এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • হরিতকী ফলের মতন......

    Shibanshu
    বইপত্তর | ২২ এপ্রিল ২০১২ | ১৩৮৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Shibanshu | 117.197.253.42 | ২২ এপ্রিল ২০১২ ১০:৫১543454
  • কখন নীরবে 'ফিরে এসো চাকা' পঞ্চাশ বছর গড়িয়ে গেলো, টের পাওয়া গেলো কি? যদি একটিমাত্র ক্ষীণকায় কাব্যসংকলন দিয়ে একজন কবির অস্তিত্ব লেখা হতে পারে পদ্যের ইতিহাসে, তবে এই বইটি একটি তর্কহীন উদাহরণ।

    একটি গল্পের ফ্রেমে এক প্রিয় কবির ছবি আঁকার একটা প্রয়াস এভাবে। জানিনা ছবিটি তাঁর মতো হবে কি না.........
  • Shibanshu | 117.197.253.42 | ২২ এপ্রিল ২০১২ ১০:৫২543456
  • হরিতকী ফলের মতন......

    .

    '.... সংগোপন লিপ্সাময়ী, কম্পিত প্রেমিকা- তোমার কবিতা, কাব্য ;'

    সেটা ছিলো অঘ্রাণের শেষ বেলা। সাকিন জামশেদ্‌পুর বই মেলার ধূসর আঙিনা। তখনও বাঁধানো হাট, ঘাসের কালিন পাতা অভিরাম ঠিকানায় যায়নি আমাদের বছরকার বইয়ের সঙ্গে রোমাঞ্চিত সাতদিন।

    যেসব বন্ধুদের সঙ্গে সময়হীন আড্ডা দেবার ইচ্ছে হয়, তারা তো সারা বছর এভাবে এক জায়গায় পঞ্চায়তের বটতলা পাততে পারেনা এই কাজের শহরে। প্রসঙ্গ-অপ্রসঙ্গ-প্রসঙ্গান্তর কথার মেঘে ভিজে সাতটি সন্ধেবেলা। প্রসঙ্গ তো নয়, সঙ্গই সেখানে মুখ্য লিপ্সা। আমার এক বন্ধু, মুষ্টিমেয় একজন, যার সঙ্গে মুখোস না পরে পদ্য নিয়ে আলোচনা করা যায়, তাকে বলি বিনয় মজুমদার শেষ কবে পড়েছো? আসলে 'ফিরে এসো চাকা' অনেকদিন ছাপা ছিলোনা। হঠাৎ 'শতাব্দীর সেরা ভূতের গল্প', 'বিখ্যাত' শিল্পীদের আঁকা ছবিসহ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আরব্য উপন্যাস জাতীয় বইয়ের পাহাড়ের মধ্যে থেকে রোগা, ম্লান, হলুদ পাতার বইটি মুখ দেখালো, অরুণা প্রকাশন থেকে ১৯৮৩ সালের সংস্করন। দাম চারটাকা। নামপাতাটি ওল্টালেই সেই বিখ্যাত নিবেদন, 'উৎসর্গ, গায়ত্রী চক্রবর্তী'। তৎক্ষণাৎ 'উৎসর্গ, পর্ণা' লিখে তাকে খুঁজে বেড়ানো ভিড়ের মধ্যে। এই সময়ই সেই বন্ধু, কী নিলে?
    'ফিরে এসো'
    সে কী? এতোদিন পরে?
    আরে না না , একজনকে দিতে হবে।
    তখনই তাকে জিগাই, শেষ কবে পড়েছো, বিনয় মজুমদার?
    এভাবে গড়িয়ে যায় তার সঙ্গে কবিতার আলাপ। কতোশত ঘাসজমি, লেগুন, মোহানা পেরিয়ে কবিতার স্রোত বয়ে যায় শব্দের ছলে। সময়ও যায়...

    হঠাৎ দেখি অসিতদা এসে হন্তদন্ত, আরে শিবাজি চলো চলো,
    বলি , কোথায়?
    ঐ স্টেজে দেখছো না, গান গাইতে হবে...
    বিপন্ন হয়ে এদিকওদিক.... দেখি পকেটে হাত দিয়ে সুদীপ দাঁড়িয়ে আছে। এইতো পাওয়া গেছে।
    য়্যাই সুদীপ শোন শোন,
    কী হলো? এগিয়ে আসে সে...
    অসিতদা, সুদীপ খুব ভালো গায়। আজ ওকে দিয়ে গাওয়ান, আমি কাল আছি...
    সুদীপ হতভম্ব, মানে?
    যা না বে, আর নখড়া করিসনা....
    অসিতদা গ্রেফ্‌তার করে নিয়ে যান সুদীপকে, আমি বাঁচি তখনকার মতো। একটা স্টেজ বাঁধা হয় সেখানে। সবাই নিজের মতো করে বাংলা গান, পদ্য, কথা বলে মাইকের সামনে। পা ব্যথা হলে অনেকে জমিয়ে শোনে, মাঝে মাঝে আবার উঠে বইয়ের স্টলে ঢুকে যায়।

    আজ এসেছে কি? কোথায় গেলো তাহলে?
    মাঝে মাঝে কবিতা নিয়ে বেশ ভাবিত হয়ে পড়ে সে।
    একবার প্রশ্ন করেছিলো, কবিতা বোঝার কোনও সরল নিয়ম আছে কি? না যে কোনও রকম নিজস্ব নিয়মে তাকে বুঝে নিতে হয়?

    আমি বলেছিলুম, কবিতা তো বোঝার জন্য নয় , ছোঁয়ার জন্য। বোঝার জন্য বানানো 'বোঝা' মানুষ অনেক জড়ো করেছে। ঐ ভার থেকে মুক্তি পাবার জন্যই তো কবিতা। কোনও বুঝদার লোককে কখনো কবিতা পড়তে দেখেছো? হ্যাঁ, অনেক বাংলার অধ্যাপক পাবে, পার্ট টাইম নানা ব্যবসার ফাঁকে সুকুমারমতি বালকবালিকাদের কবিতার ব্যাখ্যা লিখিয়ে দেন। পরীক্ষায় আসবে এই প্যারাটা, গ্যারান্টি....
    এই সব দেখেই তো সেই বরিশালের বাঙাল অধ্যাপকটি পদ্যের মাংসকৃমি খোঁটা নিয়ে ব্যাকুল হয়ে পড়েন, ঝরে যান....

    'সংশয়ে, সন্দেহে দুলে দুলে তুমি নিজে ঝরে গেছ, হরিতকী ফলের মতন।'

    বরিশালে তো আমার মামার বাড়ি। তুমি কোন অধ্যাপকের কথা বলছো?

    সুযোগ যখন পাওয়া গেছে, আমার প্রিয়তম সেই কবিতাটি শোনাবার সুযোগ কি ছেড়ে দেওয়া যায়?

    ৩রা মার্চ,১৯৬২

    ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরনে
    কতিপয় চিল শুধু বলেছিল, 'এই জন্মদিন'।
    এবং গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ
    দর্শনে বিফল বলে, ভেবেছিলো, অক্ষমের গান।
    সংশয়ে সন্দেহে দুলে একই রূপ বিভিন্ন আলোকে
    দেখে দেখে জিজ্ঞাসায় জীর্ণ হয়ে তুমি অবশেষে
    একদিন সচেতন হরিতকী ফলের মতন
    ঝরে গেলে অকস্মাৎ, রক্তাপ্লুত ট্রাম থেমে গেল।'.......

    কবিতাটি আমি বলি, সে শোনে, কয়েক মূহুর্ত হরিতকী ফলের মতন ঝরে যায়। মনে হয় শুনি সুদূর থেকে সে বলে,

    কার লেখা?

    আগে বলো, তুমি কি শুধু 'বুঝতে' পেরেছো না শব্দগুলো কোথাও ছুঁয়েছে তোমাকে?

    স্বগতোক্তির মতো বলে ওঠে, ছুঁয়েছে, ছুঁয়েছে....

    এই কবিতাটা বিনয় মজুমদারের, ওনার বিখ্যাত সংকলন 'ফিরে এসো চাকা'তে রয়েছে।
    তুমি বইটা আমাকে এনে দেবো?
    নিশ্চয় দেবো, যদি খুঁজে পাই.....

    .

    ......তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
    মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলি।'

    কয়েকদিন তেনার খোঁজ খবর নেই। ফোনের নাগালের বাইরে থাকেন তিনি। একটা জায়গায় পাওয়া যাবে নিশ্চিত। বুধবারে একবার ট্রাই নেওয়া যাবে।
    পর্ণা প্রতি বুধবার বিকেলদিকে একবার ডি এম লাইব্রেরিতে নিশ্চয় আসে, রবীন্দ্রভবন থেকে গান শিখে ফেরার পথে। স্ট্রেট মাইল রোডে লাইব্রেরির উল্টোদিকে ডাক্তার চ্যাটার্জির বাড়ির সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে অফিস পালিয়ে অপেক্ষা করি। তিনি এলেন শেষ পর্যন্ত। দেখতে পাননি আমাকে। একটু অন্যমনস্ক, অহংকারী পা ফেলা, নীলকালো কামিজ, কাঁধের ব্যাগে গানের খাতা। বাইরেই অপেক্ষা করি। বেরিয়ে এসে বাস স্ট্যান্ডের এগোতে থাকে। নি:শব্দে পাশে পাশে হাঁটি। দেখেছে, কিন্তু তাকাচ্ছে না। কী হলো আবার ? মনে হয় কিঞ্চিৎ গুরুতর ব্যাপার।

    কী ব্যাপার, সব নিমন বা নু?
    হ্যাঁ, দেখছই তো, ভালো আছি...
    পর তনি গড়বড় লাগত....
    না কোনও গড়বড় নেই...
    চলো পার্কে একটু বসি
    নাহ, তাড়া আছে, আজ এখুনি বাড়ি ফিরতে হবে
    তা ফিরবে, আমি পৌঁছে দেবো। এখানে এক মিনিট দাঁড়াও, আমি বাইকটা নিয়ে আসি...
    বলছিনা, আজ বসবো না কোথাও
    তুমি বসবে, আজ, এখুনি, আর কোনও কথা হবেনা

    থমকে দাঁড়ায়, এতোক্ষণ পরে মুখ তুলে তাকায় আমার দিকে,
    কীসের জোর এতো তোমার? কীসের?
    সেটা বলবার জন্যই তোমাকে যেতে বলছি...

    কিছু বলেনা, কিন্তু দাঁড়িয়ে যায়

    একটু পরে জুবিলি পার্কের টাটাবাবার মূর্তির নামোদিকে দেবদারুর সারি দিয়ে ঘেরা ঘাসজাজিমে দুজনে মুখোমুখি বসে থাকি অন্ত:স্বত্ব মৌনতায়।
    বলি, কিছু বলবে?
    হুঁ, গত বিষ্যুদবার তোমাকে বিষ্টুপুরে মেঘানির সামনে দেখলাম, কারুর সঙ্গে কথা বলছিলে...
    এতোক্ষণে স্পষ্ট হয় রহস্য। হা হা করে হেসে উঠি। তুমি কোথা থেকে দেখলে আমাকে?
    আমি আর পরমা হিন্দুস্তান বিল্ডিঙের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম
    আমায় ডাকলে না কেন?
    তোমাকে ডা-ক-বো? অতো ব্যস্ত ছিলে তুমি, হেসে হেসে.... মেয়েটা কিন্তু খুব সুন্দর...ও-ই কি মধুরিমা?
    ঠিক বলেছো
    তবে আর কী, আজ উঠি...
    আরে বসো, বসো.... একটা ছোট্টো কবিতা শুনিয়ে তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি,
    কার কবিতা?
    সেটাই তো তুমি বলবে...
    বেশ..

    ' ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
    লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝরে যায়-
    হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
    এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়
    কখনো ওড়েনা; তবে ভালোবাসা দিতে পারি আমি।
    শাশ্বত, সহজতম এই দান-শুধু অঙ্কুরের
    উদ্‌গমে বাধা না দেওয়া, নিষ্পেষিত অনালোকে রেখে
    ফ্যাকাশে হলুদবর্ণ না করে শ্যামল হতে দেওয়া।
    এতই সহজ,তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
    মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলি।
    গ্রহণে সক্ষম নও। পারাবত, বৃক্ষচূড়া থেকে
    পতন হলেও তুমি আঘাত পাওনা, উড়ে যাবে।
    প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি
    চলে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রনায় স্তব্ধ হব আমি।

    কিছুক্ষণ চুপ করে বলে, এটাতো আমার কবিতা; তুমি বলছো কেন?
    তাইতো, আমি ভাবলাম এটা আমার কথা তোমাকে শোনাই......
    এবার হেসে ওঠে নির্ঝরের মতো শব্দ করে, অনেকক্ষণ....

    মনে হচ্ছে শব্দগুলি স্পর্শ করেছে তোমায়

    করেছে, খুব করেছে, জীবনানন্দের মতো, কিন্তু জীবনানন্দ নয়.....

    ঠিক বলেছো, রক্তাপ্লুত ট্রাম মনে পড়ে?

    হ্যাঁ, বিনয় মজুমদার........

    ফুল মার্ক্স পেলে।

    (ক্রমশ:)
  • Shibanshu | 117.197.253.42 | ২২ এপ্রিল ২০১২ ১০:৫৪543457
  • হরিতকী ফলের মতন....

    .

    এরূপ বিরহ ভালো; কবিতার প্রথম পাঠের
    পরবর্তী কাল যদি নিদ্রিতের মতো থাকা যায়,
    স্বপ্নাচ্ছন্ন, কাল্পনিক; দীর্ঘকাল পরে পুনরায়
    পাঠের সময়ে যদি শাশ্বত ফুলের মতো স্মিত,
    রূপ, ঘ্রাণ ঝরে পড়ে তবে সার্থক সব ব্যথা,
    সকল বিরহ, স্বপ্ন; মদিরা বুদ্বুদের মতো
    মৃদু শব্দে সমাচ্ছন্ন, কবিতা, তোমার অপ্রণয়।
    হাসির মতন তুমি মিলিয়ে গিয়েছ সিন্ধুপারে ......

    অনেক ছোটো ছিলুম তখন। বাবার বিশাল বইয়ের ভার গুছিয়ে রাখার দায় নিজেই নিয়েছিলুম জাস্ট বই ঘাঁটার আনন্দ পেতে। পদ্যের বইগুলোর মধ্যেও তেষট্টি সালের ছাপা এই সংকলনটি ছিলো প্রায় নেই হয়েই। অনেকটা পাড়াগাঁর বাসর ঘরের সব চেয়ে গোধূলিমদির মেয়েটির মতো। বারো তেরো বছর বয়েসে নিশ্চয় বিনয় মজুমদারকে ছুঁয়ে থাকার মতো এলেম আমার ছিলোনা। কিন্তু পদ্যগুলি ছিলো শুধু পড়ে যাওয়ার জন্য। সব তন্তুজাল উড়িয়ে দিয়ে আটপৌরে বা তৎসম শব্দগুলিকে হৃদমাঝারে গড়িয়ে দেবার যে মসৃণ পাকদন্ডি বিনয় আবিষ্কার করেছিলেন, তার জাদু সেই বয়েসেই অনুভব করেছিলুম। তোমার মোহনরূপে কে রয় ভুলে.....? বাবাকে প্রশ্ন করেছিলুম এই কবিতাগুলি কবে বুঝতে পারবো? তিনি বলেছিলেন, বোঝার চেষ্টা কোরোনা, কাছে যাওয়ার কথা ভেবো। তার জন্য সময় দিতে হবে, নিজেকে দিতে হবে মগ্নতা। বৈষ্ণবের কৃষ্ণপ্রাপ্তির মতো অনুভব হবে একদিন, সেটাই কবিতার কাছে আমাদের প্রার্থনা।

    তার পরেও সম্ভবত সিগনেট থেকে একটা তন্বী সংস্করন প্রকাশ করা হয়েছিলো, সেটা আমরা আমাদের শহরে পাইনি।

    এটা নিয়ে একটা তুমুল তর্ক চলতো জীবনানন্দের আসল উত্তরাধিকারী কে ? দাবিদার আমার প্রিয়তম দুই কবি, বিনয় ও শক্তি। তখন কবিতাকে বা বলা ভালো বিভিন্ন কবিতার ধারার উৎস হিসেবে একজন বড়ো কবিকে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার প্রবণতা বড্ডো প্রকট ছিলো। 'রবীন্দ্র অনুসারী' বা অন্যরকম মূঢ় তকমাও ছিলো খুব সুলভ। একটু সরব হয়ে মানুষের দু:খসুখ নিয়ে চর্চা করতেন যেসব কবি তাঁরা ছিলেন 'সংগ্রামী', কেউ ছিলেন মাতাল , আর কেউ বা পদ্যবণিক। বুদ্ধদেব বসুর 'মতো' যাঁরা , তাঁরা 'বৌদ্ধ' আর বিষ্ণু দের কাছাকাছি ছিলেন 'বৈষ্ণব'রা।

    জীবনানন্দ যে ধারাটায়, অর্থাৎ পদ্যের যে প্রতিমায় শেষ পর্যন্ত স্থিত হয়েছিলেন তা কিন্তু একেবারেই 'ঘোর'সৃজনী পন্থা ছিলোনা। তাঁর জীবৎকালে তাঁর সম্বন্ধে যা কিছু বলা হয়েছে, পরবর্তীকালে দেখি সবই সত্যের থেকে দূরে। তাঁর কাছে শব্দ, শব্দবন্ধ, রূপক, প্রতীক, প্রত্নচিণ্‌হ সবই আসতো অনেক শ্রমের পর। কিন্তু কবিতাটির অবয়ব স্থির হয়ে গেলে কোনও সীবনচিণ্‌হ খুঁজে পাওয়া যেতোনা। একজন প্রকৃত শিল্পীই পারেন এরকম। একজন সফল মৃৎশিল্পীর প্রতিমায় পাওয়া যায়না খড়ের ভঙ্গুর নির্মাণ বা একজন সফল কণ্ঠশিল্পীর তানকারি পরিবেশনায় থাকেনা অকারণ সরগমের চমক দেওয়া ভেল্কি।
    সমর সেনের সঙ্গে সুনীল গঙ্গো বা প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে অলোকরঞ্জন, এভাবে সমান্তরাল খোঁজার খেলা ছিলো পদ্য পাগলদের মধ্যে। জীবনানন্দের সঙ্গে বিনয় বা শক্তির সমান্তরাল টানা ছিলো অত্যন্ত সুলভ ব্যসন। এর কারণ কি যেহেতু জীবনানন্দ জীবৎকালে ছিলেন একজন দুরূহ কবি বা তদুপরি একজন নিজের মুদ্রাদোষে সম্পূর্ণ আলাদা হওয়া এক মানুষ, তাই কলকাতার মহানাগরিক মননের অংক তাঁকে নিজের সুবিধের জন্য একটা বিশেষ গোত্রে ফেলে দিলো। বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, জীবনানন্দ একজন আদ্যন্ত কবি এবং কবিতা ছাড়া তিনি কিছু লেখেন না। অর্থাৎ,একজন সাবেক 'কবি'র ছাঁচে ফেলা হলো তাঁকে, আলুলায়িত যুক্তিবোধ ও বলগাহীন আবেগতাড়িত শব্দের বাজিকর হিসেবে , যেটা হয়তো কবিদের সম্বন্ধে সমাজের অধিকাংশ লোকেরই ধারণা। কবিও যে সর্ব অর্থে একজন শ্রমিক, সেই বোধটা বেশ বিরল। তাঁর ইতিহাসচেতনা, সামাজিক বোধির স্বরূপ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মাপের একজন ধীমান কবিও বুঝতে পারেননি। অন্য পরে কা কথা? তথাকথিত 'বামপন্থী' বিশ্লেষণে অবক্ষয়ের সাবেক ছাপ দাগানো হয়েছিলো তাঁর উপর। তাই জীবনানন্দের প্রকৃত উত্তরসূরি হয়ে আসেন একজন 'পাগল' ও একজন 'মাতাল', দুই বরেণ্য উৎকেন্দ্রিক, সরকারে দরকার নেই, তাই নিজের সুড়ঙ্গে স্বচ্ছন্দ থাকাই তাঁদের ভবিতব্য। তাঁদের স্ব আরোপিত ট্র্যান্সের মুগ্‌ধ অমরাপুরীতে স্বপ্ননির্বাসন দেওয়া হলো?

    কবিতা পড়ার বা শোনার আগে এতো কচকচি কি অনিবার্য? এতো সব নিয়ে চর্চা না করলে, ঘাম না ঝরালে কি কবিতা উপভোগ করার অধিকার জন্মায় না? কবিতা তো এভাবেই মানুষের থেকে দূরে চলে যায়।

    পর্ণা আমাকে এই প্রশ্ন করেছিলো একদিন। কিছু সন্দিগ্‌ধ, কিছু নিরাশ। আমি ভাবি, সত্যিই তো, যাঁরা পদ্য আর লিটল ম্যাগ নিয়ে সতত নানা নিরীক্ষায় ব্যস্ত তাঁরা ছাড়া কি কবিতায় আর কারো অধিকার নেই? জনপ্রিয় না হলেই কি তা 'প্রকৃত' কবিতা হবে? অংকটা কি এতই সহজ?

    .

    কিন্তু কোথায় গেলো সে আজকে? নিশ্চিত বলেছিলো আসবে, কিন্তু এতোক্ষণেও খুঁজে পেলুম না। হঠাৎ দেখি পরমা, আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি এগিয়ে যেতে নিজেই বলে উঠলো ,
    সুরঞ্জন, অই খানে যেওনাকো তুমি, বোলোনাকো কথা অই বালিকার সাথে.....

    ও নিশ্চয় কিছু জানে....

    কখন এসেছো?
    তুমি কি আমাকে জিগ্যেস করছো?
    না, তোমাকে নয়, নিস্তারিনী পিসিকে জিগ্যেস করছি....
    তাহলে তাকেই জিগাও, আমি পালাই...

    বললো, কিন্তু দাঁড়িয়েও থাকলো

    আমি বলি, কী হলো, পালাও

    না, আমি অপেক্ষা করছি সেই প্রশ্নের, যা তুমি এখনও করোনি...
    আমার তো কোনও প্রশ্ন নেই....
    তাই, বেশ...ঠিক আছে আমি ওখানে গান শুনছি, ইচ্ছে হলে এসো...
    বেশ চলো, কিন্তু আমাকে দেখলে অসিতদা আবার গানের জন্য টানাটানি করবে....
    অসিতদা তোমার নাগাল পাবেনা আজ....

    একটু এগিয়ে দেখি ঘাসের উপর তিনি বসে আছেন যেন গজেন্দ্রগামিনী। গান শুনছেন। বড্ডো ভিড় তাই দূর থেকে দেখা যাচ্ছিলো না।
    পরমা বললো, বসবে না উঠবে?
    বালিকে, গুরুজনদের সহিত পরিহাস !! নরকগামিনী হইবে ....
    তাতে আর কী? ওখানেও তো তোমায় পাওয়া যাবে...
    না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে...
    বস করো, নয়তো আমার বন্ধুবিচ্ছেদ হয়ে যাবে...
    দেখতে পেয়ে উঠে এলো সে। পরমাকে প্রশ্ন,

    কীরে কখন ফিরবি?

    সেটা তো তুই বলবি। আমি তো ভাবলাম ফেরার কোনও সিন নেই এখন...

    সই'দের রহস্যালাপ। আমার তো কোনও ভূমিকা নেই এখানে,

    '........এখন অপেক্ষা করি, বালিকাকে বিদায় দেবার
    বহুপরে পুনরায় দর্শনের অপেক্ষার মতো-
    হয়তো সর্বস্ব তার ভরে গেছে চমকে চমকে।
    অভিভূত প্রত্যাশায় এরূপ বিরহব্যথা ভালো।'

    আমার দিকে ফিরে প্রশ্ন, তোমার কতোক্ষণের কাজ আছে এখন?

    আমার তো কোনও কাজ নেই...
    তবে?
    তুমিই তো কাজ....
    আমি.....? বাত কুছ হজম নহি হুই...
    আপকি মর্জি...
    তবে চলি এখন..
    '....... বেশ, তবে চলে যাও, তবে যদি কোনোদিন কোনো
    লৌকিক সাহায্যে লাগি, ডেকে নিও.....;'

    তোমার হাতে কী?
    ফিরে এসো চাকা....

    চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মুখ, 'পেয়েছো শেষ পর্যন্ত !!! ওফ.... দারুন ব্যাপার'

    গ্রহণ করহ,
    করিলাম...

    নামপাতাটি উল্টিয়েই 'উৎসর্গ গায়ত্রী চক্রবর্তী', নিচে লেখা, 'উৎসর্গ, পর্ণা'।

    তুমি আমাকে 'উৎসর্গ' কী করে করলে? উপহার বলতে হতো... আচ্ছা গায়ত্রী চক্রবর্তী কে? কিছু জানো?

    বোধ হয় সামান্য জানি। উনি বিনয়ের পর্ণা।
    ধ্যাৎ.........

    '.... একটি উঙ্কÄল মাছ একবার উড়ে
    দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
    পুনরায় ডুবে গেলো- এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
    বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হলো ফল।......'

    এই স্মিত দৃশ্য, এই আপক্ক রক্তিম দ্রাঘিমার ছবি দেখার জন্যই তো সারা সন্ধে অপেক্ষা করে ছিলুম।

    (ক্রমশ:)
  • Shibanshu | 117.197.244.82 | ২৩ এপ্রিল ২০১২ ০০:৪৪543458
  • হরিতকী ফলের মতন.....

    .

    কবিতা বুঝিনি আমি; অন্ধকারে একটি জোনাকি
    যৎসামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক।
    এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
    অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ পড়ে আছে-
    এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক'রে নিয়ে
    যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
    তারকা, জোনাকি- সব; লম্বিত গভীর হয়ে গেলে
    না দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি
    পথ করে দিতে পারে; প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায়; যেন
    অমল আয়ত্বাধীন অবশেষে করে দিতে পারে
    অধরা জ্যোৎস্নাকে; তাকে উদগ্রীব মুষ্টিতে ধ'রে নিয়ে
    বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের, অনন্তের সার পেতে পারি।
    এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়, রক্তে মিশে আছে
    মৃদু লবণের মতো, প্রশান্তির আহ্বানের মতো।

    অঘ্রাণ যাই যাই, পৌষের প্রথম শিরশির ভোর আমাদের শহরে। বেলা হলেই রোদ ভাসিয়ে দেয়। এখানে গ্রীষ্মঋতু যেন অনন্তভবানী, ভাঁড়ার ফুরোয়না তার সারা বছর। তবে একদেড় মাস যখন তার বিক্রমে ভাঁটা পড়ে তখন সারা শহরের ফুর্তি আর বাঁধ মানেনা। ভোরের প্রথম আলো, তার ওম, ঘরে ঘরে উঁকি দিয়ে বলে, তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রনে......

    এমনই এক দশ সকালে অফিসে নানা জনতায় ঘেরায়িত হয়ে আছি, দশ দশে একশো রকম ফরমাইশ তাদের। তার মধ্যেই ম্যানেজার সাহেবের খাস আর্দালি এসে বলে, স্যার, বড়ো সাহেব ডাকছেন,
    বলো একটু পরে যাচ্ছি,
    আপনার ফোন এসেছে.....
    এই সময়....!!

    তখন তো জনে জনে ফোন থাকতো না। সারা অফিসে এক আধটা ফোন। তাতেই সবার কাজ চলে।

    ম্যানেজার সাহেবের চেম্বারে ঢুকে বলি,
    ফোন এসেছে?

    তোর কাছে শুধু মেয়েদের ফোন কেন আসে বলতো?

    স্বপনদা, মানে আমাদের ম্যানেজার সাহেব, লাহেরিয়াসরাইয়ের লোক। স্বভাবে পাক্কা মৈথিল। সুদর্শন, সাড়ে ছফুট দীর্ঘ ফ্রেম। বিহার রাজ্য ফুটবল টিমের স্টপার ছিলেন একদিন। সারা পৃথিবীটাই খেলার মাঠ তাঁর কাছে। সবার কাছেই ফেয়ার প্লে আশা করেন। কিন্তু আমাদের চাকরিতে এতো আঁকাবাঁকা, তাই মাঝে মাঝেই মন খারাপ। নিজের বাবা ছাড়া বোধ হয় পৃথিবীতে সবার সঙ্গেই তুইতোকারির সম্পর্ক। অবশ্য বৌদি খুব রাশভারি মহিলা, তাঁকে তুমি করেই কথা বলেন। আমরা আড়ালে বলতাম রামকেষ্ট ঠাকুরের অংশ আছে স্বপনদার মধ্যে। ভবতারিণীর সঙ্গেও তুইতোকারি।

    কোনও জবাব না দিয়ে রিসিভারটা তুলে নিই,
    এতো দেরি করো কেন...?
    হুঁ...
    হুঁ মানে?
    হুঁ...
    সামনে কেউ আছে নাকি?
    হুঁ....
    আজ বিকেলে একটু আসতে পারবে?
    হুঁ...
    কখন আসবে?
    হুঁ...
    ছটা, সাড়ে ছটা....?
    হুঁ...
    কোথায়?
    হুঁ....
    ওফ, নিকুচি করেছে...
    হুঁ...
    আমি মোদি পার্কের গেটে থাকবো....
    হুঁ....

    ফোনটা রাখতেই স্বপনদার প্রশ্ন,
    কে রে? বৌমা নাকি?
    কার বৌ?
    তোরই হবে...
    জানিনা, যাই অনেক কাজ পড়ে আছে
    শোন শোন, এখনই হুঁ হুঁ'র স্টক শেষ করে দিসনা, সারা জীবন রয়েছে তার জন্য। আর কোনও কথা তো বাঁচবে না শেষ পর্যন্ত.....

    সোয়া ছটা নাগাদ কীনান স্টেডিয়ামের দেওয়াল পেরিয়ে মোদি পার্কের দিকে। সন্ধের ঝুঁঝকো আঁধার নেমে গেছে এর মধ্যেই। ফুচকাওয়ালা, ক্যান্ডিফ্লস, বেলুনওয়ালা সবাই খুব ব্যস্ত সমস্ত। ঘরফেরত কারখানার খাটিয়ে লোকেরা বৌ বাচ্চার হাত ধরে বিশাল ফোয়ারাগুলিকে ঘিরে বসে চনাচটপটি খাচ্ছে।

    বাইকটা সাইড করে লাগাতেই ছায়ার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো পর্ণা।

    প্রথম বোধ হয় সময়ে এলে....
    বোলো ভাই, কুছ খাস ইত্তিলা হ্যাঁয় ক্যা?
    না.... হ্যাঁ.... মানে ঐ বইটা
    কোন বইটা?
    ফিরে এসো....
    আরে বাপরে... কবিতা শোনাতে তুমি এভাবে ডাকলে আমায়। ভাবলাম না জানি কী হলো শেষে...
    না, সত্যি, আমি বোধ হয় একটু ওভার রিয়্যাক্ট করছি....
    না, না, বলো বলো, কো ই হসিনা জব শয়ের পড়তি হ্যাঁয় তো, অউর ভি হসিন হো জাতি হ্যাঁয়....
    কী চাষাড়ে রিয়্যাক্‌শন....
    সে যাই বলো, ধন্য আমি ধন্য হে, চাষি তোমার জন্য যে ....
    চলো বসি....

    বলো ...
    ইয়ে , মানে এই 'কবিতা বুঝিনি আমি' কবিতাটা নিয়ে তোমার থেকে কিছু শুনবো ভাবলাম...

    -দ্যাখো, তোমাকে তো বলেছি আগেই, কবিতা ঠিক বোঝার জিনিস নয়। কবিতার শব্দগুলোর একটা স্কিম থাকে। আমাদের দৈনন্দিন যে বোঝাবুঝির জগৎ, তা পেরিয়ে যাবার পর যে নিজের সঙ্গে বেঁচে থাকা, তার ঠিক কোনও ব্যাকরণ হয়না। দাদু বলেছেন না নিজের অন্তরালের মানুষটিই সব চেয়ে দুর্বোধ্য। যেমন পাথরের আড়ালে জল, মানুষটিও জলের মতন। আমরা নিজের চারধারে নানা দরকারি অদরকারি পাথরের বোঝা জমিয়ে তুলি। রক্তমাংসের অসহায়তা,ভুলভাল বোধকে ঘিরে নিরাপত্তার এই পাথুরে ছলনা, এই নিয়েই ভাবি ভালো আছি, সুখে আছি। অধিকাংশ মানুষই তো স্বাচ্ছন্দ্য খোঁজে, আনন্দ খোঁজেনা। আনন্দ খোঁজার বড়ো বালাই। সংবেদনশীলতা অর্জন করতে হয়, অনেক ছোটো ছোট স্বাচ্ছন্দ্যকে জীবন থেকে বাদ দিতে হয়। এই যে দুর্গম অর্জনের পথ, সেখানকার পাথরের বাধাগুলো আমরা কবিতার কাছে গিয়ে সুগম করতে পারি। কবিতা যেন সেই সব জিলেটিন স্টিক, যাকে ক্রমশ বিস্ফোরিত করে জীবনের অনন্ত পাথর পর্বতের ভিতর আমরা সুড়ঙ্গ কেটে এগিয়ে যাই। ঐ পাথরের ওপারে কী আছে? কী পাবো সেখানে?

    '.... এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
    অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ পড়ে আছে-
    এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক'রে নিয়ে
    যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
    তারকা, জোনাকি- সব;'

    আমাকে যে আলো দেয় সে মহাজাগতিক অন্তহীন নক্ষত্রমালা হতে পারে বা হতে পারে ক্ষণস্থায়ী ফুরিয়ে যাওয়া জোনাকি। কিন্তু উভয়েরই যৎসামান্য কোমল আলোক আমার কাছে কবিতার মতো শূশ্রূষা বয়ে আনে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের, অনন্তের স্বাদ, মৃদু লবণের মতো জীবনের প্রশান্তিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেয়। দ্যাখো, একটা কথা সব সময় মনে রাখবে, কবিতা মানে আদালতের কাগজ বা সংবিধানের পাতা নয়। ডোন্ট বী টু সিরিয়াস.... টেক ইট ইজি....

    জীবন মানে তো একটা পথ চলা। যেকোন পথে যেতে প্রথমদিন শুধু পথটাকেই দেখি, তাকে মাপি। পরের দিন চোখ তুলে দেখি আশপাশ, কতো গাছ, কতো হাট, কতো খালবিল। তার পরের দিন গাছের পাতা কেমন সবুজ, কী রঙের ফুল, কোন পাখির বাসা, বিলে পদ্ম ফুটেছে না শালুক, মানুষগুলি বাইরে থেকে কেমন? তার পর কোনোদিন পেরিয়ে যাই মানুষগুলির অন্দরমহল, হেঁসেলঘর। প্রথমদিন পথের দুপাশে যেমন সব কিছু অচেনা, অজানা, অবুঝ লেগেছিলো, সেই অস্বস্তিটা যে কোথায় চলে যায়, কে জানে। কবিতাও তো জীবনের সঙ্গে সমান্তরাল চলে, তার প্রথম অবুঝপনা কখন যে অতীত হয়ে যায়, তার কোনও হিসেব থাকেনা। তখন নিশ্চিন্তে বলে উঠি, 'কবিতা বুঝিনি আমি', যেহেতু তখন আমি জেনে গেছি, বুঝি নাই বুঝি, কবিতাকে তো আমি পেয়ে গেছি। ঠিক তোমার মতন........

    যাহ...

    নাহে, সকল ছন্দের মধ্যে তুমিই গায়ত্রী.....

    এইরে, মনে পড়ে গেলো। তুমি বলেছিলে গায়ত্রীকে নিয়ে আমায় কিছু বলবে....

    দ্যাখো, আমিও যে খুব কিছু জানি তা নয়, তবে যা জানি একদিন বলবো নিশ্চয়.....

    আজই বলো....

    নাহ..... আজ তোমাকে দেখতে এতো সুন্দর লাগছে না, এক্ষুনি তোমায় হারাতে চাই না....

    আমায় হারাবে? কেন? কী হয়েছে?

    কী আর হবে? গায়ত্রীরা হারিয়ে যেতেই আসে, হারিয়ে দিয়েই যায়....

    শুধু আজেবাজে কথা। আমি তোমাকে হারাতে দেবই না....

    বেঁধে রেখো পর্ণা, দুহাত দিয়ে বেঁধে রেখো....

    ' তুমি যেন ফিরে এসে পুনরায় কুণ্ঠিত শিশুকে
    করাঘাত করে করে ঘুম পাড়াবার সাধ করে
    আড়ালে যেও না; আমি এতদিনে চিনেছি কেবল
    অপার ক্ষমতাময়ী হাত দুটি, ক্ষিপ্র হাত দুটি-
    ক্ষণিক নিস্তারলাভে একা একা ব্যর্থ বারিপাত।
    কবিতা সমাপ্ত হতে দেবে নাকি? সার্থক চক্রের
    আশায় পংক্তি ভেবে ভেবে নিদ্রা চলে গেছে।
    কেবলি কবোষ্ণ চিন্তা, রস এসে চাপ দিতে থাকে;
    তারা যেন কুসুমের অভ্যন্তরে মধু-র ঈর্ষিত
    স্থান চায়, মালিকায় গাঁথা হতে ঘ্রাণ দিতে চায়।
    কবিতা সমাপ্ত হতে দাও, নারি, ক্রমে-ক্রমাগত
    ছন্দিত ঘর্ষণে, দ্যাখ,উত্তেজনা শীর্ষলাভ করে,
    আমাদের চিন্তাপাত, রসপাত ঘটে শান্তি নামে।
    আড়ালে যেও না যেন, ঘুম পাড়াবার সাধ করে। '

    (ক্রমশ:)
  • Shibanshu | 117.197.232.234 | ২৬ এপ্রিল ২০১২ ০০:০৪543459
  • হরিতকী ফলের মতন....

    .
    ' কাগজকলম নিয়ে চুপচাপ ব'সে থাকা প্রয়োজন আজ;
    প্রতিটি ব্যর্থতা, ক্লান্তি কী অস্পষ্ট আত্মচিন্তা সঙ্গে নিয়ে আসে।
    সতত বিশ্বাস হয়, প্রায় সব আয়োজনই হয়ে গেছে, তবু
    কেবল নির্ভুলভাবে সম্পর্কস্থাপন করা যায়না এখনো।
    সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও
    মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।
    বর্ণাবলেপন গুলি কাছে গেলে অর্থহীন অতি স্থূল বলে মনে হয়।
    অথচ আলেখ্যশ্রেণী কিছুটা দূরত্ব হেতু মনোলোভা হ'য়ে ফুটে ওঠে।.......'

    আমার বন্ধু সন্দীপ একটা কবিতার কাগজ বার করে। বেশ কিছুদিন ধরেই বলছে, পরের সংখ্যার জন্য অন্তত গোটা দশেক পদ্য ওর চাই। বড়ো অস্থির সময় যাচ্ছে আজ। কতোবার বসার চেষ্টা করলুম, কতো খসড়া। কতো বার প্রথম দু'তিনটে লাইন লেখার পরে নিরাশ ছিঁড়ে ফেলা। অথচ কতো কথা বলার বাকি থেকে যাচ্ছে, কতো চমক দেওয়া শব্দবন্ধ মাছির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে মাথার চারিধারে। কিন্তু শাদা কাগজে কালো অক্ষরে তারা ধরা দিতে চাইছে না। মাঝে মাঝে হয় এমন। সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়। নিজেকে বাহুল্য বোধ হতে থাকে। গানের কাছে যাই, মানুষের কাছে যাই, বইয়ের কাছে যাই, কিন্তু শব্দ বাঁধার রেশ গুলো খুঁজে পাইনা। প্রিয় কবিদের প্রচুর পদ্য বারবার পড়ি, কতো জাদুর মতো প্রতীক, তৈরি শব্দের মায়া মাথায় ঝিলিক দিয়ে পালিয়ে যায়। পদ্যের শরীরে যদি প্রাণটাই প্রতিষ্ঠা না করা গেলো তবে তার অলঙ্কার কী প্রয়োজন। মৃতদেহের মাথায় হিরের মুকুট?

    হঠাৎ চোখে পড়ে গেলো বিনয়ের ১৪ই অক্টোবর ১৯৬০, এই কবিতাটি। ফিরে এসো চাকায় সংকলিত রয়েছে। এই কবিতাটিই যেন আমি লিখতে চাইছিলুম। কিন্তু অপচয় ছাড়া আর কিছুর নাগাল পাচ্ছিলুম না।

    '.... হে আলেখ্য, অপচয় চিরকাল পৃথিবীতে আছে;
    এই যে অমেয় জল- মেঘে মেঘে তনুভূত জল-
    এর কতোটুকু আর ফসলের দেহে আসে বলো?
    ফসলের ঋতুতেও অধিকাংশ শুষে নেয় মাটি।
    তবু কী আশ্চর্য, দ্যাখো, উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে
    তার এই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সংগীতময় হয়।'

    পর্ণার সঙ্গে শেষ যতোবার দেখা হয়েছে, জানতে চেয়েছে, নতুন কিছু লিখতে পারলুম কি না। প্রশ্ন করেছে, গান শুনিয়েছে, কিন্তু লেখাটা আর হয়ে ওঠেনি। ওকে এই কবিতাটা এখুনি শোনাতে হবে। কিন্তু ওকে এক্ষুনি পাই কোথায়?

    .

    রোববার সক্কালে গানের ক্লাস থাকে রবীন্দ্রভবনে। ঐ সময় তিনচার ঘন্টার জন্য পর্ণাকে হাইজ্যাক করা যেতে পারে। যদিও ওর সঙ্গে দেখা করার জন্য আমার অতো অ্যাডভেন্‌চার করার দরকার নেই। ওকে বাড়ি থেকেই ডেকে নিতে পারি নির্দ্বিধায়। কিন্তু একটু আলোছায়া লাগে। রোদের সঙ্গে মেঘ না থাকলে বেঁচে থাকাটা কী বোরিং হয়ে যায়।
    যথারীতি জুবিলি পার্কের গেটের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকি সকাল সাড়ে আটটার সময়। বেশ ঠান্ডা পড়ে গেছে এই ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। কপার ব্লু শাড়ি আর শাদা স্টোলে ঝলমল। বেঙ্গল ক্লাবের দিক থেকে তিনি হেঁটে হেঁটে আসছেন। কোনও দিকে দ্যাখেনা কেন? এতো অন্যমনস্ক ছন্দে অনুষ্টুপ চলন। পাইপলাইন ফ্ল্যাটের দিকে বাঁকার আগেই ধরে ফেলি,
    এই যে নমস্কার...
    আরে এ এ এ, আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম...
    সে কী তুমিও ভাবো? ওটা তো আমার একচেটিয়া বার্ডেন বলেই জানতুম।
    দ্যাখো সকাল সকাল মেজাজটা খারাপ কোরোনাতো...
    না না, সে অধিকার আমার আছে কোথায়?
    এখানে কী করছো?
    এই তোমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি...
    ওহ বুঝেছি, মধুরিমাও গানের ক্লাসে ভর্তি হয়েছে নাকি?
    কোথায় হলো? এতো করে বললুম, আমি সকালে বাইকে করে পৌঁছে দেবো আবার ফেরার সময়েও বাইকের ব্যবস্থা থাকিবে...
    কিন্তু শুনলে তো...
    কেন শুনলো না?
    বোধ হয় তোমার ভয়ে....
    আমার ভয়ে? আমার বয়েই গেছে....
    তাও বলেছিলুম, কিন্তু মানলো না.....
    দ্যাখো, এই রাস্তার উপর তোমাকে মারবো...
    দেবি, স্মরগরলখন্ডনং মমশিরসিমন্ডনম..... আমি প্রস্তুত,
    আর ভাঁড়ামি কোরোনা...
    বেশ করবো না, তবে একটা সিরিয়াস কথা আছে...
    এতো সকালে সি-রি-য়া-স কথা !!
    না, মানে তুমি আজ গানের ক্লাসে যাচ্ছো না...
    পাগল নাকি? আজ বাকি আদ্ধেকটা গান শেখানো হবে....
    ও আমি শিখিয়ে দেবো, সেই তো দুলে দুলে 'তোমার সুরের ধারা'
    নাহ, 'সুখহীন নিশিদিন...'
    রাম, রাম, দিনটাই খারাপ যাবে.... ও সব ছাড়ো.. আজ আমরা দোমোহানি যাচ্ছি। তুমি পাগলের গপ্পো শুনতে চেয়েছিলে না, গায়ত্রী কে? সেই গপ্পো করবো আর একটা অদ্ভূত পদ্য, মনে হয় আমারি লেখা, কিন্তু
    আমার জ্ঞান হবার আগে থেকে বিনয়ের নামে ছাপা আছে। চলো...

    শীতের সুবর্ণরেখা আর খরকাই অপেক্ষা করে আছে, অপেক্ষা করে আছে তার ঋজু ধৈর্যশীল শালবন, উত্তুরে হাওয়ায় তারা পদ্যের উড়ে যাওয়া পরাগমোচনের সাক্ষী থাকবে কি ....

    উনকি তমন্না দিলমে রহেগি
    শম্মা ইসি মহফিলমে রহেগি
    ইশকে মে জীনা, ইশকমে মরনা
    অওর হমেঁ ক্যা করনা হ্যাঁয় ফির....

    (ক্রমশ:)

  • Shibanshu | 117.201.166.115 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১৬:২২543460
  • হরিতকী ফলের মতন......

    .
    '..... অথচ পালঙ্করাশি আছে,
    রাজকুমারীরা আছে- সুনিপুণ প্রস্তরে নির্মিত
    যারা বিবাহের পরে বারংবার জলে ভিজে ভিজে
    শৈবালে আবিষ্ট হয়ে সরল শ্যামল হতে পারে।
    এখন তাদের রূপ কী আশ্চর্য ধবল লোহিত।
    অকারণে খুঁজে ফেরা;.....'

    রেঙ্গুনে জন্মেছিলো ছেলেটি, তার পর তারা সপরিবারে চলে আসে পশ্চিমবঙ্গে। শৈশব থেকে অংকপাগল। গণিতের মধ্যে খুঁজে পাওয়া ক্রমান্বয় যুক্তির সমারোহ, তার গভীর সাংখ্য যাত্রা, অমেয় শূশ্রূষার স্বাদে মজে ছিলো সে আজন্মকাল। তাই কি যুক্তিহীন পৃথিবীর প্রখর চাপ, দুয়ে দুয়ে পাঁচ হওয়া ঘটনাসমূহ, তাকে স্বাভাবিক সংসারী মানুষের বৃত্ত থেকে অনেক অনেক দূরে নিয়ে ফেলে দিয়েছিলো। তাঁর কাব্যগুরু যেভাবে লিখেছিলেন, '.... মরণ তাহার দেহ কোঁচকায়ে ফেলে গেল মিরুজিন নদীটির পারে', অনেকটা সেরকমই। মিরুজিন নদী তাঁর জন্য হয়ে যায় উত্তর চব্বিশ পরগণার ঠাকুরনগর গ্রাম। গাণিতিক মস্তিষ্কের শ্রেয় ফল তাঁকে নিয়ে যায় শিবপুর কলেজে। সাফল্যের সঙ্গে মেকানিক্যাল ইনজিনিয়ারিং উত্তীর্ণ হন। উচ্চপদের বৃত্তিও লাভ করেন সম্মানের সঙ্গে। প্রথম কবিতার বই, 'নক্ষত্রের আলোয়'। রুশ ভাষায় পন্ডিত। ঐ ভাষায় লেখা বৈজ্ঞানিক বইগুলি বাংলায় অনুবাদ করার কাজ করেছেন বহুদিন। হাংরির একজন মুখ্য সদস্য। পরে দূরত্ব তৈরি হয় শক্তির সঙ্গে। তাঁর গাণিতিক মস্তিষ্ক বাংলা কবিতায় আনে এক অন্যধরনের জঁর।

    গায়ত্রী চক্রবর্তী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরিজি ও বাংলায় সোনার মেডাল পাওয়া মেয়ে। দুরন্ত সুন্দরী, অসম্ভব মেধাবী। যেকোনও উচ্চাকাঙ্খী পুরুষেরই এমন একজন নারীর সাহচর্য পাবার স্বপ্ন কখনও শেষ হয়না। বিনয়ের স্বপ্নও কখনও শেষ হয়নি, চিতাকাঠ পর্যন্ত গেছে সম্ভবত। গায়ত্রী কলকাতার পাট চুকিয়ে চলে যান কর্নেল ইউনিতে, সেখান থেকে বহু সারস্বত সাধনার জয়টীকা অর্জন করে শেষ পর্যন্ত কলাম্বিয়া ইউনিতে অধ্যাপক। নারীবাদ, ইতরযান ও সমাজতঙ্কেÄর ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক নাম। তিনি কি কখনো জানতে পেরেছিলেন বিনয় মজুমদার নামে এক যুবক তাঁর জন্য উত্তীয়ের মতো অপেক্ষা করে আছে? এ রহস্যের কোনও পাথুরে উত্তর এখনও নেই। শুধু আছে ফিরে এসো চাকা। বাংলা কবিতার সর্বকালের একটি প্রধান কাব্যসংকলন; আমাদের মতো ইতরজনের জন্য।

    বিনয় কখনও বিবাহ করেননি, গায়ত্রী স্বল্পকালের জন্য স্পিভাক সাহেবের বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন।

    কোনও পালঙ্করাশি ছিলোনা কোথাও, যা জীবনে ন্যূনতম রোমাঞ্চ এনে দিতে পারে। ছিলোনা রাজকুমারীরা, যারা বিবাহের পর জলে ভিজে ভিজে শৈবালের মতো কোমল শূশ্রূষা এনে দেয় মানুষের মনে। সাগরহংসীর শুভ্র গান কখনও আসেনি। খুঁজে ফেরা অকারণই রয়ে গেছে,
    '..... আমাদের দেহের ফসল, খড় যেন ঝরে গেছে, অবশেষে স্বপ্নের ভিতরে।
    এত স্বাভাবিকভাবে সবই ব্যর্থ-ব্যর্থ, শান্ত,ধীর।'

    .
    টাটাবাবার শহর যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো কখনও হেঁটেছেন শহরের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের সেই মায়াবী কোণটিতে। যেখানে উত্তরবাহিনী পাহাড়ি বন্য নদী খড়কাই এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পূর্ববাহিনী সুবর্ণরেখার বিস্তৃত স্রোতধারায়। জায়গাটির নাম দোমোহানি। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, এই যুগ্মধারার সব তীর জুড়ে ছিলো অগণিত প্রাংশু শালের সমারোহ। সবই অতীত? তাইতো তাইতো.....

    বাইক থেকে নেমেই পর্ণা বললো,
    দ্যাখো, জল কতো নেমে গেছে..
    আমি বলি, তা বটে, কিন্তু দেখতো কতো পাথর জেগে উঠেছে এই ফাঁকে। কেউ কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে, আরো কেউ জেগে থাকে। মানুষের দিন ফুরোয় না কখনও। জল হয়ে, পাথর হয়ে, বেঁচে থাকাটাই তো মুখ্য....

    ওসব থাক, তুমি গায়ত্রীর গল্প বলো...

    -সব গায়ত্রীর গল্প কিন্তু তৎসবিতুর্বরেণ্য হয়না, সুরায় উন্মত্ত হয়ে পদাঘাতে বিচূর্ণ হওয়া পুষ্পাধারের মতো পরিতাপহীন জীবনের গল্পই শুনতে পাবে তুমি.....

    তার পর ছাড়া ছাড়া সংলাপে শোনে বিনয়, সুবিনয়, দুর্বিনয়ের গপ্পো। তার চিরকাল গায়ত্রীর শূন্য অলিন্দের দিকে চেয়ে গেয়ে যাওয়া সমুদ্রকল্লোল আর পঞ্চম সিম্ফনি। উদ্দাম একাকিত্ব, নিষ্করুণ দারিদ্র্য আর নির্নিমেষ অবসাদের নিম ইতিবৃত্ত।

    প্রিয় কবির প্রতি সজল দৃষ্টিপাত ছাড়া বোধ হয় আমাদের আর কিছু দেবার ছিলোনা।

    '..... অঙ্গুরীয়লগ্ন নীল পাথরের বিচ্ছুরিত আলো
    অনুষ্ণ ও অনির্বাণ, জ্বলে যায় পিপাসার বেগে
    ভয় হয়, একদিন পালকের মতো ঝরে যাবো। '

    -বলোতো কেন এমন হয়....অন্যরকমও তো হতে পারতো.... আর কেউ আসতে পারতো কবির জীবনে... নতুন করে পাতা ধরতো, ফুল.......

    মনে মনে বলি, হয়তো পারতো, কিন্তু উৎফুল্ল আশা আর উদ্ভাসিত ভবিষ্যৎ তো সবার জন্য নয়..... জ্যোতিষ্কসম্ভব জীবন কজন পেয়েছে। সকলের জীবনেই রক্তাপ্লুত ট্রাম কখনো না কখনো একবার মাড়িয়ে দিয়ে যাবেই।

    সুবর্ণরেখার জল সাক্ষী থাক, এমন বিষাদমগ্ন সময় পর্ণার সাথে কখনও কাটেনি। কবিতাই শুধু পারে, প্রিয় নারীর সঙ্গ ছাপিয়ে এমন গেরুয়া রঙে অন্তর রাঙিয়ে দিতে......

    পরের সপ্তাহে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন শুরু হচ্ছে। তিনটে সন্ধে খালি রেখো। জর্জদা আসবেন এবার। শেষ মূহুর্তে নো অজুহাত। এবার কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে গান শুনবো। পাগলের সঙ্গে যাবো, পাগল হবো, ভাসবো রসে পাগলপারা।

    ' যাক তবে জ্বলে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া যা হৃদয়।
    সব শান্তি দূরে থাক, সব তৃপ্তি, সব ভুলে যাই।
    শুধু তার যন্ত্রনায় ভরে থাক হৃদয়শরীর।
    তার তরণীর মতো দীর্ঘ চোখে ছিলো সাগরের
    গভীর আহ্বান, ছায়া, মেঘ, ঝঞ্ঝা, আকাশ, বাতাস।
    কাঁটার আঘাতদায়ী কুসুমের স্মৃতির মতন
    দীর্ঘস্থায়ী তার চিন্তা;.....'
  • Shibanshu | 117.201.166.115 | ২৮ এপ্রিল ২০১২ ১৬:২৩543461
  • হরিতকী ফলের মতন...

    ১০.

    ' নেই কোনো দৃশ্য নেই, আকাশের সুদূরতা ছাড়া।
    সূর্যপরিক্রমারত জ্যোতিষ্কগুলির মধ্যে শুধু
    ধূমকেতু প্রকৃতই অগ্নিময়ী; তোমার প্রতিভা
    স্বাভাবিকতায় নীল, নর্তকীর অঙ্গসঞ্চালন
    ক্লান্তিকর নয় বলে নৃত্য হয় যেমন তেমনি।
    সুমহান আকর্ষণে যেভাবে বৃষ্টির জল জমে
    বিন্দু হয়, সেইভাবে আমিও একাগ্র হয়ে আছি।
    তবু কোনো দৃশ্য নেই আকাশের সুদূরতা ছাড়া।'

    আজ তিনদিনের রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন শেষ হলো। রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এই চারদিক খোলামেলা প্রাঙ্গনে, পাশেই জুবিলি পার্ক, হুহু করে শীতহাওয়া ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। শীতহাওয়া, কিন্তু তাজা, তৃপ্ত স্পর্শ তার, চোখ মুখ স্নিগ্‌ধ করে দেয় তার স্নেহ। ভিড় পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছি। এতো রাত হয়ে গেছে, সবার বাড়ি ফেরার তাড়া। কিন্তু সমস্ত শ্রোতারা এতো নিশ্চুপ শ্রদ্ধায় ধীরে ধীরে প্রাঙ্গন খালি করে দিচ্ছে, সত্যি দেখার মতো ঘটনা। কিশোরির শীতহাত আমার হাতে, কিন্তু রোমাঞ্চে উষ্ণ সেই স্পর্শ। তার গাঢ় বেগুনি রেশমি শাড়ি, নীল শাল, কালো আঁকা চোখ, মদির ওষ্ঠ, মাদক বিদেশি সুরভির ঘ্রাণ। ডিভাইনলি টেমটিং, সিম্পলি ইররেজিস্টিবল....

    আজকের শেষ শিল্পী ছিলেন জর্জদা। বহুদিন পরে এতো তাজা গলায় গান গাইলেন প্রায় দেড় ঘন্টা। শেষে বললেন, 'আমায় মাফ করেন, আর গাইতে পারতেসি না'। স্তব্ধ, মুগ্‌ধ অতো শ্রোতাসমাগম, অপূর্ণতার আক্ষেপ নিয়েও উচ্চকিত অনুরোধ থেকে সম্বৃত থাকলো। গেরুয়া ফতুয়া আর গেরুয়া লুঙ্গি, জর্জদা করজোড়ে বিদায় চাইলেন।

    বাইরে বেরিয়েই পর্ণা বললো, একটু দাঁড়াও,
    বলি, কী হলো?
    কিছু বললে না, জর্জদার গান নিয়ে...
    এখনও ঘোরে আছি, কী বলবো? তবে একটা কেমন অনুভূতি হচ্ছে, জামশেদপুরের জন্য এটা যেন ওনার সোয়ান সং। জানিনা সামনে বসে ওঁর গান আর এখানে শোনা হবে কি না.....
    অমন কেন বলছো? ছি:, আরো অনেক অনেক দিন উনি আমাদের গান শোনাবেন ....
    তাই হোক.. তাই যেন হয়
    কোনও কবিতা মনে আসছে না?
    আসছে, তাইতো চুপ করে আছি। তোমার মনে পড়ছে,

    ' নেই কোনো দৃশ্য নেই, আকাশের সুদূরতা ছাড়া।
    সূর্যপরিক্রমারত জ্যোতিষ্কগুলির মধ্যে শুধু
    ধূমকেতু প্রকৃতই অগ্নিময়ী; তোমার প্রতিভা
    স্বাভাবিকতায় নীল,..........'
    '.... সুমহান আকর্ষণে যেভাবে বৃষ্টির জল জমে
    বিন্দু হয়, সেইভাবে আমিও একাগ্র হয়ে আছি।
    তবু কোনো দৃশ্য নেই আকাশের সুদূরতা ছাড়া।'

    এতো কাছে বসে ওঁর গান শুনলুম, কিন্তু আসলে কতো দূরে ছিলেন তিনি, সুদূর আকাশের দৃশ্যের মতন, অগ্নিময়ী ধূমকেতুর মতন।

    ঠিক বলেছো। চলোনা একটু হাঁটি...
    -মাথাফাথা খারাপ হয়েছে নাকি? এই ভিড়টা কেটে গেলেই এখানে রাস্তায় কুকুরবেড়ালও দেখা যাবেনা। শেষে পাঁড়েজি হাবিলদার উঠিয়ে নিয়ে যাবে দুজনকে। হিন্দি কাগজে কাল সকালে সনসনিখেজ হেডলাইন, ব্যাংক করমচারি সন্দিগ্‌ধ স্থিতি মেঁ যুবতী কে সাথ গিরফতার। মাফ করো ভাই...
    তুমি বড্ডো ভিতু
    তা হবে হয়তো, কিন্তু আপাতত তোমার উর্বর চিন্তায় সায় দিতে পারছি না।
    পিছনে বসো, তোমায় বাড়িতে ছেড়ে দিই....

    একটু পরেই ওর বাড়ির কাছাকাছি। পৌঁছোবার আগেই বললো, এখানে দাঁড়াও...
    কী হলো আবার?
    বলছি না দাঁড়াও...
    আচ্ছা বাবা..., ভালো পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে যাই হোক...
    শোনো একটা জরুরি কথা তোমায় বলার ছিলো...
    বোঝো, চার ঘন্টা ধরে সঙ্গে আছো, এখন মনে পড়লো 'জরুরি' কথা...
    হ্যাঁ, চেষ্টা তো করলাম অনেক, কিন্তু বলে উঠতে পারলাম না..
    বেশ বলো
    তোমায় বলেছিলাম না, একটা প্রজেক্টের জন্য দিল্লিতে জে এন য়ু-তে পেপার পাঠিয়েছিলাম,
    হ্যাঁ, বলেছিলে..
    ওরা অ্যাক্সেপ্ট করেছে...
    আরে বৌয়া, এইসন খুশখবরি দবাকে রখল অ বাড়ন...
    তুমি বাংলায় খুশি হতে পারোনা?
    কে জানে, বোধ হয় তাই..
    শোনো, আমাকে দিল্লি যেতে হবে, দুমাসের জন্য.... ভাবছি যাবোনা...
    মান গয়ে উস্তাদ, দিমাগ বিলকুল সনকা গইল.. যাবে না মানে?
    মানে যাবোনা, আমি দুমাস তোমাকে.. মানে দিল্লি গিয়ে থাকতে পারবো না...
    একদম পারবে, এমন একটা সুযোগ বারবার আসে নাকি?
    তুমিও আমাকে যেতে বলছো? আমি তোমার জন্য যেতে চাইছি না.... তোমার কোনো ফিলিংস নেই আমার জন্য...
    সত্যিই নেই, এবার যাবেতো?
    না, তবু যাবোনা, আমি জানতাম তুমি এখানে মধুরিমার সঙ্গে হাহাহিহি করবে আর আমি হস্টেলের বন্ধঘরে বসে থাকবো বইখাতা নিয়ে.....
    ও এই ব্যাপার? তা তুমিও ওখানে মধুরিমার প্রতিশোধ হিসেবে কোনও মনদীপ সিংকে জোগাড় করে নিও নাহয়। ছেলেগুলো খুব হ্যান্‌ড্‌সাম হয়, আমার থেকেও বেশি ...
    হাও কনসিট, আই'ল হিট য়ু...
    যা: বাবা, শেষে গালাগলি দিতে ইংরিজি.... যাকগে তুমি যাচ্ছো, পাক্কা.. টিকিট হয়ে গেছে?
    হ্যাঁ, বাবা করে নিয়েছে..
    তবে তো হয়েই গেলো
    তুমি একবার না বলো প্লিজ, আমি সত্যি থাকতে পারবোনা..
    বলছি না, বলবো না, চলো দিল্লি......

    '... স্বর-সুর এক হয়ে কাঁপে বায়ু, যেন তুষ্ট শীতে,
    কেঁদে ওঠে, জ্যোৎস্নার কোমল উত্তাপ পেতে চায়।
    রোমাঞ্চ তো রয়ে গেছে শীতল সাপের স্পর্শে মিশে।'

    ১১.

    অমৃতসর এক্সপ্রেস দুপুর দিকে ছাড়ে টাটানগর থেকে। গত পাঁচদিনে পর্ণা অনেক চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করার জন্য। আমি এড়িয়ে গেছি। জানি, সেই এক কথা বলবে, তোমাকে ছেড়ে দুমাসের জন্য আমি যাবোনা। এত্তো ছেলেমানুষ রয়ে গেছে এখনও, বাবার আদরের দুলালি। পৃথিবীর মাটিতে এখনও ঠিক করে পা ফেলেনি । তার দুনিয়ায় সব কিছু অন্যের। অন্যের দু:খ, অন্যের সুখ, অন্যের অপমান, অন্যের সার্থকতা, তাই নিয়ে তার জীবন। পৃথিবীর থেকে অনেক আঘাত পাবে সে, যদি একটু নিজের দিকে ফিরে না দেখে। জানিনা আমি তাকে এই নিষ্ঠুর দুনিয়ার ঝড় ঝঞ্ঝা থেকে কতোটা আড়াল করে রাখতে পারবো।

    আমি দূর থেকে দেখি ওর বাবা-মা এসেছেন স্টেশনে ছাড়তে। আমি ওঁদের সামনে আর যাইনি। ট্রেন ছাড়লো যথাসময়ে। গাড়ির আশিভাগ যাত্রী সর্দারজি। গাম্‌হারিয়া পেরোতেই এস ফোর কামরার দিকে এগিয়ে যাই। আমার সিট এস থ্রি-তে। সাবধানে এগোতে এগোতে দেখি কামরার মাঝামাঝি একটা ক্যুপে জানালার ধারে উদাসিনি পূর্বমেঘ হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। উড়ন্ত চুল আর ওড়নার ব্যাকড্রপ ছাপিয়ে মেলানকোলি পার্সোনিফায়েড একটি রূপসী তরুণী। সামনের সিটে একটি শিখ পরিবার। পাশটি খালি। রামগড় থেকে উঠবে।

    এগিয়ে গিয়ে বলি, নমস্কার আজ্ঞা....
    তুমি...তুম....ই, তু....
    -আরে হচ্ছেটা কী? সর্দারজি খুব মন দিয়ে দেখছে। জানোতো ওদের শিভালরি জাগলে একেবারে বেণীর সঙ্গে মাথা। হাত ফাত চালালে তোমারই ক্ষতি। তবে সর্দারনি যদি হাত চালায় তবে কন্সিডার করা যেতে পারে। কী ধারালো ফিচার দেখেছো?
    -তুমি কখনো শুধরাবে না, তোমার মার খাওয়াই উচিৎ...
    যদি তাই সাব্যস্ত হয় দেবি, তবে আমা হেন অসুরকে বধ করার দায়িত্ব আপনিই নিন...
    -তুমি এখানে কী করছো?
    -আজ্ঞে, আমি আমার হৃদয়েশ্বরীর সঙ্গে এই মূহুর্তে রহস্যালাপ করছি...
    -হেল, এই ট্রেনে তুমি কেন...
    -আজ্ঞে, টিকিট কাইট্যা উঠসি, নামাইতে পার্বা না....
    -ইন্‌করিজিবল...
    -কিসু কইলেন নাকি?
    -ইম্পসিবল.....
    - দ্যাখেন ঠাইরেন, ইংরাজিতে গালাগালি দিয়েন না, আমিও এ-বি-সি-ডি সব পরসি....

    কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে, অপাঙ্গে দেখে। মতলব বোঝার চেষ্টা করে। শেষে একেবারে হাল ছেড়ে দেয়।

    -তোমার যদি আসারই ছিলো, তবে আমায় বললেনা কেন?
    -দ্যাখো তুমি হইলে গিয়া 'স্টুডেন্ট'। তোমাগো কাইজ ল্যাখাপড়া করা। zদি আমি কইতাম, তয় তোমার সিত্ত সন্সল হইতো। তাই কই নাই।
    -তুমি একটু ভদ্রলোকের মতো কথা বলবে...??
    অ্যাঁ, অপমান, আমাগো মামাবারির ভাসারে অপমান... লন্ডভন্ড অইয়্যা zআইবো গিয়া.....
    -মুখটা বন্ধ করে একটু বসো। সর্দারনিকে দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি?
    -ঠিক ধরেছো, তাই তো তোমায় এতো ভালোবাসি....

    ওকে জানাই, আমি চলেছি ইলাহাবাদ। কুম্ভক্ষেত্রে । আমার বন্ধু রাজীব সিং পাটনা থেকে আসবে। ওর একটা ঠেক আছে ইলাহাবাদে। আমরা দিনকয়েক থাকবো ওখানে।
    - আমায় বলোনি কেন....?
    - সব কি বলে দিতে আছে? কিছু তো বোঝার জন্যও রাখতে হয়। শুনেছি কুম্ভতে অনেক মেমসাহেবরাও আসে। তোমার বিরহ ভুলতে এ ছাড়া আমার কিছু করার ছিলোনা।
    -তুমি কোথায় সিট পেয়েছো?
    -পাশের কামরায়....
    -এখানে আসতে পারবে না? অন্তত ইলাহাবাদ পর্যন্ত সঙ্গে যাওয়া যেতো।
    -হ লা সুন্দরী, শুধু কি ইলাহাবাদ? বহুদূর পাড়ি দিতে হবে একসাথে, হিংলাজ মরুতে গিয়া গেয়ে যাই কচুরির গান...
    -মানে?
    - ঐ হিং শুনলেই কচুরি মনে পড়ে যায় কিনা... যাকগে দেখি মামাকে বলে যদি এদিকে ম্যানেজ হয়...

    ম্যানেজ হয়ে গেলো দুটো সাইড বার্থ। ইলাহাবাদ পৌঁছোয় সকালবেলা। তার মানে রাতের ঘুম গয়া। পাগলি ঘুমোতে দেবেনা রাতভর। সেই রাতে যতো কথা, আজে কথা, বাজে কথা, সব যেন খেয়ালের স্থায়ীর মতো বারবার ঘুরে আসে ভালোবাসা হয়ে। ভালোবাসা যেন সেই শাশ্বত চাকা, যাকে রোজ নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়। রোজ দূরে ঠেলে দিই, এই বলতে বলতে, ফিরে এসো ফিরে এসো চাকা......
    আমাদের ব্যক্ত, অব্যক্ত সব সংলাপ ধরা পড়ে যায় বিনয়ের এই অতিখ্যাত কবিতাটিতে,

    ' আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই
    গলাধ:করণ তাকে না-ক'রে ক্রমশ রস নিয়ে
    তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।
    অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে
    জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল-
    আকাশের, হৃদয়ের; কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
    অথবা ফড়িং তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়।
    উড়ে যায়, শ্বাস ফেলে যুবকের প্রাণের উপরে।
    আমি রোগে মুগ্‌ধ হয়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালায়
    আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে-আশ্রয়ে।
    আমি মুগ্‌ধ; উড়ে গেছো; ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা,
    রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হ'য়ে এসো।
    আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন
    সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।'

    ভোরবেলা যখন ইলাহাবাদে নামছি, বললুম, সাবধানে থেকো, ভালো থেকো....
    সারা রাত ট্রেনজার্নি করে কেউই খুব দর্শনধারী থাকেনা। কিন্তু পর্ণাকে খুব ফ্রেশ লাগছিলো, তার হাজার ওড়া চুলের চালচিত্র, কাজলমোছা চোখ আর স্বভাবলাল ঠোঁট বলছিলো ভালো থেকো, খুব ভালো থেকো। কিন্তু মুখে বললো, সাবধানে থেকো, মধুরিমাকে নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি কোরোনা।

    আবার, আবার সেই ফিরে এসো চাকা । এ গল্প বোধ হয় আর ফুরোনোর নয়........

  • pi | 82.83.81.233 | ৩০ এপ্রিল ২০১২ ০৪:৪৭543462
  • এ গল্প বোধ হয় ফুরানোর নয় ..
  • Nina | 78.34.167.250 | ৩০ এপ্রিল ২০১২ ০৭:৪৬543463
  • অপূর্ব্ব! বারবার পড়ার মতন।
  • সুমেরু | 127.194.99.161 | ৩০ এপ্রিল ২০১২ ১০:৪৭543455
  • পড়ছি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া দিন