– ‘জিগেশ করছিলে না? কী করে বাঁচিয়ে রাখি? বড় মায়া দিয়ে বাবু। মায়া না থাকলি এ দুর্যোগে কিছুই রাখা যায় না। ঐ কচিগুলো, এত নেওটা আমার, এত মায়া যে ছাড়ি যেতি দিলাম না। এই মাঠও তাই। তোমাদের ফেলাট বানানোর গর্ত রোজ এসে গিলে ফেলতি চায় এই জমি। খুরপি নিয়ে লড়াই করি বাবু, মায়া দিয়ে আটকে রাখি যেটুকু জমিজমা পারি। আবার হেরে যাই যখন সব গর্তে ঢুকি যায়। রাবিশের নিচে ঢেকে যেতি থাকে বীজতলা, চার, ফসল সব। আবার খুরপি দিয়ে খুঁচোই। ফিরিয়ে আনি কিছু। লড়াই চলে গো বাবু। আমার ছেলেগুলো কই গেল দেখি! ’ ... ...
পহেলা বৈশাখ এলেই আজকাল একজনের কথা আমার মনে পড়ে। ভদ্রলোক আর আমি পাশাপাশি ডেস্কে বসে কাজ করতাম এক সময়। চাকরি ছেড়ে দেবার পরও তার সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা হতো। এখনো হয় কালেভদ্রে। আমাদের কলিগ সবিমল বসু ধর্ম নিয়ে প্যাঁচপ্যাচি ধরনের মানুষ। অফিস ছুটির পর দেখতাম কলা গাছের বাকল নিয়ে যাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলে বলত বাড়িতে কি নাকি পুজা আছে। সকালবেলা কখনো হাঁটতে বের হলেও দেখতাম ফুল কিনছেন। বাড়িতে নিজেই পুজা দেন। ঠাকুর দেবতায় খুব ভক্তি। আমাদের জীবন থেকে বাংলা কেলেন্ডার উঠে গেলেও সুবিমলকে দেখতাম বাংলা মাসের তারিখ পর্যন্ত মনে রাখছেন। উনার সঙ্গে কথা বলে মজা পেতাম কারণ উনি উনার জীবনে এখনো ইংরেজি তারিখের সঙ্গে বাংলা তারিখটি সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছেন। যেমন বৃষ্টি কম হচ্ছে, এ বছর বৃষ্টির দেখা নেই… সুবিমলদা বলে উঠতেন আষাড়ের আজকে ২ তারিখ ১৪ তারিখে রথযাত্রা। এর আগে বৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না…। কিংবা পৌষ ২২ চলছে কিন্তু শীতের দেখা নেই ইত্যাদি…। ... ...
শ্রীচরণেষু বাবা, তোমার তৃষ্ণা মিটিয়াছে...? কপোতাক্ষর ধারের মানুষ তুমি, আর আছে বেতনা, রূপসা, ভৈরব, চিত্রা, মধুমতী, তখন সেই সব নদ নদীতে কত জল, অথচ তুমি নাকি এক ফোটা জল পাওনি। কী আর দুঃখের কথা লিখি তোমাকে, এখন নাকি ওই সব নদীতে আর জল নেই। আমাদের গাঙের স্টিমার বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু বালি ওড়ে কপোতাক্ষর বুক থেকে। যত শুনি বুক হিম হয়ে যায়। আকন্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে মানুষ ঘুরছে নদীর পাড়ে পাড়ে। বাবা তোমার তৃষ্ণা কি মিটেছিল সেই উত্তরের দেশের তিস্তা, করতোয়া, যমুনা, ডাহুক, তালমা, চাওয়াই......এই সমস্ত নদীর জলে। সেই সব নদী কি জল দেয়? ... ...
প্রতি সন্ধেবেলা যখনই অফিসফেরতা বাসটা ঠাকুরপুকুর ছাড়িয়ে ডানদিকে বাঁক নেয় ত্রিদিবের আজকাল পেটের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে ভয় পাকিয়ে উঠতে থাকে। তার মনে হয় কলকাতার সভ্যতা থেকে এবার সে আদিম অন্ধকারের রাজ্যে প্রবেশ করছে। তার নতুন কেনা ফ্ল্যাট হাঁসপুকুর ছাড়িয়ে এক অনন্ত নিঃসীম মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে নিঃঝুম হয়ে। চারদিকে ঘাপটি মেরে থাকা অন্ধকার লাফিয়ে পড়তে চায় সুযোগ পেলেই। সেই অন্ধকারকে টর্চের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা করে দিয়ে দুই পাশের মজা পুকুরের মধ্যেকার সরু রাস্তা দিয়ে পাঁক কাদা আর সাপখোপ এড়িয়ে সন্তপর্ণে মেন গেটের দিকে এগিয়ে যেতে হয় । এই নতুন ফ্ল্যাটের পেছনেই লুকিয়ে রয়েছে গণ্ডগ্রাম। মরা ঝোপ, বুনো জংগল, ক্ষেতের জমিতে সিমেন্ট ফেলে তার ওপর মাথা তুলছে প্লাস্টিক কারখানা, খোলা মাঠের এখানে ওখানে শ্বেতীর মতন জমাট বেঁধে টুকরো টুকরো বাড়িঘর, কলাবন, অবৈধ খাটাল। কলকাতার দিকে কিছুটা এগোলে ঠাকুরপুকুর বাজার। কিন্তু এইদিকটায় বড়ই নির্জন। সন্ধ্যে হয়ে গেলে শুধু টিমটিম করে মোবাইল রিচার্জের দোকান, চায়ের গুমটি অথবা ম্যাড়ম্যাড়ে মুদীর দোকানের আলো জ্বলে। মাঝে মাঝে রাস্তা কাঁপিয়ে বাস বা ট্রেকার চলে যায় গুম গুম করে। এই ধু ধু প্রকৃতির মধ্যে রিয়েল এস্টেট বানাবার কথা সমাদ্দার ছাড়া আর কেউ ভাবতেই পারত না। ... ...
তানিয়া ভাবে, ঠিক কীসের আসায় দেশান্তরী হয় মানুষ? কাকে বলে শেকড়? কেনো এসেছিল যোগেন কাপালি চর-নরসুন্দরা থেকে তিন মাইল উজানে? একখানে যেটা উজান অন্য জায়গার তুলনায় সেই একই জায়গা হতে পারে ভাঁটি। যেখানে কাঁটাতারের ওপার থেকে ধেয়ে আসে জলজ হাতি আর আথালিপাথালি লিলুয়া বাতাস। গাঁয়ের নাম উজানডাঙ্গা। তানিয়া দুই হাতে দুই ফালি সুতো দিয়ে বানানো চিমটা মতো লোম উটপাটনের অতি সাধারণ হাতিয়ারটা ট্র্যাশবক্সে ফেলে ড্রয়ার থেকে বের করে নেয় লোমকাটার ইলেকট্রিক মেশিন। ইচ্ছে, বেজায়গার লোমগুলোকে খানিক ছেঁটে ওয়াক্স টেপ দিয়ে তুলে ফেলা। কিন্তু স্টিভ দ্বিতীয়বারের মতো ঝাঁঝিয়ে ওঠে- ‘নো নো ক্লিন ইনসাইড, ক্লিন ইনসাইড!’ হয়তো তৃতীয়-চতুর্থ কিংবা তারওচেয়ে বেশি বার। ... ...
ষোলো তারিখ বুধবার রোজকার মতো সকাল ন’টার মধ্যে ভাত খেয়ে বেরিয়ে গেল পিনাকী। দুপুরে বাড়ি আসে না, সকালেই খাওয়া সেরে নেয়। প্রথমে একবার যাবে যাদবপুর। সেখান থেকে নির্মলের দোকান। একবার দাঁড়াতে হবে মুখোমুখি হুল উঁচিয়ে। ইলিয়াস বা মদনকে বললে অবশ্য দু-চারটে মোষ নিঃশ্বব্দে গায়েব হয়ে যাওয়া কোনো ব্যাপার নয়। কেমন ভাবে আস্ত মোষ অদৃশ্য হয়, ম্যাজিশিয়ানরা বলে না। কিন্তু মোষ খ্যাদানো বড় কথা নয়। বড় কথা হল অপমানিত পরাজিত লিঙ্গের পুনরুত্থান। হেরো পুরুষ বলে কিছু হয় না। হেরে যাবার পর আর পুরুষ থাকে না। তার কুন্ডলিনী অনন্ত শয্যায় শায়িত হয় মূলাধারের চৌবাচ্চায় জিলিপির মতো বেবাক পেঁচিয়ে। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখে, মণিপুর চক্রে দশ পাপড়ি নীল পদ্মের ওপর দাপাদাপি করছে এক কৃষ্ণকায় মোষ। কী বলিষ্ঠ তার গড়ন! মোষ নাচছে, পদ্মের পাপড়ি দুলে উঠছে। শ্বাস ফেলছে আর মেঘের মতো জেগে উঠছে দু’গাছা মেয়েলি চুল। ঘুমের মধ্যে সে কঁকিয়ে ওঠে, কিন্তু বাধা দিতে পারে না। ... ...
আব্দুল মজিদের এই কার্যক্রম নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত মানুষদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকেছিল এবং অস্বাভাবিক জিনিসের প্রতি মানুষ এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করে সুতরাং কিছু মানুষ আব্দুল মজিদকে ঘিরে দাঁড়াল। আব্দুল মজিদ প্রচন্ড সূর্যের উত্তাপে গরম ভেজাল বিটুমিনের স্তর দ্বারা আচ্ছাদিত রাজপথে দাঁড়িয়ে তার চারপাশে জমে যাওয়া মুখগুলোকে দেখে ভেতরে ভেতরে পুলক অনুভব করল। তার মনে হল অনেক অনেক দিন পরে রাশি রাশি পক্ষীকূল তার ভেতরের দুনিয়ায় একসাথে উড়াল দিয়েছে এবং তারা এক স্বর্গীয় ছন্দে একসাথে ডানা কাঁপিয়ে উড়ে চলেছে। আব্দুল মজিদের শরীরের ভেতরের রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল এবং সদ্য দৌড়াতে শেখা বাছুরের মত তার সমস্ত শরীর জুড়ে ছুটে বেড়াতে শুরু করল অপার্থিব উচ্ছ্বলতাকে সঙ্গে নিয়ে। আব্দুল মজিদ এইসব অনুভব করে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। তার কণ্ঠ ভারী হয়ে এল এবং চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসল। সে নিজের চোখকে উপস্থিত জনতার চোখের আড়াল করতে উত্তপ্ত রাজপথের দিকে তাকাল এবং সে দেখতে পেল স্থানে স্থানে চাকার ঘর্ষণের ফলে রাস্তার বিটুমিন উঠে গেছে। সেইসব জায়গা রাস্তার বুকের ক্ষত হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে আর কোথাও কোথাও এইসব ক্ষত অগভীর গর্তে পরিণত হয়েছে। আব্দুল মজিদ ঝাপসা চোখ দিয়ে দেখলেও অনুভব করতে এইসব ক্ষত এবং গর্ত আসলে নগরের নাগরিকদের বিবর্ণ হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। তার খারাপ লাগে এবং সে নিজেকে শক্ত করে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে মুখ তুলে বলে, আজ আমি আপনাদের একটা গল্প বলব। শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গল্প। এইগল্প এই শহর এবং শহরে বসবাসকারী মানুষের গল্প। আপনাদের মনে হতে পারে এই গল্পের সাথে শহর এবং শহরবাসীদের কোন মিল নেই। কিন্তু এই মনে হওয়া ভুল হবে। কারণ আমি এই চারপাশের বাস্তব পৃথিবীর ভেতরের অবাস্তব জগতটাকে দেখেছি এবং সেইমত বুঝে নিয়েছি এই শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গল্পটিকে। এখন আমার দায়িত্ব আপনাদের এই গল্প শোনানোর। আপনাদের কি এই গল্প শোনার সময় হবে? ... ...
“হোক ঝঞ্ঝা” শুরু হয়েছিল একটা স্পেসিফিক ঘটনা থেকে। বয়েজ হোস্টেলের কাছে একটা ফেস্টিভ্যালের সময়ে একটি মেয়ে মলেস্টেড হয়েছিল। উপাচার্য থেকে শুরু করে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট কমপ্লেন্টস কমিটি কেউ সঠিক স্টেপ নেয়নি। কোন অ্যাকশনই হয়নি প্রথমটা। পরে, যখন কমপ্লেন্টস কমিটি বসল, অধ্যাপিকা সঙ্ঘমিত্রা সরকার, ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের হেড, কমিটির চেয়ার পার্সন মেয়েটির বাড়ি গিয়ে বলে বসলেন, তুমি সেদিন কী জামাকাপড় পরে ছিলে? তুমি কি মদ্যপান করেছিলে? ওয়্যার ইউ আন্ডার এনি কাইন্ড অফ ড্রাগস? মেয়েটি, মেয়েটির পরিবার অপমানিত বোধ করে। ভিক্টিমের চরিত্র হনন করে, ভিক্টিম অ্যাবিউজ করে, অপরাধের গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া পুরনো ট্যাকটিক্স। কলেজের ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রদের কেরিয়ার বাঁচাতেই , কমপ্লেন্টস কমিটি এভাবে মেয়েটির ওপর কিছুটা দায় চাপিয়ে একটা হালকাফুলকা অভিযোগ লিখিয়ে অল্প শাস্তির মধ্যে দিয়ে ছেলেগুলোকে ছাড় দিয়ে দিতে চাইছে। ছাত্রছাত্রীরা এটাই বুঝল। আর ফেটে পড়ল হোক ঝঞ্ঝা। ... ...
বাঘটা সুবিধা দিচ্ছে না। এখন জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ডান দিকে তাকাচ্ছে। এখনও গুলি পিছলে যাবার ভয় আছে। আব্দুল ওহাব আবার নিজের পজিশন বদলানোর কথা ভেবে বাদ দিয়ে দেয়। আজকে না পারলে কালকে হবে। কিন্তু উল্টাপাল্টা গুলি করে খামাখা একটা নিশ্চিত শিকার হাতছাড়া করা ঠিক না। এখনও যা বেলা আছে তাতে কাজ শেষ করে বড়ো নদীর ওই পাড়ে খালের ভেতরে দাঁড়ানো মহাজনের ট্রলারে দাঁত-নখ দিয়ে চামড়ার ঠিকানা বলে বেলাবেলিই বাড়ি ফিরতে পারবে। অবশ্য বড়ো নদীতে ফরেস্টারদের সামনা সামনি পড়ে যাবার ভয় আছে। গুলির শব্দ শুনলে টহল বোট নিয়ে তারা হয়ত এদিকে চলে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্য আব্দুল ওহাবেরও উত্তর মুখস্থ করা আছে। তাকে যদি জিজ্ঞেস করে সে কোনো গুলির আওয়াজ শুনেছে কি না। সে নির্দ্বিধায় উত্তর দেবে- আপনাগের বন্দুকের একটা দেওড় ছাড়া তো আর কিছু শুনিনি ... ...
সংবিধানে যে সকল এলাকা পঞ্চম তফসিলভুক্ত – মানে যে সমস্ত জায়গার জনসংখ্যার গরিষ্ঠাংশ বাসিন্দা আদিবাসী, সেই সকল এলাকায় পঞ্চায়েতি রাজ জারি করা হয়েছে ১৯৯৬ সালে প্রণীত পঞ্চায়েৎ একস্টেনশান টু শ্যেড্যুল্ড এরিয়াস (পেসা) অ্যাক্ট মাধ্যমে। উক্ত কেন্দ্রীয় আইন, ২০০৬ সালের দ্য শ্যেড্যুল্ড ট্রাইবস অ্যাণ্ড আদার ট্রেডিশিনাল ফরেস্ট ডোয়েলার্স রেকগনিশান অব ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট (এফ-আর-এ) এবং রাজ্য ছত্তিসগড়ে প্রযোজ্য ছত্তিসগড় পঞ্চায়েতি রাজ অধিনিয়ম ১৯৯৩ অনুসারে কোনো আরণ্যক গ্রামের মানুষের ব্যাবহারযোগ্য ব্যক্তিগত জমি মানে ভিটেমাটি, খেতি-আবাদী এবং গ্রামের নিস্তারী, মানে সেখানকার দেবদেবীদের থান, উৎসবের জায়গা, শ্মশান, গোচারণভূমি – সমস্ত কিছু যদি ‘বিকাশ’-এর ধ্বজিত উদ্দেশে হাপিস করতে হয়, তাহলে প্রভাবিত সমস্ত গ্রামের গ্রাম সভার মাধ্যমে রেসল্যুশান পাস করতে হবে, গ্রামবাসীদের গরিষ্ঠাংশের সম্মতি প্রয়োজন। এছাড়াও, উক্ত এফ-আর-এ আইন অনুসারে আরণ্যক গ্রামের গ্রামবাসীরদের নানাবিধ অধিকার-জ্ঞাপক পাট্টা দেওয়া হয় – যেমন বসবাসের অধিকার, খেতি-আবাদির অধিকার, খাদ্য হিসেবে আহৃত ফল-মূল-ব্যাঙের ছাতা, পানীয় হিসেবে আহৃত মহুয়া, সালফি প্রভৃতি, জীবিকার উদ্দ্যেশ্যে আহৃত তেন্দু পাতা, গালা, ধুপ বানানোর রেসিন-সমূহের অধিকার, পরম্পরা-নির্দিষ্ট স্থানে পুজো, উৎসব অন্ত্যেষ্টাদি সকল রিচুয়াল-উদযাপনের অধিকার, অরণ্য ও জীব-বৈচিত্র বাঁচিয়ে রাখার অধিকার ইত্যাদি। এই পাট্টার আবেদন-ও করা হয় উক্ত গ্রাম-সভা মারফৎ। ... ...
ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘকাল মদ নিষিদ্ধ সম্ভবত গুজরাটে। সেখানকার প্রায় ১৫% আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনধারায় সংস্কৃতিতে এর কী দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব, সেই নিয়ে কোনও কাজ হয়েছে কী না জানিনা। তবে ২০০২ সালের দাঙ্গার হিংসালীলায় জনজাতির মানুষদের সামিল করা গিয়েছিল, সেটা জানি। ... ...
মুশকিলটা এইখানে, যে এই ধরণের কাজে গণতান্ত্রিকভাবে চাট্টি আলোচনা, বা কথা বলাটা গ্রাহ্য নয়। পাবলিক বলতেই পারে, এইসবই তারা করে আসছে শতশত বছর ধরে, কিন্তু বললেই শুনতে হবে, এরকম ধাষ্টামো করার সাহস ও শিক্ষা আমাদের থাকবে কেন? ছাগুলে পাবলিকের পাগুলে কথা নাহয় বাদই দেওয়া হলো, কিন্তু এমনকি আমাদের সিভিল ইÏনিয়ার ভাইবোনেরা ও উচ্চপদাসীন বিশেষজ্ঞরাই বা খবরের কাগজে - টিভিতে-মায় ফেসবুকে নিজেদের মতামত দেখে পুলকিত হয়ে ওঠার নাবালক লোভে বিশু থেকে শিশু হয়ে উঠছে আর আমরা সেই দেখে ধিনিকেষ্ট নাচ জুড়েছি। এভাবে হয় না। এজলাসে এই মোকদ্দমা উঠলে এই এতগুলি পণ্ডিতের রায় শুধু এক্তিয়ারবহির্ভূতই নয়, এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই দায়িত্বজ্ঞানহীন হিসাবে গণ্য হতে পারে। ফলতঃ, আমোদগেঁড়ে জনতা নিজেদের মধ্যে প্রতর্ক করুক। কিস্যু আসে যায় না। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ সম্পূর্ণ ঠিক কথা বলে থাকলেও না। সোসাল মিডিয়া আর খবরের কাগজে চ্যানেলে বসে এসব হয় না। তাই অন্ততঃ সাংবাদিক ভাইবোনদাদাদিদিবেয়াইবোনাই সকলকেই করজোড়ে অনুরোধ, এই বিশেষজ্ঞ মতামতটা দেওয়া একটু তামাদি রাখুন না। অনুভব করছি, তাই বলছি। ... ...
গোটা বস্তার সম্ভাগের যা আয়তন, তার ৫১% জমি তুলে দেওয়া হয়েছে মাইনিং, পাওয়ার-প্ল্যাণ্ট সহ বিভিন্ন প্রজেক্টের জন্য। এর মধ্যে ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্টের খাঁই মারাত্মক। ঐখানে কাজ করা এক বন্ধু জানিয়েছিলো যে প্ল্যাণ্টের যন্ত্রপাতির অবস্থা তথৈবচ। অথচ, ভারতের গৌরব এই বি-এস-পি, নবরত্নের এক রত্ন সে, তাকে তো উৎপাদন করে চলতেই হবে। তাই, আউটপুট বাড়াতে, ইনপুট বাড়াতেই হবে। এ’দিকে ছত্তিসগড়ের রাজনন্দগাঁও জেলাস্থ দল্লী-রাজারার মাইন শেষ হওয়ার মুখে। অতএব, বস্তার সম্ভাগের কাঁকের ও নারায়ণপুর জেলা জুড়ে রাওঘাটে আকরিক লোহার নতুন মাইন বানাও নতুন, দান্তেওয়াড়া জেলার খ্যাতনামা বৈলাডিলার চলতি মাইনের প্রোডাকশান ক্যাপাসিটি ২৯ মিলিয়ন টন থেকে ২০২০র মধ্যে ১০০ মিলিয়ন টন কর, রাজনন্দগাঁওর মহামায়া অঞ্চলে ও বস্তার-সংলগ্ন বালোদ জেলার দুলকিতে নতুন মাইন বানাও, প্রভৃতি উদ্যোগ। শুধুই কি ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্ট? আয়রণ ওর মাইনের নাম করে নারায়ণপূরের অবুজমাড়ে, কাঁকেরের চারগাঁ নামের দুইটি গ্রামে এসে গিয়েছে নিক্কো-জয়সওয়াল কোম্পানী। দান্তেওয়াড়ার বাচেলি ও কিরণ্ডৌলে তৈরী হচ্ছে আয়রণ ওর বেনেফ্যাকশান প্ল্যাণ্ট। ইতিমধ্যে বস্তারেই তৈরী হচ্ছে তিনটি স্টীল প্ল্যাণ্ট – ডিলমিলি, নগরনাড় ও লোহাণ্ডিগরে। প্রথমটি আবার ‘আল্ট্রা মেগা’। কাঁকেরের আমাবেড়া অঞ্চলে তৈরী হচ্ছে বক্সাইট মাইন। ... ...
আর আমাদের এখানে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর কারা যেন একটা মড়া ফেলে রেখে যায় রাস্তায়। পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়, আমার রাস্তার দিকের জানলা বন্ধ করে দিই। দমবন্ধ করে অপেক্ষা করি, কখন এলাকার লুম্পেন মস্তানটা আসবে চোলাইয়ের ঠেক ফেরত, লাশটার পায়ে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে ফেলে আসবে খাল পাড়ের ঝোপে। লাশের সদগতি হবে। তার জন্য অবশ্য গুনাগার দিতে হবে পাঁচ বছর ধরে। তা হোক, বাতাসে পচা দুর্গন্ধটা অন্তত কাটবে কিছুকাল। ... ...
একই পদ্ধতিতে, নকশাল-দমনের উদ্যেশ্যে সন ২০০৬তে সালওয়া জুডুম কম্যাণ্ডো-বাহিনী গঠিত হয় বস্তার সম্ভাগে।এই বাহিনীর পুরোভাগে ছিলেন ভা-ক-পা বিতাড়িত কংগ্রেস নেতা মহেন্দ্র কর্মা। বাহিনীর সদস্য হল ছোটো ছোটো আদিবাসী কিশোরেরা। তাদের হাতে বন্দুক ধরিয়ে দেওয়া হতে লাগল এবং দুই সপ্তাহের ট্রেণিং দেওয়া হতে লাগল, তাদের লাইসেন্স দেওয়া হল বস্তারের জংলা গাঁ-গঞ্জে যখন তখন হানা দেওয়ার, যত খুশি লুট, খুন, ধর্ষণ ও গৃহদাহ সংঘটিত করার। গ্রাম-কে-গ্রাম জ্বলে ছাই হয়ে গেলো। তটস্ত আদিবাসীরা পাহাড়ি জঙ্গল ছেড়ে নেমে এলো পাকা-রাস্তা তথা হাইওয়ের দুইধারে খাঁচার মত করে তৈরী ‘ক্যাম্প’-গুলিতে। পাশাপাশি ‘কোয়া’-উপজাতির আদিবাসী কিশোর যুবকদের দিয়ে তৈরী হল কোয়া-কম্যাণ্ডো। একই ধরণের কার্য্যকলাপের উদ্দ্যেশ্যে। এই সবের জন্য টাকাপয়সা সহ সমস্ত সুবন্দোবস্ত করে দিলো সরকার। এই সব ‘স্থানীয় কম্যাণ্ডো’-বাহিনীর পাশাপাশি জোরকদমে ‘মিলিটারাইসেশান’। স্থানীয় থানাগুলির হাতে চলে এল প্রচুর অর্থ, ক্ষমতা ও ক্ষমতার উৎস তথা ভয়াল অস্ত্রশস্ত্র। বস্তারজুড়ে প্রায় সমস্ত থানা পরিণত হল কাঁটাতার পাঁচিলে ঘেরা ক্যাম্পে। এবং একের পর এক আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন হতে থাকল অঞ্চলে, অজস্র গ্রামকে ঘিরে ফেললো সি-আর-পি-এফ, বি-এস-এফ, কোব্রা ব্যাটেলিয়ন নাগা ব্যাটেলিয়নের ক্যাম্প। শক্ত নজরদারীতে ঘেরবন্দী হয়ে গেলো বস্তারের মানুষেরা। তার পাশাপাশি অন্ধ্রের কুখ্যাত নকশাল-দমক গোষ্ঠী ‘গ্রেহাঊণ্ড’ এসে করে যেতে লাগল একের পর এক এনকাউণ্টার। ২০০৮-এ যখন অপারেশান গ্রীণ হাণ্ট আরম্ভ হয় তখন থেকে আজ অর্থাৎ ২৬শে মার্চ ২০১৬ অবধি আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন হয়েছে বস্তারে। ... ...
হেডমাস্টার গল্পের কথা মনে করি। দেশভাগের পর হিন্দু ছাত্ররা ওপার থেকে এপারে চলে আসায় পূর্ববঙ্গের সাগরপুর এম,ই, ইস্কুলের হেড মাস্টার মশায়ের ছাত্র কমে গিয়েছিল খুব। দেশভাগের পর তিনি ঠিক করেছিলেন ওপার থেকে আসবেন না, কিন্তু আসতে বাধ্য হন, ইস্কুল চলছিল না। যা ছাত্র ছিল, তাদের সকলের কাছ থেকে বেতন আদায় হয় না। বুড়ো হয়েছেন। কলকাতায় এসে তাঁর দিন চলবে কী করে পরিবার নিয়ে? পঞ্চাশোর্ধ হেড মাস্টার মশায় সওদাগরী অফিসে চাকরি খুঁজতে বেরিয়েছেন। গ্রামের ছাত্রর অফিসে এসে তার কাছেই চাকরি প্রার্থনা করছেন। একটি মেয়ের বিয়ে হয়নি, তিনটি নাবালক পুত্রও আছে। কত বড় সংসার, কী করে চলবে? হেড মাস্টার মশায়কে তার ব্যাঙ্কে ক্লার্কের চাকরি দিয়েছিল ছাত্র নিরুপম। হেড মাস্টার মশায় খুব ভালো ইংরিজি পড়াতেন। তাঁর ছাত্ররা কৃতী। তিনি তাঁর এতকালের অভ্যাস ছাড়তে পারেননি। গল্পটি এত হৃদয় গ্রাহ্য, এত মানবিক যে পড়তে পড়তে স্তম্ভিত হয়ে থাকতে হয়। পার্টিশন আমাদের জীবনকে কত রকম ভাবে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল তা নরেন্দ্রনাথের গল্পে ধরা যায়। মানুষের বেঁচে থাকার ভিতরেও যে নির্মমতা তৈরি হয়েছিল, তা তাঁকে না পড়লে ধরা যায় না। নরেন্দ্রনাথের অধিকাংশ গল্প জীবিকার কথা বলেছে। পার্টিশন জীবিকা বদল করে দিয়েছিল। মেয়েদের ঘর থেকে বাইরে এনেছিল জীবিকার খোঁজে (অবতরনিকা )। ... ...
২০১৯ এ তাঁরা ক্ষমতায় ফিরবেন কিনা এই প্রশ্ন তোলায় প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। এইসময় দৃশ্যতই ঘর্মাক্ত প্রধানমন্ত্রীকে গলায় জড়ানো জাতীয় পতাকায় ঘাম মুছতে দেখা যায়। এরপর তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তাঁর হয়ে প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য ইশারা করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং আবেগঘন কণ্ঠে ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গানটি পরিবেশন করেন। ... ...
আর আজ তকের ওই ব্রেকিং নিউজে ওই “ছোট্ট” এনোমালিটুকু ছিলনা – আফজল একদম পুলিশের চাহিদামত গল্প খুব কনভেনিয়েন্টভাবে টিভির পর্দায় বলে যায়। এই স্বীকারোক্তিকে আদালত এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন যে অন্যান্য অসম্পূর্ণতা এবং অসঙ্গতিকে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেন নি মৃত্যুদণ্ড দেবার আগে। অথচ এটাই কিন্তু আফজলের একমাত্র জবানবন্দী নয়। আফজল আরেকটা জবানবন্দী দিয়েছিল – হ্যাঁ, মহামান্য আদালতের সামনে, যেখানে সে বারবার তার প্রতি আনা প্রতিটা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এমন কি এই বহুচর্চিত এবং “গুরুত্বপূর্ণ” জবানবন্দী নিয়েও তার বক্তব্য, পুলিশ তাকে ওই জবানবন্দী লিখে দিয়েছে এবং তা মিডিয়ার সামনে বলতে বাধ্য করেছে ভয় দেখিয়ে। যে “গোপন জবানবন্দী” আজ তক ফাঁস করেছে সেটা আসলে ওই সাংবাদিক সম্মেলনের একটা রিহার্সালের রেকর্ডিং। ওই স্বীকারোক্তি দেবার জন্য পুলিশ তাকে পুরো এক দিন নগ্ন করে রেখেছে, দড়িতে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছে, নিজের মূত্রপানে বাধ্য করেছে। পাঠক, এই মামলার অফিসার ইন চার্জ এবং তার সহকারীর “সুনাম”গুলো আরেকবার মনে করে দেখবেন। POTAর বলে বলীয়ান পুলিশের কাছে করা স্বীকারোক্তি আদালতের কাছে এক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় আদালতের সামনে করা স্বীকারোক্তির চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ... ...
বৃন্দা গ্রোভার সম্পূর্ণ কথোপকথনটিকে নস্যাৎ করে জানিয়েছেন, এই উক্তি কোর্টে টিকবে না। প্রমাণ হিসেবে এটাকে কোনওভাবেই দেখা যেতে পারে না। কোর্টের নির্ধারিত সংজ্ঞা অনুযায়ী, একজন “উইটনেস” হিসেবে কোর্টের সামনে তখনই নিজেকে ডিপোজ করতে পারে, যখন সে ঘটনাটা ঘটতে শুনেছে, বা দেখেছে বা পুরো ঘটনা বা তার অংশবিশেষ নিজে করেছে। একজন জাস্ট শুনল অন্য দুটো লোক কিছু বলছে, সেইটা সে কোর্টে বললে সেটা উইটনেস হিসেবে কোর্টে গৃহীত হয় না। হেডলি যতক্ষণ জানিয়েছে সে নিজে লশকরের সাথে যুক্ত ছিল, এগে একাধিকবার মুম্বাইতে এসেছিল, রেকি করে গেছিল, সে লশকর অপারেটিভ আর আইএসআইয়ের থেকে এত টাকা পেত, সেটা মুম্বাইয়ের অমুক ব্যাঙ্কের অমুক ব্র্যাঞ্চ থেকে সে তুলত, ততক্ষণ সেগুলো সাক্ষ্যপ্রমাণ। কারণ সে নিজে থেকেছে, নিজে টাকা পেয়েছে, নিজে এসেছে, নিজে গেছে, কিন্তু ইশরাতের কেসে সে কিছুই জানত না – শুধু জেনেছে দুজনের কথোপকথন পাশ থেকে শুনে। হিয়ারসে এভিডেন্স-কে এভিডেন্স হিসেবে গ্রাহ্য করে না আদালত। আর, পাবলিক প্রসিকিউটর কি অমিতাভ বচ্চন নাকি, যে উনি কেবিসির হট সীটে বসে কম্পিটিটরকে তিনটে অপশন দিয়ে তার মধ্যে একটা পছন্দ করে নিতে বলছেন? এইভাবে জেরা হয় নাকি? ... ...
সমাজের বিবর্তনের সাথে সাথে মৃত্যুদণ্ডের গুরুত্ব ক্রমশ কমেছে,এমনকি তথাকথিত বর্বর সমাজও উপলব্ধি করছে মৃত্যুদণ্ড কোন সমাধান নয়। যে হত্যা বা ধর্ষণ তাৎক্ষনিক উত্তেজনায় অথবা পরিকল্পনার ফল হিসাবে ঘটে গেছে তা পাল্টা হত্যা বা ধর্ষণের মাধ্যমে পরিপূরণ করা অবাস্তব। মৃত্যুদণ্ড অপরাধীর প্রকৃত কোন সাজা বা আদৌ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নয়। অনুশোচনার,পরিবর্তনের ক্ষেত্র এক লহমায় ছিনিয়ে নেওয়া,প্রতিশোধ পরিপূরণ মাত্র। বর্বর সমাজ তাদের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত জ্ঞানে ক্রমে মৃত্যুদণ্ডের অসারতা থেকে সরে এসেছে ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির রাস্তায়। এ কোন গোবর খেয়ে বা পুরোহিত দক্ষিণায় প্রায়শ্চিত্ত করে পাপস্খালনের তঞ্চকতা নয় বরং ক্ষতিপূরনের পরিমাণ এতো বেশী যা অপরাধীকে সারা জীবন ধরে শোধ করতে হবে এবং প্রত্যহ তার অপরাধের গভীরতা তাকে স্মরণ করাবে। ... ...