এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    ফেদেরিকো ফেলিনির চলচ্চিত্র – ধর্ম ও জীবন ভাবনা - শুভদীপ ঘোষ | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়স্টেট ও চার্চকে সম্পূর্ণ পৃথক করে দিতে হবে। রাজ্য পরিচালনার কাজে চার্চ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না এবং রাজ্যও চার্চের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। রাজ্য পরিচালনার কাজে রোমান ক্যাথলিক চার্চ সরাসরি হস্তক্ষেপ করত। নিয়ম-শৃঙ্খলা বলবৎ ছিল, যাকে বলা হত খৃষ্টীয় অনুশাসন। কিন্তু পরবর্তীতে স্টেট ও চার্চের এই বিযুক্তিকরণই ছিল সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার আদি সংজ্ঞা। নিয়ম-শৃঙ্খলা অর্থাৎ অনুশাসনের ভাবনা নিশ্চয়ই আদিম যুগে ছিল না, গুহামানবের যুগে ছিল না। জৈবিক বিবর্তনের পথ ধরে সমাজ তৈরি হয় এবং সেই পথেই কোনো একসময় নিশ্চয়ই নিয়ম- শৃঙ্খলা বা অনুশাসনের ভাবনা এসেছিল। ধর্মের উৎপত্তি ও সামাজিক অনুশাসন কি যমজ সন্তান! প্রাচ্যের প্রাচীন ধর্মগুলিই হোক বা আব্রাহামিক (সেমেটিক) ধর্মগুলিই হোক, পাপ-পুণ্যের ভয় দেখানো ব্যাপারটা ধর্মীয় অনুশাসন কায়েম রাখার পিছনে কাজ করত, তা হয়ত অস্বীকার করা যাবে না। ফলত সামাজিক অনুশাসন বা নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রত্ন-রূপ হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে ধর্মীয় অনুশাসন গুলির মধ্যে! মনুসংহিতাতে আছে, ফ্রয়েড টোটেম এন্ড ট্যাবু-তেও উল্লেখ করেছেন এরকম বিধানের - মাতৃস্থানীয়া (মাসি পিসি কাকিমা জেঠিমা) কারো সাথে একই পথে যেতে যদি তোমার (মায়ের ছেলে) সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে তুমি তাঁর পায়ের পাতা ভিন্ন অন্য কোনো দিকে তাকাবে না, আর মাতৃস্থানীয়া ঢেকে নেবেন তাঁর মুখমণ্ডল! কিনসিপ বা আত্মীয়তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় ক্লদ লেভিস্ত্রস সামাজিক বিভিন্ন বিধানের বিকাশের কেন্দ্রে রেখেছেন বিবাহ নামক অধুনা টলমলে ইন্সটিটিউশনটিকে। প্রমিসকিউটিকে আটকানোর প্রবল প্রচেষ্টা, অভিজ্ঞতা-নির্ভর বিধান বা অনুশাসনের সূচনা - এর মধ্যে মিশে আছে পাপ-পুণ্যের চেতনা। পাপ বা পুণ্য হবে, পাপ করলে শাস্তি পুণ্য করলে পুরস্কার, কিন্তু কে দেবে সেটা? এখানেই ঈশ্বরকে মাথায় নিয়ে ধর্মের অনুপ্রবেশ। আদিম মানুষের মাথায় ঈশ্বরের চিন্তা হয়ত আসেনি, তাদের ভয় ছিল পঞ্চভূতের প্রয়লঙ্কর রূপগুলি নিয়ে। যেহেতু তাতে মৃত্যু ছিল নিয়মিত ও অনিবার্য। কিন্তু ঐ অসহায়তাই একসময় তাদের ভাবতে বাধ্য করে অনন্ত ক্ষমতাশালী অতি-প্রাকৃতিক ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে। ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ালো, ধর্মহীন সমাজ আসলে নিয়ম-শৃঙ্খলা-অনুশাসন-হীন ও ঈশ্বরহীন সমাজ। বলা-বাহুল্য সেকুলার (প্রবন্ধের প্রারম্ভে বলা অর্থে সেকুলার) সমাজ অনুশাসন-হীন, এটা আধুনিক রাষ্ট্র নিশ্চয়ই মনে করে না। অনুশাসন বলবৎ করার জন্য কোর্ট-পুলিশ আছে। কিন্তু এটাও নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে পুরো ব্যাপারটা বাইরে থেকে বলবৎ করা অনুশাসন নিয়ে নয়, ব্যক্তি ও সমাজ-মানসের স্বশাসিত নৈতিক অনুশাসনের এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। আব্রাহামিক ধর্মের সূচনা হয় ইহুদি ধর্ম বা জুডাইজমের দ্বারা। তৎপরবর্তী খৃস্টান ও সর্বশেষ ইসলাম। ক্রুশবিদ্ধ খৃষ্টের মিনিয়েচার ধর্মপ্রাণ খৃষ্টানদের গলায় গলায় আমরা ঝুলতে দেখি। ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর বিখ্যাত ক্রাইস্ট দা রিদিমার থেকে সর্বত্র আমরা দেখেছি স্থাপিত খৃষ্টকে। কিন্তু ফেলিনির La Dolce Vita (১৯৬০) শুরুর দৃশ্যটির কথা ভাবুন! রোম শহরের উপর দিয়ে হেলিকপ্টারে করে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ক্রাইস্ট দা রিদিমারের মত সর্বংসহায় ভঙ্গীর খৃষ্ট-মূর্তিকে। মার্শেলো ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের দেখতে পাওয়া যায় আরেকটা হেলিকপ্টারে। বিকিনি পরা অভিজাত রমণীদের প্রশ্নের উত্তরে তারা জানায় খৃষ্টকে পোপের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আসলে আমাদের মনে হয় পরিচালক যেন ইঙ্গিত করছেন, খৃষ্টের জন্য স্থাপন করার মত উপযুক্ত স্থান সারা শহরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! এই ছবির পরিচালক ফেদেরিকো ফেলিনি (১৯২০-১৯৯৩) তাহলে কোনদিকে ইঙ্গিত করছেন? ধর্মনিষ্ঠ অনুশাসন-যুক্ত সুশৃঙ্খল সমাজের দিকে নাকি ধর্মহীন অনুশাসন-হীন উৎশৃঙ্খল সমাজের দিকে? এটা বুঝতে গেলে জানতে হবে ধর্মের ব্যাপারে ফেলিনির মনোভাব কি ছিল? “It’s difficult biologically and geographically not to be a Catholic in Italy. It’s like a creature born beneath the sea – how can it not be a fish? For one born in Italy, it’s difficult not to breathe, from childhood onward, this catholic atmosphere. One who comes from Italian parents passes a childhood in Italy, enters the church as baby, makes his Communion, witnesses Catholic funerals – how can he not be a Catholic? Still, I have a great admiration for those who declare them selves a detached laity – but I don’t see how this can happen in Italy.” একে ধর্ম নিয়ে ফেলিনির সরাসরি মতামত বলা যাবে না। কিন্তু ফেলিনির এই উচ্চারণের মধ্যে নিহিত আছে আধুনিক মানুষের মধ্যে ধর্ম-বিশ্বাস কি ভাবে জন্মায় তার রহস্য। ধর্ম যেন, যাকে কার্ল ইয়ুং বলেছিলেন ‘সমষ্টিগত মগ্ন-চৈতন্য’ (collective unconscious), তার আওতাধীন! অর্থাৎ ধর্ম-বিশ্বাস আসলে আধুনিক মানুষ পায় ‘সমষ্টিগত মগ্ন-চৈতন্য’ থেকে। কেননা এটা দীর্ঘদিন ধরে লালিত হতে হতে ক্রমেই সমাজ-মানসের অংশ হয়ে গেছে। মানুষ যেন ধর্ম-বিশ্বাস নিয়েই জন্মায়। পরবর্তীকালে যুক্তি-বুদ্ধির চর্চার ফলে কারো কারো মনে ধর্ম নামক অপৌরুষেয় বিষয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং তারা তখন নাস্তিকতার দিকে ঝোঁকে। নাস্তিকতা যেন স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে একটা লড়াই। ফেলিনির চলচ্চিত্রীয় শিকড় কিন্তু নিহিত ছিল বহুল প্রসিদ্ধ ইতালির নব্য-বাস্তববাদের অন্দরে। তাঁর শুরুর দিকের ছবিতে বিশেষত ১৯৫৭ সালের Night of Cabiria পর্যন্ত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের চিত্রায়ন, স্বাভাবিক আলোয় শুটিং ও নন-অ্যাক্টরদের ব্যবহার করার যে ব্যাপারটা আমরা দেখতে পাই, বোঝা যায় সবটাই ইতালির নব্য-বাস্তববাদের প্রভাব। ইতালির নব্য-বাস্তববাদ সম্পূর্ণত মার্ক্সীয়-বীক্ষার ফসল এবং এর পুরোধা তাত্ত্বিক সিজার জাভাত্তিনি বলেছিলেন “there must be no gap between life and what is on the screen”। সত্যিকারের জীবন ও চলচ্চিত্রে-চিত্রিত জীবনের মধ্যে কোনো তফাৎ না থাকার ব্যাপারটা ফেলিনি নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু এর সমান্তরালে তাঁর একটি নিজস্ব ধরনও গড়ে উঠছিল। তাঁর ছবিতে ক্রমেই ঢুকে পড়তে থাকে ‘সমষ্টিগত মগ্ন-চৈতন্য’র জায়গা থেকে রোমান ক্যাথলিসিজমের অনুকল্প, ধর্মীয় শুদ্ধির বিপরীতে যৌনতা নামক খ্রিষ্টীয় পাপের অনিবার্য হাতছানি এবং পঞ্চাশ-ষাটের দশকের অর্থ-প্রাচুর্যের ফলে ইতালির সমাজ-জীবনের হেডনিস্টিক প্রবণতা। এই সমস্ত বিষয়কে একসাথে ধরার জন্য ফেলিনি কার্নিভাল-সুলভ একধরনের নির্মাণ-শৈলী তৈরি করছিলেন। বিষয় ও নির্মাণ-শৈলীর এই যুগ্মই নব্য-বাস্তববাদকে অতিক্রম করে তাঁর স্বতন্ত্র একটি স্টাইলের জন্ম দিয়েছিল। ১৯২০ সালে ইতালির রোমানি শহরে রোমান ক্যাথলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফেলিনি। তাঁর চিত্র-সমাহারে সরাসরি ভাবে বাইবেলের উল্লেখ যদিও দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় ও মোটিফ ফিরে ফিরে আসে। তবে এসব কিছুই বলা-বাহুল্য রোমান ক্যাথলিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা ফেলিনির নিজস্ব বিবলিক্যাল ব্যাখ্যা। যদিও তিনি লুই বুনুয়েলের মত খৃষ্টকে সরাসরি আক্রমণ করেন নি। খৃষ্ট সম্পর্কে তাঁর মত ছিল – “যীশুর প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। মানবজাতির ইতিহাসে তিনি যে মহত্তম মানুষ তাই নয়, উপরন্তু প্রতিবেশীর জন্য যেই নিজেকে উৎসর্গ করে তাঁর মধ্যে তিনি বেঁচে থাকেন – এই বিশ্বাস।”। ব্যাবিলন থেকে প্যালেস্টাইন পর্যন্ত যে অঞ্চলের এককালে নাম ছিল ‘কানান’ সেখানে দীর্ঘদিন ধরে মানুষ এক মহাপুরুষের আবির্ভাবের জন্য অপেক্ষা করছিল। একে মেসিয়ানিজম বা মাহদীবাদ বলে। যীশু যখন নাজারেথে জন্ম গ্রহণ করেন তখন সেটা ছিল রোমক উপনিবেশ। এই রোমক উপনিবেশে ইহুদীরা দীর্ঘদিন একজন পরিত্রাতার কথা চিন্তা করতেন এবং তাঁর জন্য অপেক্ষা করতেন। অনেকে মনে করেন যীশু হচ্ছেন সেই পরিত্রাতা। অনেকে মনে করেন প্রাথমিক সময়ে যীশুর কাজের (ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক কাজের মধ্যে) মধ্যে একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার ছিল কিন্তু পরের দিকে তিনি থিয়োক্রিটিক হায়্যারারকির সঙ্গে সমঝোতার পথে হাঁটেন। তাছাড়া স্ক্রিপচারে মাসিহার আগমনে সমাজে যে যে সুফল আসবে বলে লেখা ছিল, যীশুর আগমনের পর ইহুদীরা সেগুলি দেখতে পান নি। ফলে তাঁরা যীশুকে স্বীকার করে নিতে পারেন নি। বলা-বাহুল্য এই নিয়ে প্রভূত বিতর্ক আছে এবং সেটা আলাদা আলোচনার বিষয়। প্রসঙ্গে ফিরে বলা যায় বিবিধ ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারিতা ও দ্বৈত-অবস্থানের জন্য রোমান ক্যাথলিক চার্চকে অনেক ক্ষেত্রেই ফেলিনি সমালোচনা করেছেন। ফলস্বরূপ চার্চের সেন্সর সরকারিভাবে তাঁর The Temptation of Dr. Antonio (Boccaccio 70 (১৯৬২) ছবির একটি গল্প) ও 8 & half (১৯৬৩)-কে ব্যান্ড করে। রক্ষণশীল গোষ্ঠীর সদস্যরা তাঁর অন্য ছবিগুলির ক্ষেত্রে অনেক সময়ই হলের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করত। ফেলিনির শুরুর সাদাকালো সাতটি ছবিতে খৃষ্টীয় নৈতিকতার দিক থেকে পীড়া, অপরাধ, ক্ষমা, অনুতাপ, এবং মুক্তির মত অনুষঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই ছবিগুলিতে রোমান ক্যাথলিক চার্চের কার্যকলাপকে প্রায়শই সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। প্রথম ছবি The White Sheikh (১৯৫২)-এই ফেলিনির খৃষ্টীয় মনন-বিশ্বের জোরাল প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। The White Sheikh-এ দুটি গল্প সমান্তরালে এগোতে থাকে। প্রথম গল্পে সদ্য-বিবাহিত দম্পতি ওয়ান্ডা ও ইভানকে আমরা দেখতে পাই তারা প্রথম বারের জন্য রোমে এসেছে। ভ্যাটিকানের কর্মচারী ইভানের কাকাকে প্রভাবিত করার জন্য ইভান চায় তার স্ত্রী ওয়ান্ডার সঙ্গে পরিবারের সকলের আলাপ করিয়ে দিতে। কাকা ভ্যাটিকানের দর্শকবৃন্দের সম্মুখে পোপের সঙ্গে নব্য-দম্পতির আলাপের একটা সুযোগও করে দেন। দ্বিতীয় গল্পটি সোপ অপেরার হিরো White Sheikh-র সঙ্গে ওয়ান্ডার গোপন সাক্ষাৎ নিয়ে। White Sheikh-র সঙ্গে দেখা করার জন্য ওয়ান্ডা হোটেল থেকে পালিয়ে যায়। ইভান ওয়ান্ডাকে খুঁজতে শুরু করে এবং রোমের রাস্তায় তার সঙ্গে দুজন বেশ্যার দেখা হয়। এদের মধ্যে একজনের সঙ্গে ইভান রাত কাটায়। ইতিমধ্যে হাসপাতাল থেকে ইভানের কাছে খবর আসে যে ওয়ান্ডা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এবং এখন সে হাসপাতালে ভর্তি! ইভান হাসপাতালে যায় এবং তারা দুজনেই তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ করতে থাকে। কিন্তু সত্যি তারা গোপনে কি করেছিল সেটা একে-অপরের কাছে প্রকাশ করে না। নবদম্পতি হাতে হাত ধরে বাকি দর্শকদের সঙ্গে যখন পোপের দিকে এগোতে থাকে তখন সেন্ট পিটার গির্জার ঘণ্টা বেজে ওঠে। তারা আসলে গোপনে কি করেছিল এটা না জেনেই একে-অপরকে ক্ষমা করে দেয় এবং ওয়ান্ডা তার স্বামী ইভানের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “Ivan, mio sceicco bianco sei tu!” অর্থাৎ “তুমিই এখন আমার ওয়াইট সেইখ!”। প্রকৃতপ্রস্তাবে এই সুখী সমাপ্তি কিন্তু ঐ নবদম্পতির সরলতার পুনরর্পণ নয় বরং এ যেন চার্চ নামক প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে তাদের গতানুগতিক বাস্তবতায় ফিরে আসার দ্যোতনা। দর্শক শুধুমাত্র জানে এরা আসলে গোপনে কি করেছিল। চার্চ সেই সবের গভীরে প্রবেশ না করেই উপর-উপর তাদের সরল বলে প্রতিপন্ন করে। ফেলিনি দেখাতে চান সাংগঠনিক ধর্ম কি ভাবে কাজ করে। চার্চ নৈতিকতার দিকে জোর দেয় কিন্তু তাদের উদ্বেগটা ভাসা-ভাসা। সত্যটাকে ধামাচাপা দেওয়া হয় শুধুমাত্র আদর্শ রোমান ক্যাথলিক দম্পতিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য। দুটি গল্প যেন ফেলিনি-কৃত দুটি বিশ্বের স্মারক। একদিকে ফেলিনির ছবির চরিত্রদের মনে হয়, নিজেদের মত ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পরিচালক সেখানে একজন সাইলেন্ট অবজারভার, তাঁর চরিত্রগুলির উপর কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ নেই। কিঞ্চিৎ খ্যাপাটে, অনেক সময় বহিরাগত এবং কখনো অতিরঞ্জিত এই সব চরিত্রদের প্রবৃত্তির তাড়নাকে ফেলিনি স্থাপন করেন কখনো সোপ অপেরার (The White Sheikh) প্রেক্ষাপটে, কখনো সার্কাসের (La Strada (১৯৫৪), I clown (১৯৭০)) প্রেক্ষাপটে, কখনো থিয়েটার বা ভ্যারাইটি সোয়ের (Variety Lights (১৯৫০)) প্রেক্ষাপটে, কখনো চলচ্চিত্রের/টেলিভিশনের (Intervista (১৯৮৭) , Ginger & Fred (১৯৮৬)) প্রেক্ষাপটে, কখনোবা অর্কেস্ট্রার (Orchestra Rehearsal (১৯৭৯)) প্রেক্ষাপটে। অন্যদিকে রয়েছে, ছবির চরিত্রগুলির জীবনযাত্রার বিপরীতে বহমান রোমান ক্যাথলিক চার্চের নিজস্ব নৈতিক অনুশাসনের ভাবনা। মুশকিল হল চার্চ চরিত্রগুলির কৃতকাজের মনস্তাত্ত্বিক জায়গাটি নিয়ে না ভেবেই নৈতিক অনুশাসন বলবৎ করার চেষ্টা করায়, সেটা চরিত্রগুলির অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কোনো প্রকার সমাধান দিতে পারে না। সাদাকালো পর্বের প্রথম দিকের ছবিগুলিতে হ্যাপি এন্ডিংয়ের একটা ব্যাপার থাকলেও ঐ পর্বের শেষের দিকের ছবিগুলিতে প্রধান চরিত্রের নেতিবাচক পরিণতি প্রায়শই আমরা দেখতে পেয়েছি। অপরাধী ও নির্যাতিত – কারোর প্রতিই পরিচালক অতিরিক্ত আবেগ প্রদর্শন করেন নি। গরীব ও অসহায় চরিত্ররা খৃষ্টীয় অর্থে অশুভ শক্তির শিকার, কিন্তু তারা তখনো অলৌকিকের প্রতি আস্থাশীল। চরিত্রগুলির যন্ত্রণা ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট হিসেবে বিধৃত হওয়ায় ব্যাপারটা দর্শকের মনে গভীর সহানুভূতির সঞ্চার করেঅপরের প্রতি সহমর্মিতার যে ভাবনা খৃষ্টধর্মে আছে, নৈতিকভাবে ছবিগুলি সেই মূল্যবোধের দ্বারা চালিত। যন্ত্রণা, অনুতাপ ও মুক্তি – এই খৃষ্টীয় ভাবনা এখানে যুক্ত হয়ে আছে। La Starda ছবিটিতে যেরকম। তরুণী ভবঘুরে গেলসোমিনা (ফেলিনির স্ত্রী Giulietta Masina অভিনীত) সার্কাসের প্রধান জ্যাম্পানোর (Anthony Quinn অভিনীত) পাশবিক আচরণের শিকার হয়। এই জ্যাম্পানোকে ফেলিনি চিত্রিত করেছেন একেবারে আবেগ ও মনুষত্বহীন একজন পাশবিক প্রকৃতির মানুষ হিসেবে। একদা পরিত্যক্ত গেলসোমিনার মৃত্যুর খবর একদিন জ্যাম্পানোর কানে আসে। কি হয় এই মানুষটির? La Starda-র অসাধারণ অন্তিম দৃশ্যে মদ্যপ জ্যাম্পানোকে আমরা দেখতে পাই সমুদ্রের পাড়ে অন্ধকার রাত্রিতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে। সমুদ্রের পাড়ে সুবিশাল আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে জ্যাম্পানো ডুকরে কেঁদে ওঠে। কিন্তু ফেলিনি আমাদের আকাশটা দেখান না। সমুদ্রের পাড়ে শুধুমাত্র জ্যাম্পানোতে আবদ্ধ ফেলিনির ক্যামেরা অনুতাপকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যায় যাকে শৈল্পিক সিদ্ধির চূড়ান্ত ছাড়া আর কিছু বলার থাকে না। অভিভূত আমরা শুধু বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবি কিভাবে এরকম পাশবিক একটি মানুষের মনের অন্দরে এরকম মানবিক একটা স্পন্দন জাগতে পারে? একার্থে গেলসোমিনা যেন খৃষ্ট নিজেই এবং গোটা ছবিটা যেন খৃষ্টীয় নীতিকথা। এই ছবিগুলি রোমান ক্যাথলিসিজমের প্রতীকে ঠাসা। La Starda-য় এক জায়গায় ক্রস ও খৃষ্টের স্ট্যাচু নিয়ে বিশাল একটি মিছিলের পাশে গেলসোমিনাকে দেখা যায় হাঁটু গেড়ে বসে আছে। পরে জ্যাম্পানোর সঙ্গে যাত্রার সময় একটি মঠে একজন সহৃদয় নানের সঙ্গে গেলসোমিনার পরিচয় হয়। এই মঠে যাত্রীরা রাত্রি যাপন করে। গেলসোমিনা ভীষণ শান্তি বোধ করে ঐ মঠে রাতযাপনের সময় এবং পরের দিন মঠ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সে কেঁদে ফেলে। The Swindle (১৯৫৫) ছবিতে পিকাসো নামক একটি চরিত্র ভার্জিন মেরীর একটি স্ট্যাচু দেখতে পায়। স্ত্রীকে মিথ্যে কথা বলার জন্য পিকাসো ঐ স্ট্যাচুর সামনে অনুশোচনা করতে থাকে। একটু পরে চার্চের ঘণ্টা বেজে উঠলে সে বাড়ি চলে যায়। The night of Cabiria (১৯৫৭) ছবিতে ভার্জিন মেরীর একটি প্রার্থনাস্থলের অভিমুখে আগত তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে বেশ্যা ক্যাবিরিয়া (ফেলিনির স্ত্রী Giulietta Masina অভিনীত) যোগ দেয়। তীর্থযাত্রীরা নতুন জীবনের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে মেরীর চার্চের দিকে এগোতে থাকে। ক্যাবিরিয়া মেরীর ছবির সামনে প্রার্থনা করতে থাকে যাতে তার জীবনেও পরিবর্তন আসে। কিন্তু আচারানুষ্ঠানটির পরে সে অনুভব করে কোনো মিরাকল ঘটে নি তাই তার জীবনের পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাই নেই। মধ্য-পঞ্চাশের দশক থেকে ইতালির অর্থনীতিতে জোয়ার আসে। নব্য-বাস্তববাদকে আত্মস্থ করে ফেলিনির স্বতন্ত্র স্টাইল আরো ঘনীভূত হতে থাকে। তথাপি, ১৯৬০-র La Dolce Vita-তে বা ১৯৬২-র The Temptation of Dr. Antonio-তে বা ১৯৬৩-র 8 & half-এ রোমান ক্যাথলিসিজমের চিহ্ন বিদ্যমান এবং সমালোচনা এখানে আরো বেশি স্পষ্ট। এই আলোচনার শুরুর La Dolce Vita-র সেই যীশুকে হেলিকপ্টারে করে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যে ফিরে আসা যাক। ১৯৫৭ সালের পয়লা মে, যীশুর একটি বিশাল স্ট্যাচুকে সত্যিই হেলিকপ্টারে করে সেন্ট পিটার স্কোয়ারে নিয়ে আসা হয়েছিল। চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত এই দৃশ্যটির দিকে ভালো করে তাকালে আমরা দেখতে পাবো ফেলিনির স্বতন্ত্র স্টাইল এখানে রোমের আইডেন্টিটির তিনটি দিককে একসঙ্গে ধরেছে। পিছনে কলসিয়ামের মত ধ্বংসাবশেষ রোমের পরম্পরাগত অতীতের প্রতীক, হেলিকপ্টারটি হল অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ হেডনিস্টিক বর্তমানের প্রতীক এবং রোমান ক্যাথলিক আইডেন্টিটির প্রতীক হলেন ঝুলন্ত খৃষ্ট। এই তিনটি বিষয়ের ঘাত-প্রতিঘাত ধরেই যে ছবিটি পরবর্তীতে অগ্রসর হবে ফেলিনি শুরুতেই তার ইঙ্গিত দিয়ে দেন! নব্য-বাস্তববাদী চলচ্চিত্রগুলিতে মূলত চিত্রিত হয়েছে - অর্থনৈতিক দুর্দশা জনিত সামাজিক বিশৃঙ্খলা এবং সেখানে চার্চ অনেকাংশেই উপশম ও আশার প্রতীক। ফিয়েট অটোমোবাইল, ভেস্পা স্কুটার ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী রপ্তানি করে মধ্য-পঞ্চাশ থেকে ইতালির অর্থনীতি সমৃদ্ধ হতে থাকে। একই সঙ্গে কমতে থাকে চার্চে যাওয়া মানুষের সংখ্যা এবং বাড়তে থাকে হেডনিস্টিক জীবনযাপনের প্রতি উদগ্র টান। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬২ সাল, চার্চে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ৬৯% থেকে কমে দাড়ায় ৫৩%-এ। চার্চ ছেড়ে বিনোদনের দিকে ঝোঁকার এই প্রবণতাকে ফেলিনি যতটা ক্যাথলিক চার্চের অধঃপতন হিসেবে দেখেছেন তার চেয়ে অবশ্য অনেক বেশি দেখেছেন চার্চের প্রতি আনুগত্য-হীনতা ও ধার্মিকতার প্রতি বীতরাগ হিসেবে। ফেলিনির দৃষ্টিতে ধর্মের চিহ্ন হিসেবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি তখনো সমাজের আগ্রহ ছিল বটে, কিন্তু সেই চিহ্নগুলির অন্তর্নিহিত অর্থের প্রতি কোনো আগ্রহই তখন আর অবশিষ্ট নেই। আধুনিক সমাজের কাছে ধর্ম একটা স্পেক্টাক্যালের বেশি কিছু নয়, বিনোদন মাত্র! La Dolce Vita-র শুরুতে হেলিকপ্টার সমেত ঝুলন্ত যীশুর ছায়া দেখতে পাওয়া যায় নতুন বহুতল বিল্ডিংয়ের গায়ে। বাচ্চা ছেলেরা (আগামী প্রজন্মের প্রতীক) সেটা দেখার জন্য দলে দলে দৌড়তে থাকে। এই দৃশ্যটি একই সঙ্গে দুটি জিনিসকে প্রতিকায়িত করে। এক, ধর্ম এখন স্পেক্টাক্যাল হিসেবে কাজ করছে, বিনোদন হিসেবে বাচ্চারা সেদিকে দৌড়চ্ছে। দুই, ক্যাথলিসিজমের মধ্যে সত্যি একটা স্পেক্টাক্যালের ব্যাপার আছে - গির্জাগুলির সুবিশাল উপস্থিতি, যীশুর প্যাশন, এগুলিকে ঘিরে পবিত্র দিনের উৎসব। আগামী প্রজন্ম বিশ্বাসের ছায়ায় বড় হয়েছে, স্পেক্টাক্যাল রয়ে গেছে, কিন্তু অবয়বটা আর নেই। আজকের দিনে যাকে ড্রোন শট বলে অনেকটা সেই ভঙ্গিতে ঝুলন্ত যীশুর হেলিকপ্টারটিকে রোম শহরের উপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখা যায়। নীচে ঝাঁ চকচকে আধুনিক ঘরবাড়ি কলকারখানা পরিলক্ষিত হয়। দুজন গৃহ-নির্মাণকর্মীকে দেখা যায় উড়ন্ত হেলিকপ্টারের দিকে হাত নেড়ে টাটা করতে। খৃষ্টধর্মের প্রভাবের ক্রমক্ষয়িষ্ণুতা এবং কন্সিউমার-সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের সূচক এই দৃশ্যগুলি। দুই গৃহ-নির্মাণকর্মী আক্ষরিক অর্থেই যেন হাত নেড়ে ক্যাথলিসিজমকে বিদায় জানায়। অতঃপর মার্সেলো রুবিনি (Marcello Mastroianni অভিনীত) ও পাপারাজ্জিদের হেলিকপ্টারটিকে প্রথমবারের জন্য দেখা যায়। যীশুকে ছেড়ে সিউমিংপুলের ধারে শুয়ে থাকা মেয়েদের দিকে তারা এগিয়ে যায়। খৃষ্টধর্ম থেকে বিযুক্তি এবং শারীরিক সুখের দিকে ধাবমান আধুনিক মানুষের প্রতীক-হিসেবে রুবিনি ও পাপারাজ্জিরা প্রথমেই চিহ্নিত হয়। কিন্তু মেয়েগুলি রুবিনিকে তাদের ফোন-নম্বর দিতে অস্বীকার করে। এই প্রত্যাখ্যানই আসলে রুবিনির ভবিতব্য, সারা ছবিজুড়ে আমরা সেটাই দেখবো। শারীরিক সুখ বা হেডনিস্টিক প্রবণতা যে খৃষ্টীয় আদর্শের বিপরীত এই ব্যাপারটাও এই ছবির প্রধানতম বক্তব্যগুলির একটি। বিত্ত-বৈভব যখনই সমাজে বেড়েছে হেডনিজম মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, এটা ইতালির সমাজে বহুকাল ধরেই পরিলক্ষিত। Gaius Petronius-র রচনা Satyricon থেকে ফেলিনি ১৯৭০ সালে Fellini Satyricon নামে একটি ছবি করেন। ছবিটি সম্রাট নিরোর সময়কালকে এই হেডনিজামের প্রেক্ষাপটে ধরে। রুবিনির সঙ্গে তার প্রেমিকা এম্মার সম্পর্ক মনস্তাত্ত্বিক-সমস্যার ঘেরাটোপে বন্দি। এম্মা অন্য-নারীদের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে রুবিনিকে ক্রমাগত সন্দেহ করে যায় । ব্যাপারটা অমূলকও নয়। আমরা রুবিনিকে দেখেছি ধনী ম্যাদালেনার (Anouk Aimée অভিনীত) সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে। সুইডিশ-আমেরিকান চিত্রতারকা সিল্ভিয়ার (Anita Ekberg অভিনীত) প্রতি রুবিনির লালসা বিখ্যাত নৈশ-অভিযানের দৃশ্যে পরিলক্ষিত। কিন্তু রুবিনির সেই লালসা চরিতার্থ হয় না। শারীরিক সুখের সন্ধানে রুবিনির এই একের পর এক প্রচেষ্টা আসলে শরীর-সর্বস্ব আধুনিক সভ্যতার ব্যর্থ সুখানুসন্ধান। ট্রেভি ফাউন্টেইনের জলধারা বন্ধ হয়ে যায়। কিংকর্তব্যবিমুঢ় ও দিকভ্রান্ত আধুনিক সমাজের প্রতীক রুবিনি ও সিল্ভিয়ার দিকে সাইকেল আরোহীসহ ছবির সমস্ত দর্শককুল যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এদিকে রোমান ক্যাথলিসিজমের অবস্থানটা কি? দুটি বাচ্চার কাছে ভার্জিন মেরীর অলৌকিক চেহারা প্রকাশিত হয়েছে - এম্মার পীড়াপীড়িতে রুবিনি ও এম্মা সেটা দেখতে শহরতলীতে যায়। এম্মার আশা এই উপলক্ষে যদি তাদের সমস্যাসঙ্কুল সম্পর্কেরও একটা মির‍্যাক্যাউলাস সমাধান ঘটে। কিন্তু এই গোটা ব্যাপারটাই সিরিয়াসনেস হারিয়ে দেখা যায় আদতে একটি টেলিভিশন ইভেন্টে রূপান্তরিত হয়েছে! পাপারাজ্জিরা চারিদিকে থিকথিক করছে। এদিকে একটি অসুস্থ মেয়েকে তার মা বাঁচার আশায় নিয়ে আসে। কিন্তু মেয়েটি মারা যায়। ভার্জিন মেরী কেন, কোন মিরাকলই ঘটে না। উপরন্তু অসুস্থ মেয়েটির মৃত্যুতে শোকাহত সকলে পরের দিন ভোর বেলা দেখতে পায় একজন পাদ্রি মেয়েটির মৃতদেহের পাশে বসে শোকগাথা পাঠ করছে! ফেলিনি যেন দেখাতে চান মৃত মানুষের প্রতি সন্মান-সহমর্মিতায় সাঙ্ঘঠনিক ধর্মের দিক থেকে কোনো অভাব নেই বটে, কিন্তু মিরাকল হল অসহায় মানুষের সর্বশেষ আশা যা ব্যর্থ হবে জেনেও সাঙ্ঘঠনিক ধর্ম তা প্রচার করে থাকে। মার্সেলো রুবিনি বস্তুত ফেদেরিকো ফেলিনিরই অল্টার-ইগো। গসিপ সাংবাদিকতার বাইরেও রুবিনির একটা সাংস্কৃতিক সত্তা আছে। সে একজন বড় উপন্যাসিক হতে চায়। সাংস্কৃতিক-অভিজাতদের সংস্পর্শে থাকার তার একটা বাসনা আছে। রুবিনি তার বন্ধু স্টেইনারকে খুবই সম্মান করে। রুবিনির চোখে স্টেইনার ‘আদর্শ মানুষ’। শৈল্পিক উপাদানে সুসজ্জিত স্টেইনারের প্রসাদপম বাড়ি, বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকা, তদুপরি তার অপূর্ব স্ত্রী ও দুই সন্তান – রুবিনির কাছে প্রকৃত অর্থে ‘La dolce vita’ বা ‘মিষ্টি জীবন’। রুবিনি ও এম্মা যেদিন স্টেইনারের বাড়িতে যায় সেদিন রুবিনি স্টেইনারকে বলে, “Your home is a refuge. Your children, your wife, your books, your extraordinary friends. I am wasting my life. I am not going anywhere. I had ambitions once…”। রুবিনি আসলে তার জীবনযাত্রার অন্তঃসারশূন্যতা অনুভব করে । কিন্তু চার্চে যাওয়া স্টেইনার প্রত্যুত্তরে অপ্রত্যাশিত ভাবে বলে, “Don’t do what I have done … I fear peace more than anything else. It seems to me like it’s a façade with hell hiding behind it.”। স্টেইনারের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে কিরকম একটা অস্বস্তি রয়েছে। স্টেইনারের জীবন আপাতদৃষ্টিতে সুখী ও আকর্ষণীয় লাগলেও, বোঝা যায় অন্তরালে কোথাও একটা গভীর দুঃখ-কষ্ট আছে। স্টেইনার যেন রোমের চাকচিক্যময় সমাজের পিছনের নৈতিক ভঙ্গুরতার প্রতীক। স্টেইনার তার দুই সন্তানকে মেরে নিজে আত্মহত্যা করে! ধর্মনিষ্ঠ অনুশাসন-যুক্ত সমাজ নাকি ধর্মহীন অনুশাসন-হীন উৎশৃঙ্খল সমাজ – এরকম কোনো বাইনারিতে কি আদৌ পৌঁছান সম্ভব? স্টেইনারের পরিণতি রুবিনির শেষ আশা ও বিশ্বাসের জায়গাটাকেও ধস্ত করে দেয়। উদ্দাম রাত্রি-শেষে ভোরবেলা রুবিনি যখন সমুদ্রের পাড়ে এসে দাঁড়ায়, মাঝিরা তখন একচোখ খোলা একটা বড় জেলি-মাছকে পাড়ে এনে তুলেছে। ফেলিনি এরপর রচনা করেন পৃথিবীর চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্লাইম্যাক্সটি। ঋত্বিক ঘটক যাকে মাইলেকেঞ্জেলোর ভাস্কর্যের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, La dolce vita-র সেই একমাত্র সরল-নিষ্পাপ মেয়েটি অন্তিম দৃশ্যে রুবিনিকে হাত নেড়ে ডাকে। ধর্ম-অধর্মের সীমানা ছাড়িয়ে যাবতীয় নৈরাশ্যকে অতিক্রম করে শাশ্বত মানবতার কাছে পৌঁছান ছাড়া আমাদের যে আর কোনো গত্যন্তর নেই।
    বিপ্লবের আগুন - পর্ব তিন - কিশোর ঘোষাল | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়৩[এই ফাঁকে প্রাচীন ভারতের দৈনিক কাল-বিভাগ নিয়ে একটু সংক্ষিপ্ত আলোচনা সেরে নেওয়া যাক। এই লেখায় সে প্রসঙ্গ বারবারই আসবে। আমাদের তিথি মতে যদিও দিনের হিসেবে কিঞ্চিৎ হেরফের হয়, তবে গড় হিসেব ২৪ ঘন্টাই ধরেছি। ১ দিন = ৮ প্রহর = ২৪ ঘন্টা = ১৪৪০ মিনিট = ৬০ দণ্ড। ১ দণ্ড = ৬০ পল = ২৪ মিনিট = ১৪৪০ সেকেণ্ড। ১ পল = ২৪ সেকেণ্ড। দিনের প্রহরের হিসাব কিছুটা এরকম – প্রথম প্রহর – প্রভাত – ৬ AM থেকে ৯ AM; দ্বিতীয় প্রহর – পূর্বাহ্ন – ৯ AM থেকে ১২ PM তৃতীয় প্রহর – মধ্যাহ্ন – ১২ PM থেকে ৩ PM; চতুর্থ প্রহর - অপরাহ্ন – ৩ PM থেকে ৬ PM পঞ্চম প্রহর – সায়াহ্ন – ৬ PM থেকে ৯ PM; ষষ্ঠ প্রহর – প্রদোষ – ৯ PM থেকে ১২ AM সপ্তম প্রহর – নিশীথ (মধ্যরাত্রি) – ১২ AM থেকে ৩ AM; অষ্টম প্রহর – প্রত্যূষ - ৩ AM থেকে ৬ AM] এখন এই বেলা আড়াই প্রহরে রাজপথে পথচারীর সংখ্যা বেশ কম। কয়েকজন রাজপুরুষ ঘোড়ার পিঠে দুলকি চালে নগর পরিদর্শন করছে। সকালের প্রথম প্রহরান্ত থেকেই বিপণিতে ক্রেতাদের ভিড় জমতে থাকে। এখন পথের দুধারের বিপণিগুলিও প্রায় ক্রেতাহীন। সূর্যের তেজ যত বাড়তে থাকে নাগরিক ক্রেতারা গৃহাভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। এই সময় বরং আশপাশের গ্রাম থেকে আসে গ্রাম্য লোকজন - ঘোড়া কিংবা গোশকটে। তাদের আশাতেই বণিকরা শূণ্য বিপণিতে ধৈর্য ধরে বসে থাকে। পড়শি বণিকদের সঙ্গে গল্পসল্প করে সময় কাটায়। সাধারণতঃ এই গ্রাম্য ক্রেতারা সরল হয়। কথার তুবড়িতে তাদের ভুলিয়ে ফেলা যায় সহজেই। তাদের সঙ্গে কিছুটা তঞ্চকতা করে, নাগরিক ক্রেতাদের তুলনায় বেশ দুকড়ি উপরিলাভ করে নিতে পারে বণিকেরা। তবে আজকাল গ্রাম্য ক্রেতারাও শহরমুখো হচ্ছে কম। আজকাল কিছুকিছু বণিক, গাধার পিঠে, বলদের গাড়িতে পসরা সাজিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ঘরের মেয়েরা সরাসরি তাদের পছন্দ মতো বাসন-কোসন, রান্নার সরঞ্জাম, মশলাপাতি, কাপড়চোপড়, প্রসাধনী সামগ্রী হাতে নিয়ে, নেড়েচেড়ে, দেখেশুনে কিনতে পারে। কারণ শহরে আসে পুরুষরা। বাবা হোক, স্বামী হোক, ছেলে হোক, ভাই হোক – পুরুষরা পুরুষই। তারা মেয়েদের পছন্দের ব্যাপারটা তেমন বোঝে না। উপরন্তু তাদের মনে হয়, শহুরে বণিকদের বাকচাতুর্যে পুরুষরা বড্ডো বেশি ভেবলে যায়। তারা প্রায়ই ঠকে, রদ্দি জিনিষ কিনে আনে, বেশি দামে। অতএব আজকাল মধ্যাহ্ন আহারে গৃহে যাওয়ার সময় পর্যন্ত শহরের বণিকদের সময় কাটে একঘেয়ে আলস্যে। কিন্তু আজ তেমনটা হল না। বানজারা মেয়েদের একটি দল, গান গেয়ে আর নেচে নেচে রাজপথের একপাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। তাদের চলায় যেন গন্তব্যে পৌঁছনোর কোন তাড়াই নেই! নাচ ও গানের আনন্দেই তারা যেন মত্ত। তারা কোথা থেকে আসছে কেউ জানে না। কোথায় যাবে তাও কেউ জানে না। তাদের ভাষা দুর্বোধ্য। আশ্চর্য তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ। ঝলমলে রঙদার – পরনে পা পর্যন্ত লুটোন ঘাগরা, বক্ষে চোলি। ওদের দলে আছে চারজন যুবক পুরুষ। বলিষ্ঠ চেহারা সকলের। তাদের পরনে রঙিন পাজামা আর কুর্তা। চারজনের মধ্যে তিনজন পুরুষ বাঁশি, ঝাঁঝর আর ব্যাঞ্জো বাজিয়ে নাচ গানের সঙ্গত করছে। তবে একজন – সেই মনে হয় সর্দার – দলের সবাইকে সামাল দিয়ে চলেছে। রাজপথের পথিকদের যেন কোন অসুবিধে না হয়, তাদের চলাফেরায় যেন কোন বিঘ্ন না আসে। বিপণি থেকে মানুষজন পথের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। উপভোগ করছে বানজারা দলটির নাচগান আর ওদের উজ্জ্বল বর্ণময় উপস্থিতি। এবং তার থেকেও তারা বেশি উপভোগ করছে, মেয়েদের অপরূপ রূপ আর যৌবন। তরুণ ও যুবক বণিকরা উচ্ছ্বসিত, আঃ মেয়ে তো নয় – যেন একঝাঁক প্রজাপতি উড়ে চলেছে। তাদের সকলের মনেও এখন উড়ছে ওই প্রজাপতির দল। অন্যদিকে বয়স্ক-বিজ্ঞ বণিকদের আড় চোখেও দর্শকামের আবেশ, কিন্তু মুখে বিরক্তি – কোথা থেকে জোটে এই নচ্ছার মেয়েছেলেগুলো, আমাদের ছেলেগুলোর মাথা খাওয়ার জন্যে? কোটালরা করছে কি, দূর করে দিক শহরের সীমানার বাইরে।ভিয়েনের রসের কড়াইতে আটকে থাকা মক্ষির মতো দলটির দিকে সকলের মন যখন আবিষ্ট, সেই সময়েই রাজপথে এসে পৌঁছল দুই ঘোড়ায় টানা সুসজ্জিত একটি রথ। রথের গতিতে ধীর লয়। রথের আরোহী চান না, রথের ঝাঁকুনিতে তাঁর পানপাত্রের পানীয় উছলে পড়ুক। অথবা রথের দ্রুত গতির ঝাঁকুনিতে ছিন্ন হয়ে যাক তাঁর মদিরার আবেশ। রথের আরোহী রাজ শ্যালক রতিকান্ত। তাঁর রথের দুপাশে সামনে পিছনে সমগতিতে চলেছে ছজন সশস্ত্র অশ্বারোহী রক্ষী। অনতিদূরের প্রমোদকানন থেকে, এই সময়েই, রতিকান্ত তাঁর বাস ভবনে ফেরেন। অহংকারী রতিকান্ত পথের দুধারের পথচারীদের কিংবা বিপণির বণিকদের মানুষের মধ্যেই গণ্য করেন না। পথের পাথরখণ্ড, অথবা পথের দুধারের গাছপালার দিকে তিনি যেমন নির্বিকার চোখে তাকিয়ে থাকেন, খেটে খাওয়া মানুষদের প্রতিও তিনি একই রকম উদাসীন। তবে পথচারীদের মধ্যে দৈবাৎ কোন সুন্দরী রমণীর দর্শন পেলে, তিনি মৎস্যলোভী শিকারী বিড়াল হয়ে ওঠেন। আজ পথের পাশে নাচ-গান গাওয়া বানজারা মেয়েগুলিকে দেখে তাঁর চক্ষুস্থির হয়ে গেল। সুন্দরী, যুবতী এবং নৃত্যগীত পটিয়সী এতগুলি রমণীর একত্র দর্শন পাওয়া – এ যে অভাবনীয় সৌভাগ্য। তিনি সারথিকে রথ থামানোর নির্দেশ দিলেন। রথ থামলে তাঁর পাশে পাশে চলতে থাকা অশ্বারোহী রক্ষীকে তিনি বললেন, “অ্যাই, যা তো, মেয়েছেলেগুলোকে আজ সন্ধেবেলা আমার প্রমোদ ভবনে আসার জন্যে নেমন্তন্ন করে আয়। আমি কে পরিচয় দিবি। আর বলবি প্রত্যেকের দুহাত ভরে সোনার মুদ্রা উপহার দেব। ভাল করে বুঝিয়ে বলবি, হতভাগা তোরা যা হোঁৎকা আর মাথামোটা...”।রক্ষীপুরুষ দলটির কাছে গিয়ে রতিকান্তর বার্তা দিতেই, মেয়েগুলি নাচ-গান থামিয়ে দিল। একটি মেয়ে গলা চড়িয়ে উত্তর দিল, “আমরা নাচগান করি মনের আনন্দে। আমরা বারনারী নয় হে, যে কেউ ডাকলেই তার নাট মহলে গিয়ে ধেই ধেই নেত্য করে বেড়াব। কথাটা আপনার ছোটরাজাকে স্পষ্ট করে বলে দিন, হ্যাঁ”।রতিকান্ত রথে বসে মেয়েটিকে মন দিয়ে দেখলেন, তার কথাও শুনলেন। মুগ্ধ চোখে মেয়েটিকে দেখতে দেখতে তিনি ভাবলেন, এমন জিনিষের স্বাদ তিনি বহুদিন পাননি। আহা, কী ঝাঁজ, কী তেজ, যেমন বুক তেমনে তার বুকের পাটা। নিজের বুকে ওই বুকের স্পর্শই যদি না লাগল – তা হলে তিনি কিসের রাজশ্যালক? রতিকান্ত অন্য রক্ষীকে বললেন, “অ্যাই যে, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? ওই মেয়েটাকে তুলে নিয়ে বন্দী কর। বেশী ট্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করলে সবকটাকেই ধরে কয়েদ কর – তারপর আমি দেখছি”। রক্ষীদের কর্তব্য রতিকান্তকে রক্ষা করা। তাঁকে কেউ আক্রমণ বা আঘাত করতে এলে, তাকে বন্দী করা কিংবা প্রয়োজনে হত্যা করা। কিন্তু এই নির্বিবাদী বানজারা দলটি কাউকেই আঘাত বা আক্রমণ করেনি। এক্ষেত্রে ওদের বন্দী করার কোন অধিকার তো তাদের নেই। রতিকান্তর আদেশ পেয়েও রক্ষীরা যখন ইতস্তত করছে, ঠিক তখনই অকুস্থলে উপস্থিত হল জনা ছয়েক অশ্বারোহী নগররক্ষী। তারা রক্ষীদের কথা শুনেই দ্রুত সক্রিয় হয়ে উঠল এবং ঘোড়া ছুটিয়ে ঘিরে ফেলল বানজারাদের দলটিকে। বাতাসে চাবুক চালাতে লাগল সপাসপ। চেঁচিয়ে উঠল “ছোটরাজাকে তোরা চিনিস না? তাঁর আদেশ অমান্য করার সাহস হয় কী করে? মানে মানে আমাদের সঙ্গে চল, নয়তো চাবকে পিঠের ছাল তুলে দেব”। দলের যে যুবকটিকে মনে হয়েছিল দলের সর্দার, সে মাটিতে পড়ে থাকা একটা ঝোলা থেকে ছোট্ট একটা বল্লম বের করে হাতে তুলে নিল। সেই বল্লমের ফলা দুপুরের রোদে ঝলসে উঠল আক্রোশে এবং মুহূর্তের মধ্যে সেটি উড়ে গিয়ে গিঁথে গেল রতিকান্তর গলার ঠিক পাশে আসনের পিঠে। এক চুলের জন্যে বেঁচে গেল রতিকান্ত। আচমকা এই ঘটনায়, মেয়েগুলিকে ছেড়ে নগররক্ষীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল যুবকটির ওপর। প্রহার করতে করতে মোটা রজ্জুতে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল তাকে। তারপর তুলে দিল একটি ঘোড়ার পিঠে। বন্দী যুবককে নিয়ে নগররক্ষীরা চলে যাওয়ার আগে, তারা এসে দাঁড়াল রতিকান্তর রথের পাশে। একজন নগররক্ষী মাথা নত করে বলল, “আমাদের অপরাধ মার্জনা করবেন, প্রভু। এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। আপনি সুস্থ আছেন তো?” আতঙ্কে বিবর্ণ মুখ, রতিকান্তর জিভও শুকিয়ে গিয়েছিল। তিনি কোনমতে বললেন, “না, কই? তেমন কিছু তো হয়নি। ঠিকই আছি”।সেই নগররক্ষী আসনের পিঠে গিঁথে থাকা বল্লমটি খুলে নিয়ে বলল, “দুশ্চিন্তা করবেন না, প্রভু। আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান। আজ রাত্রে হতভাগাকে অন্ধকার কারাগারে নির্জলা উপবাসে রেখে দেব। আগামীকাল প্রথম প্রহরেই ওকে রাজপথের চৌরাস্তার স্তম্ভের পাশে শূলে চড়িয়ে দেব। সকল নাগরিক দেখুক, বুঝুক - এ রাজ্যে দুর্বৃত্তের কী পরিণতি হয়”। কিছুটা ধাতস্থ হওয়া রতিকান্ত হতাশ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু ওই মেয়েগুলো? তারা তো পালিয়ে গেল!” “ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না, প্রভু। ওই দলের প্রত্যেককে আমরা অচিরেই খুঁজে বের করব। তারপর বন্দী করে আপনার সামনে এনে দাঁড় করাব। অনর্থক আপনার অনেক বিলম্ব হল প্রভু, এবার আপনি রওনা হোন। আপনার যাত্রা নির্বিঘ্ন হোক”। নগররক্ষী ইশারা করতে সারথি রথ চালনা শুরু করল, এবং আগের মতোই ছজন অশ্বারোহী দেহরক্ষী চলল সঙ্গে। বন্দী যুবককে নিয়ে নগররক্ষীরাও দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দিল উলটো দিকে। ওদিকেই নগর কোটালের কার্যালয়, বন্দীশালা ও কারাগার। এই গোলমালের শুরুতেই বিপণির ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছিল বণিকরা। আড়াল থেকে নজর রাখছিল পরিস্থিতির ওপর। এ ধরনের ঘটনায় তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কারণ তাদের অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানে, এই ধরনের বিশৃঙ্খলা হলেই, সাধারণ জনতা, নগররক্ষী সকলেই বিপণিগুলি এবং বণিকদের উপর চড়াও হয় - অকারণ মারধোর করে এবং লুঠ করে নেয় বিপণির মূল্যবান সামগ্রী। এখন রাজপথ জনশূণ্য। পথে একজনও পথচারী নেই। আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বণিকেরা তাদের সকল বিপণিগুলির দরজা দ্রুত বন্ধ করে ফেলল। তারপর একত্রে ঘরের দিকে যেতে যেতে আলোচনা করল, আজ সন্ধ্যায় আর বিপণি খুলে কাজ নেই। আগামী কাল সকালে পরিস্থিতি বুঝে যা হোক একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। ক্রমশ...
    ভুলভুলাইয়ায় ছনেন্দ্রনাথ - রমিত চট্টোপাধ্যায় | অলংকরণ: রমিত চট্টোপাধ্যায়সেদিন সকালে তেতলার পিসিমার ঘরে বসে এক মনে ড্রয়ার ঘাঁটছিল ছেনু। ওটা আসলে মহারাজ ছনেন্দ্রনাথের রত্ন ভান্ডার। যত রাজ্যের উদ্ভট জিনিসের ভিড় থেকে মনমতো জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে একটা বল্টু লাগানো লম্বা স্ক্রু ভারি পছন্দ হয়েছে, বল্টুটা খুলতে যাবে, ঠিক এমন সময় দোতলা থেকে হইচই কানে এল। শেয়ালদার মতো ব্যস্ত এলাকায় হট্টগোল তো সর্বক্ষণ লেগেই আছে, কিন্তু এই হইচই এর শব্দটা ভারি মিঠে, আর তার মধ্যে একটা চেনা চেনা গলাও উঁকি দিচ্ছে, তাই ছেনু আর থাকতে পারলো না, স্ক্রুটা ফেলে রেখে সিঁড়ি দিয়ে এক দৌড়ে নিচে নেমে এল। এসে দেখে যা ভেবেছে ঠিক তাই, দিম্মা এসেছে! সাথে এসেছে মামা, হাতে দইয়ের হাঁড়ি আর বাক্স-প্যাঁটরা। ছোড়দা আজ কলেজ যায়নি, সব জিনিসপত্র ধরে টরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। মামা ঘরে ঢুকেই বলে দিল, আমার কিন্তু দুপুরেই ট্রেন। শুনেই মা শিগগির গিয়ে রান্না চাপালো। মামা কিছুদিনের জন্য কৃষ্ণনগর ফিরেছিল, আবার এখান থেকে চলে যাবে সেইই বিলাসপুর। কলকাতায় তো আসতেই হবে ট্রেন ধরতে, তাই দিম্মাও বলেছে চল ক'দিন ঘুরে আসি কলকাতা থেকে। দিম্মাকে পেয়ে ছেনুর আনন্দ আর দেখে কে! এবার অনেকদিন পর এসেছে। ছেনু বলে, মামা আবার না ফেরা পর্যন্ত তুমি এখানেই থাকবে। দিম্মা হেসে ফেলেছে, সে কবে ফিরবে তার ঠিক আছে? তার আগেই আবার যে অন্য ব্যাপার আছে। - কী ব্যাপার? বলো না!- সে বলব'খন, বলা কি পালিয়ে যাচ্ছে!দুপুরে তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে মামা ছুটলো ট্রেন ধরতে, ছোড়দা সাথে মালপত্র নিয়ে যেতে চাইছিল কিন্তু মামা তাকেও এক ধমক লাগিয়েছে, শেয়ালদা থেকে ট্রেন হলে কথা ছিল, এইটা হাওড়া থেকে, তোমায় অদ্দুর ছুটতে হবেনা। তাই শুধু বাসে তুলে দিতে গেছে।খাওয়াদাওয়ার পর খাটে শুয়ে মা, দিদিমা আর বড়দি মিলে নানান গপ্পে মেতেছিল। ছেনু শুধু থেকে থেকেই ভাবছে ওই সেই ব্যাপারটা কী, দিম্মা যেটার কথা বলবে বলছিল পরে। চুপিচুপি দইয়ের হাঁড়িটা থেকে চামচ দিয়ে কিছুটা দই খাওয়ার পর ছেনু প্রথমে ঠিক করল, বদ্দি এখন শুয়ে, এই সুযোগে ওর আঁকার পেনসিলগুলো নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক, তারপর আর থাকতে না পেরে দিম্মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, বলো না, সকালে কী বলবে বলছিলে। কি একটা ব্যাপার যেন। দিম্মা হেসে বলে ও আচ্ছা আচ্ছা, বলছি, শোও এখেনে। মেয়েকে বলেন, শোন, তোদের সব্বাইকে কিন্তু কৃষ্ণনগর যেতে হবে, মানকের ছেলের বিয়ে।মা বলেন, মানিক কাকা, আমাদের পাশের বাড়ির?- হ্যাঁ রে বাবা, এই বিষ‍্যুদবারের পরের বিষ‍্যুদবার। মানকে নিজেই আসতো নেমন্তন্ন করতে, আমি বললাম, আমি তো যাচ্ছিই, ওদের কার্ডটাও আমার হাতে দিয়ে দে। তোদের সবাইকে যেতে বলেছে কিন্তু।- সবার তো আপিস কাছারি, ইস্কুল, কলেজ রয়েছে। এদের ফেলে কী করে যাব বলো তো! তুমি একাই যেও বরং।- সে কী! তোরা না গেলে আমি যাব কী করে? তোরা কেউ যাবি না? আচ্ছা ছোট্টুকে নিয়ে যাবো? (ছেনুকে) কি গো, তুমি পারবেনা আমায় নিয়ে যেতে?- মা, ও তো ছোটো, ও কি করে পারবে?কৃষ্ণনগর তো দূর, ছেনু আজ অব্দি উল্টোডাঙ্গা পর্যন্তও একা একা বেড়াতে যায়নি। এই সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়! ছেনু ছুট্টে গিয়ে আলনা থেকে বড়দার একটা ফুলপ্যান্ট বের করে, পায়া গুটিয়ে পরে চলে এল, কোমরটা ঢলঢলে, তাই এক হাতে ধরে চোখ বড় বড় করে বলল, আমি ছোটো? এই দ্যাখো এখন আমি ফুলপ্যান পরি। আমি ঠিক তোমায় নিয়ে যেতে পারবো। কীভাবে দিম্মা সেদিন মাকে রাজি করিয়েছিল কে জানে, তবে ছেনুর উৎসাহে আর দিম্মার আশ্বাসে শেষ অব্দি ঠিক হলো ছেনু আর দিম্মা মিলে ট্রেনে চেপে কৃষ্ণনগরে যাওয়া হবে।উৎসাহের চোটে এর পরের দিনগুলো কিভাবে ফাস্ট ফরোয়ার্ড হয়ে গেল, কেউ আর টের পায়নি। যাইহোক আমরা একেবারে যাওয়ার দিনে গিয়েই দেখি কী কান্ড চলছে! সকালবেলার ট্রেন, বাড়ির কাছেই শেয়ালদা থেকে ছাড়বে, ছেনু ও তার দিদিমাকে ট্রেনে তুলতে সবাই মিলে হাজির হয়েছে। ওঠার আগে মহারাজ একবার শাঁ করে ছুটে ইঞ্জিন অব্দি দেখে এলেন। বাড়ির কাছেই স্টেশন হওয়ার দৌলতে ট্রেন ব্যাপারটা একেবারে অচেনা বস্তু নয়, একবার দুবার চেপে দেখাও হয়েছে। হঠাৎ হাপিস হয়ে যাওয়ায় মা কষে বকুনি লাগালো, সবসময় দিম্মার হাত ধরে থাকবি, একদম কাছছাড়া হবি না, ওখানে গিয়ে দিম্মার কথা শুনে চলবি, ইত্যাদি নানান ভাষণ। ছোড়দা পাশ থেকে বলে উঠল ওখানকার মহারাজ কিন্তু ভীষন কড়া, দুষ্টুমি দেখলেই ধরে শূলে চড়িয়ে দেয়! ছেনুর উত্তরও সাথে সাথে তৈরি, কেন গোপাল ভাঁড় আছে না, ঠিক বাঁচিয়ে নেবে আমায়। এরকম নানা হাসি মজা, ট্রেনে উঠে সাথে বেঁধে দেওয়া চিড়ে, মুড়ির সদগতিকরণের ও কোনো স্টেশনে না নামার উপদেশ দেওয়া, শেষ মুহূর্তের প্রণাম টনাম ইত্যাদির শেষে সিটে বসতেই ভোঁ বাজিয়ে ট্রেনটা হুশ করে ছেড়ে দিল।ট্রেনে যেতে যেতে বেশ ভালোই লাগছিল, জানলার ধার দেখে ওরা বসেছে, হু হু করে হাওয়া লাগছে মুখে। বাইরের দৃশ্য ক্রমশ বদলে বদলে যাচ্ছে, তখন কলকাতার আশপাশ একটু পেরোলেই বেশ দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ক্ষেত, গাছপালা চোখে পড়ত। ছেনু সেসব মুগ্ধ হয়ে দেখে চলেছে, হঠাৎ হুঁশ ফিরল একটু দূর থেকে আসা ঝালমুড়িওলার ডাকে। দিদিমার হাত ধরে বায়না করা শুরু, ঝালমুড়ি খাবে? দিদিমা প্রাজ্ঞ মহিলা, তিনি বুঝলেন ট্রেনে চেপে গেলে স্টেশন ও ফেরিওয়ালা পরপর আসতেই থাকবে, সাথে ছেনুর বায়না, তাই যা করার শুরুতেই করতে হবে। তিনি ফিসফিস করে বললেন, ছোট্টুবাবু, তুমি তো জানো না, ট্রেনের খাবার একদম খেতে নেই। ওই খাবারে ঘুমের ওষুধ মেশানো থাকে, খেয়ে যেই কোনো ছোট বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়ে, ওমনি তাদের ধরে বস্তায় করে আরবে না কোথায় পাঠিয়ে, সেখানে উটের দৌড় করায়। তাতে না জিততে পারলে আর খাবার দেয়না। তুমি কি উটের দৌড়ে যাবে? উটের দৌড় ব্যাপারটা মন্দ না লাগলেও, না খাইয়ে রাখাটা মহারাজের ঠিক মনঃপূত হলো না। তাই আর বাকি রাস্তা তেমন বায়না টায়না ধরলেন না। সঙ্গে আনা মুড়ি-চিঁড়েরই সদ্ব্যবহার করা হল।মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাটেই ট্রেন কৃষ্ণনগর পৌঁছল।স্টেশনে নেমেই ছেনুর কি আনন্দ, দ্যাখো ঠিক তোমায় একা একা নিয়ে চলে এলুম! স্টেশনের ধার থেকে রিকশা চেপে বাড়ি পৌঁছুনো গেল। ওখানকার লোকেরা কেউ ছেনুকে আগে দেখেনি। মহারাজের বেশ ভালোই খাতিরদারি জুটল। তবে বাড়ির ছেলের বিয়ে ছিল আগের দিন, আজ বউ নিয়ে ফিরবে বলে সবাই সারাক্ষণই দৌড়াদৌড়ির মধ্যে রয়েছে। তার মধ্যেই আশেপাশের কয়েকটা নতুন দাদা আর দিদির সাথে ছেনুর আলাপ জমেছে। ওদের সাথে সাথে এবাড়ি ওবাড়ি ছোটাছুটি করছে, লুকোচুরি খেলা চলছে। মাঝে এক ফাঁকে এসে দিম্মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এখানে গোপাল ভাঁড়ের বাড়িটা কোথায় গো ? আমায় নিয়ে যাবে একবার? দিম্মা কি আর করে, বলল, এখান থেকে বেশ দূর তো, পরে নিয়ে যাব'খন। এমনি সময় হঠাৎ হইচই বেঁধে গেল, বউ আসছে, বউ আসছে! যারা বরণ করবে, সবাই তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল বরণডালা হাতে। প্রথমে উলু দিয়ে, তারপর হরেক কলাকৌশল পার করে বউকে নিয়ে বর মহাশয় ভিতরে ঢোকার সুযোগ পেলেন। ছেনু অবাক হয়ে বর-বউয়ের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। বাড়ির ভিতরে ঢুকেও তাদের নিস্তার নেই! আবার কি একটা পুজো গোছের হলো। পুজো শেষে নিয়ম ছিল, একটা বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে মিষ্টি খাওয়াতে হয়। বাড়ির সমস্ত বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো হওয়ার সুবাদে ছেনুরই কপাল খুলল। নতুন বউ কোলে বসিয়ে ছেনুকে একটা মিষ্টি খাইয়ে হাতেও নাড়ু, মিষ্টি, ফল, টল গুঁজে দিল। তখনই আরেকটা পুঁচকে দিদি (ছেনুর থেকে বয়সে খুব বেশি না, বছর তিনেক বড় হবে হয়তো) এসে বলল, দাও দাও আমার কোলে দাও ওকে একটু ঘুরিয়ে আনি। ছেনু হেঁটে হেঁটেই ঘুরে অভ্যস্ত। হঠাৎ তাকে আজ সবাই কোলে নিচ্ছে, ও একটু অবাক! পুঁচকে দিদিটা বাইরে নিয়ে গিয়েই ওকে কোল থেকে নামিয়ে বলল, এইনে, তুই ফলটা খা কেমন, বলে নাড়ু আর মিষ্টিগুলো হস্তগত করে হাওয়া। আচমকা এই ছিনতাইয়ে ছনেন্দ্রনাথ হতচকিত!পরদিন রাতে বৌভাত। পাশের বাড়ির ছাদে প্যান্ডেল করে খাওয়াদাওয়া হচ্ছে। পাশের বাড়ির লোক হয়ে তো আর শুরুর ব্যাচেই বসে পড়া যায় না। দিদিমা একটু রাতের দিকেই খেতে গেলেন ছেনুর হাত ধরে। দিদিমা শুধুই লুচি মিষ্টি খাবেন, পাত পেড়ে বসবেন না। সারাদিনের এত খেলাধুলো, দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত ছেনুর চোখ জুড়ে তখন খালি ঘুম নেমে আসছে। খেতে বসেই মাঝে মাঝে ঢুলে পড়ছে। ছেনুর পাশেই বসেছেন এক মাস্টারমশাই (মাস্টার মশাই আরেকটু দিই আরেকটু দিই ডাক থেকে ছেনুর অনুমান)। ছেনু লুচি-বেগুনভাজা খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়লে, সেই মাস্টারমশাই মাঝে মাঝে বাঁহাতের ঠেলায় জাগিয়ে দিচ্ছেন, ও খোকা খাও! ভাত ভাঙো। আবার ছেনু ঘুমচোখে জেগে উঠে দেখে পাতে আরো কি কি সব দিয়ে গেছে। সেদিন শেষমেষ ঘুমচোখ আর মাস্টার মশাইয়ের ক্রমাগত উৎসাহের ঠেলায় ছেনু যে কী কী খেয়েছিল, পরদিন সকালে আর তেমন মনে টনে ছিল না।পরদিনটাও সকাল থেকে বেশ আনন্দেই কাটছিল। ওদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ছেনু চুপটি করে দিম্মার পাশে শুয়েছিল। মাঝে একবার বাথরুম পেয়েছে, বাথরুম সেরে এসে আবার শুয়ে পড়ল। এরপর একটা আজব কান্ড! মাঝে মাঝেই ছেনুর বাথরুম পাওয়া শুরু হল। মানে ছেনু ফিরছে আর দিম্মা জিজ্ঞেস করছে, কই গেছিলি। ছেনু বারবার বলে বাথরুমে। দিম্মা অবাক, অনেকটা জল খেয়ে নিয়েছিলি বুঝি! ছেনু তাতেই দুষ্টু হেসে মাথা নাড়ে। এরকম বার পাঁচেক হওয়ার পর দিদিমাও পিছু পিছু গিয়ে দেখেন, বাথরুম টাথরুম কিচ্ছু না! ছেনু একবার করে উঠছে আর কৌটো থেকে দুটো করে বিস্কুট বের করে মুখে পুরছে। দিম্মা ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলে, এইবার বুঝেছি, এতবার বাথরুম পায় কী করে! আসলে চট করে উড়ে যাওয়ার ভয়ে, শেয়ালদায় বিস্কুটের টিন ছেনুর হাতের নাগালের বাইরে রাখা থাকে, আর এখানে একেবারে টেবিলের ওপরেই রাখা, আর কি জানি কেন, তাই দেখে ছেনুর খিদেটাও আজ মোক্ষম চাগিয়ে উঠছিল।বিকেলের দিকে পাশের বাড়ির একটা দাদা এসে দিম্মাকে বলল, ও জেঠি, মাঠে খেলা হচ্ছে, ছেনুকে নিয়ে যাব? দিম্মা বলল, হ্যাঁ যা, কিন্তু ছোট্টুকে চোখে চোখে রাখবি, আর ফেরার সময় সাবধানে নিয়ে আসবি। দাদাটা ঘাড় নেড়ে ছেনুকে সাইকেলে চাপিয়ে রওনা দিল। ক্যারিয়ারে বসে আশপাশ দেখতে দেখতে অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে মাঠে পৌঁছে ছেনু দেখল, বিশাল বড়ো মাঠ। যেসব দাদারা ফুটবল খেলছে, তারা অনেক বড়। বেশির ভাগই ছোড়দার মতো ঢ্যাঙা, কি জোরে জোরে দৌড়াচ্ছে! অনেকেই মাঠের পাশে বসে খেলা দেখছে। দাদাটা ছেনুকে মাঠের ধারে বসিয়ে বলল, এখানে বসে খেলা দ্যাখ, বাড়ির ফেরার সময় আবার একসাথে সাইকেলে করে ফিরব, অন্য কোথাও যাবি না কিন্তু! এই বলে দাদা সাইকেল এক কোণে রেখে ওর বন্ধুদের দলে মিশে গেল। ছেনু মন দিয়ে খেলা দেখছে, সবাই শাঁই শাঁই করে ছুটছে, দমাস দমাস করে শট মারছে গোলে। ছেনুদের গলির ফুটবলের সাথে এর বিস্তর তফাৎ। এদের খেলা দেখে ছেনু মনে মনে ঠিক করল, খেললে এদের মতোই খেলতে হবে, বড়ো বড়ো গোলপোস্ট, বড় ফুটবল নিয়ে। ম্যাচ বেশ জমে গেছে, পর পর গোল হচ্ছে। দু'দলের গোলকিপারই বেশ কাঁচা, ওদের দেখে ছেনুর ইচ্ছে করছিল, যদি দাদাদের মতো লম্বা হওয়া যেত চট করে, তাহলে ও-ই লাফিয়ে লাফিয়ে গোলগুলো বাঁচিয়ে দিত। ধীরে ধীরে এক সময়ে খেলা থিতিয়ে ম্যাচ শেষ। আলো কমে আসছে, প্রায় সন্ধে নামে নামে। মাঠও প্রায় ফাঁকা হয়ে আসছে, যারা ধারে বসে খেলা দেখছিল, তারাও একে একে বাড়ির পথ ধরেছে। ছেনুর সম্বিৎ ফিরতে আশেপাশে তাকিয়ে সেই দাদাকে খোঁজে, তাকে আর দেখা যাচ্ছে না! যেখানে সাইকেলটা রেখেছিল, সেখানে গিয়ে দেখে সাইকেলটাও নেই। পাশে একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, আমার দাদাকে দেখেছো? সে কার একটা সাথে কথা বলছিল, ছেনুকে খেয়াল না করেই আলগোছে উত্তর দিল, দ্যাখো না কাছাকাছিই আছে কোথাও। এবার মহারাজ একটু সাহস পেয়ে ভাবলেন, ঠিকই তো, আশেপাশেই আছে নিশ্চই। আমি হাঁটা লাগাই, কতো আর বড় জায়গা হবে এই কৃষ্ণনগর, রাস্তায় ঠিকই দেখতে পেয়ে যাব। তখন সাইকেলে উঠে বসলেই হবে। ও আঁতি পাতি করে মাঠের চারধারে খুঁজে আসলো, কোথাও দাদার দেখা নেই! বুকে খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে এবার রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করল, বাড়ির পর বাড়ি, রাস্তার পর রাস্তা, দোকানের পর দোকান, সব পার করে ছেনু বুঝতে পারল, দাদাটা নির্ঘাৎ ওকে ফেলে রেখে বাড়ি চলে গেছে, তাই সেই দাদাকে আর না খুঁজে একা একা বাড়িতে ফিরে যাওয়াই মনস্থির করে ফেলল। সাইকেলে চেপে আসার সময় যে রাস্তা দিয়ে এসেছে, সেটা কি আর চিনতে পারবে না! বাড়ি ফেরা আর কতই বা কঠিন হবে! যে রাস্তা ধরে এলাম, সে রাস্তা ধরে সোজা গেলেই হলো। কিন্তু হায়, এ তো আর শিয়ালদার বৈঠকখানা নয়, কৃষ্ণনগর! ছেনু চেনা ভেবে যে গলিতেই ঢুকতে যায়, গিয়ে দেখে এটা তো নয়, তবে ওই যে আরেকটা গলি দেখা যাচ্ছে, ওটাই হয়তো হবে। এভাবে গোটা ছয়েক রাস্তা, গোটা সতেরো গলি ও সাথে খান সাতেক কানা গলি ঘুরে ছেনু উপলদ্ধি করল, ভুলভুলাইয়া কাকে বলে! ছোড়দা যে মাঝে মাঝে ভয় দেখাতো, লখনৌর ভুলভুলাইয়ায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেবে, সেটা যে কৃষ্ণনগরেই আছে এটা তার জানার বাইরে ছিল। যতটা সাহসের পুঁজি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, নতুন এক একটা গলিতে ঢোকার সাথে সাথে সেই পুঁজিটা ক্রমশ কমে কমে আসছে। পা'ও ব্যথা করছে। এক সময় মনে হল, আর পারা যাচ্ছে না, ডাক ছেড়ে কেঁদেই ফেলবে বুঝি। কিন্তু হাজার হোক মহারাজ তো, আরেক মহারাজের ডেরায় এসে কেঁদে ফেলা কি উচিত হবে! এমনি সময় একটা ফাঁকা গলিতে হঠাৎ পেছন থেকে সাইকেলের হর্ন শুনে ছেনু ফিরে তাকালো। নাঃ, দাদা তো নয়, একটা কাকু সাইকেল চালিয়ে আসছে। কাকুটা ওকে কাঁদো কাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাইকেল থেকে নেমে এসে বলল, খোকা তোমার বাড়ি কোথায়? অন্য সময় হলে 'খোকা' ডাকে ছেনু খুব চটে যেত, কিন্তু এখন তারই বিপদ, কী করা যাবে! ছেনু বলল, শেয়ালদা। কাকু তো সেই শুনে অবাক, সে কী! তুমি এখানে এলে কী করে? ছেনু বলে, দিম্মার সঙ্গে এসেছিলাম, এখানে আমার দিম্মার বাড়ি।- তাই বলো। তুমি কি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছ? ছেনু হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়তে কাকু বললেন, তোমার দিম্মা কোথায় থাকে বলো, আমি পৌঁছে দিচ্ছি।ছেনু যেন চোখের সামনে স্বয়ং দেবদূতকে দেখতে পেল। ওর চোখদুটো আনন্দে হেসে ওঠে, মাথা চুলকে বলল, ওই তো কাছেই দিম্মার বাড়ি, মানে, ওই যে বিয়েবাড়িটার পাশে। বলার পরেই ছেনু বুঝতে পারল, দিদিমার বাড়িটা নিশ্চই চেনা, কিন্তু বাড়িটা যে আসলে কোথায় সেটা সে একদমই জানে না! আসলে পুরো কৃষ্ণনগর শহরটাই তো তার কাছে এক্কেবারে নতুন।বুঝতে না পেরে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, কাদের বাড়ির বিয়ে বলোতো? তোমার দিদিমার নাম কি? আর কে থাকে সাথে?- নাম তো জানি না, সাথে মামা থাকে, কিন্তু মামা তো এখন বাইরে।- মামার নাম কী?- মামা? (কি যেন নামটা! ছেনুর কিছুতেই মনে পড়ে না)- বুঝেছি, সাইকেলে ওঠো, দেখি তোমার দিদিমার বাড়ি খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। ছেনুর বুকটা একটু ঢিপ ঢিপ করছিল। লোকটাকে চেনেনা, জানেনা, বিদেশ বিভুঁই জায়গা, সাইকেলে ওঠা কি ঠিক হবে! তাও, যা থাকে কপালে, ছেনু ক্যারিয়ারে চেপে বসল।কাকু এতক্ষণ ঘুরে আসা রাস্তা গুলো আবার খানিকটা পাক মেরে, অন্য রাস্তায় এসে, ছেনুকে জিজ্ঞেস করল, এখানে কিছু চেনা লাগছে? ছেনু মাথা নাড়ে। -জোরে বলো, আমি তো দেখতে পাচ্ছি না তোমায়।- এখানে নয়।আরও নানান রাস্তা ঘোরার পরেও ছেনুর উত্তর একই দাঁড়ালো। শেষে হতাশ হয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎ ছেনুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আচ্ছা কাকু, তুমি এখানকার রাজবাড়িটা চেনো ?কাকুও হঠাৎ রাজবাড়ির কথা শুনে উৎসাহিত হলেন, ওদিকেই তোমার দিদিমার বাড়ি বুঝি?-না দিম্মার বাড়ি তো ওখানে নয়, কিন্তু, ওখানে গেলে তো গোপাল ভাঁড়কে পাওয়া যাবে, ও নিশ্চয়ই একটা বুদ্ধি বের করবে!কাকু এবার ভয়ানক রেগে গেলেন, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি তোমার বাড়ি খুঁজতে গিয়ে আর এদিকে তুমি ইয়ার্কি মারছ! গোপাল ভাঁড় আষাঢ়ে গপ্পের লোক, তাকে খুঁজে তুমি বুদ্ধি নেবে? একদম চুপটি করে বসে থাকো, তোমায় এমন জায়গায় নিয়ে যাব, সব ইয়ার্কি বেরিয়ে যাবে! (বোঝা যাচ্ছে গল্প কাহিনীর চরিত্রকে বাস্তব ঠাউড়ানোর বিপদ চিরকালই ছিল, তা ছনেন্দ্রনাথকে নয় ছোটো বলে মাফ করে দেওয়া যায়)এই না বলে কাকু শাঁ শাঁ করে স্পিড তুলতে শুরু করেছে সাইকেলে। ছেনুর এবার ভীষণ ভয় লাগছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে রে বাবা, সেই আরব না কোথায় পাঠিয়ে দেবে না তো! উটের পিঠে বসিয়ে দৌড় করাবে, না খাইয়ে রেখে দেবে? তাহলে তো আর কোনো দিনই ফেরা হবে না শেয়ালদায়! পড়ে রইল মা, দাদা, দিদিরা, পড়ে রইল তেতলার রাজত্ব। আহা, ছোড়দার সেই মোক্ষম গাঁট্টাগুলোও যেন এখন মিষ্টি মনে হচ্ছে। ছেনু তবু নিজেকে মনে মনে সান্তনা দেয়, যাক আর কিছু না হোক একবার উটের পিঠে তো অন্তত চাপা হবে। তাই সই। মহারাজ ছনেন্দ্রনাথ এবার থেকে শুধুই এক উট চালানেওয়ালা। মুখ গোঁজ করে ক্যারিয়ারে চুপ করে বসে থাকে। হাওয়া এসে কানে ঝাপটা মারছে। নোনতা জলের ধারা টোবলা গালদুটো বেয়ে নেমে আসে।"অ্যাইইই! আমার নাতিটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? ওরে তোরা দেখ রে, ছোট্টুকে কোথায় নিয়ে চলে গেল!"হঠাৎ চেনা গলা কানে আসতেই, ছেনু সাহস ফিরে পেয়ে লোকটার পিঠে জোরসে খিমচে দিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়ে কাকু দুম করে ব্রেক মারতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে ভূপতিত! ছেনু সেই সুযোগে সাইকেল থেকে নেমে কাঁদতে কাঁদতে দিম্মার দিকে দৌড় মারে। "ও দিম্মা গো, আমি উটে চাপবো না দিম্মা, আমাকে বাঁচাও!" ছেনু দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে।দিদিমা তখন বাড়ির কাছের মিষ্টির দোকান থেকে নাতির জন্যই একটু কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত সরপুরিয়া কিনে ফিরছিলেন। হঠাৎ কোন একটা অচেনা লোকের সাইকেলে চেপে নাতি কোথায় চলে যাচ্ছে দেখতে পেয়ে হইহই করে ওঠেন। দিদিমার চিত্কারে সবাই মিলে সেই ভূপতিত সাইকেল সওয়ারকে ঘিরে ধরলে জানা যায় সে নাকি একটি হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যাচ্ছিল বাড়ি ফেরানোর জন্য, পথে এই কান্ড!শেষমেশ সেই কাকুকে মাটি থেকে তুলে জল টল দিয়ে একটা বাড়ির রোয়াকে নিয়ে গিয়ে বসানো হল, অল্প সরপুরিয়াও দেওয়া হল। কাকু সেইসব খেয়ে টেয়ে, আর কখনো একা একা ঘুরবে না, সাবধানে থাকবে, এসব উপদেশ টুপদেশ দিয়ে চলে যাওয়ার পর ডাক পড়ল সেই পাশের বাড়ির দাদার। সে যতই বলে বন্ধুদের সাথে গল্পে মেতে প্রথমে ছেনুকে আনার কথা ভুলে গেলেও, পরে সে আবার মাঠে ফিরে গিয়েছিল ছেনুর খোঁজে, কিন্তু অনেক খুঁজেও তখন আর মাঠে তাকে দেখতে পায় নি -তার সেই সব অজুহাত সমবেত বকুনির সামনে কল্কে পেলে তবে তো! আর ছেনু তখন কী করছে? এক কোনে বসে চোখ মুছতে মুছতে একটু একটু করে সরপুরিয়া খাচ্ছে আর ভাবছে এখন যদি দিম্মা সরপুরিয়ার বদলে শুকনো চিঁড়েও খেতে দিত, তাহলেও সে সোনামুখ করে খেয়ে নিত, বাড়ি ফেরার এমনই আনন্দ! ফিক করে একফালি হাসিও বেরিয়ে আসে, যাক, এ যাত্রা তার রাজত্বটা তো বেঁচে গেল!
  • হরিদাস পালেরা...
    মুক্ত বন্দীশালায় কিছুক্ষণ - ২ - সমরেশ মুখার্জী | আগের পর্বে বলেছিলাম তিনটি বিপজ্জনক অপরাধীর উদাহরণ দেবো যাদের আজীবন কারাগারে বন্ধ করে রাখা‌ই বাঞ্ছনীয়: ১. চার্লস শোভরাজ - সুদর্শন, সপ্রতিভ, লেডিকিলার শোভরাজ বিকিনি কিলার নামে‌ও পরিচিত। কেননা তাঁর বেশ কিছু শিকার মৃত‍্যুকালে ছিলেন বিকিনি পরিহিতা। তাঁর শিকারদের সুচতুরভাবে প্রতারণা‌ করাই শুধু নয় জেল ও পুলিশের কর্মী‌দের চোখে ধূলো দিতে‌ও তিনি ছিলেন সিদ্ধ। তাই তার আর একটি নাম হয়ে গিয়েছিল Serpent. তার জীবনের ওপর সিনেমা, তথ‍্যচিত্র ছাড়া‌ও ২০২১এ BBC/Netflix বানায় আট পর্বের ড্রামা সিরিজ - The Serpent. (আমি দেখিনি)‌সিরিয়াল কিলার শোভরাজ ১২ জন মহিলা‌কে  হত‍্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তবে সম্ভবত তিনি ৩০ জনকে হত‍্যা করেন। ভারতের জেলে ২০ ও নেপালের জেলে ১৯, জীবনের ৩৯ টা বছর জেলে কাটিয়ে শোভরাজ ৭৮ বছর বয়সে মুক্তি পান। কৃতকর্মের জন‍্য তার কোনো অনুতাপ হয়নি।  বরং তাঁর অপরাধ জীবনের অভিজ্ঞতা ব‌ই, সিনেমা, টিভি সিরিয়ালের জন‍্য বিক্রি করে রয়‍্যাল‌টি  হিসেবে প্রচুর অর্থ কামিয়েছেন। প্রভাব খাটিয়ে, ঘুষ দিয়ে তিনি ভারতের জেলেও ছিলেন আয়েশে। চার্লসের মতো অপরাধী কারাদন্ড মার্জনা‌র যোগ্য নয়। মার্ক ডেভিড চ‍্যাপম‍্যান - ২৫ বছর বয়সে তিনমাস ধরে পরিকল্পনা করে মার্ক ঠান্ডা মাথায় জন লেননকে হত‍্যা করে। সেদিন সে অনেকক্ষণ জনের বাড়ির নীচে আর্কেডে অপেক্ষা করেছি‌ল। সে পিছন থেকে জনকে পাঁচবার গুলি করে। খুব কাছ থেকে গুলি করেছি‌ল সে। তবু একটি ফসকে যায়। চারটি‌ লক্ষ‍্যভেদ করে। জন হাসপাতালে যাওয়ার পথেই মারা যায়। মার্ক গুলি চালিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে‌ছিল। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। ফলে হাতেনাতে ধরা পড়ে। বিচারে আজীবন কারাবাসে দণ্ডিত হয়ে মার্ক জেলে আছে ১৯৮১ সাল থেকে। কুড়ি বছর পর মার্ক আইনানুগ প‍্যারোলে মুক্তি‌র আবেদন করেছিল। তার আবেদন বিশেষজ্ঞ মনোবিদ, পুলিশ কর্তাদের দ্বারা নাকচ হয়। তাদের ধারণা মার্কের impulsive nature, psychotic behavior, least regard for human life, personality disorder, manic depression, paranoid schizophrenia ইত‍্যকার নানাবিধ মানসিক জটিলতা‌র কারণে ও সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক। ফলে এযাবৎ ওর তেরোবার প‍্যারোলে‌র আবেদন নাকচ হয়েছে। ৪৪ বছর জেলে কাটিয়ে মার্ক ২০২৫ সালের আগস্টে  চতুর্দশতম প‍্যারোল আবেদনের শুনানির অপেক্ষা‌য় আছে। তখন মার্কের বয়স হবে সত্তর।হাদি মাতার - ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত স‍্যাটানিক ভার্সেস ব‌ইয়ের জন‍্য ১৯৮৯ সালে ইরানের ধর্মগুরু আয়াতোল্লা খোমেনী‌ সলমন রুশদির মৃত‍্যুদণ্ডের ফতোয়া জারী করেন। সে বছরেই খোমেনী মারা যান কিন্তু জারি থাকে ফতোয়া। সাথে যোগ হয় রুশদি‌র প্রাণনাশের পুরস্কার - তিন মিলিয়ন ডলার। সলমন ব্রিটিশ নাগরিক। তাই ব্রিটেন তাঁকে সরকারি নিরাপত্তা দেয়। প্রাণনাশের আশাংকা‌য় রুশদি দশ বছর লোকচক্ষুর আড়ালে ব্রিটেনে গোপন জায়গায় সরকারি নিরাপত্তা‌য় কাটান। তবুও তার মধ‍্যে রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট ইরাণী সন্ত্রাসীরা তাঁর ওপর ছবার ব‍্যর্থ হামলা চালায়। ১৯৯৮ সালে ব্রিটেন ও ইরানের মধ‍্যে কূটনৈতিক সমঝোতা‌য় ইরান রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট সন্ত্রাসীদের তুলে নেয়। তবে ফতোয়া ও পুরস্কার জারি থাকে। ২০০০ সাল থেকে রুশদি ভাবেন তাঁর প্রাণনাশের বিপদ হয়তো কেটে গেছে। তাই তিনি আমেরিকা‌য় যাতায়াত শুরু করেন বিশেষ নিরাপত্তা ছাড়াই।১২ই আগস্ট ২০২২ - ফতোয়া জারির ৩৩ বছর পর নিউ ইয়র্কের Chautauqua Institution এর অডিটোরিয়ামে রুশদি যে বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গেছেন - ভুক্তভোগী হিসেবে সেটি তার ভালো‌ভাবে জানা - The importance of protecting writers whose lives are under threat. হঠাৎ দর্শকদের মধ‍্যে থেকে ২৪ বছরের হাদি মাতার ছুটে উঠে আসে স্টেজে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই রুশদি‌কে দশ, বারোবার ছুরিকাঘাত করে। ও হাতেনাতে ধরা পড়ে। রুশদি প্রাণে বেঁচে যান। তবে ওনার ডান চোখ নষ্ট হয়ে যায়। একটা হাত‌ও আংশিক অকেজো হয়ে যায়। পরে রুশদি সাংবাদিকদের বলেছেন - হাদি মাতারের সাথে তাঁর ঐ ২৭ সেকেন্ডের চকিত মোলাকাত ছিল প্রায়-মৃত্যুর অভিজ্ঞতা - Near Death Experience. আর হাদি সাংবাদিকদের বলেছিল - রুশদি বেঁচে গেল? ভারি আশ্চর্য তো!  রুশদিকে ১৮ দিন পর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার সময় তাঁর চিকিৎসক বলেছিলেন, আপনি ভাগ‍্য‌বান কারণ হাদি ঠিক জানতো না - ছুরি দিয়ে নিশ্চিতরূপে কীভাবে  মানুষ মারা যায়।  তিন মাসের পরিকল্পনা‌য় সেটা ভালো করে জানতো লেননের হত‍্যাকারী মার্ক। সে কাছ থেকে পাঁচটা গুলি ছুঁড়ে‌ছিল .38 Special হেভি ক‍্যালিবার রিভলবার থেকে। পয়েন্টে‌ড বুলেট শরীর এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যেতে পারে তাই ও ভেবেচিন্তে ব‍্যবহার করেছি‌ল Hollow point expanding বুলেট যা Soft Target মানে মানব শরীরে ঢুকেই ছেৎরে ফেটে যাবে - to cause maximum damage. তাই লেনন হাসপাতাল অবধি‌ জীবন্ত পৌঁছোতে পারেন নি।হাদি লেবাননের মুসলিম। সে ছশো পাতার স‍্যাটানিক ভার্সেস ব‌ইয়ের চার পাঁচ পাতার বেশী পড়েনি‌। কিন্তু শুনেছে রুশদি ঐ ব‌ই‌তে ইসলামের অবমাননা করেছেন। সে খোমেনী‌র ফতোয়ার কথাও জানতো। ওর হয়তো মনে হয়েছে তা পালন করার নৈতিক দায়িত্ব ওর ওপরেও বর্তায়। তাই সে রুশদির প্রাণ নিতে চেয়েছিল। হাদি ধরা পড়ার পর ওর মা ওর সাথে দেখা‌ করেননি। ওর প্রাণভিক্ষা‌ও করেননি। ওর ব‍্যাপারে কোনো কথা‌ই বলতে চাননা। মঞ্চে হাতে ছুরি নিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েও হাদি আদালতে বলেছে ও নিরপরাধ - he pleaded not guilty. দেখা যাবে আদালত কী ভাবে।ফেরা যাক মুক্ত বন্দী‌শালায়অনেকের ধারণা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে ১৪ বা ২০ বছর। এই ধারণা‌র কারণ‌ও আছে। অনেক সময় সরকার কিছু আজীবন দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের ১৪ থেকে ২০ বছর মেয়াদ খাটার পর ছেড়ে দেন। কিন্তু সরকার চাইলে কাউকে আমৃত্যু কারাগারে বন্দী রাখতে পারে। তবে নতুন, হার্ডকোর অপরাধীদের জন‍্য কারাগারে স্থান সংকুলানের জন‍্য জেলারের সুপারিশে সাজার মেয়াদে‌র এক তৃতীয়াংশ রেগুলার জেলে কাটানোর পর কিছু শান্ত, ভদ্র, নিরীহ স্বভাবের দণ্ডিত‌দের মুক্ত বন্দী‌শালায় এনে রাখা হয়। তাতে বন্দী পিছু সরকারের খরচ‌ও হয় অনেক কম। তবে কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীরা মুক্ত বন্দী‌শালায় আসার সুযোগ পায় না। সেগুলি আর না লিখে উৎসুকদের জন‍্য রাজস্থান সরকারের Open Prison Policy থেকে রুল 3 অংশটা‌ই রেখে দিলাম। তাতে দুটো কৌতূহলোদ্দীপক ব‍্যাপার চোখে পড়লো। এক- ক্লজ 3d তে যেসব ধারায় দণ্ডিত অপরাধীরা মুক্ত বন্দী‌শালায় আসার জন‍্য বিবেচিত হবে না বলা আছে তাতে দফা 302 বা নরহত্যা নেই কিন্তু আছে দফা 303 - এই দফা লাগু হয় যদি কেউ সাজার মেয়াদ কাটার সময়ে জেলে বা প‍্যারোলে কদিনের মুক্তি পেয়ে তখন আবার কাউকে হত‍্যা করে।   তখন শাস্তি ফাঁসি বা আমৃত্যু কারাবাস।  দুই- ক্লজ 3m - অবিবাহিত বন্দীরা বিবেচিত হবে না। অর্থাৎ মুক্ত বন্দীশালা‌য় স্থানান্তরিত হতে গেলে তাদের রেগুলার জেলে আসার আগে বিবাববন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। জেল থেকে প‍্যারোলে কদিনের ছুটি পেয়ে বন্দী‌রা সহোদর/রা ভাই বোনের বিয়েতে যেতে পারে তবে নিজে বিয়ে করে কিনা জানা নেই। জেল খাটা পাত্রর সাথে কনের পিতামাতা বিয়ে দিতে বা পাত্রী নিজে‌ই বিয়েতে রাজী হবে বলে মনে হয়না।  তবে আইনত কোনো বাধা আছে বলে মনে হয় না। এই ক্লজ‌টা আমার অদ্ভুত এবং অযৌক্তিক লাগলো। নরহত্যা‌র দায়ে দণ্ডিত বিবাহিত অপরাধীর একজন অভয় রাজ গুর্জর। ২০০৮ সালে ওর গাঁয়ে এক উৎসবের রাতে ও তরোয়ালের কোপে ওদের গাঁয়ের এক অত‍্যাচারী গুণ্ডা ও তার দুই সাগরেদের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়ে‌ছিল। কিন্তু ও পালায় নি। তরোয়াল হাতে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করে। গুণ্ডা‌র দল সে রাতে বেশ নেশাগ্রস্ত অবস্থা‌য় ছিল। অভয়ের উন্মত্ত তরোয়ালের সামনে দাঁড়াতে‌ই পারে নি। কচুকাটা হয়ে যায়। অভয় বলে, গ্ৰামবাসীরা খুশিতে গ্ৰামে ১০০ কেজি লাড্ডু বেটেছিল। থানেদার সে রাতে ওকে বলেছিল, কুছ মজবুরী কে বজহ সে বেবশ হমলোগ যো নেহি কর পায়া, তু নে কর দিখায়া অভয় - সাবাশ! আদালতে থানেদারের সদর্থক সাক্ষ্যে প্রতিপন্ন হয় অভয় যাদের উড়িয়ে দিয়েছে তারা কেউ‌ই নিরীহ সাধারণ গ্ৰামবাসী নয়। অত‍্যাচারী গুণ্ডা। অভয় ঐ কাজ করে ফেলেছে সহ‍্যের সীমায় পৌঁছে ক্ষণিকের উত্তেজনা‌য়।  তাই বিচারে ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় অভয়ের।অভয়ের কথা শুনে মনে পড়ে গোবিন্দ নিহালনির ‘অর্ধ সত‍্য’ সিনেমার শেষ দৃশ্য। সাসপেন্ডেড ইনস্পেক্টর অনন্ত ভেলাঙ্কার (ওম পুরী) সিভিল ড্রেসে বুলেট চালিয়ে থানায় আসে। তার সিনিয়র সফি ইনামদার ওর হাবভাব দেখে শঙ্কিত হয়ে বলে - কেয়া বাত হ‍্যায় ভেলু? ওম ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলে - স‍্যার ম‍্যায় নে রামা শেট্টি কো মার দিয়া। রাজনৈতিক মদতপুষ্ট সমাজবিরোধী রামা শেট্টি‌র জন‍্য‌ই ওম পুলিশের উর্দী পরেও কিছু করতে না পেরে নিজেকে নপুংসক ভাবছি‌ল অনেকদিন ধরে। রামাকে ক্ষণিকের উত্তেজনা‌য় গলা টিপে মেরে ফেলা একটি স্ফূলিঙ্গে সেই জমা বারুদে লাগা বিস্ফোরণ। সে বারুদ জমা হয়েছিল নীতি‌বান ইন্সপেক্টর অনন্ত ভেলাঙ্কারের মনে - অনেকদিন ধরে - নানা পরিস্থিতি‌তে।সদ‍্যজ্ঞাত প্রেক্ষিতে আমি ভালো করে আবার অভয়কে দেখি। ২০২৩ এ তখন ওর বয়স বললো ৪৮ - তাহলে ১৫ বছর আগে যখন ও তরোয়ালের ঘায়ে কচুকাটা করেছি‌ল তিন গুণ্ডাকে - তখন ও তেত্রিশ। এখন শীর্ণকায় চেহারা, শান্ত মুখভাব দেখে অনুমান করা কঠিন একদা এই মানুষ‌টি ক্ষিপ্ত হয়ে এক লপ্তে তিন গুণ্ডা‌র ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছল। গতকাল কেল্লায় ওকে দেখে ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি ও এক অতীতের ঘাতক! সাবেক পোষাকে সহজ সরল স্বাভাবিক এক দেহাতী মানুষ বলেই মনে হয়েছিল।জিজ্ঞাসা করি, ঐ ঘটনার জন‍্য কী পরে আপনার কোনো অনুশোচনা হয়েছে? - কখনো‌ই নয়। পুণ‍্যকাম করলে অনুশোচনা কেন হবে বাবুজী? - ঠিক আছে, অনুশোচনা না হোক, এই যে আপনার জীবনের পনেরোটা বছর জেলে কেটে গেল, তার জন‍্য কোনো আক্ষেপ হয়?- তা হয় বৈ কি। তবে পুণ‍্য কামাতে গেলে‌ও তো দক্ষিণা দিতে হয়, ভেবেছি এটাও তেমন। তবে ওপর‌ওয়ালা আছেন। তাই আবেদন করতে এগারো বছর জেলে কাটানোর পর সরকার এখানে পাঠিয়েছে। এখানে‌ও চার বছর হয়ে গেল। হালে রিহাইয়ের আবেদন করেছি। হয়তো মঞ্জুর হয়ে যেতে পারে।- এখানে এসে কেমন লেগেছে?- এখানে থাকলে জেলের মতো দমবন্ধ লাগে না।  পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখা যায়। তাইতো আমাদের একমাত্র ছেলে নির্মল এগারো ক্লাসের পরীক্ষা‌র পর চন্দ্রপুর থেকে কদিনে‌র জন‍্য এসেছে আমার কাছে থাকতে।- এখানে পরিবারের কেউ আপনার সাথে এসে থাকতে‌ও পারে? তাহলে তো ভালো‌ই বলতে হবে।- হ‍্যাঁ পারে। একজনের সাথে আলাপ করাবো। নারায়ণ সিং তোমর। সে  তার বৌকে নিয়ে আছে। এখানেই তাদের একটি মেয়ে‌ও হয়েছে। নাম রেখেছে নয়না।- তোমর মানে তো রাজপুত বংশের?- হ‍্যাঁ। ওর চেহারা দেখবেন। ওদের মেয়েকে দেখবেন। অপরাধ একটা করে ফেলে‌ছে বটে কিন্তু কথা বললে‌ বুঝবেন ওর ত‌ওরতড়িকা গাঁ‌ওয়ারদের মতো নয়। - কিন্তু বৌ নিয়ে আছে মানে? বিয়ে কখন হোলো? - বিয়ে ওর জেলে আসার আগেই হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের মাস চারেকের মধ‍্যে‌ই খুনের দায়ে ধরা পড়ে নারায়ণ। তখন‌ও ওদের ছেলেপুলে হয়নি। ওদের পরিবারের কারুর নেতাদের সাথে যোগাযোগ আছে। তাদের সুপারিশ, বৌ সন্তান‌হীনা এই সব কারণে সাত বছর রেগুলার জেল খেটে এই মুক্ত বন্দী শালায়  ও এসেছে বছর চারেক আগে। তখনই ও বৌ কে নিয়ে আসে। নয়নার জন্ম এখানে‌ই। ওর বয়স এখন বছর আড়াই।- বিয়ের পরেই ও জেলে চলে এলো, ওর বৌ এতোদিন অপেক্ষা করেছি‌ল ওর রিহাইয়ের জন‍্য?- বয়সে অনেকটা ছোট ওর বৌ। নারায়ণের কাছেই শুনেছি বৌয়ের সাথে ওর ইসক ছিল বিয়ের আগে থেকে। আপনি তো দুনিয়া‌দারি দেখেছেন বাবুজী, বোঝেন নিশ্চয়ই সচ্চা প‍্যার মহব্বত থাকলে অনেকে অনেক কিছু সহ‍্য করতে পারে মানুষ। সাত বছর জুদাই ভী।- যদি কিছু মনে না করেন, আপনার‌ও কি বিয়ের আগে মহব্বত ছিল আপনার বৌয়ের সাথে? আপনি তো বেশ হ‍্যান্ডসাম।সরল হেসে অভয় বলে, না, না বাবুজী, আমাদের বাড়ি থেকে‌ই দেখেশুনে‌ বিয়ে হয়েছিল। আমি যখন জেলে আসি, আমাদের ছেলে নির্মল তখন দু’বছরের ছোটু। কোথায় আর যাবে বৌ। তাই আমার ফেরার অপেক্ষা‌য় আছে। কিছুদিন থাকে ওদের বাড়িতে, কখনো আমাদের বাড়িতে। সবাই খুব পছন্দ করে ওকে। এভাবেই ওদের দিন কাটছে‌।অভয় আলাপ করায় নারায়ণের সাথে। লালচে ফরসা চেহারা বহদিন জেলের হাওয়া খেয়ে মলিন হয়ে গেছে। তবু বোঝা যায় আদতে কেমন ছিল। নীলাঞ্জনা নয়না‌ও মিষ্টি। এখানে ও বাবা মায়ের সাথে থাকলেও আর কোনো আত্মীয় পরিজন,  নেই। সমবয়সী খেলার সাথী নেই। পার্কে গিয়ে খেলার সুযোগ নেই। পাথর বাঁধানো উঠোনে - পাশে এক চিলতে সবুজ। তাতে দু একটি ছোট গাছ। এটুকু‌ই ওর প্রকৃতি পরিচয়।  খেলনা নিয়ে নিজের মনে একা একা খেলে। ছোট সাইকেল চালায়। বন্দী‌শালায় ওর বাবার সহবন্দী‌রাই তার সঙ্গী। ওদের কাছে‌ও শিশুটি মুক্ত বাতাসের মতো।  এটা স্বাভাবিক বাড়ির পরিবেশ নয়। কিন্তু শিশুরা কী বোঝে তারা কোনো অস্বাভাবিক পরিবেশে আছে? কে জানে। তবে নয়না খুব গম্ভীর। প্রায় পৌনে ঘন্টা কাটিয়ে‌ছিলাম ওখানে। তার মধ‍্যে দুর থেকেও নয়নার মধ‍্যে শিশুসুলভ উচ্ছলতা দেখিনি। নয়নার জন‍্য মন খারাপ লেগেছিল আমার।নারায়ণ একটা টুল এনে বলে, বাবুজী বসুন না একটু, চা খেয়ে যান। পর্দা ফেলা ঘরের দিকে তাকিয়ে মুক্ত বন্দীশালাবাসিনী ঘ‍রণীকে চায়ের কথা বলে। একটু বাদে ওর বৌ থালায় করে তিনটে পরিস্কার ছোট গ্লাসে চা নিয়ে আসে। আমরা চা তুলে নিতে সে এক পরদেশী বুজুর্গ আঙ্কলকে হাত তুলে নমস্কার করে ঘরে চলে যায়। সে বেশ সুশ্রী। তাই ওদের মেয়েটি অমন ফুটফুটে হয়েছে। একদা সাত বছরের বিরহজ্বালা হয়তো প্রশমিত হয়েছে স্বামী কন‍্যা‌কে নিয়ে থেকে। হলেই বা একটা মোটে ঘর। তাই তার মুখে লজ্জা, বিষন্ন‌তা, ম্রিয়মাণ‌ভাব চোখে পড়লো না। আর পাঁচটা গৃহস্থ‌বধূর মতোই স্বাভাবিক লাগলো।এই সব দেখেশুনে মনেই হচ্ছিল না আমি কোনো বন্দী‌শালায় এসেছি, হলেই বা তা মুক্ত। একাকী ভ্রমণপথে এমন কত যে সব বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়! দলের সাথে কলবল করে ঘুরলে এসব অধরা রয়ে যায়। সেদিন দলে থাকলে আমি গাড়ি বা অটোতে যেতাম। ভেতরের শর্টকাট রাস্তা দিয়ে দেড় কিমি হেঁটে যেতাম না, এসব চোখেও পড়তো না। পড়লেও দলে থাকলে অভয় আমায় ভেতরে ডাকতো না।নারায়ণকে শুধোই, কেমন লাগে এখানে? নারায়ণ বলে, আমি তো পরিবার নিয়ে থাকি। খারাপ লাগে না। অভয় বলে, আমরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের মধ‍্যে বাইরে যেতে পারি। তাই কাল নির্মলকে নিয়ে কেল্লায় বেড়াতে গেছি‌লাম। শুনেছি কেল্লা‌টা বিখ্যাত। তাই তো আপনি কলকাতা থেকে এখানে এসেছেন ওটা দেখতে। অথচ চার বছর এখানে থেকেও আমার যাওয়া হয়নি। সন্ধ্যায় ফিরে আসতে হয়। ইনচার্জ মীনাজী রোজ সকাল বিকেল খাতায় হাজিরা নেন। এছাড়া জেলের মতো আর কোনো কড়াকড়ি নেই। এখানে থাকার এই নিয়ম সবাই মেনে চলে। বছরে দুবার প‍্যারোলে সাত দিনের জন‍্য বাড়ি যাওয়া যায়। এছাড়া বিশেষ কারণে, ধরুন বাড়িতে নিকটজনের শাদী বা দেহান্ত হলেও কদিনে‌র ছুটি পাওয়া যায়।- তখন যদি কেউ গিয়ে আর না ফেরে?অভয় একটা মোক্ষম ডায়লগ ঝাড়ে। বাবুজী, তোতে কো পিঞ্জরে মে রখতে হ‍্যায়, কবুতর খুলা ছোড়া যাতা হ‍্যায়। আট দশ বছর রেগুলার জেলে কাটিয়ে যারা এখানে আসে তারা জানে এরপর পেতে পারে আইনত মুক্তি। তাদের জনমকুণ্ডলী আছে পুলিশের কাছে। পালিয়ে যাবে কোথায়? কতদিন? ধরা পড়বে‌ই। তারপর আর মাফি নেই, আমৃত্যু জেলেই পচতে হবে। এসব কথা এখানে আসার আগে জেলার সাহেব প‌ইপ‌ই করে বলে দিয়েছেন। জিসকো ভী থোরা সা অকল বচা হ‍্যায়, ও কভি এ্যায়সা হরকৎ করনা তো দুর, সোচে গা ভি নেহি।অভয়ের কথা‌র প্রমাণ‌ও পেলাম এই লেখা লিখতে গিয়ে, উপরে দেওয়া নিয়মের Rule 3 c তে। (পরবর্তী পর্বে সমাপ‍্য) 
    মুক্ত বন্দীশালায় কিছুক্ষণ - সমরেশ মুখার্জী | কেল্লায় দেখা অভয়ের সাথেসূরজনগর শহর থেকে দুরে একান্তে তার অবস্থান। প্রচারের অভাব। এসব কারণেই হয়তো দু পাশে নদী বেষ্টিত অনুচ্চ লম্বাটে টিলার ওপর দ্বাদশ শতাব্দী‌র এই পেল্লায় কেল্লায় পর্যটক সমাগম খুব কম। জানুয়ারি‌র এক আমুদে শীতের সকালে গিয়ে সেখানে ঘন্টা পাঁচেক কাটিয়েছি‌লাম। সেদিন কোনো দূরাগত পর্যটক দেখিনি। কয়েকটি অল্পবয়সী স্থানীয় ছেলে এসেছি‌ল। আমার মতো ধীর লয়ে কেল্লার সবদিকে হেঁটে, সৌধের ভেতরে ঢুকে, আনাচে কানাচে ঘুরে, ছাদে উঠে চারদিক দেখে, কোথাও খানিক চুপ করে বসে, কিছুক্ষণ একজায়গায় প্লাস্টিক বিছিয়ে শুয়ে - সর্বতোভাবে এই প্রাচীন নির্জন কেল্লার ঝিমঝিমে মৌতাত সত্তায় শুষে নিতে তারা আসেনি। হয়তো আগেও এসেছে তারা। তাই কলবল করে দ্রুত পায়ে এদিক ওদিক খানিক ঘুরে জনা ছয়েকের সেই দলটি চলে যেতেই সেই বিশাল কেল্লা আবার ডুবে গেল নিঝুম স্তব্ধতা‌য়।চুপ করে একটি পাথরের বেঞ্চে বসে তাকিয়ে ছিলাম দুরে, নীচে নদীর দিকে। এমন শান্ত দৃশ‍্যে মন শান্তি‌তে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। মগ্ন‌তা ক্ষুন্ন হয় পিছন থেকে আসা প্রশ্নে: - বাবুজী, ওদিকে আর কিছু দেখা‌র আছে?একটি স্থানীয় লোক। ভুবন সোম সিনেমায় শেখর চ‍্যাটার্জী রাজস্থানী স্টাইলে সাদা কুর্তা, পাজামা, পাগড়ি পরা এক গাড়োয়ানের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এ লোকটি‌র‌ও প্রায় তেমন‌ই পোষাক। ক্ষীণকায় চেহারা। বয়স পঞ্চাশের নীচে‌ই হবে হয়তো। সাথে একটি বছর সতেরোর ছেলে।  - হ‍্যাঁ আছে তো, বড়া বুরুজ - ওটা দেখার মতো জায়গা।- আপনি দেখে এসেছে‌ন?- না, একটু বাদে যাবো। ওটাই কেল্লার শেষ প্রান্ত। এই যে নদী‌টা দেখছেন - কেল্লার বাঁদিক থেকে এসে নদী‌টা ওখানে কেল্লা‌কে বেড় দিয়ে চলে গেছে ডানদিকে। খুব সুন্দর দৃশ‍্য - দেখে আসুন, ভালো লাগবে।- আপনি তো এখনো ওদিকে যান নি বললেন, কী করে জানলেন?মৃদু হেসে বলি - দুর থেকে বেড়াতে আসি এসব জায়গায়, তাই আসার আগে ম‍্যাপে একটু দেখে নি।- আপনি কোথা থেকে আসছেন?- কলকাতা।- ক ল কা ত্তা! শুনা হ‍্যায় বহুত দুর - বংগাল মূলক মে - অতো দুর থেকে এসেছে‌ন এই  কেল্লা দেখতে! - হ‍্যাঁ, আর আপনি? সঙ্গে‌র ছেলেটি কে?- আমি তো থাকি সূরজনগরে‌ই। এ আমার ছেলে, চন্দ্রপুর গাঁও থেকে কদিনের জন‍্য বেড়াতে এসেছে আমার কাছে। ওকে এই কেল্লা দেখাতে‌ই এসেছি এখানে। আচ্ছা, বাবুজী, সুক্রিয়া, চল নির্মল, চলতে হ‍্যয় উধর - বলে লোকটি চলে যায়।আমি তাকিয়ে থাকি ওদের যাওয়া‌র দিকে। লোকটি‌র মুখের ফিচার একটু অন‍্যরকম - লম্বা‌টে মুখে চোখে পড়ার মতো দীর্ঘ চিবুক - চোখ দুটি‌ সবাক। অল্পবয়সী ছেলেটি বয়স অনুপাতে অত‍্যন্ত গম্ভীর। গাঁও থেকে বাবার কাছে বেড়াতে এসেছে। তার মানে হয়তো তার বাবা সূরজনগরেই কোথাও কাজ করে - তাই চন্দ্রপুর গাঁয়ের বাড়ি, পরিবার ছেড়ে এখানে থাকে। মুক্ত বন্দী‌শালাসেবার একাকী ভ্রমণপথে রাজস্থানের রতনপুর গিয়ে কদিন ছিলাম। সূরজনগর থেকে আরো দশ কিমি দুরে রতনপুর। সেদিন কেল্লা দেখে সন্ধ্যায় ফিরে গেছি‌লাম রতনপুর। পরদিন আবার গেছি সূরজনগর। এদিন শহরের মধ‍্যে একটি প্রাচীন প‍্যালেস, তার মধ‍্যে সংগ্ৰহালয় এই সব দেখার ইচ্ছা। সূরজনগর বাসস্ট্যান্ডে নেমে এপাশ ওপাশ দেখতে দেখতে প্রাচীন শহরের পথ ধরে যাচ্ছি। - বাবুজী! আপ ইধর? একটি হলুদ দোতলা বাড়ি। দেওয়ালে চার জায়গায় ছাদ থেকে বৃষ্টি‌র জল নামার কালচে ছোপ। সামনে বড় টানা উঠোন। পাঁচিলে লোহার মেন গেটে তালা। পাশে লোক চলাচলের ছোট অর্ধবৃত্তাকার গেট খোলা। ওখানে দাঁড়িয়ে‌ই হাঁক দিয়েছে গতকাল কেল্লায় দেখা লোকটি। বাড়ি‌র দেওয়ালে ও পাঁচিলে একটি আয়তক্ষেত্র লাল/নীল ত্রিভুজে বিভক্ত। পুলিশের চিহ্ন। তাতে সাদা অক্ষরে লেখা “মুক্ত বন্দীশালা - সূরজনগর”। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ছবিতে দুটি জায়গা‌তেই লাল মাস্কিং করে দিয়েছি।  - আরে! আপনি? এখানে?- আমি তো চার বছর ধরে এখানেই আছি।- এই মুক্ত বন্দী‌শালায়! তার মানে? আপনি কি মুক্ত না বন্দী? গতকাল কেল্লা‌য় ঘুরে বেড়াচ্ছি‌লেন যে!আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে‌ই কথা বলছি‌লাম। লোকটি বলে,- বাবুজী আপনার তাড়া না থাকলে, আসুন না ভিতরে, একটু গপসপ করা যাক।আমার তো এমন কিছু অভিজ্ঞতা সেবনের জন‍্য মন প্রাণ উন্মুখ হয়ে‌ই থাকে। পত্রপাঠ চলে যাই ভিতরে। তারপর যে বাস্তব জীবননাট‍্যর মুখবন্ধ দেখলাম, প্রাচীন সংগ্ৰহালয় দেখা‌র তুলনায় তা‌ও কম আকর্ষণীয় নয়।জানলুম তার নাম - অভয় রাজ গুর্জর। ওটি বাস্তবিক একটি মুক্ত বন্দী‌শালা বা Open Prison. অভয়ের সাথে কথা বলে জানলাম ওটা রেগুলার প্রিজন নয়। ওখানে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বন্দী‌ই আছেন। তাদের সবার ক্ষেত্রে কয়েকটি ব‍্যাপার প্রায় এক‌ই রকম:১. তারা সকলেই নরহত্যা‌র অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত।২. কেউ‌ই টাকাপয়সার জন‍্য, পরিকল্পনা করে, নৃশংসভাবে বা বহু খুন করেনি। অর্থাৎ তারা কেউ‌ই পেশাদার খুনি নয়। একটা‌ই খুন করে ফেলেছে দীর্ঘদিনের ছাইচাপা বঞ্চনা, রাগ বা হতাশার তাড়নায় আকস্মিক উত্তেজনার বশে। তাদের মধ‍্যে কেউ খুন করে পালিয়ে যায়নি। হয় থানায় আত্মসমর্পণ করেছে বা ধরা পড়ে আদালতে অপরাধ স্বীকার করেছে। তার ফলে অবশ‍্য তাদের অপরাধ মাফ হয়নি। দফা ৩০২ মাফ করার মতো গুনাহ নয়। কিন্তু তাদের অপরাধ Rarest of the rare crime বলেও গণ‍্য হয়নি। তাই তাদের মৃত‍্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হয়েছে।৩. তাদের সবার কারাবাস‌কালে আচরণ ছিল শান্ত, ভদ্র। সশ্রম কারাদণ্ড বলে, যা কাজ করতে বলা হয়েছে মন দিয়ে করেছে। জেলের মধ‍্যে কখনো কোনো উটকো ঝামেলায় জড়ায় নি। ক্ষণিকের উত্তেজনা‌য় নরহত্যা‌র মতো মারাত্মক অপরাধ করে ফেলে তাদের অনেকের মধ‍্যে পরে দেখা গেছে অনুশোচনা। ৪. ১০ বছর জেলে কাটানোর পর এদের সবাই সরকারের কাছে ক্ষমাভিক্ষার আবেদন করেছে। আবেদন করলে‌ই মঞ্জুর হবে তার কোনো মানে নেই। তবে এদের ক্ষেত্রে মঞ্জুর হ‌ওয়া‌তেই পুরোদস্তুর জেল থেকে এরা এই মুক্ত বন্দী‌শালায় স্থানান্তরিত হয়েছে। পুরোপুরি মুক্তি পাওয়ার আগে এখানে‌ও তাদের চার পাঁচ বছর থাকতে হবে। দেখা হবে তাদের সাজা মাফ করে দেওয়া যায় কিনা। এসব সময়সাপেক্ষ ব‍্যাপার। আদর্শ কারাগারনীতি‌গতভাবে বিচারব্যবস্থা‌র উদ্দেশ্য শাস্তি যেন অপরাধের সমানুপাতিক হয়। তেমনি কারাগারে‌র উদ্দেশ্য‌ও হ‌ওয়া উচিত অপরাধীর চিত্তশুদ্ধি করে তাকে পরিবার ও সমাজের মূল স্রোতে ফেরৎ পাঠানো। কিছু ব‍্যতিক্রমী পরিস্থিতি ছাড়া তাকে আমৃত্যু বন্দী করে রাখাটা সরকারের উদ্দেশ্য হ‌ওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্র কর্তৃক অপরাধীর স্বাধীনতা হরণ‌ই যথেষ্ট শাস্তি। তার ওপর নানা উপায়ে কারাগার যেন শাস্তি‌প্রদাণের উপায় না হয়ে দাঁড়ায়। বরং সেটি হ‌ওয়া উচিত সংশোধনাগার। মেয়াদ অন্তে মুক্তি পেয়ে সে তার অভিজ্ঞতা অন‍্যদের সাথে ভাগ করলে তারা হয়তো উপলব্ধি করতে পারে যে প্রিয়জনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, স্বাধীন‌ভাবে চলাফেরার অধিকার হারিয়ে দীর্ঘ বন্দীজীবন কাটানোর যন্ত্রণা। হয়তো তার অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অন‍্যেরা এমন অপরাধ করার আগে দুবার ভাববে, সংযত হতে পারে। তবে এমন আশাবাদী ভাবনা বাস্তবায়িত নাও হতে পারে। কারণ কিছু মানুষ অন‍্যের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সংযত আচরণ করে। কেউ ঠেকে শেখে। তবে অধিকাংশ মানুষ পরিচিতজনের বা নিজের - কারুর ভুল থেকেই শেখে না। তাই সমাজে এক‌ই ভুলের পুনরাবৃত্তি হয়ে চলে। সাধারণ মানুষের নরহত্যা‌র মতো অপরাধ করে ফেলা‌র ক্ষেত্রে বড় কারণ দীর্ঘ‌দিনের অবরুদ্ধ আবেগের তাৎক্ষণিক উত্তেজনা। তা ভেবে চিন্তে হয় না। তাই ক্ষণিকের গুরুতর অপরাধে‌ও তাকে আমৃত্যু জেলে আটকে রাখা উচিত নয়। মাঝে প‍্যারোলে কদিন ছাড়া পেয়ে পালিয়ে না গেলে বা ছাড়া পেয়ে আবার অপরাধ না করলে বেশ কিছু বছর বন্দী‌জীবন কাটানোর পর তাদের মুক্তি দেওয়া যেতে‌ই পারে। পৃথিবীর কিছু দেশে কারাবন্দী‌দের দাম্পত্য সাক্ষাৎ‌কারের (conjugal visit) ব‍্যবস্থা আছে। দীর্ঘ কারাবাসে দণ্ডিত অপরাধীরা নির্দিষ্ট সময় অন্তর তাদের আইনত স্ত্রী বা স্বামী‌র সাথে দুই থেকে তিন দিনের জন‍্য (কোথাও আবার এক সপ্তাহ অবধি) একান্তে মিলিত হতে পারে। তার জন‍্য জেলের মধ‍্যে‌ বা বাইরে আছে নির্ধারিত ঘর। দুজনের জন‍্য সেখানে থাকবে ছোট কিচেন ও রেশন যাতে তারা নিজেরাই কিছু বানিয়ে খেতে পারে। ফলে ঐ কদিন খাবার দেওয়ার কর্মচারী‌ও তাদের প্রাইভেসি‌ ডিসটার্ব করবে না। ঘরে থাকবে পরিপাটি বিছানা, চাদর, তোয়ালে, সাবান, লুব্রিকেন্ট এবং অবশ্যই কনডোম। শেষোক্ত বস্তু দুটি মিলিত হতে আসা সঙ্গী বা সঙ্গিনী‌ও তাদের পছন্দ মতো আনতে পারে। মেক্সিকো, কানাডা, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্কের মতো দেশ - যেখানে মানুষের কিছু মৌলিক মানবাধিকার স্বীকার ও সম্মান করা হয় - সেখানে বিবাহিত বন্দীর এটি মৌলিক অধিকার। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায় সমগ্ৰ  দেশে না হলেও কিছু প্রদেশে তা অনুমোদিত। আবার ইউকে, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, জাপানের মতো দেশে বন্দী‌দের দাম্পত্য সাক্ষাৎ‌কার অনুমোদিত নয়। তাদের ধারণা যখন কেউ অপরাধ করে জেলে আসে সে বাকি নাগরিকদের মতো মৌলিক অধিকার হারায়।বিপজ্জনক অপরাধীর কথা আলাদাতবে অপরাধী মানসিকতা‌র (Criminal mindset), স্বভাব অপরাধী (Habitual offender) বা অপরিণামদর্শী প্রতিক্রিয়া‌প্রবণ অপরাধীরা (Highly impulsive, psychotic mentality) এবং যাদের মনে অনুশোচনা‌র (Remorseful) কোনো ভাবনা‌ই আসে না তারা সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক। এমন অপরাধীদের ক্ষেত্রে আজীবন কারাবাস‌ই প্রযোজ্য। তিনটি উদাহরণ নেওয়া যাক।(ক্রমশ)
    ফারাও-এর দেশে কয়েকদিন - অন্তিম পর্ব - সুদীপ্ত | ফেরার পথে আজ আমাদের মধ্যাহ্নভোজ হল একটি ভারতীয় রেস্তোঁরায়, নাম হল ‘A Taste of India’। ভারতীয় বলছি বটে, তবে ইজিপ্সিয়ান খাবারের রেশই তাতে বেশী, তাতে আমাদের দুজনের অবশ্য পোয়াবারো। ‘সানেয়া সেমাক’ নামে এক ধরণের ইজিপ্সিয়ান পদ্ধতিতে তৈরী বেকড ফিশ খেলাম এখানে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমাদের ঐতিহাসিক মিশরের পাট চুকিয়ে রওনা দিলাম খানিক আধুনিক মিশরের দিকে, হুরগাদা শহরে, লোহিত সাগরের তীরে। সেখানেই আমরা একটা দিন সমুদ্রের তীরে কাটিয়ে দেশের পথ ধরব। হুরগাদাতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা রিসর্ট মারকিওর হুরগাদা-তে, এখানে আমরা এসে পৌঁছলাম প্রায় সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার দিকে। মাঝে একবার কফি ব্রেক রাখা হয়েছিল রাস্তায়। বিরাট এলাকা জুড়ে এই রিসর্ট, নিজস্ব একটি সমুদ্রতট-সহ। রিসেপশনে ঘর নির্দিষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আমাদের সকলের হাতে একটি ব্যান্ড বেঁধে দেওয়া হল, এটি দেখালেই রিসর্টের চত্বরে যত্র-তত্র ঘুরে বেড়ানো যাবে, স্ন্যাক্স কাউন্টার আর বার-এ খাদ্য-পানীয় মিলবে। পানীয় অবশ্য প্রতিদিন যে কোনো একটি বিনামূল্যে, তার পরে নিজস্ব খরচে। রিসেপশন পেরিয়ে কিছু স্যুভেনির-এর দোকান, তারপর একদিকে স্ন্যাক্স কাউন্টার-কাম-বার আর একদিকে ড্যান্স-ফ্লোর। আরও খানিক এগিয়ে বিরাটাকার দুটি সুইমিং পুল, আর তার ওপারেই লোহিত সাগর। বাঁপাশে একটি বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে রেস্তোঁরা, এলাহি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা, আর দুদিকে ছোটো ছোটো সুন্দর কটেজ-এর সারি। প্রতি কটেজেই তিন-চারটি করে ঘর। দেখেই আমাদের ভালো লেগে গেল। ঘর থেকে জানলা খুলে সামনেই সমুদ্র, যদিও জল তার এতই শান্ত যে ওপারে দিগন্তের বিস্তার না থাকলে জলাশয় বলে ভুল হয়! আমেরিকাতে যেমন সাধারণ হ্রদের ধারে বীচ বানিয়ে রাখে লোকে, এ যেন ঠিক তেমন! ঢেউ তো এক ছিটে-ফোঁটাও নেই। আমাদের ব্যাগ পৌঁছে দেওয়া হল সকলের ঘরে ঘরে। আজ বাকি সময়টুকু বিশ্রাম, আমরা খাওয়া দাওয়া সেরে সোজা চলে গেলাম হোটেলের লাগোয়া বীচ-এ; সমুদ্রের জলে চাঁদের আলো পড়ে মায়াবী হয়ে উঠেছে। ঠান্ডা ভালোই রয়েছে, যার ফলে আমরা দুজন ছাড়া আশেপাশে জনমানুষ নেই। শান্ত সমুদ্রে বহুদূরে একটি-দুটি জাহাজের আলো। মেঘমুক্তো আকাশে একমুঠো মুক্তদানা ছড়িয়ে দিয়েছে কেউ। চোখ সয়ে গেলে আবছা আলোয় অর্ধচন্দ্রাকার বালুতট স্পষ্ট  হয়ে ওঠে। একপাশে সারি দিয়ে লাগানো বেতের ছাতা, তার নীচে পাতা আরামকেদারা কিছু। এখানেই খানিক বসে এই নিস্তব্ধতা-কে উপভোগ করি। শান্ত সমুদ্রের জল তীরে এসে মৃদু ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তোলে শুধু। গত সাতদিন ধরে প্রাচীন সভ্যতার যে বিপুল ঐশ্বর্য দেখলাম তারই স্মৃতি রোমন্থন করি। রাতে ঘরে ফিরেও তার রেশ যেন কাটতে চায় না!  সকাল  আটটায় প্রাতঃরাশ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম লোহিত সাগরের রোমাঞ্চকর ভ্রমণে। ভূগোলে পড়ার আগেও জীবনে প্রথম লোহিত সাগরের কথা জেনেছিলাম টিনটিনের কল্যাণে, ‘লোহিত সাগরের হাঙর’ পড়ার সূত্রে (হ্যাঁ টিনটিনের একটি বই-ও আজ অবধি ইংরাজীতে পড়িনি, পাছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনবদ্য অনুবাদ ধাক্কা খায়, তাই স্নোয়ি আজও কুট্টুস হয়েই থেকে গেছে)। হোটেল থেকে খানিক দূরে একটি বন্দরে গিয়ে আমরা উঠলাম আমাদের জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা ত্রিতল-বিশিষ্ট ইয়াট, ‘মুনলাইট’-এ। ইয়াট একধরণের ছোটো জাহাজ। এর বেসমেন্ট এ রয়েছে আমাদের মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা। এর উপরের তলে সকলের বসার জায়গা, এই অংশটি কাচ দিয়ে ঢাকা। এর উপরের তলে পিছনের দিকে কিছুটা খোলা জায়গায় বসার ব্যবস্থা, আর সামনের দিকে রোদ পোহানোর ব্যবস্থা। ইয়াট-এ ওঠার পর ইয়াটের ক্যাপ্টেন আমাদের বাকি ক্রু-দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে কিছু নির্দেশাবলী জানালেন। আমরা প্রথমেই যাবো স্নর্কেলিং এর জন্য লোইত সাগরের বুকে একটি অঞ্চলে যেখানে কোরালের আধিক্য বেশী। সেখানে গিয়ে দেখলাম আরও দু-তিনটি ইয়াট এসে হাজির হয়েছে স্নর্কেলিং-এর উদ্দেশ্যে। আমরা অবশ্য এখানে স্নর্কেলিং করব না ঠিক করে রেখেছিলাম। এর আগে আন্দামানের নীল আইল্যান্ডে এ-জিনিস করেছিলাম, একজন নুলিয়া খুব যত্ন করে সমুদ্রের গভীরে নিয়ে গিয়ে আমাদের স্নর্কেলিং করিয়েছিলেন। অসাধারণ সব রঙিন কোরাল আর মাছের সমারোহ দেখেছিলাম। এখানেও অবশ্য তিনজন ক্রু  জলে রয়েছেন সবসময়, কিন্তু জল দেখে মনে হয়, এ যেন পুকুরে ডুবসাঁতারে নামা, এত নিস্তরঙ্গ। এই লোহিত সাগরের কোরাল অবশ্য  উপর থেকে ততটা আকর্ষণীয় বলে মনে হল না। যাঁরা স্নর্কেলিং করে এলেন, তাঁরাও মোটামুটি একই কথা বললেন। তবে সে যাই হোক, সাগরের জল এত ঘন নীল, একে লোহিত সাগর বলতে অসুবিধেই হয়।  সমুদ্রবিজ্ঞানীরা বলেন হয়ত কোনো এক সায়ানোব্যাকটিরিয়া-র প্রকোপে আর ক্রিয়াকলাপে কোনো কোনো অংশের জল লাল দেখাত এই সমুদ্রের, সে থেকেই এই নাম। তবে আদতে লোহিত সাগর ভারত মহাসাগরের একটি অংশ আর আশ্চর্যের কথা এই সমুদ্রে কোনো নদী-ই এসে মিলিত হয় নি। এর জলও খুবই লবণাক্ত। স্নর্কেলিং এর জায়গা থেকে এবার আমাদের ইয়াট ছুটে চলল আরও গভীর সমুদ্রে, ডলফিন দেখার উদ্দেশ্যে। প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর দেখতে পাওয়া গেল একটি ঝাঁকের, কাতারে কাতারে ডলফিন তরতরিয়ে জল কেটে ছুটে চলেছে। কখনো লাফিয়ে উঠছে, কখনো ডুব মারছে, কখনো প্রায় ইয়াটের গায়ে এসে সঙ্গে সঙ্গে চলেছে আর মাঝে মধ্যে অদ্ভুত সব শব্দ করছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! বেশ চলছিল এরকম প্রায় আধঘন্টা মতো, হঠাৎ চারপাশ থেকে আরও খানচারেক ইয়াট আর স্পীডবোট ধেয়ে এল পিছনে, ব্যস, দু তিন মিনিটের মধ্যে প্রায় পুরো ডলফিনের ঝাঁকটাই হাওয়া! যাক, সে আর কি করা যাবে, সকলেই দেখতে চায়, আমরা তবু এত লম্বা সময় ধরে ডলফিনের খেলা দেখলাম। এরপর আমরা চললাম আরেকটি গন্তব্যে, মাঝসমুদ্রে ব্যানানা বোটে চড়তে। এই বোট বা নৌকোটি রাবারের তৈরী আর হাওয়া ভরে ফোলানো। দেখতে ঠিক পাকা কলার মতো-ই আর রং-ও হলুদ। উপরে ছয় জন করে বসতে পারে, একটি করে আঙটা লাগানো আছে ধরে থাকার জন্যে। এর সামনে একটি মোটরচালিত বোটে এই ব্যানানা বোট বেঁধে দেওয়া হয় আর দুরন্ত গতিতে মোটরবোট চলতে শুরু করলে এই ব্যানানা বোট-ও কোনোমতে টাল সামলে পাল্লা দিয়ে জল কেটে দৌড়োয়। জলের ফোয়ারা, দুরন্ত গতির সাথে শরীরের ভারসাম্য রাখা আর অসীম সমুদ্রের বুকে ছুটে চলা, একেবারে রোমহর্ষক ব্যাপার বটে। সবাই মিলে খুব উপভোগ করলাম এই রাইড। এরপর ইয়াটেই হলো মধ্যাহ্নভোজ, সামুদ্রিক মাছ, মীটবলস, নুডলস, সব্জী, স্যুপ, বাকলাভা ইত্যাদি। হালকা যন্ত্রসঙ্গীতের তালে তালে খানিক পা মেলানো হল সবাই মিলে, কারণ আজই আমাদের মিশরে শেষ দিন। আগামীকাল কায়রো ফেরা এবং সেখান থেকে সোজা মুম্বই। সামাহ আর সুশান্তের সঙ্গে আমরা কিছু ছবি তুলে রাখলাম স্মৃতি হিসেবে। সামাহ এখান থেকেই বিদায় নেবে কায়রোর উদ্দেশ্যে, অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু উপহার সবাই মিলে তুলে দেওয়া হল সামাহ-র হাতে। বন্দরে ফিরে এসে আমরা কয়েকজন এবার রওনা হবো সাবমেরিন ডাইভের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে। দলের বাকি বন্ধুরা হোটেলে ফিরে গেলেন। আমরা দুটি ছোটো গাড়িতে করে রওনা হলাম আরেকটি বন্দরের উদ্দেশ্যে। পরে এই গাড়িই আমাদের পৌঁছে দেবে হোটেলে। এই সাবমেরিন ডাইভের খরচ আমাদের দুজনের পড়ল প্রায় সাড়ে চার হাজার ইজিপ্সিয়ান পাউন্ড। এই দ্বিতীয় বন্দর থেকে একটি বড় মোটরবোটে চড়ে আমরা চললাম সাবমেরিন প্ল্যাটফর্মের দিকে, যেটি রয়েছে গভীর সমুদ্রে। আমাদের সঙ্গে আরও কিছু বিদেশী পর্যটক যোগ দিলেন। যাত্রা শুরুর আগে আমাদের গলায় পরিয়ে দেওয়া হল সাবমেরিনের নামাঙ্কিত কার্ড, প্রতি কার্ডে আলাদা নম্বর বসানো। আমাদের সাবমেরিনের নাম – সিন্দবাদ। সাবমেরিন প্ল্যাটফর্ম-টি আসলে ভাসমান বলে মনে হলেও নীচের দিকে সম্ভবতঃ কোনোভাবে আটকানো আছে একি স্থানে স্থির রাখার জন্যে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমাদের সামনেই ভুস করে জলের উপর ভেসে উঠল ‘সিন্দবাদ’। আগের পর্যটক-দলকে ফিরিয়ে আনা হল, তাঁরা এক এক করে প্ল্যাটফর্মে উঠে আসতেই আমাদের নামার পালা। এখনও অবধি সাবমেরিনে ঢুকেছি দুটি জায়গায়। একটি বিশাখাপত্তনমের বালুতটে রাখা সাবমেরিন আই এন এস কুরুসুরা, এটি অবশ্য একেবারেই ছোটো; আর একটি সেই আমেরিকার বাফেলো নাভাল পার্কে রাখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত ইউ এস এস ক্রোকার SS-246 – এটি অবশ্য বিশাল মাপের। তবে সত্যি সত্যি সাবমেরিনে উঠে সমুদ্রের গভীরে ডাইভ দেবো সেই ছোটোবেলায় পড়া নটিলাস-এর মতো, এ অবশ্য অনন্য অভিজ্ঞতা! সাবমেরিনের ছোট্ট লোহার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলাম, এটি অবশ্য সত্যিকার যুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত সাবমেরিন নয়, শুধুই পর্যটকদের উদ্দেশ্যে বানানো। ভিতরে একটি লম্বা করিডোর, তার দুপাশে সারি দিয়ে কাচের জানলা আর প্রতিটি জানলার সামনে একজন করে বসার ব্যবস্থা। আর একেবারে সামনে রয়েছেন চালক; সবাই বসার পর সাবমেরিনের উপরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল ল্যাচ ঘুরিয়ে। এরপর টের পেলাম ব্যালাস্ট ট্যাঙ্কে জল ভরে দিয়ে সমুদ্রতল ছেড়ে নীচে নামছে সাবমেরিন, ডাইভ শুরু। প্রায় ৪৫ ফুট নীচে নামার পর সামনের দিকে চলতে শুরু করল। বাইরে দুজন ক্রু ডুবুরীর পোষাক পরে মাছেদের খাবার দিচ্ছে আর প্রতিটি জানলার সামনে সেই মাছের দঙ্গলকে নিয়ে ঘুরছে। বারাকুডা, ইন্দো-প্যাসিফিক সার্জেন্ট, গোল্ড-ব্যান্ড ফিউজিলিয়া, ফাইভ-লাইন কার্ডিনাল এরকম বেশ কিছু মাছ চিহ্নিত করতে পারলাম। আজ্ঞে না, আমি মৎস্য-বিশারদ নই, ওই জানলার পাশেই মাছেদের ছবিসহ তালিকা দেওয়া ছিল, তা থেকেই লোহিত সাগরে বসবাসকারী এই মাছেদের চিনে নেওয়া। এরপর সুন্দর সুন্দর রঙবেরঙের কোরালও দেখলাম বেশ কিছু। তবে কিছু কৃত্রিম জিনিসও রাখা রয়েছে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যে, হাঙরের কঙ্কাল, পুরনো জাহাজের ভাঙা অংশ, নোঙর ইত্যাদি। প্রায় ৪৫ মিনিটের সফর শেষে আবার আমরা ভেসে উঠলাম সমুদ্রপৃষ্ঠে, প্ল্যাটফর্মের গায়ে।  সাবমেরিন ডাইভের অনবদ্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এবার আমরা ফিরে চললাম হোটেলের দিকে।রিসর্টের অলস বিকেলে সমুদ্রতটে সূর্যাস্ত উপভোগ করে, আমাদের দলের অন্য পর্যটকদের সঙ্গে গল্প-গুজব করে কাটিয়ে দিলাম। আজ তাড়াতাড়ি নৈশাহার সেরে বিশ্রাম। পরের দিন ভোরের নৈসর্গিক সূর্যোদয় যেন আমাদের এই সফল মিশর পর্যটনের মধুরেণ সমাপয়েৎ! হুরগাদা বিমানবন্দরে আসার পথে বাসে আমরা সবাই এক এক করে ভাগ করে নিলাম সেই মধুর অভিজ্ঞতা।  কায়রোতে নেমে আমাদের পাঁচ ঘন্টার অপেক্ষা, সুশান্তের ব্যবস্থাপনায় সেখানেই হল মধ্যাহ্নভোজের সুন্দর ব্যবস্থা। কায়রোতে দুটি আধা ভারতীয় রেস্তোঁরা আছে, ‘রেড এলিফ্যান্ট’ আর ‘হোয়াইট এলিফ্যান্ট’;  প্রথম আসার পর আমরা গিয়েছিলাম হোয়াইট এলিফ্যান্টে। আজকের মধ্যাহ্নভোজ প্যাক হয়ে এল ‘রেড এলিফ্যান্ট’ থেকে। কায়রো বিমানবন্দরে বিমানের অপেক্ষায় বসে ভাবছিলাম আমাদের এই পুরো ট্যুরের কথা, ভ্যালি অব দ্য কিংস-এ পুরো একটা দিন কাটালে কি আরও ভালো হত? অথবা দেনদেরা-র হাথোরের মন্দিরটা যদি দেখা যেত, যার নাম এখানে এসেই প্রথম শুনেছি! হ্যাৎসেপশুটের মন্দিরে পুন্ত-এর সঙ্গে বাণিজ্যের ছবি বা রাণীর ফারাও হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার গল্পের ছবি দেখা হল না যে! যেখানেই ভ্রমণে যাই, নিঃশেষে কি কোনো কিছুই দেখা হয়? হয় না তো!  আসলে, মিশর ভ্রমণ তো বটেই, যে কোনো ভ্রমণই যেন দিনের শেষে ছোট গল্পের মতো,“অন্তরে অতৃপ্তি রবে,সাঙ্গ করি মনে হবেশেষ হয়ে হইল না শেষ।”মিশর নিয়ে যা পড়েছিলাম, যা জেনেছিলাম, তা আরও সহস্রগুণে ধরা দিল এই ভ্রমণের সূত্র ধরে, সেকথাই বা অস্বীকার করি কি করে! সাড়ে চার হাজার বছরের ইতিহাস মাত্র ন’দিনের আয়নায় ধরে রাখা, সেই সভ্যতাকে স্পর্শ করার স্মৃতি চিরদিনের করে রেখে দেওয়া, সে-ও কি কম কিছু! কায়রোর আকাশ থেকে মিশর ছেড়ে যাবার মুহূর্তে অবধারিতভাবে তাই মনে হল –“যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই-যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।“
  • জনতার খেরোর খাতা...
    প্রায় কবিতার মতো ৩ - নিবেদিতা ক্ষেপী | উত্তরের অলিগলিখসে যাওয়া দেওয়ালমোরে গল্প শোনায়পায়ে পায়ে হাঁটিফিরে ফিরে আসিমোরে স্বপ্ন দেখায়বৈশাখের তপ্ততায়আমি দাঁড়িয়ে থাকিউত্তরের অপেক্ষায়...১৪ই বৈশাখ ১৪৩১
    মিছিল - আফতাব হোসেন | সাড়ে সাত কাটা চাষ জমি ভাগে পেয়েছিল ছুটকা কিস্কু । তার থেকে দেড় কাঠায় তিন কামরার একটা একতলা বানিয়ে বাকি জমিতে সারাবছর কিছু না কিছু ফলিয়েই টিকলো এত দিন ।-"লাল মাটিতে গর্ভ দেওয়া খুব কঠিন মাস্টার " ...শোনাতো ছুটকা মাঝে মাঝে ,- "ইটা মানুষ লয় বুঝলি না , ইটা দ্যাবতা, তাও আবার ম্যায়াদ্যাবতা , স ও ব উহার মন মত না হলে শরীর গোলবেনি ক, আর তু তো জানু ম্যায়াছেনার মন পেলে শরীর কেমন ফুটে , " বলেই ফিচেল হাসি দিয়ে আড়চোখে তাকায় বউ এর দিকে । ফাগু কিস্কুর এদিকে খেয়াল খুব কম । সে ব্যস্ত তার পোয়াতি ছাগীর জন্য । গরম কোনদিনও লাগে না ফাগুর, ছোট থেকেই কাজু জঙ্গলে মানুষ । বনবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে এসব সয়ে নেওয়া অভ্যেস বরাবর । মগন যখন প্রথমবার পেটে এলো , তখন হালকা গরম লাগলেও মগন কে পেটে নিয়েই বঞ্জর লাল জমিটাকে চষে বেড়িয়েছে বরাবর । মাঝখানে বিমারে পড়েছিল একবার ছুটকা কিসকু । হাসপাতালে দৌড়ে যখন কিছু কাজ হয়নি তখন থানে নির্জলা হয়ে একশাড়িতে পড়ে ছিল চারদিন উপবাসে । অর্ধেক সারার পর গোলাপী শাড়ি পরা দুরগায়ের দিদিরা ভিটামিন দিয়েছিল লিখে দুবার । সাতশো টাকার । মাথায় আকাশ ভাঙার টাকার অংক দেখে হিসেব বুঝিয়েছিল লালুয়া গ্রামের হরি মাহাতো । হপ্তায় একবার করে মিটিংয়ে গাড়িতে করে যেতে হবে । ফি দিন একশো । প্রথম প্রথম লাজ করতো ফাগুর। তারপর সিঁদুর বাঁচাতে রঙ ভুলে দিন একশোর মিছিলের মুখ । ফাগু ভাবে এখন , ভাগ্যিস , ভাগ্যিস পার্টি ছিল , নাইলে লোকটা বাঁচতনি গো । তারপর একযুগ । মগন লায়েক বড় এখন । চার বছর উই মেদিনীপুরে দিন রাত এক করে লায়েক এখন । নিজের ঘর থেকে এগারো কিলোমিটার সাইকেল করে স্টেশন । তারপর ট্রেন । সেখান থেকে কলেজ রোজ । কলেজে সব ভালো , তবে কালো রঙ এর তামাশা বেশি শহরে । মুড়ি টিফিনে জাতের প্যারামিটার এর গল্প দেখে রোজ । ইউনিয়নের সাদা লোকেরা কি সব বোঝায় তার মাথামুন্ডু বুঝে না মগন ।  মগন জানে সিডিউল ট্রাইবের কষ্ট । উপাই ও জানে বের হবার ।মগনার চাকরি গেলো আজ । ফাগু , ছুটকা তাও নীরব বড্ড । মগনাও চুপ ।জিজ্ঞাসালাম ,- "ছুটকা, জানু ছ্যানাটার চাকরি গেছে " ?চুপ ...- " ফাগু জানে " ?এবারেও চুপ ...আসার সময় ফাগু ধরলো ,- মাস্টার , লোকটাকে তিরিশ বছর আগে বাঁচিয়ে আনিছিলাম থানের মানতে । ছ্যানাটার জন্য যেতে পারবুনি কি ?বললাম বেশ যেও। কিন্তু তাও না হলে ?হাসলো মনে হয় ফাগু কিষ্কু , সাত কাঠা ভাগে পাওয়া ছুটকা কিসকুর বউ ।চিবিয়ে বললো - " মিছিল তো আছেই , আগের মত , আবার যাবো , ছ্যানাটার জন্যই, বিনা পয়সায় ...."
    হেদুয়ার ধারে - ১২৬  - Anjan Banerjee |      অমল দশ মিনিট আগেই  পৌঁছেছে বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে  । একটা আকাশি রঙের শার্ট আর মাখন রঙা প্যান্ট পরেছে । পরিপাটি করে চুল  আঁচড়েছে । কেন এসব করেছে কে জানে ।ছটা চল্লিশ নাগাদ পিছন থেকে কার গলা শোনা  গেল ---- ' সরি সরি ... লেট হয়ে গেল ... চলুন ...চলুন ... 'পিছন ফিরে অমল দেখল ইউনিভার্সিটি ফেরতা অপরিপাটি বেশবাসে ঘামে ভেজা শরীরে রাত্রি দাঁড়িয়ে আছে । হাতের ছোট রুমালটা দিয়ে মুখের ঘাম মুছল ।যেতে যেতে বিশেষ কিছু কথা হল না । রাত্রি অমলকে নিয়ে চালতাবাগানের মোড় থেকে একটা বাসে উঠল । অমল নানা কথা ভেবে রেখেছিল  সাজিয়ে গুছিয়ে ভিজে ভিজে করে বলবে বলে ।  কিন্তু তেমন কোন অবকাশ তৈরি হল না । রাত্রি বসেছে লেডিজ সিটে আর অমল ছেলেদের সিটে । আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার এক স্টপ পরে রাত্রি সিট থেকে উঠে পড়ে বলল, ' আসুন ... আসুন '।অমল রাত্রির সঙ্গে নেমে পড়ল । নেমে রাত্রির পাশাপাশি হাঁটতে থাকল । রাত্রি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ' ইশশ্ ... সাতটা বেজে গেল । এদিকে এদিকে ... 'ওরা দুজন বাঁ পাশের গলিতে ঢুকে পড়ল । রাত্রি বলল, ' স্যারকে বলা আছে ... প্রবলেম হবে না ... 'কথাটা অমলের কানে ঢুকল কিনা কে জানে । কারণ তার মনে তখন একটা গানের সুর গুনগুনিয়ে উঠছে ----- কত কথা ছিল তারে বলিতে .... চোখে চোখে কথা হল পথ চলিতে ... ' ।কিন্তু চোখে চোখে কথাই বা হল কোথায় ? অমল বরং গুনগুনাতে পারে , চক্ষে আমার তৃষ্ণা .... তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে ... '      রাত্রি অমলকে নিয়ে নিখিলবাবুর বাড়িতে ঢুকে দেখল কোচিং ক্লাসের ছাত্রীরা সব বিদায় নিয়েছে এবং সাগর ওখানে বসে আছে । আর একজন রোগামতো ধুতি পাঞ্জাবী পরা ভদ্রলোক বসে আছে ।রাত্রি বলল, ' কি ব্যাপার ... তুমি আজকে এখানে  ... আসার কথা ছিল নাকি ?  স্যার কোথায় ? 'সাগর বলল, ' স্যার একটু ওপরে গেছে । এক্ষুণি আসছে । আসার কথা কিছু ছিল না । এমনি  এলাম একবার ... '----- ' ও .... ইনি হলেন অমলবাবু । আমার এক বন্ধুর দাদা । স্যারের কাছে এসেছেন ওনার কথা  শোনার জন্য ... দুর্দান্ত গীটার বাজায় ... অসাধারন শিল্পী ... একদিন শোনাব তোমায় নিয়ে গিয়ে ... 'তারপর সাগরের দিকে দেখিয়ে অমলকে বলল, ' এই  যে , ইনি হলেন আমার মোস্ট ট্রাস্টেড অ্যান্ড বিলাভেড ফ্রেন্ড অ্যান্ড গাইড ... 'অমল কি বুঝল কে জানে । বোধহয় কিছু বোঝার চেষ্টা করতে লাগল । এরকম বেপরোয়া খোলামেলা ঘোষণা শুনে সাগর কেমন জড়সড় হয়ে গেল । খুশিতে বোধহয় ।সে যাই হোক, দুজন দুজনকে রীতিসম্মতভাবে হাতজোড় করে নমস্কার  করল ।এই সময়ে নিখিল ব্যানার্জী ওপর থেকে নেমে এসে ঘরে ঢুকলেন ।ওরা তিনজনই দাঁড়িয়ে উঠল ।নিখিলবাবু বললেন, ' আরে বস বস ... দাঁড়ানোর কোন দরকার নেই  । আমরা সবাই সমান । ব্যক্তিপূজা আমাদের নীতির বাইরে .... 'নিখিলবাবু অমলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ' ইনিই নিশ্চয়ই অমল ... 'রাত্রি বলল, ' হ্যাঁ স্যার ... ওর কথাই বলেছিলাম আপনাকে ... '----- ' হ্যাঁ ... আমি বুঝে নিয়েছি ... 'অমলের উদ্দেশ্যে বললেন, ' রাত্রি তো তোমার ডাই হার্ড ফ্যান । ইশশ্ ... বুদ্ধি করে গীটারটা যদি সঙ্গে আনতে বলত কি ভালই না হত ... যাক , রাত্রি ...  পরের দিন আশা করি এ ভুল আর হবে না ... সঙ্গীত, বিদ্রোহ প্রতিবাদে এক ধারাল অস্ত্রের কাজ করে এসেছে চিরকাল ... 'রাত্রি ঝটপট বলল, ' না স্যার ... আর ভুল হবে না ... সোয়্যার ... 'সাগর মিটিমিটি হাসতে লাগল । বলল,  ' আর ভুল হয় ... 'আর অমল দোদুল্যমান হয়ে নিরালম্ব শূন্যে  ভাসতে লাগল । যেন মেঘের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগল মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ।নিখিল স্যারই তাকে মাটিতে নামিয়ে আনলেন আচমকা ।বললেন, ' সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন ঠিকই  , কিন্তু  কখনও কখনও কলরবও জরুরী । কিন্তু আওয়াজ আর কজন ওঠাতে পারে বা ওঠাতে চায় । এই  'পলিটিক্স অফ সাইলেন্স ' নিয়ে কত  কথা । এই  সাইলেন্স বা নীরবতা সাধারণত তিন ধরণের হয় । কেউ  নীরব হয়ে থাকেন অন্যায়ের সরাসরি সমর্থনে বা স্বীকৃতিতে । কেউ চুপ থাকেন ভয়ে । তারা মুখ খুলতে ভয় পায় । কিন্তু সবচেয়ে জটিল সমস্যা তাদের নিয়ে যারা এই দুইয়ের  মাঝখানের শ্রেণী । যারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন সংশয়ে, অজানায়, অবিশ্বাসে  কন্টকিত হয়ে ... আটারলি কনফিউজড বাই হোয়াট ইজ গোয়িং অন , কেউ  বা রেশানালি ইগনোরেন্ট অ্যাজ টু দ্য ফ্যাক্টস। মানে, ব্যাপারটা ঠিকমতো বুঝতেই পারে  না । আমাদের কিন্তু এই  দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর মানুষের কাছে আগে পৌঁছতে হবে তাদের নাড়া দেওয়ার জন্য । ইন ফ্যাক্ট উই উইল হ্যাভ টু গেট আন্ডার দেয়ার স্কিন ।একদিন এরাই হবে আমাদের সামনে এগিয়ে চলার কি কম্পোনেন্ট । কোন এক চিন্তার ঝড় বইয়ে দিয়ে মনের আগল খুলে দিতে হবে .... 'নিখিল স্যার বলে যেতে থাকেন , প্রধানত অমলের দিকে তাকিয়ে ।' .... কিন্তু মূল সমস্যাটা কি বল তো ? প্রথম শ্রেণীর জনগোষ্ঠীকে নিয়ে । বস্তুত , এদের সংখ্যা কিছু কম নয় । এদের সমর্থনেই শাষকদল ক্ষমতায় আসে এবং এদের তোষণ করে আবার ক্ষমতা দখলের প্রস্তুতি চালাতে থাকে । এই, যে কোন প্রকারের অন্যায়ের সমর্থন এবং প্রশ্রয়প্রদানকারি জনগোষ্ঠী কোন দুরাচারি শাসকগোষ্ঠীর চেয়েও ভয়ঙ্কর । কোন ভ্রষ্টাচারি রাজনীতিকদের রূপ খোলাখুলি প্রকাশিত । কিন্তু এইসব সাধারণ মানুষ ক্যামাফ্লেজিং করে সমাজে মিশে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে । সারা পৃথিবীতেই তাই ।  আমাদের আসল জেহাদ প্রাথমিক ভাবে এদেরই বিরুদ্ধে যারা চুপ করে থাকে অন্যায়ের সমর্থনে ও স্বীকৃতিতে ... 'নিখিল ব্যানার্জী জাগ থেকে ঢেলে এক গ্লাস জল খেলেন । এরপর ওপর থেকে কয়েকটা কাপ সহ  একটা কেটলিতে চা  এবং খানকয়েক বিস্কুট রেখে গেল এক মহিলা । অমল একজন গান বাজনা এবং রোমান্টিকতার নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে বসবাস করা নির্ঝঞ্ঝাট সরকারি অফিসের কর্মচারী ।  এইসব গনগনে কথাবার্তা শুনে তার জল থেকে তোলা মাছের মতো অবস্থা হল । সে প্রথম দিকটা খাবি খাচ্ছিল , তবে পরের দিকে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে গেল । রাত্রির রমনীয় উপস্থিতি তার একটা কারণ । নিখিলবাবুর কথাগুলো সে একেবারে কিছুই  বুঝতে পারছিল না, তা না ... কিন্তু আর সবাইয়ের মতো সেও তো এসব নিয়ে কোনদিন চিন্তাভাবনা করেনি । খাবার খেলেই তো হজম হয় না , বিশেষ করে যদি তা গুরুপাক হয় । পরিপাক যন্ত্র সবার তো সমান হয় না । অমলের পরিপাক যন্ত্র কেমন তা হয়ত ক্রমশ জানা যাবে ।    দেশ বিদেশের আরও অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করলেন নিখিল ব্যানার্জী । কোন দেশে কিভাবে পরিবর্তনের সূচনা, উদ্যোগ এবং পরিণতি রূপ পেয়েছিল বা ব্যর্থ হয়েছিল তা নিয়ে অনেক কথা বললেন নিখিল স্যার । সেগুলো অত্যন্ত সারগর্ভ আলোচনা । কিন্তু দুঃখের ব্যাপার অমল মোটেই মন বসাতে পারছিল না এইসব মাটির মানুষের সুখ দুঃখের আলোচনায় । সে অকৃত্রিম আন্তরিকতায় ভাবল , এটা অবশ্যই তার অপদার্থতা এবং কূপমন্ডুকতা । সরিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও একটা চিন্তা তাকে ক্রমাগত খুঁচিয়ে যেতে লাগল , রাত্রির সঙ্গে ওই  ভদ্রলোকের সম্পর্কটা কি ?  মোস্ট ট্রাস্টেড অ্যান্ড বিলাভেড ফ্রেন্ড বলতে কি বোঝায় ? কিন্তু তার মন মোমের মতো গলে গেল না , বরং ধীরে ধীরে  শীতল বরফের মতো জমাট কাঠিন্যের দেয়াল তুলে দিল চারদিকে ।  প্রায় এক ঘন্টা পরে নিখিল স্যার বললেন, ' পরের শুক্রবার আবার একসঙ্গে হব আমরা । আমি যা সব বললাম সে ব্যাপারে তোমরা মতামত জানাবে আশা করি । আমি যা বললাম তা ভুল না ঠিক সেটা তো জানার দরকার । ইমপেরিয়াস অ্যাটিটিউডে আমি বিশ্বাসী নই  ।সাগর,রাত্রি এবং ওই ধুতি পাঞ্জাবী পরা ভদ্রলোক মুখ খোলবার আগেই অমল বলে উঠল , ' পরের দিন আমি অবশ্যই মতামত জানাব । কথা দিয়ে গেলাম । এটা শিয়োর, ধরি মাছ ,না ছুঁই পানি করে থাকব না ।এতক্ষণ চুপচাপ থাকার পর অমলের এই আকস্মিক উত্তাপ নিঃসরণ দেখে নিখিল স্যার খানিকটা অবাক হয়ে গেলেন ।তারপর বললেন, ' বটেই তো , বটেই  তো .... এই ফোর্সটাই তো চাইছি  ... গো অ্যাহেড অমল  ... বাকল ডাউন অ্যান্ড হ্যাভ আ গো ... ' ' আচ্ছা ... এখন আসছি তা'লে' ,বলে অমল বেরিয়ে যাচ্ছিল ।রাত্রি বলল, ' দাঁড়াও ...  আমি একটু এগিয়ে দিই '।সাগর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ' চল আমিও যাচ্ছি ... 'অমল বলল, ' না না না .... দরকার হবে না ...  আমি চলে যেতে পারব ... ', বলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল । নিখিল স্যার ভাবলেন, ছেলেটার বোধহয় কোন জরুরী কাজের কথা মনে পড়ে গেছে ।রাত্রি মাথা নীচু করে বসে আকাশ পাতাল ভেবে  তার নিজের ত্রুটি খুঁজে বেড়াতে লাগল । সাগর ভাবল, ' রাত্রি নিশ্চয়ই ছেলেটাকে কিছু খারাপ কথা বলেছে । সে জন্য রাত্রির ক্ষমা চাওয়া উচিত ।আর , ওই যে ভদ্রলোক ওখানে বসেছিলেন,  প্রভাকর বটব্যাল ... তিনি ভাবলেন , ' ছেলেমানুষ সব ... এদের কি কোন মস্তিস্কের স্থিরতা আছে ! বড় চঞ্চলমতি .... '     ( চলবে )********************************************
  • ভাট...
    commentnb | তামিলনাড়ুর মেন ইন্ডাস্ট্রিই তো ঘুষ দেয়ানেয়া। ঘুরতে গেলেই বোঝা যায়।
    commentdc | এটা শুধু তামিল নাড়ু :-)
     
     
    Chennai: As Tamil Nadu votes in the first phase of Lok Sabha elections on Friday, the Election Commission of India (ECI) seized cash and materials, including gold and silver, worth a whopping Rs 1,300 crore in about a month after the Model Code of Conduct (MCC) came into force on March 16. Of this, silver and gold topped the list with officials estimating their value to be about Rs 1,084 crores followed by cash (Rs 173.85 crore) in a state that is notorious for bribing voters.
    commentdc | এই যে, &\ এর জন্য একটা খবর খুঁজছিলাম, কদিন আগে হিন্দুতে বেরিয়েছিলঃ 
     
     
    The poll body has seized ₹4,650 crore, including drugs, cash and liquor, an amount which is higher than that recovered in the 2019 elections
     
    The Election Commission (EC) on April 15 said it was on track to seize the largest amount of inducements, including drugs and cash during an election in the last 75 years. Even before polling begins for the Lok Sabha elections, it has seized ₹4,650 crore, an amount which is higher than that recovered in the 2019 elections. During the 2019 general elections, ₹3,475 crore had been recovered by the EC.
     
    তবে এসবই খুচরো বাজেয়াপ্ত। এরকম কয়েকবার ধরা হয়, টোটাল টাকার ১০% হয়তো (শতাংশটা আন্দাজে বললাম, নানান লোকের মতামতের অ্যাভারেজ)। 
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত