এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • শিকাগোয় শিহরণ

    Nabhajit লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ০৭ নভেম্বর ২০২৩ | ৫৪৭ বার পঠিত | রেটিং ৪ (২ জন)
  • প্রথমেই বলি, এই লেখাটা বেশ কিছুদিন আগে ফেসবুকের একটা গ্রুপে লিখেছিলাম কিন্তু তেমন কোনো পাঠক পাই নি। এখানে আবার দিচ্ছি যদি আপনাদের ভালো লাগে জানাবেন। গল্পটা বড় তাই দু তিন ধাপে পড়তে হবে।

    এক

    কৃষ্ণেন্দু ওরফে ক্রিস বুঝতে পারে নি এতো বড় ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে। ওর চোখের সামনে দুজন লোক ওর বন্ধু আইভরিকে গুলি করলো। আইভরি লুটিয়ে পড়েছে রাস্তায়। ক্রিস গাড়ি থেকে নামে নি, আইভরি নামতে মানা করেছিল। ক্রিস গাড়ি পার্ক করেছিল একটা গলির মুখে যেখানে আরো অনেক গাড়ি পার্ক করা আছে| গাড়ি অন্ধকার করে ভেতরে বসে ছিল ক্রিস। আইভরি বলে গেছিলো ও ফোন করবে। আইভরি একটা কাপড়ের ব্যাগ গাড়ির পেছনের সিটে রেখেছিলো। আইভরি ফোন করলে ক্রিস ওই ব্যাগটা নিয়ে এগিয়ে যাবে সামনের একটা গাড়ি সারানোর দোকান আছে সেদিকে।

    এই জায়গাটার নাম শিকাগো হাইটস। শিকাগোর দক্ষিণে কুখ্যাত দুষ্কৃতীদের শহর। এখন সন্ধ্যে সাতটা বাজে কিন্তু বাইরে তাকালে মনে হবে মাঝরাত। কেউ নেই এই রাস্তায়। আসে পাশের বাড়িঘরগুলো জীর্ণ, আলো জ্বলছে, কিন্তু খুব ম্রিয়মাণ। বাড়ি ঘরের সামনে রাস্তায় দাঁড় করানো আছে গাড়ি, সেইখানেই এক জায়গায় গাড়ি পার্ক করে দাঁড়িয়ে আছে ক্রিস, অপেক্ষা করছিলো আইভরির ফোনের। এখন শীতকাল, কাল পর্যন্ত বরফ পড়েছিল, আজ বরফ পড়েনি কিন্তু বাইরে তাপমান প্রায় মাইনাস ১৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। রাস্তায় বরফ নেই কিন্তু রাস্তার দু ধারে বরফ আরকাদার একটা কালো মিশ্রণ জমা আছে। এই রাস্তায় খুব জোরে গাড়ি চালানো যায় না, খুব পেছল। হঠাৎ ক্রিস দেখলো দুজন লোক ওই গাড়ির গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে এসেছে আইভরিকে দেখে, কিছু বলছে কিন্তু ক্রিস শুনতে পায় নি, গাড়ির কাঁচ বন্ধ, আইভরিও কিছু বলতে চাইছে ওইলোক দুটোকে, কোনো বচসা চলছে ওদের মধ্যে। ওই দুজনের একজন আচমকা ওর কোটের পকেট থেকে একটা রিভলভর বের করে আইভরির দিকে তাক করে এগিয়ে আসতে লাগলো। ক্রিস বুঝতে পারছে না কি করা উচিত। বিনা অস্ত্রে ও কিই বা করতে পারে? হঠাৎ গুলি চললো।একটা না, পর পর দুটো। ক্রিস দেখছে আইভরি লুটিয়ে পড়ছে। ক্রিস যেখানে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে ওই গ্যারেজ প্রায় ১০০ গজ দূরে। লোক দুটো এবার এদিক ওদিক দেখছে। কি খুঁজছে কে জানে? হয়তো দেখতে চাইছে কেউ ওদের গুলি চালাতে দেখলো কি না। লোক দুটোর মুখ দেখতে পাইনি ক্রিস কিন্তু দুজনের মধ্যে একজন একটা জুতো পড়েছে যার গায়ে ফ্লুওরোসান্ট কোনো পট্টি লাগানো আছে যা এই আধোঅন্ধকারে জ্বলছে।

    কিছুক্ষন পর ওরা দুজন মিলে আইভরিকে উঠিয়ে ওদের গ্যারাজের পাশে রাখা ময়লার ব্যাগ যেখানে জমা আছে, সেখানে ফেলে নিজেদের গ্যারাজে ঢুকে গেলো। ক্রিসের হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। চোখ সামনের গ্যারাজের দিকে। দু মিনিট পর ওই দুজন গ্যারাজের শাটার বন্ধ করতে শুরু করলো। ওরা দুজন ভেতর থেকে শাটার বন্ধ করছিলো। এই সুযোগ। ক্রিস হালকা হাতে গাড়ি স্টার্ট করলো। ক্রিসের গাড়িটা খুব ভালো SUV। তেমন কোনো আওয়াজ হয় না। গাড়ির হেডলাইট না জ্বালিয়ে খুব আসতে আসতে গলির মুখ পর্যন্ত গেলো, তারপর বড় রাস্তায় এসে হেডলাইট জ্বালিয়ে দে দৌড়। ক্রিস সব রাস্তা চেনে এদিকের। বিশপ ফোর্ড ৩৯৪ ধরে ও এগিয়ে চলতে থাকলো উত্তরে আই৯৪ এর দিকে, সেই রাস্তা ওকে নিয়ে যাবে শিকাগো ডাউনটাউন। প্রতি মুহূর্তে ও রিয়ার ভিউ আয়নায় দেখছে কেউ পিছু নিয়েছে কি না। ভয়ে ওর ঘাম ঝরতে শুরু করেছে। আইভরির জন্য খুব খারাপ লাগছে। ও কি কিছু করতে পারতো? আইভরি কে বাঁচাতে পারতো ? না বোধহয়। তাহলে ওকেও প্রাণ দিতে হতো অকারণে।

    কিছুদূর গাড়ি চালিয়ে এক জায়গায় গাড়ি পার্ক করলো ক্রিস। পুলিশকে রিপোর্ট করা দরকার কিন্তু ও নিজের নাম দিতে চায় না এই মুহূর্তে। নিজের ফোনে নেট চালিয়ে দেখলো যে ইলিনয় স্টেটে নাম না দিয়েও ক্রাইম রিপোর্ট করা যায়। এটা ইউনিভার্সিটি পাড়া তাই দুএকটা পাবলিক টেলিফোন বুথ আছে। ও নম্বর মেলালো ৯১১। ও প্রথমেই বললো যে ও নিজের নাম এই মুহূর্তে দিতে চায় না, কিন্তু ও এক খুনের প্রত্যক্ষদর্শী। ক্রিস বললো যে ও শিকাগো হাইটস গেছিলো নিজের প্রয়োজনে, একবারও বলে নি যে আইভরি ওর সাথে ছিল। যে দুজন গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে আইভরিকে খুন করেছে, তাদের মুখ আর মাথা ঢাকা ছিল কারণ এই ঠান্ডায় লোকজন মাথা আর মুখ ঢেকেই রাখে সেজন্য ক্রিস ওদের বিবরণদিতে পারবে না কিন্তু যে গ্যারেজ থেকে ওই লোক দুটো বেরিয়েছিল আর যেখানে ডেডবডি ফেলে দেওয়া হয়েছে তার বর্ণনা দিয়ে ফোন ছেড়ে দিলো।

    এতদিন শুধু শুনে এসেছে শিকাগোর আন্ডারওয়ার্ল্ডের গল্প। শিকাগো শহরের উত্তর আর পশ্চিম খুব সম্ভ্রান্ত কিন্তু দক্ষিণ দিকটা ভয়ঙ্কর। প্রেসিডেন্ট ওবামার বাড়ি ছিল শিকাগোর দক্ষিণে হাইড পার্কে, সেজন্য উনি চেষ্টা করছিলেন দক্ষিণে কিছু উন্নতি করার। অনেক নতুন নতুন শহরতলি বানিয়েছেন, সেগুলো যথেষ্ট ভালো যেমন অর্ল্যান্ড পার্ক, টিনলী পার্ক। কিছু পুরোনো জায়গা আছে যেগুলো এখনো আগের মতো দুর্গম, যেমন শিকাগো হাইটস, কেলুমেট পার্ক, ব্লু আইল্যান্ড। এই সব জায়গাগুলো মূলত কালো আফ্রিকান মার্কিন আর ল্যাটিনোদের বসতি।

    ক্রিস এসেছিলো শিকাগো হাইটস আইভোরির সাথে। আইভরি ক্রিসের নতুন বন্ধু। বন্ধুকে সাহায্য করবে বলে ক্রিস এসেছিলো। আইভরির ইতিহাস খুব ভালো নয়। একসময় ও ভাড়ার সৈনিকদের ট্রেইনার ছিল। আইভরি নামকরা ব্যায়ামবীর ছিল এই শিকাগো শহরের। পরে একটাট্রেনিং ক্যাম্প চালাতো। স্বভাবতই ওর ছাত্ররা ছিল বেশির ভাগ কালো মার্কিন। এরা যোগ দিতো ভাড়াটে সৈন্য বাহিনীতে। এই কাজ করতে করতে আইভরি জড়িয়ে পরে এক ড্রাগ চক্রে। এখানে বলে রাখা ভালো যে মার্কিন ভাড়াটে সৈন্যবাহিনীর অনেক লোকজন যুদ্ধের নৃশংসতা বরদাস্ত করতে পারে না, তাই ড্রাগের নেশায় জড়িয়ে পরে। আইভরির ছাত্রদের কেউ কেউ সেই নেশার শিকার হয়েছিল। তখন আইভরি না চাইতেও কোনো ভাবে সেই চক্রে জড়িয়ে পরে। এই চক্রের কাছে মাথা নত করেছে প্রশাসনও। অনেক টাকার লেনদেন। অনেক তাবড় তাবড় রাজনৈতিক নেতা, পুলিশের বড়কর্তা, অনেক আইনজীবী এই সমান্তরাল অর্থ ব্যবস্থার শিকার।

    দুই

    হঠাৎ একটা প্রমোশন তার সাথে নতুন দেশে পোস্টিং। তিন বছরের প্রজেক্ট। ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকা। কম বয়েস বলেই এই অফারটা নিয়েনিলো কৃষ্ণেন্দু ওরফে ক্রিস। প্রায় ১৪ বছর ইংল্যান্ডে চাকরি করার পর শিকাগো, খুব খারাপ লাগবে না। জীবনে কিছু ভেঞ্চার আর এডভেঞ্চার না থাকলে ক্রিসের মনে হয় জীবনটা চিনি ছাড়া চা। ক্রিস প্রায় ছয় ফুটের মতো লম্বা, মাথায় কোঁকড়া চুল গায়ের রং, সুকুমার রায়ের গঙ্গারামের মতো, বেজায় কালো, কিন্তু ওর মধ্যে একটা আকর্ষণ ক্ষমতা আছে। ওর কথায়, ওর চোখে আর ওর চেহারায়। বলিষ্ঠ চেহারা, আর পাঁচটা বাঙালির মতো নয়। দু বছর হয়ে গেলো ক্রিস শিকাগোয় কাজ করছে, আর কয়েকটা মাস তারপর ও ফিরে যাবে ইংল্যান্ডে |

    চাকরির জায়গাটা দক্ষিণ শিকাগোর অন্যতম কুখ্যাত শহরতলি 'ব্লু আইল্যান্ড '। এখানে দিনে দুপুরে গুলিগোলা চলে, লাশ পরে, পুলিশেরগাড়ি ঘোরাঘুরি করে কিন্তু কোনো কুল কিনারা করতে পারে না। এখানে যে ধরণের লোকজন থাকে তাদের সাথে থাকা একটু মুশকিল তাই ক্রিসবাড়ি নিয়েছে শিকাগো ডাউন টাউনে। গাড়ি কিনেছে একটা বড় SUV, অনেক দিনের শখ ছিল ক্রিসের। ইংল্যান্ডে পেট্রোলের দাম এতো বেশি যে বড় গাড়ি চালাতে অনেক খরচ হয়। আমেরিকা সেই তুলনায় সস্তার দেশ। সকালে অফিসে ঢুকে যায়, সারাদিন ব্যাস্ত থাকে আর দিনের শেষে ডাউন টাউন ফিরে যায়। ক্রিস একা থাকে তাই জমজমাট জায়গা হয়তো ওর জন্য কিছুটা ভালো। মিশিগান লেকের ধারে একটা পার্ক আছে, মিলেনিয়াম পার্ক, সেখানে মাঝে মাঝেই কিছু না কিছু হতেই থাকে, কখনো গানের উৎসব, সারা পৃথিবীর গায়করা এসে ভিড় করে। সন্ধ্যেবেলা নিজের ২১৫ ওয়াসিংটন স্ট্রিটের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে একটু হেঁটেই মিলিনিয়াম পার্কে গিয়ে বসে, একটা বিয়ার খায়, গান শোনে, তারপর ফ্ল্যাটে এসে ডিনার করে ঘুম। সকাল সকাল ঘুম ভাঙলে এই ফ্ল্যাটেই একটা সুইমিং পুল আছে, ১৪ তলার ছাদে, সেখানে গিয়ে একটু সাঁতার কাটে, গ্রীষ্ম কালে সেটা সম্ভব, কিন্তু শীতের দিনে বাইরে তাপমান থাকে -১৫ -২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। ক্রিসের ফ্ল্যাটটা ৩৭ তলায়। বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে উইলিস টাওয়ার দেখা যায়, প্রায় ১০০ তলা বাড়ি। ক্রিস একা আছে প্রায় ১০ বছর। বিয়েটা টেঁকে নি বেশিদিন। একা থাকাটা একটা অভ্যাসের মতো, কিছুদিন একা থাকলে আর কারো সাথে মানিয়ে নেওয়া খুব কঠিন হয়ে পরে। বাড়ির লোকজন ভাবে, আহা বেচারা একা একা আছে! কিন্তু ক্রিস ভালোই আছে।

    কোনোদিন রাত বারোটায় হঠাৎ মনে হলো মেহেদী ভাই এর দোকানে অনেক দিন যায় নি। মেহেদী ভাই একটা দেশি রেস্টুরেন্ট চালায় নর্থ হলস্টেড স্ট্রিটে, সারা রাত খোলা থাকে। ট্যাক্সি ড্রাইভারদের রেস্টুরেন্ট। অনেক দেশি ট্যাক্সি ড্রাইভার জড়ো হয় সেখানে, ক্রিস গিয়ে ওদের সাথে গল্প জুড়ে দেয়। ক্রিস অকারণে নিজের পরিচয় দেয় না। তাই সকলের সাথে অনায়াসে মিশে যেতে পারে। মেহেদী ভাই এর একটা আইটেম আছে, নাম ফ্রন্টিয়ার চিকেন। ক্রিস খেয়ে বলে
    - মেহেদী ভাই, লাহোর ইয়াদ আ গয়া।
    মেহেদী ভাই জানে যে ক্রিস ইন্ডিয়ান। একদিন হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করেছিল
    - লাহোর গয়ে কভি ?
    কোনোদিন মেহেদী ভাইয়ের রেস্তোরাঁয় খেয়ে ফেরার পথে একটা নিম্নমানের নাইটক্লাবে ঢুকে যায়। এখানে বেশির ভাগ লোক কালো মার্কিন। এদের কাছেও ক্রিস একজন বন্ধু বা 'ব্রো'।

    ক্রিস এর অনেক এরকম আড্ডার জায়গা আছে। কোনো আড্ডায় ও অন্য আড্ডার গল্প করে না। যেমন একটা ক্লাব আছে শিকাগো তে নাম BIC - বেঙ্গলিস ইন শিকাগো। এরা মাঝে মাঝে বাঙালি আড্ডা জমায় কিন্তু বেশির ভাগ আড্ডার বিষয় বস্তু হলো পরের বছরের পুজো। কে সেক্রেটারি হবে, কে হবে ক্যাশিয়ার আর কালচারাল অনুষ্ঠানে কার বাচ্ছা গাইবে, কবিতা বলবে ইত্যাদি। ক্রিস অনেক দিন হলো কলকাতা ছেড়েছে, ভারত ছাড়ার আগে প্রায় নয় বছর ও দিল্লিতে ছিল। সেই কারণে কলকাতা নিয়ে ও খুব বেশি গদগদ নয়। শিকাগো এসে একদিন মিলেনিয়াম পার্কে এক বাঙ্গালীর গ্রুপের সাথে দেখা হয়, তাদের অনুরোধেই এই ক্লাবে আসা, কিন্তু এই একদল বাঙালি নিয়েই ক্রিসের সব চেয়েবেশি বিড়ম্বনা।

    কখনো কখনো ক্রিস মিশিগান এভিনিউ এর ওপর শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউটের বাঁধানো সিঁড়ির ওপর গিয়ে অকারণে বসে থাকে। এখানেই স্বামী বিবেকানন্দ সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। রাস্তার এই অংশটাকে এখন 'স্বামী বিবেকানন্দ ওয়ে' নাম দিয়েছে মার্কিন সরকার। এখানে রাস্তার ওপর কিছু আফ্রিকান মার্কিন ছেলে টেবিল পেতে দাবার বোর্ড লাগিয়ে খেলে। একদিন ক্রিস দেখছিলো দাঁড়িয়ে। একজন ওকে জিজ্ঞাসা করে
    - তুমি খেলতে জানো ?
    - হাঁ, তোমাদের খেলা দেখছি।
    - এসো, এক হাত খেলো। প্রতি গেমে তুমি দেবে দু ডলার। জিতলে পাবে চার ডলার, হারলে কিছু পাবে না।
    - না আমি পয়সা দিয়ে খেলতে চাই না।
    - প্লিজ, আমাদের ভুল বুঝো না। আমরা একটু মজা করি কিছু পয়সা জিতলে।
    - ঠিক আছে, চলো এক হাত খেলছি, রাজি হয়ে ক্রিস দু ডলার দেয়। সেই গেমে ক্রিস যেতে। ওরা চার ডলার দেয় ক্রিসকে। পর পর চারটে হাত জিতে যায় ক্রিস। একজন জিজ্ঞাসা করে তুমি কি বিশ্বনাথ আনন্দ। ক্রিসের খুব ভালো লাগে শুনে যে এরা বিশ্বনাথ আনন্দের নাম জানে। খুশি হয়ে সব জেতা টাকা ফিরিয়ে দেয় ক্রিস। সেদিন থেকে ক্রিস এদের কাছেও 'ব্রো'।

    তিন

    কিছুদিন ধরে খাওয়ার খুব অনিয়ম হচ্ছিলো, তার ওপর মার্কিন খাবারের প্লেটের সাইজও অনেক বড়। অকারণে বেশি খাওয়ার জন্য বেশ মোটা হয়ে গেছে ক্রিস। কিছু একটা করা দরকার। অফিসে ক্রিসের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট একদিন ওকে বলে যে শিকাগোর দক্ষিণে একটা ছোট শহর আছেনাম হোমউড, সেখানে ওর চেনা একজন ট্রেইনার আছে তার কাছে গেলে খুব তাড়াতাড়ি ওজন কমতে পারে। একদিন বিকেলে অফিসের পর গিয়ে হাজির হলো ক্রিস। জিম এর ট্রেইনার নাম আইভরি। অবশ্যই আইভরি একজন আফ্রিকান মার্কিন। জিমে আর যারা ছিল সকলেই আফ্রিকান মার্কিন। কি বিশাল চেহারা এক একজনের ! ক্রিস ওর এসিস্টেন্টের নাম বলতেই চিনতে পারলো আইভরি। রাজি হয়ে গেলো ক্রিসকে ট্রেনিংদেওয়ার জন্য। সপ্তাহে তিন দিন আসতে হবে আর একটা খাওয়া দেওয়ার চার্ট নিয়ম মেনে ফলো করতে হবে। ক্রিস রাজি হয়ে গেলো। ভাবলোএবার খুব সহজেই ভুঁড়ি কিছুটা কমবে। পর দিন ক্রিস অফিসের পর হাজির আইভরির ক্লাবে। আইভরি প্রথমে ওকে ৩০ মিনিট একটা এলিপ্টিকাল মেশিনে চলতে বলে। মাঝে মাঝে এসে আইভরি রেসিস্টেন্স লেভেল বাড়িয়ে যাচ্ছিলো। এই তিরিশ মিনিট বেশ কষ্ট করেই পার করলো ক্রিস। ভাবলো আজকের মতো বোধহয় এটুকু। আইভরি এর পর ক্রিসকে নিয়ে একটার পর একটা মেশিনে বিভিন্ন ওজন তোলার কসরত করতে লাগলো। ক্রিস আর পারছিলো না। ওর বমি হয়ে গেলো। এই অবস্থায় ক্রিস মাটিতে শুয়ে আছে, একটু লজ্জাও করছে। চোখে অন্ধকার দেখছে। মিনিট তিনেক পর উঠে বসলো ক্রিস। ভাবছিলো কি করে বাড়ি ফিরবে। ঠিক সেই সময় আইভরি এসে বললো
    - যাও চোখে মুখে জল দিয়ে এসো, আরো দুটো মেশিন বাকি আছে।
    একেই বলে ট্রেনিং। সেদিন যখন বাড়ি ফিরলো ক্রিস গাড়ি চালাতেও কষ্ট হচ্ছিলো। কোনো রকমে কিছু খেয়ে ঘুম, এতো ঘুম অনেকদিন হয় নি ক্রিসের। পরের দিন ঝড়ঝরে শরীর। এরপর সপ্তাহে তিন দিন চলতে থাকলো ক্রিসের ট্রেনিং। ইতিমধ্যে ক্লাবের অন্য ছেলেদের সাথেও ভাব হয়েছে। ট্রেনিংয়ের শেষে আড্ডা জমে ওঠে। টনি, ডিজেল, আইভরি আর আলেক্স এরা বুঝতে শুরু করেছে যে ক্রিসের ওপর ভরসা করা যায়। এরা সকলেই প্রাক্তন সৈনিক। অনেক আলোচনা চলতো এদের সাথে। ক্রিস প্রথম জানতে পারে কালো মার্কিন দের মনের কথা, তাদের সমাজের কথা। একবার ক্রিসকে বলেছিলো,
    - তোমরা ব্রিটিশদের অধীনে ছিলে, পরে স্বাধীনতা পেয়েছো, কিন্তু তোমাদের একটা ইতিহাস আছে, যা তোমরা জানো। আমাদের কথা ভেবে দেখেছো ? আমাদের কোনো ইতিহাস নেই এই আমেরিকায়, আমাদের পূর্বপুরুষ দাস হয়ে এই দেশে এসেছিলো, কোথা থেকে এসেছিলো আমরা জানি না, আমাদের কেউ এসেছে নাইজেরিয়া থেকে, কেউ বা কেনিয়া, কেউ ইথিওপিয়া, কিন্তু আমাদের কারোর কোনো ইতিহাস জানা নেই, নেই কোনো বংশলতিকা। হয়তো সেজন্য আমেরিকার সব কালো লোকের এক শ্রেণী। আমরা কালো। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখনো ভালো চাকরি পায় না। ভালো কলেজে যেতে পারে না। আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা আমাদের আন্ডারওয়ার্ল্ড। আমাদের মধ্যে যারা ভালো রোজগার করে তারা তাদের ছেলে মেয়েদের আর্মড বডিগার্ড দিয়ে স্কুলে পাঠায়, তুমি জানো? সাধারণ লোকজনের ছেলেরা আন্ডারওয়ার্ল্ড এর খপ্পরে পরে জীবন নষ্ট করে। ছোটবেলায় তাদের দিয়ে স্কুলে ড্রাগ বিক্রি করানো হয়। আরো অনেক অসামাজিক কাজ এই সব ছোট ছেলেমেয়েদের দিয়ে এরা করায়।
    ক্রিসের এক নতুন জ্ঞান হয়েছিল আইভরির কথা শুনে। সাধারণ লোকজন এসবের কিছুই জানতে পারেনা। একদিন আইভরি বলেছিলো এক নতুন ড্রাগ, 'মেথ ক্রিস্টাল', কি ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে মার্কিন দুনিয়ায়
    - মেথ ক্রিস্টাল কি ?
    - হিরোইন বা কোকেন বা মারিয়ুয়ানা এই সব নেশার জিনিস তৈরী হয় কোনো না কোনো গাছ থেকে, কিন্তু মেথ বা মেথামফেটামাইন প্রথম ড্রাগ যা ল্যাবরেটরিতে তৈরী করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিকদের ঘুম ভাগানোর ওষুধ। খুব উত্তেজক ড্রাগ। এখন এই ড্রাগ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
    ক্রিস অবাক হয়ে শুনছিলো এই ড্রাগের ইতিহাস।
    আইভরি আরো বলেছিলো
    - হিরোইন বা কোকেন খুব দামি, সেই তুলনায় এই ড্রাগ সস্তা। নীল বা সাদা ক্রিস্টাল পাওয়া যায়, বাজারে এই ড্রাগ কে গ্লাস বলেও বিক্রি করা হয়। বিদেশ থেকে চোরাপথে আনার দরকার হয় না, গোপন ল্যাবরেটরিতে তৈরী করা যায় এই ড্রাগ, যে কোনো দেশে। এই ড্রাগ সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ।

    (ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ০৭ নভেম্বর ২০২৩ | ৫৪৭ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ভূতনাথ - Nabhajit
    আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • গুরুর রোবট ১৭ | 165.1.172.197 | ০৭ নভেম্বর ২০২৩ ২০:৪২525693
  • পর্ব/ এপিসোডের ব্যাপারটায় একটু গোলমাল হয়েছিল, তাই অন্য লেখার সঙ্গে জুড়ে গেছিল। এই লেখার সঙ্গে অন্য পর্ব যোগ করলে সব পর্বের মাস্টার টপিক নং হবে 28602। এপিসোডের বিবরন আপনার পছন্দ মত, ১, ২,৩ ও হতে পারে, বা পর্বের নাম।
    এটা ঠিক করে দিলাম, পর্বের নাম আপনি সম্পাদনা করে বদলে দিতে পারেন।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন