এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ মাইক্রোপ্লাস্টিক - স্বাতী রায় | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়২০১৮ সালে ইউরোপ উপকূল থেকে একটি বাচ্চা স্পার্ম তিমিমাছের মৃত্যুর খবরে ‘ইশশ’, ‘আহা’র বন্যা বয়ে যায়। জানা যায় যে তিমি মাছটির পেটে ভরা ছিল বিভিন্ন রকমের প্লাস্টিক ব্যাগ, জালের অংশ, বস্তা এমনকি জেরিক্যানও। বৈজ্ঞানিকদের অনুমান তিমি মাছটি না পেরেছে এই সব প্লাস্টিক শরীর থেকে বার করে দিতে, না পেরেছে সেসব হজম করতে। তার ফলে সম্ভবত পেটের প্রদাহ থেকে গ্যাস্ট্রিক শকে তার মৃত্যু হয়।তবে টিভিতে, কাগজে ছবি দেখে ইসস বলা সহজ, তিমিশাবকটির অবশ্য এত ক্ষমতা নেই যে আমাদের ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিক প্রোডাকশনের গ্রাফকে নিচের দিকে টেনে নামায়। তার ছবি দর্শকের মনে যতই আঘাত করুক না কেন! এই তিমিশাবকটি একা নয় কিন্তু, অনুমান যে বছরে প্রায় লাখখানেক তিমি, সীল ইত্যাদি সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী প্লাস্টিকের কারণে মারা যায়, হয় ছেঁড়া জালের টুকরোতে জড়িয়ে ডুবে মরে, আর নাহলে এই বাচ্চা তিমিটির মতন কোন রকম শারীরিক শক পেয়ে। সেই সঙ্গে অনুমান লাখ খানেক সামুদ্রিক পাখি। তারা সমবেত ভাবে মানুষকে কাঠগড়ায় তুলতে পারে না, এই যা বাঁচোয়া। আমরা ডাঙ্গার জীব, সমুদ্রের প্রাণীরা মারা গেলেও যতক্ষণ না আমাদের গায়ে মৃত্যুর ঝাপটা সরাসরি এসে লাগছে, ততক্ষণ আমরা নড়ে বসব কেন? না নড়ে বসতে চাইলে, কেউ অবশ্য জোর করছে না। কিন্তু মুষ্টিমেয় কেউ কেউ হয়ত বুঝবেন যে হয়ত অজানা শত্রু আমাদের দুয়ারেই হাজির। শত্রুর নাম হল প্লাস্টিক। এমনিতে প্রচণ্ড দরকারি জিনিস। কিসে না লাগে! কিন্তু সমস্যা এইটাই যে প্লাস্টিক বলতে আমরা যে বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য বুঝি, তাদের সবকটিকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার কোন পকেটসই সুবিধাজনক পরিবেশ বান্ধব উপায় মেলে না। আবার সেটা এমনি ফেলে রাখলে প্রকৃতিতে মিশে যেতে অতি দীর্ঘ সময় লাগে। আর ততদিনে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সেটা ম্যাক্রো-প্লাস্টিক মেসো-প্লাস্টিক, মাইক্রো-প্লাস্টিক ইত্যাদি বিভিন্ন আকারের চেহারা নেয়। ম্যাক্রোপ্লাস্টিক হল ২.৫ সেমির থেকেও দৈর্ঘে বা প্রস্থে বড় যে কোন প্লাস্টিকের টুকরো। ৫ মিমি – ২.৫ সেমি অবধি টুকরোকে বলে মেসো-প্লাস্টিক। আর মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হও ১ মাইক্রো মিলিমিটার থেকে ৫ মিলিমিটারের সাইজের প্লাস্টিকের কণা। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়েই আজকের কথা। কারণ আজকের দিনে এরা জলে স্থলে বাতাসে সর্বত্র ভেসে বেড়াচ্ছে। টেকনিক্যালি দেখলে রাসায়নিক দিক থেকে এরা সকলে অবশ্য এক নয়। পলিথিলিন বা পলিপ্রোপাইলিন বা পেট বা পিভিসি ইত্যাদি কোন রকমের প্লাস্টিকের থেকে তৈরি তার উপর নির্ভর করে মাইক্রোপ্লাস্টিকের গোত্র। তবে এক্ষেত্রে গোত্রে কি আসে যায়! কেন মাইক্রোপ্লাস্টিককে বিপদ বলে ভাবছি? এক তো ভারতের অর্থনীতিতে প্লাস্টিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ কোটি টাকার মোট ব্যবসা। ২০২৪ থেকে ২০৩০ সালের আনুমানিক বার্ষিক বৃদ্ধি ৬.৬%। প্রচুর লোকের রুজি রোজগার জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। আবার এর মধ্যে মোটামুটি কুড়ি শতাংশের এদিক ওদিক এক্সপোর্ট হয়ে দেশের বিদেশী মুদ্রার ভান্ডার স্ফীত করে। প্লেক্সকনসিল (দ্য প্লাস্টিক এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিল) সূত্রে পাওয়া যে সরকারি লক্ষ্যই হল ২০২৭ সালের মধ্যে এই বহির্বানিজ্যকে অন্তত আড়াইগুণ বাড়ানো। তাছাড়া নিজেদের জীবনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, প্যাকেজিং থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে বিলাস সামগ্রীর আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে সবেতেই প্লাস্টিক কিভাবে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের জীবনে। সহজে তাকে নিজের জায়গা থেকে নড়ানো যাবে না। কাজেই বোঝাই যাচ্ছে যে প্লাস্টিক, ‘আপনি থাকছেন স্যার’। এদিকে সরকারি হিসেব মতে১, ২০২০-২১ সালেই (পরের বছরগুলির তথ্য মেলেনি) দেশে ৪১ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গ বছরে ৪.২ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে ২০২০-২১ সালের সরকারি তথ্য অনুসারে তৃতীয় স্থানে, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ুর ঠিক পরেই। এই সংখ্যাটাও বছর বছর বাড়ছে। অবশ্যই প্রথম সারির দেশের তুলনায় মাথা পিছু বিচারে কিছুই না এই সংখ্যাটা - আমাদের জনসংখ্যা বিপুল হওয়ায় সুবিধা। তবু সংখ্যাটা তো নিছক অঙ্কের দিক দিয়ে কম নয়। আরও সমস্যা হল আমাদের কথা আর কাজে খুব বেশি সামঞ্জস্য নেই। আর সরকারি হিসেব মতে এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্যের দুই তৃতীয়াংশ উৎপাদক কোম্পানির দায়িত্ব। তার পরেও এক তৃতীয়াংশের তো কোন হিসেবই নেই। বাস্তবে কি হয়? তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে কোম্পানিরও কিন্তু শুধু প্রসেসিং এর দায়িত্ব, কতটা সত্যি সত্যি কি হচ্ছে তার খবর সব কোম্পানি রাখে কি? এমনিতেও কতটা বর্জ্য কোম্পানি ফিরে পেল, সেগুলো কিভাবে প্রসেস করল, এই ধরণের কোন একাউন্টিং হয় কি? এই বর্জ্য যায় কোথায়? ব্যক্তিগত ব্যবহারের যে প্লাস্টিকের মগ, বালতি, ডাস্টবিন ইত্যাদি কিনি আমরা, সেগুলো কি উৎপাদককে ফেরত দেওয়ার কোন ব্যবস্থা আছে? তার ব্র্যান্ড জিজ্ঞেস করলেই তো বিপদে পড়ে যাব! আর আমরা হেথায় হোথায় যেসব পুরোন প্ল্যাস্টিক ফেলে রাখি, বা সেসব জিনিস জঞ্জালের সঙ্গে ফেলে দিই, তার সামান্য অংশই বাস্তবে রিসাইকল হয়। বেশিটাই রোদে, জলে-বৃষ্টিতে পড়ে থাকে আর ক্ষয় হয়ে হয়ে মাটি-জল-বাতাসে মেশে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের সেকেন্ডারি উৎস।অবশ্য এছাড়া ব্যবসার জন্য আলাদা করে মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি করাও হয়। সেটাই প্রাথমিক উৎস। ওই যে ফাঊন্ডেশনের টিউবটি আপনার ড্রেসিং টেবলে শোভা পাচ্ছে বা যে লিপস্টিক বা ফেস পাউডারটি ছাড়া আপনি বাড়ির বাইরে বেরোতে পারেন না, সেটি কি কি দিয়ে তৈরি আমরা আর কজন জানতে যাই? এই যে বিদেশে অল্পবয়সী মেয়েদের মধ্যে টিউবিং মাস্কারা এত জনপ্রিয়, সেই টিউবটি কিসের তৈরি জানেন কি? “বিট দ্য মাইক্রোবিড” ক্যাম্পেইনের মতে, মেবেলাইন কোম্পানির ৮৫% প্রডাক্টে মাইক্রোবিড ব্যবহার করা হয়। এমনকি আমাদের ঘরের পাশের ল্যাকমে কোম্পানির সানস্ক্রিন লোশন “সান এক্সপার্ট এস পি এফ ৫০ আলট্রা ম্যাট লোশন” এও মাইক্রোবিড মিলেছে। তবে এদেশে যেহেতু এইসব নিয়ে মানুষের মাথা-ব্যথা কম, তাই দেশজ ব্র্যান্ড নিয়ে এখানে মাথাব্যথাও কম। এদিকে বিশ্বজুড়ে কসমেটিকস কোম্পানিগুলোর সর্বমোট বাজার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তাই এখানে মাইক্রোপ্ল্যাস্টিকের বহুল ব্যবহার চিন্তার বিষয় বৈ কি! শুধু একা হরেক কসমেটিকসকে দায়ী করলে হবে না। বস্তুত ২০১৯ সালের নেচারে প্রকাশিত এক পেপারে২ জানানো হয়েছিল যে পরীক্ষা করে দেখা গেছে সাধারণ সিনথেটিক জামাকাপড় বাড়িতে ব্যবহৃত ওয়াশিং মেসিনে কাচা হলে প্রতি কেজি কাপড়ে ১২৮ থেকে ৩০৮ মিলিগ্রাম মাইক্রোফাইবার বেরোয়। অবশ্যই কাপড়ের চরিত্রের উপর নির্ভর করে সংখ্যার এই হেরফের হয়। আর এই মাইক্রোফাইবারের একটা বড় অংশ আবার কোন অধুনা-প্রচলিত বর্জ্য-জল-শোধন প্রক্রিয়ায় আটকানো যায় না। ফলে সেসব সোজা গিয়ে পরিবেশে জমে। এই ডেটার থেকে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন যে বছরে যত মাইক্রোপ্লাস্টিক সমুদ্রে গিয়ে পড়ে, তার অন্তত ৩৫% আসে এই কাপড় কাচার থেকে। অবশ্য এই তথ্য মিলেছে ওয়াশিং মেশিনে কাচা কাপড় দিয়ে। এবার কেউ কেউ ভাবতেই পারেন যে ভারত উপমহাদেশে তো এখনও হাতে কাপড় কাচাই বেশি প্রচলিত। তাই বিপদ ওদের, আমাদের আর কি! কিন্তু আসলে সমস্যা আছে। কারণ সমুদ্রের জল আসলে কোন রাজনৈতিক সীমানা মানে না। আর দ্বিতীয়তঃ কাপড়ের থেকে মাইক্রোফাইবার ওঠে মেকানিকাল ও কেমিকাল স্ট্রেসের কারণে। হাতে কাচলে মেকানিকাল স্ট্রেস খানিকটা কম হলেও কেমিক্যাল স্ট্রেসের মাত্রার মনে হয় খুব হেরফের হবে না। আবার ধাই ধপাধপ কাপড় আছড়ে আছড়ে কাচলে কি হয় দেবাঃ ন জানন্তি। এছাড়াও ‘একবার কাচলে কাপড় আবার প্রায় নতুনের মতন হয়ে ওঠে’ এমন ধারার বিজ্ঞাপন দেওয়া বহু ডিটারজেন্ট বা ফেব্রিক সফটনার এর মধ্যেই মাইক্রোপ্ল্যাস্টিক থাকে। ইউরোপের প্রচলিত ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে অন্তত ১১৯ টা ব্র্যান্ডে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। সে অবশ্য ইউরোপে বিধিনিষেধও কড়া, ফলে যে সব পদার্থ দিয়ে তৈরি তার সবিস্তার হিসেব প্যাকেটের উপর দিতে হয়। আমাদের অত নিয়মের কড়াকাড়ি নেই। আর ভারতের ব্র্যান্ডগুলো নিয়ে বিশেষ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার হদিশও সহজে মেলে না। অন্য হাতে এক কনজ্যুমার রিপোর্ট৩ বহুল প্রচলিত ১২ টি ডিটারজেন্ট ব্রান্ডের তুলনামূলক পরীক্ষা করে জানিয়েছে যে এদের কোনটাতেই মাইক্রোবিড নেই। কাজেই বৈজ্ঞানিক ভাবে কেউ হাতে কাপড় কাচার পরের বেরোন জলকে পরীক্ষা না করে দেখা অবধি বা ব্র্যান্ডগুলির উপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা না হওয়া অবধি আমরা এসব অমূলক ভয় বলে আপাতত নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমাতেই পারি। আমাদের রোজের জীবনে অবশ্য গাড়ীর চাকা ইত্যাদি আরও অনেককিছু জানা-অজানা উৎস থেকেই নিয়ত প্লাস্টিক ক্ষয় হতেই থাকে। তবে স্বস্তির জায়গা খুব একটা হয়তো নেই। এমনিতেই সমুদ্রের ধারে ধারে গবেষণা করে জানা গেছে পৃথিবীর ১৯২ টা উপকূলীয় দেশে যত প্লাস্টিক বছরে তৈরি হয়, তার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ মাইক্রোপ্লাস্টিক হিসেবে গিয়ে জমা হয় উপকূল অঞ্চলে। আমাদের সুন্দরবন অঞ্চলে প্রচুর প্লাস্টিকজাত দূষণ-পদার্থ সমুদ্রের জলে ভেসে এসে জমা হচ্ছে। আবার ভিতর থেকে যেসব নদী বয়ে যাচ্ছে তারাও প্লাস্টিক দূষক নিয়ে গিয়ে ঢালছে। দুয়ে মিলে সুন্দরবনের অবস্থা করুণ হচ্ছে। আর আমাদের সাধের কলকাতার পাশের গঙ্গার জল নিয়ে পরিবেশবিদদের মাথা ব্যথা অনেকদিনই। সাম্প্রতিক গবেষণায়৪ তাঁরা হুগলি নদীর মিষ্টি জলের এলাকার (অর্থাৎ মোহনার কাছের নোনতা জল বা তারপরের মিশ্র জলের অঞ্চল ছাড়িয়ে আরও উত্তরের অংশ থেকে) থেকে ১০ টি স্যাম্পল নিয়ে তার ভিত্তিতে পরীক্ষা করে জানিয়েছেন যে, সব কটি স্যাম্পলেই মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে। সর্বোচ্চ মাত্রায় মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে বালিখালের কাছে - ২০৬৯ টি টুকরো প্রতি মিটার কিউব মিষ্টি জলে। এঁদের সংগৃহীত তথ্য সাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমাদের আধা পরিশ্রুত বা অপরিশ্রুত বর্জ্য তরলই আসলে মিঠে জলের গঙ্গার জলের মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের প্রধান উৎস। এছাড়াও অবশ্যই গঙ্গার ধারের বিভিন্ন কলকারখানার থেকে অন্য ধরণের জলদূষণও হয়। কিন্তু সেসব বলতে গেলে নিবন্ধের আকার শুধুই বাড়বে, তাই থাক সে কথা। জলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কথা আগেই আগ্রা, হরিদ্বার, পাটনা এলাহাবাদ এসব জায়গায় নজরে এসেছে। কারোর কারোর মনে থাকতে পারে, কাগজে বেরিয়েছিল, ২০১৯ সালে পলতার জল পরিশোধন কেন্দ্রে মধ্যে ফিলটার করার জায়গায় মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছিল।৫ পাওয়া যাওয়ারই কথা। কারণ পলতার জল আসে গঙ্গার থেকে আর গঙ্গার জলই তো দূষিত। আর এটাও বুঝে নিতে কোন অসুবিধা নেই যে এখনও যেহেতু ফিল্টার করে সব মাইক্রপ্লাস্টিক আটকানো যায় না, তাহলে কিছুটা প্লাস্টিক শুদ্ধ জলই আমাদের বাড়ি বাড়ি এসে পৌঁছেছে। আমরা শোধিত জল জেনে সেই জলই পরমানন্দে পান করেছি। কিন্তু হায় এতকিছু জেনেও আমাদের ঘুম ভাঙ্গে না! বিপুল পরিমাণে প্রাত্যহিক বর্জ্য পরিশোধনের কোন মহতী পরিকল্পনাও নজরে এল কি? এই তো আমাদের অবস্থা! অবশ্য জলের কথা বলছি যখন, তখন এই পৃথিবীর হাওয়া, মাটি কিছুই কি আর মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ থেকে সংরক্ষিত? একেবারেই না। মাইক্রো প্লাস্টিক কণারা সহজেই হাওয়ায় ভেসে ভেসে দূর দূরে চলে যায়। অবশ্য কলকাতার ক্রমনিম্নমুখী হাওয়ার গুণগত মান গোটা পৃথিবীর মানুষের চিন্তার বিষয়। আর তাতে ভাসমান কণারা এতোই বিপজ্জনক মাত্রায় প্রায় সব সময়ই ঘুরে বেড়ায়, তাই সেটাই বড় চিন্তার বিষয়। আলাদা করে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিয়ে বিশেষ গবেষণা হয়েছে বলে চোখে পড়েনি। জাপানের বিজ্ঞানীরা অবশ্য শঙ্কা প্রকাশ করেছেন৬ যে বাতাসে ভাসমান কণাদের তো পিএম২.৫ মাপ দিয়ে মাপা হয় আর সেটাকেই স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক বলে ভাবা হয়, ভাসমান মাইক্রোপ্লাস্টিক কণারা তার থেকে আকারে বড় বলে হয়ত তেমন নজরদারিতে আসছে না। তাহলে কি স্বাস্থ্যের পক্ষে কী বিপজ্জনক সেটাও নতুন করে ভেবে দেখা দরকার আছে? আর এখন তো (২০২৩ সালের কাগজে বেরিয়েছিল খবরটা৭) হিরোশি ওকোচির নেতৃত্বে জাপানি বৈজ্ঞানিকরা মাউন্ট ফুজির উপর জমে থাকা মেঘের মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের সন্ধান পেয়েছেন। সমস্যা এই আমাদের পৃথিবীকে ঘিরে রাখা বায়ুমন্ডলে উপস্থিত মাইক্রোপ্লাস্টিক কণারা তারা সমবেত ভাবে মেঘ তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াকেই ঘেঁটে দিতে পারে। সেই সঙ্গে মেঘের থেকে সূর্যালোক প্রতিফলন বা বৃষ্টি হওয়ার ধরণ ইত্যাদি বদলে দিতেও তারা সক্ষম। সব মিলিয়ে পৃথিবীর আবহাওয়াকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা ধরে এই অদৃশ্য কণাগুলো। এমনিতেই আবহাওয়ার বদলের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে আমরা নাজেহাল, সেই সঙ্গে আরও বারুদ হয়ত পরিবেশে জমা করছি নিজেদের অজান্তে। আর যে দেশে অধিকাংশ প্লাস্টিক বর্জ্যের ভবিতব্য জমি ভরাট করার কাজে লাগতে সেখানে মাটিও যে প্লাস্টিকময় হয়ে যাবে তাতে আর আশ্চর্য কি? ২০২০ সালেই বর্ধমানের মেমারি অঞ্চলে সমীক্ষা করে গবেষকরা৮ দেখেছেন মাটিতে কিভাবে ম্যাক্রোপ্লাস্টিক ও মাইক্রো প্লাস্টিক দুইই মিশে রয়েছে। তাঁরা এও জানিয়েছেন যে মাটিতে প্লাস্টিকের উপস্থিতি কিভাবে মাটির জলধারণ ক্ষমতা ইত্যাদি চরিত্র বদলে দিচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদনে প্রভাব পড়ছে। আর সেই প্লাস্টিক গাছের মধ্যে দিয়ে খাদ্যে মিশে মানুষের প্লেটে এসে পৌঁছাচ্ছে। কারণ হিসেবে তাঁরা মূলত দায়ী করেছেন মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য দেওয়া আধা-তরল, আধা-কঠিন পরিশোধিত বর্জ্য-অবশেষকে। এতেই প্লাস্টিক ভরা। এছাড়াও আছে প্লাস্টিক আবরণে মোড়া সার (যতদূর পড়েছি, এ বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ ধারনার নিতান্তই অভাব, সারের ধীরে ধীরে মাটিতে মেশা নিশ্চিত করতে প্লাস্টিকের মোড়ক দেওয়া হয়, অন্য কোন কারণ আছে কি?)। এমনিতেই বঙ্গোপসাগরের পাশের সুন্দরবন প্লাস্টিক সেসপিট বলে বহুদিন ধরেই আখ্যা পেয়েছে। সেখানকার মাটি, জল ও প্রাণী-উদ্ভিদের জীবনে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব নিয়ে অল্প কিছু কাজ তাও চোখে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জায়গায় এই হিসেব আদৌ হয়েছে কিনা জানা নেই। অথচ বিদেশে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন যে প্লস্টিক কিভাবে গাছের অঙ্কুরোদ্গমের হারকে বা অঙ্কুরের বাড়কে ব্যাহত করে। মানুষের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতিরও ক্রমশঃ প্রমাণ মিলছে। নেদারল্যান্ডের ২২ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে ১৭ জনের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে। বস্তুত এখনও অবধি পরীক্ষায় আমাদের লালা, রক্তপ্রবাহ, প্লাসেন্টা, কোলন, ফুসফুস, মল ইত্যাদির মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে মাতৃদুগ্ধ ও সদ্যজননীর প্ল্যাসেন্টাতেও। আজকের বিজ্ঞানীরা বলছেন মানুষের শরীরে তিনভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢোকে। প্রথমত শ্বাস গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ফাইবার বা হাওয়ার সঙ্গে মিশে থাকা কণা হিসেবে এসে শরীরে ঢুকতে পারে। ইন্ডিয়া টুডে গত বছরের একটা খবরে জানিয়েছিল যে আমরা প্রতি সপ্তাহে একটা করে ক্রেডিট কার্ড তৈরি করার মতন যথেষ্ট পরিমাণে মাইক্রো প্লাস্টিক শ্বাসের সঙ্গে টেনে নিই। গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা৯ মাইক্রোপ্লাস্টিক কিভাবে মানুষের শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে দিয়ে ঘুরে বেড়ায় তার একটা মডেল বানিয়েছেন। নাক দিয়ে ঢুকে শেষে রক্তের সঙ্গে মিশে যায়, তারপর চলতে চলতে সোজা ফুসফুস বা হৃৎপিন্ডে বা অন্যান্য অঙ্গে পৌঁছে যায়। অবশ্য শুধু যে দূষিত হাওয়া দায়ী এমন তো নয়, খাবার বা পানীয়ের মাধ্যমেও মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে ঢুকতে পারে। এই যে গোটা শীতকাল জুড়ে ধাপার কাছের ইস্টার্ণ বাইপাশের ধারে ধারে কলকাত্তাই বাবুদের গাড়ি থামিয়ে নধর সবজি কিনতে দেখা যায়, সেই সব ‘ড্যাঞ্চি’ সবজির সঙ্গে সঙ্গে আমরা কী কী যে খাই কে জানে! তবে এইসব নিয়ে দেশজ রিসার্চ এখনও তেমন মেলে না। তাই আপাতত বিদেশী রিসার্চ থেকেই বলা যাক যে ইটালিতে রোজকার আলু, ব্রকোলি ইত্যাদি সবজির মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এমনকি যে আপেল নিয়ে বলা হয় যে ‘অ্যান অ্যাপেল আ ডে / কিপস দ্য ডক্টর অ্যাওয়ে’, সেই আপেলেও এই দূষকের হদিশ মিলেছে। অবশ্য পরিবেশ-দূষণের আরেকটা ফল হল খাদ্য শৃঙ্খলে মাইক্রো প্লাস্টিকের ঢোকার পাসপোর্ট পাওয়া। ফাইটোপ্ল্যাংটন বা সায়ানোব্যাক্টিরিয়া মারফৎ তাদের খাদক বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে দিয়ে ধাপে ধাপে মানুষের শরীরে এসে ঢোকে। এই যে পাশের বাড়ির দত্তবাবুর বাড়িতে তিনদিন বর্ষার ইলিশ এসে গেল বলে ঈর্ষায় নীল হয়ে গিয়ে আপনি বাজার থেকে বিপুল দাম দিয়ে গোটা ইলিশ কিনে আনলেন আর সোশ্যাল মিডিয়ায় বড় করে ছবি পোস্টালেন, জানেন কি সেই ইলিশের মধ্যে কি কি আছে? অবশ্য বিজ্ঞানীরা বলছেন ত্বকের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমেও শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক লেগে যায়, ভিতরে অনুপ্রবেশ না করতে পারলেও। তার গায়ে লেগে থাকা টক্সিক পদার্থ থেকেও বিপত্তি হওয়া সম্ভব। একবার শরীরে ঢুকতে পারলেই হল, তারপর যে কত রকমের বিপত্তি ঘটাতে পারে! যেমন বেয়াড়া আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিকের খোঁচা লাগতে পারে বিভিন্ন অঙ্গ- প্রত্যঙ্গে। প্রদাহ তৈরি হয়। তার উপরে বিভিন্ন মাইক্রোপ্লাস্টিকের রাসায়নিক গড়ন আলাদা আলাদা তো, আর প্লাস্টিক তৈরির পর্বেও বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। সবে মিলিয়ে শরীরের ভিতরে বিভিন্ন এন্ডোক্রিন ডিসর‍্যাপ্টার বা তাদের ক্ষরণে সহায়ক পদার্থ ঢোকে, মোটাদাগের ভাষায়, বহুবিধ হরমোনের গণ্ডগোল সৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ে। যার ফলশ্রুতি বাড় বৃদ্ধির সমস্যা, বিভিন্ন প্রজনন তন্ত্রের সমস্যা থেকে ক্যান্সার, নিউরোডিজেনেরেটিভ অসুখ অবধি অনেক কিছুই হতে পারে। আরও একটা সমস্যা হল যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের গায়ে লেগে লেগে বিভিন্ন হেভি মেটাল বা অন্যান্য টক্সিক পদার্থও শরীরে ঢুকতে পারে, তারাও বিভিন্ন রকমের খেলা দেখায় শরীরে। বলে না একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর! নিরীক্ষায় দেখা গেছে এমনকি কম দূষিত হাওয়াতেও দীর্ঘদিন ধরে শ্বাস গ্রহণের ফলে হৃৎপিণ্ডের বা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা হতেই পারে।১০ খুব সম্প্রতি কালে অবশ্য এক গবেষণায় ২৫৭ জনকে পরীক্ষা করে দেখানো হয়েছে যে যাদের গলার ধমনীতে জমে থাকা প্লাকের প্রলেপের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে তাদের মধ্যে বছর তিনেকের ধারে কাছে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক ও তার থেকে মৃত্যুর সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে চারগুণ। বিপদ বলে বিপদ! এছাড়াও বিজ্ঞানীরা হজমের গোলমাল থেকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কমে যাওয়া থেকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস জনিত টিস্যুর ক্ষতি ইত্যাদি বহু শারীরিক বিপদ সম্ভাবনার পিছনেও প্লাস্টিককে চিহ্নিত করেছেন১১ - উৎসাহীরা একটু নেট ঘাঁটলেই বহু তথ্য পাবেন। তবে এই নিয়ে আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। যদি বিজ্ঞানীদের বলা এই সব সম্ভাবনা সত্যি হয়, তাহলে মাইক্রোপ্লাস্টিককে নিঃশব্দ ঘাতকের তকমা দেওয়াই যুক্তিযুক্ত হবে। অবশ্য ক্ষয়িত প্লাস্টিকের অপর ফর্ম মানে ন্যানোপ্লাস্টিককেও এই বিপদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। তবে অবশ্য এই দেড় কোটি মানুষের দেশে মানুষের প্রাণ ম্যাক্রো স্কেলে সব চেয়ে সহজলভ্য। কিছুটা ভারতীয় জীবন দর্শনও হয়ত মানুষকে কিঞ্চিৎ দার্শনিক করে দেয়, তারা ভাবে মরব তো একদিনই, এত না ভেবে আনন্দে বেঁচে নিই। হবে হয়ত। আর যে দেশে এক বিপুল সংখ্যক মানুষ দৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা করতে করতেই ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে সেখানে আর অদৃশ্য শত্রু নিয়ে কেই বা ভাববে! তার উপর এদেশে গবেষণার খাতে যা সামান্য অর্থ ব্যয় হয় আর সম্প্রতিকালে সেই গবেষণা- অর্থের যে ধরণের গবেষণার দিকে গতি, তাতে এই ধরণের অনিশ্চিত গবেষণা তথা প্রকৃত ক্ষতি মাপার জন্য ক্ষেত্র সমীক্ষা কতটা হওয়া সম্ভব সেও বোঝা খুবই সহজ! কাজেই হয়ত না জানা থাকলেই জীবনে শান্তি বাড়ে। আর জেনে গেলে তখন হয়ত ওই বিদেশের মতন নো প্লাস্টিক উইক জাতীয় কিছু নিঃশব্দে পালন করে আত্ম-পাপ ক্ষালনের চেষ্টা করতে হয়। এও জানা যে তাতে সামগ্রিক কোন ছাপই পড়বে না হয়ত। কিভাবে কমানো যায়? ভোগবাদে রাশ টেনে? ব্যক্তিজীবনে বদল এনে? নাকি অন্য কিছু করা দরকার? অবশ্য কি করলে যে সত্যিকারের বদল আনা সম্ভব তাও কি কেউ একা একা বার করতে পারে? ‘একাকী গায়কের’ জন্য কি আদৌ এই গান? সামগ্রিক সর্বস্তরের ঐকান্তিক চেষ্টার দরকার। ব্যক্তি চেষ্টার সঙ্গে সরকারি নীতির সামগ্রিক মেলবন্ধন হলে তবে না কিছুটা কাজ হয়! আর না হলে এই সব লেখা শুধু ভীতি-উদ্রেককারী বলে বাজে কাগজের ঝুড়িতে জমা হয়! ১) https://pib.gov.in/PressReleasePage.aspx?PRID=1943210 ২) De Falco, F., Di Pace, E., Cocca, M. et al. The contribution of washing processes of synthetic clothes to microplastic pollution. Sci Rep 9, 6633 (2019). https://doi.org/10.1038/s41598-019-43023-x৩) https://consumeraffairs.nic.in/sites/default/files/file-uploads/ctocpas/Deterjent_powder.pdf৪) Ghosh, S., Das, R., Bakshi, M. et al. Potentially toxic element and microplastic contamination in the river Hooghly: Implications to better water quality management. J Earth Syst Sci 130, 236 (2021). https://doi.org/10.1007/s12040-021-01733-9৫) https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/experts-warn-of-micro-plastics-in-kmc-water/articleshow/69065930.cms৬) Wang, Y., Okochi, H., Tani, Y. et al. Airborne hydrophilic microplastics in cloud water at high altitudes and their role in cloud formation. Environ Chem Lett 21, 3055–3062 (2023). https://doi.org/10.1007/s10311-023-01626-x৭) https://www.thehindu.com/sci-tech/energy-and-environment/japanese-scientists-find-microplastics-are-present-in-clouds/article67356549.ece৮) Maji, Piyush & Mistri, Biswaranjan. (2021). PLASTIC CONTAMINATION, AN EMERGING THREAT FOR AGRICULTURAL SOIL HEALTH: A CASE STUDY IN MEMARI II C. D. BLOCK, PURBA BARDHAMAN, WEST BENGAL, INDIA. Pollution Research. 40. 120-129.৯) Riaz, Hafiz Hamza & Lodhi, Abdul Haseeb & Munir, Adnan & Zhao, Ming & Mumtaz Qadri, Muhammad Nafees & Islam, Saidul & Farooq, Umar. (2024). Breathing in danger: Mapping microplastic migration in the human respiratory system. The Physics of Fluids. 36. 10.1063/5.0205303.১০) Lee Y, Cho J, Sohn J, Kim C. Health Effects of Microplastic Exposures: Current Issues and Perspectives in South Korea. Yonsei Med J. 2023 May;64(5):301-308. doi: 10.3349/ymj.2023.0048. PMID: 37114632; PMCID: PMC10151227.১১) Environ. Health 2023, 1, 4, 249–257 Publication Date:August 10, 2023. https://doi.org/10.1021/envhealth.3c00052
    ভ্রমণের বিষ - প্রতিভা সরকার | সদা আনন্দময় যে মানুষ হিমাচল প্রদেশে ঢুকলাম শিবরাত্রির সমারোহ মাথায় নিয়ে। জলুসের পর জলুস যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে, সবাই নিজেদের ট্র‍্যাডিশনাল পোষাকে সজ্জিত, মেয়ে পুরুষের মাথা আচ্ছাদিত, হিমাচলি রঙবেরঙের ঠাটু, টুপি, সব একেবারে জায়গা মত। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, সবাই চলেছে মান্ডির তিনশ বছরের পুরানো শিবমন্দিরের দিকে, যে দেবতার এমনই মহিমা, গত বছর জুলাই মাসের বন্যায় আশেপাশে সব রসাতলে গেছে, কিন্তু মন্দিরটির কোনো ক্ষতি হয়নি। পেতলের পাল্কিতে জলুসের ঠিক মাঝখানে দেবতা যাচ্ছেন, তাঁর অঙ্গও পেতলের। নানা রঙের জাব্বাজোব্বা, মস্তকাবরণে তাঁকে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। কিন্তু যে মানুষদের কাঁধে চড়ে তিনি যাচ্ছেন তারা সবাই আনন্দময় গ্রামীণ মানুষ, সাদাসিধে আর বিশ্বাসী।তীর্থান গ্রামের পঞ্চায়েত কার্যালয় প্রাঙ্গণে আর একরকম আনন্দের বিস্ফার দেখলাম দুদিন পর, আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস উপলক্ষে। পঞ্চায়েত প্রধান মহিলা, সরকারি আধিকারিকও তাই। মাইকে তারা নারী সশক্তিকরণের উদ্দেশে গঠিত বিভিন্ন সেল্ফ হেল্প গ্রুপগুলিকে নানা উন্নয়নমূলক কাজ ও ঋণপ্রকল্প সম্বন্ধে অবহিত করাচ্ছিলেন। তাদের কথা শেষ হতেই মেয়েরা শুরু করল নাচগান। বিভিন্ন গ্রুপের বিভিন্ন ধরণের প্রোগ্রাম। নাম এবং ঠাটুও বিভিন্ন। লক্ষ্মী মহিলা মন্ডলের ঠাটু বা মস্তকাবরণ উজ্জ্বল সোনালী, জাগৃতি নারীশক্তি মন্ডলের বেগুনি, তাতে কুলু স্টাইলের ছাপছোপ। ধর্মীয় নয়, পরম্পরাগত নয়, তবু এই উৎসব গ্রামের বেশিরভাগ মেয়েদের অংশগ্রহণে ধন্য হচ্ছে দেখে ভালো লেগেছে। অনেক কথা হল লক্ষ্মী গ্রুপের প্রধান জি, বিদ্যার সঙ্গে। মেয়েরা এখানে লোনের টাকায় উলের পোশাক বানিয়ে ট্যুরিস্টদের কাছে বিক্রি করে, আচার ঘি জ্যামজেলি ছাড়াও পাইন ফলের অংশ দিয়ে নানা দৃষ্টিনন্দন হস্তশিল্প বানায়। মোটামুটি কিছুটা লাভ থাকে বৈকি বেশির ভাগ গ্রুপেরই। নাহলে হাড়ভাঙা খাটুনির পর মেয়েরা আরও কাজের দায়িত্ব নিতে যাবে কেন! এই জি, বিদ্যার চোখেই সব দেখা হল আমার। পাহাড়ের কোনো দেবতা নেই?তীর্থান গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে, দেবতা মানুষকে এবং জাগতিক সমস্ত কিছুকে রক্ষা করেন সব দুর্ভোগ দুর্বিপাক থেকে। এই বিশ্বাস তীর্থান বা হিমাচলের কেন, হয়ত ভারতবর্ষের সব গ্রামে গ্রামে সব উৎসবের প্রাণ, সব আনন্দের মূল। এই মানুষগুলো শ্রম ও অর্থ দান করে নিজেদের গ্রামের চৌহদ্দিতে মন্দির বানাবে, সেখানে নিত্য পূজার্চনা হবে, তবে না গ্রাম পূর্ণতা পাবে! আমি বিদ্যাকে শুধোই, শুধু পাহাড়ের কি কোনো একক দেবতা নেই, যিনি তাকে রক্ষা করতে পারেন লাগাতার ধ্বংস আর নির্বিচার আক্রমণ থেকে? তাকে বলি, সমস্ত পাহাড়ের রাণী যে হিমাচল প্রদেশ তার চেহারা দিনের দিনের পর দিন যেভাবে কুৎসিত হয়ে উঠছে, তা কল্পনাতীত। পাঞ্জাব পেরিয়ে হিমাচলের সীমানায় ঢুকলেই শুধু উন্নয়ন, নির্মাণ, জেসিপি আর ট্রাকের পর ট্রাক! ট্যুরিজম পয়সা আনে, এজন্য রাস্তার পর রাস্তা তৈরি হচ্ছে, সিঙ্গল লেন ডাবল হচ্ছে বিয়াসের পাশে, সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে যাচ্ছে জেসিপি। ধুলোভরা গাড়ি চলার রাস্তাই হয়ত খুব শিগগিরই উন্নয়নের একমাত্র প্রতীক হয়ে উঠবে। বিদ্যা বা অন্য মেয়েদের বেশি বাইরে যাওয়া হয় না। ক্ষেতি বাড়ি মন্ডলের কাজ সামলাতে অনেক সময় যায়। তবে তারাও শুনেছে পাহাড় ফুটো করা টানেলের পর টানেলের কথা! চল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে না পেরোতে পাঁচখানা টানেল ধোঁয়া আর ধুলো ভর্তি বিরাট হাঁ-মুখে মানুষকে গিলে নেয়। টানেল আগেও ছিল, কিন্তু সে সংখ্যায় কম, যাত্রাপথ হ্রস্ব করা ছাড়া তার আর কোনো কাজ ছিল না। এখন তো ভঙ্গুর পাহাড়ের পেট ফুটো করে কেবলই টানেল, জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে। এরকম চললে কোনো যুদ্ধ বাঁধার আগেই পাহাড় ধ্বসে পড়বে, কোনো নির্মাণই বাঁচবে না, সঙ্গে মারা পড়বে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ, ভেঙে পড়বে বাস্তুতন্ত্র। গতবারের সেই বন্যাবিদ্যারা বলে, প্রকৃতির রুদ্ররোষ যে কী ভয়াবহ চেহারা নিতে পারে, তা দেখিয়ে দিয়েছে গতবারের বন্যা। মান্ডির শিবমন্দির বেঁচে গেলেও মানুষের প্রাণ, ঘরবাড়ি, জীবজন্তু, গাছপালা, কিছুই রেহাই পায়নি। বন্যার জল সঙ্গে নিয়ে এসেছে বিশাল ধ্বস, ব্রিজ উপড়ে, জনপদ ভাসিয়ে সে এক প্রলয়ংকর কাণ্ড! মেয়েরা দেখায়, তীর্থান নদীর ওপর এই ব্রিজের নীচে এখনও লেগে আছে এক বিরাট গাড়ির (টাটা হ্যারিয়ার) কংকাল। না বলে দিলে চেনার উপায় নেই। সেতুর মুখোমুখি পাহাড় উপড়ে ধ্বসের সঙ্গে নেমে এসেছে অজস্র ছোট বড় পাথর। ধ্বসের পথে পড়েছিল এক বিরাট গোশালা। দুধেলা গাই সমেত সেটি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। জল উঠে এসেছিল অনেকদূর। সেতুটিও বেশ খানিকটা ভেসে গেছে বন্যার জলে। কিন্তু কী আশ্চর্য, নদী সরে আসায় বন্যার পর বোল্ডার পরিকীর্ণ তীর সাফ করে এর মধ্যেই উঠে গেছে হোমস্টে নামের সব ছদ্মবেশী হোটেল। এখন নাকি আইন হয়েছে নদীর গায়ের ওপর নির্মাণ চলবে না। একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এতদিন এই আইন ছিল না! যেগুলো এরমধ্যেই মাথা তুলেছে সেগুলো আর একটা বন্যায় ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবে বলে অপেক্ষা থাকবে আমাদের? লক্ষ্মী মন্ডলের লক্ষ্মী মেয়েরাও এই প্রশ্নের সামনে বিমূঢ় হয়ে পড়ে।সব দেখেশুনে মনে হয় ট্যুরিজম একটা ভয়ংকর দৈত্যের চেহারা নিয়েছে। হিমাচল প্রদেশে যেহেতু জমি কেনা যায় না, স্থানীয়দের জমি লিজ নিয়ে হোমস্টে-র নামে হোটেল ব্যবসা খুলে চলেছে রাজ্যের বাইরের ধনী ও প্রভাবশালীরা। স্থানীয়রা লিজের টাকা ও কর্মসংস্থানের অল্প সুযোগই পাওনা বলে মেনে নিয়েছে। কঠিন হাতে এর মোকাবিলা না করলে অচিরেই গোটা হিমালয় ধ্বংস হয়ে যাবে। পরিবেশের সেই নির্বিচার ধ্বংস প্রভাব ফেলবে সারা দেশেই। বিবর্তনের পথে এত সুন্দরের সৃষ্টি হল, সে কি শুধু ধ্বংস হবার জন্যই? তীর্থান গ্রামের মেয়েরা, সমস্ত অধিবাসীরা এ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল এবং চিন্তিতও। কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞ আটকাবার উপায় তাদের অজানা। বৃহত্তর পরিবেশ ভাবনায় দেশের যে মাথারা ভাবিত হলে কাজ দিত, তারা কোথায়!
    পরিবেশ ভাবনায় ভারতীয় সংস্কৃতি সাহিত্য: সেকাল-একাল - সন্তোষ সেন | পরিবেশ বিপর্যয় আজ রাষ্ট্রীয় সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব চরাচরে পরিব্যাপ্ত। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে ১.৪৪ ডিগ্রির ঘরে, কোন প্রান্তে তীব্র দাবদাহ- খরা-তাপপ্রবাহ; অন্যত্র প্রবল বৃষ্টি-বন্যা-ধস, এমনকি দুটো বিপরীত এক্সট্রিম আবহাওয়া প্রায় একই সময়ে একই স্থানে আছড়ে পড়ছে। হিমবাহের অতিদ্রুত গলন, জল বাতাস নদীর দূষণ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে প্রবলভাবে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সংবিধান-গণতন্ত্র-পরিবেশের সংকট সব জড়াজড়ি করে জট পাকিয়ে তুলেছে। প্রবল মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, আর্থিক বৈষম্য সহ পরিবেশ সংকটের মূল কারণ দেশি-বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির নির্বিচারে জল জঙ্গল জমি পাহাড় নদী: প্রকৃতির সব উত্তরাধিকার লুটেপুটে ধ্বংস করা। পরিবেশ বিঘ্নকারীর সংখ্যা হাতে গোনা হলেও এর প্রভাব পড়ছে নিম্নবিত্ত মানুষ, প্রান্তিক কৃষক, কৃষি শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষ ও বনবাসী জনজাতিদের জীবনে। অথচ সমাজের একটা বড় অংশ এখনো কেমন যেন নীরব নিশ্চুপ নিষ্ক্রিয়।এই নিবন্ধের ছোট পরিসরে অতি সংক্ষেপে একটি প্রাথমিক আলোচনা করার চেষ্টা করব ভারতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মননে পরিবেশ ভাবনার গুরুত্বের ওপর। প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ নিয়ে একটি সুসংহত ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা প্রাচীন ভারতের দর্শনে উপস্থিত ছিল না ঠিকই। কিন্তু অজস্র মনিমুক্তো ছড়িয়ে আছে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির অন্তরালে। সিন্ধু সেঁচে এই মনিমুক্তো তুলে এনে আজকের স্থানকালের প্রেক্ষিতে সমাজে প্রথিত করতে পারলে মানব জমিনে নিশ্চিত করেই একটি চারা গাছ রোপণ করা যাবে, যা ডালপালা মেলে শতধারায় বিকশিত হবে। প্রাচীন ভারতের অথর্ব-সংহিতার পৃথিবীসুক্তে ৬৩টি মন্ত্রকবিতা জুড়ে বরফ ঢাকা পাহাড়, ধূলি-পাথর সমাকীর্ণ বিস্তৃত মাঠঘাট, বনজঙ্গল, নদী-সাগর, ছয় ঋতুর সুন্দর সমাহার, নানান কীটপতঙ্গ, পাখপাখালি, ছোট বড় বন্যপ্রাণ: সবকিছু নিয়েই একটা গোটা পৃথিবী ও তার সভ্যতার পরিচয় সুপ্ত আছে। অথর্ববেদের কবির অনুভবে ঔষধি বনস্পতির লালনভূমি বিশ্বম্ভরা বসুধা। নানান জনগোষ্ঠীর বিকাশক্ষেত্রও বটে এই ধরণী। মাটির পৃথিবীর সঙ্গে জীবজগতের এই অন্তরঙ্গতার কথা উঠে এসেছে মহাভারতের কবি ভীষ্মের মুখেও। ভাববাদী দৃষ্টিতে জারিত প্রকৃতি সত্তার অন্তরালে ঋগবেদের সরস্বতী নদী ‘পাবণী জলধারার মূর্তিমতী সুচেতনা’র দেবী হয়ে উঠেছিল। ভূলোক, ব্রহ্মাণ্ড, কিংবা গাছ পাহাড় পাথর হয়ে উঠেছিল দেবতার প্রতীক। তাকে অবলম্বন করে ছান্দোগ্য উপনিষদে সম্পদ-উপাসনার রীতি গড়ে ওঠে। আজও আমরা দেখি আদিবাসী মানুষজন পাহাড় গাছ পাথর নদীকে দেবতাজ্ঞানে (বিমূর্ত ঈশ্বর ভাবনা নয় কিন্তু) পূজা করেন। মনে রাখা দরকার, জঙ্গল পাহাড় গাছ রক্ষার জন্য আদিবাসীদের প্রকৃতিপূজা ও বন জঙ্গলের যৌথ মালিকানার সংস্কৃতি পাহাড় জঙ্গলকে ভয়ংকর ধ্বংসের হাত থেকে একটা মাত্রায় হলেও টিকিয়ে রেখেছে।লতাগুল্ম, ঔষধি-বনস্পতি, জল বাতাসকে সম্বোধন করে তার সাহায্য চাওয়ার কথা এবং গাছগাছড়ার স্বাস্থ্যকর উপকরণের সপ্রশংস উল্লেখ অথর্ববেদে মাঝে মাঝেই উঠে এসেছে। এর মধ্যে আধ্যাত্মদৃষ্টির ভূমিকা স্পষ্ট হলেও বাস্তব উপযোগিতা নির্ধারণের হিসেবি মনোভাবের অসীম মূল্যও কিছু অবজ্ঞা করার নয়।এবার আসি প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কালিদাসের কথায়। ‘বিক্রমোর্বশীয়’ নাটকে শোকার্ত পুরূরবা হারিয়ে যাওয়া প্রেয়সীর খোঁজে লতাপাতাকে জড়িয়ে ধরেন পরমাত্মীয়ের মতো। মেঘদূতের নির্বাসিত বিরহী যক্ষ মেঘকেই ভাই সম্বোধন করে প্রেমিকাকে দুটো কথা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করেছিলেন আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে। আর শকুন্তলা নাটকটি কবি রচনা করেছেন প্রকৃতির কথা মাথায় রেখে প্রকৃতির রূপ রস গন্ধের সাথে জৈব-অজৈব প্রাণ ও মানুষের যাপনকে জড়িয়ে নিয়ে। তাই বনবালা শকুন্তলার কাছে বনজ্যোৎস্না লতাটি আদরের ভগিনী হয়ে ওঠে। তার ফুল ফোটার দিনটিকে যৌবন সমাগমের দিন হিসেবে স্মরণীয় করে রাখার জন্য একটি আম্রবৃক্ষের সাথে বিয়ে দেন প্রিয়ংবদা-অনসূয়া সমেত শকুন্তলা। মনমরা হরিণশাবক তাঁদের পালিত সন্তান রূপেই বিবেচিত হয়। শকুন্তলা নিজে সাজসজ্জা পছন্দ করলেও কখনো গাছের জ্যান্ত ফুল ছিঁড়ে খোঁপায় দিতেন না, বরং গাছে ফুল ফুটলে উৎসবের তরঙ্গ বয়ে যেত শকুন্তলার মননে। গাছের গোড়ায় জল না দিয়ে কোনদিন জলপান করতেন না তিনি। অথচ আজ সারা দেশজুড়ে গাছ কাটার ধূম পড়ে গেছে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। কোন কোন ব্যক্তি/সংস্থার উদ্যোগে কিছু গাছ পোঁতা হলেও তাদের যত্নআত্তির কথা যেন কারোর মাথাতেই আসেনা।পতিগৃহে যাওয়ার দিনে বনের কাঁটাঝোপ, লতাগুল্ম শকুন্তলার কাপড় টেনে ধরে যেন বলে উঠতে চায়, যেও না সখি-আমাদের ছেড়ে যেও না। হরিণীর আর্ত চাহনি শকুন্তলার চোখ ভিজিয়ে দেয়। নিজের মতো সন্তানসম্ভবা হরিণীর নির্বিঘ্ন প্রসবের খবর না পাওয়া পর্যন্ত শকুন্তলার যেন স্বস্তি নেই। কোকিলের কুহূতান না শোনা পর্যন্ত শকুন্তলার পা সরে না। তাঁর কেবলই মনে হয়, অরণ্যদেবী বুঝি যাবার অনুমতি দেননি এখনো। কালিদাসের ভুবনমোহিনী প্রতিভা প্রকৃতির সন্তান শকুন্তলাকে প্রকৃতির সাথে অবিচ্ছেদ্য প্রীতির বাঁধনে বেঁধেছে। উপমা-রূপকের পথ ধরে কুমারসম্ভবেও ফিরে ফিরে আসে প্রকৃতির কথা, প্রাণের কথা, সহজ সরল যাপনের কথা। উপমার ছবি হয়ে ওঠে পুষ্পভর্তি লতার চলাফেরার জীবন্ত চিত্র-বর্ণন। প্রকৃতিকে নিজের অংশ হিসেবে ভাবতে পারতেন বলেই জনৈক বনবাসী রাজা দুষ্যন্তকে হরিণ মারতে নিষেধ করতে পারেন। আরও কিছু অমূল্য সাহিত্য সৃষ্টির দিকে আলোকপাত করা যাক। খেলাচ্ছলে হোক, শিকারের লোভেই হোক ব্যাধের হাতে ক্রোঞ্চবধের নির্মম কাহিনী বাল্মীকির শোকবিহ্বল কণ্ঠে শ্লোক হয়ে ফুটে ওঠে। অন্যদিকে কাদম্বরীতে বানভট্ট একদল মানুষের আত্মঘাতী অরণ্য বিনাশের নিন্দা করেছেন স্পষ্টভাবেই। শালিকলনাথের চোখে একটি গাছ হল ক্লান্ত পথিকের পরম আশ্রয়, যার নিচে বসে মায়ের আঁচলের মতো স্নেহ, স্নিগ্ধ ছায়া পায় পথিকবর। কবি ধর্মপালের মতে তৃণভোজী হরিণের কাছে তৃণভূমি হল মা। আর গাছপালা হল বন্ধু-বান্ধব, নিকট আত্মীয়। ধর্মের ভয় দেখিয়েও প্রকৃতি-মা কে রক্ষার কথা বলেছেন কেউ কেউ। লাঙল চালালে মাটির অনেক পোকামাকড় মারা যায় বলে ব্রাহ্মণের হলকর্ষণ নিষেধ করেছিলেন মনু। তাই বলে ঋষি যজ্ঞব্রত যজ্ঞসভায় পশুবলি দিতে কোনরকম কুণ্ঠা বোধ করেননি।নিসর্গনীতি নিয়ে শাস্ত্রবাক্যের শ্লোক/উপদেশ বা সংস্কৃত সাহিত্য এইভাবে পরিবেশের সাথে মানুষকে সম্পৃক্ত ও অন্তরঙ্গ করে তুলতে চেয়েছে। মাটি আমার মা, গাছ আমার বন্ধু পরমাত্মীয়, জল আমার অন্তরঙ্গ সত্তা, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব সহ সমগ্র প্রাণীকুল আমার বেঁচে থাকার শর্ত: এই সত্তায় মানুষের মনন জারিত হলে সমস্যার সমাধান অনেকাংশে হয়ে যায়। নিজেকে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ অংশ হিসেবে ভাবতে পারলে মুষ্টিমেয় মানুষের দ্বারা পরিবেশে ধ্বংসসাধনের বিরুদ্ধে সে প্রতিবাদের হকদারও হয়ে উঠতে পারে।পরিবেশ ধ্বংস করে আত্মতুষ্টি ও স্বর্গলাভের তীব্র নিন্দা করা হয়েছে পঞ্চতন্ত্রের গল্পে। যেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছে –গাছ কেটে বা পশু হত্যা করে মাটি ভিজিয়ে যদি স্বর্গে যেতে হয়, তবে নরক যাত্রার পথ কোনটা? গাছের ডালে ডালে পাখি, কোটরে পোকামাকড়, ফুলে ফুলে মৌমাছি প্রজাপতিকে আপন করে নিয়ে এক বৃক্ষের দাঁড়িয়ে থাকার কথা সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে পঞ্চতন্ত্রের গল্পে। পুণ্যলাভের পথ হিসেবে দিঘি জলাশয় খনন, সুসংহত বনসৃজনের কথা ধর্মকর্ম হিসেবেই পুরাণে গণ্য হলেও এই বোধটি আজকের দিনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। প্রয়োজন কেবল ধর্মের নামাবলি সরিয়ে নৈসর্গনীতির বোধকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে যুক্তিবাদী ভিতের ওপর দাঁড় করানো।এই আলোচনায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার। অর্থশাস্ত্রের সূনাধ্যক্ষ প্রকরণে হাতি ঘোড়া, কিছু জলচল প্রাণী ও নদী-পুকুর-খাল-সরোবরে জন্মানো মাছ, কোঁচ, জলকাক, হাঁস সহ ময়ূর ময়না ইত্যাদি পাখি সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। বনে পশুপাখি ধরা পড়লে তাদের জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়ার রাজাদেশও স্থান পেয়েছে অর্থশাস্ত্রে। বেশকিছু মঙ্গলসূচক পশু-পাখি সংরক্ষণের কথাও বলা হয়েছে এখানে। রাজাদেশ লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধান আছে অর্থশাস্ত্রে। যেমন বনে আগুন লাগানোর শাস্তি হিসেবে পুড়িয়ে মারর সুপারিশ করেছেন স্বয়ং কৌটিল্য। জীবন্ত পুড়িয়ে মারার বিধানকে বিরোধিতা করেও বলা চলে, প্রকৃতিসংহার অবশ্যই শাস্তিযোগ্য। এবং এক্ষেত্রে শাস্তির খাঁড়া সুতীক্ষ্ণ করতে হবে পরিবেশ সংহারের মূলহোতা হাঙ্গর কর্পোরেট বাহিনী ও তাদের সেবাদাস নানান কিসিমের সরকার প্রশাসনের দিকেই। অঙ্গুলি হেলন করতে হবে লুটেপুটে খাওয়ার জন্য পরিবেশ আইনগুলোকে পরিবর্তন করার নীল নকশার দিকেও। আসলে পাপপুণ্যের ভয় দেখিয়ে বা নরকবাসের আশঙ্কা জাগিয়ে, কিংবা আচার বিচার ও আত্মশুদ্ধির দোহাই দিয়ে, শাস্তির ব্যবস্থা করে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি বা দর্শন পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে মানুষের ভূমিকা সুনির্দিষ্ট করতে চেয়েছিল। এই বিষয়গুলোই আজকের সমাজ মননে প্রথিত করতে হবে যুক্তিবাদ ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর দাঁড়িয়ে।সেকালের প্রাচীন সাহিত্য: বেদ উপনিষদ এবং প্রাচীন কাব্য ও নাটক, বিশেষ করে সেকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী কালিদাসের সাহিত্য সৃষ্টি একালের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর ভীষণভাবে রেখাপাত করে। কবিগুরুর পরিবেশ ও নৈতিকতা সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা সহ তাঁর সমগ্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটা কেন্দ্রীভূত মূল সুর রয়েছে। এক অখণ্ড জীবন দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ বা সমগ্র বিশ্ব একটি পরিবারভুক্ত, এই বিশ্বমানবতার বোধ গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শনে। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতি ও মানুষ এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ‘অরণ্য দেবতা’ প্রবন্ধে কবি বলছেন –মানুষ অমিতাচারী। যত দিন সে অরণ্যবাসী ছিল ততদিন অরণ্যের সঙ্গে তার আদান-প্রদান ছিল। ক্রমে মানুষ যখন নগরবাসী হল, তখন অরণ্যের প্রতি মমত্ববোধও সে হারাল। মানুষ তার প্রথম সুহৃদ তরুলতাকে নির্মমভাবে নির্বিচারে ধ্বংস করে ইটকাঠ আর কংক্রিটের শহর গড়ে তুলতে মনপ্রাণ এক করল। রবীন্দ্রনাথ আরও লিখছেন –অরণ্য ধ্বংস ও বৃক্ষছেদনের ফলস্বরূপ ভারতবর্ষের উত্তর-অংশে গ্রীষ্মের উৎপাত মাত্রাছাড়া হয়েছে। সবুজ বৃক্ষ ও জঙ্গল বিনাশ করে মানুষ যেন দেশে মরুভূমি ফিরিয়ে আনবার উদ্যোগ নিয়েছে। কি অসম্ভব দূরদৃষ্টি। একশত বছর আগে রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে উঠে এসেছে আজকের দিনের ভয়ানক পরিবেশ বিপর্যয়ের স্পষ্ট চালচিত্র। বিপন্ন হিমালয় পৃথিবীর মানচিত্র থেকে উধাও হয়ে গেলে ভারত সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো রুখাশুখা মরুভূমি বই অন্য কিছু নয়।এই প্রবন্ধেই তিনি লিখছেন –“সেই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের আহ্বান করতে হবে বরদাত্রী বনলক্ষ্মীকে –আবার তিনি রক্ষা করুন এই ভূমিকে। দিন তাঁর ফল, দিন তাঁর ছায়া।” কবির উপলব্ধি –আধুনিক মানুষ বিলাসবহুল ও প্রদর্শনমূলক জীবনযাপনে নিদারুণভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্বমানবতার পূজারী রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বলোকে পরিব্যাপ্ত। তাই তিনি স্পষ্ট করে বলতে পারেন –“এই সমস্যা আজ শুধু এখানে নয়। মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে অরণ্যসম্পদকে রক্ষা করা সর্বত্রই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকাতে বড়ো বড়ো বন ধ্বংস করার ফলে এখন বালু উড়িয়ে আসছে ঝড়, কৃষিশস্যকে নষ্ট করছে, চাপা দিচ্ছে। ….. লোভী মানুষ অরণ্যকে ধ্বংস করে নিজেরই ক্ষতি ডেকে এনেছে। বায়ুকে নির্মল করার ভার যে গাছপালার উপর, যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিকে উর্বরতা দেয়, তাকেই সে নির্মূল করেছে” (অরণ্য দেবতা)। ‘শান্তিনিকেতন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন – “যে বিরাট প্রকৃতির দ্বারা মানুষ পরিবেষ্টিত, যার আলোক এসে তার চক্ষুকে সার্থক করেছে, যার উত্তাপ তার প্রাণকে স্পন্দিত করে তুলেছে, যার জল তার অভিষেক, যার অন্নে তার জীবন, …. ভারতবর্ষ সেই প্রকৃতির মধ্যে আপনার ভক্তিবৃত্তিকে সর্বত্র ওতপ্রোত করে প্রসারিত করে রেখে দিয়েছে।” তিনি বলছেন, এই বিশ্বপ্রকৃতির সাথে পবিত্র যোগেই ভারতবর্ষ নিজেকে বৃহৎ করে জেনেছে। আহা, প্রকৃতির সাথে মানবসত্তার কী অপূর্ব আত্মিক যোগ।পাশ্চাত্যের সাথে প্রাচ্য তথা ভারতের প্রকৃতিবোধ ও জীবনদর্শনের স্পষ্ট ফারাক তুলে ধরেছেন তিনি — “শেকসপীয়রের As You Like নাটক একটা বনবাস কাহিনী, টেম্পেস্টও তাই, Midsummer Night's Dream-ও অরণ্যের কাব্য। কিন্তু সে-সকল কাব্যে মানুষের প্রভুত্ব ও প্রবৃত্তির লীলাই একেবারে একান্ত –অরণ্যের সঙ্গে সৌহার্দ্য দেখতে পাইনে। অরণ্যবাসের সঙ্গে মানুষের চিত্তের সামঞ্জস্য সাধন ঘটেনি।”অথচ কালিদাসের শকুন্তলা নাটকের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। প্রকৃতিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শকুন্তলা’ প্রবন্ধে বলছেন – কালিদাস তাঁর অপরূপ কৌশল ও প্রতিভায় শকুন্তলাকে লীলা ও ধর্মের, স্বভাব ও নিয়মের, নদী ও সমুদ্রের ঠিক মোহনার উপর স্থাপিত করেছেন। তপোবনের প্রকৃতি বর্ণন সম্পর্কে তিনি উচ্ছ্বসিত। তাঁর মতে –তপোবনে স্বভাব এবং তপস্যা, সৌন্দর্য এবং সংযম সব মিলেমিশে একাকার। সেখানে সমাজের কৃত্রিম বিধান না থাকলেও ধর্মের কঠোর নিয়ম বিদ্যমান। শকুন্তলার সহজ সরল সুন্দর অথচ গভীর পবিত্রতা সম্পর্কে তিনি লিখছেন –“শকুন্তলাকেও ধূলা লাগিয়াছিল, কিন্তু তাহা সে নিজেও জানিতে পারে নাই। …. সে অরণ্যের চঞ্চলা মৃগীর মতো, নির্ঝরের জলধারার মতো, মলিনতার সংসর্গেও অনায়াসেই নির্মল।” এখানেই রবীন্দ্রনাথের মহত্ত্ব। তাঁর প্রকৃতিপ্রেম ভীষণ প্রগাঢ় ছিল বলেই ‘ধুলোলাগা মলিন শকুন্তলা’কে তিনি অনাবিল জলধারার সাথে, অরণ্যের সরলা হরিণীর সাথে তুলনা করতে পারেন। নদীর বুকে বড় বাঁধের অযৌক্তিকতা ও বিপদ সম্পর্কে বিজ্ঞানী ও নদী বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন ধরেই সরব। ২০২৩ সালে সিকিমে গ্ল্যাসিয়ার লেক আউটবার্স্টের কারণে তিস্তার উপর বড় জলাধার জলের তোড়ে উড়ে যাওয়া এবং কয়েকশ নাগরিকের মৃত্যু নদী বাঁধের বিপদ সম্পর্কে চিন্তাভাবনাকে নতুন করে উস্কে দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকের কথা আমাদের উল্লেখ করতেই হয়। তিনি প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি বা প্রবহমানতা রুদ্ধ করার বিপক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। প্রাকৃতিক জলধারার ওপর আমাদের সকলের সমান অধিকার, তাই এই জলধারার স্রোত বা গতিপথ পরিবর্তন করা অমার্জনীয় অপরাধ। তাই ‘মুক্তধারা’য় শেষ পর্যন্ত এই অপ্রয়োজনীয় বাঁধকে মুক্ত করে স্রোতকে তার নিজস্ব গতিতে বইতে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।এই নিবন্ধটিকে নির্দিষ্ট অক্ষরসীমার মধ্যে বাঁধতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি ভাবনার আরও নানান পরিচয়: একগুচ্ছ প্রবন্ধ, এমনকি ছোট গল্প বা কবিতার কথা অনুল্লিখিত থাকল। বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন পড়েছে যে, আধুনিক ভারতে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে প্রকৃতি ভাবনা, জীবনদর্শন এক উন্নত মাত্রা লাভ করেছে। এই ভাবনা গুলোকে সম্যকভাবে বুঝে নিয়ে আজকের স্থানকালের প্রেক্ষিতে প্রয়োগ করার মধ্য দিয়ে বিশ্বজোড়া প্রকৃতি বিপর্যয়ের সমাধানের তল পাওয়া সম্ভব বলেই মনে করি। বর্তমান যুগের সাহিত্যে, দর্শনে তথা জনমানসে পরিবেশ সংক্রান্ত যে আধুনিক রূপটি ফুটে উঠেছে, তা উল্লেখ করতে হলে সামনে আনতে হবে বর্তমান কালের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ও তার রূপকারদের। শুধুমাত্র উদাহরণস্বরূপ আমরা উল্লেখ করব চিপকো আন্দোলনের কথা। শ্রদ্ধেয় পরিবেশবিদ সুন্দরলাল বহুগুণা, যিনি হিমালয়কে হাতের তালুর মতো চিনতেন, প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন হৃদয় দিয়ে, যাঁর নেতৃত্বে উন্নয়নের অজুহাতে কয়েকশত গাছ কাটার বিরুদ্ধে উত্তরাখণ্ডের আদিবাসী জনগণের বুক দিয়ে গাছ আগলে রাখার আন্দোলন ৫০ বছর ছাড়িয়ে গেল। অথচ উন্নয়নের নামে, নগরায়ণের নামে সবুজ বনানী সহ হেক্টরের পর হেক্টর অরণ্য নিধন হয়েই চলেছে মহা সমারোহে। আজকের দিনের আরেকটি আন্দোলনের কথা সোচ্চারে বলতেই হয়। অবিরল নির্মল গঙ্গার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন জি ডি আগরওয়াল সহ একাধিক সাধুসন্ত। হরিদ্বারের কংখলে মাতৃসদন আশ্রমের সন্ন্যাসীরা জীবনপণ করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন হিমালয় ও গঙ্গাকে রক্ষা করার স্বার্থে, বিগত দশ বছর ধরে ‘নমোমী গঙ্গা’ প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা গঙ্গার জলে তলিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে, গঙ্গার ভয়ানক দূষণের বিরুদ্ধে। হিমালয়ের কথা এসে পড়লে লাদাখের আদিবাসীদের আন্দোলনের মুখ সোনম ওয়াংচুর কথা স্মরণ করতেই হয়। লাদাখ-কাশ্মীর সংলগ্ন হিমালয় সহ ভারতের বড় বড় নদী, সিন্ধু গঙ্গা অলকানন্দা ধৌলি ইত্যাদি বাঁচানোর লড়াইয়ে আজ প্রচুর মানুষ/সংগঠন এগিয়ে আসছে। এই আন্দোলন গুলিতে প্রাণ সঞ্চার করতে ভারতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি তথা জীবনদর্শনকে সামনে আনতে হবে অনেক বেশি করে, অবশ্যই যুক্তিনিষ্ঠ সত্যের উপর ভিত্তি করেই। ভোগ-সর্বস্বতা সম্পর্কে ‘বিলাসের ফাঁস’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ একটি প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য রেখেছেন – “এখনকার দিনে ব্যক্তিগত ভোগের আদর্শ বাড়িয়া উঠিয়াছে। এখন আহার পরিচ্ছদ, বাড়ি গাড়ি জুড়ি, আসবাবপত্র দ্বারা লোকে আপন মহত্ত্ব ঘোষণা করিতেছে। ধনীতে ধনীতে এখন এই লোভের প্রতিযোগিতা। আমাদের দেশে ইহাতে যে কতদূর পর্যন্ত দুঃখ সৃষ্টি করিতেছে, তাহা আলোচনা করিলেই বুঝা যাইবে।”‘আত্মপরিচয়’ গ্রন্থে নবীন রবীন্দ্রনাথের কলমে উঠে এসেছে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা। আত্মপরিচয় এর ভাষা বেশ কাব্যিক মনে হলেও ‘সুদূর বিস্তৃত শ্যামল অঙ্গ’, ‘আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে’, প্রকাণ্ড বৃহৎভাবে এই শব্দগুচ্ছ গুলোর মধ্য দিয়ে তিনি স্পষ্ট করেছেন বিপুলা বিশাল নৈসর্গিক প্রকৃতি তার সমস্ত রূপ -রস-গন্ধ নিয়ে মানুষের বৃহৎ প্রকাণ্ড শরীরকে (এক্সটেন্ডেড বডি) তৈরি করেছে। রক্তমাংসের ক্ষুদ্র শরীরের আরামের মোহে আমরা যতই অন্ধভাবে ছুটি না কেন, সেইটি নেহাতেই আত্মসর্বস্ব এক ক্ষুদ্র ভাবনা। তাই আমাদের আজ ভাবতে হবে অনেক বৃহৎ পরিসরে অনেক বড় পরিধিতে মননকে জারিত করে। ‘আপনা হতে বাইরে দাঁড়া’লে ‘বুকের মাঝে বিশ্বলোকের’ সাড়া মিলতে অসুবিধে কোথায়?ঋণস্বীকার: ১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রণীত – মেঘদূত, কালিদাস, অরণ্য দেবতা, শান্তিনিকেতন, মুক্তধারা, বিলাসের ফাঁস ও আত্মপরিচয়।২। প্রাচীন ভারতের পরিবেশ নীতি: সংস্কৃত শাস্ত্র সাহিত্যের দর্পণে –করুণাসিন্ধু দাশ।
  • হরিদাস পালেরা...
    মহম্মদ সেলিম এবং লক্ষ্মীর ভাণ্ডার  - সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় | মহম্মদ সেলিম বহু ক্ষেত্রেই  সঠিক কথা বলে থাকেন। এবারও বলেছেন। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নিয়ে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, "কেউ কেউ স্বঘোষিত বিপ্লবী আছে, তাদের  আমরা বলি ফেসবুকে বেশি বিপ্লবীয়ানা করবেননা। কিন্তু করে। এখানে এমন একটাও সিপিএমের কাছ থেকে এক্সপেক্ট  করতে পারোনা, যে, মহিলাদের সম্পর্কে বা এ ধরণের ভাতা সম্পর্কে অফিশিয়ালি ডিনাউন্স করছে। কেন করবে? আমরা আমাদের বামপন্থী আন্দোলন মানে হচ্ছে, গোট বিশ্বে আমরা চাই, সরকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে, মানুষের যে অধিকার দিতে পারছেনা, তাকে কিছুটা অন্তত সাবসিডাইজ করবে। আর বাকি যারা এগুলো নিয়ে কটাক্ষ করছেন, তাঁরা বামপন্থী নন, তাঁরা হতে পারেন সমর্থক, আমাদের দায় আমাদের কথা তাঁদের কাছে নিয়ে যাওয়া, আমাদের মাধ্যমগুলো দিয়ে, সরাসরি তাঁদের কাছে গিয়ে। কেউ কেউ উগ্র সমর্থক আছেন, তাঁদের আমরা সমর্থক থাকতে বলব, উগ্রতা কমাতে বলব।" (শুনে শুনে লেখা, মোটামুটি হুবহু উদ্ধৃতি)। এর আগেও সেলিমের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েছি। গুরু জয় গোস্বামীর বই ছাপার পর, এইরকমই উন্মত্ত ট্রোল করছিল সমর্থকরা, এক মহাপ্রভু তো জয়দাকে কীকরে কবিত লিখতে হবে সেটাও শেখাতে বসেছিলেন, তখনও সেলিম ঠিকঠাক অবস্থান নিয়েছিলেন। এবারও বক্তব্যের যে মূল সুর, তার সঙ্গে দ্বিমত হবার কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু তার পরেও একটা ব্যাপারে কিছুতেই একমত হওয়া যাচ্ছেনা, যে ব্যাপারটা কিছু উগ্র সমর্থক ঘটিয়েছেন মাত্র ( অন্য কেউ করেছেন কিনা, সে প্রশ্নটা  অবশ্য সেলিমকে করা হয়নি)। আদতে এই ন্যারেটিভটার উৎস কী জানিনা, কিন্তু একাধিক নেতাকে অবিকল এই "ভিক্ষা" টোনে কথা বলতে শুনেছি ইতিপূর্বে। সনতারিখ মনে নেই বলে নামধাম লিখলাম না। কিন্তু একদম সাম্প্রতিক কালেও, এই চব্বিশে লোকসভা ভোটের ফল বেরোনোর পরেও তারকা প্রার্থী দীপ্সিতা ধরকে খুব কাছাকাছি একটা কথা বলতে শুনলাম। তিনি খুবই শান্ত, সুভদ্র, বিনীত ভঙ্গীতে বললেন, "সাধারণ মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছেন। তাঁদের হয়তো মনে হয়েছে ছেলেমেয়ের স্বচ্ছ চাকরি  পাওয়ার চাইতে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পাওয়াটা ভালো, অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কাজ হবে আবার তাদের কাছেই যাওয়া, তাঁদেরকে এটা বোঝানো, কেন তাঁদের ছেলেমেয়ের চাকরি পাওয়াটা তাঁর ইলেকশনের অ্যাজেন্ডা হওয়া দরকার। যতদিন তাঁরা বুঝছেন না, ততদিন আমরা কথা বলব।"  এটাও প্রায় হুবহু উদ্ধৃতি। কানে শুনে লেখা। এতে কথার সুর অসম্ভব ভালো, বক্তব্যে ভিক্ষা শব্দটা নেই, ভাতায় তেমন কোনো আপত্তিও নেই, কিন্তু তারপরেও, ভাতা ব্যাপারটা ভালো না, আসল কথা হল স্বচ্ছ চাকরি। সমস্যা হল, ভাতা ভালো না, আসল ব্যাপার হল স্বচ্ছ চাকরি, ব্যাপারটা হরেদরে কিন্তু একই হল। এবং সেটা যথারীতি সেই শাইনিং দাবীদাওয়া। শুনে মনে হচ্ছে বিশ্বের সবার লক্ষ্য যেন এসএসসি অথবা আইটির চাকরি করা বা চাওয়া। এ কথা একশবার সত্য, যে, সরকারি বা হোয়াইট-কলার চাকরি পেলে কেউ ভাতার ধার ধারেনা। কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য হল, বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষই সাদা-কলার কাজ করেনা। বিশ্ব শব্দটা ইচ্ছে করেই বললাম, কারণ অনুন্নত, উন্নত সব দেশেই বেশিরভাগ লোক শ্রমিক, চাষা, কারিগর, গাড়িচালক, দোকানদার, পাহারাদার ইত্যাদি প্রভৃতি। তারা কেউ স্বচ্ছ চাকরির ধার-ধারেনা। নিজের কাজে একটু বেশি উপার্জন চায়, উপার্জনের স্থিরতা চায়। এবং একই সঙ্গে ভাতাও চায়। দুটোই চায়। আমেরিকার মতো দেশেও ভোটের ইসু তাই সিলিকন-ভ্যালি নয়, রাস্ট বেল্ট, এবং  সোশাল-সিলিউরিটি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ইত্যাদি। এতে লোকের বোঝার আদৌ কোনো ভুল নেই। পাকড়ে ধরে বোঝানোরও কিচ্ছু নেই। বোঝাতে গেলে কেউ কানও দেবেনা। বরং বুঝতে হলে বুঝতে হবে তাঁদের, যাঁরা বোঝাবেন বলে দাবী করছেন। কারণ তাঁরা একটা কল্পলোকে বসবাস করছেন। এবং এটা একা দীপ্সিতারও সমস্য নয়। আমার চারদিকে যাঁরা বামপন্থী পরিচয়ে আছেন, তাঁদের  বেশিরভাগেরই এইরকমই ধ্যানধারণা। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত। সমর্থক থেকে নেতা পর্যন্ত। তাঁরা একটা বুদবুদে বসবাস করেন। অথবা মতাদর্শগতভাবেই চাড্ডি। বুদ্ধবাবুর আমলে "চাষার ছেলে কি চাষা থেকে যাবে", থেকে এটার শুরু। গত দেড়-দুই দশকে তাঁদের একটা বিশ্লেষণও মেলেনি, ডাহা ফেল করেছেন। এর পরে নিজেদের বিশ্লেষণ নিয়েই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। কিন্তু নিজেদের শিক্ষাগরিমা হোক, বা অন্য কোনো ইলিউশনের কারণেই হোক, দেড়-দুই দশকের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার পরেও, তাঁদের ধারণা, তাঁরাই ঠিক, এবং সেটা পাবলিককে বোঝানোর মতো অবস্থানে আছেন। পাবলিক যেহেতু কান্ডজ্ঞান রাখে, তাই তারা এই অদ্ভুতুড়ে বিষয়টা বোঝেনা, সেখান থেকেই আসে হতাশা। এবং সেখান থেকে আসে রাগ। গাল পাড়া শুরু হয়ে যায়।  মহম্মদ সেলিম এই পুরো প্রক্রিয়াটা  বোঝেননা হতেই পারেনা। কিন্তু তিনি হয় কোনো অজ্ঞাত কারণে গুড-কপ-ব্যাড-কপ খেলেন, অথবা পিতামহ ভীষ্মের মতো, বুঝেও কিছু করার নেই। যে কারণেই হোক, সব মিলিয়ে ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে এই, যে, পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম মূলত শাইনিং মধ্যবিত্তের অ্যাসপিরেশন বয়ে চলেছে। কর্মসূচিতে যাই লেখা থাক, স্লোগানে, বয়ানে, সেলফিতে, টিভিতে। বস্তুত টিভির পর্দায় দেখে আদৌ বাম কোনো দৃষ্টিভঙ্গী আদৌ আছে বলেও মনে হয়না। এর ফাঁকে তৃণমূল দখল করে নিয়েছে মধ্যপন্থার জায়গাটা। বাঁ দিক থেকে বিরোধিতার জায়গা ছিল। কিন্তু বিরোধিতার  জায়গাটা  নিয়ে নিয়েছে দক্ষিণপন্থীরা। বিকাশবাবুরা কোর্টে এবং টিভিতে যা যা করেছেন, পুরোটার ফসলই নিয়েছে দক্ষিণপন্থা। এখনও বাঁদিকে জায়গা ফাঁকা আছে, কিন্তু খুবই ছোটো। সেটুকু দখল করাও সোজা না, কিন্তু তার জন্য পতাকা নিয়ে লম্ফঝম্প করলেই হবেনা, একটা লাইন থাকা দরকার, যে লাইনে কথা অন্য কেউ বলছেনা। কিন্তু সেদিকে এগোনোর কোনো লক্ষণ দেখা যায়না। সেই একই, কর্মসংস্থান নয় চাকরি, টাটা কত ভালো ছিল, আমাদের ভালো-ভালো ছেলেগুলো সব বেঙ্গালুরু চলে যাচ্ছে, এবং চোর-চোর। এর একটাতেও দক্ষিণপন্থার সঙ্গে বিশেষ তফাত নেই। অথচ বলার পরিসর ছিল। "বিকল্প" টা কী, ভাবা যেত। সত্যিই তো লোকে অবস্থার উন্নতি চায়, কিন্তু তার একটা বাস্তবসম্মত উপায়, পথ তো বাতলাতে হবে। বেড়ে চলা অসাম্য নিয়ে বলা যেত। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে বলা যেত। সবই অতীত কালে বলছি, কারণ, এখন বললে আমার মতো কয়েকটা উৎপটাং লোকের সমর্থন পাওয়া যাবে, কিন্তু যে মধ্যবিত্ত শাইনিং ভিত্তিটুকু সিপিএমের টিকে আছে, তারাও আর থাকবে কিনা বলা মুশকিল।  এই অবস্থায় পিতামহ ভীষ্ম ছাড়া আর কিছু হওয়া যায় বলে মনে হয়না। মহম্মদ সেলিমও তাই হয়েছেন। বাম হতে গেলে সমর্থকূল যাবে, আর সমর্থক রাখতে গেলে বামত্ব যাবে। বামদের থাকা দরকার জানি, কিন্তু এই ধাঁধার সমাধান কীকরে হবে জানিনা। অবশ্য অতটা ভেবেও দেখিনি। বিনামূল্যে কেনই বা ভাবব। তিনোরা যা চাল দেয় তার চেয়ে দুবস্তা যদি বেশি দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন, তো ভেবে দেখতে পারি।
    শিক্ষা না ভিক্ষা? - Anirban M | বাংলায় সিপিএম প্রার্থীরা পরাজিত হওয়ার পরে অনেক বাম-সমর্থক নাকি লিখেছেন বাংলায় মানুষ শিক্ষার বদলে ভিক্ষাকে বেছে নিয়েছেন। আমি ফেসবুক থেকে দূরে। গুরুচন্ডালির পাতাতেই প্রথম দেখলাম খবরটা । এই ধরণের কথা খুব বিরক্তিকর, বিশেষতঃ কেউ যদি নিজেকে বামপন্থী বলে দাবি করেন তাঁর থেকে। সবথেকে বড় কথা, এই ধরণের মতামত বামপন্থী পার্টিগুলির গ্রহণযোগ্যতা আরও কমিয়ে দেবে। আমি সংখ্যার জগতের মানুষ। তাই ভাবলাম একটু তলিয়ে দেখি যে বাম প্রার্থী হিসেবে সারা দেশে যাঁরা জিতলেন, তাঁদের থেকে কি তৃণমূলের হয়ে যাঁরা জিতলেন তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব আলাদা কিছু? এবং বাংলায় যে বামেরা হারলেন আর বাংলায় যে তৃণমূল জিতলেন তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতার খুব কিছু ফারাক আছে? (আমার তুলনাটা কিন্তু শুধুই ডিগ্রির ভিত্তিতে, কে কোন প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রি পেয়েছেন এবং কোন প্রতিষ্ঠানের মান কেমন সেই তুলনা করার তথ্য আমার কাছে নেই) আমি সমস্ত প্রার্থীদের মধ্যেও এই তুলনাটা করতে পারতাম কিন্তু তাতে একটু সময় বেশি লাগত কারণ তৃণমূল মূলত পশ্চিমবঙ্গে প্রার্থী দিলেও, বাম প্রার্থী সারা দেশেই ছড়িয়ে আছে। সামাজিক মাধ্যম এবং এদিক ওদিক থেকে যা খবর পেলাম তাতে তিনটি দল থেকে বাম প্রার্থীরা জিতেছেন – সিপিআই, সিপিআই(এম) আর সিপিআই(এমএল)(লিবেরেশন)। আমি নিচের সারণীতে তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা দিলাম। আমার সূত্রঃ https://www.news18.com/elections/।  কিন্তু তথ্যের মূলসূত্র নির্বাচনী কমিশনে পেশ করা এফিডেভিট।সারণী ১ বিজয়ী বাম প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতাএরপর, আমি পশ্চিমবঙ্গে জয়ী তৃণমূল প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা একটি সারণীতে প্রকাশ করব। এক্ষেত্রে তথ্য নেওয়া হয়েছে https://www.myneta.info সাইট থেকেসারণী ২ঃ বিজয়ী তৃণমূল প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতাএর পরে আমরা দেখি পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়ানো বাম প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার হিসেব যাঁরা সবাই ভোটে হেরেছেন।  সারণী ৩ঃ পরাজিত বাম প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এরপর এই তিনটি সারণীর ভিত্তিতে আমরা তিনটি পাইচিত্র বানাই যেখানে যথাক্রমে দেশের মধ্যে জেতা বাম প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিন্যাস, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলের জেতা প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিন্যাস আর পশ্চিমবঙ্গে বাম্ফ্রন্টের হারা প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিন্যাসচিত্র১ঃ দেশের মধ্যে জেতা বাম প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিন্যাসচিত্র ২ঃ পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলের জেতা প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিন্যাসচিত্র ৩ঃ পশ্চিমবঙ্গে বাম্ফ্রন্টের হারা প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিন্যাসএই তিনটি বিভাগের মধ্যে তেমন যে খুব ফারাক আছে তা নয় কিন্তু। মানে কোন ভাবেই জয়ী বাম প্রার্থীদের, জয়ী তৃণমূল প্রার্থীদের থেকে বেশি  শিক্ষিত বলা যায় না। বরং শতাংশের হিসেবে, জয়ী তৃণমূল প্রার্থীদের মধ্যে পোস্ট গ্রাজুয়েটের শতাংশ বেশি। এরপরে দেখা যাক পশ্চিমবঙ্গের বাম ও তৃণমূল প্রার্থীদের মধ্যেকার তুলনা।  বাংলার বামেদের খুব কিছু ফারাক কী আছে তৃণমূলের সঙ্গে? একমাত্র বলার মত ফারাক হল বামেদের হয়ে দুজন পিএইচডি করা প্রার্থী ছিলেন যা তৃণমূলের ক্ষেত্রে অমিল। কিন্তু যদি গ্রাজুয়েটের শতাংশ দেখেন তাহলে তৃণমূলের ক্ষেত্রে তার শতাংশ ৪৫% আর বামেদের ক্ষেত্রে তা ৩৭%। অন্যদিকে উচ্চমাধ্যমিক বা তার নিচের শিক্ষাগত যোগ্যতার লোক তৃণমূলের জয়ীদের মধ্যে আছে ২১% আর বাম প্রার্থীদের মধ্যে আছে ২৩% । সুতরাং, শিক্ষাগত যোগ্যতায় যে তৃণমূলের জয়ী প্রার্থী আর বামেদের পরাজিত প্রার্থীদের মধ্যে যে বিরাট কোন ফারাক আছে তা নয়। অন্যদিকে অন্যরাজ্যের যে বামেরা জিতলেন আর আমাদের রাজ্যে যাঁরা হারলেন তাঁদেরও মধ্যে খুব ফারাক কিছু নেই। জেতা বামেদের মধ্যে গ্রাজুয়েট বেশি কিন্তু হারা বামেদের মধ্যে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বেশি -- এরকম ধরণের ফারাক। কিন্তু খুব মূলগত ফারাক কিছু নয়। আসলে জেতা বা হারার সূত্রটা অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে। সেটা না খুঁজে জনগণকে দোষারোপ করলে আখেরে ক্ষতি কিন্তু বাম রাজনীতির। 
    হাঁটতে হাঁটতে - দ | দীর্ঘ পদযাত্রা বলতে আমার প্রথমেই মনে আসে গান্ধিজীর ডান্ডি অভিযান। ইংরেজের লবণ আইনের প্রতিবাদে ২৪ দিন ধরে পায়ে হেঁটে ৩৮৫ কিলোমিটার অতিক্রম করার গল্প। স্কুলের ইতিহাস বইয়ে পড়া  লম্বা রাস্তা হেঁটে পেরোনর ঐ গল্পের পর আবার লকডাউনের সময় অভিবাসী শ্রমিকদের হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরার গল্প চমকে দিল মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত ভারতকে। ডান্ডি অভিযান আর লক ডাউনের মাঝেও রয়েছে অজস্র হাঁটার গল্প আমার আপনার চোখের আড়ালে। জলের জন্য হাঁটা, স্কুলে যাওয়ার জন্য হাঁটা। কাজ খোঁজার জন্য হাঁটা, কাজ হারিয়ে হাঁটা। কখনও ভালবাসার গল্প কখনও বা মৃত্যুর ঘ্রাণমাখা অন্তহীন হাঁটার গল্প মিশে রয়েছে এই দেশের এক বড় সংখ্যক মানুষের যাপনে। বুন্দেলখন্ডের সাতনা জেলার রাজোলা গ্রামের মেয়েদের পড়াশোনা শেষ হয় ক্লাস ফাইভে উঠলেই। কারণ মনে করা হয় ঐ বয়সে মাথায় দুটো মাটির  কলসি পরপর বসিয়ে হাঁটার ক্ষমতা হয়ে যায় মেয়ের। আর এই ক্ষমতার সদ্ব্যবহার ভিন গাঁ থেকে জল আনার কাজেই হওয়া উপযুক্ত বলে মনে করেন সেখানকার বাসিন্দারা। এই গ্রামের মেয়েদের বিয়েও হয় হাঁটতে পারা এবং জল আনতে পারার ক্ষমতার উপরে ভিত্তি করেই। মেয়েদের রূপ এখানে তেমন কোনও গুরুত্ব পায় না। উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রেদেশের সীমান্ত অঞ্চল ঝাঁসি, চম্বল ইত্যাদি এলাকায় ১২ টা গ্রামে প্রচলিত নিয়ম হল যে সব গ্রামে  জলের কোন উৎস আছে অর্থাৎ মেয়েদের অন্যত্র যেতে হয় না জল আনতে সেই গ্রামের প্রাপ্তব্য বরপণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশী।‘গাঁও কানেকশান’  নামক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে ১৯টা রাজ্যের ৩৯ শতাংশ গ্রামীণ মহিলা প্রতিদিন গড়ে ৭ কিলোমিটার করে হাঁটেন জল আনার জন্য। ১৮ হাজার মানুষের মধ্যে সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে ৩ হাজার জন দিনে দুবার  ৫ কিলোমিটার করে হাঁটেন জল বহনের জন্য। মোটামুটি দেখা গেছে ভারতের একজন গ্রামীণ মহিলা দিনে গড়ে ৫ থেকে ২০ কিলোমিটার হাঁটে শুধু জল আনার জন্য।  ভূগর্ভস্থ জলতল ক্রমশ নেমে যাওয়ায় আরো বেশী করে মানুষ দূরবর্তী স্থান থেকে জলবহনে বাধ্য হচ্ছেন আর এঁরা বেশিরভাগই মহিলা। এ তো গেল শুধু জলের জন্য হাঁটা। এবার  আমরা একটু পিছিয়ে যাই চলুন। ১৯৪৭ এর জুনে ভারত ভাগ হবে এবং পরে সীমান্ত  ঘোষণার  সঙ্গে সঙ্গেই সীমান্তের দুই পার জুড়ে শুরু হয় অভূতপূর্ব মাইগ্রেশান যার অনেকটাই হেঁটে হেঁটে।   ১৯৪১ এ জাপান বোমা ফেলে বার্মায় আর সেখানে বসবাসকারী সাধারণ ভারতবাসী প্রথমে রেঙ্গুন থেকে জাহাজে করে ভারতে ফেরার চেষ্টা করে। মাস দুই পরে জাহাজঘাটা বন্ধ হয়ে গেলে বার্মায় আটকে পড়া ভারতবাসী হাঁটতে শুরু করে। তিনটি রুট ধরে হেঁটে ফেরে মানুষে, একটি আরাকান কয়ে চট্টগ্রাম আরেকটি চিন্দউইন উপত্যকা ধরে মণিপুর সীমান্ত আর তৃতীয় রুট লেদোপাস হয়ে অসম। তা সেই বোধহয় প্রথম রুজিরুটির সন্ধানে বাইরে যাওয়া ভারতবাসী আচমকা বিপর্যয়ে একসাথে হেঁটে ১০০০ কিলোমিটারের মত রাস্তা পাড়ি দিয়ে স্বস্থানে ফেরার চেষ্টা করে। এবার এই যে রুজিরুটির সন্ধানে বাইরে যাওয়া এর কারণ মূলত নিজ বাসস্থান বা আশেপাশে জীবিকার যোগাড় না হওয়া।১৯৪৭-৪৮ এ দেশভাগ পরবর্তী মাইগ্রেশান ও অসংখ্য লোকের হাঁটার ছবির পরে ভারত আবার দেশবাসীকে হাজারে পনেরোশ মাইল হাঁটতে দেখল লক ডাউনের সময়। মাত্র তিন ঘন্টার নোটিশে গোটা দেশ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবি মানুষ পথে নেমে আসতে বাধ্য হন। তাঁদের কাজ এবং বাসস্থানও চলে যায়, অথচ যানবাহন সব বন্ধ,থাকার উপায় নেই  ঘরে ফেরার উপায়ও নেই।  প্রধানমন্ত্রী বা নীতি নির্ধারক মন্ত্রীরা কেউই এঁদের কথা ধর্তব্যের মধ্যে আনেন নি। ২০২০র ৮ইমে  সারা ভারত আঁতকে উঠেছিল মহারাষ্ট্রে আওরঙ্গাবাদের কাছে রেললাইনে ছিটিয়ে থাকা রক্তমাখা আধপোড়া রুটি আর মানুষের দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গর ছবি দেখে। ৮৫০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি পৌঁছোবার কথা ছিল মানুষগুলোর।  এই দলটির অধিকাংশ লোক ছিলেন গোন্দ সম্প্রদায়ের, আওরঙ্গাবাদ থেকে ছত্তিশগড়ে ফেরার ট্রেন  চালু হতে পারে এই সম্ভাবনার কথা শুনে এঁরা লাইন ধরে হাঁটতে শুরু করেন। এঁরা জানতেন কোথাও কোন ট্রেন চলছে না, তাই ৩৬ কিলোমিটার অর্ধাহার, অনাহারে একটানা হেঁটে   অবসন্ন হয়ে লাইনে ঘুমিয়ে পড়ার সময় এঁদের মনে রেললাইনে ঘুমানোয় কোনও বিপদাশঙ্কা কাজ করে নি। ছিন্নভিন্ন মৃতদেহের ছবি দেখে অবশ্য ভারতবাসীর একাংশ প্রশ্ন তুলেছে ‘রেললাইনটা কি ঘুমানোর জায়গা?’ সেই ভারতবাসী যারা প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ  মেনে ব্যালকনিতে থালা বাটি পিটিয়ে, রাত ন’টায় বাড়ির সব আলো নিভিয়ে ব্যালকনিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে করোনার সাথে লড়েছে।রেললাইনকে বালিশ আর কংক্রীটের স্লিপারকে বিছানা বানিয়ে যারা ঘুমিয়ে পড়েছিল তাদের কারো বাড়িতেই ‘ব্যালকনি’ নেই, ছিলও না কস্মিনকালে। বিদ্যুৎ সংযোগও কজনের বাড়িতে ছিল বা আদৌ একজনের বাড়িতেও ছিল কিনা সন্দেহ। একটা ব্যপার এখানে খেয়াল করার মত সেটা হল যে কোনো রেল দুর্ঘটনায় আমরা দেখি রেলের তরফে এবং সরকারের তরফে হেল্পলাইন তৈরী হয়, আহত নিহত ব্যক্তিদের নাম আছড়ে পড়ে  দূরদর্শনের পর্দায়, সংবাদপত্রের পাতায়। এই ঘটনার পরে আমরা কোনও মাধ্যমেই মৃতদের নাম ধাম তেমন দেখতে পাই নি। তবে জামলো মাকদম বা রণবীর সিঙের নাম আমরা অবশ্য জানতে পেরেছি। জামলো সেই ১২ বছরের মেয়েটি ১৫০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে বাড়ির ৫০ কিলোমিটার আগে মরে যায়।রণবীর সিং, দিল্লি থেকে হেঁটে মধ্যপ্রেদেশ যেতে গিয়ে ২০০ কিলোমিটার চলার পরে পথে শুয়ে মরে যায়।  ফোনে বাড়ির সাথে শেষবার কথা হবার সময় ফিসফিস করে বলেছিলেন  সম্ভব হলে এসে আমাকে নিয়ে যাও। সরকারি নীতির প্রত্যক্ষ প্রভাবে মৃত এই শ্রমজীবিদের অন্তত দেহটুকুও কোনও সরকারই  বাড়ি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে নি। আসুন  এবার একটা অন্যরকম হাঁটার গল্পে চোখ রাখি। উত্তরাখন্ডে এখনো পর্যন্ত ৭৩৪টি গ্রামকে বলা হয় ভুতিয়া গাঁও, মানে ভুতুড়ে গ্রাম। না না ভুতের ভয় টয় নয় জীবনধারণের  প্রাথমিক জিনিষগুলো যথা খাদ্য,বস্ত্র, বাসস্থান,জল, বিদ্যুৎ, সড়ক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র না পেয়ে  দলে দলে মানুষ গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে অন্য কোথাও। গ্রাম শুন্য হওয়া ঠ্যাকাতে সরকার একটি দপ্তর তৈরী করেছে ‘উত্তরাখন্ড পলায়ন আয়োগ’।উত্তরাখন্ডের পাউড়ি গাড়োয়াল জেলায় এরকম অসংখ্য গ্রাম আছে যার লোকসংখ্যা মাত্র দুই কিংবা এক। থেকে যাওয়া শেষ বাসিন্দার মৃত্যু হলে গ্রামটি সম্পূর্ণ শুন্য হয়ে যাবে। এরকমই একটা গ্রাম সাইনা। একটামাত্র পরিবার অবশিষ্ট রয়েছে, দুজন মানুষ, ভরত সিং ও তাঁর স্ত্রী সুশীলা। দুটো  গরু আছে তাঁদের, সামনের জমিতে কুমড়ো, শশা আর কিছুটা বাজরা চাষ করেন। একদিকে মস্ত উঁচু পর্বতশ্রেণী আর একদিকে সরু ঝর্ণা থেকে তৈরী হওয়া নদীর মাঝে সাইনা। মাসে একবার গ্যাস সিলিন্ডার আসে, সেই ভ্যান ওঁদের বাড়ি পর্যন্ত আসতে পারে না। কারণ রাস্তা নেই। ভরত সিং পাহাড়ি চড়াই উৎরাই বেয়ে সিলিন্ডার ঘাড়ে পিঠে করে নিয়ে আসেন কয়েক কিলোমিটার। পথের মাঝামাঝি এক জায়গায় সুশীলা এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাকী পথটুকু দুজনে ধরাধরি করে নিয়ে আসেন সিলিন্ডার।সারা ভারত জুড়ে বছভর  যে মাইলের পর মাইল পদযাত্রা চলে এগুলো তারই সামান্য  কয়েকটা টুকরো দেখলাম আমরা। এরকম আরো অজস্র  হেঁটেচলার, হাঁটতে হাঁটতে বসে পড়ার, পড়ে মরে যাবার নির্মম কাহিনী রয়েছে সমৃদ্ধ দত্তর  লেখা ‘হাঁটার গল্প’ বইয়ে। এই লকডাউনে যারা হেঁটে গেল দেশজুড়ে তারা কজন পৌঁছাল গন্তব্যে? কেমন ছিল সেই পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরন্তর হাঁটার অপমানগুলোর কাহিনী? কত রকমের মাইগ্রেশান হয় দেশে? শিক্ষার নিরিখে একেবারে নীচের দিকে থাকা বিহার আর একদম উপরে থাকা কেরলে মাইগ্রেশানের হার এত বেশী কেন? কী সেই অন্তর্নিহিত সমীকরণ যার ফলে দলে দলে মানুষ বাইরে যায়? এইরকম নানা প্রশ্নের উত্তর এই বইতে  খোঁজার চেষ্টা করেছেন লেখক।ঝলমলে সোশ্যাল মিডিয়া আর স্মার্টসিটির বাইরে কবে থেকে যেন হেঁটেই চলেছে আরেকটা ভারত। এতদিনে তাদের অন্তত নামটুকু নথিবদ্ধ থাকার কথা ছিল সরকারের কাছে। কথা ছিল, কিন্তু নেই আসলে, আর সেজন্য আমরা ন্যুনতম লজ্জিতও নই, প্রশ্নও করি না কেন অভিবাসী শ্রমিকদের তালিকা নেই সরকারের কাছে? কেন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও গ্রামীণ মেয়েদের এত হাঁটতে হবে শুধুমাত্র জলের জন্য? বইটা আমাদের জ্বলন্ত এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় ‘সুনাগরিক’এর দায়িত্ব পালন করি নি আমরাও। অত্যন্ত জরুরী বইটায়   সামান্য দু’একটা ত্রুটি যা নজরে এল ‘জামলো মাকদম’এর নাম ‘জামালো’ লিখেছেন একাধিকবার। মৃত বালিকার নামটুকু অন্তত ঠিক করে বলা দরকার আমাদের সকলেরই। ১০৪ নম্বর  পৃষ্ঠায় রাজেন্দ্রর বাবার মৃত্যু  প্রথমে লেখা হয়েছে জমিবিক্রির শোকে হার্ট অ্যাটাক, কিছু পরে আবার করোনায় মৃত বলে লেখা। এই খুচরো ভুলগুলো আঁটসাঁট সম্পাদনায় এড়ানো সম্ভব ছিল।  বই – হাঁটার গল্পলেখক – সমৃদ্ধ দত্তপ্রকাশক – দে’জ পাবলিশিংদাম – ৩০০/-     
  • জনতার খেরোর খাতা...
    মিষ্টিকথা - পাগলা গণেশ | রেখে রেখে মিষ্টিখানি,শেষপাতে খাব বলে,শেষে আর খাওয়াই হলো না।জুতোর কাদা পড়ে গেল এসে।শুরু থেকেই কয়েকবার মনে হয়েছে,একটা কামড় দিয়েই দিই,কিন্তু শেষে পুরোটা তারিয়ে তারিয়ে খাব বলে,রেখে দিয়েছিলাম নিজেকে বঞ্চিত করে।সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার,এই পুরো সময়টা ওটা আমাতেই অর্পিত ছিল,কিন্তু আমি তার যথার্থ ব্যবহার করিনি,যখন কাদার ছিটে পড়ল,তখন একটু বাঁকা হাসি কি দেখিনি,কান্নাও ছিল জানি।এখন আমি আফসোস করছি,কিন্তু আমার কিচ্ছু করার নেই,ফেলে দেওয়া ছাড়া।
    জীবন তরঙ্গ পর্ব ৪২  - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ পর্ব ৪২  বিএ পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকে ফলাফল প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত অনেকটা সময়। বাড়িতে বসে বসে নন্দিতার বোর হচ্ছিল। তার একটা বড় কারণ, ঠাকুমা বাড়িতে নেই। ঠাকুমার ভাই  অসুস্থ। খবরটা পাওয়ার পর, অসিত মাকে নিয়ে গিয়ে কোলকাতায় মামার বাড়িতে রেখে এসেছে। নন্দিতারা কয়েকজন বন্ধু মিলে দার্জিলিং এ যাওয়ার প্ল্যান করল। মেয়ে কোনদিন এভাবে  বাবা মা ছাড়া একা কোথায় বেড়াতে যায়নি। সম্মতি দিতে অসিত এবং নীলিমার স্বাভাবিক ভাবেই একটু দ্বিধা ছিল। যাওয়াটা অবশ্য আটকায়নি। অসিত পরিচিত লোক মারফৎ  নন্দিতা আর ওর বন্ধুদের দার্জিলিং এ থাকা আর ঘোরার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।যাওয়ার আগে নীলিমা মেয়েকে সতর্ক করে বলেছিল—  পাহাড়ি রাস্তা, সাবধানে চলাফেরা করবি।  আবার যেন কোন অঘটন না ঘটে।নন্দিতা মাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিল—অত চিন্তা কোরো না তো! এখন আমি বড় হয়ে গেছি মা।যাতায়াত সমেত বেড়ানর জন্য পাঁচ দিনের সময়সীমা বাড়ি থেকে বরাদ্দ হয়েছিল।     নন্দিতার ভাই তিমিরও ওদের সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছিল। কিন্তু কয়েকমাস বাদে ওর পার্ট ওয়ান পরীক্ষা বলে বাড়ি থেকে অনুমতি পায়নি। নন্দিতারা চারজন বন্ধু মিলে বেড়াতে গিয়েছিল। অভিভাবক ছাড়া বেড়াতে যাওয়ার আলাদা কিছু মজা আছে। এত কাছে থাকলেও দার্জিলিং এ নন্দিতা মাত্র দুবার গেছে। প্রথমবার এত ছোট ছিল যে, কিছুই মনে নেই। দ্বিতীয়বার  গিয়েছিল, যখন নন্দিতা ক্লাস সিক্সে পড়ে। সেই বয়সের কোন কিছু ভোলার কথা নয়, ভোলেওনি। বেশি করে মনে আছে দুর্ঘটনার কথা। পাহাড়ি রাস্তা, মা বা বাবার হাত ধরেই নন্দিতা হাঁটত। সেদিন হোটেল থেকে বেরোবার সময় নন্দিতা একছুটে বাকিদের থেকে  খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। ভাই বায়না করছিল বলে মা বাবা  একটু পিছনে ছিল। একটু যেতেই একটা লোমওয়ালা কালো কুকুর লেজ নাড়তে নাড়তে নন্দিতার দিকে এগিয়ে এল। ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে নন্দিতা রাস্তার একেবারে ধারে চলে এসেছিল। তারপর কেউ কিছু বোঝার আগেই পা হড়কে নিচে পড়ে গেল। নন্দিতার মা বাবা ছাড়াও আরো লোকজন দৌড়ে এসে নন্দিতাকে নিচের রাস্তা থেকে তুলে আনল।  কপাল ভাল খাদে পড়েনি। ওরা যে রাস্তা দিয়ে আসছিল, সেটাই ঘুরে এসে সাত আট ফুট নিচে দিয়ে গেছে। নন্দিতার পা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে, দুটো হাতেরও কয়েক জায়গায় ছড়ে গেছে। বেড়ান ওদের মাথায় উঠল। হোটেলের লোকেদের সাহায্যে মেয়েকে নিয়ে অসিত হাসপাতালে দৌড়ল। হাতে তেমন কিছু না হলেও পায়ে তিনটে স্টিচ পড়ল। সেই কাটার দাগ নন্দিতার ডান হাঁটুর পাশে আজও রয়ে গেছে।আগের দুর্ঘটনার কথা মাথায় থাকায়, সেবারে নন্দিতা একটু বেশি সতর্ক হয়েই হাঁটাচলা করেছে। বন্ধুরা তাই নিয়ে মস্করা করতে ছাড়েনি। আনন্দে পাহাড়ে ক’টা দিন কাটিয়ে নন্দিতা বাড়ি ফিরে এল। ফিরে আসার কয়েকদিন বাদেই বাবার  কাছে ঠাকুমার তলব এল, ওনাকে  নিয়ে আসার জন্য।অসিত ফোন করে বলেছিল—এতদিন বাদে গেছ, আরো ক’টা দিন থেকে এস মা। তোমারো ভাল লাগবে, ওদেরও ভাল লাগবে।ওদিক থেকে সোজাসাপ্টা উত্তর এসেছিল—ভুলুকে দেখতে এসেছিলাম, ও এখন ভাল আছে। বাড়ির বাইরে আমার বেশিদিন ভাল লাগে না। তুই ছুটি নিয়ে এসে আমায় নিয়ে যা।অসিত মাতৃ আদেশ অমান্য করেনি।    ঠাকুমার ফিরে আসার খবরে নন্দিতার খুব আনন্দ হল। ঠাকুমা না থাকায় বাড়িটা বড় ফাঁকা  ফাঁকা লাগছিল।ঠাকুমা ফিরে আসছে। বাবা নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে ফোন করে  জানিয়েছে যে, ঠাকুমা একা নয়, সঙ্গে আসছে আর একটা ছেলে। সে নাকি আবার কয়েকদিন থাকবে। নন্দিতা বা  নীলিমা কেউই ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। অশেষ কৌতূহল নিয়ে ওদের আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ওরা বাড়ি আসার পর ঠাকুমা যখন ছেলেটার গুণ গাইতে শুরু করল, তখন আর কেউ না বুঝলেও, নন্দিতার ঠাকুমার মতলব বুঝতে অসুবিধে হয়নি।ঠাকুমাও বেশিক্ষণ ব্যাপারটা নাতনীর কাছে চেপে রাখতে পারেনি। ছেলেটা দুপুরে অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর  ঠাকুমা এক ফাঁকে নন্দিতার কানে কানে এসে জিজ্ঞেস করলেন—দিদিভাই পছন্দ হয়?নন্দিতা না বোঝার ভান করে জিজ্ঞেস করল—কি ঠাকুমা?--নতুন অতিথি।নীলিমা এসে পড়ায় কথা আর এগোয়নি। অতিথি সৎকারের আড়ালে বুড়ির আসল মতলবটা নন্দিতা বুঝতে পারল। অফিসে ফাইলপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে সন্ধে হয়ে গেল। নয়ন প্রয়োজনের থেকে অনেকটা বেশি সময়  অফিসে রইল, যাতে কাজটা দিন দুয়েকের মধ্যে নামিয়ে দেওয়া যায়। ট্রেনের টিকিট পেতে অসুবিধে হলে বাসে ফিরে যাবে। অজানা অচেনা একটা বাড়িতে এক আধ দিনের বেশি থাকা উচিৎ নয়। এমন একটা গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেল যে, ওখান থেকে বেরিয়ে আসাও মুশকিল। তবে নয়ন মনে মনে একটা ছক কষে রেখেছে। দু দিনের মধ্যে  যদি কাজ শেষ হয়ে যায় তাহলে তো কথাই নেই। যদি না হয়, তাহলে কোলকাতায় ফিরে আসছে  বলে, ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কোনো হোটেলে গিয়ে উঠবে।  নয়নের উকিল পাড়ার অফিস থেকে অসিতদের বাড়ি অনেকটা দূরে। ওখানকার যানবাহনের ব্যাপারে  নয়ন  ওয়াকিবহল নয়, ফলে বাড়ি ফিরতে প্রায় নটা বেজে গেল। ফিরতে রাত হচ্ছে দেখে, ও বাড়ির সকলেই একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল।নয়ন বাড়িতে ঢুকতে নীলিমা জিজ্ঞেস করল—ফিরতে এত দেরি হল? গাড়ি পাচ্ছিলে না?--কাজ করতে করতে অফিস থেকে বেরোতে একটু দেরি হয়ে গেল। সেই দেরিটা আর একটু বাড়ল যানবাহনের জন্য। আসলে সব বিকল্পগুলো তো জানি না। সরি, আমার জন্য আপনাদের ডিনার করতে দেরি হয়ে গেল।নিজের অজান্তেই নয়নের দেরি হওয়ার জন্য নন্দিতারও একটু চিন্তা হচ্ছিল। একটা অচেনা ছেলের জন্য চিন্তা হওয়ার কোন কারণ নেই, কিন্তু হচ্ছিল। ওর মা আর ঠাকুমার মত  নন্দিতাও উদগ্রীব হয়ে ছিল।নয়নের কথার উত্তরে নন্দিতা বলল—আমরা সাহেবদের মত সন্ধেবেলা ডিনার করিনা। আমাদের ডিনার হয় রাত এগারটায়। ঠাকুমার উদ্দেশ্য জানার পর  নন্দিতা ছেলেটাকে একটু ভাল করে জানা আর বোঝার চেষ্টা শুরু করল। হাতে সময় কম, যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। দেখতে ভাল আর চাকরিও ভাল করে, এই দুটো প্লাস পয়েন্ট তো আছেই। এ ছেলেকে যে কোন মেয়েই পছন্দ করবে। নন্দিতারও মনের ভেতর একটু যে আকুলি বিকুলি হচ্ছে না, এমন নয়। তবু শুধু বাইরে নয়,  ছেলেটার মনের ভেতরটাতেও যতটা সম্ভব উঁকি মেরে দেখা দরকার। ঠাকুমা ট্রেন থেকে ধরে আনল, আর ছেলেটা বাধ্য ছেলের মত নন্দিতার সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসে গেল, ব্যাপারটা এতটা সরল নয়। ছেলেটার নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ আছে, প্রেমিকা থাকতে পারে, দুশ্চরিত্র হতে পারে। সব থেকে বড় কথা, অপত্য স্নেহের আড়ালে ঠাকুমার এই ষড়যন্ত্রের কথা ছেলেটা ঘুণাক্ষরেও জানে না।  নয়ন ফ্রেশ হয়ে আসার পর জমিয়ে আড্ডা বসল। ঠাকুমা থেকে আরম্ভ করে তিমির, সকলেই ছিল সেই আড্ডায়।ঠাকুমা কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন—বাবা কয়েকদিন আছো তো?--কাজ শেষ হতে যে ক’দিন লাগবে। মনে হয় তিন চার দিন লেগে যাবে।উত্তর শুনে ঠাকুমা আর নাতনী দুজনেই খুশি হল। মুখ ফস্কে সত্যি কথা বলে ফেলে নয়ন একটু মুশকিলে পড়ে গেল। ওর প্ল্যান ছিল, দুদিন বাদেই  ফিরে যাচ্ছে বলে এই বাড়ি থেকে  বেরিয়ে কোন হোটেলে গিয়ে ওঠা।ব্যাপারটা সামাল দিতে বলল—অবশ্য এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না। ডকুমেন্ট গুলো ঠিকঠাক পেয়ে গেলে আগেও কাজ শেষ হয়ে যেতে পারে।ঠাকুমা মুচকি হেসে বললেন—অত তাড়াহুড়ো করার কি আছে? সময় নিয়ে ধীরে ধীরে কাজ করলেই তো হয়।  ঠাকুমার কথা শুনে নয়ন হেসে ফেলল। নন্দিতা মনে মনে বুড়িকে স্যল্যুট করল। প্রায় ঘন্টা দুয়েক ধরে অনেক গল্প, মজা, মস্করা হল।  মা আর মেয়ে দুজনে গান করল। নয়ন মুগ্ধ হয়ে শুনল। দুজনেরই গানের গলা খুব ভাল। আসরে মগ্ন হয়ে থাকার ফলে ঘড়ির দিকে কারো চোখ পড়েনি। সেদিন ঐ বাড়ির ডিনারের সময় অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছিল।একবারের জন্যও কাউকে দেখে মনে হয়নি  যে, ওদের সাথে নয়নের সবে  সেদিন সকালে পরিচয় হয়েছে। নয়ন যেন কতকালের চেনা।     চলবে
    রঙের ছোঁয়া - Sukdeb Chatterjee | রঙের ছোঁয়াশুকদেব চট্টোপাধ্যায়আজকে অনিক বাড়ির বাইরে বেরোবে না। অন্তত এ বেলা তো নয়ই। আজ বলে নয়, চিরকালই এই দিনটা খুব ঠেকায় না পড়লে ও চেষ্টা করে ঘরেই কাটাতে। আসলে রং খেলতে অনিকের কোনদিনই ভাল লাগে না। সেই ছোট্টবেলায় যখন ওর বন্ধুরা নানারকমের পিচকিরিতে ভরে ছুটোছুটি করে রং খেলত, তখনও অনিক চেষ্টা করত একটু তফাতে থাকতে। কলেজে পড়ার সময় একবার বন্ধুদের চাপে পড়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রং খেলতে হয়েছিল। সেবার মুখে মাথায় সব এমন রং মাখিয়ে দিয়েছিল যে দু তিন দিন সাবান শ্যাম্পু লাগিয়েও তা পুরোটা ওঠেনি। ওখানেই শেষ। তারপর শত অনুরোধেও আর কখনও দোল খেলেনি।অল্প কিছুদিন হল অনিক এই বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে এসেছে। এখান থেকে ওর অফিসটা কাছে পড়ে। বাড়ির তিনতলার একমাত্র ঘরটা ওর জন্য বরাদ্দ। সবকিছু আলদা ব্যবস্থা আছে। ওর একার জন্য ঘরটা যথেষ্ট বড়। বাড়ির মানুষগুলোও ভাল। আপনজনের মতই ওর দেখাশুনো করে। বাড়িটা রাস্তার ওপরে। জলখাবার খেয়ে ঝুল বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে নভেল পড়ছিল। বই পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে রাস্তার দিকে চেয়ে দেখছে। বাচ্চা বুড়ো সব একে অপরকে রঙে চুবিয়ে ভূত করছে। এতে কি যে এত আনন্দ অনিক বুঝে উঠতে পারে না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বইয়ে চোখ ফেরায়। কিন্তু মনঃসংযোগ করতে পারে না। বারে বারেই নিচে বাইরের দিকে নজর চলে যাচ্ছে। একটা গরুকে রং মাখিয়ে কিছু লোক মজা মারছে। নিরীহ প্রাণীরও এই নোংরামির হাত থেকে মুক্তি নেই। বই বন্ধ করে অনিক ঘরে এসে টিভি খুলে বসল। এখানেও নিস্তার নেই। অধিকাংশ চ্যানেলেই শুধু দোল খেলার ছবি। অগত্যা একটা কার্টুনের চ্যানেল খুলে দেখতে লাগল। কিছু সময় পরে হঠাৎ মুখে মাথায় কে যেন আবির মাখিয়ে দিল। পরিষ্কার জামাকাপড় সব আবিরে ভরে গেল।“কি হচ্ছে কি ?”—অসন্তুষ্ট হয়ে একটু জোরেই কথাটা বলার পর তাকিয়ে দ্যাখে আবিরের প্যাকেট হাতে ঘরের একধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই বাড়ির একমাত্র সন্তান, পিয়ালি।---রাগ করলেন ? দোলের দিন একটু রং না খেললে ভাল লাগে বলুন ! আর এমন একটা দিনে আপনি কিনা ঘরে বসে বাচ্চাদের মত কার্টুন দেখছেন।অনিক কি বলবে ভেবে পায় না। ওরকম ভাবে রিঅ্যাক্ট করাটা উচিত হয়নি। কি করে বুঝবে যে পিয়ালি আবির মাখাতে এসেছে।খুব সংকোচের সঙ্গে বলল---কিছু মনে করবেন না। আমি না ঠিক বুঝতে পারিনি যে আপনি।---তা বোঝার পরেই বা কি করলেন !---আমি সত্যিই খুব লজ্জিত।---শুধু লজ্জা পেলেই হবে! রং খেলার একটা নিয়ম আছে জানেন না!---আমি কোনদিন তো রং খেলি না, কি করে জানব বলুন !---কেউ আবির মাখালে তাকেও একটু আবির লাগাতে হয়।অনিক তাকিয়ে দ্যাখে যে আবিরের প্যাকেটটা পিয়ালি ওর দিকে বাড়িয়ে রেখেছে। এদের সাথে খুবই অল্প দিনের পরিচয় তাই আড়ষ্টতা একটু ছিলই। তবু সব দ্বিধা সংকোচ কাটিয়ে প্যাকেট থেকে আবির নিয়ে অনিক পিয়ালিকে মাখাতে লাগল। প্যাকেট কখন শেষ হয়ে গেছে তবু রং মাখানো আর শেষ হয় না। রং যে তখন হৃদয়ে লেগেছে।নিচে থেকে মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরতে পিয়ালি এক ছুটে ঘর থেকে পালাল। আবির ধুয়ে ফেললেও পিয়ালির মুখের রাঙা ভাবটা কিন্তু ফিকে হতে সময় লাগবে। আর অনিক,রঙের ঘোরে বিভোর হয়ে ভাবে, 'এমন দোল রোজ আসে না কেন'!Email [email protected]
  • ভাট...
    comment---- | r2h আমি বরং আরেকটা অল্টারনেটিভ প্রপোজ করি?
    গুরু নেটওয়ার্ক সূত্রে তো অনেক এরকম মানুষ জড়িত যাঁরা ভোটে ডিউটি দিতে যান। এরকম বেশ কিছু মানুষের তরফে ভোটের সময়কার রিগিং ছাপ্পা গায়ের জোরে করানো ভোটের বা ভোটগণনা সময়কার অভিজ্ঞতার সংকলন করা হোক। লেখকদের অ্যানোনিমিটির দায়িত্ব গুরুই নিক নাহয়। আমন্ত্রিত লেখাই নিন। দেখুনই না কী রকম সমস্ত অভিজ্ঞতার দেখা পান। 
    আমার বহু বন্ধু প্রিসাইডিং অফিসার হয়ে প্রতি ভোটেই যায় তো। আমার নিজের বহু আত্মীয়ই ভোট কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট হিসেবে বসতেন এবং বসেন। বাম আমল থেকে তিনো আমল, সব রকম ভোটের খবরই পেয়েছি, পাই। তাই এইসব ভোটের রেজাল্ট দেখে জনমানসের ওরিয়েন্টেশন সংক্রান্ত থিয়োরি চর্চায় উৎসাহ পাই না।
    comment | ওদিকে রান আউটকে এক সিয়াইএসএফ জওয়ান(ঈ) চড় মেরেছে। সেই কৃষক আন্দোলনের সময় বাজে কথা বলেছিল সম্ভবত সেইজন্যই। 
    comment | আগেই বলেছিলাম তো যে কোন পশুপাখী হতে গর্বিত রাকৃমির শিক্ষায় শিক্ষিত ইতর হওয়ার চেয়ে। বাই দা রাস্তা এত্তসব জীবেপ্রেম হ্যানা ত্যানা  বলে  রাকৃমির এলিমেন্টরা বিভিন্ন জীবজন্তুকে এমনভাবে রেফার করার চেষ্টা করে যেন তারা ওই রাকৃমির কৃমিগুলোর তুলনায় নিকৃষ্ট! 
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত