মোট আটজন। একটা ছোট বৃত্ত। চারটে বড় পাঁচ ব্যাটারীর টর্চ। জ্বলছে। একটা তার মধ্যে মাঝেসাঝে একটু পাড়াটা বা মাঠে চোখ বোলাচ্ছে। যেসব মনুষ্য এবং মনুষ্যেতর প্রাণীরা তাদের এই কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করছে, তাদের মধ্যে কোনও অবাঞ্ছিত চাঞ্চল্য ঘটছে কিনা মেপে নিচ্ছে। আর বাকি তিনটে আলো স্থির। ঐ বৃত্তটার কেন্দ্রে। কেন্দ্র মানে ঠিক বিন্দু নয়। বরং আর একটা বৃত্ত। দু'জন কনস্টেবল শাবল দিয়ে ক্রমাগত ঝপাঝপ কুপিয়ে যার পরিধি আর গভীরতা সমানে বাড়িয়ে দিচ্ছে। তিনটে টর্চের সাথে পাঁচজোড়া চোখও ওই দিকেই নিবদ্ধ। বাকি একজোড়া চোখ আলাদা। সেও দেখছে ওদিকেই। কিন্তু ওই আলগোছে। মাঝেমাঝেই চোখ সরাচ্ছে। কখনও বুজছে। এই চোখজোড়ার মালিক গোটা দলটার মধ্যেই যাকে বলে অড ম্যান আউট। বাকিরা সবাই সশস্ত্র, সবার কাছেই থ্রি নট থ্রি রাইফেল, কেবল এই দলটার নেতা যে, স্থানীয় থানার মেজবাবু, এস আই দিবাংশু কর, যে সিগারেট টানছে, গর্ত খোঁড়াটা নজর করছে আর মাঝেমাঝে আড়চোখে ওই লোকটাকে দেখছে, তার খালি কোমরে সার্ভিস রিভলভার। কিন্তু এই লোকটা নিরস্ত্র। সুঠাম চেহারা, একটা চোখ আর ঠোঁটের কোনটা ফুলে রক্ত জমে আছে। পরনে একটা ছেঁড়া গেঞ্জি আর আস্ত লুঙ্গি। দুটো হাত সামনে জড়ো করা। হ্যান্ডকাফ লাগানো। কোমরেও একটা মোটা দড়ি বাঁধা যার খুটটা পেছনে এক কনস্টেবলের শক্ত মুঠোয়। ... ...
শাড়ির খসখসানি শুনে মেয়েমানুষ সেটা ওমর আলী আগেই বুঝেছিলো। তা মেয়েমানুষ হলেই তাকে হুট করে ঘরে বসতে দিতে হবে নাকি! ওমর আলী হানিফকে বকাঝকা করতে লাগল। দিনকাল বড় খারাপ। ৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। কাল সন্ধ্যাবেলাও মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা গুলি ফুটিয়ে জয় বাংলা বলে শ্লোগান দিয়েছে স্কুল ঘরের মাঠে। পুরো গ্রাম ভেঙ্গে পড়েছে তাদের দেখার জন্য। ঐ দলের পালের গোদা সেন্টু আজকাল কি রকম ঠেস মেরে মেরে কথা বলে। ছোকরার মাথায় কেউ ঢুকায় দিছে মেলিটারি আইসা ওমর আলীর বাড়িতেই বসছিল। খানাপিনা করছে। ওমর আলী ভাল উর্দু জানে। বাতচিৎ তার মাধ্যমেই হয়েছে। সেন্টু যে মুক্তিবাহিনীতে গেছে এইটা যদি মেজর সাবরে বলে ওদের বাড়িঘর সে জ্বালাই দিতে বলত, কি পারত না তখন ওমর আলী? গ্রামের মাইনষের উপকার করছে ওমর আলী। বাড়ি-ঘর জ্বালাইতে দেয় নাই। হিন্দু জেনানাদের নিজের ঘরে আশ্রয় দিছে। রাতের আন্দারে তাগো বর্ডার পার হইতে সাহায্য করছে। অহন যদি সেদিনকার চেংরা পুলাপান কান্দে মেশিনগান নিয়া চোখ গরম দেখায় কেমুন লাগে? ... ...
সকাল সকাল দুজন উঠোনে শুয়ে। এক বৃদ্ধ, এক কিশোরী। পুবদিক থেকে এক টুকরো এবড়ো-খেবড়ো বাঁজা জমি বিপুল উৎসাহে উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু এক গাঁ মানুষের কাঁধ ছাড়িয়ে মাথা তুলতে পারেনি। অবশ্য নতুন করে দেখার কী বা আছে তার? দেখা ছাড়া তার জীবনে আছেই বা কী? বর্ষা যায়, শরৎ যায়, তার শরীরে কেউ লাঙল দেয় না। আগাছা বুকে নিয়ে সারা দিনমান সে হাউ হাউ চেয়ে থাকে দূরের ধানক্ষেত সর্ষে ক্ষেতের দিকে। ক্রমশ গরু-বাছুর ফিরে গেলে তার বুক মাড়িয়ে সন্ধ্যা হেঁটে যায়। কাঁটা উঁচিয়ে রাত্রির বাড়ি ফেরা দেখে একমাত্র বামন খেজুর গাছটা। তারপর সেও ঘুমিয়ে পড়ে। মাঠ জেগে থাকে। সারারাত দেখে আর শোনে। পাশের বাড়িতে সবুজ কপাটওয়ালা দরজা বন্ধ করে রাত ফিসফিস করে। ... ...
অরূপ প্রথমে ভেবেছিল কম্পিউটারে বেশিক্ষণ কাজ করার জন্য চোখে ব্যথা হচ্ছে। সবাই যেমন বলে, টানা কিছুক্ষণ কাজ করার পর একটু বিশ্রাম, সবুজ গাছপালার দিকে তাকিয়ে থাকা – সে রকম করতে শুরু করেছিল। তারপর একদিন দোল-পূর্ণিমার রাতে ছাদে বসে নীপার সঙ্গে গলা মিলিয়েছিল – ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান। হঠাৎ আকাশে তাকিয়ে সে দেখতে পেয়েছিল চাঁদের চারপাশে রামধনুর সাত রং নিয়ে একটা বৃত্ত। সে কথা শুনে নীপা খুব অবাক হয়ে বলেছিল – কই, না তো। তারপর একদিন বাসের হেডলাইটের চারপাশে সে রকম রঙিন বৃত্ত দেখল। কিন্তু অরূপ খুব অবাক হয় যে, এই রামধনু নীপা দেখতে পায় না। ... ...
রুমেলার আকাশকে নিয়ে সমস্যা নেই। সমস্যা আকাশের বন্ধুর ফ্যামিলিকে নিয়ে। ঐ মেয়েটা একমাত্র চাকুরে নয়, ও গৃহবধূ। বাকি সবাই বিশাল বিশাল আই টি ক্যাট। কিন্তু সবচেয়ে জিতে গেছে যেন আকাশ আর নিশান্তের চোখে সুন্দরী ওই মেয়েটাই, এত ভাল সাজতে জানে। কী প্রপার ও। কী সুন্দর ওর পা, হাত। গাল, নাক। তা ছাড়া ও ভীষণ গোছানো। আকাশের বন্ধু নিশান্ত ওর বউকে নিয়ে পাগল। প্রশংসা শুরু করলে থামতে পারেনা। ... ...
বেশ দূর। বেশ কয়েক কিলোমিটার দূর। যখন পুলিশ স্টেশনে গেলাম দেখলাম বকুল বসে আছে। তার মুখ ফ্যাকাশে। নিজের নাম বলতেই পুলিশি স্টাইলে অফিসার কিছু প্রশ্ন করলেন আমাকে। তারপর একটা চিরকুট বের করে দেখালেন- দেখেন। সুইসাইড নোটে আপনাদের দুজনের নাম আর ফোন নম্বর লেখা আছে। অবশ্য তেমন কিছু না। শুধু লেখা আপনাদের সাথে যেন যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু আপনারাতো কোনো রিলেটিভ নন। স্রেফ বন্ধু। অবশ্য তার এক চাচাকেও ফোন করা হয়েছে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে। তিনি দুপুরের মধ্যেই এসে পড়বেন। তাকে বলা হয়েছে তিনি যেন ছেলের বাবাকেও খবর দেন। তিনিও হয়ত এসে পড়বেন বিকেলের মধ্যে। ...কিন্তু ঘটনা হলো কেন সে সুইসাইড করল? আপনারা কী জানেন এ ব্যাপারে? ...অত মানুষ থাকতে আপনাদের নাম কেন সে লিখে গেলো সুইসাইড নোটে? বিষয়টা পুলিশ হিসেবে আমাদেরকে অবশ্যই ভাবতে হবে... ... ...
চন্দ্রাবতী মায়ের প্রসঙ্গ তুলে খোঁটা দেয়, ‘বাবা তুমি কাপুরুষ’। এ শব্দটা মেয়ে শিখলো কোত্থেকে? মা ছাড়া বড় হওয়া গাঁও-গেরামের মেয়ে, কৈশোর না-পেরোনো বয়সেই অনেকখানি পরিণত। প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করা হয় না চন্দ্রাবতীকে, বরং আত্ম-আবিস্কারে মগ্ন হয় অঘোর গায়েন, সত্যি কি কাপুরুষ সে? দোষতো তার নিজের। কেনো নিজের অবস্থা বিবেচনা না করে সে আত্মসমর্পণ করেছিল প্রেম আর মোহের কাছে? তার বান্ধা পালা শুনে সুলেখা পাগল হয়েছিল বলেই কি নিজের অভাবী-আধপেটা জীবনে ওকে জড়ানো কোনো বিবেচনাসম্পন্ন কাজ ছিল? কিন্তু কীই বা করার ছিল? বয়সটা মোহাচ্ছন্নতার, অবাধ্য যৌবনের। কাপুরুষের মতো তখনো সুলেখার বারবার বিয়ে করার তাগিদকে অগ্রাহ্য করেছে সে, কালক্ষেপণ করেছে, ভৎর্সনা করেছে সুলেখাকে, ‘পাগলরে যদি বল নিজের ঘরে আগুন লাগাইয়া দিতে সে কি লাগাইবো?’ সুলেখাকে নিজের দুর্বহ জীবনের সাথে জড়াতে ঠিক বিবেক থেকে সায় পেতো না অঘোর -হয়তো এটা কাপুরুষতা। তবু সুলেখার সুখের কথা ভেবে কাপুরুষই থাকতে চেয়েছে সে, কিন্তু পারলো কই? ভালোবাসার ক্রমাগত আহবানের কাছে কত সময় কাপুরুষ থাকা যায়? ... ...
আমি নাড়ানাড়ি করছি একটা দূরবীন নিয়ে। দূরবস্তুর দর্শন সাধন যন্ত্রবিশেষ, টেলিস্কোপ। যার কাজই হ্ল দূরস্থিত বস্তুকে দৃশ্যতঃ নিকটস্থ বা বর্ধিত করা। গালিলেওর দূরবীন বলে চালানোর চেষ্টা করছে নাকি বিক্রেতা? না না, তা নয়। আমি যন্ত্রটির গুণাগুণ পরীক্ষার ছলে প্রথমেই বিক্রেতা যুবকের মুখের ওপর ফোকাস নিবন্ধ রাখলাম। সে আমার সামনে অনেক বড় হয়ে প্রতিভাত হ’ল। ঈষৎ লালচে দাড়ি। দাড়ির লোমকূপগুলি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাঁ ঠোটের কোণে হসন্তের মত সামান্য কাটা দাগ। কোথকার মানুষ সে? ফ্রান্স? জার্মানী? স্পেন? পর্তুগাল? বুলগেরিয়া? রোমানিয়া? হাঙ্গেরি না কিরঘিজস্থানের? নাকি সিরিয়া ইরাক ইরান তুরষ্ক আফগানিস্থান মিশরের? ভারতীয়ও তো হতে পারে। কেননা আজ যারা ইউরোপের ভবঘুরে, জিপসী, রোমানী, এককালে তারা ছিল ভারতীয়ই। ... ...
আমাদের একতলার ছাদ। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পড়ছে সেই ছাদে। আর ছাদটাকে আমার মনে হচ্ছে যেন একটা তেপান্তরের মাঠ! অথচ চারপাশে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা বহুতল আমাদের এই ছাদটাকে কেমন গায়েব করে রেখেছিল। জানো আব্বা, ইদানিং আমি ছাদে উঠলে খুব অসহায় বোধ করতাম। আকাশ দেখতে পাই না বলে নিজেকে মানুষ ভাবতে পারতাম না। দিগন্ত দেখতে পাই না বলে আমার শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত। তাই পারত পক্ষে আমি আর ছাদে উঠতাম না। কিন্তু এখন মায়ের খোঁজে এসে এ কী দেখছি আমি? ছাদটা যেন আমাদের ছাদ নয়, সত্যিকারের একটা তেপান্তরের মাঠ হয়ে বিরাজ করছে। আমার অদ্ভূত লাগছে। ... ...
সত্যি বলতে কি, আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় অদ্ভুত ব্যাপার হল আমাদের ঘন ঘন চেহারা (ভূমিকা) বদলানোর প্রবণতা। বিশ্বের কাছে বেশির ভাগ সময়ে, আমরা সহোদর ভাই-বোনের মত; সারাক্ষণ বাবার নেকনজরে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে বাবা বেড়াতে নিয়ে যায় কি একটা খেলনা কিনে দেয় কি আরো ভালো হয় যদি হাতখরচের পরিমাণটা একটু বাড়িয়ে দেয়। আর বাকি সময়ে আমরা বিবাহবচ্ছিন্ন দম্পতির মত, একসঙ্গে থাকছি, সারাক্ষণ পরস্পরের পেছনে লাগছি, পরস্পরকে দোষারোপ করছি যে কার জন্য একসঙ্গে থাকা যাচ্ছে না, কিন্তু কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছি না যে আমরা আর একসঙ্গে নেই আর সেইমত সমঝোতাতেও আসতে পারছি না। মনে হয় যেন আমাদের ভাগাভাগির ক্ষত এখনও এত জীবন্ত, এত যন্ত্রণাদায়ক যে আমরা যে ছেড়ে এসেছি তা ওরা মেনে নিতে পারে না, আর ওরাই যে আমাদের ছেড়ে আসতে বাধ্য করেছে আমরাও এটা মেনে নিতে পারি না । এইরকম একটা ক্ষেত্রে আমরা শুধু এই ভেবেই শান্তি পেতে পারি যে অন্যজনও আমার মতই আহত হয়েছে; সর্বপ্রকারে সেই চেষ্টা করাই এখন আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ। ... ...
পার্কসার্কাসের ধাঙড় বাজারের সার্কাস হোটেল। সামনের ফুটপাথে একটা হাইড্রেন, তার থেকে মুখ খুলে হোসপাইপ লাগিয়ে কর্পোরেশনের লোক রোজ ভোরে রাস্তা ধুয়ে দেয়। সময়টা যে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। তোড়ে যে জল বেরিয়ে আসে তা কিন্তু গঙ্গার ঘোলা জল, আর ফুটপাথে থেকে তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠলেই খোলা উনুন বসানো। সেখানে ঝকঝকে শিকে গেঁথে পোড়ানো হচ্ছে মশলা মাখা লালচে হলুদ রঙের মাংসের টুকরো। তৈরি হচ্ছে শিককাবাব। তার পাশেই দু'জন ময়দা মেখে লেচি বানিয়ে সেঁকছে রুমালি রুটি আর ভেজে তুলছে পরোটা। ... ...
১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে বাংলা একাডেমী আয়োজিত বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে দুটো ব্যানার হোর্ডিং-এর লেখা শ্লোগান পড়ে খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম—“শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বলুন”, “শুদ্ধ বানানে বাংলা লিখুন”। তখনই মনে কয়েকটা প্রশ্নের উদয় হয়েছিল। শুদ্ধ ইংরেজি বলা বা লেখার জন্য আমরা যতটা আগ্রহ বোধ করি এবং যত্ন নিই, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে তার অভাব কেন? আমরা সকলেই কি বেশিরভাগ সময় শুদ্ধ বাংলা বলি বা লিখি? অথবা ব্যাপারটা কি এরকম যে বাংলা ভাষায় সব রকম বানানই চলে, এবং, শুদ্ধতার কথা বলা এক রকম স্পর্শকাতরতা বা ছুতমার্গ? নাকি, আমরা যে অনেক সময়ই ভুল বলি বা লিখি তা নিজেরাও জানি না বলেই এই সব ভাবি? ... ...
যেখানে প্রথাগত সাংবাদিকতা ব্যর্থ,যুদ্ধের ময়দানে অনুপস্থিত, নির্দিষ্ট মিডিয়া হাউসের রাজনৈতিক অবস্থান অনুযায়ী খবরকে বিকৃত উপায়ে পরিবেশন করতে বাধ্য,সেখানে স্বাধীন আমজনতার সাংবাদিকতা এখন ভবিষ্যতের নূতন প্রহরী। নাজি জের্ফের মত এই সমস্ত স্বাধীন দেশপ্রেমী সাংবাদিকরা সংবাদের দুনিয়ায় গণতন্ত্র বজায় রাখছেন। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রবিরোধীদের ভূমিকার তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রস্তুত করছেন। সরকার এবং বিদ্রোহীরা যাতে গণতান্ত্রিক অবস্থান বজায় রাখে এবং আরও স্বছ ভাবে কাজ করতে বাধ্য হয় তার জন্য নিরলস কাজ করছেন। আর মধ্য প্রাচ্যের এই নূতন মিডিয়ার দুনিয়ায় নাজি জের্ফ এক অনবদ্য ব্যক্তিত্ব। আজকের দুনিয়া যেখানে জনসেবা ক্রমশ ক্ষীয়মাণ এবং সাংবাদিকতার চরিত্র পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে দ্রুত,সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের এই সমস্ত স্বাধীন নাগরিক সাংবাদিকদের গ্রুপ, ক্রমে আরও বেশি বিশ্বস্ত, বেশি নিরপেক্ষ এবং প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক মতামত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ক্রমশ নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছেন। অন্তত মধ্যপ্রাচ্যে নাগরিক সাংবাদিকতা প্রথাগত মিডিয়ার জায়গা সক্ষম ভাবে প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম হয়েছে। নাগরিক সাংবাদিকতার এই হটাৎ বিস্ফোরণ সাময়িক কোন ঘটনা নয় বরং এইটাই ভবিষ্যতের ছবি হতে চলেছে। নাজি জের্ফ যেমন বলেছিলেন “To defeat us, they would have to shut down the Internet. And they can’t do that because all of them use the Internet.” ... ...
অরণ্য তার অগণন সন্ততীদের জন্য যুগ-যুগান্ত ধরে সাজিয়ে রেখেছে খাদ্য তথা পুষ্টি-সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য-সুরক্ষার ঢালাও আয়োজন। কাঁকের-নারায়ণপুরের গ্রামগুলিতে বনৌষধি হিসেবে কাজে লাগে আম, আমলকি, হত্তুকী, ভেলওয়া, বজ্রদন্তী, পাঠ-জড়ী, ফলসা, বকফুল, রসনা, ভাসাম-পাত্রী, ভরহা, পোটর, হলুদ ফুল, ভুঁইনিম, নিমপাতা, মোগ্রালাটা, কুমড়ো-পাতা, ভালু-মুএসলি, সাদা মুএসলি, চার, লাসা, ফুটু, বোডা, অর্জুন গাছের ছাল, বেল, লেজোমররা, ভুঁইকুমড়ো, পৈরা-ফুটু ও নানাবিধ ব্যাঙের ছাতা, পোকামাকড়ের শুকানো মাংস প্রভৃতি থেকে তৈরী হয় নানাবিধ ওষুধ। উপশমের উপাচারও নানাবিধ। কয়েকটা উদাহারণ দেখা যাক ... ...
গোণ্ডি ভাষায় বিয়ে মানে মারমীং। বস্তারের গোঁড় জনজাতির মধ্যে নানান ধরণে বিয়ে প্রচলিত। বিভিন্ন দ্রাবিড়-গোষ্ঠির মত এইখানেই মামা-ভাগ্নীর বিয়ে বহুলপ্রচলিত। মানা হয়, মামার ঔরসে প্রথম সন্তান ধারণের অধিকার ভাগ্নীর। অবশ্যই, বিবাহোত্তর। পিসতুতো ভাই বোনেদের বিয়েও এইখানে সামাজিক স্বীকৃতি ও সমাদর পেয়েছে। এই এণ্ডোগ্যামি-কে ‘সমাজে দুধ ফেরানো’ ধরা হয়। অবশ্য সমস্ত বিয়েই যে এইরকম হয় না নয়। আপন আপন জীবনসঙ্গী চয়ন করে নেওয়ার সম্পুর্ণ সামাজিক অধিকার রয়েছে বস্তারের যুবক-যুবতীদের। বিভিন্ন ধরণের বিয়ে হলেও, প্রথাগত ভাবে মূল রূপরেখা একই রকমের। প্রথমে বরপক্ষ কন্যা পক্ষের বাড়ি যায় তত্ত্ব নিয়ে (কোনো কোনো প্রথায় এর উল্টোটাও হয়)। তত্ত্বে থাকে ফল, গুড়, মহুয়া, সালফি ইত্যাদি। সন্ধ্যে বেলা দুই পরিবারের মানুষেরা আর গ্রামের জ্যেষ্ঠরা বসে, খানা-পিনা চলে দেদার, সূচিত হয় বিবাহবন্ধনের প্রথম ধাপ। এর পর আরো দুইতিনবার এইভাবে তত্ত্ব নিয়ে যাওয়ার পর দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যায়। তারপর বিয়ে। বস্তারের বিভিন্ন ধরণের বিয়ের মধ্যে প্রধান ধরণগুলো নিয়ে একটু জেনেশিখে নেওয়া যাক। অবক্ষয়ের মুখে এই জানাশেখাগুলোই তো সম্বল। ... ...
এই সব পড়ে নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে যুবকবৃন্দ হাজির হল পাশের গ্রামের গাইতার কাছে। তার আশীর্বাদ নিয়ে হাজির হল সেই পাশের গ্রামের ঘোটুলে – এইবার চলল সারারাত দেদার গানের পালা। সেই গ্রামের ঘোটুলের লেয়া, মানে যুবতীরা-রা গানের মাধ্যমে হেঁয়ালী কৌতুকের প্রশ্নশেলে বিঁধতে থাকলো লেয়োর, মানে পাশের গ্রামের ঘোটুলের যুবকদের, আর সেই লেয়োরেরা গানে গানেই জবাব দিতে লাগল, উত্তর প্রত্যুত্তরে জমে উঠলে রাতের মৌতাত, রঙ্গকৌতুকের ফোয়ারা। এই গানের লড়াইয়ের নাম ‘দ্রার’। নাচে গানে সকাল হল। এ’বার বেরোনোর পালা। নাচিয়ে গাইয়ের দল আবার চলল গাইতার বাড়ির উঠোনে – এইবারের নাচের নাম ‘দেউর তেররুহানা’। নর্তকেরা একে অপরের কাঁধে চড়ে বানিয়ে তুললো মানব-মীনার – তারিফ ও আশীর্বাদ কুড়োলো গ্রামবাসীর, গাইতার। এইবার সাদরে খাওয়ানো হবে নাচিয়ে-গাইয়েদের, তারপর আবার সেই গ্রামের গাইতা-পত্নীর থেকে ‘শেষা’ বিদাই গ্রহণের পালা। ... ...
যে সময়কার কথা, তখন না ছিলো মাইন, না ছিলো রাষ্ট্র, না ছিলো এ-কে ৪৭। এইসবের অনেক অনেক আগে, কুয়াশাঢাকা কোন গণোনোত্তর অতীতে, থাকত সাত ভাই। সাত ভাই বড় হতে থাকল সেই গাঁয়ের বনে ঢাকা শান্ত ছায়ায়। বড় ছয় ভাই ছিলো দামাল দুরন্ত অরণ্যসন্তান। ছোটোটি ধির-স্থির, শান্ত-শিষ্ট, জ্ঞানগম্ভীর। তার গভীর কাজলচোখে ছায়া পড়ে অরণ্যের, আকাশের ও মননের আয়নায় ফুটে ওঠে প্রজ্ঞাঋদ্ধ তারারাজি। আর তার রক্তে রক্তে বইতো গানের তরঙ্গলহরী বুঝি। এক সাথে বারো রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারত সে। বনের গাছপালা, পশুপাখি, পোকামাকড়েরাও বুঝি শান্ত হয়ে শুনতো সেই বাজনা, ভেসে যেতো সুরের প্রবাহে। বাকি ছয়ভাই খেত-খামারের কাজ করতে লাগল দিনভর, বয়ঃক্রমে ঘর বাঁধলো, বিয়ে করল। পড়ে রইলো লিঙ্গো। অথচ তার গান-বাজনায় এতই মুগ্ধ ছিলো তার দাদাবৌদিরা, যে তাকে ঘরের কাজ, বনের ফল-কাঠ-বীজ-শিকার জোগাড়, খেতি-বাড়ির কাজ, এমনকি রান্না-বান্নার কাজ করার জন্য বকুনি দিতে মন সইতো না কারুরই। সে এ’সবের ধার ধারতো না, শুধুই গাইতো আর বাজাতো। ক্রমে ক্রমে তিক্ত হয়ে উঠলো তার ছয় দাদার গৃহী মন। ... ...
এমনভাবে দুহাতের অঞ্জলি ভরে দেবার ক্ষমতা যাঁর করায়ত্ত তিনি কেন মুঠি কৃপণ করে রাখলেন? আর এও মনে হয়, যে জন্য রাখলেন, তা কি সফল হয়েছে কোথাও? তিনি যাঁদের হয়ে সওয়াল করে গেলেন, অ্যাকাডেমিক আলোচনার বাইরে তাঁদের কোনো কাজে কি আসবে নবারুণের লেখা? কোনো কবি বা কোনো কবিতা তো শেষ কথা বলে না! কোনো প্রতিক্রিয়াও কি আনে? শেষ অব্দি আকাশের বোমারু বিমানকে পরম বিশ্বাসে পাখির ঝাঁক ভেবে নেওয়া মানুষরাই তো আমরা। ... ...
নবারুণ ভট্টাচার্যের লেখার সঙ্গে সহবাস আমার কাছে সাধারণত খুব স্বস্তিদায়ক হয় না। ঠিক যেরকম চ্যাপলিনের ছবি দেখাটা – মানে ঐ মজা, হাসি, ব্যঙ্গ, কৌতুক, খিস্তি খাস্তার আড়ালে থাকা যে বাস্তবের চাবুকটা আছড়ান এঁরা, সেটার শব্দ যাঁরা শুনতে পান… তাদের পক্ষে এই পাঠগুলো খুব সহজ হয় কিনা জানিনা… কিন্তু আমার অস্বস্তি হয়। তারপরে অনেকক্ষণ বা অনেকদিন নানা ভাবে এই আখ্যানগুলোর চরিত্ররা তাদের নানা ঘটনা নিয়ে ঘুরে ফিরে যাতায়াত করে মগজে, মনে… অস্বস্তি হয়। ... ...
বিস্ফোরণ ঘটছিল, আর তা নবারুণের মধ্যেই। বদলাচ্ছিলেন কবি। কবি নবারুণ ভটাচার্যের পরিচয় বদলে যাচ্ছিল কবি পুরন্দর ভাটের মধ্যে। যেমন সাহিত্যসম্রাট ঔপন্যাসিক বঙ্কিম মন খুলতেন আফিংখোর কমলাকান্তের মুখোশের আড়ালে – হয়তো তেমনিভাবেই পুরন্দর ভাট ছদ্মনামটাই আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল সময়দীর্ণ নবারুণের। কবি নবারুণ সিরিয়াস – তার থেকে শতযোজন দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছ্যাবলামোভরা গদ্যকার নবারুণ। কিন্তু ধীরে ধীরে দুইধারা মিলেমিশে গেছে। তাই ২০১২ সালে ‘ভাষাবন্ধন প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত ‘পুরন্দর ভাটের কবিতা’-তে কোথাও নেই নবারুণ ভট্টাচার্য! সেখানে ফিক্ফিক্ হেসে কপিরাইটের দাবি করেন ফ্যাতাড়ু ও চোক্তারেরা! সেখানে উৎসর্গ পত্রে লেখা থাকে – ‘সব খচ্চর ও হারামিদের’! ... ...