এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    বিপ্লবের আগুন - পর্ব তিন - কিশোর ঘোষাল | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়৩[এই ফাঁকে প্রাচীন ভারতের দৈনিক কাল-বিভাগ নিয়ে একটু সংক্ষিপ্ত আলোচনা সেরে নেওয়া যাক। এই লেখায় সে প্রসঙ্গ বারবারই আসবে। আমাদের তিথি মতে যদিও দিনের হিসেবে কিঞ্চিৎ হেরফের হয়, তবে গড় হিসেব ২৪ ঘন্টাই ধরেছি। ১ দিন = ৮ প্রহর = ২৪ ঘন্টা = ১৪৪০ মিনিট = ৬০ দণ্ড। ১ দণ্ড = ৬০ পল = ২৪ মিনিট = ১৪৪০ সেকেণ্ড। ১ পল = ২৪ সেকেণ্ড। দিনের প্রহরের হিসাব কিছুটা এরকম – প্রথম প্রহর – প্রভাত – ৬ AM থেকে ৯ AM; দ্বিতীয় প্রহর – পূর্বাহ্ন – ৯ AM থেকে ১২ PM তৃতীয় প্রহর – মধ্যাহ্ন – ১২ PM থেকে ৩ PM; চতুর্থ প্রহর - অপরাহ্ন – ৩ PM থেকে ৬ PM পঞ্চম প্রহর – সায়াহ্ন – ৬ PM থেকে ৯ PM; ষষ্ঠ প্রহর – প্রদোষ – ৯ PM থেকে ১২ AM সপ্তম প্রহর – নিশীথ (মধ্যরাত্রি) – ১২ AM থেকে ৩ AM; অষ্টম প্রহর – প্রত্যূষ - ৩ AM থেকে ৬ AM] এখন এই বেলা আড়াই প্রহরে রাজপথে পথচারীর সংখ্যা বেশ কম। কয়েকজন রাজপুরুষ ঘোড়ার পিঠে দুলকি চালে নগর পরিদর্শন করছে। সকালের প্রথম প্রহরান্ত থেকেই বিপণিতে ক্রেতাদের ভিড় জমতে থাকে। এখন পথের দুধারের বিপণিগুলিও প্রায় ক্রেতাহীন। সূর্যের তেজ যত বাড়তে থাকে নাগরিক ক্রেতারা গৃহাভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। এই সময় বরং আশপাশের গ্রাম থেকে আসে গ্রাম্য লোকজন - ঘোড়া কিংবা গোশকটে। তাদের আশাতেই বণিকরা শূণ্য বিপণিতে ধৈর্য ধরে বসে থাকে। পড়শি বণিকদের সঙ্গে গল্পসল্প করে সময় কাটায়। সাধারণতঃ এই গ্রাম্য ক্রেতারা সরল হয়। কথার তুবড়িতে তাদের ভুলিয়ে ফেলা যায় সহজেই। তাদের সঙ্গে কিছুটা তঞ্চকতা করে, নাগরিক ক্রেতাদের তুলনায় বেশ দুকড়ি উপরিলাভ করে নিতে পারে বণিকেরা। তবে আজকাল গ্রাম্য ক্রেতারাও শহরমুখো হচ্ছে কম। আজকাল কিছুকিছু বণিক, গাধার পিঠে, বলদের গাড়িতে পসরা সাজিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ঘরের মেয়েরা সরাসরি তাদের পছন্দ মতো বাসন-কোসন, রান্নার সরঞ্জাম, মশলাপাতি, কাপড়চোপড়, প্রসাধনী সামগ্রী হাতে নিয়ে, নেড়েচেড়ে, দেখেশুনে কিনতে পারে। কারণ শহরে আসে পুরুষরা। বাবা হোক, স্বামী হোক, ছেলে হোক, ভাই হোক – পুরুষরা পুরুষই। তারা মেয়েদের পছন্দের ব্যাপারটা তেমন বোঝে না। উপরন্তু তাদের মনে হয়, শহুরে বণিকদের বাকচাতুর্যে পুরুষরা বড্ডো বেশি ভেবলে যায়। তারা প্রায়ই ঠকে, রদ্দি জিনিষ কিনে আনে, বেশি দামে। অতএব আজকাল মধ্যাহ্ন আহারে গৃহে যাওয়ার সময় পর্যন্ত শহরের বণিকদের সময় কাটে একঘেয়ে আলস্যে। কিন্তু আজ তেমনটা হল না। বানজারা মেয়েদের একটি দল, গান গেয়ে আর নেচে নেচে রাজপথের একপাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। তাদের চলায় যেন গন্তব্যে পৌঁছনোর কোন তাড়াই নেই! নাচ ও গানের আনন্দেই তারা যেন মত্ত। তারা কোথা থেকে আসছে কেউ জানে না। কোথায় যাবে তাও কেউ জানে না। তাদের ভাষা দুর্বোধ্য। আশ্চর্য তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ। ঝলমলে রঙদার – পরনে পা পর্যন্ত লুটোন ঘাগরা, বক্ষে চোলি। ওদের দলে আছে চারজন যুবক পুরুষ। বলিষ্ঠ চেহারা সকলের। তাদের পরনে রঙিন পাজামা আর কুর্তা। চারজনের মধ্যে তিনজন পুরুষ বাঁশি, ঝাঁঝর আর ব্যাঞ্জো বাজিয়ে নাচ গানের সঙ্গত করছে। তবে একজন – সেই মনে হয় সর্দার – দলের সবাইকে সামাল দিয়ে চলেছে। রাজপথের পথিকদের যেন কোন অসুবিধে না হয়, তাদের চলাফেরায় যেন কোন বিঘ্ন না আসে। বিপণি থেকে মানুষজন পথের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। উপভোগ করছে বানজারা দলটির নাচগান আর ওদের উজ্জ্বল বর্ণময় উপস্থিতি। এবং তার থেকেও তারা বেশি উপভোগ করছে, মেয়েদের অপরূপ রূপ আর যৌবন। তরুণ ও যুবক বণিকরা উচ্ছ্বসিত, আঃ মেয়ে তো নয় – যেন একঝাঁক প্রজাপতি উড়ে চলেছে। তাদের সকলের মনেও এখন উড়ছে ওই প্রজাপতির দল। অন্যদিকে বয়স্ক-বিজ্ঞ বণিকদের আড় চোখেও দর্শকামের আবেশ, কিন্তু মুখে বিরক্তি – কোথা থেকে জোটে এই নচ্ছার মেয়েছেলেগুলো, আমাদের ছেলেগুলোর মাথা খাওয়ার জন্যে? কোটালরা করছে কি, দূর করে দিক শহরের সীমানার বাইরে।ভিয়েনের রসের কড়াইতে আটকে থাকা মক্ষির মতো দলটির দিকে সকলের মন যখন আবিষ্ট, সেই সময়েই রাজপথে এসে পৌঁছল দুই ঘোড়ায় টানা সুসজ্জিত একটি রথ। রথের গতিতে ধীর লয়। রথের আরোহী চান না, রথের ঝাঁকুনিতে তাঁর পানপাত্রের পানীয় উছলে পড়ুক। অথবা রথের দ্রুত গতির ঝাঁকুনিতে ছিন্ন হয়ে যাক তাঁর মদিরার আবেশ। রথের আরোহী রাজ শ্যালক রতিকান্ত। তাঁর রথের দুপাশে সামনে পিছনে সমগতিতে চলেছে ছজন সশস্ত্র অশ্বারোহী রক্ষী। অনতিদূরের প্রমোদকানন থেকে, এই সময়েই, রতিকান্ত তাঁর বাস ভবনে ফেরেন। অহংকারী রতিকান্ত পথের দুধারের পথচারীদের কিংবা বিপণির বণিকদের মানুষের মধ্যেই গণ্য করেন না। পথের পাথরখণ্ড, অথবা পথের দুধারের গাছপালার দিকে তিনি যেমন নির্বিকার চোখে তাকিয়ে থাকেন, খেটে খাওয়া মানুষদের প্রতিও তিনি একই রকম উদাসীন। তবে পথচারীদের মধ্যে দৈবাৎ কোন সুন্দরী রমণীর দর্শন পেলে, তিনি মৎস্যলোভী শিকারী বিড়াল হয়ে ওঠেন। আজ পথের পাশে নাচ-গান গাওয়া বানজারা মেয়েগুলিকে দেখে তাঁর চক্ষুস্থির হয়ে গেল। সুন্দরী, যুবতী এবং নৃত্যগীত পটিয়সী এতগুলি রমণীর একত্র দর্শন পাওয়া – এ যে অভাবনীয় সৌভাগ্য। তিনি সারথিকে রথ থামানোর নির্দেশ দিলেন। রথ থামলে তাঁর পাশে পাশে চলতে থাকা অশ্বারোহী রক্ষীকে তিনি বললেন, “অ্যাই, যা তো, মেয়েছেলেগুলোকে আজ সন্ধেবেলা আমার প্রমোদ ভবনে আসার জন্যে নেমন্তন্ন করে আয়। আমি কে পরিচয় দিবি। আর বলবি প্রত্যেকের দুহাত ভরে সোনার মুদ্রা উপহার দেব। ভাল করে বুঝিয়ে বলবি, হতভাগা তোরা যা হোঁৎকা আর মাথামোটা...”।রক্ষীপুরুষ দলটির কাছে গিয়ে রতিকান্তর বার্তা দিতেই, মেয়েগুলি নাচ-গান থামিয়ে দিল। একটি মেয়ে গলা চড়িয়ে উত্তর দিল, “আমরা নাচগান করি মনের আনন্দে। আমরা বারনারী নয় হে, যে কেউ ডাকলেই তার নাট মহলে গিয়ে ধেই ধেই নেত্য করে বেড়াব। কথাটা আপনার ছোটরাজাকে স্পষ্ট করে বলে দিন, হ্যাঁ”।রতিকান্ত রথে বসে মেয়েটিকে মন দিয়ে দেখলেন, তার কথাও শুনলেন। মুগ্ধ চোখে মেয়েটিকে দেখতে দেখতে তিনি ভাবলেন, এমন জিনিষের স্বাদ তিনি বহুদিন পাননি। আহা, কী ঝাঁজ, কী তেজ, যেমন বুক তেমনে তার বুকের পাটা। নিজের বুকে ওই বুকের স্পর্শই যদি না লাগল – তা হলে তিনি কিসের রাজশ্যালক? রতিকান্ত অন্য রক্ষীকে বললেন, “অ্যাই যে, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? ওই মেয়েটাকে তুলে নিয়ে বন্দী কর। বেশী ট্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করলে সবকটাকেই ধরে কয়েদ কর – তারপর আমি দেখছি”। রক্ষীদের কর্তব্য রতিকান্তকে রক্ষা করা। তাঁকে কেউ আক্রমণ বা আঘাত করতে এলে, তাকে বন্দী করা কিংবা প্রয়োজনে হত্যা করা। কিন্তু এই নির্বিবাদী বানজারা দলটি কাউকেই আঘাত বা আক্রমণ করেনি। এক্ষেত্রে ওদের বন্দী করার কোন অধিকার তো তাদের নেই। রতিকান্তর আদেশ পেয়েও রক্ষীরা যখন ইতস্তত করছে, ঠিক তখনই অকুস্থলে উপস্থিত হল জনা ছয়েক অশ্বারোহী নগররক্ষী। তারা রক্ষীদের কথা শুনেই দ্রুত সক্রিয় হয়ে উঠল এবং ঘোড়া ছুটিয়ে ঘিরে ফেলল বানজারাদের দলটিকে। বাতাসে চাবুক চালাতে লাগল সপাসপ। চেঁচিয়ে উঠল “ছোটরাজাকে তোরা চিনিস না? তাঁর আদেশ অমান্য করার সাহস হয় কী করে? মানে মানে আমাদের সঙ্গে চল, নয়তো চাবকে পিঠের ছাল তুলে দেব”। দলের যে যুবকটিকে মনে হয়েছিল দলের সর্দার, সে মাটিতে পড়ে থাকা একটা ঝোলা থেকে ছোট্ট একটা বল্লম বের করে হাতে তুলে নিল। সেই বল্লমের ফলা দুপুরের রোদে ঝলসে উঠল আক্রোশে এবং মুহূর্তের মধ্যে সেটি উড়ে গিয়ে গিঁথে গেল রতিকান্তর গলার ঠিক পাশে আসনের পিঠে। এক চুলের জন্যে বেঁচে গেল রতিকান্ত। আচমকা এই ঘটনায়, মেয়েগুলিকে ছেড়ে নগররক্ষীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল যুবকটির ওপর। প্রহার করতে করতে মোটা রজ্জুতে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল তাকে। তারপর তুলে দিল একটি ঘোড়ার পিঠে। বন্দী যুবককে নিয়ে নগররক্ষীরা চলে যাওয়ার আগে, তারা এসে দাঁড়াল রতিকান্তর রথের পাশে। একজন নগররক্ষী মাথা নত করে বলল, “আমাদের অপরাধ মার্জনা করবেন, প্রভু। এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। আপনি সুস্থ আছেন তো?” আতঙ্কে বিবর্ণ মুখ, রতিকান্তর জিভও শুকিয়ে গিয়েছিল। তিনি কোনমতে বললেন, “না, কই? তেমন কিছু তো হয়নি। ঠিকই আছি”।সেই নগররক্ষী আসনের পিঠে গিঁথে থাকা বল্লমটি খুলে নিয়ে বলল, “দুশ্চিন্তা করবেন না, প্রভু। আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান। আজ রাত্রে হতভাগাকে অন্ধকার কারাগারে নির্জলা উপবাসে রেখে দেব। আগামীকাল প্রথম প্রহরেই ওকে রাজপথের চৌরাস্তার স্তম্ভের পাশে শূলে চড়িয়ে দেব। সকল নাগরিক দেখুক, বুঝুক - এ রাজ্যে দুর্বৃত্তের কী পরিণতি হয়”। কিছুটা ধাতস্থ হওয়া রতিকান্ত হতাশ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু ওই মেয়েগুলো? তারা তো পালিয়ে গেল!” “ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না, প্রভু। ওই দলের প্রত্যেককে আমরা অচিরেই খুঁজে বের করব। তারপর বন্দী করে আপনার সামনে এনে দাঁড় করাব। অনর্থক আপনার অনেক বিলম্ব হল প্রভু, এবার আপনি রওনা হোন। আপনার যাত্রা নির্বিঘ্ন হোক”। নগররক্ষী ইশারা করতে সারথি রথ চালনা শুরু করল, এবং আগের মতোই ছজন অশ্বারোহী দেহরক্ষী চলল সঙ্গে। বন্দী যুবককে নিয়ে নগররক্ষীরাও দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দিল উলটো দিকে। ওদিকেই নগর কোটালের কার্যালয়, বন্দীশালা ও কারাগার। এই গোলমালের শুরুতেই বিপণির ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছিল বণিকরা। আড়াল থেকে নজর রাখছিল পরিস্থিতির ওপর। এ ধরনের ঘটনায় তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কারণ তাদের অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানে, এই ধরনের বিশৃঙ্খলা হলেই, সাধারণ জনতা, নগররক্ষী সকলেই বিপণিগুলি এবং বণিকদের উপর চড়াও হয় - অকারণ মারধোর করে এবং লুঠ করে নেয় বিপণির মূল্যবান সামগ্রী। এখন রাজপথ জনশূণ্য। পথে একজনও পথচারী নেই। আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বণিকেরা তাদের সকল বিপণিগুলির দরজা দ্রুত বন্ধ করে ফেলল। তারপর একত্রে ঘরের দিকে যেতে যেতে আলোচনা করল, আজ সন্ধ্যায় আর বিপণি খুলে কাজ নেই। আগামী কাল সকালে পরিস্থিতি বুঝে যা হোক একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। ক্রমশ...
    ভুলভুলাইয়ায় ছনেন্দ্রনাথ - রমিত চট্টোপাধ্যায় | অলংকরণ: রমিত চট্টোপাধ্যায়সেদিন সকালে তেতলার পিসিমার ঘরে বসে এক মনে ড্রয়ার ঘাঁটছিল ছেনু। ওটা আসলে মহারাজ ছনেন্দ্রনাথের রত্ন ভান্ডার। যত রাজ্যের উদ্ভট জিনিসের ভিড় থেকে মনমতো জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে একটা বল্টু লাগানো লম্বা স্ক্রু ভারি পছন্দ হয়েছে, বল্টুটা খুলতে যাবে, ঠিক এমন সময় দোতলা থেকে হইচই কানে এল। শেয়ালদার মতো ব্যস্ত এলাকায় হট্টগোল তো সর্বক্ষণ লেগেই আছে, কিন্তু এই হইচই এর শব্দটা ভারি মিঠে, আর তার মধ্যে একটা চেনা চেনা গলাও উঁকি দিচ্ছে, তাই ছেনু আর থাকতে পারলো না, স্ক্রুটা ফেলে রেখে সিঁড়ি দিয়ে এক দৌড়ে নিচে নেমে এল। এসে দেখে যা ভেবেছে ঠিক তাই, দিম্মা এসেছে! সাথে এসেছে মামা, হাতে দইয়ের হাঁড়ি আর বাক্স-প্যাঁটরা। ছোড়দা আজ কলেজ যায়নি, সব জিনিসপত্র ধরে টরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। মামা ঘরে ঢুকেই বলে দিল, আমার কিন্তু দুপুরেই ট্রেন। শুনেই মা শিগগির গিয়ে রান্না চাপালো। মামা কিছুদিনের জন্য কৃষ্ণনগর ফিরেছিল, আবার এখান থেকে চলে যাবে সেইই বিলাসপুর। কলকাতায় তো আসতেই হবে ট্রেন ধরতে, তাই দিম্মাও বলেছে চল ক'দিন ঘুরে আসি কলকাতা থেকে। দিম্মাকে পেয়ে ছেনুর আনন্দ আর দেখে কে! এবার অনেকদিন পর এসেছে। ছেনু বলে, মামা আবার না ফেরা পর্যন্ত তুমি এখানেই থাকবে। দিম্মা হেসে ফেলেছে, সে কবে ফিরবে তার ঠিক আছে? তার আগেই আবার যে অন্য ব্যাপার আছে। - কী ব্যাপার? বলো না!- সে বলব'খন, বলা কি পালিয়ে যাচ্ছে!দুপুরে তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে মামা ছুটলো ট্রেন ধরতে, ছোড়দা সাথে মালপত্র নিয়ে যেতে চাইছিল কিন্তু মামা তাকেও এক ধমক লাগিয়েছে, শেয়ালদা থেকে ট্রেন হলে কথা ছিল, এইটা হাওড়া থেকে, তোমায় অদ্দুর ছুটতে হবেনা। তাই শুধু বাসে তুলে দিতে গেছে।খাওয়াদাওয়ার পর খাটে শুয়ে মা, দিদিমা আর বড়দি মিলে নানান গপ্পে মেতেছিল। ছেনু শুধু থেকে থেকেই ভাবছে ওই সেই ব্যাপারটা কী, দিম্মা যেটার কথা বলবে বলছিল পরে। চুপিচুপি দইয়ের হাঁড়িটা থেকে চামচ দিয়ে কিছুটা দই খাওয়ার পর ছেনু প্রথমে ঠিক করল, বদ্দি এখন শুয়ে, এই সুযোগে ওর আঁকার পেনসিলগুলো নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক, তারপর আর থাকতে না পেরে দিম্মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, বলো না, সকালে কী বলবে বলছিলে। কি একটা ব্যাপার যেন। দিম্মা হেসে বলে ও আচ্ছা আচ্ছা, বলছি, শোও এখেনে। মেয়েকে বলেন, শোন, তোদের সব্বাইকে কিন্তু কৃষ্ণনগর যেতে হবে, মানকের ছেলের বিয়ে।মা বলেন, মানিক কাকা, আমাদের পাশের বাড়ির?- হ্যাঁ রে বাবা, এই বিষ‍্যুদবারের পরের বিষ‍্যুদবার। মানকে নিজেই আসতো নেমন্তন্ন করতে, আমি বললাম, আমি তো যাচ্ছিই, ওদের কার্ডটাও আমার হাতে দিয়ে দে। তোদের সবাইকে যেতে বলেছে কিন্তু।- সবার তো আপিস কাছারি, ইস্কুল, কলেজ রয়েছে। এদের ফেলে কী করে যাব বলো তো! তুমি একাই যেও বরং।- সে কী! তোরা না গেলে আমি যাব কী করে? তোরা কেউ যাবি না? আচ্ছা ছোট্টুকে নিয়ে যাবো? (ছেনুকে) কি গো, তুমি পারবেনা আমায় নিয়ে যেতে?- মা, ও তো ছোটো, ও কি করে পারবে?কৃষ্ণনগর তো দূর, ছেনু আজ অব্দি উল্টোডাঙ্গা পর্যন্তও একা একা বেড়াতে যায়নি। এই সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়! ছেনু ছুট্টে গিয়ে আলনা থেকে বড়দার একটা ফুলপ্যান্ট বের করে, পায়া গুটিয়ে পরে চলে এল, কোমরটা ঢলঢলে, তাই এক হাতে ধরে চোখ বড় বড় করে বলল, আমি ছোটো? এই দ্যাখো এখন আমি ফুলপ্যান পরি। আমি ঠিক তোমায় নিয়ে যেতে পারবো। কীভাবে দিম্মা সেদিন মাকে রাজি করিয়েছিল কে জানে, তবে ছেনুর উৎসাহে আর দিম্মার আশ্বাসে শেষ অব্দি ঠিক হলো ছেনু আর দিম্মা মিলে ট্রেনে চেপে কৃষ্ণনগরে যাওয়া হবে।উৎসাহের চোটে এর পরের দিনগুলো কিভাবে ফাস্ট ফরোয়ার্ড হয়ে গেল, কেউ আর টের পায়নি। যাইহোক আমরা একেবারে যাওয়ার দিনে গিয়েই দেখি কী কান্ড চলছে! সকালবেলার ট্রেন, বাড়ির কাছেই শেয়ালদা থেকে ছাড়বে, ছেনু ও তার দিদিমাকে ট্রেনে তুলতে সবাই মিলে হাজির হয়েছে। ওঠার আগে মহারাজ একবার শাঁ করে ছুটে ইঞ্জিন অব্দি দেখে এলেন। বাড়ির কাছেই স্টেশন হওয়ার দৌলতে ট্রেন ব্যাপারটা একেবারে অচেনা বস্তু নয়, একবার দুবার চেপে দেখাও হয়েছে। হঠাৎ হাপিস হয়ে যাওয়ায় মা কষে বকুনি লাগালো, সবসময় দিম্মার হাত ধরে থাকবি, একদম কাছছাড়া হবি না, ওখানে গিয়ে দিম্মার কথা শুনে চলবি, ইত্যাদি নানান ভাষণ। ছোড়দা পাশ থেকে বলে উঠল ওখানকার মহারাজ কিন্তু ভীষন কড়া, দুষ্টুমি দেখলেই ধরে শূলে চড়িয়ে দেয়! ছেনুর উত্তরও সাথে সাথে তৈরি, কেন গোপাল ভাঁড় আছে না, ঠিক বাঁচিয়ে নেবে আমায়। এরকম নানা হাসি মজা, ট্রেনে উঠে সাথে বেঁধে দেওয়া চিড়ে, মুড়ির সদগতিকরণের ও কোনো স্টেশনে না নামার উপদেশ দেওয়া, শেষ মুহূর্তের প্রণাম টনাম ইত্যাদির শেষে সিটে বসতেই ভোঁ বাজিয়ে ট্রেনটা হুশ করে ছেড়ে দিল।ট্রেনে যেতে যেতে বেশ ভালোই লাগছিল, জানলার ধার দেখে ওরা বসেছে, হু হু করে হাওয়া লাগছে মুখে। বাইরের দৃশ্য ক্রমশ বদলে বদলে যাচ্ছে, তখন কলকাতার আশপাশ একটু পেরোলেই বেশ দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ক্ষেত, গাছপালা চোখে পড়ত। ছেনু সেসব মুগ্ধ হয়ে দেখে চলেছে, হঠাৎ হুঁশ ফিরল একটু দূর থেকে আসা ঝালমুড়িওলার ডাকে। দিদিমার হাত ধরে বায়না করা শুরু, ঝালমুড়ি খাবে? দিদিমা প্রাজ্ঞ মহিলা, তিনি বুঝলেন ট্রেনে চেপে গেলে স্টেশন ও ফেরিওয়ালা পরপর আসতেই থাকবে, সাথে ছেনুর বায়না, তাই যা করার শুরুতেই করতে হবে। তিনি ফিসফিস করে বললেন, ছোট্টুবাবু, তুমি তো জানো না, ট্রেনের খাবার একদম খেতে নেই। ওই খাবারে ঘুমের ওষুধ মেশানো থাকে, খেয়ে যেই কোনো ছোট বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়ে, ওমনি তাদের ধরে বস্তায় করে আরবে না কোথায় পাঠিয়ে, সেখানে উটের দৌড় করায়। তাতে না জিততে পারলে আর খাবার দেয়না। তুমি কি উটের দৌড়ে যাবে? উটের দৌড় ব্যাপারটা মন্দ না লাগলেও, না খাইয়ে রাখাটা মহারাজের ঠিক মনঃপূত হলো না। তাই আর বাকি রাস্তা তেমন বায়না টায়না ধরলেন না। সঙ্গে আনা মুড়ি-চিঁড়েরই সদ্ব্যবহার করা হল।মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাটেই ট্রেন কৃষ্ণনগর পৌঁছল।স্টেশনে নেমেই ছেনুর কি আনন্দ, দ্যাখো ঠিক তোমায় একা একা নিয়ে চলে এলুম! স্টেশনের ধার থেকে রিকশা চেপে বাড়ি পৌঁছুনো গেল। ওখানকার লোকেরা কেউ ছেনুকে আগে দেখেনি। মহারাজের বেশ ভালোই খাতিরদারি জুটল। তবে বাড়ির ছেলের বিয়ে ছিল আগের দিন, আজ বউ নিয়ে ফিরবে বলে সবাই সারাক্ষণই দৌড়াদৌড়ির মধ্যে রয়েছে। তার মধ্যেই আশেপাশের কয়েকটা নতুন দাদা আর দিদির সাথে ছেনুর আলাপ জমেছে। ওদের সাথে সাথে এবাড়ি ওবাড়ি ছোটাছুটি করছে, লুকোচুরি খেলা চলছে। মাঝে এক ফাঁকে এসে দিম্মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এখানে গোপাল ভাঁড়ের বাড়িটা কোথায় গো ? আমায় নিয়ে যাবে একবার? দিম্মা কি আর করে, বলল, এখান থেকে বেশ দূর তো, পরে নিয়ে যাব'খন। এমনি সময় হঠাৎ হইচই বেঁধে গেল, বউ আসছে, বউ আসছে! যারা বরণ করবে, সবাই তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল বরণডালা হাতে। প্রথমে উলু দিয়ে, তারপর হরেক কলাকৌশল পার করে বউকে নিয়ে বর মহাশয় ভিতরে ঢোকার সুযোগ পেলেন। ছেনু অবাক হয়ে বর-বউয়ের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। বাড়ির ভিতরে ঢুকেও তাদের নিস্তার নেই! আবার কি একটা পুজো গোছের হলো। পুজো শেষে নিয়ম ছিল, একটা বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে মিষ্টি খাওয়াতে হয়। বাড়ির সমস্ত বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো হওয়ার সুবাদে ছেনুরই কপাল খুলল। নতুন বউ কোলে বসিয়ে ছেনুকে একটা মিষ্টি খাইয়ে হাতেও নাড়ু, মিষ্টি, ফল, টল গুঁজে দিল। তখনই আরেকটা পুঁচকে দিদি (ছেনুর থেকে বয়সে খুব বেশি না, বছর তিনেক বড় হবে হয়তো) এসে বলল, দাও দাও আমার কোলে দাও ওকে একটু ঘুরিয়ে আনি। ছেনু হেঁটে হেঁটেই ঘুরে অভ্যস্ত। হঠাৎ তাকে আজ সবাই কোলে নিচ্ছে, ও একটু অবাক! পুঁচকে দিদিটা বাইরে নিয়ে গিয়েই ওকে কোল থেকে নামিয়ে বলল, এইনে, তুই ফলটা খা কেমন, বলে নাড়ু আর মিষ্টিগুলো হস্তগত করে হাওয়া। আচমকা এই ছিনতাইয়ে ছনেন্দ্রনাথ হতচকিত!পরদিন রাতে বৌভাত। পাশের বাড়ির ছাদে প্যান্ডেল করে খাওয়াদাওয়া হচ্ছে। পাশের বাড়ির লোক হয়ে তো আর শুরুর ব্যাচেই বসে পড়া যায় না। দিদিমা একটু রাতের দিকেই খেতে গেলেন ছেনুর হাত ধরে। দিদিমা শুধুই লুচি মিষ্টি খাবেন, পাত পেড়ে বসবেন না। সারাদিনের এত খেলাধুলো, দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত ছেনুর চোখ জুড়ে তখন খালি ঘুম নেমে আসছে। খেতে বসেই মাঝে মাঝে ঢুলে পড়ছে। ছেনুর পাশেই বসেছেন এক মাস্টারমশাই (মাস্টার মশাই আরেকটু দিই আরেকটু দিই ডাক থেকে ছেনুর অনুমান)। ছেনু লুচি-বেগুনভাজা খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়লে, সেই মাস্টারমশাই মাঝে মাঝে বাঁহাতের ঠেলায় জাগিয়ে দিচ্ছেন, ও খোকা খাও! ভাত ভাঙো। আবার ছেনু ঘুমচোখে জেগে উঠে দেখে পাতে আরো কি কি সব দিয়ে গেছে। সেদিন শেষমেষ ঘুমচোখ আর মাস্টার মশাইয়ের ক্রমাগত উৎসাহের ঠেলায় ছেনু যে কী কী খেয়েছিল, পরদিন সকালে আর তেমন মনে টনে ছিল না।পরদিনটাও সকাল থেকে বেশ আনন্দেই কাটছিল। ওদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ছেনু চুপটি করে দিম্মার পাশে শুয়েছিল। মাঝে একবার বাথরুম পেয়েছে, বাথরুম সেরে এসে আবার শুয়ে পড়ল। এরপর একটা আজব কান্ড! মাঝে মাঝেই ছেনুর বাথরুম পাওয়া শুরু হল। মানে ছেনু ফিরছে আর দিম্মা জিজ্ঞেস করছে, কই গেছিলি। ছেনু বারবার বলে বাথরুমে। দিম্মা অবাক, অনেকটা জল খেয়ে নিয়েছিলি বুঝি! ছেনু তাতেই দুষ্টু হেসে মাথা নাড়ে। এরকম বার পাঁচেক হওয়ার পর দিদিমাও পিছু পিছু গিয়ে দেখেন, বাথরুম টাথরুম কিচ্ছু না! ছেনু একবার করে উঠছে আর কৌটো থেকে দুটো করে বিস্কুট বের করে মুখে পুরছে। দিম্মা ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলে, এইবার বুঝেছি, এতবার বাথরুম পায় কী করে! আসলে চট করে উড়ে যাওয়ার ভয়ে, শেয়ালদায় বিস্কুটের টিন ছেনুর হাতের নাগালের বাইরে রাখা থাকে, আর এখানে একেবারে টেবিলের ওপরেই রাখা, আর কি জানি কেন, তাই দেখে ছেনুর খিদেটাও আজ মোক্ষম চাগিয়ে উঠছিল।বিকেলের দিকে পাশের বাড়ির একটা দাদা এসে দিম্মাকে বলল, ও জেঠি, মাঠে খেলা হচ্ছে, ছেনুকে নিয়ে যাব? দিম্মা বলল, হ্যাঁ যা, কিন্তু ছোট্টুকে চোখে চোখে রাখবি, আর ফেরার সময় সাবধানে নিয়ে আসবি। দাদাটা ঘাড় নেড়ে ছেনুকে সাইকেলে চাপিয়ে রওনা দিল। ক্যারিয়ারে বসে আশপাশ দেখতে দেখতে অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে মাঠে পৌঁছে ছেনু দেখল, বিশাল বড়ো মাঠ। যেসব দাদারা ফুটবল খেলছে, তারা অনেক বড়। বেশির ভাগই ছোড়দার মতো ঢ্যাঙা, কি জোরে জোরে দৌড়াচ্ছে! অনেকেই মাঠের পাশে বসে খেলা দেখছে। দাদাটা ছেনুকে মাঠের ধারে বসিয়ে বলল, এখানে বসে খেলা দ্যাখ, বাড়ির ফেরার সময় আবার একসাথে সাইকেলে করে ফিরব, অন্য কোথাও যাবি না কিন্তু! এই বলে দাদা সাইকেল এক কোণে রেখে ওর বন্ধুদের দলে মিশে গেল। ছেনু মন দিয়ে খেলা দেখছে, সবাই শাঁই শাঁই করে ছুটছে, দমাস দমাস করে শট মারছে গোলে। ছেনুদের গলির ফুটবলের সাথে এর বিস্তর তফাৎ। এদের খেলা দেখে ছেনু মনে মনে ঠিক করল, খেললে এদের মতোই খেলতে হবে, বড়ো বড়ো গোলপোস্ট, বড় ফুটবল নিয়ে। ম্যাচ বেশ জমে গেছে, পর পর গোল হচ্ছে। দু'দলের গোলকিপারই বেশ কাঁচা, ওদের দেখে ছেনুর ইচ্ছে করছিল, যদি দাদাদের মতো লম্বা হওয়া যেত চট করে, তাহলে ও-ই লাফিয়ে লাফিয়ে গোলগুলো বাঁচিয়ে দিত। ধীরে ধীরে এক সময়ে খেলা থিতিয়ে ম্যাচ শেষ। আলো কমে আসছে, প্রায় সন্ধে নামে নামে। মাঠও প্রায় ফাঁকা হয়ে আসছে, যারা ধারে বসে খেলা দেখছিল, তারাও একে একে বাড়ির পথ ধরেছে। ছেনুর সম্বিৎ ফিরতে আশেপাশে তাকিয়ে সেই দাদাকে খোঁজে, তাকে আর দেখা যাচ্ছে না! যেখানে সাইকেলটা রেখেছিল, সেখানে গিয়ে দেখে সাইকেলটাও নেই। পাশে একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, আমার দাদাকে দেখেছো? সে কার একটা সাথে কথা বলছিল, ছেনুকে খেয়াল না করেই আলগোছে উত্তর দিল, দ্যাখো না কাছাকাছিই আছে কোথাও। এবার মহারাজ একটু সাহস পেয়ে ভাবলেন, ঠিকই তো, আশেপাশেই আছে নিশ্চই। আমি হাঁটা লাগাই, কতো আর বড় জায়গা হবে এই কৃষ্ণনগর, রাস্তায় ঠিকই দেখতে পেয়ে যাব। তখন সাইকেলে উঠে বসলেই হবে। ও আঁতি পাতি করে মাঠের চারধারে খুঁজে আসলো, কোথাও দাদার দেখা নেই! বুকে খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে এবার রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করল, বাড়ির পর বাড়ি, রাস্তার পর রাস্তা, দোকানের পর দোকান, সব পার করে ছেনু বুঝতে পারল, দাদাটা নির্ঘাৎ ওকে ফেলে রেখে বাড়ি চলে গেছে, তাই সেই দাদাকে আর না খুঁজে একা একা বাড়িতে ফিরে যাওয়াই মনস্থির করে ফেলল। সাইকেলে চেপে আসার সময় যে রাস্তা দিয়ে এসেছে, সেটা কি আর চিনতে পারবে না! বাড়ি ফেরা আর কতই বা কঠিন হবে! যে রাস্তা ধরে এলাম, সে রাস্তা ধরে সোজা গেলেই হলো। কিন্তু হায়, এ তো আর শিয়ালদার বৈঠকখানা নয়, কৃষ্ণনগর! ছেনু চেনা ভেবে যে গলিতেই ঢুকতে যায়, গিয়ে দেখে এটা তো নয়, তবে ওই যে আরেকটা গলি দেখা যাচ্ছে, ওটাই হয়তো হবে। এভাবে গোটা ছয়েক রাস্তা, গোটা সতেরো গলি ও সাথে খান সাতেক কানা গলি ঘুরে ছেনু উপলদ্ধি করল, ভুলভুলাইয়া কাকে বলে! ছোড়দা যে মাঝে মাঝে ভয় দেখাতো, লখনৌর ভুলভুলাইয়ায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেবে, সেটা যে কৃষ্ণনগরেই আছে এটা তার জানার বাইরে ছিল। যতটা সাহসের পুঁজি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, নতুন এক একটা গলিতে ঢোকার সাথে সাথে সেই পুঁজিটা ক্রমশ কমে কমে আসছে। পা'ও ব্যথা করছে। এক সময় মনে হল, আর পারা যাচ্ছে না, ডাক ছেড়ে কেঁদেই ফেলবে বুঝি। কিন্তু হাজার হোক মহারাজ তো, আরেক মহারাজের ডেরায় এসে কেঁদে ফেলা কি উচিত হবে! এমনি সময় একটা ফাঁকা গলিতে হঠাৎ পেছন থেকে সাইকেলের হর্ন শুনে ছেনু ফিরে তাকালো। নাঃ, দাদা তো নয়, একটা কাকু সাইকেল চালিয়ে আসছে। কাকুটা ওকে কাঁদো কাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাইকেল থেকে নেমে এসে বলল, খোকা তোমার বাড়ি কোথায়? অন্য সময় হলে 'খোকা' ডাকে ছেনু খুব চটে যেত, কিন্তু এখন তারই বিপদ, কী করা যাবে! ছেনু বলল, শেয়ালদা। কাকু তো সেই শুনে অবাক, সে কী! তুমি এখানে এলে কী করে? ছেনু বলে, দিম্মার সঙ্গে এসেছিলাম, এখানে আমার দিম্মার বাড়ি।- তাই বলো। তুমি কি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছ? ছেনু হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়তে কাকু বললেন, তোমার দিম্মা কোথায় থাকে বলো, আমি পৌঁছে দিচ্ছি।ছেনু যেন চোখের সামনে স্বয়ং দেবদূতকে দেখতে পেল। ওর চোখদুটো আনন্দে হেসে ওঠে, মাথা চুলকে বলল, ওই তো কাছেই দিম্মার বাড়ি, মানে, ওই যে বিয়েবাড়িটার পাশে। বলার পরেই ছেনু বুঝতে পারল, দিদিমার বাড়িটা নিশ্চই চেনা, কিন্তু বাড়িটা যে আসলে কোথায় সেটা সে একদমই জানে না! আসলে পুরো কৃষ্ণনগর শহরটাই তো তার কাছে এক্কেবারে নতুন।বুঝতে না পেরে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, কাদের বাড়ির বিয়ে বলোতো? তোমার দিদিমার নাম কি? আর কে থাকে সাথে?- নাম তো জানি না, সাথে মামা থাকে, কিন্তু মামা তো এখন বাইরে।- মামার নাম কী?- মামা? (কি যেন নামটা! ছেনুর কিছুতেই মনে পড়ে না)- বুঝেছি, সাইকেলে ওঠো, দেখি তোমার দিদিমার বাড়ি খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। ছেনুর বুকটা একটু ঢিপ ঢিপ করছিল। লোকটাকে চেনেনা, জানেনা, বিদেশ বিভুঁই জায়গা, সাইকেলে ওঠা কি ঠিক হবে! তাও, যা থাকে কপালে, ছেনু ক্যারিয়ারে চেপে বসল।কাকু এতক্ষণ ঘুরে আসা রাস্তা গুলো আবার খানিকটা পাক মেরে, অন্য রাস্তায় এসে, ছেনুকে জিজ্ঞেস করল, এখানে কিছু চেনা লাগছে? ছেনু মাথা নাড়ে। -জোরে বলো, আমি তো দেখতে পাচ্ছি না তোমায়।- এখানে নয়।আরও নানান রাস্তা ঘোরার পরেও ছেনুর উত্তর একই দাঁড়ালো। শেষে হতাশ হয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎ ছেনুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আচ্ছা কাকু, তুমি এখানকার রাজবাড়িটা চেনো ?কাকুও হঠাৎ রাজবাড়ির কথা শুনে উৎসাহিত হলেন, ওদিকেই তোমার দিদিমার বাড়ি বুঝি?-না দিম্মার বাড়ি তো ওখানে নয়, কিন্তু, ওখানে গেলে তো গোপাল ভাঁড়কে পাওয়া যাবে, ও নিশ্চয়ই একটা বুদ্ধি বের করবে!কাকু এবার ভয়ানক রেগে গেলেন, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি তোমার বাড়ি খুঁজতে গিয়ে আর এদিকে তুমি ইয়ার্কি মারছ! গোপাল ভাঁড় আষাঢ়ে গপ্পের লোক, তাকে খুঁজে তুমি বুদ্ধি নেবে? একদম চুপটি করে বসে থাকো, তোমায় এমন জায়গায় নিয়ে যাব, সব ইয়ার্কি বেরিয়ে যাবে! (বোঝা যাচ্ছে গল্প কাহিনীর চরিত্রকে বাস্তব ঠাউড়ানোর বিপদ চিরকালই ছিল, তা ছনেন্দ্রনাথকে নয় ছোটো বলে মাফ করে দেওয়া যায়)এই না বলে কাকু শাঁ শাঁ করে স্পিড তুলতে শুরু করেছে সাইকেলে। ছেনুর এবার ভীষণ ভয় লাগছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে রে বাবা, সেই আরব না কোথায় পাঠিয়ে দেবে না তো! উটের পিঠে বসিয়ে দৌড় করাবে, না খাইয়ে রেখে দেবে? তাহলে তো আর কোনো দিনই ফেরা হবে না শেয়ালদায়! পড়ে রইল মা, দাদা, দিদিরা, পড়ে রইল তেতলার রাজত্ব। আহা, ছোড়দার সেই মোক্ষম গাঁট্টাগুলোও যেন এখন মিষ্টি মনে হচ্ছে। ছেনু তবু নিজেকে মনে মনে সান্তনা দেয়, যাক আর কিছু না হোক একবার উটের পিঠে তো অন্তত চাপা হবে। তাই সই। মহারাজ ছনেন্দ্রনাথ এবার থেকে শুধুই এক উট চালানেওয়ালা। মুখ গোঁজ করে ক্যারিয়ারে চুপ করে বসে থাকে। হাওয়া এসে কানে ঝাপটা মারছে। নোনতা জলের ধারা টোবলা গালদুটো বেয়ে নেমে আসে।"অ্যাইইই! আমার নাতিটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? ওরে তোরা দেখ রে, ছোট্টুকে কোথায় নিয়ে চলে গেল!"হঠাৎ চেনা গলা কানে আসতেই, ছেনু সাহস ফিরে পেয়ে লোকটার পিঠে জোরসে খিমচে দিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়ে কাকু দুম করে ব্রেক মারতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে ভূপতিত! ছেনু সেই সুযোগে সাইকেল থেকে নেমে কাঁদতে কাঁদতে দিম্মার দিকে দৌড় মারে। "ও দিম্মা গো, আমি উটে চাপবো না দিম্মা, আমাকে বাঁচাও!" ছেনু দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে।দিদিমা তখন বাড়ির কাছের মিষ্টির দোকান থেকে নাতির জন্যই একটু কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত সরপুরিয়া কিনে ফিরছিলেন। হঠাৎ কোন একটা অচেনা লোকের সাইকেলে চেপে নাতি কোথায় চলে যাচ্ছে দেখতে পেয়ে হইহই করে ওঠেন। দিদিমার চিত্কারে সবাই মিলে সেই ভূপতিত সাইকেল সওয়ারকে ঘিরে ধরলে জানা যায় সে নাকি একটি হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যাচ্ছিল বাড়ি ফেরানোর জন্য, পথে এই কান্ড!শেষমেশ সেই কাকুকে মাটি থেকে তুলে জল টল দিয়ে একটা বাড়ির রোয়াকে নিয়ে গিয়ে বসানো হল, অল্প সরপুরিয়াও দেওয়া হল। কাকু সেইসব খেয়ে টেয়ে, আর কখনো একা একা ঘুরবে না, সাবধানে থাকবে, এসব উপদেশ টুপদেশ দিয়ে চলে যাওয়ার পর ডাক পড়ল সেই পাশের বাড়ির দাদার। সে যতই বলে বন্ধুদের সাথে গল্পে মেতে প্রথমে ছেনুকে আনার কথা ভুলে গেলেও, পরে সে আবার মাঠে ফিরে গিয়েছিল ছেনুর খোঁজে, কিন্তু অনেক খুঁজেও তখন আর মাঠে তাকে দেখতে পায় নি -তার সেই সব অজুহাত সমবেত বকুনির সামনে কল্কে পেলে তবে তো! আর ছেনু তখন কী করছে? এক কোনে বসে চোখ মুছতে মুছতে একটু একটু করে সরপুরিয়া খাচ্ছে আর ভাবছে এখন যদি দিম্মা সরপুরিয়ার বদলে শুকনো চিঁড়েও খেতে দিত, তাহলেও সে সোনামুখ করে খেয়ে নিত, বাড়ি ফেরার এমনই আনন্দ! ফিক করে একফালি হাসিও বেরিয়ে আসে, যাক, এ যাত্রা তার রাজত্বটা তো বেঁচে গেল!
    স্লোভাকিয়া ২ - হীরেন সিংহরায় | ব্রাতিস্লাভা দুর্গ খেলাঘর : গড়া এবং ভাঙা বুদাপেস্ত থেকে ব্রাতিস্লাভা যাবো। দানিউবের পাশে সিংহ সেতুর কোনায় ইন্টার কনটিনেনটাল হোটেলের বয়স্ক কন্সিয়ার্জের সঙ্গে বেশ আলাপ হয়ে গিয়েছিল একাধিকবার সাক্ষাতের কারণে। তিনি অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ ইংরেজি, জার্মান এবং কিমাশ্চর্যম, রোমানিয়ান অবধি বলেন। হাঙ্গেরি ও বুদা এবং পেস্ট সম্বন্ধে তাঁর কাছে অনেক তথ্য আহরণ করি যা উইকিপিদিয়াতে মেলে না।গাড়িতে উঠতে দেখে টিবর এগিয়ে এলেন।-  ভিয়েনা ফিরছেন?-  না, ঠিক সিধে নয়। ব্রাতিস্লাভায় কাজ আছে। আচ্ছা যেভাবে এসেছি সেই পথেই তাতাবানিয়া হয়ে এম ওয়ান ধরে যাবো? একটু ঘুর হয়ে যাবে না?-  তা হবে, কিন্তু আরেকটা রাস্তাও নিতে পারেন। এম ওয়ান ধরুন, যেমন এসেছেন, খানিক গিয়েই পাবেন চেম, সেখানে ডাইনে ঘুরে দানিউব নদী পার হয়ে কমারোম নেমেসোচা দিওসফরগেপাতোনি পেরিয়ে পঝনি পৌঁছে যাবেন; মানে এসেছিলেন দানিউবের ডানদিক ধরে, ফিরবেন বাঁ দিক ধরে! বুদাপেস্ত থেকে ব্রাতিস্লাভার পথ গুগলের আবির্ভাবের দশ বছর আগে থেকেই ম্যাপ দেখে ইউরোপে গাড়ি চালাচ্ছি। হল্যান্ডের মাসট্রিখটে প্লেন থেকে নেমেছি, যাবো বেলজিয়ামের লিয়েজ হয়ে জার্মানির আখেন কিন্তু মোটরওয়ের বোর্ডে সে নাম নেই-আছে Luik, Lüttich, Aken Aix-la-Chapelle–বুঝ গুণী যে জানো সন্ধান! টিবরের মুখে শোনা নামগুলো সেই রকম অচেনা ঠেকল!আমি কিছু বলার আগেই টিবর একটু বিব্রত মুখে বললেন, দুঃখিত, কিছু না ভেবেই আপনাকে রাস্তার শহর গ্রামের হাঙ্গেরিয়ান নামগুলো বলে ফেলেছি; এদের আজকের পরিচয় স্লোভাক নামে, সেটা আপনি গুগলে অবশ্য ঠিক পেয়ে যাবেন : যেমন নেমেসোচা হল জেমিয়ান্সকা অলচা!আমি বললাম, হল্যান্ড, চেক, পোল্যান্ড বা রোমানিয়াতে তাদের ভাষার পাশাপাশি হাজার হাজার জার্মান নামের সঙ্গেও আমার দীর্ঘদিনের পরিচয় আছে–হাঙ্গেরিয়ানটা নতুন যোগ হলো। দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপে গিয়ে আমার ইউরোপীয় ইতিহাস ও ভূগোলের জ্ঞানের খামতিটা ক্রমশ বুঝেছি।একদা ইউরোপের মাঝখানে কোথাও বসবাস করতেন স্লাভ জাতি। কালে খাদ্যের অকুলান হলো, নিয়মিত তুরকিক অভিযানে জীবন বিপর্যস্ত–দেড় হাজার বছর আগে ভাগ্য সন্ধানে তাঁরা ইউরোপের তিন দিকে বেরিয়ে পড়লেন। পোল্যান্ডের প্রচলিত লোকগাথা অনুযায়ী তিন স্লাভিক ভাই, লেখ চেখ রুশ গেলেন তিন দিকে–উত্তর দিকে লেখ, পুবে রুশ দক্ষিণে চেখ। লেখ বাসা বাঁধলেন আজকের পোল্যান্ডে (লেখ নামক বিয়ার তাঁর নামকে অমর করে রেখেছে) বেলারুশ; রুশ যেখানে থামলেন সেটি আজকের রাশিয়া, ইউক্রেন (আক্ষরিক অর্থে সীমানা), চেখ ভাই গেলেন দক্ষিণে, আজকের বলকান অবধি। কালক্রমে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেন সকলে। পশ্চিমে কেন যান নি তার কোন ব্যাখ্যা পাই নি। হয়তো বর্বর গথ ভিসিগথ জাতির নৃশংস আচরণের কাহিনী শুনেছিলেন অথবা এই তিন অঞ্চলে তাঁরা পেলেন বাসযোগ্য ভূমি; লোভ বাড়ান নি। ইতিহাসের কি বিচিত্র পরিহাস-স্লাভ হারাবে তাদের আপন রাজ্য ; হাবসবুরগ, হোহেনজোলারন/প্রাশিয়ান রাজারা শাসন করবেন সকল স্লাভ জাতিকে*, দক্ষিণে এলো অটোমান। এরই মাঝে হাবসবুরগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাঙ্গেরিয়ানরা দখল করলো আধখানা বলকান, আজকের স্লোভাকিয়া। একমাত্র ব্যতিক্রম স্লাভিক রুশ যারা অন্য স্লাভেদের ওপরে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করবে।একদিন পশ্চিমের সেই গথ ভিসিগথ ফ্রাংক উপজাতি, আজকের জার্মানি সরব হবে আপন স্বার্থে স্লাভ বাসভূমি দখলের দাবিতে-নাৎসি অভ্যুদয়ের বহু আগেই জার্মান মনিষীরা বললেন ইংরেজ, ফরাসি, স্প্যানিশ বা ডাচের কলোনি আছে নানান মহাদেশে। আমরা ইউরোপে খুঁজে নেবো আমাদের বাসভূমি (লেবেনসরাউম)-সে জমি আছে পুবে। পরবর্তী পঞ্চাশ বছর ইউরোপের ইতিহাস নির্মম স্লাভ দমনের কাহিনী–পুবের পানে ধাও (দ্রাং নাখ অস্টেন)।১৯১৪ সালে সারায়েভোতে ল্যাটিন ব্রিজের পাশে অস্ট্রিয়ান রাজকুমারের ওপরে যে গুলি বর্ষিত হয় সেটি ছিল স্লাভিক স্বায়ত্ত শাসনের দাবির বজ্র নির্ঘোষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে পোল্যান্ড নামক দেশটির পুনরাবির্ভাব হল, ক্রোয়াট ও স্লোভেনদের আপন দেশ (পরবর্তী কালে ইউগোস্লাভিয়া– দক্ষিণ স্লাভ), চেক এবং স্লোভাকদের দেশ-চেকোস্লোভাকিয়া। যিশুর ভজনা সকলেই করেন, তবে কেউ ক্যাথলিক, কেউ প্রটেস্টান্ট বাকিরা অর্থোডক্স, বসনিয়াতে মুসলিম–ইহুদিদের সঙ্গে তেমন বিরোধ নেই। বুলগারিয়া, সার্বিয়া সিরিলিক অক্ষরে লেখে। ভাষার দিকে দিয়ে স্লাভ জাতি প্রায় অভিন্ন এবং ইন্দো ইউরোপীয় গোষ্ঠীর সদস্য। শয়ে শয়ে শব্দ আছে যাদের আপনি আমি খুব চিনি–পোলিশে পিঞ্চ মানে পাঁচ, রাশিয়ানে নিঝনি মানে নিচু, নভ নব, নতুন, গরদ গড় : নিঝনি নভ গরদ, নিচু নতুন নগর। চেক ভাষায় দেন আমাদের দিন, সারবো ক্রোয়াটে চিচা মানে কাকা।হাবসবুরগ রাজবংশের পতনের আগে অবধি দক্ষিণ ও পশ্চিম স্লাভিক দেশগুলি ছিল ভিয়েনার অধীনে। বিশাল সাম্রাজ্য হারিয়ে অস্ট্রিয়া আজ এক কোটিরও কম মানুষের ছোট্ট দেশ। তবে পুরনো সাম্রাজ্যের রেশ দেখা যায় সর্বত্র। ভিয়েনা শোয়েখাট বিমান বন্দরে প্লেন নামার ঠিক আগে জানলার বাইরে একটি আলোকিত শহর দেখছিলাম কৌতূহলের সঙ্গে-অস্ট্রিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান বালিকা আমাকে বললেন, ওটা ভিয়েনার নয়, ব্রাতিস্লাভার আলো! এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ভিয়েনা মুখো অটোবানে গাড়ি চালালে পরের পর সাইনবোর্ড চোখে পড়ে-এই দিকে প্রাগ (চেক) ব্রাতিস্লাভা (স্লোভাকিয়া) ওই রাস্তায় বুদাপেস্ট (হাঙ্গেরি) লুবলিয়ানা (স্লোভেনিয়া), জাগ্রেব (ক্রোয়েশিয়া )। সাম্রাজ্যের স্মৃতি।হাবসবুরগ রাজবংশের পতনের পরে এবং দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝে আগে অবধি স্লাভিক দেশগুলির অবস্থান ছিল বারুদের গাদায়। জার্মানি দখল করল চেক, পোল্যান্ড। তারপর একদিন অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটাল বৃহত্তম স্লাভিক দেশের পানে-সে ঘোড়া ফিরল মৃতপ্রায় হয়ে।পাঁচ বছরের জন্যে নাৎসি প্ররোচনায় স্লোভাকিয়া নামের দেশটি দেখা দিয়েছিল (১৯৩৯-১৯৪৫), পরে সেটি চেকের সঙ্গে মিশে যায়। ব্রাতিস্লাভা (স্লোভাক প্রেশপরক, হাঙ্গেরিয়ান পঝনি, জার্মান প্রেসবুরগ) নামের শহর কোনদিন ছিলো না ইতিহাস বা ভূগোলে। নদীর আরেকটু উজানে বুদা শহর তুর্কি কামানের গোলা গুলির রেঞ্জে পড়ে; অটোমান আক্রমণ থেকে রাজন্যবর্গ ও পারিষদদের প্রাণ বাঁচাতে বুদা হতে রাজধানী এই পঝনি শহরে স্থানান্তরিত হয়, সেটি তখন সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর। অন্তত এক ডজন হাঙ্গেরিয়ান রাজার করোনেশান হয়েছে এখানকার গির্জেয়, আপামর জনসাধারণ হাঙ্গেরিয়ান বলেন। ১৮৬৭ সালে অস্ট্রিয়ান হাবসবুরগ সাম্রাজ্যের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্মিলনের (পারসোনাল ইউনিয়ন) পরে এই অঞ্চল সরাসরি ভিয়েনা থেকে শাসিত, দলে দলে জার্মান ভাষা-ভাষী ভিড় করলেন, অচিরেই তাঁদের সংখ্যা হাঙ্গেরিয়ানদের ছাড়িয়ে যায়; হাঙ্গেরিয়ান পজনি পরিচিত হলো জার্মান প্রেসবুরগ নামে: প্যারিসে আর্ক দে ত্রিউম্ফকে ঘিরে যে বৃত্তাকার পথ আছে তার উত্তর ভাগের নাম রু দে টিলসিট, দক্ষিণ অংশের নাম রু দে প্রেসবুরগ! প্লাস দে লা কনকর্ড হতে শঁজে লিজে যেতে বাঁ হাতে পড়ে ; গত সপ্তাহে সে পথে গাড়ি চালাতে গিয়ে আবার লক্ষ করেছি।১৯১৮ সালের আগে স্লোভাকিয়া নামের কোন দেশ ছিল না। নিজ বাসভূমে পরবাসীর তুল্য স্লোভাকের সংখ্যা দশ শতাংশের কম। উত্তর অংশ হাঙ্গেরিয়ান, দক্ষিণ হাবসবুরগ/জার্মান; মাতৃ ভাষাটা বলেন সন্তর্পণে আপন গৃহকোণে, দুটি একটি ছোটো গির্জে বাদে রবিবারের ভজনা হয় জার্মান ও হাঙ্গেরিয়ানে, স্লোভাক ভাষায় পাঠাভ্যাস সীমিত।তারপর একদিন অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান রাজপাটের পতন হলো; দেশের নাম হল স্লোভাকিয়া, শহরের নাম ব্রাতিস্লাভা (আক্ষরিক অর্থে ভ্রাতৃ গৌরব) - পাশা উলটে গেলে প্রেসবুরগের জার্মান জনতা পশ্চিমে ভিয়েনা মুখে পাড়ি দিলেন, পঝনির হাঙ্গেরিয়ান মানুষ পূব পানে বিশ কিলো মিটার হেঁটে হাঙ্গেরি পৌঁছুলেন প্রায় রাতারাতি। মধ্য ইউরোপে ছিন্নমূল জন যাত্রার ইতিহাস গাঢ় বেদনার, অতি দীর্ঘ।চেক এবং স্লোভাক ভাষায় পার্থক্য যে কোথায় বোঝা শক্ত। কিছু শব্দ ও উচ্চারণের ব্যবধান বাদে প্রায় একই-ডাচ আর ফ্লেমিশ ভাষার মতো। অস্ট্রিয়ান, সুইস আর জার্মানির জার্মান ভাষার পার্থক্য তার চেয়ে অনেক বেশি: স্লোভাক বর্ণ মালায় অবশ্য ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অক্ষরের সম্ভার (৪৬)। ধর্ম এক-কাগজে কলমে ক্যাথলিক, যদিও তুলনামূলক ভাবে চেকের চেয়ে বেশি সংখ্যক স্লোভাক রবিবারে গির্জেয় হাজরে দেন। ব্রাতিস্লাভায় আজ নব্বুই শতাংশ স্লোভাক, পাঁচ শতাংশ হাঙ্গেরিয়ান, কিছু চেক এবং অনেক খুঁজলে হয়তো দশটা জার্মান ভাষী পরিবার পাওয়া যাবে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে যুদ্ধ শেষে আবার চেকোস্লোভাকিয়া। তবে এবারে সোভিয়েত প্রভাবিত অঞ্চল, পতাকায় কাস্তে হাতুড়ি। বছর চল্লিশেক বাদে বার্লিন দেওয়াল পতনের পরে এলো ভেলভেট বিপ্লব-রাশিয়ানরা পশ্চাদপসরণ করলেন, পতাকার রঙ বদলাল, ভোটের কাগজে নানা দলের নাম দেখা গেল। কয়েক বছর না ঘুরতে চেক ও স্লোভাক কোন লড়াই ঝগড়া নয়, ভদ্রভাবে বার্তালাপ করে দেশের সীমানা আলাদা করে নিলেন (আশ্চর্যভাবে সেটা মিলে যায় ১৯৩৯ সালের সীমা রেখার সঙ্গে!) যা আজ মখমল বিচ্ছেদ (ভেলভেট ডিভোর্স) নামে পরিচিত।উত্তর হাঙ্গেরি আর দক্ষিণের হাবসবুরগ জমিদারি মিলিয়ে নতুন দেশ স্লোভাকিয়া, রাজধানীর নতুন নাম ব্রাতিস্লাভা (আক্ষরিক অর্থে ভ্রাতৃ গৌরব)। ব্রাতিস্লাভা দুর্গ থেকে দেখা, দানিউবের ওপারে সোভিয়েত স্থাপত্য দানিউবের (জার্মান ডোনাউ, স্লোভাকে দুনাই, হাঙ্গেরিয়ানে দুনা) উজানে ডাইনে পুরনো শহর, বাঁয়ে সোভিয়েত স্থাপত্যের কংক্রিট স্মৃতি বিজড়িত আবাস। সেই সোভিয়েত অঞ্চলে দেশলাই বাকসোর মতন একটি বহুতল অট্টালিকার তিন তলায় সিটি ব্যাঙ্কের অফিস; লিফট এতো বাজে ও ঢিমে তালে চলে, আমরা হেঁটেই উঠতাম। এর চেয়ে সস্তার কিছু হয়তো আমাদের জোটে নি! অপরূপ পুরনো শহরে (স্তারে মেসতো) মিটিং সেরে অফিস ফেরার সময়ে সিটি ব্যাঙ্কের প্রপার্টি ম্যানেজারের শাপ শাপান্ত করেছি! আর কিছু পেলেন না?ব্রাতিস্লাভা ইউনিভারসিটিতে বিজনেস এবং কমার্স পাঠ শেষে তরুণ মারেক পটোমা আমাদের ব্যাঙ্কে ট্রেড ফাইনান্স দফতরে যোগ দিয়েছে। স্কুলে পড়ার সময়ে কমিনিজমের সূর্যাস্ত তার দেখা। পশ্চিম থেকে আমরা যে কি মহতী বাণী বয়ে নিয়ে এলাম সেটা বোঝার চেষ্টা করে। মারেকের চোখে মুখে শিশু সুলভ কৌতূহল, ব্রাতিস্লাভা ক্লাসরুমের জানা ট্রেড ফাইনান্সের সঙ্গে ৩৯৯ পার্ক এভিনিউতে লেখা সিটি ব্যাঙ্কের সংবিধানের সঙ্গে কাজকর্ম মেলাতে হিমসিম খায়। তাই তার প্রশ্নের শেষ নেই – এটা এরকম ওটা আমরা করি কেন (এখনও আমার বাগাড়ম্বর মনে রেখেছে, সম্প্রতি ইমেল পেলাম তার)। চমৎকার দিন। আমরা দুজন দানিউবের ব্রিজের ওপরে নানান গল্প করতে করতে দেশলাই বাকসোরূপ অফিসের পথে হাঁটছি, পায়ের তলায় নীল নদী–ব্লু দানিউব! আহা, এই তো সুদিন, এমনি দিন! পুরাতনকে বিসর্জন দিয়ে সিমেন্ট ও পাথরের এক নবীন অরণ্য তৈরির সোভিয়েত প্ল্যান থেকে কোনক্রমে রক্ষা পেয়ে আজও জেগে আছে ব্রাতিস্লাভার পুরনো শহর, স্তারে মেসতো। অন্যদিকে কমিউনিস্ট যুগের শিল্পকলা। দিন এবং দৃশ্যটা পরিষ্কার মনে পড়ে। সামনে পুরোনো ব্রাতিস্লাভা, পিছনে কংক্রিটের জঙ্গল মারেককে জিজ্ঞেস করেছিলাম আচ্ছা, তোমরা চেক থেকে আলাদা হলে কেন? মারেক বলেছিল বিভিন্ন লোককে প্রশ্ন করলে বিভিন্ন জবাব পাবে। তবে আমার কাছে একটা নিতান্ত সহজ ব্যাখ্যা আছে।-  সেটা কি?-  আইস হকি।ভারতে ক্রিকেটকে ধর্ম এবং শ্রীমৎ তেন্দুলকারকে ঈশ্বর বলে দাবী করা হয় বলে শুনেছি–যেমন লিথুয়ানিয়াতে বাস্কেট বল। আইস হকির ষাট মিটার লম্বা তিরিশ মিটার চওড়া ছোট্ট ময়দানে নিয়মিত ভাগ দৌড় করে থাকে বহু দেশ, যাদের মধ্যে হয়তো সুইডেন বনাম ফিনল্যান্ড, ফিনল্যান্ড বনাম রাশিয়া, কানাডা বনাম আমেরিকার তীব্র রেষারেষির কথা সকলেই জানেন; সেই একই ধুন্দুমার কাণ্ড যে চেক এবং স্লোভাকিয়ার আইস হকির মাঠেও চলে সেটা আমার ঠিক জানা ছিল না। কিন্তু সেটা দেশ ভাগের কারণ কি করে হতে পারে?মারেক বললে, তাহলে শোনো, চেকোস্লোভাক আইস হকি দলে একজনের বেশি স্লোভাক কখনো জায়গা পেতো না। চেকের জন সংখ্যা আমাদের ডবল, প্লেয়ারের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। তাদের খেলোয়াড়রা পয়লা সুযোগ পাবে-যত ভালোই খেলুক না কেন, স্লোভাকদের কপালে কষ্টে সৃষ্টে জুটবে একটা পজিশন। আমি স্কুলে, বিশ্ব বিদ্যালয়ে আইস হকি খেলেছি। ভেবেছি আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত। তাহলে আমাদের আইস হকি টিম হবে ছ জন স্লোভাককে নিয়ে!যুক্তিটাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না হয়তো। যে দেশে বাস করি, সেই যুক্তরাজ্যে খেলার মাঠ নিতান্ত বিযুক্ত-দেশের জাতীয় পতাকা এক হলেও ফুটবল খেলে চারটে আলাদা দেশ: ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস, উত্তর আয়ারল্যান্ড; ক্রিকেট খেলে তিনটে দেশ; একটি বিচিত্র কারণে রাগবি খেলার সময়ে দুই আয়ারল্যান্ড এক সঙ্গে মাঠে নামে, ব্রিটিশ লায়ন্স রাগবি টিম আবার এই চারটে দেশের সংমিশ্রণ! অ্যান্ডি মারে টেনিস ম্যাচে জিতলে তাকে ইংরেজ মাথায় তোলে, হেরে গেলে স্কটিশ বলে হেনস্থা করে। ভারতীয় ক্রিকেট দলে বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে প্রতিবাদী সুর শুনেছি আমাদের বাল্যকালে-পঙ্কজ রায় এবং সৌরভ গাঙ্গুলির মধ্যবর্তী কালে কোন বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটে স্থান পান নি (অম্বর রায় ও সুব্রত গুহের চারটি করে টেস্ট ম্যাচ খেলা বাদে) বলে আমরা ক্ষুদ্ধ হয়েছি। আমার চেনা ত্রিনিদাদের ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরিচিত জনেরা অভিযোগ করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল নির্বাচনে ত্রিনিদাদ টোবেগো নাকি মোটেও সুবিচার পায় না। শোনা যায় সেই আক্রোশে পোর্ট অফ স্পেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম ভারতের টেস্ট ম্যাচে স্থানীয় জনতা ভারতীয় দলকে সমর্থন করে থাকে। ড্যারেন গঙ্গা, নিকলাস পুরাণ, সুনীল নারায়ণের নাম উল্লেখ করলে তারা বলে, হ্যাঁ, ওই কটাই! কতজন যে সুযোগ পায় নি।কিন্তু তাই বলে দেশ ভাগ?নতুন রাষ্ট্র গড়ার দশ বছরের মধ্যে বিশ্ব আইস হকি প্রতিযোগিতায় (২০০২) তৎকালে দুনিয়ার অন্যতম সেরা দুই টিম কানাডা ও সুইডেনকে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছায় এবং সেখানে রাশিয়াকে হারিয়ে সোনা জেতে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের ছোট্ট দেশ স্লোভাকিয়া। মারেক পটোমা এখন দুবাইতে সিটি ব্যাঙ্কের উচ্চপদে আসীন। তাকে সেদিন মনে করিয়ে দিলাম-স্লোভাকিয়া বিশ্ব আইস হকি কাপ জিতলে সে এক লাইনের ইমেল পাঠিয়েছিল। এই কি স্বপ্নরাজ্য? (ইজ দিস ড্রিমল্যান্ড) ব্রাতিস্লাভায় সিটিব্যাঙ্কের দেশলাই বাক্স সদৃশ অফিস *আমাদের (প্রাশিয়ান) অস্তিত্ব বজায় রাখতে হলে পোলিশ জাতিকে সমূলে উচ্ছেদ করতে হবে – অটো ফন বিসমার্কWenn wir bestehn wollen, nichts andres tun, als sie (Polen) ausrotten- Otto von Bismarck ক্রমশ...
  • হরিদাস পালেরা...
    মুক্ত বন্দীশালায় কিছুক্ষণ - সমরেশ মুখার্জী | কেল্লায় দেখা অভয়ের সাথেসূরজনগর শহর থেকে দুরে একান্তে তার অবস্থান। প্রচারের অভাব। এসব কারণেই হয়তো দু পাশে নদী বেষ্টিত অনুচ্চ লম্বাটে টিলার ওপর দ্বাদশ শতাব্দী‌র এই পেল্লায় কেল্লায় পর্যটক সমাগম খুব কম। জানুয়ারি‌র এক আমুদে শীতের সকালে গিয়ে সেখানে ঘন্টা পাঁচেক কাটিয়েছি‌লাম। সেদিন কোনো দূরাগত পর্যটক দেখিনি। কয়েকটি অল্পবয়সী স্থানীয় ছেলে এসেছি‌ল। আমার মতো ধীর লয়ে কেল্লার সবদিকে হেঁটে, সৌধের ভেতরে ঢুকে, আনাচে কানাচে ঘুরে, ছাদে উঠে চারদিক দেখে, কোথাও খানিক চুপ করে বসে, কিছুক্ষণ একজায়গায় প্লাস্টিক বিছিয়ে শুয়ে - সর্বতোভাবে এই প্রাচীন নির্জন কেল্লার ঝিমঝিমে মৌতাত সত্তায় শুষে নিতে তারা আসেনি। হয়তো আগেও এসেছে তারা। তাই কলবল করে দ্রুত পায়ে এদিক ওদিক খানিক ঘুরে জনা ছয়েকের সেই দলটি চলে যেতেই সেই বিশাল কেল্লা আবার ডুবে গেল নিঝুম স্তব্ধতা‌য়।চুপ করে একটি পাথরের বেঞ্চে বসে তাকিয়ে ছিলাম দুরে, নীচে নদীর দিকে। এমন শান্ত দৃশ‍্যে মন শান্তি‌তে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। মগ্ন‌তা ক্ষুন্ন হয় পিছন থেকে আসা প্রশ্নে: - বাবুজী, ওদিকে আর কিছু দেখা‌র আছে?একটি স্থানীয় লোক। ভুবন সোম সিনেমায় শেখর চ‍্যাটার্জী রাজস্থানী স্টাইলে সাদা কুর্তা, পাজামা, পাগড়ি পরা এক গাড়োয়ানের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এ লোকটি‌র‌ও প্রায় তেমন‌ই পোষাক। ক্ষীণকায় চেহারা। বয়স পঞ্চাশের নীচে‌ই হবে হয়তো। সাথে একটি বছর সতেরোর ছেলে।  - হ‍্যাঁ আছে তো, বড়া বুরুজ - ওটা দেখার মতো জায়গা।- আপনি দেখে এসেছে‌ন?- না, একটু বাদে যাবো। ওটাই কেল্লার শেষ প্রান্ত। এই যে নদী‌টা দেখছেন - কেল্লার বাঁদিক থেকে এসে নদী‌টা ওখানে কেল্লা‌কে বেড় দিয়ে চলে গেছে ডানদিকে। খুব সুন্দর দৃশ‍্য - দেখে আসুন, ভালো লাগবে।- আপনি তো এখনো ওদিকে যান নি বললেন, কী করে জানলেন?মৃদু হেসে বলি - দুর থেকে বেড়াতে আসি এসব জায়গায়, তাই আসার আগে ম‍্যাপে একটু দেখে নি।- আপনি কোথা থেকে আসছেন?- কলকাতা।- ক ল কা ত্তা! শুনা হ‍্যায় বহুত দুর - বংগাল মূলক মে - অতো দুর থেকে এসেছে‌ন এই  কেল্লা দেখতে! - হ‍্যাঁ, আর আপনি? সঙ্গে‌র ছেলেটি কে?- আমি তো থাকি সূরজনগরে‌ই। এ আমার ছেলে, চন্দ্রপুর গাঁও থেকে কদিনের জন‍্য বেড়াতে এসেছে আমার কাছে। ওকে এই কেল্লা দেখাতে‌ই এসেছি এখানে। আচ্ছা, বাবুজী, সুক্রিয়া, চল নির্মল, চলতে হ‍্যয় উধর - বলে লোকটি চলে যায়।আমি তাকিয়ে থাকি ওদের যাওয়া‌র দিকে। লোকটি‌র মুখের ফিচার একটু অন‍্যরকম - লম্বা‌টে মুখে চোখে পড়ার মতো দীর্ঘ চিবুক - চোখ দুটি‌ সবাক। অল্পবয়সী ছেলেটি বয়স অনুপাতে অত‍্যন্ত গম্ভীর। গাঁও থেকে বাবার কাছে বেড়াতে এসেছে। তার মানে হয়তো তার বাবা সূরজনগরেই কোথাও কাজ করে - তাই চন্দ্রপুর গাঁয়ের বাড়ি, পরিবার ছেড়ে এখানে থাকে। মুক্ত বন্দী‌শালাসেবার একাকী ভ্রমণপথে রাজস্থানের রতনপুর গিয়ে কদিন ছিলাম। সূরজনগর থেকে আরো দশ কিমি দুরে রতনপুর। সেদিন কেল্লা দেখে সন্ধ্যায় ফিরে গেছি‌লাম রতনপুর। পরদিন আবার গেছি সূরজনগর। এদিন শহরের মধ‍্যে একটি প্রাচীন প‍্যালেস, তার মধ‍্যে সংগ্ৰহালয় এই সব দেখার ইচ্ছা। সূরজনগর বাসস্ট্যান্ডে নেমে এপাশ ওপাশ দেখতে দেখতে প্রাচীন শহরের পথ ধরে যাচ্ছি। - বাবুজী! আপ ইধর? একটি হলুদ দোতলা বাড়ি। দেওয়ালে চার জায়গায় ছাদ থেকে বৃষ্টি‌র জল নামার কালচে ছোপ। সামনে বড় টানা উঠোন। পাঁচিলে লোহার মেন গেটে তালা। পাশে লোক চলাচলের ছোট অর্ধবৃত্তাকার গেট খোলা। ওখানে দাঁড়িয়ে‌ই হাঁক দিয়েছে গতকাল কেল্লায় দেখা লোকটি। বাড়ি‌র দেওয়ালে ও পাঁচিলে একটি আয়তক্ষেত্র লাল/নীল ত্রিভুজে বিভক্ত। পুলিশের চিহ্ন। তাতে সাদা অক্ষরে লেখা “মুক্ত বন্দীশালা - সূরজনগর”। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ছবিতে দুটি জায়গা‌তেই লাল মাস্কিং করে দিয়েছি।  - আরে! আপনি? এখানে?- আমি তো চার বছর ধরে এখানেই আছি।- এই মুক্ত বন্দী‌শালায়! তার মানে? আপনি কি মুক্ত না বন্দী? গতকাল কেল্লা‌য় ঘুরে বেড়াচ্ছি‌লেন যে!আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে‌ই কথা বলছি‌লাম। লোকটি বলে,- বাবুজী আপনার তাড়া না থাকলে, আসুন না ভিতরে, একটু গপসপ করা যাক।আমার তো এমন কিছু অভিজ্ঞতা সেবনের জন‍্য মন প্রাণ উন্মুখ হয়ে‌ই থাকে। পত্রপাঠ চলে যাই ভিতরে। তারপর যে বাস্তব জীবননাট‍্যর মুখবন্ধ দেখলাম, প্রাচীন সংগ্ৰহালয় দেখা‌র তুলনায় তা‌ও কম আকর্ষণীয় নয়।জানলুম তার নাম - অভয় রাজ গুর্জর। ওটি বাস্তবিক একটি মুক্ত বন্দী‌শালা বা Open Prison. অভয়ের সাথে কথা বলে জানলাম ওটা রেগুলার প্রিজন নয়। ওখানে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বন্দী‌ই আছেন। তাদের সবার ক্ষেত্রে কয়েকটি ব‍্যাপার প্রায় এক‌ই রকম:১. তারা সকলেই নরহত্যা‌র অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত।২. কেউ‌ই টাকাপয়সার জন‍্য, পরিকল্পনা করে, নৃশংসভাবে বা বহু খুন করেনি। অর্থাৎ তারা কেউ‌ই পেশাদার খুনি নয়। একটা‌ই খুন করে ফেলেছে দীর্ঘদিনের ছাইচাপা বঞ্চনা, রাগ বা হতাশার তাড়নায় আকস্মিক উত্তেজনার বশে। তাদের মধ‍্যে কেউ খুন করে পালিয়ে যায়নি। হয় থানায় আত্মসমর্পণ করেছে বা ধরা পড়ে আদালতে অপরাধ স্বীকার করেছে। তার ফলে অবশ‍্য তাদের অপরাধ মাফ হয়নি। দফা ৩০২ মাফ করার মতো গুনাহ নয়। কিন্তু তাদের অপরাধ Rarest of the rare crime বলেও গণ‍্য হয়নি। তাই তাদের মৃত‍্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হয়েছে।৩. তাদের সবার কারাবাস‌কালে আচরণ ছিল শান্ত, ভদ্র। সশ্রম কারাদণ্ড বলে, যা কাজ করতে বলা হয়েছে মন দিয়ে করেছে। জেলের মধ‍্যে কখনো কোনো উটকো ঝামেলায় জড়ায় নি। ক্ষণিকের উত্তেজনা‌য় নরহত্যা‌র মতো মারাত্মক অপরাধ করে ফেলে তাদের অনেকের মধ‍্যে পরে দেখা গেছে অনুশোচনা। ৪. ১০ বছর জেলে কাটানোর পর এদের সবাই সরকারের কাছে ক্ষমাভিক্ষার আবেদন করেছে। আবেদন করলে‌ই মঞ্জুর হবে তার কোনো মানে নেই। তবে এদের ক্ষেত্রে মঞ্জুর হ‌ওয়া‌তেই পুরোদস্তুর জেল থেকে এরা এই মুক্ত বন্দী‌শালায় স্থানান্তরিত হয়েছে। পুরোপুরি মুক্তি পাওয়ার আগে এখানে‌ও তাদের চার পাঁচ বছর থাকতে হবে। দেখা হবে তাদের সাজা মাফ করে দেওয়া যায় কিনা। এসব সময়সাপেক্ষ ব‍্যাপার। আদর্শ কারাগারনীতি‌গতভাবে বিচারব্যবস্থা‌র উদ্দেশ্য শাস্তি যেন অপরাধের সমানুপাতিক হয়। তেমনি কারাগারে‌র উদ্দেশ্য‌ও হ‌ওয়া উচিত অপরাধীর চিত্তশুদ্ধি করে তাকে পরিবার ও সমাজের মূল স্রোতে ফেরৎ পাঠানো। কিছু ব‍্যতিক্রমী পরিস্থিতি ছাড়া তাকে আমৃত্যু বন্দী করে রাখাটা সরকারের উদ্দেশ্য হ‌ওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্র কর্তৃক অপরাধীর স্বাধীনতা হরণ‌ই যথেষ্ট শাস্তি। তার ওপর নানা উপায়ে কারাগার যেন শাস্তি‌প্রদাণের উপায় না হয়ে দাঁড়ায়। বরং সেটি হ‌ওয়া উচিত সংশোধনাগার। মেয়াদ অন্তে মুক্তি পেয়ে সে তার অভিজ্ঞতা অন‍্যদের সাথে ভাগ করলে তারা হয়তো উপলব্ধি করতে পারে যে প্রিয়জনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, স্বাধীন‌ভাবে চলাফেরার অধিকার হারিয়ে দীর্ঘ বন্দীজীবন কাটানোর যন্ত্রণা। হয়তো তার অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অন‍্যেরা এমন অপরাধ করার আগে দুবার ভাববে, সংযত হতে পারে। তবে এমন আশাবাদী ভাবনা বাস্তবায়িত নাও হতে পারে। কারণ কিছু মানুষ অন‍্যের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সংযত আচরণ করে। কেউ ঠেকে শেখে। তবে অধিকাংশ মানুষ পরিচিতজনের বা নিজের - কারুর ভুল থেকেই শেখে না। তাই সমাজে এক‌ই ভুলের পুনরাবৃত্তি হয়ে চলে। সাধারণ মানুষের নরহত্যা‌র মতো অপরাধ করে ফেলা‌র ক্ষেত্রে বড় কারণ দীর্ঘ‌দিনের অবরুদ্ধ আবেগের তাৎক্ষণিক উত্তেজনা। তা ভেবে চিন্তে হয় না। তাই ক্ষণিকের গুরুতর অপরাধে‌ও তাকে আমৃত্যু জেলে আটকে রাখা উচিত নয়। মাঝে প‍্যারোলে কদিন ছাড়া পেয়ে পালিয়ে না গেলে বা ছাড়া পেয়ে আবার অপরাধ না করলে বেশ কিছু বছর বন্দী‌জীবন কাটানোর পর তাদের মুক্তি দেওয়া যেতে‌ই পারে। পৃথিবীর কিছু দেশে কারাবন্দী‌দের দাম্পত্য সাক্ষাৎ‌কারের (conjugal visit) ব‍্যবস্থা আছে। দীর্ঘ কারাবাসে দণ্ডিত অপরাধীরা নির্দিষ্ট সময় অন্তর তাদের আইনত স্ত্রী বা স্বামী‌র সাথে দুই থেকে তিন দিনের জন‍্য (কোথাও আবার এক সপ্তাহ অবধি) একান্তে মিলিত হতে পারে। তার জন‍্য জেলের মধ‍্যে‌ বা বাইরে আছে নির্ধারিত ঘর। দুজনের জন‍্য সেখানে থাকবে ছোট কিচেন ও রেশন যাতে তারা নিজেরাই কিছু বানিয়ে খেতে পারে। ফলে ঐ কদিন খাবার দেওয়ার কর্মচারী‌ও তাদের প্রাইভেসি‌ ডিসটার্ব করবে না। ঘরে থাকবে পরিপাটি বিছানা, চাদর, তোয়ালে, সাবান, লুব্রিকেন্ট এবং অবশ্যই কনডোম। শেষোক্ত বস্তু দুটি মিলিত হতে আসা সঙ্গী বা সঙ্গিনী‌ও তাদের পছন্দ মতো আনতে পারে। মেক্সিকো, কানাডা, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্কের মতো দেশ - যেখানে মানুষের কিছু মৌলিক মানবাধিকার স্বীকার ও সম্মান করা হয় - সেখানে বিবাহিত বন্দীর এটি মৌলিক অধিকার। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায় সমগ্ৰ  দেশে না হলেও কিছু প্রদেশে তা অনুমোদিত। আবার ইউকে, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, জাপানের মতো দেশে বন্দী‌দের দাম্পত্য সাক্ষাৎ‌কার অনুমোদিত নয়। তাদের ধারণা যখন কেউ অপরাধ করে জেলে আসে সে বাকি নাগরিকদের মতো মৌলিক অধিকার হারায়।বিপজ্জনক অপরাধীর কথা আলাদাতবে অপরাধী মানসিকতা‌র (Criminal mindset), স্বভাব অপরাধী (Habitual offender) বা অপরিণামদর্শী প্রতিক্রিয়া‌প্রবণ অপরাধীরা (Highly impulsive, psychotic mentality) এবং যাদের মনে অনুশোচনা‌র (Remorseful) কোনো ভাবনা‌ই আসে না তারা সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক। এমন অপরাধীদের ক্ষেত্রে আজীবন কারাবাস‌ই প্রযোজ্য। তিনটি উদাহরণ নেওয়া যাক।(ক্রমশ)
    ফারাও-এর দেশে কয়েকদিন - অন্তিম পর্ব - সুদীপ্ত | ফেরার পথে আজ আমাদের মধ্যাহ্নভোজ হল একটি ভারতীয় রেস্তোঁরায়, নাম হল ‘A Taste of India’। ভারতীয় বলছি বটে, তবে ইজিপ্সিয়ান খাবারের রেশই তাতে বেশী, তাতে আমাদের দুজনের অবশ্য পোয়াবারো। ‘সানেয়া সেমাক’ নামে এক ধরণের ইজিপ্সিয়ান পদ্ধতিতে তৈরী বেকড ফিশ খেলাম এখানে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমাদের ঐতিহাসিক মিশরের পাট চুকিয়ে রওনা দিলাম খানিক আধুনিক মিশরের দিকে, হুরগাদা শহরে, লোহিত সাগরের তীরে। সেখানেই আমরা একটা দিন সমুদ্রের তীরে কাটিয়ে দেশের পথ ধরব। হুরগাদাতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা রিসর্ট মারকিওর হুরগাদা-তে, এখানে আমরা এসে পৌঁছলাম প্রায় সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার দিকে। মাঝে একবার কফি ব্রেক রাখা হয়েছিল রাস্তায়। বিরাট এলাকা জুড়ে এই রিসর্ট, নিজস্ব একটি সমুদ্রতট-সহ। রিসেপশনে ঘর নির্দিষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আমাদের সকলের হাতে একটি ব্যান্ড বেঁধে দেওয়া হল, এটি দেখালেই রিসর্টের চত্বরে যত্র-তত্র ঘুরে বেড়ানো যাবে, স্ন্যাক্স কাউন্টার আর বার-এ খাদ্য-পানীয় মিলবে। পানীয় অবশ্য প্রতিদিন যে কোনো একটি বিনামূল্যে, তার পরে নিজস্ব খরচে। রিসেপশন পেরিয়ে কিছু স্যুভেনির-এর দোকান, তারপর একদিকে স্ন্যাক্স কাউন্টার-কাম-বার আর একদিকে ড্যান্স-ফ্লোর। আরও খানিক এগিয়ে বিরাটাকার দুটি সুইমিং পুল, আর তার ওপারেই লোহিত সাগর। বাঁপাশে একটি বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে রেস্তোঁরা, এলাহি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা, আর দুদিকে ছোটো ছোটো সুন্দর কটেজ-এর সারি। প্রতি কটেজেই তিন-চারটি করে ঘর। দেখেই আমাদের ভালো লেগে গেল। ঘর থেকে জানলা খুলে সামনেই সমুদ্র, যদিও জল তার এতই শান্ত যে ওপারে দিগন্তের বিস্তার না থাকলে জলাশয় বলে ভুল হয়! আমেরিকাতে যেমন সাধারণ হ্রদের ধারে বীচ বানিয়ে রাখে লোকে, এ যেন ঠিক তেমন! ঢেউ তো এক ছিটে-ফোঁটাও নেই। আমাদের ব্যাগ পৌঁছে দেওয়া হল সকলের ঘরে ঘরে। আজ বাকি সময়টুকু বিশ্রাম, আমরা খাওয়া দাওয়া সেরে সোজা চলে গেলাম হোটেলের লাগোয়া বীচ-এ; সমুদ্রের জলে চাঁদের আলো পড়ে মায়াবী হয়ে উঠেছে। ঠান্ডা ভালোই রয়েছে, যার ফলে আমরা দুজন ছাড়া আশেপাশে জনমানুষ নেই। শান্ত সমুদ্রে বহুদূরে একটি-দুটি জাহাজের আলো। মেঘমুক্তো আকাশে একমুঠো মুক্তদানা ছড়িয়ে দিয়েছে কেউ। চোখ সয়ে গেলে আবছা আলোয় অর্ধচন্দ্রাকার বালুতট স্পষ্ট  হয়ে ওঠে। একপাশে সারি দিয়ে লাগানো বেতের ছাতা, তার নীচে পাতা আরামকেদারা কিছু। এখানেই খানিক বসে এই নিস্তব্ধতা-কে উপভোগ করি। শান্ত সমুদ্রের জল তীরে এসে মৃদু ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তোলে শুধু। গত সাতদিন ধরে প্রাচীন সভ্যতার যে বিপুল ঐশ্বর্য দেখলাম তারই স্মৃতি রোমন্থন করি। রাতে ঘরে ফিরেও তার রেশ যেন কাটতে চায় না!  সকাল  আটটায় প্রাতঃরাশ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম লোহিত সাগরের রোমাঞ্চকর ভ্রমণে। ভূগোলে পড়ার আগেও জীবনে প্রথম লোহিত সাগরের কথা জেনেছিলাম টিনটিনের কল্যাণে, ‘লোহিত সাগরের হাঙর’ পড়ার সূত্রে (হ্যাঁ টিনটিনের একটি বই-ও আজ অবধি ইংরাজীতে পড়িনি, পাছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনবদ্য অনুবাদ ধাক্কা খায়, তাই স্নোয়ি আজও কুট্টুস হয়েই থেকে গেছে)। হোটেল থেকে খানিক দূরে একটি বন্দরে গিয়ে আমরা উঠলাম আমাদের জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা ত্রিতল-বিশিষ্ট ইয়াট, ‘মুনলাইট’-এ। ইয়াট একধরণের ছোটো জাহাজ। এর বেসমেন্ট এ রয়েছে আমাদের মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা। এর উপরের তলে সকলের বসার জায়গা, এই অংশটি কাচ দিয়ে ঢাকা। এর উপরের তলে পিছনের দিকে কিছুটা খোলা জায়গায় বসার ব্যবস্থা, আর সামনের দিকে রোদ পোহানোর ব্যবস্থা। ইয়াট-এ ওঠার পর ইয়াটের ক্যাপ্টেন আমাদের বাকি ক্রু-দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে কিছু নির্দেশাবলী জানালেন। আমরা প্রথমেই যাবো স্নর্কেলিং এর জন্য লোইত সাগরের বুকে একটি অঞ্চলে যেখানে কোরালের আধিক্য বেশী। সেখানে গিয়ে দেখলাম আরও দু-তিনটি ইয়াট এসে হাজির হয়েছে স্নর্কেলিং-এর উদ্দেশ্যে। আমরা অবশ্য এখানে স্নর্কেলিং করব না ঠিক করে রেখেছিলাম। এর আগে আন্দামানের নীল আইল্যান্ডে এ-জিনিস করেছিলাম, একজন নুলিয়া খুব যত্ন করে সমুদ্রের গভীরে নিয়ে গিয়ে আমাদের স্নর্কেলিং করিয়েছিলেন। অসাধারণ সব রঙিন কোরাল আর মাছের সমারোহ দেখেছিলাম। এখানেও অবশ্য তিনজন ক্রু  জলে রয়েছেন সবসময়, কিন্তু জল দেখে মনে হয়, এ যেন পুকুরে ডুবসাঁতারে নামা, এত নিস্তরঙ্গ। এই লোহিত সাগরের কোরাল অবশ্য  উপর থেকে ততটা আকর্ষণীয় বলে মনে হল না। যাঁরা স্নর্কেলিং করে এলেন, তাঁরাও মোটামুটি একই কথা বললেন। তবে সে যাই হোক, সাগরের জল এত ঘন নীল, একে লোহিত সাগর বলতে অসুবিধেই হয়।  সমুদ্রবিজ্ঞানীরা বলেন হয়ত কোনো এক সায়ানোব্যাকটিরিয়া-র প্রকোপে আর ক্রিয়াকলাপে কোনো কোনো অংশের জল লাল দেখাত এই সমুদ্রের, সে থেকেই এই নাম। তবে আদতে লোহিত সাগর ভারত মহাসাগরের একটি অংশ আর আশ্চর্যের কথা এই সমুদ্রে কোনো নদী-ই এসে মিলিত হয় নি। এর জলও খুবই লবণাক্ত। স্নর্কেলিং এর জায়গা থেকে এবার আমাদের ইয়াট ছুটে চলল আরও গভীর সমুদ্রে, ডলফিন দেখার উদ্দেশ্যে। প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর দেখতে পাওয়া গেল একটি ঝাঁকের, কাতারে কাতারে ডলফিন তরতরিয়ে জল কেটে ছুটে চলেছে। কখনো লাফিয়ে উঠছে, কখনো ডুব মারছে, কখনো প্রায় ইয়াটের গায়ে এসে সঙ্গে সঙ্গে চলেছে আর মাঝে মধ্যে অদ্ভুত সব শব্দ করছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! বেশ চলছিল এরকম প্রায় আধঘন্টা মতো, হঠাৎ চারপাশ থেকে আরও খানচারেক ইয়াট আর স্পীডবোট ধেয়ে এল পিছনে, ব্যস, দু তিন মিনিটের মধ্যে প্রায় পুরো ডলফিনের ঝাঁকটাই হাওয়া! যাক, সে আর কি করা যাবে, সকলেই দেখতে চায়, আমরা তবু এত লম্বা সময় ধরে ডলফিনের খেলা দেখলাম। এরপর আমরা চললাম আরেকটি গন্তব্যে, মাঝসমুদ্রে ব্যানানা বোটে চড়তে। এই বোট বা নৌকোটি রাবারের তৈরী আর হাওয়া ভরে ফোলানো। দেখতে ঠিক পাকা কলার মতো-ই আর রং-ও হলুদ। উপরে ছয় জন করে বসতে পারে, একটি করে আঙটা লাগানো আছে ধরে থাকার জন্যে। এর সামনে একটি মোটরচালিত বোটে এই ব্যানানা বোট বেঁধে দেওয়া হয় আর দুরন্ত গতিতে মোটরবোট চলতে শুরু করলে এই ব্যানানা বোট-ও কোনোমতে টাল সামলে পাল্লা দিয়ে জল কেটে দৌড়োয়। জলের ফোয়ারা, দুরন্ত গতির সাথে শরীরের ভারসাম্য রাখা আর অসীম সমুদ্রের বুকে ছুটে চলা, একেবারে রোমহর্ষক ব্যাপার বটে। সবাই মিলে খুব উপভোগ করলাম এই রাইড। এরপর ইয়াটেই হলো মধ্যাহ্নভোজ, সামুদ্রিক মাছ, মীটবলস, নুডলস, সব্জী, স্যুপ, বাকলাভা ইত্যাদি। হালকা যন্ত্রসঙ্গীতের তালে তালে খানিক পা মেলানো হল সবাই মিলে, কারণ আজই আমাদের মিশরে শেষ দিন। আগামীকাল কায়রো ফেরা এবং সেখান থেকে সোজা মুম্বই। সামাহ আর সুশান্তের সঙ্গে আমরা কিছু ছবি তুলে রাখলাম স্মৃতি হিসেবে। সামাহ এখান থেকেই বিদায় নেবে কায়রোর উদ্দেশ্যে, অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু উপহার সবাই মিলে তুলে দেওয়া হল সামাহ-র হাতে। বন্দরে ফিরে এসে আমরা কয়েকজন এবার রওনা হবো সাবমেরিন ডাইভের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে। দলের বাকি বন্ধুরা হোটেলে ফিরে গেলেন। আমরা দুটি ছোটো গাড়িতে করে রওনা হলাম আরেকটি বন্দরের উদ্দেশ্যে। পরে এই গাড়িই আমাদের পৌঁছে দেবে হোটেলে। এই সাবমেরিন ডাইভের খরচ আমাদের দুজনের পড়ল প্রায় সাড়ে চার হাজার ইজিপ্সিয়ান পাউন্ড। এই দ্বিতীয় বন্দর থেকে একটি বড় মোটরবোটে চড়ে আমরা চললাম সাবমেরিন প্ল্যাটফর্মের দিকে, যেটি রয়েছে গভীর সমুদ্রে। আমাদের সঙ্গে আরও কিছু বিদেশী পর্যটক যোগ দিলেন। যাত্রা শুরুর আগে আমাদের গলায় পরিয়ে দেওয়া হল সাবমেরিনের নামাঙ্কিত কার্ড, প্রতি কার্ডে আলাদা নম্বর বসানো। আমাদের সাবমেরিনের নাম – সিন্দবাদ। সাবমেরিন প্ল্যাটফর্ম-টি আসলে ভাসমান বলে মনে হলেও নীচের দিকে সম্ভবতঃ কোনোভাবে আটকানো আছে একি স্থানে স্থির রাখার জন্যে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমাদের সামনেই ভুস করে জলের উপর ভেসে উঠল ‘সিন্দবাদ’। আগের পর্যটক-দলকে ফিরিয়ে আনা হল, তাঁরা এক এক করে প্ল্যাটফর্মে উঠে আসতেই আমাদের নামার পালা। এখনও অবধি সাবমেরিনে ঢুকেছি দুটি জায়গায়। একটি বিশাখাপত্তনমের বালুতটে রাখা সাবমেরিন আই এন এস কুরুসুরা, এটি অবশ্য একেবারেই ছোটো; আর একটি সেই আমেরিকার বাফেলো নাভাল পার্কে রাখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত ইউ এস এস ক্রোকার SS-246 – এটি অবশ্য বিশাল মাপের। তবে সত্যি সত্যি সাবমেরিনে উঠে সমুদ্রের গভীরে ডাইভ দেবো সেই ছোটোবেলায় পড়া নটিলাস-এর মতো, এ অবশ্য অনন্য অভিজ্ঞতা! সাবমেরিনের ছোট্ট লোহার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলাম, এটি অবশ্য সত্যিকার যুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত সাবমেরিন নয়, শুধুই পর্যটকদের উদ্দেশ্যে বানানো। ভিতরে একটি লম্বা করিডোর, তার দুপাশে সারি দিয়ে কাচের জানলা আর প্রতিটি জানলার সামনে একজন করে বসার ব্যবস্থা। আর একেবারে সামনে রয়েছেন চালক; সবাই বসার পর সাবমেরিনের উপরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল ল্যাচ ঘুরিয়ে। এরপর টের পেলাম ব্যালাস্ট ট্যাঙ্কে জল ভরে দিয়ে সমুদ্রতল ছেড়ে নীচে নামছে সাবমেরিন, ডাইভ শুরু। প্রায় ৪৫ ফুট নীচে নামার পর সামনের দিকে চলতে শুরু করল। বাইরে দুজন ক্রু ডুবুরীর পোষাক পরে মাছেদের খাবার দিচ্ছে আর প্রতিটি জানলার সামনে সেই মাছের দঙ্গলকে নিয়ে ঘুরছে। বারাকুডা, ইন্দো-প্যাসিফিক সার্জেন্ট, গোল্ড-ব্যান্ড ফিউজিলিয়া, ফাইভ-লাইন কার্ডিনাল এরকম বেশ কিছু মাছ চিহ্নিত করতে পারলাম। আজ্ঞে না, আমি মৎস্য-বিশারদ নই, ওই জানলার পাশেই মাছেদের ছবিসহ তালিকা দেওয়া ছিল, তা থেকেই লোহিত সাগরে বসবাসকারী এই মাছেদের চিনে নেওয়া। এরপর সুন্দর সুন্দর রঙবেরঙের কোরালও দেখলাম বেশ কিছু। তবে কিছু কৃত্রিম জিনিসও রাখা রয়েছে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যে, হাঙরের কঙ্কাল, পুরনো জাহাজের ভাঙা অংশ, নোঙর ইত্যাদি। প্রায় ৪৫ মিনিটের সফর শেষে আবার আমরা ভেসে উঠলাম সমুদ্রপৃষ্ঠে, প্ল্যাটফর্মের গায়ে।  সাবমেরিন ডাইভের অনবদ্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এবার আমরা ফিরে চললাম হোটেলের দিকে।রিসর্টের অলস বিকেলে সমুদ্রতটে সূর্যাস্ত উপভোগ করে, আমাদের দলের অন্য পর্যটকদের সঙ্গে গল্প-গুজব করে কাটিয়ে দিলাম। আজ তাড়াতাড়ি নৈশাহার সেরে বিশ্রাম। পরের দিন ভোরের নৈসর্গিক সূর্যোদয় যেন আমাদের এই সফল মিশর পর্যটনের মধুরেণ সমাপয়েৎ! হুরগাদা বিমানবন্দরে আসার পথে বাসে আমরা সবাই এক এক করে ভাগ করে নিলাম সেই মধুর অভিজ্ঞতা।  কায়রোতে নেমে আমাদের পাঁচ ঘন্টার অপেক্ষা, সুশান্তের ব্যবস্থাপনায় সেখানেই হল মধ্যাহ্নভোজের সুন্দর ব্যবস্থা। কায়রোতে দুটি আধা ভারতীয় রেস্তোঁরা আছে, ‘রেড এলিফ্যান্ট’ আর ‘হোয়াইট এলিফ্যান্ট’;  প্রথম আসার পর আমরা গিয়েছিলাম হোয়াইট এলিফ্যান্টে। আজকের মধ্যাহ্নভোজ প্যাক হয়ে এল ‘রেড এলিফ্যান্ট’ থেকে। কায়রো বিমানবন্দরে বিমানের অপেক্ষায় বসে ভাবছিলাম আমাদের এই পুরো ট্যুরের কথা, ভ্যালি অব দ্য কিংস-এ পুরো একটা দিন কাটালে কি আরও ভালো হত? অথবা দেনদেরা-র হাথোরের মন্দিরটা যদি দেখা যেত, যার নাম এখানে এসেই প্রথম শুনেছি! হ্যাৎসেপশুটের মন্দিরে পুন্ত-এর সঙ্গে বাণিজ্যের ছবি বা রাণীর ফারাও হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার গল্পের ছবি দেখা হল না যে! যেখানেই ভ্রমণে যাই, নিঃশেষে কি কোনো কিছুই দেখা হয়? হয় না তো!  আসলে, মিশর ভ্রমণ তো বটেই, যে কোনো ভ্রমণই যেন দিনের শেষে ছোট গল্পের মতো,“অন্তরে অতৃপ্তি রবে,সাঙ্গ করি মনে হবেশেষ হয়ে হইল না শেষ।”মিশর নিয়ে যা পড়েছিলাম, যা জেনেছিলাম, তা আরও সহস্রগুণে ধরা দিল এই ভ্রমণের সূত্র ধরে, সেকথাই বা অস্বীকার করি কি করে! সাড়ে চার হাজার বছরের ইতিহাস মাত্র ন’দিনের আয়নায় ধরে রাখা, সেই সভ্যতাকে স্পর্শ করার স্মৃতি চিরদিনের করে রেখে দেওয়া, সে-ও কি কম কিছু! কায়রোর আকাশ থেকে মিশর ছেড়ে যাবার মুহূর্তে অবধারিতভাবে তাই মনে হল –“যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই-যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।“
    ভোটবৈতরণী - দ্বিতীয় দফা - সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় | নিজস্ব সংবাদদাতাঃ পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন চলছে টি২০র গতিতে। গতকাল দ্বিতীয় দফার ভোটের দিন সকাল থেকেই কেন কে জানে, বাংলাপক্ষ প্রচার চালাতে থাকে, বাংলায় সম্পত্তি কেনাবেচায় একমাত্র বাঙালির অধিকার। রহস্যটা বোঝা যায় দুপুরে, যখন  প্রধানমন্ত্রী এসে জবাব দেন, তিনিই আসলে বাঙালি। এ জন্মে না হলেও পরের জন্মে হবেনই। কলকাতার মেট্রোরেল দেখে বড় হয়েছেন, সেটা আগেই জানা ছিল। কিন্তু বাঙালির ব্যাপারটা নতুন। তিনি কখনই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননা। তাই বাঙালির সব সম্পত্তিই বেচে দিতে চান বলে এত আগ্রহ কিনা, প্রশ্ন করা যায়নি। এসবের মধ্যেই জানা যায়, মুখ্যমন্ত্রী হাইকোর্টকে বিজেপির দালাল বলে কেলোর কীর্তি করেছেন। বলেছিলেন আগেই, হাইকোর্ট বিশেষ রা কাড়েনি, শুধু এক বিচারপতি বলেছিলেন, এবার পঞ্চাশ হাজার চাকরি খেয়ে নেব কিন্তু। সেটায় কারোরই তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি। বিজেপিরও কোনো সমস্যা ছিলনা। কিন্তু কার কোথায় নরম জায়গা আছে কে জানে, কোথা থেকে ব্যাপারটা গায়ে লেগে যায় বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের এবং তিনি নাকি আবার মামলা করতে চলেছেন। এবার আর শিক্ষকদের না, চাকরি খাবেন আস্ত মুখ্যমন্ত্রীর।এ বিষয়ে তেমন কোনো খোঁজখবর করা যায়নি, কারণ ওদিকে পশ্চিমবঙ্গের উপদ্রুত অঞ্চলে এর মধ্যে নেমে যায় এনআইএ, এনএসজি, সাঁজোয়া গাড়ি রোবট। তারা শাজাহানের তাজমহল  খুঁড়ে বার করে ফেলে অনেক গাদা বন্দুক, যা দিয়ে আস্ত তেজো মহালয়া ধ্বংস করে ফেলা যেতে পারে। কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধীপক্ষরা এই নিয়ে হইচই করলেও সুবিধে করতে পারেনি। কারণ নির্বাচন কমিশনের অবস্থান এ ব্যাপারে থান ইটের মতো কঠিন। ভোট যেহেতু রাজ্যে হচ্ছে, তাই তারা রাজ্যের বাহিনীর হাত-পা বেঁধে রাখবে, কিন্তু কেন্দ্রীয় এজেন্সিরা যা খুশি করতে পারে। কারণ কেন্দ্র নামে কোনো রাজ্য নেই। ব্যাপারটা ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু সমস্যা হয় অন্যদিকে। সব এজেন্সিই তাজমহলে নেমে যাওয়ায়, উত্তরবঙ্গের বালুরঘাটে এজেন্ট কম পড়ে যায়। বিজেপি প্রার্থী নিশ্চিত হারের মুখে পড়ে যান। সেই নিয়ে ব্যস্ততার সুবাদে বীরভূমে পাল্টা হানা দেয় জিহাদি বাহিনী। তারা বিজেপি সেনানায়কের প্রার্থীপদ নাকচ করে "যথেষ্ট খেলা হয়েছে" বলতে বলতে তাঁকে বনবাসে পাঠিয়ে দেয়। অসমর্থিত সূত্রের খবর, অনুব্রত মন্ডল নাকি খবর শুনে জেলে ছড়া কাটেন, "সেই তো ছড়ালি, তবে কেন সরালি"। এই প্রতিবেদক অনেক চেষ্টা করেও এই সংবাদের সত্যতা যাচাই করতে পারেননি।সব মিলিয়ে, তাজমহল খুঁড়তে সফল হলেও, এনডিএ জোট পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে একটু কঠিন অবস্থায়। তাদের একমাত্র আশা ছিল ইন্ডিয়ার মধ্যে অন্তর্কলহ। মুখ্যমন্ত্রী এবং সিপিএম এতদিন একে অপরের নাম শুনলেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। কিন্তু সে আশায় জল ঢেলে মুখ্যমন্ত্রী শোনা যাচ্ছে, ঘোষণা করে দিয়েছেন তৃণমূল চুরিটা শিখেছে সিপিএমের থেকে। সিপিএম এই ব্যাপারে আপাতত তীব্র প্রতিক্রিয়া দিলেও, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গুরু-শিষ্য পরম্পরাকে স্বীকার করাই গভীর সম্পর্ক তৈরির প্রথম ধাপ। ফলে ইন্ডিয়ার ভবিষ্যৎ ক্রমশ এ রাজ্যে উজ্জ্বল হতেই পারে। * এর পুরোটাই খিল্লি করে লেখা, বুঝতেই পারছেন। কিন্তু একদিনে এতকিছু ঘটে যাচ্ছে, এটা একেবারেই মিথ্যে না। সব কিছুর থই পাওয়া যাচ্ছেনা। কিন্তু প্রতিটি ব্যাপারের প্রতিবেদন থাকা দরকার, কারণ আমরা টের না পেলেও ইতিহাস তৈরি হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, প্রতিটি ঘটনায়। আপনারা যদি মনে করেন, এই ঘটমান ইতিহাসের ধারাবিবরণীর কিছু অংশ লিখতে চান, তো অবিলম্বে লগিন করুন। যা দেখছেন, যা হচ্ছে, সিরিয়াস অথবা খিল্লিমূলক, আঞ্চলিক অথবা কেন্দ্রীয়, নগণ্য অথবা গুরুতর, তো ঝপাঝপ লিখে ফেলুন খেরোর খাতায়। আমরা ভোটবাক্স নামক একটি  বিভাগে পুরে দেব। কোনো সম্পাদনা ছাড়াই। হ্যাঁ আমরা সম্পাদিত লেখাও বার করছি, কিন্তু ইতিহাস স্রেফ সম্পাদনার ভরসায় থাকবে কেন? আপনিও লিখুন। ইতিহাস কারো বাবার জমিদারি না। 
  • জনতার খেরোর খাতা...
    মিছিল - আফতাব হোসেন | সাড়ে সাত কাটা চাষ জমি ভাগে পেয়েছিল ছুটকা কিস্কু । তার থেকে দেড় কাঠায় তিন কামরার একটা একতলা বানিয়ে বাকি জমিতে সারাবছর কিছু না কিছু ফলিয়েই টিকলো এত দিন ।-"লাল মাটিতে গর্ভ দেওয়া খুব কঠিন মাস্টার " ...শোনাতো ছুটকা মাঝে মাঝে ,- "ইটা মানুষ লয় বুঝলি না , ইটা দ্যাবতা, তাও আবার ম্যায়াদ্যাবতা , স ও ব উহার মন মত না হলে শরীর গোলবেনি ক, আর তু তো জানু ম্যায়াছেনার মন পেলে শরীর কেমন ফুটে , " বলেই ফিচেল হাসি দিয়ে আড়চোখে তাকায় বউ এর দিকে । ফাগু কিস্কুর এদিকে খেয়াল খুব কম । সে ব্যস্ত তার পোয়াতি ছাগীর জন্য । গরম কোনদিনও লাগে না ফাগুর, ছোট থেকেই কাজু জঙ্গলে মানুষ । বনবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে এসব সয়ে নেওয়া অভ্যেস বরাবর । মগন যখন প্রথমবার পেটে এলো , তখন হালকা গরম লাগলেও মগন কে পেটে নিয়েই বঞ্জর লাল জমিটাকে চষে বেড়িয়েছে বরাবর । মাঝখানে বিমারে পড়েছিল একবার ছুটকা কিসকু । হাসপাতালে দৌড়ে যখন কিছু কাজ হয়নি তখন থানে নির্জলা হয়ে একশাড়িতে পড়ে ছিল চারদিন উপবাসে । অর্ধেক সারার পর গোলাপী শাড়ি পরা দুরগায়ের দিদিরা ভিটামিন দিয়েছিল লিখে দুবার । সাতশো টাকার । মাথায় আকাশ ভাঙার টাকার অংক দেখে হিসেব বুঝিয়েছিল লালুয়া গ্রামের হরি মাহাতো । হপ্তায় একবার করে মিটিংয়ে গাড়িতে করে যেতে হবে । ফি দিন একশো । প্রথম প্রথম লাজ করতো ফাগুর। তারপর সিঁদুর বাঁচাতে রঙ ভুলে দিন একশোর মিছিলের মুখ । ফাগু ভাবে এখন , ভাগ্যিস , ভাগ্যিস পার্টি ছিল , নাইলে লোকটা বাঁচতনি গো । তারপর একযুগ । মগন লায়েক বড় এখন । চার বছর উই মেদিনীপুরে দিন রাত এক করে লায়েক এখন । নিজের ঘর থেকে এগারো কিলোমিটার সাইকেল করে স্টেশন । তারপর ট্রেন । সেখান থেকে কলেজ রোজ । কলেজে সব ভালো , তবে কালো রঙ এর তামাশা বেশি শহরে । মুড়ি টিফিনে জাতের প্যারামিটার এর গল্প দেখে রোজ । ইউনিয়নের সাদা লোকেরা কি সব বোঝায় তার মাথামুন্ডু বুঝে না মগন ।  মগন জানে সিডিউল ট্রাইবের কষ্ট । উপাই ও জানে বের হবার ।মগনার চাকরি গেলো আজ । ফাগু , ছুটকা তাও নীরব বড্ড । মগনাও চুপ ।জিজ্ঞাসালাম ,- "ছুটকা, জানু ছ্যানাটার চাকরি গেছে " ?চুপ ...- " ফাগু জানে " ?এবারেও চুপ ...আসার সময় ফাগু ধরলো ,- মাস্টার , লোকটাকে তিরিশ বছর আগে বাঁচিয়ে আনিছিলাম থানের মানতে । ছ্যানাটার জন্য যেতে পারবুনি কি ?বললাম বেশ যেও। কিন্তু তাও না হলে ?হাসলো মনে হয় ফাগু কিষ্কু , সাত কাঠা ভাগে পাওয়া ছুটকা কিসকুর বউ ।চিবিয়ে বললো - " মিছিল তো আছেই , আগের মত , আবার যাবো , ছ্যানাটার জন্যই, বিনা পয়সায় ...."
    হেদুয়ার ধারে - ১২৬  - Anjan Banerjee |      অমল দশ মিনিট আগেই  পৌঁছেছে বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে  । একটা আকাশি রঙের শার্ট আর মাখন রঙা প্যান্ট পরেছে । পরিপাটি করে চুল  আঁচড়েছে । কেন এসব করেছে কে জানে ।ছটা চল্লিশ নাগাদ পিছন থেকে কার গলা শোনা  গেল ---- ' সরি সরি ... লেট হয়ে গেল ... চলুন ...চলুন ... 'পিছন ফিরে অমল দেখল ইউনিভার্সিটি ফেরতা অপরিপাটি বেশবাসে ঘামে ভেজা শরীরে রাত্রি দাঁড়িয়ে আছে । হাতের ছোট রুমালটা দিয়ে মুখের ঘাম মুছল ।যেতে যেতে বিশেষ কিছু কথা হল না । রাত্রি অমলকে নিয়ে চালতাবাগানের মোড় থেকে একটা বাসে উঠল । অমল নানা কথা ভেবে রেখেছিল  সাজিয়ে গুছিয়ে ভিজে ভিজে করে বলবে বলে ।  কিন্তু তেমন কোন অবকাশ তৈরি হল না । রাত্রি বসেছে লেডিজ সিটে আর অমল ছেলেদের সিটে । আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার এক স্টপ পরে রাত্রি সিট থেকে উঠে পড়ে বলল, ' আসুন ... আসুন '।অমল রাত্রির সঙ্গে নেমে পড়ল । নেমে রাত্রির পাশাপাশি হাঁটতে থাকল । রাত্রি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ' ইশশ্ ... সাতটা বেজে গেল । এদিকে এদিকে ... 'ওরা দুজন বাঁ পাশের গলিতে ঢুকে পড়ল । রাত্রি বলল, ' স্যারকে বলা আছে ... প্রবলেম হবে না ... 'কথাটা অমলের কানে ঢুকল কিনা কে জানে । কারণ তার মনে তখন একটা গানের সুর গুনগুনিয়ে উঠছে ----- কত কথা ছিল তারে বলিতে .... চোখে চোখে কথা হল পথ চলিতে ... ' ।কিন্তু চোখে চোখে কথাই বা হল কোথায় ? অমল বরং গুনগুনাতে পারে , চক্ষে আমার তৃষ্ণা .... তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে ... '      রাত্রি অমলকে নিয়ে নিখিলবাবুর বাড়িতে ঢুকে দেখল কোচিং ক্লাসের ছাত্রীরা সব বিদায় নিয়েছে এবং সাগর ওখানে বসে আছে । আর একজন রোগামতো ধুতি পাঞ্জাবী পরা ভদ্রলোক বসে আছে ।রাত্রি বলল, ' কি ব্যাপার ... তুমি আজকে এখানে  ... আসার কথা ছিল নাকি ?  স্যার কোথায় ? 'সাগর বলল, ' স্যার একটু ওপরে গেছে । এক্ষুণি আসছে । আসার কথা কিছু ছিল না । এমনি  এলাম একবার ... '----- ' ও .... ইনি হলেন অমলবাবু । আমার এক বন্ধুর দাদা । স্যারের কাছে এসেছেন ওনার কথা  শোনার জন্য ... দুর্দান্ত গীটার বাজায় ... অসাধারন শিল্পী ... একদিন শোনাব তোমায় নিয়ে গিয়ে ... 'তারপর সাগরের দিকে দেখিয়ে অমলকে বলল, ' এই  যে , ইনি হলেন আমার মোস্ট ট্রাস্টেড অ্যান্ড বিলাভেড ফ্রেন্ড অ্যান্ড গাইড ... 'অমল কি বুঝল কে জানে । বোধহয় কিছু বোঝার চেষ্টা করতে লাগল । এরকম বেপরোয়া খোলামেলা ঘোষণা শুনে সাগর কেমন জড়সড় হয়ে গেল । খুশিতে বোধহয় ।সে যাই হোক, দুজন দুজনকে রীতিসম্মতভাবে হাতজোড় করে নমস্কার  করল ।এই সময়ে নিখিল ব্যানার্জী ওপর থেকে নেমে এসে ঘরে ঢুকলেন ।ওরা তিনজনই দাঁড়িয়ে উঠল ।নিখিলবাবু বললেন, ' আরে বস বস ... দাঁড়ানোর কোন দরকার নেই  । আমরা সবাই সমান । ব্যক্তিপূজা আমাদের নীতির বাইরে .... 'নিখিলবাবু অমলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ' ইনিই নিশ্চয়ই অমল ... 'রাত্রি বলল, ' হ্যাঁ স্যার ... ওর কথাই বলেছিলাম আপনাকে ... '----- ' হ্যাঁ ... আমি বুঝে নিয়েছি ... 'অমলের উদ্দেশ্যে বললেন, ' রাত্রি তো তোমার ডাই হার্ড ফ্যান । ইশশ্ ... বুদ্ধি করে গীটারটা যদি সঙ্গে আনতে বলত কি ভালই না হত ... যাক , রাত্রি ...  পরের দিন আশা করি এ ভুল আর হবে না ... সঙ্গীত, বিদ্রোহ প্রতিবাদে এক ধারাল অস্ত্রের কাজ করে এসেছে চিরকাল ... 'রাত্রি ঝটপট বলল, ' না স্যার ... আর ভুল হবে না ... সোয়্যার ... 'সাগর মিটিমিটি হাসতে লাগল । বলল,  ' আর ভুল হয় ... 'আর অমল দোদুল্যমান হয়ে নিরালম্ব শূন্যে  ভাসতে লাগল । যেন মেঘের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগল মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ।নিখিল স্যারই তাকে মাটিতে নামিয়ে আনলেন আচমকা ।বললেন, ' সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন ঠিকই  , কিন্তু  কখনও কখনও কলরবও জরুরী । কিন্তু আওয়াজ আর কজন ওঠাতে পারে বা ওঠাতে চায় । এই  'পলিটিক্স অফ সাইলেন্স ' নিয়ে কত  কথা । এই  সাইলেন্স বা নীরবতা সাধারণত তিন ধরণের হয় । কেউ  নীরব হয়ে থাকেন অন্যায়ের সরাসরি সমর্থনে বা স্বীকৃতিতে । কেউ চুপ থাকেন ভয়ে । তারা মুখ খুলতে ভয় পায় । কিন্তু সবচেয়ে জটিল সমস্যা তাদের নিয়ে যারা এই দুইয়ের  মাঝখানের শ্রেণী । যারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন সংশয়ে, অজানায়, অবিশ্বাসে  কন্টকিত হয়ে ... আটারলি কনফিউজড বাই হোয়াট ইজ গোয়িং অন , কেউ  বা রেশানালি ইগনোরেন্ট অ্যাজ টু দ্য ফ্যাক্টস। মানে, ব্যাপারটা ঠিকমতো বুঝতেই পারে  না । আমাদের কিন্তু এই  দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর মানুষের কাছে আগে পৌঁছতে হবে তাদের নাড়া দেওয়ার জন্য । ইন ফ্যাক্ট উই উইল হ্যাভ টু গেট আন্ডার দেয়ার স্কিন ।একদিন এরাই হবে আমাদের সামনে এগিয়ে চলার কি কম্পোনেন্ট । কোন এক চিন্তার ঝড় বইয়ে দিয়ে মনের আগল খুলে দিতে হবে .... 'নিখিল স্যার বলে যেতে থাকেন , প্রধানত অমলের দিকে তাকিয়ে ।' .... কিন্তু মূল সমস্যাটা কি বল তো ? প্রথম শ্রেণীর জনগোষ্ঠীকে নিয়ে । বস্তুত , এদের সংখ্যা কিছু কম নয় । এদের সমর্থনেই শাষকদল ক্ষমতায় আসে এবং এদের তোষণ করে আবার ক্ষমতা দখলের প্রস্তুতি চালাতে থাকে । এই, যে কোন প্রকারের অন্যায়ের সমর্থন এবং প্রশ্রয়প্রদানকারি জনগোষ্ঠী কোন দুরাচারি শাসকগোষ্ঠীর চেয়েও ভয়ঙ্কর । কোন ভ্রষ্টাচারি রাজনীতিকদের রূপ খোলাখুলি প্রকাশিত । কিন্তু এইসব সাধারণ মানুষ ক্যামাফ্লেজিং করে সমাজে মিশে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে । সারা পৃথিবীতেই তাই ।  আমাদের আসল জেহাদ প্রাথমিক ভাবে এদেরই বিরুদ্ধে যারা চুপ করে থাকে অন্যায়ের সমর্থনে ও স্বীকৃতিতে ... 'নিখিল ব্যানার্জী জাগ থেকে ঢেলে এক গ্লাস জল খেলেন । এরপর ওপর থেকে কয়েকটা কাপ সহ  একটা কেটলিতে চা  এবং খানকয়েক বিস্কুট রেখে গেল এক মহিলা । অমল একজন গান বাজনা এবং রোমান্টিকতার নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে বসবাস করা নির্ঝঞ্ঝাট সরকারি অফিসের কর্মচারী ।  এইসব গনগনে কথাবার্তা শুনে তার জল থেকে তোলা মাছের মতো অবস্থা হল । সে প্রথম দিকটা খাবি খাচ্ছিল , তবে পরের দিকে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে গেল । রাত্রির রমনীয় উপস্থিতি তার একটা কারণ । নিখিলবাবুর কথাগুলো সে একেবারে কিছুই  বুঝতে পারছিল না, তা না ... কিন্তু আর সবাইয়ের মতো সেও তো এসব নিয়ে কোনদিন চিন্তাভাবনা করেনি । খাবার খেলেই তো হজম হয় না , বিশেষ করে যদি তা গুরুপাক হয় । পরিপাক যন্ত্র সবার তো সমান হয় না । অমলের পরিপাক যন্ত্র কেমন তা হয়ত ক্রমশ জানা যাবে ।    দেশ বিদেশের আরও অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করলেন নিখিল ব্যানার্জী । কোন দেশে কিভাবে পরিবর্তনের সূচনা, উদ্যোগ এবং পরিণতি রূপ পেয়েছিল বা ব্যর্থ হয়েছিল তা নিয়ে অনেক কথা বললেন নিখিল স্যার । সেগুলো অত্যন্ত সারগর্ভ আলোচনা । কিন্তু দুঃখের ব্যাপার অমল মোটেই মন বসাতে পারছিল না এইসব মাটির মানুষের সুখ দুঃখের আলোচনায় । সে অকৃত্রিম আন্তরিকতায় ভাবল , এটা অবশ্যই তার অপদার্থতা এবং কূপমন্ডুকতা । সরিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও একটা চিন্তা তাকে ক্রমাগত খুঁচিয়ে যেতে লাগল , রাত্রির সঙ্গে ওই  ভদ্রলোকের সম্পর্কটা কি ?  মোস্ট ট্রাস্টেড অ্যান্ড বিলাভেড ফ্রেন্ড বলতে কি বোঝায় ? কিন্তু তার মন মোমের মতো গলে গেল না , বরং ধীরে ধীরে  শীতল বরফের মতো জমাট কাঠিন্যের দেয়াল তুলে দিল চারদিকে ।  প্রায় এক ঘন্টা পরে নিখিল স্যার বললেন, ' পরের শুক্রবার আবার একসঙ্গে হব আমরা । আমি যা সব বললাম সে ব্যাপারে তোমরা মতামত জানাবে আশা করি । আমি যা বললাম তা ভুল না ঠিক সেটা তো জানার দরকার । ইমপেরিয়াস অ্যাটিটিউডে আমি বিশ্বাসী নই  ।সাগর,রাত্রি এবং ওই ধুতি পাঞ্জাবী পরা ভদ্রলোক মুখ খোলবার আগেই অমল বলে উঠল , ' পরের দিন আমি অবশ্যই মতামত জানাব । কথা দিয়ে গেলাম । এটা শিয়োর, ধরি মাছ ,না ছুঁই পানি করে থাকব না ।এতক্ষণ চুপচাপ থাকার পর অমলের এই আকস্মিক উত্তাপ নিঃসরণ দেখে নিখিল স্যার খানিকটা অবাক হয়ে গেলেন ।তারপর বললেন, ' বটেই তো , বটেই  তো .... এই ফোর্সটাই তো চাইছি  ... গো অ্যাহেড অমল  ... বাকল ডাউন অ্যান্ড হ্যাভ আ গো ... ' ' আচ্ছা ... এখন আসছি তা'লে' ,বলে অমল বেরিয়ে যাচ্ছিল ।রাত্রি বলল, ' দাঁড়াও ...  আমি একটু এগিয়ে দিই '।সাগর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ' চল আমিও যাচ্ছি ... 'অমল বলল, ' না না না .... দরকার হবে না ...  আমি চলে যেতে পারব ... ', বলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল । নিখিল স্যার ভাবলেন, ছেলেটার বোধহয় কোন জরুরী কাজের কথা মনে পড়ে গেছে ।রাত্রি মাথা নীচু করে বসে আকাশ পাতাল ভেবে  তার নিজের ত্রুটি খুঁজে বেড়াতে লাগল । সাগর ভাবল, ' রাত্রি নিশ্চয়ই ছেলেটাকে কিছু খারাপ কথা বলেছে । সে জন্য রাত্রির ক্ষমা চাওয়া উচিত ।আর , ওই যে ভদ্রলোক ওখানে বসেছিলেন,  প্রভাকর বটব্যাল ... তিনি ভাবলেন , ' ছেলেমানুষ সব ... এদের কি কোন মস্তিস্কের স্থিরতা আছে ! বড় চঞ্চলমতি .... '     ( চলবে )********************************************
    কী কী হারিয়েছেন  - Eman Bhasha | কী কী হারিয়েছেন ১০ টাকায় মোবাইল রিচার্জ।এখন কমপক্ষে ১২৯ টাকা।লাইফটাইম মোবাইল রিচার্জ ৩০/ ৩১ দিনে মাসের বদলে ২৮ দিন।১০০ টাকায় টিভি দেখা। এখন কমপক্ষে ৩৫০ টাকা। তাও কয়েকটি চ্যানেল ৪৫ টাকার সর্ষে তেল ২২০ টাকা হয়ে এখন ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা।১০ টাকার সবজি ভাত ৩৫-৪০ টাকা।১২ টাকার ডিম ভাত ৫০ টাকা।১৮ টাকার মাছ ভাত ৬০-৬৫ টাকা।আলাদা ভাত তরকারি চাইলে পয়সা।৬০ টাকার পেট্রল ১০৩ টাকা।গ্যাস ৪১০ থেকে ১১২৯ টাকা হয়ে ৮২৯ টাকা।আটা ১৮ থেকে ৪২-৫০ টাকা।চাল ৩০ টাকা থেকে ৬০-৬৫ টাকা।খুচরো পয়সা চলে না।দু টাকা ভিখিরিও নেয় না।
  • ভাট...
    commentআ খোঁ | সব কর্পোরেটই এক জায়গায় এক - তা হল তাদের মুনাফা তৈরির লিপ্সা। কর্পোরেটের নাম-স্থান-কাল-ক্ষমতা চেঞ্জ হতে পারে। কিন্তু পুঁজির মূল চরিত্র একই থাকতে বাধ্য। এই চরিত্র নিয়েও পুঁজির নিজের মধ্যেও প্রচুর দ্বন্দ্ব থাকে। ছোট পুঁজি-বড় পুঁজি , দেশি পুঁজি-বিদেশী পুঁজি নানারকম। কিন্ত ওভারঅল কন্ট্রোল পুঁজির মুনাফা লিপ্সার নিয়মেই কনগ্লোমারেট মনোপলি পুঁজির হাতেই থাকে। তো এই মনোপলি পুঁজির সাথে ফ্যাসিস্ট স্টেটের স্ট্রং কোরিলেশন থাকতেই হবে। ডিসি নাই মানতে পারেন কিন্তু ইহাই এতদিনের সত্য। যে কোনো মডার্ন স্টেটেই ফ্যাসিস্ট এলিমেন্টস ভরে থাকে। কিন্তু তা তখনই কেন্দ্রে আসতে পারে যখন মনোপলি পুঁজি তার পেছনে ফুল ফ্লেজেড দাঁড়িয়ে পড়ে। আরএসএস এর প্রচেষ্টার নিশ্চই বড় ভূমিকা আছে। কিন্তু তা কখনোই এই মাপে সফল হতো না যদি না মনোপলি বড় পুঁজি তার পেছনে এসে দাঁড়াতো। ভারতের মিশ্র পুঁজির ক্যারেক্টারে প্রথম আঘাত হানেন মনমোহন সিং। তারপর থেকে মনোপলি পুঁজির হাত ধরে ফ্যাসিস্ট স্টেটে পৌঁছনো শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল। আজকের দিনে ক্যাপিটালিজমের সমস্ত কুলক্ষণগুলো যখন ফেটে ফুটে বেরোচ্ছে তখন মানুষের যাবতীয় ক্ষোভ যাতে অন্যদিকে চানেলাইজড হয় তার মোক্ষম নিদান হলো ফ্যাসিজমের উত্থান। আর অরিত্র যেমন বললেন স্বাভাবিকভাবেই অলিগার্কিক কনগ্লোমারেট যে কোনো স্টেটে বেশি করে চাইবে নিয়ন্ত্রণবাদী শক্তি। যে শক্তি ওই মনোপলি পুঁজির এজেন্ট স্টেট্ হিসেবে কাজ করবে। আজকের সার্ভেলেন্স পুঁজির সময়ে এই শয়তানের জোট ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।  অনেকে ভুল করেন যে নিয়ন্ত্রণবাদী মানে সেখানে ক্যাপিটালিজম-এর অসুবিধে। কেননা তা লিবেরাল না। এই ভাবনা ঠিক নয়। নিয়ন্ত্রণবাদী ফ্যাসিস্ট কেন্দ্র নিমন্ত্রন করে মুক্ত জনমতকে পাবলিক ইন্টারেস্ট কে। আর ক্রোনি হিসেবে কাজ করে সরাসরি মনোপলি কর্পোরেট লুটের স্বার্থে। ভারত কিছু ব্যতিক্রম নয়। আদানি আর আম্বানির যে উত্থান তার ইন্ডাস্ট্রি ক্যারেক্টার হল নন ট্রেডেড অথবা হাইলি রেগুলেটেড। ( ইরানে মোসাদেঘ যখন তেলের খনি ন্যাশনালাইজ করে তখন সিআইএ আর এম সিক্স ক্যু করেছিল কেননা আমেরিকান ও ব্রিটিশ স্টেট তাদের ক্রোনি ব্রিটিশ অয়েল কোম্পানি এংলো ইরানিয়ানের জন্য কাজ করছিল।) মোদির ফ্যাসিস্ট সরকার তাদের এতো কেন দরকার তা তো আর রকেট সায়েন্স নয়।  আর সেই জন্যই এই খেলায় টাটার মতো পুরোনোদের হিন্দুত্বওয়ালাদের পেছনে থলি হাতে দৌড়োতে হচ্ছে। কংগ্রেস উদারনীতি আনলেও নিজের মিশ্র চরিত্রের জন্যই বিজেপির থেকে এ ব্যাপারে অনেক  পিছিয়ে। বিজেপির রেগুলেটেড সেক্টরগুলিকে ধ্বংস করা বিলগুলি লক্ষ্য করবেন। আর কংগ্রেসের এবারের ম্যানিফেস্টো লক্ষ্য করবেন। তফাৎটা স্পষ্ট। আর ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থানে এ জিনিস বারবার হয়। জার্মানিতে জাপানের কেস স্টাডি করুন। মুসোলিনি বলেছিলেন এ ফিউশান অফ স্টেট এন্ড কর্পোরেট পাওয়ার। এবার স্টেটের চরিত্র মৌলাবাদী হতে পারে ; একনায়কতন্ত্রী হতে পারে কিন্তু কেবলমাত্র এই ফিউশনেই ফ্যাসিসমে পৌঁছনো সম্ভব। ঠিকঠাক বলতে পারলাম কিনা জানি না।  যাই হোক।  
    comment&/ | দ্রি কে মিস করছি। উনি থাকলে হয়তো বুঝিয়ে দিতেন মুসলিমরাষ্ট্র হিন্দুরাষ্ট্র সবেতেই কর্পোরা কেমন সচ্ছন্দ। সৌদি আরবেও ওরা হুলিয়ে আছে।
    comment&/ | অসীম চট্টোপাধ্যায় 'নকশালবাড়িনামা' বইয়ের (লেখাটা ধারাবাহিক বের হত 'দেশ' পত্রিকায়) জন্য আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন , সোশাল মিডিয়ায় তুমুল বেধেছে বচসা। একজায়্গায় শুনলাম সত্যজিৎ রায়ের ছেলে সন্দীপকে নাকি নকশালরা খুন করতে গেছিল। লোকে জিজ্ঞেস করছে কেন সন্দীপ কী করেছিলেন? তখনও তো তিনি খারাপ সিনেমা বানানো শুরু করেন নি। আর খারাপ সিনেমা বানানোর জন্য তো আর কারুকে খুন করা যায় না, সেটা অনুচিত কাজ।
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত