এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • কোনো এক গাঁয়ের কথা

    shrabani
    অন্যান্য | ২২ এপ্রিল ২০১০ | ১৫৯৪২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শ্রাবণী | 69.94.98.99 | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:৩৩449733
  • সকালে মিশনের নিত্য কাজকর্ম শুরু হয়েছে। আজ ছুটির দিন, প্রার্থনার পর ছেলেরা তাই মাঠে ক্ষেতে কাজ করছে। মহারাজদের একজন আছে তাদের সঙ্গে। অনঙ্গ ও ফনিভুষন শিবচরণকে নিয়ে যখন মিশনে পৌঁছল তখন বড় মহারাজ মন্দিরঘর থেকে সবে বেরিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে ভাঁড়ার ঘর থেকে চাল ডাল বার করা সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছে। দুটো রিকশা বোসপাড়ার কর্তাদের নিয়ে এসে উঠোনের একধারে দাঁড়াতে, সবাই সেদিকে তাকায়। এদের দেখে অবাক হলেও মুখে কিছু না বলে মহারাজ হাসিমুখে এগিয়ে আসে। সকলকে নিয়ে গিয়ে বারান্দায় পাটি পেতে বসায়।
    কথা ফনিভুষণই শুরু করে, সে সকলের বয়জেষ্ঠ্য তাই। সেই কোনকালে এখনকার মহারাজের মিশনে আসা থেকে তাকে দেখে আসছে, আগের বড় মহারাজের আমলে চাঁদাটাদা নিতে গাঁয়ে বাড়ি বাড়ি নিয়মিত আসত তখন।
    -"একটা দরকারী কাজে এই সাতসকালে তোমাদের কাছে আসা হে ।"
    ফনিভুষণ শুধু তার বাড়ির বা গাঁয়ের নয়, এদিককার সাত গাঁয়ের মাতব্বর ব্যক্তি। বড় মহারাজ বিনয়ে নুয়ে পড়ে,
    -"কত্তা, আপনারা নিজেরা এত কষ্ট করলেন কেন। আমাকে একবার ডেকে পাঠালে পারতেন।"
    ফনিভুষণ এমনিতে বেশ শান্ত নরম মানুষ, কিন্তু প্রয়োজনে বজ্রের মত কঠিন হতে পারে। এখন একটু শক্ত হয়েই বললে,
    -"ডেকে পাঠিয়ে কাজ হলে নিশচয়ই পাঠাতাম। কথা আমাদের তোমার সঙ্গে, তাই এই ছেলেদের আর তোমার অন্যান্য লোকেদের এখান থেকে সরে যে যার কাজে যেতে বলে দাও।"
    গণ্যিমান্যি লোকজন দেখে মিশনের সবাই কাজ থামিয়ে বারান্দায় উঠোনে চারপাশে ভিড় করে এসেছিল। ফনিভুষণের কথা শুনে বড় মহারাজ সবাইকে সেখান থেকে চলে যেতে বললে। সবাই চলে গিয়ে জায়গাটা খালি হয়ে শুধু রয়ে গেল কর্তারা আর মিশনের মহারাজ ও রবি।
    ফনিভুষণ সবার দিকে দেখে আবার বলল,
    -"তুমি তো মিশনে প্রথম থেকেই আছ, সেই যবে থেকে মেজ কর্তা বিপিন সামন্ত তোমার গুরুকে নিয়ে এসে এই হাটগাছিতে মিশন বা আশ্রম তৈরী করল। সামন্তদের বাড়ির রাখাল নিমাই তখন তোমাদের এখেনে কাজ ধরল। ভুল কিছু বললে আমার বয়স হয়েছে শুধরে দিও।"
    মহারাজের কিঞ্চিত ভ্যাবাচাকা খাওয়া অবস্থা। সে হাতজোড় করে বলে,
    -"না, আপনি এদিকের সবচে প্রাচীন লোক কত্তা, আপনি কেন ভুল বলবেন। কিন্তু আজ এসব কথা কেন, তাই তো বুঝতে পারছিনি।"
    -"কথা তো তেমন কিছু বলিনি এখনো যে বুঝতে পারবে, তবে শেষ হলে ঠিকই বুঝবে মনে হয়। এখন যা বলি শোনো। নিমাই হল আমাদের কানা পঞ্চুর ভগ্নীপতি। তার ছেলে হল মদন যে নিমাইয়ের বউ মরে যেতে এখানে মিশনে তোমাদের আশ্রয়ে থাকতে আসে। এখন সে শুনতে পাই বড় হয়েছে,লায়েক হয়েছে। আমরা সবাই জানতুম সামন্তদের অনেক গোলমেলে কাজকম্ম নিমাই করত। তা সত্বেও তোমরা নিমাইকে এখেনে কাজে রেখেছিলে। এখনো এই বাপবেটার তোমাদের এখেনে নিয়মিত যাতায়াত আছে।"
    মহারাজ চুপ করে ফনিভুষণের কথা শুনছিল। সে থামতে কী বলবে যেন বুঝতে পারেনা।

    -"আপনি তো এখানকার পুরনো লোক কত্তা। আপনি তো সবই জানেন, মেজ সামন্তকত্তার দয়াতেই চলত তখন মিশন। বকলমে তিনিই এই আশ্রমের কর্তা ছিলেন। আমি তো তখন কোনোকিছুতে ছিলাম না, গুরুর আদেশ অনুযায়ী কাজ করতাম। সে তো অনেককাল আগেকার কথা, এখন নিমাই বুড়ো হয়ে গেছে, এতকালের পুরনো লোক, আসে মাঝে মাঝে। মিশনে তো অনেকরকমের লোক আসে, সবার জন্যেই দরজা খোলা।"
    -"এতদিন আমি মুখ খুলিনি কিন্তু আর না খুললে চলছেনা। তুমি যখন সত্যিটা বলবেনা তখন আমিই বলি। পীরচকে শেঠেরা ছিল সামন্তদের এক নম্বরের প্রতিপক্ষ, মামলা মকদ্দমা খেয়োখেয়ি লেগে থাকত দু তরফে হামেশা।
    তোমার গুরু সুবিধের লোক ছিলনা, তাই তার বিপিন সামন্তের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল। নিজের দেশ থেকে পালিয়ে সে এখানে এসে ডেরা বেঁধেছিল। আমার ধারণা সামন্ত মিশন খুলেছিল অনেক ভেবেচিন্তে উল্টোপাল্টা কাজের জন্যে ভেক হিসেবে। বিপিন সামন্তের সঙ্গে শুধু শেঠেদের ঝগড়া ছিল তাই নয়, তার নিজের ভাই ভগ্নিপতিদের সঙ্গেও অনেক সমস্যা ছিল। সে ভালো লোক ছিলনা, কুলাঙ্গার ছিল এক রকম। নিমাই, তোমার গুরু সব তার হাতের অস্ত্র ছিলে শত্রুদের বিরূদ্ধে লড়াইয়ে।
    কিন্তু ভেক হোক আর যাই হোক, মিশনে ভালো কাজ হচ্ছিল, অনাথ আশ্রম, গরীবদের শিক্ষা ইত্যাদি, লোকে কিছুদিনের মধ্যেই মিশনকে শ্রদ্ধা ভক্তি করতে আরম্ভ করেছিল।
    এ অঞ্চলের কিছু ভালো লোকেরা মিশনের কাজে উৎসাহ ভরে যোগ দিয়েছিল। এতে অবশ্য তোমার গুরুর লাভ হয়, মিশনের সৎপথে আয় বাড়তে অসৎ কাজ থেকে যেসব টাকা আসত তার হিসেব মেলানো সহজ হয়ে গিয়েছিল। সেসময় শেঠেদের চুরি নিয়ে মিশনের লোকেদের ওপর তাই কেউ সন্দেহ করেনি।
    নিমাই পঞ্চুর নেশার দোসর ছিল, সেই সন্ধ্যেয় নেশা করতে গিয়ে শেঠেদের দোকানে টাকার কথা আর সবাই তাদের ছেলের না ফিরে আসা নিয়ে যে ব্যস্ত, দোকান অরক্ষিত পড়ে আছে, একথা নিমাইকে বলে ফেলে। নিমাই জানত সামন্ত সুযোগ খুঁজছে শেঠেদের লোকসান করার। মনে হয় সে তাই গিয়ে সবকথা সামন্ত আর মহারাজকে জানায়। মহারাজের বুদ্ধিতে রাতারাতি টাকা মাল সরিয়ে ফেলা হয় দোকান থেকে। এক ঢিলে দুই পাখি, শেঠেদের ক্ষতি করে সামন্তদের ব্যবসার রমরমা হয় আর তোমার গুরুরও নগদ লাভ হয়।
    সেসময় পরপর কতগুলো চুরি হয়েছিল, এই চুরিটাও তাদেরই একটা বলে ভেবে নেয় লোকে। মিশনের তখন যেরকম ভাবমূর্তি তাতে সেখানে এসে খোঁজ করার কথা সেসময় পুলিশ বা গাঁয়ের লোক ভাবতে পারত না।
    সামন্তদের পুরনো খাতাপত্র থেকে ঠিকানা বার করে বাঁকড়ো জেলায় তোমার গুরুর বাড়িতে খবর নিয়েছে পুলিশ থেকে, সেখানে তার ছেলেদের বিরাট অবস্থা, সবই নাকি তাদের বাবার বিদেশের রোজগারে। আর সে বড় মহারাজ তো শুধু তোমার গুরুই ছিলনা তোমার মামাও ছিল যেমন এই ছেলেটি রবি,এখন যে তোমার শাগরেদ সে আসলে তোমার ভাগ্নে। মহারাজের বাড়ি থেকেই সব খবরাখবর পেয়েছে পুলিশ।"

    ফনিভুষণ একটু থামতেই মহারাজ হু হু করে ওঠে,
    -"সেসব যবে হয়ে গেছে,গেছে, সে তো অনেকদিনের কথা। তাতে আমার কোনো হাত ছিলনা কত্তা। সব মামার আর সামন্ত কর্তার কাজ। আমি এসবে কখনো থাকিনি। এখন ওসব কিছু হয়না। আমরা মিশনে খেটে খাই, গাঁয়ের ভালো করার চেষ্টা করি।"
    -"তাই নাকি? রাধামাধবের মন্দির চুরির দুদিন আগেও মদন মিশনে এসছিল, সেখান থেকে পঞ্চুর ওখেনে রাতে থাকতে গেসল। মন্দির চুরি, তারপরে লোকে যখন মন্দির নিয়ে ব্যস্ত থাকবে তখন গদিতে চুরি এসব নিমাই মুখ্যু আর তার বেটার মাথা থেকে বেরিয়েছে বলতে চাও? তোমাদের কোনো হাতই নেই তাতে?"

    কথায় সবাই এত মগ্ন ছিল যে কেউ খেয়াল করেনি কখন রাম দারোগা এসে দাঁড়িয়েছে। মহারাজ ফনিভুষনের কথার উত্তর দেবার আগেই সে এগিয়ে আসে, নিজের বাবার দিকে একবার তাকায়, সে দৃষ্টিতে সায় দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
    -"জ্যাঠা, নিমাই আর মদনকে আমরা থানায় ধরে এনেছি। প্রথমে ওরা স্বীকার কচ্ছিলনা তারপর বগা এসে মদনকে শনাক্ত করতে তখন সব স্বীকার করে। মজিদ কামারটাও দলে আছে। সে ঘর থেকে পালিয়ে এই মিশনে ছিল, ওটাকেও আজ সকালে হরিপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে ধরেছি। এবার এই মহারাজদের নিয়ে যাব।"
    রামের কথায় বড় মহারাজ চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে চারদিকে পুলিশ, তখন কেমন একখানা হাল ছেড়ে দেওয়া গলায় বলে,
    -"মিশনে আমরা সবাইকেই আশ্রয় দিই, সে কেমন লোক দেখিনি। এখানে তো দিনে রাতে অনেকেই আসে। এর জন্যে আমাদের দোষ দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে কত্তা?"
    ফনিভুষণ এবার আস্তে আস্তে উঠে পড়ে, যা করার এবার রামই করবে।
    -"তোমার আশ্রমের খোলা দরজা দিয়ে তো সব মহাপুরুষরা আশ্রয় নিতে আসে দেখি হে। চোর, চোরেদের স্যাঙাত কামার। তাদের উদ্ধারের জায়গা নাকি মিশন?
    তা, সে তুমি তাদের উদ্ধার করতে চাও ভালো কথা, তবে অন্য জায়গা দ্যাখো। এখানে এসব চলবেনা। এখানে অনেক ভালো কাজ হয় বলে তা দিয়ে কি খারাপ কাজ ঢাকা যায়?
    আমরা এই জন্যে এলাম নাহলে সাতগাঁয়ের লোক ভুল বুঝবে, ভাববে পুলিশ এসে মিশনের সাধুদের ওপর অকারণ অত্যাচার করছে। এখন রাম এসে গ্যাছে, যা তার করণীয় সে করবে, আমরা গাঁয়ের লোকেদের যা বোঝাবার বোঝাব। তুমি ভেবে নাও এখন কী বলবে পুলিশকে। তোমার বাপু গেরো এখন ফসকা, আঁটুনি আর নেই, নিমাই মদন সব ধরা পড়ে গেছে, পঞ্চু সাক্ষী দেবে।
    তোমার গুরু আর বিপিন সামন্ত মরে গিয়ে রেহাই পেয়েছে, তোমাকেই তাদের কর্মফলের ভার বইতে হবে, যেমন এতদিন লাভের ভাগ ভোগ করেছো। লাভের কথায় মনে হল,তোমাকে একটা কথা জানিয়ে দিই, কার বুদ্ধি জানিনে তবে সেই কুটোর বস্তাটা এখন বোসেদের পাড়ার হামারে। সেটা কাল রাতে তোমার মদন পায়নি। তাই ভেবোনা যে জেল থেকে বেরিয়ে এসে মালপত্র উদ্ধার করে আবার অন্য কোনোখানে মিশন খুলে বসবে মামার মত। আর এই মিশনও থাকবে, আমরা গাঁয়ের লোকেরা চালাব, যেসব নিরপরাধ ভালো লোকেরা আছে তারা থাকবে। শুধু মিশনের আড়ালে তোমাদের ব্যবসাটি আর চলবেনা।"

    মহারাজের আর তার পাশে দাঁড়ানো রবির মুখ এবার বুকের ওপর ঝুলে পড়ে।
    আর কিছু না বলে ফনিভুষণ দাঁড়িয়ে থাকা রিকশার দিকে এগিয়ে যায়, পিছু পিছু বাকিরা। শুধু রাম দারোগা আর তার চেলারা রয়ে যায়, তাদের কাজ তখনো বাকী!
  • শ্রাবণী | 69.94.98.99 | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:৪৮449734
  • পরদিন সন্ধ্যেবেলায় সরীঠাকুমার ঘরে আগের দিনের মত ওদের কজনের জমায়েত হয়েছে, জগ বংশী কড়িরাম বিষ্টু। "পিসীমা পুরো গল্পটা বল, পুরোটা শুনব।"
    জগর মধ্যে আর সেই সরীঠাকুমাকে পাত্তা না দেওয়া ব্যাপারটা নেই। যদিও তারও একটা ভূমিকা আছে পুরো ঘটনাতে তবু তার কাছে সবকিছু এখনো পরিস্কার নয়।
    পঞ্চুর পিছু নিয়ে সে সেদিন পাকুড়তলায় পঞ্চুর বোনের বাড়ি পৌঁছে যায়। মাঠের ধারে একটেরে বাড়ি, সেখানে গিয়ে নজর রাখতে রাখতে সে মিশনের রবি মহারাজকে সেখান থেকে বেরোতে দেখে। রবিকে সে খুব পছন্দ করে, তার সম্বন্ধে কোনো সন্দেহই নেই ওর মনে তবু ও তার সামনে যায়না। পুকুরধারে ঝোপের আড়াল থেকে মদনদের বাড়ির ওপর নজর রাখে।
    পঞ্চুর সঙ্গে নিমাইদের কথা কাটাকাটি হচ্ছিল কিছু একটা নিয়ে। কিছুক্ষণ পরে পঞ্চু বেরিয়ে ফেরার পথ ধরলেও, জগা ঠিক করে ও নিমাইয়ের বাড়ির ওপর নজর রাখবে। সারাদিন ওখেনেই বসে থাকে, খিদে পেলে পুকুরপারের গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে খায়। দুপুরবেলা দেখে মদন বাড়ি থেকে একখানা ঝুড়ি চাপা দেওয়া কিছু নিয়ে বেরিয়ে ময়রাপুকুরের দিকে যাচ্ছে। জগও তার পিছু পিছু যায়। অনেকটা যাওয়ার পর একটা পোড়ো শিবমন্দির আছে সেখানে গিয়ে মন্দিরের লাগোয়া মাটির ঘরে তালা খুলে ঢুকল। কিছুক্ষণ পর মদন ঘর থেকে বেরিয়ে ফেরার পথ ধরলেও জগ রয়ে যায় সেখানে। মদন চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে ও অনেক চেষ্টা চরিত্র করে চালের খড় সরিয়ে দেখে, ঘরে একটা লোক। ঘরটার দেওয়াল যদিও পুরু মাটির, চালের বাতার বাঁধনি অত মজবুত ছিলনা। বাতা সরিয়ে জগ ঘরের মধ্যে লাফ দেয়, ঘরে বাঁধা ছিল বগা চোর। মদন তাকে ভাত দিতে এসছিল।

    মন্দির চুরির রাতে বগা বোসপাড়াতে চুরি করতে এসেছিল, ঠাকুরপুকুরের পাড়ে বগাকে হঠাৎ দেখে মদনরা প্রথমে রাধামাধবদের মূর্তি সব ফেলে দেয় ভয়ে। ওদিকে বগাও ধরা পড়ে গেছে ভেবে দৌড় দেয়। বগাকে দৌড়তে দেখে মদনরা তার পেছনে দৌড়য়। গয়না ইত্যাদি সব আগে মন্দিরে খুলে ঝোলায় ভরে নিয়েছিল বলে সেগুলো সঙ্গে থেকে যায়, মূর্তিগুলো রয়ে যায়। মদনের বয়স কম, সে দৌড়নোয় অনেক বেশী পটু। এদিক ওদিক আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে ছুটে সে বগার আগে গিয়ে বগাকে ধরে এবংত আকে কাবু করে।
    বগা মদনকে চিনত না, মদন আর নিমাই মিশনের বাঁধা চোর তাদের অন্য চোরেদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। বগাকে ধরে নিয়ে এসে তারা পোড়ো শিবমন্দিরের ঘরে বন্ধ করে রাখে। এদিকে বগার বাড়ির লোকে খোঁজও করেনা, একে তো বিষয়কর্মের জন্যে তার বাড়ি যাওয়া আসার কোনো ঠিক থাকেনা,তায় তার শ্বশুরবাড়িতে শালীর বিয়ে, বউ আজকাল সেখানে।মদনরা হয়ত পরে বগাকে ছেড়ে দিত, মালপত্রের ভাগটাগ হয়ে গেলে, নিজেরা কিছুদিন গা ঢাকা দিত। বগা চোর, সে নিশচয়ই পুলিশের কাছে যাবেনা। তবে ঐদিন তাকে ধরতে হয়েছিল কারণ আসল চুরিটা তখনও বাকী ছিল।
    সেই গল্পটা জগ শুনতে চায়, সেইসঙ্গে পীরচকের শেঠেদের দোকানের পুরনো বৃত্তান্তটাও।
    এদিকে এরাও জগর গল্পটা ভালো করে শুনল সবাই। বিকেল হলে জগ আর বগা সেই চাল দিয়ে বেরিয়ে হাটগছির রাস্তা না ধরে এদিক ওদিক ঘুরপথ দিয়ে হরিপুর পৌঁছয় তারপর থানায় গিয়ে রাম দারোগাকে সব জানায়।

    সরীঠাকুমা কিছু অনুমান আর কিছু শিবচরণের কাছে থানার যা খবর জানা গেছে তাই মিলিয়ে ওদের বাকী কাহিনীটা বলে। মদন মাঝে মাঝে পঞ্চুর কাছে আসত এখান ওখানের খবর নিতে। পঞ্চু মিশনের মহারাজদের ও সামন্তদের ব্যাপারটা জানতনা কিন্তু এটা জানত যে নেশার ঝোঁকে ওর মুখ থেকে খবর পেয়েই পীরচকের শেঠেদের দোকানের সেই বিরাট চুরিটা হয়েছিল, এবং যেহেতু নেশার আসরে নিমাই ছিল, কোনোভাবে নিমাই চুরিটার সঙ্গে যুক্ত।
    নিমাই ওদিকে সেই প্রথম থেকেই ওকে ব্ল্যাকমেল করত এই বলে যে সে সবাইকে বলে দেবে যে দোকানের টাকার খবর পঞ্চু দিয়েছে, পরবর্তীকালে মদনও ওকে এই ভয়টা দেখিয়েই এদিক ওদিকের খবর নিত, চুরি করতে।
    আগের মহারাজ মারা যাবার পর থেকে নিমাই আর মিশনে থাকতনা। যদি কোনোভাবে কেউ ওকে সন্দেহও করে তবু মিশনের সঙ্গের যোগসূত্রটা যেন ধরা না পড়ে তাই।
    তা ঐসব খবরাখবর নেওয়ার জন্যেই মদন মাঝে মাঝে রাতে পঞ্চুর কাছে আসতে।
    কিছুদিন আগে এরকমই সদরের পাশ দিয়ে খামারে চালাঘরের দিকে যেতে গিয়ে ও সরকারমশাই আর ভুজঙ্গের কথায় জানতে পারে টাকাপয়সা আদায়ের ও সদরে যাওয়ার পরিকল্পনা। বেশ বড় দাঁও হিসেবে ও বাপের সঙ্গে এবং মহারাজের সঙ্গে আলোচনা করে। এমনিতে দোকানঘরে সারাদিন রাত লোক থাকে, হয়ত টাকা থাকবে যখন বেশী বেশী পাহারা হবে। সেইসময় যতদুর সম্ভব মহারাজ বা রবির মাথা থেকে এই মন্দির চুরি করার আইডিয়া আসে।
    নিয়মিত যাতায়াতে মদন জানত যে মন্দিরের চাবি সরকারমশাইয়ের ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো থাকে। সে ঘরও খোলাই থাকে সারাদিন। মন্দিরে চুরি করা সবথেকে সহজ কারণ সেখানে চুরি হতে পারে এই ধারণাটাই কারুর মনে নেই। ঐ চাবির ছাপ নিয়ে নকল চাবি বানানো সোজা, নাহলে চাবি আগে থেকে চুরি করলে সেটা জানাজানি হয়ে লোকে সাবধান হয়ে যেতে পারে, চুরির আগেও চাবি নেওয়া যাবেনা, রাতে ঘর বন্ধ থাকে।
    চাবির ছাপটা কোনোসময় নিয়ে নেয় মদন, সারা দিন দুপুর বিকেল ঘর খোলা থাকে। যে রাতে বংশী লোক দেখেছিল সে রাতে মদন এসেছিল, সেদিনই চাবির ছাপ নিয়ে গেছিল হয়ত।

    মজিদকে দিয়ে চাবি বানায়। মজিদের নিয়ম হল সে চুরির বৃত্তান্ত না জেনে এরকম চাবি বানায় না। মজুরি নেয় না সে, তার চুরিতে ভাগ থাকে। দুখে কামার সুলতানপুরে তার খোঁজে এসেছে পূব গাঁ থেকে শোনা মাত্র সে বেপাত্তা হয়ে যায়, প্রথমে অবশ্য পুকুরপাড়ে দুখেকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে। সে যে বাড়িতে কিছুক্ষণ আগেও ছিল তা দুখে পরে বুঝতে পারে। মধু কামার যখন হাপরের আগুনে তার বিড়ি ধরিয়ে দেয়, দুখের মনে পড়ে যায়, মজিদের বাবাও হাপরের আগুনে বিড়ি ধরিয়েছিল। যে কামার সকাল থেকে হাটে গেছে তার কামারশালায় হাপর জ্বলবে কেন সেদিন!

    ওদিকে আদায়ী টাকা এসেছে গদিতে, সেই রাতেই মন্দির চুরি হল। ওরা ঠিকই ধরেছিল যে রাধামাধবের মন্দির চুরি হলে বোসেদের সব্বাইকার জীবনযাত্রাই থেমে যাবে। শুধুমাত্র মূর্তি গুলো নিয়ে যায়নি বলে সবকিছু একদিনেই স্বাভাবিক হয়ে যায়, নাহলে আরো সময় পেত ওরা মনের সুখে গদিতে চুরি করে বামাল সরিয়ে বিলি বন্দোবস্ত করার। কিন্তু বগার জন্যে মন্দিরের চুরিটা আধা খ্যাঁচড়া হয়ে রয়ে গেল। তবু যেটুকু সময় পেল তাতেই তাদের কাজ হয়ে যায়।
    মন্দির চুরির জিনিস এবংটাকা সব একসাথে করে বস্তায় ভরে মদন একফাঁকে এসে অনঙ্গ বোসেদের কয়লাঘরে রেখে গেল। সেদিন দিনেরাতে অনেকেই এসেছে পাড়ায় চুরি দেখতে, জন মজুর বেপাড়ার লোক, কেউ খেয়ালও করেনি, বস্তা মাথায় মুনিষ কেউ এসে কোথায় যাচ্ছে। সারা তল্লাট তল্লাশি করলেও পুলিশ নিশ্‌চয়ই যাদের চুরি হয়েছে তাদের বাড়ির কয়লাঘরে চোরাই মাল খুঁজতে যাবেনা!

    পঞ্চু এব্যাপারে সঠিক জানতনা কিন্তু মদনকে সে দেখেছিল পাড়ায় আসতে তাই সন্দেহে সে পরদিন সকালে রায়েদের ভেতর ঘরে ঢুকেছিল। হাজারি তাকে দেখেছিল ভেতর থেকে আসতে, তবে মনে হয়না পঞ্চু বুঝতে পেরেছিল চোরাই মাল কোথায় আছে।
    ঘুঁটের ব্যাপারটা না হলে হাজারিও কুটোর বস্তাটা নজর করত না। তবে সরীঠাকুমা প্রথমে না কান করলেও পরে কেমন মনে হয়েছিল তার যে ঐ কুটোর বস্তাটায় কিছু থাকলেও থাকতে পারে।
    তল্লাশি টল্লাশি সব শেষ হলে মদন আবার বস্তা সরিয়ে পঞ্চুর ঘরে রেখে দেয়। মিশনে চোরাই মাল রাখবেনা আর তাদের ঘরেও নিয়ে যাওয়ার সাহস নেই, যদি কোনোভাবে কারো নজরে পড়ে যায়। এমনিতেই বগাকে আটকে রাখতে তাদের খুব অসুবিধে হচ্ছিল, তারা ইচ্ছেমত কোথাও যেতে পারছিল না। পঞ্চুর চালায় কেউ কোনোদিন যায়না, অনেক আজেবাজে জিনিসপত্র পড়ে থাকে আর সবচেয়ে বড় কথা পুলিশ প্রথম দিনেই সেখানে আশ মিটিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে গেছে। মদন স্বীকার করেছে সে ঐদিন যে মজুররা গোয়ালের চাল ছাইতে এসেছিল তাদের দলে ভিড়ে যায় সে। কড়িরাম আর বিষ্টুকে সে রাতে বেশী খুঁজতে হয়নি, ওরা পঞ্চুর ঘর থেকে বস্তা নিয়ে এসে ঠাকুমার হামারে তুলে দেয়।

    সনাতন বগার ব্যাপারটা কড়িরামকে জানায়, তখন থেকেই তারা বগার খোঁজ করছিল। পচা ওদিকে মিশনের কাছে সাইকেলে মজিদকে দেখে, সেও অন্যান্য ছেলেপিলের মত মিশনে যায় মাঝে মাঝে এবং কখনো মজিদকে দেখে থাকবে। হরিপুর যাচ্ছে বলে মুহূর্তের মধ্যে লোকটা উধাও হয়ে গেল, কাছেপিঠে মিশন ছাড়া আর কিছু নেই। পচার সন্দেহ হয় না কিন্তু সে যখন সনাতনকে গিয়ে কথাটা বলে সনাতনের খটকা লাগে। সে আড়াল থেকে মিশনের ওপর নজর রাখে এবং মজিদকে দেখে, মজিদকে সে ভালোই চিনত। এমনিতে এদিককার চোরেদের কিছুটা সন্দেহ ছিল যে মিশনে মাঝে মাঝে গোলমেলে লোকেরা আসে, উল্টোপাল্টা কিছু হয় তবে তারা সাহস করে কোনোদিন মুখ খোলেনি। আসলে স্বয়ং মহারাজরা যে নিমাই মদনের মত চোরেদের মহাজন সেটা এরা ধারণা করতে পারেনি।

    থানায় খবর দিলে রাম দারোগা মজিদ কে ধরে। মিশনের মহারাজদের ব্যাপারে খবর নিতে, মজিদকে ধরতে পুলিশকে সব জানাতে হত কিন্তু রাম কে এমনি ডেকে বললে সে কড়িরামের মত চোরেদের বা সরীঠাকুমার কথা হয় শুনবেনা নয় হাঁকডাক করে সব পন্ড করে দেবে।
    তাই ঠাকুমা আর কড়িরাম মিলে ঠিক করে সবকথা রামের বাবা শিবচরণকে জানিয়ে তাকে দলে নেবে এবং বাবা বললে রাম চুপচাপ তাদের কথামত কাজ করবে। তাই সকালে শিবচরণ যখন হাঁটতে বেরোলো, তখন কড়ির জামাই গিয়ে তাকে ঠাকুমার বার্তা দিল। শিবচরণ বুদ্ধিমান ব্যক্তি, সব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে রাম দারোগাকে যা করতে হবে সেইমত করাতে থাকে।
    মিশনের ব্যাপারটা যখন বোঝা হয়ে গেছে, চোরাই মাল পাওয়া গেছে তখনও বগাকে না পাওয়া গেলে কোনো প্রমাণ এদের হাতে ছিলনা। সবাই বগার অপেক্ষায় ছিল। বগাকে নিয়ে জগ রামের কাছে আসতেই খবরটা রাম শিবচরণকে জানায়। তখন সরীঠাকুমা সবাইকে নিয়ে ফনিভুষনের কাছে গিয়ে তাকে আর অনঙ্গকে সব কথা বলে।
    অবস্থা পড়তি হলেও মিশনের প্রতিষ্ঠাতা সামন্তদের প্রতিপত্তি এখনো ভালৈ, মিশনের মহারাজদের ওপর এত বড় অভিযোগ আনলে লোকে চট করে বিশ্বাস করতে চাইবেনা, সামন্তরাও ছেড়ে দেবেনা বিশেষ করে শেঠেদের চুরির ব্যাপারটাতে তাদের বাড়ির লোকের নামও জড়িয়ে পড়ে যদি। তাই ঠিক হয় পুলিশ গিয়ে মহারাজদের গ্রেফতার করার চেয়ে আগে ফনিভুষণদের মত বিজ্ঞ মাতব্বররা গিয়ে ওদেরকে কোনঠাসা করবে যাতে ওরা বেশী ঝামেলা না পাকাতে পারে, সোজাসুজি দোষ স্বীকার করে নেয়।
  • শ্রাবণী | 69.94.98.99 | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:৫৮449735
  • *************************************
    সব শোনার পর সবার চোখে জগর জন্যে প্রশংসা, সেই বগাকে খুঁজে বার করেছে। গাঁয়ের লোকেরাও খুব বলছে জগর কথা। ইস্কুলের বটুকবাবু বলেছে জগকে একখানা মেডেল দেবে। এমনকি কাল সারাদিন বাড়ি ফেরেনি তবু রাতে সব কথা শুনে ওর বাবা বেধড়ক দেয়নি, বরং একটু প্রশ্রয়ের সুরেই কথা কয়েছে। জগ এবার পঞ্চুকে আগে যে প্রস্তাবটা দিয়েছিল সেটাই সরীঠাকুমাকে দেয়,
    -"ও ঠাকমা, তোমার তো চোর ধরায় খুব বুদ্ধি। চলনা তুমি আমি আর বংশী মিলে একটা গোয়েন্দা এজেন্সী খুলি। এই কড়িজ্যাঠা আর সনাতন দাও আমাদের সাহায্য করেবে।"
    সরী ঠাকুমা পাশে রাখা লাঠিটা তুলে এক বাড়ি মারতে যায় জগর মাথায়।
    -"অলপ্পেয়ে, যত বদবুদ্ধি মাথায়। আমার কাজের শেষ আছে? এই কদিন চাদ্দিকে তেমন করে দেখতে পারিনি তাতেই পাড়াময় অনাচার। কাল শুনলাম ধম্মদাসের ছোট ছেলেটার বউ শাশুড়ী খাওয়ার আগে নিজে খেতে বসে গেছল আবার শাশুড়ীকে শেষপাতে তেঁতুলছড়ার সঙ্গে গুড় দেয়নি।
    পল্টনের বোন আর অজিতের মেজো মেয়ে একা একা ধর্মতলায় গিয়ে চাটুজ্যে পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে আড্ডা মারছিল। আমি না খেয়াল করলেই পাড়ার এই কমবয়সী মেয়েবউগুলো বেয়াদবী শুরু করে দেয়। ঘরে গিয়ে ভালোকরে কাজকম্ম কর মন দিয়ে, বাবাকে সাহায্য কর। যার যা কাজ তাকে তাই সাজে, বুঝলি? কড়ি সনাতনের চোর ধরে বেড়ালে চলবে, তাহলে চুরি করতে শেখাবে কে? চোরেরা জানতে পারলে ওদের কাছে আর আসবে টেনিং না কী বলে সেই নিতে?"
    জগ আর বংশী মুখ চুন করে মালপো খেতে খেতে বেরিয়ে গেল, অবশ্য গোয়েন্দা এজেন্সী তারা খুলবেই, বংশীর চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে দুজনের সেই পরামর্শই হতে থাকে।

    নিমাই মদন আর মহারাজদের দুজনকে সদরে চালান করে দিয়ে রামচরণ থানায় বসে ছিল। এই প্রথম এত বড় দুটো চুরির কেস এত তাড়াতাড়ি মিটে গেল তবু তার মনে সুখ নেই। গাঁঘরে কথা বাতাসে ভাসে, সবাই জেনে গেছে আসলে কাদের জন্যে চোর ধরা পড়েছে। তার ছেলে আজ সকাল থেকে বন্ধুর সঙ্গে গোয়েন্দা গোয়েন্দা খেলছে, একজনের নাম হয়েছে জগ আর একজনের বংশী।
    বউ আর মা দুজনে সরী ঠাকুমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, বড়বাড়ির মেয়ের ব্যাপারই আলাদা, এই বয়সেও এমন বুদ্ধি, বেটাছেলেদের হার মানিয়ে দেয়।
    সকালে বাজার যাওয়ার পথে সব এক এক করে থানায় এসে গল্পটা শুনতে চাইছে কিন্তু তাদের কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেরাই সব বলে যাচ্ছে।
    এমনকি হেডমাস্টার বটুক বাবুও আজ রাস্তায় বাজার না করে বাজারে গেছিল আর যাওয়ার পথে থানায় এসে দুগ্গাপুজার পালাগানের মত করে পা ঘুরিয়ে বলে গেল, "চন্দ্রচূড়চরণ চিন্তিয়া নিরন্তর, ভবভাব্য ভদ্রকাব্য ভণে মহেশ্বর, ভবের ভৈরবী ভবানী বানী বানী স্মরণে"।
    এর মানে কী রাম জানেনা কিন্তু তাকে কটাক্ষ করে কিছু বলা হল সেটা বুঝতে পেরেছে সে। কাল চোরেদের ধরার সময় সে বেশ খুশীমনেই ছিল কিন্তু আজ তার সুবিধের মনে হচ্ছে না। পচা বগা এইসব চোরেরাও তার থেকে বেশী গুরুত্ব পাচ্ছে মনে হচ্ছে। যে গাঁয়ে চোরেরা পুলিশের কাজ করে নাম কিনছে সে গাঁয়ে থাকা যায়!

    কাগজ আর পেন নিয়ে বদলির দরখাস্ত লিখতে শুরু করেছে এমন সময় মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। গাঁয়ের সব মাতব্বরেরা ঢুকছে, বোসবাড়ির কত্তারাই প্রধান তাদের মধ্যে, তার বাবা শিবচরণও আছে সঙ্গে। কিন্তু কী আশ্চর্য!
    আজ আর কেউ রামকে তার কাজের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে তাকে ঠিকপথে চালিত করার চেষ্টা করল না। বরং সবাই একবাক্যে তার ভূয়সী প্রশংসা করতে থাকল, সে কত করিৎকর্মা, গাঁয়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে মিলেমিশে এতবড় চুরির সমাধান করল। শিবচরণও তাকে কোনো বকাবকি না করে বেশ একটা প্রশান্তির ভাব মুখে নিয়ে সবার মুখে ছেলের প্রশংসা শুনতে লাগল।
    রাম অভিভূত, সবার জন্যে চা আর বাদুর তেলেভাজা আনতে দিল দুখনকে। চা চপ খেয়ে সবাই চলে গেলে সে দরখাস্তের কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে উঠল, একবার বোসপাড়ায় সরীঠাকুমার বাড়ি যেতে হবে!

    ঠান্ডাটা আস্তে আস্তে জাঁকিয়ে পড়ছে, নগেন পাড়ুই পরদিন থেকে আর অত ভোরে পুকুরে চান করতে যাচ্ছেনা। এছাড়া আরো একটা কারণ আছে যদিও সেটা সে কাউকে বলেনি, আবার যদি কিছু হয় তাই দখিনমাঠে লোক চলাচল শুরু হলে তবেই সে চানে যায়।
    কর্তাদের হস্তক্ষেপে কানা পঞ্চুর আর কোনো শাস্তি হয়নি, এতবছর ধরে সে অনেক সয়েছে। চুরির ব্যাপার আন্দাজ করে সে চোরাই মাল উদ্ধার করার জন্যেই যে ভাগ্নের বাড়ি গিয়েছিল সেটা সবাই বুঝেছে। বোসপাড়াতে সবাই মিলে ঠিক হয়েছে এক এক বাড়ি থেকে একেকদিন রোজ দুবেলা খাবার দেওয়া হবে কানাকে। খাওয়ার জন্যে তাকে আর দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হবেনা।
    হলে কী হবে, পরদিন ভোরে পঞ্চু আবার বারোয়ারীতলায় গিয়ে কাশতে কাশতে "একবার বিদায় দে মা" গেয়ে ভিক্ষে করেছে। আর লোকে আজকাল যেন ভিক্ষেটা একটু বেশী দিচ্ছে, কেউ আর কানাকে গালমন্দও করেনা এখন আর।

    বিনয় বামুন এখন রোজ রাতে রাধামাধবের মন্দিরের সামনেটা ঘিরে সেখানে শুয়ে থাকে। মন্দিরে এখন বিলিতী তালা, কোলাপসিবল গেট।
    দুপুরের আড্ডায় মেয়েরা সবাই সরীঠাকুমার কাছে রোজ একবার মন্দির চুরির গল্প শোনে মানে শুনতেই হয়! অবশ্য এ নিয়ে কারুর কোনো অভিযোগ নেই, ঠাকুমাকে এখন পাড়ার মাতব্বরেরা তো বটেই গাঁয়ের লোকেও সমীহ করে চলে বেশী বেশী।
    রাধামাধবের গয়নাগুলো সব পাওয়া গেলেও তাদের আবার একবার পালিশ করিয়ে তবেই ঠাকুরকে পরানো হয় আর ফনিভুষণ আজকাল আর ঘুমের জন্যে আপিমের খোঁজ করেনা, কেন কে জানে!

    গাঁয়ের ক্থা ফুরোলো.........................
  • nina | 78.34.167.250 | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২৩:০৮449736
  • এই ডিজাইনের চটিজোড়া চাই----

    এমন লেখা বাংলা সাহিত্যের আজ প্রয়োজন---পূজোসংখ্যাগুলোর অবনতি দেখে প্রাণ কাঁদে----আর এমন অমূল্য রতন আছে আমাদের ভান্ডারে
    গুরুর পূজোসংখ্যা চালু হোক--অনুরোধ জানিয়ে গেলাম---
  • 4z | 109.227.143.99 | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২৩:২১449737
  • আহা … শ্রাবণীদি টুপি খুল্লাম।
  • kumu | 132.161.242.141 | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০০:০৩449738
  • বড় আনন্দ পেলাম,জয় হোক শ্রাবণীর।
  • | 24.96.14.235 | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২০:৪৮449739
  • বাঃ বাঃ সুন্দর ডিটেইল
  • san | 24.96.91.141 | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২১:১৩449740
  • শ্রাবণীদি ফুলটাইম লেখেনা ক্যানো ? ঃ-০
  • de | 190.149.51.68 | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১৬:১২449741
  • সত্যি, শ্রাবণীর লেখা যেন এবারের গুরুর পুজোর উপন্যাস! শ্রাবণী তোমার রহস্য উপন্যাসগুলো একসাথে বই করে বার করো কোথাও -- ভারী সুন্দর লেখার হাত তোমার! মন ভরে গেলো!
  • i | 134.168.47.148 | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১৬:৫৬449743
  • হুঁ। শ্রাবণীর এযাবৎ নেটে প্রকাশিত সব লেখা একত্র করে বই বের করা হোক গুরুচন্ডালি প্রকাশন থেকে। এবছর-ই?
  • Blank | 180.153.65.102 | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২১:১৪449744
  • ব্যপক ব্যাপক।
  • aranya | 154.160.226.53 | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২১:২১449745
  • আম্মো সুর মেলাচ্ছি, আগে বলেছিলাম আবারও বলছি, বই আকারে বের হোক, গুরু-র তরফ থেকে।
  • | 60.82.180.165 | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২১:৩৮449746
  • খুব ভালো লাগলো।
  • শ্রাবণী | 127.219.176.36 | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২১:৩৫449747
  • সবাইকে পড়ার জন্য থ্যাঙ্ক স। যতই নির্বিকার থাকার কথা ভাবি, লিখে কেউ পড়লে ভালোই লাগে আর উৎসাহ দিলে তো আর কথা নেই , এই শেষ আর না প্রতিজ্ঞা করেও, আবার কিবোর্ড খুলে বসে যাই।
    স্যান, ফুলটাইম তো দুর আমি হাফ টাইম ও সময় পাই না। টেস্ট প্রসিজিওর ফাইন্যাল করার মাঝে এটা শেষ করলাম আর এখন এই ঝুমরিতলাইয়াতে বসে সকাল থেকে রাত্তির টেস্ট করছি, ফোন নেট সবকিছুই কালেভদ্রে চলে, মর্জি মাফিক!:(((
  • aranya | 154.160.98.31 | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২৩:১৬449748
  • ঝুমরিতলাইয়া - খুব মিষ্টি নাম তো, কোথায় এই জায়গাটা?
  • aranya | 154.160.98.31 | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০০:১৯449749
  • বু গু-র লেখায় ছিল বোধ্হয়, বিহার বা এখনকার ঝাড়খণ্ডে, বড়ই সুন্দর জায়গা, মনে লয়।
  • শ্রাবণী | 127.219.176.36 | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৭:৪২449750
  • অরন্য,
    ঝুমরিতলাইয়া বলে জায়গা আছে বোধায় তবে কোথায় আমি ঠিক জানিনা!:)
    হিন্দিতে ঝুমরিতলাইয়া অনেকটা বাংলার ধ্যাদ্ধেরে গোবিন্দপুর টাইপের বা Godforesaken place অর্থে চলে, ওটা কথার কথা।
    আসলে আমি ছত্তিশগড়ের এক জায়গায় বসে আছি এবং তার নামটা শুনতে মোটেই ভালো না।
  • aranya | 154.160.98.31 | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৮:৩৩449751
  • নতুন একটা হিন্দী এক্সপ্রেশন শিখলাম, থ্যাংকু শ্রাবণী, আশা করি ধ্যাদ্ধেরে গোবিন্দপুরে বেশি দিন থাকতে হবে না :-) ।
  • kumu | 132.160.159.184 | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১২:০৮449752
  • রামু দারোগা-যাকে গ্রামের গুরুজনদের ভয়ে সর্বদা কাঁটা হয়ে থাকতে হয়,চোরেরা যাকে সাহায্য করে,দারোগা হয়েও যে বসার চেয়ার অব্দি পায় না-অবিস্মরণীয় চরিত্র।এই চরিত্রটিকে যেন পরেও দেখতে পাই।
  • ঐশিক | 213.200.33.67 | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১০:৩১449755
  • ওফফ পুরোটা আবার পেথ্ষম ঠিকে পড়তি হবেনে, মামুর কাছে এইটে পুজো সংখ্যা হিসেবে বের করার দাবি জানালুম। শ্রাবনিদী আফনে আরো ল্যাখেন নইলে আমরা পড়ব কি?
  • Sarbani | 236712.158.1234.161 | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১২:৫৮449756
  • কোনো এক গাঁয়ের কথা......

    উটকো লোক
    *************************************************
    শোবার ঘরের লাগোয়া গাছগাছালি ঘেরা দক্ষিনের একানে বারান্দাটা পাল মশায়ের বড় প্রিয় দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামস্থল। রোজ খাওয়াদাওয়ার পরে এখানে এসে আরামকেদারায় বসে বসে একপ্রস্থ দিবানিদ্রা সেরে নেয়।
    অবশ্য তার আগে গিন্নীর হাতে সাজা পান খেতে হয়। সারাদিনে এই একটি নেশা, দুবেলা খাওয়ার পরে দুটি পান। বছরকয়েক আগেও সিগারেট বিড়ি চলত ভালোই, দেদার।

    একবার কাশি ধরল এমন, নীলু ডাক্তারের কোনো ওষুধেই সারেনা। কেশে কেশে জেরবার, ঘুম খাওয়া সব মাথায় উঠেছিল। ঘোর আপত্তি সত্বেও ছেলেরানাতিরা শেষে নব্য ডাক্তার অরুন মিত্তিরকে ডাকল, গাদা টেস্ট মেস্ট করিয়ে, গুচ্ছের টাকা ধ্বংস করে সেও ফেল। শেষে ওই নীলুই উপায় বার করল, সিগারেট বিড়ি বন্ধ করে দেখা যাক। খুব কষ্ট হয়েছিল এতকালের নেশা ছাড়তে, কিন্তু গিন্নী আর গিন্নীর চেলাচামুন্ডাদের কড়া পাহারায় সে অসম্ভবও সম্ভব হল আর আশ্চয্যির বিষয় হল তিনদিনে তিনমাসের কাশি কোথায় উধাও। এরপরে আর কাউকে বলতে হয়নি, মহেন পাল নিজেই নেশা ছেড়ে দিল যে শুধু তাই নয়, গাঁয়ে সে আশেপাশে থাকলে কারুর আর ধোঁয়া ফোঁকার জো রইল না, চোখে পড়লেই হাতের লাঠির বাড়ি।

    ফাগুন শেষে পড়ন্ত বেলার হাওয়াটা বড় মোলায়েম, ঘুম ভাঙার পরেও অনেকক্ষন আবেশে চোখ বুঁজে থাকে। আরামকেদারাটা বিশাল, মহেনের দাদুর বাবার আমলের, নয় নয় করেও দেড়শ বছরের তো হবেই। পালকত্তা লম্বা মানুষ, পা ছড়িয়ে শুলে, বারান্দার শেষে খুঁটি অবধি পা পৌঁছে যায়। কে যেন পায়ে হাত দিল, নাকি পায়ে কী ঠেকে গেল, জ্যান্ত কিছু। আলসেমো এমনই যে চোখ বুজোনো অবস্থাতেই মহেন গলা ঝাড়ে, “কে রা”?

    চিঁহি স্বরে কেউ বলে ওঠে, “আমি কত্তা” ।

    চোখের পাতাদুটো টেনে খোলার চেষ্টা করে মহেন, খুঁটির কাছে কুঁকড়েমুকড়ে বসে থাকা একখানা চেহারা। রোদ্দুর পড়ে গেছে, বিকেল প্রায়, চারিদিক থেকে গাছের ডালপালার ছায়া পড়ে আধঅন্ধকার দুয়ার, চশমাটা হাতের কাছে নেই, ঠাহর হয়না ঠিকমত। ছিদাম না? ছিদেই তো, নাকি দাশু?

    -“কে তুই? চশমা ছাড়া আজকাল দেখি না তেমন। ছিদাম?”

    -“না কত্তা।“

    দিনে রাতে কত লোকই তো আসে তার কাছে, চেনা অচেনা, নানা বিষয়ে পরামর্শ নিতে, সাহায্য চাইতে। গাঁয়ের সবচেয়ে প্রবীণ সে, কাউকে ফেরাতেও পারেনা। চোখ বুজে আবার গা এলিয়ে দেয়,

    -“যা, দেরাজের ওপর থেকে চশমাটা নিয়ে আয় দিকি, তারপর তোর কথা শুনব।“

    কয়েক মিনিট আবার সব চুপচাপ, আর তারই পরে গিন্নীর বাজখাঁই গলার আওয়াজে নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান।

    -“এই এই , কে তুই? উটকো লোক, ঘরে ঢুকেছিস কী বলে? দেরাজ হাঁটকাচ্ছিস কেন, দিন দুপুরে চুরির মতলব, বলি ইয়ার্কি পেয়েছ?”

    মহেন নিশ্বাস ফেলে গা ঝাড়া দেয়, তারপরে গলা তোলে,

    -“ও গিন্নী, ওকে আমি পাঠালাম তো চশমা আনতে। ও চোর কেন হবে, বাউরিদের ছিদে তো !”

    এবার পালগিন্নী পায়ে দুমদাম আওয়াজ তুলে বাইরে আসে, একহাতে কত্তার চায়ের কাপ, অন্যহাতে চশমা। চাও আগে খেতনা, সেই কাশির অসুখটার পর থেকে আদা চা ধরেছে দু বেলা। গিন্নীর চেহারাটি ভারী, সমীহ উদ্রেককারী, দাপটও খুব। এই বয়সেও ঘরেবাইরে বউ নাতবউ আর গাঁয়ের বউ ঝিদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে চলে সমানে।

    -“বলি, ভীমরতি কি এসেই গেল, নাকি চশমা ছাড়া চোখের মাথা একেবারে খেয়ে বসে আছ? এ নাকি ছিদে বাউরি! তাহলে আমি কুইন ভিক্টোরি আর তুমি নবাব খানজা খাঁ।“

    বলতে নেই চার কুড়ির ওপর বয়সে ভয় ডর শরীরে আর তেমন বেঁচে নেই, তবু যেটুকু আছে তা এই ঘরের মানুষকেই। একটু তটস্থ হয়েই শোয়া শরীরটা বসা হয়, ওদিকে ছিদের মত গড়নের কালো সুটকে লোকটা দেওয়ালের সঙ্গে প্রায় মিশে মুখখান কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে একধারে।

    পাল গিন্নী চায়ের কাপটা ঠক করে রাখে কেদারার চওড়া হাতলের ওপর। কত্তা তাড়াতাড়ি চশমাটা চোখে গলাতে গলাতে মুখ তুলে লোকটার দিকে তাকায়,

    -“না হে, তুমি তো ছিদে নয়, দাশুও তো মনে হচ্ছেনি। কে তুমি?”

    গাঁয়ের ডাকসাইটে দুই প্রবীণের সামনে, লোকটা দাঁড়িয়ে থেকেও কচ্ছপের মত গুটিয়ে যাওয়ার ভাব করে,

    -“এজ্ঞে কত্তা, ওই যে ঠাকুমা কইল, উটকো লোক। আমি হলুম গিয়ে একখান উটকো লোক।“

    ঘুমের আমেজ পুরোপুরি গিয়ে মহেনের ধীর স্থির ভাব ফিরে এসেছে। সে তাড়াহুড়ো করে না, আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। গিন্নী ওদিকে মহা ব্যস্ত মানুষ, একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার তার সময় নেই, নেহাত কত্তার ছোটখাটো কাজগুলো নিজে করতে পছন্দ করে বলে, মুড়িভাজা ফেলে চা নিয়ে এসেছে। সে তাই অধীর হয়ে বলে,

    -“ অত কথা কিসের, আমি খোকাকে ডাকছি, এটাকে ধরে থানায় দিয়ে আসুক। ভালো মানুষ হলে চশমা আনার নাম করে দেরাজ খোলে? সাঁটসুলুক দেখে রাখছিল, রাতে এসে চুরি করত।“

    কোনরকমে গিন্নীকে সামলায়, পাল বাড়িতে রাতের বেলাও চোর ঢোকেনা। এদিককার চোরেরা প্রায় সকলেই নিধিরামের শিষ্য বা তার শিষ্যদের শিষ্য, এ বাড়িতে ঢোকা তাদের গুরুর বারন। সেই কোন যৌবন বেলায়, নিধিরামকে মহেন এমন শিক্ষে দিয়েছিল যে সে নিজে আর কোনোদিন মহেন পালের বাড়ির দিকে পা মাড়ায় নি, পরবর্তীতে শিষ্যদেরও এ বাড়ি থেকে দুরে থাকতে শিখিয়েছে অন্তত মহেন পালের জীবদ্দশায় এমনটিই চলার কথা।
    এই অচেনা লোকটা হতে পারে এ গাঁয়ের নয়, তবে বাইরের লোকের এত সাহস কী হবে, ভর বিকেলে দুরভিসন্ধি নিয়ে গাঁয়ের মাঝের বাড়িতে ঢুকবে। তার কৌতুহল হচ্ছিল একটু, লোকটা কেন এসেছে জানা দরকার। গিন্নীর ওই দেরাজ হাঁটকানোর কথাতেই একটু গোলমাল লাগছে, নাহলে অজানা লোকই বা হল!

    গিন্নীর পছন্দ হল না ব্যবস্থাটা তবু দুমদুম করে চায়ের কাপ নিয়ে ভেতর বাড়ির দিকে চলে গেল, গজগজ করতে করতে, মেলা কাজ পড়ে আছে, বোধকরি ছেলেদের খবরও দেবে।

    গিন্নী চলে যেতেই আবার শান্ত চারধার, বাগান পেরিয়ে খিড়কি পুকুরের দিক থেকে কোকিলের একটানা ডাক ভেসে আসছে।

    -“ওহে, একটু এদিকে এই মুখোমুখি এস দিকিনি বাপু, সব বেত্তান্ত শুনি। কোত্থেকে এসছ, কী প্রয়োজন।”

    লোকটা একটু সরে এল যদিও ঠিক সামনে এল না, পাশ বরাবর। তাই সই, মহেন আর জোর করেনা, হাতের কাছে রাখা এলাচের ডিবিটা থেকে একটা এলাচ ভেঙে মুখে দেয়।

    -“এজ্ঞে, আপনের নাম অনেক সুনেচি, এদিকপানে এসচিলুম, ভাবলুম, একবার কত্তার দর্শন করে যাই।”

    মহেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, যদিও এ গাঁয়ে তার প্রভাব বিস্তর, মান আছে, তবু দূর দূর থেকে তাকে দেখতে লোক আসছে, এ একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। সে কী বারোয়ারী কালী না পঞ্চানন্দ শিব! বাধা দেয়না লোকটার কথায়, জানা বোঝার ব্যাপার আছে বলেই মনে হচ্ছে, গিন্নীর সন্দেহ বোধহয় উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবেনা।

    লোকটা কোনো বাধা না পেয়ে উৎসাহিত হয়, বাবু হয়ে বসল মেঝেতে, একটা কাঠপিঁপড়ে ঘোরাঘুরি করছিল, সেটাকে হাতের এক ঝাপটায় খতম করল। ঘরের ভেতরে মহেন পালের বাবার আমলের দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে তিনটে বাজল। পাল কত্তার বৈকালিক ভ্রমণের সময় হয়ে এসেছে, এখুনি গিন্নী পাঠাবে কাউকে তাড়া দিতে। হয়ত ওদিকে ভেতরবাড়ির দিকের দরজার আড়ালে দূত এসে দাঁড়িয়েও আছে। সন্দেহজনক লোকের সঙ্গে কর্তাকে একা ছেড়ে চলে যাবে এমন কাঁচা কাজ মহেন গিন্নী করে না।

    -“এবারে কলাইয়ের ফলন তেমন হলনি। আমার আবার বুঝলেন না কত্তা সব জমিটুকুতেই ওই কলাই বোনা। লাভের হিসেব এবার গন্ডগোল হই গেল। তাই এদিক ওদিক ঘুরছি, কাজের ধান্দা দেখছি। লোকে বলে এগাঁয়ে আপনিই মাথা, যা হয় সব আপনার দয়া দাক্ষিণ্যে, তাই শরণে এসে পড়া।“

    কথাবার্তা বেশ গোছানো, কিন্ত পরিচয় দেয়না কেন। সে নিজে আজকাল চাষবাস তেমন দেখেনা, ছেলেরা দেখে, নাতিরাও সব লায়েক এখন। দরকারে পরামর্শ দেওয়া ছাড়া তার তেমন কাজ নেই। তবে কলাইয়ের ফলন এ দিকে এবারে ভালো হয়নি এটা ভুল নয়। যা ফসল উঠেছে তাতে ঘর খরচাই কম পড়েছে, বিক্রিবাটা তো দুরের কথা। মেয়েরা নিত্যদিন সম্বচ্ছরের বড়ি কম হল বলে অনুযোগ করছে।

    -“বাপু হে, আমার বেরনোর সময় হল যে, একটু তাড়াতাড়ি কথা সার দেখি, গিন্নী আবার তাড়া দিতে এল বলে।“

    গিন্নীর নাম শুনে লোকটা সভয়ে নড়ে বসে,

    -“না না, তাঁর আবার আসার কী দরকার হল, আমার কথা এখুনি শেষ হয়ে যাবে। কথা হল দূর থেকে আসচি বুঝলেন কিনা, বেলা পড়ে এসছে, আজ রাতটা কত্তার চরণে ঠাঁই হলে, কাল সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ব।”

    এককালে অচেনা অজানা লোককে ঘরে একরাত দুরাত ঠাঁই দেওয়া নিয়ে কারোর কোনো সমস্যা ছিলনা কোনো খানেই, কিন্ত ওই যে, এখন দিনকাল ভালো নয়, কী থেকে কী হয় কে বলতে পারে।তাই ভাবনা চিন্তা করতে হয় বৈকি। মহেন পাল ভাবে,

    -“তা বেলা তো তেমন হয়নি বাপু। তুমি তো রোদ থাকতে দুকুরেই এলে। এতক্ষণে রওনা হয়ে গেলে যেখানে যাবার ঠিক পৌঁছে যেতে সন্ধ্যেরাতে। কী মতলবে এগাঁয়ে আগমন, একটু ঠিকঠাক খোলসা করে বল দেখি?”

    লোকটা আবার দেওয়ালের দিকে সরে যায়, বিনয়ে মাথা প্রায় ভুঁয়ে,

    -“কিছুই কত্তার নজর এড়ায় না দেকি। ভোলা ঠাকুর বারবার কয়ে দেছিল, খবর্দার, তোর মিছে কথা কওয়ার স্বভাব যেন পালকত্তার সামনে বার না হয়। কত্তা ঠিক ধরে ফেলবে আর ভুল বুঝাবুঝি হবে। আসলে গাঁয়ে টিকতে পারছিলুম নি, সব্বদা ভুতে তাড়া করে। অমন তাগড়াই বঙ্কিম ওঝাও কিছু করতে পারলনি। বলল কিছুদিন অন্য কুথাও গিয়ে থাকলে যদি পিছু ছাড়ে।

    কোথা যাই, কুটুম তেমন কেউ নেই যার কাছে গিয়ে মাসখানেক থাকা যায়, বউও একই গাঁয়ের মেয়ে। ভোলা ঠাকুর বিজ্ঞ লোক, সে মতলব দিল এই গাঁয়ে আসার, আপনার কথাও সেই বলল। গিয়ে পড়লে একটা বেবস্তা হই যাবে।“

    বয়স হয়েছে তবু লোকে বলে মহেনের মাথা এখনো পরিস্কার, স্মৃতিশক্তি প্রখর, যদিও মহেন নিজে মানেনা। মাঝে মাঝে তার মনে হয় বুঝি বা জং ধরি ধরি করে, জানা জিনিস ভুল হয়। ভাবতে ভাবতেই

    উঠে ঘরের ভেতরে যায়, জামা পরে, দরজার কোনে দাঁড় করানো লাঠিটা হাতে নেয়।

    -“চল হে, আমি বেরোব এখন, যেতে যেতে কথা হবে। আমি অনেক ভোলাকে চিনি, এই গাঁয়েই নয় নয় করে সাড়ে ছ খানা ভোলা আছে। তোমার এই ভোলাটি কোনখানের বল দিকি, আমাকে সে কেমনে চেনে?“

    লোকটা উঠে দাঁড়াল, মুখটা বেজার কি !

    -“এজ্ঞে, এট্টু চা হলে হতনি, কথা কইতে সুবিধে হত। আপনের সন্ধের জলখাওয়া কটা নাগাদ হয়?”

    মহেন উত্তর না দিয়ে বাড়ির ভেতর উঠোনে নামল, সেখানে নানা লোক নানা দিকে কাজে ব্যস্ত ছিল। উঠোন পেরিয়ে সদরের দিকে যেতে যেতে খেয়াল হল বাড়ির সবাই হাতের কাজ থামিয়ে এদিকে চেয়ে, বুঝল সঙ্গের লোকটিকে দেখছে সবাই। গিন্নী চোখে পড়ল না, হয়ত রান্নাঘরের ভেতরে আছে। দরজার কাছে গেছে, বড়নাতবউ ঘোমটা টেনে জলের গেলাস হাতে দাঁড়াল, “বেশী রাত করোনি দাদু, ঠাকমা বলল, আলো কমলেই ধীরু কে পাঠাবে!” ধীরু ছোট নাতি, মহেন জল খেয়ে বেরিয়ে পড়ল, পেছন পেছন লোকটা।
    ********************************************
  • aaahaaaa | 237812.68.5667.107 | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০২:৫২449757
  • উরিঃ না! আবার সে এসেছে ফিরিয়া আমাদের তরে
  • Sarbani | 236712.158.1234.161 | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:৩৬449758
  • কেমন একটা পাগলা দাশু শোনাচ্ছে!
  • Sarbani | 236712.158.1234.161 | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:৩৯449759
  • (২)

    চৈত্র শেষের দিকে শুকনো ধুলো ওড়ে, আসন্ন গরমের আভাস। লাল মোরামের পথে ধীরে সুস্থে হাঁটে, চারিদিকে চোখ।

    -“এবার বল, ভোলা কে, আমারেই বা চিনল কেমনে? কোন গাঁয়ে বাস তোমার, আর সে কেমন ভূত যে মানুষকে একেবারে ঘর ছাড়া গাঁছাড়া করে দেয়?”

    রাস্তায লোকজন নেই, লোকটা এদিক ওদিক দেখে নেয়,

    -“গাঁয়ের নাম কই নি বুঝি, দ্যাখেন দিকি কথায় কথায় ভুলেই গেচি। বলাহাটি, সেইকেনের কালীতলার পুরুত ভোলা ঠাকুর। নদীর ধারে গিয়ে নৌকো ধরে ওপারে উঠলেন, সেকেন থিকে মাইল দুয়েক জমির আল ধরে হাঁটা, তারপরে বড় একটা আশুতগাছ আসবে, তার বাঁ দিক বরাবর আরো মাইলটাক গেলেই সুধীর মালের মুদির দোকান, বলাহাটির শুরু।“

    বলাহাটি, মহেনের আবছা চেনা লাগে গাঁয়ের নামটা, কী বিষয়ে মনে নেই, ভোলা ঠাকুর বলেও কাউকে মনে পড়েনা।

    -“সেইকেনে বুঝলেন কত্তা, আজম্ম বাস করছি কিন্ত এর আগে কখনো এমন ভুতের উৎপাত দেকিনি। কয়েক মাস আগে চান কত্তে গেছি বউকে ভাত বাড়তে বলে। ফিরে এসে দেখি সে সগড়ি পাড়ছে। আমি নাকি খেয়ে দেয়ে পুকুরে গেচি আঁচাতে। ভাবলাম তাই বোধায় হবে, মাঠে খেটে মাথায় রোদ লেগে বেভুল মত হয়েছে। দুদিন পরে মুদি দোকানে তেল কিনতে গেলে কয় আমি নাকি দুদিন আগে ধারে এক ব্যাগ সওদা করে এখুনি পয়সা এনে দিচ্চি বলে সেই যে গেছি আর আসিনি। এদিকে আমার ঘরে সব কিছু বাড়ন্ত, হাতে টাকা নেই।

    সে থেকে ঘরে বাইরে এরকম হয়েই যায়, বউ, মা ভাবে আমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে। শেষে ভোলা পুরুতকে গিয়ে সব খুলে কই। তার আগে গাঁয়ের ঘরে ঘরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখি কোথাও আমার মত দেখতে নতুন কেউ এয়েছে কিনা!

    ভোলা ঠাকুর মন্দিরের দুয়ারে আঁক কষে বলে, এ কোনো অপদেবতার কান্ড, আমার বেশ ধরে অপকম্ম করে বেড়াচ্ছে। তখন গেলুম ভাঙনের বঙ্কিম ওঝারা কাছে। সে এসে অনেক জলপড়া দিল, গন্ডী কাটল, কুথায় কী! এই দুদিন আগেই পরান জেলে দাসপুকুরে মাছ ধরছিল, দাসেদের কুটুম এয়েছে, তা সে যখন দ্বিতীয়বার জলে নেমেছে আমি নাকি পেত্থম বারের সব মাছ নিয়ে দাঁত বার করে “পরানদা মাছ নে গেলুম” বলে পেলিয়েচি। দাস কত্তাকে নিয়ে বাড়ি এসে সব চড়াও হল, চোরের মার খেয়ে মরতুম শুধু ভোলা ঠাকুর সময়মত এয়ে পড়ল, তাই বেঁচে গেলুম।

    কী কই কত্তা, মাঝে মাঝে তো পেত্যয় হয় আমিই বুঝি ভূত নয় ভূতই আসলে আমি!”

    বারোয়ারীতলার প্রায় কাছে এসে পড়েছে ওরা, ওদিক থেকে ধীরেন মান্না আসছিল, গলায় মাফলার জড়ানো, সারা বছরই থাকে মান্না বুড়ো। বয়সে মহেন পালের চেয়ে ক বছরের ছোট হবে, খুব শীত কাতুরে। একটু হাওয়া দিল কী না দিল গরমকালেও চাদর জড়ায়, বেশীক্ষন বাইরে থাকেনা, হাওয়া লেগে যাবে। মহেন কে দেখে বলল,

    -“উঁহু , আজ হাওয়াটা ভালো নয়, সুয্যি ডোবার পরে বাইরে থাকা ঠিক হবেনা। তুমি দাদা এখন বেরুলে, এ বয়সে এরকম অত্যাচার করা ঠিক না। “

    মহেন অল্প হাসে, ধীরু বয়সকালেও এমনটাই ছিল। খেলাধুলা কোনো কিছুতে থাকতনা, ওই এক বাই, হাওয়া লেগে যাবে। ঘরেও শুধু দরজা জানালায় ফাঁক খুঁজে বেড়ায় সারাদিন ধরে, খুঁজে খুঁজে সেসব ফাঁক আটকানোই ওর দিনের কাজ, বাড়ির লোকে তিতিবিরক্ত হয়ে যায় তবু হেলদোল নেই!

    -“হ্যাঁ, আজ একটু বেলা হয়ে গেল, সব এসেছে?”

    সে কথার উত্তর না দিয়ে ধীরু মান্না চোখদুটো ছুঁচোলো করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

    -“তোমার পেছন পেছন ওটা কে আসছিল, ছিদে বারুই না? আমাকে দেখে যেন শিব মন্দিরের দিকে চলে গেল।“

    তাই তো। ধীরুর সঙ্গে কথা কইতে গিয়ে মহেন খেয়াল করেনি কখন সঙ্গের লোকটা উধাও হয়েছে। কিন্ত ধীরুও লোকটাকে ছিদে ভেবেছে, তারই মত।

    -“হ্যাঁ, একটা লোক আসছিল বটে, তবে ছিদে না, কোন বলাহাটির লোক বলল। কেন এসেছে সেটাই বলছিল, বলতে বলতে কোথায় চলে গেল।“

    -“দ্যাখো দাদা, চোর বদমাশ নয়ত? ভিন গাঁয়ের লোক, চেনা নেই জানা নেই এখানে এসেছে কী কাজে! আর আমাকে দেখে অন্যদিকে চলে গেল কেন, দিনকাল ভালো নয়।“

    ঠান্ডা ছাড়া ধীরুর এই আর এক বাতিক, চোর। সবসময়ই সে চোর দেখে, যেখানে সেখানে, ঘুমে জাগরনে। রাতে চোখে ভালো দেখেনা, অনেক সময় বাড়ির লোককেই চোর ভেবে লাঠিপেটা করেছে অন্ধকারে।

    মহেন এ নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাইল না, দেরী হয়ে যাচ্ছে। পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়ে অন্যমনস্কে বলল,

    -“অচেনা হবে কেন, ভোলা ঠাকুর পাঠিয়েছে।“

    ধীরু নিজের রাস্তায় গেল, মহেন একটু এগিয়ে বারোয়ারীতলায় আটচালায় উঠতে উঠতে, হঠাৎ খেয়াল করল, ভোলা ঠাকুরের নাম শুনে ধীরু অবাক হয়নি, উল্টে যেতে যেতে বলে গেল,

    -“ও, ভোলার লোক, তাই এমনধারা”!

    ধীরু ভোলা ঠাকুরকে চেনে, অথচ সে চেনেনা, এ কী করে হয়। মহেন ঘাড় নাড়তে নাড়তে নিজের নির্দিষ্ট জায়গায় বসে। তাকে ঘিরে অনেকে অনেক কথা বলতে থাকে, আসন্ন গাজন ও চড়ক মেলা নিয়ে। বোসেরা সেবাইত হলেও পঞ্চানন্দ গাঁয়ের সবার, তার পুজোয় সবাই সমান উৎসাহ ভরে যোগ দেয়। মহেন পাল আজ সেসব কান করে শোনেনা, নিজের ভাবনাতেই থাকে।

    রায়কত্তা দুবার ডেকে যখন সাড়া পায়না তখন একটু অবাক হয়, তারপরে আরও উঁচুতে গলা তোলে,
    -“দাদা, থানায় নতুন দারোগা এসছে, একবার গাঁয়ের তরফ থেকে দেখা করতে হয় তো।“
    মহেন এমনিতে কানে কম শোনে কিন্ত আবার কেউ খুব বেশী চেঁচিয়ে কথা কইলে বিরক্ত হয়। আজ তবে বিরক্ত হয়না, অপ্রস্তত হয়,

    -“হ্যাঁ কী যেন বলছিলে দেবেশ, তাতো বটেই, তাতো বটেই। নতুন দারোগার সঙ্গে দেখা করতে হয় বৈকী।“
    -“দাদার কি শরীরটা যুত নেই আজ, কেমন একটা দেখাচ্ছে।“
    মহেন এবার সামলে নেয়,
    -“না না, শরীর ঠিক আছে, একটা খটকা লাগছিল, তা সে যাক, কী বলছিলে বল।“

    -“ঘন্টা দারোগার বদলি যে নতুন দারোগা এসছে তার সঙ্গে আমরা গাঁয়ের মাতব্বররা এখনো দেখা করতে যাইনি। আমি তো গত মাস অবধি হাঁফটানে বিছানা ছাড়তে পারিনি। এই চড়ক উপলক্ষ্যে বোসেরা আর তার সাথে আমরা দু চারজন গিয়ে থানায় নেমন্তন্ন করে আসি, সেইসঙ্গে গাজন আর চড়কের সময় এই গাঁয়ের ওপর একটু আলাদানজর রাখার কথাও বলে আসি। প্রতি বছরই তো এসময় নানা দিক থেকে চোর ছ্যাঁচড়রা সব গাঁয়ে এসে জড় হয়।“

    মহেন একটু হাসে,

    -“ওই দারোগা ও তার দু তিনজন সাগরেদ আর এলাকার ঘাগী চোর ছ্যাঁচড়দের কী ধরবে! কোনকালে আর ধরতে পেরেছে, যা করার গাঁয়ের ছেলেরাই বরং করে। শিষ্টাচার, সে তোমরা গিয়ে দেখা করে এস, বলেও এস। তবে এবছর তার সঙ্গে নিধের সঙ্গে পরামর্শ কর যাতে তার শিষ্যিদের বলে ব্যবস্থা করে, বাইরের লোকেদের ওপর নজর রাখে। গাঁয়ের চোর রেখেঢেকে চুরি করবে, সে নাহয় যাহোক, কিন্ত বাইরের চোর মেড়েমুষরে নেবে, তাতে ক্ষতি বেশী।তাছাড়া গাঁয়ের সম্পত্তি বাইরে যেতে দেবই বা কেন!“

    সবাই এ ওর দিকে তাকায়, নিধে বা নিধিরাম চোরকে গাঁয়ের লোকে সমঝে চলে, কর্তারাও। বয়স হয়ে চুরি থেকে অবসর নিলেও এখানো এলাকার চোরেদের ওপরে তার প্রভাব অটুট। সে গাঁয়ের কাউকে তেমন রেয়াত করে না, নিজের মত থাকে, ডাকলে জমায়েতে আসে টাসেও না, নাতি বা ছেলেকে পাঠিয়ে দেয়।

    তবে ইদানিং যে মহেনের সঙ্গে তার খুব সদ্ভাব হয়েছে সেটা কারুর জানতে বাকি নেই। তারক বোস একটু ভেবেটেবে শেষমেশ বলেই ফেলে,

    -“কাকা, আমরা নাহয় দেবেশকার সঙ্গে থানায় যাই কাল, নিধে কাকার সঙ্গে কথাটা নাহয় তুমিই বলে নিও। আমাদের কথা কী আর নিধেকাকা শুনবে? হয়ত বলে বসবে এমন একটা সময়ে মেলা ভিড়, আমদানীর এই তো সময়, তখন আমাদের গাঁয়ের চোরেদের ব্যবসা বন্ধ রাখতে বলে কোন মুখে!”

    -“আরে ব্যবসা গুটিয়ে রাখতে কে বলছে চোরেদের, বাইরের লোকেদের ওপর খালি নজর রাখতে বলা হচ্ছে। সে যাক, আমিই না হয় নিধের সঙ্গে কথা বলব। এখনো তো বেলা আছে, একবার নাহয় ঘুরেই আসি ওদের পাড়া থেকে, অনেককাল যাওয়া হয়নি।“

    মহেন উঠে পড়ল, সবাই একটু অবাক, চৈত্র মাস পড়তে এখনো এক দিন বাকী, গাজনের দেরী রয়েছে, এত তাড়াহুড়ো কিসের।

    বড় রায়ের মত প্রবীণরা অবিশ্যি অনুমান করল, গাজনটা অজুহাত, পাল কত্তার নিধিরামের সঙ্গে দেখা করে গল্পগুজব করার, চাদ্দিকের খবর নেওয়ার ইচ্ছে হয়েছে।
    ***********************
  • Sarbani | 236712.158.1234.161 | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:৪৫449760
  • (৩)

    বোসপুকুরের পাড় ধরে হেঁটে চলে মহেন, পঞ্চানন্দের নতুন মন্দিরকে ডাইনে রেখে সরু রাস্তাটা ধরে। তেঁতুল তলার একটু আগে আবার কোথা থেকে হুট করে লোকটা পাশে এসে চলতে শুরু করে তার সাথে।

    -“আমার ব্যবস্থাটা তাইলে কী করলেন কত্তাদাদু?”

    -“তা তুমি ছিলে কোথায় এতক্ষন, ধীরুকে দেখে বেপাত্তা হলে কেন বল দিকি? তোমায় নিয়ে তো কথাই হলনি পাঁচজনের সঙ্গে।“

    -“এইটা কী কন, আমি গায়েব হব কেন। পেটটা একটু মোচড় দিচ্ছিল, সকাল থেকে খাওয়া নেই, তাই মনে হয় কবরেজ মশাই সেই যাকে অম্লশূল বলে তাই হয়ে গেছে। একটু মাঠের দিকে গেলুম তো।

    ফিরে আসতে আসতে দেখি আপনি এদিকপানে হাঁটা দেছেন, তখন পিছু পিছু এসে ধরলুম।“

    চলতে চলতে অন্যমনস্ক হয়েই বলে পালকত্তা,

    -“তাই তো, মুশকিল হল, আমার ঘরে রাতে তোমায় ঠাঁই দিলে গিন্নী তুলকালাম করবে। ওই যে তোমাকে দেরাজে হাত দিতে দেখেছে।“

    -“না দাদু, ঠাকুমার মনে লয় চোখে একটু সমিস্যে দেখা দেছে, ভুল দেখছেন। সময় থাকতে বলি কী এগবার ডাক্তার দেখিয়ে নিন।“

    -“সে যাই হোক, পষ্ট করেই কইছি বাপু, আমার ঘরে সুবিধে হবেনি।“

    -“আপনার উপর আমার বড় আশা ছেল যে দাদু, এখুন কুথা যাই আমি, এই সাঁঝের বেলায়। এ গাঁয়ে আমার কেউ নেই যে।“

    লোকটার কথার ধরণে যে কারো খুব দুঃখ হবে এমন নয়, মহেনেরও হলনা। তবু কী ভেবে বলল,

    -“চল দেখি নিধেকে বলি, ওর ওখানেই নাহয় কাটাও আজ রাত। সকালে তো চলে যাবে বলছ?”

    কত্তার চোখ সামনের রাস্তার দিকে ছিল, লোকটার চমকানো তার চোখে পড়েনা।

    নিধিরাম এককালে এ অঞ্চলের নামকরা চোর ছিল, এখন অবসর নিয়েছে। জমিজমা দেখে, আশির ওপরে বয়স হল, পালকত্তার থেকে কিছুটা ছোট। এদিককার চোরেরা বেশীরভাগ তার শিষ্য, তাদের ওপর তার প্রভাব এখনো অসীম। এলাকার প্রতিটি চুরি ও সকল চোরেদের গতিবিধিও নিধের নখদর্পণে। আগে মহেন পালকে সে এড়িয়ে চলত কিন্তু সাম্প্রতিক কালে কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক গাঁয়ের সমবয়স্ক দুটি মানুষের মধ্যে এক গভীর সখ্যতা গড়ে উঠেছে।

    আপন মনে চলতে চলতে মহেন খেয়াল করেনা লোকটা সঙ্গে আসছে কিনা। সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখে নিধিরাম দুয়ারে বসে আছে, তার সামনে উঠোনে উবু হয়ে একজন বসে। মহেনকে আসতে দেখে নিধে উঠে দাঁড়াল,

    -“এস এস দাদা, অনেকদিন বাদে এদিকে এলে।“ মাটিতে বসে থাকা লোকটা কী একখানা কায়দায় উবু অবস্থাতেই সরে একেবারে কোণের দিকে টগর ঝোপের আড়ালে চলে গেল। মহেন কৌতূহলে তাকালেও ঠিক নজরে পড়ল না। ততখনে নিধের নাতবউ এসে পাটি পেতে দিয়ে গেছে পাল কত্তার বসার জন্যে।

    -“হ্যাঁ, এতকাল শীতের জন্যে বাড়ির বাইরে বড় একটা বেরনো হতনা। তা তুইও তো যেতে পারতিস। পায়ের ব্যথা কেমন আছে?”

    -“ওইতেই তো মেরেছে আমারে। কোনরকমে আছি আর কী। কদিন তো এমন গেল, এই বারদুয়ারে পর্যন্ত আসতে পারিনি। তা চা খাবে তো নাকি দুধ খাবে?”

    -“নাঃ, চা খাওয়া হয়েছে। ও জিনিসে আমার নেশা নেই, বেশী খেতে মন চায়না। এখন কিছু খাবনি, বউমাকে বারণ কর। যে কথা কইতে আসা, গাজন আসছে, এসময় অনেক উটকো লোক গাঁয়ে ঢোকে। তুই তোর চ্যালাদের একটু সামলিয়ে রাখিস, মেরেমুসরে যেন না নেয়। পঞ্চানন্দের থানের বদনাম হলে সে গাঁয়ের বদনাম। এছাড়া বেপাড়ার চোরেদের ওপর নজর রাখতে হবে, বাড়াবাড়ি যাতে না করতে পারে!”

    নিধিরাম পা দুটো দুয়ারের ওপর তুলে ছড়িয়ে দিল। বেশীক্ষণ পা নামিয়ে বসতে পারেনা, ভয়ঙ্কর বাতের ব্যামো তার।

    -“তাহলে দুটি মুড়ি খাও, এই ভেজে উঠল বউমা। এখানে দুটি খেলে বৌঠান কিছু বলবেনিকো।“
    পাল খেয়াল করল নিধিরাম সঙ্গে সঙ্গে তার কথার সরাসরি উত্তর দিল না। সে জোর করল না,

    -“সে নাহয় খাব। অন্য একটা দরকারও আছে। একী, সেই লোকটা কোথায় গেল, এই একটু আগেই তো সঙ্গে আসছিল।“

    -“কার কথা বলছ দাদা, তুমি তো একাই এলে, সঙ্গে কেউ ছিলনি তো।“

    মহেন ঝোপের দিকে তাকিয়ে বলে,

    -“কে বাছা নিধের চ্যালা, লুকিয়ে রয়েছ, যাও দেখি একটু ওই পুকুরপাড় অবধি, একটা কালো রোগা সিড়িঙ্গেপানা লোক দেখতে পাও কিনা।“

    নিধের আদেশের অপেক্ষা না করেই তার চ্যালা তীরের মত দৌড়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল, মহেনের আসার পথের দিকে। নিধের মুখটা একটু করুণ, খানিকটা বেজার।

    -“হ্যাঁ দাদা, বলি সঙ্গে কে ছিল? কুটুমটুটুম নয়ত?”

    -“না, কুটুম নয়। কেন রে?”

    -“আরে ওইটা তো মাথামোটা দুজ্জধন, ডেকে আনতে পাঠালে, মেরেধরে বেঁধে না নিয়ে আসে!”

    -“কী জানিস, ভাবনার কিছু নেই। আমার কেমন মনে হচ্ছে যারে আনতে পাঠালুম সেও কম নয়, সাক্ষাত যুধিষ্ঠিরের ভাই।“

    -“যুধিষ্ঠির? কোন যুধিষ্ঠিরের কথা কইছ?”

    -“মহাভারতের, পাণ্ডবের বড় জনের কথা। বাদ দে, ও তুই বুঝবিনে। এখন বল দেকি, বলাহাটি আর সেকেনের ভোলা ঠাকুররে ক্যামনে চিনিস?”
    নিধিরামের গলায় অবাক হওয়া সুর,
    -“বলাহাটি ক্যামনে চিনি মানে, তুমি চিননি?”
    -“চেনা চেনা লাগছে বটে, তবে কেন সেটা মনে করতে পারছিনি।“

    -“অবশ্য তোমার মনে থাকার কথা নয়, সে অনেককালের কথা। তখন আমাদের বাপেরা বেঁচে, বোসেদের মুহুরী ছিল নবীনজ্যাঠা, সেই যে পঞ্চানন্দের থানের সব দেখাশুনো করত, আরও কী সব কাজ করত বোসেদের, তার বাড়ি ছিল বলাহাটিতে।সেখানে খুব ভালো কলাইয়ের চাষ হত, এ গাঁয়ে বোসেদের রায়েদের আরও কাদের জানি বলাহাটিতে কলাইয়ের ক্ষেত ছিল, ওই নবীনজ্যাঠাই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।

    তখন ফি বছর এই শীতে কলাই নিয়ে বলাহাটি থেকে লোক আসত, রায়েদের চালায় থাকত। তাদের সঙ্গে অনেকের বেশ ভাবসাবও হয়ে যেত। তারপর কবে সেসব বন্ধ হয়ে যায়, বোধহয় নবীন মুহুরী মরে যাবার পরেই, সে এখন আর ঠিক মনে পড়েনি।“

    নিধেরামের কথা শুনে মহেন পালের মনে পড়ে গেল। সে অনেককাল আগের কথাই বটে, তেমন কিছু ব্যাপার নয় তাই মনে ছিলনা।
    -“হ্যাঁ, মনে পড়েছে, তোর বাপ দুখীকাকার সাথে ওই নবীন মুহুরীর খুব দহরম ছিল, তাই বোধহয় তোর এত কথা মনে আছে।“

    বাপের” সঙ্গে সম্পর্কের কথা উঠতে নিধিরাম একটু অপ্রস্তত হয় তবে আর কিছু বলেনা, শুধু সায় দেয় একটু। তার বাপও তারই মত এ অঞ্চলের নামকরা চোর ছিল এককালে।

    মহেনকে একটু চিন্তাক্লিষ্ট দেখালো। নাঃ, লোকটাকে নিয়ে আসুক, নিধের এধরণের লোকের সঙ্গে কাজ কারবার বেশী, সে কথা বলে দেখুক, লোকটার আসল মতলব কী, ভুতের গল্পটা কেন জানি অদ্ভত ঠেকছে।

    সে একটু একটু করে দুপুর থেকে লোকটা আসা থেকে কী হয়েছে কী বলেছে সব বৃত্তান্ত নিধিরামকে শোনায়।

    -“না, ভোলা ঠাকুর, এনামে বলাহাটির কাউকে চিনি বলে তো মনে পড়ছেনি।তবে হতে পারে নবীন জ্যাঠার ঘরের কেউ।“

    -“পুরোহিত বলল তো, তা নবীন মুহুরী কি বামুন ছিল?

    নিধিরাম একটু ভাবে, তারপরে ঘাড় নাড়ে।

    -“না, সেকথা ঠিক স্মরণ নেই। তারক বা ভীমকে জিগ্যেস করে জানা যাবে, যদিও নবীন মুহুরী মরেছে সে আজ নয় নয় করে বছর ষেটেক তো হবেই, তবু ওদের বাপের সময়কার পুরনো লোক, ওরা নিশ্চয়ই খবর জানে।“

    মহেন পালের কথাটা ন্যয্য মনে হল।বলাহাটির সঙ্গে এ গাঁয়ের সম্পর্ক পরিস্কার হয়ে যাওয়াতে তার মন এখন অনেক শান্ত। বিকেল ঘন হয়ে এসেছে, আঁধার হলে আবার রাস্তা পুকুর ঠিকমত ঠাহর হয়না আজকাল।

    -“না রে এবার উঠি।তোর দুর্যোধন তো ফিরে এলনা এখনো। বলাহাটির শংকরাটিরও টিকি দেখা যাচ্ছেনা।“

    নিধিরাম হা হা করে উঠল।

    -“উঠবে কী দাদা, বউমা যে মালপো ভাজছে, তোমায় চাখাবে বলে।তুমি খেলে আমিও দুটো পাই, আজকাল পাছে খেয়ে মরি, এরা এত আতুথুতু করে, কিছুই দেয়না, শুধু সেদ্দ আর পোড়া।খাওয়া দাওয়া আমার চিরকালই ধরাকাট, নাহলে রাতে কাজ করা যেতনা।বুড়ো হয়ে রিটার করে যে একটু খাওয়ার সুখ করব, তাও এমন বাত ব্যাধি ধরল, ডাক্তার সব বারণ করেছে, আর ঘরের এরা সবও হয়েছে এক একটি চৌকিদার।“

    মহেন উঠতে গিয়েও বসে পড়ে, সাথে সাথে তপাই মালপোয়ার থালা আর তপাইয়ের মা চায়ের কাপ এনে রেখে, গলায় কাপড় টেনে মহেনের উদ্দেশ্যে গড় হয়। মেয়েটি বড় ভালো, মহেন পালকে খুব ভক্তি করে। চোরের সংসারও আজ এমন লক্ষ্মীমন্ত ভরভরন্ত হয়ে উঠেছে শুধু এই বউটি হাল ধরেছিল বলে।নিধিরাম অনেক চেষ্টা করা সত্বেও তার ছেলে বা নাতিরা কেউ জাতব্যবসা ধরেনি এরই জন্যে। নিধিরাম জানে কিন্ত বউমা তাকে এত যত্নে বলতে গেলে তুলোয় করে রাখে, যে এনিয়ে ছেলের বউকে কোনোদিন সে দুষতে পারেনা। আক্ষেপ হলে ছেলের ওপর চেঁচায়, তবে ছেলে শান্ত, মা মরা, ছোট থেকেই ভীতু প্রকৃতির, দোকান আর বাড়ি ছাড়া কোনদিকে তাকায় না, ডাকসাইটে বাবার মুখের ওপর তেমন কথা কয় না। নিধিরামের দিনরাত কাটে তার শাগরেদ ও পুরনো চেলাদের নিয়ে, তাদের পরামর্শ দিতে, সমস্যার সমাধান করতে।

    খেতে খেতে দুজনে এদিক সেদিকের কথা বলতে বলতে কখন দুর্যোধন এসে সুট করে দরজা দিয়ে ঢুকে তুলসীতলার দিকটায় চুপ করে দাঁড়িয়েছে, মহেন খেয়াল করেনি। তবে এই বয়সেও নিধিরামের মাথার চাদ্দিকে চোখ থাকে, খাওয়া শেষ করে চায়ের কাপে একটা আয়েশ চুমুক দিয়ে বলে,

    -“কীরে পেলি, পালকত্তা যে লোককে খুঁজতে পাঠালো তাকে? তা কোথায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিস তারে, পুকুরধারে? সদরে ডেকে নিয়ে আয়, বল কত্তারা ডাকছে।“

    নিধিরামের কথা শুনে মহেন চা খেতে গিয়ে বিষম খেল প্রথমটা। তারপরে ব্যাপারটা পরিস্কার হয়, নিধিরাম কথাগুলো তার চেলাকে বলছে।দুজনে উত্তরের আশায় তুলসী তলার দিকে তাকায়। লোকটি কেমন দেওয়ালে মিলিয়ে যেতে যেতে কী একটা বলে যা মহেনের কানে ঘোঁত শোনালেও, নিধিরাম চুকচুক করে ওঠে,

    -“কোথাও কেউ নেই? কালীতলার দিকটা দেখছিলি?”

    উত্তরে আবার ঘোঁত।

    নিধিরাম এবার মহেনের দিকে একটু আনমনে তাকায়। বয়স হয়ে কী দেখাটেখায় গণ্ডগোল হচ্ছে পালকত্তার? দুর্যোধন তো যে সে চোর নয়, ছ কোশ দূর থেকে মানুষের উপস্থিতি টের পায়, না নড়লেও পায়, গেরস্ত ঘুমিয়েছে কী জেগে আছে কিনা নিঃশ্বাস শুনে বুঝে নেয়।আরো এরকম অজস্র গুন তার, শুধু মাথাটা একটু মোটা, নাহলে সে মহাচোর হতে পারত।যদি বলাহাটির লোক, যেমন মহেন বলছে বোসপুকুর অবধি তার সাথে এসেছে, তাহলে সে এখনো আশেপাশেই থাকবে, দুজ্জোধন টের পাবেনা নতুন লোকের উপস্থিতি, এ হতে পারেনা।

    মহেন পোড়খাওয়া কম না, দুর্যোধনকে না চিনলেও, নিধিরামকে জানে, সন্দেহটা আঁচ করে বলে,

    -“না রে নিধে, এখনো ভীমরতি ধরেনি আমার। বলাহাটি বা যেখান থেকেই হোক এক উটকো লোক এ গাঁয়ে ঢুকেছে। কিছু আগেও সে আমার সাথে ছিল। এবং আমার ধারণা এখন আরো পরিস্কার যে সে লোক বেশ ধড়িবাজ, আমাদের সবাইকে মায় তোর এই দুজ্জধনটিকেও সে ঘোল খাওয়াতে পারে। আমার মনে হয় এই তোর চৌহদ্দি ছাড়ালেই সে আবার আমার সঙ্গ নিয়ে তার গপ্প শুনিয়ে কান ঝালাপালা করবে। কিন্ত কথাটা হচ্ছে কেন? কী জন্যে সে এ গাঁয়ে এসেছে আর আমার বাড়িতেই বা কেন?

    যাক, চোখ কান একটু খোলা রাখিস ও তোর যে যেখানে আছে তাদের রাখতে বলিস, আমি এবার উঠি। এছাড়া চড়ক মেলার কথাটাও যা বললাম খেয়াল রাখিস। নতুন দারোগা, আর ওই তো দুটো সেপাই তার, ঢাল তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দার।তুই গাঁয়ের মাথাদের একজন এখন, তুই থাকতে মেলা সুষ্ঠভাবে হবেনি, গাঁয়ের বদনাম হবে, এতো তুই হতে দিতে পারিস না।“

    কথা শেষ করে মহেন উঠতে গেলে নিধিরাম হাঁকডাক শুরু করে।দাদাকে সে একা যেতে দেবেনা, কখন অন্ধকার নেমে যাবে, তপাই সঙ্গে যাক।
    মহেন তাকে বুঝিয়ে নিরস্ত করে, গাঁয়ের মধ্যে চারিদিকে লোক, তার ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। তাছাড়া কেউ সঙ্গে থাকলে উটকো লোকটি সামনে আসবে না, আড়ালেই রয়ে যাবে, তাতে করে তার উদ্দেশ্য কিছু বোঝাও যাবেনা। এর চেয়ে সামনে থাকলে তার কথা, গতিপ্রকৃতি দিয়ে আসল ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধে হবে। নিধিরাম আর আপত্তি করে না।

    মহেন বেরিয়ে কিছুটা গিয়ে, পাড়ার শেষ বাঁকে অদৃশ্য হওয়া মাত্র নিধিরাম দুর্যোধনের দিকে ইশারা করতে, সে সঙ্গে সঙ্গে চিলের মত ছোঁ করে বেরিয়ে যায় মহেন যে রাস্তা ধরেছে সেই দিকে।
    ******************************************
  • n | 236712.158.782323.33 | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১১:০৪449761
  • ভেরি গুড
  • Santanu | 236712.158.1234.155 | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৭:২৫449762
  • এ তো পুজো উপহার, অনেক ধন্যবাদ
  • | 236712.158.1234.135 | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:৫৮449763
  • অনেক দিন পরে তোমার লেখা পড়লাম শ্রাবণী দি।
    তোমার সোনার কলম। গুরুর সেই প্রাচীন কাল থেকে আমি তোমার গুণমুগ্ধ পাঠক।

    ভালো থেকো।
  • SKM | 236712.158.565612.253 | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১১:৩৫449764
  • অনেক দিন পর পুরানো গুরু এর ছোয়া
  • ওটা | 236712.158.1234.135 | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২১:৩৮449766
  • সর্বাণী
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন