেও গলা দিয়ে গোঙানী ছাড়া আর কিছু বার হয় না। চোখের সামনে ছেলেটা শেষ হয়ে যাচ্ছে আর সে নীরব দর্শকের মত দেখছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না। বুকের ভিতরটা ফেটে যেতে চায় কুন্তলার। একটা গরম স্রোত চোখের নীচে টের পান। মোছেন না বয়ে যেতে দেন।

    পিঠটা কটকট করে। বিছানায় এসে বসেন। বিকালে একটা ধকল গেছে। বুড়ো শরীরে এত ধকল আজকাল সয় না। একটা আয়া রাখতে হবে। আজ বিকেলে টের পেয়েছেন ভালোমত যে নীহারকে সামলানো নিজেদের পক্ষে সম্ভব নয় আর। সমস্ত শরীরটা পাথরের মত শক্ত আর ভারী। এতটুকু নড়াতে পারছিল না। গোঙাতে গোঙাতে কি করে যে বিছানার প্রান্তে এসে পড়েছিল জানতেই পারেননি তিনি। অথচ পাশের ঘরেই গেছিলেন কি একটা যেন আনতে নীহারকে ঘুমোতে দেখে। আর সেই ফাঁকেই কখন যে উঠে পড়েছিল সে টেরও পায়নি। ঘরে এসে ঐভাবে দেখে বুকটা পুরো উড়ে গেছিল। ঠেলার চেষ্টা করছিল কিন্তু নড়াতে পারছিল না। তবু চেষ্টা করে একটু ভেতরে সরাতে পেরেছিল। তার সাথে দুর্বোধ্য গোঙানীতে কি যে বলতে চাইছিলো কিছু বুঝছিলো না কুন্তলা। তবে সে যে খুব অস্থির হয়ে পড়েছিল সেটা বেশ বুঝেছিল। অস্থিরতা যে ক্ষতিকর নীহারের পক্ষে সেটা বুঝেই শান্ত করার জন্য গায়ে-পিঠে হাত বুলোতেই যেন একটু আরাম পেল ছেলেটা। তারপর চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়লো।

    নমিতাই তো দেখাশোনা করে আজকাল নীহারের। তাই সে-ই বেশি বোঝে। কদিন হল মেয়েটা একটা কম্পিউটার ক্লাসে ভরতি হয়েছে। সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস। দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে বেড়িয়ে যায়। সেই সময়টুকু যা দেখতে হয় কুন্তলাকে। প্রথমটা একটু গররাজি ছিলেন, কিন্তু বাস্তবটাকেও তো অস্বীকার করতে পারেননি। নীহার খুব অল্প দিনের অতিথি। তারও তো বয়স হচ্ছে। যতদিন আছেন ততদিন পেনশনের টাকা। তারপর দুটো মেয়েকে নিয়ে কি করবে নমিতা? বাঁচতে তো হবে খেয়ে-পড়ে। জমানো টাকাও তো বিশেষ নেই। তাই আর না করতে পারেননি।

    চোখটা জ্বালা জ্বালা করে। বালিশে মাথা ঠেকিয়ে চোখটা বন্ধ করেন। চোখ বন্ধ করলেই অতীতদিনের ছবি চোখের সামনে ভেসে চলে। এই তো মাত্র সেদিনের কথা। ছোট্ট নীহার ওঙা ওঙা করে কাঁদত। হিমসিম খেত কুন্তলা চুপ করাতে গিয়ে। অম্বরীশের কোলে গেলেই একদম শান্ত। এমন বাপসোহাগে ছেলে জীবনে দেখেননি। আজ অম্বরীশ ও নেই, আগামীকাল নীহারও থাকবে না। একটা কান্না বুক ঠেলে ওঠে। বালিশে মুখ গুঁজে দেন পাছে বিয়াস জেগে ওঠে।

    *******

    নীহার ও নমিতা

    *****

    সকালের সূর্যের এই নরম আলোটা ভারী ভালো লাগে। জানলার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে একটুকরো হলুদ আলো লুটোপুটি খায় ঘরের লাল মেঝেতে। মনটা ভালো হয়ে যায়। আরও একটা দিন দেখার সুযোগ পেলো সে। হাতে গোনা দিন বেঁচে আছে বলেই মনে হয় প্রতিটা মুহুর্ত বড় দামী।ভগবানকে মনে মনে ধন্যবাদ দেয় সে, এখনো সে অনুভুতিগুলো বুঝতে পারে, দুঃখ একটাই সেগুলোকে প্রকাশ করতে পারে না।

    ছয় বাই সাত খাটের একটা পাশে সে পড়ে থাকে নির্জীবের মত। ওদিকের একটা তক্তপোশে নমি আর তিয়াস। অকাতরে ঘুমিয়ে আছে। তিয়াস এখনো ব্রেস্টফীড করে তাই নমি ওকে রাতে নিজের কাছে নিয়ে শোয়। বলা ভালো শুতে বাধ্য হয়। না হলে রোগীর ঘরে ঐটুকু শিশুকে নিয়ে শুতে কার বা মন চায়। ফুলের মত মেয়েটা। মাঝে মাঝে এসেই তার খড়খড়ে গালে মুখ ঘষে। ভয় লাগে নীহারের। জানে তার রোগ ছোঁয়াচে নয়, তবু ভয় লাগে। মাথাটা সরাতে চাইলেও সরাতে পারে না। অব্যক্ত যন্ত্রনা গোঙানীর মত গলা দিয়ে বার হয়। ভয় পায় মেয়েটা। বকুনি খায় মায়ের কাছে। এদিকে আসা যে ওর মানা। নাহ নমিকে দোষ দেয় না সে। তবু মাঝে মাঝে একটা অভিমান হয়।

    মাথাটা তুলে এদিক-ওদিক দেখে। কিন্তু বেশিক্ষণ তুলে রাখতে পারে না। পড়ে যায়। এ বাড়িতে দুটো ঘর। এই ঘরটা মা-বাবার। নাহ ভুল হচ্ছে। তার বিয়ের আগে এই ঘরটা ছিলো তারই। বিয়ের পর মা-বাবা নিজেদের ঘর ছেড়ে দেন। তখন থেকেই এই ঘরটায় মা-বাবা থাকত। অসুস্থ হবার পর সে আবার এই ঘরে শিফট করেছে। এই ঘরের পাশেই বাথরুমটা। তাই এই ঘরটাই নমি নিয়েছিল যাতে চট করে বাথরুমে নিয়ে যেতে পারে নীহারকে। প্রথম প্রথম নমি একটু সাহায্য করলেই পারত। তারপর তো সেটা বন্ধ হয়ে গেল পুরো শরীরটা পড়ে যেতে।

    নমি আজকাল দুপুর হলেই বেড়িয়ে যায়। কিসব শিখছে। বেঁচে থাকতে তো হবে। রাগ হয় না, কিন্তু আজকাল সারাক্ষণ মনে হয় নমি , মা, বিয়াস, তিয়াস তার সামনে থাকুক। যতক্ষণ চোখটা খোলা থাকবে ততক্ষণ সে ওদের দেখবে, ওদের কথা শুনবে। বিয়াস আসে খুব কম। ছোট্ট বিয়াস যেন বড় হয়ে যাচ্ছে বড় তাড়াতাড়ি। শান্ত হয়ে গেছে। চুপচাপ।

    সকাল থেকে জ্বালাটা থাকে না। দিন পড়ে এলেই যেন একটা জ্বালা শরীরটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে চায়। তখন খুব মনে হয় আর পারছি না। এবার মুক্তি দাও, মুক্তি। রোদটা এখন খাটের কাছটাতে চলে এসেছে। আজ কি রবিবার? নমি এত বেলা অবধি তো ঘুমোয় না। খুব ইচ্ছে করে নমিকে ডাকতে। গলা দিয়ে একটা গোঙানী বেরোয়।

    কি হয়েছে? নমি চকিতে উঠে আসে। গোঙানীটা কি জোরে হয়ে গেছে?

    চোখের ইশারায় বলে কিছু না। নমি তার সবকথা বোঝে না। কিছু কিছু বুঝতে পারে। এখন যেমন তার খুব ইচ্ছে করছে নমি তার পাশে বসে থাকুক অনেকক্ষণ, নমি কি সেটা বুঝবে?

    *****

    বুকের ভিতর যেন হাপড় টানে। ভোরের দিকেই ঘুমিয়েছে সে। রাতে বারবার ভয় হয় এই বুঝি পড়ে গেল মানুষটা। ঘুমোয় ঘুমোয় চমকে চমকে ওঠে নমিতা। এত সকালে গোঙানীর শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গেছিল। নিজেকে গুছিয়ে নেয় একটু। তিয়াস অকাতরে ঘুমোচ্ছে। তক্তপোশের মাঝখানটা ঠেলে দেয় মেয়েটাকে। ধীর পায়ে এসে বসে নীহারের বিছানায়। আলতো করে হাত রাখে নীহারের বুকে। মানুষটা যেন কঙ্কালসার হয়ে গেছে। দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে নীহারের চোখে বেয়ে। কি যেন বলতে চায় নীহার। কিন্তু কিছু সে বোঝে না। উৎকন্ঠিত হয় নীহারের চোখে জল দেখে।

    কিছু কি কষ্ট হচ্ছে তোমার? ডাক্তারকে খবর দেব কি?

    চোখের ইশারায় না বলে নীহার।

    বেলা বাড়ে। বসে থাকলে চলবে না। উঠে পড়ে নমিতা। সারাদিনে অনেক কাজ। কাচাকাচি থেকে ঘোর-দোর পরিষ্কার, রোগীর পথ্য বানানো, নিজেদের রান্না। কাজের লোকটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে সে নিজে থেকেই। একলা শাশুরীর ওপর আর কত জোর দেওয়া যায়। নীহারের রোজগার বলতে যা ছিলো সেসব তো বছরখানেক হতে চলল বন্ধ। হাতের দিকে নজর পড়ে। একজোড়া পলা ছাড়া হাতে আর কিছু নেই। আগে অবশ্য হাতে বারোমাস দুগাছা সোনার চুড়ি পড়ে থাকত। সেই চুড়ি আর কয়খানা গহনা বন্ধক দিয়ে টাকা দিয়েছিল নীহারের ব্যবসার জন্য।

    ভেবেছিল নীহার দাঁড়িয়ে গেলে পরে সব ছাড়িয়ে নেবে। মন্দ চলছিল না নীহারের ব্যবসা। একটু একটু করে লাভের মুখ দেখছিল আর ঠিক তখনই শুরু হল মাথাব্যাথা। প্রায় অজ্ঞান হয়ে যেতে শুরু করল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নমিতা।

    খাটের পাশের জানলাটা খুলে দেয়। একরাশ আলো যেন ঝাঁপিয়ে ঘরে ঢুকে আসে হাসি হাসি মুখ করে। নীহারের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নীহার ঘুমিয়ে পড়লেই আজ জানলাটা মনে করে বন্ধ করতে হবে। বিকেলের মরা আলো দেখলেই নীহার কেমন একটা করে। এই কিছুদিন আগেও যখন কথা বলতে পারত তখনও একটা সাইড পড়ে যায় নি। কিন্তু বুঝে গেছিল এ রোগ আর সারবে না। প্রায় বলত একটা দিন শেষ হয়ে গেল নমি। আমার জীবন থেকে একটা দিন কমে গেল। আর তারপরেই অস্থির হয়ে উঠত। কি করে মানুষ করবে মেয়েদুটোকে? কি হবে নমি তোমার? শান্ত করতে পারত না। তারপর তো একটা করে দুটো সাইডই পড়ে গেল। জড়িয়ে গেল কথা। এখন শুধু মাথাটা বেঁচে আছে। বুঝতে পারে সবকিছু। কিন্তু কিছু বলতে গেলেই গোঙানী বের হয়। চোখটা কি ভিজে আসছে? তাড়াতাড়ি করে নমি বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে।

    নমিতার চলে যাবার পথে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে নীহার। সব বোঝে সে।

    নমিতা

    *********

    একটাও ফেরার বাস পাচ্ছে না, অনেকক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছে সে। আজ প্রথম দিন ছিল অফিসে। দাদার পরিচিত অফিস। রিসেপশনিস্টের কাজ। মন্দ কি। তেমন পড়ালেখাও তো তার নেই যে এর চেয়ে ভালো কিছু জোগাড় হবে। চলে তো যাবে।

    সময় করে কম্পিউটারটা শিখেছিল বলে চাকরীটা পেতে সুবিধা হল। তেমন কাজ কিছু কঠিন তো মনে হল না। সমস্ত ফোনকল আটেন্ড করা, কে কোথা থেকে কেন ফোন করেছে সেসব জেনে নিয়ে লিখে রাখা। কিছু ডেটা এন্ট্রী, নেটে বিভিন্ন কোম্পানীর প্রোফাইল চেক করে তাদের প্রোডাক্টের কিছু ইনট্রোডাকশন পাঠানো, ফাইল ম্যানেজমেন্ট এইসব। কাজে বসার আগে বেশ ভয় ভয় লাগছিল পারবে তো? দাদার সন্মান বলেও তো একটা জিনিস আছে। কিন্তু কাজে বসার পর আর কিছু মনে ছিল না। প্রথমদিন বলেই মনে হয় চাপটাও কম গেছে।

    আজ সুন্দর করে সেজেছে সে অনেকদিন পর। একটুও ইচ্ছে করছিল না। সিফনের এই সি গ্রিন শাড়িটা বছর দুই আগে দিয়েছিল নীহার। শাড়িটার সাথে ম্যাচিং করে কানের দুল আর হাতে একটা বালাও পড়েছে। ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক। নীহার তাকিয়েছিল। আজকাল আর তেমন করে অনুভুতিতে সব কিছু ধরা পড়ে না নীহারের। মাঝে মাঝে চিনতেও পারে না। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তবে বুঝতে পারে। গলা দিয়ে একটা গোঙানী বের হয়, চিনেছে বা বুঝেছে সেটা সেই গোঙানী থেকে বোঝা যায়। খারাপ লাগছিল নমিতার সেজেগুজে বেরোতে। কিন্তু কিছু তো করার নেই। অফিসে ঢোকার আগেই বলে দিয়েছিল ফিটফাট হয়ে আসবেন।তাই যতটা না করলে নয় ততটাই সে নিজেকে সাজিয়েছে।

    একটা ভিড় বাস এসে দাঁড়ায়। উঠে যায় নমিতা ঠেলেঠুলে। ধীরে ধীরে জায়গা করে ভিতরে ঢুকেই একটা বসার জায়গা পেয়ে যায় জানালার পাশে। বাসটা যথেষ্ট লোড নিয়ে নিয়েছে বলেই হয়ত নির্দিষ্ট স্টপেজ ছাড়া দাঁড়াচ্ছে না। জোরে ছুটছে আর জানালা দিয়ে হু হু করে ঢুকছে ঠান্ডা হাওয়া। ঝিমুনি চলে আসে নমিতার। জোর করে চোখদুটোকে জাগিয়ে রাখে সে। সেই কোন সকালে উঠে রান্না -বান্না, ঘর পরিস্কার, বিয়াসকে তৈরি করে স্কুল পাঠানো, তিয়াসের কাঁথা-কাপড় কাচা সব করে আয়া আসতে তাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে দুটো নাকে-মুখে গুঁজেই নিজে তৈরি হয়ে দৌঁড় মেরেছে। প্রথমদিন বলে কথা, দেরী হলে বিশ্রী ব্যাপার হত।

    দিন কয়েক হল একটা আয়া রাখা হয়েছে। সত্যি আর পেরে উঠছিল না একা হাতে এত কাজ। শাশুরী তো তিয়াসের ঝক্কি সামলায়। বিয়াসকে পড়ানো, স্কুলে নিয়ে যাওয়া-নিয়ে আসা সব করেন তিনি। তারপর আর তাকে সংসারে কি করতে বলতে পারে নমিতা। তার ওপর সবে দেড়বছর হল শ্বশুরমশায় মারা গেছেন আর তার ঠিক পরপর নীহারের অসুস্থতা। শোক-তাপে মানুষটাই কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। তার এই চাকুরী করাটাকেও হয়ত ভালোভাবে নেননি। কিন্তু কিছু করার নেই। তার একার পেট হলে ভাবত না। দুটো মেয়ে আছে। তাদের লেখা-পড়া, খাই-খরচ, পোশাক- আষাক সবই তো এখন তার ওপর এসে বর্তেছে। শাশুরীর ওপর কি ভরসা। যে কদিন আছেন সে কদিন। তারপর? এই তারপরটাই তো বুঝতে হবে। গাংঅ বুজে আসছে, সেখানে আর কোনদিন বান আসবে না, নদীকে তো নতুন পথ খুঁঅজে নিতেই হবে।

    কুন্তলা

    ******

    …. দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না
    সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি….

    হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মনে হয়, আনমনে গানের কথাগুলো কানে যেতেই মনে মনে বললেন কুন্তলা। দূর থেকে ভেসে আসছে গানটা। নিঝুম দুপুরবেলা বলেই মনে হয় শব্দগুলো এট স্পষ্ট। তিয়াস ঘুমিয়ে আছে। আজ বড় জ্বালাচ্ছিল বাবার কাছে যাবে বলে। তিনি যেতে দেননি। নীহার কদিন ধরে খাচ্ছেই না। সারাদিন আচ্ছন্নের মত পরে আছে। দিনকয় হয়ে গেল। ডাক্তার ডাকা হয়েছিল। তৈরি থাকতে বলে গেলেন তিনি। চেনা ডাক্তার। নীহারকে জন্মাতে দেখেছেন। বাড়ির বাতাসটা ভারী হয়ে আছে। নিস্তব্ধ বাতাসে মৃত্যুর ধীর পদক্ষেপ শুনতে পাচ্ছেন কুন্তলা। সময় হয়ে এসেছে।

    বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না। প্রাণের ভিতরটা হু হু করে। এই দুহাতের মধ্যে যাকে বড় করলেন হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা, স্নেহ, অন্তরের সমস্ত সুধা দিয়ে, স্বপ্ন দিয়ে তার শবদেহ পড়ে থাকবে এই পায়ের কাছটিতে। ভাবতেই পারেন না তিনি। কল্পনা করলেও শিউড়ে ওঠেন। পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।কিন্তু বাস্তব থেকে যে পালানো যায় না।

    নমিতা মাস কয়েক হল একটা চাকুরী পেয়েছে। অনেকটা সময় বাড়ির বাইরেই কেটে যায় তার। একটা সাময়িক মুক্তি এই বাড়ীর বাতাস থেকে। মৃত্যুর গন্ধ থেকে। মেয়েটা বাঁঅচার রাস্তা খুঁঅজছে। বিয়াসের আসার সময় হল। শাড়িটা পালটে বেড়িয়ে যান তিনি। রাস্তায় পরিচিত এর-ওর সাথে দেখা হয়। সবাই নীহারের সম্পর্কে জানতে চায়। এক উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত লাগে। মোড়ের মাথায় গাড়িটা এসে দাঁড়ায় নেমে আসে বিয়াস। কাঠি কাঠি পা, রোগা শরীরে বেঢপ লম্বা লাগে। চুপচাপ, কিছুটা চিন্তিত প্রতি পদক্ষেপ। মেয়েটাও যেন পাল্টে গেছে এই বয়সেই। ব্যাগটা হাতে নেন কুন্তলা বিয়াসের কাছ থেকে , তারপর নীরবে পার করেন বাকি রাস্তাটা। এটাই এখন কুন্তলার রুটিন জীবন।

    *******

    একটু আগেই শেষ হয়েছে নীহারের পারলৌকিক কাজ। ফটোতে এখনও তাজা রজনীগন্ধার মালা। ধুপের ধোঁঅ্যা এখনও বাড়ির বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ডাঁই হয়ে পড়ে আছে ধুপের একরাশ ছাই ধুপদানীকে ঘিরে। আর পড়ে আছে নির্জীবের মত তিনটে প্রাণী।

    বিয়াস

    *****

    বাবার শেষ ইচ্ছে ছিল বিয়াস তার মুখাগ্নি করবে। সেই মত বিয়াস মুখাগ্নি করেছে। ছোট্ট কিশোরী বিয়াস যেন হঠাৎঅ করেই বড় হয়ে গেছে এই ছমাসে। এবারের পরীক্ষার রেজাল্টটা আর বাবাকে জানানো হল না তার। খুব ভালো রেজাল্ট হয়েছে তার। এতটা সে নিজেও আশা করেনি। বাবাকে সে গত কয়েকমাস ধরে এড়িয়ে চলেছে। দূরে দূরে সরে থেকেছে। বাবাকে ছাড়া এই পৃথিবীতে বাঁচাটা শিখে নিতে চেয়েছে। আজ বড় হু হু করছে মনের ভিতরটা। কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদতে পারছে না। মা, ঠাম্মি এদের সামনে কাঁদে কি করে ?

    বাবাকে সেদিন চন্দন পড়ে খুব সুন্দর লাগছিল। বাবার বিয়ের একটা ফটো আছে ডাইনিং-এ। বিয়ের সময় তোলা, ঠাম্মি বলছিল।সেই রকম সুন্দর দেখাচ্ছিল বাবাকে, শুধু বাবা ঘুমিয়ে ছিল। চির ঘুম। সেদিনও খুব কান্না পাচ্ছিল বিয়াসের। সেদিনও কাঁদেনি ও। শুধু একটা গোঙানী বেড়োচ্ছিল গলা দিয়ে। যে যা করতে বলেছিল তাই করছিল যন্ত্রচালিত পুতুলের মত।

    প্রতিদিন স্কুলে যাবার সময় ঐ খাটটা চোখে পড়ত। বাবা শুয়ে থাকত। সে যখন স্কুলে যেত বাবা তখন ঘুমে আচ্ছন। আর যখন ফিরত তখনও তাঅই। খাটটা খালি খালি লাগছে। খাটটা আছে শুধু বাবা নেই। একটা কান্না ঠেলে আসে। বিয়াস দৌড়ে চলে যায় ছাদের সিঁড়িতে।

    নমিতা

    *****

    তিয়াসটা ঘুমোচ্ছে। আজকাল বড় জ্বালায় ঘুমোতে। সারাক্ষণ বাবা বাবা করে এঘর ও ঘর খুঁজে চলেছে। ভয় হচ্ছে মেয়েটা না হেঁদিয়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ছয় বাই সাত খাটে একটা কোণে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে তিয়াস। বাকি খাটটা ফাঁকা। গত ছমাস ধরে এই খাটটাই ছিল নীহারের একমাত্র আশ্রয়স্থল। বড় ফাঁকা লাগছে।

    নীহারের জন্য যত ভাবনা, চিন্তা, উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, পরিশ্রম সব কিছু থেকেই নিস্কৃতি দিয়ে গেছে নীহার। এখন অখন্ড অবসর। কোন কাজে মন লাগে না। করতে হয় বলেই যেন করা। শুধু স্মৃতি এসে পিছু টানে।

    সেদিন অফিসে থাকাকালীন কেমন যেন মনটা টেনেছিল নমিতার। একটু ম্যানেজ করে বাড়ি ফিরে দেখেছিল নীহারের চোখের দৃষ্টি স্থির শীতল, উর্ধগামী। কদিন ধরে খাওয়া-দাওয়া বন্ধই ছিল, চিনতে পারছিল না এতদিন কাউকে। কিন্তু সেদিন ঘরে ঢুকে খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই নীহার তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসেছিল, নাকি সেটা তার ভ্রম আজও বুঝে পায় নি নমিতা। শাড়িটা পাল্টে আসতে আসতেই নীহার চলে গেছিল। স্থির শরীরটা দেখেই দৌড়ে গিয়ে শাশুরীকে ডেকে এনেছিল। খবর দিয়েছিল পাড়ার ডাক্তারকে।

    সাজিয়ে দিয়েছিল শাশুরী ঠিক সেদিনের মত করে যেদিন বিয়ে করতে এসেছিল নীহার তাকে। কি সুন্দর লাগছিল। বড় প্রশান্ত মুখ। রোগযন্ত্রনা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া নীহার চির নিদ্রায় ঘুমিয়ে ছিল। নাহ আর পারে না সে, ধীরে ধীরে মুখ গুঁজে দেয় বালিশের মধ্যে।

    কুন্তলা

    *****

    অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে চলো প্রভু, মৃত্যু থেকে নিয়ে চলো অমৃতের পানে - থেকে থেকে এই বাণী স্মরণ করেছে কুন্তলা এই কদিন ধরে তবু ধরে রাখতে পারেনি চোখের জল। আজ সারাদিন নিজেকে ঘরে বন্দী করে রেখেছে কুন্তলা। একবারও যায়নি বিয়াস যেখানে নীহারের কাজ করছিল সেখানে।

    কি দেখতে যাবে সে? আজ তো এবাড়িতে তার পারলৌকিক কাজ করার কথ নীহারের। অনেক তো দেখা হল। জীবনের অনেক রঙ-গন্ধ-রুপ দেখা তো হল। আর কি বাকী? বাকী ছিল নিজ সন্তানের মৃত্যু দেখা তাই তো আজও বেঁচে আছে সে। অভিশপ্ত জীবন তার।

    ছোট ছিল যখন তখন প্রতিবছর এই হাতে চন্দন পড়িয়ে সাজিয়ে দিত কুন্তলা নীহারকে। অনেক বছর পর আবার পড়ালো সে নীহারকে চন্দন। শেষ চন্দন, শেষ চুম্বন। ভেসে যায় মুখ-গলা অশ্রুজলে। পুত্রশো কের মত শোক হয় না। কবে মিলবে নিষ্কৃতি এই যন্ত্রনা থেকে?

    ( শেষ )
  • Ishani | 125.244.232.17 | ০১ আগস্ট ২০১৪ ১৯:১০644636
  • পাতায় গল্প শেষ | যুদ্ধও | জীবনে এই তো সবে শুরু ! :(
  • joldip | 134.125.50.16 | ০২ আগস্ট ২০১৪ ১৩:৪৬644637
  • ধন্যবাদ তৃষা। জীবন আবার নতুন করে শুরু করেছে হয়ত নমিতা। বিয়াস আর তিয়াস এখন অনেক ছোট। কুন্তলা নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছে ঠাকুরের গানে, কথামৃততে, এও তো একরকম শুরু তাই না।
  • kiki | 127.194.71.178 | ০২ আগস্ট ২০১৪ ২০:৩৮644638
  • হুম্ম !! ঃ(
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট প্রতিক্রিয়া দিন