দু বছর আগে গুরুচণ্ডালির পাতায় কিশোর ঘোষালের আগমন নয় আবির্ভাব হলো। এক বিদ্যুৎচমক। ক্রমশ তিনি আমার হাতে ধরে নিয়ে গেলেন, বর্তমানের আলোয় অতীতকে চেনালেন। সলতে না পাকালে সাঁঝবাতি জ্বলে না। তিনি সেই সলতে পাকানোর পর্বটি দেখালেন সযত্নে। আমার পৃথিবীকে চেনার জানার যে বিশাল ফাঁক ছিল, সেটিকে তিনি অবহিত করালেন, প্রতিটি লেখা পড়ে ভেবেছি – এতো দিন কোথায় ছিলেন? ... ...
অরুন্ধতী নির্লিপ্ত ভাবে সাজিয়েছেন দশটি গল্প। মেয়েদের গল্প বলব নাকি জীবনের গল্প বলব সে প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি এখনো। তবে সব কটি গল্পেই মেয়েরা তীব্র রকমের আছেন। খুব মোলায়েম ভাবে বলা, নিখুঁত ডিটেইলিং ওলা জীবন্ত দশটি গল্প। প্রতিটা গল্পেরই উপজীব্য জীবনের জটিল অন্ধকার এক একটা দিক । আর প্রায় প্রতিটা গল্প অব্যর্থসন্ধানী তীরন্দাজ। ... ...
প্রতিভা সরকার গল্প উপন্যাস লেখেন পাঠককে ভুলিয়েভালিয়ে মোহাবিষ্ট করে রাখতে নয়। চরিত্রগত ভাবে একজন পরিবেশ-কর্মী, মানবতাবাদী, নারীবাদী সংবেদনশীল লেখিকা হিসেবে পাঠককে ভাবিয়ে তোলাই প্রতিভার ‘হিডন এজেন্ডা’। সমাজের সমস্ত স্তরে জমাট বাঁধা অন্যায়ের বিরুদ্ধে পাঠক-সমাজকে মনে মনে আন্দোলনের ভাগীদার করে তোলাই প্রতিভার উদ্দেশ্য। ‘রসিকার ছেলে’ উপন্যাসে প্রতিভা সে ব্যাপারে সফল। ‘রসিকার ছেলে’ উপন্যাসটি দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ করা হলে সমাজবিজ্ঞানের কিছু উপকার হতে পারত। জাত-পাতের রাজনীতির বিরুদ্ধে জন-জাগরণে মৃদু তরঙ্গ উঠলেও উঠতে পারত। বইটির ইংরেজি অনুবাদ করবেন, প্রকাশ করবেন, বৃহত্তর আঙিনায় পাঠকের হাতে তুলে দেবেন – এমন প্রকাশনা সংস্থা কবে উদ্যোগ নেবে জানা নেই। এনবিটি বা সাহিত্য অকাদেমী কি এগিয়ে আসবে? ... ...
নিউ ইয়র্কে বলে, ইউ ক্যান টেক দি গার্ল আউট অফ ব্রনক্স বাট ইউ ক্যান নট টেক দি ব্রনক্স আউট অফ দি গার্ল। ভারমুক্ত আমি চলে এসেছি অনেক দূরে ইংল্যান্ডের সারেতে কিন্তু কুণালের লেখা মনে করিয়ে দিল, ‘ইউ ক্যান নট টেক বরানগর আউট অফ মি’। কুণাল আমার চেয়ে অনেক ছোটো হবেন, কিন্তু তিনি আর আমি দেখেছি এক আশ্চর্য উত্তাল সময়কে –দিকে দিকে ছড়ানো লাল আগুনের উত্তাল কলকাতা একাত্তর, সেখানে তিনি অর্থনীতি পড়ছেন, অমর্ত্য সেনের পভার্টি অ্যান্ড ফেমিনের কথা বলছেন আর তুষার রায়! রতন বাবু রোডের, আমাদের তুষারদার ব্যান্ডমাষ্টার অঙ্ক কষছেন ম্যাজিক লুকিয়ে চক এবং ডাস্টার। ... ...
তবে বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দানীর উৎসে পাশ্চাত্যের ঋণ থাকলেও এ কথা মানতেই হবে, পিতৃতান্ত্রিক অপরাধ-সাহিত্যপরিসরে গোয়েন্দা হিসেবে নারীদের উঠে আসা একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল। আর এই উত্থান যে ধূমকেতুর মতো সহসা দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাওয়ার মতো নয়, সে কথাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল তার পরবর্তী দুই দশকেই। তাই কৃষ্ণা-শিখার মতো অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় মাতোয়ারা সম্পন্ন তরুণী কিংবা বিন্দিপিসি-সদুঠাকুমার মতো ঘরোয়া বয়স্কা মহিলা নন, ক্রমশ এই দুনিয়ায় আসর জাঁকিয়ে বসতে শুরু করলেন সেই মেয়েরা, যাঁরা পেশাগতভাবেই গোয়েন্দাগিরি বা অন্য কোনও বৃত্তিকে অবলম্বন করেছেন। অজিতকৃষ্ণ বসুর ডিটেকটিভ নন্দিনী সোম সায়েন্স কলেজ থেকে এক্সপেরিমেন্টাল সাইকোলজির স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানাধিকারিণী। ... ...
ইতিহাসের বিশেষ সন্ধিক্ষণ ইতিহাসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে পরখ করার সৌভাগ্য হয় ক’জনের! বৃত্তের বাইরে থেকে নয়, একেবারে কেন্দ্রে থেকে পটপরিবর্তনের সাক্ষী থাকা এবং তাকে লিপিবদ্ধ করা গল্প বলার ছলে, এ নিতান্ত সহজ কাজ নয়। পাঠ্যবইয়ের ‘ইতিহাস’-এর বাইরে বেরিয়ে যে ভাবে ঐতিহাসিক ঘটনা লেখক নিজে পরখ করেছেন, তার অভিঘাত যা নিজে চোখে দেখেছেন এবং বিশ্লেষণী মন নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন, তা এই বইটিকে নিছক ভ্রমণ কাহিনী বা আত্মজৈবনিক অন্য কোনও রচনার থেকে পৃথক করেছে। এখানেই হীরেন সিংহ রায়ের পূর্ব ইউরোপের ডায়েরি স্বতন্ত্র। গুরুচণ্ডালী-তে যে লেখা ইতিপূর্বে ধারাবাহিক হিসাবে প্রকাশিত হত, তা-ই এ বার দু’মলাটের মধ্যে। ... ...
গাছের যে অংশ থাকে মাটির ওপরে তাই আমরা দেখি। অর্থাৎ কাণ্ড , শাখা, ডালপালা আর পাতা - ফুল - ফল। আর যা থাকে মাটির নীচে, সেটা অদৃশ্যগোচরই রয়ে যায়। যেমন, শিকড়। শিকড় সন্ধান করতে লাগে.... খুঁজলে পাওয়া যায়। আর না খুঁজলে, বিস্মৃতির অতলে। আমাদের আদত যাপন চিত্রের এক অনুপুঙ্খ ধারা - বিবরণ হিসেবে নয়, ধারণ করে রাখে যে সব পাতা, সে সব পাতাগুলো এক জায়গায় জড়ো করলে হয় ইতিহাস। ইমানুল হকের লেখা 'কাদামাটির হাফলাইফ' সে অর্থে ইতিহাস। ... ...
“আকণ্ঠ কুয়োয় ডুবে আছে যে মানুষ সে জানে তার আকাশ বৃত্তাকার। তাকে দিগন্তরেখার লোভ দেখিও না।” পড়ে খটকা লাগলো যে আমার আকাশও কি বৃত্তাকার দেখছি বহুদিন? যে চিন্তা এতদিন টনক নড়ায় নি! স্মৃতি হাতড়ে মনে করার চেষ্টা করি আকাশের অন্য কোন আকার দেখেছিলাম কি না! কিন্তু এই স্মৃতিও খুব সহজে মনে পড়ার নয়। এ গত জন্মের আচ্ছন্নতা নিয়ে ইহজন্মে মাতৃ-জঠরে ভাসমান থাকার স্মৃতি। যা স্মৃতি আর বিস্মৃতির মাঝের গোধূলি! যা হৃদয়েরও যে একটি মস্তিষ্ক আছে, হৃদয় যার খোঁজ রাখে না, তাকে মনে করিয়ে দেয়। ... ...
বয়স্ক জার্মান ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, আমিই সেই জার্মান সৈনিক। ডেভিড সেটা বুঝলেন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। উনচল্লিশ বছর আগে ইলিনয়ের ডেভিড দে ফ্রিস অস্ত্র হাতে জার্মানির হেসেনের এক পরাস্ত জার্মানের মুখোমুখি হয়েছিলেন। চারদিকে যখন খুন কা বদলা খুন হচ্ছে, সেখানে অস্ত্রহীন জার্মানকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন তার ওপরওয়ালার অফিসে। তার পরিচয়পত্র নাম ইত্যাদি নথিবদ্ধ করে, তাকে যুদ্ধবন্দির সম্মান দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধের শেষে বিজেতারা ফিরেছেন শিকাগো ইলিনয়, আর বিজিত ফিরেছেন হেসেন, জার্মানি। জার্মান ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন প্রথমে। ডেভিডও ততক্ষণে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়েছেন। চার দশক আগের দুই শত্রু। একে অপরকে আলিঙ্গন করলেন। ... ...
'কাদামাটির হাফলাইফ' -- একটি অনন্যসাধারণ রচনা। অনন্যতা নামকরণে। হৃদয়ে বিরাজ করা ভাবনা নির্বাচনে। অনবদ্য জীবনকথা উচ্চারণে। বৈঠকি মেজাজে সত্যোচ্চারণ করার অভূতপূর্ব ভঙ্গিমায়। ১১৬ পর্বে বিন্যস্ত জীবনে জীবন যোগ করার অবিস্মরণীয় সাহিত্যকর্ম 'কাদামাটির হাফলাইফ' সাহিত্যকর্ম তো বটেই, অন্তত আমার নিবিড় পাঠ অনুভবে। বইটির প্রতিপাদ্য বিষয়ের সঙ্গে ষোলআনা একাত্মতায়। আমরা জানি কোনো প্রচারধর্মী, রাজনৈতিক, সামাজিক বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থেকে জাত হতেই পারে না প্রকৃত সাহিত্য। ভাবে ভাষায় ও রূপে তার নির্মাণ এক 'হয়ে ওঠার' বৃত্তান্ত। মার্কিন কবি আর্চিবল্ড ম্যাকলিশের কথায় : " A poem Should not mean / But be." ইমানুল হকের 'কাদামাটির হাফলাইফ' ঠিক তেমনই গ্রামবাংলার নির্ভেজাল ও 'কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা'-র সার্থক সাহিত্যরূপ। ... ...
খুবই গোলমেলে অ্যাসাইনমেন্ট। ‘আমার জার্মানি’ বইটার রিভিউ করতে বসেছি। গোদা বাংলায় পুনর্বার দেখা (Review) কি দেখব, কোনখান থেকে দেখব। শুধু জার্মানি হলে কথা ছিল। স্টেট ব্যাঙ্কের চাকরি ১৯৭২ সালে। জলপাইগুড়ি বহরমপুর শ্যামবাজার ব্রাঞ্চে কাজ শেখা। তিন বছর বাদে দু-বছরের জন্য জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট অফিসে বদলি। ফ্রাঙ্কফুটের প্রথমদিন একটি অসামান্য অবদান। পুরো লেখাটার মধ্যে ছড়িয়ে আছে রসিকতার মণিমুক্ত। যে লেখক নিজের দুঃখ নিয়ে নির্মল রসিকতা করতে পারে তার লেখনি কোন মার্গে উঠতে পারে এই অধম রিভিউ রাইটার তা কল্পনাও করতে পারেননি। আসার সময় হাতে ছিল ১২৫ ডলার তার মধ্যে ৫৫ ডলার নিজের সুটকেসের লাইনিংয়ের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন। হাতে পেনসিলের মতো করে ধরা ছিল ৭০ ডলার। হীরেন পৌঁছে গেলেন ফ্রাঙ্কফুর্টে কিন্তু সুটকেস পৌঁছলো না। নিজের অসহায় অবস্থার বিবরণে যে স্যাটায়ার লুকিয়ে আছে, তা এককথায় নান্দনিক। ... ...
সংকলনটি দেশভাগের অব্যবহিত পরবর্তীকালে জন্ম নেওয়া ছিন্নমূল প্রজন্মের নতুন দেশে বেড়ে ওঠার নতুন জনপদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এক জরুরী প্রয়াস। বইয়ের প্রচ্ছদে যেন দেখি - কালো বাংলা অক্ষরমালারা কাছাকাছি আসতে আসতে ধেবড়ে গেছে, তাদের গা বেয়ে গড়াচ্ছে রক্তের দাগ, সেই রক্ত আবার কালচে জমাট বেঁধে জন্ম নিয়েছে মানুষদের আবছা অবয়ব। বইয়ের ভূমিকাতেও সোমনাথ রায়ের মনে পড়েছে তার কলকাতার বাড়ির পাশের খলিসাকোটা কলোনির মানুষদের কথা, যারা বরিশালের খলিসাকোটা গ্রাম থেকে চলে এলেও নিজেদের গণস্মৃতি এবং গণশোক ছিন্ন হতে দেননি এবং কলোনির নামের মধ্যে দিয়ে নিজেদের গ্রামকে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। ... ...
দীর্ঘদিন আমরা ইংরেজদের দাসত্বে থাকলেও, আমাদের বাল্যে বিলেত অর্থাৎ ইংল্যাণ্ড সম্বন্ধে বেশ সমীহ জাগানো একটা ধারণা তৈরি করেছিলেন, আমাদের বিলেত-ফেরত ডাক্তার ও ব্যারিষ্টাররা। তাছাড়া ইউরোপের যে কটি দেশ সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল ছিল, সেগুলি হল, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানি, স্পেন, গ্রীস ইত্যাদি। আরও কিছু দেশ যেমন, পোল্যাণ্ড, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়াকে চিনতাম সে দেশের ডাকটিকিট সংগ্রহের সুবাদে। এখনও মনে আছে, পোল্যাণ্ড, হাঙ্গেরি এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার স্ট্যাম্পগুলি, ইংল্যাণ্ডের “মহারাণি” মার্কা একঘেয়ে স্ট্যাম্পগুলির তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং চিত্তাকর্ষক ছিল। আরেকটা দেশের নামও মনে আছে - “নিশীথ সূর্যের দেশ” নরওয়ে! আলোচ্য গ্রন্থদুটি পড়া শেষ করে মনে হল, লেখকের হাত ধরে ইউরোপের ওই অচেনা-অজানা-অস্পষ্ট দেশগুলি থেকে এইমাত্র যেন ঘুরে এলাম। ... ...
এ'লেখাটি কোনও 'ম্যানিফেস্টো' নয় জানবেন। এটি একটি শোকে ভেজা ছেঁড়া তমসুক মাত্র। প্রলাপ। আগুন, সে আর যথেষ্ট কই ধরাবার? এখন তো প্রিয় সব শবদেহ'ই অর্ধদগ্ধ! ... ...
কোভিড, বিধ্বংসী ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বইপাড়ার বিবরণ ‘মার্কো পোলোর ভ্রমণ বৃত্তান্ত ২০২০’ আখ্যানে এসেছিল। বাঙালি যত আধুনিক হল, যত অর্থবান হল, বিনোদনের নানা উপকরণ পেতেই বই ত্যাগ করল। মধ্যবিত্ত, সংস্কৃতিপ্রবণ মানুষ কেউ কেউ বইকে আঁকড়েই বাঁচতে চাইল, স্বপ্ন দেখল। বাড়ি গাড়ি ভোগবাদের আতিশয্য বিসর্জন দিয়ে কেউ বাইরে মত্ত হল। ভোগবাদে ভেসে যাওয়া, ক্ষমতার অন্দরমহলে থাকা মানুষ বইকে অবহেলা করতে শুরু করল। বিমলের প্রতি অখিলের মনোভাবের মধ্য দিয়ে লেখক কালের ধ্রুব সত্যের তরঙ্গমালা এঁকে চলেন। ... ...
গল্প শেষ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভিলমন্ত শুধুমাত্র পাস্তারনাকের কথা শুনেছিলেন। স্তালিনের কথাগুলো তাঁর বন্ধু তখনই নিজে তাঁকে বলেছিলেন। লাইনটা কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাস্তারনাক আবার ফোন করার চেষ্টা করেন। তিনি জানাতে চেয়েছিলেন যে মান্দেলস্তাম সত্যিই তাঁর বন্ধু নন, এমনটা নয় যে তিনি ভয় পেয়ে তাঁর সাথে বন্ধুত্ব অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বৃথাই চেষ্টা, ফোন ডেড! ... ...
১৯০২ এর সেপ্টেম্বরে, মৃত্যুর মাস তিনেক আগে, কাশ্মীরে থাকাকালীন,কর্নেল জেমস টডের ‘অ্যানালস অ্যান্ড অ্যানটিকুইটিস অফ রাজস্থান’ বইটি দেখে সহচরদের বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “বাঙলার আধুনিক জাতীয় ভাবসমূহের দুই তৃতীয়াংশ এই বইখানি হইতে গৃহীত।” ভুল কিছু বলেননি। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে জ্যোতি-রবি-অবন ঠাকুর, কার কল্পনাকেই-বা প্রভাবিত করেনি টডের বই-এর মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে রাজপুত পৌরুষ ও নারী সতীত্বের আপোষহীন লড়াইয়ের চিত্র? ‘কেতুনপুরে বকুল-বাগানে/কেসর খাঁয়ের খেলা হল সারা।/যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল/সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা’ পড়েছি রবীন্দ্রনাথের ‘হোরিখেলা’ কবিতায়। “বিধর্মী শত্রু সোনার মন্দির চূর্ণ করে বল্লভীপুর ছারখার করে চলে গেল,” পড়েছি অবন ঠাকুরের রাজকাহিনীতে। ... ...
এঁরা কোন সবজান্তা একপক্ষীয় আলোচনা না করে সমস্যার উপর বহুকৌণিক আলো ফেলেছেন। দেখিয়েছেন সমস্ত হাতে গরম সমাধানের সীমাবদ্ধতা। অথচ সবগুলোই প্রাসঙ্গিক। জমির মালিকানার একচেটিয়া অধিকারের ভিত্তিতে সামন্ততান্ত্রিক শোষণ যেমন কৃষির উন্নতির বাধা, কিন্তু আজকে তার চেয়ে বড় বাধা ভারতের কৃষকসমাজের ছোট এবং প্রান্তিক চাষিদের (ভারতে গড় ৮০% এবং বাংলায় ৯০%) জন্য সরকারি ব্যাংকের সেকেলে আইন এবং গরীবকে তাচ্ছিল্য করার সংস্কৃতি; যার ফলে ওদের জন্যে সুলভ সার, বীজ, এবং ট্রাক্টর বা হাল বলদের জন্য ঋণ পাওয়ার দরজা বন্ধ হয়ে থাকে। ... ...
আফ্রিকার সঙ্গে আমার কাব্যিক পরিচয়, আমার চেতনার ঊষাকালে। কোন কোন রোববার, রবি ঠাকুরের সঞ্চয়িতা খুলে আমার পিতৃদেব আমাদের কিছু কিছু কবিতা পাঠ করে শোনাতেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল “আফ্রিকা”। মা বলতেন, “ওইটুকু ছেলে এই কবিতার মর্ম কী বুঝবে?” বাবা বলতেন, “মর্ম এখন নাই বা বুঝল। এই অমোঘ শব্দ-চয়ন, অন্ত্যমিলহীন ছন্দের এমন ঝংকার, বিষয়ের ব্যাপ্তি, নিষ্ঠুর সভ্যতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও এমন মানবিক আবেগ। এগুলোই আপাততঃ ওর মনে বসত করুক না - মর্ম উদ্ধারের সময় তো পড়েই রইল আজীবন”। আমার প্রতি তাঁদের উভয়ের বিবেচনায় এতটুকু ফাঁকি ছিল না। আর বড়ো বিলম্ব হলেও, ওই কবিতার মর্মোদ্ধার হল, হীরেন সিংহরায় মহাশয়ের “আমার আফ্রিকা” গ্রন্থটি পড়ে। ... ...
জীবনের অন্ধকারমালাই সুবিমলের পাঠক্রম। খুন, জখম, সন্ত্রাস, ধর্মীয় বিভেদ, বিস্ফোরণ, পুলিশি অত্যাচার অন্যদিকে যৌনতার নন্দনকানন। যৌন মিলনের যে পরম তৃপ্তি তা নারী-পুরুষ উভয়ই ভোগ করে কিন্তু পরক্ষণেই জাগে সামাজিক গ্লানি। এই দ্বন্দ্বই সুবিমলের টার্নিং পয়েন্ট। কেন জাগে পাপবোধ? কেন দঃশিত হয় নরনারীর সামাজিক বোধ, কেন স্বীকার করে না পরকীয়া? কেন মেনে নেয় না জীবনের স্বাভাবিক দাবিকে। এই যে সেক্স করা ও তাকে সামাজিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃতি না দেওয়া এই আলো অন্ধকার নিয়ে তিনি আখ্যানের ভেলা ভাসান। এমনকি তিনি মারাত্মক ভাবে চেতনার গান বাজান। তা বিপ্লব হোক বা মধ্যবিত্ত বিবেক হোক। চেতনা না থাকলে নতুন জোয়ার সম্ভব নয় তা কেবল আয়োজন সর্বস্ব। অথচ আজ আয়োজন সর্বস্ব পরিমণ্ডলের রমরমা। উৎসবের ফানুস উড়িয়ে চেতনাহীনতার মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টির যে ডাক তা যে যথার্থই ভিত্তিহীন তা তিনি প্রয়োগ করে দেখান। সমাজের বিবিধ স্তরের বয়সের নারীর দৈহিক চাহিদাকে সামনে রেখে নারী মনস্তত্ত্বের নিপুণ বিশ্লেষণে অবতীর্ণ হন। এত বড় সমাজ, এত বড় পরিমণ্ডল, এত শ্রেণি, বয়স বিভাজনে সকলেরই কম বেশি যৌনতা আছে। তার নানা রকমফের প্রক্রিয়া, চাহিদা, সম্পর্ক। বেশিরভাগই আড়ালে আবডালে। বিভাজনোত্তর সমাজে নারী পুরুষ পারিবারিক সম্পর্ককে অস্বীকার করে আড়ালে মিলিত হয়েছে। কোথাও ক্লেদ নেই, গ্লানি নেই। আছে এক তৃপ্তির আনন্দ। তার বহুবিধ বয়ান নিয়ে এই আখ্যান। ভাষা আগ্রাসন থেকে জাতি খণ্ডীকরণ, বাঙালির হুজুকে প্রবণতা থেকে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের শূন্য অবয়ব কোন কিছুই নজর এড়িয়ে যায় না। জগাখিচুরি হিন্দি, ইংরেজি মিডিয়াম, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির আদ্যশ্রাদ্ধ, পক্ষ-বিপক্ষে কোন্দল, সংস্কৃতির নষ্টচরিত্র, আধিপত্যবাদের সংস্কৃতি মিলিয়ে দিনের আলোর পরিমণ্ডলের উপর সুবিমল বুলডোজার চালান নিজস্ব ভঙ্গিতে। ... ...