এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বকবকস (জার্মান সাহাবের গপ্পো)

    Falguni Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৯ এপ্রিল ২০২৪ | ২৪১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • সেই আমার কিশোরী কালে জীবনের ছন্দ ছিল অনেক ধীর। এত হুটোপাটি দৌড়াদৌড়ি ছিল না। প্রয়োজন যে ছিল না তা নয় তবে ভাবখানা এই যেন হচ্ছে-হবে- হয়ে গেলেই তো ফুরিয়ে গেল। দুপুরে খাওয়ার পর পান মুখে বাড়ির বৌদের চুল শুকানোই হোক বা বিকেলে পাড়ায় মেয়েদের মহিলা মজলিস -- সবেতেই বেশ একটা চেখে দেখবার মত (মনে-চোখে-মুখে) ব্যাপার ছিল।

    গ্রামের দিকে কর্মক্ষেত্রে হওয়ার সুবাদে এখনও চোখ মেলে দেখি অনেক কিছুই। রাস্তার দুপাশের সবুজ ধানে যখন পাক ধরে আসে- পাশাপাশি সময়ের হাত ধরে হাজির হয় দৈত্যাকার হাঙরমুখো ধান মাড়াই মেশিন। দু-তিন ঘন্টায় সব ধান/গম শেষ। খড় – বিচুলি খুদকুঁড়োর বালাই নেই। অথচ  বছর পাঁচেক  আগেও গল্পটা ছিল অন্যরকম। গ্রামের পিচভাঙা দাঁত বের করা রাস্তা, দুপাশের মাড়িও গেছে ধ্বসে- তুবড়ে। তার উপর চার- পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে এক বিশেষ শিল্পে বিছানো ধান বা গম। তোমরা বাইক বা সাইকেল আরোহী তাতে কি! হাত-পা ভেঙে, কোমর ছেঁচে, পায়ের গোড়ালি মচকিয়ে, চোখে সর্ষেফুল দেখে, চোখের জলে নাকের জলে হয়ে যেভাবে পারো গন্তব্যে পৌঁছাও। আমাদের ধান মাড়াই , গম মাড়াই হলেই চলবে।

    খুব রাগ হত, কই আমাদের ছোটোবেলায় তো এরকম দেখিনি। মানুষ এতটা বিবেকহীন তখন ছিল না।  ধান ওঠা, ধান ঝাড়াই, মাড়াই এগুলি ছিল যেন উৎসব। কত তার প্রস্তুতি। প্রত্যেক সম্পন্ন গৃহস্থেরই খামার বাড়ি থাকত। অনেক সময় সেটা বসত বাড়ির পিছনের দিকে হত, আবার কোনো ক্ষেত্রে সামনের বড় উঠোনটাই খামার বাড়ি।  ধান মাড়াই-এর আগে সেই উঠোন ‘দোয়ানো’ হত। উঠোনের সব মাটিকে কুরে উপড়ে(সারাদিন ধরে) জল দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হত সারারাত। পরের দিন সক্কাল বেলা দু-তিন জন সেই প্যাঁকপ্যাঁকে পাঁক ধরা মাটিকে আচ্ছা করে পা চালিয়ে ময়দা ঠাসা করত। 

    আর উঠোনের ঠিক কেন্দ্রে বসানো হত কাঠের বা বাঁশের খুঁটি। কেন্দ্রস্থল একটু উঁচু রেখে বৃত্তাকারে চারিপাশে ঢালু করে দেওয়া হত। ঐ মাটিতে পা দিলে পায়ের পাতা, গোড়ালি সহ বেশ আধহাত ঢুকে যাবে এমন অবস্থায় মাটিটা এলে দু-দিন ফেলে রাখা হত। দিন দুয়েক ধরে দিনের কড়া রোদ ও রাতের হিম খাওয়ানোর পর মাটি আঁসিয়ে এলে খুব যত্ন সহকারে কাঠের চ্যাপ্টা বস্তু দিয়ে (অনেকটা ক্রিকেট ব্যাট জাতীয় দেখতে) মাটিকে পিটিয়ে পিটিয়ে শক্ত করা হত।

    ঐ মাটি যতক্ষণ পিটানোর মত শক্ত না হত সেই দিন দুয়েক বাড়ির সিং দরজা থেকে দাওয়া(বারান্দা) পর্যন্ত পৌঁছানোর কি ব্যবস্থা? যতই ঢিলেঢালা হোক, জীবন তো আর থেমে থাকে না। সে এক বিশেষ নৃত্যকৌশল। ঐ কাদা প্যাঁকপ্যাঁকে মাটিতে পেতে রাখা খানকয়েক ইটে পা মেপে মেপে ছন্দে বন্ধে দুলে দুলে তালে তালে চলতে হত। কারণ পা ফসকালেই বুঝবেন যে আপনার শিক্ষা অসম্পূর্ণ, উঠোন নিজ অবস্থাতেই আছে। উঁহু নাচতে না জেনে উঠোন বাঁকা কিছুতেই বলা যাবে না।

    মনে পড়ে তখন ঐরকম দোয়ানোর সিজন চলছিল। আর সেই খ্যাপা জার্মান সাহেবটিকে নিশ্চয় মনে আছে আপনাদের। কোথায় কোথায় সারা দিন ঘুরে ঘুরে রাজ্যের কুলো, ডালা, ঝাঁঝরি সংগ্রহ করে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে (গ্রামের স্কুল) স্নান করে তার অভিজ্ঞতার কথা সোনামুখ করে বলবে বলে তার বিশেষ সঙ্গীদের (গ্রামের দু-তিন জন শিক্ষক)দরজায় হাজির। এদিকে উঠোনে তখন সেই প্যাঁকপ্যাঁকে পাঁক ধরা কাদা। পাঁকের এপারে দাওয়ায় চিন্তাকুল শিক্ষকের দল— 

    ‘যদি সাহেব জুতো মসমসিয়ে উদয় হয়, বিশেষ কৌশলটি তো অজানা’—  ঠিক তখমই পাঁকের ওপারে সাহেব হাজির। চোখেমুখে অপার বিস্ময়---

         “হোয়াট এ বিউটিফুল ব্ল্যাক সফট সয়েল!!”---
         সাথে সাথে অনেকগুলি কন্ঠের হাহাকার---
         স্টঅঅঅপ! সসস্টটঅপপ! স্টপপপপ!!!

    আর স্টপ!! লেংচে লেংচে, জুতো, জামা, প্যান্টে, কাদায় মাখামাখি করে একমুখ সোনা বাঁধানো দাঁতের হাসি নিয়ে সাহেব বৈতরণী পার হলেন। এধারে দুগগা বলে সব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

    পরে জিজ্ঞেস করে জানা গেছিল, ওনার কাছে—“ ইট ইজ সোওও ফানি অ্যান্ড এনজয়েবল।“ আর জামাকাপড়, জুতো বা শরীরের কাদা সে তো ধুয়ে স্নান করে নিলেই চলে যাবে।

    ফাল্গুনী ফাগুন ঘোষ
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ২০:৫৯531219
  • বাঃ! চোখের সামনে দেখতে পেলাম। ভালো লাগল খুব। বকবকানি চলুক।
  • প্রতিভা | 103.118.50.5 | ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ২১:১২531220
  • মজার কান্ড তো!  লেখার গুণে আরও মজাদার। 
  • Soumyadip Maschatak | ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ২১:৪৩531224
  • অতীত আর বর্তমানকে স্বল্প পরিসরে তুলে ধরার প্রয়াসটি যেমন মনোগ্রাহী তেমনই রঙিন। সহজ সুরে সহজ কথা বলার ধরনটির জন্যই পড়ে ফেলতে হয় একটানা।
  • Argha Bagchi | ০২ মে ২০২৪ ২২:৪৮531323
  • এরকম আরো চাই | অনেক ভুলে যাওয়া রীতি জানতে পারলাম |
  • ফাল্গুনী ঘোষ | 2409:40e1:3:46b1:3097:86ff:fef6:a6f4 | ০৮ মে ২০২৪ ০৬:৩২531504
  • @Argha Bagchi 
     
    আমার অভিজ্ঞতায় যেটুকু যা আছে, এখানে দেব।  পাবেন পড়তে 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন