আমি যেন একটা ঘাসের বনের মধ্যে শুয়ে আছি। মানুষের মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে, এমন একটা ঘাসের বন। দূরে হয়তো একটা বাওবাব গাছ। যেমনটা আফ্রিকায় বা চাঁদের পাহাড়ে পাওয়া যায়, তেমন। ... ...
এটা আসলে ট্রেনের গল্প। আমার বাবা নেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথ, পেশায় রেল-কর্মচারী - বছরে দু-দুটো পাশ পেতেন আর আমরা পুজোর ছুটি, শীতের ছুটি দেদার ঘুরে বেড়াতাম এদিক-ওদিক। প্রায়ই প্ল্যান শুরু হতো পুষ্কর লেক দিয়ে, শেষ হতো পাশের পাড়ায় পুরীর বীচে। কখনো আবার হঠাৎ করে দেখতাম একগাদা কিচিরমিচির করা ফ্যামিলি নিয়ে চলেছি পাহাড়ে বা সমুদ্রে। ইস্কুল থেকে কলেজে উঠে তো আরো মজা, ফি বচ্ছর শিক্ষামূলক ভ্রমণ হয়, একজন অসহায় টিচার, আর একগাদা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। আমাদের সেই ছোটো আর মাঝারি-বেলার সব গরমের ছুটি যদি একটা আঁতেল আর্ট ফিলিম হয়, তার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হবে শুধুই কু-ঝিক-ঝিক এবং ফাঁকে ফাঁকে 'চায়ে গ্রম চায়ে'। ... ...
বিজ্ঞানকে পছন্দ করি বা না করি, একে ছেড়ে থাকা আমাদের কারওর পক্ষেই সম্ভব নয়। সকালের ব্রেকফাস্ট থেকে রাতের ঘুম, বারেবারেই আমাদের বিজ্ঞানের শরণাপন্ন হতে হয়। বিজ্ঞানের শরণাপন্ন বলতে আমি মাইক্রোওয়েভ টেকনোলজি বা স্মার্টফোন টেকনোলজির কথা বলছি না। আমি বলছি রোজকার জীবনের নানা সিদ্ধান্তের কথা, যার পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে বিজ্ঞানের নানা অন্ধিসন্ধি। কী রকম? ধরা যাক, আপনি সকালে জ্যাম-পাঁউরুটির বদলে ওটমিল খান। কেন? না, ছোটকাকুর ডাক্তার বন্ধু বলেছেন ময়দার জিনিষ না খেতে। কিন্তু তিনি এটা জানলেন কী করে যে ময়দা খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর? কী করে আবার, ডাক্তার মানুষ, তাই জানেন। উঁহু, উত্তরটা হল না। তিনি জানেন, কেন না, কেউ কোথাও এটা নিয়ে গবেষণা করে উত্তরটা খুঁজে বার করেছেন। ডাক্তারকাকু সম্ভবত কোনও জার্নালে পড়ে এটা জেনেছেন। ... ...
মধুর ঠোঁট থেকে সিগারেটটা পড়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে লোকটাকে আচমকা ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করল সে। পারলো না, আরও দু জন লোক কাছেই ছিল, একজন মধুকে ল্যাং মারল, সে উলটে পড়ে যেতেই চার জন মিলে তাকে ধরে পিছমোড়া করে হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দিল। তারপর কোমরে দড়ি পরিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল পাশের গলির দিকে, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুলিশের গাড়ি। মধুকে তাতে তুলে বেরিয়ে গেল গাড়িটা। আশেপাশে জড়ো হওয়া লোকেরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। ... ...
তাছাড়া সেদিন কি শুধু সুকল্প তাকে মুক্তি দিয়েছিল? ঊর্মি সুকল্পকে দেয়নি মুক্তি? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের হাত ধরে ঘটে যাওয়া এই নিঃশব্দ বিপ্লবকে কোনোদিন স্বীকার করে নি করবেও না। কিন্তু তাতে ঊর্মীদের কৃতিত্ব কমে না। ... ...
…ঝটিকা হ্রদ-পাহাড়-অরণ্যের দেশ রাঙামাটি ভ্রমণ। আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে নিছকই ব্যক্তিগত অন্তর্দশন। ভেতরে অশান্ত পার্বত্যাঞ্চলের স্মৃতির ঢেউ তোলপাড়। ব্যাগপ্যাকে চণ্ডালের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ ‘পাহাড়ে বিপন্ন জনপদ (সাংবাদিকের জবানবন্দীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের অকথিত অধ্যায়)’, যেন গোটা পাঁচেক আর্জেস গ্রেনেড। সঙ্গ দেন কয়েক গুণীজন… ... ...
পৃথিবীর আরো নানাবিধ জিনিসের মত বাটিকের উৎপত্তি নিয়েও টানাবাহানা আছে – বিশেষ করে যখন আজকে যাকে বাটিক বলি তেমন ডিজাইনের কাপড় দেখা গেছে ভারত, চীন, মিশর থেকে শুরু করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার নানা জায়গায়। এই সব জিনিস নিয়ে বিতর্ক শেষ হয় না – কথায় বলে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু! তবে মোটামুটি আজকাল যা স্বীকৃত তা হলে বাটিক পদ্ধতির উৎপত্তি হয়েছিল আজকের দিনের ইন্দোনেশীয়া দেশের জাভা দ্বীপে। বাটিক শব্দটির উৎপত্তি জাভা থাকে, মূল শব্দ ছিল ‘আমবাথিক’। জাভানীজ ভাষায় ‘আমবা’ মানে হচ্ছে চওড়া বা বৃহৎ এবং ‘থিক’ শব্দের অর্থ ‘বিন্দু’। এই ভাষাতেই বাথিকান শব্দের অর্থ আঁকা বা লেখা। কালের ক্রমে ইন্দোনেশীয়ার মূল স্রোতে যখন বাথিকা মিশে গেল তখন ‘থিক’ শব্দবন্ধ উচ্চারিত হতে লাগল ‘টি’ দিয়ে এবং সেই থেকেই আজকের বাটিক শব্দটি। ... ...
পাড়ার নিজস্ব পেপারওয়ালা, সব্জিওয়ালা, ঠাকুরমশাই ও নাপিত কাকু থাকত। পাড়ার এক ঘরের মাস্টারমশাই, বেশ ক ঘরের হয়ে যেতেও সময় নিত না। তখন মোবাইল নেই, এক বাড়িতে ফোন বাজলে অন্য বাড়িতে ছুটে যেতে হত। শোনাতে হত তাদেরকেও হাল সমাচার। ছাদের অ্যান্টেনাগুলো নিজেদের মধ্যে চুপিচুপি গল্প সেরে নিত। দড়িতে দড়িতে শুকোত লাল-নীল ছাপা শাড়ি... কাঁটা ঘুড়ি অনেকদিন ঝুলে থাকত ইলেক্ট্রিকের তারে...আর সার বেঁধে পাখিরা কখনও ওতে বসে তাদের মিটিং সারত... ... ...
ওনাকে ভারতের Commercial Art এর জনক বলে গিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। মানুষটি ছিলেন স্বদেশীয়ানার "ফ্লেভারে" ভরপুর। Lipton Co. র কাজ হাতে নিয়েছিলেন এই শর্তে -- " আমি কিন্তু স্বদেশী চা বাগানের মালিকের বিজ্ঞাপনও বানাবো সাহেব ! ইচ্ছে হয় আমায় রাখো, নয়ত চল্লুম। " দেশের মানুষের জন্য বিজ্ঞাপন করতেন বিনা পারিশ্রমিকে। ... ...
শেষ বিকেলের আলোয় ডলি রাখাইনের ফর্সা কচিপানা মুখে লালচে আভা। কণ্ঠস্বর বাস্পরূদ্ধ, যেন অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্ট হতে থাকে, আচ্ছা, বিপ্লব দা, আপনার তো ঢাকায় অনেক টাকার চাকরি! এ রকম একটা বাড়ি সস্তায় কিনতে পারেন? মানবিক লোকজন এসবের দখল নিলে রাখাইন মালিকটি দেশান্তরে গিয়েও অন্তত নিশ্চিন্ত যে, যাক, পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির নিশানাটুকু তো টিকে থাকবে, সেটুকু তো আর একেবারে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে না! … ... ...
সময়টা ১৯৪০ সালের আশেপাশে – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তখন জাপানের অবস্থা ভালো নয়, নানা দিকে পিছু হটছে জাপানী ইম্পিরিয়াল বাহিনী। সাধারণ লোকেরাও বুঝতে পারছে যে এই যুদ্ধে জাপানের পরাজয় প্রায় আসন্ন। কিন্তু তখনও সম্রাট এবং তার বাহিনী শেষ কামড় দিতে লড়ে যাচ্ছে। নিত্য নতুন সৈন্য নিয়োগ হচ্ছে – প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে যুবক সম্প্রাদয় নিযুক্ত হচ্ছে যুদ্ধে যাবার জন্য। পরিবার জানাচ্ছে সেই সব তরতাজা যুবকদের বিদায় – মুখে বলছে সবাই, কারো বাবা-মা, কারো প্রিয়তমা, কারো ভাই, কারো স্ত্রী – “শপথ করো আবার দেখা হবে” – কিন্তু প্রায় সকলেরই চোখের কোণের জল টের পাচ্ছে যে এই শপথ রক্ষার প্রায় কোন উপায়ই নেই! সেদিনের দেখাই শেষ দেখা! ঠিক এমন ভাবেই বিদায় জানাচ্ছিলেন মাসাকি তাকাওকা তাঁর ছাত্রদের। মাসুকি তখন ইহিমে পার্বত্য এলাকার এক ছোট্ট গ্রামের কৃষি বিদ্যালয়ে পড়াতেন। সেই বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ছিল এক বিরাট চেরী গাছ। মাসাকি জানতেন আসল সত্যি – কিন্তু তবুও প্রত্যেক ছাত্রের হাতে হাত রেখে অঙ্গীকার করছিলেন যে আবার দেখা হবে স্কুল প্রাঙ্গণে ফুল ফুটে ভরে ওঠা চেরী গাছের তলায়। যুদ্ধের পর যেন তারা সবাই আবার স্কুল প্রাঙ্গণের চেরী গাছের তলায় ফিরে আসে। ... ...
সলিল চৌধুরীর গানের যন্ত্রানুষঙ্গের বিবর্তন ... ...