এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কুলদা রায় | 34.90.91.2 | ০৩ ডিসেম্বর ২০১২ ২৩:৫৬583337
  • আজ পেলেকার জন্মদিন
    ------------------------

    আজ আমার ঈশ্বরের জন্মদিন। তার ডাক নাম পেলেকা। এই পেলেকা শব্দটি এসেছে পেলেকার্ড লুঙ্গী থেকে। সত্যিকারে ঈশ্বর নিজের হাতেই এই পেলেকার্ড লুঙ্গী বানিয়েছেন।

    ঈশ্বরের বাড়ি রঘুনাথ গ্রামে। ইউনিয়ন পাদ্রী শিবপুর। উপজেলা বাকেরগঞ্জ। পাদ্রী শিবপুরে--নমশুদ্রদের শিবঠাকুর, পাদ্রী পেদ্রো মশাই আর চরমোনাইয়ের দূরসম্পর্কের ভায়রা ভাই নয়া পীর সাব থাকেন। কারো সঙ্গে কারো বিবাদ নাই।

    বাকেরগঞ্জ যখন আমি প্রথম গিয়েছিলাম—সেদিন ছিল মঙ্গলবার। সেদিন বেলা হয়ে গেছে। নদীর চরে কলসকাঠী। এই গ্রামে আমার রোগীর নাম তরমুজ। এর পাশেই মিষ্টি আলুর লতা ডগডগিয়ে উঠেছে। সরিষা ক্ষেতে সবে বর্ণ আসতে শুরু করেছে। আকাশ তখন আর নীল থাকে না। তরমুজের মত লাল হয়ে যায়। মতিন মুন্সী নামে কৃষক আমাকে বলেন, স্যার, এইটাকে লাল কইবেন না। কইবেন গোধুলী। এই গোধুলী লগ্নে মেয়েরা পরী হইয়া ওঠে। এই পরী দেইখা বিভুতীবাবু একটা গল্প লেখছিলেন। নাম মেঘমল্লার। মেঘমল্লারে বাঁশি বাজাইলে পরী নদীকুলে নাইমা আসে। বিভুতিবাবু তার নাম দিছিলেন সরস্বতী। আপনেগো বিদ্যার দেবী।

    এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে মতিন মুন্সী মেঘমল্লার রাগে আলাপ জুড়লেন। আমরা দুটো ফুটি খেলাম। আর খেলাম কচি খিরাই আর মটরশুঁটি পোড়া। সাক্করকোরা চালের পায়েস খেয়ে যখন ফেরার পথ ধরেছি—তখনও মেঘমল্লার ঘনিয়ে উঠছে, বাঁশবন ভেদ করে জ্যোৎস্না উঠেছে। একটা শীতল হাওয়া বইছে। আর আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছেন সাক্ষাৎ সরস্বতী। তিনি জননী। তিনি জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি—তিনি গরীয়সী।

    দবদবিয়া নদী পার করে দিয়ে এই সরস্বতী বললেন, আমার বাড়ি পাদ্রী শিবপুর। পোলাগো নাম আইনতন আর আনু--আনোয়ার। আইনতনরে তুমি পাইবা না। সে হাঁটে হাঁটে ঘোরে। পেলেকার্ড লুঙ্গী বেঁচে। কিন্তু আনুরে--আনোয়াররে পাইবা। আনোয়ারের লগে তোমার লগে দেখা হইবে। সে মাথায় হেমিংওয়ের টুপি পইরা ঘোরে। এ-ই চিহ্ণ।

    ফলে আমাকে হেমিংওয়ের টুপি দেখার জন্য এক যুগ অপেক্ষা করা লাগে। ঈশ্বর বললে যুগ হয় নিমেষ। আমি এই ঈশ্বরের এক নিমেষের তলে তলে থাকি। এ কারণে আমার কোনো বাসনা নাই। আমার কোনো যাতনা নাই। যা দেখতে চাই তাই দেখি। যা শুনতে চাই তাই শুনি। এই চোখ, কান আর বোঝনদারী আমার নয়। ঈশ্বরের। তার জামা গায়ে দিয়েই আমি হাঁটি। তার পায়েই আমি ভর করে দাঁড়াই। আমি যে কোনো ঈশ্বরকে মানুষের মত করে চিনি—যে কোনো মানুষকে ঈশ্বরের মত করে চিনতে চেষ্টা করি। এ জগৎ ঈশ্বরময়।

    এই ঈশ্বরই একদিন আমাকে ফোন করে বলেন, আসেন—হেমিংওয়ে সাবে আপনের জন্য খাড়াইয়া আছেন। দেরী কইরেন না। তার তাড়া আছে। তিনি বুড়া হইছেন। কিন্তু হাউস কমে নাই। মাছ-টাছ ধরবেন। মাছের নাম সার্দিনো।

    আমি তখন ছুটে যাই ইউনিয়ন টার্ন-পাইকে। সেখানে লোকজন একটা বড় দরজা দিয়ে ঢুকছে আর বের হচ্ছে। এইখানেই ঈশ্বর থাকেন। কিন্তু আমি কোনো ঈশ্বরের দেখা পাইনা। একজন লম্বা চওড়া লোক এসে বলেন, কারে খোঁজেন। আমি কিছু না বুঝেই বলি, একজন বুড়ো মানুষ--একজন মানুষ-বুড়োকে খুঁজি। তিনি বলেন--কি নাম তার?
    বলি, পেলেকা। অথবা পেলেকা নয়। অন্য কিছু। ভুলে গেছি।

    তিনি মাথা তুলতে বলেন ছাদের দিকে। এই ছাদ থেকে একটা লম্বা করিডোর নেমে এসেছে। সেখানে একটা কাফের মধ্যে বেশ কয়েকজন বুড়ো মানুষ নানা ভঙ্গীতে বসে আছেন। এদের মধ্যে একজন চিকন-চাকন বুড়োকে চিনতে পারি। তিনি বার্নাড শ। একটু গম্ভীর হয়ে বলেন, ওহে বৎস, যাকে খুঁজছো, তার মাথায় কী টাক আছে?

    একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, জানি না। তারে দেখিনাই। শুনছি মাথায় টুপি আছে।

    --টাক না থাকলে মাথায় টুপি দেবে ক্যান?
    --সেইটা তো আমি জানি না। জানে সরস্বতী মাতা।
    সরস্বতীর কথায় তার মুখে হাসি ফোটে। তিনে বলেন, আগে বলবে তো হে বৎস। ঐ যে তোমার টুপিওলা।

    তখন টুপিপরা পেলেকাকে নয়-- হেমিংওয়েকে দেখতে পাই। তিনি টুপি মাথায় দিয়েই আছেন। টুপির একটা দিক কাত করা। বাঁদিকের চোখটা সামান্য কুঁচকে আছে। দেখে আমার নিজের অস্বস্তি লাগে। এই লোক হেমিংওয়ে হতে পারেন-- কিন্তু আমার পাদ্রী শিবপুরের ঈশ্বর হবেন না। কলসকাঠীর তরমুজ চাষী মতিন মুন্সী বলেছিলেন, পাদ্রী শিবপুরের আইনতনের মুখে গোঁপ নাই। তার ছোটো ভাই আনু ওরফে আনোয়ারের মুখেও গোঁফ থাকতে পারে না।

    শুনে এবার হেমিংওয়ে সাবেই কথা বলে ওঠেন। বলেন, ব্রাদার, উপরে নয়--তোমার পাশে তাকাও।
    পাশে তাকিয়ে দেখি, সেই লম্বা লোকটা কফি হাতে গভীর মনোযোগের সঙ্গে একটা বই দেখছেন। তার মাথায় হেমিংওয়ের টুপি আছে। মুখটা ক্লিন শেভড। চোখে গোল চশমা। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে পরিস্কার করে বলে উঠলেন, আমার নাম আনোয়ার শাহাদাত। বাড়ি পাদ্রী শিবপুর।

    তাকে আমার চিনতে কষ্ট হয় না। এই আনোয়ার শাহাদাতই আমার চেনা। তিনি আইনতনের ভাই। কদমবিবির ভাগ্নে। আব্দুল আজিজের ভাতিজা।

    ‘এই আব্দুল আজিজ হাতের ঢিল-ইটখানা দিয়ে গায়ের সবটুকু জোর শক্তি ঢেলে রামপুরা টিভি সড়কের উপর লেপ্টে থাকা ট্যাংক চলে যাওয়ার দাগ মুছে ফেলার চেষ্টা করে। তার কেনো যেনো মনে হয় ট্যাংকের এই দাগের মধ্যেই রয়েছে এই জনপদ পিষ্টনের চিহ্ন, ঘষে ঘষে হাতের ইটখানা দিয়ে তা মুছে ফেলে দিতে চায়। ‘

    এই আনোয়ার শাহাদাত আমার ঈশ্বর। আমার শিক্ষক। তিনি আছেন বলেই আমি আকাশকে আকাশের মত দেখি। মানুষকে মানুষ বলে চিনি। আর পরীকে পরীমানব। তিনি এই আকাশ, মানুষ আর পরীকথা লেখার জন্য খাগের কলম তুলে দেন আমাদের হাতে। এর জন্য হাইৎনার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি নিজেই বানিয়েছেন ভূষো কালি। বলেন, লেখেন। নিজেকে লেখেন। ্নিজেকে লেখা ছাড়া উপায় নেই। এই-ই আপনার ভবিতব্য। ভবিতব্য কীর্তখোলার জলে ভেসে যায়। আমি তখন জলের মধ্যে জল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এই জলের নাম সোমরস। এই জলের নাম রবিরস। এই জলের নাম কনিরস। এই কনিরস লোয়ার ম্যানহাটনে কনিয়াক নামে ত্রিনিদাদের দস্যুরা বিক্রি করে।

    আজ ঈশ্বরের জন্মদিন। এদিন আমিও জন্মেছিলাম পেলেকার লুঙ্গী পরে।

    আমাদের মায়ের নাম কলসকাঠীর সরস্বতী। বাপের নাম লালন শাহা। দাদাজান রবি বুড়ো। আর নানাজান প্রভু যীশু। আমরা দুজন মাঝে মাঝে হাডসন নদীর পাড়ে বসে অন্ধকারের মধ্যে মেঘমল্লারে গলা মেলাই। আমাদের মাথার ভেতরে চাঁদ ওঠে। মেঘ করে। বৃষ্টি হয়। রোদ হয়। এর গায়ে সাক্করকোরা চালের ঘ্রাণ লেগে আছে। আর কিছু নয়।

    শুভ জন্মদিন হে আমার ভাই আনোয়ার শাহাদত।

    ----------------------
    আনোয়ার শাহাদাত
    গল্পকার, উপন্যাসিক, চলচ্চিত্রকার

    জন্ম :
    ৩ ডিসেম্বর, বরিশাল।

    গল্পগ্রন্থ :
    ১. ক্যানভেসার গল্পকার
    ২. হেলে চাষার জোয়াল-বৃত্তান্ত
    ৩. পেলেকার লুঙ্গী (প্রকাশিতব্য)

    উপন্যাস :
    ১. সাঁজোয়াতলে মুরগা

    চলচ্চিত্র :
    কারিগর

    শর্ট ফিল্ম :
    ডায়ানার ৬
    এ্যাস ইট সুড বি
    প্রিন্টার পারফেক্ট
    ন্যানি
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন