এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • যা হারিয়ে যায়

    indo
    বইপত্তর | ১৪ জানুয়ারি ২০০৬ | ১০৩৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • indo | 62.6.139.14 | ১৪ জানুয়ারি ২০০৬ ১৮:৪১450786
  • খুঁজে পাওয়ার গপ্পে চিরকালই কাঁচা। ছোটবেলা থেকেই বরং হারাতে খুব ভালবাসতাম। গন্ধওলা রাবার, অজস্র রং-পেন্সিল, মামার দেওয়া ওয়াটারম্যান কলম, ছাতা।

    বেশ ছোটবেলাতেই হারিয়ে ফেললাম'অমল ধবল পাল'। লেরমন্তভের সেই বইটা, সমর সেন অনুবাদ করেছিলেন। গাভ্রিক আর পেতিয়া, জেলের পো আর ইস্কুল মাস্টারের ছেলের বন্ধুত্ব। ফেরারী নাবিক ধরবার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে টিকটিকি, অথচ বিপ্লব শব্দটা একবারের জন্যও বলল না। পেতিয়াকে দিয়ে তো একবার গোপন প্যাকেটও পৌঁছ করালো। শুওরের চর্বির টুকরো দেওয়া ফেনা ভাতের সোয়াদ , এখনো মুখে লেগে রয়েছে। মেছুনী 'মিদি','মিদি', বলে চীৎকার করছে।

    মেজ পিসি বই পড়তে খুব ভালোবাসতেন। পঞ্চাশের, ষাটের দশকের সব বসুমতী সাহিত্য পত্রিকা, আনন্দবাজার একসঙ্গে বাঁধানো ছিল , ডাঁই করে রাখা, ঠাকুমার ঘরে। আট-ন বছর বয়সে পড়ে ফেললাম সপ্তপদী, লালবাঁধ, কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী।

    আর তো কিছুই মনে পড়ছে না। বললাম যে, হারিয়ে ফেলায় ওস্তাদ ! শুধু একটা কাজের মেয়ে গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছিল-চাঁদ চাঁদা চাঁদ চাঁদা কামরাঙ্গা রে। বাড়িতে চাঁদা মাছ এসেছে, মা কামরাঙ্গা দিয়ে রান্না করবে। তারপর কি হল? 'অব মোচি পড়হে' বলে যে হিন্দুস্তানী দারোয়ান ডাক দিত, আর পিলপিল করে ভুতের মত কেলে কুচকুচে কাঙ্গালীভিখিরি যত ঝাঁপিয়ে পড়ত ভোজের আসরে, তারা কোথায় গেল?

    হারিয়ে যায়। সদ্য কিশোরের একলা দুপুর,'শিল কাটাও' ডাক, মেজ পিসিমা কত কাল হল মারা গেছেন। কিশোরীবেলায় পড়তেন ঐ সব বই? ডায়েরী লিখতেন,আট বোন এক ভাইয়ের অনটনের সংসারে ঐ একটুকরো সুখ ছিল, শীতের ছাদে তেঁতুল আচার খাওয়ার মত? বইগুলো কোথায় আছে, কি ভাবছে, কে জানে !

    সবে সেদিন হারালাম 'দক্ষিণের বারান্দা'। কেনার পর বছরখানেকও রাখতে পারিনি।

    হারায়নি কিন্তু; পুরোটা মনে আছে। টোকো আম খাওয়া, হীরে খোঁজা, যেবার সা- বুলবুল এল, অবনঠাকুর দার্জিলিং গেলেন, দেয়ালা পত্রিকা বের হল, 'আঁব দাড়ি চাঁব দাড়ি বুলবুল চশমেদার দাড়ি'।
    বাসা ভেঙ্গে যায়, বাড়ি বদলে যায়। দক্ষিণের বারান্দা, ও হারাবেই। শিক বের করা হতশ্রী ফ্ল্যাট উঠছে, আমাদের জামরুল গাছটাতে কত পাখী এসে বসতো।

    শীতের অনেক পাখী ফুরিয়ে গেছে। নরম সব পাখীরা।

  • dam | 61.246.28.94 | ১৪ জানুয়ারি ২০০৬ ২২:০৯450789
  • 'বসুমতী' 'বসুমতী'! আমি হারিয়ে ফেলেছি সেই মোটা মোটা বাঁধানো বসুমতীদের। মামার বাড়ীতে আলমারীতে বাঁধানো সারি সারি ব্রাউন পেপারের মলাট দেওয়া। একটা ধারাবাহিক ছিল 'বাতিঘর'। সুমিতার কি হল তা জানার জন্য আমার সব কটা বন্ধু হাঁ করে অপেক্ষা করত। কবে লুকিয়ে লুকিয়ে পরের মোটকা বইটা থেকে পড়ে, ওদের বলব, তবে ওরা জানবে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে 'অ্যানুয়ালি' পরীক্ষা হয়ে গেলেই অবাধ স্বাধীনতা। একতলার বারান্দায় রোদ্দুরে মা'রা বসত। দোতলার বারান্দায় রোদ্দুর একটু কম। রেলিঙে সারাদিন ধরে গরম হয় ধবধবে সাদা ওয়াড় পরানো লেপের দল। তারই ফাঁক দিয়ে আসা রোদ্দুরে পা রেখে পড়া চলে মোটকা মোটকা 'বসুমতী', 'শুকতারা', শিশুসাথী এমনকি কৃত্তিবাসী রামায়ন আর ছেঁড়াখোঁড়া কাশীদাসী মহাভারত।

    বসুমতীতেই পড়া 'কাল তুমি আলেয়া', 'লৌহকপাট'। কি ভীষন ভাল লাগত 'লৌহকপাট', অথচ হারিয়েই তো ফেলেছি--- কই আর তো মনে পড়ে না সেই জেলারবাবুর কথা। 'ইন্দ্রানীর প্রেম' পড়ে জেনেছিলাম কোন পাঞ্জাবী পরিবারে বেড়াতে গিয়ে, বিনা নেমন্তন্নে রাতের খাওয়া খেয়ে যেতে বললে কক্ষণো খেতে নেই। ওরা নাকি ভীষণ নিন্দে করে। পরে পাঞ্জাবীদের মিশে সেরকম কিছুই দেখলাম না। কে জানে ওরাই বদলে গেছে কিনা।

    আর সেই যে উপন্যাসটা ---- 'হৃদয় পাত'---- আজও যার শেষ খুঁজে পাই নি। এমনকি নামের মানেটাও ঠিক করে বুঝে উঠতে পারি নি-----মামাবাড়ীতে শেষ অংশটা ছিল না। ছোট পিসীর বাড়ী বেড়াতে গিয়ে দেখি সেখানেও রয়েছে কিছু বসুমতী। এবং হ্যাঁ 'হৃদয় পাত'র যতটা পড়েছিলাম তার পরেও বেশ খানিকটা অবধি পড়া গেল ---- তারপর ফুস্‌স্‌স্‌স। বাকীটা আর কোথায়ও, কোন লাইব্রেরীতেও খুঁজে পেলাম না। একেবারে হারিয়ে গেল।

    ৭৭ এর বন্যায় ৫ দিন স্কুলে যেতে হয় নি। লুকিয়ে পড়েছিলাম 'বর্নালী', আর দস্যু মোহন অমনিবাস। এখন আর পড়ব না। হারিয়ে গেছে।

    হারিয়ে গেছে আশাপুর্ণার 'শোনো শোনো গল্প শোনো'। সেই দুর্দান্ত বাক্য 'কী করে বুঝব!" ঐ পরিস্থিতিতে নিজেই ?যে কতবার পড়লাম-----

    হারিয়ে গেছে শুভ্রা আর শর্বরীর সাথে ঝগড়া করে খেলতে না গিয়ে পড়ে ফেলা 'মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড'। হারিয়ে গেছে ডিসেম্বরের ছুটি। ----'তুমি মেয়ে। বড় হয়ে গেছ এখন আর খেলতে যেতে নেই' বাড়ীতে বন্ধ শীতের ছোট্ট বিকেল- হারিয়ে গেছে।
    বাঁচা গেছে।
  • kali | 69.252.171.153 | ১৪ জানুয়ারি ২০০৬ ২৩:৫২450790
  • হারিয়ে যায়...হারিয়ে যায়,বই,দিন,মানুষ,'তরতাজা সময়'। আমার সব কটা রাশিয়ান বই হারিয়ে গেছে।সাশা আর আলিওশা, পেনসিল আর সর্বকর্মা,আজিজের রাখালী,সব্বাই।

    প্যানেরার দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় ঝাপসা উইন্ডস্ক্রীনে কেমন যেন একটা ওয়াশের ছবি টোকা দেয়..... ছোট্ট একটা খালি পা মেয়ে,সাতটা রুটি নিয়ে বাড়ি ফিরছিলো,কুকুরে খেয়ে গেলো সব, স-অ-ব। বাবার কালোজিরে দেওয়া,মায়ের পোস্ত দেওয়া,নিজের মিষ্টি দেওয়া আর ভাইয়ের গোলাপী রুটিটাও।আমায় কেউ আর একটা সাত রঙা পাপড়ির ফুল এনে দেবেনা,যা দিয়ে ওদের ফিরিয়ে আনা গেছিলো কোনদিন।কুকুরে সব খেয়ে নিয়েছে।চেটেপুটে,এক্কেবারে হাম হাম হাম করে।

    কোলিয়া বলে সেই ছোট্ট বীর ছেলেটাও হারিয়ে গেছিলো,একা একা হয়তো নয়।বারুদের নীল গন্ধভেজা যুদ্ধের উঠোনে,তবু একা একা হয়তো নয়।পাউল ওর হাত ধরেছিলো হয়তো,হারিয়ে যাবার সময়। পাউল ও ফেরেনি যুদ্ধ থেকে।পশ্চিমের দিকটায় সব চুপ সব চুপ সব চুপ.... হারিয়ে গেছে ফিকে হলুদ কাগুজে মলাটের পাতা ছেঁড়া পাউল,মূলার,ক্যাতজিনস্কি।

    সাশুক বলে সেই ছুলি মুখো ছেলেটা ওর ভাঙা কাঁচের কুখতিল নিয়ে সেই যে সাগরতীরে গেলো,এত দিন কেটে গেলো,এখনও ফিরলো না তো। ওকে কেউ একবার ডেকে দেবে? শীতের জন্য জমিয়ে রাখা এক টুকরো চর্বি লোভের বশে খেয়ে ফেলে ছেলেটা বড্ড ভয় পেয়েছিলো।যদি বাবা বকে,যদি মা রাগ করে? ওকে কেউ একবার ডেকে দেবে?

    না থাক,ডেকোনা,থাক,হারিয়ে গেছে,হারিয়ে থাক। স্বপ্নলোকের চাবি কেউ কি সত্যি করে কোনদিন খুঁজে পায়? হারিয়ে থাক,খুঁজে পেলেই তো ফুরিয়ে গেলো।

  • b | 86.135.80.123 | ১৫ জানুয়ারি ২০০৬ ০১:০০450791
  • এমন একটা দিনে নফিজুল মরে গেছিল, যেদিন কোনো ভদ্দরলোক মরে না। দিব্য ফাগুন হাওয়া, গোছানো পাট পাট বা অবস্থা ভেদে কুঁচকে সরে যাওয়া হলুদ শাড়ির গেরুয়া বর্ডার আঁচল, পলাশ পেড়ে দেওয়া নতুন উকি ঝুকি অথবা স্প্রিং-গোটানো পৌরুষ, কোনো প্রাক্তনী ফ্রেঞ্চ কাট দের আড্ডা থেকে উপচে পড়ে ভাসতে ভাসতে রেল লাইনে এ গড়িয়ে পড়া বিলিতি ভেজা জ্যোৎস্না রাতের গান, লোকায়ত দের তাড়ি প্রভাবিত উচ্চকন্ঠ জীবন দর্শন, বা ভ্যাবলা আদিবাসী সাইকেল আরোহীকে, শ্রমিক ঐক্য র ঘাড়ে পা দিয়ে, সুমো চালক এর খিস্তি। সব ই ছেল।

    কিন্তু নফিজুল সেদিন ই বেমোক্কা মরে গেলো। তাও কিনা একটা ঘা পেকে উঠে। ছো: । একটা ভোটার বা সামর্থক ছেলে মরে যাওয়ায় জাতীয়তাবাদী দের ও ঐ তাগ্‌ড়া সোমত্থ বসন্ত কে ফেলে শেষে কিনা বল্ল ভ পুর পেরিয়ে অন্ধকার রাস্তায় যেতে হল স্কুটার, সাইকেল নিয়ে।চল্লিশ মিনিট।

    আমি, নেহাত ই এক বেঞ্চ বা বিড়ি বান্ডিল এর বন্ধু বলে একটু ন্যাকা ন্যাকা ফ্যাঁচ কল্লাম বটে, কিন্তু আবার সমবেদনার জন্যো এগিয়ে আসা নানা আকারের হাত গুলোর মধ্যে সরু শ্যামলা পানা লাল চুড়ি কেই ধল্লাম তো। সে কি দু:খ না বসন্ত!

    দানা ভাঙ্গা কাঁকড়ি বক টা ,যাকে ধান মাঠ থেকে গেঁড়ি শামুক এনে পথ্যি খাইয়েছিলো, সে বেটাও ওকে মনে রেখেছে কিনা সন্দ। শামুক গুলো তো থুতু ফেলা খুশি।

    হারানোর আর দিন পেলে না তোতলা কংগ্রেসী বা বিপথে পরিচালিত গেঁয়ো নফিজুল। শালো!
  • b | 86.135.80.123 | ১৫ জানুয়ারি ২০০৬ ০১:১৮450792
  • আমার আগের প্যারাগ্রাফ টাকে কেউ উড়িয়ে দিতে পারবেন? বই বিষয়ে আলোচনা এটা খেয়াল করিনি। আবার ছড়িয়ে ফেলেছি।

    নিজের লেখা ভুল করে submit করে দেওয়ার পর delete করার একটা ব্যবস্থা থাকলে খুব ভালো হত।
  • Samran | 61.2.3.121 | ১৬ জানুয়ারি ২০০৬ ০০:২১450793
  • যা হারিয়ে গেছে? বরং বলতে পারি সবই হারিয়ে গেছে। সব, সব কটা বই, ছেলেবেলা, ছেলেবেলা থেকে জমানো সমস্ত কিছু, বই আমার। হারিয়ে গেছে। কি যে ছিল আর কি ছিল না, হারিয়েছে সেই স্মৃতিও। হারিয়েছে প্রায় সব নাম। চরিত্র।

    পড়তাম দস্যু বনহুর সিরিজের বই। সুদর্শন সুপুরুষ বনহুর। যাকে দস্যু বলে কেউ বুঝতেই পারতনা। থাকে সে কান্দাইয়ের জঙ্গলে। অসংখ্য ঘোড়া তার আস্তাবলে। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে সে শহরে আসে তার প্রেমিকার সাথে দেখা করতে। তার সেই প্রেমিকার নামও হারিয়েছে। মাকে লুকিয়ে পড়তে হত সে সব বই। মা একবার দেখল কি বাজেয়াপ্ত। হারিয়েছে সব কটি বনহুর।
    বনহুরের বই প্রথম হাতে আসে দাদার মারফত। প্রথম বইটি সে পায় তার কোন এক বন্ধুর কাছ থেকে, আর তারপরের বইটি সে কিনে আনে। আমি তখন বেশ ছোট, বই কেনার মত বড় হইনি তখনও কিন্তু পড়া শুরু হয়ে গেছে দাদার কল্যাণে।অপেক্ষা করে থাকতাম কখন তার পড়া হলে আমি হাতে পাব বইটি। আর বইয়ের জন্য দাদাকে বেশ খোসামোদি করতে হত। পড়া হয়ে গেলেই সে বইয়ের আর কোন মুল্য থাকেনা তার কাছে, কিন্তু যেই আমি পড়ব বলে নিতাম অমনি হয়ে যেত সেই বইটা মহামুল্যবান। কোন কারণে তার রাগ হলেই কেড়ে নিত সে বইটি। আর সেই রাগ তার হরবখতই হত।

    কুয়াশা, যে ছিল এক গোয়েন্দা। দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াত সে। রাতের অন্ধকারে কালো আলখাল্লা পরে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে নিজের কাজ করত সে। সমাধান করত নানা সমস্যার। সেই বয়সে বেশ হিরো হিরো একটা ইমেজ তৈরি হয়েছিল। পেপার ব্যাক এর পাতলা পাতলা বই। একশর উপর বই ছিল কুয়াশা সিরিজের। সব কটা তো ছিলনা তবে ছিল বেশ কিছু। হারিয়েছে সব।

    তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। স্কুলের লাইব্রেরী থেকে এনে পড়ি আমলকীর মৌ, স্তব্ধতার কানে কানে। দিলারা হাশেমের বই। বই দেওয়ার আগে লাইব্রেরী স্যার জানতে চাইতেন অত মোটা বই নিয়ে তো যাচ্ছ, পড়বে তো? স্যারকে অনুরোধ করতাম যেন দুটি বই দেন, কিন্তু একটির বেশি বই পেতামনা হাতে। লাইব্রেরী ক্লাসে যাওয়া ছিল বাধ্যতামুলক। ক্লাসের অনেক মেয়েই ছিল যাদের অনিচ্ছা সত্বেও যেতে হত, সেরকমই দুটি মেয়ে ছিল আমার বন্ধু, তাদের সঙ্গে চুক্তি ছিল তারা বই নিয়ে আমায় দিয়ে দেবে। এভাবে একদিনে তিনটি বই পেয়ে যেতাম। এক সপ্তাহের জন্য।বাড়ি ফিরে সেদিন আর খেলতে না গিয়ে সেই বই নিয়ে সোজা পড়ার টেবিলে। উপরে পড়ার বই নিচে গল্পের বই। এই চালাকিটুকু করতে হত মায়ের জন্য।
    আমলকীর মৌ বইটি আমি পরে কিনেছিলাম।
    ঐ সময়টাতে আমি এমন সব আত্মীয় বন্ধুর বাড়িতে বেশি যেতাম যাদের বাড়িতে বই আছে। একবার বই আনা আবার ফেরত দেওয়া। প্রায় প্রতিবারই একটা করে বই রেখে দিতাম। পরে খোঁজ হলে অবশ্য ফেরত দিতে হত। সে বড় দু:খের ব্যাপার হত।

    ঈদ সংখ্যা বিচিত্রায় প্রকাশিত উপন্যাস মিউর‌্যাল এর শুধু নামটুকুই আছে। হারিয়েছে গল্প,চরিত্ররা।
    ইমদাদুল হক মিলনের হে প্রেম। চরিত্রের নাম চেষ্টা করেও মনে পড়ছেনা। তখন, সেই ৮০ সালে বেশ অভিনব ষ্টাইলে লেখা হে প্রেম মুগ্‌ধ করেছিল। হারিয়েছে সেটি এবং পরপর কিনে ফেলা মিলনের সবকটি বই।
    সাপ্তাহিক বিচিত্রা। প্রতিটি সংখ্যা কি যত্নে জমিয়ে রাখতাম। ঈদের এক বিশেষ আকর্ষণ ছিল ঈদসংখ্যাগুলো।
    জন্মদিনে পাওয়া রুশদেশের উপকথা। ইভানের ছেলেবেলা।
    কাকার কাছ থেকে পেয়েছিলাম শেষের কবিতা। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের সবকটি খন্ড। শরৎ রচনাবলী। হারিয়েছে সব।
    তিনগুণ বেশি দাম দিয়ে কেনা সব পুজোসংখ্যা। ভারতীয় লেখকদের লেখা বইয়ের আকর্ষণ ছিল অন্যরকম। বেশি দাম দিয়ে কিনতে হত বলে বেশ অনেকদিন ধরে টাকা জমাতে হত আর তারপরে রাত জেগে সে বই পড়া।
    বিয়ের পরে বরের কাছ থেকে পাওয়া প্রথম উপহার,বই। উত্তরাধিকার, সোনার হরিণ নেই, বাবলি। সেই প্রথম পড়ি বুদ্ধদেব গুহর লেখা। তারপর পরপর পড়েছি তার বেশ কিছু বই। ওর লেখা বেশ খানিকটা যেন মেলে আমাদের সেলিনা হোসেনের লেখার সাথে। উল্টোটাও হতে পারে। বইয়ের নাম,চরিত্রের নাম,গল্প কিছুই ঠিকঠাক মনে নেই তাই সঠিকভাবে বলতে পারছিনা।
    অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কাকিমার বাপের বাড়ি থেকে এনেছিলাম অশনী সংকেত। বইটি পড়ে এমন মনে হচ্ছিল যেন আমিও আছি এক দুর্ভিক্ষের দেশে। খাবার দেখে ভেবেছি, খাবার? কোথা থেকে এলো? দুর্ভিক্ষ চলছেনা!
    পিসির বাড়ি বেড়াতে গিয়ে পেয়েছিলাম 'এক রমনীর যুদ্ধ'। পিসতুতো ভাইয়ের ছিল সেটি। পড়ব বলে চেয়ে এনে আর ফেরত দেওয়া হয়নি।

    প্রথমবার কলেজ স্ট্রিট যাই বাংলাদেশ থেকে আসা এক আত্মীয়ের সাথে। তাদের কিছু বই কেনার ছিল,রঙ কেনার ছিল। মনে আছে আমার সেদিন সারাটা দিন আমার কেটেছে ঐ বইপাড়ায়। এ দোকান, ও দোকান ঘুরে ঘুরে। বই দেখে। নতুন বই। পুরনো বই। বেশ কিছু বই কিনেছিলাম। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা। মেয়ে তখন ছোট, তাকে তার জ্যাঠিমার কাছে রেখে সারাদিন বই দেখে বেড়ানো। হারিয়েছি সেই বই এমনকি বইয়ের নামও।

    হারিয়েছে বিয়ের পরে স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া সব চিঠিপত্র। সেগুলো রাখা ছিল একটা বন্ধ আলমারীতে অন্য বেশ কিছু দরকারী কাগজ-পত্রের সাথে। বেশ কিছুদিন পর পরিষ্কার করার জন্যে আলমারী খুলতে দেখা গেল উইয়ে খেয়েছে ভেতরকার যাবতীয় কাগজ। চিঠি কি কেবলই চিঠি। চিঠি যায়, সঙ্গে নিয়ে যায় আরো অনেক কিছু।

    ধীরে ধীরে বই পড়া কমতে লাগল সময়ের সাথে সাথে। বাড়ি যখন যেতাম, প্রায় সব বই ই নিয়ে যেতাম সাথে করে। রেখে আসতাম আমার অন্য সব বইয়ের সাথে। একটা সময় এমন এলো আমার পড়া বলতে শুধুই খবরের কাগজ। দেশে আলমারীতে সাজানো আমার সব বই,ম্যাগাজিন। বহু বছর তারা ছিল আমার অনুপস্থিতি সত্বেও। এখন আর নেই। প্রায় চার বছর বিবিধ কারণে দেশে যাওয়া হয়নি, যখন গেলাম, গিয়ে দেখি সবকিছুই তেমনি আছে নেই শুধু আমার বই।

    যে আলমারীতে আমার বই থাকত এখন সেখানে বিভিন্ন জিনিসপত্র।

    সামরান
  • sumeru | 61.2.3.190 | ১৬ জানুয়ারি ২০০৬ ১১:৪১450794
  • টই-ও যে হারিয়ে যায়
    --------------------

    এই রকম বদ স্বভাব অন্তত আমার না, যদিও হারানোর বেয়াদবি মজ্জায়-মজ্জায়, প্রথম প্রেম কেটে যাবে যাবে দশা, ইনকিউবেশনেই,ওফ, বই-এর ফাঁকে যে ছাই ছাই পালক রাখা ছিল, তা আমার জানাই ছিল না, ফেরৎ-পর্ব শুরু করে দিয়েছি,ঝামেলা করে বই তো নিল না,লিখিও উহা ফিরৎ চাহ কি না? সেন্টু-মেন্টু দিয়ে একটা চিঠি তৎসহ একটি ময়ূরের পালক,না ভবি ভোলার নয়,ঐ পালকে তার হাজার বছরের পথ হাঁটার প্রেম জমে, নিকুচি করেছে, আমরা যেন পেরেম করি নাই, হাফ প্যান্টুলুনে...

    একটা হারষ্টেন ভরতি নোট লেখা ছিল আমার, একদম গিজি-গিজি-গিজি, অন্য কেউ পড়তেই পারবে না, আসলে লোকাল ট্রেনে আপিস টাইমে বসে যাওয়ার কারণে, কিছু একটা খুলে আঁকি-বুকি কাটতেই হত, এই বসতে দে, বসতে দে, প্রথমে রেখার চলন থাকত জিরাফের মত, বসার পরে স্রেফ উঁই পোকা।তা খাসা, বসা ছিল, নোট ছিল, কাটা ছিল, কুটি ছিল,রোবে মালটার থেকেও দু-ইঞ্চি উপর দিয়ে যায়, গুরু ছোবিও আঁকছি, মালও নামাচ্ছি, খাল্লাস, হ্যাঁ সেই, জলে ভিজল না, পোকায় কাটল না, ঐন্দ্রিলা নিয়ে গেল মলাট দিয়ে দেবে বলে, মলাট-ওয়ালা যে মাল হাতে এল, চক্ষু না চায়, পরাণ যায় যায় যায়...

    আমার সঞ্চিতার মলাটে ছিল নাম না জানা এক মানস সুন্দরীর ছবি। জয়ন্তদের বাড়ির ম্যাকডাওয়েল কোম্পানির গোটা ক্যলেন্ডারটাই আমরা ঝেড়ে দিয়ে ছিলাম, প্রতি পাতায় দীর্ঘশ্বাস ছবি, তুমি কি জিনিস গুরু, চারজনের ভাগে পড়ল একটা করে পাতা, যে বই-এ কম হাত পড়ে, তার মলাট দিয়ে ফেলাম, তবু স্কুলের বন্ধুদের তো দেখাতেই হয়, অগত্যা স্কুলব্যাগে। হেডু মালটা যে বড় ব জানতাম, হই-চই দেখে সটান ক্লাসে, ছবি সমেত বই বাজেয়াপ্ত, কার বই, কার বই? কে উঠে দাঁড়ায়, পাগোল, ক্লাস সিক্স...

    মায়া ও বাতায়ন জুড়ে যে চটি বইগুলি লুব্ধক হয়ে উঠবে, তারা কখনই আমার নিজের ছিল না, বই আসে বই যায়, হলুদ সেলোফেনে মোড়া অক্ষত যোনিটি যেন পাওয়া হয়েই ওঠে না আমার, পানপাত্রে চলকে পড়া অতিরিক্তের মত, ঐটিতেই যেন বেঁচে থাকা, চাঁদা তুলে কেনা বিদেশী ভোগপত্রিকাগুলি কখনই কাছে থাকার নয়, হায়, অধরা মাধুরী,আহা কত কিছুই তো সাধ বাকী থাকবে জীবনে, কিন্তু যে ঝলমলে কুহকিনীরা ডাকছে ,অস্বীকার করলে ওপরওয়ালার কাছে কী জবাব দেব, সুতরাং ব্লেড, কাটা-কুটির পর তাদের স্থান মলাটের অন্তরালে, আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে, খুকী হাসে বিনাবাসে,তো সেই সীতাদের আস্তাবল একদিন হরণ হবে, পল্লীর পথ পরে,ঠিক একবেলার জন্য,বাবার বন্ধু অমিতাভকাকু চেয়ে নিয়ে যাবে কৃত্তিবাসী রামায়ণটি এবং ফেরৎ আসবে না সারা জীবনেও, সেই রাত্রেই হার্ট অ্যাটাক, না না এই মৃত্যুটি কোন হত্যা নয়, নিশ্চিত…

    সুমেরু
  • b | 67.103.141.130 | ১৭ জানুয়ারি ২০০৬ ০৭:১৬450795
  • ছোটোবেলায় দারুন প্রিয় বই ছিল Three Men in a boat। কে জানি বই টা ঝেড়ে দিল। এখন রূপা তে বই টা দেখি, উল্টে-পাল্টে, কিনতে ইচ্ছা করে না। আবার যদি হারিয়ে যায়।
    আরো মজার হারানো ও' হেনরীর গল্প কালেকশন। হার্পার কলিন্সের বই ছিল। বাবা কিনে এনেছিল কোনো এক বই মেলা থেকে। আমার ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাসের বন্ধু সুনীল ঢোলে বই টা নিয়ে বলল just ফেরত দেব না। তোর তো বহু বার পড়া!!
    তাও আজ চাইলেও এই বই গুলো কিনে পড়তে পারি।
    ইস্কুলের দিন গুলো তে সকাল সন্ধ্যায় প্রেয়ার ছিল মাস্ট। আমাদের চরম বিরক্তির বিষয়। প্রেয়ারের জন্য আবার সাদা ধুতি-চাদর ছিল। তখন আমাদের হাতের কাছে অ্যাডাল্ট সাহিত্য সুনীলের 'অমৃতের পুত্র কন্যা'। প্রেয়ার ড্রেসের যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে আমরা রাতে খাবার পরে সেল্ফ স্টাডি তে গায়ে ঐ প্রেয়ার চাদর জড়িয়ে 'অমৃতের পুত্র কন্যা' পড়তাম। একজন বসে বসে কথকতার মত পাঠ করত, অন্য সবাই গদগদ ভক্তি নিয়ে শুনত। পরে আবার বিশেষ বিশেষ অংশের টীকা টীপ্পনী ব্যখ্যা করা হত। এখন হাতে বই টা পেলেও প্রেয়ার নেই, চাদর নেই। আর সময় টাও হারিয়ে গেছে।
  • n | 131.95.121.107 | ১৩ জুন ২০০৮ ২১:২৩450796
  • এই লেখাগুলো আবার চলতে পারে? নাকি কারুর আর বই হারায় না আজকাল?
  • Paramita | 63.82.71.141 | ১৩ জুন ২০০৮ ২২:৩৬450787
  • আমার প্রচুর নাম হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রিয়জনেরা, সবাই আজ নেইও, সে প্রিয় নামে ডেকেছিল -
  • Du | 67.111.229.98 | ১৪ জুন ২০০৮ ০০:০১450788
  • আরে সেই থেকেই তো দু নামকে তুলে আনা।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন