বুদ্ধিদীপ্ত বেজায় মজাদার একটি বই যেখানে কল্পনা, বাস্তব, রহস্য আর খ্যাপামি দিব্যি মাখামাখি হয়ে বসে আছে! পড়তে পড়তে মনে পড়ে যাচ্ছিল লীলা মজুমদার, নবনীতা দেব সেন, শিবরাম, জেমস থারবারকে... কিন্তু ওইটুকুই, বাস্তবে স্টাইলটা লেখিকার একান্তই নিজস্ব। আমি বলি কি, ভূমিকা পড়ে সময় নষ্ট করবেন না; ঝাঁপিয়ে পড়ুন মূল বইয়ের পাতায়। একটা সতর্কবার্তা – সিরিয়াস রামগরুড়ের ছানাদের জন্য এই বই নয়।' ... ...
এক যে ছিল ভীষণ কেবলী মেয়ে, টিঙটিঙে রোগা, থাকার মধ্যে মাথায় ঘন চুল, মুখচোরা আর প্র্যাকটিকালে ভয়। কেমিস্ট্রী ছাড়া সবকিছু পড়তে ভালবাসে, পাকপাড়া থেকে বেলগাছিয়া এসে ট্রামে করে কলেজ যায়। আর ছিল এক ডাক্তারীর ছাত্র, বেজায় গম্ভীর, নেহাত দরকার না পড়লে কথাটথা কয় না, সবসময় রামগরুড় মুখ করে ঘোরে কিন্তু পেটে শয়তানি বুদ্ধি গিসগিস করে। সেদিন ডিসেম্বর মাস, অসময়ে প্রবল বৃষ্টি। হাঁচতে হাঁচতে কেবলী কলেজে চলেচে, বগলে তিনটে প্র্যাকটিকাল খাতা, এক হাতে তোয়ালেরুমাল, অন্য হাতে বাসের রড, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। ... ...
আমার পাশে যে বসে ছিল তাকে বললাম, “এ তো গামা গাছের ডগাগুলো কেটে দিয়ে গেছে মনে হচ্ছে! সাদা প্লেটে চিজ ছড়িয়ে দিলেই কি গরুর খাবার মানুষের হয়ে যায় নাকি!” পাশের জন বলল “হোয়াট ইজ গামা?” তাকে অনেক কষ্টে আমার বিখ্যাত ইংরাজিতে বোঝালাম, যে এর সাথে ভাস্কো-দা-গামা-র কোন সম্পর্ক নেই। বাড়ির গরুতে খাওয়ার জন্য আমরা জমিতে গামা (বাংলায় অনেক জায়গায় একে গমা বা গ্যামা বলা হয়) চাষ করতাম। এমনি সবুজ লকলকে ডাঁটির মত গাছ জমি থেকে কেটে এনে বাড়িতে খড় কাটার বঁটিতে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে কুচাও। আমাকে বলা হল এগুলোকে নাকি ‘অ্যাসপারাগস’ বলে! গামা গাছের ডাঁটির বিজ্ঞান সম্মত নাম যে অ্যাসপারাগস, সেটা কে আর জানত! ... ...
হাতের বাতি দোলাতে দোলাতে পুব-মাথা থেকে শুরু করে বিল্ডিঙের পশ্চিম-মুখো চলেছিল বিল। বারোটার ঘণ্টা শুরু হতে হতেই ও সেই আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে হপস্কচ খেলার ভঙ্গিতে প্রতিটা ঢং শব্দের সঙ্গে কল্পিত ছক লাফাতে লাফাতে পার করল। কেউ দেখলে ভাবত এই মোটা মুচওয়ালা মুশকো জোয়ানটা করছে কী? আর ওর আট বছরের মিয়নো বউ সিমোন দেখলে কী বলত? কে কী বলল বা ভাবল তাতে বিলের ঠ্যাঙা। রাতের অন্ধকার যেমন কিছু ভয় জুটিয়ে আনে, তেমনি অনেক ভান-ভণিতাও ছেড়ে চলে যায়। এই যেমন, রাত একটার ঘণ্টা বাজার সময়, সে যদি পুব দিকে থাকে তাহলে ক্যাপ্টেন বার্কের গ্রে হাউন্ড জ্যাকের মত গলা উপরে তুলে একটা গম্ভীর ডাক ছাড়ে। দিনে দিনে গলাটা জ্যাকের মত সুরে খেলছে। ভাবলেই গর্বে বিলের বুক ভুঁড়ি ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায়। এমনি-ধারা নানান খেলা দিয়ে নিজেকে জাগিয়ে রাখে বিল গেন্স। ... ...
ছোটবেলা থেকেই আস্থা রেখেছিলাম বিজ্ঞানে, সত্যে, যুক্তিতে। ঠিক সেই কারণেই আজ যাদের বিরুদ্ধে কলম ধরতে বাধ্য হলাম, তাঁদের একএকটা রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবেই ধরতাম। তাঁরা যখন কিছু লিখতেন, বলতেন, যাচাই না করেই সেই ফ্যাক্টগুলো মেনে নিতাম, অনেক সময় দ্বিমত হতাম তথ্যের ব্যাখ্যায়, কিন্তু তথ্যে বা basic framework এ নয়। একটা আস্থা ছিলো, বিশ্বাস ছিলো, শ্রদ্ধা ছিলো - তাঁদের সততায়, জ্ঞানে, বুদ্ধিবৃত্তিতে। কিন্তু এখন যখন দেখি এঁদের অনেকেই পূর্বনির্ধারিত বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে বাস্তবকে অস্বীকার করে অন্ধ বিশ্বাসের প্রচার করেন তখন মানতেই হলো, কোভিড১৯ অনেক কিছুই কেড়ে নিয়ে গেল তার মধ্যে নিয়ে গেলো এই আস্থাটাও, এতেও কম রিক্ত হলাম না – অন্তত ব্যক্তিগত ভাবে । এই বয়সে আস্থার জায়গা খুব কম, সেখানেও যখন টান পড়ে, হতাশ লাগাটা বোধহয় অস্বাভাবিক নয়। ... ...
নোটের খাতা বন্ধ করছি। ছাতা-পার্স ভরছি ব্যাগে। এ সময়ে হঠাৎ একটা অন্য গলার স্বরে একখানা প্রশ্ন এল আমার দিকে। প্রশ্নটা মেয়েদের গলার স্বরে। মাথায় ঘোমটা। গলাটা সরু। ভাঙা ভাঙা। খাজার বৌ সাবিনা কখন যেন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিচু টালির বারান্দায় মাথাটা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সেখান থেকেই জিজ্ঞাসা করল, দিদি, কী হবে এসব লিখে? আমদের কোনও লাভ হবে? এতক্ষণ যারা খাজার দিকে তাকিয়ে, খাজার কথার উপর দিয়ে কথা বলে চলেছিল, তারা থেমে গেল। খাজার থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে নিল একবার। সবাই চুপ। যেন আমার উত্তরের অপেক্ষার সেকেন্ড-মিনিট গোনা চলছে এখানে। হঠাৎ যেন একটা পরীক্ষার বেল পড়েছে। পরীক্ষক এখানে অনেকজন। তারা সবাই তাকিয়ে আছে একদিকে। পরীক্ষার্থী আমি একলা। হাঁ করে বসে আছি। কী বলব আমি এ প্রশ্নের উত্তরে! ... ...
এই মদ্যপান নিয়ে বাঙালির নৈতিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস বড় পুরাতন। মূলধারার সাথে অস্ফুট লোকাচারের পার্থক্য তো ছিলই; কিন্তু মূল সুর ছিল সহাবস্থানের। কথিত আছে, একবার শাক্ত সাধক কমলাকান্তকে মদ্যপান করতে দেখলে, বর্ধমানরাজ তেজচন্দ্র তিরস্কার করেন। প্রত্যুত্তরে মাতৃভক্ত কমলাকান্ত মদ্যকে দুগ্ধে পরিণত করে সেই দুধে দেবীপ্রতিমার পূজা করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতিভূ তেজচন্দ্রের কাছে যা অনৈতিক, সাধক কমলাকান্তের কাছে তা নয়। ভারতীয় লোকাচারের ঊর্ধ্বে থাকা সাধক সামাজিক নিয়মনীতির অধীন নন। কমলাকান্তের মতই, সাধক রামপ্রসাদও মদ্যপান করতেন। পণ্ডিতসমাজের প্রধান কুমারহট্ট এ নিয়ে তাঁকে তিরস্কার করলে, রামপ্রসাদ বলতেন, “সুরাপান করিনা আমি / সুধা খাই জয় কালী বলে”। কিন্তু সব প্রেমিক যেমন দেবদাস নয়, সকল মদ্যপই রামপ্রসাদ নয়। শাক্তমতে গুহ্যসাধন-ক্রিয়ায় মদ্যপানের যে রীতি, তা প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ না হওয়াটিই স্বাভাবিক। কিন্তু ‘প্রাত্যহিক জীবন’ তো কোন সমসত্ত্ব ধারণা নয়, বরং তা স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভিন্ন। একদিকে প্রাক-ঔপনিবেশিক বঙ্গীয় উচ্চবর্গ যেমন পারতপক্ষে মদ্যপান এড়িয়ে চলেছে, মঙ্গলকাব্যের অন্ত্যজ শ্রেণি অবশ্য শুঁড়িখানায় ক্রমাগত ভিড় জমিয়ে গেছে। তাই মদের বিচারেই বাঙালি অনেক আগেই ‘আমরা-ওরা’-র ব্যবধান তৈরি করে ফেলেছে। ... ...
আজকে 'সাম' নামে এক সিরিয়ান রেষ্টুরান্টের খাবারের কথা, এও সেই আমষ্টারডাম শহরে। সাম হল গিয়ে সিরিয়ার রাজধানী দামাসকাস শহরের ডাক নাম। তো সেই থেকেই এরা খুলে বসেছে পুরানো স্মৃতি ভরা নাম নিয়ে রেষ্টুরান্টে। কালে কালে এরা এত বেশী নাম করে ফেলে যে তিনটি ব্রাঞ্চ খুলে ফেলে এদিক ওদিক। আগে থেকে বুক না করে গেলে টেবিল পাবার চান্স প্রায় নেই। আমি এখানে অনেকবার একা একা খেতে গেছি - বলেছে টেবিল নেই, আমি নেগোশিয়েট করেছি - আপনাদের পরের রিজার্ভেশন কটায়? রাত আটটার রিজার্ভেশনের ওরা আসার আগেই আমি খেয়ে হাওয়া হয়ে যাব এখান থেকে। দয়া করা আমাকে কোনের দিকে টেবিলে অ্যাডজাষ্ট করে দিয়েছে অনেক বার। ... ...
আমি আগে বাঙাল, পরে বাঙালি। আজীবন ইস্টব্যাংগল, আমরণ লালহলুদ। শবাসনে ক্যান্ডিক্রাশ খেলতে খেলতে বাঙালদের জেদ, পরিশ্রম, স্ট্রাগলের গৌরবের আঁচ পোহাই।... ইলিশ না ভালোবেসে যতখানি বাঙাল হওয়া সম্ভব। আশৈশব পান্তা না ছুঁয়ে বড় হলে যতখানি বাঙাল হওয়া সম্ভব। আমি শুঁটকির ওমে বেড়ে উঠেছি, কচুর কন্দ, ডাঁটা, লতি, পাতার পাহাড়ে চাপা পড়ে গেছি, জেনেছি যে পৃথিবীতে একমাত্র বিষাক্ত না হলে সমস্ত ঘাসপাতা বেটে খাওয়া যায় - খালি পান্তা আমার সিলেবাস থেকে বাদ পড়ে গেছে। অথচ পড়ার কথা ছিল না। পড়তে থাকুন... ... ...
মনিপিসি কলেজের জন্য আজ বের হলো না। আর ঠাকুমার কাঁথাগুলোও কাঠের বাক্সে থেকে গেলো। একে তো হাটবার তার উপর মনিপিসির ব্রতের দিন। উনুনের আঁচ নিভলো না আজ। তবে উনুনে আমিষ ওঠার আগেই ঠাকুমা নিরামিষ পদ করে নিতে চায়। ব্রতশেষে লাল আটার রুটি দিয়ে মনিপিসি ঝিঙে বাসন্তী খাবে। ... ...
সুকোভ কোনও সময় টুপি পরে খাবার খায় না। সেটা খুলে সে হাঁটুর ওপর রাখে। তার দিয়ে তৈরি করা একটি চামচ যেটা সেই ১৯৪৩ সাল থেকে তার সঙ্গী সেটা সে তার পায়ের ছেঁড়া ন্যাকড়াগুলোর মধ্যে থেকে বার করে। চামচ দিয়ে দুটো বাটির তরল নাড়িয়ে দেখে। গরম, ধোঁয়া উঠছে। এক চামচ সে মুখে দেয়, আরও এক চামচ। উষ্ণতা তার শরীরের জমে থাকা হিম ভেদ করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। আঃ স্বর্গীয়! তার মুখ উদ্ভাসিত, কোনও কষ্টই তার কাছে আর কষ্ট নয়। লপসিটা সে নাড়ায়, চলে যাবে, মাছের একটা সেদ্ধ ক্ষীণ কাঁটাও আছে যেটার সঙ্গে ফুলকো পাখনার টুকরাটাকরা লেপটে আছে। প্রতিটি কাঁটা সে শুষে নিঃশেষিত করে ফেলে, ছিবড়ে করে টেবিল ভরিয়ে দেয়। ৎসজারের বাটিতে আবার একটা বরফঘেয়ো আলু! কোনও তাড়াহুড়ো নেই তার, ধীরে সুস্থে খায়। আলুটা মিষ্টি, কিন্তু শক্ত। সুকোভ একটা বাটির তরল শেষ করে অবশিষ্টটা কাচিয়ে দ্বিতীয় বাটিতে ঢেলে দেয়। সেটাও চেটেপুটে চকচকে করে দিয়ে তবে তার শান্তি। ... ...
এইসবের মাঝখানে পড়ে আমার ভাবনাচিন্তারা সব কেমন গুলিয়ে যেতে থাকল। মনের মধ্যে প্রশ্ন ওঠা শুরু হল, সত্যিই কি এই বিভিন্ন ধরনের অসাম্যের বিরূদ্ধে আন্দোলন হাত ধরাধরি করে চলতে পারে? কি ভাবে ক্যুইর আন্দোলনে একজন বামপন্থী (মতান্তরে ভাম্প্যান্টি) ও একজন দক্ষিনপন্থীর (মতান্তরে ভক্ত চাড্ডীর) সহাবস্থান হতে পারে? যখন সমকামী আন্দোলনের জন্য কথা বলছি তখন কি আমার অন্য রাজনৈতিক/সামাজিক পরিচয়টাকে সরিয়ে রাখতে হবে? তখন আমার শুধু একমাত্রিক পরিচয়, আমি একজন সমকামি? কিন্ত তাহলে, যে ঘেটোর বিরুদ্ধে এই আন্দোলন, সে গন্ডীই কি নিজের চারিদিকে টেনে নিচ্ছি না আমি? আবার লিঙ্গ-আন্দোলনকে যদি ডান-বামে ভাগ করি, তাহলে কি শক্তিক্ষয় করছি না নিজেদের? "মিনিস্কিয়ুল মাইনরিটি" কি আরো ছোট হয়ে যাচ্ছে না? যদি দেখি ক্যুইর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শোভা পাচ্ছে স্পন্সর অনুপম খেরের কাট আউট, যিনি আমার মতে জে এন ইউ ইস্যুতে বাকস্বাধীনতার কন্ঠরোধ করতে চেয়েছিলেন, তখন কি করব? যেহেতু ক্যুইর ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল তাই তার সঙ্গে থাকব, না কি সরে আসব, আর না কি অপছন্দটাকে যথাস্থানেভ্য জানিয়ে রেখে চুপচাপ বসে যাব? আর না কি সন্ত টেরেসার মত বলব, টাকায় কোনও দাগ নেই? টাকা কোথা থেকে এল গুরুত্বপূর্ণ নয়, কি কাজে খরচ হল সেটাই আসল? ... ...
বাগামায়ো ও উসেগুহহার সিম্বামওয়েন্নির মধ্যে আমাদের অভিযান সর্বোচ্চ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিল, সেটা হাজার ফুটের বেশি হবে না, আর কিঙ্গারু হেরার উত্তরে, দিলিমা শীর্ষ নামে যে পাহাড়গুলো পরিচিত, এখানে ওখানে তাদের একেকটা পাহাড়চূড়া বাদ দিলে, মিকেসেহের আশেপাশে ভূমি কিন্তু ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠেছে। টানা সমান্তরাল ঢেউ এর মত, পাহাড়ের শিরগুলো গভীর জঙ্গল বা মসৃণ ঘাসে ঢাকা— ঢালগুলো সুচারুভাবে পশ্চিমদিকে তরঙ্গের তলদেশের গভীরে নেমে যাচ্ছে, এর মধ্যে দিয়েই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে জল বয়ে গিয়ে উঙ্গেরেঙ্গেরিতে পড়ে। ... ...
ক্রিকেটের মতোই মেয়েদের হকি ভারতে দুয়োরানীর মর্যাদা পেয়ে এসেছে তাদের পুরুষ দলের তুলনায়। এক্সপোজার কম, টুর্নামেন্ট কম, শারীরিক সক্ষমতা কম সর্বোপরি মানসিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া। কিন্তু ওই যে ওপরে বললাম, যাদের প্রতিনিয়ত সমাজের সঙ্গে মেয়ে হিসেবে, খেলোয়াড় হিসাবে এবং সমাজ ব্যবস্থার শিকার হিসাবে লড়তে হয় তারা বোধহয় এতো সহজে হার মানে না। ... ...
ক্যাটোরবাসী বিছানায় একটা হাল্কা সুবাস ছিল। কোন মন কাড়া আতরের গন্ধ, নারী শরীরের সুগন্ধি আবেশ। গোবিনের মনে পড়ছিল দামুর মায়ের কথা, রমনাবি। গত বিশ বছরে বিবির সঙ্গে মোলাকাত হয় দুই বছরে একবার। গোবিন বাড়ি ফিরলে তার তাম্বুল খাওয়া ঠোঁটের হাসি ছড়িয়ে পড়ে, পায়ে আলতার পোঁচ পড়ে, হাটে চুপড়ি ভরা নোলা আর খলিসা মাছ বেচে জালালের বিলে ধুন্দুলের খোসা দিয়ে ঘসে ঘসে সিনান করে চালা ঘরের বিছানায় গোবিনের কাছে ঘন হয়ে আসত। রমনাবির পাক দেওয়া পাটালি গুড়ের মত চামড়ায় নাক ডুবিয়ে আঁশটে গন্ধে সিনা জুড়াত গোবিনের। মৎস্যগন্ধা নারী তার লেজের ঝপটায় ভাতারকে পাকে পাকে জড়িয়ে নিত একদম। স্বপ্নে দামুর মায়ের জন্য ছটফট করে উঠল দশ ঘাটের পানি-ছ্যাঁচা, ব্রিটিশ জাহাজের পোড় খাওয়া লস্কর গোবিন্দ সারেং। দামুর মা, জীর্ণ বেড়ায় ঘেরা তার একচালা ঘর, ভিটের এক ছটাক জমিতে মাথা দোলানো নিমের শীতল বাতাস, স্বপ্নে তাকে ঘিরে ধরেছিল। ক্যাটোর বিছানায় যখন ঘুম ভাঙল গোবিন্দের, তখনও মনে জেগে রইল পায়ের তলায় শক্ত জমির কথা, পায়ের পাতায় ধুলা মাখার সুখানুভূতি। গোবিন্দ সাব্যস্ত করল যা হয়েছে সে বাচ্চা পীরের দোয়া। এই যে আক্রাম হঠাৎ করে চোখের সামনে কোন ভোজবাজিতে হাফিস হয়ে গেল সেটা আখেরে ভালই হল। তাকে জাহাজে ফিরতে দিল না। যে ইঞ্জিন রুমের জন্য বছরের পর বছর বাঙ্কার থেকে চাঁই চাঁই কয়লা বয়ে নিয়ে এসেছে, হাতুড়ি মেরে মেরে সেই কয়লা ভেঙেছে, কিংবা ফার্নেসের হ্যাচ খুলে আগুনে কয়লা ঠেলেছে, সে জাহাজি জীবন আর তাকে টানছিল না। সেই কোন জোয়ান বয়সে মাছ ধরার জাল গুটিয়ে রেখে জাহাজের খোলে প্রবেশ করেছিল গোবিন্দ। তার দেশ বিদেশ দেখার হাউশ মিটেছে। অনেক দেশের লোক দেখেছে সে-ও সত্যি, কিন্তু জীবনের এতগুলো বছর কেটে গেছে তিরিশ-হাত পানির নিচে, সে যেন এক অন্য পৃথিবী। যেখানে জীবনের সব চাওয়া পাওয়া জড়ো হয় হাতের ফুলে ওঠা পেশিতে। ... ...
গত প্রায় দেড় বছর ধরে করোনাভাইরাসের অতিমারী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করেছে, জীবনের নানান দিক আর আগের মতন নেই | প্রাণঘাতী এই বিশ্বব্যাপী অতিমারী না হয় একরকম, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরেকটি অতিমারী মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, সেটি তথ্যবিভ্রান্তির অতিমারী। বিশেষ করে সম্প্রতি করোনাভাইরাসের টিকা, এবং টিকা দেওয়া-নেওয়া নিয়ে নানান রকম বিভ্রান্তিমূলক তথ্য চোখে পড়ছে। তাদের মধ্যে কয়েকটি নিয়ে এই আলোচনা। প্রতিটি “ভ্রান্ত ধারণা” (“মিথ”) আমরা প্রথমে উল্লেখ করে তারপর সেটিকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছি। ... ...
কয়েকবছর হল, জীবনের দুটো নিয়ন্ত্রককে আমরা বরণ করে নিয়েছি বেশ। প্রথমটা ছোট্ট একটা স্ক্রিন বসানো রবারের ব্যান্ড। কব্জিতে তা এঁটে রাখতে হয় চব্বিশ ঘণ্টা। হ্যাঁ, স্নান করার সময়ও খোলা নিষ্প্রয়োজন। পোশাকি নাম ফিটনেস ট্র্যাকার। আপনার চলন, শয়ন, স্বপন-বপন সব কিছু সেই ১৫ গ্রামের ছোট্ট ডিভাইস মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করবে। স্মার্ট ফোনের লেজুড় হয়ে কল, এসএমএস, হোয়্যাটসঅ্যাপের নোটিফিকেশন তো পাঠাবেই, ডায়ালের তলায় রাখা ইনফ্রারেড আলো আপনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপবে, হৃৎস্পন্দন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবে। ... ...
আমাদের বাঙলার রাজা লক্ষণ সেনের (শুনেছি বখতিয়ার খিলজি যখন বাঙলা আক্রমণ করেন, তখন লক্ষণ সেন নাকি বসে ভাত খাচ্ছিলেন – আক্রমণের খবর শুনে হাত না আঁচিয়েই ঘোড়ায় চড়ে পিছনের দরজা দিয়ে হাওয়া!) মত এই খেমাই রাজাদেরও প্রধান এবং প্রিয় খাদ্য ছিল ভাত – সাথে মেকং এবং টোনলে-স্যাপ নদীর মাছ, গেঁড়ি-গুগলি-শামুক-ঝিনুক, একদম টাটকা ধরা। ট্রাডিশ্যানাল খেমাই ক্যুজিনের প্রধান ডিশগুলি ছিল – স্যুপ, স্যালাড, একটা মাছের কোর্স, একটা মাংসের ডিশ, শাকসবজি এবং ভাত। মুখে জল আনা নানা রকমের সস বানাতে ছিল এরা প্রসিদ্ধ – আর খাবারে নানাবিধ মশলা এবং সুগন্ধি ইনফিউজ করার চেষ্টা করত। আর একটা কথা, কাম্বোডিয়ার রান্না বান্নায় রসুন কিন্তু বেশ দিল খুলে ব্যবহার করা হয়। শেষ পাতের মিষ্টি বলতে তা ছিল ফলমূল এবং নারকেল থেকে বানানো। সব মিলিয়ে বেশ জমকালো ব্যাপার। ... ...
যাত্রা, চলচ্চিত্র সব ধ্বংস করে দিয়ে আমরা পরীমণির কাছে আশা রাখছি সে ছ্যাঁচোরের মতো দু চার পয়সা রোজগার করে কোনরকমে চেয়ে চিন্তে জীবন কাটিয়ে সতীত্বের পরকাষ্ঠা দেখাবে। সব দায় পরীমণির। যখন তার সামান্য চোখের ইশারায় সে বুভুক্ষু পুরুষকে বাগে নিতে পারে ,তুড়ি মেরে আয় করে নিতে পারে অঢেল অর্থ, বিলাসী জীবন। শরীরের বিনিময়ে যে অর্থ বিত্ত সহজলভ্য, তা গ্রহন না করে নিজেকে সতী সাধ্বী রাখার দায় কেবল পরীমণির। এর সব দোষও হয়তো পরীমণির। ... ...
ত্রয়োদশ শতকের প্রাচীন শহর কাওলের ধ্বংসাবশেষ। একেই সম্ভবত স্ট্যানলে দুর্গ বলছেন এমবুয়ামাজি থেকে প্রায় ষাট মাইল দক্ষিণে, মাফিয়া বা মনফিয়া দ্বীপের বিপরীতে রুফিজি নদীর সবচেয়ে উত্তরের মুখ: এর থেকে আরও এক ডিগ্রি দক্ষিণে গেলে পড়বে কিলওয়ার বিখ্যাত বন্দর, দাস ব্যবসায়ীদের বিখ্যাত আড়ত। মৃমা নামের এই ভূখণ্ডটি সভ্য বিশ্বের দৃষ্টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আজকের দিনে যখন দাসেদের প্রশ্নটি বহু উত্তেজিত আলোচনার কেন্দ্রে, তখন আমাদের সকল মনোযোগ এখানেই প্রবলভাবে জড়ো হওয়ার দরকার। আমাদের কাছে এই অঞ্চলের গুরুত্ব তার বন্দরগুলির কারণে – মোম্বাসা, বুয়েনি, সাদানি, হুইন্ডে, বাগামোয়ো, কাওলে, কনডুচি, দার সালাম, এমবুয়ামাজি ও কিলওয়া – আফ্রিকার অভ্যন্তরে ধরে আনা, চুরি করে আনা বা কেনা দাসেদের তিন-চতুর্থাংশ এখান থেকেই বিদেশে পাঠানো হয়। এই কথাটা মনে রাখা উচিত। ... ...