এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • জীবন তরঙ্গ  পর্ব ৩৩ 

    Sukdeb Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ মে ২০২৪ | ৬৩ বার পঠিত
  • জীবন তরঙ্গ  পর্ব ৩৩

    একদিন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস কম ছিল। অন্য কোথাও না গিয়ে নয়ন সোজা বাড়ি ফিরে এল। বাড়িতে ঢুকে দেখে, মায়ের চোখটা ছলছল করছে।

    --কি হয়েছে গো  মা?  দেখে মনে হচ্ছে তোমার মনটা ভাল নেই।

    আহেলি চোখের জল মুছে বলল—দুপুরে ছোড়দা ফোন করেছিল, ছোট কাকিমা আর নেই।

    নয়ন চুপ করে বসে পড়ল। খবরটা যে অপ্রত্যাশিত এমন নয়, তবু খুব খারাপ লাগছে। দাদু দিদা বলতে নয়ন ঐ দুজন মানুষকেই জানে। শৈশবের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে ঐ দুজনকে ঘিরে। ছোড়দাদু একেবারে একা হয়ে গেল।

    --এসে যখন পড়েছিস, আর বসে থাকিসনি বাবা। হাত মুখ ধুয়ে একটু খেয়ে নে, তারপর চল বেরিয়ে পড়। আমি তো একাই যাচ্ছিলাম।  এসে গেছিস যখন, তোর সাথেই যাই। তোর বাবার অফিসে ফোন করে দিয়েছি, ও অফিস থেকে ওখানে চলে যাবে।

    বড় মামারা সকলে এসে গেছে। অবনি ঘরের বাইরে দালানে এক ধারে একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে রয়েছেন।  আহেলি দিন সাতেক আগে এসেছিল। ছোট কাকার ঘরে অনেকক্ষণ ছিল। শরীর অনুমতি না দিলেও, সেদিন কাকিমা অনেক গল্প করেছিলেন।  ভাগ্যিস এসেছিল, না হলে আর  দেখাই হত না। সারা জীবন আফসোস থেকে যেত। ওরা অবনির কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

    --টিনা, তোর কাকিমা ঘরে আছে, দেখে আয়। দাদুভাই তুই আমার পাশে একটু বোস।

    নয়ন দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।

    --খুব কষ্ট হচ্ছে দাদুভাই? কাঁদিস না দাদু। সেদিন বললাম না, আমাদের ডিপারচারের সময় হয়ে গেছে। শুধু ডাক আসার অপেক্ষা। ওপর থেকে ডাক এলেই রওনা হতে হবে। দিদা পরে এসে আগে চলে গেল। অবশ্য যাওয়ার আগে পরে কিছু নেই। যার জন্য যতটুকু সময় বরাদ্দ আছে তার এতটুকু এদিক ওদিক হওয়ার যো নেই। তোর নন্দা মাসি তো কবেই চলে গেছে। দুজনে পাশাপাশি অনেকটা পথ চললাম। এবার আমার একলা চলার পালা।

    নয়নরা আসার আগে অবনি একেবারে চুপ করে বসে ছিলেন। নয়নকে পেয়ে কথা বলে কিছুটা  হালকা হলেন। নয়ন দিদাকে দেখার জন্য ঘরে উঁকি দিল। বিছানায় শান্ত হয়ে শুয়ে রয়েছেন। মুখে রোগের জ্বালা যন্ত্রণার কোন ছাপ নেই।  যে  শরিকদের নয়ন কোনদিন চোখে দেখেনি, তারাও অনেকে এসেছে। দিদার শোকে তাদের মধ্যে থেকেই কান্নার আওয়াজটা বেশি আসছে। মাও কাকির পাশে বসে কাঁদছে। একটু পরে নয়ন মামার সাথে শ্মশান যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে বেরোল।
     
    --মুখাগ্নি কে করবে ছোটমামা? 

    --আমিই করব। অন্য কেউ যদি করতে চায় তাহলে আলাদা কথা। ছোটকাকা মনে হয় ঘাটে যাবে না। বয়স হয়েছে, না যাওয়াই ভাল।

    একটু বাদে শ্যামবাজার থেকে সব জিনিসপত্র কিনে নন্দরা ফিরে এল।  দুজন  অল্প বয়সী ছেলে খাটের ওপর তোষক পেতে চার কোনায় রজনীগন্ধার কয়েকটা করে স্টিক বেঁধে দিল। অবনি পাশেই বসে ছিলেন। শান্তির দেহ এনে খাটের ওপর শোয়ান হল। শ্মশান যাত্রীরা সকলে প্রস্তুত। প্রথম কাঁধ দেবে বাড়ির লোকেরা। নন্দ ছাড়াও অবনির আরো কয়েকজন ভাইপো এসেছে। বেরোবার আগে নন্দ বোনকে ডেকে বলল—টিনা তুই ছোটকাকার কাছে থাকিস। 

    অবনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—আমিও তোমাদের সাথে যাব।

    নন্দ মৃদু আপত্তি করে বলল—তোমার শরীর ভাল নয়, নাই বা গেলে।

    --তোর কাকিমা কোথাও একা যেতে সাহস পেত না। যেখানেই  গেছে, আমি সঙ্গে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে এসেছি। শেষটুকু আর একা ছাড়ি কেন!

    কাশী মিত্তির ঘাটে দাহ হল। শ্মশানে স্ত্রীর দেহের সামনে গিয়ে অবনি একটু বসলেন। স্ত্রীর মাথায়, কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে  মুখটা কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন— কতবার বলেছি একা যাওয়ার অভ্যাস কর, শোনোনি। কোথাও একা যেতে না, একা থাকতে চাইতে না, এবার কি হবে? এবার শুধু একাই একা, তুমিও একা, আমিও একা।

    স্ত্রীর মৃত্যুর পর এই প্রথম বৃদ্ধ কেঁদে ফেললেন। নয়ন গিয়ে দাদুকে সরিয়ে নিয়ে এল। আর কোন দাবীদার না থাকায়। মুখাগ্নি নন্দই করল।

    রমেন পরের দিন বাড়ি ফিরে এল। আহেলি আর নয়ন কাজকর্ম শেষ হওয়া অব্দি বাগবাজারে রয়ে গেল। ওখান থেকে চলে আসার আগে আহেলি কাকাকে অনুরোধ করেছিল—ছোট কাকা, আমার সাথে রহড়ায় চল। এখানে একা একা না থেকে সকলের মাঝে থাকলে ভাল লাগবে।

    অবনি হেসে বলেছিলেন—একা কোথায় রে? তোর কাকিমা তো এখানে চারদিকে ছেয়ে রয়েছে।  ও স্বার্থপরের মত ছেড়ে চলে গেল বলে কি আমিও ওকে এখনই ছেড়ে চলে যাব! তবে আমার মেয়ের বাড়িতে নিশ্চই যাব। নতুন পরিবেশে একটু রপ্ত হয়ে নিতে দে, তারপর। তোরাই তো আমার বল ভরসা মা।

    নয়নের এম এ ফাইনাল পরীক্ষা প্রায় এসে গেল। এম এর সাথে সাথে ডব্লিউ বি সি এস এর জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওদের এম এ  পরীক্ষার মাস খানেক পরেই ডব্লিউ বি সি এস এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষার দিন পড়েছে। ওটা টপকাতে পারলে মেন পরীক্ষায় বসতে পারবে।  তারপর পার্সোনালিটি টেস্ট। পরেরগুলো কপালে থাকলে পরে ভাববে, প্রথমে নয়ন প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ওপরেই ফোকাশ করেছে। দু চারটে বই কিনেছে, কিছু স্টাডি মেটিরিয়ালও যোগাড় করেছে। দুটো পরীক্ষা গায়ে গায়ে পড়ে যাওয়ায় একটু সমস্যা হচ্ছে।  

    থার্ড পেপার বাদ দিয়ে ফাইনাল পরীক্ষা বেশ ভালই হল। থার্ড পেপারটা ঠিক মনোমত হয়নি। পরীক্ষার পর থেকে রেজাল্ট বেরনোর আগে পর্যন্ত যে মস্তি  হয়, তা আর করা গেল না।  ডব্লিউ বি সি এস পরীক্ষার জন্য জোর কদমে লড়তে লাগল। আড্ডা দেওয়াও খুব কমে গেছে। এর জন্য বন্ধুদের কাছে মাঝে মাঝে কথা শুনতে হয়। খেলা দেখতে যাওয়াও সাময়িকভাবে বন্ধ।

    একটা দিন নিয়মের ওলট পালট হয়ে গেল। রজতের মামার ছেলের পাঁচ বছরের জন্মদিন। ওর মামা বাড়িতে এসে সকলকে বলে গেছে। পাশ কাটানর উপায় নেই, যেতেই হবে। 

    রমেন যায়নি, নয়ন মাকে নিয়ে গিয়েছিল। রজতরা আগের দিন চলে গিয়েছিল। নয়ন  ছোটবেলায় একবার রজতের সাথে ওর মামার বাড়িতে এসেছিল। সেই সময় দেখা বারুইপুরের মানচিত্র অনেক পাল্টে গেছে। অনেক  নতুন নতুন  ঘরবাড়ি , দোকানপাট হয়েছে। রজতের মামার বাড়িটা মোটামুটি  একই রকম আছে। বাড়ির লাগোয়া জমিটাতে বড় প্যান্ডেল হয়েছে।  রজত  দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে ভেতরে নিয়ে গেল। ওর মামি, দিদা ওদের দেখে খুব খুশি হল। মামির কোলে বার্থ ডে বয়। আহেলি আদর করে বাচ্চাটাকে কোলে নিল। শান্ত বাচ্চা, কোল পরিবর্তনে কোন বিদ্রোহ করেনি।  মামি রজতের দাদুর সাথে দেখা  করেতে  নিয়ে গেল। রজতও সঙ্গে গেল।  নয়নের ছোড়দাদুর মতই বয়স হবে। নয়ন রজতের কাছে ওর মামার বিয়ের সময়ের অশান্তির কথা শুনেছিল। সেই অশান্তির নায়ককে দেখে মনেই হল না যে, এই নিপাট ভাল মানুষ ঐ কান্ড করতে পারে। দাদু ওদের সাথে অনেক গল্প করলেন। বেরিয়ে আসার পর রজত মজা করে ওর দাদু সম্বন্ধে নয়নকে বলেছিল—যেমন শুনেছিলিস, দাদুকে ঠিক সেভাবে মেলাতে পারলি না তো! পারার কথা নয়। তোকে বলেছিলাম রত্নাকরের কথা আর তুই মোলাকাত করলি বাল্মিকীর সাথে। দাদু এখন পুরো পাল্টে গেছে। যে মামিকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না বলেছিল, তাকেই এখন চোখে হারায়।

    সেদিন খুব আনন্দ হল। সকলে অনেক করে রাতে থেকে যেতে বলছিল, কিন্তু ওরা এটা ওটা বলে পাশ কাটাল। অনেকটা পথ যেতে হবে। একটু আগে বেরোলে ভাল হত, কিন্তু সম্ভব হল না। ওরা যখন বারুইপুর থেকে রওনা দিল তখন রাত দশটা বেজে গেছে। বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে ঘড়ির দুটো কাঁটার  আলিঙ্গন করার সময় হয়ে গিয়েছিল।     

    চলবে
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন