তাঁর গল্পের প্রধান চরিত্ররা সকলেই অ্যান্টি হিরো। অসফল মানুষ, জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ মানুষ। সমুদ্র গল্পের লোকটিও তাই, মঙ্গল গ্রহ বা তারিণীর বাড়ি বদল গল্পের তারিণী, সামনে চামেলি গল্পের ক্রাচ বগলে লোকটিও তাই। কিন্তু প্রতিটি চরিত্রই হল গভীর অনুভূতিপ্রবণ। তাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় সব সময় সজাগ। এই সব ব্যর্থ মানুষের ভিতর আবার অন্য মানুষও আছে। তিনি ছিলেন জাত শিল্পী। শুধু মাত্র কাহিনি কথনের যখন রমরমা, দগদগে কাহিনি যখন বিক্রি হয়ে যায় হাজার হাজার, তখন প্রায় নিভৃতে তিনি শিল্পের সাধনা করে গেছেন। হ্যাঁ, একমাত্র জীবনানন্দকেই যেন মনে পড়ে যায় জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীকে পড়তে পড়তে। আমি যখন জীবনানন্দের জলপাইহাটি উপন্যাসটি পড়ি, সেই ব্যর্থ অসফল মানুষটির কথা পড়ি, তখন মনে পড়ে যায় জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর কথা। ট্রাঙ্ক বন্দী সেই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি উদ্ধার হয়েছিল জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর মৃত্যুর বছর সাত আট বাদে তো নিশ্চয়। শিল্পের কথা যখন বলছি, ‘রাইচরণের বাবরি’ গল্পটির কথা বলি। ... ...
বেগুনের ভরের চেয়েও, বেগুনের জিন এর এই গুরুত্ব কিন্তু এর আগে বোঝা সম্ভব হয় নি। আসলে ভেবে দেখতে গেলে, জিএম বেগুনের জিনে এত বেশি রকমের তারতম্য, যে এগুলি বেগুনের উপসর্গ মাত্র। প্রকৃত প্রস্তাবে, এটি একটি সম্পূর্ণ নূতন প্রজাতির সিন্থেটিক সব্জি। এই তো কদিন আগেই বিদেশমন্ত্রী জুবেদা খাতুন রাষ্ট্রসংঘের বক্তৃতায় বললেন যে অর্গ্যানিক বেগুন চাষ বাংলাদেশের কৃষি স্বাধীনতা এবং সামাজিক পছন্দ (সোসাল চয়েস) এর দৃঢ় প্রতীক। কৃত্রিম উপায়ে প্রস্তুত জিএম বেগুন যে শুধু মুনাফালোভী চক্রান্ত তাই নয়, সেগুলি বেগুনই নয়। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সদ্ভাব রক্ষা ও গবেষণায় সম্পূর্ণ সাহায্যে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ প্রস্তুত। মহামান্য আদালতের রায়ের পরে আশা করা যেতে পারে যে এ নিয়ে কোনওরকম ভুল বোঝাবুঝি থাকবে না ও প্রকৃতির দান প্রকৃতির কাছেই থাকবে। এ নিয়ে যেন দুই দেশের মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্ববোধে আঘাত না লাগে। এমন কি তিনি এও বললেন - লেট বাইগনস বি বাইগনস। ... ...
সে ছিল একটা নির্জন রাস্তা আর সেই রাস্তায় ক্রাচ বগলে সে হাঁটে। দুঃখী, বঞ্চিত আর ব্যর্থ মানুষের কল্পনা আর আকাঙ্খার গল্প। খুব বড় লেখক, আমার পিতৃতুল্য লেখক জিজ্ঞেস করতে লাগলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তখন তিনি শিশুর মতো। আমরা যারা ওই পুস্তক প্রকাশনীতে যেতাম, শচীন দাস, সমীর চট্টোপাধ্যায়, কখনো কবি তুষার চৌধুরী এবং পবিত্র মুখোপাধ্যায় – সকলেই তাঁকে পড়েছেন। তাঁর নানা লেখা নিয়ে আমাদের নানা কৌতুহল নিরসন করতেন হয়ত কখনো, কিন্তু বারবার প্রসঙ্গান্তরে চলে যেতেন। আমার মনে আছে তাঁকে শুনিয়েছিলাম আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতার কথা। গ্রামীণ যাত্রাদল আসছে শীতের ধানকাটা মাঠ ভেঙে, সুবর্ণরেখা নদী পার হয়ে। হিরোইনের কোলে দুধের বাচ্ছা। কোন ভোরে বেরিয়েছে ধ-ডাংরি যাত্রাদল। বেলা বারোটার পর এসে পৌঁছল। হিরোইনের মাথার চুলে খড়কুটো, বাচ্ছা কাঁদছে। রাস্তার দুপারে দাঁড়িয়ে গাঁয়ের চাষাভুসো মানুষজন দেখছে তাকে। কে যেন হেঁকে উঠে ডাকল আমাকে, হিরোইন হিরোইন দেখুন স্যার... তিনি মগ্ন চোখে তাকিয়ে আমার দিকে। আমি কুন্ঠিত গলায় বললাম, আপনি এইটা নিয়ে লিখবেন? ... ...
এই চ্যানেলেও তাঁর টেকার এটাই রহস্য। এই যে তিনি চোখ বন্ধ করে ঘুমে তাতে তাঁর মাথা বন্ধ নেই। ঘুমের মধ্যেও তিনি দেখে চলেছেন যে ওপরের কোনো একটা ঘরে মিটিং হচ্ছে। সেখানে বসে নিত্যপ্রিয় তাঁকে খুব খিস্তি করছে। বলা বাহুল্য নিত্যপ্রিয়ই তাঁকে ‘সমকাল’ পত্রিকা থেকে এখানে এনেছিল। সেখানে থাকাকালীন নিত্যপ্রিয় ও তিনি একই লবিতেও ছিলেন। সম্পাদক-মালিক ছিল বীতশোক ঘোষ। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তাঁর, বীতশোক আর নিত্যপ্রিয়র। বীতশোক যত যত মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়েছেন তত তত তাঁদের দূরত্ব বেড়েছে। বীতশোক অবশ্য যখন আজকের মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়েছেন তখন তিনি মন্ত্রীসভায় এক সদস্য মাত্র এবং কোণঠাসা। তার কিছুদিনের মধ্যেই ছেড়ে দেবেন মন্ত্রীত্ব। তারপরে একদিন ফিরেও আসবেন। আবার মন্ত্রী হবেন। তখনকার মুখ্যমন্ত্রী যত অসুস্থ হতে থাকবেন, এনার গুরুত্ব বাড়তে থাকবে। বীতশোকও রাজ্য-রাজনীতিতে মাতব্বর হবেন। ভুলে যাবেন এককালে তিনি, নিত্যপ্রিয় ও অমানিশ একসঙ্গে রাত্রে ফিরতেন এক গাড়িতে। তখন অবশ্য নিত্যপ্রিয় আর বীতশোক দুজনই বেকার। নিত্যপ্রিয় বৌ-এর স্কুল মাস্টারির টাকায় মদ খেয়ে বেড়ায়। কিন্তু স্কুল মাস্টারির টাকা কম বলে নিত্যর সঙ্গী তখন বাংলা। বীতশোকের স্ত্রী অধ্যাপিকা। ফলে বীতশোক বিদেশী মদ তখনো খেতেন। এবং নানা সময়েই নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হাজির হতেন সন্ধেটা কোনো রকমে কাটাতে। প্রতিদিন পাবে গেলে অনেকটা টাকা যায়। এমনই এক অনুষ্ঠানে নিত্যপ্রিয়র সঙ্গে নতুন করে সখ্যতা। বীতশোককে মদ খাওয়ার পরে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটা নিতে নিত্যপ্রিয়র কোনো সমস্যা ছিল না। বিদেশী মদ এবং সঙ্গের চাট জুটলে সে জুতোও পরিয়ে দিতে পারে। প্রেস ক্লাবে মদ সস্তা এবং সেই খেতে ও আরো নানা জটিল ইক্যুয়েশন কশতে দুজনেই যেতেন সেখানে। প্রেস ক্লাব থেকে অমানিশের পত্রিকার রাত্রের গাড়িতে তিনজনে ফিরতেন বেশিরভাগ দিন। ... ...
কার্টুনের শিরোনাম ? ঠিক করুন আপনারাই ! ... ...
এর থেকে মনে হয়, হাসাকে যতটা সুখী ভাবতাম-মানে এখন ভাবছি বসে- ততটা সুখী নিশ্চয় সে ছিল না। শাশুড়ী ও পোড়া রুটি প্রসঙ্গে তার অত খচে যাওয়ারই বা কি ছিল, সেসব কি তার দুর্বল পয়েন্ট, অ্যাকিলিসের হিল? আর বনিতা, সে-ই কি সার্থক সুখী ছিল? নাকি সুখের কল্পনা করে রস পেত এত?সে কি হাসা'র নাম করে নিজের ভবিষ্যৎজীবনের সুখের ছড়াই বানাত বসে বসে? এমন বনিতা , যার পায়ে সোনার নূপুর, যার শাশুড়ী পালিয়ে বেঁচেছে, এবং যে দিনান্তে পেট ভরে রুটিটা - পোড়া হোক যাই হোক-অন্ততঃ খেতে পায় ! এইরকম সব প্রশ্ন পায় এখন ভাবতে বসলে। হাসা ও বনিতাকে পেলে খুঁটিয়ে জেনে নেওয়া যেত। কিন্তু তাদের পেলে তবে তো ! আমারও বয়স বাড়লো, আর দুজনেই এক এক করে- না, যা ভাবছেন তা নয়, একসঙ্গে নয়- যে যার মত আলাদা আলাদা কোথায় যে খসে পড়লো, কে জানে। আর তাদের খুঁজে পাওয়া গেল না। ... ...
মরা মাছের চোখের মত তা ছিল ক্ষুদ্র ও নিষ্প্রভ, আমাদের স্কুল জীবন বা মফস্বল। মরা মাছের চোখ যায় যত দূরে, সাইকেল বুঝি কখনো অপেক্ষা করত ঠিক ততটা দূরে পার্শ্ববর্তী স্কুলের শেষ ঘন্টাটি শোনার জন্য। কার জন্য, আজও জানি না। তবে, রবিবারে ক্ষমাদি আসতেন সেতার শিখতে পাশের বাড়িটিতে, তার শাড়ি বা সালোয়ার মিশে থাকত তার পেলব ত্বকে, আজ যদি বলি সে’ই ছিল সেতার আর হাসলে ঝালা বাজত দুই বাড়ির সীমানায় থাকা কাঞ্চন ফুলের গাছে, তাহলে আজ সেই শহরের অনেকেই মেনে নেবেন, সেই ছিল আমাদের মধুবালা টু সুচিত্রা সেন। মাধ্যমিকের পর জেনেছিলাম ক্ষমাদির ছেলে পড়ে আমার থেকে এক ক্লাস নীচুতে, কাজেই দলে ভারী হওয়ারই সম্ভাবনা। গুপী ডাক্তারের মেয়ে মহাশ্বেতা ছিল আমার থেকে দুই বছরের ছোট। শান্ত মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে তর্ক করত নাওয়া-খাওয়া ভুলে, সেই JNU যাওয়ার আগে পর্যন্ত। কানগুলো লাল হতে হতে কখন যে ঝান্ডা হয়ে পতপত করে উড়ত টের পেতাম না। ... ...
আমরা, ছোটরা তখন দাদির মুখের চিবুনো পান খেতাম। অনেকক্ষণ ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে পান খেত না দাদি। খানিকক্ষন চিবিয়ে রসটা খেয়ে নিয়ে পানটা হাতে নিয়ে আওয়াজ দিত, ‘পান কেডা খাইবি আয় রে’ বলে। ততক্ষণে পানের রসে টুকটুকে লাল হয়ে যেত টকটকে ফর্সা দাদির দুই ঠোঁট আর ঠোঁটের কষ। তাকালে দেখা যেত অপূর্ব এক লালের আভা ছড়িয়েছে ঠোঁট ছাড়িয়ে চিবুকের খাঁজে, বয়েসের ভাঁজে। একটা দুটো হাত সঙ্গে সঙ্গেই এগিয়ে যেত সেই চিবুনো পান খাওয়ার জন্যে। সকালের নাশ্তা বা দুপুরের খাওয়া বা বিকেলের চায়ের পরে আব্বা যখন বারান্দায় দাদির বেতের সোফার পাশে দ্বিতীয় সোফাখানিতে গিয়ে বসত, তখন একখিলি করে পান এগিয়ে দিত দাদি। মায়ের পাশে বসে গল্প করতে করতে পান চিবুতো আব্বা। ... ...
এইই বিভ্রমের গল্প। এগারো বছর আগে একজন ঘুমপাড়ানী বুড়ো এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে যে উপহার দিয়ে গেছিলেন সেই গল্প। এখনও আমার ব্রেনে এনকেফালোম্যালেশিয়া আসন পেতে রয়েছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় এই নিয়ে আরো জানি। পড়ে ফেলি অনেক কিছু। জিজ্ঞেস করি যাঁরা জানেন তাঁদের। আবার পরের মূহূর্তে ভাবি -- থাক। ভালো লাগে এই অন্য দুনিয়ায় মাঝে মাঝে পা রেখে ফিরে আসতে। ম্যাজিক দুনিয়ার সমস্তটা জেনে ফেলে কী লাভ? ভালো লাগে এইই। ভালো লাগে যখন বিভ্রম আমার ঘাড়ের ওপর ফুঁ দেয়। আমার কানে কানে হাওয়ার স্বরে ফিসফিস করে বলে-- 'আলোহোমোরা'। ... ...
গাজন - সোমনাথ রায় লিটলমেঘ মেলা - শুভ্রনীল সাগর গণেশ পাইনের রানি - শিবাংশু দে না-হওয়া কথারা -সোনালি সেনগুপ্ত দৃষ্টিকোণ - শান্তনু রায় মামুলি কথা -মলয় ভট্টাচার্য মুকুর - শ্ব মর্স কোড - অধীশা সরকার গুহালিপি - চিরন্তন কুণ্ডু মনান্তর - নিশান চ্যাটার্জী স্বগতভাষণ - সুমন মান্না ফেরা - মিঠুন ভৌমিক ... ...
নতুন ছেলেটা খুব বকবক করছে। মেয়েটা খুব হাসছে। প্রথম ছেলেটার মুখে ক্ষুণ্ণ ভাব। হঠাৎ খেয়াল করে টিনের বাক্সটা এখনো তার হাতে। বাক্সটা মেয়েটাকে ফেরত দেয়। মেয়েটা এর হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে অম্লানবদনে অন্য ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিল। তাতে প্রথমজনের মুখের ক্ষুণ্ণ ভাবটা আরো বেড়ে গেল। একটু পরে পথের ধারে একটা খারাপ হয়ে যাওয়া রোড রোলার। প্রথম ছেলেটা হাঁচোড়পাচোড় করে ড্রাইভারের সিটে ওঠার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে সঙ্গীরা অনেকটা এগিয়ে গেছে দেখে হাল ছেড়ে দিয়ে আবার হাঁটা লাগায়। স্কুল মনে হয় আর বেশি দূরে নয়। রাস্তায় এদের মতই রংজ্বলা নীল হাফপ্যান্ট অথবা স্কার্ট পরা কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে দেখা যাচ্ছে এবার। ... ...
বাড়ির পেছন দিকে ছিল একটা এঁদো ডোবা। আর ঘন ঘাস। এই ঘাস শুকিয়ে হয়েছিল আমাদের প্রিয় বিছানা। এই নরম গরম বিছানায় আমরা জড়াজড়ি ঘুমাতাম। আবার ঘুমের মধ্যে স্বপ্নও দেখতাম। সে সময় আমাদের একটি ছোটো বোন আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ও স্বপ্ন দেখতে জানত না। ... ...
বাদুরে খেয়ে ফেলা লিচুর খোসার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অন্ধকারে ফচকাটা ঝলসে ওঠে! রাত্তির সবে গভীর হতে শুরু করেছে। ঘন-দুধের সর হয়ে তখনো তা পুরু হতে পারে নাই! অথচ শলাগুলোর তীক্ষ্ণ আগা আয়শা খাতুনের দিকে তাক করা! খানিক পরই তা ধাই করে বুকে বিঁধে যাবে। একেবারে বাম পার্শ্বে। বাম পাশ, না ডান? ডান পাশ, না বাম? যেনো ভয়ানক তাল-বেতালের ভেতর পড়ে আয়শা খাতুন উদ্দিশ করতে পারে না! কিন্তু সে নিশ্চিত জানে তাক করে থাকা ফচকাটা তাকে বিদ্ধ করবে। করবেই। ফচকার ধারালো শলা বুকের মাংসপেশিতে ঠিক ইঞ্চি তিনেক গেঁথে যাবে। মুহূর্তে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটবে। আর আয়শা খাতুন তখন আর্তনাদ করে উঠবে। তীব্র-তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। অতঃপর মরিয়া হয়ে সুইচ বোর্ড হাতড়াবে। কাঠের বোর্ডটা হাতে ঠেকলে খুট করে সুইচ জ্বালাবে। এই পর্যন্তই। তারপর সবকিছু শান্ত। স্থির। নিরব। নির্জন। নিথর। একেবারে গোরস্থানের মতো থই থই নির্জনতায় ভরে যাবে ঘরখানা। আয়শা খাতুন ধীরে সুস্থে এই নির্জনতায় পা ডুবাবে। বালিশের কাছে রাখা চশমাটা চোখে পড়বে। চশমা চোখে নিজের বুক-পেট ভালো করে দেখবে। হাতিয়ে হাতিয়ে রক্তচিহ্ন খুঁজবে। অতঃপর ফচকার তীক্ষ্ণধার শলাগুলো খুঁজবে। কিন্তু কোথাও কিনা ওইসবের আলামত নাই! সব যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে! আয়শা খাতুন চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলবে। আঁচলের কোণা দিয়ে ভালো করে মুছে-টুছে ফের পড়বে। এবং পুনরায় দেখার চেষ্টা করবে। কোথায় সেই ক্ষত? কোথায় রক্তের প্রপাত? ঝলসে ওঠা ফচকা? এই সবের চিহ্নও কোথাও নাই! এই রকম অযাচিত বিপদে আয়শা খাতুন কালে-ভদ্রে পড়েছে। অবশ্য এ বিষয়টাও তো নিশ্চিত নয়। জীবন যদি মস্তক হয় তাহলে তার লেজ হলো বিপদ! ফলে যতদিন জীবন ততদিন বিপদ। ধড় থেকে লেজ আলাদা করা যায় না। জীবন আর বিপদ তাই আষ্টে-পৃষ্টে বাধা থাকে! ... ...
আমার মা ফার্মগেট চিহ্নিত করে রাখে একটা ব্যানার দিয়ে। যাতে লেখা ‘গরু-ছাগলের বিরাট হাট’। পাশ দিয়ে দুইটা বড় বিল্ডিং, তারপর টুকরি-মাথায় কয়টা বেঞ্চি, কিছু গাছ, হ্যাঁ পার্ক, তারপরেই চক্ষু হাসপাতাল। মায়ের চোখে সমস্যা। মা আমাকে চিনতে পারো তো মা? মা-মা! বারবার বলার পরও তার এই বাতিক যায় না। আরে বাবা, অই ব্যানার যে আজীবন থাকবে না—এই জানা কথা তারে কে বোঝায়? এমন তো হইতে পারে একদিন দেখা গেল—সামনে দিয়ে কালো বিড়াল পথ কেটে যায়নি, বাম চোখ সকাল থেকে থেকে-থেকে নাচেনি, আমার মা যাকে বলে চৌখ নাচানি, বলে ডাইন চৌখ নাচলে সুসংবাদ আর বাম চৌখ নাচিলে তোর কপালোত শনি। এমন তো হতে পারে সব পূর্বাভাসের দেবতারা, চিহ্নগুলো উধাও হয়ে গেছে! তখন? মা তারপরেও নাখালপাড়াকে চিনে রাখে ‘এইখানে ভাল হাতের কাজ করা হয়’, ইন্দিরা রোডকে ‘বনসাই প্রশিক্ষণ’ আর নিজের বাসাকে চিনে রাখে তিন রোড আগে একটা মস্ত বড় খাড্ডা দিয়ে। আমার ভয় করে। মা আমাকে চিনতে পারো তো মা? আমি তোমার লাল, মা, আমি তোমার লাল, লাল পান্না। আমি বলি মা পান্নাতো সবুজ। তবু মা টাকা জমায়, বুড়া বয়সে তাকে কে দেখবে? কে? এর কাছ থেকে চেয়ে, আধিয়ারের কাছে তিন ছটাক ধানের প্রাপ্য বুঝে নিয়ে, বাপের পকেট কেটে, আমাদের গিফটের টাকা জমানোর নাম করে, আমার সুন্নতের কচকচি নতুন ২ টাকার বান্ডিলের কথা এইমাত্র মনে পড়ল, এইভাবে নিজের পাত থেকে নিজের স্বাচ্ছন্দ্য সরিয়ে রাখে মা। ‘মা আমি তো আছি’—বলতে পারি না। বলতে পারি না, মা এক ভয়ানক রূপসীর হাত থেকে পালিয়ে আছি, ওরা আমাকে মিষ্টি খাওয়াইতে চায়। মা সুরা পড়ে, ফুঁ দেয়, আমার চোখে মুখে লেপ্টে যায় বর্ণমালা। মা আমার হাতে লেখে ‘পুত্র’, চোখে লেখে ‘নীল’, হাতে-পায়ে ফোঁড়ার দাগের একটু নিচে লিখে দেয়— ‘৮ সোনারগাঁও জনপথ রোড, উত্তরা, মাস্কট প্লাজা থেকে সোজা পশ্চিমে একটা ৪ রাস্তা, তারপরে আরেকটা ৪ রাস্তা, দুই তিনটা বাড়ির পর একটা তিন ডাবগাছঅলা বাড়ি’—যাতে লোকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারি এই আমার বাড়ির ঠিকানা। ... ...
জোনাকির গ্রামে আজ পর্যন্ত বাসের রাস্তা তৈরি হয়নি। কোথাও যেতে হলে বেশ খানিকটা হেটে বড় রাস্তায় এসে বাসের জন্যে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। ধুলো ও বর্ষার কাদামাখা পা খানা বট গাছের তলায় চাপা কলের জলে ধুতে ধুতে বার বার ঘাড় উঁচু করে দেখতে হয় জোনালি নামে গুয়াহাটি যাওয়ার বাসটা আসছে কি না ! কোন কারনে জোনালি এসে না পৌঁছালে ম্লানমুখে বাড়ি ফিরে যেতে হয়। বাসে বসার কথা কেউ ভাবে না। হাঁস-মুরগি,শুকনো মাছ ,মাগুর-কই মাছের টিন, শুকনো পাটের দম বন্ধ করা বাসে দাঁড়াতে পারাটাই পরম সৌভাগ্যের বিষয়। অবশ্য বিশেষ কাজ না থাকলে কেউ ই গ্রামের বাইরে যাওয়ার কথা চিন্তাও করে না। ... ...
এক যে ছিল ভীষণ কেবলী মেয়ে, টিঙটিঙে রোগা, থাকার মধ্যে মাথায় ঘন চুল, মুখচোরা আর প্র্যাকটিকালে ভয়। কেমিস্ট্রী ছাড়া সবকিছু পড়তে ভালবাসে, পাকপাড়া থেকে বেলগাছিয়া এসে ট্রামে করে কলেজ যায়। আর ছিল এক ডাক্তারীর ছাত্র, বেজায় গম্ভীর, নেহাত দরকার না পড়লে কথাটথা কয় না, সবসময় রামগরুড় মুখ করে ঘোরে কিন্তু পেটে শয়তানি বুদ্ধি গিসগিস করে। সেদিন ডিসেম্বর মাস, অসময়ে প্রবল বৃষ্টি। হাঁচতে হাঁচতে কেবলী কলেজে চলেচে, বগলে তিনটে প্র্যাকটিকাল খাতা, এক হাতে তোয়ালেরুমাল, অন্য হাতে বাসের রড, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। ... ...
- এক থাপ্পড় লাগাব অসভ্য মেয়ে, সিনিয়ারদের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় জাননা ? - যাব্বাবা, আমি কোথায় ভাল মনে বলতে গেলাম, তোমার জীন্সটা ফ্যান্টা, আর তুমি চমকে দিলে ? দেখ, সিনিয়ার বলে অত এয়ার নিওনা, মোটে তো দুবছরের বড় – - চমকে দিলাম আবার কী ভাষা, ঠিক করে কথা বল। আমাকে কী বলে ডাকলে তুমি ? আমার নাম শুচিস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ছোট করে, স্মিতা। বুঝলে ? - কী করে জানব দিদিভাই, দুনিয়ার লোক তোমায় শ্যামা বলে ডাকে শুনি, তাই আমিও বললাম, শ্যামাদি। খুব অন্যায় করেছি না? পায়ে ফায়ে ধরতে হবে নাকি? ... ...
কিন্তু, আসল ব্যাপারটা মোটেই এরকম নয়, এই ‘অহিংস’ ঘটনা ঘটার দিন বিকেলে প্রেসিডেন্সির বন্ধ গেটের বাইরে সাধন পাণ্ডে মহাশয়ের নেতৃত্বাধীন জনসভার বক্তব্য থেকে আসল ব্যাপার পরিস্ফুট হয় । ‘চক্রান্ত’-এর অন্ধকার কেটে আলোর দ্যাখা পান ডিরোজিয়ানরা এবং অন্যান্য মূঢ় ব্যক্তিবর্গ । আসলে তৃনমূল ছাত্র পরিষদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে প্রেসিডেন্সি থেকে বেরিয়ে ছাত্রছাত্রীরা হামলা করে, যে জন্য মিছিলে উপস্থিত লোকজন বাধা দিতে বাধ্য হন । যে কারণে পরের দিন প্রেসিডেন্সির হাজারে হাজারে ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-কর্মচারী-প্রাক্তনী যখন পথে নামেন, তখন প্রেসিডেন্সির ছাত্র দেবর্ষি চক্রবর্তী এবং প্রেসিডেন্সি প্রাক্তনী ছন্দক চ্যাটারজির বিরুদ্ধে এফ আই আর দায়ের করে টি এম সি পি , ১৪৭, ১৪৮ ও ১৪৯ নং ধারায়, দাঙ্গা বাধানো এবং উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগে । এই দেবর্ষি চক্রবর্তী আগেরদিন হাসপাতালে গেছিলেন আহত হয়ে ? ও সে তো নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে গিয়ে লেগে গেছিল । আরেকজন ছাত্রকেও হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল না? ওরা দুজন নিজেদের মধ্যে মারামারি করছিল । সিম্পিল । ... ...
কিন্তু বিজ্ঞান ব্যাপারটা কী? কাকে বলব বিজ্ঞান আর কেই বা না-বিজ্ঞানের দলে? কিভাবে ঠিক হবে তাদের সীমা, সীমানা? এই প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ, বিজ্ঞান কি আর তার বৈশিষ্ট্যই বা কি, এটা না বুঝলে বিজ্ঞানের আধিপত্যের রাজনীতিটা বোঝা মুশকিল। এই প্রশ্নটা নতুন নয়, আদতে বেশ পুরোনো দার্শনিক প্রশ্ন। এখন একটু দেখে নেওয়া যাক বিজ্ঞানের বিশেষত্বকে প্রশান্ত/অতলান্তের অপর পাড়ের পন্ডিতেরা কিভাবে দেখেছেন, ভেবেছেন। ... ...
মৃত্যুর ওপার নিয়ে মানুষের জিজ্ঞাসা আজকের নয় । এই প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য মীমাংসা হওয়া প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হয় । সংবেদনশীল এবং কৌতূহলী মানুষেরা এই প্রশ্ন উথথাপন করবেন এবং নিজেদের মত করে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা চালাবেন – এটা তাই প্রত্যাশিত বলেই ধরে নেওয়া যায় । প্ল্যানচেটের মাধ্যমে এপারের সঙ্গে ওপারের সেতুবন্ধনের প্রয়াস তারই একটা অংশ । বিভিন্ন যুগের কিছু বিশিষ্ট মন এ পথে আকৃষ্ট হয়েছে । এখানে তেমন কয়েকটি উদাহরণ রইল মাত্র । অতীত বর্তমান মিলিয়ে এই তালিকা আসলে দীর্ঘ । এবং পুনরাবৃত্তি যদি ইতিহাসের ধর্ম হয়, সম্ভবতঃ ভবিষ্যতেও এই পথে সন্ধানী পথিকের অভাব হবে না । ... ...