![]() বইমেলা হোক বা নাহোক চটপট নামিয়ে নিন রঙচঙে হাতে গরম গুরুর গাইড । |
অমিয়ভূষণঃ এক বিরল প্রজাতির লেখক
বিপুল দাস
অমিয়ভূষণ মজুমদারের জন্ম ১৯১৮ সালের ২২শে মার্চ। এ বছর তাঁর জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হতে চলেছে। কিন্তু এ কথাও আমাদের জানা এই বিরল প্রজাতির লেখকের জন্মশতবর্ষ সাহিত্যসংস্কৃতি জগতের প্রখর আলোর নীচে আসবে না। বিপণন কৌশলের অন্যতম শর্ত হয় সাধারণ্যে গ্রহণযোগ্যতা। প্রতিষ্ঠান তাই চায়। জনচিত্তজয়ী লেখমালা, চলচ্চিত্র, ক্রীড়া ও অন্যান্য বিনোদনের জন্য প্রচারের পাদপ্রদীপের আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তাকে আরও মহিমা দান করে কৌশলী প্রতিষ্ঠান। ব্যতিক্রমী স্রষ্টার জন্য থাকে কিছু মননশীল পাঠক, ব্যতিক্রমী সৃষ্টির গৌরবকে তাঁরা অনুধাবন করতে পারে, সেই রচনাকে তাঁরা কুর্নিশ জানায়। এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে নগণ্য। কিন্তু কালোত্তীর্ণ মহৎ সৃষ্টির তাতে কিছু আসে যায় না। সেখানেই অমিয়ভূষণ সৃষ্টি আলাদা হয়ে গেছে চলাচলের নিরাপদ পথ থেকে। আর এক মজুমদার, কমলকুমারের মতই তাকেও বিদগ্ধ পাঠক এবং সমালোচক ‘লেখকদের লেখক’ হিসেবে গণ্য করেছেন।
বাংলাভাষায় যারা ছোটগল্প এবং উপন্যাস লিখছেন বা গত ত্রিশ/চল্লিশ বছরে যা লেখা হয়েছে, সামান্য কয়েকজনকে বাদ দিলে যা পড়ে থাকছে, সেগুলো পড়ে মনে হতেই পারে চলাচলের নিরাপদ, প্রথাগত পথকেই তারা বেছে নিয়েছেন। ব্যক্তিবিশেষের গল্প বলার ভঙ্গিতে একটু উনিশবিশ হচ্ছে, কিন্তু তুলনামূলক ভাবে অপ্রচলিত কোনও লিখনশৈলী, যার ব্যতিক্রমী প্রকরণ আন্দোলিত করতে পারত সনাতন কাঠামো, গল্পবলার প্রথাগত প্রকরণকে আক্রমণ করে খুঁজে আনতে পারত নতুন কৌশল – তেমন বারুদগন্ধী বিপজ্জনক পথে প্রায় কেউ নেই। হাতে গোণা দুচারজনের লেখায় সেই দুঃসাহসের ইশারাটুকু কখনও ঝিলিক দিয়ে যায়। কিন্তু পাঠকের কাছে পৌঁছবার জন্য একটা আকুতি বোধহয় লেখার সময় গোপনে কোথাও কাজ করে। লেখক-পাঠক communication- এর দায়, সেতুবন্ধনের গোপন প্রবৃত্তি পরোক্ষে কাজ করে। সেই দায় গল্প বলার দুঃসাহসী নতুন পথের খোঁজ না করে সহজভাবে শেষ পর্যন্ত পাঠককে একটা গল্প শোনাতে চায়। তখন সমঝোতার প্রশ্ন আসে। কেমন হবে আমার বলার ভঙ্গি, কাদের জন্য আমি গল্প লিখছি, সমাজের কোন শ্রেণীর মানুষের কাছে আমি আমার বার্তাটুকু পৌঁছে দিতে চাই, emotional factor, নাকি cerebral factor – কাকে বেশি প্রাধান্য দেব।
তখন যে প্রশ্নটা অবধারিতভাবে উঠে আসে, তা হল – সাহিত্য কি একধরণের বিনোদনের উপকরণ, নাকি আমাদের জীবনযাপনে অবিরত যে সংশয়, যে সংকট আমাদের বেঁচে থাকাকে বিপদগ্রস্ত করে রাখে, তাকে উন্মোচিত করা। আমাদের বেঁচে থাকার গ্রাফ তো কখনওই সরলরেখা নয়। অজস্র উঁচুনিচু রেখা। বিচিত্র, রহস্যময়। প্রেম, অপ্রেম, ঘৃণা, ভালোবাসা, পেটের খিদে এবং যৌনতা, কাম ও ঘাম, অশ্রু এবং রক্ত – এসব কিছুই একজন লেখকের কালির সঙ্গে মিশে থাকে। এর ভেতর কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ – সেটা নির্দেশ করার দায় লেখকের নয়। সে দায় সমাজসংস্কারকদের, সমাজসেবীর, গুরুদেবের, আচার্যদের, যুগাবতার মহাপুরুষদের। লেখক শুধু সত্ত্ব এবং তমঃ, আলো এবং আঁধারকে শিল্পসম্মতভাবে চিহ্ণিত করেন। যদি বিনোদন হয়, তবে সে লেখায় cerebral factor –এর কোনও প্রয়োজন পড়ে না। সেখানে বাণিজ্যমুখিনতাই প্রধান বিচার্য বিষয়। পাঠকের ইচ্ছাপূরণের জন্য গল্প চাই। পাঠকের কাছে খুব সহজে পৌঁছে যাওয়ার কয়েকটা সমীকরণ থাকে। সে সব পড়ার পর একটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয় শুধু। কিন্তু যে রসায়নে অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘অ্যাভলনের সরাই’ বা ‘সাইমিয়া ক্যাসিয়া’ চিরকালের জন্য সিরিয়াস পাঠকের মনে আসন পেতে বসে, সে রসায়ন এসব বাণিজ্যমুখী গল্পে থাকে না। সাহিত্যের একটি ধারা বিষয়, লিখনশৈলী ও বর্ণনকৌশলে জনমনোরঞ্জনের পথ অনুসরণ করে। পাঠকের মনে সাময়িক তৃপ্তি দেয়। এসব লেখায় লেখকের সবসময় একটা দায় থাকে পাঠকের সঙ্গে communicate করার। লেখকের চিন্তার স্বাধীনতা থাকলেও মনে হয় তিনি কোনও শর্তাধীন হয়ে লিখছেন। পাঠকের চাহিদার সঙ্গে সমঝোতার লক্ষণ সে সব লেখায় স্পষ্টই বুঝতে পারা যায়। বেশির ভাগই সাধারণ মানুষের তীব্র, অপূর্ণ বাসনাপূরণের গল্প। এ সব কাহিনী দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এই জনপ্রিয়তা খুব সাময়িক। দু’দশ বছর গড়িয়ে গেলে সে লেখা সময়ের মহাঝঞ্ঝায় শুকনো, বিবর্ণ পাতার মত কোথায় উড়ে যায় – ভবিষ্যতের পাঠক বা সমালোচক তার কোনও হদিশ পায় না। কালগর্ভে লীন হয়ে যায় সেই সাহিত্যকর্ম। অমিয়ভূষণ খুব সচেতন ভাবেই সে পথে কোনও দিন হাঁটেননি।
লেখককে তো ইতিহাসসচেতন হতেই হয়। না হলে কীভাবে তিনি এই সভ্যতার, মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার কথা লিখবেন। মানুষ কত দীর্ঘপথ দিল। কত ধর্মযুদ্ধের নামে অন্যায় যুদ্ধ, এখনও ডাইনির মাংসপোড়া গন্ধে উল্লাস শোনা যায়, কত সাম্রাজ্যের উত্থানপতন হল। এসব কিছু মন্থন করে জীবনের রহস্যময়তার কথা, কোনও এক সার সত্যের সন্ধান করে যান লেখক। পুরাণের নতুন পাঠ, মঙ্গলপাঠের নবনির্মাণ, যে পাশ্চাত্য লেখনরীতিকে মডেল করে একসময় আধুনিকতার সংজ্ঞা ঠিক করা হয়েছিল, তাকে অতিক্রম করে দেশজ পাঁচালি, ব্রতকথা, পুরাণ, মঙ্গলকাব্যের বিনির্মানের মধ্য দিয়ে,আমাদের লোককথা, উপকথাকে নতুন আঙ্গিকে লিখছেন অনেকেই। অমিয়ভূষণমনস্ক পাঠক অবশ্যই লক্ষ করে দেখেছেন ধূসর অতীত নয়, অমিয়ভূষণের লেখায় এসেছে অনতিঅতীত। গড় শ্রীখণ্ড, রাজনগর, মধু সাধুখাঁ উপন্যাসের পটভূমি মানবসভ্যতার সুদূর অতীত নয়, চাঁদ বেনে ব্যতিক্রম, কিন্তু সেখানেও অতীত এবং সমকাল পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।
বাংলা সাহিত্যের তিন ব্যতিক্রমী গদ্যকার হিসেবে ধরা হয় কমলকুমার মজুমদার, জগদীশ গুপ্ত এবং অমিয়ভূষণ মজুমদারকে। লেখকদের লেখক হিসেবে অনেক সমালোচক তাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী কালে নবারুণ ভট্টাচার্য, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, রবিশঙ্কর বল এবং আরও দু’একজনের লেখায় আমরা সেই লিখনের ব্যতিক্রমী শৈলী দেখেছি। জনমনোরঞ্জনের জন্য এরা কোনও দিনই লেখেননি। বাংলা সাহিত্যের সাধারণ পাঠকদের অনেকে এই লেখকদের নামও হয়তো শোনেননি। অমিয়ভূষণ এদের মধ্যে নিজস্ব মেজাজে অনন্য হয়ে উঠেছেন। সেটা তাঁর বিচিত্র বিষয় নির্বাচনের জন্য হতে পারে। হতে পারে তাঁর অননুকরণীয় লিখনশৈলীর জন্য। এবং অবশ্যই তাঁর লিখন সম্পর্কে নিজস্ব দর্শনের জন্য। তার নিজের কথাতেই ‘ হায়ার ফিজিক্স যেমন সর্বজনগ্রাহ্য করা যায় না, সাহিত্যকেও তেমনই সর্বগ্রাহ্য করা যায় না’। এই একটি কথাতেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি যা বলতে চান, সেটি বুঝে নেবার দায় পাঠকের। যে কোনও বিষয়ের গভীরে যাওয়ার জন্য বিশেষ অভিনিবেশ এবং মননশীলতার যদি প্রয়োজন হতে পারে, তবে সাহিত্যকর্মটির অন্তরালে যে রসের সৃষ্টি লেখক তৈরি করলেন, তাকে বুঝে নেবার জনই বা পাঠকের বিশেষ ধীশক্তির প্রয়োজন কেন থাকবে না। এই যুক্তি থেকে অমিয়ভূষণ কোনও দিন সরে আসেননি। তাই, এ বঙ্গে অমিয়ভূষণের পাঠককুল সর্বার্থে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে লেখক কি পাঠকের সঙ্গে communication চাননি ? একজন স্রষ্টা অবশই চাইবেন। কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসে কিছু বিরল প্রজাতির লেখক থাকেন, তাঁরা তাঁদের উচ্চ অবস্থানেই থেকে যান অভিজাত একটা অহংবোধ বা দাপট নিয়ে। সেখান থেকে নীচে নেমে এসে জনচিত্তজয়ী বিনোদনমূলক লেখার প্রতি কোনও দিন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন না। অমিয়ভূষণ আপোষহীন ছিলেন নিজের লেখা নিয়ে।
আসলে সত্যকথন এবং সেই কথনভঙ্গী কেমন হবে, সেই রীতি একেবারেই লেখকের নিজস্ব দর্শনসঞ্জাত। অমিয়ভূষণের লিখনভঙ্গী এখনও অননুকরনীয় থেকে গেছে। তাঁর Text এবং Discourse নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায় Text হয়তো এমন কিছু অভিনব নয়, কিন্তু সেই Text-কে বয়ে নিয়ে যাওয়ার মত, চলন এবং বর্ণনকৌশলে রয়েছে Discourse-এর ম্যাজিক। বিশেষ করে Text-প্রেক্ষিতে conversation, subject, object, statement-এর মাঝে যে semiotic ব্যঞ্জনা তিনি প্রয়োগ করেছেন, তার ফলে তাঁর গদ্য বিদগ্ধ পাঠকের কাছে প্রচলিত শব্দের আড়ালে অন্য চিত্রকল্প তৈরি করেছে। ব্যতিক্রমী গদ্যকার হিসেবে চিহ্নিত হ’ন অমিয়ভূষণ মজুমদার। চিন্তাভাবনায় ক্ল্যাসিকপন্থী, কখনও মনে হয় দাম্ভিক, অথচ ‘অতি বিরল প্রজাতি’র মত অতি আধুনিক, দুঃসাহসিক লেখাও তিনি লিখেছেন। এমন কথাও শোনা যায়, ব্যক্তিগত যাপনে রক্ষণশীল, সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন, অথচ তাঁর প্রচুর লেখায় পাচ্ছি প্রান্তিক মানুষের জীবনচর্যার কথা। তাঁদের সুখদুঃখের কথা, এমন কী কখনও তাঁদেরই Dialect-এ নিখুঁত ভাবে উঠে এসেছে।
অমিয়ভূষণের পরে যাঁরা লিখতে এসেছেন, তাঁদের বাদ দিলে বাংলা সাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে যাঁর লেখায় আমরা প্রথম বৌদ্ধিক চলন খুঁজে পেলাম, তিনি অমিয়ভূষণ মজুমদার। এবং যা হয়, এ ধরণের লেখা, cerebral factor যার প্রধান লক্ষণ, সে লেখা কখনই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্য পায় না। গড় শ্রীখণ্ড, রাজনগর, মহিষকুড়ার উপকথা, মধু সাধুখাঁ, ফ্রাই ডে আইল্যান্ড, নরমাংসভক্ষণ এবং তাহার পর, চাঁদবেনে – বাংলা সাহিত্যের এ সব অসাধারণ সম্পদ প্রকাশিত হয়েছে অবাণিজ্যিক ছোট পত্রিকায়। কোনও বড় কাগজে নয়। কিন্তু নিরপেক্ষ সমালোচক এবং বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকের নজর এড়ায়নি, ক্ষমতাশালী লেখককে চিনে নিতে দেরি হয়নি।
ইংরেজি সাহিত্য ছিল প্রবল পছন্দের বিষয়। বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়া অন্য কোনও লেখকের দিকে তাঁর উদার দৃষ্টি ছিল না। বিতর্কিত ছিলেন নানা কারণে। রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্মোপাসনা, নিরাকার ঈশ্বরের কল্পনা অথচ তাঁকে সাকার হিসেবে কখনও স্বীকার করে উপস্থাপন করার ব্যাপারেও তাঁর ঈষৎ বঙ্কিম আপত্তি ছিল। সমসময়ের কোনও লেখাই তাঁকে আকৃষ্ট বা প্রভাবিত করতে পারেনি। শেক্সপিয়র, স্কট, ডিকেন্স, মান, টলস্টয়ে আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। কখনও মনে হয় ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ওপর বোধ হয় তাঁর বেদনা এবং দুর্বলতা রয়েছে। অথচ তাঁর সমগ্র রচনা পাঠে এই প্রতীতিও জন্মায় সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত, চিরকালের বঞ্চিত মানুষদের কথাই হয়তো চিরকাল বলতে চেয়েছেন। কিন্তু সে বলার ধরণই আলাদা। মানুষের মনের দুর্গম রহস্যকে ছুঁয়ে দেখা, ইতিহাস এবং সমকালকে জুড়ে দেবার magic discourse, কথাবুননের আশ্চর্য কুশলতা এবং ভাষার সেই অনিবার্য দার্ঢ্য তাঁকে আলাদা করে দেয়। তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, ব্যক্তি অমিয়ভূষণ নয়, লেখকস্বত্তা এখানে ব্যক্তিকে অতিক্রম করে। নির্মোহ লেখক, ঘটনা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সব কিছু দেখেন। তারপর শুরু হয় মেধামন্থন। লেখা হয় গড় শ্রী খণ্ডের মত মহতী উপন্যাস। তাঁর সাইমিয়া ক্যাসিয়া থেকে এক টুকরো গদ্য তুলে আনছি। ‘ ...সামনে, যাকে স্কাইলাইন বলে, সেখানে একটা পাহাড়ের কাঁধ। ঠিক এখানেই কালো পাটকিলে পাহাড়টার গায়ে বেশ খানিকটা জায়গা শাদা, না জানা থাকলে ধস নামার চিহ্ন বলে মনে হবে। পেমার বাড়ি থেকে অন্য রকম দেখতে পাওয়া যায়। কিম্বা দেখতে পাওয়া যায় কথাটা ঠিক হলো না। পেমা জানে বলেই বলতে পারে তার বাড়ির বাইরের দিকের বারান্দা থেকে সোজা পথে দু’ফার্লং আর ঘোরা উৎরায়ের পথে হেঁটে দু’মাইল গেলে ওখানে একটা কোয়ার্টজ্ জাতীয় পাহাড়ের গুহা আছে। সোজা কথায় বলতে হবে ধূমল রঙের একটা চমরী বাছুরের শাদা কপাল, পাঁশুটে শাদা জিভ; জিভের সরু হয়ে আসা ডগাটা নিচের পথটার ধারে নেমে এসেছে। শহর থেকে পনেরো-ষোলো মাইল দূরের এই নির্জন পাহাড়টাকে বাচ্চা-চমরী বলা হ’য়ে থাকে’।
এই যে একটা পাহাড়কে বিশেষ লক্ষণ দিয়ে পরিচিত করানো, এই উপমার জন্য শব্দের অপ্রচলিত Diction, স্থান-কাল-পাত্রের অভিনবত্ব – এই গল্পেই চরিত্রগুলো হচ্ছে পেমা, থেন্ডুপ, শাও চি, রিম্পোচে, গিয়াৎসো; এসেছে লালফৌজ, অতীশ দীপংকর, এসেছে গল্পের মেজাজের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষায় স্থানীয় প্রবাদ ( উত্তুরে কুকুর যখন চিল্লানী শূকরীকে মাতৃত্ব দেবে, তখন অমিতাভ আর থাকবে না পৃথিবীতে), সাধারণ বাঙালি পাঠকের কাছে এই প্রেক্ষিত নতুন। আর গল্প বলার ভঙ্গিমা একেবারেই স্বতন্ত্র। চমক লাগে বই কী। অন্য লেখদের থেকে তিনি মুহূর্তেই আলাদা হয়ে যান শৈলীর স্বাতন্ত্র্যে। তাঁর অদ্ভুত বিষয় এবং Narrative-এ রয়েছে চতুর Diction. ফলে অনেক সময়েই মনে হয় গল্প বলার ঔপনিবেশিক ধারাটি তিনি গ্রহণ করেছেন। বিশেষ কোনও Imagery গঠনের জন্য তাঁর উপমাগুলি বাংলা সাহিত্যে নতুন প্রয়োগ। এই গল্পেই দেখুন পাহাড়ের বর্ণনায় তিনি লিখেছেন -- ধূমল রঙের একটা চমরী বাছুরের শাদা কপাল, পাঁশুটে শাদা জিভ; জিভের সরু হয়ে আসা ডগাটা নিচের পথটার ধারে নেমে এসেছে। শহর থেকে পনেরো-ষোলো মাইল দূরের এই নির্জন পাহাড়টাকে বাচ্চা-চমরী বলা হ’য়ে থাকে’। হঠাৎ মনে হয় কোনও বিদেশি গল্পের অনুবাদ পড়ছি। এই ধারা তিনি দ্বিধা না করেই তাঁর লেখায় এনেছেন।
আর একটি বিষয় নিয়ে সম্ভবত তাঁর তীব্র প্যাশন ছিল। অনেক লেখাতেই ব্যাপারটা ঘুরে ফিরে এসেছে। সেটা হ’ল সংকরায়ণ। তাঁর জীবন কেটেছে বাংলা সাহিত্যসংস্কৃতির কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে পরিধি অঞ্চলে। এক সময়ের কোচ রাজাদের করদ রাজ্য, মহারাজার শহর কোচবিহারের ভারতভুক্তি হয় ১৯৪৯-এ। আজীবন এই শহরে বাস করে সাহিত্যসৃষ্টির কাজে মগ্ন থেকেছেন অমিয়ভূষণ। এ অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাসের বৃত্তান্ত তাঁর লেখায় এসেছে। এসেছে ডুয়ার্সের গাঢ় সবুজ অরণ্যের কথা, এসেছে মেচ-কোচ-খেন-রাভাদের কথা। এসেছে পাহাড়ের মানুষদের কথা। মহিষকুড়ার উপকথা তাঁর এক অসাধারণ উপন্যাস। দু’টি ভিন্ন প্রজাতির সংকরায়ণ এবং তার ফলে উন্নত বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জাতির কথা অদ্ভুত এক Metaphor-এর প্রয়োগে এই উপন্যাসকে ধ্রুপদী করে তুলেছে। অরণ্যসংলগ্ন গ্রামে কবে যেন এসেছিল বাইসন( Indian gaur), বুনো সেই প্রাণীর সঙ্গে মিলন হয়েছিল গ্রামের কোনও গৃহপালিত গাভীর। এই ইশারাটুকু নিয়ে উপন্যাসটি শুরু হয়। আবার সাইমিয়া ক্যাসিয়া, উরুণ্ডি বা অ্যাভলনের সরাই গল্পেও ভিন্ন দেশ, ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে সংকরায়ণের কথা রয়েছে। কৌমের শুদ্ধতা রক্ষা, আবার এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে আন্তর্মিলনের কথা তাঁর বিষয় ছিল। সাইমিয়া ক্যাসিয়া গল্পেও দেখি হান্ একজন লালফৌজের মেজর এবং অন্য গোষ্ঠীর যুবতী পেমার মধ্যে যৌন সংসর্গের আভাস। যুদ্ধের সময় যারা বাস্তুহারা হয়েছিল, তাদের অনেক পরিবারকেই পুনর্গঠিত ইয়োরোপের এ-নগরে ও-নগরে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল। সেই রকম একদল উদ্বাস্তুদের নিয়ে গল্প ‘অ্যাভলনের সরাই’। দলে কত রকমের মানুষ একসঙ্গে কতদিন ধরে হেঁটে চলেছে অ্যাভলের সরাই-এর খোঁজে। সেখানে পৌঁছতে পারলেই আর কোনও কষ্ট থাকবে না। দলে রয়েছে মুখোশ পরা সাইমন, গল্পের একদম শেষে জানা যায় যুদ্ধ তার নাক উড়িয়ে দিয়েছে। সেখানে ভয়ঙ্কর দু’টি শূন্য গহ্বর। দলে ছিল নিনা, এক সুন্দরী যুবতী। শহরে পলিটেকনিকের ছাত্ররা ছিল তার শরীরের খরিদ্দার। সেই নিনার সঙ্গে সাইমনের সম্পর্কের ইশারা রয়েছে। এদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল সরাই আর মাত্র বেয়াল্লিশ কিলোমিটার। শেষ পর্যন্ত ওরা একটা খাদের কিনারে এসে পোয়ঁছেছিল, যেটা একটা দড়ি ধরে পার হতে হয়। মুখোশ খুলে দড়ি ধরে প্রথম লাফ দিয়েছিল সাইমন। তখনই নিনা দেখেছিল সাইমনের নাকের ফুটোর জায়গায় অতল গহ্বর, নিনা পাগল হয়ে গিয়েছিল। আর বংশে যাতে সংকরায়ণ না ঘটে, রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য পুত্রবধূ এবং শ্বশুরের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে দুঃসাহসিক লেখাটিও এক অতি বিরল উপন্যাস।
সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর সোজাসাপটা বক্তব্য ছিল – ‘দর্শনের জন্য দর্শন, বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান, তেমনি সাহিত্যের জন্যই সাহিত্য। শিল্পের জন্মটাই আসল কথা। এই শিল্পের ভেতরেই সব কিছু থাকতে পারে। মানুষের কান্নাঘামরক্ত, পৃথিবীর ইতিহাস, মানুষের প্রেম, ঘৃণা। তাঁর এই ‘সাহিত্যের জন্য সাহিত্য’ ধারণার জন্য তাঁর কিছু বামপন্থী লেখকবন্ধু তাঁর অনেক বিরূপ সমালোচনা করেছেন। তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘লিখনে কী ঘটে’ বইতে তিনি লিখেছেন –‘ আমি কেন জন্মালাম ? পৃথিবীর চূড়ান্ত সুখ, চূড়ান্ত শান্তি থেকে বঞ্চিত হলাম। এইভাবেই ফ্রাস্ট্রেশন আসে। সাব্কনশাসে ঢুকে যায়। সাব্কনশাসে ঢুকে ভাবে এর থেকে বাইরে যাবার পথ কই। শিল্প সাহিত্য সঙ্গীত সেই মুক্তির পথ খোঁজে’।
কোন বিভাগের লেখাঃ
![]() |
শেয়ার করুন |
মন্তব্যের পাতাগুলিঃ [1] [2] [3] [4] এই পাতায় আছে 43 -- 62

Re: অমিয়ভূষণঃ এক বিরল প্রজাতির লেখক

Re: অমিয়ভূষণঃ এক বিরল প্রজাতির লেখক
আমি লিখেছিলাম 'আমি হার্ডকপিগুলোই পড়িনি। শুধু দ্যাকো আমি সোন্দীপন কিনি টাইপের নিশ মানসিকতায় ভোগা লোক।' তাতে আবারও আসল '"কিনি" কোথায়? আপনি তো বলতে চাইলেন "নামাই"।'!!! আর তারপর একগুচ্ছের ধারণার চাষ অগুণতি আগাছা সমেত - ' নিজেকে কন্ট্রাডিক্ট করলেন', 'এই পিডিএফ এর খোঁজ হার্ড কপি কেনার পরে পেয়েছেন', 'গদ্য ও গল্প কিনে সাথে রাখার মত, উপন্যাস নয়' টাইপ। হুঁকো হাতে রয়েছে নাকি গাঁজার ছিলিম?
@h সাক্ষাৎকার পুরোটা টাইপ করার ধৈর্য আমার নেই। তবুও কমলকুমার এবং জগদীশ গুপ্ত সম্পর্কে তাঁর মত এই টইয়ে প্রাসঙ্গিক 'মনে হতে পারে' ভেবে দিলাম। আপনিই দেখুন এ ব্যাপারে কারও কোনো উত্তর দেওয়ার দায় থাকে কি না?
কমলকুমার - ... কমলকুমারের কারিকুরিটা কোন জায়গায়? কমলকুমারের ইমেজগুলো মনে মনে চলবে চোখের সামনে ফুটে উঠবে না। ... প্রথম কমলকুমারের লেখা পাই চতুরঙ্গে, আর কেউই সাহস করে ছাপত না। ... ওঁর ভাষা তখন খুব অ্যাট্রাক্ট করে। আমরা যা দেখি উনি তার চেয়ে অন্যরকম কিছু দেখেন। খুব ধৈর্য ধরে পড়লে একটা জিনিস পাওয়া যায় - যে শব্দগুলোর স্রোত চলছে তার পিছনে একটা ঢেউ চলছে অর্থাৎ ছবি ভাসছে। ... ওঁর ভাষার গঠনের মধ্য দিয়ে এই যে continuity of the flow of imags just below the circle that is the language. এটা কিন্তু কিছুতেই অনুকরণ করা যায় না। এইদিকটা ছিল কমলকুমারের, অবশ্য ভাষার জটিলতা কী ইমেজের সার্থকতার দিক দিয়ে জেমস জয়েস অনেক বড়। অবশ্য জেমস জয়েসের ঐতিহ্য গোটা ইউরোপীয় সাহিত্য, আর এ কী? এত ছোট ছোট, রামকৃষ্ণ, কতগুলো মধ্যযুগীয় ভাবধারা আর মজা হচ্ছে সেই ভাবধারা খুব ডেপথে পৌঁছয়নি ... এত ক্ষমতা, কিন্তু theme is not great enough. আমাকে বললে ঐ থিমে লিখব না।
জগদীশ গুপ্ত - ... ওঁর বহিরঙ্গে চমক আছে, নতুনত্ব আছে কিন্তু ভেতরে ঢুকে দেখ - সেই শরৎচন্দ্র। ... যতই আমরা বলি জগদীশ গুপ্ত বাংলা সাহিত্যের ভীষণ একটা জিনিস তা কিন্তু নয়।

Re: অমিয়ভূষণঃ এক বিরল প্রজাতির লেখক
যতটুকু টাইপ করলে, তাতে আমি কাল যেটা লিখতে গিয়েও লিখিনি সেটা খানিকটা বলার সাহস পাচ্ছি। এবং লিটল ম্যাগ আন্দোলন সম্পর্কেও আপাতত আমার অ্যানালিসিস। নির্লজ্জতার শেষ পর্যায়ে পৌছলে লোকে নিজেকে কোট করে, কিন্তু যেহেতু এই কদিন আগেই এই খানেই এটা লিখেছি, এবং কেউ ই পড়েছে এরকম দুঃসংবাদ এখানো পাওয় যায় নি, তাই সেখান থেকেই বলছি, এবং কে কি মনে করলো, তাতে এন্ড অফ ডে বাল ছেঁড়া গেল,
"
মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে যদি জলবিভাজিকা ধরা যায় পশ্চিম বাংলার মুদ্রিত সংস্কৃতিতে কয়েকটা আগে পরের ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
মতাদর্শের বিবর্তনের হিসেবে আমরা বাঙালি জাতির ইতিহাস রচনার প্রয়াস, সাধারণ ভাবে ইতিহাস রচনায় আর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী পেয়েছি, প্রতিযোগিতা মূলক ভাবে ইউরোপীয়ত্বর বিপরীতে ভারতীয়ত্ব গঠন প্রচেষ্টা পেয়েছি, রাজনৈতিক স্বাধীনতার আকুতি পেয়েছি, রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে ভাবনার স্বাধীনতায় গুরুত্ব প্রদানের প্রয়াস পেয়েছি,সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্যের প্রতিক্রিয়ায় একধরণের বিভিন্ন স্তরের অন্তর্মুখী বা দূরপ্রাচ্য র সঙ্গে একাত্মীভূত প্রাচ্যধারণার প্রবর্তন ও ব্যবহার পেয়েছি। কখনো পরিবার ঐতিহ্য ইত্যাদিকে কেন্দ্রে রেখে আধুনিকের প্রতিক্রিয়াও পেয়েছি।স্বাভাবিক ভাবেই কথাসাহিত্যের ইতিহাস তার নানা সাক্ষ্য বহন করে।
বিংশ শতকের তিরিশ-চল্লিশের দশকে এসে একটা নতুন আধুনিকতার চর্চা পাচ্ছি, ৪২এর আন্দোলনের সময় নতুন করে আন্তর্জাতিকতা বনাম জাতীয়তাবাদ পাচ্ছি, আরেকটু পরেই সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে দুশ্চিন্তা পাচ্ছি পাছি, ভাষা আন্দোলনের অভিঘাত আসছে। এবং পরিচয় পত্রিকার প্রখ্যাত বিতর্ককে কেন্দ্র করে শিল্পীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা পেয়েছি। রিয়েলিজম এবং সোশালিস্ট রিয়েলিজম, বিশেষতঃ নাগরিকতার সীমানার সাংস্কৃতিক ভৌগোলিক বিস্তারের প্রচেষ্টা পেয়েছি। জাতীয়তাবাদী এবং প্রগতি সাহিত্য গোষ্ঠীর বিভাজন ও পাচ্ছি সেই ৪২এর আন্দোলনের সময় থেকে, আবার ফ্যাসীবাদবিরোধী লেখক শিল্পী গোষ্ঠীর সংগঠনে তার কিছু ওলটপালটও দেখেছি।
কিন্তু ৭১এর মুক্তিযুদ্ধের সময় যেটা বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বাঙালী জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় রাষ্ট্র শক্তি একে অপরের কাছ থেকে এক ধরণের অনুমোদন পাচ্ছে, যেখানে বামপন্থী অর্থে প্রগতির ধারণা শুধু না, পশ্চিমবাংলায় সামাজিক, রাজনৈতিক, মরাল যে কোনো স্থিতাবস্থাকে প্রশ্ন করাই কখনো সম্ভাব্য রাষ্ট্রবিরোধী এবং বিশেষ করে বাঙালী জাতির ঐক্যে অমনোযোগী বলে পরিগণিত হচ্ছে, এবং সাহিত্য গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব ক্রমশঃ সরাসরি রাজনৈতিক শিবিরের দ্বন্দ্বে পরিণত হচ্ছে। এটাই আরো পরে এসে প্রকৃত শিল্প বনাম বাজারী শিল্পের তর্কে পরিণত হচ্ছে। কবি শিল্পীরা কে কেন কোন পত্রিকায় লিখছেন, আর কোন পত্রিকায় লিখতে গেলে কিরকমটি হওয়া দরকার, এইরূপ বিচিত্র সম্পাদকীয় নিদানে ব্যতিব্যস্ত হচ্ছেন, আবার অন্যদিকে বিষয় হিসেবে সমাজ ও রাজনীতির বা বলা ভালো বিষয় হিসেবে সামাজিক এবং রাজনৈতিক দুটি ধারার মধ্যে একটা কৃত্রিম ভেদ তৈরি হচ্ছে, করা হচ্ছেও বলা যেতে পারে। পাঠক হিসেবে অতি সংক্ষেপে লজ্জা পেলেই চলে।
বাংলা ও বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাস চর্চায় যেমন প্রাকআধুনিক সময়ের বিষয়ে একটা চর্চা দেখতে পাচ্ছি ভাষাবিদ বা ঐতিহাসিকদের কাজে, কিন্তু সাহিত্যপাঠের জগতে যেন দেখা যাচ্ছে, অন্তত পশ্চিম বঙ্গের পাঠ জগতে দেশভাগের অল্প আগে থেকে প্রায় সত্তর দশক পর্যন্ত সময়টা ধরলে,আগ্রহ মূলত ঊনবিংশশতকের দ্বিতীয় ভাগে বাঙালির তথাকথিত জাগরণের সময় কে কেন্দ্র করে। জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। কিন্তু ৭১এর পরে বিশেষ করে বাংলাদেশে ইতিহাসের চর্চাটা জাতীয়তাবাদ নির্মাণের পর্যায়ে গিয়ে থেমে আর যাচ্ছে না, বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের বাঙালিত্বের ঐতিহ্য সন্ধানে আরো পিছোচ্ছেন, উপন্যাসের বিষয়ে উঠে আসছে প্রাকআধুনিক। একই সঙ্গে বাঙালী মুসলমানের আত্মানুসন্ধানে একটা ধর্মনিরপেক্ষ ধারা শক্তিশালী হচ্ছে, ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক আনুকুল্য ও পেতে শুরু করছে নতুন স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে।
কিন্তু এপার বাঙলায় একই সময়ে, সবধরণের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক শিবিরের কলকাতা কেন্দ্রগুলি থেকেই যেন ভাঙা দেশের বাঙালি রুচির অগ্রাধিকার ঠিক করে দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, অতি ক্লান্তিকর সেই প্রচেষ্টা। রাজনৈতিক ঘটনাবলী যা ঘটছে তাতে সেটা হয়তো অস্বাভাবিক নয়। বাংলার নাগরিক সংস্কৃতির কলকাতা কেন্দ্রিকতা এই কয়েকটা দশকে তৈরি হয় নি, কলকাতা ছাড়া বড় শহর গড়ে ওঠেনি বলেই তৈরি হয়েছে, এতে ব্যক্তিগত ভাবে কেউ দোষীও না, কিন্তু প্রকাশনা সংস্থার পক্ষ থেকে একাধারে রুচি ও বাজার তৈরি করার প্রকট প্রচেষ্টার উল্লেখ না করলে সত্তর ও আশির দশকে পাঠ অভিজ্ঞতার কিছুই বলা হয় না। শ্লীলতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো লেখা, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস, নারীবাদী উচ্চারণের বলিষ্ঠ লেখাগুলিও এই রুচি নির্মাণ তথা বাজার বিভাজন বা বিষয় প্রাধান্যর বিচিত্র অংকে, সমসাময়িক পশ্চিমের উল্টো পথে গিয়ে সমাজ পরিবর্তনে বামপন্থী রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলায় আগ্রহী লেখক গোষ্ঠী বা পত্রিকাগুলির সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারছে না, অন্য পরিসর খুঁজে নিতে বাধ্য হচ্ছে, যেখানে ব্যক্তিচিন্তার মূল্য ধরে নেওয়া যাচ্ছে বেশি। বড় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিরোধী রা নারীবাদী বা অন্যান্য যৌনতার উচ্চারণকে অনেক পরে, অনেক দেরীতে নিজেদের লড়াইয়ে দোসর মনে করছেন।অত্যন্ত দুঃখজনক ভাবে ন্যারেটিভের ধরণ ধারণ সম্পর্কে নিরীক্ষাও এই ভাবেই একটি বাহুল্য বিতর্কে পরিণত হচ্ছে, কারণ সমাজ বা ব্যক্তিপ্রাধান্যের সাহিত্যাদর্শ বনাম বামপন্থী রাজনৈতিক সচেতনতা সঞ্জিত সাহিত্যাদর্শের শিবিরের দ্বন্দে তার স্থান কম।
বলা বাহুল্য এই কাঠামোটির বাইরে তো বটেই, ভেতরেও, জীবন সম্পর্কে গভীর ভাবে আগ্রহী, নিরীক্ষায় সাহসী এবং বিশেষতঃ ব্যাপক অংশের পাঠকের রুচি নির্মাণে অনাগ্রহী লেখককে খুঁজে পেতে পাঠককেও পরিশ্রম করতে হচ্ছে। বহু লেখক স্বল্প পঠিত কেন অপঠিতই থেকে যাচ্ছেন।
"
গোটাটা স্কিপ করলেও বড় কোন ক্ষতি নেই, একটা কথা বোঝা দরকার, স্বল্প পঠিত সাহিত্য মানেই , পরাজিতের সাহিত্য হবে, এই ভাবনা শুধু পরবর্তীর প্রামান্যের অভাবে না, দৃষ্টিভঙ্গী বা দুরাশা হিসেবেও চুড়ান্ত সৎ কিন্তু দিকভ্রষ্ট। পার্সোনালি আমার মনে হয়েছে অমিয় ভূষণ যে এস্থেটিক ট্র্যাডিশন কে নিজের ভাবছেন বা যে এস্থেটিক নিজে তৈরী করতে চাইছেন, তাতে পাঠ সম্ভাবনা বা বিশেষতঃ ষাঠের দশকের পরবর্তী সাংস্কৃতিক বিকল্পকে রাজনৈতিক বিকল্প সন্ধানের অংশ হিসেবে ভাবছেন না অনেক সময়েই, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই যেটা হচ্ছে, আমরা যেহেতু শিবির দ্বন্দ্বে র থেকে পাঠক হিসেবে মুক্তি চাওয়া আর না চাওআর মাঝে আমরা জগদীশ, কমলকুমার এবং অমিয়ভূষণ কে ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছি। এটার থেকে বেরোনো টাই অমিয়ভূষণ পাঠের প্রথম পদক্ষেপ। তবে পক্ষাবলম্বন তো থাকবে , তো আমি গড় শ্রী খন্ড কেন তেমন পসন্দ করি নি, সেটা পরে বলার চেষ্টা করবো। আর 'ট্রমা' শব্দটা অমিয়ভূষণ যে ভাবে ব্যবহার করেছেন, তার উৎস সন্ধান দিয়েই আলোচনা টা করার চেষ্টা করবো। সেই অর্থটায় আমার আপত্তি কিছুটা আছে। রাজীব চৌধুরী লিখেছেন অবশ্য, ট্রমা চিহ্নিত এপিক তবে আমার সেই ইনটারপ্রিটেশন টেও স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা আপত্তি আছে। অমিয় ভূষণ ওঁচা কিছু লিখেছেন, সেটা হাতে থাগলে সুবিধে হত, কিন্তু ক্লাসিক গুলো কেন প্রশ্নাতীত না আমি আমার মত করে বলার চেষ্টা করব। আমার কাছে তাত্ত্বিক অমিয়ভূষণ লেখক অমিয়ভূষণের চেয়ে, অনেক বেশি, রিপিট অনেক বেশি দামী।

Re: অমিয়ভূষণঃ এক বিরল প্রজাতির লেখক
যে পার্ট টুকতে ভুলে গেছি।
'লজ্জা পেলেই চলে...' এর পরে '... বাংলা ও বাঙালির ...' আগে র চিপা টাতে এই পারট টা পড়তে পারো।
'অন্যদিকে বাংলা ভাষা সাহিত্যের চর্চার ইতিহাসে দেশ ভাগ এবং বিশেষতঃ স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ গঠনের পর, পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে আধুনিকতা চর্চায় নতুন করে কলকাতা কেন্দ্রিকতা প্রকট হচ্ছে। আমরা ঢাকার বা বারেন্দ্র এবং রাঢ় বাংলার পত্রপত্রিকার খবর ঢের কম পেতে শুরু করছি। ১ কলকাতার তিরিশের দশকের আধুনিকতা চর্চা সত্তর পরবর্তী আধুনিকতা চর্চার মূল আদর্শ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার সত্তর দশকের পশ্চিমবঙ্গে বিশুদ্ধ বিপ্লব প্রচেষ্টা এবং তার মর্মান্তিক ব্যর্থতা নতুন করে হয় ছোটো পত্রিকার আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে নয় তো বামপন্থার আভ্যন্তরীন বিতর্কের প্রকৃত পরিসর বা নকশাল আন্দোলনের প্রকৃত উত্তরসূরী হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় নতুন কোন্দলের পরিসর হয়ে উঠছে।একটা কথা পরিষ্কার করে নেওয়া অবশ্য দরকার, স্বরের বহুত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা, অসংখ্য পত্রপত্রিকা যে প্রত্যেকেই নিজের মত করে মানুষের কথা আরো আরো মানুষকে পৌঁছে দিচ্ছিলো এবং দিচ্ছে এবং দেবে, এটা মেনে নিতে অসুবিধে নেই, তবে প্রকৃত নিরীক্ষা, অন্তত আখ্যানে বা শৈলীতে বা ভাষায় বা বিষয় বিস্তারে ক্লান্তিকর ভাবে কমে আসছিল, এইটেও পাঠক হিসেবে অনেকের অভিজ্ঞতা ।'

Re: অমিয়ভূষণঃ এক বিরল প্রজাতির লেখক
ইশান/সিকি/পাই কে অনুরোধ একটা জিনিস যদি করা যায়, যে কমেন্ট গুলো বিপুল বাবুর লেখাটা নিয়ে সেগুলো একজায়্গায় রেখে বাকি ভাট আরেকজায় সরানো যাবে? জাতে এলেবেলে আর ড্যাশ এর তর্কটা রইলো, এই ভাট বা অন্য মন্তব্য গুলো ও রইলো। এই ভাটের চোটে স্লা লোকে ওনার মূল পোবোন্দো না পড়ে আরো ভাট দেবে।

Re: অমিয়ভূষণঃ এক বিরল প্রজাতির লেখক

Re: অমিয়ভূষণঃ এক বিরল প্রজাতির লেখক
কিন্তু এটা পুরো সত্যিও নয়। এই আটের দশকেই বহু লেখা হচ্ছে, যা পুরোপুরি ডায়ালেক্ট নির্ভর ভাষায়। যা নাগরিক বাংলায় অভ্যস্ত মানুষের বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। এবং তুমি যদি খেয়াল করো, খবরের কাগজে সেই সময় থেকে, একটু আগেই হয়ত, জেলার খবর, বড় ঘটনা প্রথম পৃষ্ঠায় জায়গা পাচ্ছে। এটার পিছনে ব্যবসাবুদ্ধি আছে, এবং ব্যবসাবুদ্ধি এমনি এমনি আসে না, তার মধ্যেও অ্যাসিমিলেশনের গল্প থাকে।

Re: অমিয়ভূষণঃ এক বিরল প্রজাতির লেখক
এলেবেলেকেও যদ্দুর মনে পড়ছে বইএর পাতার ছবি তুলে পোস্ট করার টিউটোরিয়াল দেওয়া হয়েছিল। সে আবার ইন্টারভ্যু টাইপ করতে বসে কেন? ফোন হারিয়েছে? (টিয়াপাখি)
অনুষ্টুপ অনীক এক ব্রাকেটে রাখার কারণ নকু ইনক্লিনেশন নয়?
সোভিয়েত ভাঙছে ৯২ তে। তা দিয়ে ৮ এর দশকের সাংস্কৃতিক ক্ষয়িষ্ণুতা কিভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য?

Re: অমিয়ভূষণঃ এক বিরল প্রজাতির লেখক
অনীক, অনুষ্টুপ এক বন্ধনীতে রাখা নকু ইনক্লিনেশন কিনা জানি না। হলেও, তার ব্যাখ্যা কী, সেটা বুঝিনি তখনো, এখনো বুঝি না।

Re: অমিয়ভূষণঃ এক বিরল প্রজাতির লেখক
ধর বনফুল বলো, সতীনাথ বল তো স্মল টাউন থেকেই লিখছেন, কিন্তু ৭১ এর পরের শিবির নির্মাণ কলাচর্চার ক্ষেত্রে মহানগর কেন্দ্রিকতা বাড়াচ্ছে মাত্র, আমি এটাকেই ফ্যাসীবাদ বিরোধী শিল্পী সংঘের মিটিং ৪৮ সালে, তার থেকে ধর এমারজেন্সী ৭৫ সালে এই পিরিয়ডের এস্থেটিক চয়েজ গুলো বোঝার চেষ্টা করছি, লেখক দের মধ্যে। আশিতে এটাই খানিকটা কন্টিনিউড হচ্ছে, নব্বই তেও হচ্ছে। এবং তার পরের ব্যাপক নগরায়ণ , বাঞ্ছিত বা অবাঞ্ছিত যাই হোক এই ঐতিহ্য র মূলে আঘাত করে নতুন লেখা তৈরী করবে। তার কিছু উদা আমরা ৯০ এর দশকে পেয়েছি, পরে আরো পাবো। ধরো, বিজন ভট্টাচার্য্যের পোলা , যে কিনা নবান্নর বিজন ভট্টাচার্য্য, সপ্তাহ পত্রিকায় ৭১- ৭২ সালে বেরোনো গল্পের থেকে এক্বারে ২০১১ তে বেরোনো আংশিক চন্ফ্রগ্রহণ বেরোনো পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে, গ্রামীন কৃষি পরিবেশ নিয়ে গল্প লিখছেন একটা, বুড়া কাহারের কথা, ১৯৭৯ তে বেরোচ্ছে। যে সময়ে ন্যাশনালিস্ট শিবির ক্ষমতাসীন লেফ্ট বিরোধী বামপন্থী শিল্পী দের অ্যাকোমোডেট করছে বা করার চেষ্টা করছে, সে সময়্তেও রেজিস্টান্স লোকেলটা কে গ্রাম থেকে শহরে তিনি সরিয়ে আনছেন। আই পি টি এ র নার্ভ সেন্টার এ বড় হয়ে, সে আর্বানিটি র মধ্য়্হেই যা খোঁজার খুঁজছে, সোশালিস্ট রিয়ালিজম যা পড়ে এসেছেন, সেটার থেকে বেরোতে গিয়ে ফ্যাতাড়ু দের ওড়াতে হচ্ছে, একটা নতুন সাব ভারসন খুঁজতে হচ্ছে। কিন্তু তিনিও আধুনিকতা সম্পর্কে প্রধান তিরিশের দশকের বিতর্ক গুলো থেকে মোর ইমিডিয়েট রাজনৈতিক বিতর্কে র মধ্যে থাকছেন। অমিয় ভূষণ সেটা রিফিউজ করছেন, তিনি আধুনিকতার সোশালিস্ট রিয়ালিজম এর আগের আর্বান ওয়েভ টা কে নিজের ইনটেলেকচুয়াল ট্র্যাডিশন বলে মনে করছেন। এটাই তাঁকে অনন্য করেছে। এটা সচেতন ভাবে ফিকশনে অল্প লোক ই এনেছেন, এই জন্যেই তিনি বিকল্প পাঠকের প্রিয় ত্রয়ীর বাকি দুজন, জগদীশ গুপ্ত এবং কমলকুমার এর থেকে দার্শনিক ভিষনে অনেক অনেক আলাদা। তোমার টাইপ করা সাক্ষাৎঅকার সেটাই বলবে, আমি সুদু তার একটা কেনো খুজছি।
মন্তব্যের পাতাগুলিঃ [1] [2] [3] [4] এই পাতায় আছে 43 -- 62
আপনার মতামত দেবার জন্য নিচের যেকোনো একটি লিংকে ক্লিক করুন