এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  শিক্ষা

  • মারিয়াম মির্জাখানি – এক রাজকুমারীর কথা 

    মোহাম্মদ কাজী মামুন লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | শিক্ষা | ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ৬৩৮ বার পঠিত
  • মাত্র আঠারো বছর বয়সে এক ইরানি বংশোদ্ভুত আমেরিকান নারী এমন একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করেন যা প্রায় চব্বিশ বছর ধরে বিশেষজ্ঞদের হতবুদ্ধি করে রেখেছিল। কাজটির বিনিময়ে মেয়েটি তার প্রফেসরের কাছ থেকে মাত্র ১০ ডলারের একটি নগদ পুরুষ্কার লাভ করেন; কিন্তু ১৯ বছর পর এই মেয়েটিই লাভ করেন ফিল্ড পুরুষ্কার, যাকে গণিতের সর্বোচ্চ পুরুষ্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আশ্চর্য হল, বিগত আশি বছরে মাত্র ৬০ জন ফিল্ড মেডেলিস্ট আছেন আর এদের মধ্যে মাত্র একজনই নারী মেডেলিস্ট আছেন, যিনি তার ৩৭ বছর বয়সেই গলায় ঝোলাতে সক্ষম হন এই দুর্লভ পদক। হ্যাঁ, মারিয়াম মির্জাখানিই এই সাড়া জাগানো ইতিহাসের রচয়িতা।

    ইরানে ইসলামিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কিছুটা আগে, ১৯৭৭ সালের ১২ মে একজন প্রকৌশলী পিতা ও গৃহবধূ মায়ের মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম নেন মারিয়াম। ঐ সময়টাতে মারিয়ামের পরিবার তাদের সন্তানকে পূর্ণ প্রতিরক্ষা দিয়ে গেছেন। ইরাক-ইরান যুদ্ধের পর পুনর্গঠনের যুগে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রটি শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে জাতির সব থেকে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য কিছু বিশেষ স্কুল নির্মাণ করে। আর উচ্চ স্কোর করে মারিয়াম সুযোগ পেয়ে যান বিশেষভাবে নির্মিত ফারযেইনজান স্কুলটিতে। আশ্চর্য হল, গণিত ছিল একমাত্র বিষয় যাতে মারিয়াম উপরের দিকে থাকতে ব্যর্থ হতেন তার সিক্স গ্রেডে থাকাকালীন। একই বেঞ্চে বসতেন এমন একজন আজীবন বন্ধুর কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, একদা মারিয়াম বিশের মধ্যে ষোল স্কোর করেছিলেন, এবং তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে গণিতের কারণেই এমন হয়েছে; রাগে, ক্ষোভে, শোকে তিনি স্কোরশিট ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। সেই সময়টাতে তিনি তাত্ত্বিক গণিতবিদ হওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি।
    মারিয়ামের ভাই ও শিক্ষকেরা তাকে অবশ্য গণিতের প্রতি আগ্রহী করে তুললেন। ফারযেইনজান স্কুলের অধ্যক্ষের প্রচেষ্টায় গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়ার সুযোগ হয় মারইয়ামের, ১৯৯৪ সনে হংকংয়ে এবং পরের বছর কানাডায় গোল্ড মেডেল অর্জন করেন। একটি বিষয়ে নিখুঁত স্কোর করেন মারিয়াম এবং অলিম্পিয়াডের ইতিহাসের সর্বোচ্চ সন্মানা লাভ করেন। এরকম অর্জনের পর শরিফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে সরাসরি সুযোগ পেয়ে যান মারিয়াম, সেখানে হাঙ্গেরিয়ান গনিতবিদ পল আরডোস এর আড়াই দশক পূর্বের সৃষ্ট গানিতিক সমস্যাটির সমাধান করে তাক লাগিয়ে দেন।

    মারইয়াম মির্জাখানি ২০০৪ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন। এরপর আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে উড়ে যান অক্সফোর্ডের ক্লে ম্যাথমেটিক্যাল ইন্সটিটিউটে, যাদের ব্রত ছিল মানুষের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনে গাণিতিক চিন্তার সৌন্দর্য, ও ক্ষমতাকে কাজে লাগানো। সেখান থেকে ফেলোশিপ সম্পন্ন করে মারইয়াম প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি পদ লাভ করেন এবং পেয়ে যান স্বপ্নের ব্ল্যাকবোর্ড যা পুরো ভরে ফেলবেন তিনি ইকুয়েশান, আর ফরমুলা দিয়ে আর ছড়িয়ে দেবেন তার গাণিতিক ভাবনা ছাত্রদের মাঝে। শীঘ্রই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র ৩২ বছর বয়সেই তাকে পূর্ণ অধ্যাপকের পদ অর্পণ করে। সেখানে কাজ শুরু করার পর রাইম্যান সমতল ও স্থানিক জ্যমিতিতে অবদানের জন্য ইতিহাস সৃষ্টি করে ফিল্ড মেডেল লাভ করেন মারিয়াম। ন্যাচার জার্নাল তাকে ২০১৪ সনে ১০ জন মানুষের একজন গণ্য করেন যারা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীর জন্য।

    মারিয়ামের ভাষায় গণিতের সৌন্দর্য তার কাছেই ধরা দেয়, যে ধৈর্য ধরে অনুসরণ করতে পারে একে। তিনি দাবী করতেন যে, তিনি একজন ধীর চিন্তক, অনেকটা সময় ব্যয় করার পরই কেবল পরিষ্কার হত তার কাছে পথটা। তার কাছে গাণিতিক সমস্যার সমাধান ছিল যেন জংগলে হারিয়ে যাওয়া, সমস্ত জ্ঞানকে ব্যবহার করে এরপর একটি কৌশল যার প্রয়োগ ও কিছুটা ভাগ্যের সহায়তায় এরপর পাহাড়ের চুড়োয় উঠে যাওয়া, আর সব কিছু পরিষ্কার দেখতে পাওয়া, বিস্তৃতভাবে। মারিয়াম তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে বলেন, “জানার চেষ্টা কর, আসলেই তুমি কী চাও, আর কখনোই পথ-বিচ্যূত হয়ো না।“মারিয়াম বিনোদন শিল্পে ‘জিনিয়াস’ এর যে অদ্ভুতুরে রূপটি প্রদর্শিত হয়, সেরকম ছিলেন না। তার বন্ধুরা বলেন, “মারইয়াম আর দশজনের মতই মনোরম ছিলেন এবং আমরা তাকে এরকমই ভালবাসতাম যদি তার কোন স্বীকৃতি নাও থাকতো।“

    মারইয়ামের মা-বাবা গণমাধ্যমে থেকে মেয়ের ফিল্ড মেডেল প্রাপ্তির সংবাদ জানতে পারেন। পরে মারইয়াম নাকি বলেছিলেন এই মেডেল অর্জন তেমন কিছু না। ২০০৮ সালে গণিতবিদ হিসেবে যখন খ্যাতির মধ্যগগনে, তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন এভাবে, “আমি পছন্দ করি একাকী কার্যকলাপ।“ তার চেক বংশোদ্ভূত সহকর্মী ও স্বামী জেন ভনড্রেককে সাথে করে কন্যাকে লালনপালন করা, অডিও বুক শোনা ও অঙ্ক করার মাধ্যমেই কাটতো তাদের অবসর।

    ২০১৩ সালে মারিয়ামের ব্রেস্ট ক্যানসার ধরা পড়ে, কঠিন ও কষ্টকর চিকিৎসার পরেও তা ছড়িয়ে পড়ে চার বছরের মাথায়, প্রথম যকৃত ও পরে অস্থিমজ্জায়। তার চল্লিশতম জন্মদিনের আড়াই মাসের মধ্যেই মারিয়াম মির্জাখানি চলে যান। তার মৃত্যু সারা বিশ্বে শোকের ঢেউ বইয়ে দেয়। তার দেশে তাকে জাতীয় বীরের মর্যাদায় বিদায় জানানো হয়। এই তারকা গণিতবিদকে নিয়ে জাতীয় শোক সহানুভূতি এই পর্যায়ে পৌছে যে, যখন জানা যায় যে, মেয়ের জন্য ইরানি নাগরিকত্বের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন, ইরানের ইসলামিক আইনসভার ৬০ জন সদস্য বিদেশী নাগরিকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ইরানিয়ান মায়ের সন্তানের জন্য স্বয়ংক্রিয় নাগরিকত্বের প্রস্তাব করেন।

    পৃথিবী জুড়েই তরুণ গণিতবিদদের উপর মারিয়াম মির্জাখানির প্রভাব রয়েছে। আমেরিকান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি তাকে কেন্দ্র নিয়ে ‘লেকচার’ প্রবর্তন করেছে। ইরানে তার মৃত্যুদিবসকে গণিত দিবস ঘোষনা করা হয়েছে। তার ছোট্র অথচ সমৃদ্ধ জীবন সাক্ষ্য দেয় জ্ঞান অন্বেষণে তার অসাধারণ মনোবলের কথা, একটি পথ যা অতিক্রম করে গেছে রাজনৈতিক ও লিঙ্গভিত্তিক সীমারেখা। তার সাফল্য দিয়ে তিনি ইরানের মেয়েদের মর্যাদায় সমুদ্রসম পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন। যতটা তার দেশের ইসলামিক রিপাবলিক অনুমোদন করে তার থেকেও অনেক বৃহৎ একটি জীবন তিনি সৃষ্টি করে গেছেন। তার গল্প সঙ্গত করে এই ধারণার সাথেই যে, মেয়েদের ইতিহাস মানুষেরই ইতিহাস, আলাদা কিছু নয়।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ৬৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন