থাপ্পড় মেরেছেন নবারুণ। হ্যাঁ, একদম কষে সপাটে থাপ্পড় মেরেছেন। বাঙ্গালির চিরকালের শুয়ে বসে আরাম করে প্রেম-থ্রিল-কমেডির কাহিনি ও কবিতা পড়ার অভ্যাসের মূলে আঘাত করেছেন তিনি। এবং একদম ঠিক করেছেন। প্রথমেই একটা স্বীকারোক্তি আছে। আমি জানিনা মহিলা পাঠক বলে কোনো আলাদা বিভাগ আছে কিনা, তাই স্বভাবতই মহিলা পাঠকের বিচারে নবারুণের লেখার বিশ্লেষণ করতে আমি অক্ষম। আমি বরং একজন সাধারণ পাঠক হিসাবে নবারুণকে দেখব। মানে তার এই থাপ্পড় আমার কেমন লেগেছে আর কি! ... ...
অথচ সেই মুহূর্তে বাস্তব তার ‘ইন্টারোগেশন’ নিয়ে তাঁর সমস্ত ইচ্ছেকে ধূসরিত করছে, না মানলেও রাষ্ট্রদ্রোহিতার কলঙ্ক লাগানো শহীদদের প্রতি বর্বরোচিত আক্রমণের নগ্নতায় বিপন্নতা দেখা দিচ্ছে। কবিতাকে সশস্ত্র করছেন আদিবাসীর বল্লম, চর দখলের সড়কি, বর্শা, তীক্ষ শর, বন্দুক ও কুরকি দিয়ে। আবার কয়লাখনির মিথেন অন্ধকারে হিরের মতো জুলন্ত চোখের শাসানির যে ভয় শাসককে দেখালেন তা দেশকালের সীমানার বাইরে চির প্রতিস্পর্ধী এক কবির। নবারুণ স্থির থাকবেন কী করে, তিনি যে দেখেছেন তরাই থেকে সুন্দরবনের সীমা সারা রাত্রি কান্নার পর শুষ্ক দাহ্য হয়ে আছে। (এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না) ... ...
কিন্তু, অধিগ্রহণের পুরো প্রক্রিয়াটাই যে বেআইনি ছিল, এই ব্যাপারে উনি কোনো সন্দেহ রাখেননি। ওনার মতে, যেহেতু আগেই জমি চিহ্নিত হয়েছিল, ও ক্যাবিনেট মিটিঙে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছিল, সেহেতু চাষিদের অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে থাকা অসন্তোষ, অভিযোগের বা আপত্তির, তৎকালীন ল্যান্ড-কালেক্টর কোনো বিচার করেননি, আর, মেকানিকালি উপেক্ষা করেছেন, বা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আগে থেকেই নিয়ে ফেলা সিদ্ধান্তের ওপর সিলমোহর ফেলতে একটা আই-ওয়াশ বা ছলনার মাধ্যমে চাষিদের ও জমির মালিকদের অভিযোগের বিবেচনা করা হয়েছিল, যার অন্তিম পরিণতি, সেই অভিযোগগুলির উচিত বিবেচনা না হওয়া। কমপেনসেশন বা ক্ষতিপূরণের পরিমাণ যেভাবে ঠিক হয়েছে সে নিয়েও উনি প্রশ্ন তুলেছেন। অতএব, ওনার মতে, জমি অধিগ্রহণ জনস্বার্থে হয়ে থাকলেও, অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। ... ...
'হায়দার'-এর রিস্কগুলি আখেরে ছবিটিকে উতরেছিল না ডুবিয়েছিল তা নিয়ে তর্ক থাকবে। কিন্তু বিশালের ওই মারাত্মক ডিপার্চারটি অঞ্জনের ভালো লাগেনি – হায়দার খুররমকে হত্যা করতে পারে না। আমি তো আগেই বলেছি 'হায়দার'-এর প্রোজেক্টই ছিল মূল প্লটের নিষ্পত্তিকে বিপর্যস্ত করা, মায়ের ইন্টারভেনশনে। আর একটা পয়েন্ট ভাবুন - সেই ছেলেবেলায় জেনেছি হ্যামলেট procrastinator, সে ভাবে খালি, অ্যাক্ট করতে পারেনা। বিশাল কি করলেন? হ্যামলেটকে সেই সংজ্ঞাতেই ফ্রিজ করে দিলেন। তার অ্যাক্টের আর কোনো মূল্যই থাকলো না। বরং কাকা-ভাইপো একটা ভূতগ্রস্থ পরিবারের অবশিষ্ট হয়ে ঘুরে বেড়াবে উপত্যকাময় যাদের আত্মীয়তার সূত্র হল একজন নারীর প্রতি তাদের প্রেম, যে নারী আর দেশ এখন একাকার হয়ে গেছে রক্তে-মাংসে-বরফে। এই রিস্কগুলো, এই ডিপার্চারগুলো নতুন ইন্টারপ্রিটেশন হয়ে অবলম্বনে মূল্য বাড়ায়। আর অতিরিক্ত আবেগ তৈরি করে। 'হেমন্ত'-এ সেই আবেগ নেই; 'হেমন্ত' বড্ড sane ও যৌক্তিক। ... ...
ভয় পেয়ে গিয়েছিল ছোট্ট মেয়েটা। অনেক লোকের মাঝে তাকে সকাল থেকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। এই পাড়াতে, এইরকম বাড়িতে আগে কোনোদিন আসেনি সে। তার বাড়ির লোকেরাও কোনোদিন আসেনি। তাকে আসতে দিতেও মন চায়নি তাদের। প্রায় জোর করেই চলে এসেছে ছোট্ট মেয়েটি। কারণ সে জানে তার ওপর এবার সংসারের অনেকটা দায়িত্ত্ব। কিছুদিন আগেই বাবা মারা গেছেন। মাকে সঙ্গে নিয়ে তাকে উঠে আসতে হয়েছে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে সারাদিন, সারা রাত অমানুষিক পরিশ্রম করেও বাড়ির লোকের মন পায়নি তারা। চলে আসতে হয়েছে সেই অপমানকর আশ্রয় থেকেও। মায়ের সেই দুঃখ ছোট্ট মেয়েটি ভুলতে পারেনি কোনোদিন। ভুলতে পারেনি পড়শিদের সেই কানা-ঘুষো। আসলেই যাকে বাবা বলে ডাকতো, আদতে সেই কি ছিল তার বাবা? নাকি মায়ের অন্য কেউ...? লজ্জায় রাঙা হয়ে যেত ছোট্ট সেই মেয়েটার মুখ। দারিদ্র্য ছিল। কিন্তু দারিদ্র্যের সাথে সম্মানবোধ ছিল খুব তীব্র। ছোট্ট মেয়েটা মনে মনে পণ করেছিল আর যাইহোক দিদি, মা, এই সংসারটাকে সে কোনোদিন ভেসে যেতে দেবে না। সবাই যাতে দুবেলা খাবার পায়, পড়ার কাপড় পায়, মাথা গোঁজার জায়গা পায়, সন্মানের সাথে জীবন নির্বাহ করতে পারে তার জন্য ছোট্ট মেয়েটা নিজের সমস্ত শখ, আহ্লাদ, নিজের ছোটবেলাটা বিসর্জন দিয়ে একলা একলা প্রতীক্ষা করছে। অনেক আলো, অনেক যন্ত্রপাতি আর বেশ কিছু রঙ-চঙে মানুষের মাঝে। মনে হচ্ছে আজ তার অগ্নি পরীক্ষা। হ্যাঁ, এই ছোট্ট বয়সেই। ... ...
বিগত এক দশকের বাংলা ছবি (মানে, কাগজের ভাষায়, তথাকথিত "মননশীল" বাংলা ছবি) দেখলে একটা কথা খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, বাংলা সিনেমার সাথে আন্তর্জাতিক সিনেমার সম্পর্ক, যা সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক একদা স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন, এখন প্রায় পূর্ণতঃ ছিন্ন হয়েছে। বাংলা সিনেমা, অধুনা, তার নির্মাণে ও মেজাজে, পরিপূর্ণ মধ্যবিত্ততার একটি পঙ্কিল আবর্তে পাক খেতে খেতে, একমনে, নিজেই নিজেকে ক্রমাগত ধ্বংস করে চলেছে। বিশ্বসিনেমার ভাষা যতই বদলে যাক না কেন, যতই জটিল হয়ে উঠুক না কেন তার অন্তর্গত আখ্যানের বুনন, বা সেই আখ্যানের সঙ্গে বহির্বাস্তবের লেনদেন ও টানাপোড়েন, বাংলা ছবি, তবুও, দৃশ্যের মাধ্যমে একটি নিটোল, নাটকীয় অথচ অন্তঃসারশূন্য গপ্প বলাকেই তার পবিত্র কর্তব্য ঠাউরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে ব্যস্ত থাকবে। এমনকী, ছবির ভাষা নিয়ে মাথা ঘামানো ছেড়ে, শুধু যদি এটুকুই প্রত্যাশা করি যে সেই গল্প, আদতে, মধ্যবিত্তের কোন গূঢ় আস্তিত্বিক সংকট বা জটিল স্ববিরোধকে দর্শকের সামনে উপস্থাপিত করবে, তাহলেও আশাভঙ্গের শিকার হতে হয়। কেননা, মধ্যবিত্তের হাঁচি-কাশি-টিকটিকি-প্রেম-অপ্রেম-আমাশার গল্পকে, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে, সভ্যতার সংকট হিসেবে উপস্থাপিত করাই, এখন তার নতুন দস্তুর। এবং এই অন্তঃসারশূন্যতাকে আড়াল করার জন্যে রয়েছে আরোপিত কেতা, যা, বস্তুতপক্ষে, ষাট-সত্তরের দশকের আভাঁ-গার্দ ছবির থেকে ধার করা, পরবর্তীতে মিউজিক ভিডিওর জমানায় ব্যবহৃত হতে-হতে বাসি মাংসে পরিণত হওয়া, ক্যামেরা বা সম্পাদনার কৌশলমাত্র। বিশ্বসিনেমার কথা বাদ দিলেও, কেবল যদি হিন্দি বা মারাঠী সমান্তরাল ছবির কথাই ধরি, তাহলেও বোঝা যায়, বাংলা সিনেমা ঠিক কোন গর্তে গিয়ে মুখ লুকিয়েছে। ... ...
এইখানে কিছু জিনিস ক্লীয়ার করে নিতে হবে। হীরো কিন্তু মূলত ভূমি উদ্ধারের জন্য এসেছে। তাকে উদ্ধার করে সেই তৃতীয় পার্সনের হাতে তুলে দিতে হবে। মানে হাবাপনার চোদ্দগুষ্টি আর কী! সেটে ব্যাপারটা অনেকবার অনেকে আপত্তি করেছে, কিন্তু পেলেদা শুনতে চাননি। ওঁর একটাই দাবী। সেটা হ’ল, যত বেশী গোঁৎ, তত বেশী ফোঁৎ। সুতরাং দর্শকের নিডপূরণ ও ন্যাপকিনের কথা মাথায় রেখেই হীরোর এই উদারীকরণ। তার বেশী কিছু না। অতএব প্ল্যান অনুযায়ী হীরো বিয়ে ভন্ডুল করবে। তারপর নায়িকাকে নিয়ে পালাবে। তিস্তার দিক দিয়ে পালানোটা বেটার। সাদা সুমো করে। ব্রিজের ওপারে তৃতীয় পান্ডব লাল সুমো নিয়ে অপেক্ষা করবেন। একটা ট্রেন থাকবে। সেটা চললেও কোনো অসুবিধে নেই। কোনটা ভারত বাংলাদেশ বর্ডার সেটা নিয়ে দর্শককে মাথা ঘামাতে দিলে চলবে না। দৈবাৎ কেউ যদি ঘামিয়েও ফেলে তবে তার জন্যে রয়েছে নির্ভেজাল মুগ্ধবোধ। ... ...
এমন এক বিচিত্র সময়ে কী করছিলেন নবারুণ? যে মৃত্যু উপত্যকাকে নিজের দেশ বলে মানতে তীব্র অস্বীকার করেছিলেন তিনি, সেই মৃত্যু উপত্যকাই তাঁর সাহিত্যের জরুরি মোটিফ হয়ে রইল সারা জীবন। বহু ব্যর্থতা, অনাচার, জীর্ণ পোকায় কাটা অস্তিত্ব দেখেও আমরণ বামপন্থায় আস্থা হারাননি তিনি। তাঁর সাহিত্যের পাত্ররা তাই সময়মতো পাল্টে নিয়েছে নিজেদের একটু একটু করে। হারবার্টের বিনুর মতো তারা আর গুলি খেয়ে মরার মতো বোকামি করে না। ভূতের সঙ্গে কথা বলে বলে ক্লান্ত হারবার্ট কবজির শিরা কেটে বরফ জলে হাতটা ডুবিয়ে দিয়েছিল। তার বিছানার নীচে রাখা ডিনামাইট চুল্লির ভিতর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কী হুলুস্থূল বাধিয়ে দিল তা আর দেখে ওঠা হয়নি হারবার্টের। অতখানি কল্পনাশক্তিও ছিল না তার। ... ...
‘কাঙাল মালসাট’ সম্পর্কে এই আত্মপ্রচারটুকুর নিতান্ত প্রয়োজন ছিল কারণ ‘কাঙাল মালসাট’ হাপিত্যেশ করা হাহাকারে ভরা নষ্ট ভ্রষ্ট চরিত্র বাঙালির জন্য। চাকতির বোম্বাচাক কিম্বা সেক্স ভকিলের অবাধ উল্লেখ ছলমাত্র অর্থাৎ পেঁয়াজের একটি খোসা অথবা পরত সে যে নামেই তাকে ডাকা যাক না কেন, নামে কি-বা আসে যায়। অর্থটি বোধগম্য হওয়া নিয়ে কথা। উপন্যাস(!)টিকে বুঝতে গেলে মালসাট অর্থাৎ ডুবোজাহাজের মতোই কিম্বা ডুবুরির মতো অর্থের অনেক গভীরে যেতে হবে যা বোধহয় আমারও সাধ্যাতীত। আমি নিজেও তো মনে হয় কিছুই বুঝিনি। যা বুঝেছি তা এই — কাঙাল শব্দটি দ্ব্যর্থক — গরীব অথবা ভিখিরি। বাঙালি এখন দুটোই। সিনেমা সিরিয়াল প্রযোজনা করছেন অবাঙালি। নৃত্য-সঙ্গীত পরিচালকও তাই। রামোজি সিটি সেখানে রমরমিয়ে সিটি বাজাচ্ছে, বাঙালি হিন্দী সংস্কৃতির কাছে বুলি মেলে বসে আছে হাপিত্যেশ করে। আর মালসাটের অর্থ যদি ডুবোজাহাজ হয় তাহলে ভ্রমেও ভাবিবেন না এটি submerine। এটি সেই ডুবন্ত জাহাজ যাকে আজ টেনে তুলে উদ্ধার করা বোধহয় অলীক কল্পনা। ... ...
আশা ছিল সকলেই নিজেদের জানা নবারুণ-পাঠিকাদের লিখতে উৎসাহী করবেন, এবং জরুরি, যারা চেষ্টা করেও নবারুণ-পাঠিকা হয়ে উঠতে পারেননি, তাদেরও। কেন একজনের লেখা একেবারেই আকর্ষণ করছে না - এটাও ত লেখার। এই জায়গাটা দেখেছি একেবারেই ধরা পড়ে না কোথাও। অথচ বর্তমান বাংলা ভাষার একজন মেজর লেখক হিসেবে তিনি চিহ্নিত হচ্ছেন। বিরূপ পাঠপ্রতিক্রিয়া ও তো লিখে ফেলা যায়। কেন এগনো যাচ্ছে না লেখার মধ্যে, কোথায় কীভাবে আটকাচ্ছে। ইন্টারভিউও তো ভালো অপশন। ইন্টারভিউ নিয়ে কেউ কোথাও কিছু লিখেছে বলে জানিনা। যে, ইন্টারভিউর মধ্যে দিয়ে মানুষটা কীভাবে বেড়িয়ে আসছেন, কিভাবে তাঁকে নিজের মতো একরকম বুঝে নেওয়া যাচ্ছে। চেয়েছিলাম নিজের কথাও লিখবেন কেউ কেউ, ওঁর লেখা পড়তে পড়তে কীভাবে রিয়্যাক্ট করছেন, রিলেট করছেন বা করছেন না, থট প্রসেস পাল্টে যাচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গী পালটে যাচ্ছে বা যাচ্ছে না। কতটা পারা গেল, এই সংকলনটিই তার সাক্ষ্য দেবে। ... ...
যাঁরা নানা কারণে লিখতে পারলেন না নবারুণারী তে, ফেসবুক ও গুরুচন্ডা৯ সাইটে তাদের নতুন-পুরোনো পোস্ট থেকে কিছু মতামত, কিছু আলাপ-আলোচনার নির্যাস রাখা রইল এই অংশে। এর অনেকগুলোই ভাটিয়া৯ অংশে অনেকের সাথে আলোচনার অংশ হিসেবে লেখা বলে এখানে একত্রে একটি লেখা হিসেবে পড়তে খানিক অদ্ভুত লাগতে পারে। সামান্য কিছু এডিটও করতে হল কথোপকথন থেকে বক্তব্য ও সময়কালের সাযুজ্য বজায় রেখে লেখাগুলো আলাদা করতে, তবু, যাঁরা লিখেছেন, তাঁদের মনোভাব আর বক্তব্যের সারবত্তা ধরে রাখা জরুরি মনে হাওয়ায় এবং অন্য কোন উপায় না থাকায় এগুলি এভাবেই রইল। আশা রাখি পরবর্তীতে এঁরা অন্যত্র কখনো নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তারিত লিখবেন। যাঁরা লিখলেন না আত্রেয়ী মিঠু সায়নী সিনহা রায় সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায় সুচেতা মিশ্র শুচিস্মিতা সরকার মীনাক্ষী মন্ডল পারমিতা দাস ... ...
‘হারবার্ট’ আর ‘কাঙাল মালসাট’। ‘হারবার্ট’ আমার মতে বাংলা ভাষার উপন্যাসের একটা মাইলস্টোন। সাধারণত মার্কামারা স্ত্রীপাঠ্য উপন্যাসের মধ্যে পড়ে বলে মনে হয় না। প্রসঙ্গত, ‘স্ত্রীপাঠ্য’ শব্দটি আমার গালাগাল হিসেবে ব্যবহৃত বলেই মনে হয়। কারণ আপনারা সম্ভবত জানেন, আর সন্দেহ থাকলেও সেকথা পরে হবে। এখন ‘হারবার্ট’ যে আমার বেশ সুখপাঠ্য লাগে এবং তাকে সেই লজিকে ‘স্ত্রীপাঠ্য’ এর দলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল কিনা সে আপনারা ঠিক করুন। হারবার্টের মতো কোন লোকের কাছাকাছি আসার ভাগ্য আমার হয় নি তাই সত্য-মিথ্যা-কল্পনার তুলনা দিতে পারবো না। ব্যক্তিগতভাবে বামপন্থী, যুক্তিবাদী পরিবেশে বড় হয়েছি, চিরকাল যুক্তিবাদীদের দলের পাল্লাই ভারী করেছি। কিন্তু হারবার্ট-এ যুক্তিবাদীদের অসংবেদনশীলতা ছাপ রেখে যায় আমার মনে। পাঞ্চলাইন ‘কখন কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা কে ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও বাকি আছে’ –র থেকেও বেশি। হারবার্ট নিয়ে আবার কথা হবে। ... ...
কিন্তু দ্বিতীয় ও সচেতন পাঠে আমি দেখতে পাই এই সব ক্রিয়াকর্ম। ঠিক যেভাবে ছোটবেলায় আস্বাদন করে, প্রায় চেখে চেখে চেটে চেটে পড়া উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনির গল্প-এর বাঘের বাচ্চাদের মেরে কেটে ঝুলিয়ে রেখে তেলের মধ্যে টপ টপ রক্ত পড়ার ছ্যাঁক ছোঁক আওয়াজ ও বাইরে বসে বাঘ বাবাজির সে আওয়াজে পিঠে ভাজা হচ্ছে ভাবার ঘটনা, আজকের আমার সচেতন দৃষ্টিতে, পরিবেশপ্রীতি ও পশুপ্রীতির দৃষ্টিতে বিষম, অসহ্য, পলিটিকালি ইনকারেক্ট, গ্রহণীয় নয়। ঠিক যেভাবে প্রায় অধিকাংশ রসালো প্রাচীন কাহিনি আজ হয় পাগল, নয় শারীরিকভাবে অক্ষম, নয় কোন না কোন ভাবে শোষিত মানুষের অ-সংবেদনশীল বিবরণের কারণে পরিত্যাজ্য হয়ে যাচ্ছে। ... ...
সেই জায়্গা থেকে বিস্ফোরণ ও তৎসংক্রান্ত দর্শনকে তুচ্ছ লাগা হয়তো একদম ধৃষ্টতাই - হারবার্ট পড়ার এত বছর পরে আজ আর বিস্ফোরণকে তেমন তীব্রও মনে হয় না অথচ এত দিন পরেও একটা দৃশ্যকল্প কেমন জ্বালায় - ঐ শেষ পরিচ্ছেদের একটা দৃশ্যকল্প - হারবার্টের সেই সাইনবোর্ড বেলুন বন্দুকওলা কিনে নেয় এবং এর ওপরে কাঁটা পেরেক ঝুলিয়ে বেলুন ঝোলাবার ব্যবস্থা করে - সব বেলুন ফেটে গেলে পেরেকের মধ্যে হয়তো বা চোখে পড়বে, উল্টো হরফ - 'মৃতের সঙ্গে কথোপকথন' প্রোঃ হারবার্ট সরকার - ... ...
তোমাকে পড়ছি রাষ্ট্রদ্রোহী, তোমাকে খুঁড়ছি নিরন্তর যাওয়া-আসা সেও চলতেই থাকে, পুড়ে যায় পোড়ো মাটির ঘর ... ...
হুট করে লিখতে বললেই কি পাট করে প্রবন্ধ নেমে যায়? সব সময় হয়তো না। কিন্তু, কিছু কিছু বলার মতো কথা তো থাকেই যা অন্তত না বলে থাকা অনুচিত। অনুরোধ একান্তই ফেরাতে পারেননি যাঁরা, তাঁদের দু-কলম অনন্যোপায় লেখা এখানে একসঙ্গেই থাকল, নাহোক নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করার অছিলাতেই। ... ...
তা-ও তো, তখনও হারবার্ট পড়িনি। ফ্যাতাড়ুদের বৃত্তান্ত তো নয়-ই! হারবার্ট পড়তে দিল আমারই হাতিবাগান পাড়ার কোনও এক বন্ধু। পড়লাম আর শিউরে-শিউরে উঠলাম। এই বেস্-এর ওপর দাঁড়িয়ে, আমি লিখব কী করে? কোন কনভিকশন নিয়ে ? লিখব, আর ভুশ করে ডুবে যাব তো ছাইগাদায়। ব্যবহৃত হব, আধো-অন্ধকার, পুরনো বাড়ির কলতলায় বাসন-মাজার আঁশটে কাজে। বাড়িগুলি প্রোমোটারের হাতে চলে গেলে, কাঁসা-পিতল বাতিল হয়ে গেলে, সে-কাজেও লাগব না আর ! ... ...
মনের ভাবপ্রকাশের জন্য মানুষ যা সৃষ্টি করেছে নিজের বাগ্যন্ত্রের মাধ্যমে, তা-ই হয়ে উঠেছে সাহিত্য। নিজের মনের ভাব অপরে জানুক, মনে রাখুক, তার ভাবপ্রকাশেও যেন আমারই ভাবের ছায়া পড়ে – এই আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন। হয়তো ব্যক্তিত্বের উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গেই এই স্বকীয়তার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে মানব মননে। তখন থেকেই ভাষা গঠনের পর পরই ভাব প্রকাশের বাহ্যিক, প্রকাশিত রূপকে সংরক্ষণের চেষ্টাও শুরু, হয়তো। এই সংরক্ষণ করতে গিয়ে মানুষ বুঝল। সেইসব প্রকাশ্য রূপই সে মনে রাখতে পারছে, যেগুলি সে ঝোঁক দিয়ে বলছে, বলছে, ছন্দে, বলছে অন্ত্যমিলে। মৌখিক সাহিত্যের পরম্পরায় আমরা এর প্রমাণ পাই। এরই সঙ্গে আসছে ভাষার লিখিত রূপ, লিপি। কিন্তু মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের আগে সেই লিপি, বা ভাষার লেখ্য রূপ খুব কম সংখ্যক মানুষেরই আয়ত্ত ছিল। লিপিকরের সংখ্যাও ছিল অপ্রতুল। সংখ্যাগুরু মানুষ তাই সাহিত্যরস আস্বাদন করতে নির্ভর করেছেন মৌখিক সাহিত্যের ওপরেই। ... ...
এসব বলে বেঁচে থাকা বামন। শোনে এক নতুন লোক - উইন্ডচিটার, যে তাদের পানীয় জলের শুদ্ধধারা দেখিয়ে দিয়ে বিশ্বাস অর্জন করে প্রথমে। এমনকি খেলনানগরে লুকোনো সোনার কথাও সত্যি, বলে সে। ‘৮’ এবং ‘৯’ ভাবে ওই সোনাবেচা টাকা দিয়ে আবার কারখানা খুলবে। তারা কারখানা-প্রাঙ্গন খুঁড়ে পাথরের স্ল্যাব বের করে, কিন্তু উইন্ডচিটারের দেওয়া ঘুমপাড়ানি ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে হাতকাটার দল ওদের দেখতে পায় [কে ওদের খবর দিল?] এবং গর্তের মধ্যে সোনার মুদ্রা থাকায়, যেটা উইন্ডচিটারই রেখে দিয়েছিল, ওরা চোর সন্দেহে ‘৮’ ও ‘৯’ কে উলঙ্গ করে পিটিয়ে মেরে ছাদের ওপর উল্টো করে ঝুলিয়ে দ্যায় একটি অস্বাভাবিক বড় মৃত শকুনের পাশে। সেটি প্রকৃতপক্ষে ওই ধ্বংসকারী ক্যাপিটালিস্ট শ্রেণির খবর পাচারকারীর কাজ করত। ... ...
আজন্ম পরিচিত কিন্তু ছুঁয়েও না দ্যাখা তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন, খোয়াবনামা যেভাবে আলমারিতে এসেছিল, হারবার্ট সেভাবে আসেনি। হারবার্টকে আনা হয়েছিল নিজের হাতে, সচেতনে। নতুন শিখতে থাকা পাখিপড়া তত্ত্বজ্ঞানের বুদবুদ মাথায় নিয়ে,অন্যের পরামর্শে হারবার্ট পড়তে বসা হয়েছিল আট বছর আগে। উদ্দেশ্য নিয়ে হারবার্ট পড়ার কারণ হলো, এতে নাকি মূলধারার বাইরের প্রথাবিরোধী প্রতিষ্ঠানবিরোধী উত্তরাধুনিক নানা জ্ঞানের সমাহার রয়েছে। তাছাড়া, নবারুণের ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ লাইনটি সংসদ থেকে ফুটপাথ, ডান থেকে বাম, সবাই যে যার সুবিধামতন যেভাবে মুখস্থ আওড়ায় তাতে মনে হয়েছিল সে বেশ কেওকেটা লেখক হয়ে থাকবে! নাম দেখে অনুবাদ বই বলে ভুল করা মহাজ্ঞানী ‘আমি’ উপন্যাসের কোত্থাও কোনো তত্ত্বের উল্লেখ না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ি। বড় বড় তত্ত্ব শেখার উদ্দেশ্য নিয়ে বসে, আনকোরা অনভিজ্ঞ মাথা আর বাছা বাছা মজার খাবার খাওয়া জিবে সোয়াদ নিলে কোন বই থেকে কতখানিই বা শেখা যায়! ... ...