এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • ময়ূরঝর্ণা - পর্ব ১৮ 

    বিতনু চট্টোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৫ মার্চ ২০২৪ | ৩৫৭ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৩ জন)
  • উঠে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নেয় সিংরাই ওরফে জয়ন্ত। হ্যারিকেন জ্বালানো আছে তিনটে। যদিও অন্ধকারে সবার মুখ দেখা যায় না ভালো করে, ‘আজ একটা অদ্ভুত সময়ে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি। গত কয়েক বছরে আমরা, আমাদের দল কেউ ভাবতেও পারিনি এতটা রাস্তা আমরা পৌঁছতে পারব। কিন্তু আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। গরিব মানুষের সম্পূর্ণ মুক্তি, স্বাধীনতা এবং মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের আরও অনেকটা রাস্তা পার করতে হবে। আজ থেকে পাঁচ-দশ বছর আগেও এই এলাকার কী পরিস্থিতি ছিল আপনারা তা ভালো জানেন। আপনারা জঙ্গল দিয়ে ঘেরা গ্রামের মানুষ। আপনাদের জীবন-জীবিকা জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল। সারাদিন জঙ্গলের কেন্দু পাতা কুড়িয়ে আপনারা ল্যাম্পস সোসাইটিকে বিক্রি করেন। আজ থেকে কয়েক বছর আগেও ল্যাম্পস সোসাইটি কেন্দু পাতার কত টাকা দাম দিত? দু’হাজার পাতা বিক্রি করে পেতেন পাঁচ টাকা। আর আজ কত টাকা পাচ্ছেন? অনেকটা দাম হয়তো বাড়েনি, কিন্তু যতটুকু বেড়েছে, তা ল্যাম্পস সোসাইটি নিজে থেকে বাড়ায়নি। আমাদের আন্দোলনের জন্য দাম বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছে।
     
    আপনাদের দাবি নিয়ে আমরা আন্দোলন করছি, আমরা তো অন্যায় দাবি কিছু করছি না। গরিব মানুষের চিকিৎসা যাতে ঠিক মতো হয়, রোজগার যাতে বাড়ে, শোষণ-বঞ্চনা যাতে কমে, তার জন্য আমাদের আন্দোলন। কিন্তু আপনাদের যে দাবি আছে, যা প্রয়োজন আছে, তার সমাধান না করে পুলিশ আপনাদেরই হেনস্থা করছে। আপনাদের ওপর দমনপীড়ন চালাচ্ছে। সরকার যদি আপনাদের ন্যায্য দাবি অনুযায়ী সমস্যাগুলোর সমাধান করতো, তবে তো আমাদের আন্দোলনের দরকার পড়ত না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার একদিকে আপনাদের দাবি পূরণ করছে না, আবার আপনারা সেই দাবি আদায়ে আন্দোলন করলে, আপনাদের দমন করতে পুলিশ পাঠিয়ে দিচ্ছে। এর কারণ কী? এর কারণ, শাসক দল, পুলিশ, রেশন মালিক, জোতদার এবং বড় ব্যবসায়ী সবাই একদিকে, অন্যদিকে আপনাদের মতো গরিব মানুষ। আমাদের পার্টি গরিব মানুষের পক্ষে। তাই আমরা যখন আপনাদের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছি, পুলিশ আপনাদের ওপর দমন নীতি চালাচ্ছে। এর মানে, আপনাকে অধিকারও দেবে না, আবার আপনি তা বলতে গেলে, বলতেও দেবে না।
    কিন্তু আপনার অধিকার পেতে হলে আন্দোলন ছাড়া কোনও রাস্তা নেই। আন্দোলন ছাড়া কেন্দু পাতার দাম বাড়েনি। আন্দোলন করতে গিয়ে দরকারে জেল খাটতে হবে, পুলিশের গুলি খেতে হবে। বিনা রক্তপাতে যেমন বাচ্চা প্রসব হয় না, তেমন বিনা রক্তপাতে অধিকারও আদায় হবে না। অধিকার পেতে গেলে কষ্ট স্বীকার করতে হবে। সেই কষ্ট স্বীকার করতে আমরা রাজি আছি, আমরা জানি আপনারাও রাজি আছেন। কিন্তু আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা না হোক তা কে চায়? যারা ওই শাসক শ্রেণি, পুলিশ, ব্যবসায়ী, জোতদার, বড়লোকদের দালাল, তারা চায় না গরিব মানুষ তার অধিকার পাক। এই দালালদের খুঁজে বের করতে হবে। তারাই পুলিশের ইনফর্মারের কাজ করছে। এই যে ধরুন আমরা কয়েকজন এই গ্রামে এসেছি, আমরা তো নিশ্চয় পুলিশকে খবর দেব না। আপনারা যারা নিজেদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আজ মিটিংয়ে এসেছেন, তারা নিশ্চয় পুলিশকে খবর দেবেন না। কিন্তু তাও পুলিশ খবর পাচ্ছে। কীভাবে পাচ্ছে? তার মানে এই গ্রামে কেউ আছে, হয়তো এই মিটিংয়েও কেউ আছে যে গরিব মানুষের ভালো চায় না। তারা আপনাদের সঙ্গে মিশে আছে, পুলিশকে খবর দিচ্ছে আমাদের ব্যাপারে। পুলিশের এই  দালালদের খুঁজে বের করতে হবে। এবং তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। গরিবের শত্রু এবং পুলিশের দালালদের চরম শাস্তি দিতে হবে। আজ আমরা এই কথা বলে গেলাম, আপনারা চোখ-কান খোলা রাখুন, আমরাও খোঁজ করছি। গিরুলিয়া গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষকে আজ আমরা বলে যাচ্ছি, আমরা কয়েকজনকে শনাক্ত করেছি, যারা পুলিশের দালালের কাজ করছে। ইনফর্মারের কাজ করছে। গরিব মানুষের বিরোধিতা করার শাস্তি তাদের পেতেই হবে।’
     
    এর পর আরও অনেক কথাই বলে জয়ন্ত। তাদের রাজনীতির থেকেও বেশি করে বলে গ্রামের সাধারণ মানুষে সমস্যা, জীবন সংগ্রামের কথা। কিন্তু গোটা বক্তৃতায় সবচেয়ে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয় তাদের আগামী দিনের রণকৌশলের কথা। এমসিসি’র নতুন রাজনৈতিক লাইন ঘোষণা হয়ে যায় গিরুলিয়ায় আজকের গ্রাম বৈঠকে। যদিও এই রাজনৈতিক লাইনের পরীক্ষানিরীক্ষা আগেই রাজ্যের জঙ্গলমহলে শুরু করে দিয়েছে পিপলস ওয়ার গ্রুপ। কিন্তু যখন এমসিসি’ও সেই রাস্তাই বেছে নিল এবং প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দিল, তখন এক নতুন মোড়ে এসে দাঁড়াল বেলপাহাড়ি, বান্দোয়ান, বারিকুল, রাইপুর সহ পুরো জঙ্গলমহলের রাজনীতি। এটা একুশ শতকের প্রথম দশকের গোড়ার দিকের কথা। এর পর থেকে পুরোপুরি বদলে গেল জঙ্গলমহলের চেহারা।    
              
    ১০-০৯-২০০৩, মুখোমুখি এমসিসি-পিপলস ওয়ার গ্রুপ

    বিকেল প্রায় চারটে, লালজলের জঙ্গলে কিছুটা ছাড়া ছাড়া বসে এমসিসি’র দলটা। একদিকে ব্যাগ, টেন্ট গোছাতে ব্যস্ত কয়েকজন, বাকিরা চুপ করে বসে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। কিছু আগেই বনমালী জানিয়ে দিয়েছে, আজ সন্ধে নামলেই এলাকা ছাড়তে হবে। ঠিক হয়, জঙ্গলের রাস্তা ধরে যাওয়া হবে বাঁকুড়ার বারিকুলে। আপাতত কিছুদিন সমস্ত অ্যাক্টিভিটি বন্ধ রাখতে হবে বেলপাহাড়িতে। সকালের ঘটনাটা মনে পড়লে এখনও যেন হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে দ্বিজেন, অর্জুন, বনমালী, সিংরাইদের। পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টার প্রায় হয়েই যাচ্ছিল আজ। 
    মাস’খানেক আমলাশোলের শবর পাড়ায় থাকার পর কিছুদিন আগে এমসিসি দলটা চলে এসেছিল লালজলের জঙ্গলে। গত চার-পাঁচদিন লালজলের জঙ্গলেই রাতে থাকছিল সতেরো-আঠেরো জন। দুপুর তখন প্রায় একটা। হঠাৎই জঙ্গলে কিছু মুভমেন্ট টের পায় বনমালীরা। ঘোর বর্ষা, জঙ্গল এখন অনেকটাই ঘন। কোনও কোনও জায়গায় কয়েক হাত দূরের লোককেও দেখা যায় না, আচমকাই কিছু ভারী বুটের শব্দ। সেই সঙ্গে অনেকের গলার আওয়াজ। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয় বনমালী, সিংরাইয়ের। সিংরাই, ধ্রুব আর বনমালী ছিল একসঙ্গে। দু’শো মিটার আগে দ্বিজেন আর অর্জুন। বাকিরা আরও কিছুটা দূরে দূরে। পায়ের আওয়াজে চোখে চোখে ইশারা হয়ে যায় নিজেদের মধ্যে। কাঁধ থেকে নামিয়ে বন্দুক হাতে তুলে নেয় তিনজনই। বনমালীদের আন্দাজও ছিল না আজ সকালে বেলপাহাড়ি থানায় এসেছে একের পর এক পুলিশের গাড়ি। ঝাড়গ্রাম থেকে এসডিপিও অনিরুদ্ধ তো বটেই, বেলপাহাড়ি এসে হাজির হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার। দু’তিন দিন আগে সোর্স মারফত বেলপাহাড়ি থানায় খবর পৌঁছেছিল, চাকাডোবার আশপাশের জঙ্গলে মাওয়িস্ট স্কোয়াডের মুভমেন্ট হচ্ছে। কিন্তু এমসিসি দলটা যে লালজলের জঙ্গলে থাকছে তার কোনও নির্দিষ্ট খবর ছিল না পুলিশের কাছে। অনিরুদ্ধ আর বেলপাহাড়ির ওসি প্রভাত নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ঠিক করেছিল লালজলের জঙ্গলে রেইড করবে। ভোর ভোরই জঙ্গলে ঢোকার কথা ছিল পুলিশের। কিন্তু গতকাল রাতে অনিরুদ্ধকে কোনও একটা কাজে ফোন করেছিল জেলার পুলিশ সুপার। তখনই কথায় কথায় অনিরুদ্ধ জেলার এসপিকে জানিয়েছিল আজ জঙ্গলে রেইডের প্ল্যান করছে তারা। এসপি জানায়, সে নিজে আসতে চায় বেলপাহাড়ি। মেদিনীপুর থেকে রওনা দিয়ে বেলা দশটা নাগাদ ঝাড়গ্রামে পৌঁছয় মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার। তারপর বেলপাহাড়ি থানা থেকে দুপুর বারোটা নাগাদ পুলিশ সুপার, এসডিপিও’র বিরাট কনভয় রওনা দেয় লালজলের দিকে।
     
    জঙ্গলে ঢুকে পাশাপাশি হাঁটছিল অনিরুদ্ধ আর জেলার এসপি। পিছনে তাদের সিকিউরিটি। পুলিশের প্রায় কুড়ি-পঁচিশজনের দল ঢুকেছিল জঙ্গলে। ওদিকে বনমালীরা সতেরো জন। পায়ের শব্দটা প্রথম পেয়েছিল সিংরাই, গলা দিয়ে একটুও শব্দ না করে সতর্ক করেছিল বনমালীকে। বনমালী চেপে ধরে ধ্রুবর হাত। তিনজনই নিমেষে উঠে পড়ে পাশাপাশি দুটো গাছে। কিন্তু সেই সময় পায়নি কিছুটা দূরে থাকা দ্বিজেন আর অর্জুন। বনমালীরা যেখানে ছিল তার কিছুটা আগে হঠাৎই কী ভেবে বাঁদিকে টার্ন নিল পুলিশের টিমটা। তাদের কুড়ি ফুটের মধ্যে তখন দ্বিজেন আর অর্জুন। বনমালী আন্দাজ করে বিপদ আসন্ন। গাছে নিজেকে সেট করে নিয়ে ট্রিগারে হাত দেয়, অন্যদিকে দম বন্ধ করে বন্দুক হাতে তুলে নেয় দ্বিজেন আর অর্জুন। ধরা পড়ার থেকে মেরে মরা ভালো।
    এরপর মিনিট দুয়েক কীভাবে যে কাটল তা এই তিন ঘণ্টা বাদেও ভাবতে পারে না বনমালী, দ্বিজেন, সিংরাইরা। বর্ষায় সদ্য গজানো ঝোপঝাড় সরাতে সরাতে দ্বিজেন আর অর্জুনের প্রায় কুড়ি ফুট দূর থেকে হেঁটে চলে যায় পুলিশের পুরো টিমটা। কারও চোখেও পড়ে না গাছের আড়ালে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে এমসিসি’র দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। পুলিশের দলটা সামনে থেকে বেরিয়ে যেতেই পজিশন নিয়ে নেয় সবাই। পজিশন মানে সুবিধেজনক উঁচু গাছ বা এমন কোনও জায়গায় রেডি হয়ে বসে থাকা, যাতে এনকাউণ্টার হলে অ্যাডভান্টেজ পাওয়া যায়। জঙ্গলের যুদ্ধে শুধু ঠিকঠাক পজিশনের জন্যই চারজন যোদ্ধাও হারিয়ে দিতে পারে তিরিশ জনের সশস্ত্র বাহিনীকে।
    প্রায় আড়াই-তিন ঘণ্টা কোনও নড়াচড়া না করে নিজের নিজের জায়গায় বসে থাকে পুরো এমসিসি দলটা। তারপর তারা নিশ্চিত হয়, পুলিশ বেরিয়ে গিয়েছে। তারপর তারা সিদ্ধান্ত নেয়, অন্ধকার হলেই লালজল ছাড়ার। ততক্ষণে পুলিশের পুরো টিমটা ফিরে গিয়েছে বেলপাহাড়ি থানায়। বিকেল চারটে নাগাদ পশ্চিম মেদিনীপুরের এসপির কনভয় বেরিয়ে যায় বেলপাহাড়ি থানা থেকে। আরও কিছুটা সময় থানায় থেকে যায় অনিরুদ্ধ।
     
    রাত আটটা নাগাদ লালজল থেকে বেরোয় সতেরো জনের দলটা। কিছুটা গ্যাপ রেখে সিঙ্গল লাইন ফর্মেশনে এগোতে থাকে তারা। চারদিকে ঘন অন্ধকার, জঙ্গলের কোনও কোনও জায়গায় চাঁদের আলোও ঢোকে না। এই সব রাস্তা হাতের তালুর মতো চেনা বনমালী, দ্বিজেনদের। বর্ষার এই সময়টা মাটি ভেজা, শুকনো পাতাও নেই কোথাও, তাই পায়ের আওয়াজ হয় না। তবু আজ একটু বেশিই সতর্ক বনমালীরা। জোড়আম পেরিয়ে সামান্য এগোতেই দ্বিজেন টের পায় জঙ্গলে কিছু মানুষের উপস্থিতি। পুলিশ কি এখনও তল্লাশি চালাচ্ছে নাকি? থমকে দাঁড়ায় লাইনের একদম সামনে থাকা দ্বিজেন আর সাঁওতা। কিছুটা গ্যাপ রেখে থেমে যায় সিংরাই আর সুনিয়াৎ। সুনিয়াৎ ঝাড়খন্ডের ছেলে, এখনও বাংলা বলতে পারে না ঠিক করে। তবে বুঝতে পারে অল্প অল্প। সিংরাই দেখে সুনিয়াৎ চোখের নিমেষে উঠে যায় একটা গাছের ওপর। সামান্য শব্দ হয় শুধু, কিন্তু জঙ্গলের লড়াইয়ে গাছের ওপর পজিশন নেওয়া মানেই যে শত্রুপক্ষের থেকে অনেক বেশি অ্যাডভান্টেজ নিয়ে নেওয়া তা জানে সবাই। কিন্তু জানলেই তো হয় না, দরকারের সময় তা পারে ক’জন!
    ওদিকে যাদের নড়াচড়ার আওয়াজ পেয়ে সতর্ক হয়ে যায় বনমালী, সিংরাই, সুনিয়াৎ, দ্বিজেনরা, যে যার মতো হাতে তুলে নেয় বন্দুক, হাত রাখে ট্রিগারে, তারা কিন্তু বুঝতে পারে না তাদের ঘিরে নিয়েছে সশস্ত্র এমসিসি স্কোয়াড। বনমালী, দ্বিজেন, অর্জুন, সিংরাই, সাঁওতা, সুনিয়াৎ, শিবানী, জবা, অনন্তরা দু-তিন’জনের ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে শত্রুপক্ষের জন্য। সবাই জানে, জঙ্গলে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে যুদ্ধ জেতা যাবে না। জঙ্গলে যুদ্ধ জেতার একটাই রাস্তা, শত্রুপক্ষের থেকে সুবিধেজনক পজিশন নেওয়া। চোখের পলক পড়ে না কারও, দম বন্ধ করে অপেক্ষা করে সবাই। কেটে যায় মিনিট পনেরো-কুড়ি বা আধ ঘণ্টা। প্রথম সন্দেহটা হয় সাঁওতার, সেই ছিল সবার সামনে। যাদের তারা ঘিরেছে তারা সত্যিই পুলিশ তো! নাকি সাধারণ গ্রামবাসী? কয়েকটা টুকরো টুকরো শব্দ আসে ভেসে আসে তার কানে। কথা বলছে কয়েকজন। মাঝে মাঝে দু’চারটে হিন্দি শব্দও যেন শুনতে পায় সে। সাঁওতা তাকায় দ্বিজেনের দিকে। দ্বিজেনেরও মনে সন্দেহ হচ্ছিল, পুলিশ হলে এই জঙ্গলের ভেতর এত রাতে নিজেদের মধ্যে কথা বলবে কেন? গ্রামের মানুষই বা কী করছে এত রাতে? নানা প্রশ্ন আসে এমসিসি স্কোয়াডটার মনে, কিন্তু কেউ বুঝতে পারে না, যে চার-পাঁচজনের নড়াচড়া এবং গলার আওয়াজ শুনে তারা এতক্ষণ পজিশন নিয়ে বসে আছে তারা আসলে পিপলস ওয়ার গ্রুপ বা জনযুদ্ধের একটা ছোট দল। তারা মাজুগাড়া থেকে যাচ্ছে কাঁকড়াঝোড়, মাঝে খেতে থেমেছে। সেই দলটায় আছে মদন মাহাতো, কল্পনা মাইতি, শশধর মাহাতো এবং তেলেগু দীপক।                     
    জঙ্গলের মধ্যে গোল হয়ে বসে সবাই। প্রথম কথা শুরু করে বনমালী। প্রায় সবাই একে অন্যকে চেনে। যদিও তাদের কাজের জায়গা আলাদা, তাদের দল আলাদা, দলের রাজনৈতিক লাইন আলাদা। পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা, শালবনি থেকে শুরু করে গোয়ালতোড়ের জঙ্গল হয়ে বাঁকুড়ার সারেঙ্গা এবং আশপাশের এলাকায় জনযুদ্ধের গতিবিধি। অন্যদিকে, বেলপাহাড়ি, রানিবাঁধ, খাতরা, বারিকুলে প্রভাব বেশি এমসিসি’র। আজ জোরআম জঙ্গলে রাতে যে দু’দল মুখোমুখি পড়ে যায়, প্রায় দু’ঘণ্টা কথা বলে নিজেদের মধ্যে, সেই একুশ জনের মধ্যে একমাত্র তেলেগু দীপক ছাড়া কেউই পরিষ্কার জানে না, দু’দলেরই একদম শীর্ষ স্তরে প্রাথমিক একটা আলোচনা শুরু হয়েছে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে।
     
    সংগঠনের কাজ কেমন এগোচ্ছে, মানুষ কী বলছে তা নিয়ে বনমালী কিছু বলতে শুরু করলে তাকে থামিয়ে দেয় মদন মাহাতো। ‘দেখ সুকান্ত, তোমাকে একটা কথা বলছি। মানুষ যতই তোমাদের বা আমাদের সমর্থন করুক না কেন, পুলিশ যেভাবে দমনপীড়ন চালাচ্ছে, তাতে বেশিদিন মানুষ আমাদের পাশে থাকতে পারবে না। আমি অন্য রাজ্যে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, মানুষ যতই আমাদের রাজনীতির পাশে দাঁড়াক, গ্রামের মানুষ সমর্থন করতে চাইলেও করতে পারবে না। আমরা যদি পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারি, মানুষের ভয় কাটানো যাবে না। মানুষ এখন আমাদের বলছে, পুলিশ আমাদের ওপর অত্যাচার করছে, আপনারা পুলিশের ওপর বদলা নিন।’
    মদন মাহাতোর কথা চুপ করে শোনে সবাই, কেউ কোনও কথা বলে না। বনমালী, দ্বিজেনের দিকে তাকিয়ে এবার মুখ খোলে তেলেগু দীপক, ‘দাদা, আপ তো পাবলিককে পাস যা রহে হো। কেয়া বাতা রহে হ্যায় গরিব আদমি। আপকা পার্টি, হামারা পার্টি আলাদা হ্যায়, লেকিন হাম চাহতে তো হ্যায় একহি চিজ। হামারা লক্ষ্য এক হ্যায়। আপলোগ চাহে তো হাম এক জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি বানা সাকতে হ্যায়। পুলিশকে খিলাফ অ্যাকশন করনাই পড়েগা। নেহি তো পাবলিক ডর যায়গা।’
    তেলেগু দীপকের প্রস্তাব শুনে চিন্তায় পড়ে যায় বনমালী। বুঝতে পারে জনযুদ্ধের নেতারা ঠিক কথাই বলছে, গ্রামে গ্রামে গিয়ে ইদানীং একই কথা শুনছে তারাও। কিন্তু জনযুদ্ধের সঙ্গে জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি? থমকে যায় বনমালী, তারপর বলে, ‘আমাদের পার্টি, আপনাদের পার্টি আলাদা। একসাথে এভাবে জয়েন্ট কমিটি করে কিছু করা সম্ভব নয়। আপনারা আপনাদের মতো কাজ করুন, আমরা আমাদের মতো কাজ করি।’
    এই ঘটনার ঠিক এক বছর বাদে, ২০০৪ সালে ২১ শে সেপ্টেম্বর পিপলস ওয়ার গ্রুপ বা জনযুদ্ধ এবং মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার বা এমসিসি মিলে যাবে। তৈরি হবে নতুন দল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মাওবাদী। এবং এই দুই দল মিশে যাওয়ার পর বাংলাতে মাওবাদী আন্দোলন এক নতুন মোড় নেবে। যদিও আজ যারা জোড়আম গ্রামে কথা বলল, তারা প্রায় কেউই জানে না, দু’দলের একদম শীর্ষ স্তরে এই আলোচনা শুরু হয়েছে। কিছুটা জানে তেলেগু দীপক। কিছুটা হয়তো আন্দাজ করতে পারে বনমালী, দ্বিজেন। জোড়আমে দু’দলের কথাবার্তা শেষ হলে জনযুদ্ধ স্কোয়াড কাঁকড়াঝোড় হয়ে ঘাটশিলার রাস্তা ধরে, এমসিসি’র সতেরো জন ভোর রাতে পৌঁছয় বাঁকুড়ার অরলো গ্রামে।  

    ১১-১০-২০০৩, কাঁকড়াঝোড়

    চারদিন আগেই দলদলির জঙ্গলে এক বৈঠকে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল বনমালীরা। ঠিক হয়, ভূলাভেদা থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গিয়েছে কাঁকড়াঝোড়ের দিকে, সেখানে মাটির রাস্তায় ল্যান্ড মাইন পাতবে সিংরাইরা। প্রত্যেকটা গ্রামে এবং জঙ্গলে পুলিশের গতিবিধি বেড়েই চলেছে। পুলিশের বিরুদ্ধে অ্যাকশন না করলেই নয়। ল্যান্ড মাইন পাতার দায়িত্ব পড়ে সাগেন ওরফে রাজারাম এবং সুনিয়াতের ওপর। তাদের সাহায্য করার জন্য থাকবে সিংরাই, অনন্ত, অর্জুন। দলদলির জঙ্গলে বসে অপারেশনের প্ল্যানিং চূড়ান্ত করে বনমালী আর দ্বিজেন। সেদিন সেখানে এই সাতজন ছাড়াও উপস্থিত ছিল বানেশ্বর আর বিমলা। ঠিক হয়, কাঁকড়াঝোড়ের দু’কিলোমিটার আগে জিপ ঢোকার রাস্তায় ল্যান্ড মাইন পাতা হবে। তারপর অপেক্ষা করা হবে পুলিশের জন্য। পুলিশের গাড়ি এলে ল্যান্ড মাইন ব্লাস্ট করাবে সুনিয়াৎ। গাছের ওপরে পজিশন নিয়ে থাকবে সাগেন, সিংরাই, অর্জুন, অনন্ত। বিস্ফোরণের পর পুলিশ রাস্তায় নামলে একসঙ্গে আক্রমণ করা হবে চারদিক থেকে। কাঁকড়াঝোড় বেছে নেওয়ার কারণ, অপারেশনের পর দ্রুত মিনিট পনেরো-কুড়ির মধ্যে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঝাড়খন্ড পালানো যাবে। প্ল্যানিং অনুযায়ী দু’দিন আগেই অপারেশনের দায়িত্বে থাকা পাঁচজনের দলটা চলে এসেছে কাঁকড়াঝোড়। ১০ তারিখ সারা রাত তারা জঙ্গলের রাস্তায় ল্যান্ড মাইনের তার পাতার কাজ করে। মাটির রাস্তায় গর্ত করে পোঁতা হয় সিমেন্টের পাইপ, তাতে ভর্তি পাথরকুচি, লোহার বল। আজ সকাল থেকে পজিশন নিয়ে নেয় সবাই। শুধু যেখানে তারের শেষ মাথা সেখানে জঙ্গলে লুকিয়ে অপেক্ষা করে সুনিয়াৎ। পুলিশের গাড়ি এলে ডিটোনেট করবে সে। পুলিশ পুরো বেলপাহাড়ির বিভিন্ন জঙ্গলে টহলদারি চালাচ্ছে, কবে আসবে এই রাস্তায় নিশ্চিত নয় কেউই। কিন্তু আসবে তো বটেই, আজ নয়তো কাল, নয়তো...। বিকেল তিনটে বেজে গেলে যে যার নিজের পজিশন ছেড়ে দেয়। আজ আর পুলিশ আসবে না। আবার কাল সকাল থেকে অপেক্ষা।
     
    কাঁকড়াঝোড়ে জঙ্গলের কোথায় সুনিয়াৎ, সিংরাইরা থাকছে তা জানা ছিল শুধু বনমালীর। রাত প্রায় সাড়ে দশটা, খাবারের পর নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল সিংরাই, অর্জুন, সাগেনরা। হঠাৎই সেখানে এসে হাজির হয় বনমালী। বনমালীকে দেখে চমকে ওঠে সবাই।
    ‘খবর শুনেছ?’ হাঁফাতে হাঁফাতে প্রশ্ন করে বনমালী।
    সবাই এ-ওর দিকে তাকায়, বুঝতে পারে না কোন খবরের কথা বলছে বনমালী।
    ‘পিডব্লুজি অ্যাকশন করে দিয়েছে। আজ দুপুরে কাঁটাগাড়াতে পুলিশ কনভয়ে ব্লাস্ট করেছে দীপকের স্কোয়াড। পুলিশের সঙ্গে এনকাউণ্টার হয়েছে জনযুদ্ধর। বান্দোয়ানের ওসি নীলমাধব দাস মারা গেছে,’ টানা বলে থামে বনমালী। বনমালীর কথায় যেন বজ্রপাত হয়, কেউ কোনও কথা বলতে পারে না।
    ‘আমি বিকেলে খবরটা শোনার পরই ধ্রুবকে বারিকুল পাঠিয়েছি দলের বাকিদের অ্যালার্ট করতে। দ্বিজেন রানিবাঁধ চলে গেছে। আমি নিজে এখানে এলাম। আমাদের সবাইকে ইমিডিয়েট সাবধান হতে হবে। কাল থেকেই পুরো জঙ্গলমহলে পুলিশের অপারেশন শুরু হবে। পুলিশ চিরুনি তল্লাশি শুরু করবে। গ্রামে গ্রামে হানা দেবে, অনেক নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর অত্যাচার করবে। আগামী কয়েকটা দিন, অন্তত এক মাস খুব ভাইটাল। কোনও রকম রিস্ক নেওয়া যাবে না। এই সময় কোনও গ্রামে ঢোকার দরকার নেই। তোমাদের অপারেশনের কী অবস্থা?’
    ‘তার পাতা হয়ে গেছে। আমরা রেডি,’ জবাব দেয় সিংরাই।
    ‘এখন অপারেশন করা যাবে না। আজ রাতেই তোমরা বেরিয়ে যাবে এখান থেকে। আপাতত ঘাটশিলায় গিয়ে থাক কিছুদিন। সবার একসঙ্গে থাকার দরকার নেই। আমি এখনই বেরিয়ে যাব। সিংরাই আমার সঙ্গে চল। বাকি চারজন দুটো দলে ভাগ হয়ে বর্ডার ক্রস করে যাও তাড়াতাড়ি। আমাকে একবার লালজলে জিতেনের বাড়ি যেতে হবে। সেখানের কাজ সেরে আমি আর সিংরাই বেরিয়ে যাব।’
    বনমালীর কথায় কেউ কোনও জবাব দেয় না। এই অপ্রত্যাশিত ডেভেলপমেন্টের জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউই। পুলিশকে অ্যাটাক করার যে প্ল্যান তারা করেছিল, তা জনযুদ্ধ করে দিয়েছে, ভাবতে পারে না তারা!    
    ‘আমরা তাহলে কোথায়, কবে মিট করব?’ প্রশ্ন করে অনন্ত।
    ‘আপাতত আগামী এক মাস অন্তত বাংলায় ঢুকবে না কেউ। সব কিছু ঠিক থাকলে সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে লাখাইসিনি বেস ক্যাম্পে দেখা হবে।’ ২০০৩ সালের ১১ অক্টোবর, মাঝরাতে কাঁকড়াঝোড়ের জঙ্গল ছেড়ে ঘাটশিলার দিকে রওনা দিল অনন্ত, সুনিয়াৎ, রাজারামরা। সিংরাইকে নিয়ে লালজলের রাস্তা ধরে বনমালী। লালজলে জিতেন মুর্মুর বাড়ির উঠোনে এক বিশেষ জায়গায় মাটিতে পোঁতা আছে দুটো রাইফেল। তা জানে শুধুমাত্র বনমালী আর অর্জুন। রাইফেল দুটো নিয়ে ভোর হওয়ার আগে বেরিয়ে যেতে হবে রাজ্য ছেড়ে। ভোরের আলো ফোটার আগে বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় এমসিসি’র যতজন  সক্রিয় সদস্য ছিল, সবাই একে একে ঝাড়খন্ডে ঢুকে পড়ে।
     
    পরদিন ভোর থেকে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রামে শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড পুলিশি মুভমেন্ট। গ্রামে গ্রামে পুলিশের হানা। গ্রেফতার করা হল বেশ কয়েকজনকে, তার চেয়েও বেশি লোককে করা হল জিজ্ঞাসাবাদ, হেনস্থা। রাজ্যে প্রথম কোনও ওসি খুনের ঘটনায় সাড়া পড়ে গেল প্রশাসনে। অনিরুদ্ধ বা যে পুলিশ অফিসাররা জঙ্গলমহলে কাজ করছিল তারা অনেকেই এলাকার পরিস্থিতি বুঝতে পারছিল কয়েক বছর ধরে, কিন্তু বান্দোয়ান থানার ওসি নীলমাধব দাসের খুনের পর নড়েচড়ে বসল মহাকরণ। জঙ্গলমহলে শুরু হল ব্যাপক ধরপাকড়, যার আঁচ এসে পড়ল সরাসরি সাধারণ মানুষের ওপর। এই ব্যাপক ধরপাকড়, পুলিশের তৎপরতার গর্ভে জন্ম নিল রক্তাক্ত মাওবাদী কার্যকলাপের এক নতুন অধ্যায়। আর ইতিহাস জানে, ২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে পুরুলিয়ার বান্দোয়ান থানার ওসি খুনের ঘটনার পর যত এগিয়েছে ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোট, ততই বারবার খবরের শিরোনামে এসেছে বান্দোয়ান, বেলপাহাড়ি, বারিকুল, বাঘমুন্ডি, রানিবাঁধের নাম। আর সব শেষে ২০০৮ সালে লালগড়।
    কিন্তু বান্দোয়ানের ওসি খুনের ঘটনার পর কোন রাস্তায় এগোল এমসিসি এবং জনযুদ্ধের রাজনৈতিক আন্দোলন, আর ২০০৪ সালে এই দু’দল মিলে যাওয়ার পরে কী কী ঘটতে শুরু করল জঙ্গলমহলজুড়ে, তা এই ময়ূরঝর্ণার বিষয় নয়। কারণ, সেই সমস্ত ঘটনা যে বা যারা ঠিকঠাক জানে এবং বলতে পারে, তাদের সকলেই আজ, মানে ১২ই অক্টোবর ২০০৩, ভোর সাড়ে পাঁচটা-ছটার মধ্যে পেরিয়ে গেল বাংলার সীমানা। বেলপাহাড়ি আর জামবনির সীমানায় পরিহাটি মোড়ে খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা দু’-পাঁচজন গ্রামবাসী দেখল, একজন মাঝবয়সী লোক আর এক যুবক দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছে গিধনি স্টেশনের দিকে। বাংলা ঝাড়খন্ড সীমানার গিধনি স্টেশনে পৌঁছে একটু দূরত্ব রেখে দুটো আলাদা বেঞ্চে বসল বনমালী ওরফে সুকান্ত আর সিংরাই ওরফে জয়ন্ত। ঘড়ি দেখল বনমালী, টাটানগরের ট্রেন আসতে এখনও দেরি আছে।

    এপিলগ বা উপসংহার

    ময়ূরঝর্ণা গ্রামে সুবল মান্ডির বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় দেড়’বছর। অনিরুদ্ধর কাছে সেই বাচ্চা ছেলেটার গল্প শুনে ওই এলাকা, ওই পরিবার, তাদের জীবনযাপনের কথা জানতে চেয়েছিল অরিন্দম। কিন্তু ধর্মাল মান্ডির সঙ্গে কথা বলার পর অরিন্দম বুঝতে পারে, যতক্ষণ না তার দাদা সিংরাইয়ের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে, ততক্ষণ বোঝা অসম্ভব জঙ্গলমহলের পুরো রাজনীতি। মাঝে একবার অরিন্দম ভেবেছিল, ধর্মালের মুখে যা শুনেছে, সিংরাইকে নিয়ে যতটুকু জেনেছে তা লিখে রাখবে। কয়েকবার লেখার চেষ্টাও করে, কিন্তু পারে না। শেষমেশ সেই চেষ্টা বাতিল করে অরিন্দম।
     
    অরিন্দম ভাবতেও পারে না হঠাৎই একদিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে। সেদিন দুপুরে অরিন্দম অফিসে বসেছিল, সেটা ২০১৮ সালের গোড়ার দিক। নিউজ রুমে খবর এসে পৌঁছয়, কোনও এক বড় মাওবাদী নেতা আত্মসমর্পণ করেছে, সরকারের পক্ষ থেকে তা ঘোষণার প্রস্তুতি চলছে। অরিন্দম টেলিভিশনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় লাইভ সম্প্রচার। রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল বলতে শুরু করেন, ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মাওবাদীর বাংলা, ঝাড়খন্ড, ওড়িশার অন্যতম নেতা, রাজ্য মিলিটারি কমিশনের সদস্য সিংরাই মান্ডি ওরফে জয়ন্ত রাজ্য পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করেছে...।’ রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল বলতে থাকেন, আস্তে আস্তে ক্যামেরা তাঁর মুখ থেকে সরে ফ্রেমটাকে বড় করে নেয়। অরিন্দম দেখে, মাওবাদী কমান্ডোদের জংলা পোশাক, কালো টুপি পরা এক যুবক কাঁধে এক সেল্ফ লোডেড রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই যুবকই সিংরাই মান্ডি ওরফে জয়ন্ত ওরফে ফড়িং! হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে অরিন্দম। কানে আসতে থাকে রাজ্য পুলিশের ডিজির কথা, ‘তিন রাজ্য মিলে খুন, নাশকতা সহ অন্তত ৫০ টি মামলা রয়েছে সিংরাইয়ের নামে। তাকে গ্রেফতারের জন্য বাংলা এবং ঝাড়খন্ড সরকার মিলিয়ে ৪০ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এই রাজনীতির ভুল বুঝতে পেরেছে সে। তাই সে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে এসেছে...।’ ডিজি’র কথা আবছা হয়ে আসে, অরিন্দমের কানে ধাক্কা মারে দুটো শব্দ, সমাজের মূলস্রোত। রাষ্ট্র যে সমাজ দেখতে চায়, যেমন সমাজ দেখাতে চায়, সেটাই আসলে সমাজের মূলস্রোত! অরিন্দম তাকিয়ে থাকে এত বছর এই মূলস্রোতের বাইরে থাকা কাঁধে রাইফেল, কালো টুপি, জংলা পোশাক পরা যুবকের দিকে। টেলিভিশন সেটের সামনে দাঁড়িয়ে তার মাথায় সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো পরপর ভেসে ওঠে সাদা-কালো দৃশ্যগুলো, ন’দশ বছরের একটা ছেলে সাইকেলে বিশ-তিরিশটা হাঁড়ি, কলসি বেঁধে মা’কে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলেছে আদিবাসী পাড়ায় বিক্রি করবে বলে, ছেলেটার চোখের সামনে মাটিতে মিশে যাচ্ছে তাদের কাঁচা বাড়ি, থানায় বীভৎস অত্যাচারের পর ছেলেটা খাবার হাতে তুলতে পারে না, থালায় মাথা নামিয়ে মুখ দিয়ে তুলে নেয় রুটি, ছেলেটার মা দীর্ঘ দিন যক্ষ্মা রোগে ভুগে মাঝরাতে হাসপাতাল যাওয়ার পথে সাইকেল থেকে পড়ে মারা যায়! অরিন্দম দেখতে থাকে, সেই ছেলেটা এখন যুবক, চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে ক্যামেরার সামনে, ঘরছাড়ার আঠেরো বছর বাদে সে ফিরছে সমাজের মূলস্রোতে! অরিন্দম আরও মন দিয়ে তাকায় টেলিভিশন সেটের দিকে, বোঝার চেষ্টা করে সমাজের মূলস্রোতে ফেরার আনন্দ কি দেখা যাচ্ছে এই যুবকের চোখে-মুখে?
     
    এই ঘটনার পর কেটে যাবে আরও প্রায় চার বছর। অবশেষে একদিন অরিন্দম জোগাড় করে ফেলবে সিংরাই মান্ডির ফোন নম্বর। সেটা ২০২২ সালের এপ্রিল মাস। অরন্দিম ফোন করবে সিংরাইকে। নিজের পরিচয় দেবে, বলবে সে দেখা করতে চায় তার সঙ্গে। কেন তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে একজন অপরিচিত ব্যক্তি, বুঝতে পারবে না সিংরাই। প্রথমে রাজি হবে না সে। এরপর তাদের মধ্যে ফোনে কথা হবে কয়েকবার। শেষ পর্যন্ত সিংরাই রাজি হবে অরিন্দমের সঙ্গে দেখা করতে। ২০২২, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে একদিন দুপুর সাড়ে বারোটায় সায়েন্স সিটির সামনে তাদের দেখা হওয়ার সময় নির্দিষ্ট হবে। সময়ের কিছুটা আগেই অরিন্দম পৌঁছে যাবে সায়েন্স সিটির সামনে। এই প্রচণ্ড গরমেও সায়েন্স সিটির সামনে কিছু মানুষের জটলা। মেইন গেটের সামনে পান, সিগারেট, সরবত, চায়ের দোকান থেকে খানিকটা এগিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে অরিন্দম। মাথার ওপরে কড়া রোদ, সাড়ে বারোটা বেজে যাবে, ঘড়ির কাঁটা এগোবে একটার দিকে, বারবার ঘড়ি দেখবে অরিন্দম। তাকিয়ে থাকবে আন্ডার পাস, সামনের চওড়া রাস্তার দিকে। এক সময় অরিন্দমের মনে হবে যার জন্য অপেক্ষা করছে, সে হয়তো তাকে দেখছে কিছুক্ষণ ধরে। হয়তো বুঝে নিতে চাইছে, এই লোকটা একা এসেছে তো? অরিন্দম যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া প্রতিটা লোকের দিকে তাকিয়ে খুঁজবে সিংরাই মান্ডিকে, বুঝতেও পারবে না কখন সে সায়েন্স সিটির ভেতর থেকে বেরিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে!

    শেষ 

                
     

     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৫ মার্চ ২০২৪ | ৩৫৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Tarun Das | ১৫ মার্চ ২০২৪ ১৭:৩৬529398
  • খুব সুন্দর । অসাধারণ । খুবই রোমাঞ্চকর
     
  • Eman Bhasha | ১৫ মার্চ ২০২৪ ২০:২২529405
  • ভালো লেখা
  • manimoy sengupta | ১৭ মার্চ ২০২৪ ২২:৩১529520
  • যা, শেষ?!  আরে, এখানেই থামিয়ে দিলে কি করে হবে? বাকিটা লিখবেন কবে?  
    প্রতিটি পর্ব গোগ্রাসে পড়েছি। 
  • Prolay Adhikary | ০২ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:৩৬530152
  • এই লেখাটি কি বই আকারে প্রকাশ পেয়েছে ? সত্যিই লেখাটি পড়ে সমৃদ্ধ হলাম ।
  • dd | 49.207.193.68 | ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ২১:১১530225
  • বিতনু বাবুকে, বলতে পারেন আমার "fan mail"।

    আপনার উপন্যাসে আপনি দেখছেন এক কিশোর মাওবাদীর চোখ দিয়ে আর কিষেনজীকে নিয়ে লেখাটা একজন দুঁদে পুলিশ অফিসারের চোখ দিয়ে। কোনো খানেই আপনি খামোখা জ্ঞান দেন নি বা কোনো একটা স্ট্যান্স নেন নি। সম্পুর্ণ নিরপেক্ষ ভাবে দেখা। দুটো লেখাই। খুব কঠিন কাজ।

    আর ডিটেইলসের কথা আর কী বলবো। একবারে ইতিহাস, ভুগোল, সমাজ ... সবই গুলে খেয়েছেন। এবং লিখেছেন স্বচ্ছন্দ গতিতে।

    বহুদিন পরে ,এই পত্রিকার আঙিনায় একটা লেখা পড়ে এরকম মুগ্ধ হলাম। আরো লিখবেন , আশা করছি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন