এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বকবকস 

    Falguni Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ২৯০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • গ্রীষ্মের উদাসী দুপুর মানুষকে তো খ্যাপাটে করেই ছাড়ে। চাঁদিফাটা রোদ্দুর আর বিনবিনিয়ে ঘামে তেলে মাখামাখি হয়ে প্রত্যেক মানুষের তখন বেশ রসালো অবস্থা(রস চ্যাটচ্যাটে)। কিন্তু যাই হোক প্রাণটা তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে! তাই গলায় গ্যালন গ্যালন ঠান্ডা জল আর বরফ ঢুকতে থাকে বিচিত্র রঙ, গন্ধ আর শোভায় পানীয়ের বোতলের মাধ্যমে আর আছে প্রাণজুড়ানো আইসক্রিম, কুলফি। তবে এখন এগুলো যতই সহজলভ্য হোক না, আমার কিশোরীবেলায় বেশ দুর্লভ ছিল কিছুটা প্রযুক্তিগত আর বাকিটা পিতৃগত কারণে। তাছাড়া তখন জীবনধারণের ধারণাটাও ছিল অন্যমাপের। 
     
    গ্রামে মাটির দোতলা বাড়ির দাওয়ায় বাঁধানো মেঝের টেম্পারেচারে ভিজে গামছা কাঁধে ফেলে ‘স্লীপ’ মোডে দিব্যি দিবানিদ্রা, রাত্রিনিদ্রার সুখভোগ চলত। একুশ ডিগ্রীতে হাত-পা কনকন, সতেরো ডিগ্রীতে গলা বসে যাওয়া বা এয়ারকন্ডিশন্ড ঘরে ঠান্ডা-গরমে শরীর খারাপ হওয়ার দুর্ভাবনা ছাড়াই দিন গড়িয়ে যেত।
    মনে পড়ে চৈত্রের গরমের সাথে সাথে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করতে আসত কলসী, মাটির জালা। গ্রামের হাটেও তা দু- পাঁচ টাকায় কেনাবেচা হত। মাটির উনুনের মাথার মত তিনটে ইটের মাথা বানিয়ে ভিতরে বালি দিয়ে উপরে বসানো থাকত জালা বা কলসি। উফ! কি দাঁত কনকনে ঠান্ডা জল! কিন্তু গলা ধরে যাওয়ার কোনো ভয় নেই।  সাথে ছিল কাঁচা আমের টক আর ঘরে পাতা দই। এর পাশাপাশি পান্তা বা আমানি ভাত( একদিনের বাসি ভাতকে জল দিয়ে /জল পাল্টে রেখে হালকা টকভাব এলে, তবে যেন গেঁজিয়ে না যায়)—
                 “পান্তা ভাত পাতে ফেলি
                  তাতে নুন তেল দলি
                  সাথে পোস্তবাঁটা ও পেঁয়াজ
                  আহারে লঙ্কার কি ঝাঁঝ!—( কবিগুরু যেন আমায় ক্ষমা করেন)
    এসবের সঙ্গে সঙ্গত করত তালশাঁস, নুন-গোলমরিচ মাখা জাম, এর-তার গাছ বা গ্রামের বাগানের রসালো মিষ্টি আম। তাই তখনকার দিনে শুধু শরীর নয়, মনটাও বেশ রসালো হয়ে থাকত (এই রস চ্যাটচ্যাটে নয়, টইটম্বুর)।

    এহেন আমাদের ঢিলেঢালা কিশোরীবেলায় জার্মান থেকে এক সাহেবের উদয় হয়েছিল। তা এখনকার মত দু-চারবার বিদেশ ঘুরে বিদেশীদের সঙ্গে সেলফি তুলে পোস্টানো বা বন্ধু করার মধ্যে যে স্ট্যাটাস উত্তোলনের ব্যাপারটি রয়েছে সেটা তখন দূর অস্ত। উল্টে চোখ গোল্লা গোল্লা করে কৌতুহল টাই ছিল প্রধান বিষয় ও বিবেচ্য। তাছাড়া ছ’ফুটের উপর লম্বা, সুঠাম, সাদা, সোনালি চুলে, সোনা বাঁধানো দাঁতের হাসিতে যে জৌলুস ছিটকাতো তা আমাদের দুবেলা বেঁটেখাটো, নাদুস-নুদুস, কালোকেলো দেখা শিশু কিশোর চোখে অপার বিস্ময়। সেই সাহেবটি অবশ্য নিজের কাজেই এসেছিলেন — ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের সংস্কৃতির উপর গবেষণার কাজে।

    এলেন তো এলেন, এক্কেবারে গন্ডগ্রামেই এলেন। অত জার্মান ঘেঁষা ইড়িং বিড়িং ইংরাজি কে বোঝে বাপু! সুতরাং তিনি বাধ্য হলেন বর্ণপরিচয়ে হাতে খড়ি করতে। আর খুব ধৈর্য ও অধ্যবসায় সহকারে “আমি এখন ওয়ানে আছি” বলে প্রথম শ্রেণির পাঠ শুরু করলেন। এই ব্যাপারে তার সহায়তায় ছিলেন গ্রামের স্কুলের গুটিকয় শিক্ষক (আমার বাবা সেই তালিকাভুক্ত আর শিক্ষকের সন্তান হওয়ার সুবাদে আমি ও আমার ভাই)। পড়াশোনা তো চলছে তার পাশাপাশি সাহেবের উদরপূর্তিও ভালোই চলত গ্রামের বিশিষ্ট মানুষজনের বাড়ি বাড়ি। একদিন আমাদের বাড়িতে সাহেবের ডাক পড়ল। পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে মা সলজ্জ ভঙ্গীমায় পরিবেশন করলেন। কিন্তু খাবারের একটি পদে এসে সাহেবের চক্ষু স্থির —
    “হোয়াট ইস দিস?”
    -- “নাও ঠ্যালা! আর খাওয়াবে আমড়ার টক?” – বাবার গলায় বিরক্তি।
    নাছোড় সাহেব না বুঝে ছাড়বে না! এবার বোঝাও আমড়ার সঙ্গে আমের সম্পর্ক! আমড়া কি আমের ছোট ভাই! অবশেষে স্বাদের বর্ণনা দিয়ে কাঁচা একটি আমড়া প্রদর্শন করিয়ে ‘আমড়ার টক’ পদটি সাহেবের উপলব্ধজাত হল।
     
     সন্তুষ্ট চিত্তে সানন্দে আহার পর্ব সমাধা করে সাহেব নিম্নরূপ মেনু তালিকাটি অন্য জায়গায় গল্প করে বেড়ালেন—
       ১। রাইস
       ২। স্পিনাচ
       ৩। পালসেস
       ৪। ফিশ
       ৫। চিকেন
       ৬। কার্ড
       ৭। সুইট
    অ্যান্ড ডেলিসিয়াস রাউন্ড রাউন্ড আম-রার ঝোল।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Soumyadip Maschatak | ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:৩৮530706
  • অনবদ্য স্মৃতিচারণ । আক্ষরিক অর্থেই বেজায় সুস্বাদু এবং তাপহারক। আধা বা পুরো গ্রামের শীতলতায় মোড়া ক্ষর গ্রীষ্মের শৈশব তার যাবতীয় রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে হাজির হয়েছে লেখাটিতে। সত্যিই সেও এক সময় ছিল বটে। এহেন আখ্যায়িকা কাল ভ্রমণের সুযোগ করে দেয়। বড্ড ভালো লাগলো।
  • সমরেশ মুখার্জী | ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ২২:৩৩530709
  • শেষে সাহেবের আমড়ার টক খাওয়া‌র পর্বটি মিষ্টি লাগলো। তবে ভাগ‍্যিস সাহেব আমড়া‌র টক কে 'আম-রার ঝোল' অবধি রেখেছি‌লেন - অনুবাদ করতে গিয়ে 'আওয়ার জুস' করে দেননি  :-)
  • প্রতিভা | 2401:4900:7337:cf63::e3a:10ec | ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:১৩530742
  • শরীর মন দুইই ঠান্ডা হয় এমন লেখায়।
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০১:৪৬530769
  • চমৎকার লেখা।
    ফিরে গেলাম সেই সব দিনে।
    গিন্নির কাছে গল্প শুনেছি তার শিক্ষক মশাই পিতৃদেবও একবার এক জর্মান সাহেবকে বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন যিনি তখন বাংলা বলা মকসো করছিলেন এবং তার পছন্দের খাদ্য জানাতে গিয়ে বলেছিলেন - আমি চিঁড়া খাইব।
    এই সব অতীত সুখস্মৃতি পারিবারিক জগতে অমূল্য রত্ন হয়ে জমা থাকে। তারপর কেউ কেউ লিপিবদ্ধ হয়ে ইতিহাসের ক্যানভাসে যুক্ত হয়ে যায়।  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন