আশেপাশের সব জায়গার থেকে প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু। মাগালা কেপের থেকে উত্তর দিকে, দুটো পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে হ্রদের জল বয়ে যাচ্ছে। এই পর্বতশ্রেণি দুটো আমাদের অবস্থানের প্রায় ত্রিশ মাইল উত্তরের একটি বিন্দুতে এসে মিলেছে। মাগালার রুন্ডিরা খুবই সভ্য ভব্য। অবশ্য নিষ্পলক হাঁ করে তাকিয়ে থাকতেও এদের জুড়ি নেই। তাঁবুর দরজার কাছে ভিড় করে এরা আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল, যেন আমরা অতীব কৌতূহলের বস্তু, আর ঝপ করে উবেও যেতে পারি। ... ...
সমুদ্রসৈকতের কাছাকাছি বেশ কটা গ্রাম রয়েছে। সমুদ্রের তীরে লোকের ভিড় দেখলে জায়গাটা কত জনবহুল তা বোঝা যায়। কিসুনওয়ে ও মুরেম্বওয়ে নামের অন্তরীপ দুটোর মাঝামাঝি বিকারি নামের একটা জায়গা আছে - আসলে বেশ কটা গ্রামের সমষ্টি। সেখানকার এক মুটওয়ারের আবার ভারি নজরানার উপর লোভ। বদবুদ্ধিওলা কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে দর কষাকষি করতে পারব না। তাই জিজিদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল না এমন গ্রামগুলো এড়িয়ে চলছিলাম। কিন্তু আমাদের জিজি পথপ্রদর্শকও পথ ভুল করল আর একাধিকবার আমাদের এইসব বিপজ্জনক জায়গাতে নিয়ে গিয়ে হাজির করেছিল। ... ...
পঞ্চম দিনের ভোরে ন্যাবিগ্মা দ্বীপের আশ্রয় ছেড়ে আমরা বেরলাম। এক ঘণ্টারও কম সময়ে কেপ কিতুন্ডাতে পৌঁছলাম। এই অন্তরীপটি স্তূপাকার বেলেপাথরের তৈরি একটা নিচু ছাদের মত। যে বিশাল বক্ররেখ পর্বতশ্রেণীর থেকে লুয়াবা বা তার অন্যান্য সঙ্গী নদীদের জন্ম, সেই শৈলশ্রেণীর গোড়া থেকে প্রায় আট মাইল দূর পর্যন্ত এই ছাদের মতন বেলেপাথুরে জমি বিস্তৃত। এরপর আমরা গভীর উপসাগর পেরিয়ে কেপ কাসোফুতে এলাম। লুয়াবার ব-দ্বীপ এই উপসাগরের মাথায়। এই চত্বরে অসংখ্য গ্রাম রয়েছে। মুকুঙ্গুর অবস্থান খুব সুন্দর। এখান থেকে পরপর কিগোঙ্গো, কাটুঙ্গা ও বুগুলুকা ইত্যাদি অন্তরীপ বা কেপগুলো সব দেখা যাচ্ছে। এখানে পৌঁছাতে সবকটা জায়গাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে। ... ...
একটা বটগাছের নিচে ছাউনি খাটানো হল; চারপাশে টাঙ্গানিকার হালকা-ধূসর জলরাশি, তার পাশে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া পাহাড়ের সারি। পাম-কুঞ্জ, কলাঝাড়, সাবু-সহ শস্যখেত দিয়ে সাজানো নিয়াসাঙ্গা গ্রামটি অবস্থিত নিয়াসাঙ্গা নদীর মুখে। তাঁবুর কাছেই গ্রামবাসীদের ছোট-বড় আধা ডজন ক্যানো ছিল। তাঁবুর দরজার সামনেই যতদূর চোখ যায় মিষ্টি জলের রাশি মৃদু বাতাসকে ডাক পাঠাচ্ছে— দূরের উগোমা, উকারাম্বা চোখে পড়ে। ঘন-নীল-শিরা-লাঞ্ছিত মুজিমু দ্বীপপুঞ্জও ফুটে ওঠে চোখের সামনে। আমাদের পায়ের তলায় পরিষ্কার, জলে-ধোয়া নুড়ি, সমুদ্রের অস্থির ঢেউয়ে ভেসে ভেসে কূলে এসে সারি বেঁধে জমা হয়, কোথাও বা স্তূপের আকার নেয়। আমাদের ডাইনে বাঁয়ে পিছনে যে পাহাড়ের রাশি সেগুলো কি দিয়ে তৈরি তা এই পাথরগুলোর থেকেই হদিশ পাওয়া যাবে। ... ...
আমাদের জাহাজটা উগোমার একটি বিশাল এমভুলে গাছ থেকে বানানো। এটা একটা নড়বড়ে ক্যানো ছাড়া আর কিছু নয়। এটা একটা আফ্রিকান আর্গো। এর গ্রীক দেশীয় বিখ্যাত প্রতিরূপের থেকে অবশ্য এই জাহাজ অনেক বেশি ভাল কাজে নিযুক্ত। আমরা সোনার লোম আনতেও যাইনি, কোন ভাড়া খাটতেও যাইনি। বরং একটা বাণিজ্যপথ খুঁজতে গিয়েছিলাম যার মারফত নীলনদের জাহাজগুলো উজিজি, উসোওয়া এমনকি আরও দূরের মারুঙ্গু অবধি আসতে পারে। ... ...
লিভিংস্টোন ও আমি, টাঙ্গানিকা হ্রদের উত্তর প্রান্ত দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করার পরে যদি জিজিদের অযৌক্তিক দাবি বা ভয়ের কাছে নতি স্বীকার করে, রুসিজি নদীর সমস্যার সমাধান না করেই উন্যানয়েম্বেতে ফিরতে বাধ্য হতাম, তাহলে নিশ্চিতভাবেই দেশে ফিরে সকলের ঠাট্টা তামাশার পাত্র হতাম। কিন্তু জানতাম যে জিজিদের, বিশেষ করে ওই হাস্যকর বর্বর কানেনা সর্দারকে দলে নেওয়ার জন্যেই ক্যাপ্টেন বার্টন ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাই আমরা সতর্ক ছিলাম। বুঝেছিলাম যে এই ভৌগলিক সমস্যাটার সমাধানের ক্ষেত্রে এই ধরনের লোকেরা আমাদের কোন সাহায্যই করবে না। আমাদের সঙ্গে কয়েকজন ভাল নাবিক ছিল, খুবই অনুগত। ভাবলাম, শুধু একটা ক্যানো ধার করতে পারলেই সবকিছু ঠিকঠাক হবে। ... ...
এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, আবিষ্কারকরা যেটাকে অবিসংবাদিত সত্যি বলে জেনেছেন, সেটাও বলতে পারবেন না, বললেই তাঁদের দাগিয়ে দেওয়া হবে যে তাঁরা দেশের ভৌগোলিকদের প্রিয় তত্ত্বগুলির বিরোধিতা করার জন্য দল বেঁধেছেন। বা অভিযোগ করা হবে যে সুপরিচিত তথ্যগুলোকে তাঁরা বিকৃত করছেন। বিদগ্ধ মিঃ কুলি' একজন আরবের কথার ভিত্তিতে একটা গোটা মধ্য আফ্রিকা জোড়া বৃহৎ হ্রদের রূপরেখা এঁকেছিলেন। সেই হ্রদ নিয়াসা, টাঙ্গানিকা ও এন'ইয়ানজা ইত্যাদি বেশ কয়েকটা হ্রদকে জুড়ে রয়েছে। এদিকে লিভিংস্টোন, বার্টন, স্পেক, গ্রান্ট, ওয়েকফিল্ড, নিউ, রোশার, ইয়োন্ডারডেকেন এবং বেকার যখন প্রমাণ করলেন যে, এগুলো একটা না অনেকগুলো আলাদা আলাদা হ্রদ, আলাদা আলাদা নামের, দূরে দূরে ছড়ানো, তখন কেন তিনি একবারও স্বীকার করবেন না যে তিনি ভুল করেছেন? ... ...
দু'জন আরবও এই ধাতুর আশায় রুয়ার কাটাঙ্গা নামের জায়গাটাতে হাজির; তবে সংকীর্ণ গিরিখাতে খননের বিষয়ে তাদের কিছুই জানা নেই, অতএব তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা খুবই কম। এইসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় আবিষ্কারগুলি করার ঠিক আগে ডাঃ লিভিংস্টোন ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার সঙ্গীরা আর এক পাও এগোতে রাজি নয়। একটা বড় দল ছাড়া তারা এগোতে ভয় পাচ্ছিল; আর, মান্যুয়েমায় দলবল জোগাড় করা সম্ভব ছিল না, ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডাক্তার উজিজির দিকে মুখ ফেরাতে বাধ্য হয়েছিলেন। ... ...
আরবরা যে দেশেই যাক না কেন, নিজের জাতের নাম ডোবাতে তারা সবসময় মুখিয়ে থাকে। তবে এর কারণ অবশ্য আরবের প্রকৃতি, গায়ের রং বা জাত নয়, এর একমাত্র কারণ হল কেবলমাত্র দাস-বাণিজ্য। যতদিন জাঞ্জিবারে দাস-ব্যবসা চলবে, ততদিন এই এমনিতে উদ্যমী আরবদের বিরুদ্ধে গোটা আফ্রিকার আদিবাসীদের ঘৃণা জেগে থাকবে। জাঞ্জিবার থেকে আফ্রিকার অন্দরে যাওয়ার মূল পথ বরাবর এই নিষ্ঠুরতার কাহিনীগুলো অজানা, তার কারণ এই যে এখানকার স্থানীয়দের হাতে বন্দুক ছিল, সেই সঙ্গে কীভাবে সেই অস্ত্রগুলো ব্যবহার করতে হয় তাও তাদের শেখানো হয়েছিল, আর সেই বন্দুকের ব্যবহারে মোটেই তারা পিছপা ছিল না। ... ...
এই দুটো কাজ সুসম্পন্ন হলে, একমাত্র তারপরই, নীল নদের রহস্য ব্যাখ্যা করা সম্ভব। হ্রদের থেকে জন্ম নেওয়া লুয়ালাবা নদী অজস্র হ্রদের মধ্যে দিয়ে বিপুল জলধারা নিয়ে যে দুটি দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে, সেই দেশদুটি হল রুয়া (স্পেক যাকে বলেছেন উরুওয়া) ও মান্যুয়েমা। এই নদীর বিপুল জল রাশি দেখলে অবাক না হয়ে পারা যায় না। ইউরোপ এই প্রথম জানল যে ট্যাঙ্গানিকা ও কঙ্গো নদীর পরিচিত উৎসগুলির মধ্যে লক্ষ লক্ষ নিগ্রো জাতির বসবাস। যে সাদা মানুষেরা আফ্রিকার বাইরে এমন শোরগোল তোলে, তাঁদের এই নিগ্রোরা কখনও চোখেও দেখেওনি, তাদের কথা শোনেওনি। অসাধারণ শ্বেতাঙ্গদের প্রথম প্রতিভূ হিসেবে ডাঃ লিভিংস্টোনকে দেখার সৌভাগ্য যাদের হয়েছিল, তিনি মনে হয় তাদের মনে একটা অনুকূল ধারণা তৈরি করতে পেরেছেন। ... ...
এইভাবে যতদূর সম্ভব গবেষণা করে, এলিফ্যান্টাইন বা তার থেকেও দূরে গিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আর অন্যের মুখের কথা থেকেও এইটুকুই জানতে পেরেছি। এলিফ্যান্টাইন শহর পেরিয়ে আরও উজানে যেতে গেলে এলাকাটা খাড়া উপরের দিকে উঠে গেছে, তাই, এখানে, নৌকার দুদিকে দড়ি বেঁধে এগোতে হয়, যেমনটা লাঙ্গলে বলদ জোতার সময় করতে হয়; কিন্তু দড়ি ছিঁড়ে গেলে স্রোতের টানে নৌকা ভেসে চলে যায়। এইভাবে চার দিনের পথ চলা। এখানে নীল নদ এঁকেবেঁকে চলে। বারো শোয়েনি পথ এইভাবে চলতে হয়; আর তারপরে একটা সমভূমি আসে, সেখানে নীল নদ একটা দ্বীপের চারপাশে প্রবাহিত হয়; এর নাম ট্যাকোম্পেসো। এলিফ্যান্টাইনের লাগোয়া উজান এলাকায় ও দ্বীপটার অর্ধেকাংশে ইথিওপিয়ানরা বাস করে; বাকি অর্ধেক অংশে মিশরীয়রা থাকে। এই দ্বীপের কাছেই একটা বিস্তীর্ণ হ্রদ রয়েছে, যার সীমানা বরাবর ইথিওপিয়ান যাযাবরদের বাস। ... ...
সবাই জানে যে হাতির দাঁতের ব্যবসা কেন্দ্রগুলো নীল নদের পেথেরিকের নামাঙ্কিত শাখা ধরে প্রায় ৫০০ মাইল অবধি ছড়ানো। এই কথাটাও অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে যখন বলা হয়েছিল যে গোন্ডোকোরো, ৪° উত্তর অক্ষাংশে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০০০ ফুট উপরে অবস্থিত আর এদিকে যে জায়গায় থামা হয়েছিল সেই ৪° দক্ষিণ অক্ষাংশের জায়গাটারও উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে ২০০০ ফুটের সামান্য বেশি। দুটো নদীই সমুদ্র থেকে ২০০০ ফুট উঁচুতে, একে অপরের থেকে ৮° অক্ষাংশ দুরে, অথচ দুটোকে এক ও একই নদী বলা হচ্ছে, এই ব্যাপারটা কিছু মানুষের কাছে একটা ভারি আশ্চর্য কথা বলে মনে হতে পারে। তবে বিস্ময় প্রকাশে লাগাম পড়ানো ভাল, এটা বুঝতে হবে যে এই বিপুল, বিস্তৃত লুয়ালাবা মিসিসিপির চেয়েও চওড়া, এটা একটা হ্রদজাত নদী; মাঝে মাঝেই এত বিপুল-পরিমাণ জল একেকটা ছড়ানো হ্রদ তৈরি করে ফেলেছে; তারপর আবার খানিক সরু হয়ে চওড়া নদীর চেহারা নিয়েছে, আবার আরেকটা হ্রদ তৈরি করেছে, আর সে কারণেই, ৪° অক্ষাংশ বা তার থেকেও উত্তরে ডাক্তার আবার একটা বড় হ্রদের কথা শুনেছিলেন। যতক্ষণ না লুয়ালাবা, যেখানে ডাক্তার থেমেছিলেন আর বাহর গজলের দক্ষিণতম বিন্দু, যেখানে পেথেরিক এসেছিলেন, এই দুটি নদীর উচ্চতা নিখুঁত নির্ভুল ভাবে জানা যায়, ততক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। ... ...
উগুহহা বন্দর থেকে একদল ব্যবসায়ীর সঙ্গে তিনি রওনা হলেন প্রায় সোজা পশ্চিমদিকে, উরুয়ার উদ্দেশে। পনের দিন হেঁটে পৌঁছালেন বামবারেতে। এটা মান্যেমার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ হাতির দাঁতের ভাণ্ডার। স্থানীয়রা জায়গাটাকে বলে , মান্যুয়েমা। প্রায় ছ'মাস ধরে তিনি বামবারেতে আটকে রইলেন। পায়ে একটা ঘা হয়েছিল, মাটিতে পা ফেললেই সঙ্গে সঙ্গে তার থেকে পুঁজ-রক্ত বেরচ্ছিল। সেরে ওঠার পরে, তিনি উত্তর দিকে রওনা হন। বেশ কিছু দিন পর লুয়ালাবা নামের এক প্রশস্ত হ্রদ-জাত নদীর পাশে এসে পৌঁছান। এই নদী উত্তর ও পশ্চিম দিকে বয়ে চলেছে। কিছু কিছু জায়গায় আবার দক্ষিণ মুখোও তার চলা। সব মিলিয়ে বেশ গুলিয়ে দেওয়া ব্যাপার। এক থেকে তিন মাইল পর্যন্ত চওড়া নদী। নিজের জেদ ছেড়ে তিনি এর আঁকাবাঁকা গতিপথ অনুসরণ করার চেষ্টা করেন, শেষকালে দেখলেন লুয়ালাবা গিয়ে পড়েছে সরু, দীর্ঘ কামোলোন্ডোর হ্রদে। যেখানে গিয়ে পড়েছে সেই জায়গাটা মোটামুটি ৬° ৩০' অক্ষাংশ। আর একে দক্ষিণে অনুসরণ করে, তিনি আবার সেইখানে এসে পৌঁছেছিলেন যেখানে তিনি লুয়াপুলাকে মোয়েরো হ্রদে প্রবেশ করতে দেখেছিলেন। ... ...
লুন্ডা বা লোন্ডা দেশে পা রাখার পরেপরেই, কাজেম্বে শাসিত এলাকায় প্রবেশ করার আগে, লিভিংস্টোন চাম্বেজি নামের একটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ নদী পেরিয়েছিলেন। দক্ষিণের সেই ব্যাপ্ত, বিশাল নদী, যে নদীর নামের সঙ্গে লিভিংস্টোনের নাম চিরকাল জড়িয়ে থাকবে, তার সঙ্গে এর খুবই নামের মিল। ব্যাপারটা সেই সময়ে লিভিংস্টোনকে বিভ্রান্ত করেছিল, আর সেই কারণেই , তিনি এই নদীকে তার প্রাপ্য মনোযোগ দেননি, বিশ্বাস করেছিলেন যে চাম্বেজি তাহলে আদতে জাম্বেজিরই উৎস ধারা, আর তাই তিনি মিশরের যে নদীর উৎসের সন্ধান করছেন, তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক বা যোগাযোগ নেই। পর্তুগিজ তথ্যের সত্যতার উপর গভীর বিশ্বাস রাখাই তার দোষ হয়েছিল। এই ত্রুটি সংশোধনের জন্য তাকে অনেক, অনেক মাসের ক্লান্তিকর পরিশ্রম করতে হয়েছে, অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ... ...
বাবিসা সর্দারের গ্রামে থাকাকালীন, হ্রদের পশ্চিম তীরের থেকে এক মিশ্র-বর্ণের আরব এসে পৌঁছায় ও খবর দেয় যে মাজিতুর একটা দল তার সব কিছু লুঠ করেছে। ঘটনাটা এমন একটা জায়গায় ঘটেছে যেটা তারা এখন যেখানে আছেন তার থেকে কমপক্ষে ১৫০ মাইল উত্তর-বায়ু (উত্তর-উত্তর-পশ্চিম) কোণে। ডাক্তার ও জোহানাদের সর্দার মুসা দু'জনেই সেটা খুব ভাল করে জানেন। মুসা খুব আগ্রহ নিয়ে আরবদের গল্প শুনেছিল আর সেটা পুরো বিশ্বাস করেছিল। তার অবশ্য অন্য কারণ ছিল, সেটা এখনই বলব। ... ...
এক রাতে আমার নোট-বই বের করলাম, আর তাঁর মুখ থেকে তাঁর ভ্রমণ সম্পর্কে বক্তব্য শোনার জন্য বসলাম; নিঃসংকোচে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বললেন। তার একটি সারসংক্ষেপ নিচে দেওয়া হল। ডাঃ ডেভিড লিভিংস্টোন ১৮৬৬ সালের মার্চ মাসে জাঞ্জিবার দ্বীপ থেকে রওনা দেন। পরের মাসের ৭ তারিখে তিনি সদলবলে কিন্ডিনি বে থেকে আফ্রিকার অভ্যন্তরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তাঁর দলে ছিল বোম্বাই থেকে আসা বারোজন সিপাই, কোমোরো দ্বীপপুঞ্জের জোহানার নজন লোক, সাতজন মুক্তি পাওয়া দাস, আর দু'জন জাম্বেজির লোক। তাদের পরীক্ষামূলক ভাবে দলে নেওয়া হয়েছিল। এছাড়া ছটা উট, তিনটে মোষ, দুটো খচ্চর আর তিনটে গাধা। এইরকম মোট ত্রিশজন লোক সঙ্গে ছিল, যাদের মধ্যে বারোজন যেমন সিপাই ছিল, যারা দলকে পাহারা দেবে। তাদের বেশিরভাগই এনফিল্ড রাইফেল দিয়ে সজ্জিত । সেই রাইফেলগুলো বোম্বাই-এর সরকার ডাক্তারকে উপহার দিয়েছিল। ... ...
যদি তাঁর চরিত্রের ধর্মীয় দিকটি বিবেচনা না করি, ডাঃ লিভিংস্টোনকে জানা সম্পূর্ণ হবে না। তাঁর ধর্ম তাত্ত্বিক ধর্ম নয়, বরং এ এক ধ্রুব, অকপট, আন্তরিক অনুশীলন। কাউকে দেখানোর জন্যও না, উচ্চকিতও না, শান্ত, ব্যবহারিক জীবনে এই সদাজাগ্রত বোধের প্রকাশ। একেবারেই আক্রমণাত্মক নয়। এই বিষয়টা কখনও কখনও বিরক্তিকরও বটে, যদি অপ্রাসঙ্গিক না হয়। তাঁর মধ্যে ধর্মের মাধুর্য বিরাজমান; কেবল ভৃত্যদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহারই না, স্থানীয় গোঁড়া মুসলমান বাসিন্দাদের প্রতি, তাঁর সংসর্গে আসা সকল মানুষের প্রতি আচরণেই তাঁর ধর্মভাবের প্রকাশ। তীব্র মেজাজ, উদ্যম, প্রাণবন্ত স্বভাব আর সাহসের অধিকারী লিভিংস্টোন এটা ছাড়া অবশ্যই নিঃসঙ্গ, কঠোর প্রভু হয়ে উঠতেন। ধর্ম তাঁকে পোষ মানিয়েছে, তাঁকে একজন খ্রিস্টান ভদ্রলোক বানিয়েছে: অমার্জিত, একগুঁয়েমিকে পরিমার্জিত, অবদমিত করেছে; ধর্মের প্রভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন একজন অতি কাম্য সঙ্গী ও অতি-প্রশ্রয়দাতা প্রভু - এমন একজন মানুষ হয়েছে যাঁর সঙ্গ বেশ ভাল মাত্রায় উপভোগ্য। ... ...
ডাঃ লিভিংস্টোনের বয়স প্রায় ষাট, অবশ্য শরীর সেরে ওঠার পরে তাঁকে পঞ্চাশও পেরোয়নি এমন মানুষের মত দেখাচ্ছিল। তাঁর চুল এখনও বাদামী রঙের, তবে রগের কাছে একটা দুটো ধূসর দাগ দেখা যায়; তাঁর গোঁফ-দাড়ি ঘোর ধূসর। প্রতিদিন দাড়ি কামান। তাঁর হালকা বাদামি রঙের চোখ, দারুণ ঝকঝকে; বাজপাখির মতন তীব্র দৃষ্টি। শুধুমাত্র তাঁর দাঁতই তাঁর বয়সের দুর্বলতা প্রকাশ করে; লুন্ডার কঠিন খাদ্য তাঁর দাঁতের সারিটি ধ্বংস করেছে। শিগগিরই একটু মোটা মতন হয়ে গেলেও, তাঁর চেহারা সাধারণের তুলনায় একটু বেশিই লম্বা, কাঁধটা একটু সামান্য ঝোঁকা। হাঁটার সময় তাঁর পদক্ষেপ ভারী হলেও দৃঢ়, অনেকটা একজন অতি-পরিশ্রান্ত মানুষের মত। একটা নৌবাহিনীর টুপি পরেন, তার ডগাটা অর্ধবৃত্তাকার, এই টুপি দিয়েই তাঁকে সারা আফ্রিকা চেনে। যখন তাঁকে প্রথম দেখি, তাঁর পোশাক তাপ্পি-মারা, তবু অত্যন্ত পরিষ্কার। ... ...
১৮৬৯ সালের অক্টোবরে আমাকে লিভিংস্টোন আবিষ্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। মিঃ বেনেট টাকা নিয়ে বসে ছিলেন আর আমিও যাওয়ার জন্য তৈরি। পাঠক, লক্ষ্য করবেন যে আমি কিন্তু সরাসরি তাঁকে খুঁজতে চলে যাইনি। এই কাজ শুরু করার আগে আমার আরও অনেক কাজ ছিল, অনেক হাজার মাইল পেরোতে হয়েছিল। ধরুন যে, প্যারিস থেকে সোজা জানজিবারে পৌঁছে গেলাম, সাত বা আট মাস পরে, সম্ভবত, উজিজিতে আমাকে পাওয়া যেত তাহলে, কিন্তু লিভিংস্টোনকে তখন সেখানে পাওয়া যেত না; তিনি তখন লুয়ালাবাতে ছিলেন; এবার আমাকে তাহলে মান্যুয়েমার আদিম বনের মধ্য দিয়ে, লুয়ালাবার আঁকাবাঁকা পথ ধরে, তাঁকে ধাওয়া করে কয়েক শত মাইল ঘুরে ঘুরে মরতে হত। ... ...
আমি পসরার মূল্য দিয়েছি, ওঁকে সাহায্য করার জন্য এতদূর এসেছি। তবে গত রাতে ওঁকে যতটুকু দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে যে, আমাকে যেরকমটা বিশ্বাস করানো হয়েছিল উনি ঠিক ততটা কিপটে, মনুষ্যদ্বেষী নন। স্বল্প কথায় উনি আমাকে অভ্যর্থনা করলেও, আমার সঙ্গে করমর্দন করার সময় যথেষ্ট আবেগ প্রকাশ করেছেন। কেউ তাঁর পিছু নিলে তিনি যদি সে মানুষের প্রতি এতই বিরক্ত হতেন, তাহলে কি আর আমায় ওই ভাবে স্বাগত জানাতেন? ... ...