“পরব হল, এই ধর আমোদ, নাচ গান। সোহরাইতে ঠাওর করিসনি, কেমন নাচ করে বিটিছেলারা?” ধাতুরির ফ্যাসা কণ্ঠে চঞ্চল জীবের কামজ্বর চিতাধূমচালিত চৈত্রের বিশুদ্ধ পাতার ন্যায় অন্তর্হিত হইবার পূর্বে যেরূপ অবশেষ রাখিয়া যায়, ধাতুরি সেমতো চক্ষু উন্মীলন করিয়া বুধনিকে অবলোকন করিল, সে দংশনে শীতপত্রের বিশুষ্কতা, ফলত নিষ্ফল—“এই, এই যে সারদাপ্রসাদ আর বুধনি, উয়াদের বাপলা হবেক সব্ব অগ্রে। উয়ারা বর বউ হবেক, গাঁও জুড়ে বসবেক ভোজ, উয়ার অন্তে আসবেক বারুনি পরব। কিত্তে মজা! মজাই মজা!” হাহাকার করিয়া বুড়া বাতাস ধাতুরির জিহ্বা চুম্বন করিল। ... ...
পারমিতার অবিশ্বাস্য লাবিয়ার তুলতুলে কুচুরমুচুর গোলাপি অনায়াস ঠোঁটের মাঝে চারভাঁজ করা দুটো দু’হাজার টাকার করকরে পিঙ্কি-পিঙ্কি নোট কালো বেঁটে কদমছাঁট চাপদাড়ি সোনার বোতাম হাফকুর্তা হেটোধুতি কুলীন খদ্দের চার্বাক টিরিনচাগা (বংপুং) গুঁজে দেবার পর ব্যাপারটা স্পষ্ট হল গলা খ্যাঁকারির পর দরোজায় তিনটে টোকা পড়তে ফুলকলি ওরফে নিভা ওরফে রানি ওরফে মৌসুমী ওরফে পারমিতা সন্ধ্যা হলে যার নাম রোজই পালটে যায় ... ...
ইউটিউবের বদান্যতায় যে বাঙালির এখন ঘরে ঘরে শেফ, বিভুঁইয়ের মাস্টারশেফের ঝাঁকে ঝাঁকে প্রতিযোগীদের ড্রিবলিং করে টিকে থাকা শীর্ষ তিনের একমাত্র মহিলাটির জটিল-কুটিল খাবারের বদলে এই 'সাধারণ' রান্নাটি ফাইনাল ডিশ হিসেবে পরিবেশনায় তাঁরা কিঞ্চিৎ পাজল্ড। এমনিতেই ক্লান্তিকর মানিমেকিং সর্বস্ব মধ্যবিত্ত মিডিওকার বাঙালি, আঁতেল প্রমাণান্তে, এট্টু গাঁয়ের ছোঁয়া পেলেই আহা উহু করতে করতে গায়ের ক্যামাফ্লোজখানা নালেঝোলে ভিজিয়ে ফেলেন; তাঁরা গালভরা নাম দেন 'ফোক', তাপ্পর ফোকি (রি নয়, সেটার সহমর্মী কোনভাবেই নন বলেই বাহুল্য) সেজে নববর্ষে পান্তা ইলিশ খান, মাঝেমাঝে মাটির দেওয়ালে সাজা রেঁস্তোরায় কচুভর্তা খেয়ে ভাবসমাধি যান। অতএব, এই পান্তাকে অ্যান্টিক্লাস স্ট্রাগলের মর্যাদা না বাঙালির নেকু স্মৃতিরোমন্থনের সোৎসাহ পৌষপার্বণ বলা হবে সে সিদ্ধান্তে আসতে তাঁরা গলদঘর্ম হচ্ছেন, বৈকি। ... ...
মনিপিসি কলেজের জন্য আজ বের হলো না। আর ঠাকুমার কাঁথাগুলোও কাঠের বাক্সে থেকে গেলো। একে তো হাটবার তার উপর মনিপিসির ব্রতের দিন। উনুনের আঁচ নিভলো না আজ। তবে উনুনে আমিষ ওঠার আগেই ঠাকুমা নিরামিষ পদ করে নিতে চায়। ব্রতশেষে লাল আটার রুটি দিয়ে মনিপিসি ঝিঙে বাসন্তী খাবে। ... ...
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বনগাঁয়, উদ্বাস্তু-শিবিরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কলেরার প্রাদুর্ভাব। স্যালাইনের জোগান যথেষ্ট না হওয়ায় মুত্যু-মিছিল। একসময় দেখা গেল, মোট আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৩০%। বনগাঁ উদ্বাস্তু-শিবিরে এইসময় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য পাঠানো হল ডা. দিলীপ মহলানবিশকে.... কলেরার জীবাণু দূষিত জল আর খাবার দিয়ে শরীরে ঢোকে আর বংশবৃদ্ধি করে এক বিষাক্ত রাসায়নিক তৈরি করে, যার প্রভাবে রোগী উদরাময়ে আক্রান্ত হয়। কলেরার জীবাণুর আবিষ্কারক জার্মান বিজ্ঞানী ডা রবার্ট কখ (১৮৪৩-১৯১০) পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন, এই পদার্থ আমাদের অন্ত্র থেকে শোষিত হয়ে রক্তে ছড়িয়ে পড়ে। ডা. শম্ভুনাথ দে অত্যন্ত সরল এক পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রমাণ করেন, কলেরার জীবাণু-নিঃসৃত বিষাক্ত পদার্থ জীবাণু-কোষের বাইরে চলে আসে এবং রোগের যাবতীয় লক্ষণ সৃষ্টি করে আমাদের ক্ষুদ্রান্ত্রের মধ্যে থেকেই.... আমার ক্ষোভের সীমা ছিল না, যখন ব্যক্তিগত আগ্রহে তাঁর অবদান সম্বন্ধে বইপত্র ঘাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, যে-শহরে আমার বাড়ি, সেই শহরেরই এক কোণে তিনি থাকতেন- দুই গেঁয়ো যোগীর গল্প .... ... ...
জীবন চলমান। কাদামাটির রাস্তা গিয়ে মেশে পিচে অ্যাসফল্টে। প্রকৃতির হাওয়া কেড়ে নেয় বিদ্যুতি বাতাস। তার মাঝেই উঁকিঝুঁকি দেয় জোনাকিরা। হাতছানি দিয়ে ডাকে গ্রামীণ স্বপ্ন। আন্তরিকতা আর সৌজন্যের তফাৎ বুঝতেই কেটে যায় অনেকটা সময়। কাদামাটি আর ইটপাথরের সংশ্লেষময় সময়ের বৃত্তান্ত। ... ...
বাদশা আকবর ফুফুর হাত দু’টো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন, “গল্প শুনতে এসেছি ফুফু হজরত।” ফুফু এবারে একটু দুষ্টু মিষ্টি হেসে বলে ওঠেন, “কেন রে? দরবার খানকে ছুটি দিয়েছিস নাকি? দরবার খান ছেড়ে শেষে আমাকে নিয়ে পড়লি কেন?” জালালুদ্দিন আকবর বললেন, “সে আলাদা আর আপনি আলাদা। সে আমাকে কোথায় কোথায় নিয়ে যায় আমি তার হদিশ রাখতে পারি না। উড়িয়ে নেয়, ভাসিয়ে নেয়। একরাশ রঙে সাঁতার কাটি। কখনো রক্তে টগবগে তুফান ছুটিয়ে দেয়। আমাকে খেপিয়ে দেয়, মাতিয়ে দেয়। কিন্তু কখনো মন চায় গাছের ছায়ায় বসতে, শান্ত হতে চায়। জিরোতে চায়, ঘরে ফিরতে চায়, পিদিমের আলোয় বসে থাকতে চায়। আপনি আমার সেই জিরেন, সেই ছায়া, ফুফু হজরত। তা ছাড়া দরবার তো বানিয়ে বানিয়ে গল্প শোনায় শুধু। আমাদের ঘরের কথা, বাবার কথা, দাদুর কথা – এসব আপনি ছাড়া আমাকে আর কে শোনাবে ফুফু হজরত?” ... ...
মণিশঙ্কর বিশ্বাসের কবিতা ... ...
স্বৈরাচারকে একটা নান্দনিক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন সঞ্জয়। সেই ব্যাটনই হাতে তুলে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। হিন্দু রাষ্ট্রকে নাগরিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ গড়ে তোলার জন্য যে নগর পরিকল্পনা তিনি করেছেন তার কাছে সঞ্জয় নেহাতই বামন। সঞ্জয় বড়জোর চাইতেন শহরটাকে নতুন করে দেওয়াল দিয়ে ঘিরতে। আর মোদির উচ্চাকাঙ্ক্ষা গোটা শহরটাকে নতুন করে গড়ার। যখন স্বাস্থ্য পরিষেবা না পেয়ে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন তখন মোদির ধ্যান-জ্ঞান সেন্ট্রাল প্রোজেক্ট। শোনা যাচ্ছে, এমন ভাবেই এই সেন্ট্রাল ভিস্তা তৈরি করা হবে যাতে রাষ্ট্রপতি ভবন সংসদ ভবন অন্যান্য প্রশাসনিক দফতরগুলো প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকেই দেখা যায়। এর থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যদি সুযোগ থাকত তাহলে গোটা দেশটাই নতুন করে গড়তে প্রধানমন্ত্রী। ইতিমধ্যেই আমরা দেখে ফেলেছি বেনারস ঘাটের 'সৌন্দর্যায়ন' বা আমেদাবাদের মোতেরা স্টেডিয়ামের নব নামকরণ। এগুলি সেই বৃহত্তর পরিকল্পনারই অংশবিশেষ। ... ...
নো বাজেট কি? – এই মহার্ঘ্য প্রশ্নটা বহুদিন ধরে জ্বালাচ্ছে। এটাকেই আগে শেষ করা যাক। এ বিষয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় মত বোধহয় এটাই যে কোন ছবিই আসলে নো-বাজেট হতে পারে না। কিন্তু যাঁরা এটা মনে করেন তাঁরা হয়তো মাথায় রাখেন না যে নো-এক্সপেন্স বলা হয়নি। এবার যাঁরা জীবনে কোনরকম কোনো প্রোজেক্ট বা প্রোডাকশনের সাথে যুক্ত থেকেছেন তাঁরা বলবেন যে বাজেট তো বাবা সব কিছুরই হয়, হ্যাঁ এটা হতে পারে যে তোমরা হিসাবটা করো না। তবু ইনভিসিবল হলেও সেটা তো আছেই। - ব্যাপারটা ঠিক ওরকম নয়, অন্তত ফিল্মের ক্ষেত্রে। প্রথমে বলে নেওয়া যাক যে নো-বাজেট ছবিকে জিরো বাজেট বা মাইক্রো বাজেটও বলা হয়ে থাকে। আমরা অবশ্য নো প্রেফিক্সটা বসানোরই পক্ষপাতী। এবার প্রশ্নটার উত্তর দুদিক থেকে দেওয়া যায়। প্রথমে সহজ উত্তরটা দিই। ধরা যাক, পটলবাবুর শখ বাগান করা, জবাদি মোবাইলের সদ্য বাজারে আসা সেট কিনতে পছন্দ করে, আবার আলুদা অফিসের বাচ্চা মেয়েদের সাথে উইকএন্ডে ডিনারে যায়; মানে হ্যাবিট থেকে হবি অবধি যে অঞ্চলটা মানুষের জীবনে, তার পিছনেও তো মানুষ টাকা খরচ করে। আর কে কোনখাতে কতটা খরচ করলো সেটা তার সামাজিক পরিচয়ও গড়ে দেয় কিছুটা মাত্রায়। চাঁপাবৌদি যেমন বাড়ি গেলেই নতুন ফ্রিজ, নতুন এসি দেখাতে শুরু করেন, এক্কেবারে প্রাইস ট্যাগ সহ, সেটাতেই তাঁর আনন্দ। ঠিক সেরকমই, আমি ছোটবেলায় ক্রিকেটারদের ছবি জমাতাম খাতায়, বন্ধুদের দেখাতাম বাড়ি এলে, বড় হয়ে সিনেমা বানিয়েছি। ব্যাপারটা পৃথিবীতে বেশিরভাগ লোকই যেহেতু করেনা তাই আমার বা আমাদের এই অদ্ভুত স্বভাব অনেকেই নজর করেছে। একটা পরিচয়ের মতো। বেঁচে থাকারও তো একটা খরচ আছে, নিঃশ্বাস নেওয়ারও। ইচ্ছা থাকলে সেই টাকাটাতেও ছবি বানানো যায়। নো-বাজেট ফিল্ম কিছুটা এরকমই। সারা পৃথিবীতেই। তবে এর বাইরে আরও কতগুলো ব্যাপার আছে। সেগুলোকে দ্বিতীয় তথা জটিল উত্তরটির অন্তর্গত করলাম। ... ...
সকালবেলা। জোরে জোরে দরজায় বেল বাজছে। আপনি দরজা খুললেন। খুলেই কিছু অফিসারদের দেখতে পেলেন: "আমরা ইডি। আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমাদের সাথে যেতে হবে। এক্ষুণি।" আপনি তাদের সাথে তাদের অফিসে পৌঁছালেন। আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়: "আপনি কি গত বছর আপনার একটা প্লট গুপ্তজিকে বিক্রি করেছিলেন?" আপনি বললেন: "হ্যাঁ, আমার নিজস্ব প্লট ছিল, কোনো বিতর্কিত সম্পত্তি ছিল না। দু নম্বরি করে বিক্রি করিনি, কোনো কালো মামলাও নেই। সঠিক পন্থায় নথিভুক্ত, সাক্ষী, সমস্ত প্রমাণও আছে আমার কছে।" তারা আপনার প্রমাণের প্রতি একটুও আগ্রহী নয়: "আপনি কি জানেন যে গুপ্তা, যার কাছে আপনি প্লট বিক্রি করেছেন, ব্যবসায় কারচুপি করার জন্য তার বিরুদ্ধে ৪২০ র মামলা আছে?" আপনি মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন: "দেখো ভাই, আমি তার কাছে প্লট বিক্রি করেছি, কন্যাদান করিনি। সম্পত্তির এজেন্ট চুক্তিটা করেছে। পেমেন্ট চেকের মাধ্যমে এসেছে। তার সাথে, তার পরিবার বা ব্যবসার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। মাস কয়েক আগে আমি খবরের কাগজে পড়লাম যে তার বিরুদ্ধে কিছু ফর্ম রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। কিন্তু সেসব তো আমাদের চুক্তির পরে ঘটেছে।" আপনি মনে করলেন,যে ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়েছে। বিষয়টা মিটে গেছে। কিন্তু তখনই আপনার মাথায় পাহাড় ভেঙে পড়বে: "মনে হচ্ছে আপনি PMLA (প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট) আইনটার ব্যাপারে কিছু জানেন না। আপনি এই আইনের অধীনে একজন অপরাধী। কারণ অপরাধের আয় আপনার পকেটে পৌঁছেছে। কাজেই আপনিও একজন অপরাধী। এই অপরাধের দরুন আমরা আপনাকে গ্রেপ্তার করছি!" ... ...
রসগ্রাহী পাঠকমাত্রেই জানেন, ঐতিহাসিক উপন্যাসকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে গেলে, তথ্যের খুঁটিনাটি ও সত্যতা-সম্পর্কে লেখককে কতখানি নিষ্ঠাবান হতে হয়। আমি আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে যতটুকু বুঝি, রাজর্ষি এই কাজে সম্পূর্ণ সফল। সপ্তদশ শতকের বাংলা, বিশেষ করে, সমতটের বাকলা-বাখরগঞ্জ থেকে, সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রাম হয়ে, আরাকান বা রাখান-দেশ অবধি বিস্তৃত ভূখণ্ডের ভুগোল ও ইতিহাস, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে এই উপন্যাসে। শুধু তা-ই নয়, সামাজিক আচার-ব্যবহার, খাদ্যাভ্যাস, বাচনভঙ্গী, এমনকী নৌবিদ্যার খুঁটিনাটি বর্ণনাতেও, লেখকের মনোযোগ ও যত্নের ছাপ সুস্পষ্ট। অথচ, তথ্যের এমত প্রাচুর্য কখনও বাহুল্য হয়ে ওঠেনি। বরং, পটভূমির বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে, গল্পের চরিত্রগুলিকেও আরো বেশি রক্তমাংসের বলে মনে হয়েছে। ... ...
দেশভাগ বিষয়টি কোনো রাতারাতি ঘটে যাওয়া আকস্মিক ঘটনা নয়, অনেকদিন ধরেই একটু একটু করে তার প্রেক্ষিত তৈরি করা হয়েছিল – ঠিক সেইরকমই, সেই সময়ের ভারতীয় শিল্পীদের কাজে তার যে প্রতিফলন রয়েছে তাও ঠিক একদিনের ঘটনা নয়। .... আশ্চর্যের ব্যাপার হল, বাংলার নাটক, সাহিত্য, ফটোগ্রাফি এবং চলচ্চিত্রের মধ্যে দেশভাগের বিষয়টির যে জোরালো উপস্থিতি, তা কিন্তু চিত্রকরদের কাজের মধ্যে নেই। দেশ ভাগ হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ বাস্তু হারিয়ে শেষ সম্বল নিয়ে এপার বাংলায় চলে আসছে – এমন দৃশ্য আমরা সমকালীন ফোটোগ্রাফ এবং কিছু পরে নির্মিত চলচ্চিত্রে দেখতে পেলেও খুব কম শিল্পীই এই বিষয় নিয়ে সরাসরি ছবি এঁকেছেন। চিত্রকলা এমনই এক দৃশ্যভাষা, যেখানে কেবলমাত্র চোখে দেখা দৃশ্যের একটা চটজলদি ডকুমেন্টেশন করে দিলেই চলে না, শিল্পীর নিজস্ব ভাবনা, মনন এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্লেষণ কাজের অঙ্গ হয়ে যায়। চলচ্চিত্রের মত ন্যারেটিভ মিডিয়াম নয় বলেই, চিত্রকলার ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া বেশ জটিল এবং যথেষ্ট ম্যাচিওরিটি দাবি করে। ফলে চিত্রকরদের কাজে আমরা দেশভাগ যতটা পেয়েছি, তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছি তার রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের অনুসন্ধান। .... ... ...
আগেই বলেছি মানবীর সংখ্যা লোক আদালতে নগণ্য। পিতৃতান্ত্রিকতা,অবরোধ, অশিক্ষা, গার্হস্থ্য হিংসার বাধা টপকে বাইরের পৃথিবীটা দেখা এখনো শহরের চৌহদ্দির বাইরে গ্রামেগঞ্জের বেশিরভাগ মেয়েদের কাছে স্বপ্ন। লড়াই করতে শিখবে কি ! নিজের ব্যবসা তো দূরস্থান। তাই হঠাৎ কাউকে তেমন দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যেমন গেল এবারে। আর কাকতালীয়ভাবে সেদিনটা ছিল ৮ই মার্চ। ... ...
ইদানীং সুপ্রিম কোর্টের একটি বক্তব্য নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত নাকি পুলিশ প্রশাসনকে বলেছে ভারতে যৌনকর্মীদের সঙ্গে সম্মান দিয়ে কথা বলতে, মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার করতে, কথায় কথায় ওদের টানা হ্যাঁচড়া করে অপদস্থ না করতে। ওরা একটি পেশায় রয়েছে, কোন অপরাধ তো করেনি। আর নিজের পছন্দমত জীবিকা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আমাদের সংবিধানে স্বীকৃত। তাহলে? ... ...
আমাদের চারদিকে সারাক্ষণ খড়মড়ে মত বাস্তব ছড়িয়ে আছে। কাগজে, রুপোলী বা সোনালী পর্দাতেও। আমি তাদের সাথে কথা বলি। অন্য সবার মত। কথা বলি, হাঁটি একসাথে কিছুটা, কখনো কখনো তাদের বাড়ি লৌকিকতা করতে যাই। কিন্তু ওদের আমি ভালোবাসিনা। কঠোর বাস্তব, তাকে আমি ভালোবাসিনা। সমাজের খাতায় আমার অনেক রকম নাম লেখা আছে। বোকা, ভিতু, ক্যাবলা, অসুস্থ মস্তিষ্ক, এইসব। তবু আমি ঐ তাদের ভালোবাসি। কোমল অবাস্তব গল্পদের। রূপকথা, উপকথা, লোককথা, পুরাণ। তাতেও খড়মড়ে আছে, ধারালো, ছুঁচলো, টগবগে গরম, এসব আছে। তবু কেমন যেন মনে হয় জলের ভেতর দিয়ে শোনা শব্দের মত হয়ে যায় ওরা। নরম, ফিসফিসে। আমার মনে হয়। আমি অবাস্তব গল্পদের ভালোবাসি। রূপকথাদের । ... ...
কড়ে আঙুলে গুনে গেঁথে রাখি কয়টা পুজো দেখলাম। স্কুলে সব্বাই জিগ্যেস করবে তো "কটা ঠাকুর দেখলি রে"? অথচ, কোনোবারই সংখ্যা দশ ছাড়ায় না। অথচ, অন্যেরা কত কত ঠাকুর দেখে। চারদিনই দেখে। কলকাতায় থাকতাম সময়ে তো একদিন বাবা নিয়ে বেরোত। তাও প্রায় দিনেদিনেই। সন্ধ্যের পর থেকে তো বাবা যাবে 'বনফুলে'। বিজয়ার দিন বাবা নিয়ে যেত আউট্রাম ঘাটে, আর অল্প একটু অন্ধকার হতেই ফেরত। সেখানেও মাত্র ২-৩ টে ঠাকুরই দেখা হত। অত তাড়াতাড়ি শুধু বাড়ীর ঠাকুরই দুই একখান আসে তো। ... ...
শ্রেণি বিভাজনে আজ যদি প্রলেতারিয়েত, লুম্পেন-প্রলেতারিয়েত, লুম্পেন-বুর্জোয়া, বুর্জোয়া, পেটি-বুর্জোয়া ইত্যাদি বলা হয় তাহলে মানুষ যার পর নাই বিরক্ত হবেন। আবার সেইসব বস্তাপচা বিশেষণ! এসব বিংশ-শতাব্দীর ব্যাপার, একবিংশ শতাব্দীতে এইসব চলে না। একবিংশ শতাব্দী হল উত্তরাধুনিকতার যুগ এবং উত্তরাধুনিকতা বামপন্থা বা মার্কসবাদকে আধিপত্যকামী বা হেজিমনিক মনে করে ও বিরোধিতা করে। ব্যাপার যে এখন আরও অনেক জটিল এবং উক্ত বিশেষণগুলি যে এখন আর এদের সম্যক পরিচয় বহন করে না জগার মত সিন্ডিকেট-বস বা বিউটি (দেশান্তরিত ও অত:পর স্বামী কর্তৃক বিক্রিত), মালাদের মত একবিংশ শতাব্দীর শহুরে যৌনকর্মীদের দেখলে অবশ্যই বোঝা যায়। সত্য বিউটিদের সঙ্গে জগা গণেশ এবং চাঁদু সোমাদের সঙ্গে সুধাময়দের পরিবার - দুটি আলাদা উলম্বে স্থাপিত। ... ...
সুভাষ মুখোপাধ্যায়। জীবনের অন্তিম পর্বের একগুচ্ছ কবিতা। তবু এর পাঠে কদাচ বোধ হয় না এ কোনো অশীতিপরের রচনা। বরং যেন এক পথ-ভোলা পর্যটক, জগতের অসংতিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুতা পাতিয়ে ফেলেছেন নীরবে। এবং তারই মধ্যে সম্পৃক্ত তাঁর কবিতার অতি-পরিচিত রাজনৈতিক দর্শন, শ্লেষ, ব্যঙ্গ, রসিকতা, ব্ল্যাক হিউমর, এসমস্ত কিছুই। পড়লেন হিন্দোল ভট্টাচার্য। ... ...
বাড়িতে অনেকে কানাঘুষো করলেও আমার খুব ভাল লেগেছিল যখন জানতে পারলাম বিয়ের পর দিদি-জামাইবাবু এই বাড়িতেই থাকবে। আমার কাছে তো এটা মেঘ না চাইতেই জল ছিল। এক তো দিদি বাড়িতেই থাকবে আর উপরি হিসেবে ডাক্তার জামাইবাবু। বিজ্ঞানে লবডঙ্কা এই শালিকে কি দয়া করে একটু পড়া দেখিয়ে দেবে না? যখনই সময় পেতাম ঘুরঘুর করতাম নতুন দম্পতির আশেপাশে। জামাইবাবুও আমাকে খুব পছন্দ করে। দোকানে নিয়ে যায়, পড়া দেখিয়ে দেয়, কত গল্প বলে। আর কত কত গল্পের বই আছে জামাইবাবুর কাছে। এর মধ্যে এসে যায় অন্যরকম একটা দিন। দুপুরবেলা দিদি-মা-জ্যেঠিমারা বাইরে যেতে ডাক পড়ে আমার নতুন জামাইবাবুর ঘরে। আমি লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যাই। ... ...