এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • একটি এক্সপেরিমেন্টাল গল্প

    Sankha
    অন্যান্য | ৩১ আগস্ট ২০১১ | ৪৬৯৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • Sankha | 96.234.98.74 | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ ১০:৩৫491123
  • উইন্টার
    *****

    আজ আকাশে গোটাগুটি একটা চাঁদ উঠে পড়ছে। সব হোমওয়ার্ক সেরে ফেলা বাচ্চার মত একগাল হাসি নিয়ে উঁকি মেরে দেখছে পৃথিবীর 24x7 চলতে থাকা কার্টুন নেটওয়ার্ক। ধপধপে সাদা জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে এই অলীক প্রান্তর। আর সেই চাঁদের আলো বেয়ে নেমে আসছে ঝুরঝুরে হিমকণার মত ঠান্ডা কুয়াসা।

    তারা তিনজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে। টিউশনি পড়তে এসেছিলো ওরা। টিউশনি শেষ, এবারে ঘরে ফেরার পালা। পড়ে ফেরার পথে একটু দাঁড়িয়ে গিয়ে খানিকক্ষণ আড্ডা মেরে নেয় ওরা। আজও তার কোন ব্যত্যয় হয়নি।

    তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা একটা তিনমাথার মোড়ের মত, ঐ জমিগুলোর মাঝে আলের ওপর। তার একদিকে আল গিয়ে মিশেছে মোরাম বিছানো একটা মাঝারি মাপের রাস্তায় যেটাতে যা হোক করে দুটো ভ্যান রিকশা একে অন্যকে মুখোমুখি পেরোতে পারবে। এই রাস্তাটা সেই দূরে পিচরাস্তার ওপাশে ইলেকট্রিক অফিসের সামনে থেকে উদ্ভূত হয়ে সোজাসুজি এগিয়ে গেছে রেলপাড়ের দিকে। এই রাস্তার দুপাশে এককালে কেউ শখ করে কিছু লম্বা লম্বা গাছ লাগিয়েছিলো, সেই সব গাছের ঝুঁকে পড়া ছায়া জমাট বেঁধে আছে রাস্তার ওপর। আলোয়-ছায়ায় কাটাকুটি খেলে জেব্রা ক্রসিং এর মত লাগছে ঐ সব গাছের তলাগুলো।

    তার চোখ বারবার চলে যায় দূরে রেলপাড়ের দিকে, কার্তিক মাস নয় ঠিকই কিন্তু এমন জোৎস্নার রাতেই তো মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খেতে আসে এমনই কোন নির্জন প্রান্তরে। একরাশ খোঁচা খোঁচা গোঁফদাড়ির মত লাগছে রেলপাড়ের ঢালু জমিটাকে। তার ওপরে শুনশান রেললাইনে কুয়াশা জমে দেওয়ালের মত হয়ে আছে। গলার মাফলারটাকে আরেকটু টাইট করে পরে সে।

    সব কিছু নিয়ে গাবজালি হচ্ছে তাদের, ক্লাসের মেয়ে (ভুলেও 'সেই তার' নাম নয়), তাদের অন্য অন্য টিউশনির জায়গাতে কোথায় কি সিলেবাস কভার হল, খবরের কাগজের হেডলাইন, পরের বছর তাদের স্কুলের একটা খুব বড় জুবিলি আছে, সেই জন্যে প্রোগ্রাম, এগজিবিশন এই সব অর্গানাইজ করতে হবে, তার গাঁজা খাবার সুলুক সন্ধান এই সব।

    আড্ডাটা বড়িয়া জমে গেছে, একটু আদিরসের আধিক্য, সবারই মুখের হাইড্রেন্ট খুলে তোড়ে খিল্লি বেরোচ্ছে, এমন সময়....

    হঠাৎই তার মনে হল কিছু একটা ঘটছে। তার চোখের সামনেই, কিন্তু সে ধরতে পারছে না। কিছু একটা যেন ঠিক স্বাভাবিক নয়, এক অজানা তাড়নায় সে কথা থামিয়ে এদিক ওদিকে তাকালো। তারপরেই তার নজর সিধে হয়ে গেলো।

    বহুদূরে রেলপাড়ের ওপর থেকে কুয়াসার আস্তরণ ভেদ করে যেন অন্য জগত থেকে আবির্ভূত হয়েছে একটা আকৃতি, আর দ্যাখ-না-দ্যাখ সেটা খুব দ্রুতগতিতে ঢালু পাড় বেয়ে নেমে এলো। তার ঋজু গড়ন, এত দূর থেকে আর বেশি কিছু বোঝা না গেলেও একরঙা সাদাটে কাপড়ে মোড়া অবয়ব তীব্রগতিতে নামছে, সেটা টের পাওয়া যায়।
    রেলপাড় আর নিচের রাস্তার যোগসূত্র আছে, সে একটা পায়ে চলা পথ, খুব খাড়াই, দিনের বেলাতেও দেখে শুনে উঠতে বা নামতে হয় এবং সেটাও একেবারে সোজাসুজি না। মাঝখানে অনেক ছোটখাট ঝোপ, কাঁটা বন আছে, গরু বাছুরও এমন হুড়মুড়িয়ে নামে না।

    নিচে চত্বরমত জায়গাতে নেমে আকৃতিটার সুমুখে এই মোরাম রাস্তাটাই পড়েছে। তার মনে হল যেন মূর্তিটা ঐ পথ ধরেই এগিয়ে আসছে, তাদের দিকেই, এদিকপানেই ... আরে আরে ও কি?

    রাস্তার পাশে গাছগুলোর ফাঁকে এক দুবার যেন তাকে নড়তে দেখা গেল, তারপর সেই জমে থাকা ছায়া ছায়া আঁকিবুকির মধ্যে যেন মিলিয়ে গেল সেই অবয়ব। একটা শূন্যতা যে নিমেষে গিলে খেলো সেই অবয়বের চিহ্নটুকু।

    আর এই সমস্ত ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেলো, সে কথা থামিয়ে একটা ছোট শিস দিয়ে উঠলো। তার চোখের মণি বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে, তার সমগ্র স্নায়ু দিয়ে সে অনুভব করতে চাইছে সেই অবয়বকে, এতটুকু কোন নড়াচড়া, শব্দ, কোন কিছুই।

    তার বন্ধুরাও তার মুখচোখের এই আকস্মিক পরিবর্তন খেয়াল করেছে। সাইকেলের সিটে বসা বন্ধু জিজ্ঞেস করলো, 'কিরে কি হল? এমন থম মেরে গেলি?'
    - 'সেকি! তোরা দেখলি না?'
    - 'কি দেখবো বলতো? তুই ই তো ওদিকে হাঁ করে তাকিয়েছিলি!'
    - 'তুই কিছু দেখলি নাকি'? অপর বন্ধু জিজ্ঞেস করে। তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। হঠাৎ করেই যেন তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমে গেছে বলে তার মনে হয়। ঘাড় বেয়ে সিরসিরে একটা কেন্নো যেন পিঠের দিকে নামতে থাকে।

    বেশিক্ষণ লাগে না, তারপরেই দলটাকে তারা দেখতে পায়।

    রেলপাড়ের ওপরে কয়েকটা জোরালো টর্চের আলো দেখা দিয়েছে, সেই আলোর ফোকাস এদিক ওদিক ঘোরে, তাদের দিকেও কেউ যেন একবার ফোকাস মারলো, সেই কৃত্রিম আলো ক্ষীণ হলেও চোখে ধাঁধা লাগায়। লোকগুলো পায়ে চলা পথটা খুঁজে পেয়েছে বোঝা গেল, আলোগুলো বাঁকা পথে দেখে শুনে হিসেব করে নিচে নামে।

    তার দুই বন্ধুর কাছে সাইকেল আছে, স্রেফ তার কাছেই নেই। তার বাড়ি কাছেই, পাড়ার পাশেই। হাতের চারসেলের টর্চটাকে শক্ত করে চেপে ধরে সে। লোকগুলো এই দিকেই আসছে।

    অনেকটা এগিয়ে এসে দলটা দূর থেকে তাদের দেখতে পায় আর সঙ্গে সঙ্গে থমকে পড়ে।

    তার বুকের মধ্যে ধুপধাপ ঢেঁকির পাড় পড়ছে। আড়চোখে বন্ধুদের মুখের দিকে তাকায় সে, দেখে উৎকণ্ঠায় তাদেরও চোয়াল শক্ত, সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে থাকা আঙ্গুলের গাঁট গুলো এই ফটফটে আলোয় যেন চকচকে, রক্তশূন্য লাগে। সে ফুটিফাটা ঠোঁট ভিজিয়ে নেবার জন্যে জিভ বোলাতে গিয়ে সবিস্ময়ে খেয়াল করলো জিভও শুকিয়ে খড়খড়ে।

    লোকগুলো ফিসফাস কি একটা সাঁট করে নিলো, নেতা টাইপের একজন এগিয়ে এসে বেশ সাবধান ভাবেই জিজ্ঞেস করলো, 'কারা ওখানে?'

    'পাড়ার ছেলে। তোমরা কারা?' সে অনুভব করে এই কটা কথা বলতে তার গলা চিরে চিরে যাচ্ছে, আ: এই সময় একটু জল যদি পাওয়া যেতো...

    পাশ থেকে তার বন্ধু একটু চেঁচিয়ে ওঠে, 'এতো রাতে কি চাই?' তার এই খাপছাড়া চিৎকারে একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক যেন চমকে থেমে যায়। নৈ:শব্দে মোড়া, কুকুরের চোখের মত জ্বলজ্বলে চাঁদের আলোতে ছায়াতে, সেই থমথমে মুহূর্তকটি যেন লাফ দেবার আগে টান টান শ্বাপদের মত ভয়ংকর লাগে।

    *********

    রাত প্রায় নটা সাড়ে নটা বজে। এইদিকের রাস্তাঘাট সব যেন নিশুতি হয়ে গেছে। দূরে দূরে লোকের বাড়ির ফাঁকফোঁকর, ভেন্টিলেটর দিয়ে আলো দেখা যায়। এছাড়া বাকি পৃথিবী শুনশান, শীত তার কুটকুটে কম্বলে মুড়ে নিয়েছে চরাচর। একটা ঝুপসি গাছ পেরিয়ে নিজের বাড়িটা দেখতে পেয়ে সে একটা চাপা নি:শ্বাস ফেললো। এতক্ষণ হনহন করে হেঁটে এই শীতের রাত্রেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা আবার সে মনে মনে ভেবে নেয়।

    লোকগুলো আসার আগে বন্ধুদের প্রশ্নে সে হতভম্ব হয়ে যায়, কেননা গোটা ঘটনাটার সাক্ষী তার মানে শুধু সে?

    ভুল দেখেছে এই কথা বলে আর উড়িয়ে দেওয়া যাবে না ব্যাপারটা, কেননা লোকগুলো নাকি পালিয়ে আসা একজন পাগল আত্মীয়কে খুঁজছিলো। একজন মেয়ে কে।

    ঠিক এই জায়গাটাতেই তাদের সন্দেহ হয়। লোকগুলোর হাবভাবে, বারবার ফিসফাস করে নিজের মধ্যে আলোচনা করে প্রতিটি কথার জবাব দিচ্ছিলো তারা। কিছু একটা চেপে যাবার আর মেয়েটাকে খোঁজার একটা উৎকট তাড়া দেখে তারা এ ওর হাত টেপে। আর কোন কিছুই দেখার পুরো ব্যাপারটা চেপে যায়। সেই সময় সে মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। কথা যা বলার তার দুই বন্ধুই বলে।

    লোকগুলো ফিরে যাবার সময় আলজমির দুপাশে তাদের টর্চের আলো আঁকুপাঁকু করে কাউকে খোঁজে। স্পষ্টত:ই বিশ্বাস করে নি তাদের কথা।

    লোকগুলো চলে যেতে তাদের টনক নড়ে। তারাও একটু এগিয়ে এগিয়ে এদিকে সেদিকে টর্চ মেরে দেখতে থাকে বিস্তীর্ণ ধানজমি, সরু আল, দূরের ছোট্ট ডোবার পাড়। একটা চোরা বাতাস বয়, আসে পাশে গাছের মাথা দুলতে থাকে, দূরে ফোকাস মারায় তাদের টর্চের আলো ডুবে যায়, তারা কিছুই দেখতে পায়না। একটানা জ্বালিয়ে রাখায় দপদপ করে ক্ষীণ আর লাল হয়ে আসে টর্চের আলো।

    অথচ কেউ যদি রাস্তা থেকে এই জমিতে নেমেও পড়তো, সেটা অনেক দূর থেকেও বুঝতে পারার কথা। যে এসেছিলো এই দিকে, সে কোথায় উবে গেলো? কিকরেই বা কেউ খুঁজে পেলো না? লোকগুলোর একবর্ণ কথা তারা বিশ্বাস করে নি, তারা কারা?

    যদি লোকগুলো খারাপ কেউ হয়, আর কোন ভাবে মেয়েটাকে খুঁজে পেয়ে যায়! এই নিশুতি রাতে?

    ভাবতেই তার মাথা দপদপ করে।

    ফেরার পথে শীতের রাতে ফিনকি দেওয়া আলোয় মোড়া চাঁদ একধরণের গা ছমছমে বিভ্রম তৈরি করে, অন্ধকার তবু মেনে নেওয়া যায়, রাতের বেলা কয়েক হাজার মাইল ওপর থেকে নেমে আসা এত আলোতে তার মনে হয় অসংখ্য দৃষ্টি তার দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে। আনাচ-কানাচ থেকে।

    সে বাঁক পেরিয়ে নিজের উষ্ণ নিশ্চিন্ত আস্তানায় ঢুকে পড়ার আগে একবার মুখ তুলে ওপরে চাইলো।

    মানুষের মত প্রকৃতিও রহস্য পছন্দ করে হয়ত, সব কিছু সে জানায় না। তার আঁচলের খুঁট থেকে মাঝে মধ্যে এক আধটা আধুলি বের করে দিলেও লুকিয়ে রাখে আরও কতকগুলো।

  • Nina | 12.149.39.84 | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ ১৯:৫০491124
  • আরিব্বাস!!! থমকে দাঁড়িয়ে গেছে মনটা-----তারপর? তারপর?
  • Sankha | 96.234.98.74 | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ ২৩:১৮491125
  • ... অ্যান্ড স্প্রিং
    *********

    টলোমলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা গোটাগুটি বছর শেষ হয়ে গেলো।

    পেছন ফিরে তাকালে স্রেফ একবার চোখের পলক ফেলার মত লহমা সময়।

    সময় পাল্টাচ্ছে। কিছুই থেমে নেই। কেউ কারুর জন্যে বসে নেই।

    এবারের নবীনবরণের কমিটিতে সে আছে।

    নিচু ক্লাসে যারা ভর্তি হয়, তাদের বাদ দিলে ক্লাস ইলেভেনে অনেক নতুন নতুন বাইরের ভালো ভালো ছাত্রছাত্রী তাদের স্কুলে ভর্তি হয়। প্রতিবছর। এই বহিরাগতদের প্রতি স্কুল কতটা যত্নবান সেটা দেখানোর একটা মাধ্যম হিসেবে স্কুল এই নবীনবরণের আয়োজন করে। ক্লাস টুয়েলভের ছেলেমেয়েরাই ম্যানুয়াল লেবার দেয়, তা নইলে এই অনুষ্ঠানের সব ব্যবস্থা অনেক আগে থেকেই ওয়েল ডিফাইনড।

    ফুলটুল দিয়ে একটা বড় হলঘর সাজানো হয়, অনেক টিচার স্কুল, রেজাল্ট, কেরিয়ার, তাদের অঞ্চল এই সব ভারি ভারি টপিক নিয়ে লম্বা লম্বা লেকচার দেন। নিচু ক্লাসে জীবন বিজ্ঞান ও ইতিহাস পড়ান এমন একজন শিক্ষক কিছু গান জানা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে দুএকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গান, নতুন ভর্তিদের পুষ্পস্তবক আর পেন দেওয়া হয়, কিঞ্চিৎ মিষ্টি মুখের ব্যবস্থাও থাকে, পায়রার ডিমের সাইজের ক্ষীরকদম্ব, কড়াপাকের সন্দেশ আর নিমকি। স্থানীয়রা বা যারা জানে, নিমকিটা ছোঁয়না, বাকিরা খায় এবং বাকি দিনটা অম্বলে আইঢাই করে কাটায়।

    সে যেহেতু গান গাইতে পারে, এবং বেশ ভালোই গায়, এই কমিটিতে সেও আছে। তাছাড়া এই বছর তাদের স্কুলে বড় মাপের একটা প্রোগ্রাম আছে, সেই দিকে তাকিয়ে এটা একটা ড্রেস রি:আর্শাল ও বলা যায়।

    সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়তে হয়েছে ফুল আনতে। ওটা তার দায়িত্বে। আর্টস, কমার্স আর সায়েন্স মিলিয়ে বেশ ভালোই লোকজন। দোকানি ভোর ভোর নাকি সব রেডি করে রাখবে, টাটকা ফুল দিয়ে স্তবক বানিয়ে। তার কাজ দোকানির বিল নেওয়া, ফুলের ডেলিভারি স্কুল অবধি করে দেওয়া। পরে দোকানি স্কুলের থেকে টাকা নিয়ে নেবে।

    ঘটনাটা ঘটল তার তৃতীয় ট্রিপটা মারার আগে।

    অন্য সবার মত ফুলদোকানিও 'ইন্ডিয়ান স্টান্ডার্ড টাইমে' চলে। ব্যাপারটা সে নির্দিষ্ট সময়ে দোকানে গিয়ে টের পেয়েছিলো। সেটা প্রথমবার। দোকানি তখন সবে মাত্র দোকান খুলে বসে বুকপেট চুলকোতে চুলকোতে হাই তুলছে। তাকে একেবারে টাইমের টাইম পৌঁছে যেতে দেখে দোকানি ফুলের চিন্তায় তার রাতের ঘুম ঠিক হয়েছিলো কিনা এই সব জিজ্ঞেস করে। দোকানি নেহাত তার বাবাকে চেনে বলে সে অতিকষ্টে জিভের ডগায় এসে যাওয়া দোকানি আর দোকানির পূর্বসূরী সংক্রান্ত বাক্যগুলো গিলে ফের কখন এলে ডেলিভারি পাওয়া যাবে জানতে চায়।

    পরের চুক্তির সময়ের আধঘন্টা পরে এসে সে ডেলিভারি পায় ঠিকই, কিন্তু পুরোটা একসাথে না। অগত্যা সে যতগুলো স্তবক রেডি ছিলো সেগুলো নিয়েই স্কুলে ফেরে। মনটা সেই নিয়ে খিঁচড়ে ছিলো।

    নবীনবরণের দায়িত্বে থাকা টিচারের অনেক বয়স, মুখের লাগাম বয়সের ব্যস্তানুপাতিক এবং তিনি পুরুষকারে তীব্র বিশ্বাসী। তার এতো দেরিতে এতো কম সাপ্লাই নিয়ে আসা দেখে তিনি তার মর্দাঙ্গিতে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং প্যান্ট শার্ট পাল্টে বারো হাত কাপড়ে আঁচল ও ঘোমটা টানতে বলেন। তার সঙ্গে আর যারা গান গাইবে, সেই সব মেয়েদের সামনেই। নেহাত সিনিয়র মোস্ট ক্লাসের স্টুডেন্ট না হলে হয়ত দুঘা জমিয়েও দিতেন।

    জিনিসপত্র আরেকজনের জিম্মায় রেখে সে নিচে সাইকেল রুমে ফেরে। জলদি জলদি বাকি মাল নিয়ে আসতে হবে, নতুন ব্যাচের লোকজন আসতে শুরু করে দিয়েছে। চোখে না দেখলেও পেছনে ঘনিয়ে ওঠা হাসিগুলো তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছিলো। পারলে সে খালি হাতেই কয়েকটা ঘাড় মটকে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়, ইনক্লুডিং টিচার।

    পেছনের চাকার লকটা খুলতে গিয়েই ব্যাপারটা চোখে পড়লো তার। টায়ার বসে গেছে। একফোঁটা হাওয়া নেই। সামনের টায়ারেও একই হাল। ভালভের দিকে চোখ পড়তেই সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হলো। ভালভের প্যাঁচটাকে কেউ একেবারে ওপরে তুলে দিয়েছে। কোন **** **, *** **** etc etc র প্র্যাকটিক্যাল জোক।

    এতক্ষণের ফিক্সড ডিপোজিটে রাখা রাগটা ফেটে বেরিয়ে এলো। উত্তাল খিস্তি মারতে মারতে সে প্রথমে ঘুরে দাঁড়িয়ে উল্টো দিকের ঝকঝকে নতুন ছোট খাট দেখতে মেরুন কালারের সাইকেলের চেনগার্ডে প্রথম লাথিটি মারে। তারপর আবারও। ধারেপাশের আরো দু একটা সাইকেলেও। যথাসাধ্য জোরে। অন্ধের মত। রাগের প্রথম সিটি তার মাথার প্রেসার কুকার থেকে বেরোতে সে আরো প্র্যাকটিক্যাল ড্যামেজে মন দেয়। শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ। আশেপাশের বেশ কয়েকটা সাইকেলের পাম্প খুলে দিলো সে।

    ***********

    অনুষ্ঠান ভালো হয়েছে। তার গানের পর তুলনামূলক ভাবে বেশি হাততালি পড়েছে। স্বয়ং স্যার তার প্রশংসা করেছেন আলাদা করে। অবশ্যই সবার সামনে।

    আরো একটা ব্যাপার আছে। স্টেজ ফ্রাইটের প্রাথমিক চটকাটা কেটে যাবার পর সে সাহস করে সামনের নতুন মুখগুলোর দিকে তাকায়। বিশেষ করে হাততালি পাবার সময়। একটা খুব উঙ্কÄল মুখ আর মানানসই হাসিতে তার চোখ চুম্বকের মত আটকে যায়।

    মেয়েটি নতুন। এই তল্লাটে প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। মাঝারি মাপের মফ:স্বলে যা হয় আর কি। একে সে আগে দেখে নি। বাটালির মত ধারালো চিবুকের পাশে একটা ছোট তিল, তার বুকের মধ্যে পানা জমা হেজে মজে যাওয়া পুকুরে কোন অতল থেকে একটা মস্ত বড় মাছ যেন ঘাই মারলো। সেও তারই দিকে তাকিয়ে আছে, সরাসরি, নজর সরাচ্ছে না।

    পরের গান শুরু হবার পরেও দুটো দৃষ্টি এক অন্যকে অনেকক্ষণ অনুসরণ করেছিলো।

    বাকি স্কুলের ক্লাস চললেও এই নবীনবরণ উপলক্ষ্যে আজকের দিনে ইলেভেন টুয়েলভের তাড়াতাড়ি ছুটি। অনুষ্ঠান শেষ হলেই। যেহেতু সে সকাল থেকে উদভ্রান্ত খেটেছে, তাই তাকে অনুষ্ঠান পরবর্তী গোছগাছ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। সকাল থেকে যা যা ঘটেছে, সে গড়ের বাগানে গিয়ে মৌজ করে ব্যোমভোলায় দুটো টান দিয়ে এগুলো নিয়ে একটু ভাবতে চায়। তার আগে সাইকেলে পাম্প দিয়ে নিতে হবে। সে সাইকেল রুমের দিকে এগিয়ে যায়।

    ফাঁকা রুম, সারি সারি হিরো, বিএসএ ইত্যদি নানা রঙের, ধরনের, গড়নের সাইকেলের দঙ্গল, এই সব কিছুর মধ্যে সেই মেয়েটি ছলোছলো চোখে নিচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার নবীনবরণে পাওয়া ফুলের তোড়াটা ধুলোভরা মেঝেতে অবহেলায় লুটোচ্ছে।

    সে দরজার সামনে আসতে মেঝেতে তার লম্বা ছায়া সেই ফুলের তোড়ার ওপর এসে পড়ে। মেয়েটি মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলায়, একটু মুখ টিপে কষ্ট করে হাসেও যেন।

    - 'কি হয়েছে, কোন সমস্যা?' আপনা থেকেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে কথা।

    - 'তোমাদের স্কুল বুঝি এরকম?' একটা সুরেলা তেজি গলা শোনা গেল।

    এতক্ষণ খেয়াল হয় নি, এবারে সামনে চোখ পড়তেই তার পিলে চমকে গেল। মেয়েটির সামনে স্ট্যান্ড করানো আছে তার সকালের তান্ডবের শিকার সেই ঝকঝকে নতুন মেরুন রঙের সাইকেলটি। সেটা যে লেডিস সাইকেল, এই হুঁশ তার তখন ছিলো না। চেন গার্ডের তলাটা দুমড়ে ভেতরের দিকে বেঁকে আছে, ধুলোবালি মেশানো জুতোর ছাপ দেখা যাচ্ছে এবং তার সাইকেলের মত এটারও পেছনের চাকায় কোন পাম্প নেই, তফাৎ শুধু এইটুকুই, এটার এই দুরবস্থা সে নিজের হাতে করেছে।

    এই রাঙা বসন্তের দুপুরে কোথাও কোন কোকিল ডাকছে না, কোন উদাসী হাওয়াও দেয় নি, স্কুলের দিক থেকে নিচু ক্লাসে বাচ্চাদের চেল্লামেল্লি কানে আসছে, তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে এবং তাদের সামনে যে পরিস্থিতি, তা মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক না, তবুও....

    পরের কথা শুরু হবার আগে দুটো দৃষ্টি এক অন্যকে অনেকক্ষণ অনুসরণ করেছিলো।
  • i | 203.158.52.216 | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ ১১:৪২491126
  • শঙ্খ,
    কিছু মনে না করলে আমার একটা প্রশ্ন আছে:
    এক্সপেরিমেন্টাল গল্প শিরোনাম কেন?
  • Sankha | 96.234.98.74 | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৪:১৪491127
  • এই যাহ্‌ রিপ্লাই দেই নি।

    বলছি, কেন এক্সপেরিমেন্টাল। একটু সময় নিয়ে।

    তারি ফাঁকে, আপনার কিছু মনে হচ্ছে না? :-))
  • i | 137.157.8.253 | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৪:৫৫491128
  • শঙ্খ,
    আপনি আগে বলুন , সমালোচনায় রাগ করেন কি না। পুজোর আগে আমি মোট্টে ঝগ্‌ড়া চাইনা।
    আপনার লেখার হাতটি ভালো লেগেছে বলেই কিছু সমালোচনা করার আছে। মানে ঐ যে জিগালেন কি মনে হয়েছে সেই সব বলতাম। আমার ব্যক্তিগত মত আর কি।
    তো, আপনি যদি রেগে যান, তবে ঐ চাট্টি কথা পুজোর পরে বলব-একদম কালীপুজো পার করে।
    ঠিকাছে?
  • Sankha | 96.234.98.74 | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৮:০১491129
  • ইন্দ্রাণী,
    সমালোচনা গঠনমূলক হলে তাতে রাগ করার কিছু নেই। আর আমি অ্যাবসলিউট কিছুতে বিশ্বাস করি না। সুতরাং আপনি বলুন যা বলার আছে। এক্সপেরিমেন্টই তো চলছে। অপেক্ষা করে লাভ কি?

    কিন্তু আপনার কেন মনে হচ্ছে ঝগড়া হতে পারে? :-))
  • i | 137.157.8.253 | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১১ ১১:৫০491130
  • আগে বলি, লেখার সমালোচনার ব্যাপারে আমি দুর্মুখ। বন্ধুবিচ্ছেদ ঘটে যায়। ভালো না লাগলে আমি বলতেই পারব না-বা:।
    আমি যা বলব -আমার ব্যক্তিগত মত। আপনার ওপর কোনো রকম বিদ্বেষ থেকে আমি কিছু বলছি না-এইটা মনে রাখবেন। আপনার লেখার হাতটি ভালো লেগেছে, মুগ্‌ধ করেছে এলেখার বহু ডিটেইলিং। তাই সামান্য কটি কথা।আমি এমন কেউ নই যে কথাগুলো আপনাকে খুব সিরিয়াসলি নিতে হবে। সাধারণ মনোযোগী এক পাঠকের কিছু কথা। জাস্ট পড়ে নেবেন আপনার সময়মত। এইটুকুই।

    দেখুন, আপনার শিরোনামটিই আমাকে বড় পীড়িত করেছে। সমস্ত লেখা জুড়ে তাড়া করে বেরিয়েছে এই শিরোনাম-শুধু খুঁজে গেছি -কোথায় এক্সপেরিমেন্ট? কোথায় এক্সপেরিমেন্ট? বিষয়ে? শৈলীতে? এখন অবধি পাইনি খুঁজে।
    একটি পোস্টে তৃপ্তি লিখেছেন-আপনি এরকম লেখেন নি আগে। সেটা থেকেই এক্সপেরিমেন্ট।হয়তো ঠিকই।তবে
    আমি শুধু এই লেখটিই বিচার করছি কাজেই আপনি আগে কি লিখেছেন, তা বিচার্য নয় আমার।

    দ্বিতীয়ত: এই যে সাবহেডিংগুলি-প্রায় সবকটিই একটু যেন প্রেডিকটেবেল লাগলো আমার। U/A এপিসোড বা ফল যদি উদাহরণ হিসেবে ধরি-বিস্তৃত ব্যাখ্যায় যাবো না। ধরুন এই যে ফল বা উইন্টার-গল্পের পটভূমি কি ঐ ঋতুতেই হতে হবে? এটা কেমন চড়া দাগ হয়ে যায় না কি? একটা অসম্ভব শৈত্যের উপাখ্যান আপনি লিখতেই পারেন-কিন্তু তাকে কেন শীতের রাতেই ঘটতে হবে?
    আপনার উইন্টার অংশের থেকে শীতের রাত ইত্যাদি শব্দগুলি তুলে দিয়ে দেখুন-প্রজেক্ত করুন মনের শৈত্যকে-লেখা একদম অন্য উচ্চতায় চলে যাবে।

    তৃতীয়ত: বিশেষণ কি একটু কমানো যায় না?রামতেরি গঙ্গা ময়লী স্টাইল বলেই পরের শব্দে সিক্তবসনা শব্দটি অর্থহীন। বাহুল্যমাত্র। পাঠকের স্পেস কেড়ে নেওয়া যেন। এরকম বহু আছে। একটু এডিট করে নির্মেদ টানটান করে দেওয়া যায় না?

    চতুর্থত: লেখার প্রতিটি অংশ তার নিজের মত। বিচ্ছিন্ন। আলাদা করে একটি লেখা হিসেবেই পড়া যায়। কিন্তু সমস্ত অংশগুলি কোথাও একটা মিলেমিশে ফোর সীজনের অর্কেস্ট্রা হয়ে বেজে ওঠার কথা ছিল। সেইটা হোলো না এখনও। জোড়ের দাগ স্পষ্ট।

    আরও হয়তো কিছু বলার আছে। কিন্তু এইটুকুই থাক।

    আপনার কলম চলুক।
  • ranjan roy | 14.97.203.88 | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১১ ১৫:১৮491131
  • ইন্দ্রাণী,
    প্রথমেই বলি আমার শংখের লেখা ভাল লেগেছে। অনেকদিন বাদে পিসি খুলে তরতর করে পড়ে গেছি। কৈশোরোত্তর আলো-আঁধারি মনখারাপ করা পাগল ভালোলাগা কেমন যেন চেনা ,মনে হয়েছে।
    তবে আমি ভালো ক্রিটিক নই। দময়ন্তী, শমীক আর তোমাকে জানি।
    আমি তোমার প্রত্যেকটি মন্তব্য খুব মন দিয়ে পড়লাম। সব সময়ই তোমার লেখাগুলো( সংখ্যায় খুব কম হলেও, ওপাড়া-এপাড়া সব মিলিয়েই বলছি) বিশেষ মন দিয়ে পড়ি।
    সবিস্ময়ে খেয়াল করলাম যে তোমার দেয়া সতর্কবাণীগুলো আমার লেখার ব্যাপারে ভীষণ ভাবে প্রযোজ্য।
    আমি এবার নিজের লেখার ব্যাপারে আরো সতর্ক হব-- যাতে লেখা আরো টানটান এবং নির্মেদ হয়।
    আর একটি অনুরোধ, আমি বয়সে বড় বলে আমার লেখার নির্মম সমালোচনা করতে দ্বিধা কোর না। বড় খুশি হব। বন্ধুবিচ্ছেদ হবে না, এটুকু গ্যারান্টি!
    আখেরে লাভ তো আমারই, ষোলআনা:)))
  • indrani | 124.168.181.106 | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১১ ১৭:৪৫491133
  • রঞ্জনদা,
    লজ্জা দিয়েন না।
    আসলে, এক এক জনের ভালো লাগা এক এক রকম। আমি নির্মেদ হতে বলছি কারণ মেদে আমি হোঁচট খাই কিন্তু কারো কাছে হয়তো এই হালকা মেদটুকুই প্রার্থিত মসৃণ্‌গতি পঠনের জন্য।
    এগুলো আমার ব্যক্তিগত মত। আমার একান্ত ভালো লাগা মন্দ লাগা। এই আর কি। বেশি গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নাই। শঙ্খকে তাই তো বললাম।
    আমার গুরু কয়েছেন-'লেখক তো স্রষ্টা। সৃষ্টির রসায়ন তার চৈতন্যে সব সময় কাজ করতে থাকে। এই ক্রিয়াশীলতা প্রত্যেকবার চেষ্টা করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে। দড়িটা ছুঁয়ে দিলে গল্পের জন্ম হয়।'
    শঙ্খ ডেফিনিটলি সে দড়ি ছুঁয়ে দিয়েছেন।
  • Nina | 12.149.39.84 | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১১ ২১:২৯491134
  • তোমার হাতের সমালোচনা, হল দিয়ে
    যেমন মামা তেমন সাজা
    গরম ভাতে ঘী!

  • Nina | 12.149.39.84 | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১১ ২১:৩০491135
  • ইন্দ্রাণী কে বল্লাম---
    ওপরের কমেন্টটা
  • Sankha | 96.234.98.74 | ০৪ অক্টোবর ২০১১ ১০:২২491136
  • ইন্দ্রাণী,

    শুক্রবার অফিস থেকে ফিরে এসে এক কাপ চা নিয়ে বসে গেছলুম কিছু লিখতে। আপনি আমার সমালোচনা করেছেন বলে না, কয়েকটি কৈফিয়ৎ, যেগুলো আগে দিতে গিয়েও বারবার থমকে গেছি, সেগুলো নিয়ে একটু স্পষ্ট লেখার প্রয়োজন অনুভব করছি। তারপরে পুজো আর কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপারে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ায় সে চিঠি শেষ হলো না। সেভ করা আছে, কিন্তু থাক, নতুন করেই লিখি।

    পয়েন্ট বাই পয়েন্ট আপনার কমেন্টে আসি।

    লেখার সমালোচনা: না, আপনি এমন কিছু লেখেন নি, যাতে বন্ধু বিচ্ছেদের মত সিভিয়ার কিছু ঘটে যাবে। আপনার ব্যক্তিগত মত দিয়েছেন, বেশ করেছেন। সমস্ত পাঠকেরই সেই অধিকার আছে। আমি নিজে সমালোচনা নিয়ে ভাবি, দরকার মত নিজেকে পাল্টে নিই। কোন কিছুই অ্যাবসলুট বলে আমি মনে করি না। আপনি অন্তত: অনেকগুলি যুক্তি দিয়েছেন। আসুন সেই গুলি একটু ঘেঁটে দেখি।

    শিরোনাম: বুঝলুম কি বলতে চেয়েছিলেন। আপনাকে আমার প্রশ্ন, এক্সপেরিমেন্ট মানে কি সব সময়ই পাথ ব্রেকিং কিছু আপনি ভাবেন? ঐ দিক থেকে না ভেবে অন্য কয়েকটা দিক থেকে ভাবুন। লেখাটা শুরুই হচ্ছে শিবাংশুদার একটি লেখার শেষ লাইন থেকে, যেটা কিনা প্রথমে মজলিশ এবং পরে গুচর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাহলে একটা স্পেসিফিক টার্গেট অডিয়েন্স নিয়ে আমি শুরু করলাম আমার লেখা। এবং তার একটা কারণ ও আছে। কেন রেফারেন্স দিলাম শিবাংশুদার লেখার?
    শিবাংশু এই লেখাটি প্রথমে মজলিশে লেখেন, এমন একটা সময়ে যখন ওঁর লেখার বিরুদ্ধে 'ভারি ভারি, তৎসম, জটিল, বড়' এই সব বিশেষণ বসছে। এই সবের এক দু দিনের মধ্যে শিবাংশুদার এই লেখাটি বেরোয়, আমরা সবিস্ময়ে দেখি, ঐ সব বিশেষণের খোলস ছেড়ে, প্রবন্ধের ভাষার হাতছানি উপেক্ষা করে শিবাংশুদা এই রকম একটা সাবলীল গদ্যের জন্ম দিলেন।

    আপনি যেমন সরাসরি লেখা নিয়েই বিচারে বসেছেন, আমি বিচারে বসি লেখকের পূর্বাপর যতখানি আমার জানা আছে, সেই সব নিয়ে। লেখার স্টাইল স্টাডি করা আমার খুব পছন্দের বিষয়। দেখলুম শিবাংশুদার নিজের হাতে নিজের সিগনেচার স্টাইল ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছেন।

    এই লেখা শুরু করার আগে আমি নিজেও গুটিকতক লেখা লিখেছি মজলিশে, সেগুলোর বিষয় আলাদা হলেও লেখার ধরণ ধারণ এক, অন্তত: আমার কাছে। নতুন পাড়ায় এসে কি নিয়ে লেখা যায় ভাবছি, শিবাংশুদার লাস্ট লাইনটা দেখে আমি একটা গল্প চোখের সামনে দেখলুম, আলাদা গল্প যার শুরু আর শেষটা আমি জানি। বাকিটা বানাতে হবে।

    এই খান থেকেই শুরু হল এক্সপেরিমেন্ট। আগে সেটাই দিলুম নাম, কেননা এই গল্পটার মাধ্যমে আমি অন্তত: কয়েকটা জিনিস নিয়ে পরীক্ষা চালাবো:
    ১ ধারাবাহিক: আগে কখনো লিখি নি, আমার কাছে পরীক্ষা
    ২ ভাষা: আমি যে ধরণের গদ্যে অভ্যস্ত এই লেখার ভাষা আলাদা। পাঠকেরা কতখানি অনুভব করবেন আমি জানি না, আমি নিজে লেখার সময় অনুভব করি
    ৩ ফিকশান লেখা
    ৪ নানান আইডিয়ার ব্যবহার

    তো এই অ্যাজেন্ডা নিয়ে আমি যে শুরু করলুম, সেটা পাঠকেরা জানবেন কি করে? নতুন পাড়ায় আমিও যে ফ্রেশ কিছু দিতে চাইছি, সেটা বলব কি করে? তখন ঠিক করলাম, হিন্টস রাখি, যেমন নামে; পরে পরে ডিসক্লেইমার দেবো।

    তারপর সূত্র দিলুম, শিবাংশুদার গল্পের শেষ লাইন দিয়ে। গল্পের ধরতাই হিসেবে অনেক কিছুই দেওয়া যায়, যেতো, কিন্তু আমি যে গল্প তৈরির পেছনের গল্পটা ছুঁতে চাইছি, সেটা সরাসরি লিখতে গেলে কেমন মানে বই লিখছি মনে হয়, এই যেমন এখন হচ্ছে, কিন্তু এবারে না লিখে উপায় নেই, আপনি খোলাখুলি জিগগেস করেছেন।

    আইডিয়ার ব্যবহার নিয়ে ডিটেলে বলতে চাই না, পাঠকরা নিজেরা ফীল করবেন, এটাই কাম্য, তবুও হিন্টস হিসেবে বলতে পারি: 'স্প্রিং, সামার ... এই পুরো এপিসোডটি (পরে বিস্তারিত লিখছি), গালাগালি (গোনাগুনতি * এর ব্যবহার, ছাপার অযোগ্য টাইপ ক্লিশে না, আবার অনিচ্ছুক পাঠককে সেগুলো শোনাতেও চাই না, তার চেয়ে যিনি জানেন, ফিল ইন দা ব্ল্যাংকস করে নেবেন), জায়গার পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেল, অথচ কোন নাম নেই, মূলত: সে, তার এই সব দিয়ে লেখা, চরিত্রগুলো একটু অন্যভাবে আঁকা, নিতান্তই না হলে নয় এই ভাবে রিলেটেড দু একটি পারিবারিক সম্পর্ক দেখানো, নির্দিষ্ট কোন সময় বা সালকে ধরছি না, অন্তত: দশ থেকে পনের বছরের গ্যাপের প্রজন্মের লোকজনও রিলেট করতে পারবেন, এই চেষ্টা, দরকার মত ফ্ল্যাশব্যাক... ইত্যাদি প্রভৃতি।'

    প্রেডিকটেবল সাবহেডিং: এই বিষয়টা ব্যক্তিবিশেষে পাল্টে যায়। আপনি নিজেকে দিয়ে দেখুন না, মূল শিরোনামের জন্য আপনি সারা লেখা খুঁজে গেলেন, কোন কারণ ধরতে পারলেন না, অথচ যেই দেখলেন সাব হেডিং আর গল্পের এক ছাদের নিচে বসবাস, আপনার সেটা প্রেডিকটেবল লাগলো। হয়তো কোন কোন পাঠক এটাতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন।
    এবারে যে দ্বিতীয় প্রসঙ্গটা তুলেছেন, আমার সোজাসুজি উত্তর হল হ্যাঁ, ঐ গল্পগুলোর পটভূমি ঐ ঋতুতেই হতে হবে। সেটা না হলে আমি যে কথাটা বলতে চেয়েছি সেটা ফুটবে না।

    এক এক করে বলি: স্প্রিং: নতুন জীবনের/সময়ের মেটাফর হিসেবে দেখুন। রোমান্স, হোলির আদর্শ সময়। ঠিক সেই সময় দেখুন সে নতুন ক্লাসে উঠেছে, জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা দিয়ে, ষোলো-সতের-আঠেরো বছরের আগুন রক্তে নিয়ে সে জানতে চাইছে কিছু আপাত গোপন কথা, সোজাসুজি কোন রাস্তা বা উপায় নেই, তাই এসেছে চটি বই এর ধারণা।

    সামার: এই পর্ব পুরোটাই মূলত একটা মেটাফর। কাঁকড়ার আনাগোনাই বলুন, বালিতে নাম লেখাই বলুন, আবরণ হীন হয়ে দৌড়ানোই বলুন বা সমুদ্রের জায়গা ছেড়ে দেওয়ার কথা। আর ঠিক সামার বলেই আমি সমুদ্রের ধারে বেড়ানো এনেছি, 'সফেন সমুদ্রের' (কিছু একটা ছুঁয়ে গেল কি?) স্পর্শ এনেছি।

    পাঠক যদি সেই ভাবে না ভাবেন?

    ক্ষতি নেই, শুধু একটা বেড়াতে আসার গল্প হিসেবে পড়লেও চলবে। সদ্য সদ্য তার একতরফা (জটিলতা এড়াতে, নইলে এই সম্পর্কটা নিয়ে আরেকটা এপিসোড ছিলো, সেটা এডিটিং এর সময় বাদ দিয়েছি, পরে অন্য ভাবে কাজে লাগাবো) প্রেম ভেঙ্গে গেছে, সে পালাতে চাইছে সব কিছু থেকে, একটা নাম সে ভুলতে চাইছে প্রাণপনে। সামার না হলে মূল গল্পের দিক থেকে মুশকিল, আপনি যদি সময়ের লিনিয়ারিটিতে ভাবেন।

    ফল: এইখানে আমার হাতে এসেছে একটা অন্য ধরণের গল্প। লাইব্রেরি স্যারের মৃত্যু আর সেই সুবাদে আসবে একটি শিশুর পিতৃহীন হয়ে যাবার গল্প। সেইখানে মহালয়াকে আমি ব্যবহার করবো 'পিতৃপক্ষের শেষ' এই ট্যাগ লাইন টার জন্য।
    এমনিতে মহালয়ার দিন শ্রাদ্ধ-দিবস হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ, যদি কেউ বছরের নির্দিষ্ট দিনে মৃত পূর্বপুরুষদের কাজ না করতে পারেন, যে কোন কারণেই হোক, এই দিনে তা পারেন, দিনটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ।

    আমি সেটাকে কাজে লাগাতে চাই। দিনটার সিগনিফিক্যান্স কাজে লাগাতে। নইলে এই ঋতুতে আমি গড়ের আটচালার পুজো দেখাতে পারি, বিসর্জনের গল্প নিয়ে লিখতে পারি, অনেক অপশন আছে। কিন্তু তার জীবনের চারটে স্বাদের চারটে গল্প লিখতে চাই, এইখানে একটা আলাদা অপচুনিটি এসেছে, তাকে প্রথম বার মৃত্যুর খুব কাছে দাঁড় করিয়ে দেখবো তার রিয়্যাকশান কি হয়।

    '... যে শিশু সে যে জানেই না, তার পিতৃপক্ষ ইহজন্মের মত শেষ' এই লাইনটাতে আমি তার উপলব্ধির মাধ্যমে শিশুটির অসহায় জায়গাটা ধরতে চাইলাম।

    'ফল' ছাড়া এই লাইনটা আমি লিখতে পারবো না। ঐ লাইনটাই আসবে না। আমার কাছে, 'পিতৃপক্ষের শেষ' এই লাইনটা ধাক্কার মত এসেছে, যখন ভেবেছি। দেখতে চেয়েছি পাঠক কি ভাবে রিয়্যালাইজ করেন।

    উইন্টার: তিনটে ঋতু পেরিয়ে এসেছি আমরা। শীতে কি ধরণের গল্প লেখা যায়? এই ঘটনাটা যেটা কিনা সত্যিই ঘটেছিলো, মানে ঐ তিনজনের একজন আমি ছিলাম, সেটা লিখলাম। অদ্ভুত এই যে, বাকি গুলো স্থান কাল পাত্র সব বানানো, কিন্তু এইটা সত্যি আর এটা শীতেই ঘটে, আমার তখন ক্লাস নাইন। ঐ একটা মূর্তির হারিয়ে যাওয়া, তারপর কয়েকটা লোক এলো, একটা মেয়েকে খোঁজ করছিলো, স-অ-ব।
    পরে ভেবে দেখেছি, শীতকাল বলেই ব্যাপারটা এই ভাবে আমাদের চমকে দিয়েছিলো, অন্য ঋতুতে হলে রাস্তাঘাটে লোকজন থাকতে পারতো, এই ঘটনার টাইমলাইন রাত সাড়ে আটটা থেকে নটা, কেননা তারপরে সে বাড়ি ফিরছে। শীতকালে নিশুতি হয়ে যাওয়া যতটা স্বাভাবিক, অন্য ঋতুতে ততটা না। এটা আমার নিজের অভিজ্ঞতা। ভূতের গল্প বর্ষাতেই যেমন ভালো জমে, শৈত্যের গল্প শীতকালেই আনাই ভালো। পাঠক কোরিলেট করতে পারবেন।

    তিন নং পয়েন্টটা মেনে নিলাম। এমনকি এর মধ্যে একটা লেখাও লিখেছি, যাতে মূলত: এই ফীডব্যাক মাথায় রেখে কি বোর্ডে হাত রেখেছি। যদি সময় পান এই লিঙ্কটা একবার দেখবেন: http://www.banglalive.com/Blog/Other/293
    ছোট ছোট বাক্যে, ফাস্ট পেসের লেখা।
    ইচ্ছাকৃত ভাবে একটা অতিরিক্ত বিশেষণ রেখেছি, অভয় দিলে বলি, আপনার জন্যই :-)) দেখি আপনার চোখ ফাঁকি দিতে পারি কিনা। (ডি: বাকি কিছুও থাকতে পারে, সেগুলো অনিচ্ছাকৃত।)

    চার নং পয়েন্টটা নিয়ে বলি, এই 'স্প্রিং, সামার...' পর্বে আমার একটা ডিসক্লেইমার লেখা ছিলো। কেন পর্বটা এতো বড়? কেন এর চারটে সাব এপিসোড? মূল গল্পের থেকে কোথায় এ আলাদা।

    মনে হচ্ছে সেইটে আগে লিখি, পরে বিশদে আলোচনা করা যাবে।

    ""লিখে তো দিলুম, একবছর বাদে টের পায়, কিন্তু এই একটা বছর 'তার' কেমন গেলো, জানতে ইচ্ছে করে বৈকি।

    সেই খান থেকেই এই এপিসোডের সূচনা। আরেকটা পরীক্ষা। এটা তারই ডিসক্লেইমার।

    এই একটা বছরের গল্প অনেক ভাবে লেখা যায়। না লিখে জাম্প করে পরের বছর কি হল সেই গল্পেও চলে যেতে পারি। ফলে মূল গল্পের সূত্রের এগিয়ে যাবার সঙ্গে এই পর্ব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে না। এই পর্বে তাই গল্পটাকে একটু বিছিয়ে দিলুম। চারটে সিজন বা ঋতুতে তার জীবনে ঘটে যাওয়া চারটে স্বাদের গল্প। মূল পর্ব একটাই, তার চারটে অপেক্ষাকৃত ছোট সাব-এপিসোড। পঞ্চম পর্বে গল্পটাকে একটু এগিয়ে নেবো।

    এখন কথা হচ্ছে চারটে গল্প অন্য শিরোনামেও লেখা যেত। ঋতুর নামে লেখার কারণ কি?

    'চক্র' বা 'সার্কল অফ লাইফ' এর কনসেপ্ট। একেকটা সিজনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ প্রকৃতি পাল্টে পাল্টে যায়, মানুষও পাল্টায়। অভিজ্ঞতা বাড়ে, তারপর আবার সেই চাকা ঘোরার শুরু।

    এই জিনিসটা নিয়ে অনেকদিন ধরে কিছু লেখার ইচ্ছে, এই পর্বে গল্পে গল্পে নামিয়ে দিলুম।
    তাছাড়া একেকটি সিজনে ঘটে যাওয়া গল্পের সঙ্গে ঐ সিজনের থিমের আবছা কিছু যোগসূত্র রাখার চেষ্টা করেছি।

    আর হ্যাঁ, আমার ভীষণ প্রিয় ডিরেক্টর কিম কি দুকের ২০০৩ সালের ঐ বিখ্যাত সিনেমাটি থেকেই এই পর্বের নাম ও ধারণা নেওয়া।""

    জোড়ের দাগ পাবেন না কেন? যাতে মিশ না খায়, আমি তো সেই হিসেবেই লিখেছি। সময়ের একটা আলগা যোগসূত্র ছাড়া এই চারটে গল্পের কোন কনভার্জ পয়েন্ট নেই। চেষ্টাকৃত ভাবেই। জীবন যেরকম। এক্সপেরিমেন্ট না করলে এক সুরের কিছু লিখতুম। এখানে সে দায় আমি নিচ্ছি না।

    ****

    অনেক কিছু লিখলাম। যে কথাগুলো বলতে গিয়ে কেমন কেমন লাগছিলো, মানে বই লেখাতে আমার তীব্র অনীহা, যাঁরা পড়বেন, ইন্টারপ্রিটেশন নিজেরাই করে নেবেন। আমি ও সেই ভাবেই পড়ি। ভাবি।

    তবুও এই আলোচনার মাধ্যমে অনেক ঋদ্ধ হওয়া গেল, খামতির জায়গাগুলো পয়েন্ট আউট করে ভালো করলেন।

    আর এক্সপেরিমেন্ট ই তো করছি আমি। এই গুলো পর্যবেক্ষণ :-))

    পুজো ভালো কাটুক আপনার ও আপনাদের।
  • i | 137.157.8.253 | ০৪ অক্টোবর ২০১১ ১০:৫৮491137
  • শঙ্খ,
    আমার মনে হয় আপনার আর আমার চিন্তা ভাবনার গতিপ্রকৃতি কিঞ্চিৎ আলাদা।
    এই নিয়ে কথা বাড়াবো না। লেখার স্বাদ নষ্ট হবে।
    তবে, যে প্রশ্নটি করেছেন-তার উত্তর হ্যাঁ। এই শত সহস্র লেখা / লেখকের ভীড়ে-ছাপা অক্ষর বা ওয়েবজিনে আমি খুঁজে বেড়াই অন্য রকম লেখা। একদম অন্যরকম কিছু।

    কলম যেন না থামে।

    শারদ শুভেচ্ছা-
  • dd | 122.167.17.10 | ০৪ অক্টোবর ২০১১ ১১:২৯491138
  • সাহিত্যের জন্য মানে বই আমি ও অপছন্দ করতাম কিন্তু এখন দেখি যখন লেখকের পার্সোন্যাল জীবনের খুঁটি নাটি,কোন মানসিকতা বা কোন ঘটনার পরে তিনি লিখলেন, এই সব জানলে অনেক ক্ষেত্রেই (নট ১০০%) আরো ভালো করে রসোপলব্ধি করা যায়।

    এটা ঘটনা।
  • ranjan roy | 14.97.117.202 | ০৪ অক্টোবর ২০১১ ১২:৩৪491139
  • ডিডি'র সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।
    দুটো উদাহরণ দিতে ইচ্ছে করছে।
    এক,
    সুনীল গাঙ্গুলি'র অনুবাদে "" অন্যদেশের কবিতায়'' কোন ইউরোপীয় কবির তিনলাইনের ছোট্ট কবিতার প্রথম লাইন"" ওরিয়ল পাখি মেলেছে তার কালো ডানা''। যেই পাদটীকাতে জানলাম যে ওটি বিশ্বযুদ্দের পটভূমিকায় লেখা আমার মনের স্লেটে কবিতাটি অন্যভাবে ধরা দিল।
    দুই, যেই ইন্দোডাক্তারের থেকে জানলাম যে ফরাসী ভাষায় ব্লঁশ এর মানে সাদা আর নিষ্পাপ পবিত্রতার আমেজ আনে , অমনি "" এ স্ট্রীট কার নেমড্‌ ডিজায়ার'' নাটকে ব্লঁশ চরিত্রটির আয়রনি আর নির্মম যন্ত্রণা খানিকটা বুঝতে পারলাম।
  • Sankha | 71.187.134.116 | ০৮ নভেম্বর ২০১১ ০৯:৫৩491140
  • বাপস!! একমাসের ওপর হয়ে গেল রঞ্জনদার লাস্ট কমেন্টের পর! মাঝখানে আর কিছুই লিখি নি!

    যাইহোক, এসে গেল গল্পের পঞ্চম পর্ব। এতদিন পরে লেখা, নতুন জায়গা থেকে শুরু করলে আর খেই খুঁজে পাওয়া যাবে না মনে হল, তাই আগের পর্বে অর্থাৎ '...অ্যান্ড স্প্রিং' পর্বে যেখানে থেমেছিলাম, সেইখান থেকে শুরু করলাম। এই জায়গাটা বলতে হতই, খামোকা ফ্ল্যাশব্যাকে বলার দরকার নেই।

  • Sankha | 71.187.134.116 | ০৮ নভেম্বর ২০১১ ১০:০২491141
  • (৫) Yesod: The Foundation Sephiroth
    *************************

    চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মেয়েটিই প্রথমে কথা বলে, 'এবারে কি করবো? নতুন স্কুলে আসছি বলে বাবা এই সাইকেলটা কিনে দিলো। দু সপ্তাহও হয়নি...' বলতে বলতে তার গলাটা যেন করুণ হয়ে আসে।

    আর তার বুকের মধ্যে ঝড়ের বিকেলে জানালার পাল্লা যেন অবিরত খোলা বন্ধ হতে থাকে, ধুপধাপ শব্দ ওঠে ভেতরে ভেতর। তার হঠাৎ করে যেন শীত করে ওঠে। গায়ে কাঁটা দেয়। এই সব কথা সে একটা ঘোরের মধ্যে থেকে শুনতে পায়। তার প্রাণপণে ইচ্ছে করে আঙ্গুল বাড়িয়ে চিবুকের তিলটা একবার ছুঁতে। অজান্তেই তার হাতের তর্জনি উদ্যত হয়ে ওঠে।

    কয়েকটি মুহূর্ত বা তারও ভগ্নাংশ হবে হয়ত। মেয়েটির গোল গোল হয়ে ওঠা চোখের দিকে তাকিয়েই হয়ত তার সম্বিৎ ফিরে আসে। সে ঝটিতি নিজেকে সামলে নেয়। পরিস্থিতি সামলিয়ে নিতে হাত প্রসারিত করে সে ভিড়ের মধ্যে নিজের পুরনো সাইকেলটা দেখিয়ে বলে, 'ওইযে, ওইটা আমার। একই অবস্থা..' বলে একটু দেঁতো হাসার চেষ্টা করে। তার কথায় হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে মেয়েটি গলা বাড়িয়ে জরিপ করে তার সাইকেলের অবস্থা।

    হয়তো নিজেকে একই রকম ভাবে পরিস্থিতির শিকার দেখিয়ে সে যাহোক করে মেয়েটির কাছ থেকে কিছু সিমপ্যাথি পেতে চেয়েছিলো, কিন্তু এক লহমায় সেটা ব্যাকফায়ার করে গেল। মেয়েটি একঝলক দেখে দুম করে বলে বসলো, 'ও বাবা! এখানে এই রকমই হয় নাকি? এতো ছোটলোকের স্কুল!'

    আঝাঁটব্রহ্মতালু দাউ দাউ করে জ্বলে যাওয়া টের পায় সে। সকালের সেই রাগটা তার শিরায় শিরায় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এই স্কুলে সে এতগুলো বছর পড়েছে, একজন বাইরের লোকের থেকে প্রথম দিনেই এমনতর ফীডব্যাক সে মেনে নিতে পারে না। বেশ ঝেঁঝেই সে বললো, 'তাহলে ভর্তি হলি কেন এমন স্কুলে? ভদ্দরলোকের স্কুলে পড়লেই পারতিস'।

    - 'তোঁমরাঁ কি কঁরতিছ এখানে?'

    ঝামেলাটা হয়ত আরেকটু গড়াত, যদি না আচমকাই এই স্বরটা দরজার কাছ থেকে ভেসে আসত। সে হতাশ ভাবে মাথা ঝাঁকাল। এই কন্ঠস্বরের মালিকের সঙ্গে তার মিউচুয়ালি অপছন্দের সম্পর্ক।

    তাদের অ্যাসিস্টেন্ট হেডস্যার।

    ভদ্রলোককে শুধু সেই যে অপছন্দ করে তা না, স্কুলের অধিকাংশ লোকই এই একটি ব্যাপারে একমত। অকারণে না। ভদ্রলোক প্রচন্ড খিটখিটে এবং কুচুটে টাইপ। ময়লা রঙের, গোলগাল, বেঁটে খাটো মানুষটিকে আজ অবধি তারা ধুতি আর কনুইয়ের ওপর অবধি আস্তিন গোটানো পাঞ্জাবি ছাড়া দেখেনি। শীতকালে ভদ্রলোক এর ওপরে বড়জোর হাতকাটা কার্ডিগানের মত সামনে বড় বড় লজেন্স-বোতাম লাগানো সোয়াটার নইলে মামুলি একটা শাল পরেন। পায়ে মোজা ছাড়া কালো পাম্পশু। সপ্তাহের মাঝামাঝি বোধহয় একবারই দাড়ি কামান, ফলে প্রায় সবদিনই গালে অল্পবিস্তর গুঁড়োগুঁড়ো দাড়ি এমনিতে অপ্রসন্ন মানুষটিকে অপ্রসন্নতর করে তোলে। যখন ভদ্রলোক মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে নাকের ডগায় সরু গোল ফ্রেমের চশমার ওপর দিয়ে কারো দিকে ভুরু তুলে তাকান, একটা 'তুমি আবার কোন হনু এলে হে' টাইপ তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তির হাড়পিত্তি জ্বলে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। স্কুলে ভদ্রলোকের অবস্থানটা অনেকটা কালমেঘ পাতার জলের মত, উপকারী কিন্তু বিস্বাদ।

    এই ভদ্রলোক সবসময়েই একটা বেত হাতে চরকির মত স্কুলে ঘুরপাক খান। কোন ক্লাসে টিচার নেই, ছাত্ররা গোলমাল করছে, ইনি ঠিক পৌছে যাবেন, 'লিঁখ, একটি ত্রিঁভুজের দুটি বাহু যদি...'
    খপাখপ তিন চারটে অঙ্ক কষতে দিয়ে ইনি চলে যাবেন পরবর্তী ক্লাসে। ভদ্রলোকের কথাগুলো একটু নাকি সুরে শোনায় সবসময়।

    ঠিক এই ভাইটাল মুহূর্তটাতেও ইনি পৌছে গেছেন, ভদ্রলোকের কান আছে বলতে হবে, সে ভাবল। এখন প্রশ্ন হলো এই সাইকেল রুমে তাদেরকে কোন অঙ্ক কষতে দেবেন?

    এবারেও মেয়েটিই আগে মুখ খোলে, 'দেখুন না স্যার কারা যেন অনেকগুলো সাইকেলের কি অবস্থা করেছে। আমারটাও, এই দাদারটাও। দাদা বলছিলো স্কুল কমিটিতে রিপোর্ট করতে হবে, তারপর সারাতে নিয়ে যেতে হবে।', তারপর একটু দম নিয়ে যোগ করে, 'আমি আজকেই ভর্তি হলাম স্যার। ইলেভেন সায়েন্স। এখানে নতুন এসেছি। আগে পড়তাম ...', যে জায়গাটার নাম সে করল সেটা বেশ ভালো গার্লস স্কুল, কিন্তু তাদের এলাকার কাছাকাছি নয়। বাস ধরে অনেক দূরে যেতে হয়।

    - 'হুঁ। দেখতিছি। কি নাম তোমার? ইলেভেনে পড়তে এত দূরে এলে কেন? দৈনিক যাতায়াত তো পারবে না।' স্যার সেই বিরক্তিকর ভাবে চশমার ওপর দিয়ে তাকান।

    মেয়েটি নাম বলে (সে জানে এই নাম স্যার আর ভুলবেন না), তার বাবার বদলি হয়েছে, সে আর তার মা এখানে জেঠুর বাড়িতে থাকবে, তাই সে এই স্কুলে ভর্তি হয়েছে, কারণ এই অঞ্চলে এর থেকে ভালো স্কুল আর নেই। বেশ গুছিয়ে তাদের স্কুলের নামে ভালো ভালো কয়েকটা কথা মেয়েটি বলে। তার মনে হয়, একটু আগের লুজ স্টক করে ফেলার মেরামতি হিসেবেই এত কথা আসছে, আর সে তার একমাসের গাঁজা বাজী রাখতে পারে, এর অনেকগুলোই ঢপ। তবে মেয়েটার হাঁড়ির খবর মুফতে জানা গেল, সেটা একটা ব্যাপার।

    এবারে স্যার তার দিকে তাকান।

    - 'তোমরাই তো এসব কর, তাই না? তোমাদের লোজ্জা করেনি? নতুন ভর্তি হইছে, প্রথম দিনেই কি ভাবতিছে বল তো। স্কুলটা নিজের ভাবতে পারলে না তোমরা। এতদিনের এত নামের স্কুল...'

    সে মনে মনে তারিফ করে স্যারের। এতবছর ছাত্র চরিয়ে পুরো ঘুঘু একেবারে। এই ভাবে চললে কালকের মধ্যেই তার সাইকেলের দুর্দশা কে করেছে বেরিয়ে যাবে।

    কিন্তু মুখে তো তা বলা যায় না, সে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, 'না স্যার আমি সত্যি জানিনা। আমার সাইকেলেও পাম নেই। আজকেই প্রথম দেখছি। আমি রিপোর্ট করব ভাবছিলাম', মিথ্যে কথাটা বেমালুম বলতে কোথায় বাধে তার, তবুও রিপোর্টের কথাটা তার মোক্ষম লেগেছে। না:, মেয়েটার হেডে মাথা আছে তো! কেমন গুছিয়ে দুম করে বলে দিলো।

    'হুঁ, ব্যবস্থা করতিছি। ছেলে মেয়ের সাইকেল রুম এক কেন? আলাদা করতে হবে। আর এইসব বাঁদরামি কে করতিছে জানতে পারলে আমাকে খবর দিবে।'

    যা: শালা, সাইকেল রুম আলাদা করে দেবে? শেষমেষ এই দাঁড়াল ব্যাপারটা? সে মনে মনে একটা খিস্তি মারল।

    তবে স্যারের কথা তখনো শেষ হয়নি, স্যার তার পদবী ধরে ডাকলেন, 'তুমি একে মোড়ের কাছে কোন একটা সাইকেল দোকান দেখিয়ে দিও'।

    ********************

    তারা দুজন তাদের সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে চলেছে সিনেমা মোড়ের দিকে। চলার তালে তালে তাদের সামনে তাদের লম্বা ছায়া নির্দ্বিধায় একে অন্যের সঙ্গে মিশে যায় বারবার।

    তাদের স্কুলের থেকে সিনেমা মোড়ের দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটা 'শু ইউনিভার্সিটি'-র সামনে অবধি একটানা এসেছে। এই পথের ডানদিকে গড়ের পরিখা সমানে চলেছে রাস্তার পাশাপাশি। পিচে বাঁধানো এই রাস্তা। ছোট্ট মফস্বল শহরের ব্যস্ততমও বোধহয়। এই ভরা দুপুরেও মেলা লোক ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। বেশির ভাগই কলেজ স্টুডেন্ট। তাদের স্কুল ছাড়িয়ে একটু এগোলেই ডানদিকে একটা মস্তবড় দীঘি পড়ে। কলেজ দীঘি। সেই দীঘির পরেই স্থানীয় কলেজ। কলেজের কিছু কিছু ছেলেমেয়েদের দুপুরে ওদিকের বাঁধানো প্রশস্ত ঘাটটাতে বসে থাকতে দেখা যায়। কলেজের পাশে, গেটের মুখটা সবসময়েই গমগম করে রকেফেলারদের গুলতানিতে। সেইখানে তাদের একসঙ্গে হাঁটতে দেখে কে একজন হেঁকে বললো 'নিচে পান কি দুকান, উপর গোরি কা মকান!' তার পাশ থেকে 'ফাটাও বিষ্টু, সামনে হরিপদ, পেছনে গাড্ডা।' (এর বহু বছর পরে 'ফাটাও বিষ্টু, ফোটাও ফুল' যখন একটি রাজনৈতিক দলের স্লোগান হিসেবে শোনে সে, প্রাণখুলে হেসেছিলো)।

    এই সব সহজিয়া ইঙ্গিতধর্মী আওয়াজ সে নিজেও আগে দিয়েছে। দলে থাকলে সব্বাই দেয়। ধুমকি থাকলে আরো উল্টোপাল্টা কথাও হয়। সে একটু ইতস্তত করে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেওয়া টাইপ কিছুই করছে না, বরং চোখ বড় বড় করে মুখ তুলে লোকজন দেখতে দেখতে এগোচ্ছে। জায়গাটাকে চিনে নিচ্ছে। সেটা তার কেন জানি বেশ পছন্দ হলো। এই মেয়েটার মধ্যে বেশ স্পোর্টিং অ্যাটিচুড আছে। আওয়াজ দেওয়া লোকজন অভ্যস্ত আচরণ না পেয়ে যেন একটু মুষড়েই পড়ল।

    - 'এমা ছি ছি কি বলতে কি বলে ফেলেছিলাম তখন! ইস্‌স্‌স! এরকম বলা উচিৎ হয়নি আমার।' একটু এগিয়ে এসে মেয়েটি জিভ কাটে। তারপর একটু থেমে যোগ করে,
    - 'তুমি কি রাগ করলে? ভুল হয়ে গেছে, আর এরকম বলব না। এটা তো এখন আমারও স্কুল।'
    সে কি বলবে না বুঝতে পেরে চুপ থাকে। মনের কাল্পনিক আয়নায় সে দেখে তার মুখটা হাঁড়ির মত লাগছে। তার বোধহয় মনের ভাব লুকোবার ক্ষমতা কম। অথবা এও হতে পারে, এই রকম চোখেমুখে কথাবলা মেয়ের কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে রাখার শক্তি নিয়ে সে পৃথিবীতে আসেনি। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, তার মেজাজটা রীতিমত বিগড়ে গেছে এবং সেটা খুব নগ্ন ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। আবার এই যে মেয়েটা তার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে, এই ব্যাপারটা তার বেশ ভালোও লাগছে, সেটাও কি প্রকাশ পাচ্ছে? এ এক অদ্ভুত দোলাচল।

    -'যা হবার হয়েছে, আগে সাইকেল সারাতে হবে, নইলে ফিরতেই পারবো না।'

    সে অস্পষ্ট বিড় বিড় করে 'হুঁ তাইতো'।

    রাস্তাটা ধরে আর একটু এগোলে ডানদিকে একটা বইয়ের দোকান, বাঁদিকে এনসিসির স্থানীয় কার্যালয়। এরপরেই রাস্তাটা ডানদিকে মোক্ষম একটা মোচড় মেরে বেঁকে গেছে। এই বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে গড়ের পরিখার ওপাশে তাকালে গাছগাছালির ফাঁকে পুরনো রাজবাড়ি আর তার বাইরের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের অংশ বিশেষ চোখে পড়ে। তার কেমন একটা অভ্যেস আছে, সাধারণত অন্যদিকে হুশ করে জোরে সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে যাবার সময়েও সে একঝলক দেখে নেয়।

    আজকেও হয়ত দেখত, কিন্তু এই সময়েই মেয়েটি বলে উঠলো, 'ঐতো সাইকেল দোকান!'।

    কোন সাইকেল দোকানের কথা বললো সে জানে। ঐ সাইকেল দোকানে সে যাবে না। তার একটা ইতিহাস আছে। এই দোকানদার বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে উলটোপালটা ঝামেলা করেছে। কেন করেছে, তার ইতিহাস আরো লম্বা। সেটা এখন বলার সময় নয়।

    -'এই দোকানটায় আমি যাই না। তুই যদি এখানে সাইকেল ঠিক করিয়ে নিতে চাস, করে নে। আমি আরেকটা চেনা দোকানে যাবো।'

    মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়ে। এক পলক ঠোঁট কামড়ে ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করে। তারপর মুখে একটু হাসি টেনে এনে ,মাথা নেড়ে বলে 'না তোমার সঙ্গেই যাবো। চলো কোথায় যাবে। খুব দূরে কি?'

    অনেক উঁচুতে রাজবাড়ির পোষা একঝাঁক পায়রা অর্ধচন্দ্রাকৃতি কক্ষপথে তাদের ঠিক মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। তাদের সমবেত ডানা ঝাপটানোর শব্দ যেন শোনা যায় নিচে। ফ্লাইট অফ ফ্যান্সি।

    তার মনটা ভালো হয়ে গেল। সেই হাসি যেন তার মধ্যেও সংক্রামিত হয়। সে একটু হাসল, হালকা মনে।

    মেয়েটা মাথা হেলিয়ে তার হাসিটা দেখল। এক চোখ ভর্তি কৌতুক নিয়ে বলল, 'যাক, রাগ পড়লো এতক্ষণে! নতুন স্কুলে তুমি আমার প্রথম বন্ধু হলে তাহলে।'

    -'বন্ধু?' একটু থমকে যায় সে, এক ক্লাস সিনিয়র এই ব্যাপারটায় জোর দেবে কিনা ভাবে, তারপর বলে 'ঠিক আছে, আমার কোন মেয়ে বন্ধু নেই', আরেকটু থেমে বলে, 'মানে, ছিলো না, হলো।', মোড় এসে গেছে, সে বাঁ দিকে সাইকেলের হ্যান্ডেল ঘোরায়, 'ঐদিকে যেতে হবে এবারে। সামনেই সাইকেল দোকান।', একটু থেমে বলবে কি বলবে না দোনোমোনো করে বলেই ফেলে, 'আর তার পাশেই আমাদের এখানকার বিখ্যাত চপের দোকানগুলো। যাবি?'।
  • Shibanshu | 59.93.86.113 | ০৮ নভেম্বর ২০১১ ১৮:২২491142
  • বেশ ফ্লো এসেছে। চরৈবেতি....
  • p jogai | 202.75.200.19 | ০৮ নভেম্বর ২০১১ ১৯:৪৬491144
  • তরতরিয়ে এগোচ্ছে. চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি
  • Nina | 12.149.39.84 | ০৯ নভেম্বর ২০১১ ০০:০৪491145
  • চলুক চলুক---সঙ্গে আছি
  • Sankha | 71.187.134.116 | ১৪ নভেম্বর ২০১১ ১০:০২491146
  • (৬) ইয়েলো ব্রিক রোড
    *************

    'কুড়িকিলো' তার নামটা পেয়েছে তার কাছের বন্ধুদের থেকেই। খেলার মাঠে ঈষৎ অপটুদের কপালে যে অবহেলা বা লাঞ্ছনা যুগে যুগে সম্ভবামি, সে তার সীমা অনেকটাই ছাড়িয়ে গেছে। ফুটবল মাঠে লোকজন তাকে গোলে রাখতেও ভয় পায়। ব্যাকে যে খেলবে তাকে বলা হয়, মনে রাখবি তোর পেছনে আছে শুধু গোলপোস্ট। তাকে শুনিয়েই। ব্যাক চেঞ্জ হলে পুরনো ব্যাকি নতুন জনকেও একই কথা আবার শোনায়।

    ক্রিকেটে বাউন্ডারী লাইনের এমন কোন জায়গায় তাকে পাঠানো হয়, সেখানে বল পাঠাতে পারলে সেই ব্যাটসম্যানকে অন্তত বার দু-তিনেক বল কেনার চাঁদা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।

    এই সব নিয়ে কুড়িকিলোর বর্ণময় জীবন।

    এত গন্ডগোলের মূলে আছে তার পৃথুল পশ্চাদ্দেশ। জীনসের টাইট প্যান্ট তাকে মানায় না। কোন কারণে দৌড়াতে হলে এমন হাস্যকর ভাবে তার পেছন আন্দোলিত হয়, সে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ক্লাস এইটের পর থেকেই তার খেলার মাঠের নির্মম বন্ধুরা নাম রেখেছে 'কুড়িকিলো'। এই সব নাম চাউর হতে বেশি সময় লাগে না। খুব জলদি স্কুল আর টিউশনির টিচাররা ছাড়া প্রায় সবাই তাকে কুড়িকিলো, বা সংক্ষেপে কেকে বলে ডাকে।

    কুড়িকিলো তার খেলার মাঠের খামতি পুষিয়ে দেয় পরীক্ষার নাম্বার দিয়ে। তার ক্লাসমেটরা বলে, তোর কি 'ওখানেও' কিছুটা ব্রেন আছে? মুখে একটা নিপাট ভালোমানুষের হাসি ঝুলিয়ে রাখলেও তাকে যারা কাছ থেকে চেনে, পারলে একটু অ্যাভয়েডই করে, কেননা মুখের হাসির কোন ছায়া সচরাচর তার চোখে প্রতিফলিত হয় না।

    কুড়িকিলো এখন ইলেভেনে উঠেছে। সেও এই স্কুলেরই ছাত্র। স্কুলের পরিচালন কমিটিতে তার বাবা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার সুবাদে সব শিক্ষকরাই তাকে চেনেন, একটু সমঝেই চলেন।

    কুড়িকিলোকে নিয়ে এই সমস্ত কথাগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে প্রসেস করে সামনে তুলে ধরতে তার ব্রেন সেকেন্ডের কত ভগ্নাংশ ব্যবহার করেছে সে জানে না, কিন্তু সেই থেকেই তার ভুরুটা যে কুঁচকে আছে, সেটা যে নিছকই এই সকালের সত্তর ডিগ্রি কোণে উঠে বসা সূর্যের কারণে হয়নি, বুঝতে তার বিলকুল অসুবিধে হচ্ছে না।

    আলাদা করে দহরম-মহরম না থাকলেও, একই অঞ্চলের বাসিন্দা হবার আর এক ক্লাসে না হলেও এক স্কুলে পড়ার সুবাদে এর-ওর-তার প্রচুর তথ্য আপনাআপনিই কেমন করে চলে আসে, জমে থাকে স্মৃতির চোরকুঠুরিতে, সময় মত অচিন কোন জাদুকর যেন সেগুলো ধুলো ঝেড়ে-মুছে সামনে ধরে। এবং সেটা হতে থাকে এমন সব অসময়ে, যখন চেতনার একটা অংশ প্রাণপণে অন্যকিছু নিয়ে ভাবতে চাইছে।

    সিনেমা মোড় থেকে ইলেকট্রিক অফিস আসার আঞ্চলিক বড় রাস্তা ধরে কুড়িকিলো যার সঙ্গে খুব হাতপা নেড়ে কথা বলতে বলতে এইদিকেই আসছে, ইদানিং তার চিবুকের তিলটা চোখের সামনে ভাসিয়ে প্রতিদিন তার ঘুম আসে। সব বারেই তার দ্বিধাগ্রস্ত আঙ্গুল বা ঠোঁট সেই তিল ছোঁবার ছোট্ট অনন্ত দূরত্বটুকু পেরোনোর আগেই ভেন্টিলেটর বা জানালার ফাঁক দিয়ে আসা আলো বা অ্যালার্মের যান্ত্রিক শব্দ কসাইয়ের মত এককোপে তার চোখ থেকে ঘুমের সন্ধি আলাদা করে দেয়। শুয়ে থাকার ঘোর কেটে যায় তার মন থেকে, অতৃপ্তিতে জেগে ওঠা শরীরের মতই।

    কুড়িকিলো সেই মেয়েটির সঙ্গে দিব্যি ভাব জমিয়ে নিয়েছে। মেয়েটির পরণে খুব উঙ্কÄল একট ময়ূরকন্ঠি রঙের পোষাক আর ওপরে সাদা ওড়না, সকালের আলোতে ঝক ঝক করছে, দুজনে মিলে সেই নবীনবরণের দিনে তারা যেমন একসঙ্গে ফিরেছিলো, সেইভাবেই পাশাপাশি সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে ফিরছে, শুধু এই সুন্দর ছবিটিতে তার কোন স্থান নেই।

    কিন্তু এমনতো হবার কথা ছিলো না। এই ছবিটাই সে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বিমূর্ত ভাবে সাজিয়ে চলেছে, যখন আগের সপ্তাহে আচমকাই তার বাবার সঙ্গে বাজার করে এক ভ্যানে করে ফেরার সময় তাদের একটু আগে সাইকেলে করে এই মেয়েটিকে বইয়ের ব্যাগ সমেত, কোথাও একটা থেকে ফিরতে দেখে সে সযত্নে মনে মনে সময়টা নোট করে নিয়েছিলো। এইতো দেখা করার আদর্শ সুযোগ। রাস্তায় কি লোকের আচমকা দেখা হতে পারে না? আর দেখা হয়ে গেলে এক দুটো কথা বলতে বলতে কি তারা একসঙ্গে কিছুক্ষণ কাটাতে পারে না? হ্যাঁ, মুখোমুখি এসে দুরকম ভান করা যেতে পারে, এক হল, ঘ্যামসে, যেন দেখতেই পাইনি, এই রকম ভাবে আস্তে আস্তে সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে যাওয়া, ও-ই দেখতে পেয়ে ডাকুক না। তখন ঘুরে তাকালেই হবে।

    না, খর্চা আছে মামা। ব্যাপারটা সেরকম না হলে চাপ হয়ে যাবে, তারচেয়ে প্ল্যান বি খেলা অনেক সেফ, দূর থেকে দেখতে পেয়ে একগাল হাসি নিয়ে 'আরে, তুই? কোথাও পড়তে গেছলি নাকি?' টাইপ একটু অভিনয়। বুক বলছে প্ল্যান এ, মাথা বলছে প্ল্যান বি। কি জ্বালা!

    কিন্তু কোন প্ল্যান সি তো সে ভাবেনি, তাই এই রকম একটা মুহূর্তের মোকাবিলা কিভাবে করা যায়, সে ব্যাপারে বুক আর মাথা দুজনেই খুব চুপচাপ। কুড়িকিলো কেন, মেয়েটির সঙ্গে আদৌ যে কেউ থাকতে পারে, সেটা সে ভেবেই দেখেনি।

    কথা বলতে বলতে ওরা অনেকটাই এগিয়ে এসেছে, দূরত্ব এখনো বেশ কিছুটাই, কিন্তু তার এইভাবে বেকুবের মত রাস্তার পাশে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না।

    এই দিকে একটা গলি বেরিয়ে গেছে, যার মুখে সে দাঁড়িয়েছিলো। দেরি না করে সে গলিটাতেই চটপট ঢুকে পড়লো। রাংচিতা আর ভেরেন্ডা গাছের বেড়া দুপাশে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া গলিটাতে ঢুকতেই একরাশ মনখারাপ তাকে মুড়ে নিলো।

    সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হবার সুবাদে ইলেভেনে সেই মেয়েটি আর কুড়িকিলো একই সঙ্গে পড়ে সে জানত। অতএব তাদের এক ব্যাচে পড়তে যাওয়া বা ফেরা খুব স্বাভাবিক, সে কি আর জানে না? কিন্তু আজকে দুজনকে একসঙ্গে আসতে দেখে সে অনুভব করলো হঠাৎ করে তার খুব একলা লাগছে। ডুবন্ত মানুষের মত একলা। অসহায়।

    এই রকম অনুভূতি তার আগে একবার হয়েছিলো, সেইটে কোনভাবে তার সঙ্কÄ¡য় গেঁথে গেছে। কয়েকজন বন্ধু মিলে তারা ভরা বর্ষায় কলেজ দীঘিতে সাঁতার কাটতে গেছলো। সে দীঘি তখন উপছানো যৌবন নিয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের পানে। ছোটবেলার অভ্যেসমত ডুব সাঁতার দিয়ে সে ঘোলাটে সবুজ জলের মধ্যে ওপর থেকে চুঁইয়ে আসা আলোর স্তর দেখছিলো, জলের মধ্যে কথা বললে কেমন দুর্বোধ্য শোনায় তাই শুনছিলো। ডোবা আর ভাসা। আবার ডোবা। একবুক দম নিয়ে।

    এইভাবে কতটা সময় কেটে গেছে, সে হুঁশ তার ছিলো না। হঠাৎ একসময় সম্বিৎ ফিরে পেতে সে দেখে তার ধারে কাছে কেউ আর নেই, তার বন্ধুরা অনেকদূরে পাড় থেকে তাকে চেঁচিয়ে ডাকছে।

    তার ভয় হয়েছিলো, খুব ভয়, এই মস্ত বড় জলের পরিসীমায় সে একা, জলের লেভেলে চোখ রেখে তার মনে হয় সে যেন এক বিশাল নদীতে এসে পড়েছে, নিচে অস্থির ভাবে ছুঁড়ে চলা পায়ে আটকায় না কোন স্থলজমি, চারদিকে শুধু গাঢ় কালচে সবুজ জল থই থই করছে।

    আজকেও তার মনে হয় সে যেন সেই রকম জলের মধ্যে এসে পড়েছে। কালচে সবুজ জলে তার আলোয় ভরা সকালটা একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে। দু একবার খানাখন্দে পড়ে তার সাইকেল লাফিয়ে উঠলো। একটা খোলা জায়গায় এসে সে সাইকেল থেকে নেমে হাঁফাতে থাকে। আশাভঙ্গ বলেই হয়ত একটু দিশেহারা লাগছে, কি করবে কিছু খুঁজে পায় না।

    - 'কিরে তুই এখানে কি করছিস? টিউশনি নেই?'

    আচমকাই কথাটা একটা চেনা কন্ঠস্বর থেকে শুনতে পেয়ে সে এতটাই চমকে উঠল যে আরেকটু হলে সাইকেলটাই তার হাত থেকে পড়ে যেত।

    একবছর আগে এই গলাটা শুনবে বলেই যেন তার সকাল হত হলুদবাটা রঙ নিয়ে। সে স্কুলে যেত একেবারে বাঁদিকের সিটের দখল পাবার প্রত্যাশা নিয়ে। নিজের নোটখাতা বানাত নিজের জন্যে নয়, কারুর কাছ থেকে স্রেফ একদুটো প্রশংসাসূচক অব্যয় শোনার তাগিদে।

    সেই সে। তার প্রথম মানসী।

    একবছর একসঙ্গে পড়ার সুবাদে আর তার প্রিয় বন্ধুর বান্ধবী হবার সুবাদে তাদের মধ্যে এখন ভালই আলাপ। কয়েকটা টিউশনিতেই তারা তিনজন একসঙ্গে পড়তে যায়। টুকটাক কথাও হয়। via তার বন্ধু।

    সময় সব ভুলিয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু কখনো কখনো বিশ্বাসঘাতকতাও করে বৈকি। আজকের এইরকম একটা ভালনারেবল সময়; একটু কি কোথাও আজো না শুকোনো কাটা ঘা থেকে চোঁয়ায় স্মৃতির বিষ? একটা ধুলো আর রাবিশে জমা পাথরের বেদীর পাশে কি বহুদিনের চুপ করে থাকা ঘন্টা পলকা বাতাসে মৃদুমন্দ বাজতে থাকে?

    একটু জোর করেই সে মুখে নিয়ে আসে একচিলতে হাসি, 'এই তো। আরেকজন কোথায়? তুই একা ফিরছিস?'

    কথাগুলো যাকে বলা, সে মুখ টিপে হাসে, 'আমার আগে তো তোরা বেশি বন্ধু। আমি তো বাইরের লোক', হাসিটা চওড়া হয়, 'সে বাবু আজকে আগে বেরিয়ে গেছে। বাড়ির কি কাজ আছে বললো', তারপর একটু গলা নামিয়ে, 'হ্যাঁরে, নতুন ক্লাসের কারুর সঙ্গে প্রেম করছে নাকি বলতো? তোরা তো ওর কাছের লোক, নিশ্চয়ই খবরটবর রাখিস'। তার মিটি মিটি হাসি যেন থামেই না।

    সে স্থির চোখে তাকিয়েছিল। তার ভেতরে ভেতরে জন্ম নিচ্ছিলো বাষ্প, সেই বাষ্প জমে তৈরি হয় টলটলে এক বিন্দু স্বচ্ছ জল, শুক্তির মধ্যে মুক্তোর মত সে জল খুব দামী, তাই সে ধরে রাখলো সেই জল, শুধু একটা অতিরিক্ত ভার যেন জমা হল কোথাও।

    - 'হ্যাঁহ, তোকে বলে দিই আর আর তারপর আমার বন্ধুর ক্যালানি খাই আর কি?' সে একটু রহস্যের ভান করে, নিজের সঙ্গে তার যুদ্ধ চলতেই থাকে।

    - 'ওও বুঝেছি, তারমানে ব্যাপার ভালোই এগিয়েছে। আচ্ছা! তোরা ছেলেরা...'

    - 'ছেলেরা বিশ্বাসী, খুব ভালো আর উপকারী। সবাই জানে, আর বলতে কি...', মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো, মুক্তোর আংটি ঝলসিয়ে একটা পাতলা হাত প্রায় তার মুখের কাছে উঠে আসায় সে থতমত খেয়ে চুপ করে যায়।

    -'ওরে থামরে, থাম, এতো বেশি নিজেদের ঢাক পেটাস না, ভূতের মত সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লেকচার মারলে দেখবি একদিন তলায় শেকড় গজিয়ে গেছে।' একটু থেমে আসল কথাটা বলে দেয়, 'আমাকে মোড় অবধি নিয়ে যাবি? আসতে আসতে জুতোর ফিতেটা কেটে গেল রে।' তার গলার স্বরটা একটু ক্লান্ত শোনায়।

    সে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখল সত্যিই তাই। ডানপায়ের পাটির বুড়ো আঙ্গুল আর অন্য আঙ্গুল গুলোর মাঝখানে সরু স্ট্র্যাপটা ছিঁড়ে গেছে, সেই স্ট্র্যাপ একটু পেছনে গিয়ে দুদিকে ভাগ হয়ে গোড়ালির দুপাশে লেগে আছে, লটরপটর করছে। তার মানে এই এতটা রাস্তা ও পা টানতে টানতে এসেছে, কেননা পা তুললেই জুতোর তলাটা নিচে নেমে যাবে, জুতো খুলে যাবে পা থেকে।

    সাইকেলের ক্যারিয়ার থেকে নোটের খাতাটা খুলে বের করে তুলে ধরল সে, 'এটা একটু ধরে বোস। পা টা তুলে রাখিস। আমি আস্তে আস্তে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি', সে নিজে সিটে চেপে তার ক্যারিয়ারে বসা অবধি অপেক্ষা করল, যখন বুঝল সব রেডি, প্যাডল শুরু করেও থেমে গিয়ে সামান্য পেছনে ঝুঁকল, 'পরশুদিন বিকেলে কেমিস্ট্রির টিউশনির পর ঘুঘনি-মুড়ি আর চপ, মনে থাকবে তো?'

    'তোর না এই সেদিন জন্ডিস হয়েছিলো, ঘুঘনি খেতে লজ্জা করে না ..'

    বার্গেনিংটা জমে উঠেছিলো, তার মুখ থেকে অজান্তেই ভাঁজগুলো মিলিয়ে যাচ্ছিলো, মেয়েরা একদিকে পা ঝুলিয়ে বসে বলে ব্যালান্সের একটু অসুবিধে হয়, সেটাও খেয়াল রাখতে হচ্ছে। মোরাম রাস্তার ওপরে মাঝে মধ্যে ইঁট দাঁত বের করে হাসছে, কখনো মোরাম চটে গিয়ে কুকুরের ঘায়ের মত মাটি কাদা বের করা অংশ জেগে অছে, এই সব এড়িয়ে সাবধানে সাইকেল চালাচ্ছে সে, যাতে হঠাৎ ঝাঁকুনি না লাগে।

    এত কিছু করা সঙ্কেÄও তার নিজের জন্যই একটা বড় ঝাঁকুনি যে অপেক্ষা করছিল, সে ঘুণাক্ষরেও বোঝেনি। গলি থেকে একটু বেঁকে রাস্তাটা পিচের রাস্তায় মিশে গেছে, জায়গাটা একটু ঢালু হয়ে উঁচু বলে ডবল রাইডে অল্প চাপের, নিয়মমত সে একবার বেল দিলো, ওদিক থেকে বেল নেই মানে রাস্তা ক্লিয়ার, নিশ্চিন্ত হয়ে সে প্যাডলে পা দাবালো, টাল সামলাতে ক্যারিয়ার থেকে অন্যজন হাত তুলে তার জামা খামচে ধরল, আর বেশ ভালো গতিবেগ নিয়ে সে এক দুহাতের মধ্যে একটা সাইকেলের সামনে দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল। সাইকেলের আরোহী একটু যেন চমকেই মুখ তুলে চাইলো, আর চোখাচোখি না হলেও ময়ূরকন্ঠি নীল তার চোখ আবার ঝলসে দিলো।

    এ এখানে কি করছে?

    কুড়িকিলো কে ত্রিসীমানায় কোথাও দেখা যাচ্ছে না, সে মালটা গেল কোথায়?

    আর কদিন আগে বলা 'আমার কোন মেয়ে বন্ধু নেই' এই কথাটাই বা তার মাথার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কেন?

    বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠেছিলো তার, কেউ কোন জবাবদিহি চায়নি, তবু তার কোথাও একটা মনে হল সে কাউকে যেন ঠকাচ্ছে।

    হয়ত নিজেকেই।

    মোড়ের মুখে এসে মাথায় আচমকা ঠপাৎ করে একটা মিঠেকড়া আঘাত খেয়ে তার চটক ভাঙ্গলো। পেছনে বসে থাকা সওয়ারির হাতে সে নিজের নোটের খাতাটা ধরতে দিয়েছিলো, সেইটাকেই রোল করে পাকিয়ে সওয়ারি তার মাথায় এক ঘা জমিয়েছে। সে ক্যাঁচ করে ব্রেক মারে।

    পেছনের জন তখন রীতিমত তড়পাচ্ছে, 'আরে, তোকে কি পেঁচোয় পেয়েছে? তখন থেকে থামতে বলছি, কথা কানে যায় না? দিই আরেক ঘা?'

    -'মেরি বিল্লি মুঝসে মিঁয়াও?'

    -'বিল্লি কোত্থেকে এলো? আমাকে বলছিস?'

    -'আমার নোটের খাতা দিয়ে আমাকেই পেটাচ্ছিস? এতটা পথ ক্যারি করে আনলাম...'

    -'না পেটাবে না, তাহলে সাইকেল থেকে ঠেলে ফেলে দেবো?

    -'এই জন্য বাইবেলে বলেছে কদাচ উট এবং স্ত্রীলোকের সাহায্য করিবে না। ইহারা তোমার তাঁবু এবং সাইকেলে আসিয়া তোমাকেই উৎখাত করিবে। চেল্লাচ্ছিস কেন?'

    -'ভ্যাট, ওটা তো সেই আরবের গল্প। বাইবেল কেন হবে? আর তোকে যে তখন থেকে বলছি থামতে, মুচি দোকান পেরিয়ে গেল, জুতোটা সারিয়ে নিতাম।'

    -'ও হ্যাঁ হ্যাঁ, চল আবার নিয়ে যাচ্ছি।'

    -'তুই হঠাৎ থম মেরে গেলি কেন? বেশ তো বোল ফুটছিলো?'

    মুচির দোকানটা মোড়ে ঢোকার একটু আগেই পড়ে। ছোট্ট একখুপরি একটা ঘরের মধ্যে বুড়ো মুচি দোকান সামলায়। মাঝে মাঝে গোমড়া মুখ করে তার জোয়ান ছেলেও বসে দোকানে, তবে তার গরম মেজাজ আর পরিপাট্যহীন কাজের জন্য লোকজন তার বাপকেই বেশি খোঁজে। আজকে দোকানে বুড়োই বসে আছে। লোহার বেঁটে তিনমাথাওলা নেহাইয়ের ওপরে একটা স্যান্ডেলের পিন পিটিয়ে পিটিয়ে চৌরশ করছিলো একমনে। তাদের দেখে কাজ থামিয়ে একগাল হাসে, পানের ছোপ লাগা দাঁত বের করে। মুখে 'কি হইছে?' বলেও একঝলক পায়ের দিকে তাকিয়েই অভিজ্ঞ ডাক্তারের মত বুঝে যায় সমস্যা। সে যতক্ষণে জুতো সারিয়ে দেবে, ততক্ষণ পরে থাকার জন্য পাশ থেকে একজোড়া বড় চপ্পল বের করে মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দেয়।

    সে একটু সরে এসে ফেলে আসা পথের দিকে তাকালো। যতদূর নজর যায়। একটা ভ্যাপসা গরম ছাড়ছে চারদিকে, দূরে পিচের রাস্তা চকচক করে ওঠে, দু একজন লোক কুঁজো হয়ে হাঁটছে, একটা ভ্যান আসছে ভর্তি সওয়ারি নিয়ে ঐ দিক থেকে, রাস্তার পাশে একটা ঝোপের সামনে পেছনের পা তুলে একটা কুকুরও সে দেখতে পেল। যাকে খুঁজছিলো, শুধু সেই নেই এই দৃশ্যপটে। দেখতে দেখতেই একটা আঞ্চলিক বাস তীব্র হর্ণ দিতে দিতে তার পাশ থেকে বেরিয়ে সেদিকে চলে গেল। বাসের খোলা ছাদে একটা বাচ্চা বসেছিলো, তাকে তাকাতে দেখে মুখ ভ্যাঙ্গালো।

    দীর্ঘশ্বাস মেশানো একটা হাসি দিয়ে সে মুখ ঘুরিয়ে মোড়ের দিকে তাকাল। বেলা গড়ানোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হট্টগোলের মাত্রা। এক একটা বাস এসে দাঁড়ালেই রিকশাওলাদের মধ্যে ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে যাচ্ছে যাত্রী তুলবার। যারা বাসে উঠবে, তাদের ঊর্ধতন চতুর্দশ পুরুষের জিনের মধ্যে ভদ্রভাবে লাইনে দাঁড়ানোর জন্য কোন নিউক্লিক অ্যাসিড সাজানো ছিলো না, সুতরাং এই বংশানুক্রমিক খামতিতে বিন্দুমাত্র লজ্জিত না হয়ে সকলেই কনুই আর নোংরা ভর্তি জুতোর সদ্ব্যবহার করে একে তাকে গুঁতিয়ে যেমন পারছে বাসে ওঠার চেষ্টা করছে। যারা নামবে তারাও উপায়ন্তর নেই বুঝে ক্রমাগত কমবয়েসি বাছুরের মত এদিক ওদিকে চাঁট মারতে মারতে হুড়মুড়িয়ে নিচে নামছে। যে যাকে পারছে শাপশাপান্ত করছে, মুখখিস্তি করছে। এত কিছুর পাশে জার ভর্তি লেবু আর টকঝাল লজেন্স, খবরের কাগজ আর নিয়মিত ম্যাগাজিন, সোলার বাক্সে রঙবেরঙের ফ্রোজেন 'পেপসি'র সরু লম্বা প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট, ডুমুর দিয়ে বানানো কালচে শুকনো 'আমলকি' ইত্যাদি নিয়ে হকারেরা জানালায় জানালায় ঘুরে বিক্রির চেষ্টা চালাচ্ছে।

    রাস্তার পাশে একমনে এই ছবিটা দেখছিলো সে, মনটা এখনো উথালপাথাল হয়ে আছে, খেয়াল না করে সরতে সরতে সে হয়ত একটু একটু করে রাস্তায় উঠে পড়ছিলো, আচমকাই বোঁ করে প্রায় ঘাড়ের পাশে দিয়ে একটা স্কুটার বেরিয়ে গেল, আরেকটু হলেই তার সঙ্গে ধাক্কা লাগত, স্কুটার আরোহী এত স্পীডের মধ্যেও ঘাড় বেঁকিয়ে তাকে লক্ষ্য করে 'বেজন্মার বাচ্চা' বলে চিল্লিয়ে উঠলো। ঘৃণা ভরে সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে জুতোর দোকানের দিকে তাকাতেই দেখল তার ডাক পড়েছে।

    -'তোর আক্কেলটা কি বলতো? মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করছিস? আরেকটু হলেই চাপা পড়তিস তো?'

    এত তীক্ষ্ণ গলায় মেয়েটি বলে উঠলো যে বুড়ো পর্যন্ত একবার মুখ তুলে চাইলো। সে একটু বিব্রত হল। দু পা হেঁটে এসে তার সাইকেলের বাঁকানো হ্যান্ডেলে হাত রাখলো মেয়েটি, হয়ত বুড়োর শোনার গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই।

    -'তোর কিছু একটা হয়েছে। কি সেটা?'

    -'আরে ধ্যুস!'

    -'আমি বলবো?' মেয়েটির গলাতে এমন একটা কিছু ছিল যে ধক করে ওঠে তার ভেতরটা, পাগুলো যেন মোমের তৈরি মনে হয়, একটু বসতে পারলে ভালো লাগত। জাল গুটিয়ে আসছে ক্রমে ক্রমে।

    সে উত্তর, অনুমতি কিছু না আউড়ে শুধু তাকিয়েই থাকলো, আর যেন পালানোর জায়গা নেই, চারদিক মোড়া আয়নার সামনে হা-উলঙ্গ সে। তার মুখের ওপরে মণি স্থির নিবদ্ধ করল সেই মেয়ে, 'তার আগে তুই বলতো, একটু আগে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওই মেয়েটা কে?'
  • Sankha | 71.187.137.148 | ২৭ ডিসেম্বর ২০১১ ১০:০০491147
  • এবারে একমাসেরও বেশি গ্যাপ। এই সময়টায় অনেক ঝড় ঝাপটা গেছে। তবুও লেখার ভূত মাথা থেকে নামে না। কুড়িয়ে বাড়িয়ে একটু সময় পেলেই লিখি। এই সব করে, একটু বেশি সময় নিয়ে বেশ বড়-সড় আকারেই এলো এবারের পর্বটি। ভেবেছিলুম দুটো অংশে ভেঙ্গে দেবো। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো তেমন কিছু করতে আর ইচ্ছে নেই। থাক। পুরোটাই থাক।
  • Sankha | 71.187.137.148 | ২৭ ডিসেম্বর ২০১১ ১০:০৫491148
  • পর্ব ৭: বিটারসুইট সিম্ফনি
    ***************

    অ্যালেগ্রো
    ---------

    অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছিলো সে। ঠান্ডা তীক্ষ্ণ জলের ফোঁটাগুলো তার মুখের খোলা জমিতে একটানা যেন সন্তুরের মেজরাবের মত আছড়ে আছড়ে পড়ছিলো, তারপর তার জুলফি, কানের লতি বেয়ে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছিলো।
    আকাশের রঙ দেখার একটা প্রবল তাড়নায় সে চোখ খুলতে চাইছিলো বারবার, কিন্তু এই বৃষ্টির মধ্যে চোখ খুলে রাখার কোন ক্ষমতা তার নেই বলে তার সমস্ত ইন্দ্রিয় কেন্দ্রীভূত হয়ে আসছে নেমে আসা এক অক্ষৌহিণী বৃষ্টিরেখার একটানা ঝুম ঝুম শব্দে। অদ্ভুত মাদকতাময় সে শব্দ, সেই জলে ভেজার শিহরণ, থেকে থেকে খুব মিহি একটা বাতাসে সে কেঁপে কেঁপে উঠছিল, চরাচর ঝলসে দেওয়া একেকটা বজ্রপাতের নীল আগুন তার বন্ধ চোখের মধ্যেও হানা দিচ্ছিলো বারবার।

    তার নাম ধরে কেউ ডাকছিলো, থেমে থেমে, অনেক দূর থেকে কেউ যেন তাকে উদ্দেশ্য করে চ্যাঁচাচ্ছিলো, তার ইচ্ছে করে সাড়া দিতে, কিন্তু কি এক অপরিসীম ক্লান্তি তাকে ঢেকে রেখেছে, সে নিজের কুহরে গুটিয়ে যায়।

    কেউ দ্রুত এসে পাশে দাঁড়ালো, আর তার মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়লো, দেখতে না পেলেও পায়ের ছপ ছপ জল ছেটানোর শব্দ আর চোখের পাতার ওপরে ঘনিয়ে ওঠা ছায়া তাকে বলে দিল এই সব কথা।

    একটা জলে ভেজা হাত তার ফুলে ওঠা চোখের নিচের হাড়ের ওপরে পড়তেই সে শিউরে উঠলো, ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে চাইলো, আর তখুনি তলপেটে তীব্র একটা মোচড় দিয়ে তার শরীর জানান দিলো, মন ভুলে গেলেও বা ভুলতে চাইলেও প্রতিটি ব্যথার স্মৃতি ধরা আছে তার পেশীতে, গ্রন্থিতে।

    গলাটা থামছিলোই না, ক্রমাগত প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলো, 'তুমি এখানে পড়ে আছো কেন? কি হয়েছে? কথা বলছো না কেন? কি হয়েছে বলবে তো।' সে খুব দুর্বল ভাবে মাথা নেড়ে কিছু একটা বলতে চাইলো, কিন্তু সেটুকু করতেও তার শরীরের বিভিন্ন অংশে যন্ত্রণার তরঙ্গ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। মুখের মধ্যে রক্তে ভর্তি লালা জমে নোনতা হয়ে আছে। পিক ফেলে হাতের পিঠ দিয়ে মুখ মুছে নেয় সে, ঘাসের ওপর নিজের রক্ত দেখে কেমন অদ্ভুত লাগে তার, পরমুহূর্তেই তা ধুয়ে যায়। মুখ থেকে ধাতব নোনতা স্বাদ যাচ্ছিলো না। ঠোঁটের পাশটা কেটে ফুলে গিয়েছে। মাথাটা ঘুরছে অল্প অল্প। দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে জ্বর আসছে তার শরীরে। এত মার সে জীবনে কোনদিন খায়নি।

    চোখদুটো করকর করছে, একটা চোখ যেন এমনিতেই ঢেকে এসেছে হনুর হাড় ফুলে গিয়ে, জল গড়িয়ে যাচ্ছে সেই চোখ থেকে, তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সবকিছু কেমন ঝাপসা লাগে, তাই সে নিশ্চিত হতে পারছিলো না সামনের জনকে নিয়ে। তার কি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে?

    এতক্ষণ তার মুখের ওপরে ঝুঁকে ছিলো, তাকে তাকাতে দেখে কুড়িকিলো হাত বাড়িয়ে দিলো, 'উঠতে পারবে?'

    দমকা বাতাসে গাছের মাথা ঘুমন্ত সহযাত্রীর মত ঢুলে ঢুলে পড়ে একদিকে, বৃষ্টি আর মেঘের পাল তাড়িয়ে আরো অন্য কোন গঞ্জের দিকে নিয়ে যায় সেই রাখাল বাতাস। গাছে, পাতায় জলপড়ার শব্দ ক্রমে মন্থর হয়ে আসছে, আকাশ ফর্সা হয়ে এলো।

    পাঁজর ঝনঝন করল ঠিকই, কিন্তু সেও কোনমতে বাড়িয়ে দিলো নিজের হাত।

    *********

    অ্যাডাজিও
    ----------

    গড়ের মূল ফটক দিয়ে বেরোলে বাঁদিকে তাদের স্কুল, ডানদিকে গোঁত্তা খেয়ে গিয়ে রাস্তা সোজা চলে গেছে সিনেমা মোড়ের দিকে। ডাইনে বাঁয়ে না গিয়ে নাক বরাবর এগোলে এই রাস্তাটা তাদের স্কুলের পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে উঁচু হয়ে উঠে গেছে। তাদের স্কুলের পাশ দিয়ে একটা খাল গেছে, এই রাস্তাটা সেই খালের ওপরে ব্রীজের কানেকটিং রাস্তা। ব্যস্ত এবং খুব বিপজ্জনক।

    বিপজ্জনক অনেকগুলো কারণে। এই রাস্তা বহু পুরোনো। আগে এটা রাজাদের ব্যবহারের রাস্তা ছিলো। বহু পুরনো ছোট ছোট ইঁটে এই রাস্তা বানানো। পরবর্তী কালে এক দুবার পিচের পলেস্তারা পড়েছিলো, কিন্তু যে কোন কারণেই হোক, সেই পিচের আবরণ জায়গায় জায়গায় উঠে গিয়ে নিচের ইঁট বেরিয়ে পড়েছে। সমস্ত রাস্তাটা অসমান, এবড়ো খেবড়ো, গাড়ির চাকা পড়লেই ঘটাং করে লাফিয়ে ওঠে। এই রাস্তায় পিচ আবার পড়বে, ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে, (কবে যে মামা এতকিছু হবে!) এইসব কথাগুলো, তার মতই তাদের অঞ্চল প্রধানও ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে বলে তার বিশ্বাস।

    তারপর রাস্তাটা বড্ড খাড়াই। একা একা বহুত মেহনৎ করে সে একদুবার ফুল স্পীডে সাইকেলে চেপে ব্রীজের ওপর অবধি যেতে পেরেছে, তবে তার পরে কুকুরের মত জিভ বের করে হাঁপাতে হয়। বাঁটুল দি গ্রেট ছাড়া ডবল রাইডে এই ব্রীজের ওপরে উঠবে সে বান্দা গোকুলেও পয়দা হয়নি এখনো।

    এই খাড়াই আর এবড়ো খেবড়ো হবার মাসুল আদায় হয়ে গেছে বহু আগে, সে তখন হয়ত কোমরের লাল কারের ঘুনসি দিয়ে হাফপ্যান্ট আর একটা ফুটো তামার পয়সা বেঁধে রাখতো, সে শুনেছে, একজন স্থানীয় শিক্ষিকা, তিনি তখন বৃদ্ধা, রিক্সায় চেপে এই রাস্তাটা ধরে নামতে নামতে দুর্ঘটনায় পড়েন। শ্রুতি অনুযায়ী দ্রুতগতিতে নিচে নামার সময় সেই রিক্সা কোনভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারে রাস্তা আর স্কুলের মাঝের মোটা রেলিং এ, হুডখোলা রিক্সা থেকে সেই শিক্ষিকা রেলিংএর ওপর দিয়ে ছিটকে অনেক নিচে পড়ে যান। পাঁজরের হাড় মটকে গেছলো তাঁর, আর চশমা ভেঙ্গে চোখের চারিদিকে গেঁথে গেছলো, খুব নির্মম সেই মৃত্যু।

    মিনিট দশ পনের বাদে ব্রীজের পাশে বাজারের মেন রাস্তার ওপরে ডাক্তারের চেম্বারে বসে সে ভাবছিলো, কে জানে আজকেই এই সব কথাগুলো এত বেশি মনে আসছে কেন? হয়ত তার নিজের একটা চোখ প্রায় বন্ধ আর বুকের নিচে টনটনে ব্যথা তাকে এই সব মনে করাচ্ছে। চেম্বারটা রাস্তার প্রায় ওপরেই, দরজার এতো কাছে সে বসে আছে, ব্রীজের একটু অংশ ঐ দূরে বাঁকের মুখটায় দেখা যাচ্ছে।

    দুপুর থেকে পিঠোপিঠি অনেকগুলো ঘটনা ঘটে চলেছে, দম ফেলার ফুরসৎ নেই, তার মাথা ভাবতে গিয়েই চক্কর দিয়ে উঠছিলো। সে বুঝতে পারছিলো না, ঠিক এই সময় স্বপ্ন না বাস্তব, কোন স্টপেজে ব্রেক মেরে আছে তার সঙ্কÄ¡। হাড়েমজ্জায় চারিয়ে যাওয়া ব্যথাটা বলছে, স্বপ্ন বললে নাকি হে বাপু, আরেকটু চাগাড় দেবো নাকি? ভেজা জামাকাপড়গুলোও যেন ওম্‌ নেবার আশায় গায়ে আরো সেঁটে বসে, কুড়িকিলো জোরাজুরি না করলে সে হয়ত 'শালার নিকুচি করেছে' বলে বাড়িই চলে যেত, শরীর আর টানছে না। কিন্তু ছেলেটার বাস্তববুদ্ধি প্রখর, জেদও খুব, আজকেই ডাক্তার না দেখালে পরের দিন বাড়াবাড়ি হয়ে যেতে পারে। সবার ওপরে সেই জন্ডিসের পর থেকে তার বাড়ির কাছের নার্সিংহোমওয়ালা ডাক্তারবাবুর কাছে যাবার কথা ভাবলেই তার ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়, মাথার মধ্যে অশ্লীল শব্দ লাফিয়ে ওঠে। সবমিলিয়ে হাতের কাছে এই ডাক্তারবাবুই ভরসা।

    ডাক্তারবাবুর ঘরের সামনে বুকসমান উচ্চতায় দুটো পাল্লা ভেজানো আছে, থানায় যেমন থাকে, তারপরে একটা পুরনো পর্দা। ভেতরে কেউ বেশ সগৌরবেই পেটখারাপ আর আমাশার ফিরিস্তি শোনাচ্ছে ডাক্তারবাবুকে। সারাদিনে কবার হয়, কিরকম হয় এই সব কথাগুলো এঘরেও অল্প অল্প ভেসে আসছে, লোকটা বোধহয় কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, না চিল্লিয়ে কথা বলতে পারে না। সে হতাশ ভাবে এদিক ওদিকে তাকাল।

    পরীক্ষা দেবার পিচবোর্ডের মত মেটিরিয়াল দিয়ে আলাদা করা দুকামরার একটা ঘর নিয়ে ডাক্তারবাবুর চেম্বার, বাইরের এই ছোট প্যাসেজে কয়েকটা বেতের মোড়া আর একটা বহু পুরনো বেঞ্চি রাখা আছে। খান কতক আদ্যিকালের পুরনো ম্যাগাজিন রাখা আছে একটা মোড়ার ওপর। দেওয়ালে দু একটা ওষুধের বিজ্ঞাপন, ন্যাতপেতে ক্যালেন্ডার, ঠোঁটের ওপরে আঙ্গুল রেখে এক "নার্স হিসেবে ঠিক বিশ্বাস যোগ্য নয় এরকম সুন্দরী"-র সাদাকালো ছবি সবাইকে চুপ করতে বলছে।

    সে ছাড়া আর একটাই গেঁয়ো গুর্বো লোক বসে আছে চেম্বারে, লোকটার চোখ সেই পোস্টারটাকে গিলছে।

    সন্ধ্যে নেমে আসছে, অনেকক্ষণ হল কারেন্ট নেই, ঘরে একটা হ্যারিকেন রেখে গেছে কেউ, তার দম কমানো আছে, হুটহাট ঢুকে পড়া দমকা বাতাসে আগুনের শিখা দপদপিয়ে উঠছে, তাদের ছায়া দেওয়ালে নেচে নেচে ওঠে। কেরোসিনের গন্ধে সাধারণত মশা পালায়, অথচ তার হাতে পায়ে সমানে মশা কামড়াচ্ছে একটু সুযোগ পেলেই। সে চটাং চটাং করে নিজেকেই থাবড়াচ্ছিলো আর তারপর কামড়ের জায়গাগুলো চুলকে নিচ্ছিলো। অন্য লোকটি বোধহয় গন্ডারের চামড়া নিয়ে জন্মেছে, অথবা মশার কামড় নিয়ে সে এতটুকুও ভাবিত নয়।

    ভেতরের লোকটা বেরিয়ে যেতেই সিড়িঙ্গে চেহারার অ্যাসিস্ট্যান্ট তাকে হাত নেড়ে ডাকলো। তাকে ঘরে ঢুকিয়ে নিজে দরজার কাছে বেঁটে টুলে বসে পড়লো, আর সে ডাক্তারবাবুর উল্টোদিকের চেয়ারের হাতল ধরে দাঁড়ালো। ডাক্তারবাবু একটা প্যাডে কিছু লিখছিলেন, তাকে ঢুকতে দেখে পাতা মুড়ে রেখে মুখ তুলে চাইলেন, তারপর অস্ফুটে বললেন, 'ওরে বাবা!'

    হাল্কা একটা মিষ্টি ধূপের গন্ধ এসে নাকে লাগছে। মশার প্যানপেনে সুর আর কানে আসছে না। টেবিলের ওপরে একটা ভালো দামী ল্যাম্প জ্বলছে, আর তার পাশেই একটা ছোট প্লেটে মোমদানি। দেখলেই বোঝা যায় বেশ অনেক বছর ধরে এই মোমদানিতে মোম জমে জমে দুর্গের মত সব আকৃতি তৈরি হয়েছে। ডাক্তারবাবুর চেয়ারের পেছনে একগাদা মেডিকেল জার্নাল বা ঐ টাইপ কিছু ডাঁই করে রাখা। ঘরের একদিকে একটা অয়েল ক্লথে মোড়া পেশেন্ট বেড, তার পাশে লম্বা টেবিলে জলের জাগ, গুচ্ছের ওষুধ, স্যাম্পল, লিফলেট, গিফট এই সবে ভর্তি। সেদিকের দেওয়ালে একটা ওষুধ কোম্পানির নাম লেখা ঘড়ি দেখতে পেল, অদ্ভুত ব্যাপার ঘড়িটা উল্টোদিকে চলছে।

    হাতের ইঙ্গিতে তাকে বসতে বলে ডাক্তারবাবু নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে তার কাছে এলেন। তার মুখচোখের কাটাছেঁড়াগুলো ভালো করে দেখলেন, ড্রয়ার হাতড়ে একটা পেন্সিল টর্চও বেরোল, সেইটে ফোকাস করে করে; গায়ে টেম্পারেচার আছে বুঝতে পেরে কোত্থেকে একটা থার্মোমিটার বের করে তার জিভের তলায় পুরে দিলেন। এই ব্যাপারটা তার ঘেন্না করে। এবারে এই থুতুটা না পারা যাবে গিলতে না পারা যাবে ফেলতে।

    মোমবাতির আলোতে থার্মোমিটারের রিডিং পড়তে পড়তে ডাক্তারবাবুর মুখে একটু যেন বেশিই ছায়া জমেছে মনে হল। নিজের চেয়ারে বসতে বসতে ডাক্তারবাবু প্রথম কথা বললেন, 'যাও বাইরে থেকে থুতু ফেলে এসো, ইচ্ছে হলে ঐ জাগ থেকে জল নিয়ে কুলকুচিও করতে পারো।'

    তাকে বেরোতে দেখে সেই উটকো লোকটা ধাঁ করে চেম্বারে ঢুকে যাচ্ছিলো, কিন্তু অ্যাসিস্ট্যান্টের খেঁকুনি শুনে আবার নিজের মোড়াতে একপা তুলে বসে হাঁটু চুলকোতে লাগল। ব্যাটাকেও মশা কামড়েছে তার মানে। মনে মনে একটা অবৈধ আনন্দ হল তার।

    সে এসে চেয়ারে থিতু হয়ে বসা অবধি অপেক্ষা করে ডাক্তারবাবু মুখ খুললেন, 'মারামারি না অ্যাক্সিডেন্ট?'

    সে একটু ইতস্তত: করে বলে 'মারামারি ঠিক না, মার খেয়েছি', তার নিজের কাছেই গলাটা ক্ষীণ শোনায়,।

    - 'প্রচুর মার খেয়েছ দেখতেই পাচ্ছি, সে ঠিক আছে, দিতে পেরেছ কিনা সেটাই বড় কথা।'

    সে মুখ তুলে তাকায়। এই কথা সে আশা করেনি। ডাক্তারবাবু তার দিকেই তাকিয়ে আছেন, চশমার পুরু কাঁচের মধ্যে চোখদুটো বড় দেখায়, সে একটু ভরসা পেল, মনে একটু স্বস্তি এল, লোকটার ওপর কোথাও একটা ভরসার জায়গা তৈরি হল তার মনের মধ্যে।

    তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ডাক্তারবাবু মুচকি হাসেন, 'ওপেন আপ। লুকোবার কিছু নেই, কথাগুলো বললে তুমি হাল্কা হবে। ভয় নেই, আমি জাজমেন্টাল নই, তোমার বয়েসে আমিও অনেক মারামারি করেছি। খেয়েওছি, দিয়েওছি। ইট'স দা সেম ওল্ড ওয়ার্ল্ড।'

    দায়সারা ওষুধ না লিখে এই কাউন্সেলিং তাকে ভরসা যোগায়। কাটা ঠোঁটে টান পড়ে, জিভ দিয়ে জ্বালাটুকু চেটে নিয়ে সে বলতে শুরু করে। অনেক কথাই জমে ছিলো তার।

    ************

    স্কের্ৎজো
    --------

    -'ভিকো টারমেরিক, নেহি কসমেটিক রে শালা। মাখবি না মানে, তোর ঘাড় মাখবে!'

    - 'ঘাড় কেন, **ও মাখবে, হ্যাহ হ্যাহ!'

    এই সব গাড়োয়ালি ইয়ার্কিতে তারও কুলকুলিয়ে হাসি পায়, মুখের সামনে উদ্যত কাদা মাখা হাতগুলো সে আর আটকাতে পারে না। সে মুখ চেপে হাসে আর তার দুই বন্ধু বেশ তারিয়ে তারিয়ে তার মুখে, গায়ে, যত্র তত্র কাদা মাখাতে থাকে। এর নাম হলো 'মাডালাইজেশন'।

    আজকে রথ।

    তারা তিনবন্ধু এসেছে রথ টানতে।

    রথের দড়ি টানার আগে মাডালাইজেশন ইজ এ মাস্ট।

    এই ছোট মফ:স্বলের রথযাত্রা বেশ বিখ্যাত। রাজবাড়ি যাদের, সেই সামন্ত রাজারা এই রথযাত্রার প্রচলন করেছিলেন অনেক অনেক বছর আগে, পুরীর জগন্নাথধামের আদলে। পুরীর মতই রথের দড়ি টানা, এই অঞ্চলে একটি বিশেষ রকমের হাইপ।

    আগের বছর শারীরিক অসুস্থতার কারণে আর মন টানেনি বলে সে যোগদান করেনি, কিন্তু তার দুই বন্ধুই আগের বারে রথের দড়ি টেনেছে। সেই অভিজ্ঞতার ভাগ প্রয়োজনাতিরিক্ত ভাবে তাকে সমানে যুগিয়ে চলেছে এই দুজন।

    রথের দড়ি টানা বিস্তর হ্যাপার কাজ। জলে কাদায় বসে যাওয়া মাটিতে সুবিশাল রথ টানতে মেহনত লাগে। রথের ইয়া মোটা কাছি ভেজা, পিচ্ছিল হয়ে থাকে, সেই কাছি ধরে টানারও কৌশল আছে, যখন টানার ডাক আসে, মাটি থেকে তুলে নিয়ে সবাই মিলে একসাথে টানে, প্রবল আকর্ষণে সেই কাছি প্রসারিত হয়, তারপর ছাড়ার ডাক এলে সবাই একসঙ্গে ছেড়ে দেয়, কাছি আবার সংকুচিত হয়, ঠিক সময়ে ছাড়তে না পারলে হাতে লেগে যাবার সম্ভাবনা আছে।

    আরো একটা ব্যাপার হয়, শুরুতে যত লোক থাকে পরের দিকে আস্তে আস্তে অনেকেই কেটে পড়ে। একটা ধারণা আছে লোকেদের মধ্যে, যে রথের দড়ি ছোঁয়াটাই খুব পুণ্যের কাজ। ফলে এক দু মিনিট নাম-কা-ওয়াস্তে টেনে বা একটুকু ছোঁয়া লাগিয়ে যে পুণ্য অর্জন হয়ে যায়, লোকজন তার সুদেই বছরভর কাটিয়ে দেবার পরিকল্পনা করে। এইজন্যে যারা শেষ অবধি থাকে, চক্ষুলজ্জায় বা দায়িত্ববোধে, সংখ্যায় কম বলে তাদের ওপরে বেশ চাপ পড়ে যায়।

    তারা এসবের তোয়াক্কা করে না। বাড়ির লোকজন অনেকভাবে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পরের বছর কে কোথায় থাকবে তার ঠিক নেই, সে এবারের সুযোগ ছাড়তে রাজি না।

    প্ল্যান অনুযায়ী সব ঠিকঠাকই চলেছে। তাদের এক বন্ধুর বাড়ি খুব কাছেই। তারা সেখানেই ঘাঁটি গেড়েছে সকাল থেকে। খিচুড়ি সাঁটিয়ে ছাদের ঘরে ঢালাও সতরঞ্জি পেতে শুয়ে-বসে আড্ডা, তারপর রথ টেনে বন্ধুর বাড়ির পুকুরে সাফসুতরো হয়ে চা, পাঁপড়, জিলিপি, সব একেবারে খাপে খাপ। তখন রোদও ছিল অল্পবিস্তর।

    বিকেলের বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা না থেকে গাঁজার ঠেক থেকে ঘুরে আসতে ইচ্ছেটাই দিনের টার্নিং পয়েন্ট। বা হয়তো শুধু সেই দিনটারই নয়, আরো বৃহত্তর সময়সীমার।

    গড়ের মধ্যে ঢিবির দিকটায় পেছন ফিরে বসলে সামনে ডানকোণে গাছপালার ফাঁক দিয়ে গোপালজীর মন্দিরের চুড়ো দেখা যায়। সেই বেঁটে গাছগুলোর গুঁড়ি আজকে ফাঁকা। সে একাই বসেছিলো। গাঁজার ঠেকের কেউই আসেনি আজকে। সবাই বোধহয় রথের মেলায় ব্যস্ত। গড় আজকে বড় শুনশান।

    সাইকেলটা বন্ধুর বাড়িতে রেখে আসার জন্য একটু খেদ হচ্ছিলো তার, ভিড়ের মধ্যে চলতে সুবিধে হবে বলে সে সাইকেল রেখেই বেরিয়েছে, অনেকটা পথ বেমক্কা হাঁটতে হয়েছে, আবার এতটা পথ ফিরতে হবে। তা নইলে আরেকটা কাজ করলেও হয়। সাইকেল থাকুক ওখানেই, চেনাজানা কাউকে পেলে নিজের বাড়ির দিকেই ফিরবে সে, সাইকেল এক দু দিন বাদেও নিয়ে আসা যায়।

    এইসময়েই ঢিবির দিক থেকে সাইকেলের শব্দ আর লোকজনের কথাবার্তা শুনে সে একটু কৌতূহলী হল। তার বন্ধুরা আসছে নাকি?

    ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে দেখল তিনটে ছেলে। এখানকারই হবে হয়ত, একজনকে কেন জানি একটু চেনা চেনা ঠেকল। সে একটু বিরক্ত হল, এরা না আবার এই ঠেকে জাঁকিয়ে বসতে চায়। সে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

    ছেলেগুলো থমকে গেছে, সে অনুভব করল ওরা নিজেদের মধ্যে কি গুজগুজ করছে। তারপর একজন এগিয়ে এসে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, 'অ্যাই, ***, এখানে বসতিছু যে বড়!'

    কথা নেই বার্তা নেই, নোংরা খিস্তি খেয়ে সে ভুরু কুঁচকে ঘুরে তাকায়, 'কেন? বসেছি তো কি হয়েছে?'

    -'এটা মোদের জায়গা। মুখে মুখে চোপা করবিনা। বলতিছি বসতে না, বসবিনা।' ছেলেটা আঙ্গুল তুলে কথা বলছে। আগে কোথায়... আগে কোথায় যেন ...

    এই সব চমকে দেওয়া সে আগে দেখেছে, নিজেও করেছে, তাই না ঘাবড়ে একটা পাল্টা খিস্তি দিয়ে বলে, '***? বাপের ** পড়ে আছে এখানে? সাহস থাকলে তোল দেখি।'

    -'মার খেয়ে মরবি **, আগেই বলতিছি, ভাগ!' খুব তাচ্ছিল্য করে ছেলেটা এগিয়ে এসে তার গালে হাল্কা চাপড় মারে।

    সে হাতটা চেপে ধরে জোর করে, তার মাথায় একটা খুনে রাগ ধকধকিয়ে ওঠে, একটু জোরেই সে মুচড়ে দেয় ছেলেটার আঙ্গুল, ছেলেটা ককিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়।

    পেছন থেকে একজন বললো, 'বেশি রং মারতিছে রে। একটু চটকে দে'।

    কর্কশ, শিরা ওঠা, গাঁট গাঁট আঙ্গুলগুলো এগিয়ে এসে তার চুলের মুঠি চেপে ধরলো, আর হ্যাঁচকা টানে ছেলেটার রাগে বিকৃত মুখের দিকে তার মুখও ঘুরে গেল। প্রচন্ড দাহ্য সেই এক লহমায় ঘৃণায় ভর্তি মুখটা দেখে মনে পড়লো এই একই ঘৃণা সে আগেও দেখেছে, ছেলেটাকে চেনা চেনা লাগাটা আর এই ঘটে চলা ব্যাপারটা, দুটোই তার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল।

    এই সেদিনের সেই পলাতক ছেলে, যেদিন এর সঙ্গের মেয়েটি তাদের দিকে থুতু ছিটিয়েছিল, সেদিন সে কিন্তু সামাল দিতেই চেয়েছিলো, বাওয়ালির পথে যেতে চায়নি। অথচ আয়রনি এটাই আজকে সেই ছেলেটার সঙ্গেই তার মারামারি শুরু হয়েছে।

    নাহ আর সেই মেয়েকে সে দেখে নি, না একলা, না এর সঙ্গে। সেটার সঙ্গে আজকের এই ঘটতে চলা ঘটনার কোন যোগসূত্র আছে কি?

    সে জানে না, শুধু এইটুকুই বোঝে যে আজকে তাদের অবস্থান পালটাপালটি হয়ে গেছে। আজকে সে একা।

    অদ্ভুত ভাবে সময় যেন স্থির হয়ে আসে তার সামনে, সে একই সঙ্গে বহু আগের সেই সন্ধ্যেবেলা, ঠিক এই মুহূর্তে ছেলেটার এগিয়ে আসা আর কিছুক্ষণের মধ্যে যে মারামারিটা হবে এই তিনটে ঘটনাই যেন অনুভব করতে পারে। যেন এসবই ঘটে গেছে, ঘটে আসছে, শুধু তারা নিছক কুশীলব, আর একবারের মত তারা নিজের নিজের পার্টটুকু করে আবার ফিরে যাবে যে যার অভ্যস্ত বৃত্তে।

    এই পূর্বাপর ঘটনার ছক টের পেয়ে তার রক্ত ফুটতে থাকে, হার্টটা যেন ফেটে যাবে এমন জোরে ধকধকিয়ে ওঠে, হিংস্র হাতাহাতির মধ্যেও চোখের কোণ দিয়ে সে দেখে বাকি দুজনও মুঠো শক্ত করে এদিকেই এগিয়ে আসছে, অদ্ভুত ভাবে সে নিশ্চিন্ত হয় যেন এটাই ঘটার ছিলো। দ্য শো মাস্ট গো অন!

    জলেকাদায় ভিজে সারাটা দুপুর রথের দড়ি টেনেছে, বিকেলবেলায় স্নান, এই এতটা পথ হেঁটে আসার ক্লান্তি, একজনের সঙ্গে এঁটে ওঠাই তার জন্য মুস্কিল ছিলো, তিনটে নির্মম মুখ তাকে ঘিরে ধরতে অনেক ছোটবেলায় ঘটা একটা ঘটনা তার মনে পড়ে গেল। কোন এক বর্ষার বিকেলে তাদের উঠোনের সামনে পেরিয়ে যাওয়ার সময় একটা শামুককে তারা কয়েকজন বন্ধু ধরে ফেলে। হতভাগ্য প্রাণীটি তার খোলসে ঢুকে যাবার আগেই সরু কাঠি ঢুকিয়ে সে পথ বন্ধ করে দেয় কেউ। তারপর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার প্রতিক্রিয়া দেখে চলে তারা অনেকটা সময় ধরে। শেষ অবধি কেউ সেটার খোলস আর ঢাকনার দিক চেপে টেনে ছিঁড়ে ফেলে মুক্তি দেয় তার সব যন্ত্রণার। মরা শামুকের বিগলিত শরীরের ওপর লাথি মেরে তার মৃত্যু সুনিশ্চিত করেছিলো তারা সেদিন, অবশ্যই রাবারের হাওয়াই চপ্পলে পা ঢেকে, কেননা শামুকের খোলসে পা কাটার ভয় আর ব্যথা, এই দুটো জিনিস সম্পর্কেই সেই বয়েসে তারা জেনে গেছিলো।

    তার তো কোন খোলস নেই যাতে পা কাটার ভয় থাকবে, তাই যেন নির্দ্বিধায় সব দিক থেকে তার ওপরে ঢেউএর মত আছড়ে পড়ছিল এলোপাথাড়ি আঘাতগুলো। তবে তারও মুক্তি আসতে খুব বেশি দেরি হলো না।

    কোনাকুনি চোখের নিচে সজোরে কেউ মারলো, গালের হাড় আর আঙ্গুলের গাঁটের সংঘর্ষে 'ঠক' করে শব্দ হল, মাথা ঘুরিয়ে বেঁটে গাছের গুঁড়িটায় মুখ থুবড়ে গেলো তার, মুখের নিচেটায় আর কোন সাড় পেলোনা সে। গড়িয়ে গেল নিচে, আরো নিচে।

    মাটিতে যখন পড়ল সে তখনো তার মাথা আর চোখ কাজ করছে, সে বুঝে যাচ্ছিলো সে আর পারবে না, সে হেরে গেছে। শারীরিক কষ্টের থেকেও এই অক্ষমতাটাই তাকে হানে।

    গালের ওপরে একফোঁটা জল পড়তে সে প্রথমে ভেবেছিলো এটা তারই চোখের জল হয়তো, কিন্তু চারিদিকেই টুপটাপ নেমে আসা ফোঁটাগুলোর টেম্পো যেন বাড়তেই থাকল, সে অবাক হয়ে দেখল তার চারিদিক ভরে যাচ্ছে ছিটকে পড়া জলের গুঁড়োয়, মাটির ভাপে, ঘাসের গন্ধে।

    কয়েকটি খন্ড মুহূর্তের জন্য সবকিছু থেমে গেছলো, তার ওপরে ঝরে পড়া মারও, হয়ত সে নিচে পড়ে গেছলো বলে, বাকি দুজন সেই আগ্রাসী ছেলেটাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যেতে চায়, এমনিতেই হুজ্জুতে জড়িয়ে গেছে তারা... বৃষ্টি নেমে আসছে খুব জোরে... আরো জোরে... প্রেস্টো... প্রেস্টিসিমো...

    কি কারণে সে ওপরে তাকাতে চেয়েছিলো ঠিক মনে নেই, ঠিক সেই ঘাড় ঘোরানোর সময়টাতেই তার নাভির নিচে একটা স্যান্ডেলের রুক্ষ সোলে মোড়া ফ্রিকিক এসে পড়ল... শটে খুব জোর ...

    আকাশটা দেখা হলো না... ছেলেটা নিশ্চয়ই ভালো ফুটবল খেলে... অসহ্য যন্ত্রণা পেটে... চোখ বুজে এলো... সারা শরীরময় লাভার স্রোত নামছে...

    উহ্‌হ্‌!!

    ********************

    রন্ডো
    ------

    -'ওইভাবেই পড়েছিলে? মাঠে? জলকাদায়? তোমার বন্ধু যদি দেখতে না পেত? দেখেও না এগিয়ে এলে?'

    এ উত্তর সে জানে না বলে চুপ করে রইলো। এতক্ষণ বকবক করে গলা চিরে চিরে গেছে। খুব তেষ্টা পায়। আড়চোখে তাকিয়ে দ্যাখে তার জামায় প্যান্টে কাদামাটি শুকিয়ে আসছে।

    একটা নিশ্বাস ফেলে ডাক্তার বাবু প্যাডে কিছু লিখতে লিখতে বললেন, 'ওষুধগুলো যত তাড়াতাড়ি পারো খেয়ো। কমপ্লিট বেড রেস্ট। দু তিন দিন পরে ভালো থাকলে এসে একবার দেখিয়ে যাবে। আর রাতে যদি বমি হয়, হাসপাতাল যেতে হতে পারে। আপাতত আমি এটিএস করে দিচ্ছি আর ক্ষতগুলোয় ড্রেসিং, বাড়িতে মারকিউরোক্রোম থাকলে লাগাতে পারো। চেষ্টা করবে জল না লাগাতে।', দরজার পাশে বসা অ্যাসিস্টেন্ট সব কথাই এতক্ষণ শুনছিলো, সে খেয়াল তার ছিলো না, ডাক্তার বাবু তার দিকে তাকাতেই সে উঠে গেল।

    বাঁ হাতে ইঞ্জেকশনের রামচিমটি আর এদিক ওদিকে কাটা ঘায়ে আয়োডিনের শিরশিরানি নিয়ে সে বেরোল। জলে ভেজা ন্যাতপেতে নোটগুলো ডাক্তারবাবুকে দিতে তার খুব লজ্জা করছিলো, তবে ভাগ্যিস আজকে রথ, মেলায় কিছু কিনবে বলে টাকা সঙ্গে নিয়েই সে বেরিয়েছিলো, নইলে সচরাচর বেশি টাকা তার সঙ্গে থাকে না।

    বেরোতেই দেখলো বসে থাকা লোকটা তার দিকে খুব বিষ চোখে তাকাল। এতক্ষণ ধরে সে চেম্বারে বসে গল্প বলেছে আর এ বাইরে বসে মশার কামড় খেয়েছে কথাটা ভাবতেই তার ঈষৎ খারাপ লাগলো।

    কুড়িকিলো বাইরেই ছিলো। তাকে দেখে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ইস্‌স্‌স। এতক্ষণ ধরে ছেলেটা অপেক্ষা করছে তারজন্যে? কুড়িকিলো সম্পর্কে তার মনে যে তেতোভাবটা ছিলো সেটা পাল্টে যেতে শুরু করেছে।

    ছেলেটা কিছুতেই ছাড়লনা তাকে। ঐদিকেই নাকি কি কাজ আছে, তার বাড়ি যাবার পথেই পড়বে। আপত্তি করতেও শক্তি দরকার হয়। গরমকালে মোড়ের মাথায় একটা লোক রংবেরংএর সিরাপ আর সরবতের ঠেলাগাড়ি নিয়ে বসে, লেবুজল চাইলে কাঠের একটা জাঁতির মত জিনিসে আধখানা লেবু ভরে চাপ দিলেই সমস্ত রস নিংড়ানো হয়ে যায়, একফোঁটাও আর পড়ে থাকে না, নিজেকেও তার সেই বিশুষ্ক আধালেবুর মত মনে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে কুড়িকিলোর সঙ্গে ব্রীজের দিকে হাঁটতে শুরু করলো সে।

    ঘরের ভেতর থেকে বাইরেটা অনেক বেশি অন্ধকার মনে হচ্ছিলো, কিন্তু বাইরে এসে বোঝা গেল, অল্প এক দু ফোঁটা আলো এখনো লেগে রয়েছে মেঘলা আকাশের গলিঘুঁজিতে। বিকেলের জোরদার বৃষ্টির পরে আর আপাতত আকাশ আর ঢালবে না ধরে নিয়ে লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়েছে নতুন উদ্যমে। পাশ দিয়ে হুশহাশ ভ্যান, রিক্সা, সাইকেল, স্কুটার, মোপেড, বাইক বেরিয়ে যাচ্ছে। অনবরত প্যাঁপুঁ, কিড়িং কিড়িং, রকমারি হর্নের শব্দে যেন কান ঝালাপালা হবার যোগাড়। সবার ওপরে একটু দূরেই মেলার ভিড়, হট্টগোল, প্যাঁপো বাঁশির শব্দ, মাইকের অ্যানাউন্সমেন্ট, বাচ্চার ওঁয়াও ওঁয়াও কান্না, তারস্বরে বেজে চলা চলতি সিনেমার গান, লোকের দরদাম, দোকানির হাঁকডাক, পাঁপড়, জিলিপি, তেলেভাজার গন্ধ, পাকা কাঁঠালের বাস। জীবন ছুটছে নিজের গতিতে। কেউ থেমে নেই।

    এই সবকিছু আস্তে আস্তে মোলায়েম হয়ে এলো, যখন ব্রীজের ওপরে এল তারা। লোকজনের ভিড় আছে, কিন্তু মেলার হট্টগোলটার মুখে কাপড়চাপা দিয়েছে কেউ। ব্রীজটা হেঁটেই নেমে এলো তারা। জলে কাদায় ডবল রাইডে নামার ঝুঁকি নিতে কেউই রাজি না। নেমে স্কুলের সামনেটায় এসে তাকে সামনে রডে বসিয়ে কুড়িকিলো জোরে প্যাডেল মারলো।

    শু ইউনিভারসিটি অবধি আসতে কোন সমস্যা হল না। কিন্তু এরপরেই তেমাথার রাস্তাতে লোকের যেন ঢল নেমেছে। কুড়িকিলো তবু যাহোক করে ক্রমাগত বেল বাজিয়ে রাস্তা বের করার চেষ্টা করছিলো, তাতে সামনে একটা লোক অত্যন্ত খচে গিয়ে ঘুরে গিয়ে বললো, 'বেল খুলে **এ গুঁজে দিবো।' কিভাবে গুঁজে দেবে সেটা হাত নেড়ে দেখাতে কুড়িকিলো সাইকেল থেকে নেমে পড়লো।

    প্রথমটা সে ভেবেছিলো আবার বাওয়ালি শুরু হতে যাচ্ছে, কিন্তু না, দেখা গেল সেসব কিছু নয়, কুড়িকিলো বরাবরই এই সব থেকে দূরে থাকে, সে ঝামেলায় যেতে চায় না। অগত্যা সেও নামলো, যদিও শরীর আর টানছে না।

    মোড়ের দিকে যাওয়া অসম্ভব। ভিড়টা সেই দিক থেকেই স্রোতের মত এদিকে আসছে। একটু থেমে তারা কাছেই একটা ওষুধ দোকান থেকে প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে ওষুধ কিনে নিলো। তার সব টাকাগুলো তো গেলই, কুড়িকিলোর থেকেও কয়েকটা টাকা ধার করতে হলো। ছোট ছোট খামে খাবার নিয়ম লিখে ওষুধ ভরে একটা বড় সাদা খামে সব ঢুকিয়ে দিল দোকানি। সে সেটা যা হোক করে জামার বুকপকেটে গুঁজে রাখলো।

    এবারে এগোতে হয়। বাধ্য হয়ে তারা গার্লস স্কুলের দিকের রাস্তাটা নিলো। এটা মেন রাস্তার সমান্তরালে গেছে। তবে তাকে ইলেকট্রিক অফিসের পাশের রাস্তাটা নিতে হবে। সেটা করতে একটা মাঠ পেরোতে হয়। জলে কাদায় তার কি হাল হয়ে আছে কে জানে। ঐ রাস্তাটা ধরে সোজা এগোলে মেন রাস্তাক্রশ করে তার বাড়ির দিকে যাবার রাস্তা, রেললাইনের দিকে যাবারও বটে। কিন্তু তা না হলে তাদের অনেকটা ঘুরে যেতে হবে।

    কুড়িকিলোর হাঁফ ধরে আসছে, সে বেশ বুঝতে পারছিলো। একে ডবল রাইড তার ওপরে সাইকেলের হেডলাইটের জন্য পেছনের চাকায় ডায়নামো ফেলা আছে, সামনে রডে বসে সে কুড়িকিলোর স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমশ: হাঁপ ধরায় বদলে যেতে টের পেলো। নিজের অক্ষমতার উপরে তার একটা অহেতুক রাগ দানা বাঁধছে।

    সেটা পুরোপুরি ফেটে পড়লো যখন জলে কাদায় ভর্তি মাঠটার সামনে তারা শেষমেষ এসে দাঁড়ালো। দাঁতে দাঁত চিপে সে না বলে পারলো না : 'সময় যখন খারাপ যায়/ ** **** ** হয়!!'

    ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই মোরাম রাস্তাটা যেন নেমে হারিয়ে গেছে জল, কাদা, নরম মাটি, ঘাস, ছোট গাছ, অজস্র ব্যাঙ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে ভর্তি বিস্তীর্ণ একটা আরো অন্ধকার শূন্যস্থানে। সাইকেলের হেডলাইট মেরে এদিক ওদিকে ভরসার কিছুই তারা দেখতে পেলো না, সেরেফ একটু দূরেই কারো একপাটি হাওয়াই চপ্পল কাদায় আধখানা গেঁথে আছে। বেচারি জুতোর মালিক বোধহয় ঝোঁকের বশে এই জায়গাটা পায়ে হেঁটে পেরোতে গেছলো।

    তাদেরকে এবারে অনেকটা ঘুরে যেতে হবে। আগে তাদের ফিরতে হবে সেই মেন মোরাম রাস্তায়, যেটা গার্লস স্কুলের দিক থেকে এসেছে, তারপর সেইটে ধরে এগোলে প্রথমে পড়বে প্রোফেসর পাড়া (স্থানীয় কলেজের বেশ কয়েকজন অধ্যাপক এই জায়গাটিতে পাশাপাশি বাড়ি বানিয়ে একটি এলিট পাড়া বানিয়েছেন), তারপরে মুসলমান পাড়া পেরিয়ে তারা পড়বে একটা গুরুত্বপূর্ণ পিচরাস্তায়, যেই রাস্তাটা চলে গেছে হাইরোড বা জাতীয় সড়কের দিকে। ঐ রাস্তা ধরে বাঁয়ে গেলে একটা বড় মোড়, সেখান থেকে আবার বাঁয়ে মোড় নিয়ে, তারা এসে পড়বে মেন রাস্তা আর ইলেকট্রিক অফিসের সংযোগস্থলে, যেটা এখান একবারে না হলেও বার দুই তিনেক ঢিল ছোঁড়ার দূরত্বেই আছে।

    উপায় নেই, এই জায়গাটা আপ, তাদের সাইকেল ঠেলে যেতে হবে, তারা পা বাড়ালো, সেই সময়েই একটু যেন উশখুশ করেই কুড়িকিলো কথাটা পাড়ল।

    - 'তুমি যদি জাস্ট পাঁচটা মিনিট দিতে পারো, মোড়ের আগেটায় একজনের বাড়িতে আমি জাস্ট দেখা করেই চলে আসবো। আসলে আগে ভাবছিলাম তোমাকে বাড়িতে ড্রপ করে তারপর যাবো, কিন্তু... মানে এখন তো ওদিক দিয়েই ঘুরে যেতে হচ্ছে... তাই... '

    শরীরটা প্রাণপণে বিশ্রাম চাইছে, তবুও স্রেফ মনের জোরে সে পা চালায়, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়, 'আরে হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। তুই এতটা করলি আমার জন্যে, পাঁচ মিনিটে আর কি হবে...'
    তারপরে একটু থেমে বলে, 'আমাদের এদিকে কার বাড়িতে যাবি? আর্জেন্ট কিছু?'

    কুড়িকিলো একটু ইতস্তত: করলো, তারপরে নামটা বললো। কি একটা অজুহাতও দিচ্ছিলো, কিন্তু প্রথম বাক্যটার পরে বাকি সব কথা তার করোটির বাইরে থেকেই প্রতিফলিত হয়ে হারিয়ে গেল। কোনক্রমে সে 'ও' বলতে পারলো।

    তার গুম মেরে যাওয়াটা নিয়ে কুড়িকিলোর হয়ত সন্দেহ হলেও হতে পারত, কিন্তু মোরাম রাস্তায় ফিরে সাইকেলে চাপার পর কি একটা বলতে গিয়ে সেই যে কুড়িকিলোর মুখে একটা মশা ঢুকে গিয়ে কাশি টাশি হয়ে একাকার কান্ড হয়ে গেল, বাকি রাস্তাটা হ্যাক থু করে গলা ঝাড়া আর খক খকানি ছাড়া তারা মোটামুটি চুপচাপেই কাটিয়ে দিলো। এইটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, সে খেয়াল করেছে, তার মাথার ওপরে মাঝে মধ্যে মশা ঘোরে, তার কাছে পিঠে আর কেউ থাকলেও তাদের মাথার ওপরে ঘোরে না, বেছে বেছে কেবল তার সঙ্গেই এমন ব্যবহার। এই নিয়ে এককালে বিস্তর আওয়াজ খেয়েছে সে, আজকে কুড়িকিলোও যে এটারই ভিকটিম না, কে বলতে পারে। এই প্রথম তার মনে হল, বেশ হয়েছে শালা! পরক্ষণেই সে নিজের জিভ কাটলো। মনে মনে।

    মোড়ে এসে তারা বাঁদিকে ফিরলো। এই জায়গাটায় তেমন ভিড়ভাট্টা নেই। এইবারে অনেকটা গেলে তবেই ইলেকট্রিক অফিসের ঐ জায়গাটা। একটু গিয়েই সাইকেল বাঁদিকে ফেরালো কুড়িকিলো।
    এই দিকটায় জনবসতি বেশি তারওপর সামনেই মোড় বলে এদিক ওদিক থেকে ঠিকরে আসা আলোয় মোটামুটি বোঝা যায়। রাস্তা থেকে একটু নেমে গিয়েছে একটা রাস্তা, পাশেই বিডিও অফিস। জনপ্রাণী নেই, নিঝুম, একটু কুকুর ভেতরে শুয়ে ছিলো, তাদের দেখে এক দুবার ভুকভুকিয়ে থেমে গেল।

    এই রাস্তাটায় সে আগে কোনদিন আসেনি, বস্তুত: বিডিও অফিসেও আসা হয়নি, রাস্তাটার দুপাশে সারি সারি সুপুরি গাছে ভর্তি, সামনেই একটা জাব্দা লোহার গেট। এটাই তাহলে সেই তার বাড়ি, থুড়ি তার জেঠুর বাড়ি। ভালো, চেনা থাকলো।

    গেটের ভেতরটা বেশ অন্ধকার। তবে ঢুকে বোঝা গেল কংক্রিটে মোড়া, পাশেই একফালি বাগানে সারি সারি গ্যাঁদাফুলের গাছ লাগানো। আরো কয়েকটা ফুলের গাছ আছে এদিক ওদিকে, হালকা সুবাস, আয়োডিনের ধাতব গন্ধ ভেদ করে তাকে একটু স্বস্তি দিলো। পাশেই একটা সিমেন্টের বেঞ্চি দেখে সে বসে পড়লো।

    -'কি হল বসে পড়লে? খারাপ লাগছে?'

    -'না, ঠিক আছি, যা, তুই ঘুরে আয়, আমি এই অবস্থায় অচেনা লোকের বাড়ি গিয়ে কি করবো, এখানেই বসলাম।'

    -'পাগল নাকি, এই অন্ধকারে কি বসে থাকবে? সাপখোপ কামড়ে দেবে, আজকে তোমার দিনটা ভালো যাচ্ছে না, একটু আগে নিজেই তো বললে, সময় যখন খারাপ যায়...'

    -'নারে, আমাকে দেখলে চোরডাকাত ভাবতে পারে, তুই যা, দেরি করিস না।'

    কুড়িকিলো আর কথা বাড়ালো না। তাকে আর তারপাশে সাইকেল রেখে সে এগিয়ে গেলো। এই বাড়িতে ঢোকার গেট বা দরজাটা অন্যদিকে বোধহয় এবং সেটা কুড়িকিলো জানে।

    তার ভেতরে টাগ-অব-ওয়ার চলছে। আবার তার বুক আর মাথা তাকে উল্টোপাল্টা সাজেশন দিচ্ছে। একজন বলছে, আরে **, এক পলকের একটু দেখা, আরো একটু বেশি হলে ক্ষতি কি? পরের জন বলছে, এই চেহারা ছবি নিয়ে? মাইরি? খুচরো থাকলে হাতে ধরিয়ে দেবে, না চাইতেই। এমনকি সে আনমনেই আঙ্গুল চালিয়ে চুলগুলো একবার ঠিক করারও চেষ্টা করলো।

    বাড়িটা অন্ধকারে ঢেকে আছে। মশার উপদ্রবে লোকজন সন্ধ্যে হলেই জানালা দরজায় হুড়কো দিয়ে দেয়। তবুও ভেতরে আলো জ্বললে ভেন্টিলেটার, জানালার ফাঁক ইত্যাদি দিয়ে বোঝা যায়। এই বাড়িটা একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে আছে। ওপরের বারান্দার দিকেও সে একবার কষ্ট করে মাথা তুলে তাকালো, কেউ কি আড়াল থেকে দেখছে তাকে? আচ্ছা, কুড়িকিলো কেন এলো এখানে? কিসের দরকার?

    এতক্ষণ সাইকেলের রডে বসে তার পেছন ধরে গেছলো। ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে স্ল্যাব থেকে জল যেন শুষে নিচ্ছে তার আধভেজা তৃষ্ণার্ত প্যান্ট। বহুদূরের হট্টগোল যেন রাতের আকাশে একটা ট্র্যাজেক্টরি বেয়ে তার কাছে আসছে, তাতে করে পারিপার্শ্বিক নিস্তব্ধতা বেশি করে কানে লাগে। সে ওদিক থেকে শুনতে পেলো কুড়িকিলো গেটে টং টং করে শব্দ করে ডাকলো (সে একটু উৎকর্ণ হলো)... ভেতর থেকে কেউ একজন হেঁড়ে গলায় 'খি, খাখে ছাই' এই সব বলতে বলতে বেরিয়ে এলো ... ধুর অন্য কেউ, সে না... কি সব কথা বার্তা হচ্ছে ওদিকে ... কুড়িকিলো কি একটা বোঝাচ্ছে খুব ধরে ধরে, অমনোযোগী বাচ্চাকে নামতা পড়ানোর মত করে... 'গড়' কথাটা এক দুবার বললো নাকি? তার কথা হচ্ছে? ... হেঁড়ে গলা মোটেই ইমপ্রেসড না, কি সব ঘুক ঘাক শব্দ করছে ...বিডিও অফিসের পাশের মাঠ থেকে একটানা ব্যাঙের ডাক... কেউ বেশ দূরে রেডিওর চালিয়েছে... নব ঘুরিয়েই যাচ্ছে বোধহয়, একটা স্টেশন আসছে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে... একটু হাওয়া দিলো, সামনে সুপুরি গাছগুলো রোগা শরীরে ঝাঁকড়া চুলের মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে সেই হাওয়ার কানে ফিসফিস করে কি সব বলে... মশার পিনপিন শব্দে আনমনেই হাতের খোলা জায়গাগুলোয় হাত বুলোতে বুলোতে তার নিজের গা বেশ গরম ঠেকে...নিশ্বাসও যেন গরম, গলায় ব্যথা করছে আর ধরে আসছে... একটা খুব চেনা চেনা ফুলের গন্ধ ... নামটা পেটে আসছে, জিভের ডগায় আসছে না... কুড়িকিলো কি এইখানে আজ রাতে থেকে যাবে নাকি... বড্ড শীত করছে যে... কেন এলো এখানে ফেরার সময় জিগগেস করতে হবে কায়দা করে... কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে!...

    জ্বরের ঘোরটা বেড়ে যাচ্ছে, তা মাথা আস্তে আস্তে বুকের উপরে ঝুঁকে আসছিলো, সে নিজেকেই জড়িয়ে ধরছিলো দু হাত দিয়ে, ঠিক এমন সময়ে গেটের দিক থেকে একটা তীব্র টর্চের আলো ধেয়ে এলো, আর ফোকাসটা তার উপরেই নিবদ্ধ হল, কানে এসে ধাক্কা মারলো ভ্যানের তারস্বরে প্যাঁকু প্যাঁকু হর্ন। এমনকি আরো পেছন থেকে সেই কুকুরটাও হই হই করে চিল্লিয়ে উঠলো।

    কেউ বা কারা এসেছে।

    একটা ভ্যানরিকশা গড়ানে রাস্তাটা ধরে সটান নেমে এসেছে, সওয়ারিরা প্রথমটা হয়তো হা হা করে খোলা গেট দেখে বা বাগানের মধ্যে অন্ধকারে ওইভাবে একটা মূর্তিকে বসে থাকতে দেখে হকচকিয়ে গেছলো, কেউ একজন সম্বিৎ পেয়ে চীৎকার করে উঠলো। সে ঝাপসা চোখ তুলে দেখার চেষ্টা করলো... ফোকাস ঠিক হচ্ছে না...

    হয়তো হাতে নাতে চোর ধরার উত্তেজনাতেই সবার আগে ছুটে এসেছিলো ভ্যানচালক, তার খেটে খাওয়া শক্ত হাতের মুঠোর টানে পড়্‌ পড়্‌ করে জামাটা ছিঁড়ে গেল কোথাও একটা, মাথাটা সিসের মত ভারি বলে চেষ্টা করেও সে উঠতে পারলো না, ভ্যানচালক তখন তাকে জোরে ঠেলে ফেলে দিলো সেই সিমেন্টের সিটের ওপরে আর তাকে চেপে ধরলো আর তার মাথা জোরে ঠুকে গেলো স্ল্যাবের ওপরের দিকটায় আর তার দম বন্ধ হয়ে এলো। তার ওষুধ ভর্তি খামটা নিচে পড়ে গেল।

    'ওয়েল আই নেভার প্রে
    বাট টুনাইট আ'ম অন মাই নীজ ইয়া
    আই নীড টু হিয়ার সাম সাউন্ডস দ্যাট রেকগনাইজ দ্য পেইন ইন মি, ইয়া'

    কিছু একটা ঘটেছে, চারদিক ঝলমল করছে আলোয়... কারেন্ট এলো নাকি ... আর শরীর টানছে না... তার মুখের ওপরে অনেকে ঝুঁকে পড়েছে... খালি একটা মুখ সে চিনতে পারল, হলুদ আলোয় মুখের ভাঁজগুলোর সিল্যুয়েটে অকৃত্রিম উদ্বেগ চিনতে পেরে তার ভারি নিশ্চিন্ত বোধ হয়।

    'আই লেট দ্য মেলোডি শাইন, লেট ইট ক্লীনজ মাই মাইন্ড, আই ফীল ফ্রী নাউ
    বাট দি এয়ারওয়েজ আর ক্লীন অ্যান্ড দেয়ার'স নোবডি সিংগিং টু মি নাউ'

    চারিদিকের হট্টগোল গুলো ক্রমশই দুর্বোধ্য হয়ে আসছে, কিন্তু আর কোন কর্কশ হাত, কোন রুক্ষতা তাকে স্পর্শ করে নেই। আলো, আরো আলো এসে পড়ছে, আরো কিছু গলা, কুড়িকিলোও হয়ত এসে পড়বে, সে কিছুই বুঝছে না, কিন্তু অনুভব করল সে নিরাপদ, তার জন্য ভাবার লোক আছে, কেউ তাকে চোর ভেবে মারবে না, এক ঝলকের দেখা মুখটাই তাকে বাঁচাবে নিশ্চয়ই।

    সেটাই তার জন্য অনেক। আর তার কিইবা চাইবার থাকতে পারে? এইটুকুর জন্যই সবকিছু মানিয়ে নেওয়া যায়।

    সারাদিনে এই প্রথমবার দুফোঁটা জল তার নিজের ইচ্ছেয় চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে গেল...

    ...

    ... 'কজ ইটস আ বিটারসুইট সিম্ফনি, দিস লাইফ...
  • siki | 123.242.248.130 | ২৭ ডিসেম্বর ২০১১ ১০:২৫491149
  • গুরু থেমে গেলে কেন? দম আটকে গেছে যে!!
  • Sankha | 71.187.137.148 | ২৮ ডিসেম্বর ২০১১ ০০:৫১491150
  • সিকি,

    :-)) আরে এতো মার খেলো, ডাক্তারবাবু দু তিন দিন বেডরেস্ট নিতে বলেছেন। আমি একটা ভ্যান ও জুটিয়ে দিলুম, বাড়ি ফিরতে সুবিধে হবে। একটু রেস্ট নিক। আমিও নতুন একটা গল্পে হাত দিয়েছি: অ্যাপ্রেইজালের গল্প, সেইটে শেষ করে দি ফাঁকতালে।

    তারপরে আবার ভাবতে বসবো।
  • siki | 123.242.248.130 | ২৮ ডিসেম্বর ২০১১ ১০:৫৪491151
  • দ্যাখো কাণ্ড! কোনও মানে হয়? কোথায় এমন গল্প, আর কোথায় অ্যাপ্রেইজাল। কীসে আর কীসে, চাঁদে আর ইসে ...
  • | 124.171.5.236 | ০৩ মার্চ ২০১২ ০৫:৪১491152
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন