শশী ঠাকুরমার পুরো নাম শশীবালা ভট্টাচার্য্য। বয়স পঁচাশি পেরিয়ে গেছে । শরীর ঝুঁকে গেছে। একটা লাঠি নিয়ে ঠুক ঠুক করে চলেন । চোখে মোটা ঘোলাটে কাঁচের মান্ধাতার আমলের চশমা । তিনকূলে তেমন কেউ নেই । দূর সম্পর্কের এক ভাগ্নে আছে , শিবশঙ্কর । বড় ভাল লোক । তারও বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে । সে আহিড়িটোলা থেকে প্রায় প্রতিদিন এসে মামীর দেখাশোনা করে । যতদিন মামী বাঁচবে শিবশঙ্করকে বিবেকের তাগিদে এ কর্ত্তব্য পালন করে যেতেই হবে । আজও লাঠিটায় ভর দিয়ে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন শশীবালা । বোধহয় শিবশঙ্করের আগমনের অপেক্ষা করছিলেন । শিবশঙ্কর সাধারণত সন্ধে সাতটার আগে আসে ... ...
টোপাই বাবার ভাঙা সাইকেলটা নিয়ে মন্ডলপাড়ায় রেশান দোকানের দিকে যাচ্ছিল । পাড়ায় অনিতা মাসী খবর দিল যে, রেশানে কাল চাল ঢুকেছে । যেতে যেতে রাস্তায় দুবার চেন খুলে গেল সাইকেলের । দোকানে গিয়ে দেখল বিরাট লাইন । সিদ্ধেশ্বর চক্রবর্তী রাস্তার একপাশে ছোট কার্ড আর থলে হাতে নিয়ে হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে ছিল । টোপাই সিদ্ধেশ্বরবাবুর সামনে গিয়ে সাইকেল থেকে নামল । ----- ' কিরে ..... এখন এলি ? আজ আর কিছু পাবি না .... কাল ভোরে এসে লাইন দিতে হবে আমাদের .... '----- ' কেন ? '----- ' এ...ই আজ বলছে কুড়িজনের বেশি পাবে না । আবার কাল কুড়িজন । লাইনে তো দেখছিঅন্তত ... ...
( শেষ পর্ব )পরদিন দুপুরবেলা বড়পুকুরে ডুবুরি নামল । আদালতের নির্দেশ । কলতানের অনুমান এবং গুল্টুর চাক্ষুষ বিবরণ সত্য প্রমাণিত করে পুকুরে ডুব দেওয়া ডুবুরি জলের তলা থেকে আট ইঞ্চি লম্বা একটা ছুরি তুলে নিয়ে এল । জং ধরেনি , কারণ জলের তলায় অক্সিজেনের অভাব । আদালত আর সময় দিল না । অসুস্থতার আর্জি বিচারক গ্রাহ্য করলেন না । হৃদয় এবং বসন্ত শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত দিনে কোর্টে হাজিরা দিল ।সঙ্গে প্রচুর দলবল । তিনটে টাটা সুমোয় করে এসেছে । তারা কোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রচুর হৈ চৈ করছে । দেবমাল্য মৌসুমীকে বলল, ' একদম নার্ভাস হয়ো না ..... ওরা কিচ্ছু করতে ... ...
খালি খাতা জমা দেবার কথা শুনে কলতান বলল , ' এ..টাই আমি ভাবছিলাম । গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে তুই যে রোবট হয়ে যাসনি এটা প্রমাণ হল । সোদপুরে শান্তনীড় আবাসনে ইনভেস্টিগেট করতে গিয়ে আমারও এরকম রেভেলেশান হয়েছিল । ঠিক আছে ... নেভার মাইন্ড ... যা করেছিস বেশ করেছিস ... তুই পারলে কাল সকালের দিকে একবার আয় ... 'মৌসুমী মৃদুস্বরে বলল , ' আ..চ্ছা ' ফোন রেখে দেবমাল্যর দিকে ফিরল কলতান।----- ' মৌসুমী ওভারলোডেড হয়ে গেছে । লোড থেকে রিলিভ করতে হবে এনিহাউ ... বুঝলে ? ----- ' হ্যা ... ঠিক কথা ... ' ----- ' তুমি হিয়ারিং-এর ডেটটা বার করার চেষ্টা কর ... ... ...
সকাল আঠটার সময় দেবমাল্যর বাড়িতে চলে এল মৌসুমী । কাল রাত্রেই ফোনে পুরো বৃত্তান্ত জানিয়ে দিয়েছে কলতানকে । সব শুনে কলতান যদিও ফুরফুরে মেজাজে আছে , মনে একটা উৎকন্ঠার কাঁটা বিঁধে আছে যে রেকর্ডটা ঠিকমতো হল তো ? নাহলে এত টানাহ্যাচড়া, ঝকমারি সব মাঠে মারা যাবে । মৌসুমী ঢুকতেই কলতান বলে উঠল, ' ব্রেভো ব্রেভো ... ইয়াং গার্ল ... হ্যাটস অফ ... হোয়াট আ গ্রেট জব ... ' পারলে ওকে জড়িয়ে ধরে কলতান। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিল । মৌসুমী বলল, ' আরে দাঁড়ান দাঁড়ান ... ঠিকমতো রেকর্ডেড হল কিনা দেখে নিন আগে । তারপর সেলিব্রেট করবেন ... '----- ' ইয়েস অফ কোর্স ... ...
সকাল নটার সময় মৌসুমীর মোবাইলে কলতানের একটা কল এল ।----- ' হ্যালো স্যার ... বলুন ... '----- ' হ্যা ... ঠিক আছিস তো ? তোকে এরকম একটা আনসেভারি রেসপনসিবিলিটি দিয়ে আমি খুব আনইজি ফিল করছি । দেখ .... তোর তেমন অসুবিধে হলে ... ছেড়ে দে ... আমি অন্য কিছু ট্রাই করছি ... ' ----- ' না না ... স্যার ... আমি কাজটা যখন নিয়েছি ... শেষ করেই ছাড়ব ... আমারও তো গরজ আছে না ? একটা নীরিহ লোক এইভাবে... তাছাড়া মাঠে খেলতে নেমে গেছি ... এখন আমি ছাড়তে চাইলেও বসন্ত ছাড়তে চাইবে কি ? '----- ' এই তো ... ... ...
সকালবেলায় দেবমাল্য বলল, ' কলতানদা পরাণের পরিবারকে একবার দেখে আসবেন নাকি ? ওদের সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ করা হয়নি । কিছু টাকাও দিয়ে আসতে হবে । গত তিন বছরে কেসটা তুলে নেবার জন্য অনেক হুমকি ফেস করতে হয়েছে । কিন্তু পরাণের স্ত্রী সুজাতা তবু হাল ছাড়েনি। দাঁত কামড়ে পড়ে ছিল পাক্কা তিনবছর আমার ওপর নির্ভর করে।তাছাড়া আর একজন ওদের সাপোর্ট বলুন, শেল্টার বলুন প্রচুর দিয়েছিলেন । তিনি হলেন বীরেন ঘোষ মশাই । নাহলে এদের বেঁচে থাকাই প্রায় অসম্ভব ছিল । ওদের ছেলেগুলো প্রচুর প্রোটেকশান দিয়েছিল ... সুজাতা তার দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে এখন পাশের গ্রাম ছামুড়িতে আছে ওর এক বোনের কাছে ... ...
আজ বুধবার । মৌসুমীর লাইব্রেরী যাবার দিন । সন্ধে ছটা নাগাদ সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।বই ফেরত দিয়ে কাউন্টারে স্লিপ জমা করে টেবিলের দিকে সরে এসে দাঁড়িয়ে একটা বাংলা সাপ্তাহিকীর পাতা খুলে সেই দিকে চেয়ে রইল । পাতার অক্ষরগুলো কিছুই মাথায় ঢুকছে না । মনের ভিতর এলোমেলো চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে ।যেন পরীক্ষা হলে বসে আছে প্রশ্নপত্র পাবার প্রতীক্ষায় । প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে গেলে জড়তা কেটে যায় । তার উচ্চমাধ্যমিক শুরু হতে এখনও প্রায় দু মাস । কিন্তু সেটার সম্মুখীন হওয়াটা এখন অতি সহজ সরল ব্যাপার মনে হচ্ছে মৌসুমীর । এ পরীক্ষাটা কিভাবে সামলে নেওয়া যাবে সেই হিসেব ঘুরছে মনের ভিতর । ... ...
কলতান একটু দ্বিধান্বিত হয়ে বলল , ' বলছিলাম যে.... বাড়ি না গিয়ে অন্য কোথাও কথা বলা যায় না ? 'ওরা তিন জন হাঁটছিল । একপাশে একটা ছোট শিবমন্দির পড়ল । পাশে দুটো লম্বা নারকোল গাছ । পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে । মন্দির এখন ফাঁকা । কলতান বলল, ' এইখানটায় একটু বসলে হয় না ? '----- ' তা হয় .... কিন্তু ..... এটা ....' বলে চোখের ইশারায় গুল্টুর দিকে দেখাল ..... ' ----- ' ওকে বাড়িতে রেখে আসলে হয় না ? আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি ..... ' কলতান নীচু গলায় বলে।----- ' তা হয় .... কিন্তু ... এখানে বসলে কেউ দেখলে আবার ..... গ্রামের ... ...
থানার আই সি স্বরূপ রাউথ বলল, ' দেবমাল্যবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে । উনি পরাণ বাগ্দীর কেসটার ব্যাপারে ইগারলি সিনসিয়ার । অ্যন্ড কোয়াইট জাস্টিফিয়েবলি সো ..... । দেবমাল্য সরকার আপনার হেল্প নিয়ে ভালই করেছে । গড ফরবিড .... আমি কিন্তু খুব ডাউটফুল অ্যবাউট দা আউটকাম .... বিকজ অফ দা পলিটিক্যাল অ্যটমসফিয়ার অফ্ দিস প্লেস ...... আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই .... 'কলতান ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে চোখ বুজিয়ে একদিকে ঘাড় কাত করল । স্বরূপ রাউথের বয়স প্রায় পঞ্চাশ । অনেক থানা ঘুরে এখানে এসেছেন । বারবার ট্রান্সফারের কারণ বোধহয় তার আপোষহীন স্বভাব । মুখ বুজে অন্যায় মেনে নেবার মানুষ স্বরূপ ... ...