... কি আশ্চর্য্য, বিমান বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যর দায় স্বীকারের কথা উঠলেই সব তছনছ হয়ে যায়, কিন্তু বাম সমর্থকদের 'প্রতিনিধি' সেজে পার্টির সাধারণ সম্পাদককে কাঠগড়ায় দার করানোটা আবার কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ! নেপথ্য ভাষ্যকারকে সবিনয় অনুরোধ যে এই সুবিদাবাদী, সংকীর্ণ দলবাজির রাজনীতি এবং দ্বিচারিতা বন্ধ করুন। এতে বামপন্থার কোনো লাভই হবে না। সিপিআইএম-এর সাধারণ সম্পাদক পার্টির আজ এই বিপর্যয়ের জন্য অনেকাংশেই দায়ী। তাঁর তথাকথিত 'থার্ড-ফ্রন্ট'-এর নামে মুলায়াম সিংহ-জয়ললিতার লেজুরবৃত্তিও মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁকেও যেমন এই বিপর্যয়ের দায় নিতে হবে, তেমনি এই রাজ্যের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব, পার্টির রাজ্য সম্পাদক ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীরও এই বিপর্যয়ের দায় মাথা পেতে স্বীকার করা উচিত। কারণ পশ্চিমবঙ্গে গত ছয় সাত বছর ধরে বামপন্থী রাজনীতির যে কদর্য অবক্ষয় আমরা দেখেছি - গায়ের জোরে জমি অধিগ্রহণ, নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানো, রেশন ব্যবস্থায় দুর্নীতি, রিজবানুরের অপমৃত্যু, মহিলাদের প্রতি অসম্মানজনক মন্তব্য এবং সর্বপরি আক্রান্ত বামপন্থী কর্মীদের পাশে না দাঁড়াতে পারা - তার জন্য রাজ্যের বাইরের কাউকে দায়ী করা অনুচিত।... ... ...
এই গণেশকে সঙ্গে নিয়েই একদিন আমি পৌঁছে গেলাম স্বর্গলোকে, এবার ঠিক সময়ে। মেহফিল তখন সবে জমে উঠেছে। স্বর্গলোক দ্বিতল বিশিষ্ট। উর্ধভাগে গন্ধর্ব-কিন্নরদের নাচ, ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে সর্বসাধারণের জন্য নৃত্যাঙ্গন। দেখলাম সেই অনিন্দ্যসুন্দর স্বল্পবসন দিব্যপুরুষদের নাচ দেখার জন্য শুধু আমরা সমকামি পুরুষরাই নই, বহু নারীরাও ভিড় জমিয়েছেন। স্টেজের ওপর নাচের সঙ্গে সঙ্গে বহু ডলারের টিপ্সও হাওয়ায় উড়ে চলেছে। পরে অবশ্য দেখলাম, যা কিছু নোট উড়ে চলছে তার বেশির ভাগটাই এক ডলারের নোট। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ আরো উদ্দাম হতে লাগলো। আমাদেরও তখন অল্প অল্প নেশা হওয়া শুরু হয়েছে। স্টেজ থেকে নেমে এসে একজন দিব্যপুরুষ আমাদের সঙ্গে এসে বসলেন। সাধারনতঃ এই সময়, আধো আলোছায়াতে, একটুকু ছোঁওয়াছুঁয়ির ফাল্গুনি শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু আমার কপাল খারাপ। গণেশ আই আই টি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং করে এসে এম আই টিতে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র। বামপন্থী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। অতএব ও গে বার ডান্সারদের সমাজতাত্তিক ইতিবৃত্ত জানতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিউটি (দিব্যপুরুষের এই নামই আমি দিয়েছিলাম) খানিকবাদে বিরক্ত হয়ে অন্য টেবিলে উঠে চলে গেল। গণেশ অবশ্য তার আগে ওর হাতে বেশ একটা ভালো টিপস দিয়ে দিল। ... ...
রামচন্দ্র জানতেন, এবং বুঝতেন, জম্বুদ্বীপে পাকাপাকি সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গেলে, পপুলার সাপোর্ট তাঁর দরকার। শুধুমাত্র গায়ের জোরে এই আসমুদ্র-হিমাচল দাবিয়ে রাখা বেশিদিন সম্ভব নয়। আজ লঙ্কা জয়ের দরকার হয়ে পড়েছে কারণ এই অযোধ্যাই হবে তাঁদের আর্য-সাম্রাজ্যের পরীক্ষাগার। কিন্তু দশরথ বা গৌতম মুনির মতন ওটাকেই মূল লক্ষ্য বলে রামচন্দ্র ধরে নেননি। কারণ কেউ জানুক বা না জানুক, এটা ঘটনা যে আর্যত্ব দিয়ে রামচন্দ্রের কিছু এসে যায় না। ওটা ততদিন-ই দরকার, যতদিন ক্ষমতার পক্ষে কাজ করবে। রামচন্দ্র বোঝেন ব্যবসা। ক্ষমতার ব্যবসা। যে বা যা তাঁকে ক্ষমতা এনে দেবে, তিনি তাকেই ব্যবহার করবেন। যেমন, এই মুহূর্তে, অযোধ্যার ক্ষমতায় নিজের গদি সুনিশ্চিত করতে হলে, লঙ্কা অভিযান দরকারি, আর তাই ব্যবহার্য। ... ...
কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ তো অহিংস, তিনি হঠাৎ কেন এরকম ভাবে মোদিকে আক্রমণ করবেন। এর দায় লেখকের। ডাক পাঠকের মত সেও শুনেছে। শুধোলে ঠাট্টা করে বলে, ওনার দেড়শর ওপর বয়স, এখন কি আর মুখের ভাষা ঠিক থাকে। কিন্তু সে বস্তুত বিশ্বাস করে, এ না বলে গুরুদেবের উপায় ছিল না। তিনি হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, চলমান বিশ্বযুদ্ধ দেখতে দেখতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন। মুসোলিনির রাজসিক মায়াকে ঔদার্য ভেবে পরে মাথার চুল ছিঁড়েছেন। হিংসা বড় পীড়া দ্যায় তাকে। তবু সেসবই শেষ কথা নয়। দাদু উত্তরাধুনিক, সোভিয়েত পতনের পরে ক্রিশ্চান আলোকপ্রাপ্তি ছেড়ে উত্তর উপনিবেশবাদের মধ্যে ইতিহাসের আশ্রয় দেখতে পাচ্ছেন। বিশ্বনাগরিক বলে আরাফত, শ্যাভেজ, জাপাতিস্তাদেরও ঘুরে ঘুরে দেখেছেন তিনি। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর থেকে শিল্পবিপ্লবের আগ্রাসী রূপটা ক্রমশঃ প্রতীত হচ্ছে তাঁর মানসে। অরণ্য, কৃষি ধ্বংস করে পরিকল্পনাহীন ভাবে বেড়ে চলেছে কিছু উঁচু মানুষের দাবি। দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে, এত দরিদ্র হচ্ছে যে দারিদ্রের সংজ্ঞা পালটে দিতে হচ্ছে। পৃথিবী উষ্ণতর হচ্ছে। মানুষকে বের করে আনা হচ্ছে জল-মাটি-অরণ্য-পাখি-র সংশ্লেষ থেকে। আরও একলা হচ্ছে, এলিয়েনেটেড হচ্ছে সে। আর রবীন্দ্রনাথ দেখছেন, আমাদের ঐতিহ্যে, সংস্কারে, উৎসবে মিশে আছে এর বিরোধিতার বীজ। জাপাতাদের সংগঠক জেনারেল মার্কোস বলছেন, একমাত্র ট্রাইবাল কমিউইনিটি স্ট্রাকচারেই তিনি দেখছেন আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার শক্তি। রবীন্দ্রনাথও দেখছেন, এই হিন্দুত্বকে যা সবাইকে অমৃতের পুত্র বলে সম্বোধন করে। যা কুল-মান-এর তোয়াক্কা না করে মনের মানুষের সন্ধানে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। যে হিন্দুত্ব দেখায়, ছোট ছোট মানুষের কাজ, তাদের অ্যাবস্ট্রাক্ট লেবার-এর সম্মেলন শতশত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ-এর পরেও থেকে যায়। দুহাজার বছরের ইতিহাস পুনর্পাঠের সূত্র দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বলছেন, ইতিহাস, সমস্ত যুগে সমস্ত দেশে এক হবে এই কুসংস্কার ত্যাগ না করলেই নয়। তিনি জানেন রাজার রাজা হয়ে মানুষের বেড়ে ওঠার জন্য এই পঠনের দরকার কতটা। বিতর্কের গভীরে ঢুকে খুঁজে আনতে হবে সত্য কী, ঝড়ে বাইরের নিয়ম নড়ে যাওয়ার পর ভবিষ্যতের জন্য অটুট হয়ে কোনটা পরে থাকে। ... ...
"ছাড়পত্র" শব্দটা শুনতে নিরীহ মতন, আসলে এর প্রকৃত অর্থ হছে মোদীর ইচ্ছামত ধনের প্রসার যে কোনওদিকে - সমান্তরালভাবে, মাঠে ঘাটে, উল্লম্বভাবে, মাটির ওপরে বা নিচে, এবং পরোক্ষভাবে, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের দাবি মেনে নেবার মাধ্যমে, ইনসিওরেন্স এবং খুচরো বিপণন ক্ষেত্রে। আর যদি পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়মকানুন, মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষিজমি বা কোনও গোষ্ঠীর অস্তিত্ব এই প্রসারণের পথে বাধা সৃষ্টি করে, তা হলে তাদের ছিঁড়েখুঁড়ে উন্নয়ন নিজের রাস্তা করে নেবে, সরকারের প্রত্যক্ষ মদত এবং সহযোগিতায়। কঠোর সিদ্ধান্ত নেবার এই ক্ষমতাই মোদীকে এত জনপ্রিয় একটি আইকন করে তুলেছে ভারতীয়দের কাছে - এবং আন্তর্জাতিকভাবেও, বিশেষত বড় বড় বণিকগোষ্ঠীর কাছে। কেন এবং কীভাবে দেশের সেরা বিজনেসম্যানেরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা কংগ্রেসের থেকে মুখ ফিরিয়ে মোদীর সমর্থক হয়ে গেলেন, তা খুঁজতে গেলে ভারতীয় রাজনীতির মূলে বয়ে চলা জীবনের ছন্দের দেখা মেলে। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও দেখার বিষয় যে এই একদেশদর্শিতা এক অভূতপূর্ব সংকট তৈরি করেছে, তাৎক্ষণিক পাইয়ে দেবার খেলা ক্রমশ তার স্বাভাবিক সীমানা ছাড়িয়ে ফেলেছে। নিও-লিবারাল পলিসি এবং লাইসেন্স রাজ অবসানের ফলে কম্পানিগুলো যে সুবিধে ভোগ করতে শুরু করেছিল, এবং সরকারের যে লাভ হবার লক্ষ্যমাত্রা ছিল কোম্পানিগুলোর থেকে, তা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। মাদ্রাজ স্কুল অফ ইকোনমিক্সের এন এস সিদ্ধার্থনের মতে, বর্তমান ব্যবসায়িক পরিবেশে মুনাফা ম্যানুফ্যাকচারিং-এর মাধ্যমে ঘটছে না, ঘটছে সরকারের মদতে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করে। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের প্রকাশিত রিপোর্টের কিছু অংশ তুলে ধরে তিনি দেখিয়েছেন, যদিও কয়লা আর টুজি স্পেকট্রামের অ্যালোকেশনের দুর্নীতিতে কোম্পানিগুলোর প্রচুর লাভ হয়েছে, আসলে কিন্তু লাভ হয়েছে কোম্পানিগুলোর "প্রেফারেন্সিয়াল অ্যালটমেন্টে"র ফলে, যে ধরণের অ্যালটমেন্ট না হলে হয় তো কোম্পানিগুলো সাদাসিধাভাবেই ব্যবসা করতে থাকত - বড় কোনও লাভের মুখ তারা দেখত না। এই প্রাকৃতিক সম্পদ কিন্তু শুধুই কয়লা বা টুজি স্পেকট্রামেই সীমাবদ্ধ নয়, এমন কি জল আর জমিও এর মধ্যে আছে। আর এই সবের মধ্যে উঠে আসছে মোদী-বিবৃত নতুন কর্পোরেট ভারতের পোস্টার বয় গৌতম আদানীর মুখ, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর উত্থানের সাথে সাথে যিনি অবিলম্বেই দেশের সর্বাধিক আলোচিত বিজনেসম্যান হিসেবে পরিগণিত হতে চলেছেন। ... ...
২০১৪র সাধারন নির্বাচন যে কথাটা সর্বাগ্রে প্রমাণ করল, তা হল – ভারতীয় মিডিয়ার আর যাই থাক না কেন, মেরুদণ্ড নামক বস্তুটি নেই। নরেন্দ্র মোদির ফ্যাসিবাদি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অওয়াজ তোলার এদের না আছে সদিচ্ছা, না আছে সৎ সাহস। এদের মধ্যে কেউ কেউ তো আবার সক্রিয় ভাবে হাত ও মিলিয়েছেন মোদির সঙ্গে। মিডিয়া হাউস গুলো দিনের পর দিন সাংবাদিকতার নামে যা করে গেছে তা হল – মোদি বন্দনা – মোদির প্রোপাগ্যান্ডা। মোদির বেশ কয়েকটা "ফিক্সড" ইন্টারভিউ দেখলে ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হয়। সাজানো লাগে। এই সমস্ত "ফিক্সড" ইন্টারভিউগুলোতে মোদিকে স্নুপগেট বা সাজানো এনকাউন্টার নিয়ে একবারও জবাবদিহি করতে হয় না। থাকে না কোনো প্রতি-প্রশ্ন। তাঁর মুখ নিঃসৃত বাণীই প্রশ্ন কর্তার কাছে ধ্রুব সত্য। ... ...
একাধিক ভোটের কাউন্টিং এজেন্ট হওয়ার সুবাদে দেখেছি, ব্যালটের পেছনে ভোটার নিজের বাতিল ভোটের সম্পক্ষে যুক্তি লিখে এসেছেন, কিম্বা সিম্পল খিস্তি l বাতিল ভোট তখন একটা বেশ ভালো পার্সেন্টেজ পেত l ইভিয়েম সে সুযোগ থেকে নাগরিককে বঞ্চিত করেছিল l একসঙ্গে দুটো বোতাম টেপা যেত না l টিপলেও ফ্র্যাকশন অফ সেকেন্ডের ফারাক বুঝতে পারত মেশিন আর প্রথম ভোটকে কাউন্ট করত l ২০১৪র ভোট এদিক থেকে জরুরি হয়ে উঠেছে l এই প্রথম ভারত দেশ না-ভোটের অধিকার দিয়েছে l একটা স্টেপ যাকে অস্বীকার করে আর থাকা যায়নি l কিন্তু রাইট টু রিকল নেই, এখনো l আর এখনো বুঝে উঠতে পারিনি যে কী করে আমার সব সামাজিক ইস্যুর প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারেন একজন ব্যক্তি – পাঁচ পাঁচ বছরের জন্যে l আমার প্রতিটি রিয়াকশন কী ভাবে পৌঁছয় একজন প্রতিনিধির কাছে ! আর যাঁরা মনে করেন, যে ন্যূনতম হলেও পৌঁছয় – একজন প্রতিনিধি অন্তত থকা জরুরি – তাঁদের কাছেও আমার জিজ্ঞাসা – এই প্রতিনিধিরা সর্বোচ্চ স্তরে যাওয়ার আগে কিম্বা পরে এমন লেভেলের ব্যক্তিগত আক্রমণে যান, যে তাঁদের দেউলিয়া মনে হতে থাকে l এঁদের ঠেকাতে তখন আবার পুলিশ লাগে কিম্বা কমিশন – যারা আবার সকাল সাড়ে ৯ টায় সেন্ট পার্সেন্ট পোলিং হয়ে গেলেও বলতে থাকেন – ভোট হয়েছে যথাযথ l আর সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গিয়ে একজন আরেকজনের বক্তব্যই শোনেন না l শুধু তাই নয় – খিস্তি করেন, মারামারি করেন, এবং তাঁদের মারামারি ঠেকাতে বারের মত বাউন্সার লাগে, যাদের নাম হয় মার্শাল l এঁরা এ-ও জানেন যে এঁদের সমস্ত কীর্তি কলাপ টিভিতে দেখা যাচ্ছে – লাইভ l কিন্তু এঁরা একই সঙ্গে এ-ও জানেন যে ভোটারদের সঙ্গে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে গেছে l যে ভোটারদের নিয়ে প্রতিনিধি মিছিল করেন বা করতে চান l ক্রমশ মানুষ ও মিছিল আলাদা হয়ে যায়। ... ...
জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে এবং তাদের পরিবেশ জীব – বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সিকিমবাসী আন্দোলন সংগ্রাম চালাচ্ছে সেই ১৯৯৫ সাল থেকে। পশ্চিম বাংলা, আসামেও বিভিন্ন রাজনৈতিক, পরিবেশবাদী সংগঠন ক্ষতিকর এসব বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম চালাচ্ছে। গনসংহতি আন্দোলন সহ বাংলাদেশের বাম মোর্চা গত ৮ থেকে ১০ এপ্রিল ২০১৪ তিস্তার পানির দাবিতে ঢাকা থেকে লালমনিরহাট দোয়ানি পর্যন্ত রোড মার্চ করেছে। যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল তিস্তা নিয়ে উদ্ভুত এই সমস্যা একা বাংলাদেশের মরুকরণ বা খাদ্য নিরাপত্তার সমস্যা নয়, কিংবা পশ্চিম বাংলার উন্নয়নের সমস্যা নয়। অথবা এককভাবে তা সিকিমের আদিবাসী, সাধারন মানুষদের জীবন, জীবিকা, ধর্ম, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও জীব – বৈচিত্র্য রক্ষার সংগ্রামও হতে পারেনা। ক্ষতিগ্রস্ত আমরা সবাই। ফলে বাসযোগ্য পৃথিবী নির্মাণের এই সংগ্রাম সিকিম, পশ্চিম বাংলা, বাংলাদেশ সহ সকলের। ... ...
সুখী দিদি ঘাসের উপর দিয়ে ঝরা পাতার উপর দিয়ে ছায়ার উপর দিয়ে খণ্ড খণ্ড নৈশব্দের মধ্যে দিয়ে ছবির বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে গেছে। সাধু পরমানন্দের বাড়ির পিছনের বাড়িটিতে। ওই বাড়িটিতে সুখী দিদির ছোট একটি ঘর। জং ধরা চালে নীলমণি লতা। দুখীরাম সেই কবে এনেছিল। তাদের পুকুরটিতে গোহাটের গরুগুলি মুখ দেখে আর জল খায়। হাম্বা করে ডাক দেয়। সুখী দিদি এই ছবির বাগান থেকে এই বাড়িটিতে যেতে যেতে তার পায়ের ছাপটি ফেলে যাচ্ছে ঘাসের উপরে। সেখান থেকে জোনাকি পোকার মত মৃদু মৃদু আলো বেরুচ্ছে। আর এই দেখে লিকলিকে লোকটির দুচোখ বেরিয়ে এসেছে। গলা থেকে বেরুচ্ছে গর গর শব্দ। সাধু পরমানন্দের বৌ কমলা দিদিমণি রান্না বান্না ফেলে দৌড়ে এসেছে । লোকটিকে পেছন থেকে টেনে ধরল। লোকটির গলার রগ ফুলে উঠেছে। কপালে ঘাম। ছুটে যাওয়ার ইচ্ছে। কিন্তু সত্যি সত্যি যাওয়ার ইচ্ছে নেই। সুখী দিদির নাম ধরে ডেকে যাওয়াই তার জন্য ভয়াবহ এবং একমাত্র নিয়তি। কমলা দিদিমণি বলছে, মথি উদয়। মথি উদয়। ঘরে আয়। ঘরে আয় বাবা। যেতে যেতে ফিরে ফিরে ছবির বাগানটিকে দেখতে লাগল মথি উদয় নামের এই মানুষটি । বাগানের মধ্যেকার নতমুখী মানুষটিকে। তার চলে যাওয়াটিকে। উড়তে থাকা কালো কাকটিকে। সাধু পরমানন্দ তখনো সুর করে বলছে- -- ‘ঈশ্বর কহিলেন, রাত্রি হইতে দিবসকে বিভিন্ন করণার্থে আকাশমণ্ডলের বিতানে জ্যোতির্গণ হউক; সে সমস্ত চিহ্নের জন্য, ঋতুর জন্য এবং দিবসের ও বৎসরের জন্য হউক; এবং পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য দীপ বলিয়া আকাশমণ্ডলের বিতানে থাকুক; তাহাতে সেইরূপ হইল।‘ ... ...
এখন এসব কথাবার্তা থেকে কি আমন ধানের ক্রপিং ইনটেনসিটি ক্যালকুলেট করা যায়? বিঘা প্রতি ইনটারনাল রেট অব রিটার্ন হিসাব করা যায়? অপটিমাম কস্ট বের করা যায়? ল্যাসপেয়ার্স ইনডেক্স কষা যায়? কস্ট-আউটপুট রেশিও বের করা যায়? অথচ ভারত সরকার, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, আই এম এফ জানতে চাইছে। ভাল হল যে সর্বজনীন ভাইরাল ফিভারে আমিও আক্রান্ত হলুম। টানা ছুটি। দাড়ি গজিয়ে গেল। হাত বুলিয়ে দাড়ি আদর করি। এই ফাঁকে, মুখে তো অফুরন্ত হাই, ছেলেমেয়েকে ওদের ছোটবেলায় যে জুনিয়ার এনসাইক্লোপিডিয়া কিনে দিয়েছিলুম, তার ছবি দেখে টাইমপাস। হাই তুলতে-তুলে দাড়ি খুঁজি। নানারকম জ্ঞানবিজ্ঞানের দাড়ি। ... ...
প্রায় গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি, এমন সময়ে পেছন থেকে লোকটির গলা কানে আসে। ফিরে দেখি, এদিকেই হেঁটে আসছে। ও ইশারায় আমাকে অপেক্ষা করতে বলে। ওপর থেকে তার চেহারার প্রকৃত বিশালত্ব আন্দাজ করা যায় না। তাকে ছোটো, এমনকী, যথেষ্ট অসহায় বলে মনে হয়। তার হাঁটার ভঙ্গীতে ক্লান্তির ছাপ ফুটে ওঠে। আমি ঢালু জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকি। “আমাকে দেখলে চিনতে পারবে? পরে?” ফেরার পথে লোকটি জিজ্ঞাসা করে। আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম। ও চুপ করে থাকি। “মনে থাকবে নিশ্চয়ই।” লোকটা মুখ থেকে অনেকটা ধোঁয়া ছেড়ে হাসে। অল্প কাশি হয়। সে বুকের ওপর আড়াআড়ি হাত রাখে। ও ধীরে ধীরে সামলে নেয়। একটি কুকুর হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে এসে পড়েছিল। হর্ণ দিতে ছিটকে সরে যায়। আমি আড়চোখে বাঁ-দিকে তাকাই। দেখি, চোখ বন্ধ। ও ঠোঁটের কোণে অল্প হাসি লেগে আছে। “ইটস নট ইজি, ইয়াং ম্যান। নট সো ইজি।” ... ...
লাইব্রেরিতে সোভিয়েত দেশ খুব একটা কেউ পড়ত না। বরং ‘কালনাগিনীর প্রতিহিংসা’ কিংবা ‘মরণগুহার ভয়ংকর’ খোঁজ করেও পাওয়া যেত না। আমার কিন্তু সোভিয়েত দেশ ভালো লাগত। কী মসৃণ ঝকঝকে কাগজ, কী সুন্দর রঙিন ছবি। তখন অন্য কোনও পত্রিকায় রঙিন ছবি প্রায় দেখাই যেত না। নতুন পত্রিকা এলেই আমি প্রথমে পৃষ্ঠা খুলে গন্ধ শুঁকতাম। কাগজ থেকে, অক্ষর থেকে রাশিয়ার বাতাস ফুসফুস ভরে টেনে নিতাম। বুকের ভেতরটা বিশ্বাসে ভরে উঠত। মনে হত আমার শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে লেনিনগ্রাদ, মস্কো, বাকু, আজারবাইজান, তাসখন্দের বাতাস। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করতাম পৃথিবীর ভেতরে শ্রেষ্ঠ দেশ হচ্ছে ইউ এস এস আর। পত্রিকায় এক একজন লেখকের নাম খুঁজে পাই, লাইব্রেরি থেকে তাদের বই খুঁজে নিয়ে পড়ি। বাংলায় অনুবাদ। তুর্গেনিভ, গোগোল, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি। নিকোলাই অস্ত্রয়েভস্কির ‘ইস্পাত’ পড়ে তো দু’রাত ঘুমই হল না। আমারও ইচ্ছে করত মাতৃভূমি না বলে আমাদের দেশকে পিতৃভূমি বলে ডাকতে। সেই লেনিনগ্রাদ থেকে ভারখায়ানস্ক – পৃথিবীর আদ্ধেকটা জুড়ে তো ওরাই রয়েছে। যুদ্ধ হলে শুধু একটা বোতাম টিপবে, আমেরিকা ফিনিশ। ... ...
প্রথম দেখায় বিন্দুরে বুকিং দিছিল মতি। এমন মাল না চাখলে জিবলা কাইট্টা ফালান্ উচিত। কিন্তু বিন্দু তো আটটা-দশটা বাজারী মাইয়্যার মতো না। হলে সিট পাওয়ার জন্য একটু তদবীরে এসেছিল। পরে অবশ্য কৃতজ্ঞতাবশত দলের বড় মিছিলগুলানে অ্যাটেন্ড করত। সেই থেকে শুরু। যা হোক, মতিন ওরফে কুক্কুরু-মতি সেইদিন সাক্ষাত মোরগা-মতি। দুধচিনি বেশি কিং সাইজ চা খেয়ে কথা উঠছিল, কী করে অপোন্যান্ট গ্রুপকে ক্যাম্পাস ছাড়া করা যায়? তখন গাণ্ডু-হেলালের টেম্পার দেখার মতো। বলে, ‘অত কওনের কাম নাই, ল সেন্ট্রাল মাঠে যাই, কাটারি হান্দায়া দেই। ব্যস ফাইনাল।’ ‘কিন্তু বিন্দু যে আমারে টাসকি দিলো দোস্ত!’ ‘হ, কঠিন মাল একখান।’—এখনও নিজের কথা কানে বাজে কুক্কুরু-মতির। কী করে পারত সে? যার সাথে একটা লটরপটর চলতেছে তারে নিয়া এমন ছালবাকলাহীন কথা! এখন মাথা দপদপ করে। শেষে রাগ বাড়ে নিজের ওপরই। ওর নাম কুক্কুরু-মতিন না হয়ে গাণ্ডু-মতিন হওয়া উচিত ছিল। বুঝতেই পারেনি এই বিন্দুর প্রেমে পড়ে যাবে, আর ওর গলার কাটা হয়ে উঠবে বিলা-মেজবাহর ডাইল উৎসবের রাত। কারণ, শুধু দেখে খান্ত হয়নি, সেদিন রগরগে কিপটা ব্লুটুথ দিয়ে নিজেদের মোবাইলে নিয়ে যে যার মতো ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বিদিক নাচ-গানা করেছিল। সেদিন ঘুরেফিরে একই কথা—মামা কইও না, কইও না, শহীদ হয়া যাই! সেদিন ‘ম্যায় দুধারি তলওয়ার হু’ গান গাইতে গাইতে তারা ভাগ করে নিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ দিকের টেন্ডারবাজি—‘বকশিবাজার তোর, গিরিঙ্গি লেন গাণ্ডুর আর গেদু-আলিমের হইল কোর্টচত্বর।’ ... ...
লোকটা অবিনাশকে দেখে হাসল। ভাল আছেন, অবিনাশ? অবিনাশ ভাবল, এই যে ভাল আছি কিনা জিজ্ঞেস করল লোকটা, আসলে কিন্তু এটা কোনও প্রশ্ন নয়। আমি তো কোনওদিনই উত্তর দিই না। তাতে তার খুব একটা কিছু আসে যায় বলে মনে হয়না। তবু লোকটা বলে, ভাল আছেন অবিনাশ? আসলে ও আমায় মনে করিয়ে দেয় যে আমি অবিনাশ। কিন্তু আমি অবিনাশ কেন? আমার বৌ নেই কেন? আমি চাকরি করিনা কেন? আমি বাড়িতে একা থাকি কেন? আমি কি পাগল? ... ...
তারা আসল দরিয়ায় নয় এখন। সোমনাথপুরের বর্ষায় আউশ ধানের ক্ষেত, জলাভূমি, শ্রাবণের পূর্ণিমার জোবায় সাগর থেকে ঠেলে-পুরে দক্ষিণাঞ্চলে যে-জল উঠেছে তা নামার আগেই আবার অমাবস্যার জোবা এসে গেছে। ফলে পুরো দিনের আলো ঝড়ের সন্ধ্যা-আকাশের রূপ ধরেছে। পাগলাটে আকাশে গুড়ো বৃষ্টি উড়ছে বর্ষার নির্মেঘ আকাশে যেমন গুটিপোকার পঙ্গপাল নামে। জোয়ারের জল ক্ষেতের পেট ফাঁপিয়েছে মরা গোরুর মতো। বীজধানের ক্ষেত তো কথাই নেই, ভিটার পাটক্ষেতও ভাসিয়েছে তুফান। বিশাল ক্ষেতের কোথাও আলের উপর বেড়ে-ওঠা নিসঃঙ্গ খেজুর গাছগুলোই দাঁড়িয়ে আছে বাতাসের ঝাপটায় বিধ্বস্ত মাথা নিয়ে। এ-গ্রাম ও-গ্রামের মাঝখানে অবাধ জলরাশিতে ঢেউয়ের হিল্লোলে কলম ফরাজী নাতিদের এটা দরিয়াই ভেবে নিতে বলেছে। ডুবে যাওয়ার আগে বিলের মাঝে যে ছোট খাল ছিল তার শেষমাথার জলায় শাপলা ধরেছে প্রচুর। জল পেয়ে শাপলা আরও দীর্ঘ হয়ে উপরে ভাসিয়েছে মাথা। লম্বা শাপলার ঝাড় তুলে এনে রেঁধে ভাওর দিন চালিয়ে নেবে এমন পরিকল্পনা করে কলম ফরাজী নৌকায় উঠে বসে। আমগাছের শেকড়ের সঙ্গে বাঁধা নৌকার রশির বান খুলে নাতিদের ‘জোংরা’সহ আসতে বলে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির হাত থেকে পিঠ বাঁচানোর জন্য। বড় নাতি হাবেলের পরনের লুঙ্গি খুলে দুভাই লুঙ্গির দুপ্রান্ত বাতাসের উলটোদিকে ধরে নৌকার গলুইর গুড়ায় দাঁড়িয়ে বাদাম-নামক পাল তোলে। নাতিদের বানানো লুঙ্গি-পালে বাতাস লেগে নৌকা জোরে চলা শুরু করার পরই দাদু হাল ধরে শান্ত হয়ে বসে দিগম্বর নাতিদের খোঁচা মেরে কথা বলে--‘মোর হালাগো দেহি লজ্জাশরমের মাতাডা খাওয়া গেচে। দুইডা ছিলা ক্যালা, ল্যাংডা ফহির অইচে।’ এর পরই দাদুর লুঙ্গি বাতাসে উলটে যায় যেমন পুঁটিতে ঠোকর বসাবে বলে অপেক্ষারত স্থির বলাকারা পাখা অনাকাক্সিক্ষত দমকা বাতাসে উলটে গিয়ে ডানার নিচের বিবর্ণ মাংস বেরিয়ে পরে। আর তখনই নাতিরা চেঁচিয়ে ওঠে--দাদুর বেগগুইন জিনিস দেহন যায়। ... ...
সিন নদীর পারে সেবারের জুলাইটা ছিল সত্যিই অন্যরকম। ইউজিন, তোমার কি মনে পড়ে? জুলাই বরাবরই এই ফরাসী দেশে ভিন্ন আভা, ভিন্ন দীপ্তি নিয়ে আসে। প্রায় পৌনে একশ বছর আগের জুলাইয়ের চোদ্দ তারিখের গল্পটা পিতামহ পিতামহীরা শোনায় নি কি? দিকে দিকে খবর রটে গেছিল যে বাস্তিল দুর্গের উপর কামান থেকে গুলি ছোঁড়া হবে সাধারণ, নিরস্ত্র মানুষের উপর। আর সে খবরে এত দিনের ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত ও বিপন্ন মানুষ যত ভয় পাবার বদলে বরং উল্টো হঠাৎই অতিকায় দৈত্যের মনের জোর নিয়ে ছুটলো সো-জা বাস্তিল দুর্গ বরাবর। ১৪ই জুলাইয়ের দু’দিন আগেই রাজা ভার্সেই থেকে সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসে জনতার উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। জনতাও এর উত্তরে সাথে সাথেই পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তÍত হয়ে গেছিল। শহরের ঘণ্টা বেজে উঠলো। জনগণের পক্ষ থেকে সতর্ক ঘণ্টা। জনতা দরকারে রাষ্ট্রীয় অস্ত্রভাণ্ডারও দখল করতে প্রস্তÍত। একটি গার্ড রেজিমেন্ট জনতার পক্ষে অবস্থান নিল। ঠিক তার দু’দিন পরেই অর্থাৎ চোদ্দ তারিখেই যেই না খবর রটলো যে বাস্তিল দুর্গ থেকে মানুষের দিকে গুলি ছোঁড়া হবে, অমনি সব ধেয়ে গেল দুর্গ বরাবর। তারপর বাকিটা ইতিহাস। গিলোটিনে অভিজাতদের মাথা। লিবার্তে-ফ্রাতের্নিতে-ইগালিতে...সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা...মানুষ স্বাধীন হয়েই জন্মায়...তথাপি সে সদা শৃঙ্খলিত! তবু, ইউজিন...যেমনটা তোমার পিতামহ বলতেন আর এ-ও জানা কথাই...প্রতিটা বিপ্লবের পরই আসে একটি করে প্রতিবিপ্লব...হাজার অন্যায়ের প্রতিবাদেও কারখানায় শ্রমিক ধর্মঘট করতে পারত না। নারী রয়ে গেল আগের মতই নিরক্ষর, গৃহকর্মের দাসী। তবে বিপ্লবটা কোথায়? তবু ১৭৯২ থেকে ১৮৭০...গুনে গুনে ৭৮টা বছর পরে আবার এই জুলাই...সে যেন একইসাথে রক্তবর্ণ অথচ পিঙ্গলাভ মেঘ, যা যে কোন ঝড়ের আগে দেখা যায়। ... ...
রাত প্রায় এগারোটা বাজে। বাবার বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি দু’টোই খুব বেশি প্রগতিশীল না। বাবার বাড়িই শাহবাগ থেকে কাছে। দ্রুত একটা রিক্সা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করে ফারহানা। আধা ঘণ্টায় পৌঁছে যায়। কলিং বেল টিপতেই মেজো আপা দরজা খোলে, ‘শাহবাগ থেকে মাত্র ফিরলি? জানিস, ব্লগার থাবা বাবা যে মারা গেছে? টিভিতে বললো!’ ‘হুম- রাজিব হায়দার নামে একজন মারা গেছে জানি...’ ‘সে-ই ত’ থাবা বাবা নামে লিখত। তুই ত’ আর ব্লগ পড়িস না। আমি বাবা লন্ডনে থাকি বলে দেশের সব পেপারের ই-ভার্সন আর ব্লগ পড়তে হয়! ছেলেটা নাস্তিক ছিল। তা’ নাস্তিক হওয়া কি দোষের? তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাই? তাই বলে তাকে খুন করতে হবে? কবে আমরা একটু সভ্য হবো?’ ... ...
...তবু বিপ্লবের পিছু পিছু পায়ে পায়ে নিঃশব্দে হেঁটে আসে যে প্রতিবিপ্লব ক্ষুধার্ত ডাইনির মতো, সে সহসাই পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপ্লবের কাঁধে ছুরি বসায়। বাঘনখে বিদ্ধ করে তার হৃৎপিণ্ড। তাই কি হয় নি? মার্চের ২২ তারিখেই অভিজাতদের কিছু দাঙ্গাবাজ গায়ে পড়ে হামলা করলো কমিউনের লড়াকু শ্রমিকদের সাথে। শ্রমিকরা আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করতেই ওরা ছুরি, পিস্তল, লাঠি রেখে পালালো। কমিউনের সেনাপতি লুলিয়ার লোকটিকে তোমাদের যে ভাল লাগত না, সেটা ত’ ঠিকই ছিল ইউজিন! অভিজাতরা তাড়াতাড়িই যে আবার দখল করে নিল দুর্গ মঁ-ভালেবিঁ। ব্যর্থতার শাস্তিতে বহিষ্কৃত হবার সাথে সাথে কমিউনের পিছু নিল সে। ভার্সেই থেকে আসা অভিজাতদের শেষ বাহিনীর পক্ষে কাজ করলো লুলিয়ার। হায়, শ্রমিক নারীরা পর্যন্ত লড়াইয়ে এগিয়ে এলো। নিজেদের দরিদ্র, নিরন্ন বস্তি রক্ষায় পুরুষের পাশাপাশি তারাও কামান চালালো। গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লো রাস্তায়। নিকোলা আর জাঁকের স্ত্রী, প্রেয়সিরা খুন হলো রাস্তায়। মৃত স্বামীর শবদেহের পিছু হাঁটতে হাঁটতে শিশু সন্তানের কাণে শ্রমিক মেয়েরা শ্লোগান দিয়েছে, ‘ভিভা পারি কমিউন!’ তবু ভার্সেইয়ের সেই বিপুল সৈন্যবাহিনীর সাথে শেষরক্ষা হলো কি? শ্রমিক নেতা ফ্লুঁরাসকে পেছন থেকে খুন করলো বুর্জোয়া সেনাপতি দেসার্ত, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের হাত থেকে যার জীবন বাঁচিয়েছিল ফ্লুঁরাসই। ফ্লুঁরাসের মৃতদেহ টুকরো করার দৃশ্য ভার্সেইয়ের গোলাপ বাগানে উপভোগ করলো বুর্জোয়াদের স্ত্রী ও রক্ষিতারা। ৬ই এপ্রিল শহীদ শ্রমিকদের শবযাত্রায় কফিনের পিছু পিছু দুই লাখ শ্রমিকের শবযাত্রার ঢল...শুধু পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না কমিউনের...ভার্সেই সৈন্যরা এপ্রিলের ৭ তারিখ দখল করে নিল নিউলি-তে সিন নদীর ঘাট। মে মাসের শেষ নাগাদ জার্মানরা বন্দী ফরাসী সৈন্যদের ছাড়ার পর বুর্জোয়াদের শক্তি আরো বাড়লো। ফরাসী বুর্জোয়াদের সাথে হাত মেলালো জার্মান বাহিনীও...আটটা দিন...আট/আটটা দিন সে কি খাণ্ডবদাহন! লোশেজের কবরখানা ভরে উঠলো নর-নারী-শিশু-বৃদ্ধের লাশের স্তুপে। ত্রিশ হাজার মানুষ হত্যার পর শুরু হলো পাইকারি গ্রেপ্তার। লড়াইয়ের শেষ দুই দিনে হেরে যাবে বুঝে শ্রমিকেরা নিজের হাতে নিজের প্যারি প্রিয়তমার দেহে জ্বালালো আগুন। বুর্জোয়া ভার্সেই যেন পায় নিছকই এক অগ্নিদগ্ধ শহর। তিন দিন ধরে দাউ দাউ করে জ্বললো আগুনের লকলক শিখা। ... ...
ঘুমন্ত নগরীতে সবাই ঘুমোচ্ছে। সবাই পাথরের মত ফ্রিজ। রানীর পায়ের কাছে এক মস্ত ফিনিক্স পাখি, সেও ঘুমোচ্ছে। দুইজন মুখোশধারী জ্যান্ত যুবক সব খুঁটে খুঁটে দেখছে। একজন রানীর পাশে রাখা বড় ঘন্টায় আওয়াজ করতেই সবাই জেগে ওঠে। অন্যজন ফিনিক্স জেগে উঠতেই তরবারি দিয়ে তার গলা কেটে ফেলে। নগরীর সবাই ছটফট করতে করতে ড্রাগনের আকারধারণ করে ও মারা যায়। ভয়েস ওভারে সীমান্তবাবা কী করে অশুভ শক্তি ড্রাগনদের ধ্বংস করতে হবে তার বিবরণ দেন। সারা সমুদ্র লাল রঙ হয়ে যায়। মুখোশ পরিহিত দুই যুবক তার মধ্যে দিয়ে ভেসে ওঠে। সমুদ্রতটে দেখা যায় ড্রাগন দেবাদিদেব ইউনিকর্ণ ছটফট করতে করতে ঢুবে যেতে থাকে চোরাবালিতে। মুখোশ পরা দুই যুবক তাকে ডিঙিয়ে ফ্রেমের দুইপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ড্রাগন দেবাদিদেব ইউনিকর্ণ বাঁচাও বাঁচাও করতে করতে ঢুবে যায় চোরাবালিতে। ... ...
মরুপ্রান্তর। দিন। রক্ষীরা চলেছে উটের পিঠে। তাদের মাথায় ছত্রী ধরে আছে মরু পোষাকে স্থানীয় মানুষ। পেছন পেছন চড়া রোদে সালমা ও রুমকি কোলে সন্তান নিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে চলেছে দিগন্তের দিকে। আবহে দুইজনের একসঙ্গে থাকার গানটির স্যাড ভার্শন শোনা যায় (হামনিকা শুনে শোলের কথা মনে পড়বে)। কাঁটাতারের বেড়া। রক্ষীরা তাদের বেড়া পার করে ফিরে যায়। ... ...