এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • জয়পরাজয় - সম্রাট, সাম্রাজ্য ও সুন্দরী

    Pradhanna Mitra লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৪ জুন ২০২৩ | ৩৬৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)


  • “Nothing endures, but nothing is meaningless either. We rise, we fall, we rise again, and again we fall. We go on. I too have succeeded and I have also failed. Death is close now. In death do triumph and failure humbly meet. We learn far less from victory than from defeat.”

    রুশদী-র লেখা উপন্যাসের একদম শেষ পর্যায়ের লাইনগুলো আমি যখন পড়ছি, মনের মধ্যে তখন বড়ো উথাল পাথাল। পড়তে পড়তে আমিও যে কখন পম্পা কম্পানা-র সহমর্মি হয়ে পড়েছি, টের পাই নি। টের পাই নি, কীভাবে আস্তে আস্তে আমার বয়সও আড়াইশো বছর পার করল। নয় বছর বয়সে যে মেয়ের জীবন শুরু হল মা-র অগ্নিপ্রবেশের সাথে সাথে, সেই মেয়ে কখন যেন রাণী হল, কখন যেন অজ্ঞাতবাসে গেল, কখন যেন রাজমাতা হল, কখন যেন দৃষ্টিহীন হয়েও দৃষ্টিমতী রয়ে গেল --- ইতিহাস তারও কোনও চিহ্ন রাখল না।

    ইতিহাস কারোরই চিহ্ন রাখে না। মার্কেজ কি এমন গল্পই লিখেছিলেন তার নিঃসঙ্গতার শতবর্ষে? সাম্রাজ্যের উত্থান আর পতন --- কয়েকশো যুগ তার সময়কাল হলেও, তার চিহ্ন কি থাকে অবশেষে? --- “সে চিহ্ন যাবে মিলিয়ে / যে রাত্রে সকল চিহ্ন পরম অচিনের মধ্যে যায় মিশে।।”

    সলমন রুশদী তার নবতম উপন্যাসের পটভূমিকা নির্মাণ করেছেন বিজয়নগর সাম্রাজ্যকে ঘিরে। ১৪শ শতক থেকে তার গল্পের সূচনা --- ছায়ায় মায়ায়। ম্যাজিক রিয়েলিজম্‌ এই উপন্যাসের পাতায় পাতায়। ঠিক যেন মহাকাব্যের দ্যোতনা। ‘কাম্পিলা রায়’-এর মৃত্যুর সাথে সাথে পতন হয় কাম্পিল্য সাম্রাজ্য --- “…the tiny principality of Kampili, “Kampila Raya,” raya being the regional version of raja, king. This second-rate raya had just about enough time on his third-rate throne to build a fourth-rate fortress on the banks of the Pampa river, to put a fifth-rate temple inside it, and to carve a few grandiose in…” জওহর ব্রতের আগুনের গ্রাস সমাজকে নারীশূন্য করে। নারীশূন্য সমাজ অস্তিত্বহীন। নারী থেকেই সমাজের পুনরারম্ভ।

    নয় বছরের বালিকা পম্পা। বেঁচে থাকে। পালক ঋষি বিদ্যাসাগর। গুহাবাসী তারা। আশীর্বাদ বর্ষিত হয় তার ওপর --- “you will fight to make sure that no more women are ever burned in this fashion, and that men start considering women in new ways, and you will live just long enough to witness both your success and your failure, to see it all and tell its story, even though once you have finished telling it you will die immediately and nobody will remember you for four hundred and fifty years.” --- আশীর্বাদ, না অভিশাপ?

    দুই ভাই --- হুক্ক আর বুক্ক। ক্লান্ত, ভীত, পলাতক। এসে পৌছয় ঋষি বিদ্যাসাগরের গুহায়। পম্পার হাত থেকে পায় এক থলি বীজ। জাতকের বীজ। সে বীজ ছড়িয়ে দেয় পম্পার তীরে, জঙ্গলের ধারে। যেখানে একদিন গণমৃত্যু হয়েছিল, সেখানেই গড়ে ওঠে সাম্রাজ্য। এক রাত্রে। বিষনাগা। দুই সম্রাট, এক মহিষী, এক বিদেশী – সঙ্গম বংশের উত্থান। ঈর্ষা আছে, ঈর্ষা থাকে। সমাজ তৈরী হয়, সমাজ এগিয়ে চলে। নীতি সমাজকে একত্র করে, এক করতে পারে না। একে-একে কালের স্রোতে সবাই বয়ে যায়। থেকে যায় পম্পা। থেকে যায় বিদ্যাসাগর। গুরু হয়ে ওঠে শিষ্যার প্রতিস্পর্ধা। সমাজ এখন ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ে মুখোমুখি। দেবতা বড়ো, না মানুষ বড়ো? --- “... even the magic seeds have one rule for the rulers and another for the ruled, he reflected. But if the ruled continue to be unruly it won’t be easy to rule them.”

    দিন যায়, রাত যায়। মানুষ যায়, মানুষ আসে। সমাজের গতি শ্লথ। পম্পা তেমনই যুবতী, যেমন ছিল। মানুষ অস্বাভাবিকতাকে কবেই বা গ্রহণ করেছে? নিয়ম নীতির বাঁধনে কাউকে না বাঁধতে পারলে সমাজ বড়ো দুর্বল বোধ করে। তখন সে মনে করে বিনাশেই মঙ্গল। ম্যাজিকে সমাজ তৈরী হয়, কিন্তু সে চলে বিশ্বাসে, Puritan বিশ্বাসে। ম্যাজিক তখন বিভীষিকা। সমাজ হয়ে ওঠে অসহিষ্ণু --- “The dynasty would descend into squabbling, growing religious intolerance, and even fanaticism.”

    পম্পা আর তার তিন মেয়ে। পালায়। জঙ্গলে। কত বছর কেটে যায় জঙ্গলে --- দশ, পঁচিশ, পঞ্চাশ? মনে পড়ে? হ্যাঁ, ১৩২ বছর। জঙ্গল মানে কি? --- “They had arrived in arajakta, the place without kings.” এখন কি অরাজকতা চলছে? সারা বিশ্বজুড়ে? আমরা যাকে বলি মধ্যযুগীয় বর্বরতা। আমরা শিউরে উঠি। প্রতিবাদ করি। প্রতিকার করতে পারি কি? যারা প্রতিবাদ করে না, তারা জঙ্গলে মিশে যায় --- যুক্তাশ্রী; যারা মুক্তি চায়, পাখী হয়ে উড়ে যায়, অন্য বিশ্বে --- জেরেল্ডা; যারা জঙ্গলের নিগড়ে নিজেদের বেঁধে রাখে – প্রেমে-অপ্রেমে – জ্যোৎস্না। কেবল ঘুমিয়ে থাকে সাম্রাজ্যের প্রাণপুত্তলি --- বহু বছর পরে কেউ আসবে, তার অপেক্ষায়। অজ্ঞাতবাস ভাঙবে। মিথ সত্য হবে। অলৌকিক প্রাণ পাবে। লৌকিক হবে। দেবত্ব তার আসন পাবে। সাম্রাজ্য আবার জাগবে। শুরু হবে সুবর্ণ যুগ। অচলায়তনের শাসন ভাঙবে কেউ, যেমন ভেঙেছিল কৃষ্ণদেবরায়, কুড়ি প্রজন্ম পর। পম্পা এবার রাণী নয়, রাজমাতা।

    সমাজ এখন স্থিতিশীল। পরিণত। সে জানে, কীভাবে নিজেকে স্থির রাখতে হয়। যৌবনের স্পর্ধা নেই। বিদ্যাসাগর নেই, মাধ্বাচার্য আছেন। ডোমিঙ্গো নুয়েন্স নেই, নিকোলো ডি’ ভেরি আছেন।

    সমাজ এগোয়। বার্ধক্যের দিকে। ঈর্ষা-হিংসা-দ্বেষ – বাড়ে। রাজা অত্যাচারী। সমাজ অন্ধ। ব্রাহ্মণ্যরাজ ঠুঁটো জগন্নাথ। মন্ত্রী তথা বুদ্ধিজীবী কারাগারে। একে অপরের হাত ধরে অন্ধকার ঘরে বসে থাকে। অন্ধকার কেন? রাষ্ট্র অন্ধ। পম্পা’র চোখের জ্যোতি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মৃত্যু আসে - বুদ্ধিজীবীর, দেবত্বের, সম্রাটের, সাম্রাজ্যের। প্রতিবেশীই বহিঃশত্রু। তাদের কাছে মূর্তি মহাপাপ। শিল্প মহাপাপ। সৌন্দর্যের বহিপ্রকাশ তাদের শাস্ত্রে লেখা নেই। এতএব ধ্বংস অনিবার্য। তারা ধ্বংস করে। প্রাসাদ চুরমার করে। শিল্পের বিনাশে তাদের আনন্দ। “...there was the sound of smashing: the destruction of palaces and statues and all that had been beautiful. The giant statues of Lord Hanuman and of the goddess Pampa were broken into so many pieces that afterward it was impossible to believe that such statues had ever existed. The bazaar burned; the “foreigner’s house” burned; almost all that had been the capital city of the empire of Bisnaga was reduced to rubble, blood, and ash.” তারা ভাবে, এভাবেই বিনাশ হবে বিধর্মীরা। তারা জানে না, মহাকালের গাঁথা লেখা থাকে মাটির তলায়। তার মহাকাব্যিক নাম - জয়পরাজয়। রাষ্ট্রমাতা যে ইতিহাস লিখে রেখে যায়, সে ইতিহাস মরেও মরে না। অন্তিম পর্যন্ত তার যাত্রা। মহাকাব্যিক ছন্দেই হোক, কিম্বা মহাউপন্যাসের পরিভাষায়।

    সলমন রুশদী ভাষার জাদুকর। তিনি জানেন কীভাবে পাঠককে পড়াতে হয়। এ পর্যায়ে আমার মনে পড়ে যায় হারুকি মুরাকামিকে, বা হুমায়ুন আহমেদকে। সলমন রুশদী গোটা পৃথিবীর আত্মাকেই কি ধরে রাখতে চেয়েছেন এই উপন্যাসে? জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, গোটা জীবনের সাথে সাথে গোটা পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থাকে তিনি দেখেছেন। এটাই কি তার উপলব্ধি? দার্শনিক উপলব্ধি নয়। ঐতিহাসিক উপলব্ধি। কখনও কখনও গল্পের টানটান বুনোট আলগা হয়ে যায়, কখনও প্রচন্ড আঁটসাঁট, কখনও অতিদ্রুত। ছন্দপতন ঘটে, ছন্দ আসে। কখনও আঙ্গুলের নখ কাটি দাঁত দিয়ে, কখনও ফেলে রাখি – দুদিন, তিনদিন। কখনো রাত কেটে যায়, কখনও পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ি। বিষনাগা তবু এগিয়ে চলে, পম্পার যাত্রা অব্যহত থাকে। আমি পড়ি। আমি পড়া শেষ করি...

    “Their deeds will only be known in the way they have been set down.
    They will mean what I wish them to mean.
    I myself am nothing now. All that remains is this city of words.
    Words are the only victors.”

    =====================

    Victory City
    Salman Rushdi
    Penguin Publication
    Price – 699/-
    কবি কৃতজ্ঞতাঃ শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন