এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • নানা দেশের উপকথা

    Omicron
    অন্যান্য | ১৮ ডিসেম্বর ২০১০ | ১১০৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • omicron | 151.141.84.114 | ১৮ ডিসেম্বর ২০১০ ২৩:১৩466922
  • এই উপকথা ব্রাজিলের। ব্রাজিলের উত্তরপূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল থেকে গল্পটি সংগ্রহ করে ১৮৮৩ সালে প্রথম গ্রন্থাকারে সঙ্কলন করেন সিলভিও রোমেরো।

    গল্পে চলে যাই। এক ছিলো রাজা আর তার ছিলো রাণী। সমুদ্রতীরে তাদের সুখের রাজ্য। প্রাসাদকেল্লা ধনজন সহায়সম্পত্তি সব ছিলো অঢেল, কিন্তু দীর্ঘকাল দাম্পত্যজীবন যাপন করেও সন্তানের মুখ দেখতে পান না রাজারাণী। রাণী মুষড়ে পড়েন, রাজা মুখ শুকনো করে রাজ্যভার পালন করতে থাকেন।

    এমন সময় দেবতা তাদের নিরুচ্চার প্রার্থনা শুনলেন, রাণী সন্তানসম্ভবা হলেন। নির্দিষ্ট সময় পরে সন্তান জন্মলাভ করলো, যমজ সন্তান। এক ফুটফুটে পরীর মতন খুদে মেয়ে আর সেই মেয়ের গলা জড়িয়ে এত্তটকু ছোট্টো একটা সাপ।

    রাজকন্যার নাম রাখা হলো মারিয়া আর সাপমেয়ের নাম হলো ডোনা লাবিস্মিনা। দুজনে একসাথে বড় হয়, খেলাধূলা করে। সমুদ্রতীরে মারিয়া ছুটে বেড়ায় আর সাপবোন জলে নেমে সাঁতরায়। খেলাশেষে বাড়ীফেরার সময় ডোনা লাবিস্মিনা এসে মারিয়ার গলা জড়িয়ে কুন্ডলী পাকায় আর রাজকুমারী খুশি হয়ে ঘরে ফেরে।অযেদিন ডোনার দেরি হয় সেদিন ছোট্টো মারিয়া কান্না জুড়ে দেয়।

    আরেকটু বড় হবার পরে একদিন সাপবোন মারিয়াকে বলে, "বোন, আমি তো আর তোর সাথে থাকতে পারবো না। সমুদ্রে চলে যেতে হবে আমাকে। কিন্তু কখনো যদি তোর কোনো সঙ্কট হয়, আমাকে স্মরণ করা মাত্র আমি আসবো।"

    ডোনা লাবিস্মিনা সমুদ্রে মিলিয়ে গেল, সেদিন খেলাশেষে একা একা মারিয়া ফিরে এলো রাজপ্রাসাদে। তারপর দিন যায়, রাজকুমারী বড় হয়, তার রূপগুণের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশেদেশান্তরে।

    পাশের দেশের এক খুব ধনী এক বুড়ো রাজা তখন সদ্য বিপত্নীক হয়েছেন, কচি একটি নতুন রাণীর জন্য তার মন আকুলিবিকুলি। দেশে দেশে ঘুরে রাজকন্যা দেখে বেড়ান। একদিন মারিয়াদের ওখানে গিয়ে তিনি হাজির। মারিয়াকে দেখে খুব মনে ধরলো, পারলে তখুনি বিয়ে করে নিয়ে যান।

    মারিয়ার মা-বাবা তো মহা খুশী, ভাবী জামাতাকে খুব আদর-আপ্যায়ন করেন। এদিকে মারিয়ার মনে সুখ নেই। ঐ কুচ্ছিত বুড়ো টাকার জোরে বিয়ে করতে চায় তাকে, সে কেন রাজি হতে বাধ্য ? ছি ছি, ও বিয়েতে রাজি হওয়ার চেয়ে সমুদ্রে ডুবে মরা ভালো যে! কোনো উপায় কি নেই? তার কি কেউ নেই?

    মনে পড়ে সাপবোনকে, সে ছুটে যায় সমুদ্রতীরে, ডাকে "ডোনা, ডোনা, ডোনা, বোন কই তুই? আমাকে যে কিনে নিয়ে যায় টাকার কুমীর এক কুচ্ছিত বুড়ো রাজা।"

    ডোনা মুহূর্তের মধ্যে হাজির। বলে, "বোন, ভয় নেই। তুই ঐ বুড়োকে বল বনের সব ফুল আঁকা বনসবুজ পোশাক যেন তোকে বানিয়ে দেয়, নাহলে তুই বিয়েতে রাজি না।"

    মারিয়া তাই করলো। বুড়োর সত্যিই অনেক টাকা, দিকে দিকে সে পোশাকের সন্ধানে লোক পাঠালো। বেশ কিছুদিন লাগলো বটে, তবে পোশাক এসে গেল।

    এবার? এবার কী হবে? ভর্ত মারিয়া আবার সাপবোনকে ডাকে। ডোনা বলে "বোন, ভয় নেই। তুই ঐ বুড়োকে বল সমুদ্রের সব মাছ আঁকা সাগরনীল পোশাক যেন তোকে বানিয়ে দেয়, নাহলে তুই বিয়েতে রাজি না।"

    মারিয়া তাই বললো, কিন্তু এবারেও কিছুদিনের মধ্যই পোশাক এসে গেল। আতঙ্কে নীল হয়ে সমুদ্রতীরে ছুটে গেল মারিয়া, আকুল হয়ে ডোনাকে ডেকে বললো, "আর বুঝি হলো না রে বোন, মরতেই হবে আমার।"

    ডোনা সাহস দেয়, বলে, "না বোন, এত সোজা না। তোর কোনো ভয় নেই। আরো কিছুটা সময় আমরা পাবো। তুই ঐ বুড়োকে বল আকাশের সব তারা আঁকা আকাশনীল পোশাক যেন তোকে বানিয়ে দেয়, নাহলে তুই বিয়েতে রাজি না।"

    মারিয়া তাই বললো, বুড়ো রাজা দিকে লোক পাঠালো। এবারে বেশ দেরি হলো কিন্তু শেষপর্যন্ত পোশাক এসে গেল। এবার?

    ডোনা নৌকার ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। রাতের অন্ধকারে কাপড়চোপড়ের পুটলি নিয়ে একা একা সেই নৌকায় চেপে বসলো মারিয়া। এবারে অকূলে পাড়ি, দেখা যাক ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যায়।

    পাশে পাশে জলে সাঁতরে আসে ডোনা, বলে, "বোন, এই নৌকা যেখানে ডাঙায় ঠেকবে সেখানে তুই নামবি। সে দেশের রাজপুত্র তোকে দেখে প্রেমে পড়বে। তোদের বিয়ে হবে, তোরা হবি রাজা আর রাণী। সুখের সংসার হবে তোর। বোন, একটা অনুরোধ। তোদের বিয়ের দিনে সমুদ্রতীরে এসে তিনবার আমায় ডাকবি নাম ধরে, তবে আমার শাপমুক্তি হবে। আমি আবার মানুষ হবো। মনে থাকবে বোন?"

    অনিশ্চিতের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে সজল চোখে মারিয়া বলে, "মনে থাকবে বোন, নিশ্চয় মনে থাকবে। আমার বিপদের দিনে তুই ছাড়া আর কেউ আমায় রক্ষা করে নি, তোর জন্য এটুকু করতে পারলে আমি ধন্য হবো।"

    ডোনা লজ্জা পায়, বলে, " না না এ আর এমনকি। কীই বা করেছি। ডাঙা কাছিয়ে এসেছে বোন, কাল সকালে তীরে ঠেকবি। আমি এবারে আসি রে।" ডোনা মিলিয়ে যায় জলের গভীরে।

    পরদিন মারিয়ার নৌকা পাড়ে ঠেকে। সে নামে। সে এক সুন্দর রাজ্য, ফুলেফলেশস্যে ঝলমল করছে। কাছেই ঝলমলে রাজপ্রাসাদ। মারিয়া রাজার কাছে কাজ চায়, রাজার বাগানে সে মালিনীর কাজ পায়।
    তারপরে দিন যায়, মারিয়া সকালসন্ধ্যা ফুলগাছে জল দেয়, ফুলগাছের পরিচর্যা করে, ফুল তুলে তোড়া বেঁধে দিয়ে আসে প্রাসাদে। তার কাজে সবাই খুশি।

    কাজ শেষ হলে পারিশ্রমিক নিয়ে আর খাবারদাবার পুঁটলি বেঁধে সে ফিরে আসে নিজের কুটিরে। খেয়েদেয়ে দাওয়ায় পাটি পেতে শুয়ে আকাশের তারাদের দিকে চেয়ে তার মনে পড়ে পূর্বজীবন, সে তখন রাজকুমারী ছিলো। সে তুলনা করে, কোন জীবনটা ভালো ছিলো, এখনকার এই গরীব স্বাধীন জীবন নাকি সেই সোনারূপোমণিমুক্তার শেকলে জড়ানো পরাধীন জীবন?

    রাজোদ্যানে পুষ্পপরিচর্যা করে দিন যায় মারিয়ার, বৃদ্ধা পুরানো মালিনী চাঁদের কণার মতন মেয়েটিকে নিজের নাতনীর মতন মনে করে খুব যত্নে কাজ শেখান। মাঝে মাঝেই আবার কেন জানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, "আহা, এমন চাঁদপানা মুখ, এ কি রোদের তাতে পোড়ার জন্য? সাত সমুদ্দুর পার থেকে রাজপুত্রেরা নৌবহর সাজিয়ে কি আসে না এই মুখেরই জন্য? আর এ মুখপোড়া আমাদের রাজপুত্তুরের কেন চোখে পড়ে না এই আশমানি ফুল?"

    মারিয়া রেগে যায়, বলে, "দাদীমা, কেন তুমি এসব কথা কও? স্বাধীনভাবে খেটেখুটে উপার্জন করে জীবন কাটাচ্ছি, ঐ সোনার খাঁচার পাখি হওয়ার চেয়ে এ কি অনেক ভালো না?"

    বুড়ী মালিনী হেসে বলে, "সেতো ভালো রে নাতনি কিন্তু ভালোবাসার বাসাও যে বড়ো ভালো। প্রার্থনা করি শীগগীর সুখের ঘর হোক তোর, সেখানে চাঁদের হাট বসুক।"

    মারিয়া অন্যদিকে সরে যায় কাজ করতে করতে, দাদীমা তার সব কথা জানলে বিস্ময়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে। সে যে রাজকন্যে ছিলো, সেই সোনার শিকল ছিঁড়তে গিয়েই যে স্বেচ্ছায় সংসারসমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছে একা। ও যে কী বিষ, সে নিজে ছাড়া কে জানে আর!

    মাঝে মাঝে মাবাবার কথা মনে পড়ে মারিয়ার, তারা না জানি কত চিন্তা করছে মারিয়ার কথা ভেবে। কিন্তু তারপরেই সে শক্ত করে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে। সে যখন পায়ে পড়ে বলেছিলো ও ধনী বুড়ো রাজার সঙ্গে বিয়ের কথা ভেঙে দিতে তখন তো তারা কান দেয় নি। তাহলে হয়তো এভাবে ঘর ছেড়ে অকূলে ভাসতে হতো না তার। এখন আর চিন্তা করে কী হবে।

    দিন যায়, রাত কাটে। একসময় উৎসবের সময় আসে সে রাজ্যে। বছরের সবচেয়ে বড়ো উৎসব, তিনদিন তিনরাত ব্যাপী চলবে নাচগান খানাপিনা। গরীব বড়লোক রাজাপ্রজা ছেলেবুড়ো সকলেই আনন্দে উদ্বেল, চারিদিকে সাজোসাজো পড়ে গেছে। এসময় ধনীগরীব সকলেই নূতন পোশাক কেনে।

    মারিয়া বাগানের কাজ করছিলো, বুড়ী মালিনী এসে তাকে একখানা পোশাক উপহার দিয়ে বলে রাত্তিরে উৎসবের জোশ বেশী, তখনই তো নাচগান হবে ভালো ভালো। মারিয়া যেন সুন্দর সেজে এই নতুন পোশাক পরে অবশ্যই নাচে যোগ দেয়।

    মারিয়া ভাবে সে বিদেশে বিভুঁইয়ে একা, আজ কোন আপনজনের হাত ধরে সে কীসের আনন্দের উৎসবে যাবে? আবার মনে হয় এই যে আত্মীয় না স্বজন না এই বৃদ্ধা তাকে নিজে থেকে আদর করে উপহার দেয়, এই বা কী কম পাওয়া?

    উৎসবদিনের সন্ধ্যায় চারিদিকে সমারোহ, আলোয় চারিদিক ঝলমল, বাজি পুড়ছে, ফানুস উড়ছে। অজস্র লোক সেজেগুজে যাচ্ছে নাচের জায়গায়। রাজারাণী চলেছেন লোকলশকর নিয়ে, রাজপুত্র চলেছেন সঙ্গীসাথী নিয়ে। উৎসবের দিনগুলিতে রাজাপ্রজা সমান।

    মারিয়া স্নানটান করে ঘরে গিয়ে পেটরা থেকে বার করলো সেই বনসবুজ পোশাকটি। সেটি পরে নিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখলো। আবার সে রাজকুমারী মারিয়া, উদ্যানপরিচারিকা মালিনীকে আর দেখা যাচ্ছে না। পোশাক আশাক গয়নাগাঁটিই কি তবে পরিচয়?

    এবারে মারিয়া চললো নৃত্যস্থলীতে, সেখানে মারিয়াকে দেখে তো সবাই স্তম্ভিত। মেঘবরণ কেশ, চম্পাবরণ কন্যা যাকে ঘিরে বনভূমির উদার নববসন্তসৌন্দর্য ঝলকে উঠছে। কে এই মেয়ে? এ কী পৃথিবীর কেউ নাকি অপ্সরোলোকের কেউ?

    রাতভোর নাচ চললো, মারিয়া নাচলো রাজপুত্তুরের সঙ্গে। রাজপুত্র ততক্ষণে যাকে বলে একেবারে পুরাই কুপোকাৎ। এমন নিরূপমা পরমাসুন্দরী মেয়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলো? এ কি স্বপ্ন? এ কি মায়া?

    শেষরাতে নাচশেষে সবাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে মারিয়া চুপি চুপি ফিরে গেল বাগানে তার ঘরখানিতে। পোশাক পালটে সাজ ধুয়ে কেশবিন্যাস খুলে আবার বাগানের মালিনী হয়ে গেল সে।

    রাজপুত্র পরদিন সকালে বাগানে এসে কেন জানি তার মুখের দিকে চেয়ে বলে," শোনো তুমি কি গেছিলে কাল রাতের নৃত্যসভায়?"

    নতমুখিনী মারিয়া বলে, " না, আমি উৎসবে যাই নি রাজপুত্র।"

    রাজপুত্র বলে, " কিছু মনে কোরো না, তোমার মুখের সঙ্গে কোথায় জানি মিল আছে তার, যে কাল রাতে নাচলো আমার সাথে।"

    হাতজোড় করে মারিয়া বলে, "আমি গরীব মানুষ রাজপুত্তুর, কী হবে আমার সঙ্গে রাজকীয় রসিকতা করে?

    বিষন্ন রাজপুত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "না না রসিকতা নয়, সে যে কোথায় চলে গেল! হয়তো আজ রাতে ---থাক, আশা করে কী হবে? " তারপরে হাত বাড়িয়ে দিয়ে সেই রাজভিখারী কাহিনির মতন সে বলে, "আমাকে একটা ফুল দেবে মালিনী?"

    মারিয়া শশব্যস্ত হয়ে ফুল এগিয়ে দেয়, রাজপুত্র ফুল নিয়ে নত হয়ে ধন্যবাদ দিয়ে চলে যায়। মারিয়া সেইখানেই দাঁড়িয়ে থাকে, নড়তে পারে না, যেন বাগানের পাথরের নারীমুর্তি।

    পরের রাতে আবার। এবারে মারিয়া পরেছে সাগরনীল পোশাকখানি। তাকে অলৌকিক রূপবতী দেখাচ্ছে। রাজপুত্র তার সাথে নাচতে নাচতে নিজের পোশাক থেকে একখানি রত্ন ছিঁড়ে গোপণে গুঁজে দিলো মারিয়ার বেণীতে।

    সবাই ঘুমালে মারিয়া চুপিসাড়ে চলে গেল নিজের ঘরে, রাজকুমারী থেকে আবার সে সাধারণ মালিনীতে পরিবর্তিত হলো।

    পরদিন সকালে খবর পেলো রাজপুত্রের খুব জ্বর, উঠতে পারে না। সে একতোড়া ফুল চাইছে কেবল। মারিয়া নিজেই গেল ফুলের তোড়া নিয়ে। রেশমীকম্বল চাপা দিয়ে কুকড়েমুকড়ে বিছানায় শুয়ে ছিলো রাজপুত্র। মারিয়া গেলে সে জ্বরে রাঙা চোখ মেলে হাত বাড়িয়ে ফুলের তোড়া নিলো, আর দেখলো তোড়ার একেবারে মাঝের ফুলগুলোর মাঝখানে সেই গোপণে দেওয়া রত্নটি জ্বলজ্বল করছে!

    একমুহূর্তে কম্বলটম্বল সরিয়ে সে উঠে বিছানা থেকে নেমে পড়লো, কোথায় গেল তার জ্বর, কোথায় গেল তার অসুখ! আনন্দে পাগলের মতন হয়ে গিয়ে উদ্দাম নাচতে নাচতে সে বললো, "আমি জানতাম, আমি জানতাম, আমি জানতাম তুমিই সেই।"

    সেই সন্ধ্যায় মারিয়ার বিয়ে হলো রাজপুত্রের সাথে। মারিয়া পরেছিলো আকাশনীল সেই পোশাক যাতে সব তারা জ্বলজ্বল করছে। তার চেয়েও বেশী জ্বলজ্বল করছিলো নবদম্পতির চোখমুখ।

    কিন্তু হায়, সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে মারিয়া ভুলে গেল দুখের সাথী সাপবোনটির কথা। ডোনা লাবিস্মিনার নাম ধরে তিনবার আর তার ডাকা হলো না সাগরের তীরে এসে। শাপমুক্তি হলো না সাপবোনের। তাই আজো সমুদ্র কেঁদে কেঁদে আছড়ে পড়ে বালুকাবেলায়।

    (শেষ)
  • hu | 71.201.25.54 | ১৮ ডিসেম্বর ২০১০ ২৩:২৪466933
  • বাহ!
  • omicron | 151.141.84.114 | ১৮ ডিসেম্বর ২০১০ ২৩:৩৪466937
  • এটা ইনুইটদের মধ্যে প্রচলিত গল্প।

    এক ছিলো বিরাট মহাসাগর, তার হিমজলে বরফ ভেসে বেড়াতো। সেই মহাসাগরে সাঁতরে বেড়াতো মস্ত মস্ত তিমি। তারা মনের সুখে জলের ফোয়ারা তুলে নি:শ্বাস ছাড়তো আর সাগরের ক্রিল খেতো।

    এক ছিলো হামবড়াইওয়ালা কাক, সে ডাঙার কাছের ঢেউয়ের উপরে উপরে উড়তো আর ফিরে এসে অন্যদের কাছে বাহাদুরি করতো সে একদিন এক বিরাট তিমি শিকার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে।

    এরকম চলতে চলতে একদিন সবাই কাককে জোরসে চেপে ধরলো, বড় বড় তিমির একটা দল এসেছে কাছে, যাও একটা শিকার করে আনো।

    কাক আর কী করে, চললো উড়ে। তিমির নি:শ্বাসের ফোয়ারা দেখেই তো তার প্রাণ উড়ে যায় আরকি। তবু কোনোরকমে দম ধরে সে আরো কাছে গিয়ে দেখতে গেল। অমনি কী থেকে কী হলো, কাক হুশ করে ঢুকে গেল এক বিরাট তিমির মুখের ভিতরে।

    ঢুকে তো সে অবাক! দিব্যি নিকোনো ঝিকোনো পরিপাটী ঘরবারান্দা। ভেতরের ছোটো ঘরে একখানি লন্ঠন জ্বলছে আর তার পাশে বসে আছে এক সুন্দরী মেয়ে। সে খুব মন দিয়ে লন্ঠনটার পরিচর্যা করছে।

    মেয়েটা হেসে কাককে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললো, "আরে এসো, বসো। কী খাবে বালো।"

    মেয়েটা কাককে খাবার দাবার পানীয় এনে দেয় আর বারে বারে সতর্ক করে দেয় লন্ঠনটার দিকে কিন্তু যেও না ভাই।

    কাক মনের সুখে খায় দায় আর দেখে মেয়েটা ভারী চঞ্চল, কেবল দৌড়ে দৌড়ে বাইরে যায় আর ঘরে আসে।

    কাক বলে, "এত ছোটাছুটি করছো কেন ভাই? শান্ত হয়ে বসো না।"

    মেয়েটা হেসে বলে, " না, আমি শান্ত হয়ে বসলে চলবে না। জীবন জিনিসটাই এরকম, কেবল ছোটাছুটি।"

    কাক আদরে-যত্নে থাকে কিন্তু মেয়েটা আর তার চোখের মণির মতন আগলে রাখা লন্ঠনের রহস্য কিছু বোঝে না। একদিন যেই মেয়েটা বাইরে গেছে কাক দিয়েছে লন্ঠনে টান, অমনি সেটা পড়ে গিয়ে নিভে গেছে। সেটা নিভে যেতেই চারিদিকে জীবনের আলো নিভে গিয়ে মৃত্যুর গন্ধে ভরে উঠেছে। আর সেই মেয়েটা ? সে আর ফিরলো না।

    কোনোরকমে হাঁচোড় পাচোড় করে কাক বেরিয়ে এলো। এতক্ষণে সে বুঝলো সেই জ্বলন্ত লন্ঠনখানা ছিলো তিমির জ্যান্ত হৃৎপিন্ড আর ছোটাছুটি করা মেয়েটা ছিলো তার প্রাণ। লন্ঠন নিভে যেতেই তিমি মরে গেছে। না বুঝে টানাটানি করতে গিয়ে কাক হয়েছে সেই তিমির মৃত্যুর কারণ।

    মৃত তিমির পিঠের উপরে বসে থাকা মুহ্যমান কাককে অন্যরা উদ্ধার করলো কয়েকদিন বাদে। সে এত বড়ো তিমি শিকার করেছে বলে সবাই তাকে শাবাস দিলো কিন্তু কাক চুপ করে রইলো।

    তারপর থেকে সে আর কখনো কারুর কাছে বাহাদুরি করতো না। মাঝে মাঝে তাকে দেখা যেতো ঢেউয়ের উপরে উপরে উড়তে, কাউকে সে বলতো না সে এমন করে কেন। সে নিজে জানতো যে সৌন্দর্যকে সে না বুঝে হত্যা করেছিলো তাকে ফিরে পাবার আশায় সে দিন গোণে।

    ___
  • omicron | 151.141.84.114 | ১৮ ডিসেম্বর ২০১০ ২৩:৩৯466938
  • আফ্রিকান উপকথা-নাটিকী

    দক্ষিণ আফ্রিকার Namaqualand অঞ্চলে প্রচলিত ছিলো এই উপকথা। এই উপকথার প্রতিধ্বনি আছে ইউরোপের সিন্ডারেলার গল্পে।অআরো নানা দেশের উপকথাতেও এইধরনের কাহিনি রয়েছে। এই গল্প ক্লদিয়েন কোয়েৎজে বলেছেন ইংরেজীতে, ছোটোবেলায় গল্পটা তিনি শুনেছিলেন ট্রিয়েন্‌ৎজিয়ে কোয়েকাস এর মুখে, কোয়েকাস বিখ্যাত Nama গল্পকথক, তাদের গল্পের থলিওলা ঠানদিদি।

    আকাশিয়া আর মস্ত মস্ত ফণীমনসার পিছনে কালাহারি মরুতে সূর্যাস্ত হচ্ছিলো। শিকারীরা বন থেকে ফিরে আসছিলো কাঁধে মৃত হরিণ ঝুলিয়ে, তাদের মুখে ক্লান্ত কিন্তু পরিতৃপ্ত হাসি। বড় বড় কাঠের থামে ঘেরা গ্রামে তখন উনুনে আঁচ পড়ছিলো, কুটিরে কুটিরে ছিলো হাসিগল্পের আওয়াজ।

    নাটিকীর দুই দিদি খুব করে মুখেচোখেহাতেপায়ে তেল লাগাচ্ছিলো, চুলে আঠা লাগাচ্ছিল, পায়ে ঝুমুর বাঁধছিলো। পূর্ণিমা রাত নামবে খানিক পরেই, চাঁদের আলোয় নাচ হবে কিনা, তখন তাদের তেলচকচকে চাঁদমুখে চাঁদনি লেগে যা লাগবে না, আহা! তরুণ শিকারীদের মাথা ঘুরে যাবে।

    নাটিকীর খুব ইচ্ছে সেও নাচে যায়, মাকে একবার বলেছিলো সে। কিন্তু মা তো স্‌ৎ মা কিনা, সে নাটিকীর উপরে সবসময়েই খাপ্পা। সোজা বলে দিলো, "যা, ছাগলগুলোকে বাইরে থেকে আন, ছাগলের ঘরে ঢোকা, রাত নামলে নেকড়ে কি শিয়ালে নেবে যে! কাঠ কুড়িয়ে আন, আগুনটা উসকে দে। কাজকর্ম কিছু কর, বয়স তো কম হোলো না। তা না ড্যাং ড্যাং করে নাচতে যাবেন তিনি!"

    নাটিকী আগে বুঝতো না, এখন বুঝতে পারে স্‌ৎমা আর স্‌ৎবোনেরা তাকে দু'চোখে দেখতে পারে না। তাদের খুব হিংসে, তাদের চেয়ে নাটিকী যে অনেক বেশী সুন্দরী। নাচের আসরে সে গেলে সবাই যে হাঁ করে নাটিকীর দিকেই চেয়ে থাকবে, তাই তাকে কিছুতেই সঙ্গে নেয় না ওরা।

    নাটিকী মনখারাপ করে মাঠে গেল ছাগলদের আনতে। তাদের নিয়ে ফিরে এসে সে দেখে মা আর দুই দিদি চলে গেছে নাচের জায়গায়। সে তখন রাঁধবার জায়গায় গিয়ে উনুনে নতুন করে আগুন দিয়ে বসলো সাজতে। আগুনে আঠা গরম হতে দিয়ে ভালো করে হাতেপায়েমুখে তেল লাগিয়ে চকচকে করলো। চুল আঁচড়ালো, ভালো কারে আঠা লাগালো। শক্ত ভুট্টাবেণী করলো মাথা জুড়ে, বেণীর ডগায় ডগায় লাগালো পুঁতির ঝালর। গলায় পরলো চকচকে বড় পুঁতির মালা। ঝুম ঝুম আওয়াজ করা একরকম শুকনো ফল লতায় গেঁথে গেঁথে সে পায়ের নূপুর বানালো, তারপরে পরলো। সব সেরে সে বন থেকে কুড়িয়ে আনা সজারুর কাঁটা নিলো চামড়ার থলিতে। তারপরে রওনা হলো।

    পূর্ণিমার চাঁদ তখন আকাশের অনেক উপরে উঠেছে, বেশ রাত হয়েছে। নাটিকী তো জানে না ঠিক কোনখানে নাচের আসর বসেছে। সে পথ চলে আর একটা করে সজারুর কাঁটা মাটিতে গেঁথে দেয় পথের পাশে। যদি শেষ অবধি খুঁজে সে নাও পায় সেই জায়গা, ফিরে তো আসতে পারবে!

    সামনে একটা উঁচু টিলা, নাটিকী উঠলো তার চূড়ায়। উঠেই দেখতে পেলো দূরে মাঠের মাঝখানে বড় আগুন, তাকে ঘিরে অনেক মানুষ। ঐখানেই তাহলে নাচের আসর? নাটিকী কী করবে? যাবে ওখানে নাকি ফিরে যাবে? স্‌ৎমা আর স্‌ৎদিদিরা আছে সেখানে, ওরা যদি রাগ করে?

    ভাবতে ভাবতে এগোয় নাটিকী, আগুনে মাংস ঝলসানো হচ্ছে, তার খিদে পাওয়ানো গন্ধ এসে লাগে নাটিকীর নাকে। তার মনে পড়ে সে সেই দুপুরের পর থেকে আর কিছু খায় নি, খুব খিদে পেয়েছে। ওখানে গেলে কিছু তো খেতে পাওয়া যাবে।

    সে থেমে থেমে এগোয়, তার পায়ের নূপুর ঝুম ঝুম করে, যেন তাকে সাহস দিয়ে বলে, "ভয় কী মেয়ে? এগিয়ে যা।"

    আগুনের কাছে এসে নাটিকী একপাশে দাঁড়ায়, ভীড়ের সুযোগ নিয়ে নিজেকে আড়াল করে স্‌ৎমা আর স্‌ৎবোনেদের কাছ থেকে। কিন্তু একসময় আগুনের আলোয় তাকে তারা দেখে। চিনতে কিন্তু পারে না। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে- কে এই মেয়ে? কাদের মেয়ে? এত পরে এসেছে? এমন একা একা?

    এক পাশে হাতে তাল দিয়ে দিয়ে গান গাইছিলো মহিলারা, নাটিকী গিয়ে যোগ দিলো। সেও তাল দিয়ে গাইতে থাকলো, প্রথমে বাধো বাধো ঠেকছিলো তার, কোনোদিন এভাবে জনসমক্ষে সে তো গায় নি! কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ডুবে গেল সুরে-তালে-ছন্দে। আর তার মনে রইলো না সে মা-হারা অভাগী মেয়ে, স্‌ৎ মা আর স্‌ৎবোনেরা তাকে দাসীর মতন দেখে, যত্ন আত্তি তো দূরের কথা, উঠতে বসতে তাকে মা-খাকী বলে গাল দেয়। তার মনে হলো এই খোলা আকাশের নিচে চাঁদের আলোয় ধোয়া মাঠে উঙ্কÄল আগুনের পাশে আনন্দিত মানুষের ভীড়ে সে একজন খুব হাসিখুশী সুন্দরী মেয়ে, এখুনি তার স্বপ্নে দেখা রাজপুত্তুর এসে তাকে বলবে, "তুমি কে গো? তুমি কি বনপরী?"

    শিকারীরা দল বেঁধে গোল হয়ে নাচছিলো, নাচের দলের এক তরুণ শিকারী নাটিকীর দিকে চেয়ে হাসলো। নাটিকী লাজে রাঙা হয়ে মুখ নামিয়ে নিলো। যখন মুখ তুললো তখন দেখে সেই শিকারী তার দিকেই চেয়ে আছে।

    রাত আরো বাড়ে, এবারে লোকেরা বাড়ী যাবার যোগাড় শুরু করে। নাটিকীর দুই স্‌ৎ দিদি বড় বড় হাই তুলছিলো। দেখে স্‌ৎ মা বললো, " অনেক রাত হলো মেয়েরা। এবারে বাড়ীর দিকে রওনা হতে হয়। নে, তোরা আর একবার করে মাংস নে। খাওয়া হলেই ঘরের দিকে রওনা দেবো আমরা।" খাওয়া শেষ হলে তারা সত্যি বাড়ীর দিকে রওনা হয়।

    নাটিকীর এসব দেখার মতন মন ছিলো না। সে আরো অনেকক্ষণ গান গায় গানের দলের মহিলাদের সাথে, চাঁদ পশ্চিমে ঢলে যখন রাত শেষদিকে, তখন আসর ভাঙে। সেই তরুণ শিকারী বলে, "চলো, আমি তোমায় এগিয়ে দিই।"

    নাটিকীর ফেলে যাওয়া সজারুকাঁটা দেখে দেখে তারা ফিরতে থাকে। সেই শিকারী খুব নরম গলায় নাটিকীর কাছে তার কথা জানতে চায়, কে সে, কাদের মেয়ে, কারা তার মাবাপভাইবোন? এতদিন পরে একজন সহৃদয় মানুষ পেয়ে নাটিকী সব কথা খুলে বলে-তার দু:সহ জীবন, স্‌ৎমা আর স্‌ৎবোনেদের অত্যাচারের কথা, নাটিকী দেখতে সুন্দর বলে তাদের ঈর্ষার অন্ত নেই, তারা তাকে কোথাও যেতে দেয় না, তাকে দিয়ে সব কাজ করায়, তার সঙ্গে নিত্য খারাপ ব্যবহার করে। কথা বলতে বলতে ভয়ে কেঁপে ওঠে নাটিকী, আজকে ঘরে ফিরলে তাকে আস্ত খেয়ে ফেলবে তার স্‌ৎমা। একে তো সে না জানিয়ে গেছিলো নাচের আসরে, আবার ফিরছে এক পুরুষমানুষের সঙ্গে!

    তরুণ শিকারী বলে, "তোমার কোনো ভয় নেই নাটিকী। আমি তোমাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাবো। তোমার স্‌ৎ মায়ের সঙ্গে আজই বরং কথা বলে বিয়ে পাকা করে ফেলি।"

    ওরা অপেক্ষাতেই ছিলো, দূর থেকে তাদের দেখেই বড় দিদি হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠলো,"মা, তোমার গুণনিধি স্‌ৎমেয়ের কান্ড দ্যাখো। ঢলানি এক নাগর জুটিয়ে ফিরছেন। ঝাঁটাপেটা করো মা, ঝেঁটিয়ে বিষ ঝেড়ে দাও ঐ অবাধ্য মেয়ের, চুলগুলো মুড়িয়ে কেটে ওকে ন্যাড়া করে দাও। পিঠে দাগ দিয়ে দাও লোহা গরম করে ছ্যাঁকা দিয়ে।"

    নাটিকী ভয়ে কাঁপছিলো, স্‌ৎমা আগুনখাকীর মতন ছুটে এলো, " হারামজাদী, আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন। আজ মুড়োঝ্যাঁটা দিয়ে ঝেঁটিয়ে তোর সব বিষ আমি জম্মের মতন ঝাড়বো, লোহা পুড়িয়ে ছ্যাঁকা দিয়ে দাগী করে দেবো জম্মের মতন। সব ঢলানিপনা ঘুচিয়ে দেবো আজ। " নাটিকীর গলাটা খিমচে ধরার জন্য হাত বাড়ালো স্‌ৎমা।

    নাটিকী পর্যন্ত পৌঁছালো না সে হাত, সেই শিকারী হালকা একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো, "শুনুন, আমি নাটিকীকে নিয়ে যাচ্ছি। গাঁওবুড়ার কাছে গিয়ে বিয়ের অনুমতি চাইবো, পঞ্চজনের সাক্ষী রেখে রীতি মেনে বিয়ে হবে। নাটিকীর কোনো অভাব যাতে কোনোদিন না হয়, সে আমি দেখবো।"

    স্‌ৎ মা তো হাঁ! বিস্ময়ে মুখ থেকে কথাই বেরোলো না খানিকক্ষণ। তারপরে সামলে নিয়ে বললো, "এ হতভাগীকে বিয়ে করে কী লাভ তোমার ভালোমানুষের ছেলে? এ অপদার্থ মেয়ে, না পারে ঘরের কাজ, না পারে বাইরের কাজ। এক কাজ করতে গেলে দশ অকাজ করে। তোমার জীবন ছারখার হয়ে যাবে, ছেলে। তারচেয়ে আমার এই অন্য দুটি মেয়ের একটিকে তুমি নাও না বেছে! আহা, এদের যেমন গুণ তেমন রূপ! দশ হাতে কাজ করে তোমার সংসার উজিয়ে তুলবে।"

    শিকারী হেসে বলে, "তা যা বলেছেন। গলা শুনেই টের পেয়েছি। চেঁচানির চোটেই আমার একখানা সংসার একেবারে দশখানা হয়ে যাবে। এসো নাটিকী, আমরা যাই।" নাটিকীর হাত ধরে সে দ্রুত হাঁটা দেয়।

    শিকারী নাটিকীকে নিয়ে যায় অনেক দূরে তার আপন মানুষজনের মাঝে। সেখানে তারা এমন পরমাসুন্দরী আর অশেষ গুণবতী নাটিকীকে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। অল্প সময়েই নাটিকী সবার আপন হয়ে গেল।

    নাটিকীর স্‌ৎমা আর স্‌ৎবোনেরা এখন খাটতে খাটতে নাজেহাল হয়ে নাটিকীকে গাল দেয়, " নাটিকী, বদমাইশ মেয়ে, একদিন তোকে পাবো হাতের মুঠায়। ঐ ছোকরা ক'দিন রাখবে তোকে? দু'দিন ফুর্তি করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যাবে। তখন দেখিস কী হয়। কোন কালামুখ নিয়ে তুই ফিরবি তখন ঘরে? কিছুতেই ঘরে নেবো না আমরা তখন। " এসব বলে আর ভাবে নাটিকী ফিরলে তারা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে! ও ছুঁড়ী যে এত কাজ করতো তা তো বোঝা যেতো না! এখন তারা তিনজনে মিলে সেই একজনের কাজ সামলাতে পারছে না!

    নিজের সংসারে নাটিকীর এখন চাঁদের হাট, উঠানে খেলা করে বেড়ায় তার শিশুরা, কলকল করে কথা বলে। শিকার করে তাদের বাবা ফিরলে দৌড়ে গিয়ে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নাটিকী দৌড়ে গিয়ে নিজের কোলে নেয় তাদের, বলে, " আরে কী দুষ্টু হয়েছে বাচ্চারা! আরে তোদের বাবাকে জিরোতে দে একটু, হাত মুখ ধুয়ে কিছু মুখে দিক, তারপরে তো গল্প বলবে! আসামাত্র কেউ এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে? "

    হাতমুখ ধুয়ে জিরোলে পর স্বামীকে আর বাচ্চাদের খেতে দিয়ে নিজের খাওয়া দাওয়াও সেরে নেয় সে। তারপরে তার শিকারী স্বামী তার বাচ্চাদের গল্প শোনায়, সেও শোনে। বাচ্চারা সবচেয়ে ভালোবাসে সেই নাচের রাতের গল্প, যেখানে একটা ছেলে একটা মেয়েকে দেখে চমকে উঠে ভেবেছিলো এ কে? এ কি বনপরী?

    নাটিকী আনন্দাশ্রু গোপণ করে, তার সত্যিই আর কোনো অভাব নেই।
  • Nina | 68.84.239.41 | ১৯ ডিসেম্বর ২০১০ ০৯:১৭466939
  • বাহ! এই তো জমে গেছে --ওমি, চলুক, চলুক!
    হুচে--তোরও কয়েকটা হোক না!
  • omi | 151.141.84.194 | ২০ ডিসেম্বর ২০১০ ২৩:০৮466940
  • আরো কয়েকটা উপকথা জমানো আছে ফিরিজে। এট্টু গরম করেই দিয়ে দেবো। :-)
  • omicron | 151.141.84.114 | ২১ ডিসেম্বর ২০১০ ০০:১০466941
  • এটা অ্যাজটেক উপকথা। মহান সর্পদেবতা কেট্‌জালকোয়াটল এর গল্প।

    কেট্‌জালকোয়াটল ছিলো দেবতাদের নগরীর সর্বজনশ্রদ্ধেয় রাজা। বিশুদ্ধ, নিষ্পাপ ও পরম উত্তম। জাগতিক কামনাবাসনা তাকে তখনো স্পর্শ করতে পারে নি। কোনো কাজই তাঁর কাছে হীন কাজ ছিলো না, সে রাজা হয়েও অনায়াসে পথঘাট ঝাঁট দিতো মস্ত এক ঝাড়ু নিয়ে, যাতে বৃষ্টিদেবতারা তারপরে এসে ভালোভাবে বৃষ্টি দিতে পারেন।

    কেট্‌জালকোয়াটল এর এক কুটিলচরিত্রের ভাই ছিলো, নাম তার টেজকাটলিপোকা। সে কেট্‌জালকোয়াটল এর এই সবদিকে একেবারে সবসেরা চরিত্র আর তা নিয়ে অন্যদের নিরন্তর প্রশংসায় একেবারে ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে মরতো। সে কেট্‌জালকোয়াটলের ভালোত্ব ভাঙতে এক জটিল চাল চাললো। একদিন সে তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে এসে কেট্‌জালকোয়াটলকে বললো, " ভাই, তুমি সারাক্ষণ খালি কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকো। সর্বক্ষণ খালি কাজ আর কাজ। এছাড়া জগতে কি আর কিছু নেই? আজ আমাদের উৎসবের দিন, তুমি আমাদের সঙ্গে আনন্দউৎসবে যোগ না দিলে আমাদের সব আয়োজন বৃথা। আসবে না ভাই?" খুব আন্তরিক গলা। অভিনয় চম্‌ৎকার পারতো টেজকাটলিপোকা।

    কেট্‌জালকোয়াটল কোনো সন্দেহ করে নি, সে সহজসরল মনে যোগ দিয়েছে উৎসবে। এদিকে টেজকাটলিপোকা সুযোগ বুঝে বার করেছে যাদু আয়না আর কেট্‌জালকোয়াটলের চোখের সামনে দিয়েছে বাড়িয়ে সেটা। যেই না যাদু-আয়নায় নিজেকে দেখতে পেয়েছে কেট্‌জালকোয়াটল, সে দেখেছে তার পবিত্র সর্পদেহ বদলে যাচ্ছে মানুষদেহে, সে ভয়ে চিৎকার করে উঠেছে। কিন্তু তখন খুব দেরি হয়ে গেছে, জাগতিক কামনাবাসনা আগুনের মতন তাকে ছেয়ে ফেলেছে ততক্ষণে। আতঙ্কে আর দু:খে অচেতন হয়ে পড়লো সে।

    পরদিন জেগে উঠে কেট্‌জালকোয়াটল দেখলো তার পাশে বসে আছে তার আরেক ভাই, জোলোটল। এই ভাই খুব ভালো, ছোটোবেলা থেকেই তার খুব ঘনিষ্ঠ সঙ্গী। কেট্‌জালকোয়াটল তার কাছে কেঁদে বললো, "এই দেহ নিয়ে কেমন করে আমি প্রিয় প্রজাদের সামনে যাবো? না না, তা কিছুতেই পারবো না। কী কুক্ষণে গতকাল আমি ওদের পার্টিতে যোগ দিয়েছিলাম! হায়, এখন কী হবে? কোথায় গেল আমার সেই শুদ্ধ পবিত্র জীবন! এই কুৎসিত মানবদেহ, এ অপবিত্র মুখ আমি দেখাতে পারবো না। আমার অবসর নিয়ে আড়ালে চলে যাওয়াই ভালো।"

    জোলোটল বলে, " ভাই, এত ভেঙে পোড়ো না তুমি। রাজা হয়ে তুমি যদি এমন ভেঙে পড়ো, তোমার প্রজাদের মনোবল আরও ভেঙে যাবে। তুমি নিজেও জানো যে টেজকাটলিপোকা তাই চায়। তোমার এই চেহারার সমস্যার আমি একটা টেম্পোরারি সমাধান করতে পারি যদি তুমি রাজী হও।"

    কেট্‌জালকোয়াটল আগ্রহী গলায় বলে, "সমাধান? করতে পারো? কেমন করে?"

    জোলোটল বলে," তুমি যদি রাজী হও আমি এমন পোশাক আর মেকাপ দিতে পারি যে তোমাকে প্রায় আগের মতনই দেখাবে।"

    কেট্‌জালকোয়াটল সাগ্রহে রাজী হয়।

    জোলোটল যত্ন করে এক মস্ত পোশাক বানায় কেটজাল পাখির সবুজ, লাল আর সাদা পালক দিয়ে। আরো বানায় পরচুলা আর দাড়ি। ঠোঁট কপাল গাল রঙ করে দেয়, একটা মুখোশও বানায় টার্কোয়েজ দিয়ে। এইসব পরে কেট্‌জালকোয়াটল হয় পালকওয়ালা সর্পদেব।

    এই ছদ্মবেশে কেট্‌জালকোয়াটল প্রজাপালন আর নিয়মিত কাজকর্ম করে যেতে থাকে নিখুঁতভাবে। জাগতিক কামনাবাসনাকে প্রশমিত করে রাখে সতর্কতার সাথে। জোলোটল তাকে কাজকর্মে আর যুক্তিপরামর্শে সবদিকে সাহায্য করে।

    কিন্তু টেজকাটলিপোকা এত সহজে ছেড়ে দেবার বান্দাই না। সে আবার আরেক ফন্দি আঁটে। আবার কান্নাকাটি আর আন্তরিকতার অভিনয় করে কেট্‌জালকোয়াটলকে আরেক উৎসবে যোগ দিতে রাজী করায়। সেইখানে কড়া সুরা পান করিয়ে কেট্‌জালকোয়াটলকে সে প্রায় অচেতন করে ফেলে। তারপরে তাকে দিয়ে এমন এক কাজ করায় যা ভনক। কেট্‌জালকোয়াটলের তখন বিচারবিবেচনার অবস্থা ছিলো না, থাকলে সে নিজের মরার পথ নিজে তৈরী করতো না। পরদিন জেগে উঠে সব শুনে শোকে মুহ্যমান হয়ে যায়, সে যা করেছে তা গড়িত অপরাধ।

    কেট্‌জালকোয়াটল আত্মাহুতির জন্য তৈরী হয়। পাথরের বাক্সে সে চারদিন শুয়ে থাকে, তারপরে উঠে নিজের সমস্ত প্রিয় জিনিস ঐ বাক্সে দিতে বলে। তারপরে তার নির্দেশে ঐ বাক্স নিয়ে ভৃত্যরা সমুদ্রতীরে যায়। সেখানে বিরাট অগ্নিকুন্ড তৈরী করে তাতে আগুন দেয় কেট্‌জালকোয়াটল নিজেই, তারপরে বাক্সসমেত উঠে বসে সেই চিতায়। প্রজাদের জলভরা চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তাদের প্রাণপ্রিয় রাজা। জোলোটল নিজেও আত্মাহুতি দেয়।

    চারদিন চাররাত চললো নীরন্ধ্র অন্ধকার। ঊষা উদিত হলো না, দিন এলো না। কেট্‌জালকোয়াটল আর জোলোটল তখন পাতালে, মৃত্যুলোকে। সেখানে তাদের পিতা মৃত্যুদেবতা মিকত্‌লানতেকুহটলি তাদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে যান অস্থিকক্ষে। সেখানে প্রাচীন হাড়গোড় ছিলো, সেগুলি তাদের দিয়ে বলেন, "এগুলি নিয়ে তোমরা পৃথিবীতে ফিরে যাও। এগুলির থেকে তোমরা মানুষ বানাও, পৃথিবীকে মনুষ্যপূর্ণ করো। বাছা কেট্‌জালকোয়াটল, মানুষ বলে তাদের ঘৃণা কোরো না, অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও এদের মধ্যে অমিত সম্ভাবনা আছে। সেই সম্ভাবনাকে প্রস্ফুটিত হতে সাহায্য করো তোমরা।"

    কেট্‌জালকোয়াটল আর জোলোটল হাড় নিয়ে ফিরে এলো। আবার দিন শুরু হলো অন্ধকার পার হয়ে।

    হাড়গুলির উপরে মন্ত্র পড়ে পড়ে নিজের রক্ত ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিলো কেট্‌জালকোয়াটল, জোলোটল সাহায্য করলো। মানুষজাতির সৃষ্টি হলো। কেট্‌জালকোয়াটল তাদের শেখাল চাষবাস আর কাপড় বোনা। তাছাড়া জেডপাথরপালিশ আর মোজাইক বানানূ শেখালো। সময় মাপতে শেখালো, বছরে মাসে ভাগ করতে শেখালো সময়কে, নানা ঋতুর পর্যায়ক্রমে আসা যাওয়ার জ্ঞানও তাদের দিলো সে।

    তারপরে একদিন সব শেখানো সমাপ্ত হলে কেট্‌জালকোয়াটল আর জোলোটল নৌকায় চড়ে চলে গেল সমুদ্রপথে পুবের দিকে। যাবার সময় তারা বলে গেল, " তোমরা ভয় পেও না, তোমাদের যা শিখিয়ে গেলাম তা ভালোভাবে ব্যবহার করে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করো। একদিন সময় হলে আবার আমরা আসবো।"

    তাদের নৌকা ভেসে গেছে দূর থেকে দূরে, মিলিয়ে গেছে ঐ যেখানে আকাশ এসে জলে মিশেছে সেইখানে। সেই থেকে মানবজাতি নিজেদের দায়িত্ব নিজেই নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে আর অপেক্ষা করছে সেইদিনের, যেদিন ফিরে আসবে কেট্‌জালকোয়াটল।
  • Nina | 67.133.199.254 | ২১ ডিসেম্বর ২০১০ ০৩:৫৭466942
  • বাহ!
  • M | 59.93.254.155 | ২১ ডিসেম্বর ২০১০ ১৫:৩৬466943
  • খুব সুন্দর
  • omicron | 151.141.84.114 | ২২ ডিসেম্বর ২০১০ ০৫:২৪466923
  • এই গল্পটির আখ্যানভাগ নেটিভ আমেরিকান কারোক উপজাতির উপকথা থেকে সংগৃহীত।

    সে অনেক অনেকদিন আগের কথা। তখন আগুন শুধু আগুন-মানুষদের কাছে ছিলো। তারা কাউকে তা দিতো না, খুব সাবধানে পাহারা দিয়ে রাখতো। মাঠে জঙ্গলে কত পশুপাখি, গ্রামে কত মানুষ-তারা কেউ আগুন পায় না। বসন্তে গ্রীষ্মে সুখের দিন, কোনো কষ্ট হয় না। কিন্তু শীতের দিনে ভারী কষ্ট। বুড়ো আর কচিরা অনেকে শীতে কষ্ট পেয়ে মারা যায়।

    এমন তো চলতে পারে না-ঋক্ষবান ভাবে। বনকুসুমীর কোলে কচি ছেলে, সামনের শীতে সে যদি না বাঁচে? বনকুসুমী সেই দুশ্চিন্তায় কুঁকড়ে যায়।

    বনমালী বলে, "কিছু একটা করতে হবে।"

    মন্ডুক মাথা দুলিয়ে বলে, "করতে হবেই কিছু। কিন্তু কী করা যায়?"

    বলাকা বলে," কায়োটেকে ডাকি। সে সবচেয়ে চালাক। একটা না একটা বুদ্ধি বার করবেই।"

    কায়োটে এসে বলে, "নো প্রবলেম। জাস্ট রিল্যাক্স। আমরা আগুন নিয়ে আসবো। ঐ স্বার্থপর আগুনমানুষেরা চিরকাল আগুন নিজেদের কাছে রেখে দেবে নাকি? তা হবে না, কায়োটে থাকতে তা হতে পারে না। "

    সবাই ভুরু তুলে বলে, "আগুন নিয়ে আসবে? কেমন করে?"

    মিচকি মিচকি হেসে কায়োটে বলে, "আমার একটা প্ল্যান আছে। এসো আমি তোমাদের বলি কী করতে হবে।"

    কায়োটের প্ল্যান মত সবাই তৈরী হলো। তারপরে একদিন পাহাড়ের পাশ দিয়ে ঘোরানো প্যাঁচানো রাস্তা দিয়ে তারা পাঁচজনে মিলে চললো আগুনমানুষদের পাথুরে বাড়ীর দিকে। সকলের গায়ে রঙীন উল্কি, নানা রঙে ছোপানো পোশাক। কায়োটের মাথায় মস্ত এক পালকের মুকুট।

    নদী পার হয়ে শুকনো শনঝোপ, তারপরে ছোট্টো একটা জঙ্গল, তারপরে এক বিরাট মাঠ। সেই মাঠের পরপারে আগুন মানুষদের বিরাট পাথুরে বাড়ী, বেড়া দিয়ে ঘেরা উঠোন। কড়া পাহারা।

    কায়োটে, ঋক্ষবান, মন্ডুক, বলাকা আর বনমালী গিয়ে পৌঁছালো সেখানে। আগুনমানুষদের বাড়ীর দুয়ারে গিয়ে বললো যে তারা যাযাবর, অনেক দূর থেকে হেঁটে হেঁটে আসতে আসতে তারা খুব ক্লান্ত আর ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর। যদি আশ্রয় পায় কিছুক্ষণের জন্য আর সামান্য খাদ্যপানীয়, তাহলে খুবই কৃতজ্ঞ থাকবে তারা।

    আগুন মানুষেরা প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় না, বলে, "তোমরা যে আমাদের জিনিস চুরি করে নিয়ে পালাবে না তার গ্যারান্টী কী?"

    কায়োটে একেবারে বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলে, "কী যে বলেন! আমরা সামান্য ধুলামাখা যাযাবর, আমরা আপনাদের জিনিস নিয়ে কি করবো ? আমরা তো আর আপনাদের ঘরে যাবো না, উঠানে বসতে দিলেই আমাদের পক্ষে ঢের। আহ, খুব ক্লান্ত আমরা। আপনাদের মতন দলু মানুষেরা থাকতে আমরা পাঁচটা অসহায় মানুষ খিদেতেষ্টায় মারা যাবো, এই কি একটা ন্যায়কথা হলো, বলুন?" কায়োটে এমন হাঁফানোর ভঙ্গী করে যেন এখুনি লুটিয়ে পড়ে মরে যাবে।

    আগুন মানুষেরা ভালো করে তাদের ঝুলিঝোলা ঝেড়েঝুড়ে দেখে তাদের ভিতরে নিয়ে গেল। উঠানে তাদের বসতে দিলো মাদুর বিছিয়ে, খেতে দিলো আর জল দিলো। পথশ্রমে ক্লান্ত তারা পাঁচজন খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লো।

    ভালো করে একঘুম দিয়ে তারা যখন উঠলো তখন বেলা আর নেই, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চোখমুখ ডলতে ডলতে মস্ত হাই তুলে কায়োটে বলে, "আরে এত দেরি হয়ে গেল? এই অন্ধকারে যাবো কিকরে আমরা?"

    আগুন মানুষেরা উঠানের মাঝখানে আগুনের কুন্ডে তখন আগুন জ্বালিয়েছে, একদিকে রান্নাবান্না হচ্ছে, সুরাপানও তারা শুরু করে দিয়েছে। রঙীন চোখে তাদের নেতা এসে হাসতে হাসতে বলে, "আরে যাযাবররা যে! ঘুম কেমন হলো? তোমরা রাতে আর যাবে কোথা? আমাদের নাচাগানা হবে একটু পরেই। খাওয়াদাওয়াও। যোগ দাও তোমরাও।" সে সবাইকে সুরাপাত্র এগিয়ে এগিয়ে দেয়।

    যাযাবরেরা হাস্যবিগলিত মুখে ধন্যবাদ দিয়ে পাত্র গ্রহণ করে, আর মুখের কাছে তুলে চুমুক দেবার অভিনয় করে। কায়োটে আগেই প্ল্যানের সময়েই সবাইকে ভালো করে সতর্ক করে দিয়েছিলো যেন ভুলেও তারা আগুনমানুষদের মাদক না পান করে।

    খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে নাচ শুরু হলো আগুন ঘিরে। কায়োটে তো একেবারে পরম উৎসাহে নাচতে নাচতে তারস্বরে গানও গাইছে। আগুন মানুষেরা তারিফ করে খুব। একসময় সে খুলে রাখা পালকের মুকুটটা পরে নেয়, তাতে নাচ আরো জমে।

    এদিকে নাচতে নাচতে আগুন মানুষদের খেয়াল হয় নি রাত অনেক হয়েছে, আগুনও কেমন নিবু নিবু হয়ে এসেছে। কায়োটে বলে "আরে উসকে দাও আলো, অন্ধকারে কি নাচ জমে?"

    আগুনমানুষদের নেতা যেই নতুন কাঠকুটো আগুন ছুঁড়ে দিয়ে আগুন খুঁচিয়ে দিয়েছে লম্বা দন্ড দিয়ে, মস্ত মস্ত শিখা লাফিয়ে উঠেছে। খুব কাছে ছিলো কায়োটে, মাথা নুইয়ে সে পালকমুকুটে ধরিয়ে নিলো আগুন।

    তারপরে ছুট ছুট ছুট, তারা পাঁচজনে দৌড়। আগুন মানুষেরা তো "আরে রে রেরে নিয়ে গেলো রে আমাদের আগুন চুরি করে নিয়ে গেল যাযাবরেরা, ধর ব্যাটাদের ধর" বলে তাড়া করেছে। কায়োটের হাতে আগুন জ্বলা মুকুট, আগুনমানুষেরা তাকে প্রায় ধরে ধরে। সে ছুঁড়ে দিলো মুকুট বনমালীর দিকে, বনমালী লুফে নিয়ে দৌড়। আগুনমানুষেরা এবারে বনমালীর দিকে দৌড়, ধরে ধরে অবস্থায় সে আগুন ছুঁড়ে দেয় বলাকার দিকে। তাড়া করে আসা লোকেরা এবারে বলাকার দিকে দৌড়ায়। এইভাবে আগুন হাত থেকে হাতে ফিরতে থাকে, আগুন মানুষেরা তাদের ধরতে পারে না। এদিকে দৌড়াতে দৌড়াতে তারা এসে গেছে মাঠ পার হয়ে সেই শুকনো গাছের কাছে। কায়োটে আগুন আছড়ে ফেলে গাছে, দাউ দাউ ধরে যায়।

    আর চিন্তা নেই, এবারে আর কেড়ে নিতে পারবে না আগুন। ব্যর্থ আগুনমানুষেরা গালাগাল দিতে দিতে ফিরে যায়। কায়োটে, বনমালী, ঋক্ষবান, বলাকা আর মন্ডুক পাঁচটি শুকনো ডালের ডগায় আগুন ধরিয়ে নিয়ে ফিরে যায় তাদের গ্রামে। তারপর থেকে আর তাদের শীতের কষ্ট হয় নি। আর কায়োটে হয়ে যায় তাদের চিরকালের বীর নায়ক।

    ডিসক্লেমার: নামগুলোর ব্যাপারে কিছুটা স্বাধীনতা নেওয়া হয়েছে বাংলায় মানানসই লাগানোর জন্য।

  • Shuchismita | 71.201.25.54 | ২৩ ডিসেম্বর ২০১০ ১৭:৪৭466924
  • ছায়াপথের কথা
    -----------

    ছায়াপথ নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে নানা গল্প আছে। তারই কিছু অনুবাদ করব।

    গল্প – ১ (উৎস: সপ্তম শতাব্দীর জাপান। তবে আদতে নাকি গল্পটি চীন থেকে জাপানে এসেছে)
    ----------------------------------------------------------------

    জাপানদেশে কামি নামে এক দেবতা ছিলেন। তিনি হলেন স্বর্গের রাজা। ইন্দ্র বলা চলে, তবে আমাদের ইন্দ্রের মত ফাঁকিবাজ নন মোটেই। পৃথিবীটা নিয়ম মেনে চলছে কিনা, সবাই মন দিয়ে নিজের কাজ করছে কিনা সেসব দিকে কামির কড়া নজর। কামির একটি মেয়ে। তার নাম তানাবাতা। যেমন তার রূপ, তেমনি গুণ। তার মত সুতো কাটতে আর কাপড় বুনতে আর কেউ পারত না। তার বোনা কাপড় ছাড়া কামির মনই উঠত না। রোজ ভোরে সূর্যের প্রথম আলোটি যে মুহুর্তে স্বর্গপূরীর দুয়োরে এসে কড়া নাড়ে, তানাবাতা অমনি তার তাঁতটি নিয়ে কাজে লেগে যায়। সারাদিন ধরে সূর্য চলে আকাশপথে, তানাবাতার তাঁত থামে না। সুতো ঘুরতে থাকে সামনে পিছে, তার থেকে নামে ছন্দ, ছন্দ থেকে আসে কবিতা। দিনের শেষে সূর্য যখন পরিক্রমা শেষ করে, সবাই দেখে তানাবাতা তার বাবার জন্য বানিয়ে ফেলেছে সবচেয়ে সূক্ষতম কাপড়, আর নিজের জন্য আস্ত একখানি কবিতা।

    একদিন তানাবাতা নিজের ঘরে বসে তাঁত বুনছে, এমন সময় এক মানুষ এসে দাঁড়ায় তার দুয়োরে। মানুষটি বড় রূপবান। একপাল গরু-মহিষ নিয়ে সে চরাতে যাচ্ছে কোথাও। তানাবাতাকে সে বলল, ‘আমি রোজ যাই এই পথে আর তোমাদের উঠোনে কাপড় শুকোতে দেখি। এত সুন্দর কাপড় আমি আর কোত্থাও দেখি নি। তুমি বুঝি এই কাপড় বোনো?’ তানাবাতা ভারী লাজুক মেয়ে। সে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। মানুষটি এবার বলল, ‘আমার নাম হিকোবুশি। তোমার নামটি তো বললে না?’ তানাবাতা চোখ তুলে হিকোবুশির দিকে তাকাল আর দেখা মাত্র মানুষটিকে খুব পছন্দ হয়ে গেল তার। কোনমতে নিজের নামটি বলল তাকে। হিকোবুশিরও ভারী ভালো লেগেছে এই মেয়েটিকে। সে সাহস করে বলল, ‘আমি যাচ্ছি এই গরু-মহিষ চরাতে সামনের সবুজ মাঠে। হাঁটবে একটু আমার সাথে?’ যদিও সারাদিন ধরে কাপড় বোনাই তানাবাতার কাজ, তবু তার খুব ইচ্ছে হল এই মানুষটির সাথে খানিক ঘুরে আসে। সে তার তাঁত রেখে হিকোবুশির সাথে বেরোল। সবুজ মখমলের মত মায়াবী মাঠে খরগোস ছুটে বেড়াচ্ছে, কাঠবেড়ালী তিড়িং-বিড়িং করছে ইতি-উতি, একটি ইঁদুর গর্ত থেকে মুখ বার করেই আবার লুকিয়ে পড়ল – তানাবাতা বহুদিন এভাবে বাইরে বেরোয় নি। হিকোবুশি তার কোমরবন্ধ থেকে ছোট্ট বাঁশিটি বার করে বাজাতে লাগল। সুর ভাসছে আকাশে-বাতাসে। গুচ্ছ গুচ্ছ উঙ্কÄল রঙীন ফুল ফুটে আছে। তানাবাতা ভারী যত্ন করে হিকোবুশির জন্য বুনোফুলের কোমরবন্ধ বানিয়ে দিল। কবিতা জন্মাল আবার – হিকোবুশির সুরে, সেই মায়াভরা মাঠের উঙ্কÄলতায় আর তানাবাতার যত্নে।

    সন্ধ্যে নামে। হিকোবুশিকে নিয়ে তানাবাতা ঘরে ফিরল। কামির কাছে গিয়ে বলল, ‘বাবা, আমি হিকোবুশিকে বিয়ে করতে চাই’। কামি অরাজি হলেন না। তানাবাতা আর হিকোবুশির বিয়ে হল। কাছেই একটি ছোট্ট কুটিরে নতুন সংসার পাতল তারা। তানাবাতার তাঁত বসল বসার ঘরে। হিকোবুশির গরু-মহিষের পাল সবুজ মাঠে চরে বেড়াতে লাগল। নবদম্পতি নিজেদের নিয়ে মগ্ন। হিকোবুশি বাঁশিতে সুর তোলে, তানাবাতার মনে কবিতারা জন্ম নেয়। সূর্যদেবতা কতবার আকাশ এপার-ওপার করল – হিকোবুশির সুর থামল না, তানাবাতার কবিতারা পথ ভুলল না। আর এদিকে তাঁতে জমল ধুলো, গরু-মহিষের দল কে কোথায় ছিটকে গেল কে জানে!

    কামি বহুদিন ধরে দেখছিলেন আর ক্রমশই তাঁর রাগ বাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্য রইল না। ‘দিনের পর দিন কাজে অবহেলা করেছ তোমরা। তাই তোমাদের আলাদা করে দেব চিরকালের মত’– এই বলে কামি স্বর্গের বাঁধ খুলে দিলেন আর তক্ষুনি সাপের ফণার মত উন্মত্ত জলরাশি আছড়ে পড়ল হিকোবুশি আর তানাবাতার মাঝখানে। তানাবাতা দেখল হিকোবুশি বহুদূরে সরে যাচ্ছে। আবছা হতে হতে শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে গেল সে। তাদের দুজনের মধ্যে যোজনবিস্তৃত অনন্ত জলধারা বয়ে চলল আজীবন। পৃথিবীর মানুষেরা তাকেই চেনে ছায়াপথ বলে।

    তবে দু:খের গল্প আমার ভালো লাগে না। জাপানীদেরও লাগত না। এই গল্পও তাই এখানেই শেষ নয়। তানাবাতার দিন চলে আগের মত। সূর্য এসে ঘুম ভাঙায়। সে তার তাঁতটি নিয়ে বসে কামির জন্য কাপড় বানাতে। হিকোবুশির কথা ভেবে মন ভারী হয়ে ওঠে, হাত চলে না। দিনের শেষে কামি এসে দেখেন তাঁর নতুন বানানো কাপড় মেয়ের চোখের জলে ভেজা। তানাবাতা বলে, ‘বাবা, আমার কাজে ভুল হচ্ছে। আমি জানি আমার শাস্তিই প্রাপ্য। তোমার জন্য তিনভুবনের সেরা কাপড় বানাতাম আমি। কিন্তু সে কাপড় আমি আর বুনতে পারছি না। হিকোবুশি চলে যাওয়ার পর আমার মন ভেঙে গেছে। যদি আমাকে আবার আগের মত কাপড় বুনতে হয়, তাহলে এটুকু আশা অন্তত আমায় দাও যে একদিন না একদিন সামান্যতম সময়ের জন্যও আবার হিকোবুশির সাথে আমার দেখা হবে’। কামি দেখলেন এই প্রার্থনা মঞ্জুর করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তিনি বললেন, ‘বেশ তাই হবে। বছরে একবার, সপ্তম মাসের সপ্তম রাতে তুমি হিকোবুশিকে দেখতে পাবে। তবে হ্যাঁ, যদি সেই রাত মেঘমুক্ত থাকে তবেই। আমার নির্দেশে এক হাজার পাখি এসে তখন সেতু বেঁধে দেবে নদীর ওপর। সেই সেতুর ওপর দেখা হবে তোমার আর হিকোবুশির’

    সেই থেকে প্রতি বছর অগাস্ট মাসের সপ্তমীতে হিকোবুশি আর তানাবাতা অপেক্ষা করে থাকে মেঘমুক্ত আকাশের জন্য। আগেকার দিনে অগাস্ট মাস পড়লেই জাপানীরা কচি সবুজ বাঁশের একটি টুকরো সাজিয়ে রাখত তাদের বাগানে। বাঁশের গায়ে রঙীন কাগজএ কবিতা লিখে ঝুলিয়ে দিত। এই উৎসবের নাম ছিল তানাবাতা-সামা। অগাস্ট মাস তারাখসার মাস। গ্রীক পুরাণে যাকে আমরা পারসিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জ বলে জানি, আকাশের সেই প্রান্ত থেকে অগাস্ট মাসে উল্কাবৃষ্টি হয়। সপ্তমী তিথিতে যদি আকাশ পরিস্কার থাকে, যদি তারাদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় এদিক-ওদিক তাহলে জাপানীরা জানে কামির নির্দেশে হাজার পাখির দল সেতু গড়ছে আকাশ-নদীতে। একটু পরেই দেখা হবে হিকোবুশি আর তানাবাতার। আর যদি মেঘে ভরা থাকে আকাশ? তাহলে আবার অপেক্ষা এক বছরের জন্য। হিকোবুশি ফিরে যাবে তার গরু-মহিষের কাছে। তানাবাতা আবার বসবে তার তাঁতে। আর দিন গুনবে পরের বছরের সপ্তম মাসের সপ্তম দিনটির জন্য। জাপানী গৃহস্থ বাগানে সাজিয়ে রাখা সবুজ বাঁশটি ভাসিয়ে দেবে নদীতে। ঢেউয়ের দোলা খেতে খেতে সেটা ক্রমশ হারিয়ে যাবে চোখের আড়ালে।

  • Netai | 121.241.98.225 | ২৩ ডিসেম্বর ২০১০ ১৯:২১466925
  • সবকটা গল্পই দারুন
  • Shuchismita | 71.201.25.54 | ২৪ ডিসেম্বর ২০১০ ০৮:২৩466926
  • গল্প – ২ (উৎস: টোবা ইন্ডিয়ান, আর্জেন্টিনা)
    --------------------------------

    [টোবা ইন্ডিয়ানদের দেখা পাওয়া যাবে দক্ষিণ আমেরিকার গ্‌র্‌যান চাকো অঞ্চলে। বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে আর আর্জেন্টিনার সীমান্তবর্তী এই এলাকা দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণতম অঞ্চলগুলির একটি। টোবারা ছিল যাযাবর। পঞ্চাশ-ষাট জনের ছোট ছোট দলে ঘুরে বেড়াত। খরাপ্রবণ এই অঞ্চলে খাবার খুঁজে পাওয়াই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় চিন্তা। তাদের ছায়াপথের গল্পও তাই খিদের গল্প।

    টোবাদের কল্পনায় সূর্য হল এক জরাগ্রস্ত বুড়ি। কচ্ছপের মত খসখসে ভারী শরীর সে অতি কষ্টে বয়ে নিয়ে চলে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। দিন যেন ফুরোতেই চায় না।

    দক্ষিণ আমেরিকার ঐ অঞ্চলে গ্রীষ্মের দিনগুলি দীর্ঘ, অগ্নিবর্ষী – তাই কি সূর্যের তুলনা কচ্ছপের সাথে?]

    সেটা ছিল গ্রীষ্মকাল। সূর্যবুড়ি সবে ঘুম ভেঙে উঠেছে। আমাদের গল্পের নায়ক চিন্নি, একটি চাতকপাখী, মন দিয়ে খাদের ওপর বিপজ্জনক ভাবে ঝুলে থাকা নড়বড়ে সাঁকোটা মেরামত করছিল। সাঁকো বলতে কিছুই না – একখানি গাছের গুঁড়ি। যেন আধশোয়া হয়ে ঠেস দিয়েছে এই পাহাড় থেকে ঐ পাহাড়ে। মধ্যিখানে গভীর খাদ। এপার থেকে ওপারের গাছগুলিকে দেখায় ঘন সবুজ। এদিকের মত ঝলসানো নয়। খাবারের আকাল পড়লে ওদিক পানে যাওয়া ছাড়া উপায় কি! অথচ দেখ, পারাপারের ধকল নিতে নিতে কেমন জীর্ণ হয়েছে সাঁকোটা। এখনই না সারালে যে কোন মুহুর্তে ভেঙে পড়বে। এইসব ভাবতে ভাবতে জলদি ঠোঁট চালায় চিন্নি। কারোব গাছের ঝুরি দিয়ে কষে বাঁধতে থাকে সাঁকোটাকে পাথরের সাথে।

    এমন সময় হাসির আওয়াজ শোনা যায়। টুকটাক দুয়েকটা কথা। দীর্ঘশ্বাস। চিন্নি দেখতে পায় দশ-বারোটি মেয়ের একটি দল এদিক পানে আসছে। - ‘সেই সকাল থেকে খুঁজে খুঁজে কি পেলাম দেখ! এক টুকরো কন্দ। তাও আবার পচা। এটা তুই কার মুখে দিবি বল!’–‘এখনই হাল ছেড়ে দিলি! সূয্যিবুড়ি তো এখনও খাপই খোলে নি’। - ‘চল ঐ কারোব গাছের ছায়ায় জিরৈ দু’দন্ড। তারপর ঠিক করা যাবে কোন দিকে যাওয়া যায়’। ওরা চিন্নির পাশে এসেই বসে। খেয়ালই করে না চিন্নিকে। গ্রীষ্মকাল। এই সাত সকালেও রোদ্দুর ঠা ঠা করছে। ওরই মধ্যে একটু হাওয়া খেলে। চানার ফলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে সেই হাওয়ায়। - ‘কি মিষ্টি বাস গো!’– মেয়ের দলের সবচেয়ে ছোটটি পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় খাদের দিকে –‘ঐ দেখ, ঐ পারে ফল ধরে আছে গাছে! কেমন রাঙা, আগুনরঙা ফল! ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে গাছটা! চল দিদি, ওপারে যাই আমরা’। চানার ফলের গন্ধে সকলেরই মরে থাকা খিদে চনমন করে উঠেছে। - ‘কিন্তু যাবি কি করে? এই গভীর খাদ পেরোব কি করে আমরা?’–‘আরে! এই দেখ! এই ঝোপের আড়ালে একখানা গাছের গুঁড়ি পাতা রয়েছে এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে। আর চিন্তা কিসের? চল চল!’–‘না না, এখনও কাজ শেষ হয়নি আমার, এখনই উঠো না তোমরা সাঁকোতে’– চেঁচিয়ে ওঠে চিন্নি। কিন্তু চিন্নির ভাষা মেয়েরা বুঝতেই পারে না। তাদের চোখে তখন আগুনরঙা ফল, পেটে গনগনে খিদে। সাঁকোর ওপর ছুটতে থাকে তারা। ওপারে পৌঁছতে হবে জলদি! খাদের মধ্যে শোঁ শোঁ করে হাওয়া দেয়। পাথরের দেওয়ালে দেওয়ালে সে হাওয়া পাক খেতে খেতে উল্টো ধাক্কা দেয় জরাজীর্ণ সাঁকোতে। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে নড়বড়ে কাঠের গুঁড়ি সবকটা মেয়েকে নিয়ে। তাদের আর ওপারে যাওয়া হল না কোনদিন।

    চিন্নি থুম মেরে বসে আছে খাদের কিনারে। সূর্যবুড়ি আগুন ঢালছে মাথার ওপর। একটু আগে যেখানে সাঁকোটা ছিল এখন সেখানে সেখানে হাঁ হাঁ করছে খাদ। ঝোপের মধ্যে খড়মড় শব্দ হয়। চিন্নি নড়চড়ে বসে। লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে আসে এক সারস। - ‘কে হে তুমি? কোত্থেকে আসছ?’– শুধোয় চিন্নি। - ‘আসছি বহুদূর থেকে। সেখানে সব খাবার ফুরিয়েছে’। - ‘যাবে কোথায়?’–‘আর কোথায়! যেখানে খাবার আছে সেইখানে! শুনেছি ওদিকের পাহাড়ে এখনও খরা নামে নি। কিন্তু পেরোব কি করে? কাছাকাছি কোন সাঁকো নেই?’–‘ছিল হে। এখানেই ছিল’– বিমর্ষ চিন্নি বলে –‘ভার নিতে পারল না। ভেঙে পড়ল চোখের সামনে। নড়বড় করছিল যখন সারাবার চেষ্টা করেছিলাম। নতুন সাঁকো বানাব এমন কারিগর তো আমি নই!’–‘কিচ্ছুটি ভেবো না তুমি। আমি বানিয়ে দেব নতুন সাঁকো’– বলল সারস। লম্বা শক্ত ঠোঁট দিয়ে কাঠ চিরে তক্তা বানাতে শুরু করে দিল। গাছের ঝুরি দিয়ে কষে বাঁধল তাদের। তারপর পাম গাছের পাতা দিয়ে সুন্দর রেলিং বানিয়ে দিল একখানা। সূর্যবুড়ি ততক্ষণে পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে। - ‘কই হে চিন্নি! নতুন সাঁকোটা কেমন হল দেখে যাও একবার!’– হাঁক দেয় সারস। –‘বাহ! তুমি তো ভারি কাজের মানুষ হে! সাঁকোর মত সাঁকো হয়েছে একটা’– তারিফ করে চিন্নি –‘চলো যাওয়া যাক তাহলে ওপারে’। - ‘দাঁড়াও, কাজ বাকি থেকে গেছে একটা’– বলল সারস –‘এখানে বড় ঝোপঝাড়। একটা পথ বানাতে হবে যাতে সবাই সাঁকোটা দেখতে পায়। খাবারের খোঁজে এসে সাঁকো খুঁজে না পেয়ে ফিরে যেতে হলে সে ভারী বিশ্রী ব্যাপার হবে’। পশ্চিম আকাশ লাল করে সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। সারস সেই রঙে রঙ মিলিয়ে ঝোপে আগুন ধরিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ল গাছ থেকে গাছে। মস্ত বড় সাদা ধোঁয়ার কুন্ডলী পাক খেতে খেতে উঠতে লাগল আকাশপানে। চিন্নি দেখল অন্ধকার আকাশের বুক চিরে এগিয়ে চলছে একটা উঙ্কÄল সাদা পথ – নাগাইক – সেই পথ ধরে হাঁটলে খাওয়া-পরার আর একটুও অভাব থাকবে না।

  • omicron | 151.141.84.114 | ২৫ ডিসেম্বর ২০১০ ০০:৪২466927
  • স্কটিশ উপকথা: সুজন ও সমুদ্রকুমারী

    সমুদ্রতীরের ছোট্টো গ্রামে থাকতো সুজন। বাপদাদাদের আমল থেকে তারা দক্ষ জেলে, সমুদ্রে মাছ ধরাই তাদের প্রধান কাজ। সুজন কিশোর বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে যেত মাছ ধরতে। এখন তার বাবা-মা দুজনেই পরলোকে, এখন সে একাই মাছ ধরতে যায় নিজের নৌকা, জাল আর লোকজন নিয়ে।

    সুজন কাজেকর্মে যেমন দড় তেমনি দেখতেও ভারী চম্‌ৎকার। তার সতেজ সবল দীর্ঘ চেহারা দেখে সবাই খুব প্রীত হয়। গ্রামের কুমারী মেয়েরা তাকে বিবাহ করার জন্য পাগল। কত সম্বন্ধ আসে সুজনের কাছে। কিন্তু সুজন সব ফিরিয়ে দেয়। সে বিবাহ বন্ধনে বাধা পড়তে চায় না, সে বলে, "এই বেশ ভালো আছি। সংসার করা মানেই হাজার হ্যাপা, আজ বৌ বলবে "এনে দে রেশমী চুড়ি/ নইলে যাবো বাপের বাড়ী/ দিবি বলে কাল কাটালি/ জানি তোর জারিজুরি", কাল ঠোঁট ফুলিয়ে বলবে "বলেছিলি যে স্নোপাউডার পমেটম এনে দিবি, কই সেসব? " পরদিন বলবে, "সোনার সুতায় কাজকরা রেশমীশাড়ী চাই আমার, এখুনি এনে দে, নইলে এক থাপ্পড়ে তোর দাঁতের হালি ফেলে দিবো, হ্যাঁ"-- ওরে বাপ রে, সে যেন সেধে খাল কেটে কুমীর আনা। ভাবলেই গায়ে জ্বর আসে।

    দিন যায়, সুজন সারাদিন কাজকর্ম করে আর দিনের শেষে মাছটাছ সব হাটে চালান হয়ে গেলে সেদিনের পারিশ্রমিক সহকারীদের ঠিকঠাকমতন গুণে দিয়ে গুণগুণ গান গাইতে গাইতে একা ঘরে ফিরে আসে নিজের উপার্জন নিয়ে।

    একদিন সে ফিরছিলো অমন, বেলাশেষের রাঙা আলোয় আকাশ ভরে আছে, সমুদ্র টলটল করছে পাত্রের কানায় কানায় ভরা রঙীন সুরার মতন। উতল বাতাস বইছে, ফাগুণ হাওয়া। সমুদ্রের দিকে চেয়ে সুজনের বুক হু হু করে উঠলো, " মনের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে / যার চোখ তাকে আর মনে পড়ে না/ আর কোনো চোখ তবু মনে ধরে না।" কে সে? তাকে কি গত জন্মে সে দেখেছিলো কোনোদিন?

    সমুদ্রে ছোটোবড়ো শিলা মাথা জাগিয়ে আছে, ওখানে সেল্কি মেয়েরা খেলছিলো। সেল্কি হলো জলমানুষ, ওরা সীলের চামড়া পরে থাকে। খেলার সময় চামড়া খুলে রেখেছে পাথরের উপরে, খুব আনন্দে সাঁতার কাটছে জলকন্যারা, একে অন্যের দিকে জল ছুঁড়ছে, হী হী হী হী করে হাসছে। সেই হাসিতে ভরে উঠছে ফাগুণ বাতাস, চরাচরে যেন স্বর্ণবৃষ্টি হচ্ছে। সুজন এত অবাক হয়েছে যে গতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে, একবার চোখের উপরে হাত বুলিয়ে নিয়ে বুঝে নিলো স্বপ্ন দেখছে কিনা। স্বপ্ন না, সত্যি! সেল্কিরা তাহলে গল্পকথা নয়, এরা তাহলে সত্যি আছে!

    সম্বিত ফিরে পেয়ে চুপি চুপি গুঁড়ি মেরে সুজন এগোলো পাথরগুলোর দিকে, ওগুলো বেশী জলে না, সুজনের কোমরজল হবে ওখানে। একটা সীলচামড়া খুব কাছে, সেটা একটান মেরে নিয়েই সুজন জলছপছপ করে পাড়ের দিকে দৌড় দিলো। জলকন্যারা টের পেয়ে গেছে, সব্বোনাশ। ডাঙার মানুষ দেখে ফেলেছে ওদের। পড়ি কি মরি কে এসে সবাই ঝটাপট সীলচামড়া পরে ফেলেছে আর জলের উপরে মাথা জাগিয়ে দেখছে ডাঙার মানুষটাকে। পাড়ের দিকে যেতে যেতে সুজন ফিরে তাকিয়ে দেখে সেল্কিরা তার দিকে চেয়ে আছে নীরবে।

    সব মাথা সীলের শুধু একটা মাথা এক মেয়ের, সে মেয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, "ওগো ডাঙার মানুষ, ডাঙার মানুষ, দ করো আমায়। সীলের চামড়াটা ফেরত দাও গো, ওটা ছাড়া আমি সমুদ্রে থাকতে পারবো না। ওগো ভালোমানুষের ছেলে, নিজের উপরেও তো দ আশা করো তুমি, তবে আমাকে কেন দ করবে না? "

    সুজনের হৃদয় বিগলিত হয় করুণায়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে জলপ্রপাতের মতন নেমে আসে ভালোবাসার অনুভূতি। জীবনে সেই প্রথম। জলের মধ্যে কাঁদছে ঐ অপার্থিব সুন্দরী তরুণী, গভীর সমুদ্রের মতন তার চোখ, জলজ্যোৎস্নার মতন তার বরণ, ঝড়ের মেঘের মতন তার কেশরাশি, সেই তো তার স্বপ্নে দেখা মেয়ে, যার জন্য আজও সে কঠোর কৌমার্যব্রত ধারণ করে আছে!

    সুজন বলে, "সাগর কন্যা, আমায় বিয়ে করবে? "

    সাগরকন্যা অবাক হয়ে বলে, "তোমায় কেমন করে বিয়ে করবো? আমি যে সাগরের মানুষ!"

    সুজন বলে, " তাতে কী? তুমি দিব্যি ডাঙায় থাকতে পারবে, এই এখন যেমন নি:শ্বাস নিচ্ছ তেমন নেবে। তোমার দু'খান পা ও তো আছে, হাঁটতেও পারবে চম্‌ৎকার! প্রথম প্রথম আমি না হয় ধরে ধরে তোমায় হাঁটাবো। ঐ পাহাড়ের চূড়ায় প্রার্থনাভবন, সেখানে আমাদের বিয়ে হবে। তুমি আমার সঙ্গে ডাঙায় থাকবে। এখানে কত কিছু আছে, পাহাড় আছে, নদী আছে, হাট আছে বাজার আছে সব তোমায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবো। তোমায় কিনে দেবো সোনার চুড়ি রেশমী শাড়ী স্নো পাউডার পমেটম আতর যা তুমি চাও। অমত করিস না কন্যে, পায়ে পড়ি তোর। আমি তাহলে বাঁচবো না।"

    সমুদ্রকুমারীর খুব একটা ইচ্ছা ছিলো কিনা কেজানে, কিন্তু সুজনের হাতে তার প্রাণভোমরা সিলচামড়াটা, সমুদ্রকুমারী রাজি হয়ে গেল সুজনের আরেকটু কষাকষির পরে।

    পরদিন পাহাড়ের চূড়ার প্রার্থনাভবনে সুজনের সাথে বিবাহ হলো সমুদ্রকুমারীর। রাঙাচেলি পরা, মাথায় মুকুট, সারা গায়ে ফুলের গহনা। পৃথিবীর সাজে সমুদ্রকুমারীর রূপ যেন ফেটে পড়ছে। সারা গাঁয়ের লোক ভেঙে পড়লো দেখতে, নতুন বৌয়ের রূপ দেখে তো তারা থ। এ কি পৃথিবীর মেয়ে? এত রূপ কি মাটির পৃথিবীর মানুষের থাকে? এ যে সেই রূপকথালোকের কুঁচবরণ কন্যা মেঘবরণ চুল! সুজন এ মেয়ে পেল কোথা?

    সুজন বলছিলো বৌ তার মামাবাড়ীর গাঁয়ের মেয়ে, ভাটির দেশে বাড়ী তার। আজই মাত্র এসে পৌঁছেছে, আগে কেউ দেখে নি কিনা, তাতেই লোকে অবাক হচ্ছে।

    সুজন তার নতুন বৌ নিয়ে সুখে সংসার শুরু করে, বৌ ও কদিনের মধ্যেই দিব্যি মানিয়ে নেয়, গাঁয়ের মানুষদের দিব্যি আপনজন হয়ে যায়। এমন আশ্চর্যসুন্দর মেয়ে, তার উপরে স্বভাবটিও বড় মনকাড়া, সবাই তাকে খুব ভালোবেসে ফেলে। তার উপরে এ নতুন বৌয়ের গুণ কত, কেমন সুন্দর গান গায়, কেমন সুন্দর আশ্চর্য সব রান্নাবান্না করে, এমন সুন্দর হাতের কাজ!

    বৌ রাঁধে বাড়ে ঘর গোছায় বাগান করে, সুজন সারাদিন কাজ করে আর মনে মনে ভাবে আহা, দিনের শেষে বৌয়ের কাছে ফিরে আসবে। বৌ কোনোদিন কিছু চায় না, তবু রোজই তার জন্য কিছু না কিছু উপহার নিয়ে ফেরে সুজন।

    ***

    দেখতে দেখতে দিন যায় মাস যায় বছরের পর বছর ঘোরে। তাদের ঘরে চারটি ফুটফুটে ছেলে আর তিনটি ফুটফুটি মেয়ে জন্মায়। সবাই ভারী খুশী। শিশুদের কলরবে খেলাধূলায় হুটোপাটিতে ভরে ওঠে তাদের ঘর উঠান বাগান, সুজনের নিজের জীবনটাকে ধন্য মনে হয়।

    আর সমুদ্রকন্যা? সেও বাচ্চাদের নাওয়ায় খাওয়ায় তাদের সঙ্গে হাসে, খেলা করে কিন্তু যখন সুজন থাকে না, তখন সে তন্নতন্ন করে ঘরে খোঁজে সেই সীলচামড়া! কোথায় সুজন রেখেছে ওটা? কোনোদিন কি পাওয়া যাবে না? কোনোদিন যদি পাওয়া যায়-

    এমনি করে আরো কত বছর কেটে যায়। ছেলেমেয়েরা এখন বেশ বড়ো। বড়ো তিন ছেলে তো বাবার সঙ্গে সমুদ্রে যায় মাছ ধরতে। তারপরের চারজনও এখন বেশ বড়, সমুদ্রতীরে তারা শুধু খেলাই করে না, ঝিনুক কাঁকড়া এসব খাদ্য সংগ্রহ করে আনে।

    একদিন সুজন সমুদ্রে গেছে বড় তিন ছেলেকে নিয়ে আর পরের তিনজন ছেলেমেয়ে সমুদ্রতীরে কাঁকড়া সংগ্রহ করছে। সবচেয়ে ছোটো মেয়েটির পায়ে ব্যথা বলে সে বাড়ীতে আছে।

    সে দ্যাখে তার মা এখানে সেখানে কীজানি খোঁজে আর খোঁজে। সে বলে, "মা মাগো, তুমি কী খোঁজো? "

    তার মা বলে, " ছোট্টো মনা রে, তোর ব্যাথা পায়ে জড়িয়ে দেবো বলে একটা সীলের চামড়া খুঁজি।"

    মেয়ে হেসে বলে, " একটা সীলচামড়া কোথায় আছে আমি জা-আ-নি। "

    তার মা থমকে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকায়, বলে " কোথায়?"

    মেয়ে বলে, "বললে কী দেবে? মিষ্টি পিঠা দেবে? লাল মালা দেবে? গোলাপী জামা দেবে?"

    অস্থির হয়ে তার মা বলে, "দেবো, সব দেবো। কোথায় ওটা?"

    মেয়ে হাত দিয়ে দেখায়, ঐ যেখানে দুই দেয়াল মিশেছে ছাদে, সেই কোণায় একটা ঝাপ আলগা, তার ভিতরে খানিকটা জায়গা আছে, সেখানে লুকানো ওটা। সে বলে, " একদিন দেখেছিলাম। মা তুমি তখন হাটে গেছিলে, সেদিন বাবা সেটা বার করে দেখে আবার ঢুকিয়ে রেখেছিলো। ওটা কি খুব দামী চামড়া মা? "

    মুহূর্তের মধ্যে সমুদ্রকন্যা সেটা বার করে আনে, তার হারানো মানিক! সীলচামড়াটা বুকের কাছে চেপে ধরে গভীর করে শ্বাস নেয়। কতকাল পরে, আহা সে যে কতকাল-

    এতকালের অবরুদ্ধ অশ্রু বন্যার মত নেমে আসে তার দুই গাল ভাসিয়ে।
    মেয়ে অবাক হয়ে গেছে, সে তো মাকে আগে এভাবে ঝরঝরিয়ে কাঁদতে দেখেনি কখনো।

    মা তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলে, "আসি রে সোনামণি। তোদের সাথে আর দেখা হবে না। তোরা ভালো থাকিস, তোরা ভালো থাকিস।"

    সাগরকন্যা সীলচামড়া পরে নিয়ে সমুদ্রের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আহা, এতকাল পরে সে তার প্রিয়তমের কাছে ফিরে যাচ্ছে।

    সুজনের নৌকা ফিরছিলো তখন, তার পাশ দিয়ে সাঁতরে যাবার সময় মুখের ঢাকা সরিয়ে সমুদ্রকুমারী বলে," সুজন, সুজন, তুমি বড় ভালো। অনেক দ করেছিলে আমায়। তোমার ঘরে আমার কোনো দু:খ ছিলো না। কিন্তু আমি যে সাগরকন্যা, সমুদ্রে আমার না ফিরে গিয়ে উপায় নেই। তোমার ছেলেমেয়েরা রইলো, তাদের নিয়ে তুমি সুখী হবে সুজন, তোমরা খুব ভালো থাকবে।"

    সুজন আর তার তিন ছেলের অবাক চোখের সামনে সমুদ্রের নীল জলে মিলিয়ে গেল সমুদ্রকুমারী। একদিন সেখান থেকেই তাকে পেয়েছিলো সুজন, সেখানেই আবার হারিয়ে ফেললো তাকে।

    সত্যি হারিয়ে ফেললো কি? রয়ে গেল তার ছেলেমেয়েরা, রয়ে গেল তার স্মৃতি। সেই নিয়ে সুজন রোজ আসবে যাবে সমুদ্রে, মাটির ডাঙার মানুষ সে, এর বেশী কী ই বা আশা করতে পারে? তার চোখের ফোঁটা ফোঁটা নোনাপানি সাগরের নোনাপানিতে মিশে যায়, অস্ফুটে সে বলে, "বিদায়,বিদায়।"

    (শেষ)

  • achintyarup | 121.241.214.34 | ২৫ ডিসেম্বর ২০১০ ০১:৪৪466928
  • কি সুন্দর
  • ranjan roy | 122.168.203.161 | ২৫ ডিসেম্বর ২০১০ ০৩:১১466929
  • ওমি আর হুচে'র এই যুগলবন্দী আমার এবারের ক্রিসমাস রাত্রিকে অদ্ভুত আনন্দে ভরে দিল।
  • Nina | 68.84.239.41 | ২৫ ডিসেম্বর ২০১০ ০৪:০৭466930
  • ওমি ও হুচের জয় হো !
  • Shuchismita | 71.201.25.54 | ২৫ ডিসেম্বর ২০১০ ১০:০৪466931
  • ছায়াপথের কথা
    ----------------

    গল্প – ৩ (স্যান উপজাতি, কালাহারি)
    -----------------------------

    অনেক অনেক দিন আগের কথা। কৈশোরের উপকণ্ঠে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে তার মায়ের হাত ধরে জীবনে প্রথমবার গ্রামের বাইরে যাচ্ছিল। কোন উত্তেজনা নয়, একরাশ ভয় কিলবিল করছে তার ছোট্ট মাথায়। সে দেখতে পেয়েছে একটা হায়না স্যাঁত করে লুকিয়ে পড়ল বুকসমান উঁচু ঘাসের জঙ্গলে। মেটে রঙের টিলাটার ওপর কিচমিচ করছে তিনটে বেবুন। একটা ধেড়ে ইঁদুর ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল তার পায়ের ওপর দিয়ে। গেল ওদিকেই যেখানে তার মা রিড ঘাসের চাটাই দিয়ে তার জন্য একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে রেখেছে। যতদিন না সে পূর্ণ নারী হয়ে ওঠে ততদিন তাকে এই ঘরেই থাকতে হবে। তার বুক ফেটে কান্না এল। ইচ্ছে হল মা’কে বলে, ‘দোহাই তোমার, ফেলে যেও না এখানে আমায়। ত্রিসীমানায় মানুষ নেই কোন। কেমন করে থাকব আমি একা একা?’ কিচ্ছুটি বলতে পারল না সে। তাদের সমাজে এমনটাই নিয়ম। এখানেই থাকতে হবে তাকে পূর্ণিমা পর্যন্ত – যতক্ষণ না সে পূর্ণতা পায়। সে দেখল আকাশে সপ্তমীর চাঁদ। অ্যাকাশিয়ার জঙ্গলে মিলিয়ে যাচ্ছে তার মায়ের ছায়া।

    একটা করে দিন যায়। রাতের চাঁদ একফালি বাড়ে। নিঝুম অন্ধকারে কুঁড়েঘরের দুয়োরে বসে সে আকাশের একমাত্র আলোটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ছোটবেলায় শোনা গল্প মনে পড়ে তার। এই চাঁদ, তারা, সূর্য, জল, জঙ্গল, মরুভূমি – সবকিছু তৈরী করেছেন ক্কাগেন – কালাহারির পবিত্র পোকা। একসময় যখন চাঁদ ছিল না, যখন সূর্য ডুবলেই নিকশ অন্ধকার, তখন ক্কাগেন তাঁর পায়ের জুতো খুলে বললেন, তোমাকে দিয়ে আমি চাঁদ বানালাম। জুতো যেমন মানুষকে নিয়ে যায় ঘাসের জঙ্গল পেরিয়ে মরুভূমির এপার থেকে ওপারে, তুমিও তেমন ঘুরে বেড়াবে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আলো নিয়ে। অন্ধকারকে তুমি ফিকে করবে।

    কিন্তু ফিকে কই! অন্ধকার যে এখনও বড্ড জমাট – মেয়েটি ভাবে। ভাবতে ভাবতেই তার মনে হয় আকাশে আরও একটু আলো জুড়ে দিলে কেমন হয়! সে তো জানে কোন গাছের মূলে আলো জ্বলে ভালো, কোন মূলে সুগন্ধ ছড়ায়। আধভাঙা চাঁদের ফ্যাকাশে আলোতেই সে একটা গাছের ডাল খুঁজে নেয়। মাটি খুঁড়তে থাকে। একটা-দুটো না, অনেক অনেক মূল চাই তার। অনেক অনেক আলো সে জ্বালতে চায় আকাশে – অন্ধকার তার একদম পছন্দ নয়।

    একরাশ মূল জোগাড় করে কুঁড়েতে ফেরে সে। একটুকরো আগুন্ন জ্বালিয়ে গেছিল তার মা। তা এখনও জ্বলছে ধিকিধিকি। সে মূলগুলো ছুঁড়ে দেয় আগুনে। সুগন্ধী সাদা ধোঁয়ায় ঘর ভরে ওঠে। আগুন থেকে কিছুটা ছাই তুলে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। ‘তোমার নাম দিলাম ক্কো – ছায়াপথ – রাতের অন্ধকারে তুমি আলো ছড়াবে, পথহারাকে পথ দেখাবে’– এই বলে সে মুঠোভরা ছাই ছুঁড়ে দেয় আকাশে। বিন্দু বিন্দু সাদা ছাই ছড়িয়ে পড়ে আকাশের এপার থেকে ওপারে। রাতের অন্ধকারে দ্যুতি ছড়ায়। যারা পথ চলছে একা একা, আলো দেখায় তাদের।

  • omicron | 151.141.84.114 | ২৭ ডিসেম্বর ২০১০ ০০:২৩466932
  • আফ্রিকা মহাদেশের উপকথাগুলি বিচিত্ররকম সুন্দর। হয়তো এতরকমের মানুষ, এত রকমের সমাজভাবনা, এত ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র, এত ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি, গল্প বলা আর শোনার দীর্ঘ ট্রাডিশন-এইসবই উপকথার এত সমৃদ্ধ ভান্ডার গড়ে তুলেছে।

    আজকে বলি আফ্রিকার দক্ষিণাংশের সান(San) জাতির উপকথা। গল্পটি অপূর্ব! এই গল্পে আছে: একেবারে প্রথমে সৃষ্টিকর্তা ক্যাগেন সব পশুপাখি তৈরী করে পৃথিবীতে ছেড়ে দিলেন, কিন্তু না বানালেন কোনো পুকুর, না কোনো নদী, না কোনো ঝর্ণা বা প্রস্রবন। কোনো ঘাসজমি নেই, কোনো ফলের গাছ নেই, চারিদিকে শুধু ধূ ধূ বালির মরু, তীব্র সূর্য আগুন ঢেলে তাতিয়ে তোলে তা সারাদিন। পশুপাখিরা সবাই পশুপাখি মেরেই মাংস ভক্ষণ করে আর তৃষ্ণা মেটায় রক্তে। কী ভয়ঙ্কর রক্তলাল সেইসব দিন, কারুর জীবনেরই কোনো নিরাপত্তা নেই।

    এক ছিলো বিরাট হাতি, সে এইসব দেখে ব্যথিত। সে বলে, "এইরকম চলতে পারে না, পারে না, পারে না।"

    পশুপাখিরা কাছিয়ে আসে, কৌতূহলী হয়ে বলে, " তাহলে?"

    মহানহৃদয় হাতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে," আমি মরে গেলে আমার দেহের পশম থেকে গজাবে ঘাস। আমার শিরাউপশিরা থেকে হবে তরমুজের লতা, তাতে রসটুসটুস তরমুজ ফলবে। আমার হাড়গুলি থেকে হবে ফলের গাছ, রসালো ফল হবে তাতে। আর কাউকে মাংস খেতে হবে না, রক্তপান করতে হবে না। প্রচুর খাবার আর পানীয় পাবে সব পশুপাখি। "

    আগ্রহ-উদগ্রীব হয়ে সবাই হাতির দিকে চেয়ে থাকে, একজন বলে," কবে, সে কবে? আহা কবে? "

    হাতি বলে, "কী জানি! আমরা, হাতিরা তো অনেকদিন বাঁচি। দেখা যাক কী হয়।"

    সবাই আশায়-আশায় চলে যায়, ভাবতে ভাবতে যায় একদিন মরু সবুজ হবে, কত ঘাস, কত ফল, মাটিতে কত রসালো তরমুজ! এত তৃষ্ণা থাকবে না, ক্ষুধা থাকবে না, রক্তলোলুপ এইসব ভনক দিনের অবসান হবে। কিন্তু সে কবে? " কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইবো তোমার রসাল নন্দনে?"

    এক ছিল মস্ত সাপ, সে হাতিকে এসে বললো, "হাতি, সত্যিই তুমি তোমার নিজের জীবন দিয়ে আমাদের জীবন সুন্দর করতে চাও, আমাদের রক্ষা করতে চাও?"

    হাতি বলে, "হ্যাঁ, সত্যি। এই বীব্‌হ্‌ৎস যন্ত্রণা আর চোখে দেখতে পারি না। এর অবসান চাই।"

    সাপ বলে, "আরেকবার ভেবে দ্যাখো। সকলের জীবন সুন্দর হবে কিন্তু তার জন্য চরম মূল্য যে তোমাকে দিতে হবে!"

    হাতি বলে, "আমি ভেবে দেখেছি, অনেকবার। আমি তৈরী।"

    সাপ বলে, "তবে তাই হোক।" বিদ্যুতের মতন চমকে ওঠে সাপের ফণা, গভীর দংশন করে সে হাতিকে, সবটুকু বিষ ঢেলে দেয়। হাতি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, যন্ত্রণায় নীল হয়ে যেতে থাকে তার বিরাট দেহ। কিছু পরেই মৃত্যু হয় হাতির।

    হাতির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে আগুনের মতন, দলে দলে পশুপাখিরা এসে হামলে পড়ে হাতির মৃতদেহের উপরে। পেট ভরে মাংস খায়, তৃষ্ণা মিটিয়ে রক্তপান করে। তারা খায় আর পান করে, খেতে খেতে দিন ফুরায় প্রায়, আর কিছু পড়ে থাকে না চামড়া, হাড় আর শিরাউপশিরা ছাড়া। একসময় সূর্য নামে পাটে, পরিতৃপ্ত উদরে পশুপাখিরা ঘুমাতে যায়। বহুদিন পরে পেট ভরে খেতে পেয়েছে তারা, মিটাতে পেরেছে তৃষ্ণা।

    পরদিন সকালে একে একে জেগে উঠতে থাকে পশুপাখিরা, আবার তপতপে গরম দিন, আবার ক্ষুধা আবার তৃষ্ণা। আবার সেই যন্ত্রণা। সকলে উন্মত্তের মতন "হা খাবার হা পানীয়" শুরু করে।
    সাপ বলে, "আরে তোমরা এত অধীর হয়ো না। মনে আছে হাতির প্রতিশ্রুতির কথা?"

    পশুপাখিদের স্মৃতিশক্তি বেশী না, অনেকেরই কিছু মনে নেই, শুধু কয়েকজন তোতলাতে তোতলাতে বলে, " হ্যাঁ , কি যেন ....হাতি বলেছিলো সে মরে গেলে তার হাড় থেকে ফলগাছ হবে....তাই বলেছিলো না? কিন্তু হাতি তো মরেনি। সাপ, তুমি তাকে মেরেছ।"

    সাপ ক্রুদ্ধ হয়ে ফোঁস করে ওঠে,"এখন আমার নামে দোষ, না? সুবিধাটুকু পাওয়া হয়ে গেলে এরা সব ভুলে যায়! আয় কে খেতে চাস আমার রক্ত, এগিয়ে আয় সাহস থাকে তো।"

    সাপের ক্রুদ্ধ চেহারা দেখে সবাই পিছু হটে, সাপের বিষদাঁতের কথা কে না জানে! সাপকে কেউ ঘাঁটাতে চায় না।

    অনাহারেই আর বিনা পানীয়েই কেটে যায় একটি দিন, ক্রমে সূর্যাস্ত হয়। রাতের বেলা একে একে পরিচিত তারারা ফোটে আকাশে। তার সঙ্গে দেখা দেয় নতুন এক তারা, সেই তারা এগিয়ে আসতে থাকে। ভয়ে শিউরে ওঠে সব প্রাণী, বলে, "ঐ যে হাতির আত্মা। আমাদের ধ্বংস করতে আসছে।"

    চুপ করে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে পশুপাখিরা, নতুন তারাটি এগিয়ে আসতে আসতে এসে স্থির হয় হাতির দেহাবশেষের উপরে। সহসা হাতির হাড়গুলি খাড়া হয়ে ওঠে, শিকড় গজিয়ে ছড়িয়ে যায় মাটির গভীরে, উপরে ডালাপালা গজায়, পাতাপত্তর হয়। ফলের গাছ হয়ে যায় ওরা। হাতির শিরাউপশিরা থেকে তরমুজের লতা হয়, রসালো তরমুজ ধরে তাতে। আর হাতির গায়ের পশম থেকে হয় মস্ত মস্ত ঘাস, হাতিঘাসের জঙ্গল বলে যা এখন পরিচিত।

    পরদিন সকালে পশুপাখিদের আনন্দ দ্যাখে কে! দলে দলে হরিণ খরগোশ গরু ভেড়া জেব্রা ঘোড়া আর বাকী সবাই বেরিয়ে পড়ে খেতে। মাঠভরা সবুজ ঘাস, আহা! শুধু কিছু কিছু প্রাণী চিতা,হায়না,সিংহ,নেকড়ে, পেঁচা-এইরকম কিছু প্রাণী বললো মাংস ছাড়া তারা বাঁচতে পারবে না, তারা চলে গেলো রাত্রির অন্ধকারে, রাতে শিকার ধরে খাবে। শকুন বললো যে তারও মাংস লাগবে কিন্তু সে নিজে মারবে না, এমনি এমনি কেউ মরে গেলে তবে খাবে।

    খাবারদাবাড়ের ব্যবস্থা তো হয়ে গেলো, কিন্তু পানীয়? কী ভীষণ তৃষ্ণা! আবার সাপকে তারা বলে,"পানীয় চাই, পানীয় চাই। তেষ্টায় মরে গেলাম।"

    সাপ বলে, "ফলে রস আছে, তরমুজেও। ঘাসেও। সেসবে তেষ্টা মেটে না তোমাদের?"

    কিন্তু কেউ শোনে না, আহ, তৃষ্ণা! আবার তারা তাকাতে থাকে এদিক ওদিক, নধর কচি কোনো প্রাণীর মিঠা রক্তে তারা তৃষ্ণা মিটাবে।

    সাপ বাধা দেয়, বলে, "না না না, আর নয়। মহান হাতি নিজের জীবন দিলো তোমাদের জন্য, তবু তোমাদের সন্তুষ্টি নেই। দাঁড়াও, দেখি কিকরা যায়।"

    সাপ মাটিতে গর্ত করে নেমে গেলো পাতালে, সেখান থেকে ফণা আর লেজের ঝাপটা দিয়ে ঠেলে ঠেলে পাতালের জল নিয়ে এলো উপরে, দেখা দিলো ঝর্ণা ও প্রস্রবণ। নিচু নিচু জায়গা জলে ভরে গিয়ে হলো পুকুর দিঘি হ্রদ, নদী বয়ে গেল উপত্যকার মাঝ দিয়ে।

    খাদ্য ও পানীয়ের সমস্যা মিটে গেল, এখন পৃথিবী ঘাসেপাতায়লতায়গাছে সবুজ, স্নিগ্‌ধ জলের এখন অভাব নেই। সকলে সুখী।

    সাপ রইলো না, আগুনে ঝাঁপ দিয়ে সে ফিরে গেলো স্বর্গে, সে কাউকে বলে নি যে হাতিকে সে মর্মান্তিক ভালোবাসতো, তাকে ছাড়া সে থাকবে কেমন করে?

    রয়ে গেছে হাতিঘাসের জঙ্গল, রয়ে গেছে সেই জলকুন্ড যেখানে প্রথম পাতালের জল নিয়ে এসেছিলো সাপ। আর রয়ে গেছে এই গল্প।
  • omicron | 151.141.84.114 | ৩১ ডিসেম্বর ২০১০ ০১:২৯466934
  • এই গল্প আফ্রিকার, কেনিয়াতে প্রচলিত উপকথা।

    এক সিংহ, নাম তার সিম্বা, সে একা একা থাকতো তার গুহায়। সতেজ সবল শক্তিশালী তরুণ সিংহ, দুনিয়ার কোনোকিছুকে সে পরোয়া করতো না। খিদে পেলে বের হয়ে অনায়াসে শিকার ধরে খেতো, খিদে মিটে গেলে বাকী খাবার ফেলে রেখে যেতো হায়েনা নেকড়ে শিয়াল এদের জন্য। সিম্বার প্রসাদলাভের জন্য চাটুকারের মতন আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতো এইসব হায়েনা নেকড়েরা, গদগদ বন্ধুত্বের কথা বলতো।

    একদিন শিকার করতে গিয়ে আহত হলো সিম্বা, পায়ে এত আঘাত লাগলো যে কোনোরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গুহায় ফিরে এলো সে। শুয়ে পড়লো। তারপরে তার হলো জ্বর, ওঠার ক্ষমতাও রইলো না। হায়েনা নেকড়েরা-এতকাল যারা প্রসাদলোভে বন্ধুত্বের গদগদ ভাব দেখাতো, তারা উঁকি দিয়ে দেখেই ব্যাপার বুঝে ফেলে সরে গেল। দু:সময়ে সিম্বাকে সাহায্য করতে কেউ এলো না। একলা গুহায় শুয়ে শুয়ে সিম্বা নিজের কপালকে দুষলো, একজনও প্রকৃত বন্ধু তার নেই বলে।

    সুঙ্গুরু যাচ্ছিলো সিম্বার গুহার কাছ দিয়ে, এমনিতে সে খুব সতর্ক হয়ে চলাফেরা করে সেই জায়গায়, বলা তো যায় না, সে ছোটো প্রাণী, সিম্বামহারাজের মতন উচ্চদরের প্রাণীর সঙ্গে দূরত্ব রাখাই তার ভালো। বলা তো যায় না, কখন কী থেকে কী হয়ে যায়।

    সে যাক গে, কিন্তু সিম্বা ওভাবে শুয়ে আছে কেন? অসুখ করলো নাকি? আহা, কেমন কুঁকড়েমুকড়ে শুয়ে আছে! সে যাবে নাকি একবার ভিতরে? সে অনেকরকম ওষুধ জানে, যদি কোনো উপকার হয়!

    সুঙ্গুরু জল নিয়ে ভীরু ভীরু পায়ে ভিতরে গেল, তৃষ্ণার্ত সিম্বাকে জল খাওয়ালো। সিংহের পায়ের ক্ষততে পাতালতার রস থেকে বানানো ওষুধ লাগিয়ে পাতা দিয়ে ঢেকে ভালো করে বেঁধে দিলো তন্তু জড়িয়ে জড়িয়ে। সিম্বাকে খেতে দেবার সামর্থ তার ছিলো না, সিম্বা যা খায় সে তা কোথায় পাবে? সে কেবল তাকে পরিচর্যা করলো সাধ্যমত। সিম্বার আধা-আধা ঘুম আধা-আধা জাগা অবস্থা, সেই অবস্থাতেই সে অনেক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানালো সুঙ্গুরুকে। সুঙ্গুরু সিম্বার ঘাড়ে, মাথায়, কেশরের ভিতর হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো, সে আস্তে আস্তে খালি বললো, "আপনি কথা বলবেন না সিম্বা, আপনি খালি চুপ করে ঘুমান। দেখবেন, কালকে অনেক ভালো লাগবে।"

    পরদিন সকালে সিম্বার জ্বর সেরে গেল, পায়ের ব্যথা কিছুটা কমলো, সে উঠতে পারলো। কাছাকাছি থেকে কিছু ছোটোখাটো শিকার করে এনে সিম্বা নিজে খেলো আর সুঙ্গুরুকে দিলো। সুঙ্গুরুর এখন একেবারে ভয় কেটে গেছে, সে বুঝতে পেরেছে সিম্বাকে সে দূর থেকে যেমন মনে করতো সে মোটেই সেরকম ভনক নয়, খুবই কোমলহৃদয়। খুব ভদ্রও।

    ক'দিন গেল, দিন দিন সিম্বার ক্ষতের অবস্থা ভালো হওয়ার দিকে যাচ্ছে। আর কয়দিন ওষুধ লাগালেই একেবারে শুকিয়ে যাবে। সুঙ্গুরু রোজ নতুন করে ওষুধ লাগিয়ে বেঁধে দেয়।

    সেদিন বিকালে খাওয়াদাওয়া সেরে গল্প করছিলো তারা দু'জনে। এমন সময় হায়েনা নিয়াঙ্গাউ খাবারের গন্ধ পেয়ে এসে হাজির। গুহার দুয়ারে এসে গলাখাঁকাড়ি দিয়ে জানান দিলো চাটুকার হায়েনা।

    সিম্বা উঠে এসে বললো, "আরে! নিয়াঙ্গাউ যে! তা এতদিন পরে কী মনে করে?"

    নিয়াঙ্গাউ তো বিনয়ে একেবারে যেন গলে যাবে এমন ভাব করে বলে," সিম্বা, তোমাকে এতদিন না দেখে সবাই যে কি চিন্তিত কি বলবো! আমি তো তাই তড়িঘড়ি খোঁজ নিতে এলাম কেমন আছো। তুমি সুস্থ হয়ে বনে ফিরবে এই আশায় সবাই দিন গুনছি। তুমি বিনা অরণ্য আঁধার।"

    সিম্বা তো নিয়াঙ্গাউয়ের ভন্ডামি দেখে স্তম্ভিত। এতখানি শঠ ও হয় কেউ! খানিকক্ষণ সে থমকে থেকে তারপরে গর্জন করে বললো,"চুপ কর চাটুকার! এতদিন পরে সুবিধা খুঁজতে এসেছে ব্যাটা সুবিধাবাদী। আমার দু:সময়ে তো উঁকি মেরে পালিয়েছিলি, একটু সাহায্যও করিস নি। এই মুহূর্তে দূর হয়ে যাবি, নইলে তোর কপালে দুর্ভোগ আছে।" সিম্বার কথা শুনে ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায় কাপুরুষ হায়েনাটা। যেতে যেতে সুঙ্গুরুর ব্যঙ্গহাসি কানে বেঁধে তার।

    এর পরেও নির্লজ্জ নিয়াঙ্গাউ হাল ছাড়ে না, সে আবার একদিন এসে হাজির। সুঙ্গুরু তখন জল আনতে নদীতে গেছে, সিম্বা গুহায় একা। খুব বিনবনত আর বিষন্ন ভঙ্গী করে নিয়াঙ্গাউ বলে, "আমি অতি দুর্ভাগা। তোমাকে নিজের বন্ধু ভাবি বলেই খোঁজ নিতে আসি, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে পারো না। " সামনের থাবা তুলে সে চোখের জল মোছার অভিনয় করতে থাকে।

    সরলসোজা সিম্বা এত ছলচাতুরি বোঝে না, সে একটু দু:খিত হয়। সেদিন ওরকম গালাগাল দিয়ে তার মন এমনিতেও খারাপ ছিলো। সে বললো, " আরে কাঁদছো কেন? সেদিন রাগের মাথায় কী বলতে কী বললাম! মনে কিছু দু:খ রেখো না। এই নাও, এটা খাও।" তার খাবারের অবশিষ্ট থেকে একটুকরো মাংস সে হায়েনাকে দেয়। মাংস পেয়ে হায়েনা খুব ধন্যবাদ দিয়ে মাংসটুকু খেতে খেতে বলে, " সিম্বা, তোমার পায়ের ক্ষতটার কি অবস্থা?"

    সিম্বা বলে, "শুকিয়ে এসেছে প্রায়। আর কিছুদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।"

    নিয়াঙ্গাউ বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে, " তোমাকে ওষুধ দেয় ঐ সুঙ্গুরু তো? বনের সবাই জানে ও কত চতুর! ও ইচ্ছে করে তোমাকে এমন ওষুধ দেয় যাতে ক্ষত সারতে সময় লাগে। নইলে এ তো কবে আরাম হয়ে যেত। ওরই জন্য দেরি হচ্ছে। তুমি সরল সোজা লোক, তাই ওকে বিশ্বাস করো।"

    সিম্বা অবাক হয়ে বলে, " সুঙ্গুরু ছিলো বলে বেঁচেছি আমি। সে ওষুধ দিয়ে ক্ষত বেঁধে দিলো আর জ্বর কমালো বলে উঠে হেঁটে গিয়ে শিকার করতে পারলাম। নইলে না খেয়েই তো মরে যেতাম। তুমি কিনা বলছো সে ইচ্ছে করে আমার পুরোপুরি সেরে উঠতে দেরি করিয়ে দিচ্ছে! কিন্তু তাতে তার লাভ কী?"

    নিয়াঙ্গাউ মুখ বেঁকিয়ে একটা বিশ্রী ভঙ্গী করে বলে," লাভ কী বোঝোনা? যতদিন তুমি পুরোপুরি সেরে না ওঠো ততদিন তোমার কাছে সে থাকতে পারবে আর বিনা পরিশ্রমে ভালো ভালো খেতে পারবে। তুমি পুরোপুরি ভালো হয়ে গেলে তো আর সেই সুবিধা থাকবে না। তখন তাকে নিজের খাবার নিজে কষ্ট করে যোগাড় করতে হবে।"

    সুঙ্গুরু জল নিয়ে ফিরে এলো নদী থেকে। নিয়াঙ্গাউকে দেখে বললো, "আরে, তুমি! সেদিন লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেলে দেখে ভাবলাম আর বুঝি আসবেই না। তা এবারে কী মনে করে?"

    সিম্বা সুঙ্গুরুর দিকে ফিরে বলে, " জানো সুঙ্গুরু, এতক্ষণ তোমার বিষয়েই শুনছিলাম এই নিয়াঙ্গাউয়ের কাছে। তুমি তো গোটা বনে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসক! তোমার মতন রোগ সারানোর ওস্তাদ আর নেই কেউ। এদিকে আমার পায়ের ক্ষত সারতে এত সময় লাগছে! অদ্ভুত! চাইলে তুমি অনেকদিন আগেই পুরোপুরি সারিয়ে ফেলতে পারতে, তাই না ?"

    সুঙ্গুরু এত অবাক আর আহত হয় যে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারে না। সিম্বা কি তাকে সত্যিই সন্দেহ করে নাকি এই শঠ হায়েনাটা ওকে কিছু উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছে? মনে মনে সে বলে, খুব সাবধানে এই পরিস্থিতি সামলাতে হবে, সামান্য এদিক ওদিক হলে বিপদ!

    সুঙ্গুরু বলে, " সিম্বা, কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা নয়। কোনো কোনো অসুখের ক্ষেত্রে খুব জটিল জিনিস দরকার হয় ওষুধ বানাতে, আমি সামান্য, ক্ষুদ্র প্রাণী, অনেকসময় যোগাড় করতে পারি না। এই যেমন আপনার ক্ষত তাড়াতাড়ি সারাতে এমন একটা জিনিস লাগবে--"

    সিম্বা উত্তেজিত হয়ে বলে, " কী জিনিস লাগবে?"

    সুঙ্গুরু বলে, "লাগবে একটা বড়সড় হায়েনার পিঠের চামড়া, মেরুদন্ডের উপরের চামড়া, একেবারে ঘাড়ের কাছ থেকে লেজের কাছ অবধি একটানে ছেঁড়া।"

    নিয়াঙ্গাউ পালাতে চেষ্টা করছিলো, পারলো না। সিম্বা বিদ্যুতের মতন লাফ দিয়ে পড়লো তার ঘাড়ে, একটানে ঘাড় থেকে লেজ অবধি ছিঁড়ে নিলো মেরুদন্ডের উপরের চামড়া। সেই থেকে হায়েনাদের শিরদাঁড়া বরাবর পিঠের লোমগুলো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।

    ***

  • omicron | 151.141.84.114 | ৩১ ডিসেম্বর ২০১০ ০১:৪৯466935
  • আফ্রিকার আরেক উপকথা, এটা পূর্ব কেপ দেশের গল্প। আশেপাশের অন্যান্য নানা দেশে নানা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এই গল্পের নানা রূপ পাওয়া গেছে। গ্রীক উপকথার কিছু কিছু গল্পের মধ্যে এই গল্পের প্রতিধ্বনি শুনে চমকে উঠতে হয়।

    গল্পে চলে যাই এবারে। সে অনেক অনেকদিন আগের কথা। তখন নদীতীরের এক গ্রামে এক মানুষ থাকতো যার ছিলো অনেক জমিজমা গরুভেড়া। বাড়ীঘর ধনদৌলত কোনোকিছুর তার অভাব নেই, কিন্তু তার আপন বলতে কেউ নেই। বুড়া বাপমা মরে গেছে, সে নিজে বিয়েও করে নি। এদিকে বিয়ের বয়সও তার প্রায় পেরিয়ে গেছে।

    একলা মানুষটা নদীতীরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, খুব একা লাগে তার। বিছিয়ে থাকা জমি দিগন্তে মিশে গেছে, সবুজ হয়ে উঠেছে শস্য, হাওয়া দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে গাছগুলোকে। দূরের মাঠে চরে বেড়ায় তার গরুভেড়ারা, মাইনে করা রাখালেরা চরায় তাদের। এসব দেখতে দেখতে সে ভাবে কত অর্থহীন সব! নদীতীরের বিরাট এক গাছের তলায় এলিয়ে বসে সে ভাবে, বিয়ে করে ফেলতে হবে। সংসার না করতে পারলে এতসব থেকেই বা কি লাভ? আরো বয়স হয়ে গেলে তখন আর কোনো মেয়েই রাজি হবে না, এইবেলা বৌ হবার যোগ্য কাউকে খুঁজে পেতে সংসার শুরু করে ফেলাই ভালো। কিন্তু কোথায় খুঁজে পাবো ? এমন কাউকে কি কখনো খুঁজে পাবো যাকে দেখামাত্র মনে হবে একে ছাড়া জীবন আমার বৃথা?

    নদীর ধারার একেবারে কাছ ঘেঁষে ঝলমল করছে একটা সবুজ পাতাভরা গাছ, সোনালী সূর্যকিরণ পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে পাতাগুলো। আমাদের গল্পের একলা মানুষটা সেই সূর্যপিয়াসিনী সবুজ গাছটির প্রেমে পড়ে গেল।

    মানুষটা কাঠের মূর্তি বানাতে পারতো। সে কুঠার দিয়ে গাছটি কেটে বাড়ী নিয়ে গেল। তারপরে দিন নেই রাত নেই মনপ্রাণ ঢেলে বানালো এক কাঠের নারীমূর্তি সেই গাছের কান্ড থেকে। এত সুন্দর হলো সেই মূর্তি যে শিল্পী পলক না ফেলে চেয়ে রইলো তার দিকে। আহা! যদি জ্যান্ত হতো!

    সে তাকে ঘিরে ঘুরতে ঘুরতে মন্তর পড়তে লাগলো আর তারপরে বারে বারে কাঠের মূর্তির চোখেমুখেনাকে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বলতে লাগলো, " জ্যান্ত হও, জ্যান্ত হও, নদীর মেয়ে ক্যামিও, তুমি জ্যান্ত হও।"

    মূর্তি মানুষী হয়ে জেগে উঠলো। একলা মানুষটা এতদিনে বৌ পেলো। সে বৌকে সুন্দর সুন্দর শাড়ী দিলো, ওড়না দিলো, আয়নাগয়না দিলো। সে তাকে বললো কেউ যদি জিজ্ঞেস করে তো বোলো, আমি ক্যামিও, নদীর মেয়ে ক্যামিও।

    বৌ শুনে মাথা কাত করে বললো, " তাই বলবো। বলবো আমি নদীর মেয়ে ক্যামিও।"

    তারপরে দিন যায়, বৌ ঘরে থাকে আর রাঁধেবাড়ে। মানুষটা কাজ করে ফিরে বৌয়ের মিষ্টি হাসিমুখ দেখে ভারী খুশী হয়। দু'জনে মিলে খেতে খেতে তারা গল্প করে। সুখে দিন যায়।

    একদিন গ্রামের কয়েকজন তরুণ বাড়ীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে ক্যামিওকে দেখতে পায়। তারা বলাবলি করে, এমন ফুটফুটে সুন্দর একটা অল্পবয়সী মেয়ে কিনা এই টাকার কুমীর বুড়োর বাড়ীতে? লোকটা এমন বৌ জোটালো কিভাবে? যেভাবেই জোটাক, ও কখনো বুড়ার ঘরে থাকার জন্য নয়। আমরা তরুণেরা থাকতে এমন নারীরত্ন বুড়োর ঘরে পড়ে থাকবে এ হতে পারে না। আমরা ওকে উঠিয়ে নিয়ে যাবো।

    যা বলা সেই কাজ। তারা ক্যামিওকে তুলে নিয়ে পালিয়ে গেল। কাজের থেকে ফিরে শূন্য ঘরে বিষন্নমনে একলা বসে রইলো ক্যামিওর স্বামী। খবর সে পেয়েছে আগেই। কিন্তু কি করবে সে? সে বসে বসে ভাবে আর ভাবে।

    দু'খানা পোষা যাদুপাখি ছিলো মানুষটার। তারা কথাও বলতে পারতো। সে তাদের সব শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়ে দিলো ক্যামিওর কাছে। পাখিরা উড়ে গেল মাঠ-পাহাড় পার হয়ে, তারপরে তারা গিয়ে পৌঁছালো সেই বাড়ীর উঠানে যেখানে চুপ করে বসে আছে ক্যামিও। বাড়ীর উঠানের গাছে বসে পাখিরা সুর করে বললো, " নদীর মেয়ে ক্যামিও, নদীর মেয়ে ক্যামিও, আমরা তোমার স্বামীর কাছ থেকে আসছি। সে তোমার ওড়নাটা ফের্ৎ চায়।"

    সেই ছেলেগুলি পাখিদের কথা শুনতে পেয়েছিলো, তারা বললো, " দিয়ে দাও ওড়না। আমরা তোমাকে আরো ভালো ওড়না কিনে দেবো।" ক্যামিও দিয়ে দিলো ওড়না। পাখিরা ঠোঁটে ওড়না নিয়ে উড়ে চলে গেলো।

    পরদিন আবার তারা এলো, সুর করে বললো," নদীর মেয়ে ক্যামিও, নদীর মেয়ে ক্যামিও, আমরা তোমার স্বামীর কাছ থেকে আসছি। সে তোমার গলার হার ফের্ৎ চায়।"

    সেই ছেলেগুলি সেদিনও পাখিদের কথা শুনলো, তারা বললো, " দিয়ে দাও গলার হার। ভারী তো এক হার। আমরা তোমাকে আরো ভালো সোনার হার দেবো।" ক্যামিও গলা থেকে খুলে দিয়ে দিলো গলার হার। পাখিরা ঠোঁটে হার নিয়ে উড়ে চলে গেলো।

    পরদিন আবার তারা এলো, সুর করে বললো," নদীর মেয়ে ক্যামিও, নদীর মেয়ে ক্যামিও, আমরা তোমার স্বামীর কাছ থেকে আসছি। সে তোমার প্রাণ ফের্ৎ চায়।"

    ক্যামিও হেসে উঠে দাঁড়ালো, উপরের দিকে মুখ তুলে বললো," নাও, নাও, নাও। " পাখিরা বিদ্যুতের মতন নেমে এসে ঠুকরে দিলো ক্যামিওর চোখে। যেই না ঠোক্কর দেওয়া অমনি জ্যান্ত ক্যামিও মুহূর্তে হয়ে গেল কাঠের মূর্তি।

    তারপরে তার হাত আর পা খসে গেল, মাথাও খসে গেল। দেহটা আবার হয়ে গেল বৃক্ষকান্ড, সে গড়িয়ে গড়িয়ে চললো নদীর দিকে। গড়াতে গড়াতে অনেক পথ পার হয়ে যেই না পড়লো নদীর ধারায়, অমনি সে আবার পাতা গজিয়ে হয়ে গেল গাছ। নদীর ধারে ঝলমলে সবুজ পাতা নিয়ে আজও সে দাঁড়িয়ে আছে, সূর্যকিরণে ঝলমল করে ওঠে সে প্রতিদিন।
  • Nina | 68.84.239.41 | ৩১ ডিসেম্বর ২০১০ ০৫:৫৭466936
  • মনটাই বেশ স্বপ্ন স্বপ্ন হয়ে গেল!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন