একজন পশ্চিমা নাগরিক যখন অফিসের পথে হাঁটতে থাকেন, কখনো কি তার মাথায় প্রশ্ন উদ্রেক করে, কী অঢেল পানিসম্পদ ব্যয়িত হয় তার ট্রাউজারটি ধৌত ও রঙ করার কাজে? ইন্টারন্যাশনাল ফাইনান্স কর্পোরেশান এর একটি সমীক্ষা বলছে, প্রতি বছর গার্মেন্টস শিল্পের সুতো ও কাপড় রঙ এবং ধৌত করার কাজে ১৫০০ বিলিয়ন লিটার পানি ব্যবহৃত হয় বাংলাদেশে – এটি সেই পরিমাণ তরল যা দিয়ে ৬,০০,০০০ অলিম্পিক সুইমিংপুলকে ভরে দেয়া যায়, বা, ৮,০০,০০০ মানুষের সারা বছরের পানির কাজ নির্বিঘ্নে চলে যায়! আমরা যে জিন্স প্রতিদিন পাদুটোর উপর চেপে রাখি, তার ওজন প্রায় ১ কেজি, আর এইটুকু পোশাককে ধৌতকরনে খোয়াতে হয় প্রায় ২৫০ লিটার পানি। আর এ হচ্ছে মিষ্টি পানি, ভূগর্ভস্থ চ্যানেল থেকে যা পাম্প করে বের করা হয়। পানির টেবিল কিন্তু অসীম নয়; প্রতিবছর ২.৫% নেমে যাচ্ছে। আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির চ্যানেলগুলো এভাবে ক্রমেই রিক্ত হচ্ছে পোশাক দৈত্যের খাবার যোগন দিতে গিয়ে, আর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দেবে যাওয়ার ঝুঁকিসম্পন্ন একটি ভূত্বক অবশিষ্ট রেখে যাচ্ছে! ... ...
ছেলেটি ঘামছিল দরদর করে, মাঝে মাঝে রুমাল দিয়ে মুছে নিচ্ছিল মুখমন্ডল, সারা শরীর যেন ভেঙ্গে পড়ছে ক্লান্তিতে, তবু উঠার নামগন্ধ নেই। তার সামনে একটি টেবিল, একটি ল্যাপটপ, আর এক গাদা কাগজপত্র। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছিল, আর এই অজ পাঁড়াগায়ে বিদ্যুত পৌঁছুলেও খেয়াল খুশীমত সে আসা যাওয়া করতো, তাই যখন পাশেই রাখা বিশাল স্ট্যান্ড ফ্যানটা ঠায় দাঁড়িয়েছিল নির্বাক, নিঃশব্দ, সামনে-পেছনে-ডাইনে-বায়ে গোল হয়ে দাঁড়ানো প্রায় জনা ষাট-সত্তর মানুষ, তাদের মধ্যে ছেলে-বুড়ো-বউ-ঝি কেউই বাদ পড়েনি, একটুও কুন্ঠিত হচ্ছিল না, ব্যাপারটা তাদের এতটাই গা সওয়া - বরং তারা প্রবল আগ্রহ নিয়ে দেখছিল ছেলেটির কাজকর্ম, তাদের জন্য আজ এক বিষ্ময়ের দিন, আজ নাকি তাদের ব্যাংক হিসাব খোলা হবে! ... ...
শ্রমক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়া ভালো লক্ষণ, কিন্তু এই বাড়তি মহিলা শ্রমের সিংহভাগই কৃষিতে যাচ্ছে, শস্তার শ্রম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে- এগুলো সুবিধার লক্ষণ নয়। ... ...
বিনিময় হার হচ্ছে অর্থনীতির সেই পিরামিড বা ফিনিক্স পাখি যাকে ধরতে বা ভবিষ্যৎবানী করতে সব থেকে বেশী ব্যর্থ হতে দেখা যায় অর্থনীতির দিকপালদের। কারণ অর্থনীতির এই উপাদানটি সারা বিশ্বের সব ঘটনা দিয়ে প্রভাবিত হয়, বিশ্বের যেকোন প্রান্তের যেকোন ঘটনায় হাজার মাইল দূরের কোন দেশের মুদ্রাও নেচে উঠে ধেই ধেই করে। ..১৯৯২ সালের ঘটনা। ....তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর সেই সময় জাতিকে তার সরকারের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা জানিয়ে বললেন, পাউন্ডকে রক্ষা করতে যা কিছু দরকার করা হবে। ব্রিটিশ সরকারের হাতে সেসময় ছিল দুটি অস্ত্র; একঃ সে তার হাতে থাকা বৈদিশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছেড়ে দিয়ে পাউন্ড কিনে নিতে পারতো এবং এভাবে পাউন্ডের কৃত্রিম চাহিদা তৈরী করে এর মূল্য পতন ঠেকাতে পারতো। দুইঃ সে মুদ্রানীতির কলাকৌশলকে কাজে লাগিয়ে সুদ হার বাড়িয়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ডেকে নিয়ে আসতে পারতো ব্রিটিশ বন্ড কিনতে, সেক্ষেত্রে বিদেশী মুদ্রা ভাঙ্গিয়ে পাউন্ড কেনার জন্য লাইন লাগতো আর এভাবে পাউন্ডের কৃত্রিম চাহিদা তৈরী হত ও দর পতনকে রুখে দেয়া যেত। ... ...
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কতটা মানবিক, কতটা যান্ত্রিক? ... ...
কেন ক্রেদি সুইস বিক্রি হল তার সম্যক তথ্য খবরের কাগজ, ইন্টারনেট , টেলিভিশনের ডিবেট (যাকে নাকি বলে নুক্কড় বহস বা নেশন ওয়ানটস টু নো) এবং লোকমুখে চেনা শোনা জানা যায়। সেটা আমার আলোচ্য বিষয় নয়। আগের পর্বে বলেছি ক্রেদি সুইসের চারটে মূল কর্মধারা – আপনার আমার চির পরিচিত কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কিঙ্গে তারা কখনো লোকসান করে নি, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ও প্রাইভেট ব্যাঙ্কিং লাভ জনক - দুনিয়ার ধনী ব্যক্তিরা তাঁদের টাকা ভরা সুটকেস ৭০ নম্বর পারাদেপ্লাতসে গচ্ছিত রেখেছেন। সুদ পেয়েছেন দবাকে। তাহলে সমস্যাটা কোথা হতে এলো? ব্যাঙ্কের অলিখিত মূলধনের নাম বিশ্বাস – সেটি যদি হারায়, দুনিয়ার কোন ব্যাঙ্ক নিরাপদ নয়। এক সময় রান অন দি ব্যাঙ্ক হতো মুখের কথায়, গুজবে, কথা হয়েছে কানে কানে। আজ সামাজিক মাধ্যমের দ্বারা সেই ব্যাঙ্ক রানের কাজ সুচারু রূপে সাধিত হয় - সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের পঞ্চত্ব প্রাপ্তির কাহিনি সকলে অবগত আছেন। ক্রেদি সুইস তার খদ্দেরের বিশ্বাস কবে হারাল? ব্যাঙ্কের প্রতি আস্থা একদিনে বিনষ্ট হয় না, একটি ঘটনায় হয়তো নয়। ঠিক কি কারণে ক্রেদি সুইস একদিন তার কাছে গচ্ছিত ধন হারাতে শুরু করল তার তালিকা শিগগির কোথাও দেখা যাবে। একদিন তা নিয়ে নিশ্চিত পুস্তক রচনা, এমবিএ ক্লাসে পড়ানো হবে। ইউটিউবে দেখা যাবে ঘণ্টা ব্যাপী ক্লিপ। সে বহু মনিষীর কাজ। ... ...
মৌসুমি ব্যবসা এক নিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানিতে জন্মলাভ করে। অথচ ইতিহাসের সব থেকে যন্ত্রণাদায়ক সত্যগুলোর একটি হল, ভবিষ্যৎ সবসময়ই আমাদের বিষ্মিত করবে, সবসময় অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটবে। বাজার সব থেকে নিষ্ঠুরভাবে তাদেরকেই চমকে দেয়, যারা সব থেকে বেশী নিশ্চিত থাকে যে, তাদের ভবিষ্যৎ অনুমানটি সঠিক হবে। ব্রিটিশ প্রাবন্ধিক জি কে চেস্টারটন একদা বলেছিলেন, "সেই লোকই আশির্বাদপুষ্ট যে কোন কিছুই প্রত্যাশা করে না, কারণ সে তাহলে আর হতাশ হবে না।" ... ...
হেনকালে একজন ব্যবসায়ী ,রাজনীতিক এবং আইনজ্ঞ মানুষ মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন – জুরিখের নিকটবর্তী এঙ্গে গ্রামে তাঁর জন্ম, জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়েছেন ( বন ও বার্লিনে কিছু সেমেস্তার সহ ) : তাঁর সকল বিদ্যা বুদ্ধি জানাশুনো এবং লবির জোরে সুইস কনফেডারেশনের কাছে আবেদন জানালেন- রেল ব্যবস্থাকে দ্রুত উন্নত করতে গেলে সে কাজটি দেওয়া হোক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে , ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা শেখানোর স্কুল খোলা হোক ( যা আজকের ফেডারাল পলিটেকনিক ইনসটিটুট ; আইদগেনোশিসে টেখনিশে হখশুলে – ETH)। সে সব না হয় হলো, কিন্তু টাকা ? সে মানুষটি বললেন , ভাবনা করো না, রেল পত্তন এবং বিস্তারের জন্য আমরা একটি ব্যাঙ্ক স্থাপন করব । লাগে টাকা দেবে সে ব্যাঙ্ক ! তিরিশ লক্ষ ফ্রাঙ্কের শেয়ার ছেড়ে তার দশগুণ অর্থ পেলেন – সবাই উন্মুখ । প্রতিষ্ঠা করলেন প্রথম সুইস ব্যাঙ্ক – ১৮৫৬ ।( দু বছর বাদে ইকনমিসট পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার জেমস উইলসনের চার্টার্ড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অস্ট্রেলিয়া এন্ড চায়না তার প্রথম শাখা খুলবে কলকাতায়, আজকের এন এস রোডে , দশ বছর বাদে হংকং সাংহাই ব্যাঙ্ক – যথাক্রমে হংকং এবং সাংহাইতে ) । ... ...
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কতটা মানবিক, কতটা যান্ত্রিক? ... ...
সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের সমস্যা অন্য রকম। মাত্র চল্লিশ বছরের পুরনো এই ব্যাঙ্কে আপনার আমার মতন সাধারণ নাগরিক খুব সামান্য টাকা রেখেছিলেন, মোট অঙ্কের দশ শতাংশও নয়। সেখানে যারা বৃহৎ অঙ্কের ডলার জমা রেখেছেন তাঁরা ব্যাংকিং জগতে হালে আবির্ভূত এক প্রজন্ম – এঁরা উদ্যোগী মূলধনের সরবরাহকারি – ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট। টাকার প্রকাণ্ড পোঁটলা নিয়ে ঘোরাঘুরি করেন, আপনার আমার পাড়ায় নয়, সেই সিলিকন ভ্যালিতে যেখানে টেক জগতের অনেক উজ্জ্বল তারকা কিছু না কিছু নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন – তাঁদের মাথায় বুদ্ধি আছে, একটা দুর্দান্ত কিছু বানানোর পুরো ব্লু প্রিন্ট আছে। নেই শুধু অর্থ। তাঁদের মধ্যে কেউ না কেউ একদিন বিল গেটস হয়ে উঠবেন – এই উদ্যোগী মূলধনের মালিক আজকে তাঁদের শেয়ার সস্তায় কিনে নিয়ে অগ্রিম অর্থ সাপ্লাই করছেন। আশা রাখেন এই টেক তারকারা একদিন এমন কেরামতি দেখাবেন যে সে শেয়ারের দাম লক্ষ ডলার হবে। অবশ্যই দশ জন উদ্ভাবকের মধ্যে দু চার জন এলিজাবেথ হোমসের মতন টোটাল ফ্রড হবেন (উনিশ বছরে স্ট্যানফোরডের ড্রপ আউট এই বালিকা নয় বিলিয়ন ডলার মূল্যের কোম্পানি বানিয়ে ফেলেছিলেন - এক ফোঁটা রক্ত থেকে ১৮০ রকমের টেস্ট করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে - এখন হাওয়ালাতে আছেন) তাতে কি? জুয়ার সব দান সমান হয় না, তাহলে তো সব খিলাড়ি রকিফেলার হয়ে যেত ... ...
এবারের সংগ্রাম মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম! আমাদের হাতিয়ার ‘সুদের হার’ আর ‘টাকার সরবরাহ’। রিভার্স গিয়ার। সুদের হার বাড়াও, নোট কম ছাপো। টাকার ভাও বেশি হলে জিনিসপত্রের চাহিদা কমবে। লোকে খরচা করবে হিসেব করবে। সুইগি থেকে খাবার না আনিয়ে গৃহবধূরা স্বহস্তে রন্ধন করবেন, নেটফ্লিক্সের চাঁদা বন্ধ করবেন। ব্যাঙ্কের খাতায় জমার পরিমাণ বাড়বে অবসর প্রাপ্ত মানুষ যারা ব্যাঙ্কে জমা টাকার সুদ থেকে জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন, তাঁরা দু হাত তুলে আশীর্বাদ করবেন। মুদ্রাস্ফীতি কমলে গ্যাঁটের টাকার মূল্য বাড়ে। ... ...
দু দশক বাদে বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্টের এক নতুন প্রয়োগের সঙ্গে পরিচিত হলাম । ব্যাঙ্কিং বাজারে স্বল্প মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি ঋণের কেনা বেচা চলে, যার নাম সেকেন্ডারি ট্রেডিং । যেমন ধরুন সিটি ব্যাঙ্ক জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার কোম্পানিকে দু বছরের কড়ারে ধার দিয়েছে এবার সিটি তার স্বত্ব বিক্রি করে দিলো রাবো ব্যাঙ্ককে । দু বছর পার হলে রাবো ব্যাঙ্ক কভেন্ট্রিতে জাগুয়ারের দরোজায় সেই টাকা আদায়ের জন্য কড়া নাড়তে পারে অথবা ইতিমধ্যেই অন্য কাউকে বেচে দিয়ে থাকতে পারে । ঋণ শোধের দিন যার হাতে মালিকানা তাঁকে আমরা বলি হোল্ডার ইন ডিউ কোর্স যিনি সেদিন সেই টাকা পেলেন অথবা হাতে হ্যারিকেন ধরলেন ! এ ধরণের ট্রেডিং তুলকালাম হারে দেখা যায় স্বল্প মেয়াদি আমদানি রপ্তানির ব্যবসায় যাকে আমরা ট্রেড ফাইনান্স বলি। বি পি ( ব্রিটিশ পেট্রলিয়াম - ব্লাড প্রেশার নয় ) ছ মাসের কড়ারে জাহাজ ভর্তি তেল বেচল কেনিয়ার কোবিলকে। কোবিল একটি হুন্ডি লিখে জানাল ১৮০ দিন বাদে তারা দশ মিলিয়ন ডলার নিউ ইয়র্কে জমা করবে বি পির খাতায় । কেনিয়ান কোম্পানির ওপরে ভরসা নেই তাই বি পি সিটিব্যাঙ্কের গ্যারান্টি চাইল- অর্থাৎ কেনিয়া দাম না চুকোলে সিটি সে ডলার দেবে । আগামী কল্য সিটি এই হুন্ডি মেলন ব্যাঙ্ককে বেচে দিতে পারে – ছ মাসের ভেতরে এই কাগজটি মালিকানা বহুবার বদলে যায় এবং এইখানে শুরু হয় ট্রেডিঙের বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্টের খেলা। ... ...
এখন ধরো শেয়ারের দাম বেড়ে যাচ্ছে দেখে আমার পুত্র ব্যাঙ্ককে বলতে পারে তুমি আর কোন সুরক্ষা নয়, আমার কোম্পানির শেয়ার জমা রাখো । কোন কারণে যদি সুদ আসল শোধ না করতে পারি, আমার শেয়ার বেচে দিয়ে টাকা উদ্ধার করে নিও , এই যেমন মর্টগেজ শোধ না করতে পারলে ব্যাঙ্ক বসতবাড়ি বাজেয়াপ্ত করে টাকা উসুল করে। পেছন থেকে একটি ছেলে বললে বাড়ি ঘরের দাম কমতে বাড়তে পারে, তবু তার কিছু মূল্য থেকে যায়। কিন্তু শেয়ারের দাম শূন্য হয়ে যেতে পারে না কি ? এই যেমন এনরনের ক্ষেত্রে হয়েছে। আমার বাবা পেনশন ফানডে এনরনের শেয়ার জমা রেখেছিলেন, এখন সেগুলো ছেঁড়া কাগজের বাকসোয় ঠাই পেয়েছে। ... ...
পরবর্তী ষোল বছরে ভারতীয় ব্যবসায় নিবেশকারীদের জন্য এক রাজপথ , এক বিশাল অটোবান খুলে গেলো – ভারতীয় শেয়ার বাজারের নিবেশকবৃন্দ টাকার গাড়ি পাঠালেন চিরাচরিত নিউ ইয়র্ক লন্ডন প্যারিস নয়, আপাত অখ্যাত এক শহর পোর্ট লুই থেকে ( জনসংখ্যা সওয়া লক্ষ) । বিদেশি ব্যাঙ্ক সেখানে নেই তাই তাঁরা তাদের ডলার পাঠান স্থানীয় ব্যাঙ্কে , তা দিয়ে কেনা হয় রাশি রাশি ভারা ভারা ভারতীয় শেয়ার । দাম বাড়লে বেচেন , ট্রেডিং করেন , ট্যাক্স দেন মরিশাসে যার হার ব্রিটেন ফ্রান্স জারমানির তুলনায় নস্যি । ভারতীয় কর বিভাগ উদার দৃষ্টি উন্মীলন করে থাকেন । সরকারি ভাবে এর নাম দেওয়া হল বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক নিবেশন (ফরেন ইন্সটিটিউশনাল ইনভেসটরস)। কাগজে কলমে এঁরা বিদেশি নিবেশক কিন্তু খুঁটিয়ে দেখে কে ? পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি না হলে মালিক নৌকর চাকরের ঠিকানা ড্রাইভিং লাইসেন্স বিজলি বা জলের বিল ব্যাঙ্কের কাছে জমা দিয়ে আপন বৈধতা প্রমাণ করার কোন প্রয়োজন নেই । টাকা বা রুপিয়া আসছে নানান দিশা থেকে , যাচ্ছে শুধু ভারতের পানে, যেমন একদা পর্তুগিজ ডাচ ইংরেজ জাহাজ যেতো । ... ...
জিডিপিকে নিয়ে আগ্রহ নতুন কিছু নয়, একে একক মাপকাঠি ধরে দেশের স্কোরশিট বের করার ইতিহাস অনেক পুরনো এবং ব্যাপ্তি সারা বিশ্ব জুড়েই। অথচ যতই দিন যাচ্ছে, ততই শ্রী হারাচ্ছে এই সোনার কাঠি এর অন্তর্গত দুর্বলতার জন্য। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল একবার লিখেছিলঃ ‘’যদি একটি শিল্পকারখানা এর পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দুষন সৃষ্টি করে এবং সরকারকে সেই দুষিত পরিবেশ পরিচ্ছন্ন করার বিল পরিশোধ করতে হয়, তাহলে এই দুইটি কাজই জিডিপিতে যোগ করে।‘’ আমাদের দেশের নির্মাণযজ্ঞে আমরা দুইটি চিত্র দেখতে পাই, একদিকে শূন্য জায়গায় নতুন বাড়ি হচ্ছে, অন্যদিকে পুরনো বাড়ি ভেঙ্গেও নতুন বাড়ি হচ্ছে। জিডিপি পুরনো বাড়ির ক্ষতকে স্পর্শ না করে দুইটি চিত্রকে একই দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করে । আইভরি কোস্ট ১৯৬০ এর দশকে আফ্রিকার জন্য প্রবৃদ্ধির উদাহরণ ছিল, আর্জেন্টিনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বিশ্বের প্রধান শিল্পোন্নত দেশগুলির একটি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল, মেক্সিকো উত্তর আমেরিকার প্রবৃদ্ধি তারকা হিসেবে দুর্দান্ত খেলে যাচ্ছিল ১৯৫০ থেকে টানা তিরিশ বছর। কিন্তু দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি-ঝড় থেমে গিয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাবে। আমলাতন্ত্র, জমির রেকর্ড, সম্পত্তি অধিকার, শিক্ষা, এবং বিচার ব্যবস্থা – রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোতে অব্যবস্থাপনা তাদের প্রবৃদ্ধির বেলুন ফুটো করে দিয়েছিল। অন্যদিকে, কোরিয়া ১৯৬০-৮০ … এই বিশ বছরে তার মাথাপিছু আয় ২০ গুন বাড়িয়ছে, ইতিহাসে যে রেকর্ড আজ পর্যন্ত কেউ ভাংগতে পারেনি। কোরিয়া পড়ে যায়নি কারণ সে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সুদৃঢ়করনে মনোযোগী ছিল শুরু থেকেই। ... ...
মূল্যস্ফীতির স্পিডমিটারটি যদি ঠিকমত ঘুরানো যায়, তাহলে ‘মূল্যস্ফীতির’ দেখা হয়ত মিলবে, কিন্তু ‘অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি’কে শত হাত দূরে থাকবে। দুঃখ হল, অনেক দেশের অসৎ প্রশাসন স্পিড লিমিটকে ছাড়িয়ে এমন রুদ্ধশ্বাসে ছোটে যে, এক সময় মূল্যস্ফীতির চাকা বিষ্ফোরিত হয়ে ধোঁয়া উঠতে থাকে। যারা সরকারকে ঋণ দিয়েছিল, মূল্যস্ফীতির তোড়ে তাদের সুদ আয় উড়ে যায় না শুধু, আসল টাকার বাঁধও দুলে উঠে। আর যারা টাকা ধরে রেখেছিল হাতের মুঠোয় বা ঘরের সিন্দুকে, তারাও ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মাথা চাপড়াতে থাকে। সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের ভবিষ্যত নাগরিকেরা, কারণ দেশটি পরে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ঋণ পায় না। এইসব দেশের সরকার তখন টাকা ছাপিয়ে হলেও তার সামরিক যন্ত্রকে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বড় করতে থাকে আর এভাবে নিজের মসনদকে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালায়; এক্ষেত্রে জনগনের কাছ থেকে কর আদায় করা হচ্ছে না সত্য; তবে তাদের টাকার মূল্য ব্যাপক অবনমন ঘটে, যা অর্থনীতিবিদগনের কাছে মুদ্রাস্ফীতি কর নামে পরিচিত। রুপি করের একটা কবিতায় আছেঃ ‘আমি জল/এত নরম/যে জন্ম দিতে পারি/এত কঠিন/যে ডুবিয়ে দিতে পারি।‘ জলের সাথে অনেক মিল টাকার। আমাদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় ব্যাংকে রেখে ভাবি ‘আসল’ টাকাটা নিরাপদ থাকবে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি তাও খেয়ে ফেলে; পুঁজিবাজারে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করে কেউ যদি ১০% মূলধনী মুনাফা অর্জন করে, তাহলে তার পুরোটাই গ্রাস করতে পারে সমহারের একটি মূল্যস্ফীতি। সম্পত্তি পুনর্বন্টনেও খেল দেখায় মূল্যস্ফীতি; আমি যদি ১০০ টাকার ঋণ করি ১০ টাকা সুদে, তাহলে আমার সুদাসল ১১০ টাকা ৫৫ টাকা হয়ে যাবে ১০০% মূল্যস্ফীতিতে। মানে, মূল্যস্ফীতি ব্যাংকের জন্য খারাপ, কিন্তু ঋণগ্রহীতার জন্য স্বর্গ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২১ সালের একটি স্থির সুদের বন্ধকি ঋণের পুরোটাই শোধ করা যেত ১৯২৩ সালের একটি পত্রিকার মূল্য দিয়ে। লাতিন আমেরিকায় ৩০ বছরের মর্টগেজ এখনো প্রায় নিষিদ্ধ। মূল্যস্ফীতির অমোঘ টানেই বাংলাদেশে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের জন্য পাগলপারা হয়ে ছুটতে দেখা যায় অনেককে। ... ...
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমি এক আবাসন কারখানায় বসবাস করছি। যেখানে তাকাই সেখানেই আবাসন ব্যবসা, প্রতি মুহূর্তে জন্ম নিচ্ছে এই ব্যবসা। যাঁরা বাপ-দাদার কাছ থেকে সম্পত্তি পেয়েছেন, তাঁরা তো আছেনই, পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, উকিল, ইমাম, আমলা—সবাই নেমে পড়ছেন এই ব্যবসায়। কিছুদিন আগে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে গিয়েছিলাম। কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে একটি প্লট কিনেছেন দুই বছর আগে, ফ্ল্যাট বানানোর জন্য এখন গৃহঋণ চাই তাঁর, বিস্তারিত শুনে বললাম, ‘স্যার, এসব ক্ষেত্রে তো গৃহঋণ হয় না, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার হলে করে দেওয়া যেত।’ প্রধান শিক্ষক মহোদয় উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘আমি তো ডেভেলপারই, আপনি আমাকে রিয়েল এস্টেট লোনই করে দিন।’ ... ...
বিশ্বজুড়ে সম্পদের একটি সাধারণ প্রবণতা হল, গরীবদের কাছে থেকে সেই ধনীদের কাছে চলে যাওয়া যারা ভোগ করে কম, যার স্বাভাবিক পরিণতি- প্রনোদণার অভাবে চাহিদায় বন্ধ্যাত্ব তৈরী হওয়া এবং ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে অর্থনীতির তলা ফুটো হয়ে যাওয়া। প্রখ্যাত ভারতীয় অর্থনীতিবিদ রঘুনাথ রাজন মনে করেন, করোনা মহামারী এ চিত্র কিছুটা হলেও পালটে দিয়েছে, চাহিদা এই মুহুর্তে এতটা পরিপুষ্ট যে, আয় ও সম্পদের সমতা কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে? ব্র্যাকের একটি গবেষনায় উঠে এসেছে, করোনা মহামারির আগে যেখানে ১ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বিমোচন হত, সেখানে করোনাকালে ৪ শতাংশ হারে নতুন দরিদ্র সৃষ্টি হয়েছে। স্পষ্টতই অর্থনৈতিক চাহিদার বলবর্ধক ঔষুধগুলো দরিদ্র জনগোষ্ঠির শরীর অবধি পৌঁছুতে পারেনি আমাদের দেশে। ... ...
আমেরিকান অর্থনীতির বিশাল মন্দার সময়ে তাঁকে হ্যাঙ্ক পলসন যা আদেশ করেছিলেন সেটাই বেরনানকে পালন করেন , তল্পি বাহক বা করণিকের মতন । বেরনানকে ব্যাঙ্কিং জগতে কোন গোলযোগের হদিশ পান নি। ২০০৫ সালের আগস্টে রঘুরাম রাজন সতর্কবাণী দিয়েছিলেন , কানে যায় নি । ২০০৭ সালের আগস্টে ফ্রান্সে ব্রিটেনে স্বল্প মেয়াদি আমানত প্রায় বন্ধ হলো। এর সঙ্গে ওয়াল স্ট্রিটের জুয়ো খেলার কোন সম্পর্ক তিনি দেখতে পান নি । অনেক খুঁজেও ব্যাঙ্কিং সুপারভিশন, অডিট , ইনসপেকশন নিয়ে বেরনানকের কোন মন্তব্য আমার চোখে পড়ে নি বরং হ্যাঙ্ক পলসন করেছেন। ... ...
এর নাম রান অন দি ব্যাঙ্ক ? ব্রিটিশ করদাতার টাকাকে উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ বলে বিলিয়ে দিয়ে কিছু কাউবয় ব্যাঙ্কার এবং তাদের ব্যাঙ্ককে বাঁচাতে চান নি মারভিন কিং। শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক বিবেচনার চেয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ বড়ো হয়ে উঠল । তবু মারভিন কিং লড়াই করেছিলেন তৎকালীন লেবার প্রধানমন্ত্রী গরডন ব্রাউনের সঙ্গে । বলেছিলেন আমি সরকারের আদেশে চলি না । আপনারাই ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন এই মাত্তর দশ বছর আগে । সেই সঙ্গে দেশের ব্যাঙ্কের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়েছেন আলাদা দফতর , ফাইনানশিয়াল সার্ভিসেস অথরিটিকে । তারা এতদিন কি করছিল ? দেখেনি স্বল্প মেয়াদের ধার নিয়ে লম্বা মেয়াদে মর্টগেজ দিয়েছে এরা । ভাবে নি বাজারি জমার (হোলসেল ডিপোজিট ) স্রোত বাজারি গুজবেরই কারণে শুকিয়ে যেতে পারে ? এই দেখাশোনার কাজটা এককালে আমরা করেছি, সাফল্যের সঙ্গে । ... ...