এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ মাইক্রোপ্লাস্টিক - স্বাতী রায় | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়২০১৮ সালে ইউরোপ উপকূল থেকে একটি বাচ্চা স্পার্ম তিমিমাছের মৃত্যুর খবরে ‘ইশশ’, ‘আহা’র বন্যা বয়ে যায়। জানা যায় যে তিমি মাছটির পেটে ভরা ছিল বিভিন্ন রকমের প্লাস্টিক ব্যাগ, জালের অংশ, বস্তা এমনকি জেরিক্যানও। বৈজ্ঞানিকদের অনুমান তিমি মাছটি না পেরেছে এই সব প্লাস্টিক শরীর থেকে বার করে দিতে, না পেরেছে সেসব হজম করতে। তার ফলে সম্ভবত পেটের প্রদাহ থেকে গ্যাস্ট্রিক শকে তার মৃত্যু হয়।তবে টিভিতে, কাগজে ছবি দেখে ইসস বলা সহজ, তিমিশাবকটির অবশ্য এত ক্ষমতা নেই যে আমাদের ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিক প্রোডাকশনের গ্রাফকে নিচের দিকে টেনে নামায়। তার ছবি দর্শকের মনে যতই আঘাত করুক না কেন! এই তিমিশাবকটি একা নয় কিন্তু, অনুমান যে বছরে প্রায় লাখখানেক তিমি, সীল ইত্যাদি সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী প্লাস্টিকের কারণে মারা যায়, হয় ছেঁড়া জালের টুকরোতে জড়িয়ে ডুবে মরে, আর নাহলে এই বাচ্চা তিমিটির মতন কোন রকম শারীরিক শক পেয়ে। সেই সঙ্গে অনুমান লাখ খানেক সামুদ্রিক পাখি। তারা সমবেত ভাবে মানুষকে কাঠগড়ায় তুলতে পারে না, এই যা বাঁচোয়া। আমরা ডাঙ্গার জীব, সমুদ্রের প্রাণীরা মারা গেলেও যতক্ষণ না আমাদের গায়ে মৃত্যুর ঝাপটা সরাসরি এসে লাগছে, ততক্ষণ আমরা নড়ে বসব কেন? না নড়ে বসতে চাইলে, কেউ অবশ্য জোর করছে না। কিন্তু মুষ্টিমেয় কেউ কেউ হয়ত বুঝবেন যে হয়ত অজানা শত্রু আমাদের দুয়ারেই হাজির। শত্রুর নাম হল প্লাস্টিক। এমনিতে প্রচণ্ড দরকারি জিনিস। কিসে না লাগে! কিন্তু সমস্যা এইটাই যে প্লাস্টিক বলতে আমরা যে বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য বুঝি, তাদের সবকটিকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার কোন পকেটসই সুবিধাজনক পরিবেশ বান্ধব উপায় মেলে না। আবার সেটা এমনি ফেলে রাখলে প্রকৃতিতে মিশে যেতে অতি দীর্ঘ সময় লাগে। আর ততদিনে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সেটা ম্যাক্রো-প্লাস্টিক মেসো-প্লাস্টিক, মাইক্রো-প্লাস্টিক ইত্যাদি বিভিন্ন আকারের চেহারা নেয়। ম্যাক্রোপ্লাস্টিক হল ২.৫ সেমির থেকেও দৈর্ঘে বা প্রস্থে বড় যে কোন প্লাস্টিকের টুকরো। ৫ মিমি – ২.৫ সেমি অবধি টুকরোকে বলে মেসো-প্লাস্টিক। আর মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হও ১ মাইক্রো মিলিমিটার থেকে ৫ মিলিমিটারের সাইজের প্লাস্টিকের কণা। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়েই আজকের কথা। কারণ আজকের দিনে এরা জলে স্থলে বাতাসে সর্বত্র ভেসে বেড়াচ্ছে। টেকনিক্যালি দেখলে রাসায়নিক দিক থেকে এরা সকলে অবশ্য এক নয়। পলিথিলিন বা পলিপ্রোপাইলিন বা পেট বা পিভিসি ইত্যাদি কোন রকমের প্লাস্টিকের থেকে তৈরি তার উপর নির্ভর করে মাইক্রোপ্লাস্টিকের গোত্র। তবে এক্ষেত্রে গোত্রে কি আসে যায়! কেন মাইক্রোপ্লাস্টিককে বিপদ বলে ভাবছি? এক তো ভারতের অর্থনীতিতে প্লাস্টিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ কোটি টাকার মোট ব্যবসা। ২০২৪ থেকে ২০৩০ সালের আনুমানিক বার্ষিক বৃদ্ধি ৬.৬%। প্রচুর লোকের রুজি রোজগার জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। আবার এর মধ্যে মোটামুটি কুড়ি শতাংশের এদিক ওদিক এক্সপোর্ট হয়ে দেশের বিদেশী মুদ্রার ভান্ডার স্ফীত করে। প্লেক্সকনসিল (দ্য প্লাস্টিক এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিল) সূত্রে পাওয়া যে সরকারি লক্ষ্যই হল ২০২৭ সালের মধ্যে এই বহির্বানিজ্যকে অন্তত আড়াইগুণ বাড়ানো। তাছাড়া নিজেদের জীবনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, প্যাকেজিং থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে বিলাস সামগ্রীর আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে সবেতেই প্লাস্টিক কিভাবে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের জীবনে। সহজে তাকে নিজের জায়গা থেকে নড়ানো যাবে না। কাজেই বোঝাই যাচ্ছে যে প্লাস্টিক, ‘আপনি থাকছেন স্যার’। এদিকে সরকারি হিসেব মতে১, ২০২০-২১ সালেই (পরের বছরগুলির তথ্য মেলেনি) দেশে ৪১ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গ বছরে ৪.২ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে ২০২০-২১ সালের সরকারি তথ্য অনুসারে তৃতীয় স্থানে, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ুর ঠিক পরেই। এই সংখ্যাটাও বছর বছর বাড়ছে। অবশ্যই প্রথম সারির দেশের তুলনায় মাথা পিছু বিচারে কিছুই না এই সংখ্যাটা - আমাদের জনসংখ্যা বিপুল হওয়ায় সুবিধা। তবু সংখ্যাটা তো নিছক অঙ্কের দিক দিয়ে কম নয়। আরও সমস্যা হল আমাদের কথা আর কাজে খুব বেশি সামঞ্জস্য নেই। আর সরকারি হিসেব মতে এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্যের দুই তৃতীয়াংশ উৎপাদক কোম্পানির দায়িত্ব। তার পরেও এক তৃতীয়াংশের তো কোন হিসেবই নেই। বাস্তবে কি হয়? তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে কোম্পানিরও কিন্তু শুধু প্রসেসিং এর দায়িত্ব, কতটা সত্যি সত্যি কি হচ্ছে তার খবর সব কোম্পানি রাখে কি? এমনিতেও কতটা বর্জ্য কোম্পানি ফিরে পেল, সেগুলো কিভাবে প্রসেস করল, এই ধরণের কোন একাউন্টিং হয় কি? এই বর্জ্য যায় কোথায়? ব্যক্তিগত ব্যবহারের যে প্লাস্টিকের মগ, বালতি, ডাস্টবিন ইত্যাদি কিনি আমরা, সেগুলো কি উৎপাদককে ফেরত দেওয়ার কোন ব্যবস্থা আছে? তার ব্র্যান্ড জিজ্ঞেস করলেই তো বিপদে পড়ে যাব! আর আমরা হেথায় হোথায় যেসব পুরোন প্ল্যাস্টিক ফেলে রাখি, বা সেসব জিনিস জঞ্জালের সঙ্গে ফেলে দিই, তার সামান্য অংশই বাস্তবে রিসাইকল হয়। বেশিটাই রোদে, জলে-বৃষ্টিতে পড়ে থাকে আর ক্ষয় হয়ে হয়ে মাটি-জল-বাতাসে মেশে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের সেকেন্ডারি উৎস।অবশ্য এছাড়া ব্যবসার জন্য আলাদা করে মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি করাও হয়। সেটাই প্রাথমিক উৎস। ওই যে ফাঊন্ডেশনের টিউবটি আপনার ড্রেসিং টেবলে শোভা পাচ্ছে বা যে লিপস্টিক বা ফেস পাউডারটি ছাড়া আপনি বাড়ির বাইরে বেরোতে পারেন না, সেটি কি কি দিয়ে তৈরি আমরা আর কজন জানতে যাই? এই যে বিদেশে অল্পবয়সী মেয়েদের মধ্যে টিউবিং মাস্কারা এত জনপ্রিয়, সেই টিউবটি কিসের তৈরি জানেন কি? “বিট দ্য মাইক্রোবিড” ক্যাম্পেইনের মতে, মেবেলাইন কোম্পানির ৮৫% প্রডাক্টে মাইক্রোবিড ব্যবহার করা হয়। এমনকি আমাদের ঘরের পাশের ল্যাকমে কোম্পানির সানস্ক্রিন লোশন “সান এক্সপার্ট এস পি এফ ৫০ আলট্রা ম্যাট লোশন” এও মাইক্রোবিড মিলেছে। তবে এদেশে যেহেতু এইসব নিয়ে মানুষের মাথা-ব্যথা কম, তাই দেশজ ব্র্যান্ড নিয়ে এখানে মাথাব্যথাও কম। এদিকে বিশ্বজুড়ে কসমেটিকস কোম্পানিগুলোর সর্বমোট বাজার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তাই এখানে মাইক্রোপ্ল্যাস্টিকের বহুল ব্যবহার চিন্তার বিষয় বৈ কি! শুধু একা হরেক কসমেটিকসকে দায়ী করলে হবে না। বস্তুত ২০১৯ সালের নেচারে প্রকাশিত এক পেপারে২ জানানো হয়েছিল যে পরীক্ষা করে দেখা গেছে সাধারণ সিনথেটিক জামাকাপড় বাড়িতে ব্যবহৃত ওয়াশিং মেসিনে কাচা হলে প্রতি কেজি কাপড়ে ১২৮ থেকে ৩০৮ মিলিগ্রাম মাইক্রোফাইবার বেরোয়। অবশ্যই কাপড়ের চরিত্রের উপর নির্ভর করে সংখ্যার এই হেরফের হয়। আর এই মাইক্রোফাইবারের একটা বড় অংশ আবার কোন অধুনা-প্রচলিত বর্জ্য-জল-শোধন প্রক্রিয়ায় আটকানো যায় না। ফলে সেসব সোজা গিয়ে পরিবেশে জমে। এই ডেটার থেকে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন যে বছরে যত মাইক্রোপ্লাস্টিক সমুদ্রে গিয়ে পড়ে, তার অন্তত ৩৫% আসে এই কাপড় কাচার থেকে। অবশ্য এই তথ্য মিলেছে ওয়াশিং মেশিনে কাচা কাপড় দিয়ে। এবার কেউ কেউ ভাবতেই পারেন যে ভারত উপমহাদেশে তো এখনও হাতে কাপড় কাচাই বেশি প্রচলিত। তাই বিপদ ওদের, আমাদের আর কি! কিন্তু আসলে সমস্যা আছে। কারণ সমুদ্রের জল আসলে কোন রাজনৈতিক সীমানা মানে না। আর দ্বিতীয়তঃ কাপড়ের থেকে মাইক্রোফাইবার ওঠে মেকানিকাল ও কেমিকাল স্ট্রেসের কারণে। হাতে কাচলে মেকানিকাল স্ট্রেস খানিকটা কম হলেও কেমিক্যাল স্ট্রেসের মাত্রার মনে হয় খুব হেরফের হবে না। আবার ধাই ধপাধপ কাপড় আছড়ে আছড়ে কাচলে কি হয় দেবাঃ ন জানন্তি। এছাড়াও ‘একবার কাচলে কাপড় আবার প্রায় নতুনের মতন হয়ে ওঠে’ এমন ধারার বিজ্ঞাপন দেওয়া বহু ডিটারজেন্ট বা ফেব্রিক সফটনার এর মধ্যেই মাইক্রোপ্ল্যাস্টিক থাকে। ইউরোপের প্রচলিত ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে অন্তত ১১৯ টা ব্র্যান্ডে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। সে অবশ্য ইউরোপে বিধিনিষেধও কড়া, ফলে যে সব পদার্থ দিয়ে তৈরি তার সবিস্তার হিসেব প্যাকেটের উপর দিতে হয়। আমাদের অত নিয়মের কড়াকাড়ি নেই। আর ভারতের ব্র্যান্ডগুলো নিয়ে বিশেষ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার হদিশও সহজে মেলে না। অন্য হাতে এক কনজ্যুমার রিপোর্ট৩ বহুল প্রচলিত ১২ টি ডিটারজেন্ট ব্রান্ডের তুলনামূলক পরীক্ষা করে জানিয়েছে যে এদের কোনটাতেই মাইক্রোবিড নেই। কাজেই বৈজ্ঞানিক ভাবে কেউ হাতে কাপড় কাচার পরের বেরোন জলকে পরীক্ষা না করে দেখা অবধি বা ব্র্যান্ডগুলির উপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা না হওয়া অবধি আমরা এসব অমূলক ভয় বলে আপাতত নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমাতেই পারি। আমাদের রোজের জীবনে অবশ্য গাড়ীর চাকা ইত্যাদি আরও অনেককিছু জানা-অজানা উৎস থেকেই নিয়ত প্লাস্টিক ক্ষয় হতেই থাকে। তবে স্বস্তির জায়গা খুব একটা হয়তো নেই। এমনিতেই সমুদ্রের ধারে ধারে গবেষণা করে জানা গেছে পৃথিবীর ১৯২ টা উপকূলীয় দেশে যত প্লাস্টিক বছরে তৈরি হয়, তার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ মাইক্রোপ্লাস্টিক হিসেবে গিয়ে জমা হয় উপকূল অঞ্চলে। আমাদের সুন্দরবন অঞ্চলে প্রচুর প্লাস্টিকজাত দূষণ-পদার্থ সমুদ্রের জলে ভেসে এসে জমা হচ্ছে। আবার ভিতর থেকে যেসব নদী বয়ে যাচ্ছে তারাও প্লাস্টিক দূষক নিয়ে গিয়ে ঢালছে। দুয়ে মিলে সুন্দরবনের অবস্থা করুণ হচ্ছে। আর আমাদের সাধের কলকাতার পাশের গঙ্গার জল নিয়ে পরিবেশবিদদের মাথা ব্যথা অনেকদিনই। সাম্প্রতিক গবেষণায়৪ তাঁরা হুগলি নদীর মিষ্টি জলের এলাকার (অর্থাৎ মোহনার কাছের নোনতা জল বা তারপরের মিশ্র জলের অঞ্চল ছাড়িয়ে আরও উত্তরের অংশ থেকে) থেকে ১০ টি স্যাম্পল নিয়ে তার ভিত্তিতে পরীক্ষা করে জানিয়েছেন যে, সব কটি স্যাম্পলেই মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে। সর্বোচ্চ মাত্রায় মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে বালিখালের কাছে - ২০৬৯ টি টুকরো প্রতি মিটার কিউব মিষ্টি জলে। এঁদের সংগৃহীত তথ্য সাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমাদের আধা পরিশ্রুত বা অপরিশ্রুত বর্জ্য তরলই আসলে মিঠে জলের গঙ্গার জলের মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের প্রধান উৎস। এছাড়াও অবশ্যই গঙ্গার ধারের বিভিন্ন কলকারখানার থেকে অন্য ধরণের জলদূষণও হয়। কিন্তু সেসব বলতে গেলে নিবন্ধের আকার শুধুই বাড়বে, তাই থাক সে কথা। জলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কথা আগেই আগ্রা, হরিদ্বার, পাটনা এলাহাবাদ এসব জায়গায় নজরে এসেছে। কারোর কারোর মনে থাকতে পারে, কাগজে বেরিয়েছিল, ২০১৯ সালে পলতার জল পরিশোধন কেন্দ্রে মধ্যে ফিলটার করার জায়গায় মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছিল।৫ পাওয়া যাওয়ারই কথা। কারণ পলতার জল আসে গঙ্গার থেকে আর গঙ্গার জলই তো দূষিত। আর এটাও বুঝে নিতে কোন অসুবিধা নেই যে এখনও যেহেতু ফিল্টার করে সব মাইক্রপ্লাস্টিক আটকানো যায় না, তাহলে কিছুটা প্লাস্টিক শুদ্ধ জলই আমাদের বাড়ি বাড়ি এসে পৌঁছেছে। আমরা শোধিত জল জেনে সেই জলই পরমানন্দে পান করেছি। কিন্তু হায় এতকিছু জেনেও আমাদের ঘুম ভাঙ্গে না! বিপুল পরিমাণে প্রাত্যহিক বর্জ্য পরিশোধনের কোন মহতী পরিকল্পনাও নজরে এল কি? এই তো আমাদের অবস্থা! অবশ্য জলের কথা বলছি যখন, তখন এই পৃথিবীর হাওয়া, মাটি কিছুই কি আর মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ থেকে সংরক্ষিত? একেবারেই না। মাইক্রো প্লাস্টিক কণারা সহজেই হাওয়ায় ভেসে ভেসে দূর দূরে চলে যায়। অবশ্য কলকাতার ক্রমনিম্নমুখী হাওয়ার গুণগত মান গোটা পৃথিবীর মানুষের চিন্তার বিষয়। আর তাতে ভাসমান কণারা এতোই বিপজ্জনক মাত্রায় প্রায় সব সময়ই ঘুরে বেড়ায়, তাই সেটাই বড় চিন্তার বিষয়। আলাদা করে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিয়ে বিশেষ গবেষণা হয়েছে বলে চোখে পড়েনি। জাপানের বিজ্ঞানীরা অবশ্য শঙ্কা প্রকাশ করেছেন৬ যে বাতাসে ভাসমান কণাদের তো পিএম২.৫ মাপ দিয়ে মাপা হয় আর সেটাকেই স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক বলে ভাবা হয়, ভাসমান মাইক্রোপ্লাস্টিক কণারা তার থেকে আকারে বড় বলে হয়ত তেমন নজরদারিতে আসছে না। তাহলে কি স্বাস্থ্যের পক্ষে কী বিপজ্জনক সেটাও নতুন করে ভেবে দেখা দরকার আছে? আর এখন তো (২০২৩ সালের কাগজে বেরিয়েছিল খবরটা৭) হিরোশি ওকোচির নেতৃত্বে জাপানি বৈজ্ঞানিকরা মাউন্ট ফুজির উপর জমে থাকা মেঘের মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের সন্ধান পেয়েছেন। সমস্যা এই আমাদের পৃথিবীকে ঘিরে রাখা বায়ুমন্ডলে উপস্থিত মাইক্রোপ্লাস্টিক কণারা তারা সমবেত ভাবে মেঘ তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াকেই ঘেঁটে দিতে পারে। সেই সঙ্গে মেঘের থেকে সূর্যালোক প্রতিফলন বা বৃষ্টি হওয়ার ধরণ ইত্যাদি বদলে দিতেও তারা সক্ষম। সব মিলিয়ে পৃথিবীর আবহাওয়াকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা ধরে এই অদৃশ্য কণাগুলো। এমনিতেই আবহাওয়ার বদলের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে আমরা নাজেহাল, সেই সঙ্গে আরও বারুদ হয়ত পরিবেশে জমা করছি নিজেদের অজান্তে। আর যে দেশে অধিকাংশ প্লাস্টিক বর্জ্যের ভবিতব্য জমি ভরাট করার কাজে লাগতে সেখানে মাটিও যে প্লাস্টিকময় হয়ে যাবে তাতে আর আশ্চর্য কি? ২০২০ সালেই বর্ধমানের মেমারি অঞ্চলে সমীক্ষা করে গবেষকরা৮ দেখেছেন মাটিতে কিভাবে ম্যাক্রোপ্লাস্টিক ও মাইক্রো প্লাস্টিক দুইই মিশে রয়েছে। তাঁরা এও জানিয়েছেন যে মাটিতে প্লাস্টিকের উপস্থিতি কিভাবে মাটির জলধারণ ক্ষমতা ইত্যাদি চরিত্র বদলে দিচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদনে প্রভাব পড়ছে। আর সেই প্লাস্টিক গাছের মধ্যে দিয়ে খাদ্যে মিশে মানুষের প্লেটে এসে পৌঁছাচ্ছে। কারণ হিসেবে তাঁরা মূলত দায়ী করেছেন মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য দেওয়া আধা-তরল, আধা-কঠিন পরিশোধিত বর্জ্য-অবশেষকে। এতেই প্লাস্টিক ভরা। এছাড়াও আছে প্লাস্টিক আবরণে মোড়া সার (যতদূর পড়েছি, এ বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ ধারনার নিতান্তই অভাব, সারের ধীরে ধীরে মাটিতে মেশা নিশ্চিত করতে প্লাস্টিকের মোড়ক দেওয়া হয়, অন্য কোন কারণ আছে কি?)। এমনিতেই বঙ্গোপসাগরের পাশের সুন্দরবন প্লাস্টিক সেসপিট বলে বহুদিন ধরেই আখ্যা পেয়েছে। সেখানকার মাটি, জল ও প্রাণী-উদ্ভিদের জীবনে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব নিয়ে অল্প কিছু কাজ তাও চোখে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জায়গায় এই হিসেব আদৌ হয়েছে কিনা জানা নেই। অথচ বিদেশে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন যে প্লস্টিক কিভাবে গাছের অঙ্কুরোদ্গমের হারকে বা অঙ্কুরের বাড়কে ব্যাহত করে। মানুষের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতিরও ক্রমশঃ প্রমাণ মিলছে। নেদারল্যান্ডের ২২ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে ১৭ জনের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে। বস্তুত এখনও অবধি পরীক্ষায় আমাদের লালা, রক্তপ্রবাহ, প্লাসেন্টা, কোলন, ফুসফুস, মল ইত্যাদির মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে মাতৃদুগ্ধ ও সদ্যজননীর প্ল্যাসেন্টাতেও। আজকের বিজ্ঞানীরা বলছেন মানুষের শরীরে তিনভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢোকে। প্রথমত শ্বাস গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ফাইবার বা হাওয়ার সঙ্গে মিশে থাকা কণা হিসেবে এসে শরীরে ঢুকতে পারে। ইন্ডিয়া টুডে গত বছরের একটা খবরে জানিয়েছিল যে আমরা প্রতি সপ্তাহে একটা করে ক্রেডিট কার্ড তৈরি করার মতন যথেষ্ট পরিমাণে মাইক্রো প্লাস্টিক শ্বাসের সঙ্গে টেনে নিই। গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা৯ মাইক্রোপ্লাস্টিক কিভাবে মানুষের শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে দিয়ে ঘুরে বেড়ায় তার একটা মডেল বানিয়েছেন। নাক দিয়ে ঢুকে শেষে রক্তের সঙ্গে মিশে যায়, তারপর চলতে চলতে সোজা ফুসফুস বা হৃৎপিন্ডে বা অন্যান্য অঙ্গে পৌঁছে যায়। অবশ্য শুধু যে দূষিত হাওয়া দায়ী এমন তো নয়, খাবার বা পানীয়ের মাধ্যমেও মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে ঢুকতে পারে। এই যে গোটা শীতকাল জুড়ে ধাপার কাছের ইস্টার্ণ বাইপাশের ধারে ধারে কলকাত্তাই বাবুদের গাড়ি থামিয়ে নধর সবজি কিনতে দেখা যায়, সেই সব ‘ড্যাঞ্চি’ সবজির সঙ্গে সঙ্গে আমরা কী কী যে খাই কে জানে! তবে এইসব নিয়ে দেশজ রিসার্চ এখনও তেমন মেলে না। তাই আপাতত বিদেশী রিসার্চ থেকেই বলা যাক যে ইটালিতে রোজকার আলু, ব্রকোলি ইত্যাদি সবজির মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এমনকি যে আপেল নিয়ে বলা হয় যে ‘অ্যান অ্যাপেল আ ডে / কিপস দ্য ডক্টর অ্যাওয়ে’, সেই আপেলেও এই দূষকের হদিশ মিলেছে। অবশ্য পরিবেশ-দূষণের আরেকটা ফল হল খাদ্য শৃঙ্খলে মাইক্রো প্লাস্টিকের ঢোকার পাসপোর্ট পাওয়া। ফাইটোপ্ল্যাংটন বা সায়ানোব্যাক্টিরিয়া মারফৎ তাদের খাদক বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে দিয়ে ধাপে ধাপে মানুষের শরীরে এসে ঢোকে। এই যে পাশের বাড়ির দত্তবাবুর বাড়িতে তিনদিন বর্ষার ইলিশ এসে গেল বলে ঈর্ষায় নীল হয়ে গিয়ে আপনি বাজার থেকে বিপুল দাম দিয়ে গোটা ইলিশ কিনে আনলেন আর সোশ্যাল মিডিয়ায় বড় করে ছবি পোস্টালেন, জানেন কি সেই ইলিশের মধ্যে কি কি আছে? অবশ্য বিজ্ঞানীরা বলছেন ত্বকের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমেও শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক লেগে যায়, ভিতরে অনুপ্রবেশ না করতে পারলেও। তার গায়ে লেগে থাকা টক্সিক পদার্থ থেকেও বিপত্তি হওয়া সম্ভব। একবার শরীরে ঢুকতে পারলেই হল, তারপর যে কত রকমের বিপত্তি ঘটাতে পারে! যেমন বেয়াড়া আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিকের খোঁচা লাগতে পারে বিভিন্ন অঙ্গ- প্রত্যঙ্গে। প্রদাহ তৈরি হয়। তার উপরে বিভিন্ন মাইক্রোপ্লাস্টিকের রাসায়নিক গড়ন আলাদা আলাদা তো, আর প্লাস্টিক তৈরির পর্বেও বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। সবে মিলিয়ে শরীরের ভিতরে বিভিন্ন এন্ডোক্রিন ডিসর‍্যাপ্টার বা তাদের ক্ষরণে সহায়ক পদার্থ ঢোকে, মোটাদাগের ভাষায়, বহুবিধ হরমোনের গণ্ডগোল সৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ে। যার ফলশ্রুতি বাড় বৃদ্ধির সমস্যা, বিভিন্ন প্রজনন তন্ত্রের সমস্যা থেকে ক্যান্সার, নিউরোডিজেনেরেটিভ অসুখ অবধি অনেক কিছুই হতে পারে। আরও একটা সমস্যা হল যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের গায়ে লেগে লেগে বিভিন্ন হেভি মেটাল বা অন্যান্য টক্সিক পদার্থও শরীরে ঢুকতে পারে, তারাও বিভিন্ন রকমের খেলা দেখায় শরীরে। বলে না একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর! নিরীক্ষায় দেখা গেছে এমনকি কম দূষিত হাওয়াতেও দীর্ঘদিন ধরে শ্বাস গ্রহণের ফলে হৃৎপিণ্ডের বা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা হতেই পারে।১০ খুব সম্প্রতি কালে অবশ্য এক গবেষণায় ২৫৭ জনকে পরীক্ষা করে দেখানো হয়েছে যে যাদের গলার ধমনীতে জমে থাকা প্লাকের প্রলেপের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে তাদের মধ্যে বছর তিনেকের ধারে কাছে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক ও তার থেকে মৃত্যুর সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে চারগুণ। বিপদ বলে বিপদ! এছাড়াও বিজ্ঞানীরা হজমের গোলমাল থেকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কমে যাওয়া থেকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস জনিত টিস্যুর ক্ষতি ইত্যাদি বহু শারীরিক বিপদ সম্ভাবনার পিছনেও প্লাস্টিককে চিহ্নিত করেছেন১১ - উৎসাহীরা একটু নেট ঘাঁটলেই বহু তথ্য পাবেন। তবে এই নিয়ে আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। যদি বিজ্ঞানীদের বলা এই সব সম্ভাবনা সত্যি হয়, তাহলে মাইক্রোপ্লাস্টিককে নিঃশব্দ ঘাতকের তকমা দেওয়াই যুক্তিযুক্ত হবে। অবশ্য ক্ষয়িত প্লাস্টিকের অপর ফর্ম মানে ন্যানোপ্লাস্টিককেও এই বিপদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। তবে অবশ্য এই দেড় কোটি মানুষের দেশে মানুষের প্রাণ ম্যাক্রো স্কেলে সব চেয়ে সহজলভ্য। কিছুটা ভারতীয় জীবন দর্শনও হয়ত মানুষকে কিঞ্চিৎ দার্শনিক করে দেয়, তারা ভাবে মরব তো একদিনই, এত না ভেবে আনন্দে বেঁচে নিই। হবে হয়ত। আর যে দেশে এক বিপুল সংখ্যক মানুষ দৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা করতে করতেই ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে সেখানে আর অদৃশ্য শত্রু নিয়ে কেই বা ভাববে! তার উপর এদেশে গবেষণার খাতে যা সামান্য অর্থ ব্যয় হয় আর সম্প্রতিকালে সেই গবেষণা- অর্থের যে ধরণের গবেষণার দিকে গতি, তাতে এই ধরণের অনিশ্চিত গবেষণা তথা প্রকৃত ক্ষতি মাপার জন্য ক্ষেত্র সমীক্ষা কতটা হওয়া সম্ভব সেও বোঝা খুবই সহজ! কাজেই হয়ত না জানা থাকলেই জীবনে শান্তি বাড়ে। আর জেনে গেলে তখন হয়ত ওই বিদেশের মতন নো প্লাস্টিক উইক জাতীয় কিছু নিঃশব্দে পালন করে আত্ম-পাপ ক্ষালনের চেষ্টা করতে হয়। এও জানা যে তাতে সামগ্রিক কোন ছাপই পড়বে না হয়ত। কিভাবে কমানো যায়? ভোগবাদে রাশ টেনে? ব্যক্তিজীবনে বদল এনে? নাকি অন্য কিছু করা দরকার? অবশ্য কি করলে যে সত্যিকারের বদল আনা সম্ভব তাও কি কেউ একা একা বার করতে পারে? ‘একাকী গায়কের’ জন্য কি আদৌ এই গান? সামগ্রিক সর্বস্তরের ঐকান্তিক চেষ্টার দরকার। ব্যক্তি চেষ্টার সঙ্গে সরকারি নীতির সামগ্রিক মেলবন্ধন হলে তবে না কিছুটা কাজ হয়! আর না হলে এই সব লেখা শুধু ভীতি-উদ্রেককারী বলে বাজে কাগজের ঝুড়িতে জমা হয়! ১) https://pib.gov.in/PressReleasePage.aspx?PRID=1943210 ২) De Falco, F., Di Pace, E., Cocca, M. et al. The contribution of washing processes of synthetic clothes to microplastic pollution. Sci Rep 9, 6633 (2019). https://doi.org/10.1038/s41598-019-43023-x৩) https://consumeraffairs.nic.in/sites/default/files/file-uploads/ctocpas/Deterjent_powder.pdf৪) Ghosh, S., Das, R., Bakshi, M. et al. Potentially toxic element and microplastic contamination in the river Hooghly: Implications to better water quality management. J Earth Syst Sci 130, 236 (2021). https://doi.org/10.1007/s12040-021-01733-9৫) https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/experts-warn-of-micro-plastics-in-kmc-water/articleshow/69065930.cms৬) Wang, Y., Okochi, H., Tani, Y. et al. Airborne hydrophilic microplastics in cloud water at high altitudes and their role in cloud formation. Environ Chem Lett 21, 3055–3062 (2023). https://doi.org/10.1007/s10311-023-01626-x৭) https://www.thehindu.com/sci-tech/energy-and-environment/japanese-scientists-find-microplastics-are-present-in-clouds/article67356549.ece৮) Maji, Piyush & Mistri, Biswaranjan. (2021). PLASTIC CONTAMINATION, AN EMERGING THREAT FOR AGRICULTURAL SOIL HEALTH: A CASE STUDY IN MEMARI II C. D. BLOCK, PURBA BARDHAMAN, WEST BENGAL, INDIA. Pollution Research. 40. 120-129.৯) Riaz, Hafiz Hamza & Lodhi, Abdul Haseeb & Munir, Adnan & Zhao, Ming & Mumtaz Qadri, Muhammad Nafees & Islam, Saidul & Farooq, Umar. (2024). Breathing in danger: Mapping microplastic migration in the human respiratory system. The Physics of Fluids. 36. 10.1063/5.0205303.১০) Lee Y, Cho J, Sohn J, Kim C. Health Effects of Microplastic Exposures: Current Issues and Perspectives in South Korea. Yonsei Med J. 2023 May;64(5):301-308. doi: 10.3349/ymj.2023.0048. PMID: 37114632; PMCID: PMC10151227.১১) Environ. Health 2023, 1, 4, 249–257 Publication Date:August 10, 2023. https://doi.org/10.1021/envhealth.3c00052
    ভ্রমণের বিষ - প্রতিভা সরকার | সদা আনন্দময় যে মানুষ হিমাচল প্রদেশে ঢুকলাম শিবরাত্রির সমারোহ মাথায় নিয়ে। জলুসের পর জলুস যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে, সবাই নিজেদের ট্র‍্যাডিশনাল পোষাকে সজ্জিত, মেয়ে পুরুষের মাথা আচ্ছাদিত, হিমাচলি রঙবেরঙের ঠাটু, টুপি, সব একেবারে জায়গা মত। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, সবাই চলেছে মান্ডির তিনশ বছরের পুরানো শিবমন্দিরের দিকে, যে দেবতার এমনই মহিমা, গত বছর জুলাই মাসের বন্যায় আশেপাশে সব রসাতলে গেছে, কিন্তু মন্দিরটির কোনো ক্ষতি হয়নি। পেতলের পাল্কিতে জলুসের ঠিক মাঝখানে দেবতা যাচ্ছেন, তাঁর অঙ্গও পেতলের। নানা রঙের জাব্বাজোব্বা, মস্তকাবরণে তাঁকে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। কিন্তু যে মানুষদের কাঁধে চড়ে তিনি যাচ্ছেন তারা সবাই আনন্দময় গ্রামীণ মানুষ, সাদাসিধে আর বিশ্বাসী।তীর্থান গ্রামের পঞ্চায়েত কার্যালয় প্রাঙ্গণে আর একরকম আনন্দের বিস্ফার দেখলাম দুদিন পর, আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস উপলক্ষে। পঞ্চায়েত প্রধান মহিলা, সরকারি আধিকারিকও তাই। মাইকে তারা নারী সশক্তিকরণের উদ্দেশে গঠিত বিভিন্ন সেল্ফ হেল্প গ্রুপগুলিকে নানা উন্নয়নমূলক কাজ ও ঋণপ্রকল্প সম্বন্ধে অবহিত করাচ্ছিলেন। তাদের কথা শেষ হতেই মেয়েরা শুরু করল নাচগান। বিভিন্ন গ্রুপের বিভিন্ন ধরণের প্রোগ্রাম। নাম এবং ঠাটুও বিভিন্ন। লক্ষ্মী মহিলা মন্ডলের ঠাটু বা মস্তকাবরণ উজ্জ্বল সোনালী, জাগৃতি নারীশক্তি মন্ডলের বেগুনি, তাতে কুলু স্টাইলের ছাপছোপ। ধর্মীয় নয়, পরম্পরাগত নয়, তবু এই উৎসব গ্রামের বেশিরভাগ মেয়েদের অংশগ্রহণে ধন্য হচ্ছে দেখে ভালো লেগেছে। অনেক কথা হল লক্ষ্মী গ্রুপের প্রধান জি, বিদ্যার সঙ্গে। মেয়েরা এখানে লোনের টাকায় উলের পোশাক বানিয়ে ট্যুরিস্টদের কাছে বিক্রি করে, আচার ঘি জ্যামজেলি ছাড়াও পাইন ফলের অংশ দিয়ে নানা দৃষ্টিনন্দন হস্তশিল্প বানায়। মোটামুটি কিছুটা লাভ থাকে বৈকি বেশির ভাগ গ্রুপেরই। নাহলে হাড়ভাঙা খাটুনির পর মেয়েরা আরও কাজের দায়িত্ব নিতে যাবে কেন! এই জি, বিদ্যার চোখেই সব দেখা হল আমার। পাহাড়ের কোনো দেবতা নেই?তীর্থান গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে, দেবতা মানুষকে এবং জাগতিক সমস্ত কিছুকে রক্ষা করেন সব দুর্ভোগ দুর্বিপাক থেকে। এই বিশ্বাস তীর্থান বা হিমাচলের কেন, হয়ত ভারতবর্ষের সব গ্রামে গ্রামে সব উৎসবের প্রাণ, সব আনন্দের মূল। এই মানুষগুলো শ্রম ও অর্থ দান করে নিজেদের গ্রামের চৌহদ্দিতে মন্দির বানাবে, সেখানে নিত্য পূজার্চনা হবে, তবে না গ্রাম পূর্ণতা পাবে! আমি বিদ্যাকে শুধোই, শুধু পাহাড়ের কি কোনো একক দেবতা নেই, যিনি তাকে রক্ষা করতে পারেন লাগাতার ধ্বংস আর নির্বিচার আক্রমণ থেকে? তাকে বলি, সমস্ত পাহাড়ের রাণী যে হিমাচল প্রদেশ তার চেহারা দিনের দিনের পর দিন যেভাবে কুৎসিত হয়ে উঠছে, তা কল্পনাতীত। পাঞ্জাব পেরিয়ে হিমাচলের সীমানায় ঢুকলেই শুধু উন্নয়ন, নির্মাণ, জেসিপি আর ট্রাকের পর ট্রাক! ট্যুরিজম পয়সা আনে, এজন্য রাস্তার পর রাস্তা তৈরি হচ্ছে, সিঙ্গল লেন ডাবল হচ্ছে বিয়াসের পাশে, সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে যাচ্ছে জেসিপি। ধুলোভরা গাড়ি চলার রাস্তাই হয়ত খুব শিগগিরই উন্নয়নের একমাত্র প্রতীক হয়ে উঠবে। বিদ্যা বা অন্য মেয়েদের বেশি বাইরে যাওয়া হয় না। ক্ষেতি বাড়ি মন্ডলের কাজ সামলাতে অনেক সময় যায়। তবে তারাও শুনেছে পাহাড় ফুটো করা টানেলের পর টানেলের কথা! চল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে না পেরোতে পাঁচখানা টানেল ধোঁয়া আর ধুলো ভর্তি বিরাট হাঁ-মুখে মানুষকে গিলে নেয়। টানেল আগেও ছিল, কিন্তু সে সংখ্যায় কম, যাত্রাপথ হ্রস্ব করা ছাড়া তার আর কোনো কাজ ছিল না। এখন তো ভঙ্গুর পাহাড়ের পেট ফুটো করে কেবলই টানেল, জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে। এরকম চললে কোনো যুদ্ধ বাঁধার আগেই পাহাড় ধ্বসে পড়বে, কোনো নির্মাণই বাঁচবে না, সঙ্গে মারা পড়বে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ, ভেঙে পড়বে বাস্তুতন্ত্র। গতবারের সেই বন্যাবিদ্যারা বলে, প্রকৃতির রুদ্ররোষ যে কী ভয়াবহ চেহারা নিতে পারে, তা দেখিয়ে দিয়েছে গতবারের বন্যা। মান্ডির শিবমন্দির বেঁচে গেলেও মানুষের প্রাণ, ঘরবাড়ি, জীবজন্তু, গাছপালা, কিছুই রেহাই পায়নি। বন্যার জল সঙ্গে নিয়ে এসেছে বিশাল ধ্বস, ব্রিজ উপড়ে, জনপদ ভাসিয়ে সে এক প্রলয়ংকর কাণ্ড! মেয়েরা দেখায়, তীর্থান নদীর ওপর এই ব্রিজের নীচে এখনও লেগে আছে এক বিরাট গাড়ির (টাটা হ্যারিয়ার) কংকাল। না বলে দিলে চেনার উপায় নেই। সেতুর মুখোমুখি পাহাড় উপড়ে ধ্বসের সঙ্গে নেমে এসেছে অজস্র ছোট বড় পাথর। ধ্বসের পথে পড়েছিল এক বিরাট গোশালা। দুধেলা গাই সমেত সেটি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। জল উঠে এসেছিল অনেকদূর। সেতুটিও বেশ খানিকটা ভেসে গেছে বন্যার জলে। কিন্তু কী আশ্চর্য, নদী সরে আসায় বন্যার পর বোল্ডার পরিকীর্ণ তীর সাফ করে এর মধ্যেই উঠে গেছে হোমস্টে নামের সব ছদ্মবেশী হোটেল। এখন নাকি আইন হয়েছে নদীর গায়ের ওপর নির্মাণ চলবে না। একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এতদিন এই আইন ছিল না! যেগুলো এরমধ্যেই মাথা তুলেছে সেগুলো আর একটা বন্যায় ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবে বলে অপেক্ষা থাকবে আমাদের? লক্ষ্মী মন্ডলের লক্ষ্মী মেয়েরাও এই প্রশ্নের সামনে বিমূঢ় হয়ে পড়ে।সব দেখেশুনে মনে হয় ট্যুরিজম একটা ভয়ংকর দৈত্যের চেহারা নিয়েছে। হিমাচল প্রদেশে যেহেতু জমি কেনা যায় না, স্থানীয়দের জমি লিজ নিয়ে হোমস্টে-র নামে হোটেল ব্যবসা খুলে চলেছে রাজ্যের বাইরের ধনী ও প্রভাবশালীরা। স্থানীয়রা লিজের টাকা ও কর্মসংস্থানের অল্প সুযোগই পাওনা বলে মেনে নিয়েছে। কঠিন হাতে এর মোকাবিলা না করলে অচিরেই গোটা হিমালয় ধ্বংস হয়ে যাবে। পরিবেশের সেই নির্বিচার ধ্বংস প্রভাব ফেলবে সারা দেশেই। বিবর্তনের পথে এত সুন্দরের সৃষ্টি হল, সে কি শুধু ধ্বংস হবার জন্যই? তীর্থান গ্রামের মেয়েরা, সমস্ত অধিবাসীরা এ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল এবং চিন্তিতও। কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞ আটকাবার উপায় তাদের অজানা। বৃহত্তর পরিবেশ ভাবনায় দেশের যে মাথারা ভাবিত হলে কাজ দিত, তারা কোথায়!
    পরিবেশ ভাবনায় ভারতীয় সংস্কৃতি সাহিত্য: সেকাল-একাল - সন্তোষ সেন | পরিবেশ বিপর্যয় আজ রাষ্ট্রীয় সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব চরাচরে পরিব্যাপ্ত। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে ১.৪৪ ডিগ্রির ঘরে, কোন প্রান্তে তীব্র দাবদাহ- খরা-তাপপ্রবাহ; অন্যত্র প্রবল বৃষ্টি-বন্যা-ধস, এমনকি দুটো বিপরীত এক্সট্রিম আবহাওয়া প্রায় একই সময়ে একই স্থানে আছড়ে পড়ছে। হিমবাহের অতিদ্রুত গলন, জল বাতাস নদীর দূষণ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে প্রবলভাবে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সংবিধান-গণতন্ত্র-পরিবেশের সংকট সব জড়াজড়ি করে জট পাকিয়ে তুলেছে। প্রবল মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, আর্থিক বৈষম্য সহ পরিবেশ সংকটের মূল কারণ দেশি-বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির নির্বিচারে জল জঙ্গল জমি পাহাড় নদী: প্রকৃতির সব উত্তরাধিকার লুটেপুটে ধ্বংস করা। পরিবেশ বিঘ্নকারীর সংখ্যা হাতে গোনা হলেও এর প্রভাব পড়ছে নিম্নবিত্ত মানুষ, প্রান্তিক কৃষক, কৃষি শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষ ও বনবাসী জনজাতিদের জীবনে। অথচ সমাজের একটা বড় অংশ এখনো কেমন যেন নীরব নিশ্চুপ নিষ্ক্রিয়।এই নিবন্ধের ছোট পরিসরে অতি সংক্ষেপে একটি প্রাথমিক আলোচনা করার চেষ্টা করব ভারতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মননে পরিবেশ ভাবনার গুরুত্বের ওপর। প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ নিয়ে একটি সুসংহত ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা প্রাচীন ভারতের দর্শনে উপস্থিত ছিল না ঠিকই। কিন্তু অজস্র মনিমুক্তো ছড়িয়ে আছে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির অন্তরালে। সিন্ধু সেঁচে এই মনিমুক্তো তুলে এনে আজকের স্থানকালের প্রেক্ষিতে সমাজে প্রথিত করতে পারলে মানব জমিনে নিশ্চিত করেই একটি চারা গাছ রোপণ করা যাবে, যা ডালপালা মেলে শতধারায় বিকশিত হবে। প্রাচীন ভারতের অথর্ব-সংহিতার পৃথিবীসুক্তে ৬৩টি মন্ত্রকবিতা জুড়ে বরফ ঢাকা পাহাড়, ধূলি-পাথর সমাকীর্ণ বিস্তৃত মাঠঘাট, বনজঙ্গল, নদী-সাগর, ছয় ঋতুর সুন্দর সমাহার, নানান কীটপতঙ্গ, পাখপাখালি, ছোট বড় বন্যপ্রাণ: সবকিছু নিয়েই একটা গোটা পৃথিবী ও তার সভ্যতার পরিচয় সুপ্ত আছে। অথর্ববেদের কবির অনুভবে ঔষধি বনস্পতির লালনভূমি বিশ্বম্ভরা বসুধা। নানান জনগোষ্ঠীর বিকাশক্ষেত্রও বটে এই ধরণী। মাটির পৃথিবীর সঙ্গে জীবজগতের এই অন্তরঙ্গতার কথা উঠে এসেছে মহাভারতের কবি ভীষ্মের মুখেও। ভাববাদী দৃষ্টিতে জারিত প্রকৃতি সত্তার অন্তরালে ঋগবেদের সরস্বতী নদী ‘পাবণী জলধারার মূর্তিমতী সুচেতনা’র দেবী হয়ে উঠেছিল। ভূলোক, ব্রহ্মাণ্ড, কিংবা গাছ পাহাড় পাথর হয়ে উঠেছিল দেবতার প্রতীক। তাকে অবলম্বন করে ছান্দোগ্য উপনিষদে সম্পদ-উপাসনার রীতি গড়ে ওঠে। আজও আমরা দেখি আদিবাসী মানুষজন পাহাড় গাছ পাথর নদীকে দেবতাজ্ঞানে (বিমূর্ত ঈশ্বর ভাবনা নয় কিন্তু) পূজা করেন। মনে রাখা দরকার, জঙ্গল পাহাড় গাছ রক্ষার জন্য আদিবাসীদের প্রকৃতিপূজা ও বন জঙ্গলের যৌথ মালিকানার সংস্কৃতি পাহাড় জঙ্গলকে ভয়ংকর ধ্বংসের হাত থেকে একটা মাত্রায় হলেও টিকিয়ে রেখেছে।লতাগুল্ম, ঔষধি-বনস্পতি, জল বাতাসকে সম্বোধন করে তার সাহায্য চাওয়ার কথা এবং গাছগাছড়ার স্বাস্থ্যকর উপকরণের সপ্রশংস উল্লেখ অথর্ববেদে মাঝে মাঝেই উঠে এসেছে। এর মধ্যে আধ্যাত্মদৃষ্টির ভূমিকা স্পষ্ট হলেও বাস্তব উপযোগিতা নির্ধারণের হিসেবি মনোভাবের অসীম মূল্যও কিছু অবজ্ঞা করার নয়।এবার আসি প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কালিদাসের কথায়। ‘বিক্রমোর্বশীয়’ নাটকে শোকার্ত পুরূরবা হারিয়ে যাওয়া প্রেয়সীর খোঁজে লতাপাতাকে জড়িয়ে ধরেন পরমাত্মীয়ের মতো। মেঘদূতের নির্বাসিত বিরহী যক্ষ মেঘকেই ভাই সম্বোধন করে প্রেমিকাকে দুটো কথা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করেছিলেন আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে। আর শকুন্তলা নাটকটি কবি রচনা করেছেন প্রকৃতির কথা মাথায় রেখে প্রকৃতির রূপ রস গন্ধের সাথে জৈব-অজৈব প্রাণ ও মানুষের যাপনকে জড়িয়ে নিয়ে। তাই বনবালা শকুন্তলার কাছে বনজ্যোৎস্না লতাটি আদরের ভগিনী হয়ে ওঠে। তার ফুল ফোটার দিনটিকে যৌবন সমাগমের দিন হিসেবে স্মরণীয় করে রাখার জন্য একটি আম্রবৃক্ষের সাথে বিয়ে দেন প্রিয়ংবদা-অনসূয়া সমেত শকুন্তলা। মনমরা হরিণশাবক তাঁদের পালিত সন্তান রূপেই বিবেচিত হয়। শকুন্তলা নিজে সাজসজ্জা পছন্দ করলেও কখনো গাছের জ্যান্ত ফুল ছিঁড়ে খোঁপায় দিতেন না, বরং গাছে ফুল ফুটলে উৎসবের তরঙ্গ বয়ে যেত শকুন্তলার মননে। গাছের গোড়ায় জল না দিয়ে কোনদিন জলপান করতেন না তিনি। অথচ আজ সারা দেশজুড়ে গাছ কাটার ধূম পড়ে গেছে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। কোন কোন ব্যক্তি/সংস্থার উদ্যোগে কিছু গাছ পোঁতা হলেও তাদের যত্নআত্তির কথা যেন কারোর মাথাতেই আসেনা।পতিগৃহে যাওয়ার দিনে বনের কাঁটাঝোপ, লতাগুল্ম শকুন্তলার কাপড় টেনে ধরে যেন বলে উঠতে চায়, যেও না সখি-আমাদের ছেড়ে যেও না। হরিণীর আর্ত চাহনি শকুন্তলার চোখ ভিজিয়ে দেয়। নিজের মতো সন্তানসম্ভবা হরিণীর নির্বিঘ্ন প্রসবের খবর না পাওয়া পর্যন্ত শকুন্তলার যেন স্বস্তি নেই। কোকিলের কুহূতান না শোনা পর্যন্ত শকুন্তলার পা সরে না। তাঁর কেবলই মনে হয়, অরণ্যদেবী বুঝি যাবার অনুমতি দেননি এখনো। কালিদাসের ভুবনমোহিনী প্রতিভা প্রকৃতির সন্তান শকুন্তলাকে প্রকৃতির সাথে অবিচ্ছেদ্য প্রীতির বাঁধনে বেঁধেছে। উপমা-রূপকের পথ ধরে কুমারসম্ভবেও ফিরে ফিরে আসে প্রকৃতির কথা, প্রাণের কথা, সহজ সরল যাপনের কথা। উপমার ছবি হয়ে ওঠে পুষ্পভর্তি লতার চলাফেরার জীবন্ত চিত্র-বর্ণন। প্রকৃতিকে নিজের অংশ হিসেবে ভাবতে পারতেন বলেই জনৈক বনবাসী রাজা দুষ্যন্তকে হরিণ মারতে নিষেধ করতে পারেন। আরও কিছু অমূল্য সাহিত্য সৃষ্টির দিকে আলোকপাত করা যাক। খেলাচ্ছলে হোক, শিকারের লোভেই হোক ব্যাধের হাতে ক্রোঞ্চবধের নির্মম কাহিনী বাল্মীকির শোকবিহ্বল কণ্ঠে শ্লোক হয়ে ফুটে ওঠে। অন্যদিকে কাদম্বরীতে বানভট্ট একদল মানুষের আত্মঘাতী অরণ্য বিনাশের নিন্দা করেছেন স্পষ্টভাবেই। শালিকলনাথের চোখে একটি গাছ হল ক্লান্ত পথিকের পরম আশ্রয়, যার নিচে বসে মায়ের আঁচলের মতো স্নেহ, স্নিগ্ধ ছায়া পায় পথিকবর। কবি ধর্মপালের মতে তৃণভোজী হরিণের কাছে তৃণভূমি হল মা। আর গাছপালা হল বন্ধু-বান্ধব, নিকট আত্মীয়। ধর্মের ভয় দেখিয়েও প্রকৃতি-মা কে রক্ষার কথা বলেছেন কেউ কেউ। লাঙল চালালে মাটির অনেক পোকামাকড় মারা যায় বলে ব্রাহ্মণের হলকর্ষণ নিষেধ করেছিলেন মনু। তাই বলে ঋষি যজ্ঞব্রত যজ্ঞসভায় পশুবলি দিতে কোনরকম কুণ্ঠা বোধ করেননি।নিসর্গনীতি নিয়ে শাস্ত্রবাক্যের শ্লোক/উপদেশ বা সংস্কৃত সাহিত্য এইভাবে পরিবেশের সাথে মানুষকে সম্পৃক্ত ও অন্তরঙ্গ করে তুলতে চেয়েছে। মাটি আমার মা, গাছ আমার বন্ধু পরমাত্মীয়, জল আমার অন্তরঙ্গ সত্তা, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব সহ সমগ্র প্রাণীকুল আমার বেঁচে থাকার শর্ত: এই সত্তায় মানুষের মনন জারিত হলে সমস্যার সমাধান অনেকাংশে হয়ে যায়। নিজেকে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ অংশ হিসেবে ভাবতে পারলে মুষ্টিমেয় মানুষের দ্বারা পরিবেশে ধ্বংসসাধনের বিরুদ্ধে সে প্রতিবাদের হকদারও হয়ে উঠতে পারে।পরিবেশ ধ্বংস করে আত্মতুষ্টি ও স্বর্গলাভের তীব্র নিন্দা করা হয়েছে পঞ্চতন্ত্রের গল্পে। যেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছে –গাছ কেটে বা পশু হত্যা করে মাটি ভিজিয়ে যদি স্বর্গে যেতে হয়, তবে নরক যাত্রার পথ কোনটা? গাছের ডালে ডালে পাখি, কোটরে পোকামাকড়, ফুলে ফুলে মৌমাছি প্রজাপতিকে আপন করে নিয়ে এক বৃক্ষের দাঁড়িয়ে থাকার কথা সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে পঞ্চতন্ত্রের গল্পে। পুণ্যলাভের পথ হিসেবে দিঘি জলাশয় খনন, সুসংহত বনসৃজনের কথা ধর্মকর্ম হিসেবেই পুরাণে গণ্য হলেও এই বোধটি আজকের দিনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। প্রয়োজন কেবল ধর্মের নামাবলি সরিয়ে নৈসর্গনীতির বোধকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে যুক্তিবাদী ভিতের ওপর দাঁড় করানো।এই আলোচনায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার। অর্থশাস্ত্রের সূনাধ্যক্ষ প্রকরণে হাতি ঘোড়া, কিছু জলচল প্রাণী ও নদী-পুকুর-খাল-সরোবরে জন্মানো মাছ, কোঁচ, জলকাক, হাঁস সহ ময়ূর ময়না ইত্যাদি পাখি সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। বনে পশুপাখি ধরা পড়লে তাদের জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়ার রাজাদেশও স্থান পেয়েছে অর্থশাস্ত্রে। বেশকিছু মঙ্গলসূচক পশু-পাখি সংরক্ষণের কথাও বলা হয়েছে এখানে। রাজাদেশ লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধান আছে অর্থশাস্ত্রে। যেমন বনে আগুন লাগানোর শাস্তি হিসেবে পুড়িয়ে মারর সুপারিশ করেছেন স্বয়ং কৌটিল্য। জীবন্ত পুড়িয়ে মারার বিধানকে বিরোধিতা করেও বলা চলে, প্রকৃতিসংহার অবশ্যই শাস্তিযোগ্য। এবং এক্ষেত্রে শাস্তির খাঁড়া সুতীক্ষ্ণ করতে হবে পরিবেশ সংহারের মূলহোতা হাঙ্গর কর্পোরেট বাহিনী ও তাদের সেবাদাস নানান কিসিমের সরকার প্রশাসনের দিকেই। অঙ্গুলি হেলন করতে হবে লুটেপুটে খাওয়ার জন্য পরিবেশ আইনগুলোকে পরিবর্তন করার নীল নকশার দিকেও। আসলে পাপপুণ্যের ভয় দেখিয়ে বা নরকবাসের আশঙ্কা জাগিয়ে, কিংবা আচার বিচার ও আত্মশুদ্ধির দোহাই দিয়ে, শাস্তির ব্যবস্থা করে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি বা দর্শন পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে মানুষের ভূমিকা সুনির্দিষ্ট করতে চেয়েছিল। এই বিষয়গুলোই আজকের সমাজ মননে প্রথিত করতে হবে যুক্তিবাদ ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর দাঁড়িয়ে।সেকালের প্রাচীন সাহিত্য: বেদ উপনিষদ এবং প্রাচীন কাব্য ও নাটক, বিশেষ করে সেকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী কালিদাসের সাহিত্য সৃষ্টি একালের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর ভীষণভাবে রেখাপাত করে। কবিগুরুর পরিবেশ ও নৈতিকতা সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা সহ তাঁর সমগ্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটা কেন্দ্রীভূত মূল সুর রয়েছে। এক অখণ্ড জীবন দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ বা সমগ্র বিশ্ব একটি পরিবারভুক্ত, এই বিশ্বমানবতার বোধ গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শনে। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতি ও মানুষ এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ‘অরণ্য দেবতা’ প্রবন্ধে কবি বলছেন –মানুষ অমিতাচারী। যত দিন সে অরণ্যবাসী ছিল ততদিন অরণ্যের সঙ্গে তার আদান-প্রদান ছিল। ক্রমে মানুষ যখন নগরবাসী হল, তখন অরণ্যের প্রতি মমত্ববোধও সে হারাল। মানুষ তার প্রথম সুহৃদ তরুলতাকে নির্মমভাবে নির্বিচারে ধ্বংস করে ইটকাঠ আর কংক্রিটের শহর গড়ে তুলতে মনপ্রাণ এক করল। রবীন্দ্রনাথ আরও লিখছেন –অরণ্য ধ্বংস ও বৃক্ষছেদনের ফলস্বরূপ ভারতবর্ষের উত্তর-অংশে গ্রীষ্মের উৎপাত মাত্রাছাড়া হয়েছে। সবুজ বৃক্ষ ও জঙ্গল বিনাশ করে মানুষ যেন দেশে মরুভূমি ফিরিয়ে আনবার উদ্যোগ নিয়েছে। কি অসম্ভব দূরদৃষ্টি। একশত বছর আগে রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে উঠে এসেছে আজকের দিনের ভয়ানক পরিবেশ বিপর্যয়ের স্পষ্ট চালচিত্র। বিপন্ন হিমালয় পৃথিবীর মানচিত্র থেকে উধাও হয়ে গেলে ভারত সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো রুখাশুখা মরুভূমি বই অন্য কিছু নয়।এই প্রবন্ধেই তিনি লিখছেন –“সেই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের আহ্বান করতে হবে বরদাত্রী বনলক্ষ্মীকে –আবার তিনি রক্ষা করুন এই ভূমিকে। দিন তাঁর ফল, দিন তাঁর ছায়া।” কবির উপলব্ধি –আধুনিক মানুষ বিলাসবহুল ও প্রদর্শনমূলক জীবনযাপনে নিদারুণভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্বমানবতার পূজারী রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বলোকে পরিব্যাপ্ত। তাই তিনি স্পষ্ট করে বলতে পারেন –“এই সমস্যা আজ শুধু এখানে নয়। মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে অরণ্যসম্পদকে রক্ষা করা সর্বত্রই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকাতে বড়ো বড়ো বন ধ্বংস করার ফলে এখন বালু উড়িয়ে আসছে ঝড়, কৃষিশস্যকে নষ্ট করছে, চাপা দিচ্ছে। ….. লোভী মানুষ অরণ্যকে ধ্বংস করে নিজেরই ক্ষতি ডেকে এনেছে। বায়ুকে নির্মল করার ভার যে গাছপালার উপর, যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিকে উর্বরতা দেয়, তাকেই সে নির্মূল করেছে” (অরণ্য দেবতা)। ‘শান্তিনিকেতন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন – “যে বিরাট প্রকৃতির দ্বারা মানুষ পরিবেষ্টিত, যার আলোক এসে তার চক্ষুকে সার্থক করেছে, যার উত্তাপ তার প্রাণকে স্পন্দিত করে তুলেছে, যার জল তার অভিষেক, যার অন্নে তার জীবন, …. ভারতবর্ষ সেই প্রকৃতির মধ্যে আপনার ভক্তিবৃত্তিকে সর্বত্র ওতপ্রোত করে প্রসারিত করে রেখে দিয়েছে।” তিনি বলছেন, এই বিশ্বপ্রকৃতির সাথে পবিত্র যোগেই ভারতবর্ষ নিজেকে বৃহৎ করে জেনেছে। আহা, প্রকৃতির সাথে মানবসত্তার কী অপূর্ব আত্মিক যোগ।পাশ্চাত্যের সাথে প্রাচ্য তথা ভারতের প্রকৃতিবোধ ও জীবনদর্শনের স্পষ্ট ফারাক তুলে ধরেছেন তিনি — “শেকসপীয়রের As You Like নাটক একটা বনবাস কাহিনী, টেম্পেস্টও তাই, Midsummer Night's Dream-ও অরণ্যের কাব্য। কিন্তু সে-সকল কাব্যে মানুষের প্রভুত্ব ও প্রবৃত্তির লীলাই একেবারে একান্ত –অরণ্যের সঙ্গে সৌহার্দ্য দেখতে পাইনে। অরণ্যবাসের সঙ্গে মানুষের চিত্তের সামঞ্জস্য সাধন ঘটেনি।”অথচ কালিদাসের শকুন্তলা নাটকের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। প্রকৃতিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শকুন্তলা’ প্রবন্ধে বলছেন – কালিদাস তাঁর অপরূপ কৌশল ও প্রতিভায় শকুন্তলাকে লীলা ও ধর্মের, স্বভাব ও নিয়মের, নদী ও সমুদ্রের ঠিক মোহনার উপর স্থাপিত করেছেন। তপোবনের প্রকৃতি বর্ণন সম্পর্কে তিনি উচ্ছ্বসিত। তাঁর মতে –তপোবনে স্বভাব এবং তপস্যা, সৌন্দর্য এবং সংযম সব মিলেমিশে একাকার। সেখানে সমাজের কৃত্রিম বিধান না থাকলেও ধর্মের কঠোর নিয়ম বিদ্যমান। শকুন্তলার সহজ সরল সুন্দর অথচ গভীর পবিত্রতা সম্পর্কে তিনি লিখছেন –“শকুন্তলাকেও ধূলা লাগিয়াছিল, কিন্তু তাহা সে নিজেও জানিতে পারে নাই। …. সে অরণ্যের চঞ্চলা মৃগীর মতো, নির্ঝরের জলধারার মতো, মলিনতার সংসর্গেও অনায়াসেই নির্মল।” এখানেই রবীন্দ্রনাথের মহত্ত্ব। তাঁর প্রকৃতিপ্রেম ভীষণ প্রগাঢ় ছিল বলেই ‘ধুলোলাগা মলিন শকুন্তলা’কে তিনি অনাবিল জলধারার সাথে, অরণ্যের সরলা হরিণীর সাথে তুলনা করতে পারেন। নদীর বুকে বড় বাঁধের অযৌক্তিকতা ও বিপদ সম্পর্কে বিজ্ঞানী ও নদী বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন ধরেই সরব। ২০২৩ সালে সিকিমে গ্ল্যাসিয়ার লেক আউটবার্স্টের কারণে তিস্তার উপর বড় জলাধার জলের তোড়ে উড়ে যাওয়া এবং কয়েকশ নাগরিকের মৃত্যু নদী বাঁধের বিপদ সম্পর্কে চিন্তাভাবনাকে নতুন করে উস্কে দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকের কথা আমাদের উল্লেখ করতেই হয়। তিনি প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি বা প্রবহমানতা রুদ্ধ করার বিপক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। প্রাকৃতিক জলধারার ওপর আমাদের সকলের সমান অধিকার, তাই এই জলধারার স্রোত বা গতিপথ পরিবর্তন করা অমার্জনীয় অপরাধ। তাই ‘মুক্তধারা’য় শেষ পর্যন্ত এই অপ্রয়োজনীয় বাঁধকে মুক্ত করে স্রোতকে তার নিজস্ব গতিতে বইতে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।এই নিবন্ধটিকে নির্দিষ্ট অক্ষরসীমার মধ্যে বাঁধতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি ভাবনার আরও নানান পরিচয়: একগুচ্ছ প্রবন্ধ, এমনকি ছোট গল্প বা কবিতার কথা অনুল্লিখিত থাকল। বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন পড়েছে যে, আধুনিক ভারতে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে প্রকৃতি ভাবনা, জীবনদর্শন এক উন্নত মাত্রা লাভ করেছে। এই ভাবনা গুলোকে সম্যকভাবে বুঝে নিয়ে আজকের স্থানকালের প্রেক্ষিতে প্রয়োগ করার মধ্য দিয়ে বিশ্বজোড়া প্রকৃতি বিপর্যয়ের সমাধানের তল পাওয়া সম্ভব বলেই মনে করি। বর্তমান যুগের সাহিত্যে, দর্শনে তথা জনমানসে পরিবেশ সংক্রান্ত যে আধুনিক রূপটি ফুটে উঠেছে, তা উল্লেখ করতে হলে সামনে আনতে হবে বর্তমান কালের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ও তার রূপকারদের। শুধুমাত্র উদাহরণস্বরূপ আমরা উল্লেখ করব চিপকো আন্দোলনের কথা। শ্রদ্ধেয় পরিবেশবিদ সুন্দরলাল বহুগুণা, যিনি হিমালয়কে হাতের তালুর মতো চিনতেন, প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন হৃদয় দিয়ে, যাঁর নেতৃত্বে উন্নয়নের অজুহাতে কয়েকশত গাছ কাটার বিরুদ্ধে উত্তরাখণ্ডের আদিবাসী জনগণের বুক দিয়ে গাছ আগলে রাখার আন্দোলন ৫০ বছর ছাড়িয়ে গেল। অথচ উন্নয়নের নামে, নগরায়ণের নামে সবুজ বনানী সহ হেক্টরের পর হেক্টর অরণ্য নিধন হয়েই চলেছে মহা সমারোহে। আজকের দিনের আরেকটি আন্দোলনের কথা সোচ্চারে বলতেই হয়। অবিরল নির্মল গঙ্গার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন জি ডি আগরওয়াল সহ একাধিক সাধুসন্ত। হরিদ্বারের কংখলে মাতৃসদন আশ্রমের সন্ন্যাসীরা জীবনপণ করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন হিমালয় ও গঙ্গাকে রক্ষা করার স্বার্থে, বিগত দশ বছর ধরে ‘নমোমী গঙ্গা’ প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা গঙ্গার জলে তলিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে, গঙ্গার ভয়ানক দূষণের বিরুদ্ধে। হিমালয়ের কথা এসে পড়লে লাদাখের আদিবাসীদের আন্দোলনের মুখ সোনম ওয়াংচুর কথা স্মরণ করতেই হয়। লাদাখ-কাশ্মীর সংলগ্ন হিমালয় সহ ভারতের বড় বড় নদী, সিন্ধু গঙ্গা অলকানন্দা ধৌলি ইত্যাদি বাঁচানোর লড়াইয়ে আজ প্রচুর মানুষ/সংগঠন এগিয়ে আসছে। এই আন্দোলন গুলিতে প্রাণ সঞ্চার করতে ভারতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি তথা জীবনদর্শনকে সামনে আনতে হবে অনেক বেশি করে, অবশ্যই যুক্তিনিষ্ঠ সত্যের উপর ভিত্তি করেই। ভোগ-সর্বস্বতা সম্পর্কে ‘বিলাসের ফাঁস’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ একটি প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য রেখেছেন – “এখনকার দিনে ব্যক্তিগত ভোগের আদর্শ বাড়িয়া উঠিয়াছে। এখন আহার পরিচ্ছদ, বাড়ি গাড়ি জুড়ি, আসবাবপত্র দ্বারা লোকে আপন মহত্ত্ব ঘোষণা করিতেছে। ধনীতে ধনীতে এখন এই লোভের প্রতিযোগিতা। আমাদের দেশে ইহাতে যে কতদূর পর্যন্ত দুঃখ সৃষ্টি করিতেছে, তাহা আলোচনা করিলেই বুঝা যাইবে।”‘আত্মপরিচয়’ গ্রন্থে নবীন রবীন্দ্রনাথের কলমে উঠে এসেছে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা। আত্মপরিচয় এর ভাষা বেশ কাব্যিক মনে হলেও ‘সুদূর বিস্তৃত শ্যামল অঙ্গ’, ‘আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে’, প্রকাণ্ড বৃহৎভাবে এই শব্দগুচ্ছ গুলোর মধ্য দিয়ে তিনি স্পষ্ট করেছেন বিপুলা বিশাল নৈসর্গিক প্রকৃতি তার সমস্ত রূপ -রস-গন্ধ নিয়ে মানুষের বৃহৎ প্রকাণ্ড শরীরকে (এক্সটেন্ডেড বডি) তৈরি করেছে। রক্তমাংসের ক্ষুদ্র শরীরের আরামের মোহে আমরা যতই অন্ধভাবে ছুটি না কেন, সেইটি নেহাতেই আত্মসর্বস্ব এক ক্ষুদ্র ভাবনা। তাই আমাদের আজ ভাবতে হবে অনেক বৃহৎ পরিসরে অনেক বড় পরিধিতে মননকে জারিত করে। ‘আপনা হতে বাইরে দাঁড়া’লে ‘বুকের মাঝে বিশ্বলোকের’ সাড়া মিলতে অসুবিধে কোথায়?ঋণস্বীকার: ১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রণীত – মেঘদূত, কালিদাস, অরণ্য দেবতা, শান্তিনিকেতন, মুক্তধারা, বিলাসের ফাঁস ও আত্মপরিচয়।২। প্রাচীন ভারতের পরিবেশ নীতি: সংস্কৃত শাস্ত্র সাহিত্যের দর্পণে –করুণাসিন্ধু দাশ।
  • হরিদাস পালেরা...
    চললুম ইর্ষাহীন দেবীর গৃহে - ১ - সমরেশ মুখার্জী | ২০১৯ এর মে মাসে চারধাম যাত্রার পীক সিজনে ৩৫ দিনের একাকী ভ্রমণে গেছি‌লাম উত্তরাখণ্ডে। ১৬.৫.১৯ কর্ণপ্রয়াগ থেকে গোপেশ্বর এসে কেদার-বদ্রী মন্দির কমিটির যাত্রী‌নিবাস খুঁজতে অনেকটা নেমে যেতে হয়েছিল। যাত্রীনিবাসে কাউকে না পেয়ে কিছুটা উঠে এসে একটা ছোট মুদীর দোকানের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রেকিং পোলে ভর দিয়ে একটু দম নিচ্ছি।  দোকানে বসে বছর পঁচিশের এক স্থানীয় তরুণী। আমার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকায়। দোকানে‌ খদ্দের নেই। দোকানের সামনে রাখা একটা প্লাস্টিক টুল দেখিয়ে বলি, একটু বসবো? সে বলে, হ‍্যাঁ, হ‍্যাঁ, বসুন না। আলাপ হয়। নাম তার অরুণা। ঐ দোকানের পিছনে ওরা চার সহপাঠী‌ মিলে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। আইন পড়ছে গোপেশ্বরে‌র কলেজে। দোকানটি বাড়ি‌ওলা মালকিনের। তিনি আশপাশে গেলে ওদের চারজনের কেউ একটু ঠেকনা দেয়। অরুণা সপ্রতিভ। জানতে চায়, কাউকে খুঁজছেন? বলি, রাত্রিবাসের জন‍্য মন্দির‌ কমিটি‌র যাত্রীনিবাসে এসেছি‌লাম কিন্তু কেউ নেই। অরুণা বলে, আমার কাছে লজ মালিকের নম্বর আছে। দাঁড়ান লাগাই। জানা গেল, এক স্থানীয় হোটেল ব‍্যবসায়ী মন্দির কমিটির থেকে যাত্রীনিবাসটি দীর্ঘমেয়াদী লিজে নিয়ে, আমূল সংস্কার করে ম‍্যারেজ হল বানিয়েছেন। কয়েকটি দ্বিশয‍্যা ঘর আছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে অতি‌থিরা থাকে। অনুষ্ঠান না থাকলে যাত্রীরা‌ও থাকতে পারে। তখন বিলকুল খালি তবু ভাড়া চাইলেন আটশো। মান অনুযায়ী বেশি নয়। তবে আমার বাজেটের বাইরে। তার অফার ব‍্যাক‌আপে রাখি। দোকানে‌র পাশেই একটা খোলা ছাদ দেখে মনে হয় প্ল‍্যান-বি এক্সপ্লোর করে দেখি। অরুণাকে জিজ্ঞাসা করি, ঐ ছাদটা কাদের? ও বলে, দোকান মালকিনের‌ই। এখন কিছু করার প্ল‍্যান নেই, পরে হয়তো ঘর উঠবে। বলি, আমার কাছে ছোট টেন্ট আছে। ওখানে কী টেন্ট পেতে রাতে থাকতে পারি? তার জন‍্য কিছু লাগলে দেবো। অরুণা বলে, আইডিয়া‌টা আপনার ভালো‌ই। একা বেড়াতে এসেছেন, দিনভর ঘুরবেন, শুধু রাতে শোয়ার জন‍্য আটশো টাকা কেন খরচ করবেন? পাততেই পারেন ওখানে টেন্ট। প‍রিস্কার কমন টয়লেট আছে। মালকিন খুব ভালো, মনে হয় আপত্তি করবেন না। পয়সা‌ও নিতে চাইবেন না মনে হয়। উনি এখন বাইরে গেছেন। এলে আমি বলবো। আপনি বসুন না। বলি, তুমি‌ও খুব ভালো, না হলে অপরিচিত কারুর জন‍্য আজকাল কেউ এতো ভাবে না। আমি আশপাশে আর একটু দেখি, কিছু না পেলে তোমায় যোগাযোগ করবো। তোমার ফোন নম্বর দাও। আমারটাও রাখো। যদি মালকিন রাজী হন, জানি‌য়ো। ফোন নম্বর এক্সচেঞ্জ করে  চলে আসার আগে বলি, জানো তো, আমার দিদির নাম‌ও অরুণা। তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো‌। সরল হাসে অচেনা অরুণা। একটু বাদে গোপীনাথ মন্দিরের সন্তকুটীরে ওখান‌কার ASI ইনচার্জ কেদারনাথজীর সৌজন্যে নিখরচায় রাত্রি‌বাসে‌র ব‍্যবস্থা হয়ে যায় (এই সিরিজের ৪নং পর্বে সে বৃত্তান্ত আছে)।  অরুণাকে ফোন করে বলি, গোপীনাথ মন্দিরে থাকার ব‍্যবস্থা হয়েছে। তুমি যে ভরসা দিয়েছিলে তার জন‍্য অনেক ধন্যবাদ। ভালো থেকো।বাড়ি থেকে বেরোবার আগে হোম ওয়ার্ক করে জানতাম  অনসূয়া দেবী মন্দির যেতে হলে গোপেশ্বর থেকে চোপতা‌র পথে ১৬কিমি দুরে বাসে বা শেয়ার জীপে মন্ডল গ্ৰামে যেতে হবে। ওখান থেকে অনসূয়া দেবী মন্দির ৫ কিমি হাঁটা‌পথ। মন্দির থেকে অত্রি মুনীর গুহা আরো ২ কিমি। সেখান থেকে জঙ্গলে‌র পথে পঞ্চকেদারের দুর্গম‌তম রুদ্রনাথ যাওয়ার একটা রাস্তা আছে বটে তবে ও পথে একা যাওয়া উচিত নয়। আমার এবারের ভ্রমণগন্তব্যে‌ও নেই তা।  তখন চারধাম যাত্রার পীক সিজনে রুটের অনেক প্রাইভেট বাস, শেয়ার জীপ উঠে গিয়ে রিজার্ভে চলছে। তার এফেক্ট হরিদ্বার থেকে ভুগছি। ভুল হয়ে গেছে যাত্রা সিজনে এসে। আমি যখন তীর্থযাত্রী ন‌ই, তখন দশেরার পর এলে এতো ভীড় থাকতো না, নির্ঝঞ্ঝাটে ঘোরা যেতো। বহু গাড়ি চলাচলে আকাশ‌ তখন ধূলিধুসরিত ঘোলাটে‌ও হোতো না, পরিস্কার নীল আকাশ পাওয়া যেতো। ছবি উঠতো সুন্দর। একটু ঠান্ডা বেশী হোতো এই যা। পরদিন গোপীনাথ মন্দিরের পালোয়ান চৌকিদার রামপ্রসাদের সাথে কথা বলে জানা গেল ১১টার আগে ওপথে শেয়ার জীপ যায় না। ও বলে, এক কাজ করতে পারেন, নটা নাগাদ লোয়ার বাজার চকে GMVN GH এর সামনে থেকে জড়িবুটি সংস্থা‌র স্টাফদের জন‍্য একটা মিনিবাস যায়। ড্রাইভার পিছনের সীটে পাঁচজনকে ওঠায়, কুড়ি‌টাকা করে নেয়। যদি ওতে জায়গা পান সবথেকে ভালো, নাহলে ১১টার শেয়ার জীপে যেতে হবে। জীপগুলো যায় তো লোয়ার বাজার হয়েই কিন্তু ওখানে সীট পাবেন না। তার জন‍্য আপার বাজারে যেতে হবে। ওখান থেকেই ভর্তি হয়ে ছাড়ে।রামপ্রসাদ যেটা‌কে জড়িবুটি সংস্থা বললো সেটা আসলে ১৯৮৯ সালে স্থাপিত Herbal Research and Development Institute (HRDI), an autonomous and Nodal Agency under Uttarakhand State Medicinal Plant Board. মণ্ডলে তার প্রধান কর্মকেন্দ্র ও হেডঅফিস।বিকেলে মার্কেট চকে যাই রামপ্রসাদের খবরটা যাচাই করতে। কন্ডাক্টেড ট‍্যূরে গেলে এসব নিয়ে ভাবার দায় নেই ভ্রামণিকের। সে দায় সঙ্গে যাওয়া পরিচালকের। তবে জনবাহনে, লো-বাজেট একাকী ভ্রমণে কয়েক‌বার ধাক্কা খেয়ে এসব প্রয়োজনীয় তথ‍্য একবার অন্ততঃ আর একটি সোর্স থেকে যাচাই করা অভ‍্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। কেউ জেনেবুঝে মিসগাইড করে না। তবে তার কিছু ভুল হলে অযথা সময় নষ্ট, হয়রানি হয়। কয়েক‌বার নিজবাহনে বৌ, ছেলে বা বন্ধুদের সাথে দীর্ঘ ভ্রমণে গেছি ২/৩/৪/৬ জন মিলে। একমাস ধরে আমার পুঁচকে মারুতি‌তে চার বন্ধু ঘুরেছি কর্ণাটক, অন্ধ্র, কেরালায় ৩৭০০ কিমি। তখন‌‌ও গুগলম‍্যাপ নির্দেশিত পথ মাঝেমাঝে স্থানীয়‌দের থেকে যাচাই করে নিয়েছি। কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় ফিডব্যাক হেল্প করে। তখন কয়েক‌বার ম‍্যাপের ডিরেকশন উপেক্ষা করে অন‍্য পথে গেছি। ২০২২এর আগস্টের শেষে ব‍্যাঙ্গালোর থেকে হাওড়া এসেছিলাম সিকি শতাব্দী কনিষ্ঠ বন্ধু‌পূত্র বন্ধু তপুর সাথে ওর ফোর্ড ইকোস্পোর্ট গাড়িতে। সরাসরি ইস্ট কোস্ট হয়ে এলে ১৮৫০ কিমি। ঘুরেফিরে আসবো বলে আমি প্ল‍্যানটা করেছি‌লাম ৩১০০ কিমি‌র। ৩০শে আগস্ট আসছিলাম তেলেঙ্গানার ওয়ারাঙ্গল থেকে ছত্তিশগড়ের জগদলপুর - ৪১০কিমি। পথে এক জায়গায় বৃষ্টির মধ‍্যে ছাতা মাথায় দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে। আগে কোথাও হাঙ্গামা হচ্ছে। রাস্তা আটকেছে লোকজন। পুলিশ জানতে চায় কোথায় যাবো। জগদলপুর শুনে বাঁদিকে‌র রাস্তায় যেতে বললো। তাহলে ঝামেলা বাইপাস করে যেতে পারবো।সে এক জনমানবহীন পাহাড়ি পথ। শেষ বিকেলের মরা আলো। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। যেন অপার্থিব ল‍্যান্ডস্কেপ। আমি গাড়ি চালাচ্ছি। তপু আশপাশে দেখে বলে, কাকু, এসব জায়গায় গাড়ি খারাপ হলে তো ফুল কেলো, বলো? বলি, ২০১৭তে কেনার পর গাড়ি তোর বত্রিশ হাজার কিমি‌ও চলেনি। ফোর্ড সার্ভিস সেন্টার থেকে ফুল সার্ভিস করিয়ে টিপটপ অবস্থায় বেরোলাম ব‍্যাঙ্গালোর থেকে, হঠাৎ তোর গাড়ি খারাপ‌ই বা হতে যাবে কেন? এতো আনরিলায়েবল তো নয় ফোর্ডের গাড়ি। কোথায় এনজয় করবি পথটা, তা না এসব অলুক্ষুণে ভাবনা আসছে কেন তোর মাথায়? খারাপ হলে, যা হবার হবে, যা করার করতে হবে। শুধুশুধু ভেবে কী লাভ। পুলিশ না পাঠালে এ পথে আসতাম আমরা? তপু, বলে, তা অবশ‍্য ঠিক, দারুণ জায়গাটা।দুদিন পর জগদলপুর থেকে বেরিয়ে গুগল ম‍্যাপ অনুযায়ী ভেবেছিলাম কোরাপুট থেকে সটান NH-326 ধরে লামতাপুট, কাকিরিগুমা, রায়গড়া হয়ে চলে যাবো টিবেটান সেটলমেন্ট - ওড়িশার মিনি ধরমশালা - চন্দ্রগিরি - ৩৬০ কিমি। কিন্তু পুরোনো অভ‍্যাসে কোরাপুটে নেমে চা খেতে গিয়ে দোকানে গুগলম‍্যাপ দর্শিত পথ কনফার্ম করতে গেলাম। জানতে পারলাম কাকিরিগুমা‌র আগে কোথাও বন‍্যায় রাস্তা খারাপ হয়ে গেছে। গাড়ি যেতে‌ও পারে, নাও পারে। চান্স না নিয়ে NH-26 ধরে ২০ কিমি ঘুরে গিয়ে NH-326এ উঠলাম কাকিরিগুমায়। কিন্তু তার ফলে পূরণ হোলো অনেকদিনের একটা ইচ্ছে।৯১তে L&T তে জয়েন করে কিছু সহকর্মীদের কাছে শুনেছিলাম দমনজোড়ি প্রকল্প নির্মাণ‌কালের কিছু অভিজ্ঞতা। কোরাপুট জেলায় পূর্বঘাট পর্বতমালার ছবির মতো সবুজ সুন্দর উপত্যকায় শুরু হয়েছিল NALCO’র প্রথম এ্যালুমিনা প্ল‍্যান্ট। ঐ প্রকল্পে বড় কাজের অর্ডার পেয়েছি‌ল L&T. তখনকার সেই বিরান জায়গায়, অনেক নাগরিক সুবিধা‌হীন জীবনের অসুবিধা সহ‍্য করে‌ বহু নির্মাণ‌কর্মী‌রা একদম শুরু থেকে গড়ে তুলেছিলেন প্ল‍্যান্ট, টাউনশিপ। ইচ্ছে ছিল বহু মানুষের পরিশ্রমের ফল কী হয়েছে দেখা‌র। পঁয়ত্রিশ বছর পর শান্ত, সুন্দর NALCO’র দমনজোড়ি টাউনশিপ দেখে বেশ লাগলো।  চলার পথে ওড়িশার পূর্বঘাট পর্বতমালার পাহাড়ি অঞ্চলের পাদদেশে বর্ষার জলে পুষ্ট অনামা জলাশয় দেখে ভাইপো চলন্ত গাড়িতে আহা উহু করে ওঠে  - কী দারুণ জায়গা গো! চল তাহলে যাই জলের কাছে - বলে কাকু পথ ছেড়ে গাড়ি নিয়ে নেমে পড়ে জলের কিনারায়। তপুর লাল কছুয়া একটু বিশ্রাম নেয়। কাকু দুর থেকে সেই সুন্দর নিসর্গের স্নিগ্ধতা উপভোগ করে। ভাইপো একদম জলের কাছে গিয়ে খানিক ভাবুক হয়ে যায়। কে জানে, হয়তো বর্ষার জমা জলে কাগজের নৌকা ভাসানোর কথা মনে আসে। খানিক পরে দুর থেকে কাকু হাঁক পাড়ে, কী রে, জলের কাছে গিয়ে একেবারে জমে গেলি যে - আয়, যেতে হবে তো আজ বহুদূরে।  ভাইপো জলের ধার ছেড়ে পা টেনে টেনে আসে - (সবুজ তীর) হয়তো জায়গাটা ভালো লেগে গেছে ওর। তাই যেতে মন চাইছে না। গাড়িতে ঘুরলে, ট‍্যাংকে তেল থাকলে, এই ধরণের কিছু অপরিকল্পিত ডিট‍্যূর‌ও পার্ট অফ দ‍্য ট‍্যূর। বেশ লাগে। অবশ্যই কোথাও পৌঁছনোর তাড়া না থাকলে। কিন্তু এখন অনসূয়া দেবী যাত্রপথ থেকে সরে গেছি বহু দূরে। ফিরে আসি সেখানে।মার্কেট চকে এক বড় সবজির দোকানী বলেন ছুটির দিন ছাড়া এখানেই বাসটা এসে দাঁড়ায় মিনিট দশেক। সোয়া নটায় ছেড়ে যায়। তার মানে রামপ্রসাদের খবর পাক্কা। একা অনসূয়া দেবী যাবো শুনে কেদারনাথজী একটু চিন্তিত মুখে বলেছিলেন, সিরোলি গাঁ‌ওয়ের পর শেষ  দু কিমি একদম বিরান,  জঙ্গলের মধ‍্যে দিয়ে পথ। মাঝে মধ‍্যে ওখানে বিকেলে‌র দিকে লেপার্ড দেখা গেছে শুনেছি। দলে বা মেলার সময় গেলে ঠিক আছে, কিন্তু একদম একা যাবেন? শুনে একটু দমে গেছিলাম। ভেবে এসেছি‌লাম, অনসূয়া দেবী মন্দির ও অত্রি মুনীর গুহা অবধি যাবো। আমার নিভে যাওয়া মুখভাব দেখে কেদারনাথজী  বলেছিলেন, শেষ বিকেলে ও পথে গেলে একটু চিন্তা‌র বিষয়। তবে আপনি সকালে এখান থেকে র‌ওনা হলে জীপে মণ্ডল গিয়ে ওখান থেকে যতো আস্তে‌ই দেখতে দেখতে যান, একটা‌র আগেই মন্দিরে পৌঁছে যাবেন। সিরোলি‌তে না হয় একটু অপেক্ষা করবেন, আর কেউ গেলে একসাথে যাবেন। নয়তো গাঁয়ের কাউকে শখানেক টাকা বখশিশ দিলে আপনাকে মন্দিরে ছেড়ে দিয়ে আসবে। দিনের বেলায় অতো ভয়ে‌র কিছু নেই। ভেবেছেন যখন, মাতাজী‌র নাম নিয়ে ঘুরে আসুন। রাতে তো ওখানেই থাকবেন বলছেন। তাহলে পরদিন একটু রোদ উঠলে, আটটা‌র পর নামবেন।সবজির দোকানে দেখা হয় অরুণা‌র সাথে। বলি, তোমার বাড়ি‌ তো বলেছিলে মন্ডল গাঁ‌ওতে‌, পড়াশোনা‌র জন‍্য এখানে এসে আছো, একটা কথা জানতে চাই। কাল অনসূয়া দেবী যাবো ভাবছিলাম। কিন্তু গোপীনাথ মন্দিরের ইনচার্জ বললেন ও পথে নাকি মাঝেমধ্যে লেপার্ড দেখা গেছে, একা যাওয়া কী উচিত হবে, তুমি কী বলো? অরুণা বলে, উনি ঠিক‌ই বলেছেন, আমি‌ও শুনেছি কয়েকবার গুলবাঘ দেখা গেছে ওদিকে, একলা যাওয়া ঠিক নয়, তাছাড়া বেশ চড়াই, থক জায়েঙ্গে আপ।  অরুণা‌র কথা শুনে আরো দমে যাই। রাতে গোপীনাথ মন্দির চত্বরে নন্দ‌ন মহারাজের ঠেকে তরুণ নাগা সন্ন্যাসী‌র রাঁধা রুটি, এঁচোড়ের তরকারি খাচ্ছি‌লাম। তীক্ষ্মদৃষ্টির বাবা বলেন - কী হোলো, আপনাকে একটু ম্রিয়মাণ লাগছে কেন? বললুম ভেবেছি‌লাম অনসূয়া দেবী মন্দির যাবো। কিন্তু গুলবাঘের ভয়ে চুপসে গেছে মনোবল। বাবা বলেন, যাবেন ভেবে এসেছেন যখন, মাতাজীর নাম নিয়ে ঘুরে আসুন। গুলবাঘ থাকলেও দিনদুপুরে ওরা লোকসমক্ষে আসে না। দুনিয়ায় মানুষ‌ই সবথেকে হিংস্র প্রাণী। জঙ্গলে‌র পশুরা‌ও তা বোঝে। তাই মানুষ‌কে ওরা সচরাচর এড়িয়ে‌ই চলে। কিচ্ছু হবে না, বে ফিকর মাতাজীকী দর্শন করকে আ‌ইয়ে। বাবার আশ্বাসে ভরসা পাই। পরদিন HRI বা জরিবুটি সংস্থার বাসটি ঠিক সময়ে এলো। ঠিক সময়ে ছেড়েও দিল। বেশ কিছু সীট খালি ছিল। পিছনে জানলার ধারে বসলুম। গোপেশ্বর থেকে চোপতার পথে কিছুটা যেতে সকালের উজ্জ্বল আলোয় ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া জমি‌তে চাষবাস, গোপেশ্বরের হালকা হয়ে আসা জনপদ, দুরে নীচে বালখিল্য নদীর খাত … চারপাশে এহেন সব মন ভালো করা দৃশ‍্যে মন থেকে মিলিয়ে যায় গতরাতে‌র গুলবাঘের আশাংকা। বাসটি আমায় মন্ডলে নামিয়ে চলে গেল ২ কিমি আগে HRI.  (চলবে)
    হিন্দু মুসলমান -- একটি অ-জনপ্রিয় আলোচনা - Partha Banerjee | যে আলোচনা অনেকেই হয়তো এই মুহূর্তে করতে চাইবেন না।  কিন্তু আমি যেহেতু আর দশ দিন পরেই পৃথিবীর উল্টোদিকে ফিরে যাবো, এবং আমাকে অনেকেই ভুলে যাবেন (সেন্টিমেন্টাল কথা নয়, জীবনের অভিজ্ঞতার কথা), তাই এ কথাগুলো আমাকে বলতেই হচ্ছে। গতকাল থেকে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। রেখা পাত্রর (বা ঐরকম দেখতে কারোর) একটি ভিডিও পোস্ট করেছে কিছু লোক, যাতে দেখা যাচ্ছে তিনি বাসন মাজছেন নিজের বাড়িতে। এবং সেই ভিডিওর সঙ্গে অশ্লীল, কুৎসিত নানা মন্তব্য।  আমি তার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম, কারণ আমার মনে হয়েছিল রাজনৈতিক ভাবে তীব্র বিরোধিতা করা এক জিনিস, এবং একজন নারীর সম্মান নষ্ট করা আর এক জিনিস।আমার নিজের ফেসবুক পেজে আমি এই ভিডিও শেয়ার করেছিলাম, এবং লিখেছিলাম, "রেখা পাত্র নিজের বাড়িতে বাসন মাজছে, এই নিয়ে একশ্রেণীর টিএমসি এবং মুসলমান ব্যক্তি নোংরা কুৎসিত কথাবার্তা পোস্ট করে যাচ্ছে, এবং আমি প্রতিবাদ করাতে আমাকেও কুৎসিত নোংরা গালাগালি দিচ্ছে। রেখা পাত্রের দুনম্বরি রাজনীতির আমরা তীব্র বিরোধিতা করবো, কিন্তু মহিলা হিসেবে তার গৃহকর্মকে ও নারীত্বকে আমরা অপমান করতে পারিনা।"এই প্রতিবাদ জানানোর পর থেকে *এক শ্রেণীর* মুসলমান ব্যক্তি আমাকে কুৎসায় ও ব্যক্তিগত আক্রমণে জেরবার করে তুলেছে। আমি কেন *মুসলমান* শব্দটি ব্যবহার করেছি। *এক শ্রেণীর* কথাটাই তারা বোঝেনি, বা বুঝতে চায়নি। এবং তারপর যথারীতি তারা এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে (১) আমি চিরকালই মুসলমান-বিদ্বেষী, (২) আমি এখনো আরএসএস'এর "মোল" (অর্থাৎ লুকোনো এজেন্ট), এবং (৩) আমার "আসল উদ্দেশ্য" তারা এখন বুঝে গেছে।এদের কয়েকজন আমারই ফেসবুকে বন্ধু সেজে থেকেছে, এবং আমি কী লিখি, কী বলি তা ফলো করেছে। কিন্তু আমার একটানা উগ্রপন্থী হিন্দুত্ব-বিরোধী কাজকর্ম, লেখালেখি, ইউটিউব আলোচনা অথবা বইপত্র -- কোনোটাই তাদের মনে কখনো কোনো রেখাপাত করেনি।একজন আবার আমাকে "মার্কিনি সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক"ও বলেছে, কিন্তু সে বা তার বন্ধুরা আমার "আমেরিকা স্বপ্নপুরী না হত্যাপুরী?" বইটা পড়েনি। ৯/১১'এর পরে আমি কীভাবে আমেরিকার রাস্তায় নেমে শাসকবিরোধী কাজ করেছিলাম (যার প্রধান বেনিফিশিয়ারি ছিল মুসলমানরা), বা আমার যুদ্ধবিরোধী কাজ -- এরা কিছুই জানেনা বা জানতে চায়না।এরা -- ফ্যানাটিক হিন্দু, মুসলমান বা খ্রিস্টান -- নিজেদের বই ছাড়া কিছুই পড়েনা।এই কথাগুলো লেখার উদ্দেশ্য হলো, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও নারীবিদ্বেষী ফ্যানাটিক হিন্দুত্ববাদী বিজেপি-আরএসএসের বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে উগ্র সাম্প্রদায়িক ও নারীবিদ্বেষী এই ফ্যানাটিক মুসলমান শ্রেণীর সমান বিরোধিতা আমাদের করতে হবে। না হলে আমাদের কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা সমাজে থাকবে না। এমনিতেই বহু মানুষ আন-ব্যালেন্সড অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ আমাদের মতো তথাকথিত "প্রগতিশীল"দের বিরুদ্ধে আনেন। এবং তার উত্তর আমরা সঠিকভাবে কখনো দিতে পারিনি।আমার কথা ছেড়ে দিন -- আমি এক অকিঞ্চিৎকর ব্যক্তি। বিজেপিরা আমাকে খুনের হুমকি দিয়েছে একাধিকবার, আমার বাবা-মা'কেও ছাড়েনি, এবং তাদের অনেকেই আমাকে "মুসলমান" ও "চটিচাটা" জাতীয় শব্দেই সম্বোধন করে থাকেন। মাংকি ব্রিগেড মুসলমান বলে, আর সিপিএম বলে চটিচাটা। এবারে তার সঙ্গে যুক্ত হলো ফ্যানাটিক কিন্তু বন্ধু সেজে থাকা এই শ্রেণীর মুসলমান। যারা বিন্দুমাত্র সমালোচনা দেখলেই প্রচণ্ড ক্ষেপে ওঠে। এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ শুরু হয়। আসল প্রশ্ন হলো, আমরা নিজেরা সাম্প্রদায়িকতা, অশিক্ষা, বিজ্ঞানবিরোধিতা ও নারীবিদ্বেষের বিরুদ্ধে কতটা সমানভাবে লড়াই করে যেতে পারছি, এবং ভবিষ্যতে আমাদের অবস্থান কী হবে?  কোন সমাজ আমরা রেখে যাচ্ছি? _________________________
    তোমার বাস কোথা যে...-৫ - Nirmalya Nag | ।। পাঁচ ।। [এই কাহিনীর সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবীত বা মৃত কোনো ব্যক্তির সাথে কোনও মিল যদি কেউ খুঁজে পান তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়। ]অরুণাভর টেস্টগুলো হওয়ার পর কেটেছে দু-তিন দিন। টেস্টের সময়ে বিনীতা হাসপাতালে ছিল, আজ অরুণাভর রিপোর্টগুলো নিয়ে ফেরার কথা। বিনীতার প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিল হয় সে নিজে যাবে বা বিকাশকে পাঠিয়ে আনিয়ে নেবে। নিজে কাজ ফেলে ২৮-৩০ কিলোমিটার যাতায়াত করবে রিপোর্ট আনার জন্য, সেটা বিনীতার বিশ্বাস হয়নি। যেভাবেই হোক, সেগুলো নিয়ে বাড়ি এলেই ধন্য হয়ে যাবে বিনীতা। আজকাল তার মেজাজ একটু খিটখিটে হয়ে আছে। স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছে সে, পারছে না। ডাইনিং টেবিলে বসে সন্ধ্যাবেলায় রঙিনকে পড়ানোর সময়ে বিনীতা বুঝতে পারছিল পড়ানোয় মন নেই তার। রিপোর্টগুলো এলে ফের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। মেয়েকে অঙ্ক করতে দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ দেখছিল সে, সেটাও খুব একটা মন দিয়ে নয়। এর মধ্যে গায়ত্রীর ফোন এল।“টেস্টের রিপোর্ট পেলি?” জিজ্ঞাসা করল গায়ত্রী।“এখনও পাইনি, আজ নিয়ে আসবে বলেছে। দেখি আনে কি না,” বলল বিনীতা।“ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিস?”“না, রিপোর্ট আগে হাতে আসুক।”“ঠিক আছে, কাল স্কুলে আসছিস তো?”“মনে তো হয়। অ্যাপয়েন্টমেন্ট তো পেতে হবে ডাক্তারের। কালই পাওয়া যাবে কি না জানি না। পেলে যাব না।”“ঠিক আছে। রিপোর্ট পেলে জানাস,” বলে ফোন কেটে দেয় গায়ত্রী, সহকর্মী হলেও যাকে বিনীতা সব চেয়ে কাছের বন্ধু বলে মনে করে।অঙ্ক করা বন্ধ করে মায়ের ফোনের কথা শুনছিল রঙিন। বিনীতা ফোন কাটার পরে জিজ্ঞাসা করল, “তোমরা কি আবার যাবে ডাক্তারের কাছে?”“হ্যাঁ, বাবার টেস্ট রিপোর্ট পাওয়া যাবে, তারপর।… বিশালের বার্থডের দিন এই ডক্টর আঙ্কলও এসেছিলেন, জানো তো?”“তাই? কী করে জানলে?”“আগের দিন যখন আমরা গেছিলাম সেদিন উনিই বললেন। তোমাকেও দেখেছেন, বললেন সাদা ড্রেস পরেছিলে।”“আমরা বেলুন নিয়ে খেলছিলাম। একটা আঙ্কলের গায়ে বেলুন লাগল, আমায় বেলুনটা দিল, নামও জিজ্ঞেস করল”“উনিই তো,” বলল বিনীতা।“তুমি দেখেছিলে?”মেয়ের সরল প্রশ্নে বিনীতার অস্বস্তি হল, আর অস্বস্তির কারণ বুঝতে পেরে নিজের ওপরেই রাগ হল তার। উত্তর না দিয়ে রঙিনের খাতা টেনে নিয়ে দেখতে লাগল সে। অঙ্কে ভুল দেখে রাগটা গিয়ে পড়ল মেয়ের ওপর।“কী করেছ এটা? টুয়েন্টি-ফাইভ আর থার্টি-ফোর অ্যাড করে ফিফটি-এইট হল কী করে? অ্যাডিশন নতুন করছ না কি? লেখাপড়ায় যদি এতটুকু মন থাকে! ফ্রেশ করে কর।”“পরে করব।”“পরে করব মানে? এখনই করবে। গাদা গাদা ভুল করবে, আর ঠিক করতে বললে পরে করব। কর।”রঙিন মুখ ব্যাজার করে মাথা নিচু করে বসে থাকল হাতে পেনসিল নিয়ে।বিনীতার রাগ কমল না। “কী হল? করছ না কেন?” ধমক দিল মেয়েকে।রঙিন কেঁদে উঠে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। সে জানে বিসার কাছে গেলে আদর পাওয়া যাবে।“রঙিন, রঙিন… এদিকে এস।” ডাকল বিনীতা। মেয়ে এল না। একটু পরে বিসপাতিয়া ভুলিয়ে ভালিয়ে ওকে নিয়ে আসবে। বিনীতার রাগ হতাশায় পরিণত হয়। টেবিলে কনুই আর কপালে হাত রেখে বসে থাকে সে, চোখ অঙ্ক খাতার দিকে থাকলেও দৃষ্টি তার শূন্য। বাইরে গাড়ি এসে থামার হালকা শব্দ শোনা যায়, তার পর কলিং বেল বাজে। বিসপাতিয়া গিয়ে দরজা খুলে দেয়। অরুণাভ ফিরল। ড্রইং রুম থেকে এসে শোবার ঘরের দিকে যাওয়ার পথে ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায় সে।“টেস্টের রিপোর্টগুলো পেয়ে গেছি,” বলল অরুণাভ।বিনীতা যেমন চুপ করে বসে দিল তেমনই থাকে, কেবল মুখটা ঘোরায় স্বামীর দিকে।“কাল যাব ডাক্তারের কাছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছি,” অরুণাভ বলে।অরূণাভ নিজেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে এটা ভেবে অবাক হয় বিনীতা। তবু হ্যাঁ না  কিছুই বলে না সে, মুখ ফিরিয়ে আবার খাতার দিকে চোখ রাখে। ভাবতে থাকে কাল সে কী করবে। অরুণাভর সাথে ডাক্তার ইন্দ্রনীল বিশ্বাসের কাছে যাবে, না কি যাবে না। স্ত্রীর হাবভাব দেখে স্বামীর কী মনে হয় কে জানে। সে বলে, “অত চিন্তা ক’র না, আমার তেমন কিছু হয়নি।”ফোন বেজে ওঠে অরুণাভর। “হ্যাঁ রামাকৃষ্ণানজী, বলুন…,” কথা বলতে বলতে শোবার ঘরের দিকে চলে যায় অরুণাভ। বিনীতা যেমন শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, তেমনই থাকে। কী একটা বড় প্রোজেক্ট হাতে নিয়েছে বলছিল, সেটার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই কি অরুণাভ নিজেই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করেছে? গায়ত্রীকে ফোন করার কথা মনে থাকে না তার। আবার মনে হয় কাল অরুণাভর সঙ্গে যাবে কি না। গেলে ডক্টর বিশ্বাস আবার ওকে নিয়ে কিছু বলবেন না তো? কিন্তু আগের দিনও তো তেমন কিছু বলেননি। ফালতু যত ভাবনা মাথার মধ্যে ঢুকে বসে আছে। ডাক্তারবাবু যদি সেদিনের পার্টিতে ওকে বার বার দেখেও থাকেন তাতে কী এসে গেছে? চৌত্রিশ বছর বয়স হয়েছে বলে সে তো আর বুড়ি হয়ে যায়নি। আজকাল তো কত মেয়ের বিয়েই হয় এই বয়সে। সে যাবে, অবশ্যই যাবে কাল অরুণাভর সঙ্গে হাসপাতালে, সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় বিনীতা। রঙিনের হাত ধরে বিসপাতিয়া আসে। মেয়ে চেয়ারে বসলে বিনীতা নরম গলায় বলে, “অঙ্ক এখন থাক, এস আমরা অন্য কিছু পড়ি। আবোলতাবোল?” প্রিয় বই-এর নাম শুনে মেয়ের চোখমুখ উজ্বল হয়ে ওঠে।“যাও, নিয়ে এস বইটা।”সুকুমার রায়ের ছড়ার বই আনতে মেয়ে নিজের ঘরে যায়। বিসপাতিয়াও ফিরে গেছে রান্না ঘরে। বিনীতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ***পরের দিন চেম্বারে বসে সিটি অরুণাভর স্ক্যান রিপোর্ট, এম আর আই রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখছে ইন্দ্রনীল। তার সামনে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রয়েছে, অরুণাভই আজ ওপিডির শেষ পেশেন্ট। দেখা শেষ হলে পেশাদারী গাম্ভীর্য নিয়ে ইন্দ্রনীল বলল, “টিউমারটা মাঝারি সাইজের। সার্জারি করতে হবে, বায়োপ্সি করে দেখতে হবে ম্যালিগন্যান্ট কি না। তারপর কেমোথেরাপি, তারপর পরিস্থিতি বুঝে অন্য ব্যাবস্থার কথা ভাবা যাবে। সার্জারির ব্যাপারটা দু-তিন দিনের মধ্যে করে ফেলতে পারলে ভাল হয়। সেটা কি পসিবল হবে?”“এত তাড়াতাড়ি?” জিজ্ঞেস করল বিনীতা?“হ্যাঁ ম্যাডাম, অ্যাজ কুইক অ্যাজ পসিবল করে ফেলতে হবে। টাকা পয়সার ব্যাপারটা আপনারা মাধুরীর সঙ্গে কথা বলে জেনে নিন। ইনসিওরেন্স থাকলে সেটার ডিটেলসও জানিয়ে দেবেন। আমি মাধুরীর নম্বর প্রেসক্রিপশনের উল্টোদিকে লিখে দিচ্ছি। রিশেপশন থেকেও জেনে নিতে পারেন কোথায় উনি বসেন।”এতক্ষণে মুখ খুলল অরুণাভ, “অপারেশনের পর ক’দিন ভর্তি থাকতে হবে?”“ধরে নিন পাঁচ-ছয় দিন। তখনকার কন্ডিশনের ওপর ডিপেন্ড করছে।”“তাহলে আমার আর একটু সময় চাই।”“নিন, তবে বেশি নয়। দু-তিন দিনের জায়গায় চার-পাঁচ দিন ম্যাক্সিমাম। প্রতিটা দিনই এখন ইমপরট্যান্ট,” বলল ডাক্তার।প্রেসক্রিপশন লিখে দিল ইন্দ্রনীল, কী কী ওষুধ খেতে হবে জানিয়ে দিল। মন দিয়ে শুনে নিল বিনীতা।“অপারেশন করার ডিসিশন নিলে আমায় ফোন করে জানালেও হবে। আমি মাধুরীকে বলে রাখব। নিজে যদি না আসতে পারেন, কাউকে দিয়ে অ্যাডভান্স টাকা পাঠিয়ে দিলেও হবে। আর হ্যাঁ, ফোনে আমায় না পেলে মেসেজ করে দেবেন, আমি রিং ব্যাক করে নেব।”চেম্বার থেকে বেরিয়ে দু’জনে চুপচাপ হাঁটছিল বাইরের দিকে।বিনীতা বলল, “একটা সেকেন্ড ওপিনিয়ন নিলে হয় না?”“অত সময় নেই। আবার একজন ডাক্তার খোঁজ, অ্যাপয়েন্টমেন্ট কর, সেটা কবে পাব তাও জানি না… একটা বড় প্রোজেক্টে হাত দিয়েছি বললাম না। আমি টাইম চাইলাম সেটার কাজ একটু গুছিয়ে নেব বলে। পাঁচ-ছ দিন আমি অফিস যেতে না পারলে প্রবলেম হবে।”কিছু একটা ভাবছিল বিনীতা। অরুণাভকে বলল বিকাশকে গাড়ি আনতে বলার জন্য। সে চট করে একবার ডাক্তারের কাছ থেকে আসছে।“আবার কী হল? কী জিজ্ঞেস করবে? আমি অফিস যাব তো,” একটু অধৈর্য হল অরুণাভ।“এখুনি আসছি, তুমি এগোও,” বলে দ্রুত ইন্দ্রনীলের চেম্বারের দিকে হাঁটা দিল সে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল অরুণাভ। তারপর ড্রাইভারকে ফোন করার জন্য মোবাইল বার করল পকেট থেকে।ডাক্তারের চেম্বারের দরজা ঠেলে ঢুকে বিনীতা দেখল ব্যাগ গোছাচ্ছে ইন্দ্রনীল। বিনীতাকে দেখে একটু অবাক হল সে।“কিছু বলবেন, ম্যাডাম?”“আপনি বললেন প্রতিটা দিনই ইমপরট্যান্ট। ওর কন্ডিশন ঠিক কতটা খারাপ?”“আরে না না। শুনুন, এই কন্ডিশন থেকে লোকে সুস্থ হয়েছে এমন অনেক এক্সাম্পল আছে।”“তার মানে কন্ডিশন খারাপ। কতটা? ও কি–”বিনীতার কথা থামিয়ে দিল ইন্দ্রনীল। “শুনুন, যা যা করার সব করা হবে। বললাম না প্রথমে সার্জারি, তারপর–”এবার ইন্দ্রনীলকে থামাল বিনীতা। “ও সব আপনি আগেই বলেছেন। এখন ক্লিয়ারলি বলুন, ও কি টার্মিনাল পেশেন্ট?”“দেখুন ম্যাডাম…”“আমি যথেষ্ট স্ট্রং, আপনি বলুন।”ইন্দ্রনীল চুপ করে থাকে। অরুণাভর গলা পাওয়া যায়, “হাতে আর ক’দিন আছে?”দুজনেই চমকে তাকায়। চেম্বারের দরজায় দাঁড়িয়ে অরুণাভ। তার আসা কেউ খেয়াল করেনি।“অফিসে একটা জরুরী কাজে হাত দিয়েছি, সেটা কমপ্লিট করা দরকার। অন্যান্য ব্যাবস্থাও করতে হবে, তাই সময়টা আমার জানা দরকার।”ইন্দ্রনীল বলল, “সার্জারিটা হয়ে যাক, বায়োপ্সি রিপোর্ট আসুক। তারপর বলব। এখন বাড়ি যান। প্লিজ।”ফেরার পথে গাড়িতে কেউ তেমন কোনও কথা বলল না। অরুণাভ ল্যাপটপ খুলে বসেছিল ঠিকই, তবে বন্ধ করে দিল। বিনীতা জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে চেয়েছিল। একবার অরুণাভর দিকে তাকাল, দেখল কোলের ওপর বই নিয়ে বসে আছে সে। তবে পড়ছে না, তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। (ক্রমশঃ)
  • জনতার খেরোর খাতা...
    মিষ্টিকথা - পাগলা গণেশ | রেখে রেখে মিষ্টিখানি,শেষপাতে খাব বলে,শেষে আর খাওয়াই হলো না।জুতোর কাদা পড়ে গেল এসে।শুরু থেকেই কয়েকবার মনে হয়েছে,একটা কামড় দিয়েই দিই,কিন্তু শেষে পুরোটা তারিয়ে তারিয়ে খাব বলে,রেখে দিয়েছিলাম নিজেকে বঞ্চিত করে।সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার,এই পুরো সময়টা ওটা আমাতেই অর্পিত ছিল,কিন্তু আমি তার যথার্থ ব্যবহার করিনি,যখন কাদার ছিটে পড়ল,তখন একটু বাঁকা হাসি কি দেখিনি,কান্নাও ছিল জানি।এখন আমি আফসোস করছি,কিন্তু আমার কিচ্ছু করার নেই,ফেলে দেওয়া ছাড়া।
    জীবন তরঙ্গ পর্ব ৪২  - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ পর্ব ৪২  বিএ পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকে ফলাফল প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত অনেকটা সময়। বাড়িতে বসে বসে নন্দিতার বোর হচ্ছিল। তার একটা বড় কারণ, ঠাকুমা বাড়িতে নেই। ঠাকুমার ভাই  অসুস্থ। খবরটা পাওয়ার পর, অসিত মাকে নিয়ে গিয়ে কোলকাতায় মামার বাড়িতে রেখে এসেছে। নন্দিতারা কয়েকজন বন্ধু মিলে দার্জিলিং এ যাওয়ার প্ল্যান করল। মেয়ে কোনদিন এভাবে  বাবা মা ছাড়া একা কোথায় বেড়াতে যায়নি। সম্মতি দিতে অসিত এবং নীলিমার স্বাভাবিক ভাবেই একটু দ্বিধা ছিল। যাওয়াটা অবশ্য আটকায়নি। অসিত পরিচিত লোক মারফৎ  নন্দিতা আর ওর বন্ধুদের দার্জিলিং এ থাকা আর ঘোরার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।যাওয়ার আগে নীলিমা মেয়েকে সতর্ক করে বলেছিল—  পাহাড়ি রাস্তা, সাবধানে চলাফেরা করবি।  আবার যেন কোন অঘটন না ঘটে।নন্দিতা মাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিল—অত চিন্তা কোরো না তো! এখন আমি বড় হয়ে গেছি মা।যাতায়াত সমেত বেড়ানর জন্য পাঁচ দিনের সময়সীমা বাড়ি থেকে বরাদ্দ হয়েছিল।     নন্দিতার ভাই তিমিরও ওদের সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছিল। কিন্তু কয়েকমাস বাদে ওর পার্ট ওয়ান পরীক্ষা বলে বাড়ি থেকে অনুমতি পায়নি। নন্দিতারা চারজন বন্ধু মিলে বেড়াতে গিয়েছিল। অভিভাবক ছাড়া বেড়াতে যাওয়ার আলাদা কিছু মজা আছে। এত কাছে থাকলেও দার্জিলিং এ নন্দিতা মাত্র দুবার গেছে। প্রথমবার এত ছোট ছিল যে, কিছুই মনে নেই। দ্বিতীয়বার  গিয়েছিল, যখন নন্দিতা ক্লাস সিক্সে পড়ে। সেই বয়সের কোন কিছু ভোলার কথা নয়, ভোলেওনি। বেশি করে মনে আছে দুর্ঘটনার কথা। পাহাড়ি রাস্তা, মা বা বাবার হাত ধরেই নন্দিতা হাঁটত। সেদিন হোটেল থেকে বেরোবার সময় নন্দিতা একছুটে বাকিদের থেকে  খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। ভাই বায়না করছিল বলে মা বাবা  একটু পিছনে ছিল। একটু যেতেই একটা লোমওয়ালা কালো কুকুর লেজ নাড়তে নাড়তে নন্দিতার দিকে এগিয়ে এল। ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে নন্দিতা রাস্তার একেবারে ধারে চলে এসেছিল। তারপর কেউ কিছু বোঝার আগেই পা হড়কে নিচে পড়ে গেল। নন্দিতার মা বাবা ছাড়াও আরো লোকজন দৌড়ে এসে নন্দিতাকে নিচের রাস্তা থেকে তুলে আনল।  কপাল ভাল খাদে পড়েনি। ওরা যে রাস্তা দিয়ে আসছিল, সেটাই ঘুরে এসে সাত আট ফুট নিচে দিয়ে গেছে। নন্দিতার পা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে, দুটো হাতেরও কয়েক জায়গায় ছড়ে গেছে। বেড়ান ওদের মাথায় উঠল। হোটেলের লোকেদের সাহায্যে মেয়েকে নিয়ে অসিত হাসপাতালে দৌড়ল। হাতে তেমন কিছু না হলেও পায়ে তিনটে স্টিচ পড়ল। সেই কাটার দাগ নন্দিতার ডান হাঁটুর পাশে আজও রয়ে গেছে।আগের দুর্ঘটনার কথা মাথায় থাকায়, সেবারে নন্দিতা একটু বেশি সতর্ক হয়েই হাঁটাচলা করেছে। বন্ধুরা তাই নিয়ে মস্করা করতে ছাড়েনি। আনন্দে পাহাড়ে ক’টা দিন কাটিয়ে নন্দিতা বাড়ি ফিরে এল। ফিরে আসার কয়েকদিন বাদেই বাবার  কাছে ঠাকুমার তলব এল, ওনাকে  নিয়ে আসার জন্য।অসিত ফোন করে বলেছিল—এতদিন বাদে গেছ, আরো ক’টা দিন থেকে এস মা। তোমারো ভাল লাগবে, ওদেরও ভাল লাগবে।ওদিক থেকে সোজাসাপ্টা উত্তর এসেছিল—ভুলুকে দেখতে এসেছিলাম, ও এখন ভাল আছে। বাড়ির বাইরে আমার বেশিদিন ভাল লাগে না। তুই ছুটি নিয়ে এসে আমায় নিয়ে যা।অসিত মাতৃ আদেশ অমান্য করেনি।    ঠাকুমার ফিরে আসার খবরে নন্দিতার খুব আনন্দ হল। ঠাকুমা না থাকায় বাড়িটা বড় ফাঁকা  ফাঁকা লাগছিল।ঠাকুমা ফিরে আসছে। বাবা নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে ফোন করে  জানিয়েছে যে, ঠাকুমা একা নয়, সঙ্গে আসছে আর একটা ছেলে। সে নাকি আবার কয়েকদিন থাকবে। নন্দিতা বা  নীলিমা কেউই ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। অশেষ কৌতূহল নিয়ে ওদের আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ওরা বাড়ি আসার পর ঠাকুমা যখন ছেলেটার গুণ গাইতে শুরু করল, তখন আর কেউ না বুঝলেও, নন্দিতার ঠাকুমার মতলব বুঝতে অসুবিধে হয়নি।ঠাকুমাও বেশিক্ষণ ব্যাপারটা নাতনীর কাছে চেপে রাখতে পারেনি। ছেলেটা দুপুরে অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর  ঠাকুমা এক ফাঁকে নন্দিতার কানে কানে এসে জিজ্ঞেস করলেন—দিদিভাই পছন্দ হয়?নন্দিতা না বোঝার ভান করে জিজ্ঞেস করল—কি ঠাকুমা?--নতুন অতিথি।নীলিমা এসে পড়ায় কথা আর এগোয়নি। অতিথি সৎকারের আড়ালে বুড়ির আসল মতলবটা নন্দিতা বুঝতে পারল। অফিসে ফাইলপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে সন্ধে হয়ে গেল। নয়ন প্রয়োজনের থেকে অনেকটা বেশি সময়  অফিসে রইল, যাতে কাজটা দিন দুয়েকের মধ্যে নামিয়ে দেওয়া যায়। ট্রেনের টিকিট পেতে অসুবিধে হলে বাসে ফিরে যাবে। অজানা অচেনা একটা বাড়িতে এক আধ দিনের বেশি থাকা উচিৎ নয়। এমন একটা গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেল যে, ওখান থেকে বেরিয়ে আসাও মুশকিল। তবে নয়ন মনে মনে একটা ছক কষে রেখেছে। দু দিনের মধ্যে  যদি কাজ শেষ হয়ে যায় তাহলে তো কথাই নেই। যদি না হয়, তাহলে কোলকাতায় ফিরে আসছে  বলে, ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কোনো হোটেলে গিয়ে উঠবে।  নয়নের উকিল পাড়ার অফিস থেকে অসিতদের বাড়ি অনেকটা দূরে। ওখানকার যানবাহনের ব্যাপারে  নয়ন  ওয়াকিবহল নয়, ফলে বাড়ি ফিরতে প্রায় নটা বেজে গেল। ফিরতে রাত হচ্ছে দেখে, ও বাড়ির সকলেই একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল।নয়ন বাড়িতে ঢুকতে নীলিমা জিজ্ঞেস করল—ফিরতে এত দেরি হল? গাড়ি পাচ্ছিলে না?--কাজ করতে করতে অফিস থেকে বেরোতে একটু দেরি হয়ে গেল। সেই দেরিটা আর একটু বাড়ল যানবাহনের জন্য। আসলে সব বিকল্পগুলো তো জানি না। সরি, আমার জন্য আপনাদের ডিনার করতে দেরি হয়ে গেল।নিজের অজান্তেই নয়নের দেরি হওয়ার জন্য নন্দিতারও একটু চিন্তা হচ্ছিল। একটা অচেনা ছেলের জন্য চিন্তা হওয়ার কোন কারণ নেই, কিন্তু হচ্ছিল। ওর মা আর ঠাকুমার মত  নন্দিতাও উদগ্রীব হয়ে ছিল।নয়নের কথার উত্তরে নন্দিতা বলল—আমরা সাহেবদের মত সন্ধেবেলা ডিনার করিনা। আমাদের ডিনার হয় রাত এগারটায়। ঠাকুমার উদ্দেশ্য জানার পর  নন্দিতা ছেলেটাকে একটু ভাল করে জানা আর বোঝার চেষ্টা শুরু করল। হাতে সময় কম, যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। দেখতে ভাল আর চাকরিও ভাল করে, এই দুটো প্লাস পয়েন্ট তো আছেই। এ ছেলেকে যে কোন মেয়েই পছন্দ করবে। নন্দিতারও মনের ভেতর একটু যে আকুলি বিকুলি হচ্ছে না, এমন নয়। তবু শুধু বাইরে নয়,  ছেলেটার মনের ভেতরটাতেও যতটা সম্ভব উঁকি মেরে দেখা দরকার। ঠাকুমা ট্রেন থেকে ধরে আনল, আর ছেলেটা বাধ্য ছেলের মত নন্দিতার সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসে গেল, ব্যাপারটা এতটা সরল নয়। ছেলেটার নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ আছে, প্রেমিকা থাকতে পারে, দুশ্চরিত্র হতে পারে। সব থেকে বড় কথা, অপত্য স্নেহের আড়ালে ঠাকুমার এই ষড়যন্ত্রের কথা ছেলেটা ঘুণাক্ষরেও জানে না।  নয়ন ফ্রেশ হয়ে আসার পর জমিয়ে আড্ডা বসল। ঠাকুমা থেকে আরম্ভ করে তিমির, সকলেই ছিল সেই আড্ডায়।ঠাকুমা কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন—বাবা কয়েকদিন আছো তো?--কাজ শেষ হতে যে ক’দিন লাগবে। মনে হয় তিন চার দিন লেগে যাবে।উত্তর শুনে ঠাকুমা আর নাতনী দুজনেই খুশি হল। মুখ ফস্কে সত্যি কথা বলে ফেলে নয়ন একটু মুশকিলে পড়ে গেল। ওর প্ল্যান ছিল, দুদিন বাদেই  ফিরে যাচ্ছে বলে এই বাড়ি থেকে  বেরিয়ে কোন হোটেলে গিয়ে ওঠা।ব্যাপারটা সামাল দিতে বলল—অবশ্য এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না। ডকুমেন্ট গুলো ঠিকঠাক পেয়ে গেলে আগেও কাজ শেষ হয়ে যেতে পারে।ঠাকুমা মুচকি হেসে বললেন—অত তাড়াহুড়ো করার কি আছে? সময় নিয়ে ধীরে ধীরে কাজ করলেই তো হয়।  ঠাকুমার কথা শুনে নয়ন হেসে ফেলল। নন্দিতা মনে মনে বুড়িকে স্যল্যুট করল। প্রায় ঘন্টা দুয়েক ধরে অনেক গল্প, মজা, মস্করা হল।  মা আর মেয়ে দুজনে গান করল। নয়ন মুগ্ধ হয়ে শুনল। দুজনেরই গানের গলা খুব ভাল। আসরে মগ্ন হয়ে থাকার ফলে ঘড়ির দিকে কারো চোখ পড়েনি। সেদিন ঐ বাড়ির ডিনারের সময় অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছিল।একবারের জন্যও কাউকে দেখে মনে হয়নি  যে, ওদের সাথে নয়নের সবে  সেদিন সকালে পরিচয় হয়েছে। নয়ন যেন কতকালের চেনা।     চলবে
    রঙের ছোঁয়া - Sukdeb Chatterjee | রঙের ছোঁয়াশুকদেব চট্টোপাধ্যায়আজকে অনিক বাড়ির বাইরে বেরোবে না। অন্তত এ বেলা তো নয়ই। আজ বলে নয়, চিরকালই এই দিনটা খুব ঠেকায় না পড়লে ও চেষ্টা করে ঘরেই কাটাতে। আসলে রং খেলতে অনিকের কোনদিনই ভাল লাগে না। সেই ছোট্টবেলায় যখন ওর বন্ধুরা নানারকমের পিচকিরিতে ভরে ছুটোছুটি করে রং খেলত, তখনও অনিক চেষ্টা করত একটু তফাতে থাকতে। কলেজে পড়ার সময় একবার বন্ধুদের চাপে পড়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রং খেলতে হয়েছিল। সেবার মুখে মাথায় সব এমন রং মাখিয়ে দিয়েছিল যে দু তিন দিন সাবান শ্যাম্পু লাগিয়েও তা পুরোটা ওঠেনি। ওখানেই শেষ। তারপর শত অনুরোধেও আর কখনও দোল খেলেনি।অল্প কিছুদিন হল অনিক এই বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে এসেছে। এখান থেকে ওর অফিসটা কাছে পড়ে। বাড়ির তিনতলার একমাত্র ঘরটা ওর জন্য বরাদ্দ। সবকিছু আলদা ব্যবস্থা আছে। ওর একার জন্য ঘরটা যথেষ্ট বড়। বাড়ির মানুষগুলোও ভাল। আপনজনের মতই ওর দেখাশুনো করে। বাড়িটা রাস্তার ওপরে। জলখাবার খেয়ে ঝুল বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে নভেল পড়ছিল। বই পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে রাস্তার দিকে চেয়ে দেখছে। বাচ্চা বুড়ো সব একে অপরকে রঙে চুবিয়ে ভূত করছে। এতে কি যে এত আনন্দ অনিক বুঝে উঠতে পারে না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বইয়ে চোখ ফেরায়। কিন্তু মনঃসংযোগ করতে পারে না। বারে বারেই নিচে বাইরের দিকে নজর চলে যাচ্ছে। একটা গরুকে রং মাখিয়ে কিছু লোক মজা মারছে। নিরীহ প্রাণীরও এই নোংরামির হাত থেকে মুক্তি নেই। বই বন্ধ করে অনিক ঘরে এসে টিভি খুলে বসল। এখানেও নিস্তার নেই। অধিকাংশ চ্যানেলেই শুধু দোল খেলার ছবি। অগত্যা একটা কার্টুনের চ্যানেল খুলে দেখতে লাগল। কিছু সময় পরে হঠাৎ মুখে মাথায় কে যেন আবির মাখিয়ে দিল। পরিষ্কার জামাকাপড় সব আবিরে ভরে গেল।“কি হচ্ছে কি ?”—অসন্তুষ্ট হয়ে একটু জোরেই কথাটা বলার পর তাকিয়ে দ্যাখে আবিরের প্যাকেট হাতে ঘরের একধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই বাড়ির একমাত্র সন্তান, পিয়ালি।---রাগ করলেন ? দোলের দিন একটু রং না খেললে ভাল লাগে বলুন ! আর এমন একটা দিনে আপনি কিনা ঘরে বসে বাচ্চাদের মত কার্টুন দেখছেন।অনিক কি বলবে ভেবে পায় না। ওরকম ভাবে রিঅ্যাক্ট করাটা উচিত হয়নি। কি করে বুঝবে যে পিয়ালি আবির মাখাতে এসেছে।খুব সংকোচের সঙ্গে বলল---কিছু মনে করবেন না। আমি না ঠিক বুঝতে পারিনি যে আপনি।---তা বোঝার পরেই বা কি করলেন !---আমি সত্যিই খুব লজ্জিত।---শুধু লজ্জা পেলেই হবে! রং খেলার একটা নিয়ম আছে জানেন না!---আমি কোনদিন তো রং খেলি না, কি করে জানব বলুন !---কেউ আবির মাখালে তাকেও একটু আবির লাগাতে হয়।অনিক তাকিয়ে দ্যাখে যে আবিরের প্যাকেটটা পিয়ালি ওর দিকে বাড়িয়ে রেখেছে। এদের সাথে খুবই অল্প দিনের পরিচয় তাই আড়ষ্টতা একটু ছিলই। তবু সব দ্বিধা সংকোচ কাটিয়ে প্যাকেট থেকে আবির নিয়ে অনিক পিয়ালিকে মাখাতে লাগল। প্যাকেট কখন শেষ হয়ে গেছে তবু রং মাখানো আর শেষ হয় না। রং যে তখন হৃদয়ে লেগেছে।নিচে থেকে মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরতে পিয়ালি এক ছুটে ঘর থেকে পালাল। আবির ধুয়ে ফেললেও পিয়ালির মুখের রাঙা ভাবটা কিন্তু ফিকে হতে সময় লাগবে। আর অনিক,রঙের ঘোরে বিভোর হয়ে ভাবে, 'এমন দোল রোজ আসে না কেন'!Email [email protected]
  • ভাট...
    commentরঞ্জন | গুজব নাইডু নাকি হোম দাবি করছেন আর নীতীশ ডিফেন্স?
    মোটাভাই যে গতবছর নাইডুকে জেলের ভাত খাইয়ে ছিলেন সেটা বোধহয় ভুলতে পারছেন না!
    গুজবে কান দিতে নেই,
    কিন্ত এসব যদি সত্যি হয়? ভোরের স্বপ্ন!
    commentটক্কর |
    comment | পাবলিক থাকলে আসা উচিৎ। তবে পাশের দেখে নিন বোতামটা টিপে দেখে নেবেন পোস্ট করার আগে আসছে কিনা। 
     
    ফেসবুকে আপলোডানো অনলি মি ছবিও ইমেজ অ্যাড্রেস দিলে চলে আসে দেখেছি।
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত