![]() বইমেলা হোক বা নাহোক চটপট নামিয়ে নিন রঙচঙে হাতে গরম গুরুর গাইড । |
বাংলাদেশের সক্রেটিস - অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক
Muhammad Sadequzzaman Sharif

https://i.postimg.cc/zfkPk8cS/razzak-5.jpg
আজকে ২৮ নভেম্বর। ১৯৯৯ সালের আজকের দিনে আনুমানিক ৮৫ বছর বয়সে মারা বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। যাকে বলা হয় গুরুদের গুরু, শিক্ষকদের শিক্ষক। বয়স আনুমানিক বললাম কারন নথিপত্র অনুযায়ী উনার জন্ম ১৯১৪ সালে তবে তিনি নিজেই বলেছেন যে ১৪ না তার আরও দুই এক বছর আগে জন্ম উনার। ঢাকার নবাবগঞ্জে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। ঢাকা থেকেই পড়াশুনা শেষ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর পাস করেন রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগ থেকে। এই সব জানা কথাই আসলে। এই একটা লোককে ঘিরে কত যে রহস্য কত যে মিথ চালু আছে তার কোন ইয়ত্তা নেই।
উনার সংশ্রবে এসেছেন আর মুগ্ধ হন নাই এমন নজির মেলা ভার। আজকে মাথার ওপরে যাদের দেখি, যারা কিছুদিন আগেও আমাদের জাতীয় জীবনের সকল আশা আকাঙ্ক্ষার শেষ আশ্রয় ছিল তারা প্রত্যেকে আব্দুর রাজ্জাক নামক পরশ পাথরের স্পর্শ পেয়েছেন।তিনি সারা জীবন বিয়ে না করে বই মহাসমুদ্রে বাস করেছেন। এক সাথে তিনটা চারটা বই পড়তেন। বিছানার ওপরে, মাথার কাছে, টেবিলে, আলমারিতে মানে যেখানে যেখানে সম্ভব সব জায়গায় বই নিয়ে উনি থাকতেন। এত এত পড়তেন কিন্তু উনার নামের সাথে যে রহস্যময় শব্দটা হুমায়ুন আহমেদ লাগিয়েছিলেন তার সার্থকতার জন্যই হয়ত তিনি জীবনে খুব বেশি কিছু লিখেনই। বেশি কিছু বলতে আসলে উনি কিছুই লিখে জান নি। দুই একটা প্রবন্ধ পাওয়া যায় আর বাকি কিসছু নাই। অগাধ জ্ঞান নিয়ে তিনি চলে গেছেন, অন্যদের জন্য কিছুই লিখে যাননি। এই সম্পর্কেই উনার ঐতিহাসিক দাম্ভিক পূর্ণ উক্তি, আমি যে লিখব, কার জন্য লিখব? বুঝার মত কেউ আছে?!! এই উক্তি উনি করেছেন কিনা না এটা পুরোটাই মিথ তা জানা যায় না। তবে তিনি লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কির অধীনে পিএইচডি করার জন্যে যান এবং উনার থিসিস পেপার জমা দেওয়ার আগ মুহূর্তে হ্যারল্ড লাস্কি মারা যাওয়ায় তিনি থিসিস জমা নিয়া দিয়ে দেশে চলে আসেন কারন তার কাছে মনে হয়েছে থিসিসের মূল্য লাস্কি ছাড়া কেউ বুঝবে না, তাই তিনি কোন ডিগ্রি না নিয়ে চলে আসেন দেশে এ কথা সত্যি।
উনাকে অনেকেই বাঁকা চোখে দেখে উনার পাকিস্তান প্রেমের জন্য। কিন্তু সত্য হচ্ছে উনি যখন পাকিস্তান চেয়েছেন তখন সেই সময় অনুযায়ী তা যেমন উনার কাছে সঠিক মনে হয়েছে বলে চেয়েছেন তেমনই পাকিস্তান হওয়ার পর উনি বাংলাদেশ চেয়েছেন এটাও সত্য। উনি পাকিস্তানিদের মানসিকতা পরিষ্কার বুঝতে পারতেন। পাকিস্তান সংবিধান রচনার সময় উনার কাছে একজন এসেছিল পরামর্শ চাওয়ার জন্য। তিনি আজীবন যে খাস ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতেন সেই ভাষায় বললেন - “দেখুন কনসটিটিউশন ইত্যাদি নিয়ে কথা টথা কইবার দরকার নাই। যাইয়া এদের শুধু একটা কথা কন: Capital of Pakistan would be transferred to Chittagong, আই থিংক, এ হলেই অল দ্যাট ইউ ওয়ান্ট, ইউ উইল গেট। বর্তমানে যে ব্যবধান, It is because the capital is in Karachi, আর কিছু করবার দরকার হবে না।"
এটা ১৯৫৫ সালের সংবিধান রচনার সময়কার কথা। এরপর ৫৮ সালে মার্শাল ল চলার সময় সরকার বিচারপতি ইব্রাহিম কে নতুন সংবিধানের জন্য কাজ করতে বলেছিল। তারা বিচারপতি ইব্রাহিম কে জানায় তিনি যা দিবেন তাই পাশ করা হবে। সরকারের এহেন আশ্বাসে বিশ্বাস করে তিনি অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের কাছে আসেন। এসে বলেন যে আপনি তো সংবিধান নিয়ে অনেকদিন নড়াচড়া করেছেন, আমাকে একটু সাহায্য করেন। সরকার কি জানিয়েছে তা শোনার পর আব্দুর রাজ্জাক উনাকে বলেছেন, “আপনি বিশ্বাস করেন যে আপনি যা দিবেন তাই আইয়ুব সরকার পাস করাবে? ওরা কোন দিনই তা করবে না, ওরা নিজেরা একটা সংবিধান বানাবে আপনাকে ডাকা হবে সাক্ষর করার জন্য!” এর পরে বিচারপতি ইব্রাহিম উনাকে জানিয়েছিল যে আসলেই আইয়ুব খান তাঁকে খুঁজছে সংবিধানে সাক্ষর করার জন্য, উনি করাচী থেকে ঢাকা এসে বসে ছিলেন সাক্ষর না দেওয়ার জন্য। পাকিস্তানের মনোভাব তার মত কম লোকেই বুঝেছিল সে সময়।
জাতীয় অধ্যাপক হয়েছিলেন ১৯৭৫ সালে। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেন। কিন্তু যতদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন ততদিন ছিলেন বটবৃক্ষের মত। চেনা অচেনা নানা মানুষের সাহায্য করে গেছেন। শিক্ষকদের দাবি দাওয়া থেকে শুরু করে সকলের দাবি দাওয়ার জন্য কথা বলে গেছেন। ১৯৫২ দালে ২১ ফেব্রুয়ারি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। গুলি হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন ছাত্রদের কাছাকাছি। এরপর যখন ২৭-২৮ তারিখের দিকে অনেক শিক্ষকদের ধরে নিয়ে যায় পুলিশ তখন তিনি তৎকালীন ভিসি কে বলেছিলেন, সরকার যেহেতু শিক্ষকদের আটকের ব্যাপারে ভিসিকে কিছু জানায় নাই তাই তিনি যেন আটক শিক্ষকদের বেতন বন্ধ না করেন। তৎকালীন ভিসির অত সাহস ছিল না যে সরকারের বিপক্ষে যায় এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু ওই ক্রান্তিকালীন সময়েও অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বাস্তব সমস্যাটা ভুলেননি।
তাঁর বুদ্ধিজীবী সত্তা, শিক্ষকতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, পরোপকারী এই সব কিছুর বাহিরে অন্য এক আব্দুর রাজ্জাকের খোঁজ পাওয়া যায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের স্ত্রী সিদ্দিকা জামানের লেখায়। তা হচ্ছে উনার রান্নার নেশা। অন্য অনেকের লেখায়ই পাওয়া গেছে এই পরিচয় তবে সিদ্দিকা জামানের মত সরাসরি অভিজ্ঞতা খুব কম মানুষের বেলায় হয়েছে সম্ভবত। রান্না করতে খুব ভালবাসতেন, খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন তিনি। সিদ্দিকা জামান কে হাতে ধরে রান্না শিখিয়েছেন তিনি। রান্নার সাথে বাজারের একটা বড় ভূমিকা আছে, তিনি বাজার করতেও খুব পছন্দ করতেন। বাজারের উনার পরামর্শ হচ্ছে মাংস আর মাছের দোকানদারের সাথে সব সময় ভাল সম্পর্ক রাখতে হয়, তাহলে কোনদিন ঠকতে হয় না। সিদ্দিকা জামান রাজ্জাক সাহেবের রান্নার ব্যাপারে আগ্রহ নিয়ে একটা দারুণ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। রোস্ট করার জন্য মাংস এনে সিদ্দিকা জামানের হাতে দিয়ে উনি বলেছিলেন, রেখে দাও, পরে রান্না করবেন। বাসায় মেহমান আসায় তিনি স্যারের আনা মাংসটুকু রান্না করে ফেলেন। পরেরদিন আব্দুর রাজ্জাক হাজির, এসেই মাংস চাইলেন আর যখন শুনলেন তাঁর আনা মাংস রান্না করে খাওয়া শেষ তখন তিনি তাকে বললেন, তুমি এইটা কি করছ, তুমি তো মানুষ খুন করতে পারবা!! আব্দুর রাজ্জাকের রান্নার পরিচয় পাওয়া যায় উনার বাসায় যারাই খাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তাদের কাছে। দেশি বিদেশি নানা ধরনের রান্না করতেন তিনি। কিন্তু যাই করতেন দুই একটা খাস ঢাকাইয়া খাবার সব সময় উনার মেন্যুতে থাকত। উপমহাদেশের রান্না নিয়ে উনি খুব গর্ব করতেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে - “যে জাতি যত সভ্য, তাদের রান্নাও তত বেশি সফিস্টিকেটেড। পশ্চিমেরা তো এই সেদিন সভ্য হইছে, তাই আমাদের রান্নার সাথে তাদের রান্নার কোন তুলনাই হয় না। এই সেদিন পর্যন্ত ওরা কাঁচা মাংস খাইত।”
উনাকে ঘিরে যে রহস্য তার কোন কুল পাওয়া যায় না। তাঁকে সন্দেহ করা হয় মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা তিনি জানতেন। ডালিমের পরিবারের সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল। কেউ কেউ সিআইয়ের চর বলতেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু আসলেই কি ছিল তা জানা মুশকিল। যে অভিযোগ করা হয় তা উনার চরিত্রের সাথে বড্ড বেমানান। কিন্তু অভিযোগের গুরুত্ব খুব একটা অল্প ছিল না, তা বুঝা যায় উনার মৃত্যুর পর একজন আওয়ামীলীগ নেতাও উনার দাফনে অংশ না নেওয়াতে।
তবে আমি আমার বিশ্বাসেই থাকতে চাই। উনি নোংরা খেলা খেলতে চাইলে আরও আগে আরও ভাল ভাবেই খেলতে পারতেন আমার বিশ্বাস। আমি শুধু পরম শ্রদ্ধায় আজকে উনাকে স্মরণ করতে চাই। আমি সেই মানুষটাকে স্মরণ করতে চাই যিনি মনে প্রাণে বাংলাদেশি ছিলেন, যিনি নিজের জ্ঞানের প্রতি এত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে পিএইচডি ডিগ্রি না নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন খালি হাতে। ফেরার টাকা ছিল না, ধার করে জাহাজে করে যিনি দেশে ফিরেছিলেন। আমি মনে প্রাণে স্মরণ করি উনাকে, যিনি কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে মশার কামড় খেতে খেতে মধ্য রাত পর্যন্ত দাবা খেলতেন। আমি এই লোকটাকে আজীবন মনে রাখব যিনি পুরো জীবনে শুধু জ্ঞানের সাধনা কর গেছেন, জ্ঞান সাধনায় কি অনাবিল তৃপ্তি তিনি পেয়েছেন যে উনার আর অন্য কিছুর দরকার পরেনি। এত এত বই পড়েছেন উনি যে এখন আস্ত একটা লাইব্রেরী হয়ে গেছে উনার পড়া বই গুলি দিয়ে। আমার মাধ্যমিক পড়ার বয়সের সময় তিনি মারা গেছেন। খুব আফসোস হয় জীবিত থাকাকালীন উনাকে বোঝার মত জ্ঞান আমার ছিল না।
আজকে উনার প্রয়াণ দিবসে গভীর ভাবে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এই জ্ঞান তাপস কে, বাংলাদেশের সক্রেটিসকে।
।
661
বার পঠিত (সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে)
শেয়ার করুন |

Re: বাংলাদেশের সক্রেটিস - অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক
শিরোনামটি কী কিছুটা বাড়াবাড়ি? আহমদ ছফা বা হালের সলিমুল্লাহ খান বাদ দিয়ে চটুল হুমায়ুন আহমেদের উদ্ধৃতিও বোধকরি তাই।
যদিও অধ্যাপক রাজ্জাক অনেক মনিষী ও গুণিজনের ভাবগুরু। শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের চেতনা বিনির্মানে তিনি নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু একজন পণ্ডিত অধ্যাপকের সৃষ্টিশীল লেখনী থাকবে না, এটি মেনে নেওয়া যায় না। সেদিক থেকে আরেক পণ্ডিত ব্যাক্তির ড. আহমদ শরীফ নমস্য, তার লেখনী ভাণ্ডারও গভীর।
ভাবনাটিকে উস্কে দেওয়ায় ধন্যবাদ।
যদিও অধ্যাপক রাজ্জাক অনেক মনিষী ও গুণিজনের ভাবগুরু। শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের চেতনা বিনির্মানে তিনি নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু একজন পণ্ডিত অধ্যাপকের সৃষ্টিশীল লেখনী থাকবে না, এটি মেনে নেওয়া যায় না। সেদিক থেকে আরেক পণ্ডিত ব্যাক্তির ড. আহমদ শরীফ নমস্য, তার লেখনী ভাণ্ডারও গভীর।
ভাবনাটিকে উস্কে দেওয়ায় ধন্যবাদ।
আপনার মতামত দেবার জন্য নিচের যেকোনো একটি লিংকে ক্লিক করুন