এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • ফেলানি :আধুনিক অসমিয়া উপন্যাস

    Sushanta
    অন্যান্য | ১২ অক্টোবর ২০১১ | ৬৩৪৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৫০495497
  • অধ্যায় পঁচিশ (২৫)
    কালী বুড়ি পুজোর আয়োজন করেছে। প্রত্যেক বছর করে আসা এই পুজো মাঝে করতে না পেরে বুড়ি আধপাগলী হয়ে পড়েছিল। পাই পাই করে পয়সা গুটিয়েছে বুড়ি। বস্তির মানুষও উৎসাহী হয়ে পড়ল। জগুরা বিকেল হতে না হতেও কাম কাজ সেরে কালী পুজোর জন্যে সাহায্য চেয়ে ঘুরছে। জগু মহাদেব সাজে, গায়ে ভস্ম মেখে হাতে ডম্বরু নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য করে ফেরে। সে একটা জটা জোগাড় করেছে, আর একটা বাঘের ছালের মতো ছাপ মারা লুঙ্গি। লুঙ্গিটা অল্প ছিঁড়েছে। সে সেটি সামলে সুমলে রেখে দেয় মহাদেবের নাচ নাচবে বলে। আজ দু’বছরের মাথাতে লুঙ্গিটা বের করেছে। ফাটা জায়গাটা ওর বেমারি বৌ ঝুঁকে ঝুঁকে সেলাই করে দিয়েছে। গায়ে ছাই মেখে, মাথায় জটা পরে, বাঘছালের লুঙ্গি পরে মহাদেব হয়ে বরের এই বেরিয়ে যাওয়াটা দেখে সে বড় আনন্দ পেয়েছে। মানুষটার সব গালি-গালাজ ভুলে গেছে, ভুলে গেছে তাকে বলা সমস্ত কটু কথাগুলো, তার সমস্ত দোষ। বাড়ি থেকে বেরোবোর আগে সে বউর সামনে ডম্বরুটা বাজিয়ে সামান্য নেচে গেল। বরের মুখে বহুদিন পরে সে হাসি দেখতে পেল।
    কালী হয়েছে বুড়ি নিজেই। পেট্রমাক্সসহ দরকারি জিনিসগুলো বুড়ির আছেই। বস্তির ভেতরে ঘুরছে, বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে, দোয়ার-মুখে দাঁড়াচ্ছে। তারপরে ঢাক বাজে, কাঁসি বাজে, তালে তালে নাচে মহাদেব। তারপরে কালী মাটিতে, উপরে মহাদেবের পা। বাড়ি বাড়িতে গৃহস্থ লোকে যা পারে দিচ্ছে, চাল , ডাল, আলু-বেগুন-লাউ, টাকা-পয়সা। টাকা-পয়সা কম , চাল-ডাল-সবজিই বেশি।
    মালতী দেখছিল। পাতলা শরীরটা টেনে টেনে কালী বুড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘুম নেই, খাওয়া নেই। সে সব দেখছে। একটা কালী পুজো করতে গিয়ে এতো আয়োজন করতে হয়! প্রসাদের জন্যে বুট-মুগ-কলা-নারকেল, ভোগের জন্যে চাল-ডাল-তেল। এগুলো না হয় লাগেই। কিন্তু এই যে পাঁচ রকমের গুড়ি দরকার পড়ে, পাঁচ রঙের গুড়ি, সাদা রঙের তন্তুল চূর্ণ১ , লাল লাল কুসুম ২ ফুল চূর্ণ, পীত বর্ণের হরিদ্রা-চূর্ণ, শ্যাম বর্ণ, কৃষ্ণ বর্ণ। বুড়ির মুখে সে এসবের কথা শুনেছে। যেখানে পারে সেখান থেকে বুড়ি এগুলো গুটিয়েছে। পাঁচ রকমের শস্য সে বাজার থেকে জোগাড় করে বুড়িকে দিয়েছে। ধান, যব, সাদা সর্ষে, তিল, মুগ। মণি জোগাড় করে দিয়েছে পাঁচ রকম গাছের পাতা—আম, বট, পাকরি৩ বকুল, জরি ৪ নবীন যোগাড় করে দিল পাঁচ রকমের গাছের ছাল –জাম, শিমুল, বকুল, কুল, বেল। জোগাড় দেখে দেখে ও অবাক না হয়ে পারে নি। বুড়ির প্রচুর কষ্ট হচ্ছে, সত্যি যেন ওর শরীরে মা কালী ভর করেছে। সামান্য হাঁটলেই যে হাঁপিয়ে উঠে সেই বুড়ি যে কোত্থেকে এতো শক্তি পেয়েছে। ভেবে ভেবে সে কিনারা করতে পারে না। সে একটা কাজ সামলে নিয়েছে। ভোরে উঠেই ডেকে এনে নিজেদের সঙ্গে বুড়িকেও ভাত এক মুঠো খাইয়ে দিয়েছে। না খেয়ে না খেয়ে বুড়ির পেট শুকিয়ে গেছে। বাচ্চা একটাও এর থেকে বেশি ভাত খায়।
    কালী পূজার আর মাত্র একটা দিন বাকি। সেদিনই শহর জুড়ে আরম্ভ হলো এক বিশাল মিছিল। অসমকে দু’ভাগ করবার দাবি নিজে হাজার হাজার দখনা৫ আর আরনাইতে ৬ শহর ভরে গেল। হাইস্কুলের ফিল্ডে বিশাল সভা হলো। এতো বড় মিছিল, এতো এতো মানুষ, এতো বড়ো মিটিং শহরের মানুষ আর দেখে নি। একটা বাজারবার মারা গেলো। সে অবশ্যি মুড়ি ভাজে নি। বুড়ির পুজোর কাজে লেগেছিল। বেশি কিছু লোকসান হয় নি। মণির মোড়াগুলোও পুরো হয় নি।
    রাতে পুজো আরম্ভ হলো। বুড়ি নিজেই খিচুড়ি রাঁধতে বসল। মুগ ডাল ভেজে তাতে সবজি দিয়ে কাঁচা লংকা ছিঁড়ে ছিঁড়ে বুড়ি বড় গামলাতে তিন গামলা খিচুড়ি রাঁধল।মালতী, মিনতি, জোনের মায়েরা কাটাকুটি বাছাবাছি করে যোগাড় যন্ত্র করে দিল। মাঝ রাতে বুড়ির গায়ে মা ভর করল। কালী মায়ের সামনে বুড়ি দাঁতে তিনটা কবুতরের মাথা ছিঁড়ে রক্ত দিল। সবাই বুড়িকে প্রণাম করল। মালতী বুড়ির এই মূর্তি কোনোদিনই তাকিয়ে দেখতে পারে নি। আজও পারে নি। সে ঘরের দাওয়াতে বসে পড়ল। হুলস্থূল শুনে গিয়ে দেখল কালীর পায়ের নিচে বুড়ি পড়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে ভোগ বিলোনো শুরু হয়েছে। বুড়ি সেই উপুড় হয়ে কালীর পায়ে পড়েই রয়েছে। সবসময়েই ভর করলে বুড়ি এরকম কালী মায়ের সামনে পড়ে থাকে। অল্প পরে উঠে বসে। ভোগ নিয়ে চতুর্দিকে হৈ হল্লা শুরু হয়েছে। গামলার খিচুড়ি প্রায় শেষের পথে। হঠাৎ মালতীর মনে হলো বুড়ি আজ একটু বেশি সময় ধরেই কালী মূর্তির সামনে পড়ে আছে। সেই অন্যসময় এই ভর নামলে আধমরা বুড়িকে নিয়ে মুখে জল ছিটিয়ে হাত মুখ ধুয়ে জল এক গ্লাস, মুখের সামনে তুলে ধরে খাইয়ে দেয়। এক টুকরো ব্রেড বা এক মুঠো মুড়ি দিয়ে এক কাপ চাও খাইয়ে দেয়। সে কাছে এগিয়ে গেল। গায়ে হাত দিয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল। বুড়ি নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। সবাই বুড়িকে প্রণাম করল। লোকগুলোর কাছে সেসময় বুড়ি আর কালী মা-র মূর্তি অদ্ভুতভাবে একাকার হয়ে পড়ল। বুড়ির নিস্তেজ শরীরটা একবার ছুঁয়ে দেখবার জন্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। মানুষগুলো অস্থির হয়ে পড়েছে। জোনের মা ওর শ্বাসের রোগী বরকে টেনে নিয়ে এলো গিয়ে। বরের হাত বুড়ির শবে ছুঁইয়ে কেঁদে ফেলল। জগু দুই হাতে তুলে কোলে করে নিয়ে এলো ওর বৌকে। চতুর্দিকে একটা পচা পচা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। পুঁজে-রক্তে ভরা শরীরটা বুড়ির পুরো শরীর ঢেকে ফেলে দিল। কেউ একজন খ্যাঁচিয়ে উঠল, “ এই পচা মহিলাটিকে সরিয়ে নে!” ফুল এলো বুড়ো দর্জিকে নিয়ে। বুড়ো দর্জি মাটিতে শুয়ে পড়ল। নইলে যে ওর বাঁকা শরীরে বুড়িকে ছুঁতে পারছে না। দলে দলে লোক এসে বুড়ির শরীর ছুঁলো, প্রণাম করল। কেউবা মালতীকে ঠেলা দিল, “যা প্রণাম করগে’, সকাল হলেই তো জ্বালিয়ে দেবে।”
    সে বিমূঢ় হয়ে কলতলাতে বসে বুড়ির শরীর নিয়ে মানুষের এই টানাটানি , কাড়াকাড়ি দেখতে থাকল।
    “মামী!” সে ফিরে তাকালো, নবীন।
    “মামী!” ওর গলার স্বর ভয়ে চাপা।
    “কী হলো?” তার নিজের স্বরই যেন অচেনা ঠেকল।
    “একটা বাজে খবর আছে।”
    “বাজে খবর?”
    “বলেছিলাম না, ওরা বাজে জায়গাতে হাত দিয়েছে।”
    “ কারা?”
    নবীন নীরব।
    “ আজ রাতে সরকার পড়ে গেছে।”
    সে নবীনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, এ কোন সময়ে লোকটা কী কথা বলে?
    “কালী বুড়ির...” সে কালীবুড়ির এভাবে মরাটা, মানুষগুলোর এভাবে অস্থির চেহারা...এসব কিছু একটা বলতে চাইছিল। থেমে গেল। আসলে সে কী বলতে চাইছে নিজেই বলতে পারে না।
    “মিলিটারি নেমেছে দলে দলে। এখানে এই মানুষগুলোকে এভাবে পেলে ওরা...।”
    নবীনও থেমে গেল। সেও কী বলতে চাইছে ঠিক করতে পারল না।
    “কালী বুড়িকে দাহ করবে...।”
    মালতীও কী বলতে যেয়ে কী বলছে। আসলে সে মানুষের ভিড় থেকে বুড়িকে বের করে আনতে চাইছে। নীল হয়ে পড়া ঠোঁটের মেয়েমানুষটি যেন এখনি ওকে বলবে, “ মণির মা, এক কাপ লাল চা, নুন দিবি।” যতই অসুখ করুক না কেন বুড়ির স্বর বসে যায় না, টনটনে থাকে।
    সকালের দিকে মানুষগুলো শান্ত হলো। বাঁশ-কাঠ জোগাড় করে বুড়ির হালকা শরীরটা চার কাঁধে তুলতে যেতেই কেউ এক মহিলা কেঁদে উঠল। তারপরেই শুধু সবার মনে পড়ল বুড়ি একজন মানুষ ছিল। কত না সাহায্য করেছিল সবাইকে। কান্নাকাটির মধ্যে বুড়ি চিতাতে উঠল।
    বুড়িকে নদী পাড়ে নিয়ে যাবার জন্যে বেরিয়ে সবাই বেশ অবাক হলো, পুরো জায়গাটা মিলিটারিতে গিজগিজ করছে। রিজার্ভের ভেতর দিয়ে সরু রাস্তাটা দিয়ে গেলে নদীর পাড়ে মুখে আগুন দেবার জায়গাতে তাড়াতাড়ি পৌঁছুনো যায়। নইলে রাস্তা দিয়ে গেলে বড়ো রকমের একটা পাক দিতে হয়। বুড়ির মৃতদেহ নিয়ে রিজার্ভে ঢুকতে গিয়ে লোকগুলো থেমে গেল। মিলিটারিই মিলিটারি। শাল, সেগুন, গামারি, বনচোম ৭ গাছের সারিগুলোর মাঝে মাঝে আকাশীলতা ৮ যেমন ছেয়ে আছে, তেমনি ছেয়ে আছে জলপাই রং। শবদেহ নামিয়ে রাখল তারা। নবীন এগিয়ে গেল। যতটা পারে সহজে বোঝাবার চেষ্টা করল, এই সরু রাস্তা দিয়েই বস্তির মানুষ শবদেহ পোড়াতে নিয়ে যায়। রাস্তা দিয়ে ঘুরে গেলে...। না, ওরা বুঝবে না। কীই আর করা , তারা রাস্তা দিয়ে ঘোরানো পথে বুড়িকে নিয়ে গেল। সবাই বুঝতে পারল এখনকার কথাই অন্য হবে।
    বেশ ক’দিন হলো লোকজনের আনাগোনা বন্ধ হয়েছে। মালতী লক্ষ্য করেছে, এই বস্তির মানুষের অসুখ হোক, কেউ করুক—একদিন বা দু’দিনই, তার বেশি সময় দিতে পারে না কেউ। কারো ঘরেই দু’দিনের বেশি চাল মজুত থাকে না। কথাগুলো তাই ভুলে তাড়াতাড়ি। দুঃখ, ক্রোধ, বিবাদ কিম্বা মৃত্যু---সবাই বড় কম সময়েই ভুলে যায়। ভাতের গ্রাসের পেছনে ছোটা মানুষের মাথাতে কিছুই বেশিদিন থাকে না। কালী বুড়ির মরার কথাও লোকে ভুলে গেল। ভুলে গেল সেই রাতে বুড়িকে দেবী বানাবার কথা। নিজের নিজের অসুখী মানুষজনকে বুড়ির সামান্য স্পর্শ দেবার কথা। সেই স্পর্শ পেয়ে কে ভাল হলো, কে হলো না সেসব খেয়ালও রইল না। তাদের নতুন এক বিপদ হয়েছে। চতুর্দিকে ছড়িয়ে গিজগিজ করছে মিলিটারি।
    সেদিন রিজার্ভে ঢেঁকি শাক তুলতে গেছিল জগুর ছেলে। সঙ্গে আরো কয়েকটি ছেলে ছিল। ওদের ধরে মিলিটারি আচ্ছা মার দিল। রিজার্ভের দিকে না গিয়ে বস্তির মানুষের চলে কী করে? লাকড়ি কোথায় পায়? বাজারে বিক্রি করবার ঢেঁকি, ভাদালি পাতার মুঠো পায় কোথায়? শাক-পাতা নাহয় তুললই না, লাকড়ি কোথায় পায়? রিজার্ভের বড় বড় গাছের ভাঙা ডাল-পালাতেই তো ওদের চুলো জ্বলে। এই লোকগুলো আরশোলার মতো কিছুতেই হার মানে না, কিছু না কিছু রাস্তা একটা বের করেই নেয়। বেঁচে থাকে। মিনতির বাড়ি থেকে সামান্য দূরে গেলে একটা শিশু গাছ আছে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ডাল-পালাতে গাছগুলো চিরল চিরল পাতাতে ভরে আছে। তারই একটা আগে থেকে মরে যাচ্ছিল, তারই একটার গুড়িতে হিং দিয়ে কেউ মেরে ফেলল। একদিন কেটে ফেলেও দিল। তারপরে সেই আরশোলার মতো বস্তির মানুষগুলো গিয়ে গাছটাকে ঘিরে ফেলল। এতো বড় গাছ, সবারই হয়ে গেল। একবেলা রেঁধে খাওয়া মানুষগুলোর আর কতটা বা লাকড়ি দরকার পড়ে? যার লাগে সেই একটা কোপ মেরে কেটে নিয়ে যায়। মণিও গিয়ে শিশু গাছের ডাল-পালা এনে চুলোর কাছে স্তূপাকৃতি করে রাখল।
    কালীবুড়ির ঘরটা সে দিন কয় বাইরের থেকে তালা দিয়ে রাখল। বুড়ির বাড়িটা আজ বহুদিন ধরে বস্তিরই কালী মন্দির হয়ে ছিল। এখনো তাই রইল। বুড়ির কালী মূর্তির সামনে আগের মতোই লোকে প্রণাম করে। কেউ মালতীকে জিজ্ঞেসও করল না, বুড়ির বাড়িতে সে ভাড়াটে হয়েই আছে। বাড়িটি তো তার নয়। কারোরই জমিজমার কাগজ পত্র নেই। কালী বুড়িরও ছিল না। টের না পেতেই বুড়ির কালী ঠাকুর, ঘর দোয়ারের দায়িত্ব ওর ঘাড়ে এসে পড়ল। ওর নতুন কাজ একটা হলো। দেবীর সামনের জায়গাটা লেপে রাখতে হয়, প্রদীপ জ্বালতে হয়, লোকের দেয়া টাকা-পয়সা তুলে সামলে রাখতে হয়। সেই সব খুচরো পয়সাতেই সে প্রদীপ জ্বালবার কাজগুলো করে।
    এক রাতে বুড়ির ঘরে যেন কিছু একটা খসখসে শব্দ করছে, সে শুনতে পেল। শব্দটা সে পরের পুরো দিনেও শুনতে পেল। ইঁদুর বাসা বেঁধেছে। একদিন সে ঘরের তালা খুলল। ভেতরে সোঁদা গন্ধ। খিড়কি দোয়ার খুলে দিলে গন্ধটা সামান্য কমল। খসখসে শব্দটা বিছানার তলা থেকেই আসছে। সে কুঁজো হয়ে বিছানার তলাটা দেখল। বাক্স-পত্রে ঠাসা। ছ্যাঁত করে পাশ দিয়ে পাত-আলদ ৯ সাপ একটা বেরিয়ে গেল। ইঁদুর ধরতে এসেছে। টেনে টেনে বাক্সগুলো বাইরে বের করল সে। তালা নেই যে বাক্সগুলোর সেগুলোতে রাখা হাবি-জাবি কাপড়গুলো ইঁদুরে খেয়ে সব ফালা ফালা করে ফেলেছে। তালা দেয়াটাতে হাত ওর থেমে গেল। চাবি কৈ থাকে সে জানে । বাক্সটি খুলতেই চমকে উঠল, এক দীর্ঘ জটা। কালী বুড়ির এই জটা শুধু সে নয় , পুরো বস্তি চেনে। কালী মা ভর করলেই বুড়ির মাথাতে এই জটা গজিয়ে উঠত। কোত্থেকে বুড়ি জোগাড় করেছিলে এই জটা? এই জটা নিয়েই বুড়ি আরতির থেকে কালী বুড়ি হয়েছিল। নাগা-মরিচের মতো ঝাল নিয়ে জীবনপাত করেছিল, মহাদেবের পায়ে পদাঘাত করে মা কালী হয়ে।
    নাকে একটা গন্ধ এসে লাগল। মাছ-ভাত আর কাঠালবিচি পোড়ার গন্ধ, বুড়ি এসে ওর পাশে দাঁড়ালো, হাতে একটা নাগা লংকা। ওর কানে গমগম করে উঠল বুড়ির তেজী গলার স্বর, “মেয়ে মানুষকে এই লংকার মতো হতে হয়। দেখতে ছোট, কিন্তু মুখে দিলে পুড়িয়ে ফেলতে পারে।” বুড়ির রোগা পাতলা শরীর থরথর করে কাঁপছে। ক্রন্দনরতা কোমল মুখের এক রমণীকে সে চড়া গলাতে ভর্ৎসনা করছে, “ মেয়ে মানুষের এই কথাটাই আমার খারাপ লাগে ।... কার জন্যে কাঁদছিস?...কোন মরদকে দেখাতে চাইছিস?...তবে হে ভাতার একটা আসবে, শরীর দলাই মলাই করে বলবে, আহা হা বেচারি। তোরা আহ্লাদে আটখানা। দলাই মলাইর পরেই না আসল সুখ। তারপরে পেট।” মেয়েটি কাঁদছে , প্রচণ্ড রাগ উঠছে। আরো জোরে চেঁচাচ্ছে বুড়ি, “ পেট যদি লাগে আরো কান্না জোড়...যত আছে, সব এসে পড়বে, তোর শরীরের বাঁধন ভালো, ভালো রকমই দলাই মলাই করতে পারবে।”মেয়েটির আরো বেশি করে রাগ চড়েছে।
    জটাতে হাত রেখে সে কেঁদে ফেলল, “ না না, আমি আর কাঁদিনি। আমি মরিনি, নাগা লংকা না হই, আমার শরীরেও ঝাল হয়েছে।”
    অনেকক্ষণ সে জটা ছুঁয়ে বসে রইল। বাইরে কারো পায়ের শব্দ শোনে বাক্সটা বন্ধ করে দিল। কেউ আসে নি। কালীর বেদীতে প্রণাম করে চলে গেছে। সে বাক্সটিতে আবার তালা দিয়ে রাখল। আবার ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে ঘরটি পরিষ্কার করে রাখল। বুড়ির যা কিছু টুকটাক সম্পত্তি ছিল ইঁদুরে খাওয়া কাপড় গুলো গেলে বাক্স একটা খালি করে তাতে ভরিয়ে রেখে স্নান করতে চলে গেল।
    স্নান সেরে কালী মায়ের বেদীতে প্রদীপ জ্বালতে গিয়ে ওর চোখে পড়ল চার-পাঁচটা মিলিটারি ড্রাইভারণীর বাড়ির দিকে যাচ্ছে। আর্মিরা এই সময় থেকেই ড্রাইভারণীর বাড়িতে আসা-যাওয়া শুরু করে। বস্তির মানুষ ড্রাইভারণীকে আজকাল বড্ড ভয় করে। কথায় কথায় আর্মির ভয় দেখায়। প্রদীপ জ্বালিয়ে রোজকার মতো তার কালী বুড়ির মুখখানা মনে পড়ল।

    টীকাঃ
    ১. তন্তুল চূর্ণ: তুঁত বীজের চূর্ণ হলেও হতে পারে। নিশ্চিত নই।
    ২. কুসুমঃ কুসুম শব্দের অর্থ ফুল। এখানে জবা অর্থে ব্যবহৃত বলে মনে হচ্ছে।
    ৩. পাকরিঃ বট জাতীয় গাছ।
    ৪ .জরিঃ আসলে পাকরিই প্রতিশব্দ। কাণ্ড থেকে শেকড় মাটির দিকে ঝুলে পড়ে বলে এই নাম। চন্দ্রকান্ত অভিধান লিখছে, “পাকৰী [সং. পৰ্কটী] বি. জৰি-গছ।”
    ৫. দখনাঃ বড়ো মেয়েদের পোশাক
    ৬. আরনাইঃ অসমিয়া ফুলাম গামোছার মতো বডো গামোছা। অনুষ্ঠানাদিতে গলাতে পরা হয়। কিম্বা পরিয়ে কাউকে সম্মান জানানো হয়।
    ৭ .বনচোমঃ উঁচু আরণ্যক গাছ, আসবাবের জন্যে ভালো বলে বিবেচিত হয়।
    ৮. আকাশী লতাঃ স্বর্ণলতা জাতীয় এক রকম পরজীবি তৃণ। এর ইংরেজি নাম Dodderকিম্বা Cuscuta,
    ৯. পাতা-আলদঃ মূলে আছে অসমিয়া কারশলা সাপ। একে কার্শলাও বলে তেমনি, বাংলাতে লতার মতো দেখতে বলে ‘পাতালত’ সাপও বলে। ইংরেজিতে একে বলে Painted Bronzeback। বৈজ্ঞানিক নাম Dendrelaphis pictus
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৫১495499
  • অধ্যায় সাতাশ (২৭)
    গত রাতে খুব বড় তুফান হয়ে গেছে। রিজার্ভে শোঁ শোঁ শব্দ করছিল। মানুষজন ভাবছিল আজ নিশ্চয় একটা গাছও আর সোজা দাঁড়িয়ে থাকবে না। বসতির সবগুলো ঘরই কোনোক্রমে ঢিগা দিয়ে সামলে সুমলে রাখা। সবাই নিশ্চিত ছিল আজ একটা ঘরও আর থাকবে না। সবাই ঘুমিয়ে গেছিল। সকালে উঠে সবাই দেখে রিজার্ভের ডাল-পালা অনেক ভাঙলেও গাছ একটাও পড়ে নি, মানুষেরও ক্ষয়ক্ষতি বিশেষ হয় নি। আসলে তুফানটা গাছগুলোর উপর দিয়ে পার করে চলে গেলো বলে ঝুপড়িগুলো বেঁচে গেল। চিনিতে যেমন পিঁপড়ে লাইন দেয়, তেমনি বসতির মানুষ গিয়ে রিজার্ভের ভেঙ্গে পড়া ডাল পালা নিয়ে আসতে লাইন দিল।
    লাকড়ি জোগাড়ে লেগে থাকতেই খবরটা জানাজানি হয়ে গেলো। পরশুর থেকে তিনশ ঘণ্টা বন্ধ। সবাই চুপ করে গেল। এতো এতো দিন! কী করে কী করবে মানুষগুলো? এমনিতেও কয়েকটা বাজার বার মারা গেছে। আজ বুঝি ধর্মঘট, কাল শোভাযাত্রা, পরশু মিটিং। আলাদা রাজ্য চেয়ে এলাকার একাংশ মানুষ জঙ্গি হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ বলল সরকার এতো বড় বন্ধ হতে দেবে না। দিল্লির সরকারও এদের আলোচনার জন্যে ডেকেছে। কথা হলো? এতো বড় বন্ধ একটা হবে! মানুষজনকে মরবার জন্যে ছেড়ে দেবার মতো হবে!
    সে সাত সকালে ভাত রাঁধতে গিয়ে দেখল চালে আর দিন দুই যাবে। মুড়ি ভাজার জন্যেও চাল নেই। হাতে টাকা বলতে চারখানা দশ টাকার নোট আছে। বড় কষ্টে জমা করেছিল। এই সামান্য নিয়ে সে তিনশ ঘণ্টা চালাবে কী করে! ভাতগুলো নামিয়েই সে বুলেনের ওখানে দৌড় দিল। কথাটার সত্যি মিথ্যা জানতে হবে।
    বুলেন একটা দা হাতে নিয়ে বসে আছে। লাকড়ি টাকড়ি কেটেছিল মনে হয়। ছেলেটা বা কোনদিকে গেল। সুমলা ব্লাউজ আর পেটিকোট একটা পরে বসে আছে। কাছে পড়ে আছে একটা ময়লা দখনা।ভারি কাপড়টা সে গায়ে রাখতে চায় না। ব্লাউজের নিচের দিকটা খোলা। সুমলা এমন করে থাকলে ওর শরীরের দিকে তাকানো যায় না, মালতী সব সময় নজর নামিয়ে আনে। আজ সে কিছু বোধ করল না। আধা-খোলা ব্লাউজটা, পেটিকোটটা ওর শরীরে বাজে কিছু লাগছে না। আসলে খোলা ব্লাউজে বাজে লাগবার মতো অবশিষ্ট কিছু আর সুমলার শরীরে নেই। বুলেন যখন থেকে আন্দোলনের কাছে ঘোরা ফেরা করতে শুরু করেছে সেই থেকে ওকে দেখবার মতো মানুষ আর নেই। সুমলা মাথাটা থেকে থেকে চুলকোচ্ছে। মালতীর নজরে পড়ল চুলে উকুনের ডিম সাদা সাদা দেখা যাচ্ছে। ওর গাতেও অনেক ময়লা জমেছে।
    “সুমলার চেহারা অনেক বাজে দেখাচ্ছে।” ওর মুখ থেকে ঘোপ করে কথাটা বেরিয়ে পড়ল।
    “কে ওর এই অবস্থা করল? আমি?” বুলেনের এই নতুন স্বভাব একটা হয়েছে। কথা বলতে বলতে মাটিতে দা দিয়ে কুপিয়ে থাকে। “ওর নিজের জ্ঞাতি ভাইরা করেছে, বুঝেছো ওর জাতের লোকে করেছে।”
    মানুষটা কেমন করে যে মাটিতে দা দিয়ে কোপাচ্ছে। মাটিতো নয়, একটা মানুষকে কোপাচ্ছে। মানুষটার নরম শরীরে দা-টা বসে বসে যাচ্ছে, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে, রক্তের ছিটায় মানুষটা লাল হয়ে পড়েছে। মালতী বুলেনের দিকে চোখ তুলে তাকালো, তার চোখজোড়া রক্তের মতো লাল।
    “ এসব কী করছিস তোরা? শুনলাম তোরা তিনশ ঘণ্টা বন্ধ দিবি?”
    “ দেব, বন্ধ হবেই। আর কী কী হয় দেখতে থাক।”
    মালতীর লাল চোখে মাটিতে কোপাতে ব্যস্ত মানুষটার রাগ উঠেছে।
    “কী হবে এসব করে?”
    “নিজেদের রাজ্য হবে।”
    “কী সোনার নাড়ু পাবি নিজের রাজ্যে? আগের সেই দলটিকে দেখলি কি না? সোনার রাজ্য গড়তে গিয়ে কী করে গোটা রাজ্যকে শ্মশান করে ফেলল।”
    “তুই ওদের দলেরই। যা তোর পেয়ারের লোকেদের সঙ্গে গিয়ে থাক।”
    “আবার সবেতে আগুন দিবি, দে দুনিয়া জ্বালিয়ে শেষ কর।”
    “দেবইতো, আগুন দেবো। দুনিয়া পুড়িয়ে শেষ করব, তবু নিজেদের রাজ আদায় করেই ছাড়ব। তোদের সরকার আমাদের লোকজনকে কী করে পুলিশ মিলিটারি লাগিয়ে মারছে দেখগে’, যা।”
    “তোকে কে এই মন্ত্র দিল? ভাঙুয়ার ছেলে? সেই ছাগল চোরের পোলা তোর আপন হলো এখন?”
    “ওকে ছাগল-চোর বলছিস কেন? সে এখন টাইগার, পার্টিতে টাইগারের অনেক দাম।”
    “ কী করে ও তোদের রাজ্য নেবার পার্টিতে? ছাগল চুরি করে?” বুলেন চটে লাল। দা দিয়ে মাটিতে এতো জোরে কোপালো যে একবার ঢোকে আর বেরুচ্ছিল না।
    “ সে এক মিনিটে হাজার হাজার মানুষ মারবার বোমা বানাতে পারে।” কথাটা বলে বুলেন থেমে গেল।
    মালতী উঠে দাঁড়ালো, “ বন্ধ দে, আগুনে পুড়িয়ে ফেল গোটা গ্রাম শহর, সবাইকে পুড়িয়ে মার। তারপর নিজের রাজ্যে সুখে থাক।”
    শিশু যেমন খিদে পেলে কোঁকাতে কোঁকাতে মায়ের কাছে আসে সুমলা তেমনি বরের কাছে এলো।
    “ মেয়েটিকে দেখবি। খেরের মতো শুকিয়ে গেছে ও।”
    “ অন্যের কথা ভাবতে হবে না। নিজের ভাবনা ভাব। কিছু যদি করবার ইচ্ছে আছে, গায়ের কাপড় খোলে নিজেদের কাপড় পরবি।” সে দা-টা এক কোপে মাটি থেকে বের করে আনল।
    “ আমার নিজের পোশাক হলো যেখানা আমার শরীর ঢাকতে পারে। আমার আলাদা কাপড় লাগবে না, রাজ্যও চাই না। যা হোক একটা পরে, দু’মুঠো খেতে পারলেই হলো।”
    “চুপ কর তুই!” বুলেন কাকে এতো কর্কশ গলাতে দাঁতে দাঁত চেপে গালি দিচ্ছে? মালতী না ভাত খেতে চাওয়া সুমলাকে? সে ধীরে ধীরে বুলেনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। ফিরে তাকিয়ে দেখল দাঁতে দাঁত চেপে চোখজোড়া লাল করে বুলেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
    বুলেনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে জোনের মায়ের বাড়িতে গেল। স্বামীর অসুখটা বেড়েছে। আজ সে ভালো থাকাটাই সংবাদ, না থাকাটা নয়। দু’হাত দিয়ে কী করে যে মহিলাটি সংসারটা চালাচ্ছে। ছেলে মেয়ে দু’টোও ছোট ছোট। ও আজকাল রাতের পরে রাত ঘুমোয় না বলতে গেলে। মুড়ি ভাজবার পরে ঠোঙা বানাবে, ঠোঙা বানানো হলে মোড়া বানাবে। আরেকটা কাজেও হাত দিয়েছে। চারালিতে পড়ে থাকা সমবায় অফিসে যে নতুন আর্মি ক্যাম্প বসেছে সেখানে কয়েকটা চা-এর দোকানও বসে গেছে। তারই একটিতে সে বাজারবার কয়েকটা বাদ দিয়ে বাকি ক’দিন গিয়ে মশলা বাটে। সমবায় অফিসটা মেরামত করে সামনে গাড়ি আসা যাওয়ার পথে চেক করবার জন্যে বাধা দেবার বোর্ড ইত্যাদি বসানো হয়েছে, পথে স্পীড ব্রেকার দেয়া হয়েছে, গাছ লাগিয়ে তাতে চুন দেয়া ইটে বাগান সাজিয়ে তোলা হয়েছে। একটা বড় সড় আর্মি ক্যাম্প চিরদিনের জন্যে এই চারালির শিমূল তলাতে বসে গেছে। আর সেই ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠল ধোপার দোকান, সেলুন, তিনখানা পিসিও, চায়ের দোকান, পানের দোকান। তারই একটা চায়ের দোকানে জোনের মা সকাল বেলা গিয়ে মশলা বাটে। তবুও সে পেরে উঠে না। ওর উপার্জনের বেশিটাই খরচ হয় স্বামীর জন্যে ঔষধ আর ইঞ্জেকশন নিয়ে আসতে। কী করে সে তাকিয়ে থাকে সামান্য একটি বাতাসের জন্যে ব্যাকুল স্বামীর দিকে। ভাত ভাত করে কাঁদতে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর দিকে। তবুও ওর মুখ থেকে হাসি ফুরোয় না। কপালে বিকেলের রোদের মতো সিঁদুরের ফোটা,একই গৌরবে গরবিনী!
    “মজবুত দেহ , বুজলি। খাটতে পারিস।”
    “ বুঝলি, তোদের মতো আমি ভাতের মাড় খেয়ে বড় হই নি। ছাগলের দুধ খেয়েছিলাম।”
    মা-মরা ওকে দিদিমা ছাগলের দুধ খাইয়ে বড় করেছেন –এই গল্প এরা বহুদিন শুনেছে।
    “ আচ্ছা, হবে। বেমারি হলেও, বুড়ো হলেও মাথার উপরে মানুষটি আছে।”
    “মাথা গুঁজবার চাল একখানা আছে, নিজের বলতে মরিচ গাছ লাগাবার মাটি একটুকরা আছে।”
    “বাড়ি এলে মা বলে ডাকবার জন্যে এক জোড়া ছেলে মেয়ে আছে।” দুখের মধ্যেও হাসতে জানে এই মানুষটির সংগে দেখা করে যাবার জন্যে ওর মনে আকুলি বিকুলি করতে শুরু করল। ওকেই গিয়ে বলবে এসব কথা। ওর সংগে কথা বলেই ঠিক করবে, কী করে কী করবে।
    উঠোনে জোনের মা বসে আছে। পরিচিত দৃশ্য। তেল গরম করে বরের পিঠে মাখছে, কাছে ছেলে মেয়ে দু’টি।
    “আয় আয় মণির মা। বস। কোত্থেকে এলি?”
    “ওই, গেছিলাম বুলেনের ওখানে।”
    “ বুলেনতো রাজ্য দাবি পার্টির বড় লিডার হয়ে গেছে।”
    “সেটিই জিজ্ঞেস করতে গেছিলাম, শোনা কথাগুলো সত্যি না মিথ্যা।”
    “ সত্যি মণির মা। বন্ধগুলো হবেই। দেখছিস না বস্তি কেমন খালি হয়ে গেল। ঘরে ঘরে শুধু মেয়ে-লোকই পড়ে আছে।”
    “ সবাই কি গুয়াহাটি চলে গেল?”
    “কাছের বড় শহর বলে গুয়াহাটিতেই গেছে বেশিরভাগ। বাকিরা কাছাকাছি অন্য শহরে গেছে।”
    “কলাই গাঁও আমাদের এখান থেকে ওই বারো-তেরো কিলোমিটার হবে। মঙ্গলদৈ মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার। সেসব জায়গাতেও গেছে নিশ্চয়।”
    “ যেখানে পারে সরে গেছে। রিকশাওয়ালারা রিক্সা নিয়ে কাছের কলাইগাঁওতেই গেছে। রাজমিস্ত্রি যে ক’টা আছে, তারা গেছে গুয়াহাটি।”
    “ লাতুর মা বলছিল, ওর ছেলেকে এসে ওর মামা নিয়ে যাবে।”
    “লাতুর মা তোকে কই পেলো?”
    “কালী বুড়ির মন্দিরে ছেলের জন্যে বাতি দিতে এসেছিল।”
    “তোকে কি সে বলল? ও আমাকে সিনেমা দেখিয়েছিল, তিনশ টাকার কাপড় দিয়েছিল, সোনার আঙটি দিয়েছিল। সে বড় গাছের তলার জমিটা নেবে বলেছিল, পাকা ঘর তুলবে বলে বলেছিল। এই রাক্ষসী সব শেষ করল। তার মন ভেঙ্গে ফেলেছে।”
    ঠিক লাতুর মায়ের মতো গলা করে চুল থেকে উকুন বাছার ভান করে যেভাবে কথাগুলো বলে গেলো মণির মায়ের হাসি উঠে গেলো। হাসতে হাসতেও ওর মন খারাপ হয়ে গেলো। লাতুর মা কি আর কম দুঃখে এসব বলে? ওর হাসি মরে গিয়ে মুখখানাতে আঁধার নেমে এলো।
    “বলতো ও মণির মা, দেখতো, দুনিয়ার যত দুঃখ মেয়ে-লোকটিকে চেপে ধরেছে, দেখতোগো বেঁচে যে আছে!” ‘দেখতোগো’ শব্দটা এমন লম্বা নাকি সুরে টেনে জোনের মা লাতুর মায়ের মতো বলল যে মালতীর আবার হাসিতে দম বন্ধ হবার জোগাড় হলো।
    সে জোনের মায়ের পিঠে হাত রাখল। বড় আলতো করে, বড় আদরে, “তুইও পারিস, জোনের মা।” মেয়েমানুষটির মুখের হাসি মরে নি, “চিন্তা করবি না, বুঝলি। মরবো না, বেঁচে থাকব। কিছু একটা করে বেঁচে থাকব।”
    জোনের মা ওকে লবণ চা মুড়ি দিয়ে খাইয়ে কলসটা দেখালো। রেশনের চাল তুলে রেখেছে। টাকা দু’তিনটাও রেখেছে। আজ সে বাক্স খুলে রুমালে বেঁধে রাখা সবচে’ বড় সম্পত্তিটা বের করল, একটা সোনার আংটি।
    “মায়ের সব গয়না বাবা সৎ-মাকে দিয়ে দিয়েছেন। আমার মা ভালো ঘরের মেয়ে ছিলেন। গয়নাগাটিও ভালো করে দিয়ে কনে বিদেয় করেছিল। সৎ-মা আমাকে কিছুই দিল না। মাত্র এটা দিল। হবে বুঝলি। কিছু একটা করে চালিয়ে দেবো। সব সময়তো আর এমন হয় না।”
    “মিনতি কী করবে? ফুল? রত্নার মা? জগু? আর নবীন?” এক শ্বাসে সে নাম ক’টা বলে গেলো।
    “সবাই কিছু না কিছু উপায় করবে, তুই কী করবি?”
    “পাঞ্জাবি গ্যারেজে বন্ধের মধ্যেই ওদের ওখানে মেরামতি করবার জন্যে বাস দু’টো নিয়েছে। বাসের বডি বানাবে। অনেক কাজ বেরুবে, মণিকেও নিয়েছে। হবে যা, কোনোক্রমে মায়ে ছেলের চলে যাবে।”
    “ তাই হোক, তোর ছেলের গায়ে আমার আয়ু লাগুক গিয়ে।”
    বাইরে শ্বাস টেনে টেনে বুড়ো জোনের মাকে ডাকল। রোদের দিকে পিঠ দিয়ে বসা বুড়োর পিঠখানা একবার উঠছে একবার নামছে।
    “যা গে’ মণির মা, আমিও যাই। বুড়োর জন্যে বড়ি এনে রাখি। বড় বেশি ধরেছে গো মানুষটাকে। দেখি, দাঁড়া, বন্ধ খুললে গুয়াহাটি নিয়ে গিয়ে বড় ডাক্তার একটা দেখাতে পারি কিনা। লাতুর মামার সঙ্গে কথা বলেছি।”
    সে বেরিয়ে গিয়ে রাস্তাতে পা দিল। ওর মন এখন অনেকটা শান্ত। জগুর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে জগু ডাক দিল।
    “মণির মা, যাও কই?
    “ এই এলাম, জোনের মায়ের সঙ্গে দেখা করে।”
    “শুনছ কি, তিনশ ঘণ্টার বন্ধ!”
    “ সেই নিয়েতো কথা বলে এলাম।”
    “ বস্তির আধা মানুষতো চলেই গেল।”
    “তুইও যাবি?”
    “যেতাম, কিন্তু এই অসুস্থ মেয়ে মানুষটিকে ফেলে যাই কই? ও যে মরেও না!”
    “ ওভাবে বলবি না , জগু।”
    “মাঝে মধ্যে বড় রাগ চড়ে, বুঝলে।”
    “একবার গুয়াহাটি নিয়ে যাবি, বন্ধ-টন্ধগুলো খুলুক।”
    “ পয়সা কিছু গুটিয়েছিলাম, এই বন্ধে সেগুলো ভেঙ্গেই খেতে হবে। সব সময় এমন হয়, ওকে ডাক্তার দেখাবো বলেই তো দু’টো টাকা জোগাড় করেছিলাম। এদিকে গোটাই, ওদিকে কিছু একটা হবেই। কখনো মনে হয় যে করেই হোক মরেই যাই, রেলের তলাতে মাথা পেতে দিতে ইচ্ছে করে।”
    “কেন এসব কথা মুখে আনিস? তোর কিছু একটা হলে যে এই বেমারি বৌটি মা –মরা পাখির বাচ্চার মতো মরে যাবে।”
    মাথা নিচু করে জগু চুপ করে রইল।
    “চিন্তা করবি না বুঝলি। মরবো না, বেঁচে থাকব। কিছু একটা করে বেঁচে থাকব।” ঠিক জগুকে নয়, জোনের মায়ের কথাগুলোই সে নিজেকে বলবার জন্যেই উচ্চারণ করল। রাস্তার কাছের নরসিংহ গাছের থেকে নরম একটা ডাল ভেঙে নিয়ে নিলো সে। বেটে চাটনি করে দিলে মণি বেশ খুশি হয়। মণি এখন গ্যারেজ থেকে আসবেই। সে জোরে হাঁটা দিল, ঘরের সব কাজ পড়ে আছে যে!
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৫১495498
  • অধ্যায় ছাব্বিশ (২৬)

    সকাল সকাল ড্রাইভারণী আর মিনতির মধ্যে বড় এক ঝগড়া লেগে গেলো। ওদের দু’জনের ঘর পাশাপাশি হলেও যাওয়া আসা নেই। মিনতি থাকে মিনতির মতো, ড্রাইভারণী থাকে নিজের মতো। মাঝে মধ্যে তর্কাতর্কি হলেও এমনতর হয় না। প্রায়ই যেমন হয় ঝগড়া হলে , বস্তির সবাই সেদিকে রওয়ানা দিয়েছে। তার উপরে এক সপ্তাহ ধরে টানা বন্ধ চলছে। লোকগুলো আধপেটা থেকে বা উপোস করে এখানে ওখানে গুলতানি মারছিল। ঝগড়াটা শুনে, দেখে বা খবর পেয়ে প্রায় সবাই গিয়ে সেখানে জড়ো হলো।
    ড্রাইভারণী একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মিনতিও তাড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝে ড্রাইভারণীর দেয়া কাঁটা তারের বেশ একখানা উঁচু বেড়া। আগেও একবার ড্রাইভারণী মিনতিকে বেশ করে খোঁচা দিয়েছিল। মিনতি বুঝি ওর বাগান থেকে লাউ চুরি করে নিয়ে গেছে। তারের উঁচু বেড়ার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সে প্রায়ই বকতে থাকে, চোর আছে বলেই এতো খরচ করে বেড়া দিতে হয়েছে। মিনতি কিছু বলে না। কে ওকে খুঁচিয়ে ক্ষেপাতে যাবে? এমনিতেও মিনতি এই ড্রাইভারণীর অসভ্যের মতো গালিগালাজ সব শুনতেই থাকে। সে সহ্য করে চুপচাপ থাকে। ড্রাইভারণীর টাকা-পয়সা আছে, পাকা ঘর আছে, মদ্যপ হলেও মাথার উপরে রোজগেরে বর আছে, আর...। বাকিটা তার ভাবতেই ভয় করে। কথায় কথায় সে আর্মির ভয় দেখায়। আর না দেখাবেই কেন! সব্বাই ওকে ভয় করে, মিনতি না করে থাকে কী করে? ড্রাইভারণী মিনতির সব জানে। কে আসে, কে আসে না। কী খায়, কখন শোয়। সবই মাছের উপরে বকের মতো নজর ফেলে দেখে রাখে। তাই ড্রাইভারণীর দাপট সহ্য করে মিনতি চুপটি মেরে থাকে। মুখে টু শব্দটিও করে না। আজ আর সহ্য করতে পারল না। সব নষ্টের গোড়া এই সপ্তাহ জোরা বন্ধ। এই সংগঠনের দেয়া বন্ধ এই শহরে সম্পূর্ণ সফল হয়। ওদের একটা কোনও লোক যদি রাস্তাতে দাঁড়িয়ে বলে যায় আজ বন্ধ, তো এক দিক থেকে সব বন্ধ হয়ে যাবে। মিনতির হাতে কানা কড়িও নেই। কার কাছেই বা চায়? সবারই একই দশা। ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে সে ড্রাইভারণীর কাছে গেছিল। বন্ধ খুললেই ঘুরিয়ে দেবে বলে টাকা কিছু চেয়েছিল গিয়ে। ড্রাইভারণী ওকে টাকা রোজগারের সহজ পথের কথা বলল। মিনতি থাকতে পারল না। সেই মিনতি ফণা তুলে তুলে বলছে,
    “ সে আমাকে রেণ্ডীগিরি করতে বলছে!”
    “তুই রেণ্ডী না তো কী রে?” ড্রাইভারণীর গলা বেশ টনটনে। কাঁসার বাসন একটাতে বাড়ি মারলে যেমন অনেক ক্ষণ ধরে অনুরণন বাজতে থাকে সেরকম অনেক ক্ষণ ধরে কানে বাজতে থাকে ওর গলা।
    “বল, তুই আমাকে আরেকবার বল রেণ্ডী!”মিনতির গলা ভেঙ্গে গেছে।
    “বলবই তো একশবার বলব, রেণ্ডী। তুই কী করে ভাতের জোগাড় করিস অন্যে না জানতে পারে, আমি জানি।”
    “কী করে খাই আমি? সারা বস্তি কি দেখে না মাথাতে টুকরি নিয়ে বাজারে আমি কী করতে যাই? বাজারে আমি কি রেণ্ডীগিরি করতে যাই? বল, বলবি না কেন?”
    “শহরের বাড়ি বাড়িতে চাকরানি কাজ করে পেকে আসা বেটি তুই, তোকে কে চিনতে পারবে?”
    “ মা নেই, বাপ নেই। চাকরানি কাজ করে না মরে বেঁচে থাকলাম। ও বলে কিনা মানুষের বাড়ি বাড়ি রেণ্ডীগিরি করে ফিরেছি!” এবারে মিনতি কেঁদে ফেলল।
    “দেখা ! মানুষকে কেঁদে দেখা। আমার মুখ ছুটাবি না!”
    “ কী আর মুখ ছুটাবি? ছুটা না। আমার ছেলের কথা বলবি? জারজ বলবি। বল যত পারিস চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বল।”
    “রেণ্ডীগিরি করে জারজ গোটায়, বলবই তো। হাজারবার বলব।”
    “আমার ছেলের বাবা আছে, ভদ্র বাড়ির ছেলে। তোর ভাতারের মতো মাতাল নয়। আমার ছেলের বাবার দিকে তোরা তাকাতেও সাহস করবি না।”
    ঝগড়াটা বেশ পেকে উঠেছে। সাতদিন বন্ধের উঠোনে, পিড়াতে লেগে গড়িয়ে পড়া মানুষগুলো বড় একটা রস পেয়েছে। রেণ্ডীর কথা, জারজের কথা, শহরে পাকা মেয়ে মানুষের কথা--- বড় রসের কথা সব। কাজিয়াটা কেউ বন্ধ করতে চাইল না।
    “ভদ্র ঘরের ছেলে। জানি না বুঝি কে সে? আর্মিকে যদি বলে দিই, ওকে না পেলে তোকেই টেনে আনবে গিয়ে। তোকে ন্যাংটো করে শকুনে যেমন মরা গরু খায়, তেমনি করে খাবে।”
    “ওই ! চুপ কর! কাকে ন্যাংটো করে শকুনের মতো খাবে বলছিস? গোটা বস্তি জানে আন্ধার হলে কার ঘরে কে ন্যাংটো হয়। কাকে শকুনের মতো খায়। সারা বস্তি জানে এসব কথা। ভয় করে বুঝলি, তোর ঐ শকুনদের ভয় করে।”
    “কী বললি তুই? আমি তোর মতো জারজ জন্ম দেয়া মেয়ে মানুষ নই রে! আমার মাথার উপর রোজগেরে মরদ রয়েছে একটা।” ড্রাইভারণী উড়াল দিয়ে কাঁটা তারের বেড়া পার করে মিনতির কাছে চলে এলো। গিয়ে মিনতির চুল ধরে টানাটানি শুরু করল। মিনতি আর্তনাদ করে উঠল। কিন্তু ওর কথা বন্ধ হয় নি।
    “ মেরে ফেলল রে! ও আমাকে মেরে ফেলল!” গলা ওর ভেঙ্গে ভেঙ্গে শোনা যাচ্ছে।
    ড্রাইভারও বেরিয়ে এসেছে । মদ খেয়ে টং । লুঙিতে গাঁট দিতে দিতে ঢলতে ঢলতে এসে সে কাঁটা তারের বেড়ার পাশে দাঁড়ালো।
    “ ওই হারামি বেটি! স্বামীর রক্ত খেয়ে তোর শান্তি হয় নি? অন্যের বৌকে ধরে মারছিস কেন?” ড্রাইভার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকালো, “ দেখছ কী? মেরে ফেলো না কেন এই বজ্জাত মেয়ে মানুষটিকে!”
    ড্রাইভারণী এবারে মিনতিকে ছেড়ে স্বামীকে আক্রমণ করল, “ বৌ টাকাতে খায় , বেটার কথা শোন। আজ এক সপ্তাহ হলো, ঘরে ক’টাকা এনেছিস রে? কার পয়সাতে মদ খেয়েছিস? শালা, হারামজাদা! পুরুষ হয়েছিস? দুই ঠ্যাঙের মাঝে হাত দিলেই সব মেয়েরাই বুঝে যাবে তুই ক’টাকার পুরুষ।”
    হুঙ্কার দিয়ে এগিয়ে এলো ড্রাইভার, “মুখ ভেঙ্গে দেব। চুপ কর! চিনিস না আমাকে! আমি দিল্লির থেকে গিয়ে গাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। কত সস্তাতে ভালো গাড়ি এনেছি, দেখেছিস? তোর কোন ভাতার এনে দিতে পারবে?”
    ড্রাইভারণী আবার সেই আগের মতো উড়ে যেন কাঁটা তারের বেড়া পার করে এলো।
    “কার রোজগারের টাকাতে গাড়ি এনেছ? মরদ হয়েছো! মর্দানি দেখাচ্ছো?”
    স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া। এই লাগবে, এই ভাঙবে। যারা জড়ো হয়েছিল, সবাই নিজের নিজের পথ ধরতে শুরু করল। মিনতি কাঁদছেই। ওর কান্না দেখে কারো কারো খেয়াল হলো, কেনই বা ও কাঁদছে। ড্রাইভারণী সঙ্গে ঝগড়াই বা লাগল কেন? দুই একজন কাছে চেপে এলো,
    “যা উঠ, ছেলেটাকে ভাত দেগে’ যা।”
    “কোত্থেকে ভাত দেবে?” জোনের মা দৌড়ে দৌড়ে এলো।
    “ভাতের জন্যেই, ছেলেটাকে ভাত দেবে বলেই তো সে ড্রাইভারণী কাছে গিয়ে হাত পেতেছিল।” কেউ একজন বলল।
    “কী বলল ও?”
    “ কী আর বলবে? শকুনগুলোর সামনে গিয়ে ন্যাংটো হতে বলল।” ফুলের গলায় ধার।
    মুখে যার হাসি ফুরোয় না কখনো , সেই রাজপুত্রের মতো দেখতে মিনতির ছেলেটা এসে মায়ের শরীরে শরীর ঘেঁসে দাঁড়ালো।
    “ভাত খাবি?” রত্নার মা জিজ্ঞেস করল।
    “হ্যাঁ।” সে মাথা নাড়ালো।
    “চল। মিনতি, তুইও চল।” রত্নার মায়ের মুখে হাসি। সবাই ওর দিকে তাকাচ্ছে। সে এক সপ্তাহ বন্ধের মধ্যেও মানুষকে বলতে পারছে, “আয়, ভাত খাবি!” রত্নার মায়ের এই হাসির আড়ালে আছে একটি জলে খেয়ে ফেলা হাত।
    রত্নার মা মিনতি আর ওর ছেলেকে যখন ভাত খাবার জন্যে ডাকছে তখনি মণির মা গিয়ে সেখানে পৌঁছুলো। সাধারণত, সে ঝগড়া-বিবাদে ঢোকে না। আজ কেউ একজন গিয়ে বলল, মিনতিকে মেরে ড্রাইভারণী একেবারে মাটিতে ফেলে দিয়েছে, সে উঠতে পারছে না। পড়ি কি মরি সে এসে মিনতির কাছে পৌঁছুলো। মিনতি তখনো কাঁদছে। ওর চুলের মধ্যে আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে সে বলল, “ যা , ভাত-মুঠো ছেলেটাকে খাইয়ে আয় গে’।” কথাগুলো বলতে গিয়ে যেন ওর বুক ফেটে যাচ্ছিল। ওর কাছেই মিনতি প্রথমে গেছিল। নারকেল তেলের ডিবাতে দুই ডিবা চালই দিতে পেরেছিল। আজ রাতে যদি মণি সিঙের গ্যারেজ থেকে টাকা কিছু না নিয়ে আসে, তবে রাত থেকে উপোস দিতে হবে। রত্নার মা মিনতি আর ছেলেকে নিয়ে চলে গেল।
    ঝগড়া দেখতে আসা মানুষগুলো জড় হয়ে বসল। কেউ কিছু বলল না। সবারই মুখ রাগে কালো হয়ে আছে। মিনতির কান্না, ড্রাইভারণী গালি, ড্রাইভারের মাতালের প্রলাপ—সব কিছুতে মিলে যেন একটা ঘূর্ণি বাতাসের মতো মানুষগুলোকে কাঁপিয়ে চলে গেল। কেউ একজন বলল,
    “আরও বন্ধ হবে।”
    “একশ ঘণ্টার বন্ধ হবে।”
    “দুশো ঘণ্টার।”
    “তিনশ ঘণ্টার।”
    “ এক হাজার ঘণ্টার।”
    “কেউ বেঁচে থাকবে না।”
    লোকগুলো আবার একটু সময় চুপ করে রইল।
    “মরবো না, বুঝলে। মরবার হলে অনেক আগেই মরে যেতাম।”
    তৎক্ষণাৎ সবার মনে পড়ল, কত কি যে বিপদ পার করে এসেছে এরা। সবাই মনে মনে কথাটি সমর্থন করল,
    “মরাটা এতো সহজ নয়।”
    “ বন্ধগুলোতে আমাদের মতো গরীবদেরই মরণ।”
    “ আমাদের বস্তিতেই লোকগুলো কুকুর মেকুরের মতো কান্না জুড়েছে। দেখগে' শহরের বাবুদের বাড়িতে।”
    “টিভি দেখছে, ছুটি কাটাচ্ছে, মাংস-ভাত খাচ্ছে।”
    “ অমন লোকে বস্তাতে ভরে চাল কেনে।”
    “বন্ধের আগের দিন বাজারে মাছ –মাংস ফুরিয়ে গেছিল।”
    “মাছের দাম শুনেই ভয় লাগছিল।”
    আবার লোকগুলোর রাগ চড়ল। রাগে সবাই গুম মেরে বসে রইল।
    “দেখে নেব, দেখে নেব, সব ক’টাকে দেখে নেব!” মদ খেয়ে কেউ একজন রাস্তা দিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে চলে গেল।
    চিৎকারটা যেন লোকগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিলো। বুকের ভেতরে পাক খেয়ে খেয়ে শব্দগুলো যেন তাদের উপোসী ঠোঁটে বারে বারে উঠে এলো,
    “দেখে নেব, সব ক’টাকে দেখে নেব!দিন আসবে!”
    গুম মেরে বসে থাকা লোকগুলোর হাতের মুঠি শক্ত হয়ে এলো। চোখগুলো পাকা অঙ্গার হয়ে এলো। উপোসী পেটে মদ পড়া লোকটা তখনো চেঁচাচ্ছে, “ দেখে নেব, সবাইকে দেখে নেব। দেখে নেব...সবাইকে...।”
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৫২495501
  • অধ্যায় উনত্রিশ (২৯)

    বন্ধ খুলেছে। বাজারগুলোও খুলেছে। দূরে যারা গিয়েছিল তারাও ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে এলো। আগের মতোই সব যেন ঠিকঠাক চলছে আবার ।
    শুধু আলাদা শোনাতে শুরু করল মীরার মায়ের কথা। মীরার বাবা রাজমিস্ত্রি। বস্তিতে কমল মিস্ত্রি বলেই জানে সবাই। কখনো বা সামান্য নেশা করে। সময় থাকলে টুকটাক জুয়াও খেলে। মানুষটা খারাপ বলে কেউ বলে না। বন্ধে সেও শহরে, মানে গুয়াহাটি গিয়েছিল। সেখানে কোনও ঠিকাদারের তলায় রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়েছিল। এই শহরে মেলা রাজমিস্ত্রির সম্মান সে ঠিকাদারের তলাতে পায় নি, ছেনি চালাতেও পায় নি। আসলে যোগালিই ছিল। তবু এই শহরে ছেনি চালিয়ে যে টাকা পায় গুয়াহাটিতে ঠিকাদারের তলাতে যোগালির কাজ করে এর থেকে বেশি টাকা রোজগার করল। শুরু শুরুতে সব ঠিকই ছিল। তারপরে সব উল্টোপাল্টা হতে শুরু করল।
    কমল মিস্ত্রি গুয়াহাটিতে ছিল সঙ্গের আরো পাঁচজন মিস্ত্রির সঙ্গে একটাই বাড়িতে কোঠা ভাড়া করে। এক সারি লম্বা ঘর, ছোট ছোট পায়রার খোপের মতো কোঠা, এক চাটাইর বেড়াতে স্নানের ঘর, দু’টো গর্ত পায়খানা, এক দল মানুষ। এক একটা কোঠাতে পাঁচ-ছ’জন মানুষ। কমল মিস্ত্রিদের চারটা কোঠা পার করে বীণা, ভারতী, আঁউসী, কৃষ্ণা, রানিরা থাকে। আঁউসীর গায়ের রং আঁউসী, মানে অমানিশার রাতের মতোই অন্ধকার। আন্ধার-বিন্ধার মুখের হাসিটা অমাবস্যার রাতের তারার মতোই উজ্জ্বল। চোখজোড়াও জ্বল জ্বল করতে থাকে। ভরপুর শরীর । ওরা সবাই লোকের বাড়িতে কাজ করে। অনেক বাড়িতেই কাজ করে। সেই সকালে বেরোয় আর রাতে ঘরে ফেরে। বীণা আর রানির বিয়ে হয়েছে। স্বামীরা খাওয়াতে পারে না, তাদের বাড়িতে রেখে নিজেরা কাজে বেরিয়েছে। কৃষ্ণা আর ভারতীর বিয়ে হয় নি। আঁউসীকে স্বামী ছেড়ে দিয়েছে। এই আঁউসী আর কমল মিস্ত্রিতে কিছু একটা হয়েছে। দু’জনে একটা ঘর নিয়ে থাকতে শুরু করেছে।
    খবরগুলো ঠিকঠাক এসে মীরার মায়ের কানে পড়ল । সে লোকটাকে ডাক পাঠালো, পাঠাতেই থাকল। খবর পাঠাতে থাকল। কিন্তু ওদিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ নেই। সে নিজেই একবার মেয়েকে নিয়ে বেরুলো। অবশ্যি হাবাগোবা মীরার মায়ের সাহস হলো ঐ বস্তির রানির জন্যে। রানি রাত্রে নিয়ে গিয়ে তাকে কমল মিস্ত্রির ঘরে ঢুকিয়ে দিল। সবাই একবার একবার এসে ওকে দেখে গেল। কোঠা জুড়ে পাতানো একটাই বিছানাতে সে মাথা নুইয়ে বসে রইল। মিস্ত্রি তাদের হোটেল থেকে এনে জিলিপি, সিঙ্গারা খাওয়ালো। সন্ধেবেলা আঁউসী এলে ভাত রান্না করল, মাংস রান্না করল। সে একটুকরো জায়গা জুড়ে একই ভঙ্গিতে বসে বসে সব দেখে গেল। মেয়েকে রানি নিয়ে গেছে। রাতে আঁউসী, সবাই ওকে ডাকে ‘আঁউচি’ বলে, আঁউচি ওকে ভাত দিয়ে মশারি টানিয়ে শুতে দিল, “এখানে বড্ড মশা।” সে কিচ্ছু বলল না। রাতে কমল মিস্ত্রি এলো। সে উঁকি দিয়ে দেখল মীরার মা শুয়েছে কি না। কোঠার একমাত্র লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে ওরা মাংস আর মিস্ত্রির আনা মদের বোতল খুলে গ্লাসে নিয়ে খেলো। ভাঙ্গা-ছেঁড়া বেড়ার ফাঁক দিয়ে মায়াবী মহানগরের ঝিলমিল আলোর টুকরো ভেতরে আসছিল। এতো আর সেই ছোট শহর নয়, যেখানে ফুল যদি বেশি করে হেসে কারো সঙ্গে কথা বলল তো গোটা বস্তি জেনে যায়; মিনতি যদি গায়ে একখানা নতুন কাপড় তুলে তবে সবাই জিজ্ঞেস করে, ‘কই এতো কাপড় পায়?’; নবীন যদি কাউকে ডাক একটা দিল, তবে পরের দিন কথা উঠে ‘ সে ওকে বিয়ে করবে কি?’; এখানে বাড়িতে ছেলে-বৌ রেখে এসে পুরুষ আরেকজন বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে একই ঘরে থাকতে পারে। ঘোরাঘুরি করতে পারে, কেউ চোখ তুলেও দেখে না। সেই মায়াবী শহরের চারদিকে ছড়ানো হীরে-মুক্তোর মতো লাইটের আলো এই মানুষ দু’টোর গায়ে পড়েছে। দু’জনে বিছানাতে উঠেছে। একাৎ ওকাৎ না করে মীরার মা বেড়ার দিকে মুখ করে শুয়ে আছে, সে শ্বাস ছাড়তেও ভয় পাচ্ছে। “ বুর্বক বেটিটা শুয়ে পড়েছে” আঁউসীর নেশা ধরা গলা। তের চৌদ্দ বছর ধরে শোনা মানুষটা শ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো মীরার মা। অনেক দিনের চেনা শব্দ। কখন শ্বাসগুলো ছোট ছোট হয়, খন বেশ দ্রুত বয় মীরার মা বহু বছর ধরে জানে। ছোট ছোট, দ্রুত শ্বাস ওর কানে পড়ছে এসে। সে স্পষ্ট দেখতে পেল ওর চেনা মানুষটির বুকের মধ্যে একটা ডাঁড়াশ সাপ কিলবিল করছে। কুচকুচে কালো। অন্ধকার থেকেও বেশি কালো। মীরার মায়ের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে কি জানি সেই সময়টুকুতেই জ্ঞানই হারিয়ে ফেলেছিল। তন্দ্রার থেকে সাড়া পেয়ে সে দেখেছিল মানুষটি গুয়াহাটিতে কাজ করতে আসবার আগে তেরো চৌদ্দ বছর ধরে রোজ যেমন আসত তেমনি কুচি মুচি করে গাঢ় ঘুমে মীরার মায়ের কাছে আসছে। এক মুহূর্তের জন্যে চেতন-অবচেতনের মাঝে দোলন্ত তার এতোদিনের অভ্যেসে চেনা শরীরটার দিকে হাত একটা বাড়িয়েই দিচ্ছিল। হঠাৎ দেখতে পেল মাথার দিকে লাল লাল গোল গোল আঁকা বাঁকা রেখাতে সাজানো একটি কালো আলদ, ওর চেনা মানুষটিকে জড়িয়ে ধরেছে। জ্ঞান ফিরে এলো মীরার মায়ের। চোখে তখন ভেসে উঠল আরেকখানা দুঃখী মুখ, ছোট বোন অনুর। উত্তর বাংলার বাঙালি ছেলে একটিকে বিয়ে করেছিল। দু’টো ছেলে মেয়ে হবার পর থেকে ছেলেটি নিখোঁজ। লোকের বাড়িতে কাজ করে করে বড় কষ্টে চালাচ্ছে সে। লোকে বলে বরটি ভালো, দোষ অনুরই। তাই যদি না হবে , তবে ঘরের বৌ রেখে নতুন মেয়ে মানুষের সঙ্গে যাবে কেন? এখন মীরার মায়ের সম্পর্কেও লোকে একই কথা বলবে, নইলে ঘরের বৌ রেখে অন্য মহিলার সঙ্গে যাবে কেন বর? লোকে আরও একটা কথা যোগ দেবে তাতে, দু’জন দিদি-বোনেরই একই দোষ, পুরুষের সঙ্গে সংসার করতে পারে না। ভোর হতেই মীরার মা চলে এসেছিল।
    লম্বা বন্ধটার পরে পরে মীরার মায়ের কথাবার্তা সব আলাদা হয়ে গেল। গুয়াহাটির থেকে এসে সে শহরের এক বাড়িতে কাজ নিলো। ছেলের পড়া ছাড়িয়ে ভুসিমালের একটা দোকানে ঢুকিয়ে দিল। হাবা মুখে সব সময় সামান্য মেলা মুখের ঠোঁট দু’টির থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। আজকাল ওর ঠোঁট দু’খানা সব সময় টান হয়ে লেগে থাকে। ওর পয়সা, ছেলের পয়সাতে ঘরে টিন লাগালো, টিউব কল বসালো। লোকজনকে বলতে শুরু করল , গুয়াহাটি থেকে স্বামী টাকা পাঠাচ্ছে। মীরার মায়ের কথাগুলো সব অন্যরকম হয়ে গেল।
    আলাদা হয়ে গেল জোনের মায়ের কথাও।
    একেবারে অন্য রকম হয়ে গেল জোনের মায়ের বাড়ি। কোনোদিকে তাকানো যায় না, আবর্জনার স্তূপ। ঘর জোড়ে কেঁচোর গর্ত, ছানি পড়ে গেছে, এলো মেলো পড়ে আছে আসবাব পত্র, বাসন বর্তন। নোংরা ঘরেই জোন আগুন জ্বালিয়ে সামান্য ভাত রান্নার চেষ্টা করে। শুরু শুরুতে পারত না, এখন পারে। ছোটটি মাকেও একমুঠো খাইয়ে দেয়।
    আর জোনের মা? মাথাতে এক থোক সিঁদুর, কপালে বিশাল ফোটা একটা দিয়ে দাওয়ায় বসে থাকে। মাঝে মধ্যে হুঙ্কার দেয়,
    “ নিয়ে আয়, কাঁচা দুধ নিয়ে আয়।”
    “এক জোড়া কালো পায়রা আন।”
    “মা আসছে, ওই দেখ মা আসছে।”
    “ মা এসে আমার পেটে ঢুকেছে।”
    শরীর টরীর না ধুয়ে চুল মেলে বসে থাকা মানুষটির স্বাস্থ্য পড়ে যাচ্ছে। চুলে জটা হচ্ছে। চোখ জোড়া লাল হয়ে থাকে। বস্তির থেকেই নয় শুধু দূর দূর থেকে কালী ভর করা মহিলাটিকে দেখতে লোক আসে। লোকজনের নিয়ে আসা জিনিসগুলো সামনে পড়ে থাকে। সে হাত দিয়েও দেখে না। বিকেলে জোন বা ওর ভাই জিনিসগুলো তুলে নিয়ে রাখে। না খেয়ে না খেয়ে মানুষটি রোগা হয়ে যাচ্ছে। চোখে মনে হয় দেখেও না, কেউ গেলে আর আগের মতো চিনতে পায় না।
    বাজার থেকে ফেরার পথে মণির মা জোনের মায়ের বাড়িতে গিয়ে এলো। সঙ্গে মিনতিও গেল। মদমত্ত মানুষটি শুকিয়ে হাড় জিরজিরে হয়ে পড়েছে। হাড়ের গড়ন বড় বলে এতোটা রোগা এখনো লাগছে না। মাথার জটাগুলো নজরে পড়ে। একটা আসনে বসে আছে, মাথার উপরে একখানা চাঁদোয়া টানানো আছে। সামনে কয়েকটা বাতি জ্বালিয়ে রাখা আছে, একটু আগে জ্বালানো ধূপদান থেকে এখনো ধোঁয়া বেরুচ্ছে। একটা কলাপাতাতে চিনি, সাগু, কলার নৈবেদ্য, আর একটা খাঁচাতে একজোড়া কবুতর।
    মিনতি আর ওকে দেখে সামান্য চোখ তুলে তাকালো জোনের মা। অনবরত হাসিতে ঝিলমিল করে যে চোখ সেটি এখন মরা মাছের মতো ঘোলা। গলাটা সোজা করতে পারছে না। ওদের দিকে সামান্য তাকিয়েই গলাটা বাঁকা করে আমার মাথা ফেলে দিল সেল। বড় চোখ জোড়ার থেকে কালো মণিদু’টো বাঁকা করে একই জায়গায় থেমে গেল। মণির মা আর মিনতি দু’জনেই হা-হুতাশ করতে শুরু করল। মাথাতে তেল, চোখে মুখে জল দিয়েও কিছু হয় না। চোখের মণি স্থির করে গলা বাঁকা করে সেই যে ফেলল , ফেললই।
    মিনতি সামান্য তেল ঝেড়ে আনতে কারো কাছে গেল। বিকেলটা ধীরে ধীরে ভারি হয়ে আসছে। দু’জন কেউ আসছে বাড়িতে। জোন আর ওর ভাই। জোনের মাথাতে এক বোঝা লাকড়ি। ভাইয়ের হাতে একটা পোটলা। দু’জনে এসে মায়ের কাছে দাঁড়ালো। সামনে পড়ে থাকা নৈবেদ্য আর টাকাগুলো তুলে নিলো।
    “ মা কিছু খেয়েছি কি খায়নি?”
    “খায় নি।”
    “তোরা!”
    “এখন খাবো।”
    ছেলে দু’জনে ভেতরে চলে গেল। মালতী প্রায় বেহুঁশ মানুষটিকে জড়িয়ে বসে রইল। চুলে হাত বুলোতে গিয়ে দেখল নোংরা। তেল পানি না পড়ে জট বেঁধেছে। সেই একই জটা? কালী বুড়ি নিজেকে আরতির থেকে কালীবুড়ি করে নিতে যে জটা মাথাতে লাগিয়ে নিয়েছিল, সেটিই কি? কালী ভর করলে বুড়ি পুরো রাত নাচত। পরদিন ঠোট নীল করে পড়ে ছিল। একই রকম কালী এর গায়েও ভর করেছে কি? কালী বুড়ি দু’দিন পড়ে থেকে আবার উঠত, মুড়ি ভাঁজত, কাঁথা সেলাই করত। জোনের মা সেই যে পা দু’টো ফাঁক করে দেখিয়েছিল, সেদিন থেকে এক ফোঁটা জলও মুখে দেয় নি। কালী বুড়ি হয়ে আরতি বেঁচে ছিল। এ যে কালী মাকে পেটে নিয়ে মরতে চাইছে। মানুষটি মালতীর কাঁধে মাথা ফেলে দিল। মদমত্ত মানুষটির ভর সহ্য করা বড় কঠিন হয়ে পড়েছে। মিনতি হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে।
    “কী হলো রে মণির মা?”
    “ এ আর বাঁচবে না।”
    দু’জনে কান্নাকাটি শুরু করল। কেউ কেউ কাছে এগিয়ে এলো। একটা লোক প্রদীপ ধূনা নিয়ে ওর আরতি করতে যাচ্ছিল। মালতী মিনতি দু’জনে জড়বৎ মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরল। মণির মা বাতি ধূনাগুলো সরিয়ে নিতে বলল। এই আসবে, লোকগুলো বাড়ি বাড়ি থেকে বেমারি মানুষগুলোকে নিয়ে দলে দলে আসবে। বাসি গু-তে মাছি পড়বার মতো ঘিরে ফেলবে মহিলাটিকে। মালতী জোনের মাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরল।
    “আসবি না, কেউ আসবি না। মরবে এখন, চোখের সামনে মানুষটি মরবে। কিছু একটা কর। বুড়ো ডাক্তারকে ডাক। মিনতি, এই লোকগুলোকে তাড়া।” মণির মা হল্লা লাগিয়ে দিল।ওর হাত পা নাড়ানো চেহারাটা দেখে কেউ বলল, সঙ্গেরটিকে কালী ভর করেছে।
    মিনতি আর সে মিলে জোনের মাকে আড়াল করল। কাছেই মীরার মায়ের বাড়ি। সেও এসে ব্যবস্থা করতে লেগে গেল। বুড়ো ডাক্তার এসে দেখে গেল। বুড়ো ডাক্তার ঠিকই বলেছে, মহিলার অসুখটি মনে। তাকে বোঝাতে হবে কালী বুড়ির কালি ভর করা আর এই কালী ভর করাতে তফাৎ অনেক। একজন জেনে বুঝে বেঁচে ছিল, অন্যজন না জেনে মরতে চলেছে।
    কথাটা মণির মা-ই বলল। আধমরা মানুষটির ঠোঁট খুলে খুলে খাইয়ে এরা বাঁচিয়ে রেখেছে, আর লোকজন আসছে তাদের নিজেদের অসুখ ভালো করতে। অনবরত এরা মানুষটিকে দেখে রাখতে পারে না, নিজের নিজের কাজকর্ম আছে। মীরার মায়ের কাজে যেতে হয়, মিনতি আর মালতীকে যেতে হয় বাজারে। জোনের মা দুই একটা কথা বলতে পারছে। ওর এখন প্রিয় কাজটি হচ্ছে অসুখ ভালো করতে আসা লোকজনের মাথাতে হাত দিয়ে আশীর্বাদ করা। ওর মনে এই ভাবটি দৃঢ় হয়েছে যে সে সত্যি অসুখ ভালো করতে পারে। মীরার মা ওদের বলল, “একে জগুর বৌয়ের ওখানে নিয়ে যাই। পারে যদি সে তাকে ভালো করুক।” মিনতিরাও ভেবে দেখল।
    “জগুর বৌকে ও চিনতে পারবে কি?”
    “ জগুর বৌকে ও আশীর্বাদ করবে তো?”
    “ সেই পচা মহিলাটি আর কি ভালো হবে?”
    “ পচা মানুষটিকে আনবি কী করে?”
    “ বেমারি মানুষটিকেই বা জগুর বাড়িতে নিয়ে যাবি কী করে?”তিনজনেই ভেবে কুল পায় না।
    মীরার মা-ই ঠিক করল। একেই জগুর বাড়ি নিয়ে যাবে। পচা মহিলাটিকে কে গিয়ে আনবে? এ শক্তপোক্ত মহিলা, এদের তিনজনের যত্ন আত্তিতে বেশ একটু ভালোও হয়েছে। যেতে পারবে।
    বাজার বসেনি এমন একটা দিনে তিনজনে মিলে জোনের মাকে জগুর বৌয়ের ওখানে নিয়ে গেল।
    ফাটা কাঁথার স্তূপের ভেতরে জগুর বৌ পড়ে আছে। চোখগুলো ঢুকে গেছে, দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছে। পচা মাছের মতো জরায়ু বেরিয়ে ঝুলে পড়েছে। উৎকট গন্ধ। কাপড়ের দলাতে রক্ত আর পুঁজের দাগ। এক পাশে বোতল একটাতে জল আর একটা খোলা ব্রেড।
    জোনের মা এক দৃষ্টিতে জগুর বৌর দিকে তাকিয়ে রইল।
    “চিনতে পারলি ওকে?” মণির মা জিজ্ঞেস করল। জোনের মা মাথা নাড়ল।
    “পারিস যদি একে ভালো কর।” মণির মায়ের কথা কালী বুড়ির মতো সোজা। জোনের মা জগুর বৌর মাথাতে হাত রেখে আশীর্বাদ করল। তারপরে জোরে পা চালিয়ে বেরিয়ে এলো। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কাপড়ের দলার থেকে বেরিয়ে এলো জগুর বৌ। ছ্যাঁচড়ে ছ্যাঁচড়ে সে জোনের মায়ের পায়ের দিকে এগিয়ে গেলো। সবার নজরে পড়ল পচা মাছের মতো ঝুলন্ত জরায়ু, মাছি ভনভন করছে। জোনের মায়ের পায়ে ধরে প্রণাম করল সে। হঠাৎ জোনের মা হা হা করে হেসে উঠল।
    মণির মা দায়িত্বটা নিলো। সকাল বিকেল জোনের মাকে জগুর বৌ-র ওখানে নিয়ে যায়। ইতিমধ্যে ঔষধ আর ইঞ্জেকশনে এর শরীরে বল হয়েছে, ধরে ধরে না নিলেও চলে।
    মীরার মা, মিনতি আর সে—তিনজনে রাতেই জোনের মাকে জগুর বৌয়ের ওখানে নিয়ে গেল। রাতে মানুষটি মারা গিয়েছিল। ওরা যেতে যেতে শব বের করে ফেলা হয়েছে। ফাটা কাঁথার দলাতে শুয়ে থাকা মানুষটির থেকে এই শবের তফাৎ শুধু একটাই। ফাটা কাঁথার দমে পড়ে থেকে মানুষটি কংকালসার হাত একটা দিয়ে মুখের মাছি তাড়িয়ে যেতো, এখন বাইরে ফেলে রাখা মানুষটির মুখেও মাছি ভন ভন করছে। কংকালসার হাত একটা আর সেগুলো তাড়াবার জন্যে বেরিয়ে আসেনি।
    মিনতিরা জোনের মাকে সেখানেই নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালো। মরা শব নিয়ে যাবার জন্যে জোগাড় যন্ত্র হচ্ছে। চাং সাজানো হয়ে গেছে।
    “দেখ জোনের মা, জগুর বৌ মারা গেল।” মণির মা ওর কানে কানে বলল।
    “যা জোনের মা, ওকে মা কালীর আশীর্বাদ দে গিয়ে।”
    “ ওকে বাঁচাতে পারবি কি?”
    “পারিস যদি তোর পেটে ঢোকা মা একে ঠিক করুক।”
    “ তোর গায়ে কালী মা আছে, একে মারবি না।”
    “ ওর অসুখও ভালো কর।”
    “যা, ওকে এখনই নিয়ে যাবে যে!”
    তিনজনে জোনের মাকে ঠেলতে শুরু করল। সে এক পা মাত্র এগিয়েছিল। বেশ ক’জন চেঁচিয়ে উঠল, “রাম নাম সত্য! জয় হরি বোল!” জগুর বৌকে চাঙে তোলা হলো। আবার এক সম্মিলিত চিৎকার, “জয় হরি বোল!, রাম নাম সত্য!...হরি বোল!...” জোনের মা চমকে উঠল। চাঙ নিয়ে মানুষগুলো চলে গেল। অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইল জোনের মা। তারপরে লম্বা লম্বা পা ফেলে বাড়ির দিকে চলে গেল। কেউ তাকে ধরতে হলো না। ঠিক আগের মতোই সে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটছে। “দাঁড়া না, জোনের মা।” বলে মিনতিরা ওর পিছু নিলো। রোজকার মতো সে ফিরে তাকিয়েছে। মীরার মা ওর জটাগুলো কেটে দিয়েছিল, ছোট চুলগুলোর মধ্যি দিয়ে সেই একই হাসি বেরিয়ে আসছে। ঠিক আগের মতোই বলছে, “ভাত খাবি ভালো করে, তবে না পায়ে জোর থাকবে...।”
    জোনের মা ঠিক নিজের বাড়িতে গিয়ে ঢুকল।
    “আয় মিনতি, আয় মালতী, মীরার মা যে আজ আমার বাড়িতে এসেছে। সাদা টিনের ঘর, টিউব কল...” মানুষটি হাসছে। বাড়িতে ঢুকেছে, “ এই জোন, তোর ছোট ভাই কই? পুরোটা বাড়ি এতো নোংরা কেন? জোন, তোর বাবা কই?” কোমরে শাড়ি প্যাঁচিয়ে হাতে ঝাড়ু তুলে নিলো। রোজকার মতো চুলগুলো ভালো করে বাঁধতে গিয়েছিল। পারে নি। ভেতরে গিয়ে বেড়াতে গুঁজে রাখা আয়নাতে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মীরার মায়েরা ওর পেছনে পেছনে গিয়ে কাছে দাঁড়ালো। আয়নাটা রেখে ও তাদের দিকে তাকালো।
    “আমার চুলের কী হলো?”
    “আমিই কেটে দিয়েছি।”
    “জট হয়ে গিয়েছিল।”
    “ উকুনে কিলবিল করছিল।”
    “আমার ফোটাটা কেন মুছে দিয়েছো?” জোনের মা আবার আয়নাটা নিয়ে বেড়াতে গুঁজে রাখা সিঁদুরের কৌটা হাতে নিলো।
    “ওটা আমাকে দে।” মীরার মা সিঁদুরের কৌটা খাপ দিয়ে নিয়ে রেখে দিল।
    জোনের মা কিছু সময় ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরেও সিঁদুরের কৌটাটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপরে হাঁটুতে মাথা গুঁজে কাঁদতে শুরু করল। তিনজনেই ওর পাশে বসে রইল।
    “কাঁদবি না জোনের মা, আমার দিকে দেখ, আমি স্বামী বেঁচে থাকতেই বিধবা।” মীরার মা কাঁদছে।
    “মীরার মা , তুইতো মানুষকে দেখিয়ে হলেও সিঁদুর পরে আছিস, আমি ওর ছেলে বড় করছি...” মিনতি কথা শেষ করতে পারেনি।
    “আমি, আমি মানুষটার শবও দেখতে পেলাম না, কই মরল, কী হলো, কাক শকুনে খেলো কিনা, না শ্রাদ্ধ না একখানা বাতি...” মণির মা-ও কান্নাতে অস্থির হয়ে পড়ল।
    ছেলেমেয়েরা এসে খোঁজা না শুরু করা অব্দি চারজনে অন্ধকার, অপরিচ্ছন্ন ঘরটিতে কাঁদতে থাকল। কখনো বা নীরবে, কখনো বা ফোঁপিয়ে, কখনো বা দাঁত কামড়ে। কাঁদতে কাঁদতে , বলতে পারে না কেউ, জলে যেমন পিঁপড়ের ঝাঁক ভাসে কখনোবা-- সেরকম জড়ো হয়ে পড়ে রইল। অন্ধকারে ওদের ক’জনকে জড়ানো, গোটানো স্তূপাকৃতি অদ্ভুত প্রাণীর মতোই দেখাচ্ছিল।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৫২495500
  • অধ্যায় আঠাশ (২৮)
    একদিন , দু’দিন, চারদিন, সাতদিন অব্দি বন্ধের অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু তিনশ ঘণ্টা কী করে কাটায় মানুষগুলো? কী খায়? কী করে? কই যায়? কেউ খোলামেলা ঘোরাফেরাও করতে পারে না। মিলিটারিতে গিজ গিজ করছে।
    মণি সক্কাল সক্কাল পাঞ্জাবি গ্যারেজের জন্যে বেরিয়ে যায়, একেবারে রাত আটটা নটাতে আসে। সে সেই সকালে ঘরে একমুঠো খেয়ে যায়, দুপুরের আর রাতের খাবার সেখানেই খেয়ে আসে। এ কয়দিনে সে বেটা ছেলে হয়ে গেছে। কোনও কোনও দোকানের পেছনে কেনাবেচা চলে, সেখান থেকে দরকারি জিনিস কিনে আনে। কোনও অসুবিধে ছাড়াই মালতীর চলছে।
    জোনের মা ঠিকই বলেছিল, কিছু একটা করে মানুষের চলে যাবে, যাচ্ছেও।
    ফুল একটা বাড়িতে কাজ নিয়েছে। বন্ধ বলেতো আর মানুষের বাড়ির কাজকম্ম বন্ধ নয়।
    জগুও হাজিরা করা শুরু করেছে।
    রত্নার মা ঘরে মশলা কুটে গুড়ো করে বাড়ি বাড়ি বিলোনো শুরু করেছে। সঙ্গে মিনতিও যায়। সে গরম মশলার ছোট ছোট প্যাকেট করে নিয়ে যায়।
    লাতুর মাও আজ এই বাড়িতে কাপড় ধোয়া, তো কাল ওই বাড়িতে ঘর লেপা চালিয়ে যাচ্ছে।
    নবীন আর্মি ক্যাম্পের কাছে যে বাজার বসে সেখানে বসতে শুরু করেছে।
    শহর ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষগুলো যা পারে, যেভাবে পারে টাকা পয়সা পাঠাচ্ছে।
    চারালিতে আর্মি ক্যাম্পের সামনে শাক সবজির একখানা ছোট বাজার বসেছে। বস্তির অনেকেই ভেতর গ্রামে গিয়ে শাক লতা যা পারে এনে সেখানে বিক্রি করতে শুরু করেছে। আসলে এই বন্ধ দেয়া পার্টি আর মিলিটারির মধ্যে বোঝাপড়া আছে। ওদের পার্টি অফিসটাও ক্যাম্পের গা লাগিয়ে বসানো। নইলে একেবারে দেশের থেকে আলাদা হয়ে আলাদা রাজ্য দাবির পার্টিটি দেশের ভেতরে রাজ্য দাবি করা পার্টিকে পেলেই মারে। একেবারে সাপে নেউলে সম্পর্ক। শেয়াল যেমন বাঘের সঙ্গে সঙ্গে থাকে বন্ধ দেয়া পার্টিটিও আর্মির সঙ্গে সঙ্গে থাকে। সুতরাং বাজার বসতেও কোনও অসুবিধে হয় নি। আর্মি ক্যাম্পেরও শাক সবজি চাই। পার্টির ক্যাম্পেও চাই। নদীতে মেরে আনা দুই এক ভাগা মাছও বিক্রি হচ্ছে, গেল রোববারেতো ছাগল একটাও কেটে বিক্রি হয়েছিল।
    চলছে। যেমন তেমন করে ফাঁক বের করে ঠেলা ঠেলি করে হলেও চলছে। থেমে থাকে নি কিছু।
    কিন্তু জোনের মা ঠেলা-ঠেলি করেও চালাতে পারে নি। শুধু যদি ভাত-মুঠোর কথা হতো, তবে কথা ছিল না। আসল কথা হলো মানুষটির অসুখ। বেছে বেছে এই ক’টা দিনেই কি এমন হতে হয়? মালতী একদিন দেখতে গেছিল। উঠোনে পা দিয়ে সে চেনা শব্দ আর দৃশ্য দেখতে পায় নি। সেই শ্বাস টানতে থাকা একটা পুরুষ আর তেল মালিশে ব্যস্ত মহিলা। সে ভেতরে গিয়ে ঢুকলো। চেনা ঘরঘর শব্দে শ্বাস টানার শব্দের বদলে সে শুনতে পেল সাঁ সাঁ শব্দ।বিছানার কাপড়ের সঙ্গে মিশে মানুষটা পড়ে আছে। সে কাছে চেপে গেল। মানুষটার ঠোঁট, হাতের আঙুল, পায়ের বুড়ো আঙুল নীল হয়ে গেছে। সাঁ সাঁ শব্দটি শুনলে টের পাওয়া যায় বুকের ভেতরে টোপ টোপ করে জল পড়বার মতো করে অল্প অল্প বাতাস যেতে পারছে। সে যে কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেটি টের পেয়েছে, কিন্তু কেউ তা ধরতে পারে নি।
    “আমার বিড়ি...” না, কথা শেষ করতে পারে নি লোকটা। বাতাস শূন্য বুক থেকে শব্দ কয়টি বড় কষ্টে বেরিয়ে আসছে।
    “নে তোর বিড়ি, খা আর মর, এগুলো টেনে টেনেই তোর আজ এই অবস্থা।”
    জোনের মা বিড়ি একটা জ্বালিয়ে বুড়াকে দিচ্ছে।
    “আমি যখন কামাই করতাম...” বুড়ো থেকে গেছে, কথা বলতে পারে নি।
    “বল না, নিজে কামাই করতাম যখন দিনে তিন চার প্যাকেট বিড়ি খেয়েছিলাম, এখন বৌয়ের রোজগারে..., বল, বলবি না কেন?”
    “ বুড়ো একটান মারতেই জোনের মা কেড়ে এনে ফেলে দিল। বুড়ো কিছু বলতে গেলে নিজের খিং খিঙিয়ে উঠল, “বল কোন প্যারের মানুষকে দেবার জন্যে নিয়েছিস, বল না!”
    বিড়িতে টান দিয়ে বুড়ো শান্ত হয়ে বিছানাতে পড়ে রইল। শুধু সাঁ সাঁ শব্দটা বেরুতেই থাকল।
    জোনের মা বাইরে বেরিয়ে এলো। বেড়াতে গুঁজে রাখা ছোট ডিবার মতো জিনিস একটা বের করল, শাড়ির আঁচলে বেঁধে রাখা পিল দু’টো বের করল। ডিবার মতো জিনিসটাতে জল দু’চামচ দিয়ে পিলগুলো ফেলে আবার ভেতরে ঢোকে গেল। বুড়োকে সে এবারে হাঁটুতে হাত রেখে বসিয়ে দিল। তারপরে নাকের কাছে ডিবাটা দিয়ে শুঁকতে দিল। ভালো করে শ্বাস টানতে পারে নি বুড়ো। কিছুক্ষণ শুঁকিয়ে সে বাইরে উঠোনে এলো।
    “আয় মণির মা, বস।” জোনের মা পুরোনো চাটাই, ধারাতে ছোট করে উঠোনেই একখানা পাকঘর সাজিয়ে নিয়েছে। দেখলেই বোঝা যায় মেয়ে মানুষের হাতের কাজ।
    “এখানে রান্নাঘর করলি কেন? তোর অসুবিধে হয় না? বৃষ্টি দিলে কী করিস?”
    “ভেতরে ভাত রান্না করলে বড় ধোঁয়া হয়, ওর ধোঁয়া লাগলে অসুখ বাড়ে। বৃষ্টি দিলে হাড়ি কড়াই তুলে ভেতরে চলে যাই। ভেতরের চুলোটা ভাঙিনি তো।” চা ঢালতে ঢালতে বলল। বস্তির সবার ঘরেই একই চা। লবণ দেয়া লাল চা। “আজ মুড়ি নেই, কতদিন হলো মুড়ি ভাজি নি।” সে গিয়ে এক বাটি চা বুড়োকে খাইয়ে এলো।
    “মণির মা , আজ ওষুধে কাজ দেয় নি।”
    “ কী করবি?”
    “ডাক্তার ডেকে ইঞ্জেকশন দিতে হবে।”
    “ ডাক্তার কই পাবি?”
    “ওষুধের দোকান খোলা আছে। বুড়ো ডাক্তারকে ডাকতে হবে।” বুড়ো ডাক্তার বস্তির মানুষের চিকিৎসার শেষ উপায়। কোনওডিগ্রিধারী নয়। ইন্দু ফার্মাসির মালিক আগের দিনের কলকাতার এম বি বি এস ডাক্তার রজনীকান্ত শইকিয়ার সঙ্গে থেকে সেই ছেলেবেলা থেকে বহুদিন থেকে কাজ শিখে ওর ডাক্তার হওয়া। অবশ্য এই বুড়ো ডাক্তারকে শহরের কেউ ডাকে না। জোনের মা তাকেই ডাকতে চাইছে।
    “এই ক’টা টাকা।” সে হিসেব করে দেখল চারখানা দশটাকার নোট ওর বাক্সের তলায় পড়ে আছে।
    “আঙটিটা বিক্রি করব।”
    “কার কাছে?”
    জোনের মা সামান্য ভাবল। এবারে ভেতরের গিয়ে আবার এলো।
    “ও মানুষজন চিনতে পারছে না আজকাল। সামান্য আগেও বিড়ির কথা বলছিল, এখন বিড়িটাও চাইল না। এবারে বুড়োকে আমি বাঁচাতে পারব না।”
    “তুই দেখি সবসময় বলিস, কিছু একটা হবে। এমন ব্যস্ত হয়েছিস কেন?”
    “ আমার সঙ্গে ড্রাইভারণীর ওখানে যাবি?”
    “ড্রাইভারণীর ওখানে?” মালতীর লজ্জা করছে।
    “ও ছাড়া সোনারা আংটি কিনতে পারার ক্ষমতা আছে কার?”
    জোনের মা আংটিটা হাতে নিয়ে ছেলেমেয়েকে বাবার কাছে থাকতে বলে মালতীর হাত ধরল। “চল, মণির মা আমি একা ড্রাইভারণীর ওখানে গেলে কাল আর বস্তিতে মুখ দেখাতে পারব না।”
    মালতী মুখে কিছু বলল না, যাবার জন্যেও উঠল না।
    “চল মণির মা, কেউ কিছু বলবে না। আমরা এতোদিন ধরে বস্তিতে আছি, আমাদের লোকে চেনে না?”
    সে যেতে রাজি হলো।
    ড্রাইভারণী বাড়ির চার-সীমা উঁচু উঁচু চাটাইর বেড়াতে ঢেকে দিয়েছে। পাকা ঘরের সিঁড়িতে পা দিতেই ড্রাইভারণী বেরিয়ে এলো।
    “আয়, আয় জোনের মা।” এমন করে ডাকল যেন এরা দু’জন প্রায়ই আসে আর কি। কুশন দেয়া চেয়ারে বসতে দিয়ে সে রত্নাকে ডাকল।
    “রত্না কি এখানে থাকে?”
    “থাকে না, টিভি দেখতে এসে আমার এটা ওটা করে দিয়ে একটু সাহায্য করে দেয় আর কি। যা তো রত্না, চা দু’কাপ আন।”
    রত্না দু’কাপ দুধ দেয়া চা, বিস্কিট, দু’রকমের মিষ্টি দু’টো প্লেটে দিয়ে গেলো।
    “খা, এই মিষ্টি আমার মামা এনেছেন। সোনার জিনিস বানাবার দু’খানা দোকান আছে তাঁর, বিশাল অবস্থা। গরীব ভাগ্নিকে দেখতে এসেছেন। মামার হাতের সোনার জিনিস দেখ। ড্রাইভারণী হাত দু’খানা তুলে ধরল। দুটো দুটো চারটা বালা চিকচিক করছে।
    রত্না তামোল দিয়ে গেল।
    “মামা ডাকছেন।”
    ড্রাইভারণী উঠে গেল। উঠে যাবার সময় ওর পায়ের পায়েল জোড়া ঝুনঝুন করে সঙ্গে গেল। যেন সে এখনি কোথাও বেড়াতে যাবে।
    “চল, জোনের মা, যাই গে’।” মালতীর কেন যেন ভালো লাগল না। ভেতরে, মানে তারা যে কোঠাতে বসেছে তার কাছের কোঠাতে ড্রাইভারণীর খিলখিল হাসি শুনতে পেলো। মালতীর নজরে পড়ল কাপড় একটাতে ঢেকে রাখা বেতের রেকে সারি সারি মদের বোতল। বস্তির লোকে বলে আর্মির ক্যাম্পের থেকে সস্তাতে মদ এনে ড্রাইভারণী বেশি দামে বিক্রি করে ভালো পয়সা করেছে।
    “চল , জোনের মা।” কেন যেন ওর এক মিনিটও থাকতে ইচ্ছে করল না।
    “ দাঁড়া না, আংটিটা দিয়ে যাই।”
    হ্যাঁ, এখানে ও এসেছিল কেন সেটাই ভুলে গিয়েছিল। ভেতরে ড্রাইভারণী কারো উপরে রাগ করেছে, ওর টনটনে গলাতে নয়, গলা ছোট করে।
    সামান্য সময় দু’জনে বসে রইল।
    “রত্না,” হিসপিস করতে করতে জোনের মা রত্নাকেই ডাকল। ড্রাইভারণী বেরিয়ে এলো।
    “এই আংটিটা রাখ, বুড়োর বড় অসুখ।”
    ড্রাইভারণী আংটিটা হাতে নিয়ে দেখল। সে আজকাল বস্তির মানুষের অলংকার বন্ধকে রাখে। নেড়ে চেড়ে দেখে সে বাঁকা হাসি একটা হাসল।
    “এতো পেতলের আংটি, সোনার জল ছিটিয়ে দিয়েছে।”
    জোনের মা সেলাইর খেপ মারবার মতো আংটিটা ড্রাইভারণীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলে উঠল, “চল।”
    ড্রাইভার ভেতরে আসছিল। আসছিল মানে এসেছেই। একটা ছেলে ধরে ধরে নিয়ে আসছে। লোকটার কাপড়ে চোপড়ে কাদা।
    “কই পড়েছিল, শুয়োরটা?” ড্রাইভারণীর গলা এবারে চড়া, টনটনে।
    “চুপ কর বেটি!” ড্রাইভারের জিহ্বা কোনও মতেই ঘুরতে চাইছিল না মুখের ভেতরে।
    “ বাগানে ভাড়া মারতে গিয়ে লাইনে পড়ে ছিল।” ছেলেটি ড্রাইভারকে বাইরের বিছানাতে শোয়াতে চাইছিল।
    “নে, শুয়োরটাকে বাইরের কল পারে নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখ। দে জল ছিটিয়ে দে গে’। তুলে আনলি কেন ওকে? পড়ে মরে থাকতে দিলি না কেন?”
    বমি আর দেশি মদের গন্ধে ঘরটা ভরে গেছে।

    রাস্তাতে পা দিয়ে এরা দু’জনে শ্বাস ফেলল। জোনের মা পাকা রাস্তা ধরে হাঁটা দিল।
    “কই যাবি?”
    “আর্মি ক্যাম্পটা পার করে রিজার্ভ পাবার আগে সোনারির দোকান একটা আছে। বুড়োর ঘরটা দোকানের পেছন দিকে। চল তো দেখি, ওখানে যাই।”
    জোনের মা আজ কোনও কারণে আজ একা ঘোরাফেরা করতে চাইছে না। ওকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াচ্ছে। যাবে না বলে সে বলি কী করে?
    বুড়ো সোনারির বাড়ি থেকে বেরিয়ে জোনের মা মাথায় কপালে হাত দিয়ে রাস্তাতেই বসে পড়ল।
    “হলো কী? সোনারিও কি একই কথা বলল?”
    জোনের মা ওর দিকে সামান্য তাকিয়ে জোরে পা চালালো। লম্বা উঁচা মহিলাটির লম্বা লম্বা পা ফেলার সঙ্গে মালতী পেরে উঠে নি। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মানুষটি মিলিয়ে গেল।
    “মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।” নিজেকে নিজে এই কথা বলে সে বাড়ির দিকে পা চালালো। মণি এলো কিনা তার ঠিক নেই। চাবি ওর হাতে।
    ঠিকই মণি এসে দাঁড়িয়ে আছে।
    “মা, কই গেছিলি? কী হয়েছে শুনিস নি?”
    “কী হয়েছে?”
    “ দুই পার্টির মধ্যে গুলা-গুলি। ওরা গিয়েছিল পয়সা ডিমান্ড করতে, অন্য পার্টি টের পেলো। ডিমান্ড করা পার্টির সঙ্গে তো আর্মি থাকেই। অন্য পার্টির সব ক’টা লাশ হয়ে গেল।”
    “কী হবে এখন?”
    “ বন্ধ খুললেই হয়তো কার্ফিউ দেবে। দিনকাল বড় খারাপ। কই গিয়েছিলি? বেরোবি না। কখন কী হয় বলতে পারি না।”
    সে মণির দিকে তাকালো। কখন যে সেই ছোট ছেলেটা ওর মাথার উপরের মানুষটা হয়ে গেল। হাসি একটা দিয়ে ও ভাতে লাগল গিয়ে।

    বিকেলে মিনতির সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত ছিল, জোনের মা এলো। মাত্র এক বেলাতেই মানুষ একটা এমন বদলে যেতে পারে? কেমন যেন হয়ে গেছে ও। কোমর অব্দি ভেজা, চুল এলো মেলো, কপালের আধলির মতো ফোটা গলে একাকার, চোখ দু’টো গোল গোল।
    “কী হলো, জোনের মা?” মিনতি হা-হুতাশ শুরু করল।
    জোনের মা এসে কালী বুড়ির থানে ধপাস করে বসে পড়ল। তারপরে লম্বা হয়ে পড়ে দণ্ডবৎ করল।
    “আমাকে আজ মা কালী দেখা দিয়েছে।” জোনের মায়ের গলা আগের মতো সজীব আর ফুর্তিবাজ নয়, কিসে যেন চেপে ধরেছে ওর গলা।
    “মা কালী দেখা দিয়েছে?”
    “ কী বলছিস , জোনের মা? কী হয়েছে তোর? চল কাপড় পালটে হাত মুখে ধুয়ে নিবি।”
    “আমি মাছ মারতে গিয়েছিলাম। নদীর পাড় ধরে যাচ্ছিলাম। সে যে হেলে পড়া বাঁশের ঝাড় একটা আছে, সেখানে মা কালী বসে ছিলেন।” সে আবার মাটিতে পড়ে দণ্ডবৎ করল। মা কালী নেমে এলেন আর এই দিক দিয়ে মা আমার মধ্যে ঢুকে গেলেন।” পা দুটো ফাঁক করে নিজের গোপনাঙ্গ সবার সামনে উন্মুক্ত করে দিল। “মা কালী আমার পেটে। দেখ আমার পেটে মা কালী।”
    জোন এসে মাকে দেখে কেঁদে ফেলল, “মা বাবা বিছানাতে পায়খানা করেছে।”
    জোনের বোন তাতে যোগ দিল, “তিন বার পেচ্ছাব করেছে।”
    জোনের মা দাঁড়ালো, “আমাকে একটু কাঁচা দুধ দিতে পারবি? আমার খিদে পেয়েছে।”
    মিনতি আর মালতী ধরে ধরে জোনের মাকে বাড়ি নিয়ে গেল। ভেতরে হেগে মুতে চ্যাপটা হয়ে মানুষটা মরে পড়ে আছে।
    সব সময় যা হয়, বস্তিতে হুড়ো হুড়ি পড়ে গেল। পাঁচ টাকা, দু’টাকা , আট আনা করে পয়সা তোলে মানুষটাকে নদীর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হলো।
    “কাঁচা দুধ নিয়ে আয়।”
    “কালা পায়রা এক জোড়া মাথা ছিঁড়ে আন।”
    “কলা দিয়ে সাগু মেখে দে।”
    “ মিষ্টি আর দুধ আন।”
    “মা কালীর খিদে পেয়েছে।”
    “মা খিদেতে কষ্ট পেলে তোদের শাপ দেবে।”
    ক্রন্দনরত ছেলে মেয়ে, লাকড়ি দিতে নিয়ে যাওয়া স্বামী, এখনো আধা বাকি থাকা লম্বা বন্ধটা, গতকালকের গোলমাল সবকিছুর ঊর্ধ্বে থেকে জোনের মা হুংকার দিচ্ছে, “কাঁচা দুধ...কলা...সাগু...মিষ্টি...কালো পায়রা...।”
    সত্যি সত্যি কেউ একজন একটা থালাতে কলা মেখে সাগু কিছু দিয়ে রেখে গেল। জ্বলে গেল একটা প্রদীপ, রাখা হলো ধোঁয়া ছড়ানো ধূপদান একটা, পায়ের কাছে রেখে গেল কালো একটা পায়রা।
    কণ্ঠ নালীতে মোচড়ে পায়রাটার রক্ত পানরতা জোনের মাকে দেখে মালতী পালিয়ে বাড়ি চলে এলো। টিউব কলের পাড়ে বসে সে হু হু করে কাঁদতে শুরু করল। বারে বারে ওর সামনে আসা যাওয়া করছিল এক লম্বা, তেলে পিছল কালো চামড়ার হাসিমুখো মহিলা, কপালে আধলির সমান সিঁদুরের ফোটা একটা।
    মহিলাটি গায়ের জোর লাগিয়ে ড্রাইভারণীকে চেপে ধরেছে, মিনতিকে তাড়া করে এসেছিল যে টনটনে গলার ড্রাইভারণী, সেই তাকে।
    মাড়োয়াড়ি বুড়ো দোকানীর ঢং দেখিয়ে মহিলাটি ওর ধবধবে সাদা দাঁত বের করে খিলখিলিয়ে হেসে বলছে, “ অনেক কিছু নিয়ে যাবি রে!”
    মহিলার স্বরটা ভিজে উঠেছে, “মরদের টান, বড় টানরে... শ্বাস টানতে থাকে, গালি পাড়তে থাকে মানুষটা...তার গলা সামান্য শুনলেই...বুড়োটা যদি না থাকে...।”
    মহিলা নরম বুকের শুকনো ঘায়ে হাত দিয়ে ছুঁয়েছে, “ আমার শরীরটা ওর মতো হাড় জিরজিরে হলেই আমার শান্তি হবে...কফে ভরা বুড়োর শরীরের কাছে আমার এই শরীর...” পাকা জামের মাটিতে গড়িয়ে পড়ার মতো মহিলা মালতীর শরীরে গড়িয়ে পড়ছে।
    কালো মহিলাটি ঘা খাওয়া আলদ সাপের মতো ঝাঁপ দিয়ে দিয়ে উঠছে, “ কেন লাগব না? কী করবে আমাকে? দা দিয়ে ঘা মারবে? আসুক , কয় ঘা মারে দেখি।”
    মহিলা চায়ের পয়সা দিচ্ছে, “মাথার উপরে পুরুষ থাকা মহিলা আমি।” কালো মুখখানা হাসিতে উজ্জ্বল।
    এই মুখটাও হাসিতে উজ্জ্বল, “ মরবো না, বেঁচে থাকব। কিছু একটা করে বেঁচে থাকব। নিশ্চয় কিছু একটা করে বেঁচে থাকব।”
    কালো মহিলাটি বারে বারে আসে, মালতীর শরীরে একখানা পুরোনো কাপড় চাপিয়ে দেয়, তাকে দিয়ে যায় একখানা কাঁথা। যায় আর আসে। গায়ে দিয়ে যায় একখানা কাপড়ের উম। তারপর মেয়ে মানুষটি সোনারি বুড়োর বাড়ি থেকে বেরিয়ে মালতীর দিকে একবার বাঁকা চোখে তাকিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে গেল যে গেলই। মহিলাটি ফিরে এসেছে, উন্মুক্ত করে দিয়েছে ওর গোপন অঙ্গ। মুখখানা ওর পায়রা পাখির রক্তে লাল।
    মণি না আসা অব্দি মালতী কলপাড়ে বসে কেঁদেই গেল।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৫৩495503
  • অধ্যায় একত্রিশ (৩১)
    সকাল হতেই বস্তিতে হুলস্থূল লেগে গেল। সুমলা পাগলি রিজার্ভে পড়ে রয়েছে। রাস্তার থেকে সামান্য দূরে একটা শিশু গাছে তলায় ক্ষতবিক্ষত উলঙ্গ দেহটা পড়ে আছে। ওর শরীরে অত্যাচারের চিহ্ন স্পষ্ট। শুকনো স্তন-দুটোর জায়গাতে দু’টুকরো ঘা। শুকনো আমের মতো যোনীর জায়গাতে একটুকরো দগদগে ঘা। এক টুকরো রুটির জন্যে মিলিটারি ক্যাম্পের ধারে কাছে ঘোরা ফেরা করতে ওকে সবাই দেখে। সে মণির মায়ের পেছনে পেছনে এসে ক্যাম্পে যাবার রাস্তার গাছটার নিচে বসে পড়ে। বিকেলে মণির মা ফিরে না আসা অব্দি বসে থাকে। অনেকেই দেখে মিলিটারিদের কেউ কেউ ওর দিকে রুটি, কখনো বা বিস্কুট ছুঁড়ে দেয়। লোকের নজরে পড়ল রোজ যেখানে সে বসে থাকে সেখান থেকে সামান্য দূরে বাঁশঝাড়ের থেকে রিজার্ভের ওই শিশু গাছটার নিচে অব্দি গলগলে রক্তের ধারা। কেউ যেন এই পথ ধরে দায়ের কোপ দিতে দিতে একটা ছাগল নিয়ে গেছে।
    মালতী ঘরের কাজকর্ম সেরে মুড়ির টিন সাজিয়ে ভাবছিল গোটা রাত এই পাগলিটা ছিল কই। ঠিক তখন ঘটনা ঘটে। আগের রাতে সিঙের ছেলের বৌর ছেলে হয়েছে বলে একটা অনুষ্ঠান ছিল। তাকে ডেকেছিল। মণি তাকে নিয়ে যাবার জন্যে সিঙের লাল লাল ছোট গাড়িখানা নিয়ে এসেছিল। কোনও জিনিস নিয়ে যেতে পাঠিয়েছিল, সঙ্গে মাকেও নিয়ে আসতে বলেছিল। গাড়ি মণিই চালিয়েছিল। নরম বসার জায়গা, একটা গান বাজছিল। বাইরের এতো গরমের মধ্যেও ভেতরটা ঠাণ্ডা, মণিকে ওর অচেনা মনে হচ্ছিল। সিঙের ছেলের দেয়া লঙ পেন্ট-সার্টে ওকে বেটা ছেলে লাগছিল। সামনে একটা গরু পড়েছে, কুকুর একটা দৌড় দিল, একটা বাঁশের গাড়ি, একটি ছোট্ট মেয়ে দৌড়ে চলে এলো রাস্তাতে। কী অনায়াসে সে এই সব কিছু পেরিয়ে চলে এলো। গাড়িটা মণি অল্প আঁকা বাঁকা করে চালাচ্ছিল। সে বলেছিল, “মা , আমিও একটা গাড়ি নেব। কুলদীপের বাবা আমাকে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে দেবে। তুই আর কত মুড়ি বিক্রি করবি।” সে কিছু বলেনি, মণির পিঠে পড়ে থাকা এক গাছা চুল সরিয়ে দিয়েছিল মাত্র।
    রাতটা এই ভালো লাগার অনুভূতির মাঝে মাঝে পাগলিকে মনে পড়েছিল। শেষ রাতের দিকে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছিল যে তাকে না দেখে নিশ্চয় মিনতি বা জোনের মায়ের বাড়িতে পড়ে আছে। খবরটা শুনে সে পড়ি কি মরি সেখানে গিয়ে পৌঁছুলো। দেহটা মিলিটারি কর্ডন দিয়ে রেখেছে। এক পলক দেখে ওর মাথাটা ঘুরতে শুরু করল। সে হেলে দুলে গিয়ে পথের পাশে বসে পড়ল। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল বুলেনের সেই স্বাস্থ্যবতী গোলগাল মেয়েটির একটা হাসিতে শান্ত হয়ে পড়া ক্রুদ্ধ মুখখানা। তার সেই মুখখানা বেড়ে বেড়ে যেন দশটা হয়ে গেল, মুখটা মানুষের, মাংসল হাড়ের তীক্ষ্ণ কুনোই থেকে বাকিটা এক একটা বাঘের থাবা, সেই থাবাতে এরা সুমলার শুকনো দেহটা চিরে চিরে খাচ্ছে। তার কানে স্পষ্ট বেজে উঠল কড়কড় করে হাড় চিবোনোর শব্দ। পুলিশ এসে সুমলার দেহটা গাড়ির পেছনে মালপত্র নেবার জায়গাতে তুলে নিয়েছে। লম্বা মানুষটি ভালো করে ঢোকেনি। কেউ জোর করে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কট করে একটা হাড়ের শব্দ হলো, মনে হয় পায়ের একটা হাড় ভেঙেই গেলো, উঠতে গিয়ে মণির মা কলকল করে বমি করে ফেলল।
    রিজার্ভে বস্তিতে পিল পিল করে ঘোরা ফেরা করতে করতে আর্মির লোকেরা বস্তির মানুষের জানাশোনা হয়ে গেছে। ওদের কেন্দ্র করে যেভাবে চারালিতে দোকান-বাজার গড়ে উঠেছে। সেভাবে বাড়ি বাড়ি মদের দোকানও বসেছে। বিশেষ করে ড্রাইভারণীর বাড়িতে দিনে দিনে মদের ব্যবসা ভালোই হচ্ছে। শুধু দেশীই নয়, সে ভালো জিনিসও রাখে। ওর নতুন ঘর উঠেছে, কালার টিভি, ফ্রিজ এসেছে। বাড়ির চারদিকে দেয়াল, তাতে ভাঙ্গা কাঁচ বসানো। সুদের ব্যবসাও বেড়েছে বেশ।
    নবীন ড্রাইভারণীর বাড়িতে কোনোদিন যায় নি। মিনতিকে নিয়ে একদিন যাবার জন্যে বেরুলো। সামান্য টাকা ধারে চাই, সুদে নেবে। অসুখে পড়ে থাকতে থাকতে ওর টাকাপয়সা সব শেষ হয়ে গেছে। গোলমালের মধ্যেই মাঝে মাঝে বাজারটা বসে। নতুন করে শুরু করতে হবে সব। মিনতি ওকে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল। ছেলের অসুখ, ঝাড়া তেল আনতে হবে। মিনতির দিকে একবার তাকালো সে, কত দুঃখই না সহ্য করছে মেয়েটি। ছেলেটার কী যেন হার্টের অসুখ আছে। বুড়ো ডাক্তার একবার বলেছিল। প্রায়ই ঝাড়া তেল, তাবিজের সন্ধানে ফেরা মেয়েটির জন্যে ওর মায়া হলো। এ ক’দিন সে কম করেছে কি নবীনের জন্যে? এই ক’দিনে সে টের পেয়েছে মেয়েটির মনে দগদগে ঘা। ঘা শুকোলে যেমন হয়, চামড়া কালো হয়েছে। কিন্তু অল্প ছোঁয়াতেই চামড়ার তলার গা-তে হাত পড়ে, আর সে আর্তনাদ করে উঠে।
    যাবে কি যাবে না ভাবতে ভাবতে সে ড্রাইভারণীর ঘরে ঢুকেই গেল। লাল শাড়ি, লাল চুড়ি, লাল ঠোঁট।
    বসেনি নবীন। সে টাকার কথা বলতে যাচ্ছিল। পুরো পরিবেশটাই ভালো লাগছিল না।
    “বস।” নবীন যে চেয়ারে বসেছে তারই হাতলে বসেছে। মদ খেয়ে পয়সা দিয়ে দিয়ে ছোট চুলের লোকগুলো চলে গেছে।
    কিছু না বলে ড্রাইভারণী ভেতরে চলে গেল। পোশাক পালটে এলো। হাতের নামে মিহি ফিতা দু’টো গায়ে ল্যাপ্টে থাকা নরম কাপড়ের জামা একটা পরে এসেছে সে। পিঠ আর বুকের একাংশ বেরিয়ে এসেছে। ফেনটা আরও জোরে চালিয়ে দিল।
    “ কী গরম পড়েছে গো!” বোতল একটার থেকে কী যেন নিয়ে সে ফ্রিজের থেকে বরফ বের করে তাকে দিল, “ খা, আজ প্রথম এলি, আমি ভাবতেই পারিনি তুই আমার এখানে আসবি বলে।”
    “ এই, মানে ড্রাইভার কই?”
    “এই মরাটার কথা আর জিজ্ঞেস করিস কেন? সে মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে।” একটা হাসি মারল, “ ও ওভাবেই থাকে।”
    “কেন?” জিজ্ঞেস করতে হয় বলেই করল। সে একটা কথাই ভাবছিল, টাকা কিছু ধারে চাইতে হবে।
    “কেন আবার?” বৌয়ের টাকাতে খেতে পায় যে । পুরুষ সে মৌজ করবে নাতো কী করবে আর?” হঠাৎ সে নাকি সুরে প্রায় কেঁদে ফেলেই বলল, “তোরা কী বুঝবি ও আমাকে কী অত্যাচার করে। রাতে মদ খেয়ে পড়ে থাকবে, গন্ধ, মাতালের নাকের থেকে বেরুনো গন্ধ শুনেছিস? শুয়োর কাটতে গেলে যেভাবে ডাকে সেরকম করে ডাকে ওর নাক। আমি পুরো রাত কাঁদতে থাকি।”
    কেঁদে কেঁদে সে মাথাটা ওর কাঁধে ফেলে দিল, “আমার জন্যে তোর কষ্ট হয় না?” এবারে সে পুর শরীরের ভার নবীনের উপরে ফেলে দিল।
    নবীনের রাগ উঠল,
    “কী করছ?”
    এবারে হাসল ড্রাইভারণী, “তুই আমাকে শহরের বাবুনিদের ডাকবার মতো ডাকছিস দেখি।” বলে হাসতে হাসতে সে নবীনের শরীরে গড়িয়ে পড়েছে।
    নবীন উঠে দাঁড়ালো, “আমি সামান্য টাকা দেবার কথা বলতে এসেছিলাম, সুদ দেবো।”
    “কত চাই?” কাজের কথাতে আসতে পেরে নবীনের ভালো লাগল।
    “দেবে? এই হাজার তিনেকের মতো।”
    “চল, তবে দিয়েই দিই। ভেতরে চল।”
    ভেতরের ঘরে শুধু একখানা বড় বিছানা। সে আলমিরা খুলে টাকা বের করল, “নে।” নবীন হাত মেলে টাকাগুলো নিলো। “এগুলো খা, নেশা হবে না, লেবুর শরবৎ।” নবীন ওকে অসন্তুষ্ট করতে চায় নি। খেয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝিনঝিন করতে শুরু করল।
    “যাই এখন।” টাকাগুলো নিয়ে যাবার জন্যে উঠল সে। টের পাচ্ছে কিছু একটা তার মগজ গ্রাস করে ফেলছে।কথাগুলো ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারছে না। হাঁটতে গিয়ে এমন মনে হচ্ছে যেন সে শূন্যে হাঁটছে , পা ফেলতে পারছে না। সে অনুভব করছিল কিসে যেন তাকে জড়িয়ে ধরেছে। তার শরীরে রুনুঝুনু করে বাজতে বাজতে একটা হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুরো শরীর জুড়ে অভূতপূর্ব এক তীব্র ভালোলাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছে। এই সব কিছুর মধ্যেও সে বুঝতে পারছে যা হচ্ছে ভালো হচ্ছে না। ড্রাইভারণীকে ঠেলে সে আবার দাঁড়ালো, “ আমি যাই।” ঠেলাটা মনে হয় একটু বেশিই হলো, মহিলা ধপাস করে পড়ে গেল। পড়ার থেকে উঠে সে সাপের মতো ফোঁস করে উঠল। নবীনকে এক গোঁতা দিল। তারপরেই বকে দিয়ে বলল, “ তুই একটা বাঁধা কপি, কী আছে তোর? সবই তো মিলিটারি থ্যাৎলে দিয়েছে। বেরিয়ে যা, দে আমার টাকা ঘুরিয়ে দে।” নবীনের হাত থেকে টাকাগুলো ছিনিয়ে নিয়ে নিলো সে।
    প্রায় অবশ মগজে সে অনুভব করল কেউ যেন চাবুক পেটা করেছে তাকে। কী বলে মহিলাটি? তাকে বলছে বাঁধা কপি? তার উত্তেজিত স্নায়ুতে অপমানের ভাবটা খানিক বেশিই হয়েছে। ওর ভেতরকার পুরুষমানুষটি অবসন্ন মগজে দপদপিয়ে উঠল। মিলিটারি তার সব থ্যাৎলে দিয়েছে! কী ভেবেছে মেয়েটি? এবারে সে ওর উদলা বাহু দু’টো ঝাঁকিয়ে দিল, “ কী ভাবছিস তুই? আমার কিছু নেই? আয়, দেখবি আয়।”
    ফিক করে একটা হাসি দিল ড্রাইভারণী, ফাঁদে পড়া শিকার দেখে শিকারির হাসি নবীনকে আরও উত্তেজিত করে তুলল।
    “দাঁত দেখাবার কী হলো? হাসছিস কেন তুই? কেন হাসছিস?” ভাঁজ না পড়া জিহ্বাতে একই কথা জিজ্ঞেস করতে করতে তার হেঁচকি এসে গেল।
    “ নে, খা।” ড্রাইভারণী তার দিকে এক গ্লাস চাল ধোয়া জলের রঙের পানীয় এগিয়ে দিল। টেবিলে ছিল একটা প্যাঁজ, কেটে দিল।
    “খা, আমাকে একটা আর্মি দিয়েছিল, বেশ দামি জিনিস।” সে এক ঢোকে খেয়ে ফেলল। আসলে তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।
    আবার হাসছে ড্রাইভারণী।
    নবীন আবার সেই একই কথা জিজ্ঞেস করতে থাকল, “কেন হাসলি? হাসলি কেন?”
    চুড়ির রুনুঝুনু শব্দটির সঙ্গে সঙ্গে একটা ভালো লাগার অনুভূতি তার শরীরে চরে বেড়াচ্ছে। মগজের শক্তি কমে আসছে, শরীরটা যেন জলাজমির থেকে উঠে আসা প্রকাণ্ড হাতির মতো উঠে আসছে, শক্তিশালী হচ্ছে। বারে বারে হুংকার দিচ্ছে।
    “লোকে মিথ্যে বলে।” মহিলাটির প্রতিটি শব্দেই খিলখিল হাসি।
    “ কী মিছা কথা”
    “তুই বাঁধা কপি হোস নি।”
    “কী বললি?”
    “লোকে যেমন বলে সেভাবে থ্যাৎলে দিতে পারে নি মিলিটারি।”
    “তুই কেন হাসছিস “ কেন হাসছিস? হাসছিস কেন?” সে একটাই কথা বলে যাচ্ছে বারে বারে।
    জলাজমির থেকে এক ধাক্কাতে উঠে এসেছে হাতিটা, বারে বারে হুংকার দিচ্ছে, তার চিৎকারে জল কাদা সব ছড়িয়ে পড়ছে, বিদীর্ণ করে ফেলছে বাতাস, চির চির করে ফেলেছে আকাশ।

    সকাল আটটা নাগাদ সবাই দেখল মাথা নিচু করে ড্রাইভারণীর বাড়ি থেকে বেরুচ্ছে নবীন । কথাটা জানাজানি হয়ে গেল। নবীন ড্রাইভারণীর ওখানে পুরো রাত কাটিয়েছে। সে গিয়ে নিজের ঘরে সেই যে ঢুকলো আর ঢুকলই, আর নাগাল পাওয়া গেল না।
    জোনের মা গেল, মণির মা, মিনতি, ফুলরাও গেল। কারো সঙ্গে কথা বলল না। সেই যে মানুষটা চুপ মেরে গেল, গেলই। কেউ দেখেছিল, ড্রাইভারণী ড্রাইভারের হাতে দিয়ে টাকাগুলো পাঠিয়েছিল। সে বুঝি ওর ঘরে ফেলে এসেছিল। সেই টাকাও নেয় নি নবীন।
    বাজারগুলো আবার নিয়মিত বসতে শুরু করেছিল। বন্ধ দিলেও আর্মি দরজায় দরজায় ঘা দিয়ে খুলিয়ে দিয়েছে। ছোট করে হলেও বাজার বসেছিল। লোকজন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। যে যা পারে জমিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছিল। চারদিকে গুজব ছড়াচ্ছে এক হাজার ঘণ্টার বন্ধ হবে। বন্যা এলে যেমন পিঁপড়েরা মুখে ডিম নিয়ে ছুটো ছুটি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মানুষজনও সেভাবেই করছিল।
    নবীন ঘরে ঢুকে আছে, না ব্যবসা শুরু করেছে এসব দেখবার কারো সময় ছিল না। এক হাজার ঘণ্টা বন্ধের একটা কালো ছায়া সবাইকে চেপে ধরেছে।
    ব্যাপারটি মিনতিই প্রথম দেখেছে। সকালে সে নবীনকে লাল চা আর মুড়ি দিতে গিয়েছিল। সেও আসলে নবীনকে ভালো করে দেখাশোনা করতে পারে নি। সময় পেলে এই একটু চা দিয়ে আসে গে’ । তাকেও এক হাজার ঘণ্টার বন্ধটা পাগলপ্রায় করে ফেলেছে। কী করে কী করবে? অন্য অনেকে মতো গুয়াহাটি চলে যাবে কি কিন্তু বেমারি ছেলেটিকে নিয়ে কী করে? যাই বললেই কি আর হলো? যায় কই? কই বা যাবে? এই ক’দিনে সে মশলা গুড়ো করে যতটা পারে বিক্রি করবার চেষ্টা করছে। কাগজের ঠোঙা বানাচ্ছে। মুড়ি ভাজছে। দুই হাতে যত পারে তত রোজগার করে রাখছে। নবীনকেই কেন, ছেলেটাকেও ভালো করে দেখতে পারে নি। যদি বিশ না হোক, দশ কেজি চালও উঠিয়ে রাখতে পারে।
    একটু অবসর পেয়ে সে সামান্য মুড়ির সঙ্গে লবণ চা নিয়ে নবীনের ঘরে গিয়েছিল। শরীরের তলাটা জবজবে রক্তে ভেজা সে পড়ে আছে। তার হুঁশ নেই। উলঙ্গ যৌনাঙ্গ থেকে গলগলে রক্ত বেরিয়ে আসছে। কাছেই একখানা ধারালো ছুরি। দু’টুকরো মাংস পড়ে আছে বিছানাতে।
    “নবীন তার আলু-বেগুন কেটে ফেলেছে রে!” চিৎকার দিতে দিতে সে রাস্তাতে চলে এলো।
    বস্তিতে হল্লা পড়ে গেল, নবীন আলু-বেগুন কেটে ফেলেছে। ডিম মুখে নিয়ে যাতায়াতে ব্যস্ত পিঁপড়েদের মধ্যে হুলস্থূল লেগে গেল। বুড়ো ডাক্তার, ইঞ্জেকশন, ঔষধ, ব্যান্ডেজ, মূর্ছিত নবীন।
    এক হাজার ঘণ্টার বন্ধ হবেই হবে। কালো ছাদটা তলায় নেমে এলো। সুস্থ হয়ে উঠা নবীনও চেনা বইয়ের দোকান থেকে ধারে বই নিয়ে বাজার ছাড়াও ফুটপাতে বসতে শুরু করল। কালো ছাঁদের করাল ছায়াতে ঢাকা পড়ে গেল দগদগে ঘা নিয়ে শিশু গাছের তলায় পড়ে থাকা সুমলা, ড্রাইভারণীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা নবীন, আলু-বেগুন কাটা, তার মরে মরে অবস্থা। সমস্ত কালো নেমে এসে ছাদটাকে ঢেকে ফেলল।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৫৩495502
  • অধ্যায় ত্রিশ (৩০)
    দুই একটা বন্ধ পার হয়ে গেছে যদিও কিছুদিন ধরে সব কিছু ঠিকঠাকই চলছে। বাজার বসছে, বেচাকেনা হচ্ছে, স্কুল কলেজ চলছে। শহরখানা ব্রহ্মপুত্র নদীর মতো হয়ে আছে। বাইরে শান্ত , ধীর; ভেতরে তীব্র স্রোত। তবু লোকে শ্বাস নিতে পারছে।
    নদীর তলার থেকে উপরে উঠে আসা ঘূর্ণির মতো হঠাৎই ঘটনাটা ঘটে গেল। শুক্রবারের বড় বাজারটা সেদিন দারুণ জমেছিল। হঠাৎই রেডিমেড কাপড়ের দোকানগুলোর কাপড়ের গাঁটগুলোর ভেতর থেকে একটা কান ফাটানো শব্দ পুরো বাজারটাকে কাঁপিয়ে দিল। পুরো বাজার মুহূর্তের মধ্যে কসাইখানার রূপ নিয়ে ফেলল। রক্ত, মাংসের টুকরো, ছেঁড়া হাত পা, নাড়ি ভুঁড়ির দম, মগজের বেরিয়ে পড়া তরল। হৈ হল্লা, কান্না। পলক না ফেলতে বাজারটি নরকে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। বোমাটা ফুটেছিল মণিহারী মাল বেচা-কেনার জায়গাতে। দশটা এগারোটার সময় বেশি ভিড় হয় মাছ-মাংস, শাক-সবজি বিক্রির জায়গাতে। কাপড়, মণিহারী মাল, দা-খুন্তি ইত্যাদি বিক্রির জায়গাতে ভিড় হয় বারোটা বাজবার পরে। মণিহারী জিনিসের দোকানগুলোতে সে সময় এমন যে একটা বেশি ভিড় হয়েছিল, তাও নয়। মাছ-মাংস-শাক-সবজি বাজারেই লোকে বেশি ঠাসাঠাসি করছিল। বোমাটা যদি এদিকটায় ফুটত তবে মানুষের মাংসের টুকরো ধান খেতের মাটির টুকরোর মতো দেখাতো। ওদিকটাতে হবার জন্যে মাংসের স্তূপের থেকে অক্ষত বা ছেঁড়া হাত-পায়ের দু’ই একটা মরা লাশ বা আধমরা কিছু মানুষ বের করে আনা গেল।
    যেখানকার দোকান সেখানে ফেলে বাজারের মানুষগুলো বস্তিতে ফিরে এলো। শূন্য বাজারটিকে মুহূর্তে মিলিটারি মালার মতো ঘিরে ফেলল। বস্তিতে ফেরার পথে পথে হাহাকার আর কান্না। ঠিক যেন এতোদিন ধরে বাসা করে থাকা গাছটিকে কেউ কেটে ফেলে দিল, ডিম বাচ্চা সহ বাসাগুলো এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল আর বাসা ভাঙ্গা পাখিগুলো? চি-চিৎকার করে, পাখা ঝাপটে পাখিরা বাতাস চিরচির করে ফেলল।
    মণি মায়ের খুঁজে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে স্কুল থেকে দৌড়ে আসছে। তার মায়ের চাদর কোথাও পড়ে গেছে, মুখে শুধু একটাই কথা, “মণি, মণি রে!” জোনের মা পায়ে ব্যথা পেল, বুড়ো আঙুলের নখ উলটে গেল। ফিনফিনিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। ও বলতেই পারে না।
    মিনতি এসেছে চুলের বেণী খুলে। ওর ছেলের কপাল ফুলে গেছে, ব্লাউজের হাত ফেটে শরীর দেখা যাচ্ছে।
    মীরার মা আসছে, শুধু খাঁচা একটাতে দু’টো মুরগি বুকে বেঁধে। সে কাঁদতে কাঁদতে আসছে। খেতির সময় এসেছে বলে মুরগিগুলো বেঁধে এনেছে বিক্রি করবার জন্যে। হুলুস্থুলুতে কোথাকার মুরগি কোথায় গেল ঠিক নেই। একটা পয়সা বাজে খরচ হলে যে বুক চাপড়ায় সে এতোগুলো মুরগি হারিয়ে পাগল হয়ে গেছে।
    শিবানীর মায়ের মোড়াগুলোর একটাও বাঁচে নি। সবক’টা চ্যাপটা হলো।
    নবীনের সাইকেলে করে বেঁধে নিয়ে আসা বইয়ের দোকান থেকে আধা বইপত্র পথে পথে পড়ে যাচ্ছে।
    ফুলের গরম মশলার একটাও প্যাকেট নেই।
    লাতুর মা এসেছিল সাদা একখানা ধুতি কিনবে বলে। পাই পাই করে পয়সা গুটিয়েছিল বেচারি। কোথাকার পয়সা কই পড়ল।
    দিনের পরে দিন, রাতের পর রাত হা ভাত, হা চাল, হা কেরাসিন, হা কাপড় করে হা হুতাশ করে ফেরা লোকগুলো প্রথমে জিনিসপত্রের হিসেব নিলো। কার মোড়া গেল, কার মুরগি, কার হাঁস। তারপর মানুষের হিসাব।
    বোমাটি যখন ফুটেছিল এদের বেশির ভাগই ছিল শাক-সবজি, চাল-ডালের দিকে। সেজন্যে অনেকটা বেঁচে গেল। বস্তিতে গিয়েই হিসাব বেরুলো যে প্রায় সবাই বিনা বিপদে ঘুরে এসেছে। শুধু জগুর খবর বেরুলো না। সে নেই।
    জগুর অবস্থা বৌ মরবার পর থেকে বাড়ি ঘড় ছেড়ে দেবার মতোই। ছেলে-দু’টোকে কোথাও কোন গ্যারেজে হোটেলে দিয়ে মানুষটা এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়। বেমারি মহিলাটি ফাটা কাঁথার দলাতে যদ্দিন পড়েছিল, তদ্দিনও ছেলেগুলোও গ্যারেজ হোটেল থেকে ঘরে ফিরে আসত, স্বামীও এসে ঘরে ঢুকত। জগু নারকেল নাড়ু আর সন্দেশের দোকান সেই কবেই ছেড়ে দিয়েছিল। বৌ যদ্দিন দুর্গন্ধময় ফাটা কাঁথার মধ্যে পড়ে থাকত তদ্দিনও সে লাল চা আর বন বিস্কুটের দোকান দিয়েছিল। বৌ মরবার পরে সে সেসব বাদ দিয়ে মদের ধান্দা শুর করল। সে সময় ও ড্রাইভারণীর বাড়িতেই পড়ে থাকত। প্রায় চাকরের মতো ছিল। শেষের দিকে চাকরই হয়ে পড়েছিল । মহিলাটি মদের বোতল আর গ্লাস চোখের সামনে নাচিয়ে ওকে দিনের পর দিন খাটিয়েছিল । শেষের দিকে মানুষটি নিজেও বেমারি হয়ে পড়ল। কাজ করতে পারছিল না, পেটের ব্যথাতে কোঁকাতে থাকল। তাকে তখন ড্রাইভারণী কেমন কিল লাথি দিয়ে বের করে দিয়েছিল বস্তির সবাই দেখেছে। কিছু দিন থেকে জগুকে দেখা যাচ্ছিল মণিহারী দোকানগুলোর সামনে ঘোরাফেরা করতে। কানুলাল একটা টুকরিতে লাল-নীল চুড়ি নিয়ে বসত, জগু গিয়ে তার পাশে বসে থাকত। বাগানের আদিবাসি মেয়েরাই মূলত তার গ্রাহক ছিল। নতুন বাগানের মেয়েরা আগের মতো লাল পাড়ের হাঁটু অব্দি শাড়ি পরে আসে না। ওদের অনেকের বাড়িতেই সুন্দর সব সোফাসেট, স্যান্ডেল খুলে ঢুকতে হয়। বোনাসের টাকাতে এরা সাইকেল কেনে, পরে আসে কামিজ-চুড়িদার। সব কিছু সময়ের সঙ্গে পালটে গেলেও পাল্টায় নি তাদের কাঁচের চুড়ি-প্রীতি। কানুলাল মেয়েদের চুড়ি পরাতো, আর জগু বসে বসে তাই দেখত। মিনতি, জোনের মায়েরা কখনো কখনোবা ওকে কানুলালের কাছে বসে থাকতে দেখে হাসি মস্করা করত। ফুলই মনে হয় বলেছিল, না মীরার মা বলেছিল জগুর বৌ যখন বিয়ে করে এসেছিল হাতে প্রচুর লাল নীল সবুজ বালা পরেছিল।
    বোমাটা ফুটেছিল কানুলাল যেখানে বসে আর তার পাশে হার-দুলের হরিনারায়ণের দোকানের মাঝখানে। কসাইখানার চেহারা নিয়েছে জায়গাটা, মিলিটারি কর্ডন করে ফেলবার পরেও সবাই দেখেছিল চারদিকে ছড়িয়ে আছে ভাঙ্গা কাঁচের চুড়ি। লাল টুকরো কয়টা গিঁটে আটকেছিল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা একটা হাতের মাংসে। সবুজ কয়েক টুকরো পড়ে রয়েছিল লালচে মাংস এক টুকরোর উপরে। এক দলা নাড়ি ভুঁড়ির মধ্যে পাক খেয়ে পড়েছিল হলদে কাঁচের চুড়ি, ভাঙ্গে নি, ফাটে নি, গোল একখানা চুড়ি। ফুল, জোনের মায়েরা জানত জগুর বৌ নতুন বৌ হয়ে যখন ছিল বেশির ভাগ সময়ই পরত ঐ হলদে রঙের চুড়ি।
    জগুর দেখা আর কেউ পেল না।
    রাতে লোকগুলো ঘুমোয় নি। এখানে ওখানে জটলা করে বসেছিল। সবার বুকে নরমাংসের এক একটা কসাইখানা, মনগুলো ডুবে গিয়েছিল শুকিয়ে চড়চড়ে রক্তের দলাতে। নীরব বস্তিতে সন্ধে সাতটাতেই বিরাজ করছিল এক অদ্ভুত নীরবতা, অনেকেই দোয়ারে বেন্দা দিয়ে ভেতরে বসে রয়েছিল। কারো চুলোতেই আগুন ছিল না। চিঁড়া মুড়ি যা পেয়েছে তাই গিলে লোকগুলো পড়ে আছে। পারাপক্ষে তারা একসঙ্গে থাকতে চাইছে। কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। বাচ্চাগুলোও কান্নাকাটি করে নি। শুধু বস্তির প্রায় সবাই শুনেছিল একটি মেয়ে মানুষের গলা, “ভাত দে না, ওই আমি ভাত খাবো তো... দে ভাত দে।” অস্বাভাবিক গলাটা সবার পরিচিত। এ সুমলা, বুলেনের পাগল বৌয়ের গলা। বুলেন আজকাল বাড়িতে প্রায় থাকেই না, এলেও আসে রাতে। ছেলেই যা পারে মায়ের করে দেয়। সুমলা খেরের মতো শুকিয়ে গেছে। নবীনের বাড়িটা বুলেনের কাছেই। নবীন প্রায়ই চিৎকার করলে ওকে ভাত একমুঠ দিয়ে আসে।
    ভাত , ভাত করে মেয়ে মানুষটির চিৎকারের মাঝে মাঝে হঠাৎ শোনা গেল গাড়ির শব্দ, ভারি বুটের শব্দ। কী হয়েছে বুঝবার আগেই মিলিটারি পুরো বস্তি ঘিরে ফেলল। মিলিটারি কেন বস্তিতে এসেছে সবাই বুঝতে পেরেছে। ভাঙুয়ার ছেলে টাইগার আর বুলেনের জন্যেই বস্তিতে মিলিটারি এসেছে। লোকে টের পেলো মিলিটারির দলটা প্রথমে বুলেনের ঘরের দিকই গেছে। ওরা যখন বুলেনের ঘরে গিয়ে ঢুকল তখন সুমলা ভাত খাচ্ছিল। ওর চিৎকারে থাকতে না পেরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নবীন আলু একটার সঙ্গে ভাত একমুঠো দিয়ে বসিয়েছিল। নবীন ভাবছিল ওকে ভাতগুলো খাইয়ে সে বিছানা নেবে। তার এখন এসময় আর কিছুই ভালো লাগছিল না। সুমলা মাটি-বালিতে একাকার করে ভাতগুলো খাচ্ছিল। নবীন কাছেই মোড়া একটাতে বসে ঘুমে পড়ে যাচ্ছিল। প্রচণ্ড এক লাথিতে সে বসার থেকে ছিটকে পড়ল। তারপরে সে টের পেল আরেকটা সোজা লাথি পড়েছে ওর দেহের গোপন অঙ্গে। যন্ত্রণায় কোঁকিয়ে সে পড়ে গেল। চোখে আঁধার দেখতে শুরু করল। কেউ একজন বস্তির মধ্যি দিয়ে তাকে ছ্যাঁচড়ে নিয়ে গেল। বস্তির লোকে দেখতে পেল নবীনের দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে রক্তের একটি ধারা মাটিতে পড়ে পড়ে যাচ্ছে।
    বন্ধ না দিয়েই সব বন্ধের মতো হলো। চারদিকে কেবল মিলিটারি। বস্তিতে যখন তখন আর্মি আসে। টাইগার আর বুলেনের বাড়ি দু’খানা মিলিটারিতে ছন্নছাড়া করে ফেলেছে। হরি ভাঙুয়া আর ওর বৌ সেই কবেই গ্রামে চলে গেছে। সুমলার দিকে তাকানো যায় না। সকালে যদি ওকে উঠোনের কাঠ-লিচু গাছে বাঁধা দেখে সবাই জানে রাতে বুলেন এসেছিল। সে অনবরত ভাত ভাত বলে চেঁচাতে থাকে, ওর গলাটাও বসে গেছে। বুকের শ্বাসের সঙ্গে ভাত শব্দটা এমন ভাবে মিলে মিশে বেরিয়ে আসে যে লোকে ভাবে সে কাঁদছে। যেদিন কাঠ-লিচুর গাছে বাঁধা থাকে না, সেদিন সে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ফেরে। পেটিকোট একটা পরে কোনও এক বাড়িতে গিয়ে ঢোকার পথে বসে থাকে। ভাত সামান্য দিলে অনেকক্ষণ ধরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেয়ে তারপর সেখানেই শুয়ে থাকে। বুলেন কোনও এক ফাঁকে এসে ছেলেটাকে নিয়ে গেল। সুমলাকেও যে বেঁধে রেখেছে তেমন নজরে পড়ল না। সে আপন মনে বস্তির বাড়ি বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়।
    বেশির ভাগ সময়ই সুমলা মণিদের বাড়িতেই থাকে। কী করে যেন বোঝে যে এখানে একটি মেয়ে মানুষ আছে যে তাকে ভালোবাসে। বোমাটা ফোটার পর থেকে মণির স্কুল প্রায় বন্ধ হবার মতোই। এমনিতেও কিছুদিন থেকে ওর স্কুল অনিয়মিত হচ্ছিল, সিঙের গ্যারাজে যাওয়াটাই নিয়মিত হচ্ছিল। একদিন সকালে মণিকে নিয়ে যেতে সিং নিজে এসেছিল। লম্বা-উঁচা গড়নের মানুষটি মায়ের সামনে মণির গুণগান করেছিল। ওর হাতযশের কথা বলছিল, আর বলছিল কত কম সময়ে সে কত ভালো গাড়ি চালাতে শিখেছে। এই কথা বললেই ওর কলজে শুকিয়ে যায়। কেনই বা ওকে গাড়ি চালাতে শিখতে হবে? ভীষণ ভয় করে ওর। কখনো বা ইচ্ছে করে বলে, যাবি না তুই সিঙের গ্যারেজে। পারে না বলতে, আজকাল এই মণির হাতখানার জন্যেই বাজার বন্ধ থাকলেও ওর চুলো জ্বলতে থাকে। কখনো বা গাড়ি স্কুটার নিয়ে কিছু লোক এসে মণিকে বাড়ি থেকেই ডেকে নিয়ে যায়। সে শুনেছে মণি হাত দিলেই বুঝি গাড়ির কল কব্জার কোথায় কী হয়েছে টের পেয়ে যায়। সিং মণিকে চলবার মতো টাকা পয়সাও দেয়। মালতীর অবসর সময় তাই ভরে পড়েছে সুমলাকে নিয়ে। শিশুর মতো মেয়ে মানুষটি। ওকে কল পাড়ে নিয়ে গিয়ে ঘসে মেজে স্নান করায়, নিজের শাড়ি পরিয়ে দিলে তেল মাখিয়ে চুল আঁচড়ে দেয়। রোগা হয়ে পড়া মেয়েটিকে ইচ্ছে মতো এদিক ওদিক করানো যায়। স্নান টান করে, চুল আঁচড়ে, ভাত ক’টা খেয়ে সুমলা যেভাবে মনির মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে দেখলেই জলে ভেজানো কোমল চালের মতো মনের মানুষটি গলে যায়। কখনো বা ওর বুকে তোলপাড় করে, কী করে সইবে এই মন এতো সব দুঃখ? ভালোই হলো, সুমলার মন একটা ভাঙ্গা রেডিওর মতো হয়ে গেছে। হাজার টেপাটেপি করলেও গানের সুর আর বাজবে না। ছুঁড়ে ফেলে আরো ভেঙ্গে ফেললেও কিছু নেই। অনায়াসে কাঠ-লিচু গাছ একটাতে বেঁধে রাখা যায়। কখনো বা শুয়ে পরা সুমলার কপালে হাত দিয়ে গুনগুনিয়ে উঠে মালতী, “ বারীতে বগরী রুব...”১
    সুরটা শুনলে সুমলা এমন হেসে উঠে যেন দাঁত না উঠা শিশু কন্যা সে।
    নবীনকে মিলিটারি ধরে নিয়ে গেছে এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। কী করেছিল মানুষটি? ভাক ভাত করে চেঁচানো একটি মেয়ে মানুষকে ভাত দিয়েছিল। বস্তির মানুষের মুখে মুখে গড়াচ্ছে বিচিত্র সব খবর, সত্যি মিথ্যা কেউ জানে না। নবীনকে উলটো করে বেঁধে রেখেছে, পুরো শরীরে গরম জল ঢেলে দিয়েছে, শরীর ফুলে ফুলে গুটি বসন্তের রোগীর মতো দেখাচ্ছে। আরেকটা কথা চুপি চুপি শোনা যাচ্ছে, নবীনের আলু-বেগুন মিলিটারি থ্যাৎলেই ফেলেছে। খিদে আর ভয়ে মানুষটি কুঁকড়ে গেছে। কী অন্যায় করেছিল বই খাতা বিক্রি করে পেটের ভাত জোগাড় করে যে ঠাণ্ডা ছেলেটি? বুলেন না হয় জংলি পার্টিটিতে গিয়ে ঢুকেছে, নবীর তার স্ত্রীকে ভাত একমুঠো দিল বলে কোন আইনে শাস্তি পাবার মতো অপরাধ হয়ে গেল?
    খিদেয় মরা মানুষগুলো বেশিদিন বিড়বিড়িয়ে থাকতে পারল না।একদিন সকালে সবাই বস্তির থেকে বেরুবার রাস্তার মুখে জড়ো হলো। কে কী বলল, কে লোকগুলোকে ডেকে আনল, কী করেই বা মানুষগুলো জড়ো হলো কেউ জানে না। শুধু জড়ো হয়েছে এরা, এটাই সত্য। সে যেন একটা বর্ষার কালো মেঘে ঢাকা আকাশ। এখনই গুড়গুড় করে মেঘ গর্জন করবে, বিজলি ছুটবে, বজ্রপাত হবে, শিলাবৃষ্টি হবে। ধুইয়ে নেবে ধরণী, কালো মেঘের দলা একটা মতো লোকগুলো মিলিটারি ক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছুলো। মহিলারা গিয়ে ঢুকল। পুরুষেরা বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি ঘণ্টা প্রায় পরে একদিনে মালতী আর দিকে মিনতি ধরে ধরে নবীনকে ক্যাম্প থেকে বের করে আনল। পোকে ধরা বেগুন গাছের ডগার মতো ঝর ঝরে হয়ে পড়েছে মানুষটি। পা ফেলতে পারছিল না। এদিক ওদিক করে থাকতেই লাতু একখানা ঠেলা নিয়ে এসে হাজির হলো। ঠেলাতে উঠতে মানুষটির কষ্ট হচ্ছিল। কাছে থেকে দেখেছে যারা টের পেল নবীনের যৌনাঙ্গ ফুলে গেছে। বাইরে বাইরে বুড়ো ডাক্তারকেও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে এরা নবীনকে বাড়িতে নামিয়ে দিল। বুড়ো নবীনকে ঔষধ দিল, চিকিৎসা করল। নবীনের বিশৃঙ্খল, নির্জন ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার সময় সবাই লক্ষ্য করল বুড়ো ডাক্তারের চোখে জল ছলছল করছে। বাইরে জড়ো হয়ে আছে একই বর্ষার কালো মেঘের মতো কালো মানুষের দলা।
    “ মানুষটাকে দেখবি, ভালো হবে সে, বুড়ো ডাক্তারের ঔষধ পড়েছে।” কথাটা বলে ডাক্তার চলে গিয়েছিল।
    যে যেভাবে পারে নবীনকে দেখে রাখছিল। যারা পারে তারা একে ওকে দেখেই রাখে, তবু কখনো বা কারো ভাগে বেশি করে পড়ে। মণির মায়ের ভাগে সুমলা , মীরার মায়ের ভাগে জোনের মা। সেভাবেই নবীনের ভাগ বেশি করে পড়ল মিনতির হাতে। সে নবীনের সেবা যত্ন করতে বেশি বেগ পেল না, নবীনের পয়সা কড়ি কিছু ছিল।
    মণির মায়েরই মাঝে মধ্যে কষ্ট হচ্ছিল। সুমলার পুরো দায়িত্ব সে কী করে নেয়? হাত ছাড়া একখানা মুখকে কে কী ভাবে সামাল দিতে পারে? কারই বা এতো শক্তি আছে? উপায় না দেখলে সুমলাকে অন্যের উঠোনেও বসবার জন্যে ছেড়ে দেয়। মণিও একদিন বিরক্তি প্রকাশ করেছিল। প্রায়ই ভাবে কাঠ-লিচু গাছের নিচে বেঁধে রেখে আসবে। শিশুর মতো হাসিটা দেখলে আর পারে না সে। দুপুরে ভাত খাবার সময়, রাতে শুবার সময় বুকখানা ধড়ফড় করে উঠে , কই বা মেয়েটি! কিছুদিন থেকে ও চোখের আড়াল হলেই সে ধড়ফড় করে উঠে। কই বা আছে? কী বা হলো? ব্যাকুল হয়ে সে মেয়েটির সন্ধানে যায়।
    সেদিন ঘরে চাল ছিল না। খুদ ক’টা বসিয়ে মণিকে আলু কিছু ভর্তা করে খেতে দিয়ে সে সুমলাকে নিয়ে বসেছিল। মণি মুখে কিছু বলছিল না। বোমা ফোটার আজ দশদিন হয়ে গেল। একটা বাজার বারও বসে নি। সে হাতের চালগুলো ভেজে মুড়ি করে বাঁধা ক’ঘর গ্রাহককে দিয়ে যা কিছু টাকা পয়সা পেয়েছিল সেসবও সেই কবেই শেষ। মণিকে সিং যা দিচ্ছে তাতেই মা-ছেলের চলে যায়। কিন্তু হাত-হীনা মুখখানা? ছেলের ক্লান্ত মুখখানা দেখে সে ঠিক করল, কাল একে লিচু গাছের তলাতে বেঁধে রেখেই আসবে। যা হয় হবে, ওর একটা মানুষ আছে না?
    এসব ভাবতে ভাবতেই আধা রাত পেরিয়ে গেল। চোখ সামান্য বুজে আসছিল কি, দোয়ারে টোকা পড়ল,
    “বৌদি, এই বৌদি, উঠ না ।”
    “কে?”
    “আমি, বৌদি।”
    সে দরজার বেন্দা খুলে দিল। বুলেন ভেতরে এলো। শরীরে ওর মিলিটারির পোশাক। কোমরে বন্দুক, পিঠে বন্দুক। সে নিজেই দরজাটা বন্ধ করে দিল।
    “এই নে।” মালতীর দিকে একটা টাকার বান্ডিল এগিয়ে দিল। খসমছ করে বের করে দেয়া নোটগুলোর কয়েকটা পড়ে গেল। সুমলা একটা ধারাতে পড়ে ঘুমোচ্ছিল। বহুদিন পরে স্বামী বুলেনের গলা শুনে দেশী কুকুরের মতো কোঁ কোঁ করে গুটি গুটি করে ওর দিকে এগিয়ে এলো। বুলেন ওর দিকে একবার তাকালো। মণির মায়ের পরিয়ে দেয়া ম্যাক্সিটা সুমলার আবর্জনাবৎ শরীরে ঝুলে আছে। শুকনো, ঠাটা পড়া স্তনগুলো ওর ঝুলঝুলে চামড়াতে পাক খেয়ে বসে থাকা বিছের মতো দেখাচ্ছে। রসকষ নেই এমন দুটো লাকড়ির মাঝখানে পোকাতে ধরা ধরা আমের মতো দেখাচ্ছে ওর যোনীদেশ। কালো বেগুনি সামনা ছেঁড়া ম্যাক্সিটি ওর শরীরে শকুনের কালো পাখনা দুটির মতো ধপ ধপ করছে। কোঁ কোঁ করে সে বুলেনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক যেন হামাগুড়ি দিয়ে শিশু একটি মায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সে হাত দুটি ওর দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। বুলেন পকেট থেকে আরো কিছু নোট বের করছে। মণির মা দোয়াতের বাতিটা জ্বালাচ্ছে। আলোতে এবারে সে বুলেনকে স্পষ্ট দেখতে পেল, ওর চেহারাটা আগের থেকে ভালো হয়েছে। নবযুবকের মতো আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে তাকে। শরীর কঠিন আর পেশীবহুল হয়েছে। রোমের জ্যাকেটটার জন্যে ওর কাঁধ আর বুক আরো সুঠাম দেখাচ্ছে। সুমলা এবারে হাঁটু ভাজ করে ওর পায়ে ধরেছে গিয়ে। বুলেন এবারে ওর দিকে তাকালো। ওর চোখে সামান্য সময়ের জন্যে খানিক মায়া দেখা গেল, পর মুহূর্তেই তার ভোগের সুস্পষ্ট ছাপ পড়া মুখে আনাচে কানাচে ফুটে উঠল লুকোতে ব্যর্থ তীব্র এক ঘৃণা। মণির মা হঠাৎ দেখল সুমলা ওর যৌনাঙ্গ ধরে ঠাপাচ্ছে। মণির মায়ের শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল ক’বছর আগের দেখা দৃশ্য একটি। বুলেনের কোনও এক কথাতে রাগ চড়েছিল। তখন সুমলা সামান্য সুস্থ ছিল। কখনো বা বুলেনের জন্যে ও নিজেই ভাত রান্না করতে পারত। ওর শরীরটাও তখন ভরা ছিল। সেদিনও সে কোঁ কোঁ করে বুলেনের কাছে যাচ্ছিল আর বুলেন শক্তপোক্ত মাংসপেশি আর গটমট হাড়ের কঠিন হাতে ওকে ঠেলেঠুলে দূরে পাঠাচ্ছিল। সুমলা তখন বুলেনের পরনের গামছা ফাঁক করে যৌনাঙ্গ ধরে ঠাপিয়েছিল। মণির মায়ের বিকল হয়ে পড়া মগজে বুঝেছিল সুমলার ধোঁয়াসাময় দুনিয়াতে ভাতমুঠো জোগাড় করে দেবার মানুষটার আসল চাবিকাঠিটি কই। সেদিন মণির মা ছেঁড়া ফাটা আজিয়ে রাখা দোয়ারের ফাঁক দিয়ে এই দৃশ্য দেখে শুধু চোখের জল ফেলেছিল।
    আজ কিন্তু বুলেন সেই কটমট হাড়ের হাতে নয়, পায়ে পরে আসা জুতোতে সুমলাকে ঠেলে দিচ্ছে। মালতী, মালতী নয় ফেলানি, ফেলানির নামের মধ্যেই কুয়োর মধ্যে ঝপাং করে ভারি জিনিস একটা পড়ার শব্দ লেগে আছে। সে একটা সূর্যমুখী লংকার মতো সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো। সুমলার হাত ধরে বুলেনের কাছে থেকে সরিয়ে উঠিয়ে দিল। সুমলা কোঁকিয়ে উঠল। ফেলানি আবার ওকে শোবার বস্তাতে নিয়ে গিয়ে ফেলল। তারপরে বুলেনের সামনে গেল। লংকা গাছের ডগার মতো থরথর করে কাঁপছে সে, চোখগুলো যেন রাগে ফেটে পড়বে। মাটিতে পড়ে থাকা নোট গুলো তুলল।
    “এই নে, তুই পাগলিকে দেখে রেখেছিলি, তোর অনেক কাছে আসবে।” নোটগুলোকে দলা পাকিয়ে নাড়ু করে বুলেনের মুখের উপর ছুঁড়ে মারল সে। তারপর তার মুখে থু থু দিল। , “শালা! পুরুষ জাত! তোরা শুধু জানিস মেয়েদের গরম গরম মাংস খেতে। মাংসের লোভই তোদের আসল কথা। মাংস শুকোলেই তোরা মেয়েদের নিংড়োনো কুশিয়ার করে ফেলে দিস।” সে জোনের মায়ের মতো উরুতে এক থাপ্পড় দিয়ে বলল কথাটা, “তোদের মাংসের লোভ, রাজ্যের লোভ, টাকার লোভ। কোত্থেকে এতো টাকা পেলি? কোথায় পেলি? মানুষ মেরে এনে টাকা দেখাচ্ছিস।” হাতের শেষ নোটগুলোও সে তার মুখের উপরে ছুঁড়ে ফেলল, “ পুরুষ হতে এসেছিস! বৌর শরীর শুকিয়েছে বলে ওকে গাছে বেঁধে রেখে চলে যাবি, টাকা দিয়ে পরের হাতে সমঝে যেতে তোর খারাপ লাগল না? তুইও যা, তোর মানুষ মেরে নিয়ে আসা টাকাও নিয়ে যা।” আবার সে তার মুখে থু দিল। সে পা নাড়িয়ে বন্ধুকটা হাতে তুলে বলল,
    “কথাটা ভালো হবে না বলে দিলাম। আমি আগেই বুঝছিলাম, তুই তোর ওই কোঁচ স্বামীকে ভুলতে পারিস নি।” মুখে তার মদের গন্ধ।
    “বেরিয়ে যা , আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা।”
    একটা মেয়ে এসে ঢুকল। নিজের ভাষাতে ওকে কিছু একটা বলল। বাতির তেল ফুরিয়ে যাচ্ছিল।, ফাটা কাপড়ের সলতেটা ভমভম করে জ্বলে উঠে পুরো ঘরটা আলোকিত করে ফেলল। আলোতে মেয়েটি জিলকে উঠল। বেটে স্বাস্থ্যবতী চেহারা। মুখখানা গোল, ফল বাকলের মতো মাংসল তেলতেলে পিছল মুখটা চিকচিক করছে। পরনের কাপড় কলসের মতো গোল, পাকা মিষ্টি কুমড়ার মতো বুকখানা ঢাকতে পারে নি। গায়ের রং বুলেনের মতোই। সে এসে বুলেনের পিঠে হাত দিয়েছে। বুলেন ফিরে তাকালো। ওর রাগ অভিমান নিমেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। মুখে ছড়িয়ে পড়ল হাসি। মেয়েটি ওর হাত ধরে নিয়ে গেল। মেয়েটি দরজা অব্দি গিয়ে আবার ফিরে এলো।
    “টাকাগুলো রাখ । এক হাজার ঘণ্টার বন্ধ হবে। তখন না খেয়ে মরবি।”
    সে আবার উরু চাপড়ে বলল, “নিয়ে যা তোদের পাপের পয়সা। দিয়ে যা বন্ধ, মারতে থাক মানুষ। পারলে বাঁচব, নইলে মরব।”
    ওর হাতপা গুলো জ্বলছে, বুকটা ধড়ফড় করছে। একটা পাথর যেন বারে বারে ওর বুকটা চেপে ধরেছে। তার চিৎকার করবার ইচ্ছে হচ্ছিল।
    “বোকার মতো বলবি না। সে বলেই পাগলিকে পয়সা দিতে এসেছে। আর কেউ হলে আসত না।” মেয়েটি আবার টাকা দিচ্ছিল।
    “আসতে হবে না। আমি পারলে ওকে খাওয়াবো, নাহলে মারব।” কেন যেন মেয়েটির উপর ওর বড় রাগ চড়ছিল। সে হঠাৎ বলে দিল, “তুই এই বৌ থাকা মরদটাকে ভর করেছিস কেন?”
    “ ও বুঝি ওর বৌ?” মেয়েটির মুখের বাঁকা হাসি দেখে ফেলানির শরীর পুড়তে শুরু করল।
    মেয়েটি বেরিয়ে গেছে। সে চিৎকার করে উঠল, “তুই ওদের চিনিস নি। ওদের হাতে মানুষের রক্ত লেগে আছে।
    রক্তের স্বাদ পেলে মানুষের ভীষণ লোভ হয়। মেয়ে মানুষের মাংসের লোভ, টাকার লোভ, রাজ্যের লোভ, লুটে পুটে খাওয়ার লোভ; ওকে লোভে পেয়েছে।” মণির মা হাঁপাচ্ছিল। ভেতরে সুমলা পাগলি হাঁটুতে মাথা গুঁজে হিক্কা তুলে তুলে কেঁদে চলেছে। মণি কোনোদিন না দেখা মায়ের রণচণ্ডী মূর্তিটা দেখে তাকিয়ে আছে।
    “ ও মা, কী হয়েছে তোর?” মণির গলাতে ভয়।
    মালতীর চোখজোড়া তখনো গোল গোল হয়ে আছে। ছেলেকে কথাটা বলতে গিয়েও ওর স্বরে ধেনো লংকার ঝাল থেকে গেছে, “ তোকে যদি এই লোভীগুলোর সঙ্গে দেখি, বলে রাখলাম আমি, মাকে আর পাবি না।”
    “আমি কেন যাব?” মণি অবাক হলো।
    “হ্যাঁ, যাবি না। পারিস যদি কাজ করে দু’মুঠো খাবি, না পারলে উপোস থাকবি। লুটপাট করে খেতে যাবি না। আমি বলে দিচ্ছি।”
    মণি এই আধপাগলি মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। কী হয়েছে আজ মায়ের? সুমলা কোঁকিয়ে কোঁকিয়ে ছ্যাঁচড়ে ছ্যাঁচড়ে মালতীর দিকে এগিয়ে এলো। মণির মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। পুড়ে যাওয়া চোখজোড়াতে দু’ফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল।

    টীকা:
    ১) অসমিয়া ঘুম পাড়ানি গানঃ বিছরাতে বড়ই রুবি.../বাগানে বপন করবি কুল...
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৫৪495504
  • অধ্যায় বত্রিশ (৩২)

    “মণির মা, ওই মণির মা!”
    মাঝরাতে মিনতির ডাক শুনে মালতী বুঝতে পারল, ছেলেটি বা ওর সঙ্গীগুলো এসেছে।
    “আয়।” সেই একই দৃশ্য। সে দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে মুখ কালো ছেলেটি।
    “ভাত খেলি?”
    “হ্যাঁ।”
    ভাত যদি খেয়েছে তবে ছেলেটি নিজেই এসেছে। সে না এলে সে ভাত-টাত না রেঁধে ঘরটা এমনিই ওদের ছেড়ে দিয়ে চলে আসে। সে এলে গরম জলে সেবা আত্তি করে, ভাত খাইয়ে তবে আসে। আজ নিশ্চিত সে এসেছেই।
    “সে এসেছে?”
    “হ্যাঁ।”
    “ও বুঝি জেলে ছিল?”
    “ছিল, ওরা ধরে নিয়ে যাওয়া লোকগুলোকে ছেড়ে দিয়েছে তো।”
    “ছেড়ে দিয়েছে না মেরে ফেলেছে? কয়লা খনিতে কাজ করতে আসা মানুষটাকে এরা মেরে ফেলে নি? ওর স্ত্রী সেই কোন বিদেশ থেকে এসে ঝাড়-জঙ্গলে স্বামীর সন্ধান করে ফিরেছিল। মানুষ মারে যে তার সঙ্গে তোর কী সম্পর্ক?”
    “লোকটাকে ওরা মারে নি। লোকটাই বরং এদের মানুষজনকে মেরে চলে যাবার সময় নদীতে পড়ে মারা গেল।”
    “তুই তো ওর কথাই শুনবি।”
    মিনতির মুখখানা উজ্জ্বল। একটা হাসি মুখে ছেয়ে আছে। ওর এই মুখখানা দেখলেই মণির মায়ের শরীর জ্বলে উঠে। কিসের এতো দরদ ওই ভিখিরিটার প্রতি? কী পেয়েছে মিনতি তার থেকে?”
    “মণির মা তোর রাগ উঠেছে। আমি জানি। কিন্তু সে এলে আমার বড় ভালো লাগে। আজ কতদিন পরে এলো ও।”
    মিনতির মুখে আলো।
    “তুই ওকে বিছানাতে উঠিয়েছিস? সত্যি করে বল।”
    মিনতি চুপ করে রইল।
    “সে একা এসেছে না সঙ্গী আছে?”
    “একাই এসেছে। পাহাড় থেকে নেমেই এরা রিজার্ভে এসেছে। সে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। এখন চলে যাবে।”
    “ওঠালি কিনা বল , ওকে বিছানাতে?”
    “এই গায়ে সামান্য হাত দিয়েছে, বিছানাতে উঠাই নি।” মিনতি আবার হাসছে।
    “সে এবারে একেবারে এসেছে। সারেন্ডারি হবে।”
    “সে কি তোকে বলেছে যে এবারে তোকে বিয়ে করবে?”
    “বলেছে।” মাথা নত করে জবার দিল মিনতি।
    “আমি তোকে বলে রাখছি তোর সব শেষ হবে। তুই জ্বলে পুড়ে মরবি। এগুলো মরলেও ভালো ছিল। মরে না কেন কোথাও গুলি খেয়ে? মেয়েটির শান্তি হতো।”
    “ওভাবে বলবি না, মণির মা।”
    “বল তুই, তোদের সবার হিংসে। এমন ফিল্মি হিরোর মতো চেহারা, সে তোকে ভালোবাসে, বিয়ে করবে, সবার হিংসা। বল, চুপ করে আছিস কেন? বলে যা, এমন মানুষদের দিকে আমরা চোখ তুলে তাকাতে সাহস করিনা। সে করবে তোকে বিয়ে! বল।”
    মিনতি চুপ করে রইল।
    “সারেন্ডার করলে ও থাকবে কই?”
    “শুরুতে ওর বাড়িতে, পরে নিজের বাড়ি করবে।”
    “নিজে বাড়ি করলে তোকে নিয়ে যাবে, বলেছে? না, বলেনি? বুঝলি মিনতি, তুই জ্বলে মরবি। আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিস তুই।”
    ছেলেকে নিয়ে এলে রোজ যে পাটিতে শোয় সেটি আরেকটু মেলে দিয়ে শুয়ে পড়ল মিনতি । মালতীও ওর পাশে শুয়ে পড়ল।
    “মিনতি, তুই সত্যিই ভাবছিস সারেন্ডার করে এলে ও তোকে বিয়ে করবে?”
    “করবে, মণির মা। সেই আশাতেই জারজ ছেলেকে বুকে বেঁধে নিয়ে এতো কষ্ট করে যাচ্ছি।” মণির মায়ের দিকে মুখ ফিরে বলল, “ ওর মনটা তোর বরের মতো সাদা রে, তোরা ওকে ভুল বুঝিস না।”
    “তোকে পয়সা পাতি দিয়েছে কি?”
    “দিয়েছে।”
    “ কিছু লুকিয়ে রাখতে দিয়েছে? কী এনেছে সঙ্গে?”
    “যা ও এনেছে, সবই জমা দেবে এবারে। অনেক টাকা আছে, সেগুলোও দেবে।”
    “ড্রাইভারণী দেখেছে কি ওকে?”
    “দেখেছে। ওই মহিলা সব জানে। সে জন্যেও ও আমাকে তোষামোদ করে চলে। নইলে কি আর আমি ওখানে থাকতে পারতাম?”
    চাদর পিছলে গিয়ে মিনতির ফর্সা শরীর বেরিয়ে পড়েছে। বেড়ার উপরের যে অংশ লেপা হয় নি সেখান দিয়ে চাঁদের আলো বাঁকা করে এসে ওর গায়ে পড়েছে। স্পষ্ট দেখা গেলো, ঠিক মাঝখানে একটা গোল লাল দাগ। ঘুমোয় নি সে। ছটফট করছে।
    “কী হলো তোর?”
    মিনতি চুপ।
    হঠাৎ কেঁদে ফেলল। নীরবেই। অনেক পরে পরে কান্নার সেই শব্দ দাঁতের কামড় ভেদ করে বেরিয়ে আসছে।
    হঠাৎই কালীবুড়িকে মনে পড়ল মালতীর। মিনতিকে কাঁদতে দেখলে বুড়ি কী বলত? সূর্যমুখী লংকার মতো শুকনো বুড়ির চোখে এতো বছরে এক ফোটা জলও দেখে নি সে। কান্নার শব্দ চেপে রাখতে পারে নি মিনতি। মণির মা যেন নিজের পিঠে অনুভব করছিল অশ্বত্থ পাতার মতো হালকা কালীবুড়ির স্পর্শ।
    মিনতির গায়ে হাত রাখল সে, “শুন মনটা এতো তাড়াতাড়ি নরম করবি না। এমন মনে দাঁত নখ বসানো সহজ বুঝলি? কালীবুড়ি আমাকে কী বলত, জানিস? মেয়েমানুষকে মেম লংকার মতো হতে হয়। দেখতে এইটুকুন, চোখমুখে পড়লে আগুন দিতে পারে।”
    মিনতি তাকে জড়িয়ে ধরল, “তুই কি পেরেছিস মণির মা, তোর মনে জ্বালিয়ে দেবার মতো ঝাল এনে গোটাতে?”
    “পেরেছি। না পারলে ছেলেটা আর আমি সেই কবেই শেষ হয়ে যেতাম। শুয়ে থাক, তুইও পারবি। দাঁত নখ পড়লেই মনটা ঝালে ভরে পড়বে।”
    “অমন করে বলবি না, তার দাঁত-নখের কথা বলবি না।”
    ধরাধরি করে দু’জনে সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়ল।

    হবে কি হবে না করতে করতে এক হাজার ঘণ্টার বন্ধ আরম্ভ হয়ে গেল। বস্তি প্রায় খালি। প্রায় সব পুরুষমানুষ যেসব এলাকাতে বন্ধের প্রভাব পড়েনি সেসব অঞ্চলে চলে গেছে। আগের বারের তিনশ ঘণ্টার বন্ধেও চলে গিয়েছিল। এবারেও মেয়েদের অনেকেও চলে গেছে। যারা আছে তারা ওই আর্মি ক্যাম্পের কাছাকাছি বসা বাজারটিকে খামচে ধরেছে। যে যা পারে সেখানেই বেচাকেনা করছে।
    মীরার মা এবার মন দিয়ে মিষ্টি কুমড়ো লাগিয়েছিল। সবাই দেখে সে কুমড়োগুলোর যত্নআত্তি করছে, কখনো বা বিকেলে বোলতার থেকে কলিগুলো বাঁচাবার উপায় করছে, কখনো বা চাং থেকে ঝুলে পড়াগুলোকে বাঁচাতে বাঁশের খাঁচা একটা বানিয়ে দিচ্ছে, কখনো বা হাওয়া-পানি ভালো করে ঢোকবার জন্যে গাছের গুড়িগুলো একটু খুঁচিয়ে দিচ্ছে। বাচ্চা কোলে করবার মতো মাটিতে হওয়া কুমড়োগুলোর তলাতে আলতো করে দিচ্ছে খের নতুবা কলা গাছের বাকল। এখন রোজই সে শুকিয়ে রাখা পাকা মিষ্টিকুমড়ো গুলো চিলতে করে কেটে কেটে ক্যাম্পের কাছের বাজারে বিক্রি করছে, শাকে-ভাতে ওর দিন চলে যাচ্ছে। মণি সিঙের গাড়ির ড্রাইভার হলোই বলতে পারি। গাড়িটা কোথাও যাবার আসবার হলে সেই আনা-নেয়া করে। তার উপরে গ্যারেজে পুরো মাইনেতে খাটা লোকের মতোই কাজ করে। মা বসে বসে মোড়া বানাতে থাকে। আগের মতো বাঁশ, প্লাস্টিকের রশি খুঁজে খুঁজে হয়রান হতে হয় না। সেই সব জোগাড় করে দেয়। বিকেলে তারও দুই একটা নিয়ে গিয়ে বাজারে বসে। কখনো বা বিক্রি হয়, কখনো বা হয় না। নাহলে নেই। এ কি আর মুড়ি যে নরম হয়ে যাবে? আজ নতুবা কাল বিক্রি হবেই। সে বড় নিশ্চিন্ত আজকাল। মা মোড়া বিক্রি করতে গেলে বা মুড়ি ভাজতে বসলে খারাপ পায়। এমন দেখলেই সে বলে, গাড়ি একটা নেবে, কাজ কর্ম হচ্ছে, মারুতি ভ্যান একটা নেবে। ট্যাক্সি চালাবে। মাঝে মধ্যে মায়ের খারাপ লাগে। ছেলেটার পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হলো। চোখা বুদ্ধির ছেলে ছিল। বুদ্ধিটা আছে বলেই সে চালাতে পারছে সংসার। বস্তির কারই বা লেখাপড়া হলো? বুকটা ধড়ফড় করে উঠে তার।
    মিনতি আর জোনের মা আচার বানাতে বসেছে। মিনতি তেল মশলার পয়সা দিল। ওর হাতে বা আর পয়সা থাকে কই? পয়সা থাকলেই সে গিয়ে ছেলেকে বুড়ো ডাক্তারের কাছে দেখিয়ে আসে। না থাকলে তেল ঝাড়ার সন্ধানে বেরোয়। ছোট ছোট প্যাকেটে আচার বানিয়ে দু’জনে বিকেলে ক্যাম্পের কাছের দোকানে বসে গিয়ে। কিছু বিক্রি যে হয় না নয়।
    ফুল আবার মদের কারবার ধরেছে। সে বানায়। বুড়ো দর্জি বাইরের ঘরে বিক্রি করে। অনেক মানুষই মদ খাবার থেকে ফুলের সঙ্গে ইয়ার্কি মারতে যায়।
    রত্নার মা যে বাড়িতে যা কাজ পায়, তাই করে। বাসন ধোয়া, সুপারি তোলা, কাপড় ধোয়া যা সামনে আসে তাই করে। মানুষটি বড় রোগা হয়ে গেছে, বুকে সারাক্ষণ একটা ধুকপুক লেগেই থাকে। রত্না ড্রাইভারণীর বাড়িতে চাকরানি হবার মতোই হলো, বাড়িটাতে যাওয়া ছাড়তে বললে সে ছাড়ে না। বিছানা ছেড়েই সে ওই বাড়িতে যাবার জন্যে পাগল হয়ে যায়। যত দিন যাচ্ছে বাবার একটা ছেলের জন্যে হা-হুতাশ বেড়েই চলেছে। মেয়ে দু’টো আর মাকে আজকাল শত্রু জ্ঞান করে।
    বন্ধটা পুরো বস্তিকে অজগর সাপের মতো গিলে ফেলেছে। অজগরটা পড়ে আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় মরা, এই গলতে শুরু করবে , গন্ধে থাকা যাবে না। কিন্তু কাছে চেপে গেলেই বোঝা যায় সাপটা মরে নি, শুধু পড়ে আছে।
    সকাল সকাল সেই অজগরটাকে কে খুঁচিয়ে দিয়েছে। সাপটি কড়মড় করে উঠল। বিছানা থেকে উঠতে না উঠতে পুরো বস্তি জুড়ে হুলস্থূল। বাড়ি যাবার পথে বুড়ো ডাক্তারকে দু’টো সাইকেল চেপে আসা ছেলে গুলি করে মেরে চলে গেছে। ডাক্তার ফার্মাসির থেকে আসছিল। একেবারে কাছে থেকে গুলি করেছে। পথের পাশে জমানো পাথরে মানুষটি গড়িয়ে পড়ল। অনেক টাকা ডিমান্ড করেছিল বুঝি। শহরে একজনও ডাক্তার নেই। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারেরা সপ্তাহে দু’তিনদিন আসে, কখনো বা আসেই না। সরকারি কোয়ার্টারগুলো সব খালি, ভেঙ্গে টেঙে গেছে। প্রত্যেকটা ঘরের উঠোন ভরে গেছে কচুরি পানা আর কচুবনে। পুরো শহর জুড়ে আজকাল এমন ঘর অনেক দেখা যায়। ফুলে ফুলে ভরে থাকা গাছগুলো ছেয়ে ফেলেছে স্বর্ণলতা , ফলের ভারে নুয়ে থাকত যে গাছগুলো সেগুলোকে চেনা অসাধ্য করে ফেলেছে কুচিলা লতা। এক সময় সৌরভ বিলিয়ে ফিরত কিন্তু এখন স্বর্ণলতার ভারে নিস্তেজ হলদে হয়ে এসেছে পুরো শহরটা। শ্বাস নেয়া কষ্ট, বাতাসে দুলতে পারে না, গ্রহণ করতে পারে না সূর্যের রং, ফুল নেই, সবুজ পাতা নেই, আছে শুধু একটা হাহাকার।
    বস্তির মানুষগুলোর ত্রাণকর্তা ছিল বুড়ো ডাক্তার। বস্তি খালি করে সমস্ত মানুষ গিয়ে পৌঁছুলো হাসপাতাল। পোষ্ট মর্টেম করার জন্যে বারান্দাতে শুইয়ে রাখা হয়েছে ডাক্তারের হলদে হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ দেহ। একই রকম আছে, সেই সাদা চুল, সাদা ভুরু, চোখের চশমা আছে। নাই শুধু মুখের হাসিটা, আশ্বাস ভরা কণ্ঠ, “অসুখ ভালো না হলে এই বুড়ো ডাক্তার চুল পাকালো কিসে?” মানুষের ভীড় বিকেল অব্দি বসে রইল। বিকেল প্রায় তিনটা থেকে শহরে গিজিগিজিয়ে থাকা পুলিশ মিলিটারির মধ্যে, সার সার বন্ধ দোকানগুলোর মাঝখানে যানবাহন শূন্য পথগুলো দিয়ে তারা বুড়ো ডাক্তারের শব দেহ নিয়ে শোভাযাত্রা করল। জোনের মা, মণির মা, মিনতি, মীরার মা, মাঝে মধ্যে বুকে ধরে ধরে রত্নার মাও পুরো রাস্তা হাঁটল। শ্মশানে যাবার সময় পুরুষ মানুষরা রইল, মহিলারা চলে এলো।
    বস্তিতে ফিরে আসার পথে সবাই লক্ষ্য করল, আজ ক্যাম্পের চারদিকে আর্মি হাতে বন্ধুক নিয়ে নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। ঠিক যেন বাঘ শিকার আলগে রেখেছে। সবাইকে মাঠে নামিয়ে দিচ্ছে। ক্যাম্পের সামনের রাস্তা দিয়ে কাউকে যেতে দেয় নি।
    রাতে চুপি চুপি খবর ছড়ালো যে ক্যাম্পে পড়ে আছে আগের বুলেন, এখনকার বাঘা টেররিষ্ট। কেউ একজন বলল শুধু সেই নয়, সঙ্গে আছে হরি ভাঙুয়ার ছেলে, এখনকার টাইগার। কেউ কেউ বলল, সঙ্গে আরও আছে। খবর জানা গেল, আজ রাতেই এদের সঙ্গীরা ডেডবডি নিতে আসবে। ওদের হাতে হাতে নানা অস্ত্র। কী করে যে বুড়ো ডাক্তারকে মারল! সার্টের পকেটের কাছে একটা সিগারেটের পোড়ার মতো দাগ শুধু, না আছে রক্ত, না আছে ঘা, ডাক্তারকে মারবার গুলিই অন্যরকম। শরীরে ঢোকে আধা ইঞ্চি গুলিটা রক্তধারার মতো ঘুরতে শুরু করে, যেদিকে যায় সেদিকেই জ্বালিয়ে যায়। ডাক্তার বুঝি দু’লাখ টাকা দিয়েওছিল, আরও পাঁচ লাখ টাকা চেয়েছিল। সংখ্যাগুলো বাড়ে কমে, তিন-সাত, এক-পাঁচ, চার-ছয়।
    পুরো রাত কেউ ঘুমোয় নি। পুরো রাত আর্মির গাড়ি যাওয়া আসা করেছিল। পুরুষ মানুষদের ডেকে ডেকে পাহারাতে লাগিয়েছিল। সকাল হতেই পাক্কা খবর বেরুলো। আর্মি তাড়িয়ে তাড়িয়ে গুলি করে মেরে আনা টেররিষ্টটা বুলেনই। তার হাতে আর্মি পিস্তল, বোমা পেয়েছে। বুলেনের ডেড বডি রাতারাতি ক্যাম্প থেকে গুয়াহাটি চালান দিয়েছে।
    ক্যাম্পের সামনে বসা বাজারটাও বন্ধ হয়ে গেল। শুধু খবর আর খবর। বস্তি আজ রাতেই জ্বলবে। একটা মানুষও বাঁচবে না। বুলেন মরার প্রতিশোধ এরা বস্তির উপর নেবে। শহরে দুটো বড় বোমা পেয়েছে, ফুটত যদি পুরো শহর শেষ হয়ে যেত। সত্যি-মিথ্যা নানান কথা। আগুনের ফুলকির মতো অনেক খবর বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে আসে। কোথাও দু’দল মানুষ বিভক্ত হয়ে এমন কাটাকাটি করল যে নদীর জল লাল হয়ে গেছে, মরা লাশে ভরে পড়েছে নদীর পাড়। লোকে শোনে আর বলে, “দেখতে থাক, আমাদের এখানেও হবে।”
    বন্ধের দশদিন পেরিয়ে গেল। রিজার্ভে কোনও একটা পাতা সেদ্ধ করে খেয়ে এক বাড়ির এক জোড়া ছেলে-মেয়ে মারা গেল, আরেকটা বাড়িতে বিষাক্ত ব্যাঙের ছাতা খেয়ে ছেলেটা মরল না অবশ্য, ডাক্তার বাঁচিয়ে দিল । প্রতিদিন ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকত এখানে। সামান্য গোবর, একটুকরো মিষ্টি কুমড়ো , একটা আলু নিয়ে হঠাৎ হঠাৎ ঝগড়া আরম্ভ হয়ে যায়। কিছু দিন থেকে এই ঝগড়া বিবাদগুলো হচ্ছে না আর। চারদিকে থমথমে নীরবতা। ক্যাম্পের বাজারটা বন্ধ হয়ে যাবার থেকে লোকগুলো সত্যি একটা অজগরের মতো পড়ে রইল।
    হঠাৎ যেন কেউ নেতিয়ে পড়ে থাকা অজগরের নরম শরীরে ধারালো কুঠার একটা বসিয়ে দিল। ফিনফিনিয়ে রক্ত বেরুলো। রক্তে ভরে পড়ল মাটি আর বাতাস।
    চিঠিগুলো দিয়ে গেল ফুলের স্বামী বুড়ো দর্জির হাতে। পিস্তল দেখিয়ে বলে গেছে না দিলে খুপরি উড়িয়ে দেবে। সকাল সকাল বাঁকা পিঠের এই বুড়োকে সবাই সবার বাড়ির দোয়ারে দেখতে পেল। চিঠিগুলোতে প্রত্যেকের থেকে ত্রিশ হাজার করে টাকা দাবি করেছে, নইলে বুড়ো ডাক্তারের দশা হবে। বুড়ো ডাক্তারের নাম নেই, কিন্তু ভয় সেই একই রকম দেখিয়েছে। বস্তির লোকগুলো সব যেন পাথর হয়ে গেল। কোনও বাড়িতেই দু’বেলা চুলো জ্বালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে, ‘ত্রিশ হাজার টাকা’—শব্দ ক’টা এই মানুষের একেবারেই অচেনা। সবাই ঠিক করল হরি ভাঙুয়ার ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। যোগাযোগ করতে গিয়ে জানা গেল টাইগারের নাগাল এরা পাবে না, কিছু একটা হয়েছে ওর। ওকে না পেলেও ওর তলার একটার সঙ্গে কথা হলো। ত্রিশের থেকে পাঁচে নামল। প্রথম কিস্তিতে দুই হাজার।
    জোনের মা বাগানের এক কোনে জমি নেবার সময় সঙ্গে পাওয়া একটা গাছ বিক্রি করল। টাকা পাঁচশ পেল।
    মীরার মা জমানো মিষ্টি কুমড়োগুলো বিক্রি করল, হাতের বালা দু’টো ছিল, সেগুলোও বিক্রি করল।
    মিনতি একশ টাকাও জোগাড় করতে পারে নি। পারে নি রত্নার মাও।
    নবীন যার থেকে বই পত্র নেয় তার থেকে তিনশ টাকা খুঁজে এনেছে। লাতুর মা তিন জোড়া কবুতর বিক্রি করল।
    রামু দোকানীর ব্যবসা আগের বন্ধেই পড়ে গেছিল, মূলটা খেয়ে ফেলে রামু এখন লাউ হাতে ফকির। সে দু’শো মাত্র জোগাড় করতে পারল।
    মণি সিঙের থেকে চেয়ে টাকা তিনশ এনেছে।
    কেউ সুপারি বিক্রি করল, হাঁস-মুরগি, ছাগল বিক্রি করল। ফলবান গাছও বিক্রি করল। কেউবা থাল –বাটি বিক্রি করে ফেলল।
    জনপ্রতি পাঁচ হাজার করে দাবি করা বস্তিতে সবার মিলিয়ে উঠল মাত্র পাঁচ হাজার। আরও পনেরো দিনের মধ্যে বাকি টাকা দেবার হুমকি দিয়ে সেই পাঁচ হাজারই নিলো।
    পুরো বস্তিতে এরা বুড়ো ডাক্তারকে মারা সেই বিদেশি আধা ইঞ্চি গুলিটাই চালিয়ে দিল। লোকগুলোর রক্তে গুলিটা ঢোকে চলতে থাকল। যে দিকেই গেল জ্বালিয়ে গেল। বুড়ো ডাক্তারের বৃদ্ধ দেহের মতো ওদের শরীর পাথরের বোঝাতে গড়িয়ে পড়বার মতো পড়াটাই শুধু বাকি।

    রাতেই খবর হলো। টাইগারদের পার্টিকে সরকার ডেকেছে, আলোচনা হবে, সুতরাং বন্ধটা উঠিয়ে দেয়া হবে। সকাল হতেই বস্তিতে হৈ হুল্লোড় পড়ে গেল। তাতে আবার আজ বাজারবারও। সমস্ত মানুষ বাজারে যাবার জন্যে লাইন লাগালো।
    জোনের মায়ের হাতে লেবু।
    মণির মায়ের হাতে মুড়া, রত্নার মায়েরও।
    মিনতির হাতে ঢেঁকি শাক।
    লাতুর মায়ের হাতে কাগজের ঠোঙা।
    ফুলের হাতে শুকিয়ে রাখা বাগানের তেজপাতা এক আঁটি।
    নবীনের হাতে বই ।
    রামু দোকানির হাতে পানি লাউ।
    গল্প করতে করতে চলমান মানুষগুলোকে দেখলে এমন মনে হয় যেন এরা রোজ এভাবেই হাসি ফুর্তি করে আসা যাওয়া করছে, কোনও দুঃখ নেই, সমস্যা নেই। যাতায়াত করছেই করছে। শুধু হাতের জিনিসগুলো বদলায়। মানুষ সবাই সেই একই আছে। একই চলন, হৈ হল্লা করে এর ওকে ডাক পাড়া, কিম্বা রাগে মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়া দুটো বাজে কথা, সামান্য কথাতেই হাসির ফোয়ারা, উঁচু গলাতে তর্কাতর্কি। সব একই থাকে। একই ছন্দে বাঁধা। শুধু হাতের জিনিসগুলো আলাদা হয়। মণির মায়ের হাতে মোড়ার বদলে মুড়ির টিন থাকে, লাতুর মায়ের হাতেও মুড়ির টিন উঠে, মিনতির হাতে গরম মশলার প্যাকেট, জোনের মায়ের হাতে বড়ই আচার। জিনিস সবারই বদলে বদলে যায়, কিন্তু হাত খালি হয় না। কিছু না কিছু নিয়ে মানুষগুলো আসা যাওয়া করতে থাকে।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৫৪495505
  • অধ্যায় তেত্রিশ (৩৩)
    সেদিন ছিল বাজারবার। বাজারে যাবার পথে লোকে দেখল রিজার্ভের কাছে বেশ কিছু চিকমিক গাড়ি, তার অনেকগুলোর রং লাল। গাড়িগুলো থেকে নেমে আসা ছেলেদের পোশাক আশাকগুলো সাধারণ মানুষের পরা কাপড় থেকে আলাদা। সঙ্গে কাজের লোক, গাছ কাটার যন্ত্রপাতি। বাজারে যেতে বেরিয়েছিল যারা তারা থমকে দাঁড়ালো। চোখের সামনে রিজার্ভের গাছগুলোতে করাত লাগল, কূঠারের ঘা পড়ল। নিঝুম অরণ্যে হৈ চৈ একটা পড়ে গেল। রিজার্ভের পাখিগুলো এমন অদ্ভুত ভাবে চিৎকার করতে শুরু করল, যে বস্তির মানুষও অবাক হয়ে ভাবতে বসল, এদ্দিন এই পাখিরা ছিলটা কই?
    জোনের মা, মিনতির মায়েরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে এসে ছিটকে পড়ল এক ঘুঘু পাখির জংলি কবুতরের বাসা। বাসাতে ডিম ছিল, আর দু’টো চোখ না ফোটা বাচ্চা। ওদের পায়ের কাছে ডিমগুলো ভেঙ্গে গেল, একটু সময় মাথা নাড়িয়ে বাচ্চাগুলো গেল মরে। অল্প সময় পরে এরা দেখল এক জোড়া পাখি এসে সেই জায়গাটা ঘিরে ঘুরে ঘুরে চিৎকার জুড়েছে। পাখির গলার স্বরে মাখানো কান্না এই ক’জন মেয়েমানুষের বুক চেপে ধরল। শুধু মিনতিকেই এই ভাঙ্গা বাসা, এই পাখিরা ছুঁতে পারল না। তার মুখে এক অপূর্ব আনন্দ। এই মুখটি ভালো করে চেনে শুধু মণির মা। ঠিক একটি সাদা বড় গাড়ির থেকে সে নেমেছে। যেন কোনও রাজা নেমে এসেছেন, সমস্ত মানুষের নজর পড়েছে গিয়ে তার উপরে। সঙ্গের ছেলেরা তার কাছে চেপে গেল। বিচিত্র রঙের একটা হাফপ্যান্ট পরেছে সে, নারকেল গাছ আর সূর্যের ছবি থাকা বুক খোলা একখানা সার্ট। রোদের জন্যে চোখে চশমা। লম্বা, সাদা, চোখা নাক, বড় বড় চোখের ছেলেটাকে ,মিনতি যেমন বলে, এই মুহূর্তে ঠিকই ফিল্মি হিরোর মতো লাগছিল। সে যেন এখনি একটা ঝর্ণার মধ্যেকার পাথরে বসে এক আধা ভেজা মেয়েকে পাশে নিয়ে গান গেয়ে উঠবে ।
    মণির মায়ের সেই পুরোনো রাগটা আবার চড়ছে। সে মিনতিকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “চল জলদি চল। এরা গাছ কাটবে, পয়সা করবে, আমাদের কি এসে যায়? চল, বলছি না?” সে হনহন করে হাঁটা দিল। পেছন পেছন বাকিরা। মিনতি ঘুরে ঘুরে পেছনে তাকাচ্ছে।
    বিকেলে যখন এরা বাজার থেকে ফিরে এলো, দুই ট্রাক কাঠ লোড করা হয়ে গেছে। রাস্তার কাছের এক টুকরো জায়গা খোলামেলা হয়ে গেছে। এরা রোজ যেমন রিজার্ভের কাছে এলে দাঁড়ায়, আজও দাঁড়ালো। কিন্তু অন্যদিনের মতো হাত পা মেলে বসল না। বেলা পড়ে এসেছে। একদল পাখি ফিরে এসে নিজেদের বাসা খুঁজে না পেয়ে ঘুরে ঘুরে চিৎকার করতে করতে কমলা রঙের আকাশটিকে চিরে ফেলছে যেন। পাখির চিৎকার বুকে বেঁধে এরা ক’জন ঘরমুখো হলো।
    দেখতে দেখতে রিজার্ভ খালি হতে শুরু করল। বস্তির বহু লোকও অন্য ধান্দা বাদ দিয়ে ওদের তলায় গাছ কাটার কাজে লেগে গেল। দেখতে না দেখতে রিজার্ভ শেষ হয়ে গেল। কেউ মাছের জন্যে বিশাল বিশাল পুকুর খুঁড়েছে। শুয়োর , মুরগির বড় বড় ফার্ম হয়েছে। এসব বুঝি সরকারি পয়সাতে হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী সারেণ্ডারীদের লক্ষ লক্ষ টাকা বিলিয়েছেন। খোলা রিজার্ভে নতুন বহু মানুষও এসে বসত করতে শুরু করেছে। একেবারে পাহাড়ের গা ঘেঁসে কিছু গাছ থেকে গেছে।
    সারেণ্ডারীরা বেশির ভাগই বিকেলের দিকে ড্রাইভারণীর বাড়ি মদ খেতে যায়। ড্রাইভারণী আজকাল রত্নাকে বিকেল অব্দি রেখে দেয়। পকোরি, চিংড়ি মাছ, মাংস ভাজতে হয়, গ্লাস ধুতে হয়। রত্না একদিন সামনে দিয়ে এক থালা পকোরি দিতে গিয়ে মিনতির রাজকুমারকে দেখতে পেল। তার উপর থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। টিভির সেই ছেলেটি। ফর্সা, লম্বা, চোখগুলো সামান্য বাদামি রঙের আর চোখের চাউনি? অনেক কথা বলে যায় কোনও কথা না বলে এই চোখ। সেও রত্নার কোমল মায়া ধরানো মুখখানার দিকে একটু সময় তাকিয়ে রইল। কলেজ জীবনে মিনতিকে দিয়ে নারী নিয়ে খেলা সে আরম্ভ করেছিল সে। রত্নার মুগ্ধ তাকানো দেখে তার অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পারল আরেকটি কোমল হরিণী তার ফাঁদে পড়ল।
    “ এই মেয়েটি কে? একে দেখছি টিভিতে নামানো যায়,” রত্নার চোখে ভেসে উঠছে সুন্দর ছেলেটির গায়ে আছড়ে পড়া সেই মেয়েটি।
    “আমার বোনই বলতে পারো।” ড্রাইভারণীর স্বর চাপা, এরা মদ খেতে এলে সে একটু সাবধানে থাকে। এই ছেলেদের সবার মতো সেও একটু ভয় করে।
    “বেশ সুন্দরী মেয়ে।” সে অভিজ্ঞ। প্রথম তিরটি ছুঁড়ল। রত্না এতেই কাৎ যে একটি ছেলে তাকে সুন্দরী বলছে।
    “কিন্তু অমন সুন্দর মেয়ের গায়ে এসব কাপড় মানায় না।” রত্নার বড় করে কাটা চুড়িদারের গলা দেখে সে কথাটা বলল।
    রত্নার ইচ্ছে করছিল বলে, কেঁদে কুটেই বলে, ওর কিছুই নেই। এগুলো সবই দিদির আনা পুরোনো কাপড়। একটাও নতুন জামা আজ অব্দি সে পরে নি। মুখে মাখবার পাউডার নেই তার। স্নান করবার সাবান নেই। কিছুই নেই তার। দেবেটা কে? সত্যি সত্যি চোখের জল পড়তে শুরু করল। ছেলেটি ঝাঁপ দিয়ে প্রায় তার কাছে গেল। হাতে ধরে টেনে এনে সস্তা বিছানা চাদরে সাজানো ড্রাইভারণীর বিছানাতে বসালো নিয়ে গিয়ে। টেনে চেপে ধরল নিজের শরীরের কাছে। “কাঁদছ কেন? আমি দেবো, তোমার যা কিছু চাই আমি দেবো। আমার সঙ্গে চলো একদিন।” ওর হাত রত্নার শরীরের যেখানে সেখানে গড়াতে শুরু করল। রত্না চোখ মুদে দিল। হাতে গোলাপ ফুল নিয়ে বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বাদামী চোখের ছেলেটি, সেই সুন্দরী মেয়েটি। কিছু সময় সেভাবেই রেখে রত্নাকে সে ছেড়ে দিল। রত্না বিছানাতেই বসে রইল।
    ছেলেরা হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল। ওরা কী সব বলাবলি করতে করতে গেছে। কিছু তার শুনেছে রত্না , কিছু শোনেনি।
    “ জিতদাকে কিন্তু মানতে হবে হে!”
    “ যেদিকে যায় , সেদিকেই ঘি-মধু।”
    “ জিতদার প্রজাপতির পেছনে ছুটতে হয় না, আপনি এসে গায়ে বসে।”
    ওরা বেরিয়ে যেতেই , ড্রাইভারণী বাঘিনীর মতো রত্নার উপরে চড়াও হলো।
    “তোর একটাও চুল মাথাতে থাকবে না, লজ্জা শরম নেই? ওর শরীরে শরীর লাগিয়েছিলি কেন? ক’দিন ধরে ওকে জানিস তুই? তোকে কি আমি এখানে রেণ্ডীগিরি করতে ডেকে এনেছি? তোর মা তোকে এখানে বিশ্বাস করে পাঠায়, গরীব মানুষ। দু’টো পয়সা পাবি, দু’টো ভাত খাবি, আমারও সহায় হবে বলে তোকে আমি আমার বাড়ি আসতে দিই। তুই কেন এতোগুলো লোকের সামনে ওকে তোর গায়ে হাত দিতে দিলি?” ওর চুল মুঠো করে ধরে ঝাঁকিয়ে দিল ড্রাইভারণী।
    রত্না কিছু বলল না। চুলগুলো ঠিক করে বেরিয়ে গেল। আর সে ড্রাইভারণীর ওখানে আসে না। এতে চুল ধরে টানাটানির কী আছে? মা অনবরত ব্যস্ত, বাবাতো বাবাই। বাবা তার থেকে টাকা পয়সাও পাচ্ছে। রত্নার কাপড় পাল্টালো, হাসি পাল্টালো, জোতা পাল্টালো। সবাই রত্নাকে তার মটর সাইকেলের পেছনে নইলে গাড়ির সামনের সীটে বসে থাকতে দেখতে পেলো।
    ট্রাকে ট্রাকে গাছ ফুরিয়ে যাচ্ছে। সজীব অরণ্য দেখতে কবরের মতো হয়ে আসছে। দিনে দিনে আরো একটি মেয়ে মানুষের বুকের সবুজ অরণ্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে শুরু করেছে। ইদুঁর মারবার ঔষধ খেয়ে মুখে ফেনা বের করে মিনতিকে পড়ে থাকতে দেখেছে নবীন। মিনতি যেদিন ইদুঁরের ঔষধ খেয়ে মরতে গেল, সেদিনই রত্না ছেলেটির দেয়া পোশাক আশাক পরে তার গাড়ির সামনের আসনে বসে সিনেমা দেখতে চলে গিয়েছিল। মিনতি কিন্তু মরল না। জোনের মাকে যেমন বাঁচিয়েছিল এরা, তাকেও বাঁচিয়ে তুলল।
    একমাস পরে রত্না ফিরে এলো। ইতিমধ্যে রিজার্ভ পুরো শেষ। যাবার বেলা গেছিল গাড়িতে, আসার বেলা বাসে। রত্নাও এখন এক উজাড় অরণ্য।
    মা যেদিন কথাটা টের পেল সেদিন প্রথমে ওকে আচ্ছা করে পেটালো। গাছের কাটা গুড়িতে ভরা জঙ্গলের মতোই সে নিথর। মার খেতে খেতে ওর হাত পা ফেটে গেল। টু শব্দটি করে নি। দাওয়াতে বসে বাবা চেঁচিয়েই চলেছে, “ ছেলে সন্তানহীন বাপ আমি, আমার কী আছে? থাকলে আজ কি আর বোনটিকে অমন ঠকাতে পারত ছেলেটা? সে গিয়ে তাকে ছ্যাঁচড়িয়ে ছ্যাঁচড়িয়ে টেনে নিয়ে আসত। আমার মেয়েকে ওভাবে যেতেই দিত না। আমার ছেলে...ছেলে রে...।” একটা কাল্পনিক ছেলে বুড়োকে কী দিতে পারত, কী করতে পারত এই সব বকতে বকতে মানুষটা দাওয়াতে বসেই রইল, কিছু একটা হলেই সব সময় সে যা করে থাকে।
    বাজার থেকে এসে মণির মা ঘরের কাজকর্ম শেষ করতে পারে নি, রত্নার হাতে ধরে রত্নার মা ওর এখানে চলে এলো। আজ মণি নেই, সিঙের গাড়ি নিয়ে গুয়াহাটি গেছে । কাল আসবে। এমনিতেই ওর মন ভালো ছিল না। রত্নাদের দেখে ভালো লেগে গেলো, কথা বলবার লোক পাওয়া গেল তবে।
    রত্নাকে কাছের থেকে দেখল সে। কত কি কথা শুনেছে এই মেয়েটিকে নিয়ে। বোলতায় বিঁধে নষ্ট করে ফেলা ঝিঙের মতো মেয়েটির দিকে অল্প সময় সে তাকিয়ে রইল।
    “মণির মা , তুই আমার সঙ্গে এক জায়গাতে যাবি?”
    “কই?”
    “একে পুঁতে রেখে আসব।”
    “কী বলছিস রত্নার মা?”
    “ যাবি কি যাবি না , বল।” তোকে বিশ্বাস করতে পারি বলেই এসেছি। মেয়ে মানুষের সবচাইতে বড় যে বিপদ সেই বিপদে পড়েছে মেয়ে।
    “কত মাস?”
    “ চার মাস।”
    “ কী করবি এখন?”
    “ আমি কী করতে হবে করব, যোগাড় যন্ত্রও করে এনেছি। একটা মানুষ চাই সঙ্গে। সে জন্যেই তোর এখানে এসেছি।”
    হঠাৎ সে মালতীর হাতে ধরে কেঁদে ফেলল, “মণির মা, একা আমার সাহস হচ্ছে না। আমার সঙ্গে তোকে যেতে হবে।”
    “কই যেতে হবে?”
    “কেঁচাইখাতি থানে।”
    সে বস্তির মানুষের মুখে এই থানের কথা শুনেছে। সেখানে বুঝি এক সময় মেয়ে মানুষও বলি দেয়া হতো। সাধারণত কোনও মানুষ সেদিকে যায় না। দরকারও পড়ে না তেমন। তারউপর একটা ভয়। সেখানে গেলে বুঝি শরীরে দোষ লেগে যায়। এসেই জ্বর হবে, নইলে রক্ত আমাশা হবে। কেউ কেউ বুঝি মরেওছে। জঙ্গলের মাঝে পড়ে আছে একটা মন্দির। সেই ভাঙ্গা মন্দিরে জট পাকিয়ে বসে থাকে কাল কেউটের এক বিশাল পরিবার।
    মালতী থুথু গিলছে,” কেঁচাইখাতি থান!”
    “কিছু হবে না , চল না। আমরা মন্দিরের দিকে যাবো না তো। আমি গিয়ে দেখে এসেছি। একটা বটগাছ আছে। তার নিচে কাজটা করে চলে আসব। ...আর কোনও জায়গাও নেই । তুইই বল যাই কই? মেয়েটির জীবন নিয়ে কথা।” সে রত্নার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। কেমন বাঁকা হয়ে পড়েছে কেঁদে কেঁদে। তার থেকেও অসহ্য লাগছে রত্নার মুখখানা। ভেতর থেকে সমস্ত রস টেনে নিয়ে বোলতাতে ভেতরে ভেতরে গলিয়ে ঝিঙার শুধু বাইরের বাকলটা ফেলে রেখেছে। কেমন করে আছে মেয়েটা। তার থেকে যদি সেই মাটিতে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকত।
    “ চল তবে।” সে দরজাতে তালা দিল। কালী বুড়ির মন্দিরের সামনে দণ্ডবৎ করল রত্নার মা, তামার থালাতে দু’টো পয়সা দিল।
    “ মন্দিরটা একেবারে ধ্বসে যাচ্ছে, দেখেছিস চালটা কেমন হয়েছে। কোনোমতে মায়ের মূর্তিটা বেঁচে আছে। বড় করে বৃষ্টি দিলেই মূর্তিটা পড়ে যাবে। দেখিস নি , মায়ের গায়ের কালো রঙ কীভাবে ঝরে যাচ্ছে?”
    “তুই কী করবি? ছেলেকে বুকে বেঁধে কোনোভাবে সংসার চালাচ্ছিস। মন্দির একটা ঠিকঠাক করা কি আর মুখের কথা?”
    “আমি আর কই পারব? আমার কীইবা শক্তি আছে? কালী বুড়ি একবেলা খেয়ে আর বেলা উপোস থেকে মায়ের সেবা চালিয়ে গিয়েছিল। কালী বুড়ির মধ্যে সত্যিই মায়ের শক্তি ছিল। বুড়ি আমাকে মায়ের দায়িত্ব দিয়ে গেল, কিন্তু শক্তিটুকু দিয়ে গেল না।”
    রত্না ওর মা আর মালতীর পেছনে পেছনে আসছে। একবার সে বমিও করল। দেখলেই বোঝা যায় সে দেহটাকে টেনে টেনে এগুচ্ছে। একে দেখলে কালী বুড়ি কী বলত? বুড়ির টনটনে উচুঁস্বরের গলা মালতীর কানে বেজে উঠল, “ কাঁদ, আরো কাঁদ। মেয়ে মানুষের এই কান্না মরদকে দেখাবার জন্যে। তবে না ভাতার আসবে, শরীর দলাই মলাই করে বলবে, ‘আহা বেচারি।’ ব্যস, মেয়ে মানুষ আহ্লাদে আটখানা। দলাই মলাইর পরেই না আসল সুখ।” বুড়ির পাতলা কম্পমান দেহ মালতীর চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠল। বুড়ি ক্ষেপে গেছে, “পেট লাগে যদি আরো কান্না জোড়...বস্তির সমস্ত ভাতার ছুটে আসবে।” তাকে বুড়ি একটা ছবি দেখাচ্ছে, “মায়ের শক্তি দেখ, পুরুষকে কীভাবে পদাঘাত করছে...” একটা সূর্যমুখী লংকা তার চোখের সামনে তুলে ধরেছে। অনেকক্ষণ বুড়ির মুখখানা চোখের সামনে ভেসে রইল।
    ওরা এসে থানে ঢুকল। থান শব্দটা ভুল হবে, কারো পা না পড়া এক টুকরো পরিত্যক্ত ভয়ঙ্কর জায়গা। বেলা পড়ে আসতে এখনো কিছু বাকি। তবুও এই জায়গাটা হালকা অন্ধকারে ইতিমধ্যে ঢেকে ফেলেছে। যেখানে সেখানে গজানো গাছগুলোতে জংলি লতা উঠেছে, এমনভাবে গাছগুলোকে জড়িয়েছে এই লতাগুলো যে অন্ধকারে প্রত্যেকটা গাছকে এক একটা বিচিত্র বসে থাকা জন্তু বলে মনে হচ্ছে। ওর সমস্ত শরীর শিরশিরিয়ে উঠল।
    রত্নার মা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সে কাছে চেপে আসতে গিয়ে কিছু একটা দেখে চমকে গেল। এক টুকরো অদ্ভুত পাথর। পাথরের মাঝখানে প্রতিপদের নতুন চাঁদের মতো কাটা। সেখানে দিব্বি একটা মানুষের গলা বসানো যেতে পারে। পাথরটা সে ছুঁয়ে দেখল। এই জায়গাতে রাজা চুপিচুপি মেয়ে মানুষ বলি দিয়েছিল। এই পাথরেই কি বসিয়ে দিত মেয়েদের গলা? হাতটা সে আবার সরিয়ে আনল। প্রচুর বিষাক্ত পিঁপড়ে পিলপিল করছে সেখানে। ওর হাতেও কামড় বসিয়ে দিয়েছে, সেই উহু আহ করে উঠল। কয়েকটা পিঁপড়ে রত্নার মুখে কপালেও উঠে গেছে। নিশ্চয় কামড়েছে। গলাতেও বেশ ক’টি লেগে ধরেছে। রত্না কাঁই কুঁই করে নি।
    কী করে এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়? অর গলার থেকে পিঁপড়ে ক’টা সরিয়ে সামান্য হেঁচকা টান দিয়ে মা ওকে নিয়ে গিয়ে পাথরের খাঁজে মাথা বসিয়ে দিল। নতুন চাঁদের মতো খাঁজে গলা বসিয়ে সে যেন খানিক আরাম পেলো, মাথাতে একটি বালা পরানোর মতো দেখালো।
    রত্নার পা দুটি ফাঁক করে মা একটা শেকড় ঢুকিয়ে দিল। রত্না মুখে সামান্য গোঙালো। হঠাৎ রত্নার মা বুকে হাত দিয়ে মুখ বাঁকা করে ফেলল। একদিনে রক্তের ডোঙাতে পড়ে থাকা মেয়েটি, আর দিকে বুকে হাত দিয়ে নীল হয়ে আসা মা। মালতী চোখে সর্ষে ফুল দেখতে পেল। সে এখন কী করে? কাকে সামলায়?
    “মণির মা , তুই হাত ঢুকিয়ে জিনিসটা বের করে আন।”
    সে দাঁড়িয়ে আছে। কী করে এখন? মেয়েটি বুকে মোচড় দিচ্ছে। মা ঘামছে, কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে।
    “মণির মা , বের করে আন। নইলে ফুলটা উজিয়ে গিয়ে কলজেতে কামড় বসাবে। তখন আর সে বাঁচবে না। আন , মণির মা। ওটা বেরিয়ে এসেছে, বের করে আন।”
    এবারে রত্নার মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘাসের উপর গড়িয়ে পড়েছে। নাড়াচাড়া করবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
    মালতী রত্নার শরীরে হাত ভরিয়ে দিল। বেরিয়ে এলো এক টুকরো মাংস, লপথপ করছে। ঘাসে গড়াতে গড়াতে বুকে হাত দিয়ে রত্নার মা দেখছে, “ফেলে দে ওটা।”
    সে দুই হাতে তুলে নিলো মাংসপিণ্ডটা। কাছ থেকে দেখলে এক বিঘৎ পরিমাণ ছেলের ভ্রূণ এটা। বাঁশের শলাকার মতো হাত পা, ছোট্ট এইটুকুন মুখ। শরীরে চামড়া নেই। চোখ মুদে আছে। সে দৌড়ে গিয়ে সেটি ফেলে দিল সামান্য দূরে। শেয়াল না কিসে যেন খাপ পেতে ছিল , নিয়ে চলে গেল। রত্নার শরীর যেন আগুনের মতো গরম। ওর মা উঠে বসেছে।
    “যা, তুই ঘরে যা গে’। আমি মনে হয় না আর উঠতে পারব।” সত্যি এক হাতে বুকটা চেপে মানুষটি আবার পড়ে গেল। রত্না দূরে গিয়ে কাছের একটা ডোবার থেকে সামান্য জল নিয়ে এসে মায়ের চোখে মুখে মারল। মা চোখ মেলে তাকালো।
    “মা।” মায়ের মুখখানা সে জল দিয়ে ধুইয়ে দিল।
    “বেগে জামা আছে।” মেয়ের রক্ত মাখানো স্কার্টটার দিকে দেখিয়ে বলল। রত্না জামা পাল্টালো। বয়ে যাওয়া রক্তেরও ব্যবস্থা হলো। কাজগুলো করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে সে কোঁকাচ্ছিল। পরে মাকে ধরে তুলল। মা একদিকে মেয়ে আর দিকে মালতীর হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো।
    তিনজনেই কেঁচাইখাতি থান থেকে বেরিয়ে এলো।
    রত্নার মা ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। বস্তির রাস্তাতে উঠতে গিয়েই মাটিতে পড়ে গেল, মুখটা কেশরাজের মতো কালো করে সে মাটিতে পড়েই চোখ বুজে ফেলল। তৎক্ষণাৎ সর্বত্র হুলস্থূল পড়ে গেল। রত্নার নতুন জামাতে আবার দাগ দেখা যাচ্ছে। মণির মা তাকে বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাকতে বলল।
    রত্নার মাকে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া, গুয়াহাটির থেকে বড় মেয়ের টাকা পয়সা নিয়ে আসা, যেভাবে পারে শ্রাদ্ধ শান্তি করা—এসবের মাঝেই রত্না উঠে বসল। ওর জামাতে যখন তখন দেখা দেয়া দাগগুলোও কারো নজরে পড়ল না। সে সব সময় যেমন কামরাঙা গাছের তলার পাথরটিতে বসে থাকত বেশিরভাগ সময় তেমনি বসে রইল।
    রত্নাকে সবাই নতুন রূপে দেখল এক বাজার বার দিনে। সে দুই হাতে দুই জোড়া মোড়া নিয়ে সবার সঙ্গে বাজারে হাঁটা দিল। সবাই ওর সঙ্গে এটা ওটা কথাও বলল টুকটাক।
    “রত্না, মা মারা যাবার পরে তুই বড় রোগা হয়ে গিয়েছিস।”
    “মোড়া কি তুই নিজেই বানালি?”
    “তোর বাবা ভালো তো?”
    “দিদি কি গুয়াহাটিতেই আছে?”
    রত্না যেদিন মোড়াগুলো নিয়ে বাজারে যাবার জন্যে বেরুলো, ওর বাবা সেই কপাল চাপড়ে বকেই যাচ্ছিল, “আমার ছেলে একটা আজ থাকত যদি, বোনকে এভাবে বাজারে যেতে দিত? কক্ষনো না। আমার পোড়া কপাল। ”
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৫৫495509
  • অধ্যায় ছত্রিশ (৩৬)
    কার্ফিউ চলছে। কখন খুলবে কেউ জানে না। এই বন্ধ আগের বন্ধগুলো থেকে একেবারেই আলাদা। কোত্থাও একটাও বাজার বসে নি। বাড়ির বুড়ো হতে ধরা ঝিঙে বা পুরল টুকরিতে করে কেউ বিক্রি করতে নিয়ে যায় নি। অথবা বিকেলে নদীতে মাছ ধরে ঢেঁকি পাতাতে ঢেকে চালনিতে করে রাস্তার পাশে বসে নি। একটাও ছোট ছেলে রাস্তাতে ক্রিকেট খেলতে বেরোয় নি। সবাই ঘরে ঘরে দরজা বন্ধ করে চুপ চাপ বসে আছে। বসে নি একটিও তাসের আড্ডা। শুধু কোথাও কোথাও কিছু মানুষ জটলা করে বসে আছে।
    এক ঘণ্টার জন্যেও খুলে নি কার্ফিউ। নারকেলের খোলা দিয়ে শেড তৈরি করে ইলেকট্রিক তারে হুক লাগিয়ে একশ পাওয়ারের বাল্ব জ্বালানো হয়েছে। সবাই প্রায় হুক লাগিয়ে সামনে পেছনে লাইট জ্বালিয়েছে। কেউ বা বাঁশের বেড়াতেই ঝুলিয়ে দিয়েছে। কেউ বাঁশেই লাগিয়েছে। কেউ বারান্দার খুটাতে বেঁধে দিয়েছে। এমনই করে এরা প্রায়ই। লাইন ম্যান ধরলে দু’চার টাকা ধরিয়ে দেয়। এখন আর কোনও বাধা নিষেধ নেই। চারদিকে দিনের মতো আলো ছড়িয়ে লাইট জ্বলছে। দুর্বল পুলগুলো ঘটং ঘটং করে নাড়িয়ে দিয়ে দিনে রাতে আর্মি পুলিশের গাড়ি যাতায়াত করছে। আর্মির কড়া হুকুম বস্তির সবাই পাহারা দিতে হবে। সবাই পালা করে পাহারা দিচ্ছে।
    সর্বত্র একটা ভয়। এই আসবে। ভয়ানক সব অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আসবে। কে মরবে ঠিক নেই। সবাইকে মরতে হবে, শুধু আগে আর পরে। উত্তর থেকে আসবে, দক্ষিণ থেকে আসবে, পূব থেকে আসবে, পশ্চিম থেকে আসবে...চারদিক থেকে আসবে।
    জংলি পার্টিও আসবে ওদের বাপদের সঙ্গে।
    একটাও বাঙালি বাঁচবে না।
    আর্মির সঙ্গে যারা থাকে তারা আসবে শিলিগুড়িতে যারা বোমা ঠেসে বসে আছে তাদের সঙ্গ নিয়ে।
    একটাও অসমিয়া বাঁচবে না।
    বাগানীয়া দলটা আসবে তীর ধনুক নিয়ে। তীরে বিষ মাখানো, শরীরে লাগলেই কেঊটের ছোবলের মতো নীল হয়ে আসে ।
    একটাও বডো বাঁচবে না।
    বাঁচবে না বিহারিরাও। হিন্দুগুলোও মরবে, মুসলমান একটাও থাকবে না।
    তাহলে থাকবেটা কে?
    কেউ থাকবে না।
    সবাই মারা পড়বে?
    সবাই মারা পড়বে।
    বাঘ সিংহে ভরা একটা অরণ্যতেও সজারুরা কান মাথা ঝাঁকিয়ে খুটে খেতে সময় পায়, সাহস করে। সজারুও জানে বাঘ –সিংহেরও যখন তখন খিদে পায় না। কিন্তু এই যে ছুঁতে না পারা, ধরতে না পারা শত্রুগুলো এদের রক্তের পিপাসা প্রতি মিনিটে থাকে। এই আসবে, এই আসবে, মিনিটে সব ছারখার করে চলে যাবে।
    সত্যিই এলো। টিভিতে যখন অসমিয়া সংবাদ দিচ্ছিল ঠিক তখন সবাই দেখল আকাশে ধুম করে কী একটা ফুটে চারদিক আলো করে ফেলেছে। এতো আলো যে উঠোনের দূর্বা ঘাস অব্দি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। তারপর ঠিক ফটকা নয়, তার থেকেও ভারি আওয়াজ সবার কানে বাজল। এই শব্দ সবার চেনা হয়ে গেছে। রক্ত পিপাসু ভূতের পায়ের শব্দ। তারপরে সব নিঝুম! শব্দগুলো এসেছিল ড্রাইভারের বাড়ির দিক থেকে। একটাও পুলিশ মিলিটারির গাড়ির শব্দ নেই। অন্য সময় যারা ঘটং ঘটং করে পুল নাড়িয়ে আসে যায় এদের গাড়িগুলো সব গেল কই? কই হারিয়ে গেল টহলদারি মিলিটারিরা? ওরাতো থাকেই অনবরত। ক্যাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, আসা যাওয়া করা মানুষের সাইকেল কেড়ে রাখে। তিন চারদিন, কখনো বা এক সপ্তাহ দশদিন পরেও ঘুরিয়ে দেয় না। কখনো বা সঙ্গে নেয়া বেগ, তল্পি তল্পা খুলে দেখে দুই একটা চড় থাপ্পড়ও বসিয়ে দেয়। পাহারা দেয়াতে কোনও ঢিলে ঢালা ভাব দেখলে গালি গালাজ মার পিট এসব আছেই। আজ এরা সবাই গেল কই?
    শুরুতে বস্তির কেউ নড় চড় করল না। মণিই বলল প্রথম, কী হয়েছে দেখতে তো হবে। মণির সাহসের কথা বস্তির সবাই জানে। তার কথাতে সাহস পেয়ে সবাই উঠে ড্রাইভারের বাড়ির দিকে এগুলো। ভেতরে কেউ কোঁকাচ্ছে। মণির পেছনে পেছনে সবাই গিয়ে ঢুকলো। রক্তের স্রোতে পড়ে আছে ড্রাইভার, তার শরীর ফুটো ফুটো করে ফেলেছে চালনির মতো। আরো কোঁকানির শব্দ শুনে এগিয়ে দেখে রত্নার বাবা পড়ে আছে। একবার চোখ মেলে তারপরেই মাথাটা একদিকে কাত করে ফেলে দিল। মেয়ের হাতে রান্না করিয়ে দু’মুঠো ভাত নিয়ে এসেছিল ছেলে মেয়ে দু’টোর জন্যে । এদের মাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবার পরে থেকেই এরা উপোস করেই দিন কাটাচ্ছিল। ড্রাইভারের সমান না হলেও তার শরীরেও বেশি ক’টি গুলির দাগ। কারো চাপা ফোঁপানোর শব্দ শুনে দেখল বিছানার নিয়ে ছেলে মেয়ে দু’টি। ছেলেটা পড়ে আছে, মেয়েটি তাকে ধরে কাঁদছে। বিছানার নিচে থেকে তাদের দু’জনকে বের করে আনা হলো। ছেলেটির শরীরে গুলি লেগেছে , শরীর শক্ত হয়ে গেছে। মেয়েটির গায়ে রক্তের কিছু দাগ লেগেছে মাত্র। ওর কিছু হয় নি। ওকে কেউ ধরে দাঁড় করাতে গেলেই সে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। ভয়ে মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। কে যেন ওকে বুড়ো দর্জির হাতে তুলে দিল, দর্জি ওকে বুকে করে সেখান থেকে চলে গেল।
    কিছুক্ষণ নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল লোকগুলো। হচ্ছেটা কী এসব? কাকে জিজ্ঞেস করবে? এতো সব পুলিশ মিলিটারি থাকতে এসব হতে পারে কী করে? আকাশের এক একটা টুকরো আলো করে তোলা পুরো শহর দেখেছে। ধম করে ফুটা শব্দ শুনেছে। আর্মি –পুলিশে দেখে নি? তবে? ভয় করে? নিজের প্রাণের ভয়?
    ব্যাপার সবাই বুঝতে পারল। বা মনে হলো যেন বুঝে উঠেছে। বোকা মানুষগুলোই ক্ষেপে গেল। ঠাট্টা হচ্ছে? ওরা যাদের যা বলে তাই করে আসছে। কানে ধরে ওঠ বস কর। করেছে। পুরোটা দিন বাজার করে আসে রাতে যদি বলেছে পাহারা দে, দিয়েছে। ভোর হতেই আবার চোখে মুখে জল দিয়ে দৌড়েছে। লাগে বললেই সাইকেল দিয়েছে। ডেকে নিয়ে বলেছে রাস্তাতে পাথর বিছিয়ে দে, দিয়েছে। ক্যাম্পে বাঁশের বেড়া দিয়েছে। সুমলা পাগলি ওদের ক্যাম্পের মুখে বলির ছাগলের মতো পড়ে রইল। ভেতরের গরুগুলো কিছু বলল? একটাও আঙুল তুলল? ওরা দেখে নি?
    ড্রাইভার, ড্রাইভারের ছেলে আর রত্নার বাবাকে নিয়ে মানুষজন বসে রইল। বস্তির কারো ঘরে চুলো জ্বলল না। চোখে ঘুম এলো না। তিনটা প্রাণীর রক্তে বস্তির সবাই ডুবে গেল। সকালে সবার চোখে দেখা গেল রক্ত জমাট।
    ভোরের আলো ফুটতে পুলিশের একটা গাড়ি এলো। বডিগার্ড সহ এক অফিসার নেমে এলো।
    কেউ একজন প্রথম ঢিলটা ছুঁড়ল। গাড়ি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। বৃষ্টির মতো পাথর পড়তে শুরু করল গাড়িতে। অফিসারটি বন্দুক বের করতে যেতেই নবীন না মণি কে যেন একটা চড় মেরে সঙ্গে লাথিও বসিয়ে দিল কয়েকটা। প্রাণ নিয়ে পুলিশের গাড়ি চলে গেল।
    কিছু সময় পরে আর্মির গাড়ি এলো। পাথর জড়ো করে রাখাই ছিল। লোকজনও তৈরি হলো। ঠনর ঠনর করে পাথরের ঢিল পড়তে শুরু করল আর্মির গাড়িতে। সবাই নয়, কিন্তু অনেকেরই ছেলে বেলা গুলতি মারার অভ্যেস ছিল, হাতগুলো সোজা । ধমাধম ভাঙ্গা ইটের টুকরো পড়তে শুরু করল। আর্মির ভান ঘুরে গেল। এলো বেশ ক’খানা বোঝাই করা পুলিশের গাড়ি। ওয়াকি টকিতে কথা বলছে। আর্মির গাড়িও আরো এলো। পুরো বস্তি পুলিশের আর্মিতে ঘিরে ফেলল।
    বন্দুকের কুঁদা দিয়ে মেরে মেরে কানে ধরে ধরে সবাইকে সার করে বসিয়ে দিল। তারপরে অজগর সাপের মতো হা করে মুখ মেলে রাখা কালো গাড়িতে এক এক করে সবাইকে তুলতে শুরু করল। মহিলারা তাই দেখছে কালী বুড়ির থানে বসে বা দাঁড়িয়ে। মুখরা যে ক’জন মহিলা, তারা শিলাবৃষ্টিতে জর্জর কপৌ ফুলের মতো চুপ।
    মণিকে কোনও এক আর্মি বন্দুকে একটা খোঁচা দিয়ে আবার লাথও মেরে দিয়েছে, “লিডারি করত্যা হায় ক্যা?” মণি শক্ত হয়ে বসে আছে। তাকে নাড়ানো যায় নি। পুলিশ একটা এসেও তাকে গুঁতো দিল, “ কোন বাপের ব্যাটারে তুই! শালা হারামজাদা!”
    মণির মা তাই দেখছিল। সে চাদরের আঁচলখানা কোমরে বেঁধে দৌড় দিল, “কাকে তুই হারামজাদা বলছিস রে?”
    মণির মায়ের পেছনে পেছনে মিনতি, রত্না, মীরার মা, ফুল, জোনের মা সবাই দৌড় দিল। যেন ওরা মণির মায়ের গায়ে আঠা দিতে সাঁটা।
    পুলিশের একটা হাসছিল, “ মালতো বেশ বড়িয়া দেখছি! ভাগিয়ে নিয়ে যাবি কি রে?”
    “ মা তুই গেলি?” দাঁত কামড়ে বলল মণি, “ মা , তোরা ভেতরে যা গে, এই কুকুরগুলোর সামনে এসেছিস কেন?”
    “ ওই কাকে কুকুর বলছিস বে?” কেউ একজন মণিকে মার একটা দিয়ে ভেনে ভরিয়ে দিল।
    “মিনতি, তোরা যা গে’।” ভেনে ঢুকে নবীন চেঁচিয়ে বলল।
    চোখের সামনে ভ্যানখানা ঘরঘর করে চলে গেল। মণির মা এক দৃষ্টিতে ভেনের দিকে তাকিয়ে রইল। যেখানটাতে ভ্যানটা মিলিয়ে গেল সেখান থেকে একটা মানুষ আসতে সবাই দেখতে পেল। মীরার বাবা। আজ বহুদিন পরে এসেছে মানুষটা। চেহারা দেখে মনে হয় যেন কোনও কঠিন অসুখে পড়েছে। চুলগুলো ঝরে গেছে, পুরো বুড়ো দেখাচ্ছে তাকে। বোধহয় অনেক আগেই বস্তিতে ঢুকেছিল। গোলমাল দেখে কোথাও লুকিয়েছিল। পুলিশ-আর্মিকে চলে যেতে দেখে বেরিয়ে এসেছে। তাকে দেখে মীরার মা তাড়াতাড়ি হেঁটে বাড়ি চলে গেছে। কান্না-কাটি করে ভয়ে বিব্রত অন্য মহিলারা তা দেখেনি।
    প্রথমে দরজাটা বাইরে থেকে তালা দিল মীরার মা। ছেলেকে পুলিশে নিয়ে গেছে, মীরা অন্য মেয়ে মানুষদের সঙ্গে। আজ বেশ কয়েক বছর পর বাড়ি আসা স্বামীর জন্যে পথে তাকিয়ে রইল। বাড়ির মুখে অচেনা মানুষকে দেখলে কুকুর যেমন ঝাঁপিয়ে উঠে মীরার মা তেমনি ঝাঁপিয়ে পড়ল বরের উপর। শুরুতে ওর বুক ভেঙ্গে পাড়ভাঙ্গা কান্না বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল। কিন্তু তারপরেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে জোৎস্না আলোতে পড়ে ঝলমল দুটি সংলগ্ন শরীর। ওর চেনা মানুষটির শরীরে এক আলদ সাপ কিড়মিড় করছে, কুচকুচে কালো, অন্ধকারের থেকেও কালো। ওর কানে বেজে উঠল এক নেশাসক্ত নারী কণ্ঠ, “বুর্বক বেটিটা শুয়ে পড়েছে।” বুকের কান্না শুকিয়ে গেলো, ওর শুকনো বুকে এখন শুধু তপ্ত বালির উপর দিয়ে হোঁ হোঁ করে বয়ে যাওয়া বাতাস।
    মানুষটা ভেতরে চলে এসেছে। দরজাতে দিয়ে রাখা তালার দিকে তাকাচ্ছে।
    “আমি লোকের মুখে জানতে পারলাম। এতোসব গোলমালের মধ্যে তোরা পড়ে আছিস। ট্রাক একটাতে চড়ে চলে এলাম। বুকটা জ্বলে যাচ্ছিল।” চারদিকে তাকাচ্ছিল সে, “ বাড়িঘর ভালোই উঠালি। ছেলে দোকানে ঢুকেছে। তুই ভালো বাড়িতে কাজ করিস, খবরাখবর সব রাখি। তোদের রোজগার পাতি ভালো।” মীরার মায়ের বুকের বালিগুলো হোঁ হোঁ করে উপরে উঠে আসছে, ওর নাকে মুখে চেপে ধরেছে, সে শ্বাস নিতে পারে নি।
    “আমি এবারে চলে এসেছি, বুঝলি। ঐ বেটি আমাকে ওষুধ করেছিল। আমাকে অসুস্থ করে ফেলেছে।” লুকিয়ে একবার মীরার মায়ের কঠিন মুখটা দেখে নিলো সে। “একজন বাবা আমাকে পানি ঝাড়া খেতে দিয়েছে। জ্যান্ত কী একটা বেরিয়ে এসেছে বমি থেকে। আমি একেবারেই চলে এসেছি। তোরে এখানে থাকলে আমি বেঁচে যাবো, নইলে ও আমাকে একেবারেই মেরে ফেলবে।”
    মীরার মা দেখে যাচ্ছে লোকটাকে। লোকটাও সোজা না হলেও বাঁকা চোখে তার কঠিন মুখের দিকে নজর ফেলছে।
    “বড় খিদে পেয়েছে। কিচ্ছু না খেয়ে আমি রাতের অন্ধকারে ইটের ট্রাকে উঠেছি। এইটুকু জায়গা হেঁটে এসেছি। এখানেই যত গোলমাল। কলাইগাঁও থেকে সব খোলা। এখানে আসব বলে জেনে সবাই ভয় পেয়েছিল। এদিকে তোরা পড়ে রয়েছিস...।” সে ধরতে পারছে মীরার মা আরো শক্ত করে আনছে নিজেকে।
    “দরজাটা খোল।” মীরার মায়ের কাছে চেপে এলো। “তোর চেহারাটা ভালো হয়েছে। বড় ঘরে খাচ্ছিস দাচ্ছিস ভালো। ছেলে রোজগার করছে। আমারই এখন কষ্ট বড়...... বেমার হয়েছে থেকে কাজ কর্ম নেই।” এদিকে ওদিকে তাকিয়ে সে মীরার মায়ের পিঠে হাত রাখতে চাইছিল।
    “একবার যদি আমার গায়ে হাত দেবে!”
    “কী করবি? তুই আমার বিয়ে করা বৌ। আমার ছেলে মেয়েদের পেটে ধরেছিস তুই।” লোকটার কথার মোলায়েম সুরটা হঠাৎই মিলিয়ে গেল।
    “খোল বলছি দরজা। নইলে ঘর দরজা সব ভেঙ্গে ফেলব। সব জ্বালিয়ে দেবো।” ধম করে সে দরজাতে লাথি মারল।
    “খুলব না দরজা। তোকে আমি ঘরে তুলব না। এই ঘর আমি করেছি। আমি কিনেছি মাটি। তুই চলে যা। যেভাবে এসেছিস সেভাবে চলে যা। তোর ঐ মেয়েছেলের ওখানে চলে যা। যা! মাংস রাঁধ গিয়ে, মদ খা গিয়ে, ওর সঙ্গে এক বিছানাতে উঠ।” শান্ত মহিলা উন্মাদের মতো হয়ে গেছে।
    এবারে সে মীরার মায়ের চুলে ধরে মাটিতে ফেলে দিচ্ছে, “শালা মাগী বেটি, দু’পয়সা রোজগার করিস বলে এতো কথা।” দরজাতে আরো দু’বার লাথি দিয়ে সুবিধে করতে না পেরে সে কাছে শুকিয়ে রাখা লাকড়ি একটা তুলে এনে ধমধম করে কোপাতে শুরু করল, “ বজ্জাত মাগি, রেণ্ডীগিরি করে পয়সার ফুটানি দেখাচ্ছিস!”
    “ কী বললে, রেণ্ডীগিরি করেছি?” কুনুই থেকে রক্ত বেরুচ্ছে।
    “ বৌ বজ্জাত না হলে কোন পুরুষ ছেড়ে যায়? তোদের বড় ছোট দুই বোনই রেণ্ডী। তোর বোনকে কেন ও ছেড়ে গেল? তোরা ভালো বলে কি আর পুরুষগুলো ছেড়ে চলে যায়?”
    “বোনের কথা বলবি না। তোর খায় না পরে?”
    “ওকে ওর মরদ ছেড়ে গেছে। তোর মরদ বাড়ি ফিরেছে।” তার গলা সামান্য মোলায়েম হয়েছে।
    “ইহ! মরদ হতে এসেছে! লাগবে না এমন মরদ আমার! আমি তোকে ঘরে তুলব না বলেছি, তুলব না।”
    “তোর সব ধ্বংস হবে। ছেলেকে পুলিশে নিয়ে গেছে। রেণ্ডীর মেয়ে রেণ্ডী হবে। তোর আবার ফুটানি...।”
    “তুই এখান থেকে চলে যা বললাম। তোর মাগিকে কথাগুলো শোনা গিয়ে যা। আমি মরি, আমার ছেলে মরে, তোর কী? আমি তোকে ঘরে তুলব না।”
    এবারে সে লাকড়ি দিয়ে মীরার মাকে মারতে গেল।
    “আমাকে মেরে ফেলছে রে!” বলে চিৎকার দিয়ে মীরার মা জটলা পাকানো মেয়েদের দিকে দৌড় দিল। চিৎকার শুনে জোনের মা, মণির মায়েরা সবাই এমনিতেই এগিয়ে আসছিল। মীরার মা গিয়ে মণির মাকে জড়িয়ে ধরল। “আমাকে বাঁচা, এর হাত থেকে বাঁচা!” ওর কুনুই থেকে বেরুনো রক্তে কাপড়ে দাগ লেগে গেছে। “ ও মেয়েছেলে রেখেছে। আমি কিছু বলিনি। মেয়েছেলের সঙ্গে একই বিছানাতে আমাকে শুতে দিয়েছে । আমি কিছু বলিনি। একটা কানাকড়িও ও আমাকে দেয় নি। আমি যা পারি রোজগার করে খেয়েছি। তোরাই বল, এখন ও এলো বলেই কি আমি ঘরে তুলব?” মীরা এসে মাকে জড়িয়ে ধরল, “মা, হাতে ব্যথা পেলি কিসে? এতো রক্ত বেরুচ্ছে!”
    হাতের লাকড়িটা ফেলে দেয় নি লোকটা।
    মীরার মাকে জোনের মায়েরা ঘিরে ফেলেছে। মণির মাকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
    লাকড়িটা উপরে তুলে নাচাতে নাচাতে একবার এগিয়েও পিছিয়ে গেল লোকটা, “আমার বিয়ে করা বৌ, আমি যাই করি। অন্যের কী?”
    “বিয়ে করা বৌ! এতো বছর ধরে তুই একে খাইয়েছিলি না পরতে দিয়েছিলি?”
    “তোর বেমার হলো বলে গুয়াহাটিটি আরেক পুরুষ ধরেছে। এখন বাড়ির কথা মনে পড়ল?”
    “বিয়ে করা বৌকে মারতে এসেছিস?”
    “বাড়ি ঘর দেখে এলি?”
    “রোজগার দেখে এলি?”
    সব্বাই মিলে ওকে চেপে ধরল। মীরার মা মণির মাকে জড়িয়ে ধরেই আছে।
    “ বল মীরার মা, ওকে ঘরে তুলবি?”
    “তুলব না। এমন মরদ আমার লাগবে না।”
    “শুনলিতো? যাগে তুই! যেভাবে এসেছিলি সেভাবেই যাগে!”
    পুলিশের গাড়ির শব্দ শুনে সবাই একটু চমকে গেলো।
    “চল আমার ঘরে চল।”
    পিঁপড়ে দলের মতো একের পেছনে আর জন কালীমায়ের থান পেরিয়ে একবার একবার প্রণাম করে মণির মায়ের ঘরে গিয়ে ঢুকল। বাইরে পুলিশের গাড়ির শব্দ শুনে ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল।
    “ভয় করবি না। আমরা এতো জন আছি। কেউ আমাদের কিচ্ছু করতে পারবে না।” কী যেন একটা ছিল ফেলানির কণ্ঠে। সবাই মাথা তুলে তাকালো।
    “ কেমন কেটেছে দেখ তো মীরার মায়ের হাতটা।”
    “এগুলোই লাগিয়ে দিই, এখানেই বেঁটে দিয়ে দি।” হাতের তালুতে টিপে রাখা কিছু গন্ধ বেরুনো জংলি পাতা মেলে দেখালো মীরা।
    মিনতি বিছানার নিচে থেকে পাটা বের করে মীরার হাত থেকে পাতাগুলো নিয়ে থ্যাঁতলাতে শুরু করল।
    বাইরে মীরার বাবার গালি গালাজ দুই একটা শোনা যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে গালির শব্দ দূরে মিলিয়ে গেল।
    এবারে একেসঙ্গে অনেকগুলো গাড়ির গোঁ গোঁ শব্দ। গাড়িগুলোর শব্দও মিলিয়ে গেল।
    পুরো ঘরে এখন ওই থ্যাঁতলানো গন্ধপাতার কড়া গন্ধ। কে যেন মীরার মায়ের শরীরে পাতার রস লাগিয়ে দিল।
    “উফ! উফ! ধরছে তো!”
    “ সামান্য না ধরলে রক্ত বন্ধ হবে কী করে? ঘা হয়ে যাবে যে নইলে?”
    মণির মায়ের কথাতে সবার মুখে সামান্য হাসি দেখা দিল।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৫৫495507
  • অধ্যায় চৌত্রিশ (৩৪)

    আজ বস্তির সমস্ত মানুষ এসে জড়ো হয়েছে মণিদের বাড়িতে। মিনতি, জোনের মা, রত্না সবাই মণির মায়ের কাছে হাত লাগিয়েছে। মিষ্টি, শিঙাড়া, লাল চা যে যেখানে পারে বসে খাচ্ছে। অধিকাংশই আছে গাড়ির কাছাকাছি। এখানে ওখানে সামান্য রঙ উঠে গেছে, সাদা গাড়িটি কেউবা ছুঁয়ে দেখছে, কেউবা ধুলো মুছে দিচ্ছে। মালতীও চোখ বাঁকা করে মাঝে মধ্যেই গাড়ির দিকে তাকাচ্ছে। তারমানে সত্যি মণি বড় হয়ে গেছে, নিজের গাড়ি কিনবার মতো বড়। সবাই চলে গেলে রাতে গাড়িতে উঠে মণি চাবি ঘোরালো।
    “আয় মা, গাড়ি চড়বি। কাল থেকে স্ট্যান্ডে দিয়ে দেবো।”
    মণির নিয়ে আসা নতুন মেখেলা চাদর পরল সে। পোশাক-জোড়া পরে তার মুখে একটা হাসি খেলে গেল। শাশুড়ি যেন লাগছে। হঠাৎ ওর সেই কামরাঙাটা দেখবার ইচ্ছে হলো। কামরাঙাটা পরে ওর কাছে এসে দাঁড়ালো এক লজ্জাবতী তরুণী। টুপ করে একটা চুমু খেয়ে নিলো মেয়েটির গালে। অনেকক্ষণ ধরে একটা মিচকি হাসি ওর মুখে লেগে রইল।
    গাড়ি চলছে। সামান্য ভালো রাস্তা পেলেই জলে নৌকো চলার মতো চলে। গর্তগুলো বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে সে এগুচ্ছে। জ্যোৎস্না রাত, নামিয়ে দেয়া গ্লাসে বাইরের বাতাস ভেতরে আসছে, মালতীর চোখ বুজে এসেছে।
    “মা, মাসে তিন হাজার করে দিয়ে কুলদীপের বাবার ধারটা মেরে দেব।”
    “ তিন হাজার?” সে চমকে উঠল।
    “ উপার্জন হবে তো মা।” মণি হাসছে।
    গাড়ির ভেতরের বাতাস আরও মোলায়েম হয়ে আসছে। মণি রাধিকা নদীর পাড়ে পাড়ে চালাচ্ছে গাড়ি। মালতী আজ বহুদিন পর পিঠে সেই সেগুনের মতো ছড়ানো হাতের ছোঁয়া অনুভব করছে। কানে ভেসে আসছে ভালোবাসাতে ভেজানো এক কণ্ঠ, “ মালতী, তুই তাহলে আমার ছেলেটাকে বড় করলি? খেটে খাবার জন্যে সমর্থও বানালি।”
    চোখ ভিজে আসছে। আজ যদি মানুষটি দেখতে পেতেন।
    “হণ্ট।” কর্কশ হুকুম একটা শুনে ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে দিল মণি। এক দল আর্মি। জনা দুই ভেতরে মাথা গলিয়ে দেখল।
    “লাইসেন্স।”
    মণি কাগজ পত্র দেখালো।
    “ইধার আও।” মিলিটারি গাড়িটা নদীর দিকে মুখ করিয়ে আলো জ্বেলে রাখতে অর্ডার দিল মণিকে। গাড়ির উজ্জ্বল হেডলাইটের আলোতে নদীর পাড়ের কাদাতে দেখা গেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাম-বুট পরে একদল আর্মি। ওরা ওখানে কিছু খুঁজছে।
    “ কী খুঁজছে ওরা?” মালতীর গলা বসে গেছে ভয়ে। কয়েকটা আর্মি দুই একটা জায়গা খুঁড়ছেও। খুন্তিও লাগিয়েছে দুই এক জায়গাতে।
    “মানুষ টানুষ পুঁতে রাখছে কি না।” মণির মুখও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
    গাড়ির আলো নিভে গেল। মরা অমাবস্যার রাতে হঠাৎই নদীর পাড় অন্ধকার হয়ে গেল। মণি বুঝিয়ে দিল তার গাড়িতে পেট্রল ফুরিয়ে গেছে। আর্মি মণিকে যেতে দিল। বস্তিতে ফিরেই প্রায় সবাইকে এই আর্মির নদী খোঁড়ার কথাটা মণি জানালো। খবরটা ভালো করে জানাজানি হতে না হতেই আর্মি এসে বস্তিতে ঢুকল। পুরুষদের প্রায় সবাইকে হাতে মশাল নিয়ে নদীর পাড়ে মরা মানুষ সন্ধানের কাজে লাগিয়ে দিল। নবীন আর মণি কাছাকাছি থাকছে। মণির নজরে পড়ল এক পাটি মানুষের দাঁত আধা কাদার মধ্যে ডুবে আছে। উপরে দুটো শামুক ঘুরে বেড়াচ্ছে। হুলস্থূল পড়ে গেল। তখন প্রায় মাঝরাত। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। আর্মি আর বাকি সবাই মিলে জায়গাটা খুঁড়তে শুরু করল। প্রায় চারফুট মাটির নিচে একটি মানুষের হাত দেখা গেল। ধীরে ধীরে সাত সাতটি জোয়ান ছেলের মৃতদেহ উঠে এলো। একেবারে শেষে উঠে এলো একটা লম্বা মরা লাশ। লাশের হাতের আঙটি একটা দেখে নবীন চেঁচিয়ে উঠল। চিৎকারে একটি আর্মি এসে ওকে বন্দুকের খোঁচা দিয়ে বলল, “চুপ রহো।” ছেলেগুলোকে বন্ধুকের বাটে ঘা দিয়ে, গুলি করে মেরে লবণ ঢেলে নদীর পাড়ে কাদাতে পুঁতে রেখেছিল। লাশগুলো যখন আর্মি নিয়ে গেল আকাশ তখন ফর্সা হচ্ছে। পুরুষ মানুষেরা ফিরে আসা অব্দি প্রায় সব বাড়িতে মেয়েরা জেগে রাত কাটিয়েছে।
    বাইরে বাইরে মণিকে স্নান করতে দেখে কাছে চেপে গেল মা। কিছু না বললেও সব বুঝতে পারল। ধূনার দানিতে নারকেলের ছোলা আর সামান্য খের জ্বালিয়ে মণির সামনে নিয়ে গেল। মণি হাতে ছুঁয়ে দিল। দরজার মুখে মা খের আর কাঠের চেলি দু’টুকরো জ্বালিয়ে দিল। কাপড় চোপড় কলপাড়ে রেখে সে ভেজা গামোছা পরে ঘরে গিয়ে ঢুকল। তুলসীর দুটো পাতা ছিঁড়ে একটা বাটির জলে ভিজিয়ে জলগুলো মণির গায়ে ছিটিয়ে দিল মা। তার পরে সে গিয়ে বিছানাতে পড়ল। সে আর তার মা সেদিন এক-গ্লাস জলও খায় নি।
    সকালে কেউ বন্ধ না দিলেও শহরে বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকে চুপি চুপি কাদাতে পুঁতে রাখা জোয়ান ছেলেদের কথা রাষ্ট্র হয়ে গেল। পুলিশে মিলিটারিতে পুরো শহর ভরে গেল। বস্তির মানুষজন সেদিনই কেউ আর বেরুলো না কোথাও। ঘরের দাওয়াতে, বাড়ির উঠোনে সবাই জটলা করে বসে আছে। হঠাৎ দেখতে পেল এক ঝাঁক আর্মি মিনতির ঘর ঘিরে ফেলেছে। তাকে ওরা গাড়িতে উঠবার জন্যে চাপ দিচ্ছে। সে যাবে না। উঠোনে বসেই মিনতি হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করল।
    “তোরা আমাকে নিয়ে গিয়ে কী করবি আমার জানা আছে।” ওর ছেলে ওকে জড়িয়ে ধরেছে। বস্তির প্রায় সবাই এসে মিনতির বাড়ির ধারে কাছে জড়ো হলো। মহিলারাও।
    সবাই তাকিয়ে আছে। কারো মুখে কথা নেই।
    ওই একটা আর্মি ওকে বন্দুক দিয়ে ঠেলছে। তার চিৎকার বেড়েই চলেছে। আরেকটা এসে ওকে গালি পাড়ছে। কী করছে ওরা? ওর চুলে ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে চাইছে।
    মণির মা ছোঁ মেরে এগিয়ে গেলো। বাতাস কলাপাতার মতো সে কাঁপছে।
    “এই কী করছিস তোরা? কাদাতে মানুষ মেরে ও পোঁতেছে?”
    জোনের মা, মীরার মা, রত্না, লাতুর বৌ সবাই এসে মিনতিকে ঘিরে ফেলেছে। পুরুষেরাও কাছে চেপে এলো।
    নবীন মিনতির কাছে এলো। ওর মুখ লাল হয়ে গেছে। একটা আবার বন্দুক দিয়ে খোঁচা দিল মিনতিকে। এবারে সে মণির মায়ের গায়ে পড়ে কেঁদে ফেলল। যে আর্মিটা মিনতিকে বন্দুকের খোঁচা দিচ্ছিল তার হাতে গিয়ে খামচে ধরল নবীন। ধীরে ধীরে কাছাকাছি জড়ো প্রতিটি মানুষ এগিয়ে এলো। লোকগুলো গোঁয়ার হয়ে পড়েছে। ডর ভয় চলে গেছে।
    “বলছিস না যে? কী করেছে মেয়েটি? কেন ওকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবি?”
    “ কী করেছে ও?”
    “ এই এক মহিলা সাতটা ছেলেকে মারতে পারবে?”
    “ গর্ত করে পুঁতে ফেলতে পারে?”
    “ নদীর পাড়ে ছ্যাঁচড়ে নিয়ে যেতে পারে?”
    “ সাতটা জোয়ান ছেলের মরা লাশ পুঁততে লবণ আনতে পারবে?”
    “ওকে কেন হেনস্তা করছিস তোরা?”
    এক পাশ থেকে ঘন করে গাঁথা মালার মণির মতো লোকগুলো সেই আর্মিকে ঘিরে ফেলেছে। বাকি পুলিশ মিলিটারি সেই ঘেরার ভেতরে যেতে পারে নি। লোকগুলো আরও ঘন হচ্ছেই হচ্ছে। মিনতির কান্না বন্ধ হয়েছে।
    এক সময় পুলিশ মিলিটারি চলে গেল।

    সেদিন রাতে নবীন মিনতিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে চলে গেল। পুরো রাত সে সেখানে থাকল। ধীরে ধীরে দেখা গেল মিনতি নবীনের ভাত রান্না করে দিচ্ছে, ঘর মুছে দিচ্ছে, বিকেলে সে ফিরে আসার পথে তাকিয়ে আছে। যেদিন মিনতি নিজের ভাড়া ঘরটা ছেড়ে দিল সবার নজরে পড়ল কথাটা। কাছাকাছি থাকে, আসা যাওয়া আছে। কিন্তু ঘরটা ছাড়তে যেন বিশেষ করে নজরে পড়ল।
    নবীনের সঙ্গে মিনতি থাকতে শুরু করলে একই মুদ্রার অন্য পিঠে আরও একটা কথাও আবার উঠল, নবীনের সেই আলু-বেগুন কেটে ফেলার ঘটনাটা। সেদিন মিনতি নবীনের বাড়ির উঠোনে কী সব কাজ করছিল। ছেলেটা স্কুলে গেছে। মিনতির পাশে গোল হয়ে শুয়ে আছে কালু। কালু একটা কুচকুচে কালো মাদা কুকুর। কোত্থেকে যেন এনেছিল মিনতি। এখন বড় হয়ে শক্তপোক্ত হয়ে গেছে। মধ্যে শরীর খারাপ হয়েছিল। নবীন কী কী ঔষধ দিয়ে ভালো করেছে। নবীনের বাড়িতে একটা শিউলি ফুলের চারা লাগাতে চাইছিল মিনতি। চারাটা পুঁততে যেতেই দেখল কেং কেং করে কালু তার দিকে দৌড়ে আসছে। যেদিকে কালু যাচ্ছে সেদিকেই একটা রক্তের ধারা। যন্ত্রণাতে কুকুরটা উঠোন জুড়ে কুঁকিয়ে কুঁকিয়ে গড়াচ্ছে। বারে বারে সে মিনতির পায়ের কাছে আসবার চেষ্টা করছিল। বেদনাতে কাতর কুকুরের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে সে চিৎকার করে উঠল। কুকুরটার যৌনাঙ্গ কেউ ধারালো অস্ত্র দিয়ে সমান করে কেটে দিয়েছে। ড্রাইভারণীর বাড়িতে জড়ো হওয়া দু’ একটা মাতালের চাপা হাসি যেন সে শুনতে পেল। হাসিটা না কুকুরের আর্তনাদ –ঠিক ধরতে পারে নি সে , তার মগজে আগুন ধরিয়ে দিল।
    সে পথে বেরিয়ে এলো। গায়ের কাপড় কোমরে বেঁধে নিলো। তারপর উরু চাপড়ে চাপড়ে সে উঁচু গলাতে চেঁচাতে শুরু করল।
    “ বেরিয়ে আসিস না কেন, তোদের আলু-বেগুনে যদি এতোই জোর তবে বেরিয়ে আয় না কেন?”
    কালুর চিৎকার আর ওর গলা দুটো যেন একই বিন্দুতে মিশে গেছে, “শোন , কান পেতে শোন, আমার আলু-বেগুনের পুরুষ চাইনে, অনেক দেখেছি এমন পুরুষ।” মিনতি বুক চাপড়াচ্ছে, “ আমার এখানে চাই মায়া মমতার পুরুষ, আলু-বেগুনের জোরে দেমাক দেখাবার জন্যে কোনও ষাঁড় চাইনা, বুঝলে!”
    এবারে সে মাটিতে বসে কাঁদতে শুরু করল, “আমি ষাঁড় গরু নয়, একটা মানুষ পেয়েছি। আমাকে কেন শান্তিতে থাকতে দিচ্ছিস না?”
    তারপরে সে উঠে গিয়ে বেদনার্ত কুকুরের কাটা জায়গাটা ধুয়ে দিল। ভেতর থেকে একটা মলম এনে লাগিয়ে দিয়ে পরম মমতাতে কুকুরটিকে জড়িয়ে ধরল। কুকুরও আরাম পেয়ে কুঁ কুঁ করে গৃহিণীর পায়ের তলাতে জায়গা নিলো। এমনি করে কুকুরকে জড়িয়ে ধরে অনেক ক্ষণ বসে রইল মিনতি।
    হঠাৎই একবার ইচ্ছে হলো রত্নার সংগে দেখা করবার। রত্না কি জানে জিতের সেই আংটিটার কথা? হীরে বসানো ছিল। পাহাড়ে যাবার বেলা অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে সেই আংটিটাও মিনতির কাছে রেখে গিয়েছিল। বহুদিন সেটি মিনতির কাছে ছিল। মিনতির কাছে রাখতে দেয়া জিনিসগুলো নবীনও দেখেছে। রত্না কি জানে লবণ ঢেলে পুঁতে রাখা শবগুলোর একটির হাতে নবীন নিজের চোখে সেই আংটি দেখেছিল? সে কি আর রত্নাকে শুধু সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েই একটা পুরো মাস রেখেছিল? সে কি রত্নাকেও বলেছিল, “তোমাকে আমি বিপদে ফেলব না?” রত্না মেয়ে মানুষ, ছোট্ট মেয়ে। সে কি আর বুঝেছে কথাগুলোর অর্থ? সেই একমাস রত্না কী ভেবেছিল? সবাই ওকে হিংসে করে, না কি ভেবেছিল ফিল্মের হিরোর মতো দেখতে ছেলেটির সঙ্গে সেও ফিল্মি নায়িকা হবে? নদীতে সাঁতার দেবে, বাগানে নাচবে। সে রত্নাকেও বলেছিল কি এসব, “আমার বাড়িটা হয়ে গেলেই তোমাকে আমি বিয়ে করব?” রত্নার দেহও তার জন্যে কেঁদেছিল কি? এখনো কি কাঁদে? সে তো আর আংটির কথাটা জানে না। ওর মুখখানা দেখলেই রত্নারও পাখির মতো উড়ে যেতে ইচ্ছে করেছিল কি?
    সত্যিই সে রত্নার বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। বাড়িতে রত্না ছিল, সে উঠোনে একটা কুরুনি দিয়ে লাউ গাছের গুড়ি সাফ করছিল । মিনতিকে দেখে তাকিয়ে রইল। সেই ছেলেটি এই মহিলাকেও...। রত্নার শুকনো শরীর দেখে তাকিয়ে রইল। একবার মিনতির তাকানো দেখে সে তার গায়েই হেলে পড়ে কেঁদে ফেলল।
    “সত্যি কথাটা বলত রত্না, তোকে কে বিপদে ফেলেছে? ও?”
    “না, সে রোজ...”
    “তবে?”
    “তার বন্ধুরা আমাকে দিনে তিন-চারবার করে...সেই সিনেমার শুটিং হবে বলে কয়ে জঙ্গলের মধ্যের বাংলোতে...”
    বোলতাতে খেয়ে বাঁকা করে ফেলা ঝিঙের মতো সে মাটিতে বসে কেঁদে যাচ্ছে। রক্ত গিয়ে গিয়ে মেয়েটি ফ্যাকাসে হয়ে পড়েছে। পচা ঝিঙের থেকে বেরুনো তরলে যেমন মাটি ভিজিয়ে ফেলে তেমনি সে যেখানে বসেছিল সেখানকার মাটি ভিজে গেছে। মিনতির নাকে একটা পুঁজের গন্ধ এসে লাগল। ঠিক পুঁজ নয়, পচা রক্ত –পুঁজ এক সঙ্গে বেরুলে যেমন গন্ধ করে। এই গন্ধ বস্তির সব মেয়ে মানুষের চেনা।
    “তুই ওষুধপাতি কিছু খাচ্ছিস?”
    “না।”
    “কী করে?”
    “পেটে ব্যথা হয়।”
    “আর?”
    “ মরা রক্ত আর পুঁজ বেরুতে থাকে।”
    “কাল আমার সঙ্গে সরকারি হাসপাতালে যাবি। দিদি জানে কি না?”
    “জানে।”
    রত্না আবার কাঁদছে। মিনতি পরম মমতায় তাকে জড়িয়ে ধরল। এ যেন রত্না নয় । রক্তে লাল কালু। কালুর মতো সেও মিনতির আরও কাছে চেপে আসছে।
    “একটা কথা তুই কি জানিস? তাকে ওই লবণের গর্তে, তার হাতের আঙটিটা..., হীরার আংটিটা নবীন নিজে দেখেছে।” লম্বা ফর্সা একটা আঙুলের হীরের আংটিতে রোদ পড়ে ঠিকরে বেরুলো, সেই আলো ওদের চোখে ছ্যাঁত করে গিয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে সেই আলোর দ্যুতি মাংস আর লবণ ঢেলে রাখা গর্তে মিশে গেল।
    রত্নার পিঠে হাত রাখতে গিয়ে গন্ধটা আরও কাছে থেকে টের পেল সে। জগুর বৌয়ের গা থেকেও শুর শুরুতে ঠিক এমনি গন্ধ বেরুতো।
    “শোন রত্না , তুই বড় কম বয়সে ষাঁড়ের গুঁতো খেলি। সাবধান, ওদের দেমাকের সামনে পরতে গলে যাবি না। তোর আরও অনেক দিন আছে।
    “আমি মরে যাবো, আমি জানি। আমার আর মরবার বেশিদিন নেই। গেল অমাবস্যাতে মা মরেছিল, আসছে অমাবস্যাতে আমি...। আমি মরবো, মরবোই আমি।”
    “মরাটা এতো সহজ কথা নয় রত্না। আমাকে দেখতো, আমি ক’বার মরতে চেয়েছিলাম জানিস? এই দেখ, মরতে চেয়েও আমি মরি নি।”
    “আজকাল নবীনদার সঙ্গে...”
    “তোকে কে বলেছে?”
    “ ও ভালো মানুষ।”
    “আছে রে রত্না, হৃদয় থাকা মানুষও আছে সংসারে।”
    রত্না চুপ করে রইল।
    “আমার ঘেন্না ধরে গেছে , বুঝলি রত্না ঘেন্নাতে ধরে গেছে আমাকে। আমিও বা কী পেয়েছিলাম? তোরই বা কী হলো?”
    “ওদের অনেক জোর।” রত্নার চোখে স্পষ্ট ক্রোধ।
    “ঠিকই বলেছিস তুই। ভীষণ দেমাক ওদের, ভীষণ শক্তি, বন্ধুক বোমার শক্তি, টাকার জোর, আলু-বেগুনের জোর।”
    “এতো জোর হলো কী করে ওদের?”
    “সবাই মিলে ওদের এতো জোর দিয়েছে, বুঝলি? আসলে ভয়, বুঝলি? সবাই ওদের ভয় করে।”
    চোখের সামনে হীরের আংটির দ্যুতি লবণ ঢালা মাংসের গর্তে পড়ে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে--- দেখতে দেখতে ওরা দু’জন বসে রইল।
    “কাল বেরুবি আমার সঙ্গে।”
    মিনতি বেরিয়ে এলো। রত্নার বাবা আসছে, “আমার যদি একটা ছেলে থাকত আজ...আমার একটা ছেলে।” স্ত্রী মারা যাবার পর ছেলের জন্যে বুড়োর হা পিত্যেশও বেড়ে গেছে। সবাই বলাবলি করে বুড়োর মাথাটা একেবারে গেছে।
    “ভাত দে বলছি না?” পেছন থেকে রত্নাকে একটা ধাক্কা দিল।
    চুলোতে আগুন ধরিয়ে বিড়বিড়িয়ে উঠল রত্না, “এরও দেমাক বড়।”
    বুড়ো বকেই চলেছে, “আমার যদি একটা ছেলে থাকত আজ...ছেলেটা মাছ, ...।দুধ.. যদি থাকত আমার একটা ছেলে।”
    কিচ্ছুটি না বলে রত্না ভাত রাঁধতে লেগে রইল।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৫৫495508
  • অধ্যায় পঁয়ত্রিশ (৩৫)

    মণি ভাড়া নিয়ে দূরে গেছে, আজ আসবে না। সে না থাকলে বাড়ি খা খা করে। মায়ের জন্যে কত যে ভাবনা ওর। পুরো যদিও করতে পারে নি, তবু মায়ের কথা ভেবেই এমন একটা ঘর তুলতে শুরু করেছে যার ভেতরেই থাকবে জলের ব্যবস্থা, স্নানের ঘর , পায়খানা। জমি যদি কিনতে হতো তবে আর কই ঘর তুলবার কথা ভাবতে পারত? কালী বুড়ির ওখান থেকে উঠে যাবে শুনে বস্তির সবাই এসে বাধা দিল, কালী মায়ের থান নষ্ট হয়ে যাবে। বস্তির সবাই কিছু একটা হলেই মায়ের কাছে এসে ভরসা পায়। থাকুক মণিরা ওখানেই। মণির হাতে দু’টো পয়সা আসতেই প্রথমে কালী বুড়ির খের বাঁশের মায়ের থান পাকা করে দিল। অবশ্যি কে কী করল কোনও হিসেব না রেখেই থানের কাজ শেষ হয়ে গেল। রজত মিস্ত্রির নামটা ভালোই মনে আছে। কাজের থেকে ফিরে সে রাতে রাতে বহু কাজ এগিয়ে দিল। রত্না এসে রোজ ধোয়া মোছা করে। সে মণির মায়ের ঘরের কাজেও সহায় করে দেয়। প্রায়ই এখানেই ভাত টাতও খেয়ে যায়। বাচ্চা মেয়ে, এই বয়সে হাসি মস্করা না করে কী করে থাকে? সেই পুরোনো কথা মালতীও তোলেনা, সে তো না-ই। ওর চেহারা সামান্য ভালো হয়েছে। মিনতি কি কম করল? সরকারি হাসপাতালে নিয়ে নিয়ে ঔষধ পাতি দিয়ে দিয়ে মেয়েটিকে ভালো করে তুলল। আগে মুড়ি ভেজে বাজারে আসা যাওয়া করে এসে বিছানাতে পড়তেই ঘুম আসত। আজকাল পুরো দিন শুয়ে বসে কাটানোর মতোই হলো। বাড়িতে আর কাজ কতটুকু? মণি প্রায় থাকেই না, শুধু রাতের খাবারটাই ঘরে এসে খায়। রত্না আছেই। মেয়েটিরও যেন হাত চুলকোতে থাকে। কিছু করবার না থাকলে আলনার কাপড়গুলোই নামিয়ে আবার গুছিয়ে রাখে। শুয়ে বসে থাকা মানুষের আর বিছানাতে পড়লেই ঘুম আসে কী করে? আর ঘুম না এলেই দুনিয়ার যত চিন্তা। আর মণি গাড়ি চালাতে শুরু করবার আগে ও একা থাকতে পেত কই? আজ ইচ্ছে করলেই মণি ফিরে আসতে পারত। কেন আসবে না খানিকটা হলেও ধরতে পারছে মালতী। জিজ্ঞেস করলে বলবে, ক্লান্তির কথা, রাত্রি বেলার বিপদের কথা। সে কি ক্লান্তিকে পরোয়া করবার ছেলে? না রাতের বিপদকে? ওর সঙ্গের ছেলে মিন্টুদের বাড়ি নদীর পাড়ে। বাড়িতে ঢোকার মুখে দু’ট নাহর গাছ। গুয়াহাটি থেকে ফেরার পথে ঐ বাড়িটার দিকে তাকালেই আজকাল মণিকে ক্লান্তিতে চেপে ধরে, রাতের বিপদের কথা বেশি করে মনে পড়ে। মালতীর মুখে একটা হাসি খেলে গেল। গেল মাসে হাজোর মন্দিরে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল মাকে, যাবার সময় পথে বন্ধুর বাড়িতেও নিয়ে গিয়েছিল। মনে হয় খবর দেয়াই ছিল। ঢোকার যায়গা থেকে বাড়ির পেছনের উঠোন অব্দি লাল মাটিতে লেপা ছিল। চিকমিকে কাঁসার থালাতে করে ওকে আর মণিকে নাড়ু-পিঠে দিয়েছিল মিন্টুর বোন রীণা। তার পরনে ছিল হাতে তৈরি কাপড়, মাথা পেছন থেকে ঢাকা, কপালে বড় করে লাল ফোটা। কাজকর্ম জানা, শান্ত , মিষ্টি দেখতে মেয়েটিকে দেখেই ভালো লেগে গিয়েছিল মণির মায়ের। রান্নাঘরে গিয়ে আরও এক কাপ চা চেয়ে নিয়ে খেয়েছিল মণি। রীণার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ফুর্তিতে উপচে পড়ে করা প্রশ্ন একটা শুনেছিল মালতী, “ আমি এলে এসব পাইনে কেন?” একই ফুর্তিতে উপচানো আরও এক নারী কণ্ঠ চাপা গলায় উত্তর দিল, “ শাশুড়ি যে প্রথম এলেন!” বিছানাতে পাশ ফিরে শব্দ করে হেসে ফেলল মালতী। ক’দিন ধরে মণি বলতে শুরু করেছে, “একটা ঘরে বড় সমস্যা, আরেকটা কোঠা বাড়ানো দরকার।” মণির বিয়েটা দিতে হবে এবারে। লাল বড় ফোটা দেয়া কোঁকড়া চুলের সেই মেয়েটি অনেকক্ষণ ওর পাশে পাশে ঘুরে বেড়ালো।
    “এই মণির মা! উঠ তো, উঠ!”
    মাঝরাতে মিনতির ডাক। ওর আবার কী হলো আজ? কত দিন পরে আজ আবার সে আগের মতো এসেছে।
    “মামী, মামী!” নবীনের ডাক।
    কী বা হলো। মণি গাড়ি নিয়ে গেছে। বুক ধড়ফড় করে উঠল।
    “ কী হয়েছে?”
    হুড়মুড় করে দু’জনে ঢুকে এলো। নবীন, মিনতি, আর ওদের ছেলে—তিনজনের মুখেই স্পষ্ট ভয়ের চিহ্ন। নবীনের কাগজের মতো সাদা মুখখানা দেখে মালতীর শরীরটাও শিরশিরিয়ে উঠল। একটা পুরুষ মানুষ ওভাবে ভয় পেয়েছে!
    পুরো দু’গ্লাস জল খেলো নবীন। মিনতি জলটুকুও খেতে পারে নি। থকথক করে কাঁপছে।
    “ওর সঙ্গের কেউ এসেছে?”
    “ না।”
    “কোনও জিনিস রাখতে এসেছে?”
    “ না তো।”
    “কী হয়েছে, খুলে বলবি তো!”
    “ দু’টো লোক ড্রাইভারণীর বাড়ির পেছনে...।”
    কথাটা মিনতি শেষ করতে পারে নি।
    “হ্যাঁ, মামী! রাত্রি বেলা মাটি খোঁড়ার শব্দ শোনে আমরা বেরিয়ে দেখলাম। ড্রাইভারণীর পায়খানার কাছে দু’টো মানুষ ফেলে রেখেছে।”
    “একটা পুরুষ, একটা মেয়ে মানুষ।”
    “কে ফেলেছে?”
    “ বলতে পারব না, লোকগুলোর মুখ বাঁধা ছিল।”
    মিনতির ছেলে ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে।
    “কী ভাষাতে কথা বলছে?”
    “বাংলা ভাষা। ড্রাইভারণীর মতো কথা বলছে।”
    “ড্রাইভার?”
    “ সে মদ খেয়ে বেহুঁশ! পালিয়েছে যেন মনে হচ্ছে।”
    “ প্রায়ই ও এমনই করে, পালালই যেন মনে হচ্ছে।”
    “ ওর টাকা চাই।”
    “টাকা নেই ওর? বস্তিতে ওর মতো জিনিস পত্রে ঠাসা পাকা ঘর আর কার আছে?”
    “ওর ব্যবসাতে মন্দা চলছে। বিছানাতে তুলবার জন্যেও মানুষ পায় না। মদও আগের মতো বিক্রি হয় না।”
    মিনতি যখন কথা বলছিল, নবীন মাথা নুইয়ে বসে পড়ল। হঠাৎ সে বলে উঠল, “আবার একটা লাগবে। টাকার জন্যে মহিলাটি নিজের বাড়িতে লাশ দু’টো পুঁততে দেয়া ঠিক হয় নি।”
    “ মানুষ দু’টো কি অসমিয়া বলে মনে হলো?”
    “ এখনই ভোর হবে। দু’-দু’টো মানুষ পুঁতে ফেলতে পারবে? পুলিশে যদি খবর পায়...আর্মি আসবে...।”
    সবার চোখে ভেসে উঠল পুলিশ মিলিটারিতে গিজগিজিয়ে থাতা সেই আগেকার বস্তি। পুরুষেরা রিজার্ভে গিয়েছিল, দোষ থাক না থাক ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আবার হবে, সব কিছু আবার হবে।
    “আমি শুনেছি, আসবার সময় ওরা ড্রাইভারণীর ভাষাতে কথা বলছিল। লাশগুলো পায়খানার টেংকিতে রাখবে। কাপড় চোপড় আর চুড়ি বালা মাটিতে পুঁতে ফেলবে।” মিনতির গলা বসে বসে গেছে।
    “ ওরা আমাদের দেখেছে।” নবীনের গলাটাও বসে গেছে।
    “ দিন দুই তোরা আমার এখানে রাতে থাকবি। এমনিতেও মণি আজকাল রাতে থাকে না।”
    “মণিকে বলবি মামী। কোনও ড্রাইভার যেখানে রাতে গাড়ি নিয়ে যেতে চায় না সেসব জায়গাতে সে আজকাল চলে যায়। দেখ গিয়ে তো কে তার মতো রাতে ভাড়া মারে?”
    “ সে একটা ঘর তুলতে চাইছে। দু’টো পয়সার জন্যেই সে অমন করছে।”
    বাইরে আলো ফুটেছে। সে তিনকাপ চা করবার জন্যে পাকঘরে গেল। মণি গ্যাস এনেছে। ভোরের রোদ পড়ে গ্যাস জিলকে উঠল। চাদরের আঁচলে আড়াল করে সে রূপালি গ্যাসটা জ্বালিয়ে নীল আগুনের দিকে তাকিয়ে রইল। লাগবে না, রোজ রাতে অন্যেরা যেখানে যেতে চায় না সেখানে গাড়ি নিয়ে যেতে হবে না। ওভাবে উপার্জন করে বাড়ি তুলতে হবে না। কালী বুড়ির ঘরটা পড়ে আছে। মালতী সেখানে গিয়ে থাকবে, মণি থাকবে এখানে। বলবে সে, মণি এলেই বলবে।
    চা খেয়ে নবীনরা চলে গেল।
    পরদিন সকাল হতেই বস্তিতে হৈ হল্লা শুরু হলো। শোয়ালকুচির থেকে এসে রিজার্ভে নতুন বাসা করেছে হরিদাস আর তার বৌ। দু’জনই নিখোঁজ। লোকটা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পাট-মুগার কাপড় বিক্রি করত। টিনের চাল দিয়ে দু’টো মানুষ কোনও রকমে থাকত। মরা সাপও ডিঙিয়ে যায় না যে মানুষ দু’টো, এরা যাবে কই? কোথাও আত্মীয় বন্ধুর বাড়ি গেলেও লোকে ওভাবে ঘর দোয়ার খুলে রেখে যায় না। কড়াইতে মাছের ঝোল, থালে বাড়া ভাত রেখে মানুষ ওভাবে বেড়াতে যায়? আত্মীয় কুটুম বলতেও আর তেমন কেউ নেই। একেবারে একেলাই ছিল স্বামী স্ত্রী। রিজার্ভের ভেজাল মাটিতে দুই একঘর মানুষ নতুন করে বসলেও এখনো অনেকেই বসে নি। ওদের বাড়ির কাছাকাছি গাছের গুড়িগুলো কই গেল কী করে জানবে এরা? বাড়িতে আশ্রয় নেয়া দেশি কুকুরটাকেই বা কী জিজ্ঞেস করা যায়? না কি বাড়া ভাত, বিছানো বিছানাকেই জিজ্ঞেস করা যায় কই গেল এরা দু’জন? দুপুরের দিকে পুলিশ মিলিটারি এসে পুরো জায়গাটা ভরিয়ে ফেলল। আর্মি এক জোড়া কুকুর নিয়ে এলো। বস্তির আর রিজার্ভের পাতলা করে বসা দুই এক ঘরের মানুষজন, মাছের পুকুর, শুয়োর –মুর্গির ফার্মের চৌকিদার-সবাই এসে কুকুর দু’টোর সামান্য দূরে এসে ভিড় করল। কুকুর দু’টোর একটা কুচকুচে কালো, অন্যটা দুধের মতো সাদা। শরীরে কোটের মতো খাকি পোশাক। যে দু’টো শেকলে কুকুর দু’টো বেঁধে রেখেছে, তাতে হাতিও বাঁধা যাবে। শক্ত-পোক্ত লম্বা চওড়া ক’জন মিলিটারি বড় কষ্ট করে কুকুরগুলোকে ধরে রেখেছে। কুকুরে প্রথমে বাড়া ভাত ছেড়ে বাকি ঘরে ঘুরে বেড়ালো। তারপর শুঁকে শুঁকে রিজার্ভের পেছনে চিকন পথ ধরে বস্তিতে গিয়ে ঢুকল। শুঁকে শুঁকে কিছু দাঁড়ায়, বাকি মানুষও দাঁড়িয়ে পড়ে। এই পথ দিয়ে গেলে প্রথমেই পড়ে মিনতির পুরোনো বাড়ি। তারপরেই নবীনের বাড়ি। তার উত্তর দিকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা ড্রাইভারণীর পাকা ঘর। ভাঙা বেড়ার ভেতর দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে কুকুরগুলো ড্রাইভারণীর উঠোনে গিয়ে ঢুকলো। বাকি লোকজন ঢুকতে না পেরে এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে রইল। তারা শুনতে পেল ভেতরে কুকুরের ভীষণ ভৌ ভৌ ডাক আর সঙ্গে ড্রাইভারণীর চিৎকার, “আমাকে ছেড়ে দে রে!” তারপরে লাগাতার নাকি স্বরের কান্না, বাড়ন্ত কুকুরের গর্জন। কৌতূহলে দুই একজন বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে গিয়েছিল, যেতেই আর্মি তেড়ে এলো। সবাই চলে গেল। বস্তির এখানে ওখানে জটলা পাকানো মানুষের ভিড়ে কুকুরের ঘেউ ঘেউ চিৎকার আর তাদের দু’টোর পায়ের কাছে পড়ে থাকা রক্তাক্ত কাপড়ের কথা রাষ্ট্র হয়ে গেল।
    কথাগুলো একান থেকে ওকান হতে না হতেই সবাই দেখতে পেল ড্রাইভারণীর বাড়ি পুলিশে মিলিটারিতে সেই বাঁশের বেড়ার মতোই ঘন করে ঘিরে ফেলেছে। ঘন ঘনা গাড়ি আসছে আসছে। লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েই গেল। খবরের পর খবর বেরুলো।
    বাঁশ ঝাড়ের নিচে রক্তমাখা কাপড় মিলেছে।
    পায়খানার টেংকিতে পাওয়া মরা লাশের মাথাতে চুল নেই, মুখ আধখানা পোড়া।
    ড্রাইভারণীকে অনেক টাকা দিয়েছে। টাকার লোভেই সে এই কাজ করতে রাজি হয়েছে।
    এদেরকে মেরেছে যে পার্টি তার একটা ধরা পড়েছে।
    ড্রাইভারণীরই জাতি গোষ্ঠীর মানুষ।
    এখানকার লোক বেশি নেই, শিলিগুড়ির থেকে এসেছে।
    অস্ত্র-শস্ত্রও এসেছে শিলিগুড়ির থেকে।
    পরিণাম যা হতে পারে লোকে তার কথাও বলাবলি করছে।
    এরা আর সহ্য করবে না বসে বসে।
    কলকাতার থেকে বোমা বারুদ নিয়ে লোক এসেছে।
    ওদের হাতে এমন বন্দুক যে ঘুরালেই পাখি মারবার মতো মানুষ মেরে ফেলে।
    ওদের সবাই বোমা বানাতে পারে।
    জংলি পার্টি এদের সহ্য করতে পারে না।
    সব্বাইকে কচু কাটা করবে এখন।
    আর্মির সঙ্গে যে শেয়ালগুলো থাকে ওদের সঙ্গেই এদের ঘনিষ্ঠতা। লোকে এরপর বোঝবার চেষ্টা করে ঘটনাগুলো ওদের গায়ে কী চেহারায় গড়িয়ে এসে পড়বে?
    আমরা আর এখানে থাকতে পারছি না।
    রাস্তাতে পড়ে মরতে হবে।
    সব রোজগার পাতি বন্ধ হয়ে যাবে।
    শিলিগুড়ির পার্টিটা কী করে পরিবারটাকে মারল দেখলি না?
    জংলি পার্টির সঙ্গে আর কোন পার্টি আছে জানিস না?
    ঐ পার্টির কাছে এই নতুনটা আর এমন কি? কার বাবার এতো ক্ষমতা যে এদের এবারে রক্ষা করে?
    সবাই মারা পড়বে। এই পার্টির মানুষ ওই মানুষগুলোকে মারবে, ঐ পার্টির মানুষ এই মানুষগুলোকে মারবে।
    মোদ্দা কথা সবাইকে মরতে হবে।
    এক মুঠো চাল, এক মুঠো আটাও পাওয়া যাবে না।
    কেউ বেঁচে থাকবে না।
    বিকেলের দিকে মানুষগুলো নিশ্চুপ হয়ে পড়ল। প্রায় সবাই দেখেছে দু’টো পায়খানার টেংকির জলে ভেজা দু’জন মানুষের মরা লাশ গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। দম বন্ধ অবস্থার থেকে বেরুতে না বেরুতেই বিকেলের আকাশ বাতাস চিরে এক বিকট চিৎকার লোকে শুনতে পেলো। ঠিক চিৎকার নয়, লাগাতার পেড়ে যাচ্ছে গালি। গালির শব্দগুলো, টনটনে গলা সবার চেনা। কিন্তু গালির অশ্রাব্য শব্দগুলোর মাঝে মাঝে যে আর্তনাদ আর কান্না ভেসে আসছে সেটি সবার অচেনা। ড্রাইভারণীকে পুলিশ গাড়িতে তুলছে। যারা ধরা পড়েছে তাদের একজন ড্রাইভারণীর হাতে টাকা দেবার কথা বলে দিয়েছে। ড্রাইভার রাতেই বাড়ি থেকে পালিয়েছে।
    “শালা হারামজাদা, বৌর টাকাতে খায় হারামজাদা! ও আমার টাকা নিয়ে চলে গেছে রে! আমি ওদের স্কুলের বই দেবো, ফীজ দেবো,আমার অসুখের জন্যে ডাক্তার দেখাবো বলে রেখেছিলাম। সব নিয়ে গেছে ও। ওকে খুঁজে আন না কেন? মেয়ে মানুষের উপরে বড় যে পুরুষের দম দেখায়। ওকে ধরে আন, বৌর টাকাতে চলা বেটাটাকে ধরে আন।”
    গাড়ির শব্দ, গালি আর কান্নাতে মিলে মিশে অদ্ভুত এক চেহারা নেয়া গলাটা অনেকক্ষণ ধরে লোকে শুনতে পেলো। অন্ধকার হবার সঙ্গে সঙ্গে এই অদ্ভুত গলাটা পুরো বস্তিকে ছেলে ফেলল। বাতাস উপরে উঠে গেল। বাতাসের জায়গা নিলো একটা গন্ধ আর অদ্ভুত সেই গলা। সেইগুলোই শ্বাসের সঙ্গে বুকে ভরে নিলো বস্তির সমস্ত মানুষ।
    খিদেয় উপোসের মধ্যেই বুক ভার করে বাতাস বাতাস করে ছটফট করতে করতে লোকগুলো ছটফট করতে থাকল। সবার না জ্বলা চুলোতে গিয়ে বসে পড়ল সেই কুকুর দু’টো, কুচকুচে কালো আর দুধের মতো সাদা। শুধু ক্ষুধার্ত পেটে গিয়ে ঢুকল বিষ্ঠার জলে ভেজা জবজবে দুই মরা শবের গন্ধ, কান দিয়ে গিয়ে মাথাতে ঘুরপাক খেতে থাকল একটি মহিলার অদ্ভুত চিৎকার।
    শহরে কার্ফিউ ঘোষণা করা হলো।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৫৬495511
  • শেষ অধ্যায়
    সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেল মণির মায়ের। অবশ্য গত রাতে সে বেশ তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েছিল। মণি একটা বিয়ের ভাড়া নিয়ে গেছে। দুই রাত থাকতে হবে। বর কনে নিয়ে একেবারে আসবে। দিনরাতের তফাৎ ভুলে গিয়ে খাটছে ছেলেটা। মা-ছেলের পেট চালাবার পরেও সিঙের ধার মারছে। মাঝে মধ্যে তার গ্যারেজে গিয়েও কাজ করে দিয়ে আসে। দুই একজন কখনো বা তাদের গাড়ি-স্কুটার বাড়ি অব্দি নিয়ে আসে। মাঝে মধ্যে মণিকেও নিয়ে যায়। কখনো বা মালতী ছেলের হাত দু’খানা দেখে। আঙুলের গাঁটগুলো কঠিন হয়ে বেরিয়ে পড়েছে, তালু সোজা হয়ে গেছে। ছেলেটার গায়ের সেই ফর্সা রং আর নেই। রোদে বাতাসে পুড়ে গেছে। মালতীর নিজেরও কি আর সেই পুকুর ভরা মাছের বাড়িতে বাড়িতে কাটানো দিনগুলোর মতো আছে? নেই। টগর ফুলের মতো হাতের ঠাঁই এখন এটা এক গাঁট বেরোনো কঠিন হাত। যদি দেখত সেই মানুষটা, কীই বা বলত এখন? সেই যে সেগুন পাতের মতো ছড়ানো হাতের মানুষটা?
    শরীরের কাপড়টা ভালো করে জড়িয়ে নিলো। পাহাড়ের কাছের এই জায়গাতে শীত বড় তাড়াতাড়ি নেমে আসে। আজ বহু দিন পর সে আকাশের দিকে তাকালো। নীল রংটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে। নীল পাহাড়টাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অনেকক্ষণ সে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইল। নীল রংটা আকাশের নীলের মতো এতোটা উজ্জ্বল নয়, খানিকটা সবুজ মেশানো। মাঝের উঁচু পাহাড়ের উপরের সাদাটুকু এই ভোরে স্পষ্ট হয় নি। সামান্য আভাস শুধু পাওয়া যাচ্ছে।
    হাতে ঝাড়ু নিয়ে সে উঠানে নেমে গেল। উঠোনে মাঝে মাঝেই ঘাস উঠেছে। কতদিন এই ঘাসগুলো ছাটতে পারে নি। গোলমাল, গোলমাল করে করে লোকগুলো আর কোনোদিকে নজরই দিতে পারে নি। আজ এই মাস কয়েক ধরে খানিক শান্তি হয়েছে। আবার বা কী হয়? সেই মণিদের ধরে নিয়ে যাবার পরে কম কিছু হলো? শুধুই কি এখানে? সেবারে সেই যে একটা রেল গড়িয়ে পড়ল, তারপরে আরো একটা। কত মানুষ মারা গেল। কত বাসে বোমা ফুটল। আজ ক’মাস ধরে কিছু ঘটে নি। নবীনের থেকেই সে জেনেছে, বুলেনের পার্টিকে সরকার সম্প্রতি আলোচনার জন্যে ডেকেছে। সেজন্যেই মনে হয় গোলমাল সামান্য কমেছে। রোদ কোনদিকে গেল, বৃষ্টি কোনদিকে গেল কেউ টেরই পেল না। দেখতে দেখতে আশ্বিন মাস এসে গেল। পুজোও এলো বলে। সে যতটা পারে হাতে ঘাসগুলো ছিঁড়ে সাফ করবার চেষ্টা করে বাদ দিল, সময় করে কোদাল-খুন্তি নিয়ে সাফ করতে হবে। ঝাড়ু দিয়ে বাকি উঠোন পরিষ্কার করে নিলো। কালী থানের পাশে কালী বুড়ির লাগানো গাছে শিউলি ধরেছে। তলাটা সাদা হয়ে গেছে। এক দু’টো হাতে নিয়ে সে শুঁকে দেখল। গন্ধটা নাকে নিয়ে খানিক বসে রইল। তারপর আবার উঠোন ঝাড়ুতে লাগল। পুরো বাড়ি নোংরা হয়ে আছে। চারদিকে জঞ্জাল আবর্জনাতে ভরে পড়েছে। এতো আবর্জনা যে কোত্থেকে জমে এসে। করে না করে না বলেও, সময় পেলেই সে ঝাড়ু নিয়ে উঠোন ঝাঁট দেয়। চারদিকটা ভালো করে দেখে নিলো। এতো সব খড়-কুটো এলো কোত্থেকে? কালী বুড়ির ঘরে চাল ফুটো হয়ে গেছে। যে ঘরটাকে সে পাকঘর করে ব্যবহার করে তার চালও ফুটো হয়ে গেছে। ফুটো চালে শালিক আর চড়াই পাখি বাসা করে আরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে খসিয়ে দিচ্ছে চাল। মণি আর কতটুকু করবে? টিন লাগিয়ে একটা ঘর তুলতেই তার কি কম পয়সা গেছে? দিনকে রাত করে খাটছে ছেলেটা। মিলিটারির মার খাবার পর থেকেই ওর ডান কাঁধে একটা ব্যথা। রোজ রাতে লবণ বাঁধা পোটলা একটা দিয়ে সেঁকা দিতে হয়। ঘুমের মধ্যে একাৎ ওকাৎ করতে গিয়ে প্রায়ই সে কোঁকিয়ে উঠে। বিয়ের ভাড়া নিয়ে গেছে, পুরো রাত ঐ গাড়ির সিটেই বসে থাকবে। ওর বিয়েটাও দিয়ে দিতে হবে। খড়-কুটোগুলো এক জায়গাতে জমা করে দাঁড়ালো মালতী। কোমর টনটন করছে। আজকাল টানা কোনও কাজ করতে গেলেই কোমরটা এমন টনটন করে উঠে। কালী বুড়ির ঘরটা পারছে ছেয়ে দিতে হবে। ঠাকুরের ঘরটা পাকা করে দেবার সময় মণি টিনের চালও লাগিয়ে দিয়েছিল। কে কবে লাগিয়েছিল এই সব খের । না পচে যাবে কই? কিছু একটা করতে হবে। খেরের দাম কি কম বেড়েছে? পাওয়াও যায় না আগের মতো। তার থেকে টিন লাগালে সস্তা পড়বে। কালী ঠাকুরের থানের পাশের চালাটা, কালী বুড়ির ঘরটা, এদের নিজেদের পাকা ঘর ----সব ক’টার চাল টিনই হোক , কিম্বা খের --কিছু একটা লাগাতে হবে। পুরো কাজটা করতে খরচ কেমন পড়বে হিসেব করতে সে বসে পড়ল।
    “ ও মণির মা, কী করছিস?” সেই জোনের মা। অসুখের পর থেকে তার আগের স্বাস্থ্য আর নেই, তাও যেটুকু মজবুত আছে তার ধারে কাছে বাকিরা টিকতে পারবে না। কী গাধার খাটুনি যে মানুষটি খাটতে পারে। ছেলে দু’টোকে নিয়ে দুই হাতে খেটে মানুষটি সংসার সামাল দিচ্ছে। জোনের মা ভেতরে এলো। হাতে একটা কাঁচি।
    “ধান কাটতে বেরুলি কই?”
    রোজকার মতো হাত-পা মেলে সে বসল।
    “ এই একটু কাশ বন কাটব গিয়ে ভাবছি। ঘরের চালটা যদি এখনই ঠিক না করি আসছে বর্ষাতে বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। এবারেই বেশ কয়েকটা জায়গাতে ফুটো হয়েছে। বাটি ঘটি দিয়ে রাখতে হয়।
    “কই কাটবি?”
    “ওই চেনিপাড়ার দিকে।”
    “কত দূরে?”
    “দূর কিছুটা আছে। রেল পথ ধরে গেলে কিছু সামনে পড়বে।”
    “একা একা যাবি?”
    “মিনতি, মীরার মায়েরাও যাবে।”
    “কখন যাবি?”
    মিনতি, মীরার মা, রত্না, ফুল সবাই এসেছে। সবার হাতে কাঁচি।
    মণির মা রোজকার মতো আজও অবাক হলো। ওদের সবার সঙ্গে ওর ব্যাপার স্যাপার মিলে যায় কী করে? সে যদি বা ভাবল একটা কম্বল কিনবে, দেখা যাবে কেউ এসে খবর দিয়ে যাচ্ছে, ওই দোকানে একটু ফুটো টুটো থাকা কম্বল সস্তাতে বিক্রি করছে। ইঁদুরে কেটেছিল। সামান্য তালি দিলেই হবে। কাপড় একটা কিনবার কথা বললে একজন বলে উঠবেই “ আমারটাও ছিঁড়েছে। গেলবার একসঙ্গে কিনেছি না? সাধনা বস্ত্রালয়ে জোড়া দেয়া শাড়ি এসেছে। আঁচল ভাল, পাকা রং। জোড়াটাও নজরে আসে না, দাম...” লাকড়ি চাই, শীত আসছে। একজনের বাড়িতে তুষ পাবেই, অন্যজন এসে গোবরের খবর দেবে। এক সঙ্গে সবার দাওয়াতে দেখা যাবে গোবর খুঁটির লাইন। হাওয়াই চপ্পল ক্ষয়ে যেতে যেতে আর ফিতে পালটানো যাচ্ছে না। একজন না একজন এসে বলবেই না, আগরওয়ালা স্টোর্সে কম দামে স্যান্ডেল দিচ্ছে। দোকানের সামনে চাল বাড়িয়ে দিয়ে দেদার স্যান্ডেল বের করে দিয়েছে, চিনিতে পিঁপড়ে পড়ার মতো গিয়ে উপচে পড়েছে মানুষে। পরদিন বাজারে যাবার পথে সবার পায়ে নতুন স্যান্ডেল। ক্ষয়ে যাওয়া, ফিতা পালটানো নয়—একেবারে নতুন চকচকে। আজও মিলে গেল। সেও ফুটো চাল নিয়ে ভাবছিল। ওরাও এসে গেছে।
    “আমিও যাই, দাঁড়া।” সে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে ওদের দিকে তাকালো। “ আয় না, একটু চা খেয়ে যা এসে। আমিও যাবো।” সবাই এরা চা-মুড়ি নিয়ে বসল। সে রাতের জল দেয়া ভাতে একটা প্যাঁজ কেটে লংকা ভেঙ্গে মেখে নিলো। সকাল বেলাই যদি দু’টো ভাত পেটে পড়ে যায়, তবে আর গোটা দিনের জন্যে ভাবনা নেই। এই কথাতেও তার ওদের সঙ্গে মিল। সবাই লংকা ভেঙ্গে ঠাণ্ডা ভাত একটু একটু খেয়ে এসেছে।
    রাস্তাতে পা দিয়েই সে পাহাড়গুলোর দিকে তাকালো। আজ দেখা যাচ্ছে না। মেঘে ঢেকে রেখেছে। আবহাওয়াও একটু ভার। আকাশ জুড়ে ছেয়ে আছে হালকা কালি রঙের একটা চাদর। এরা বস্তি পেরিয়ে এলো। উজাড় করা জঙ্গল পেরিয়ে এলো। সেই জঙ্গলের ঠাঁই এখন ঘরই ঘর। ছেলেদের মিশন পার হলো। মিশনের সামনে রোজ ওদের চলাটা ধীর হয়ে আসে। কী করে এতো সাজিয়ে সুন্দর করে রাখে মিশনটা? গেলবছরে রোপণ করা হয়েছিল ছোট ছোট বোতামের মতো ইন্দ্রমালতী ফুলগুলো। সেগুলো আগে থেকেই ফুটে গিয়ে জকমকিয়ে রেখেছে ফুলের বাগান। মণির মা আন্মনেই বলে উঠল, “দেখ, কী সুন্দর এই ফুলগুলো!”
    আবার চলার গতি দ্রুত হলো। কেক কেক করে একটা কাঠবেড়ালি এক নারকেল গাছ থেকে লাফিয়ে আরেকটা নারকেল গাছে চড়ে তৎক্ষণাৎ মিলিয়ে গেল। সবাই সেদিকে তাকালো। এখানে চারদিকে সার বেঁধে লাগানো নারকেল গাছে ঘেরা বিশাল উঠোনের এক বাড়ি আছে। শহরের এক বিশাল বড়লোকের বাড়ি। বিরাট ব্যবসা আছে। গ্যাসের ব্যবসা ছাড়াও শহরের মধ্যিখানে ঔষধের দোকান, জুতোর দোকান। আজ বছর খানেক হলো পরিবারটি উঠে চলে গেছে। জুতোর দোকানে বসত বড় ছেলেটাকে গুলি করে মেরেছিল। অনেক টাকা চেয়েছিল। ওই কাপড়ের বুড়ো দোকানীকে গুলি করে মারবার পরের ঘটনা। ছেলেটা আর্মি পুলিশকে খবর দিয়ে রেখেছিল। ওদের ছেলেরা সময় দেয়া মতোই টাকা নিতে এসেছিল। একটা আর্মির গুলিতে মরল, অন্যটি ধরা পড়ল। তার এক সপ্তাহ না যেতেই সবাই ভালো বাসে এমন শান্ত ছেলেটি রক্তগঙ্গাতে ডুবে গেল। তারপরেও এই পরিবারটি ছিল। বাড়ির মূল মানুষটিকে যখন গুলি করল, একরাতেই এরা বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। ভাগ্য ভালো যে মানুষটি বেঁচে গিয়েছিল। এতোদিন বাড়িটাতে তালা ছিল। স্বর্ণলতা গজিয়ে গাছগুলোকে হলদে করে ফেলেছিল। কাঠবেড়ালি মনের আনন্দে নারকেল গাছে গাছে ঘুরে ফল খেয়ে যাচ্ছিল। তলাটা ভরে গেছিল কাঠবেড়ালিতে খেয়ে ফুটো করে ফেলে দেয়া পচা নারকেলে। সে জায়গাটা পেরুলেই পচা নারকেলের ভাতের মাড়ের মতো গন্ধ একটা নাকে লাগে এসে। আজ এদের নাকে গন্ধটা লাগল না। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল দরজা জানালা সব খোলা হয়েছে। দু’টো লোক উঠে নারকেল গাছগুলো পরিষ্কার করছে। শুকনো পাতাগুলো কেটে ফেলছে, পাকা ফল সব পেড়ে ফেলছে। নারকেল খেতে এসে কিচ্ছু না পেয়ে কাঠবেড়ালি চিৎকার করেই পালিয়ে যাচ্ছে। কাঠবেড়ালির রাগ দেখে এদের হাসি পেয়ে গেল।
    “ পরিবারটা এলো মনে হয়।”
    “ঘর দোয়ার ছেড়ে এতোদিন এরা ছিল কই?”
    “আজ নিশ্চয় নিজের বাড়িতে ফিরে এদের বড় ভালো লাগছে।”
    “মেয়েরাও এসেছে।”
    “কী করে জানলি?”
    “ ভেতরের দিকে মেয়েদের কাপড় মেলে দিয়েছে।”
    “তোর চোখটা তো কম নয়!”
    সবাই বড় করে হাসা দিল। আসলে এতোদিন শ্মশানের মতো খালি পড়ে থাকা বাড়িটাতে মানুষজনের ফিরে আসা দেখে এদের মনটা এমনিই ভালো হয়ে গেল।
    “একেবারে থাকবে বলেই এসেছে হয়তো।”
    “ পরিবারটা থাকবে কী?”
    “ দেখ , থাকতে পারে কি না।”
    “হয়তো বাড়ি ঘরে অবস্থা দেখতেই এসেছে।”
    নিজেদের ভেতরে আলোচনা করতে করতেই ওদের মন ভার হয়ে এলো। কথা না বলে জোরে পা চালিয়ে এরা যেতে থাকল।
    প্রায় শহরের শেষে গিয়ে এরা রেলপথে উঠল। পথের পাশে পাশে পাথরের উপর দিয়ে চলতে থাকল। একটা মালগাড়ি পেরিয়ে গেল। ফুটুকা ১ , নাগা গাছের ২ ঝোপের মাঝে পড়ে এরা দাঁড়ালো কিছু। আবহাওয়া ফর্সা হচ্ছে। কোমল রোদের কিছু কিরণ চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। পাহাড়শ্রেণি নজরে আসছে। বাতাস ভেজা ভেজা। রেলের সেতুতে গিয়ে পৌছুলো। সিঁড়ির মতো ফাঁকা ফাঁকা সেতুটা এরা একে অন্যের হাত ধরে ধরে রেলের উপর দিয়ে পেরিয়ে গেল। এর নিচে দিয়েই চলে গেছে ছোট্ট নদী। ফুটফুটে পরিষ্কার জল। নদীর বুকের পাথরগুলো জিলকোচ্ছে। এক দল ছেলে মেয়ে হৈ চৈ করে সাঁতার কাটছে। নদীর পাড় দিয়ে এরা রেলের সেতুতে চড়ে। সেখান থেকে ঝপাং করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জলের তোরে সেতুতে চোঁও চোও শব্দ একটা করে। রোদ পড়ে সেই ছিটকে বেরুনো জলকে দেওয়ালির সময়কার বাজি কলাগাছের মতো দেখায়। জলে তৈরি ফুলে ভরা একখানা গাছ গজায়, পর মুহূর্তে আবার মিলিয়ে যায়। এরা ক’জন ওখানে সামান্য দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েদের খেলাটা দেখল। তারপর আবার এগিয়ে গেল। বাচ্চারা অনেকেই ন্যাংটো। সেই ন্যাংটো শরীর দুলিয়ে নেচে নেচে এই মহিলাদের দেখে কী সব বলতে বলতে পাড় দিয়ে উঠল, আবার ঝাঁপিয়ে নদীতে পড়ল। এক সঙ্গে বেশ কয়েকটা জলে তৈরি ফুলভরা গাছ। এই গজায়, এই মিলিয়ে যায়।
    আরেকটু এগিয়ে রেলের আঁকা বাঁকা পথ ধরে গিয়ে এরা ঢালু পথে নেমে গেল। নেমে দাঁড়িয়ে পড়ল আবার। আপনিই এদের কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল। একটু সময়ের জন্যে সব কিছু ভুলে গেল এরা। শুধু তাকিয়ে রইল। আদি অন্তহীন একটি কাশ ফুলের সমুদ্র। ভেজা বাতাস কাশবনের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই সাদা সমুদ্রের ঢেউ খেলে যাচ্ছে। হালকা কালো এক টুকরো মেঘে সূর্য ঢেকে ফেলেছে। দেখা যাচ্ছে না সূর্য। শুধু মেঘের কিনার ধরে রূপালি পাড় নজরে এলো। কালো মখমলের কাপড়ের রূপালি আঁচলের ছেঁড়া অংশটা দিয়ে কয়েকটা রূপালি সুতো জিরজির করে এসে কাশবনের উপরে পড়ে গেল। যেখানে পড়ল সেখানেই একটা চুমকি বসিয়ে গেল। রূপালি চুমকি বসানো একটা সাদা পাটের চাদর ঢেউ খেলাতে খেলাতে নীল পাহাড়ে গিয়ে ঠেকল।
    কাশবনের ভেতরে চলে গেল এরা ক’জন। রূপালি কাজ করা মোলায়েম পাটের চাদরের তলায় লুকিয়ে পড়ল। ফেলানি এর আগে কখনো কাশবন কাটতে আসে নি। কোন ঘরের কোথায় চাল দিতে হবে, কোথায় বেড়া বসাতে হবে এসব কালীবুড়ি দেখত। দু’বারের মতো ঘরের চাল ছাওয়া সে দেখেছিল। ওসব কাশই ছিল না সন ওসব সে নজর দিয়ে দেখে নি। জোনের মায়েরা প্রতিবছরই কাটে। যেটুকু কাজে লাগে লাগিয়ে বাকি নল বিক্রি করে দেয়। খের-টিন যারা কিনতে পারে না সেসব মানুষের জন্যে এই বিনা পয়সার কাশবন বড় কাজে আসে। চাল ছাওয়া যায়, বেড়া দেয়া যায়। শক্ত করে ছাওয়া কাশের চাল খেরের থেকে কম কিছু নয়। এমনিতে সামান্য হালকা হয়, কিন্তু বাঁশে তৈরি রশি দিয়ে বেঁধে দিলে বর্ষাটা পেরিয়ে যায়। কাশের ডাঁটা দিয়ে বেড়া করে মাটি দিয়ে সামান্য লেপে দিলে আর যদি বৃষ্টির জল না পড়বার ব্যবস্থা করা যায় বেশ কিছু দিন টিকে থাকে। ফেলানি তাকিয়ে দেখে শুধু এরা ক’জনই নয় আরো অনেকে এসে কাশ কাটছে।
    কালো মেঘের থেকে সূর্য বেরিয়ে এলো। চুমকি বসানো চাদরটা আর নেই। তার জায়গাতে ওই বাচ্চা বিয়োনোর সঙ্গে সঙ্গে যে সোনা রঙের দুধ বেরোয় সেরকম রঙের মসৃণ তাঁতশাল থেকে এই মাত্র কেটে বের করে আনা একখানা পাটের চাদর বিছিয়ে গেল। ঢেউ খেলে খেলে পাহাড়ের কাছে পৌঁছে সেই চাদর হয়ে গেল একটা নদী। বুকে জল নয়, এই মাত্র খিরানো বাচ্চা বিয়োনো গাইর দুধ নিয়ে নদীটা এঁকে বেঁকে পাহাড়ের তলায় তলায় বয়ে গেল।
    হাতে কাঁচি নিয়ে জোনের মায়েরা কাশ কাটতে শুরুই করে দিয়েছে। ওকে সামান্য অন্যরকম করতে দেখলেই ওর মুখের উপর কালো কালো চোখের মণিগুলো স্থির করে রেখে জিজ্ঞেস করবে, “ কী হলো রে, মণির মা?” রোজকার মতো আজও তার হাসি পেল। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। দুধের নদী পাটের চাদরে ঢেকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া ফেলানিকে টেনে কাছে আনতে পারল না জোনের মা। কাশবন কাটা ছেড়ে সবাই তাকেই দেখছে। জোনের মা বলে উঠল, “ এই মণির মা, বল আবার। দেখ, কী সুন্দর কাশবনটা। আবার বল।” খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল সবাই। এই হাসিই তাকে দুধের নদী থেকে পাড়ে টেনে আনল। শরীর থেকে খুলে ফেলল পাটের মোলায়েম চাদরখানা।
    “ তাই তো। দেখ কী সুন্দর!” কোমরে কাপড় প্যাঁচিয়ে সেও কাশ বন কাটতে শুরু করে দিল ।
    মীরার মা, জোনের মায়ের মতো সেই ঘন কাশবনের মধ্যে প্রথমে ঢোকে ঝোপ একটার চারপাশের গাছগুলো কেটে ফেলছে।তারপরে মাঝে পড়ে থাকা ঝোপটা কেটে মুঠো করে পাশে এক জায়গাতে রাখছে। কাশের ডাঁটার ভেতরের সাদা রসটা একবার ছুঁয়ে দেখল। কিছুটা আঠালো আর কষা। জোনের মায়েদের মতো এতো দ্রুত হাত চালাতে না পারলেও কেটে সে ঠিকই গেল। মাথার উপর দিয়ে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়োউড়ি করছে ছোট ছোট পাখি কিছু। পুরো কাশবন জুড়ে এই ছোট ছোট পাখির ঝাঁক।
    “এতো এতো পাখি। লোকে যদি সব কাশ কেটে নিয়ে যায় , এরা থাকবে কই?”
    ওর প্রশ্ন শুনে বাকিরা হাসল।
    “এতো এতো কাশ। কে কেটে শেষ করতে পারবে রে?”
    “ এটা কী পাখি, দেখছিস?”
    “ বছরে বছরে টুনটুনি পাখিগুলো কমে আসছে।”
    “কী পাখি বললি?
    “টুনটুনি পাখি।”
    “ওই যে উড়ে গেল, ওগুলো কি টুনটুনি?”
    “চড়াই পাখির মতো পাখি।”
    “ওগুলোই টুনটুনি।”
    “আগে এরা ঝাঁকে ঝাঁকে পুরো কাশবন ভরে ছিল।”
    “গাঁয়ের মানুষ রাতে আগুন হাতে করে আসে।”
    “কাঁসি বাজিয়ে বাজিয়ে আসে।”
    “খাগড়াতে বানানো বাঁশিও বাজায়।”
    “পাখিগুলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।”
    “নিথর পাখিগুলোকে মেরে মেরে খায় গো লোকে, পারে কী করে!” টুনটুনির কথা বলতে বলতে এক সময় এরা চুপ করে গেল। চারদিকে শুধু কাঁচিতে কাশ কাটার শব্দ।
    কোমরটা সোজা করতে সামান্য দাঁড়ালো ফেলানি। পাহাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, রঙ নীল হয়ে এসেছে। পাহাড়তলির নদীকে দেখতে লাগছে রাজহাঁস রোদ পোহাচ্ছে। শরীরে ঝিলিক । একবার হাত বুলোতে পারলেই যেন রেশমি ছোঁয়াতে সম্পূর্ণ শরীর শিরশিরিয়ে উঠবে।
    “পাহাড়ের নিচের কাশবনটা দেখতে নদীর মতো লাগে না?”
    “কী বলছে রে ও?”
    “সেতো নদীই ছিল।”
    “জল ছিল?”
    “নদীতে জল না থেকে কী থাকবে?”
    “তুই তখন বস্তিতে আসিসই নি।
    “তোর বিয়ে হয়েছিল?”
    “হয় নি, দিদির বাড়িতে ছিলাম।”
    “পাহাড়ের উপরের জালিমুখে তিনটা নদীই বাঁধ দিয়ে রাখা আছে। কেউ একবার বাঁধটা কেটে দিয়েছিল। ভাঙ্গা বাঁধ দিয়ে জল উপচে এসে নদী তিনটা মিলে গেছিল।
    “কী জলই না হয়েছিল সেবারে!”
    “সেবারেই রাস্তার সব পুল ভেঙ্গে গিয়েছিল।
    “পুলগুলো ভাসিয়ে কোথায় যে ফেলেছিল নিয়ে।”
    “আমাদের বস্তি পুরো ডুবে গিয়েছিল।”
    “ঘরের ভেতরে কোমর অব্দি জল।”
    “ রাধিকা আর কৃষ্ণাই সঙ্গ নিয়েছিল।”
    “ দু’টো নদী মিলে এদিকটাতেই এগিয়ে এসেছিল।”
    “এ জায়গাটা তো ধানের খেত ছিল।”
    “কী ধানই না হয়েছিল সেবারে!”
    “বড় বড় থোক হয়েছিল।”
    “পুরো মাঠ জলে ভরে গিয়েছিল।”
    “ জল ছিল পুরো আট দিন।”
    “জল শুকোবার পরে চারদিকে শুধু বালিই বালি। মাঠটাকে তলায় ঢেকে ফেলল।”
    “ এতো এতো কাশবন হলো কী করে বলে ভাবছিস?”
    “কী করে হবে আবার?”
    “নদীর বানে গুটি ভেসে এসেছে।”
    “বাতাসে ভেসে এলো।”
    “গুটি যেখানেই পড়ল, সেখানেই গাছ হলো।”
    “কাশের বীজে পাখা আছে, বুঝলি?”
    “ ফুলগুলোই পাখা হয়ে গুটিগুলোকে উড়িয়ে আনে।”
    “নদীর জলে ডোবে না, ভেসে থাকে।”
    “বালি মাটিতে পড়লেই গাছ হয়।”
    কথা বলতে বলতে বেশ কিছু কাশ এরা কেটে ফেলল। আকাশে মেঘ আছে বলে সময়টা ঠিক ধরতে পারে নি। পেটে সবার কিঁউ কিঁউ করছে। বাজারে গেলে এতক্ষণে বন বা সেদ্ধ পিঠা একটা নিয়ে চা এক কাপ খেয়ে নিত।
    “চল যাই, বেশি করে কেটে ফেললে নিবি কী করে?” মীরার মা নিজের ভাগের কাশগুলো বেঁধে ফেলল।
    জোনের মায়েরাও বাঁধতে শুরু করে দিল। বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। আবহাওয়া আবার ভার হয়ে এসেছে। সবার বাঁধা হয়ে গেছে, আর ভাবতে না ভাবতে হঠাৎই বৃষ্টি নেমে এলো। বর্ষার বৃষ্টির মতো হুড়হুড় করে নামে নি। ইলশে গুড়ি। তাড়াতাড়ি কাশের বোঝা এরা মাথাতে তুলে নিলো। বোঝার আড়ালে এদের মুখ ঢাকা পড়ে গেল। রেল পথ ধরে এরা এগিয়ে গেল। রেল সেতুর তলাতে ছেলেগুলো নেই। জায়গাটা এখন নির্জন পড়ে আছে। সেখানে সামান্য দাঁড়ালো এরা। সাবধানে ফাঁকা ফাঁকা জায়গা আর কাঠগুলো দেখে দেখে একে একে পেরিয়ে এলো। আবার হাঁটা দিল।
    বৃষ্টি পড়ে পড়ে কাশের বোঝাগুলো ভিজে গেছে।
    “জোনের মা, কাশগুলো সব ভিজে গেল যে! এখন?” ভাবনায় পড়ে জিজ্ঞেস করল ফেলানি।
    “ভিজলে কী হবে?”
    “পচে যাবে না?”
    “রোদে মেলে দিবি, শুকিয়ে যাবে।”
    “আর রোদ না দিলে?”
    “কী যে বলছিস মণির মা, আশ্বিনের বৃষ্টি আর কদিন থাকে?”
    “ পচলে আবার এসে কাটবি।”
    “এতো এতো কাশবন কে কেটে শেষ করতে পারবে?”
    “কাশবনের গুটির পাখা আছে।”
    “নদীতে ভাসে গুটি।”
    “উড়ে আসে।”
    “ উদোম বালি মাটিতে পড়লেই গাছ হয়।”
    কেউ কারো মুখ দেখছে না। ভেজা কাশের বোঝার নিচে মুখ ঢাকা পড়েছে। সবাই জোরে পা চালাচ্ছে। সংসারের সারা রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। রোদ দিলে কাশগুলো শুকোতে হবে। বেড়া দিতে হবে, চাল ছাইতে হবে। মেঘ না কাটলে যদি পচে যায় তবে আবার এসে কাশ কেটে নিয়ে যেতে হবে।
    কাশবনের বোঝার নিচে ঢাকা মুখ নিয়েই এই ক'জন মেয়ে মানুষ যাচ্ছে , এগিয়ে যাচ্ছে...
    টীকা:
    ১) ফুটুকাঃ সাধারণত সড়ক, রেলপথ বা পাহাড় টিলাতে এই ছোট গাছগুলো দেখা যায়। বৈজ্ঞানিক নামঃMelastoma malabatricum
    ২) নাগাগাছঃ অসমিয়াতে শব্দটি নগাবন। পঞ্চম অধ্যায় দেখুন।
  • সুশান্ত | 127.203.170.2 | ১৫ মে ২০১৪ ১১:৫৬495510
  • অধ্যায় সাঁইত্রিশ (৩৭)
    সবার আগে জাগল জোনের মা। সে উঠে একটা হাই দিতেই বাকিরাও সেই শব্দে সাড়া পেয়ে উঠে গেল। রাতে শুতে যেতেই একটা বেজে গেছিল। “আমরা নাহয় উপোস থাকলাম। কিন্তু এই ছেলেমেয়েগুলোকে কী করে না খাইয়ে রাখি?” বলে ফুলই প্রথম ভাত বসাবার কথাটা তুলল। এই ক’দিন সে ড্রাইভারণীর মেয়েটিকে বুকের থেকে নামায় নি। মেয়েটাও ওর গায়ে চ্যাপ্টা হয়ে লেগে আছে। চাল-ডাল মণির মায়ের ঘরে ছিল। আজ দু’দিন আগে মণি মাকে বাজার টাজার এনে দিয়েছিল । কে কে তিন চারজন লেগে পড়ে যেন নিজের নিজের বাড়ি থেকে কী কী নিয়ে এলো। সবার জন্যে খিচুড়ি হয়ে গেল। সবাই সাত সকালে ঘুম ছেড়ে উঠেছে। রাতে শুতে যেতে যতটাই হোক, ভোর না হতেই বিছানা ছাড়াটা সবার অভ্যাস। আর জেগে উঠেই কেউ বসে থাকতেও পারে না।
    মীরা বাসন ধুতে গেল। সঙ্গে গেল রত্না।
    জোনের মা ফুলঝাড়ু হাতে নিলো।
    মিনতি নিলো শলার ঝাড়ু।
    ফুল ঘর মোছার বালতি আর কাপড়।
    মীরার মা বিছানাগুলো তুলে ফেলল।
    মুহূর্তের মধ্যে ফু দিয়ে ঘরটা ভাত খাবার যোগ্য হয়ে গেল। তারপরে সবার স্নান-টানও হয়ে গেল। লবণ দেয়া লাল চা নিয়ে সবাই বসেছিল মাত্র। একটা ছেলে, মণিদের বয়সের, সঙ্গে একটি মেয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়ালো।
    মণির মা গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াতেই মেয়েটি ঝড় তুফানে দোলানো মূলি বাঁশের মতো তার বুকে ঢলে পড়ল। বুক ভাঙ্গা কান্নাতে অস্থির মেয়েটিকে বুকে ধরে রাখতে পারে নি মণির মা। মেয়েটির কান্না সবার মধ্যে গড়িয়ে গেল।
    “কাঁদবি না রীণা, কাঁদবি না।” ওকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে মণির মাও কেঁদে ফেলল। কীই বা হচ্ছে ছেলেটার! সে কি এতোই বড় হয়ে গেছে যে তাকে মিলিটারি ধরে নিয়ে যেতে পারে। ও করেছে কী? ধনী মানুষের ছেলে হতো তবে কলেজে পড়ত, ছোট্ট ছেলেটি হয়ে থাকত।
    সবারই যেন হঠাৎ ই ছোট বলে ভাবতে ভাবতে ছেলেগুলো বড় হয়ে গেল। চালের মুঠো জোগাড় করতে করতে ছেলেগুলো বড় হয়ে গেল, পুলিশ মিলিটারি ধরে নিয়ে যাবার মতো বড়ো হয়ে গেল। সবাই মিলে হাউ হাউ করে কাঁদততে শুরু করল।
    ফুল কাঁদছে অসুস্থ কুঁজো মানুষটির জন্যে।
    মীরার মা কাঁদছে অন্যের দোকানে জিনিস বিক্রি করে, তার গোঁফ গজানো ছেলে মণ্টুর জন্যে।
    নতুন ঠেলা একটা কিনে ধানের মিল থেকে তুষ নিয়ে হোটেলগুলোতে পৌঁছে দিয়ে ঘরে কিছু চাল নিয়ে আসে জোন। জোনের মা কাঁদছে সেই জোনের জন্যে।
    মিনতি নবীনের জন্যে।
    রীণা মণি নামের দাদার বন্ধু জোয়ান ছেলেটার জন্যে।
    ফেলানি মণি নামের হঠাৎই বড় হয়ে উঠা ছোট ছেলেটার জন্যে।
    মীরা কাঁদছে দাদার জন্যে।
    রত্না তার চোখের সামনে মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া বস্তির মানুষগুলোর জন্যে।
    ফেলানির বাড়ি হয়েছে যেন মরা বাড়ি। আধা তৈরি ঘর, কালী বুড়ির থান ---সবটাই কান্নাতে ডুবে গেল।
    হাউ হাউ করে কান্নার শব্দ ফোঁপানোতে পরিণত হয়েছে। কেঁদে কেঁদে নেতিয়ে পড়া মহিলাদের দেখে ফেলানির রাগ উঠে গেল। কালী বুড়ি ঠিকই বলত, মেয়ে মানুষ খালি ভেঁ ভেঁ করে কাঁদতে পারে। কী করে যে কাঁদছে মেয়ে মানুষগুলো! কিসের আশাতে কাঁদছে? বাইরে একটা পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ালো। কান্নার শব্দ শুনে ভেতরে আসবে। এসে কী বলবে? “ মাল তো বেশ বড়িয়া দেখছি! ভাগিয়ে নিয়ে যাবি কি রে?”
    “ এই তোরা চুপ করলি ?” ফেলানির গলা শুনে সবাই চমকে উঠল।
    “ কাকে শোনাবার জন্যে কাঁদছিস? কোন পেয়ারের লোক আসবে?”
    “ ওভাবে বলছিস কেন মণির মা?” আমার ছেলেটা ঠেলাতে করে ক’বস্তা তুষ টানে জানিস? ওকে আর্মি নিয়ে গিয়ে...” জোনের মা আবার কাঁদছে। সঙ্গে সঙ্গে সামান্য সময় বন্ধ হয়ে পড়া কান্নার রোল আবার উঠল।
    “তোদের কি ছেলে , স্বামী ফিরিয়ে চাই? না ওদের আর্মির হাতে ছেড়ে দিবি?”
    “ পাক্কা খবর । সবাইকে অল্প পরেই চালান দেবে।” রীণার দাদা কথাটা বলেই মাটিতে বসে পড়ল। ভেতরে আসা ছেলেটার মুখে এই কথা শুনেই ফোঁপানো কান্না আবার হাউ হাউ-তে পরিণত হলো।
    কান্নার শব্দে বাইরে টহলদার কয়েকটা আর্মি ভেতরে এলো।
    “কিউ হাল্লা –চিল্লা করতা হে?”
    “কার্ফিউ লাগা হুয়া হে, মালুম নেহি?”
    “চুপ নেহি রেহনে ছে...” একটা তেড়ে আসছিল।
    “ কী করবি কুত্তার দল?...” কথাটা মুখের ভেতরে গিলে থেমে গেল ফেলানি। ওরা চলে গেল।
    “ দাদা, তুই যা গিয়ে।” পেছনে গিয়ে লুকোনো দাদাকে বলল রীণা।
    “তুই ?”
    “ও থাকুক আমার সঙ্গে।” রীণাকে নিজের পাশে বসিয়ে বলল ফেলানি। “শুনলি ওরা কী বলে গেল? শুনলি না , না?”
    “কী করবে ওরা আমাদের?” মীরার মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
    “ কী আর করবে? কিচ্ছু করতে পারবে না।” ফেলানির কথাতে যেন সবাই সাহস ফিরে পেলো।
    “কী করবি মণির মা? মানুষগুলোকে মরতে দিবি কি?”
    “ কী করবি? ওদের চালান দেবে। তখন কী হবে?”
    “কী হবে আর? মেরে ফেলবে?” নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে উত্তরটা দিল ফেলানি।
    “ কী বলছিস রে , মণির মা?”
    “ তোর মুখে কিসে ভর করেছে?”
    “তুই মা হয়ে এই কথাটা বলছিস?”
    “পোকা পড়ুক তোর মুখে।”
    “তোর বুকে কি মায়া মমতা নেই?”
    সবাই ফেলানিকে চটে গিয়ে ঘিরে ধরেছে। আবার ফোঁপানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে।
    “ কেঁদে কেঁদে প্যারের লোকগুলোকে ডাকতে থাকবি? না কিছু একটা করবার কথা ভাববি?”
    “কী করবে?” রীণার কথা বড় কষ্টে বেরিয়ে এলো।
    “ কী আর করবি?”
    “আমাদের হাতে বন্দুক আছে, না টাকা আছে?”
    “কোথায় যাবো আমরা?”
    “ আর্মির কাছেই বা যাই কী করে?”
    “গেলেই বন্দুক দেখাবে।”
    “হট যাও, হট যাও—বলে তেড়ে আসবে।”
    ফোঁপানো কান্নার শব্দ বাড়ছে।
    “মরতে তোদের প্রচুর ভয়, তাই না?” একটু হাসল ফেলানি। কেউ কিছু বলল না।
    “আমাদের আবার মরা কী, বাঁচাই কী?” জোনের মা প্রশ্নটা ছুড়ে দিল।
    “ঠিক বলেছিস জোনের মা। আমরা জ্যান্ত মরা হয়েই আছি।” মিনতি গলা ভার করে বলল।
    “জোনের মা মরতে মরতে ফিরে এসেছে। তুইও মরার থেকে বেঁচেছিস।”
    “ঠিকই বলছিস, আমাদের আর মরা-বাঁচা কী?” হাতের যে জায়গাটা ফুলে গেছে সেখানে হাত বুলিয়ে বলল মীরার মা।
    “আমাদের কত মরল। জগু মরল, ওর বৌ মরল।” ওদের মনে করিয়ে দিতে চাইল ফেলানি।
    “জোনের বাবা, সুমলা, বুলেন।”
    “হরি ভাঙুয়ার পোলা।”
    “রত্নার মা।”
    “কালী বুড়ি।”
    “ড্রাইভার।”
    “রত্নার বাবা।”
    “ড্রাইভারের ছেলেটা।”
    “হ্যাঁ, অনেক মানুষ মরল।” কথাটা এমন করে বলল ফুল যেন লোকগুলো মরার কথা সে জানেই না।
    “আমাকেও মরা বলেই ধরো।” রত্না মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
    “মা মরল, বাবা মরল।” হুঁ হুঁ করে কাঁদছে সে।
    “তার মানে মরতে তোদের ভয় নেই?”
    “তোর, মণির মা?” মীরার মা তার দিকে তাকিয়ে আছে।
    “আমার আর কী?” ছেলেটাই আমার সব। আমার বাঁচা-মরা কি আর আলাদা কিছু?”
    ফেলানি সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
    “তোরা যাবি আমার সঙ্গে?”
    “কই?”
    “এখনো ওদের চালান দেয় নি। সেখানেই আছে। যাবি?”
    “কী করব?”
    “কোথায় যাবো?”
    “কী করে যাবো?”
    “কোথায় যাব আবার কী? আর্মি ক্যাম্পে!” গায়ের কাপড় ঠিক করে নিলো ফেলানি।
    সবাই উঠে দাঁড়ালো।
    “দেখিস নি তোরা কতবার মেয়েরা গিয়ে ক্যাম্প ঘিরে ধরেছিল?”
    “সেবারে জংলি পার্টিটার পাঁচটা ছেলে বের করে নিয়ে যায় নি?”
    “একবার ক্যাম্পে বুলেনের পার্টির মেয়েরা তিনদিন তিনরাত গিয়ে ছিল না?”

    নিঃশব্দে দাঁড়ালো এরা আর আর্মি ক্যাম্পের দিকে পা বাড়ালো। নিঃশব্দে বস্তিটা পার হলো, পাকা রাস্তাতে পা দিল। কেটে খালি করে ফেলা রিজার্ভ পার হয়ে গেল। তারপর আর্মি ক্যাম্পের সামনে এরা বসে গেল। যেখানে বসেছিল তার থেকে সামান্য দূরে ছিল শিশু গাছ একটার কাটা গুড়ি। সেখানেই পড়ে রয়েছিল সুমলা পাগলি। একটা পুরো গাছ ছিল সেখানে। এখন পড়ে আছে কিছু শুকনো গুড়ি।
    ওদেরকে দেখে দুই একটা বন্দুকধারী বেরিয়ে এলো। ওরা বসেই আছে। কেন বসে আছে জিজ্ঞেস করল বন্দুকধারীরা। এখান থেকে চলে যেতে বলল। ফেলানি দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গের বাকিরাও দাঁড়ালো।
    “আমাদের লোকজনকে নিয়ে যেতে এসেছি।” ক্যাম্পের ভেতর থেকে আরো কয়েকজন বন্দুকধারী বেরিয়ে এলো। ওরা বন্দুকের পেছন ভাগ দিয়ে ফেলানিকে ঠেলা দিল। এরাও ওদের চলে যেতে বলল।
    “আমার মানুহকিটা লাগে।”
    “হামার আদমি...”
    “ আমাদের লোক আমাদের চাই।”
    “হামার মরদ...”
    “হামারা বেটা।”
    একটাও মহিলা ফিরে যাবে না। ওদের মানুষজন না নিয়ে যাবে না।
    দিন গেল। রাত হলো। একজনও উঠেনি। ক্যাম্প থেকে এনে দেয়া রুটি কেউ ছুঁয়েও দেখল না। শুধু জল একটু একটু খেলো।
    পরদিন পুলিশ এলো। বোঝালো, গালি দিল। একজনকেও নাড়াতে পারল না। মনে হয় কার্ফিউ খুলেছিল, পুরো দিন পুরো রাত বসে থাকা মহিলাদের কথা শহর জুড়ে জানাজানি হয়ে গেছে। বহু লোক এসে আশেপাশে ভিড় বাড়াতে শুরু করল। জিপগাড়িতে করে অফিসার এলো। এই মহিলারা যেমন ছিল তেমনি বসে রইল। কিছু জিজ্ঞেস করলে ওদের একটাই কথা,
    “মানুষগুলো, আমাদের মানুষ...।”
    আরেকটা দিন গেল, সঙ্গে আরেকটা রাত।
    ভোরের দিকে রত্না ঢলে পড়ল। দেখতে আসা লোকজনই ডাক্তার ডেকে আনল। সবাই নেতিয়ে পড়েছে। মাটিতে বালিতে পড়ে থাকা মহিলাদের খবর নিতে কাগজের লোক এলো। ছবি তুলল। সব প্রশ্নের উত্তর একটাই।
    “আমাদের লোক, আমাদের লোক ফিরিয়ে চাই।”
    দু’টো দিন শেষ হলো, তিন নম্বর রাত আসবার হয়েছে। চোখে ততক্ষণে ধোঁয়াশা দেখছে এই ক’জন মেয়ে মানুষ, তাদের চোখে সন্ধ্যার অন্ধকার আরো ঘন হয়ে নেমে এলো। একজনও ভালো করে মাথা তুলতে পারছিল না। “আমাদের আর বাঁচা-মরা কী?” কে যেন বিড়বিড়িয়ে কথাগুলো বলল। সবার খিদে-কাতর শরীরে লেগে রইল একটাই কথা, “আমাদের বাঁচা-মরা...আমাদের বাঁচা-মরা...।”
    ভালো করে অন্ধকার নেমে আসবার ঠিক আগেই ফেলানি শুনল একটা ডাক, “মা।”
    সঙ্গে সঙ্গে সবাই শুনতে পেল কিছু চেনা চেনা ডাক।
    “মা।”
    “মিনতি।”
    “ফুল।”
    “ও মা।”
    “মীরা।”
    সবাই উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। ভুল দেখে নি এরা। ওদের আপনারজন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কারো মুখে কথা নেই।
    একসঙ্গে সবাই বস্তির দিকে পা বাড়ালো। উজাড় করা অরণ্য পেরুলো। পাকা রাস্তা পার করল। তারপর প্রায় নিঃশব্দ পড়ে থাকা বস্তি। বস্তি আর রিজার্ভের কিছু মানুষ রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। সবাই মিলে এগিয়ে গেল।
    আকাশে চাঁদ উঠেছিল। সেই চাঁদের কোমল আলোতে ফেলানি দেখল মণি রীণার দিকে তাকিয়ে হাসছে। রীণা মাথা নত করেছে লজ্জায়। ফেলানির মুখেও একটা স্নিগ্ধ মিষ্টি হাসি।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন