এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • জেগে ওঠ - জ্যাক কেরুয়াকের "Wake Up" বইটির বাংলায় অনুবাদ

    অরিন
    অন্যান্য | ২২ মে ২০১৬ | ৬৪৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অরিন | 111.98.194.178 | ২২ মে ২০১৬ ০৫:১৯716600
  • গতকাল বুদ্ধপূর্ণিমা ছিল, বুদ্ধদেবের জন্মজয়ন্তী, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভেসক।
    গত বছরের বেশ কয়েকটা মাস ধরে বুদ্ধদেব ও সুরঙ্গমা সূত্র কে কেন্দ্র করে একটি লেখা লিখেছিলাম, লেখাটি জ্যাক কেরুয়াকের "Wake Up" নামে বইটির বাংলা অনুবাদ ও অনুপ্রেরণায়। অল্প কয়েকজন বন্ধুবান্ধব পড়েছেন। বইটার বিভিন্ন অংশ এখানে দেবার ইচ্ছে রইল, জানি না আপনারা গ্রহণ করেবেন কি না। মূল লেখাটার সূচীপত্র এখানে রাখা আছে

    https://medium.com/জেগে-ওঠ/জেগে-ওঠ-র-পর্ব-b3ef8ae40b2f#.cwvrrt9rc

    প্রথম পর্ব (বা মুখবন্ধ, কৈফিয়ৎ, যা বলবেন), দিয়ে শুরু করি ...

    মুখবন্ধ

    জ্যাক কেরুয়াকের আঁকা, ছবির নাম enlightenment ( “দিব্যজ্ঞান” ), ছবিটা পেনসিল দিয়ে স্কেচবইতে এঁকেছিলেন ১৯৫৬ নাগাদ, মূল বইটি থেকে নেওয়া
    পরমকারুণিক বুদ্ধদেবের পদতলে শ্রদ্ধা নিবেদন করে শুরু করছি। বুদ্ধদেবকে ও সুরঙ্গমা সূত্রকে নিয়ে লেখা, যেমন বুঝেছি, সেই মত লিখব, যতটা পারি। আশা করব ত্রুটি ধরবেন, জানাবেন, কোনটা ঠিক মনে হয় সেটাও জানাবেন ও আপনারা নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন, তবে, অবশ্যই মন্তব্য করবেন।
    এই ব্লগটির সূত্রপাত জ্যাক কেরুয়াকের “wake up” নামে বইটির বাংলা অনুবাদ রূপে, তবে সবটাই যে কেবল ওই বইকে কেন্দ্র করে হবে তার বাইরে কিছু হবে না, তা হয়ত নাও হতে পারে। তবে মূল বইটিকে যথাসম্ভব আশ্রয় করে চলব। সব শব্দ ও বাক্য হয়ত যথাযথ অনুবাদ করতে পারব না, ভুল শোধরানোর হলে নির্িদ্বধায় জানাবেন। মূল বইটির শুরু Jack Kerouac মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান্টা বারবারায় গ্রথিত একটি বৌদ্ধমন্দিরে গ্রথিত একটি প্রার্থনা, Dwight Goddard এর লেখা, দিয়ে শুরু করেছেন। প্রার্থনাটির ইংরেজী ভাষ্য এই রকম,
    Adoration to Jesus Christ The Messiah of the Christian World Adoration to Gotama Sakyamuni The Appearance Body of the Buddha
    খ্রীস্টিয় জগতের আদিপুরুষ যীশুখ্রীস্টকে প্রণাম, বুদ্ধের অবতারকল্প শাক্যমুনি গৌতমকে প্রণাম!
    আমার লেখাটি জ্যাক কেরুয়াকের বইটিকে কেন্দ্র করে, বইটি আবার বিভিন্ন সূত্রের ওপর নির্ভর করে লেখা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের শাস্ত্রের উদ্ধৃতি আছে, তার বেশ কিছু সরাসরি, তবে বেশ কিছু নতুন শব্দও হয়ত জুড়ে যেতে পারে। বুদ্ধের জীবন কাহিনি মূলত অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত আর পোকালা লক্ষ্মী নরাসুর লিখিত বুদ্ধের জীবনী থেকে নেওয়া, তবে “আলোর এই মহাসমুদ্রে” এত সহস্র নদী এসে মিশেছে যে একটি থেকে আরেকটিকে আলাদা করা সম্ভব নয়। এদের মধ্যে লঙ্কাবতার সূত্র, ধম্মপদ, অঙ্গুত্তরীয় নিকায়, ইতিভুত্তক (itivuttaka), দীঘ্ঘ নিকায়, মঝ্ঝিমা নিকায়, থেরাগাথা, বিনয় পিটক, প্রজ্ঞাপারমিতা হৃদয় সূত্র, সাম্যুত্ত নিকায়, চুয়াংশি, তাও তে চিং, মিলারেপার জীবন, মহাযান সংগ্রহ।
    এই লেখাটির কেন্দ্রে এক মহাসূত্র, নাম সুরঙ্গমা সূত্র। সুরঙ্গমা সূত্র বিশাল, তাকে সংক্ষিপ্তাকারে পেশ করার চেষ্টা করব। সুরঙ্গমা সূত্র যিনি মূল লিখেছিলেন, তাঁর সন্ধান পাওয়া যায় না। তিনি খ্রীষ্টিয় প্রথম শতাব্দীতে লিখেছিলেন, সেই সময়ে অধীত জ্ঞানসূত্রেই লিখেছিলেন নিশ্চয়ই; সেই সুপ্রাচীন ধর্মকে আসুন আরেকবার আমাদের সময়ে ফিরে দেখি। অশ্বঘোষের কথা দিয়ে শেষ বা শুরু করা যাক,
    শুরু থেকে শেষ সেই মহাতাপসের কীর্তিগাথাই এই লেখার উদ্দেশ্য, যা শাস্ত্রে আছে তাই লেখা হোক, কোন রকম আত্মপ্রচার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।
  • অরিন | 111.98.194.178 | ২২ মে ২০১৬ ০৫:২২716601
  • দ্বিতীয় পর্ব

    বুদ্ধ মানে যিনি জেগেছেন।
    সেদিন অবধি, পশ্চিমের দেশগুলোতে, বুদ্ধ বলতে লোকে ভাবত, সেই যে, টুরিস্টদের জন্যে দোকানের জানলায় সাজিয়ে রাখা, সস্তার দোকানের মিষ্টি মিষ্টি হাসি হাসি মুখের নাদুস নুদুস গোলগাল আদুরে ভুঁড়ি বের করা আহ্লাদী এক “বুডা”। জানতই না যে সত্যিকারের বুদ্ধ আসলে ছিলেন এক অসামান্য রূপবান যুবক রাজকুমার। রাজপ্রাসাদে একদিন হঠাৎ গভীর চিন্তায় তিনি নিমজ্জিত, চোখের সামনে সুবেশা নর্তকীর দল, অথচ তাদের তিনি দেখেও দেখেন না, যেন তারা কেউ নেই কোথাও; দৃষ্টি ভেদ করে অনন্তে প্রসারিত, তার পর … শেষে মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে সংসার থেকে হাতটাত তুলে দিয়ে দৃপ্ত যুদ্ধাশ্বে সওয়ার হয়ে সেই যে সে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পাড়ি দিলেন অরণ্যের নির্নিমেষ গভীরতায়; সেখানে খাপখোলা শাণিত তরবারীর এক কোপে ছিন্ন করে দিলেন তাঁর সযত্নলালিত আজানুলম্বিত কাঞ্চণবর্ণ কেশদাম, তারপর ধ্যানমগ্ন হলেন সমকালীন ভারতের সাধকদের সঙ্গে; ৮০ বছর বয়সে অনন্ত সনাতন পথের, অনন্ত অরণ্যের পরিযায়ি পরম শ্রদ্ধেয় এক ছিপছিপে সন্ন্যাসীরূপে জীবনের ছেদ টেনে দিলেন চীরতরে।
    অপিচ, মানুষটা মোটেই থলথলে গোলগাল হাসিখুশি নাদুস নুদুস তো নয়ই, বরং বলা চলে সাংঘাতিক রকমের গুরুগম্ভীর, মহাদুঃখী এক তাপস। ভারতের, প্রায় তাবৎ এশিয়ার, যীশু ।
    যে ধর্মের প্রবর্তন তিনি করে গেলেন, বৌদ্ধধর্ম, অস্তিত্বের স্বপ্নে যার মহাজাগরণ, তাতে আজ লক্ষ লক্ষ মানুষ শরণ নিয়েছে। প্রাচ্যদেশের ধর্মের গভীরতা বা ব্যাপ্তির আন্দাজ আমেরিকা বা পশ্চিমের খুব অল্প মানুষেরই অবশ্য আছে। কজন লোকে জানে যে যেমন আমেরিকা, ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, ইটালি, মেক্সিকোতে খ্রীস্টধর্ম, তেমনই কোরিয়া, বর্মা (এই বই লেখার সময় বর্মা মায়নমার নামে প্রচলিত ছিল না), শ্যামদেশ (থাইল্যাণ্ড), তিব্বত, জাপান, লাল-পূর্ব চীন এই দেশগুলোতে বৌদ্ধধর্মের আধিপত্য। তো এই যে তরুণ যুবরাজ, যিনি এতটাই পরমদুঃখের প্রজ্ঞায় নিবেশিত এক প্রাণ, যে, তাঁকে হারেম-ভর্তি সুন্দরীরা অবধি টলাতে পারল না, এই তিনিই গৌতম, ৫৬৩ খ্রীস্টপূর্বাব্দে সিদ্ধার্থ নাম নিয়ে ভারতের গোরক্ষপুরে শাক্যরাজবংশে রাজকুমার হয়ে জন্মেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম, কি আশ্চর্য, মায়াদেবী (মায়া কথার অর্থ ইন্দ্রজাল); মায়াদেবী সিদ্ধার্থের জন্মের সময় মারা গিয়েছিলেন, তাই সম্পরর্কে মাসি প্রজাপতি গোতমীর কোলে সিদ্ধার্থ বড় হয়েছিলেন। ক্ষত্রিয়দের যেমনটি হওয়া উচিত, সিদ্ধার্থ যুবক বয়স থেকেই চৌকস খেলোয়াড়, ওস্তাদ ঘোড়সওয়ার; কথিত আছে যে দুরন্ত এক প্রতিযোগিতায় আর সব রাজপুত্রদের হারিয়ে সিদ্ধার্থ যশোধরার পাণিগ্রহণ করেন।
    তাঁর যখন ষোল বছর বয়স, সেই সময় তাঁর যশোধরার সঙ্গে বিবাহ হয়। রাহুল নামে একটি পুত্র সন্তানও জন্মায় তাঁদের । তাঁর পিতৃদেব মহারাজ শুদ্ধোদন তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, ও অমাত্যদের সঙ্গে মন্ত্রণা করতেন কিভাবে বছর তিরিশের সিদ্ধার্থকে এতটাই হর্ষোল্লাসে রাখা যায় যাতে ক্রমবর্ধমান গভীর দুঃখবোধ থেকে মনটাকে দূরে রাখা যায়। কি সেই দুঃখ? একদা, রাজউদ্যানের মধ্যে রথে চড়ে যেতে যেতে রাজপুত্র দেখতে পেলেন এক বৃদ্ধ মানুষ রাস্তা দিয়ে ধীরপদে হেঁটে যাচ্ছেন। “এ কেমন মানুষ? শ্বেত মস্তক, স্খলিত স্কন্ধ, ঘোলাটে চোখ, শীর্ণ শরীর, যষ্টির ওপর ভর করে চলেছেন এনার শরীর কি কেবল রৌদ্রে তপ্ত ও শীর্ণ, নাকি এই অবস্থাতেই এনার জন্ম হয়েছিল? দ্রুত ঘোরাও শকট সারথি, ফিরে চল । বৃদ্ধ বয়সের কথা ভেবে দেখলে, এ কাননের শোভায় কি বা আসে যায়, জীবনের দিনগুলো যেন ঝড়ের মত বয়ে চলে, চল, চল, দ্রুত শকট ফিরিয়ে নিয়ে প্রাসাদে নিয়ে চল আমায়। “ তারপর আরেকদিন, চতুর্দোলায় মৃত মানুষকে বয়ে নিয়ে যাওয়া দেখে রাজপুত্রের রোদন, “হে নশ্বর মানব! পশ্ব! অনুসরণকারীগণ শোকে বিহ্বল, দেখ কেমন অঝোরে কেশকর্ষণপূর্বক রোরুদ্যমান … ইনিই কি কেবল একমাত্র মৃত মানুষ, নাকি এমন আরো আছে? দেখ! শরীর ধূলায় বিলীন হবেই, অথচ দেখ সর্বত্র মানুষ কেমন অবিবেচকের মত জীবন কাটাচ্ছে; এ হৃদয় তো জড়বৎ কাষ্ঠ নয়, সে নয় পাষাণ, তবু কেন এ হৃদয় বুঝেও বোঝে না সমস্ত নশ্বর, সব বিলীয়মান …” সেই রাতে, মহারাজের কানে এই সমস্ত কথা গেল। মহারাজ রাজমন্ত্রী উদায়ীর সঙ্গে পরামর্শ করলেন। রাজার নির্দেশে উদায়ী পুরনারীদের আদেশ করলেন তারা যেন তাদের মোহিনী মায়ায় রাজপুত্রের মন ভোলায় । কত রকম অঙ্গভঙ্গিই না তারা করলে, কাঁধের আলতো রেশমী চাদর খসিয়ে ফেলে, সর্পিল বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে, ভ্রূ নাচিয়ে, কেউ কেউ আবার ব্রীড়াবনত অবস্থায় বক্ষস্থল থেকে গোলাপ ফুল চ্যুত করে ছদ্মরোদনে বলে উঠল, “ওগো রাজকুমার, এ শরীর কি আমার নাকি তোমার?” তবু, দুঃখের মেত্তায় রাজপুত্র অটল রইলেন। রাত গড়াল মধ্যরাত্রে। নারীগণ শ্রান্ত , অবসন্ন, কেউ দিভানে, কেউ বালিশে, ঘুমিয়ে পড়লেন। জেগে রইলেন রাজপুত্র। আর একরাশ কৌতুহল নিয়ে জেগে রইলেন মন্ত্রী উদায়ী।
    “এমন তো নয় আমি সৌন্দর্যের মর্যাদা দিই না”, গভীর অন্ধকারে কৌতুহলী মন্ত্রীর উদ্দেশে ঘোষণা করলেন তিনি, “এমনও নয় যে মানুষের আনন্দের যে কি ক্ষমতা তা আমি বুঝি না, তবু; তবু, সর্বত্র আমি যে দেখি সমস্ত পরিবর্তনশীল, তাইতো আমার হৃদয় বেদনায় ভারাক্রান্ত; এমন যদি হত, সবকিছু একই রকম ভাবে চলতে থাকত চিরটাকাল, প্রবহমান সময়ের, আসন্ন অসুখের, মৃত্যুর যন্ত্রণা থাকত না, থাকত না ঘৃণা, থাকত না কোন কষ্ট! ধরুন আপনি দায়িত্ব নিলেন যে এই নারীদেহের সৌন্দর্য চিরকাল একই রকম থেকে যাবে, এদের ক্ষয় হবে না, তবু, প্রেমোচ্ছাসের উল্লাসের দোষত্রুটি ধরে নিয়েও, মনকে সে তবু আটকে রাখতে পারে। তাতেই বা কি? এও তো জানি অপরাপর মানুষ বৃদ্ধ হবে, তারপর জরাগ্রস্ত হবে, তারপর তার মৃত্যু হবে, এইটুকু চিন্তা পরিতৃপ্তির যাবতীয় আনন্দ যেন কেড়ে নেয়; এইটুকু বোধ হলেই মন কেমন খারাপ হয়ে যায়, যে যাবতীয় সম্ভোগ শরীরের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে একদিন; এসব জেনে বুঝেও যে মানুষ কামিনী শক্তিতে আত্মসমর্পণ করে, তার জীবন কী পশুর জীবন। ভুলভাল, ফাঁকা, সারশূন্য, মিথ্যের লালসা! হায় হায় উদায়ী! এইটাই যে সব শেষে মনে হয়; জন্মের বেদনা, বার্ধক্যের বেদনা, মৃত্যুর বেদনা; এই যে দুঃখ, এই যে শোক, সবচেয়ে বড় ভয় তো একেই করা উচিৎ। চোখের সামনে দেখছি সব শেষ হয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, অথচ মন তাদেরই পিছে ধাওয়া করে কি আনন্দই যে পায়। হায় এ জগৎ! কি অন্ধকার, কি অজ্ঞানতা, কেউ বোঝে না!” এবং প্রতিজ্ঞা করলেন, “এক মহতী ধর্মের সন্ধান আমি করব এইবার। সে এমনই এক পথ, লোকজন জাগতিক যে সব পন্থা অবলম্বন করে তার থেকে স্বতন্ত্র! আমি ব্যাধি, জরা, মৃত্যুকে প্রতিহত করব, ব্যাধি, জরা, মৃত্যু মানুষের জীবনে যে দুঃখ বয়ে আনে তার বিরুদ্ধে যুঝব!” সেই কাজ করার উদ্দেশ্যে তিনি স্থির করলেন, সে কালের সাধারণ ধর্মের প্রথা অনুযায়ী, প্রাসাদ থেকে চীরতরে নিষ্ক্রান্ত হবেন, তারপর অরণ্যের একাকীত্বে তপস্যা করবেন।
    সেই মধ্যরাতে নিদ্রামগ্ন ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নারীদেহের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে উদায়ীকে দেখালেন, তাদের তখন আর সেই মায়াবী সৌন্দর্য নেই; নাসিকা গর্জন করছে কেউ কেউ, নানরকমের কিম্ভুতকিমাকার ভঙ্গিতে শুয়ে ঘুমে অচেতন, যেন বিশ্বগ্রাসী-দহনে খাক হয়ে যাওয়া মরমে কাতর ভগ্নীসমা একেক জন নারী , তারা এখন ক্লান্ত-নিদ্রার্ত।
    পুত্রের গৃহত্যাগ ও তপস্বীর জীবনধারণের প্রতিজ্ঞার কথা মহারাজের কানে পৌঁছল। অশ্রুসজল নয়নে মহারাজ ফরিয়াদ করলেন পুত্রের কাছে। যুবরাজ তার উত্তরে বললেন, “ওগো! আমার যাত্রাপথ আর দুর্গম কোর না! তোমার সন্তান যে এক দগ্ধ, জ্বলন্ত গৃহে বসবাস করছে, সেখান থেকে সে বেরোতে চায়, তুমি কি সত্যিই তার পথরোধ করবে! মানুষের মনে কোন বিষয়ে সন্দেহ উৎপন্ন হলে সে সন্দেহ নিরসনই যেকালে সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত কাজ, সেখানে যে মানুষটা জানতে চাইছে, বুঝতে চায়, তাকে নিষেধ করবে?”
    এরপর সিদ্ধার্থ সাফ জানিয়ে দিলেন যে এই ঘনঘোর অজ্ঞানতার তিমিরে কেবল পুত্রের কর্তব্য করে যাওয়ার খাতিরে যদি আটকে থাকতে হয়, তার চেয়ে তিনি বরং নিজের প্রাণ নিজেই হনন করবেন।
    পিতাকে শোকসন্তপ্ত দেখে যুবরাজ স্থির করলেন রাত্রে বেরোবেন। শুধু মহারাজ শুদ্ধোদন নন, যুবরাণী যশোধরাও বার বার তাঁর কাছে ভিক্ষা চাইছিলেন যেন তিনি বৈবাহিক জীবন আর রাজকার্যের দায়িত্ব হেলায় ফেলে চলে না যান। যশোধরার কোলে মাথা রেখে সিদ্ধার্থ শুয়ে মনে মনে আপন অন্তরে রোদন করলেন, তাঁর সংসারত্যাগের যে যন্ত্রণা যশোধরাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে, জানতেন! তখন ভাবলেন, “এই যে আমার স্নেহময়ী মা, সেই মানুষটা যখন আমাকে ধারণ করল, কত না গভীর মমতায়, কত না কষ্ট সয়ে আমায় বয়ে বেড়ালো মাসের পর মাস, তারপর যেই জন্মালাম সে মারা গেল, কই, তাকে তো কেউ সুযোগ দিল না আমাকে সুপুষ্ট করার, আমাকে লালন করার! একজন জীবিত, একজন মৃত, দুজনে দুপথে গেছে, কোথায় কাকে পাব? এ যেন অরণ্যে, সুউচ্চ ঘন বৃক্ষে, কত না পাখির দল সাঁঝে এসে মেশে তাদের সখা-সখীদের সঙ্গে, আবার রজনী প্রভাত হলে তারা কোথায় উড়ে যায়, কে জানে, এ জগতের মিলন বিরহ হয়তো এমনই!”
    বছর তিনেকের ঘুমন্ত শিশু, রাহুলের, মুখের দিকে তাকালেন। এর বহুকাল পরে তাঁর সেই সময়ের মনের ভাব ব্যক্ত করবেন তিনি, “রাহুলও যে এক বন্ধন, এই আরেক বন্ধন আমায় ছিন্ন করতেই হবে।”
    মধ্যরাতে সব কিছু প্রস্তুত হবার পর ভৃত্য কন্দককে ডেকে সিদ্ধার্থ বললেন, “ঘোড়ায় জিন লাগিয়ে নিয়ে এস কন্দক; অমৃতনগরে যেতে আমার তর সইছে না। যে পবিত্র ব্রত আমি গ্রহণ করেছি, তাতে আমার মন এখন সমস্ত পরিবর্তনের ঊর্দ্ধে লক্ষ্যে স্থির।” নিঃশব্দে তাঁরা দুজন রাজদ্বার পেরিয়ে গেলেন। তারপর একবার, শুধু একটিবার রাজপুত্র পিছন পানে চাইলেন। শিহরণ জাগলো দেহে মনে। রাজপুত্র ঘোষণা করলেন, “যদি জন্ম, জরা, মৃত্যু জয় না করতে পারি, এপথে আর ফিরব না!”
    সে রাতে অরণ্যপথে প্রভু ভৃত্য দুজনে চললেন। রাত ভোর হয়ে এল। প্রত্যূষে একজায়গায় এসে দুজনে ঘোড়া থেকে নেমে বিশ্রাম নিলেন। ঘোড়ার পিঠ চাপড়ে রাজপুত্র তাকে বললেন, “খুব সেবা করলি রে, অনেকক্ষণ, অনেকদিন ধরে আমাকে বয়েছিস।” পরে কন্দকের উদ্দেশ্যে বললেন, “যতক্ষণ ঘোড়ায় চড়ে এলাম, ততক্ষণই তুমি আমার পিছু পিছু এলে কন্দক, তোমার কাছে আমি ঋণী — আমি শুধু তোমায় এতদিন বিশ্বস্ত মানুষ বলেই জেনেছি — আজ তো আর শুধু কথার কথায় তোমায় বেঁধে রাখতে পারব না, তাই তোমায় বলি, আজ থেকে আমাদের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল; এই নাও আমার অশ্ব, এই অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে ফিরে যাও; আমি তো সারারাত ধরে যেখানে যেতে চেয়েছিলাম সেখানেই এসে পৌঁছলাম। “
    কন্দককে নিতান্ত বিষন্ন ও দুঃখিত দেখে রাজপুত্র তার হাতে একটি মহামূল্যবান রত্ন দিলেন, দিয়ে বললেন, “কন্দক! এই রত্নটি তুমি রাখ, একে নিয়ে আমার পিতৃদেবের কাছে যাবে, গিয়ে শ্রদ্ধাভরে তাঁকে প্রণাম করে এই রত্নটি তাঁর সামনে রেখে দেবে, এ তাঁর আর আমার অন্তরের নৈকট্যের প্রতীক। তারপর, আমার হয়ে তাঁকে বোল যেন তিনি আমার প্রতি যাবতীয় হৃদয়দৌর্বল্য পরিহার করেন, আর বোল যে, আমি জন্ম, জরা, মৃত্যু অতিক্রম করব বলেই গহন অরণ্যে কঠোর জীবনে প্রবেশ করেছি; আমি কিন্তু এ কাজ স্বর্গীয় কোন এক পুনর্জন্ম চাই বলে করিনি, আবার হৃদয় কঠোর বলেও করিনি, আমার কারো প্রতি কোন বিতৃষ্ণা নেই, আমি শুধু পরমাগতি চেয়েছি, চেয়েছি এক মহানিষ্ক্রমণ ।
    “আমার প্রবল পরাক্রমশালী পূর্বপুরুষগণ মনে করতেন তাঁদের প্রতিষ্ঠিত রাজসিংহাসন অনড়, অপরিবর্তনীয়; তাই তাঁদের রাজৈশ্বর্য আমার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন; আমি, কেবল ধর্মের কথা ভাবতে ভাবতে সেসব দূরে সরিয়ে দিলাম, কারণ ধর্মসাধনের ঐশ্বর্য অর্জনেই আমার আনন্দ!
    “হয়ত ভাবছ, আমার বয়স অল্প, আমি নেহাতই অপরিপক্ক, আস্পৃহার সময় এখনো আসেনি, তবে জেনো প্রকৃত ধর্মের আস্পৃহায় অসময় বলে কিছু নেই। সকলই অনিত্য জীবনের কিছু খেলা, জীবনের প্রতি মৃত্যুর যে বিতৃষ্ণা, তা কোনদিনই আমাদের পিছু ছাড়ে না, আর তাই, আজকের দিন, এই মুহূর্তকেই আমি বেছে নিয়েছি, এখনি, এই মুহূর্তটিই, আস্পৃহার সময়।”
    বেচারা কন্দক! সে তখন কাঁদছে।
    “নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দাও কন্দক, এ নিয়ে দুঃখ কোর না; প্রতিটি প্রাণী, যে যার নিজের মত করে, মূর্খের ন্যায় তর্ক করে যাবে যে এ জীবন নিত্য, অপরিবর্তনশীল, আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করবে যে আমি যেন আত্মীয় স্বজন পরিত্যাগ না করি; অথচ, মৃত্যুর পরে অশরীরি অবস্থায় কে আমাকে রাখবে, তারা বলতে পারবে কি?”
    উজ্জ্বল উঠতি সাধুসদৃশ বাণী, অথচ কথাগুলো এক নম্র যুবা রাজপুত্রের মুখনিঃসৃত, এমন সব কথা যে, যারা তাঁকে ভালবাসত, তাদের কাছে পাষাণের মত ভারী শোনায়। কিন্তু আর তো উপায়ও নেই; সিদ্ধার্থের সঙ্গে জাগতিক সম্পর্কের ছেদ যে টানতেই হবে।
    সিদ্ধার্থ বললেন, “আদিকাল থেকে মানুষ এই ভুল করে এসেছে, সামাজিক বন্ধনে নিজেদের বেঁধেছে, প্রেমের বাঁধনে নিজেদের আটকেছে, তারপর আবার স্বপ্নভঙ্গের মত কে কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে। আমার এই কথাগুলো জানিয়ে দিও যে, যখন আমি জন্ম-মৃত্যুর দুঃখ-বারিধি অতিক্রম করব, তার পরই আমি প্রত্যাবর্তন করব; কিন্তু আমি এও প্রতিজ্ঞা করেছি, যদি লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হই, এই পর্বত সঙ্কুল জঙ্গলেই যেন আমার শরীর বিনষ্ট হয়।”
    তখন শাণিত তরবারীর কোপে তাঁর সুন্দর স্বর্ণাভ কেশরাশি কর্তন করলেন, করে তাঁর তরবারী ও বহুমূল্য রত্নরাজি তাঁর প্রিয় বহুযুদ্ধের তুরগের পৃষ্ঠদেশে রাখলেন, রেখে তাকে বললেন, “এবার কন্দকের সঙ্গে চলে যাও। মনে দুঃখের উদয় হতে দিও না। হে মোর বীর যুদ্ধাশ্ব, তোমাকে ছেড়ে দিতে আমারও কষ্ট হচ্ছে। তবে তোমার কীর্তির আজ অবসান হল, তুমি নারকীয় জন্ম হতে দীর্ঘ মুক্তি পেলে !” তারপর সিদ্ধার্থ করতালি দিয়ে ভৃত্য ও অশ্ব উভয়কে বিদায় জানালেন। অতঃপর, রিক্তহস্ত, মুণ্ডিত মস্তক বিজয়ী এক বজ্রদেবতার ন্যায় একাকী অরণ্যে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন।
    “আমার যাবতীয় অলঙ্কার চিরকালের মত বিদায় হয়েছে, বাকী রইল পরণের রেশমী বস্ত্র, এও সন্ন্যাসীর পরিধেয় নয়!”
    ছিন্নবস্ত্র পরিধান করে একটি লোক যাচ্ছিল সে পথ দিয়ে। গৌতম তাকে হেঁকে বললেন, “শুনুন, আপনার ওই পোশাক আমার ভারি পছন্দ হয়েছে, যদি কিছু মনে না করেন, আপনার বস্ত্র আমাকে দিন, আর আমার বস্ত্র আমি আপনাকে এর বিনিময়ে দিয়ে দিচ্ছি।” এই লোকটিকে গৌতম প্রথমে ভেবেছিলেন ব্যাধ, আসলে তিনি একজন সাধু, মুনি। পোশাক বিনিময়ের পরই গৌতমের খেয়াল হল “এ তো সাধারণ বেশ নয়। ইহজাগতিক বৈষয়িক মানুষ তো পরবে না!”
    একাগ্রচিত্তে ঘুরতে লাগলেন। দিনের শেষে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত বোধ করলেন। সে কালের প্রথা অনুযায়ী, গৃহচ্যুত মানুষের যা কাজ, গ্রামের পর্ণকুটিরে দোরে দোরে ঘুরে অন্নভিক্ষা করতে লাগলেন। রাজপুত্র ছিলেন, রাজার পাকশালের রাজ-পাচকের হাতের রান্না করা সেরা খাবার খেতে অভ্যস্ত, সেই কেতাদুরস্ত অভিজাত জিহ্বায় যখন গরীব ঘরের সামান্য খুদকুঁড়োর স্বাদগ্রহণ করলেন, থু থু করে ফেলে দিতে লাগলেন। অমনি বোধ হল, এ কি অন্যায় কাজ, তখন যত কষ্ট হোক, জোর করে পুরো পাতের পুরো খাবারটুকু খেয়ে নিলেন। যা কিছু দানের মাধ্যমে তাঁকে দেওয়া হবে, নিতান্ত খারাপ হলেও তাকে অবহেলা অশ্রদ্ধা করা হবে না।
    ধর্মে উৎসর্গীকৃত যে জীবন, পরম শান্তির সন্ধানে যার যাত্রা, সেই চিরন্তন সত্যের স্বাদ অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর স্বাদ আর কিছুই নেই! ইহজাগতিক যাবতীয় হার্দিক মানসিক সম্পর্ক চুকে গেছে, এখন জিহ্বার রসনার বন্ধনে থাকার সময়ও গত হয়েছে। একদা যে মানুষটির মাথায় তাঁর তৎপর অনুগামীরা শ্বেতশুভ্র ছত্র ধারণ করত, যে মানুষটির পরিধানে ছিল রেশমের মহামূল্যবান পোশাক, আজ সেই মানুষটিই ছিন্ন বস্ত্র পরিধান করে, যৎকিঞ্চিৎ আহার শেষে, নতমস্তকে অথচ হৃষ্টচিত্তে রৌদ্রতপ্ত অরণ্যপথে একাকী চলেছেন।
    এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে নানান জনের কাছে সিদ্ধার্থ আলারা কালামার সন্ধান করতে থাকলেন। আলারা কালামা এক অতিবিখ্যাত সাধু, তাঁর সম্বন্ধে কত কিছু শুনেছিলেন। ইনি পরে সিদ্ধার্থের গুরু হবেন। আলারা কালামা শূন্যতার শিক্ষা দিতেন। তার সঙ্গে চূড়ান্ত আত্মপরিযাতনা অবলম্বন করতেন। দেখাতে চাইতেন যে তাঁর যাবতীয় শরীরবোধের উর্দ্ধে বিচরণ। শাক্যবংশের এই নতুন যুবা মুনিটিও মহোৎসাহে আলারা কালামার পদানুসরণ করতে লাগলেন। বহুকাল পরে শিষ্যদের কাছে তাঁর এই সময়কার চূড়ান্ত আত্মপরিযাতনার দিনগুলোর কথা বলবেন। বলবেন যে, “আমি সেই সময় শৈবাল, ঘাস, গোময় আহার করে শরীর ধারণ করতাম, বন্য ফলমূল, গাছ থেকে যে ফলটুকু নিজে থেকে মাটিতে পড়ত তাই খেয়ে জীবন কাটাতাম, কেশ আর কুশ পরিধান করে থাকতাম, শ্মশান মশান ছাইগাদা থেকে যা তা ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো পেতাম সেই সব পরে থাকতাম, বন্যপ্রাণীর ফেলে যাওয়া চামড়া গায়ে জড়িয়ে রাখতাম, ঘাসপাতা, বল্কল, জন্তু-জানোয়ারের লেজের টুকরো, পেঁচার ডানার পালক, যখন যা যা পেতাম তাই দিয়ে নিজের নগ্ন শরীর কোনমতে ঢেকে রাখতাম। টেনে টেনে নিজের চুল দাড়ি ছিঁড়ে ফেলতাম, মাথা, মুখ, দাড়ি গোঁফ থেকে চুল রাখব না এই প্রতিজ্ঞা করেছি সেই সময়। একবার ভাবলাম কেবল দাঁড়িয়ে থাকব, বসব না, শোব না। আবার একবার ভাবলাম সারাক্ষণ উবু হয়ে বসে থাকব। “কন্টকবিহারী” হয়ে গেলাম একবার। যখনই পাশ ফিরে শুতে যেতাম, কন্টকশয্যায় শরীর রাখতাম — একবার ভয়ংকর দুর্গম এক জঙ্গলে গিয়ে সেখানেই রয়ে যাব মনস্থ করলাম। সে এক ভয়াবহ অরণ্য, সামান্য কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ সেখানে গেলে ভয়ে তার রোম খাড়া হয়ে যাবে। এহেন যে মানুষ, পরে যিনি বুদ্ধ হবেন, তিনি এমনি করে ছ’বছর, প্রথমে আলারা কালামার সঙ্গে, তারপরে আরো পাঁচজন ভিক্ষু-সাধুর সঙ্গে উরুভেলার কাছে তপোবনে এই সমস্ত মারাত্মক অর্থহীন সাধনা করে বেড়াতেন। তার সঙ্গে উপবাস। সে উপবাস এমন সাঙ্ঘাতিক যে, “আমার হাত পাগুলো ক্ষয়াটে শুকনো পাটকাঠির মত হয়ে গিয়েছিল, কোমরের হাড় উটের কুঁজের মতো বেরিয়ে থাকত, শিরদাঁড়া দড়ির মত পাকিয়ে গিয়েছিল, বাড়াবাড়ি রকমের উপোস করে করে পাঁজরার অবস্থা হয়েছিল পোড়োবাড়ির ছাদের মত ব্যাঁকাচোরা। পেটে হাত দিলে হাত চলে যেত শিরদাঁড়ায়, হাত ঝাড়া দিলেও মাথা থেকে চুল খসে খসে পড়ত।”
    এমনি করে চলতে চলতে শেষে একদিন নৈরঞ্জনা নদীতে স্নান করতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে প্রায় ডুবে যাচ্ছিলেন। তখন বোধোদয় হল, এই যে বাড়াবাড়ি রকমের মুক্তির সাধনা চলছে, এও প্রকৃতপক্ষে যাচ্ছেতাই রকমের অজ্ঞতার নামান্তর; দেখলেন, এ সবই অস্তিত্ব নামক মুদ্রাটির এপিঠ ওপিঠ — একদিকে চূড়ান্ত ভোগবিলাস, একদিকে চূড়ান্ত ক্লেশ, উপবাস। একদিকে মাত্রাহীন, স্বার্থপরের মত, অবোধের ন্যায় বিলাস ব্যসন, বোধশক্তিরহিত; অপরদিকেও সেই বোধহীনতা, মাত্রাতিরিক্ত দারিদ্র্য-ক্লেশ-শারীরি-যাতনা নির্বোধতা, একই রকমের উল্টোপাল্টা অকারণ-অন্ধ কার্যকলাপ।
    জনৈকা মেয়ে তাঁকে দেবতা মনে করে একবাটি পায়েস দিয়েছিল, তাতে বেঁচে উঠে, সিদ্ধার্থ বললেন, “এই যে এত কষ্ট, কেবলি যাতনা!”
    একটি মেয়ে তাঁকে দেবতা মনে করে পায়েস দিয়েছিল, তার হাতের সেই পায়েস গ্রহণ করে সিদ্ধার্থ বেঁচে উঠলেন। “এই যে এত ভোগান্তি, বড় খারাপ লাগে!” ঘোষণা করলেন তিনি।
    সঙ্গী পাঁচ কঠোর তপস্বীর কাছে গেলেন, তাদের কাছে তাঁর উপদেশ, “এই যে তোমরা! কেবল স্বর্গসুখ পাবে বলে বহিরঙ্গ শেষ করার তদবির করছ, নিজের শরীরের প্রতি যতরকমের বেদনাদায়ক অত্যাচার করা যায় তার কিছুই তো বাকী রাখলে না, এদিকে একটা স্বর্গীয় জন্মের খোঁজ করে বেড়াচ্ছ, আবার তো সেই ঝামেলা পোহানোর ব্যাপার, কোন এক ভবিষ্যত আনন্দের ছবি চোখে ভাসিয়ে, দুর্বল হৃদয় শুধুই মজে যায়, ডুবতে থাকে … আর সেইজন্যেই, ঠিক সেই কারণেই, আমি দেখতে চাই কোন পথে শরীরকে সুস্থ ও মজবুত রাখব, যাতে খাদ্য দিয়ে পানীয়ের মাধ্যমে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে তাজা করে তোলা যায়, তাতে শরীরের তৃপ্তি, প্রাণের আরাম । প্রাণে আরাম আসুক, তাতে জীবনের শান্ত সমাহিত সমতার ভাবটিকে উপভোগ করি। এই শান্ত, সমাহিত সমতাবোধটাই তূরীয় অবস্থা প্রাপ্তির চাবিকাঠি। তূরীয় অবস্থাতেই সদধর্মের প্রকৃত উপলব্ধি হয়, তারপরই জড়বন্ধন থেকে মুক্তি আসবে ।
    “ইহলোক, স্বর্গলোক, নরক — ত্রিভুবনের আওতা থেকে উত্তরণ চাই আমি। যে ধর্ম তোমরা পালন করছ, এ ধর্ম তোমাদের পূর্বতন গুরুদেবগণের কৃতকর্মজনিত উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছ। কিন্তু আমি, এই যে সব এর ওর মেলানো মেশানো জোড়াতালি দেওয়া, আমি, সেইসব যাবতীয় তালগোল পাকানো ধর্ম শেষ করতে চাই, আমি চাই এমন এক ধর্মের সন্ধান, যেখানে এইসমস্ত কোনরকম সমাপতন নেই। আর ঠিক সেই কারণেই, আর কোন অর্থহীন আলাপ আলোচনার, আর কোন তর্কের মধ্যে আমি নেই, চললাম, এই তপোবনে আর এক মুহূর্তও কাটাতে চাইনা।”
    এইসব শুনে তো তপস্বীরা সাংঘাতিক চমকে গেল, বলতে লাগল, গৌতম হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু শাক্যমুনি, এই পাঁচ কঠোর তপস্বীর প্রচলিত পন্থাকে “শূন্যে গ্রন্থি বন্ধনের প্রয়াস”, বলে ছেড়ে চলে গেলেন, আত্মক্লেশী তাপস আর রইলেন না, হয়ে গেলেন পরিযায়ী পরিব্বিজক (পরিব্রাজক)।
    [এই কথা শুনে তপস্বীরা সাংঘাতিক রকমের চমকে গেল, তারা বলতে লাগল গৌতম নিশ্চয়ই হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু শাক্যমুনি, এই তপস্বীদের পন্থাকে “শূন্যে গাঁট পাকানোর প্রয়াস” আখ্যা দিলেন, দিয়ে আর আত্মক্লেশকারী তাপস আর রইলেন না, পরিযায়ী পরিব্রাজকের পথ ধরলেন]
    সিদ্ধার্থ নানা জায়গায় ভ্রমণ করছিলেন, এমন সময় তাঁর পিতার সন্তাপের কথা শুনতে পেলেন। ইতিমধ্যে ছ’বছর কেটে গেছে, এতদিন পরে এই সংবাদে তাঁর কোমল হৃদয়ে পিতার প্রতি অপার ভালবাসার উদ্রেক হল। যে লোকটি তার পিতার শোক-দুঃখের সংবাদ বহন করে নিয়ে এসেছিল তাকে বললেন, “তবে সবই স্বপ্নবৎ, সবই নশ্বর, সব শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে … প্রিয়জনের ভালবাসা, সে এই বেঁধে রাখে, তো পুনরায় সে বন্ধন শিথিল হয়, এই যে ক্রমাগত দূর থেকে দূরে সরে সরে যাওয়া, কত আর এ নিয়ে দুঃখ করা যায়? এ নিয়ে যত আফশোষই হোক না কেন তার কোন নাগাল পাওয়া যায় না। কেননা তাবৎ বস্তু সমুদায়ের কালক্রমে লয় অনিবার্য, কারণ মৃত্যুই কালের নিয়ন্তা, মৃত্যুকে দূর কর, কালও লুপ্ত হবে …
    “তোমরা চাও আমি রাজা হই … বাইরের এই রূপের বিষয় চিন্তা করলে আমার অন্তর বড় বিষন্ন হয় … ঐ যে অলঙ্কারের প্রাচুর্যে শোভিত রাজপ্রাসাদ , আমি দেখি তাতে সর্বত্র আগুন জ্বলছে, ঐ যে শত শত অমৃতের ন্যায় ব্যঞ্জন, যেন স্বর্গের পাকশালায় প্রস্তুত, তাতে যেন বিষ মিশে আছে। চক্রবর্তী রাজন্যগণ, তাঁদের বিষয় বিতৃষ্ণা হতে বিলক্ষণ অবহিত আছেন যে, ধর্মে নিবেশিত জীবনের যে স্থিতি, তার সঙ্গে রাজ্যপাট পরিচালনার ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটের কোন তুলনা চলে না। অন্তরের স্তব্ধভাব ও তার বিশ্রামই মুক্তির উৎস। একদিকে রাজসিক সম্ভোগ অন্যদিকে উদ্ধারপ্রাপ্তি, একদিকে গতি, অন্যদিকে স্থিতি, এই দুটিকে একত্র করা যায় না। আমার চিত্ত অচঞ্চল; বিষয়সম্পর্কের প্রলোভন আমি ছিন্ন করেছি, একনিষ্ঠ উদ্দেশ্য নিয়ে আমি গৃহত্যাগ করেছি।”
    পথে অন্যান্য যে সমস্ত সাধু সন্ন্যাসীদের সঙ্গে দেখা হত, তাদের উপদেশ দিতেন, “আত্মনিবৃত্তির পরম ধর্ম অনুসরণ করুন, পুরাকালে যে কথা বলা হত, তাকে অবধান করুন। পাপ হতে সন্তাপের উৎপত্তি।” পূজ্যপাদ অশ্বঘোষ বুদ্ধের এই অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন, “অটল উপস্থিতিতে ঋজু পদক্ষেপে তিনি নগরে প্রবেশ করে, মহাসন্ন্যাসীর প্রথানুযায়ী অন্নভিক্ষা করতেন, তৃপ্ত নিবিষ্ট মনে তদ্গত চিত্তে, কম ভিক্ষা পেলেন না বেশী ভিক্ষা পেলেন তা নিয়ে কোনরূপ চিন্তা ছিল না; যা পেতেন, মূল্যবান হোক, সামান্য হোক, তাকে ভিক্ষাপাত্রে রাখতেন, তারপর অরণ্যে ফিরে গিয়ে সেই অন্ন গ্রহণ করতেন ও তরণীর জলপান করতেন, অতঃপর আনন্দিত চিত্তে পর্বতে অধিষ্ঠান করতেন।”
    চচারভিক্ষম সা তু ভিক্ষুভার্যনিদায় গাত্রাণী চলঞ্চচিত ||)
    [পূজ্যপাদ অশ্বঘোষ সিদ্ধার্থের ভিক্ষাবলম্বন নিয়ে লিখেছিলেন, ““অটল উপস্থিতিতে ঋজু পদক্ষেপে তিনি নগরে প্রবেশ করে, মহাসন্ন্যাসীর প্রথানুযায়ী অন্নভিক্ষা করতেন, তৃপ্ত নিবিষ্ট মনে তদ্গত চিত্তে, কম ভিক্ষা পেলেন না বেশী ভিক্ষা পেলেন তা নিয়ে কোনরূপ চিন্তা ছিল না; যা পেতেন, মূল্যবান হোক, সামান্য হোক, তাকে ভিক্ষাপাত্রে রাখতেন, তারপর অরণ্যে ফিরে গিয়ে সেই অন্ন গ্রহণ করতেন ও তরণীর জলপান করতেন, অতঃপর আনন্দিত চিত্তে পর্বতে অধিষ্ঠান করতেন।”]
    তারপর, সিদ্ধার্থ রাজা মহারাজাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতেন, তাঁদের নিজের মতের অনুগামী করে তুলতেন । একবার সিদ্ধার্থ অরণ্যে অধিষ্ঠান করছেন, মগধরাজ বিম্বিসার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। মহারাজ বিম্বিসারের কৌতূহল, রাজপরিবারে জন্মেও কেন একজন মানুষ রাজ্যপাট শাসন করার অধিকার ছেড়ে দেয়।
    “সাধারণের মধ্যে যা দান ও বিতরণ করা হয়, তাকেই রাজ্যের প্রকৃত সম্পদ বলা যেতে পারে, কেবল রাজকোষে সঞ্চিত বিত্তই সম্পদ নয়,”, সিদ্ধার্থ বললেন, “দান খয়রাত করতে গিয়ে অর্থসম্পদ অনেকটাই বিলিয়ে গেলেও একাজে কোন অনুশোচনা থাকেনা।” মহারাজ বিম্বিসার তবু ছাড়লেন না, জানতে চাইলেন, এহেন মানুষ, যিনি রাজ্যশাসনের ব্যাপারে এমন সব বিধি বিষয়ে প্রাজ্ঞ, তিনি কি কারণেই বা রাজসিংহাসন পরিত্যাগ করেছেন, আর কেনই বা রাজপ্রাসাদের বিলাসবহুল জীবনের আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে রেখেছেন? “আমি জন্ম, জরা, অসুস্থতা, মৃত্যু ভয়ে ভীত, তাই আমি মুক্তির এক নিশ্চিত উপায় সন্ধান করি। অতএব আমি পাঁচটি বাসনাকেও ডরাই — যে বাসনাসমূহ দৃষ্টির, শ্রবণের, স্বাদ গ্রহণের, ঘ্রাণের, স্পর্শের সম্পৃক্ত — এরা অনিত্য তস্করের দল, যারা মানুষের কাছ থেকে তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ হরণ করে মানুষকে এক অলীক জীবনের বিহারী, অস্থিরমতি করে তোলে — মানুষের জীবনের শান্তি ছত্রভঙ্গ করে প্রবল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। ‘স্বর্গের আনন্দই যেখানে এমন কোন প্রাপ্তব্য নয়, সেখানে মামুলি কামনা বাসনায় কাজ কি, উন্মত্ত প্রেমের তৃষ্ণানিবারণে যা মেলে, পরক্ষণেই ভোগের উচ্ছ্বাসে সে কোথায় হারিয়ে যাবে। এ যেন সেই সম্রাটের ন্যায় অস্থির, সসাগরা ধরিত্রীর পালনকর্তা হয়েও যিনি অতিরিক্ত কিছুর সন্ধান করতে থাকেন, ওপারে আর কি আছে তার সন্ধান, মানুষের কামনা-বাসনাও তদ্রূপ; অপার মহাসমুদ্রের তুল্য, এটুকুও জানা নেই কোথায়, কখন রাশ টানতে হয়। লোভ লালসাকে একটু প্রশ্রয় দিলেই দেখবেন শিশুর বাড়বৃদ্ধির মত সে ক্রমশ বেড়ে যেতে থাকে। যে মানুষ জ্ঞানী, যিনি দুঃখ কত তিক্ত তা জানেন, আর তাই তিনি কামনা বাসনার উৎপত্তি সমূলে নিষ্পেষিত করেন। “এ জগৎ যাকে মহৎ গুণ বলে বিচার করে, সেও প্রকারান্তরে নিতান্তই দুঃখময়, মহারাজ! “সমুদায় বস্তুকে মায়াবৎ জ্ঞান করে প্রকৃত জ্ঞানী তাই বাসনা কামনা রহিত; অপিচ বাসনায় নিমজ্জিত মানুষ কেবল দুঃখেরই কামনা করে। দুঃখের উন্মেষ হওয়া মাত্র জ্ঞানী তাকে পূতিগন্ধময় অস্থিবৎ পরিত্যাগ করে দূরে নিক্ষেপ করেন। “যাকে জ্ঞানী কখনো গ্রহণ করার বিবেচনা পর্যন্ত করেন না, রাজা কিনা তাকেই আগুনে পুড়তে হলে পুড়ে, জলে সিক্ত হতে হলে সিক্ত হয়েও পাবার চেষ্টা করেন, সেই সম্পদ, যার সন্ধানে এত পরিশ্রম, সে যেন এক পচা গলা মাংসপিণ্ড! “তাই যিনি প্রকৃত জ্ঞানী তিনি কখনোই ধন সম্পদ সঞ্চয় করেন না, তাতে বিষয়চিন্তায়, শত্রুভয়ে মন দিবারাত্র উদ্বিগ্ন হয়। “ মহারাজ! কত না কষ্ট সয়ে মানুষ ধনসম্পদ লাভের ছক কষে, সেই ধনসম্পদ, যা কিনা বহু কষ্ট সয়ে উপার্জন করতে হয়, অথচ দেখুন, যেন স্বপ্নে প্রাপ্ত, এমন ভাবে কত সহজেই তাকে নষ্ট করা যায়; আঁস্তাকুড়ে যার স্থান হওয়া উচিৎ, প্রকৃত জ্ঞানী কেনই বা তিলে তিলে তাকে সঞ্চয় করে রাখতে চাইবেন! বিত্তবাসনা মানুষকে নিষ্ঠুর করে তোলে, দুঃখের তীক্ষ্ণ শলাকায় তার শরীর ভেদ করে যেন কর্কশ চাবুকের দ্বারা প্রহার করে; দীর্ঘ রাত্রি ছায়ে শরীর, অন্তরাত্মা নিংড়ে, আশা হরণ করে, লালসা যে মানুষকে অমানুষ করে তোলে। “এ যেন মাছের বঁড়শিপ্রেম! “লোভ চায় তার চাহিদা পূর্ণ করতে, কিন্তু দুঃখের যে অন্ত নেই। আমাদের কামনা বাসনাকে তৃপ্ত করতে গিয়ে আমরা তাদের শুধু বাড়িয়েই যাই। সময় বয়ে যায়, দুঃখ বার বার ফিরে আসে। “অতএব অজস্র বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে কি লাভ বলুন, এতে উদ্বেগই শুধু বাড়ে। বাসনাকে তুষ্ট করতে গিয়ে যে দুঃখের উৎপত্তি, তার অন্ত করুন মহারাজ, মহাব্যস্ত জীবনযাপন হতে আত্মসংবরণ করুন, এতেই আপনার যথার্থ বিশ্রাম!”
    মহারাজ বিম্বিসার, সেই কন্দক যেমন বলেছিল, তিনিও, আর না বলে থাকতে পারলেন না, শাক্যরাজকুমার, তোমার বাপু সংসার ত্যাগের বয়স হয়নি, তুমি নেহাতই ছেলেমানুষ। “বলছেন বটে যুবাবয়সে মানুষ ফুর্তি করুক, বৃদ্ধ হলে ধর্মচর্চা, আমি কি মনে করি জানেন, বার্ধক্যের কাল এতটাই অনিশ্চিত, যে যুবাবয়সের মত আর ধর্মপালনের শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা থাকে না।” বৃদ্ধ মহারাজ বুঝতে পারলেন । “চঞ্চলতা এক শবর, আয়ু তার ধনু, ব্যাধি তার শর, জীবনমৃত্যুর মহাক্ষেত্রে সে জীবিতের মৃগয়া করে; যখনই সে সুযোগ পায়, আমাদের প্রাণহরণ করে, বৃদ্ধ বয়সের জন্য কেই বা অপেক্ষা করে থাকবে?” ধর্মপালন বিষয়ে সিদ্ধার্থ মহারাজকে প্রাণিহত্যা ও বলিদান থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিলেন, “প্রাণহত্যা করে ধর্মসাধন, মানুষের এ কেমন প্রেম? বলিদানের ফল যদি অক্ষয় হয়, তাহলেও প্রাণিহত্যা অনুচিৎ, তবে ক্ষণস্থায়ী ফলের আশায় সে কাজ বোধকরি আরো কত অন্যায়! প্রজ্ঞাবান মানুষ প্রাণহত্যা থেকে বিরত থাকেন। বায়ুপ্রবাহের ন্যায়, তৃণশীর্ষে বারিবিন্দুর ন্যায়, অনাগত ভবিষ্যতের ফলাফল ক্ষণস্থায়ী ও অনিশ্চিত নিয়মের বশবর্তী, আমি তাকে তাই দূরে সরিয়ে রাখি, কারণ আমি যে যথার্থ মুক্তি চাই!”
    মহারাজ উপলব্ধি করলেন যে তাঁর চেতনার উদ্বোধন তাঁর অর্জিত সম্পদের পূর্বজ, অতএব এক্ষেত্রে তার গুরুত্বই অধিক। তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন, “অনুধাবনের সময় নিতান্তই কম, আমি যেন ধর্ম রক্ষা করতেই সক্ষম হই।” চক্ষুন্মীলিত হল মহারাজের, আলোকপ্রাপ্ত বোধ করলেন, গৌতমের আজীবন সমর্থক হয়ে রইলেন তিনি।
    [“ধর্মপালন বিষয়ে সিদ্ধার্থ মহারাজকে প্রাণিহত্যা ও বলিদান থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিলেন, “প্রাণহত্যা করে ধর্মসাধন, মানুষের এ কেমন প্রেম? বলিদানের ফল যদি অক্ষয় হয়, তাহলেও প্রাণিহত্যা অনুচিৎ, তবে ক্ষণস্থায়ী ফলের আশায় সে কাজ বোধকরি আরো কত অন্যায়! প্রজ্ঞাবান মানুষ প্রাণহত্যা থেকে বিরত থাকেন। বায়ুপ্রবাহের ন্যায়, তৃণশীর্ষে বারিবিন্দুর ন্যায়, অনাগত ভবিষ্যতের ফলাফল ক্ষণস্থায়ী ও অনিশ্চিত নিয়মের বশবর্তী, আমি তাকে তাই দূরে সরিয়ে রাখি, কারণ আমি যে যথার্থ মুক্তি চাই!” ]
    গৌতম যে বনে তপস্যা করতেন, সেই বনে অন্যন্য যে সব শীর্ষস্থানীয় ঋষি-মুনিও তপস্যা করতেন, গৌতম তাঁদের সঙ্গে নানান বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম, আরাদা উদারামা (Arada Udarama), গৌতম তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মুনিবর, কোন উপায়ে জরা, রোগ, ও মৃত্যু হতে উদ্ধার পাওয়া যাবে?” উদারামা উত্তর দিলেন, “অহং” এর পরিশুদ্ধিতেই প্রকৃত মুক্তি। এ ছিল সেই সময়ের সনাতনী শিক্ষা: বলা হত যে “পুরুষ”, অবিনশ্বর আত্মা, আত্মন, পরমাত্মা — জন্ম থেকে জন্মান্তরে ক্রমাগত পরিশুদ্ধ হতে হতে অবশেষে স্বর্গে শুদ্ধ আত্মার অবস্থাপ্রাপ্ত হন, এইটাই প্রতিগমনের উদ্দেশ্য।
    শুদ্ধচিত্ত গৌতমের এ কথা শুনে মনে হল, যদি এমনটা ধরে নেওয়া হয় যে জন্মের উৎস আর লয় থেকে কারো সত্যিকারের নিস্তার নেই, তাহলে পুরুষ ব্যাপারটা বেসিকালি একটা খেলার বল বই কিছু নয়। খেলার বল যেমন মাটিতে লাফাতে লাফাতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়, যখন যেরকম অবস্থার মধ্যে পড়ে, স্বর্গ, নরক, মর্ত্য, যেখানে যেমন। অথচ “জন্ম” মানে মৃত্যুও অনিবার্য — এইখানেই ত ব্যথা, এইটাই তো ক্ষয়, ভয়, সব কিছুই যে পরিবর্তনশীল।
    গৌতম বললেন, “আপনি যে বলছেন, অহংবোধ পরিশুদ্ধ হলেই তৎক্ষণাৎ প্রকৃত মুক্তি; আবার যেখানেই কার্য-কারণের একত্র সংযোগ দেখি, সেখানেই যেন জন্মের প্রতিবন্ধকতায় ফিরে যাবার একটা ব্যাপার থাকে; ধরুণ বীজের মধ্যে যে প্রাণ নিহিত; যখন মনে হয় যে মাটি, জল, অগ্নি, বায়ু সব মিলে তার অন্তর্নিহিত প্রাণকে বুঝি শেষ করে ফেলেছে, সে-ই আবার যখন উপযুক্ত পরিবেশ পায় পুনর্জীবিত হয়ে ওঠে। তার এই বেঁচে ওঠার পেছনে এমন কোন কারণ নেই, যার বহিঃপ্রকাশ আপনি দেখতে পাবেন, কিন্তু বেঁচে থাকার অন্তর্নিহিত বাসনাই তার পুনর্জীবনের কারণ; বেঁচে ওঠে ঠিকই, তার আবার মৃত্যু হবে, যেন মরার জন্যই বেঁচে ওঠা। সেই রকম, যাদের তথাকথিত মুক্তি হল, (তাদের আবার কোন না কোন সময় বন্ধন হবে), অহংবোধের ধারণা আর জীবিত প্রাণী, সেভাবে দেখলে প্রকৃত মুক্তি আর তাদের মেলে না।”
    প্রজ্ঞা আর করুণা তাঁর মধ্যে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশের সময় যত এগিয়ে এল, ততই এই যুবা সন্ন্যাসীটি দেখতে লাগলেন সমুদায় বস্তু — তপোবনে উপবিষ্ট সাধু, গাছপালা, আকাশ, আত্মা-সম্পর্কে ভিন্ন মত, নানান রকমের আত্মবোধ — সমস্তই যেন একত্রিত শূন্যতা, সমস্তি যেন কোন এক কল্পনার পুষ্প — চারিদিকে অবিভেদ্য একতা, সে একতা সর্বব্যাপী, অন্তঃসলিলা বিশুদ্ধ এক স্বপ্নময়তা।
    অস্তিত্বকে দেখলেন যেন প্রজ্জ্বলিত দীপশিখা; প্রদীপের আলোর শিখা আর সেই আলোর নির্বাণের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই। একই সঙ্গে দীপের আলো যেমন জ্বলতে থাকে, এই উজ্জ্বল আলোই তার নির্বাপণের কারণও বটে। দুই-ই এক।
    দেখলেন, পরমাত্মার অস্তিত্বের ধারণা অর্থহীন। এ যেন একটা খেলার বলের সত্তার বিধেয় নির্ণয়ের খেলা, হাওয়ায় যে বলটা এলোমেলো, এদিক ওদিক ঘুরপাক খেতে থাকে, অনেকটা কেউ যেন ইচ্ছে করে দুঃস্বপ্ন দেখে যাচ্ছে, দেখেই যাচ্ছে, ভয়াল দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, অথচ বুঝছে না যে পুরোটাই মনের মায়া।
    গৌতম একটা ব্যাপার দেখলেন যে বুদ্ধের নির্বাণকল্পের মধ্যে একটা শান্তির, একটা স্থিতির ব্যাপার আছে। নির্বাণ মানে নিভে যাওয়া, যেমন একটা প্রদীপের আলোর নির্বাপণ। কিন্তু বুদ্ধ যে অর্থে নির্বাণের কথা বলেন, তা অস্তিত্বের অতীত, তাকে অতিক্রম করে যায়। বুদ্ধের নির্বাণের ধারণায় প্রদীপের আলোর অস্তিত্বও নেই, তার অনস্তিত্বও নেই। এবং ব্যাপারটা শুধু প্রদীপের শিখার নয়, তাবৎ বস্তুর, অবিনশ্বর আত্মার, সমস্ত কিছুর ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে। এমনকি নির্বাণও নয়। প্রদীপের কথায বললে, প্রদীপের আলোকশিখাকে সংসার ধরা যাক (ইহজগৎ), প্রদীপের নির্বাপিত শিখাকে নির্বাণ বলা যাক (মরজগৎ) — বুদ্ধের নির্বাণ কিন্তু এ দুটো অবস্থার একটাও নয় — বুদ্ধের নির্বাণ এসমস্তের উর্দ্ধে , আমাদের সবরকম প্রতিষ্ঠিত ধ্যানধারণার অতীত একটা সদাজাগ্রত অবস্থা!
    সিদ্ধার্থর ঠিক আরাদার ধ্যান ধারণা যে “অহং” বা “আমি” কে মুছে দিলেই স্বর্গের পবিত্রতা অর্জন করা হবে এই ব্যাপারটা ভালো লাগেনি। সিদ্ধার্থ ঠিক বস্তুনিচয়ের মধ্যে “আমি” ব্যপারটাকে দেখছিলেন না। যার জন্য কাউকে কিছু শুদ্ধিকরণ করার নেই। এই স্বর্গের পুরো কনসেপ্টটাই স্বপ্নের জগতে বিচরণ করার মত। তন্মাত্র (“সৎ মন”) মনের পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে সমস্ত বস্তু, সবকিছুকে মনে হবে হাওয়ায় কেউ যেন জাদু-প্রাসাদ তৈরী করেছে।
    “আরাদা যা বলছেন মন থেকে মানতে পারছি না। যাই, দেখি আরো ভালো একটা ব্যাখ্যা খুঁজে বার করি।” গৌতম খুঁজে বার করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এক মনীষীর ভাষায়, “মানুষের মধ্যে, প্রকৃতির মধ্যে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, পাচ্ছেন না, অথচ দেখ! এর উত্তর লুকিয়ে আছে তাঁর আপন হৃদয়ে!”
    “সুধন্য তপস্বী” এবারে বুদ্ধগয়ায় গেলেন। আর তখনি তাঁর ওপর আদি বুদ্ধদের সুপ্রাচীন স্বপ্ন যেন ভর করল। সেখানে তমালবন, আম্রকুঞ্জ, ও বটবৃক্ষের পানে একমনে চেয়ে ধ্যানস্থ হলেন। দ্বিপ্রহরে ঝিরি ঝিরি বায়ু বইছে, সিদ্ধার্থ সেই সব বৃক্ষশাখার তলায় একা একা তন্ময় হয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, মনের কোণে কোথাও বোধ হচ্ছে ভারি রকম কিছু একটা হতে চলেছে। বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম তথাগতের সুপ্রাচীন লুপ্ত পথ খুঁজে বের করেছিলেন মাত্র, পৃথিবীর আদিমতম শিশিরবিন্দুটির পুনরায় উন্মোচন হয়েছিল তাঁর হাতে; পরম করুণামাখা চোখের একটি মরাল যেন কমল-সরোবরে ধীরে ধীরে ডানা মেলে নেমে এল, এবারে সেখানেই সে স্থিত হবে। সেই তরু! যে তরুতলে তিনি বসবেন বলে তাবৎ বুদ্ধ-জগৎ ও সমুদায় বুদ্ধ-বস্তুদের কথা দিয়েছিলেন, সেই সব বুদ্ধনিচয়, যারা দশদিকে ‘অ’-বস্তুর দীপ্তমান অনুভূতি নিয়ে সর্বত্র দেবদূত আর বোধিসত্ত্বরূপে বিরাজমান; তারা এখন অদৃশ্য পতঙ্গের মত শূন্যতার গর্ভ অভিমুখে মহাউপাসনার অনন্তযাত্রায় চলেছে । “অত্র সর্বত্র, আকাশপাতাল সব এখানেই এক হয়েছে”, সন্ন্যাসী অন্তরে অনুভব করলেন। দূরে একটি লোক ঘাস কেটে নিয়ে যাচ্ছিল, তার কাছ থেকে কিছুটা টাটকা নরম ঘাস চেয়ে নিলেন। গাছের তলায় সেই ঘাস বিছিয়ে দিলেন। তারপর সেখানে ধ্যানস্থ হলেন। সাবধানে পা গুটিয়ে ঋজু শরীরে উপবিষ্ট হলেন। বসে ধীরে ধীরে সামনে পিছনে দুলতে লাগলেন, যেন এক ঋজু, অটল মহানাগ । নিজের কাছে ঘোর প্রতিজ্ঞা করলেন, “যতদিন না বাসনার সংশ্লেষ থেকে মুক্ত হব, যতদিন না এ অন্তরাত্মা দুঃখ জয় করবে, ততদিন এই স্থান থেকে উঠব না!”
    অস্থিচর্মসার যদি হতে হয়, কাকপক্ষীতে যদি ঠুকরে শেষ করে দেয়, তবু যতদিন না বিশ্বরহস্য উন্মোচন করতে পারবেন, ততদিন এই দেবতুল্য মানব বটবৃক্ষের তলায় বিছানো তৃণাসন থেকে উঠে দাঁড়াবেন না, এই তাঁর পণ। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে তাতে জিব দিয়ে চেপে ধরলেন, তেজোময় ধীশক্তিকে দাবিয়ে রেখে, আপন অন্তরের দৃষ্টি ও অনুভূতিবোধকে প্রবাহিত করলেন অন্তরপানে। হাতে হাত, শিশুর মত মন্দ শ্লথ নীরব শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে, দুই চোখ বন্ধ, অনড়, অবিচল। ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন। তখন, সেই সোপানে সন্ধ্যার নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে, আবছায়া নামছে। সারা জগৎ থরোথরো কাঁপে কাঁপুক, এই স্থান অটল, অবিচল থাকবে। ভারতবর্ষে তখন বৈশাখ মাস, গোধুলি লগ্ন, স্বর্ণালী বাতাস বইছে, ঈষদোষ্ণ, স্বপ্নিল। প্রাণীকূল ও জগৎসমুদায়ের নিঃশ্বাসে মেশানো দিবাবসানের সতত মানসিক নীরবতা ।
    “রাত্রির মধ্যযামে, দেবদূতগণ যে প্রজ্ঞার অধিকারী, সেই প্রজ্ঞায় বুদ্ধ উপনীত হলেন। জগতের সমস্ত প্রাণীর প্রতিচ্ছবি তাঁর সামনে যেন আয়নায় প্রতিবিম্বিত হল; মৃত্যুর নিমিত্ত প্রাণীরা পুনঃপুন জন্মগ্রহণ করে, উচ্চ নীচ, ধনী দরিদ্র, সৎ বা অসৎ, যে যার কৃতকর্মের ফলহেতু, দুঃখ বা সুখভোগ করে” “তিনি দেখলেন কিভাবে অসৎ কর্মে মন অনুতপ্ত হয় ও সেই অসততার প্রায়শ্চিত্ত করার অজ্ঞাত আগ্রহ ও ইহজগতে পুনরাবির্ভাবের তেজ সঞ্জাত হয়: অন্যদিকে কোন প্রকার সন্দেহ ও অনুতাপ না রেখেই কিভাবে সৎকর্ম জ্ঞানমার্গে বিলীন হয়ে যায়। “দেখলেন পশুযোনিতে জন্মের কি ফল; কেউবা শুধু তাদের চর্ম বা পিশিতের কারণে মৃত্যুবরণ করে, কেউ কেউ তাদের শৃঙ্গের, কেশের, অস্থির, পক্ষের কারণে; কেউ হত হয় বন্ধু-আত্মীয়ের পারস্পরিক দ্বন্দে বিদীর্ণ হয়ে; কেউবা ভারবহন করতে করতে প্রাণত্যাগ করে, কারো প্রাণ যায় অঙ্কুশতাড়িত বিদ্ধ অবস্থায় । তাদের ক্ষতবিক্ষত শরীর বেয়ে অঝোরে রক্তস্রাব হয়ে চলেছে, শুষ্ক ক্ষুধিত শরীর — তবু কোন উপশম নেই, তারা পারস্পরিক সংগ্রামে রত, শরীরের শেষ শক্তিটুকুও কে শুষে নিয়েছে। আকাশে উড্ডীয়মান বা গভীর জলে নিমজ্জমান, মৃত্যুর হাত থেকে কারো নিস্তার নেই। “এবং দেখলেন, যাদের মানবরূপে পুনর্জন্ম হয়েছে, ক্লেদময়, পূতিগন্ধময় শরীর, অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাদের দিনযাপন, জন্মবস্থা থেকে যারা শঙ্কায় কম্পমান, নমনীয় শরীরে যা কিছু স্পর্শ করে তাতেই যন্ত্রণাবোধ, যেন কেউ শাণিত ছুরির ফলায় খান খান করে তাদের কেটে ফেলছে” এই যে কণ্টকময় উপত্যকা, যাকে জীবন বলে জানি, এ যেন এক বিভীষিকাময় দুঃসপ্ন। “জন্ম ইস্তক মৃত্যু, পরিশ্রম, দুঃখের হাত থেকে কারো মুক্তি নেই, অথচ পুনর্বার জন্মের আকাঙ্খা, এবং জন্মানো মাত্রই যন্ত্রণাভোগ ।” নিদারুণ অজ্ঞানতার নিপীড়নযন্ত্র নিষ্পেষণ করতে করতে নিরন্তর এগিয়ে চলে। “তারপর দেখলেন যারা সদ্গুণসম্পন্ন হয়ে স্বর্গলাভ করেছে; সতত প্রেমের তৃষ্ণা তাদের গ্রাস করে আছে, জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গেই তাদের সৎকর্মেরও অন্ত হয়, পাঁচটি চিহ্ন তাদের মৃত্যুর ঈঙ্গিত বহন করে। ঔজ্জ্বল্য হৃত হয়ে অঙ্কুর যেমন শুষ্ক অবস্থায় বিনষ্ট হয়, এই সব মানুষের পারিপার্শ্বিক আত্মীয়বন্ধুরা যত শোকই করুক, এঁদের চিরকাল বাঁচিয়ে রাখতে অপারগ। এখন শূন্য প্রাসাদ, শূন্য প্রমোদ-অঙ্গন। একাকী নিঃসঙ্গ দেবদূতগণ ধুলিধুসরিত পৃথিবীতে উপবেশিত, প্রিয়জনের কথা স্মরণ করে রোদন ও হাহাকার করছেন। বিভ্রমের এ কি ছলনা, হায়! ব্যতিক্রম নেই কোথাও, প্রতি জন্মেই নিরন্তর বেদনা। “স্বর্গ, নরক, বা পৃথিবী, জন্ম মৃত্যুর বারিধি এইভাবে আবর্তিত — অনন্ত ঘুর্ণায়মান আবর্তনচক্র — এই সমুদ্রে নিমজ্জিত শরীরসমূহ অস্থির ভাবে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে চলেছে! এইভাবে মানসচক্ষে তিনি জীবনের পঞ্চক্ষেত্র ও জাত প্রাণিসমূহের লয়তত্ব অবধান করলেন। দেখলেন সকলই কদলীবৃক্ষ কি জলবিম্বের ন্যায় শূন্য ও অসার, সাপেক্ষহীন! “
    বোধিবৃক্ষ বা জ্ঞানবৃক্ষের তলায় গৌতম ধ্যানে বসছেন, তাঁর অধিষ্ঠানের এই শুভ মুহূর্তটি নিয়ে বহু লেখালিখি হয়েছে। এই অধিষ্ঠানে উদ্যান-ভ্রমণের যন্ত্রণা ছিল না, বরং ছিল তরুতলে নিশ্চিন্তে বসে থাকার অপার শান্তি। কোনকিছুরই পুনরুজ্জীবন করার তো ছিল না, ছিল তাবৎ সমুদায়ের বিলয়। সেই প্রহরে বুদ্ধের প্রতীতি হল সকল বস্তু কারণ হতে উৎপন্ন হয় তারপর তাদের লয় অবশ্যম্ভাবী, সেই জন্যই সকল বস্তু অনিত্য, সমস্তই অসুখী, সবই অমূর্ত, অবাস্তব! তিরতির করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। গৌতম অনুভব করলেন, এই জগদ্ব্যাপারের যা কিছু সব মনসিজ, মন হতেই তাদের উৎপত্তি, ঐশ্বরীয় বাস্তবতার জমিতে মিথ্যার ফাঁকি যে বীজ বপন করে, সেই বীজ থেকে তাদের জন্ম। একটা মিথ্যা স্বপ্ন, সেই স্বপ্নটা জুড়ে শুধু দুঃখ আর শোক। “সেই অরণ্যের যত পশু ছিল, তারা স্তব্ধ ও নীরব হয়ে তাঁর দিকে অপার বিস্ময়ে চেয়ে রইল” । বুদ্ধের খুব প্রলোভন হচ্ছিল । একবার ভাবলেন যে উঠে অন্য কোথাও চলে যান, তরুতলে এই অনর্থক ধ্যান করার দরকার নেই; পরক্ষণেই উপলব্ধি হল যে এ সবই মারের প্রলোভন, তখন অনড় রইলেন। একবার মনে দারুণ ভীতির সঞ্চার হল। এদিকে চোখ বন্ধ তবু যেন চোখের সামনে দেখলেন পিছনে কি সব হচ্ছে, প্রায় জ্বর এসে গেল ভেবে: নানারকমের চিন্তাভাবনা মনে উদয় হল। কিন্তু শিশুদের খেলতে দেখলে মানুষ যেমন অবিচল থাকে, তিনি তেমনি অবিচল রইলেন; এইসব মানসিক সংশয় আর উৎপাত মনে উঠতে দিলেন, বাধা দিলেন না, তারা বুদ্বুদের মত একবার করে উদয় হল, আবার মনসমুদ্রের শূন্যতায় বিলীন হয়ে গেল। রাত হল। বুদ্ধ শান্ত নীরব রইলেন, অতীন্দ্রিয় গভীর ধ্যানের অবস্থায় প্রবেশ করলেন। সর্বপ্রকার বিমলানন্দবোধ একের পর এক তাঁর নয়নের সমুখ দিয়ে চলে যেতে লাগল। রাত্রির প্রথম প্রহরে বুদ্ধ সম্যক দৃষ্টি প্রাপ্ত হলেন (সম্মা দিত্তি), সমস্ত পূর্বজন্মের স্মৃতি তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল। “অমুক স্থানে, অমুক নাম নিয়ে প্রথম জন্মের পর ক্রমাগত নিম্নগামী হতে হতে এই বর্তমান জন্মে আসা, এভাবে নিজের সহস্র সহস্র জন্মের ও মৃত্যুর জ্ঞান হল”
    অতীন্দ্রিয় শ্রবণ
    অস্তিত্বের সারাৎসার এর মূলতত্ত্ব যাঁর আয়ত্তে, তাঁর উজ্জ্বল, রহস্যময়, মানস-সত্তায় এমন কোন জন্মের কথাই বা বিস্মৃত থাকে? যেন তিনি সব হয়েছেন। সত্যিকারের আলাদা করে “তিনি” তো কখনো ছিলেন না, তিনি সদাসর্বত্র বিরাজমান ছিলেন, কাজেই সমস্ত বস্তুই প্রকারান্তরে এক সত্তা, আর সবটাই নিখিল মানসের অন্তর্গত, কেননা ভুত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান, ত্রিকাল ব্যাপি সে-ই একমাত্র মানস। “জন্ম ও মৃত্যু গঙ্গার বালুকারাশির মতই অসংখ্য, তাবৎ জীবের প্রতি অন্বয় চিন্তায় তাঁরও হৃদয়ে অপার করুণার সঞ্চার হল” দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, জীবনের সুপ্রাচীন স্বপ্ন, বহুমাতৃত্বময় বেদনার অশ্রুজল, সেই সব সহস্র পিতৃপুরুষ যাঁরা এখন মৃত্তিকায় মিশে গেছেন, অনন্তকালের ভাই বোনেদের হারিয়ে যাওয়া দুপুরবেলা, ঘুম ঘুম মোরগের ডাক, কীটপতঙ্গের গহ্বর, শূন্যতায় অপব্যয়িত সেই সব দয়ার্দ্র অনুভূতি, ফেলে আসা কোন এক ঝিমধরা বিশাল স্বর্ণযুগ মস্তিষ্কে অনুভূতি জাগায় যে, এ চেতনা তো আজকের নয়, এই জ্ঞান বিশ্বের জন্মেরও প্রারব্ধ । তারপর, “পরম করুণার অনুভূতিও যখন অতিক্রান্ত হল, বুদ্ধ তখন পুনরায় সর্বজীবের কথা বিবেচনা করলেন, কেমন করে তারা জীবচক্রের ছটি অংশে পরিভ্রমণ করে, জন্ম বা মৃত্যু কোনটাই শেষ কথা নয়; সমস্তই শূন্যগর্ভ, সমস্তই কদলীবৃক্ষের কি স্বপ্নের কি কল্পনার প্রায় অলীক”
    অনুভূতির এই সূক্ষ্ম কারুকর্মে বুদ্ধ যখন উপবেশন করছিলেন, তাঁর মুদ্রিত নেত্রে দৃষ্টির তমসার আবছায়ায় তূরীয় দুগ্ধফেননিভ উজ্জ্বল জ্যোতি যেন সপ্রভ বিরাজমান, তাঁর কর্ণকূহরে শ্রবণসমুদ্রের অপরিবর্তনীয় স্তব্ধতা, সে সমুদ্র কখনো উদ্বেল, কখনো অপসৃয়মান, শব্দের চেতনা স্মরণে মননে আসছিল, সে শব্দ যদিও অপরিবর্তনীয়, সেই শব্দের যদিও কোন হেরফের হয়নি, বুদ্ধের চেতনার কিন্তু পরিবর্তন হচ্ছিল; জোয়ার ভাঁটায় সমুদ্রের জল যেরকম মাঝে মাঝে চিড়বিড় করে বালি ভিজিয়ে দিয়ে যায় সেইরকম; সেই শব্দ কানের অভ্যন্তরেও নয়, তার বাইরেও নয় অথচ সে সর্বত্র বিরাজমান, অনঘ শ্রবণসিন্ধু, নির্বাণের অতীন্দ্রিয়নাদ, যাকে নিষ্পাপ শিশুরা শয্যায় শুয়ে শুনতে পায়, যে থাকে চাঁদের বুকে আর ঝড়ের হাহাকারের বক্ষদেশ জুড়ে, তাকেই সদ্যজাত বুদ্ধ শুনতে পেলেন যেন কেউ শিক্ষা দিচ্ছে তাঁকে; প্রাচীন কালের ও অনাগত ভবিষ্যতের সমস্ত বুদ্ধের কাছ থেকে ভেসে আসছে এক অন্তহীন অথচ স্পষ্ট জ্ঞানগর্ভ দীক্ষামন্ত্র। দূরে কোথাও ঝিঁঝিঁ ডাকছে; মাঝে মাঝে নিদ্রিত পাখিদের গলা থেকে অনবধানবশত কিচির মিচির শব্দ; মেঠো ইঁদুরের খড়খড় শব্দ, গাছে গাছে পত্রমর্মর — অতীন্দ্রিয় শ্রবণের শান্তি এতে মাঝে মাঝে ভঙ্গ হচ্ছে বটে, কিন্তু এও দৈববশে। অবিচল, অবিভেদ্য তূরীয় শ্রবণ-পারাবারে যাবতীয় কোলাহল, যাবতীয় দৈববশ মিশে গেল, না তার বৃদ্ধি হল, না তার ক্ষয় হল, সে মহাশূন্যের ন্যায় আত্মশুদ্ধ । নক্ষত্রখচিত আকাশের নীচে , রত্নসমাধির তূরীয়নাদের স্বর্গীয় প্রশান্তিতে মগ্ন অবস্থায় ধর্মরাজ অনড় ধ্যানমগ্ন হয়ে রইলেন।
    ভোর তিনটে। ইহজগতের দুঃখের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভোরের কুয়াশা ক্রমশ ঘন হল।
    “তৃতীয় প্রহরে তাঁর গভীর সত্যের উপলব্ধি হল। তিনি দুঃখসঞ্জাত, জীবনের জটিল গ্রন্থিতে আবর্তিত জগতের তাবৎ প্রাণিকূল, সেই সব অগণিত প্রাণ, যারা বেঁচে থাকে, বৃদ্ধ হয়, তারপর এক সময় মারা যায়, তাদের জন্য ধ্যানমগ্ন হলেন। সেই সব অগণিত লোভী, কামুক, অজ্ঞানতিমিরে আবদ্ধ অগণিত মানুষের দল যাদের শেষ পর্যন্ত মুক্তির উপায় জানা নেই, বুদ্ধ তাদের নিমিত্ত ধ্যানমগ্ন হলেন।” ওগো, দেহের মৃত্যুর কারণ কি? “সৎচিন্তায়, আপন অন্তরে তিনি ধ্যানমগ্ন হলেন জন্মের, মরণের, উৎস সন্ধানে।” দেহের জন্মই দেহের মৃত্যুর কারণ। যেমন, বীজ বপণই গোলাপ ফুলের প্রস্ফুটনের কারণ। আরো দূরে দৃষ্টিপাত করলেন, জন্ম তবে কোথা থেকে এসেছে? দেখলেন জন্ম এসেছে অন্য জীবনে অন্য কোথাও কৃতকর্মের কারণে; তারপর সেই কর্মের নির্ণয় করতে গিয়ে দেখলেন যে কোন বিধাতা তাকে আপন বিধানে বেঁধে দেন নি, এমনকি তারা স্বয়ম্ভুও নয়, না তাদের নিজস্ব কোন অস্তিত্ব আছে না তার অ-সৃষ্টি; দেখলেন, দীর্ঘ, দীর্ঘতর কারণ-শৃঙ্খলে কর্মের প্রাপ্তি, কারণের পর কারণের অতিদীর্ঘ সেই শৃঙ্খল, শ্রেণীপরম্পরায় গ্রথিত মাল্যবন্ধনে আবদ্ধ তাবৎ মূর্ততা — কী নীচ রূপ, কী রজকণা, বা বেদনা।
    তারপর। বাঁশের প্রথম গ্রন্থিটি ভেঙ্গে ফেলার পরে যেমন পরপর বাঁশ আলগা করা যায়, মৃত্যুর কারণ জন্ম ও জন্মের কারণ কর্ম অনুধাবন করার পর তিনি ক্রমশ সত্যের দর্শন পেলেন; মৃত্যু জাত হয় জন্ম হতে, জন্ম জাত হয় কর্ম হতে, কর্ম জাত হয় বন্ধন হতে, বন্ধন জাত হয় বাসনা হতে, বাসনা জত হয় বেদন হতে, বেদন জাত হয় অনুভূতি হতে, অনুভূতি জাত হয় ষড় ইন্দ্রিয় হতে, ষড় ইন্দ্রিয় জাত হয় ব্যক্তিত্ব হতে, ব্যক্তিত্ব জাত হয় চৈতন্য থেকে।
    কৃতকর্ম জাত হয় বন্ধন থেকে, কর্ম এক কাল্পনিক আকাঙ্খার হেতু করা হয়, যে কাল্পনিক আকাঙ্খার বন্ধনে প্রাণী বদ্ধ, যার নামে কৃতকর্মের শুরু, বন্ধন আসে বাসনা থেকে, স্বভাবের আগেও বাসনা, বাসনা আসে অনুভুতি থেকে। যার সম্বন্ধে কিছু জানতেন না, তাকে আপনি পেতে চান নি কখনো, তারপর যেদিন পেতে চাইলেন, সেদিন হয় যাকে পেতে চেয়েছিলেন তার সম্বন্ধে সুখানুভূতি হল, আর নয়ত না পাওয়ার দুঃখ যার থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন, বাসনা নামের মুদ্রাটির এপিঠ ওপিঠ; অনুভূতি সংবেদন থেকে এসেছিল, আঙুল পুড়ছে এই সংবেদন আর অনুভূতি একসঙ্গে তো হয়না। সংবেদন হয়েছিল কারণ চেতনা জাগানিয়া বস্তুটির সঙ্গে ষড়-ইন্দ্রিয়ের (চোখ, কান, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক, মস্তিষ্ক) সংস্পর্শ হয়েছিল, আগুনের সংস্পর্শে না এলে তো আঙুল পোড়ে না ;
    ষড়েন্দ্রিয় ব্যক্তিত্বের কারণে জাত; বীজ যেমন পত্র-শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রও তেমনি একমেবাদ্বিতীয়ম দর্পণসম স্বচ্ছ পরম-মানস জাত হয়ে ষড়গুণসম্পন্ন হয়ে বেড়ে ওঠে; ব্যক্তিস্বাতন্ত্র আসে চৈতন্য থেকে, যে চৈতন্য বীজের ন্যায় অঙ্কুরিত হয়ে একেকটি পত্রে বিকশিত হয়, চেতনাকে বাদ দিলে কুতো বৃক্ষপল্লব?; তো, চৈতন্য আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে, আর কিছুই বাকী নেই; সমাপতিত কারণে চেতনা থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের উৎপত্তি, অবার অন্যদিকে অন্য কোন সমাপতনে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র থেকেই চেতনার জন্ম। সমুদ্রে জাহাজ ভেসে চলেছে, সেখানে জাহাজ ও মানুষ একসঙ্গে, আবার দেখ তীর আর জল একে অপরকে জড়িয়ে আছে; চেতনা ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আসে, ব্যক্তিত্ব শিকড় প্রোথিত করে। শিকড় ষড়েন্দ্রিয়ের বহির্জগতের সঙ্গে সংস্পর্শবোধের উৎপত্তির কারণ, সেই সংস্পর্শ যা অনুভূতিকে বয়ে আনে; অনুভূতি বয়ে আনে অভিলাষ বা অনভিলাষ; অভিলাষ অনভিলাষ দুইই বন্ধনের কারণ; বন্ধন থেকে কৃতকর্মের উৎপত্তি, কৃতকর্ম থেকে জন্মের, জন্ম থেকে মৃত্যুর; তাবৎ জীবের অস্তিত্বের এ এক অনন্ত চক্র।
    একে অতিক্রম করে, অস্তিত্ব-শৃঙ্খলের (নির্দান শৃঙ্খল) দ্বাদশ গ্রন্থিকে অবলোকন ও পরিপূর্ণ করার পর, বুদ্ধ দেখলেন এই যে চৈতন্য, যে ব্যক্তিত্ববোধের সঙ্গে সঙ্গে এত রকম সব বিপত্তিরও উৎস, সে স্বয়ং কর্ম (স্বপ্নের অবশিষ্ট অসমাপ্ত ফেলে আসা কাজ) সঞ্জাত, এবং কর্ম এসেছে অজ্ঞানতা থেকে, ও অজ্ঞানতা এসেছে মানস থেকে। যে অমোঘ অনড় বিধি ক্রিয়া ও তার ফলকে একসূত্রে বেঁধে রাখে, কি ইহকালে কি পরকালে, কর্ম তারই মূর্ত প্রতিরূপ। মরজগতের যা কিছু, পশু, মানুষ, রাজন্যবর্গের ক্ষমতা, নারীদেহের সৌন্দর্য, ময়ুরপুচ্ছের অসামান্য রূপ, মানুষের নৈতিকতা, সব সব। কর্ম সজ্ঞান জীবের উত্তরাধিকার, যে ভ্রূণ তাকে বহন করে, যে ভ্রূণে সে পুনরায় ফিরে যাবে; কর্ম নৈতিকতার মূলে, কেননা যা ছিলাম নির্ধারণ করে যা হয়েছি। যে মানুষ জ্ঞানদীপ্ত হন, আলোকপ্রাপ্ত হন, তারপর স্তব্ধ হন, সর্বোচ্চ বোধি অর্জন করে নির্বাণপ্রাপ্ত হন, তার কারণ তাঁর কর্ম নিজেকে নিঃশেষ করেছে এবং এও তার কর্মেই বিধি ছিল; তেমনই অশিক্ষিত, ক্রুদ্ধ, লোভী, নির্বোধ মানুষের কর্মও নিজেকে নিঃশেষ করতে পারেনি বলেই এই অবস্থা, এও তার কর্মেই ছিল।
    ঠিকমত আলোকপ্রাপ্ত হয়ে, সম্যকভাবে অবলোকনপূর্বক তিনি প্রজ্ঞায় উপনীত হলেন।
    জন্মের বিনাশ হলে মৃত্যুও স্তব্ধ হবে, কর্মের বিনাশ হলে জন্ম স্তব্ধ হবে, আসক্তির বিনাশ হলে কর্ম সাঙ্গ হবে, বাসনার বিনাশ হলে আসক্তির অন্ত, চেতনার নাশ হলে বাসনার অন্ত, অনুভবের নাশ হলে বেদনের অন্ত, ষড়েন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন হলে অনুভবও শেষ হবে, ইন্দ্রিয়ে প্রবেশের পথের বিনাশ হলে, ব্যক্তিত্ববোধের ও সংলগ্ন বিষয়ের অন্ত হবে। চৈতন্যের নাশ হলে ব্যক্তিত্ববোধের অন্ত, আবার ব্যক্তিত্ববোধের অন্ত হলে চেতনারও অন্ত, চেতনার অন্তে কর্মের প্রভাব থাকে না। কর্ম গেলে স্বপ্নময় অজ্ঞানতারও অন্ত হয়, অজ্ঞানতার বিনাশ হলে ব্যক্তিমানুষের মৃত্যু; মহাঋষি এই ভাবে পরম প্রজ্ঞায় উপনীত হলেন।
    এই হচ্ছে নির্দান চক্রের তালিকা:
    ১। অজ্ঞানতা
    ২। কর্ম
    ৩। চৈতন্য
    ৪। ব্যক্তিত্ববোধ
    ৫। ষড়েন্দ্রিয়
    ৬। অনুভূতি
    ৭। উপলব্ধি
    ৮। বাসনা
    ৯। আসক্তি
    ১০। কৃতকার্য
    ১১। জন্ম
    ১২। মৃত্যু
    অন্তর্দৃষ্টি জাগল, অজ্ঞানতা দূরীভূত হল, অন্ধকার রাত্রি শেষে সূর্যোদয় হল। আমাদের ইহজগতের তেজোময় উজ্জ্বল, আত্ম-অধীশ্বর বুদ্ধ স্থাণুবৎ উপবেশিত রইলেন, তাঁর অন্তরে এই মহাসংগীত ধ্বনিত হল,
    “কত না জীবনের গৃহ আমাকে বেঁধেছে,
    কতদিন তাঁকে খুঁজে পাব বলে সংগ্রাম করেছি,
    সেই তাঁকে, যিনি ইন্দ্রিয়ের এই দুঃখময় কারাগার সৃষ্টি করেছেন,
    অথচ, আজ, এই মন্দিরের স্রষ্টা — তুমি!
    এই যে তোমায় চিনলাম, তুমি আর কখনো
    এই বেদনার প্রাকার গড়ে,
    কপট বৃক্ষশাখ, মৃত্তিকার ভেলা গড়ে
    আমায় ভোলাতে পারবে না,
    তোমার দুয়ার ভেঙে সেতু পেরিয়ে
    পেয়েছি তোমায়,
    মায়া দিয়ে গড়েছ যারে, অজ্ঞানতার নামে,
    চললাম আমি মুক্তির পথে।”
    এইভাবে মুক্ত হয়ে তাঁর অন্তরে জ্ঞান ও মুক্তচিন্তার উদয় হল, জানলেন পুনর্জন্মের অন্ত হয়েছে, উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। জগতের মঙ্গলকামনায় চতুরার্য সত্যে তিনি নতুন পথের সন্ধান দিলেন।
    চতুরার্য সত্য
    ১। সমগ্র জীবন ক্লেশময় (অস্তিত্ব মাত্রই দুঃখ, অনিত্য, অপ্রকৃত/অবাস্তব অবস্থা)
    ২। দুঃখের কারণ অজ্ঞান অন্ধ বাসনা কামনা
    ৩। দুঃখ ও যন্ত্রণার অপলাপ সম্ভব
    ৪। তার পথ আর্য-অষ্টাঙ্গমার্গ
    আর্য-অষ্টাঙ্গমার্গ
    1. সম্যক দৃষ্টি (সম্মা দিত্তি)। — চতুরার্য সত্যকে আশ্রয় করে
    ২। সম্যক সংকল্প (সম্মা সংকপ্পা) — যে এই পথেই দুঃখ জয় করতে হবে
    ৩। সম্যক বাচ (সম্মা বাচ) — জগতের সমস্ত ভ্রাতা ভগিনীদের সঙ্গে নম্র, মর্মস্পর্শী বাক্যালাপ
    ৪। সম্যক কর্মান্ত (সম্মা কম্মান্ত) — নম্র, সরল, পরোপকারী, সৎ ব্যবহার
    ৫। সম্যক আজীব (সম্মা অজীব) — কারো কোন ক্ষতি না করে অন্নসংস্থান করাই জীবন
    ৬। সম্যক ব্যায়াম (সম্মা ব্যায়াম) — উদ্যম ও উৎসাহের সঙ্গে সৎপথে চলার প্রতিজ্ঞা
    ৭। সম্যক স্মৃতি (সম্মা সতি) — সর্বদা বিপথ গমনে যে বিপদ তার কথা স্মরণে রাখা
    ৮। সম্যক সমাধি (সম্মা সমাধি) — সমস্ত জীবজগতের বোধির নিমিত্ত আপন মনে একাকী ধ্যান প্রার্থনায় মগ্ন থেকে পরমানন্দ লাভ (সমাধি সমাপত্তির নিমিত্ত ধ্যান করা)
    “এই জ্ঞান যখন আমার মধ্যে জাগ্রত হল, আমার অন্তরাত্মা কামনা, পুনর্জন্ম, অজ্ঞানতার প্রমত্ততা থেকে মুক্তিলাভ করল।”
    যেভাবে তৃণের অভাবে অগ্নি নির্বাপিত হয়, সেইভাবে বুদ্ধ “আত্ম” রহিত হলেন; যে কাজ তিনি চাইতেন যে অন্যে করুক এখন তাই তিনি নিজে করলেন; পূর্ণজ্ঞানে পৌঁছনর পথ তিনি পেয়েছেন। উদ্ভাসিত জ্ঞানের আলোয় বুদ্ধের উপলব্ধি হল: যে পূর্ণজ্ঞান, সে যেন বয়ে আনা উপহার, তাঁর পূর্বে আগত অগণিত বুদ্ধের পথ নিখিল বিশ্বের দশ দিক, দশচক্র বেয়ে তাঁর কাছে এসেছে, তাতে চোখের সামনে যেন এক মহান জ্যোতি দৃশ্যমান হল যে সেই তাঁরা, বুদ্ধেরা, সর্বত্র আলোকিত করে মহাপদ্মসিংহাসনে সমাসীন, প্রপঞ্চ মহাবিশ্বের সর্বত্র সর্বকালে সর্বজীবের আর্তিতে তাঁরা সংবেদনশীল, পূর্বকাল, ইহকাল, পরকাল, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের তাবৎ অস্তিত্বে তাঁরা বিরাজমান।
    মহাসত্য নির্ণয় করলেন তিনি, অতঃপর সেই সত্যকে নিজের জীবনে উপলব্ধি করে মহাঋষি আলোকিত হলেন, সম্বোধি লাভ করে তিনি বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হলেন। এ সম্বোধি যথার্থ সম্বোধি, শুধুমাত্র অন্তরগজৎ হতে তার আত্মপ্রকাশ, সেখানে বহির্জগতের, বহির্জাগতিক ঈশ্বরের, গুরুর কোন স্থান নেই। কবি বলেছেন,
    “শিরোপরি আত্মজ্যোতি ব্যতিরেকে,
    মানুষকে কেউ পথ দেখায় না, কেউ দেখায়নি।”
    তখন সেই প্রত্যূষে প্রভাতসূর্যের জ্যোতিকিরণ ক্রমশ উজ্জ্বল হল, অপসৃয়মান ধোঁয়াশা আর কূহেলী মিলিয়ে গেল দিনের আলোয়। চন্দ্র তারকার ক্ষীণ আলো ক্রমশ নিষ্প্রভ হল, দূর হল রাত্রির তমসাঘন অন্তরায়। বুদ্ধ তাঁর প্রথম পাঠ, শেষ পাঠ, সাবেক পুরাতন পাঠ সমাপন করলেন, মহাঋষির নিঃস্বপন সুপ্তিগৃহে প্রবেশ করে, পূর্ণ সমাধির স্থিতাবস্থায় তিনি অনন্ত সত্যের উৎসমুখে পৌঁছলেন যে, আনন্দের আদি নেই, আনন্দের অন্ত নেই, আনন্দ সদাসর্বদা সৎচিতে বিরাজমান।
    এই যে বুদ্ধ সৎচিতের প্রকৃত রূপ উন্মোচন করলেন, এতে কোন বাহ্যিক দেখনদারির বহিঃপ্রকাশ ছিল না, ছিল অন্তরের নিঃস্তব্ধতা ও অপার শান্তি। সে পরম এক নিশ্চলতা, চরম এক স্থিতাবস্থা ।
    তিনি এখন শিহিভুত, শীতল।
    এইবার আসবে পরমসুখী মহাতাপসের জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত। বহু সংগ্রামের শেষে তিনি গভীর সত্যকে খুঁজে পেয়েছেন, এখন সেসব খুবই অর্থপূর্ণ, কিন্তু খুব পণ্ডিত জ্ঞানী ব্যতিরেকে তা সাধারণ মানুষের দুর্বোধ্য। সাধারণ মানুষ নেহাতই পার্থিব, তারা সুখের সন্ধানে ঘুরে মরে। তাদের ধর্মজ্ঞান, পুণ্যার্জন, বিষয়সম্পদের প্রকৃত রূপ অবধান করার ক্ষমতা থাকলে কি হবে, তারা সব পুতুলনাচের পুতুলের মতন। ছলচাতুরীর, অজ্ঞানতার মায়াজালে ফেঁসে গিয়ে, হাবিজাবি ধারণার বশবর্তী হয়ে কি যেন এক অদৃশ্য সুতোয় নাচতে থাকে। এইসব উল্টোপাল্টা ধ্যানধারণার সঙ্গে তাদের প্রকৃত শান্ত সমাহিত স্বরূপের কোন সম্পর্কই নেই। তারা কি পূর্বকৃত-স্বপ্নের কর্মফলের ধর্ম বুঝতে পারবে? তারা কি তাদের নৈতিক জগতে ক্রমান্বয়ে চলতে থাকা কার্য-কারণকে অবধান করতে সক্ষম? তারা কি আত্মার মতন একটা পাশবিক ধারণাকে বিদেয় করে মানুষের প্রকৃত স্বরূপের বিষয়টাকে ধরতে পারবে? বামুন-পুরুত ধরে এই যে তাদের মোক্ষলাভের প্রবণতা, এই প্রবণতাটিকে তারা কি অতিক্রম করে বেরিয়ে আসতে পারবে? এরা কি পরম শান্তির অবস্থাটিকে উপলব্ধি করতে সক্ষম? সেই শান্তির স্থিতাবস্থা, যা জাগতিক তৃষ্ণা নিবারণ করে নির্বাণের স্বর্গসুখের পথে মানুষকে এগিয়ে দেয়? চারিদিকে যা চলছে, তাতে যে সত্য তিনি উপলব্ধি করেছেন, যা আবিষ্কার করেছেন, সেসব প্রচার করা কি ঠিক উচিত হবে? তারপর যদি না বোঝাতে পারেন, যদি ব্যর্থ হন, তখন? সে যন্ত্রণা কি সইতে পারবেন ? এই রকম সব প্রশ্ন আর সন্দেহ তাঁর মনে উদয় হল, তারপর সার্বজনীন করুণা আর সহমর্মিতায় সেসব ধারণা মিটেও গেল। সেই তিনি, যিনি যাবতীয় স্বার্থপরতা পরিত্যাগ করেছেন, তিনি তো অন্যদের ব্যতীত কেবল নিজের জন্য বেঁচে থাকতে পারেন না। পরের জন্য বেঁচে থাকার ব্রত যে নিয়েছে তার কাছে মানুষকে পরম সুখ অর্জনের পথ দেখানোর চেয়ে মহৎ আর কিই বা হতে পারে? সাংসারিক ব্যথা বেদনা, অশ্রুপূর্ণ সমুদ্রে নিমজ্জমান এই সব প্রাণী, এদের উদ্ধারের চেয়ে মহৎ সেবা আর কিছু আছে কি? জগতকে উপহারই যদি দিতে হয়, “প্রতিষ্ঠিত সত্য”রূপী ধর্মের সন্দর্শন করানো, এই জগতকে স্ফটিকের মত কাকচক্ষু স্বচ্ছ করে দেখিয়ে দেওয়াই কি সবচেয়ে দামী উপহার নয়?
    পরিপূর্ণ মহামানব অপলক নেত্রে মহাবৃক্ষ, সমস্ত বৃক্ষের অধিরাজ যে বৃক্ষ, তার পানে অনিমেষ নয়নে চেয়ে রইলেন, “এ ধর্ম এক আশ্চর্য ও মহৎ ধর্ম”, মনে মনে চিন্তা করলেন তিনি, “আবার এদিকে গতানুগতিক জীবনের অজ্ঞানতায় প্রাণিকূল অন্ধ হয়ে পড়ে আছে, কি যে করি? এই যে এখন, যতক্ষণ বাক্যস্ফুট করছি, মানুষ কিন্তু পাপে নিষ্পিষ্ট হচ্ছে। এদের অজ্ঞাতার কারণে, যা বলব এরা কেউ শুনবে না, পাত্তা দেবে না, তার ফলে নিজেরাই শাস্তি পাবে । এর চেয়ে বরং চুপ থাকাই শ্রেয়। আজই বরং নিঃশব্দে আমার মরণ হোক!”
    কিন্তু যখন স্মরণে এল কালে কালে সর্বজগতে গতাসু বুদ্ধগণ কি দক্ষতায় বিভিন্ন জন-কে পূর্ণ সহজ সত্যের দর্শন দিয়েছিলেন, তখন ভাবলেন, “নাহ, আমিও বুদ্ধচেতনার, আলোকপ্রাপ্তির উদ্বোধন করব!”
    এর বহুকাল পরে গৌতম সারিপুত্ত ও অন্যান্য সন্ন্যাসীদের কাছে তাঁর বোধিবৃক্ষের তলায় সেই সময়ের কথা স্মরণ করে বলেছিলেন, “সেদিন যখন ধর্মের বিষয় ধ্যান করছিলাম, সর্বলোক হতে বুদ্ধেরা স্বশরীরে আমার সুমুখে উপস্থিত হয়ে সমস্বরে বললেন, “ওঁ! তথাস্তু! জগতের একমেবাদ্বিতীয়ম নেতা! শৃন্বন্তু! এই যে অপরাপর নেতৃবর্গের অতুলনীয় জ্ঞান ও ধীশক্তিতে উপনীত হলেন, ও তাঁদের ধ্যান করলেন, তাঁদের এই শিক্ষার এবার পুনরাবৃত্তি করুন। বুদ্ধরূপে আমারাও সেই পরম সত্য ত্রিকায়ায় (মূর্ত-কায়া, আনন্দ-কায়া, ধর্ম-কায়া) প্রকাশ করব। মানুষ স্বভাবত নিম্নগতি, তারা হয়ত অজ্ঞানতাবশত বিশ্বাস করতে চাইবে না, যে, “তোমরা সবাই বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হবে।”
    “তাই আমরা আমাদের ক্ষমতাবলে ও ফললাভের উৎসাহহেতু বহু জ্ঞানীকে (বোধিসত্ত্ব-মনসত্ত্ব) জাগরিত করে তুলব”
    “অগ্রজদের মুখনিঃসৃত এই মধুর বাণী শ্রবণ করে আমি আনন্দিত হলাম; চিত্তোল্লাসে সেই মুনীবরদের বললাম, “মহাতাপসগণের কথা কখনো ব্যর্থ হয়না!”
    “অতএব আমিও, জগতের মহান নেতৃবর্গ যেমন বলেছেন সেই মত কাজ করব; ক্ষয়িষ্ণু প্রাণীকূলে জন্মেছি, তাই এই ভয়ংকর জগতের দুর্দশা সম্বন্ধে অবগত আছি’
    “তখন মনে হল যে কাজের জন্য আমার জন্ম হয়েছে, মহতী ধর্ম প্রচার ও পরম চৈতন্যের প্রকাশসাধন, তার সময় সমাগত।
    “কখনো কখনো, কোথাও কোথাও, কিভাবে যেন মহাত্মারা এ জগতে আবির্ভূত হন, তারপর তাঁদের আবির্ভাবের পর, তাঁদের অপার জ্ঞান, তাঁরা সময়ে সময়ে একই ধরণের ধর্ম প্রচার করেন।”
    “এই পরম ধর্মের সন্ধান পাওয়া বড় দুর্লভ, হোক সে শত সহস্র যুগ ব্যাপী; বুদ্ধদের বাণী শ্রবণ করে তাঁদের পরম ধর্মের যথাযথ অনুসরণ করবেন, এমন মানুষ পাওয়াও দুর্লভ।
    “ঠিক এই গোলাকার মহাবটবৃক্ষে পুষ্প যেমন দুর্লভ, পাওয়া যে যায়না তা নয়, সুন্দর লাগে।”
    “তবে যে ধর্মের আমি প্রবর্তন করব তা সব চেয়ে চমৎকার! যদি কেউ একে যথাযথ ভাবে শুনে, তাকে হর্ষের সঙ্গে গ্রহণ করে, তার পুনরাবৃত্তি করে, তবে সে সব বুদ্ধদেরই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করবে।
    “এ নিয়ে মনে কোন দ্বিধাদন্দ্ব রেখো না: আমি ঘোষণা করছি আমিই সেই ধর্মরাজ!”
    “তোমরা আনন্দ কর যে তোমরা সবাই বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হবে!”
    অতএব তথাগত, যিনি-চিত্তের-তদ্গত-অবস্থা-প্রাপ্ত-হয়েছেন, যিনি প্রাণীতে প্রাণীতে কোন বিভেদ দেখেন না, যিনি আপন, পর, বহু, কোন অস্তিত্বকে, অবিভক্ত নিখিল অস্তিত্বকেও আমল দেন না, যাঁর কাছে জগৎ এক দুঃখময় মায়া বই কিছু দ্রষ্টব্য নয়, না অস্তিত্ব না অনস্তিত্ব, স্বপ্ন থেকে জাগরিত কিন্তু স্বপ্নে কি দেখলেন তাই নিয়ে চিন্তা করেন না; অতএব তথাগত, শান্ত, স্তব্ধ, উজ্জ্বল, সর্বত্র জ্যোতি বিচ্ছুরণ করতঃ, তাঁর বোধি বৃক্ষের তপস্যাস্থল থেকে উথ্থান করলেন,ও অতুল্য সম্মানে তেজে একাকী স্বপ্নময় ধরিত্রীর উপর দিয়ে এগিয়ে চললেন, চিন্তা করতে করতে, “জাত বা অজাত, সকল প্রাণীর উদ্ধারকল্পে, যে সুপ্রাচীন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তাকে আজ সম্পূর্ণ করব। যারা চায়,তারা স্বকর্ণে মোক্ষ লাভের সৎপথের উপায়ের কথা শ্রবণ করুক।”
    জগতের রাজধানী বারাণসী। সেই শহরের উদ্দেশ্যে তিনি যাত্রা করলেন।
    পথে যেতে যেতে জনৈক পূর্বপরিচিত দিগম্বর জৈন সাধু উপকের সঙ্গে দেখা। উপক দেখলেন এই মানুষটিকে, যিনি একাকী বিশ্বের জন্মরহস্য প্রণিধান করেছেন, ভুলে যাওয়া পথ বেয়ে পুনর্বার নিয়েছেন সেই আদিম প্রতিজ্ঞা, যে প্রতিজ্ঞা মণিপদ্মের মতন এতদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল, সেই মানুষটিকে শুধোলেন, “কে আপনার গুরুদেব যাঁর দীক্ষাবলে জগৎসংসার ত্যাগ করলেন?”
    “আমার তো কোন দীক্ষাগুরু নেই,” আলোকিতজন বললেন, “নেই কোন মান্যবর সম্প্রদায়; কোন ঝলমলে চমৎকারিত্ব নেই আমার; থাকার মধ্যে আছে স্বাধ্যায়-সূত্রে প্রাপ্ত গভীর এক তত্ত্ব, যে তত্ত্বে অতিমানবিক প্রজ্ঞাবলে উপনীত হয়েছি ।
    “বারাণসীর সর্বত্র খুব শিগগির অদম্য এক জীবনের দামামা বাজতে চলেছে — তবে সেখানে বসে থাকা চলবে না — আমার কোন নাম নেই — আমার কোন চাহিদাও নেই — নাম চাইনা, যশ চাই না, কিচ্ছু না।
    “জগতের একটা শিক্ষার প্রয়োজন, কিন্তু শিখবে যে, এমন ছাত্র ভূভারতে নেই, আমি নিজে নিজে তাকে সম্পূর্ণরূপে শিখেছি, তাই আমি তাকে বলি পূর্ণজ্ঞান |
    “জ্ঞান-তরবারী দুঃখকে ধ্বংস করেছে, একে তাই জগৎ ঘোষণা করেছে চূড়ান্ত বিজয়।”
    বললেন, “আমার কোন গুরু নেই। আমার সমকক্ষও কেউ নেই। আমি স্বয়ংসিদ্ধ বুদ্ধ । আমি অপার শান্তিলাভ করেছি, নির্বাণপ্রাপ্ত হয়েছি। ধর্মরাজ্যপ্রতিষ্ঠা নিমিত্ত আমি বারাণসী চললাম, সেখানে জীবন-মরণে যারা তমসাচ্ছন্ন হয়ে আছে, তাদের মঙ্গলকামনায় আমি এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের প্রজ্জলন করব। “
    “আপনি কি বলতে চান জগৎ জয় করেছেন?” উপক জানতে চাইলেন।
    জাগ্রতজন বললেন, “যাঁরা নিজেকে জয় করেছেন, তাঁরাই জগৎ জয়ী, আপন কামনাকে যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম, যাঁরা অন্যায় থেকে বিরত থাকতে জানেন, কেবল তাঁরাই এ জগতের জয়লাভের অধিকারী। আমি নিজেকে জয় করেছি, আমি পাপকে প্রতিহত করেছি, তাই আমি জগতজয়ী।
    “অন্ধকারে প্রদীপ যেমন জ্বলে, নিজস্ব কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই সে জ্বলে, সে তার নিজের জ্যোতিতেই আলোকিত, ঠিক সেইরকম তথাগতের দীপক জ্বলমান, তাতে ব্যক্তিগত কোন অনুভূতি নেই, আপন জ্যোতিতে সে দীপ্যমান।”
    বুদ্ধ বেনারসে গেলেন।
    সেখানে ঈশিপত্তনের মৃগদাবে সেই পাঁচজন সাধু বসেছিলেন, যাদের সঙ্গে তিনি একসময় তপোবনে বৃথা তপস্যায় ছ’বছর কাটিয়েছিলেন । তারা বুদ্ধকে আসতে দেখল। বুদ্ধ ধীর পায়ে চলে যাচ্ছেন, নম্রভাবে, দুচোখ মাটির দিকে সাবধানী দৃষ্টি মেলে, লাঙ্গলের ফলার মাপে মেপে মেপে পথ চলা, যেন ধর্মের প্রসাদী ফসল তিনি বুনতে বুনতে চলেছেন। দেখে ওরা ব্যঙ্গ করল।
    “এই যে গৌতম এসেছে। সেই গৌতম, যে কৃচ্ছসাধনের তপস্যার প্রথম শপথ ভেঙ্গেছিল। ওকে দেখে প্রণাম কোর না, পাত্তা দিও না, এলে খাবার দাবার দেবারও দরকার নেই।”
    কিন্তু, সম্ভ্রম আভিজাত্য নিয়ে গৌতম যেই তাদের কাছে গেলেন, অনিচ্ছাসত্তেও তারা আসন থেকে উঠে দাঁড়াল, যদিও আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিল যে গৌতমকে কোন রকম শ্রদ্ধাপ্রদান করবে না, তবু সম্ভাষণ করল, পা ধুইয়ে দিল, যা যা বুদ্ধ আশা করতে পারেন সে সব তারা করল। বুদ্ধকে দেখে কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গেল, যদিও তারা গৌতম বলেই তাঁকে সম্বোধন করল। ভগবান বললেন, “আমাকে আমার ডাকনামে আর ডেকো না, যিনি অর্হতত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁকে নাম ধরে ডাকাডাকি করাটা অসম্মানজনক । ব্যাপারটা আমাকে নিয়ে নয়। আমার নিজের দিক থেকে কিছু আসে যায় না যে কে আমাকে মানল না মানল, আমাকে শ্রদ্ধা করল কি করল না। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে, যিনি করুণাঘন হয়েছেন যিনি সর্বজীবের প্রতি সমদর্শী, তাদের ক্ষেত্রে, সেইজনকে নাম ধরে ডাকাটা ঠিক শোভা পায় না। বুদ্ধগণ জগৎ উদ্ধার করেন, তাই সন্তানগণ পিতার প্রতি যেরূপ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, তাঁদেরও সেইরকম শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। “
    এই বলে তিনি তাদের তাঁর প্রথম ধর্মোপদেশ দিলেন।
    এই ধর্মোপদেশ “বারাণসীতে ধর্মোপদেশ”, বা ধর্মচক্রপ্রবর্তনসূত্র নামে প্রসিদ্ধ। এতে তিনি চতুরার্য সত্য ও অষ্টাঙ্গমার্গ সম্বন্ধে উপদেশ প্রদান করে তাদের দীক্ষিত করলেন। পূর্ণসত্যজ্ঞানী, সর্বব্যাপী ধীশক্তির অধিকারী বুদ্ধ সংক্ষেপে তাদের মধ্যপন্থা, বা সৎমার্গ সম্বন্ধে উপদেশ দিলেন।
    “হে ভিক্ষুগণ, চরম ভাব দুপ্রকার। যে মানুষ সংসার পরিত্যাগ করেছে, তাকে এই দুইপ্রকারের চরম ভাবই পরিহার করে চলতে হবে । একদিকে লোভী, ভোগপরায়ণ, বৈষয়িক মানুষের বিষয়বিলাস, আর অন্যদিকে অর্থহীন কৃচ্ছসাধন, প্রায় আত্মহননের মতন যাতে কোন লাভ নেই।
    “মাছমাংস পরিহার করে, উলঙ্গ হয়ে, মাথা কামিয়ে, চুলে জট পাকিয়ে, কষায় বস্ত্র পরিধান করে, সর্বাঙ্গে ধুলো মেখে যাগযজ্ঞ করে, এসব করেও কিন্তু ,মানুষ যতক্ষণ মায়ামোহ থেকে মুক্তি না পাচ্ছে, তার মধ্যে পবিত্রতা আসবে না।
    “ক্রোধ, মদমত্ততা, অকারণ জেদ, ধর্মান্ধতা, লোকঠকানো, হিংসা, অহংকার, আত্মপ্রশংসা, অন্যদের ছোট করা, নাক উঁচু স্বভাব, দুর্মতি, এইগুলোই যাবতীয় কলুষতা, মাছমাংস খাওয়া নয়।
    “হে ভিক্ষুগণ, এই দুই চরম পথ পরিহার করে বুদ্ধ একটি মধ্যপন্থা আবিষ্কার করেছেন — যে পথ চক্ষু উন্মীলিত করে, যে পথে সম্বোধি প্রাপ্তি হয়, যাতে মনে শান্তি আসে, একটা উচ্চতর প্রজ্ঞার পথ, পরিপূর্ণ জ্ঞানের পথ, নির্বাণের পথ।
    “মরুভূমিতে শুকনো ঘাস, রোদে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, তায় হাওয়া লেগেছে — এবার তাতে আগুন লাগিয়ে ছড়িয়ে দিলে — সে আগুন নেভায় কার সাধ্যি? লোভ লালসা সেই প্রকার আগুন, অতএব চরমপন্থা ছেড়ে আমি আমার হৃদয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছি।
    “প্রদীপে জল দিয়ে জ্বালালে অন্ধকার দূর হয় না, নষ্ট হয়ে গেছে এমন কাঠে আগুন জ্বালাতে গেলে সে আগুন জ্বলে না।
    “ যাঁর আত্মা রহিত হয়েছে, তিনি লোভ লালসা মুক্ত; অসংযমী মানুষ লোভের বশবর্তী হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়, কামনা বাসনার টান নিম্নগামী, মানুষকে অপবিত্র করে।
    “অবশ্য জীবনের যা প্রয়োজন তা মেটানোতে তো কোন অন্যায় নেই। শরীর সুস্থ রাখা কর্তব্য, নাহলে জ্ঞানের প্রদীপের সলতে ঠিক রাখতে পারব না, মনকে পরিষ্কার ও দৃঢ় রাখা চাই।
    অতঃপর সর্বজ্ঞজন যন্ত্রণা কি তা ও যন্ত্রণাকে নষ্ট করার যে আনন্দ, সেই আনন্দময় সংবাদের বিস্তারিত আলোচনা করলেন। কৌণ্ডিন্যের নেতৃত্বে পাঁচ সাধু, দুঃখকে ঠিকমত পর্যবেক্ষণ করতে পারলে যে আনন্দের বোধ, এই তত্ত্ব উপলব্ধি করে, অবাক হয়ে গেলেন। তারপর তিনি তাঁদের অষ্টাঙ্গমার্গ চেনালেন, যে পথে চলার আলোকবর্তিকা, পথ চেনানোর সঙ্গী, যথার্থ আস্পৃহা, ঠিকমতন মর্মস্পর্শী বাক্যকথন, সে পথে বাসগৃহ, যথার্থ আচার আচরণ, ঋজু চলন, কারো ক্ষতি না করে, কাউকে না ঠকিয়ে জীবিকা নির্বাহের যথাযথ পন্থা — একজন ভাল মানুষের, একজন সুখী মানুষের, এতেই নবশক্তিবিধান। ঠিক ঠিক উদ্যোগ নিয়ে সৎপথে চলার প্রতিজ্ঞা, যে পথ মাঝে মধ্যেই হারিয়ে যায় আবার তাকে খুঁজে বেরও করতে হয়। প্রকৃতির স্বরূপে (স্বপ্ন মায়াবৎ), তাতে মনোনিবেশ করে শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে সৎচিন্তা করা (“হে মোর ভিক্ষুগণ, প্রকৃতপক্ষে সবই একরকমের শূন্যতা, কিন্তু আপনারা কি তাতে মুক্তকচ্ছ হয়ে বিরাজ করতে পারেন?”)। আর যথাযথ ধ্যান, ধুলিমলিন পদচিহ্নের পিছনে চলতে থাকা পরিষ্কার চেতনার অপার শান্তি।
    তো এই মুক্তির মন্ত্র, আনন্দসংবাদ, মধুর সত্য। “তারপর যখন দিব্যজন সত্যরূপ রাজরথের চাকা এগিয়ে নিয়ে চললেন, দ্যাবাপৃথিবী জুড়ে সে এক পরমানন্দ অনুভূত হল”
    “হে বুদ্ধ, আপনি যথার্থই পরম সত্যে উপনীত হয়েছেন”, কৌণ্ডিন্য বলে উঠলেন, মানসচক্ষে সহসা তাঁর সত্যের উপলব্ধি হল, তারপর অন্যান্য ভিক্ষুগণও তাঁর সঙ্গে একজোট হয়ে বলে উথলেন, “আপনি সত্যই বুদ্ধ, আপনি পরমসত্যকে উপলব্ধি করেছেন!”
    পাঁচ ভিক্ষু তখন দীক্ষা গ্রহণ করলেন ও সংঘের কেন্দ্রবিন্দু হলেন। এর পর সেই সংঘে শত সহস্র মানুষ শরণ নেবেন।
    বুদ্ধ বারাণসী গিয়ে ঘরে ঘরে দ্বারে দ্বারে অন্নভিক্ষা করলেন । নীর নিম্নগতি, তাই জগতের সমস্ত উপত্যকা জয় করতে পারে, বুদ্ধও তেমনি সকলের চেয়ে নম্র, তাই তিনি জগৎ জয় করলেন। এই শিক্ষাটি অবিশ্যি সবচেয়ে দামী, যে, কোন কথা না বলে শিক্ষাদান (বিনাবাক্যে শিক্ষাদান)। বিশেষ করে গৃহস্থদের কাছে নম্রতা আর দানমাহাত্মের শিক্ষা। বুদ্ধের মতন মানবজাতির রাজাধিরাজ, দীর্ঘকায়, সুপুরুষ এক মানুষ, তিনি সামান্য ভিক্ষাপাত্র হাতে তাদের খিড়কির দরজায় নতজানু হয়ে আসছেন, এই ব্যাপারটাতেই সাধারণ মানুষ নিজের চোখে দেখল, তাঁর শিশুসুলভ সারল্য অথচ মানুষকে বিশ্বাস করার এক অমোঘ শিক্ষা পেল। ভিক্ষান্তে ব্যস্ত রাজপথের ধারে শহরের বাইরে কোন একটা জায়গায় বুদ্ধ চলে যেতেন, সেখানে পাত্র নামিয়ে রেখে, পায়ের ওপর বসে ভাবসমাধি অবস্থায় ধ্যান করতেন।
    যশ নামে বারাণসীর জনৈক ধনী ব্যবসায়ীর যুবক সন্তান পৃথিবীর দুঃখে কাতর, হারেমের নারীদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। এই অবস্থায় পাগলের মত পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। শুধু সে একা নয়, তার সঙ্গে ৫৪ জন সঙ্গী বা চেলাও ছিল, এমনই যশের প্রতিপত্তি। যশ বুদ্ধের কাছে এসে কান্নাকাটি জুড়ে দিল, “হায় হায়, কি বিপদ!” বুদ্ধ তাকে শান্ত করলেন, পরিচ্ছন্ন কাপড় যেমন রঙ শুষে নেয়, বুদ্ধের কাছ থেকে সেইরকম যশ শুষে নিল জ্ঞান, যে, যে বা যা জাত হয়েছে, তার মৃত্যুও অবশ্যম্ভাবী। বুদ্ধ তাকে শিষ্যত্বে বরণ করে নিয়ে নির্বাণের পথ প্রদর্শন করলেন। যশকে ভিক্ষু হতে দেখে বাকী ৫৪ জন বন্ধুও সংঘে যোগ দিল। আলোকিত জন তখন এই ৬০ জন শিষ্যকে মহাধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দিলেন।
    “যাও, যে পথে মানুষের মঙ্গল ও আনন্দ বিধান হবে, তার উদ্দেশে রওনা দাও ।”
    “যাও, যে পথে সর্বমানবের কল্যাণ ও জগতের প্রতি করুণা বিকশিত হবে, সে পথে এগিয়ে চল ।”
  • | ২২ মে ২০১৬ ১১:০০716602
  • তারপর?
  • Arin Basu | ২২ মে ২০১৬ ১৩:৩১716603
  • "Name: দ

    IP Address : 24.97.74.52 (*) Date:22 May 2016 -- 11:00 AM

    তারপর?"
    ---

    এখন তৃতীয় অংশটা এখানে লিখলাম, এর পরের অংশগুলো গুরুচণ্ডালীর ব্লগে দিয়ে দেব। :-)
    (পুরোটা একসঙ্গে পড়তে চাইলে এই লিঙ্কটাতে ক্লিক করুন,
    https://medium.com/@arinbasu/জেগে-ওঠ-ff3975ecc010#.95fsvzl2b)

    ---

    সন্ন্যাসীদের পরিব্রাজন
    “তোমরা দুজনে জোড়ায় জোড়ায় যাও, কিন্তু যে যার মত কাজ কোর। এবার যাও,মানুষকে উদ্ধার কর, গ্রহণ কর।
    “মানুষকে সদ্ধর্ম চিনতে সাহায্য কর; যে মানুষ আকাঙ্খার ধুলোয় নিমজ্জিত হয়ে অন্ধ হয়ে আছে, তাকে পুণ্য জীবনের আলো দেখাও।
    “তারা জ্ঞানের অভাবে মরণাপন্ন।
    “তাদেরকে ধর্ম শিক্ষা দিও ।
    এইভাবে শিশুসুলভ একাকীত্বে, অমিত প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে তারা ধর্মোপ্রচারে বেরিয়ে পড়ল। ফুলে ফুলে রক্তরাগে রঞ্জিত শাখাপ্রশাখা, আশায় আশায় প্রহর হল দীর্ঘ। যে পরম সত্যকে চীরকাল ভেবে এসেছে, আজ তাকে মুখ ফুটে বলতে পারছে; এতদিন বুদ্ধের মতন কেউ ছিলেন না যিনি এমন নিশ্চিত করে বুঝিয়ে দিতেন। তারা যা এতদিন ধরে ভেবেছে, তা যে সত্যি, সেই উপলব্ধি এবার হয়েছে, যেন কতদিনের স্বপ্ন পূরণ হল। সংঘের পুষ্প প্রস্ফুটিত হল, ভারত থেকে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল, “সৎ সুগন্ধ দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল” ।
    এই সময় বুদ্ধের কাছে একজন এসে জানতে চাইলেন, গৃহস্থ অবস্থায় বাড়িতে থেকে ধর্ম পালন সম্ভব কিনা। বুদ্ধ বললেন, “সাধুও যা, গৃহস্থও তাই, যে অবস্থায় উভয়েই “আত্ম” বোধ বিসর্জন দিয়ে সমস্ত প্রাণীর প্রতি সমদৃষ্টি প্রদান করেন, তাঁরা সমান।”
    কয়েকদিনের মধ্যেই বুদ্ধের প্রায় সহস্র নুতন শিষ্যলাভ হল। তিন কাশ্যপ ভ্রাতৃত্রয় আর তাঁদের সমস্ত শিষ্যগণ বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। এঁরা অগ্নি-উপাসক। গয়ার কাছে হস্তিশিলা (elephant rock), সেই পাহাড় থেকে দেখা যায় সুমুখে রাজগৃহের বিস্তীর্ণ ছড়ানো উপত্যকা । দিগন্তে হঠাৎ করে দাবানল জ্বলে উঠেছে। তা দেখে বুদ্ধদেব সেই সহস্র অগ্নি-উপাসকদের কাছে তাঁর আদিত্য পরিযায় সূত্র ব্যাখ্যা করলেন।
    “হে সাধুগণ, সবকিছুতে আগুন লেগেছে, দেখুন। কিন্তু আগুন কোথায় লেগেছে?
    “চক্ষু, হে সাধুগণ, চক্ষুতে অগ্নিসংযোগ হয়েছে; অবয়বে অগ্নিসংযোগ হয়েছে, নয়ন-চেতনায় আগুন লেগেছে, চোখ যা দেখে তার সবকিছুতে আগুন লেগেছে, তাবৎ বোধ, সংবেদনা, সে সুখের কি দুঃখের, কি সুখদুঃখ রহিত, আগুন হতে সঞ্জাত, তাতেও আগুন লেগেছে।
    এ আগুন কিসের আগুন?
    এ আগুন লালসার আগুন, ঘৃণার আগুন, রিরংসার আগুন, জন্ম, জরার, মৃত্যুর, দুঃখের, শোকের, হতাশার আগুন।
    কর্ণে অগ্নি সংযোগ হয়েছে, শব্দেরা সব অগ্নিদগ্ধ, নাসিকায় অগ্নি, অগ্নিদগ্ধ ঘ্রাণ, জিহ্বায় আগুন, স্বাদ পুড়ে যাচ্ছে, শরীরে আগুন, যা কিছু স্পর্শ করা যায় তার সবেতে আগুন, মস্তিষক্কে আগুন, ধারণায় আগুন, মনসিজ-চেতনায় আগুন, তাবৎ বোধ, সংবেদনা, সে সুখের কি দুঃখের, কি সুখদুঃখ রহিত, আগুন হতে সঞ্জাত, তাতেও আগুন লেগেছে।
    “ হে সাধুগণ, এই দেখে যাঁরা প্রাজ্ঞ, তাঁদের চোখ সম্বন্ধে বীতরাগ জন্মায়, অবয়ব সম্বন্ধে বীতরাগ জন্মায়, নয়ন চেতনা সম্বন্ধে তাঁরা উদাসীন হন, তাবৎ বোধ, সংবেদনা, সে সুখের কি দুঃখের, কি সুখদুঃখ রহিত, আগুন হতে সঞ্জাত সমস্ত কিছতেই তাঁরা উদাসীন। শ্রবণেন্দ্রিয় সম্বন্ধে তাঁরা উদাসীন, শব্দবোধ নিয়ে উদাসীন, নাসিকা, ঘ্রাণ, জিহ্বা, স্বাদ, শরীর, স্পর্শজাত তাবৎ বিষয়ে উদাসীন, মস্তিষ্ক, ধারণা, মন-চেতনা, যা কিছু বোধ, চেতনা, সমস্ত বিষয়ে তাঁরা উদাসীন, বীতরাগ।
    “এই ঔদাসীন্য যখন উপলব্ধি হয়, তখন তাঁরা আসক্তি রহিত হন, তখন তাঁরা মুক্ত ।
    “যখন মুক্তি আসে, তখন উপলব্ধি করেন যে মুক্ত হয়েছেন।
    “তখন বোধ জন্মে যে পুনর্জন্মের অন্ত হয়েছে, বোঝেন যে পুণ্য জীবন প্রাপ্ত হয়েছেন, যা করা উচিৎ তাই করেছেন, ইহজগতের তিনি কেউ নন। “
    এই-ই পরম সত্য!
    অজস্র শিষ্যসমেত পরম শ্রদ্ধেয় জন এবার মগধের রাজধানী রাজগৃহে অবতীর্ণ হলেন।
  • pi | 24.139.209.3 | ২২ মে ২০১৬ ১৬:০৯716605
  • আপনি ব্লগে প্রথম পর্ব থেকেই রাখুন না। পরপর পর্বগুলো অ্যাপেন্ড ক'রে দিতে পারেন।
    এখনো এডিট ক'রে দিতে পারেন।
  • Arin Basu | ২৩ মে ২০১৬ ০৬:১৯716606
  • উত্তম প্রস্তাব pi । ওভাবেই করব।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন