এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • কোনো এক গাঁয়ের কথা

    shrabani
    অন্যান্য | ২২ এপ্রিল ২০১০ | ১৫৯৮১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • shrabani | 124.124.86.102 | ৩০ এপ্রিল ২০১০ ১২:২৫449794
  • তাও তো জিনিসের আর একটা ফর্ম বলেনি!:)

    সরি, হাত চালিয়ে লেখা হচ্ছেনা। এটা ঠিক রহস্য গল্প তো নয়, গাঁয়ের কথা!
  • shrabani | 124.30.233.102 | ৩০ এপ্রিল ২০১০ ১৪:৩৭449795
  • বারোয়ারী তলা আজকে প্রচুর জমজমাট। সাধারনত এই আড্ডায় একটু বয়স্ক প্রাচীন লোকেরা আসে, মায়ের মন্দিরে প্রণাম করে পরে আটচালায় বসে নানা আলোচনা চলে। তাও শীতে সবাই নিয়মিত আসেনা। কমবয়সীরা এ আড্ডায় থাকেইনা প্রায়, কেউ কেউ কখনোসখনো একটু মুখ দেখিয়ে চলে যায়। বড়দের মাঝে ধোঁয়া ছাড়া যায়না তাই তাদের জমেনা এখেনে। তারা হারানের দোকানে বা অন্য আরো দু চার জায়গায় যায়।

    কিন্তু আজ ব্যাপারস্যাপার অন্যরকম। গাঁয়ের সব পুরুষেরা আজ ঝেঁটিয়ে এই বারোয়ারীতলায় হাজির হয়েছে। শিবু এসে বসে আছে। রায়েদের মেজ কর্তা এসেছে, বোসবাড়ীর তিনভাই। এছাড়া আরও অনেকে আছে। হারানরা যখন এসে পৌঁছল, সেইমাত্র মহেন পালও এল। মহেন পাল এ গাঁয়ের প্রাচীনদের মধ্যে অন্যতম। বয়স অনেক হয়েছে, প্রায় আশু চাটুজ্জ্যেরই কাছাকাছি কিন্তু দেখে ষাটের ঘরের মনে হয়।মাথা এই বয়সেও খুব সাফ, কানে একটু যা কম শোনে, তাই চেঁচিয়ে কথা বলে। এখনও পায়ে হেঁটে পুরো গাঁয়ে ঘুরে বেড়ায়, তেমনি খাওয়াদাওয়া। প্রত্যেকটি নেমন্তন্ন বাড়িতে পাতা পেড়ে বসে এমন গুছিয়ে খেতে পারে যে ছেলেছোকরারাও লজ্জা পাবে।
    কত্তারা সবাই খুব খাতির করে বসাল তাকে একেবারে আটচালার মাঝখানে। পালমশাই বসতেই জমায়েতটার বিশৃঙ্খল ভাবটা চলে গেল। সবাই যে যার জায়গায় বসে দাঁড়িয়ে চুপ মেরে কত্তারা কি বলে শোনার জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগল।

    মেজরায় মহেন পালের দিকে মাথাটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে কি একটা বললে, সে ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিতে রায় মশাই এদিক ওদিক তাকিয়ে শিবুর দিকে ইশারা করে তাকে সামনে আসতে বলল। লোকজন সব সরে গিয়ে শিবুর সামনে আসার রাস্তা করে দিল। শিবু কত্তাদের সামনে আসরের মাঝখানে এসে হাত জড়ো করে দাঁড়ালে।
    রায়কত্তা গলা সাফ করে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
    -"এখানে গাঁয়ের পাঁচজন আছে, বয়জেষ্ঠ্যরাও আছেন। শিবুদের ঘরে কাল রাতে যে চুরি টা হয়ে গেল তার জন্যে কিছু করা দরকার। শিবু এ ব্যাপারে সবার পরামর্শ চায়, তাই আমরা আজ এ নিয়ে আলোচনা করব। কারোরই জানতে বাকী নেই যে কাল রামী খুড়ির সিন্দুক খুলে চোরে সর্বস্ব নিয়ে গেছে মায় শিবুর নতুন সাইকেল পর্যন্ত। এমনই পাকা হাতের কাজ যে দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছে, বালিশের তলা থেকে চাবি নিয়েছে, সিন্দুক খালি করেছে অথচ রামীখুড়ির মতো সজাগ গেরস্তও টের পায়নি।
    চুরি এ গাঁয়ে আগেও হয়েছে, ডাকাতও পড়েছে কয়েকবার। চোর বা চুরি যাওয়া মাল ধরা পড়েছে আবার কখনও পড়েনি। পুলিশে খবরও দেওয়া হয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে, তবে তাতে আলাদা ফল কিছু হয়নি। তাই এবার কি করা উচিৎ সেটা পাঁচজনে বলুক। এক বিধবা সমস্ত জমা পুঁজি হারিয়ে এভাবে নি:স্ব হয়ে যাবে, এতো চুপ করে বসে দেখা যায়না।"
    এতকথা বলে মেজরায় বেশ একটা প্রশান্তির হাসি হেসে ধুতির খুঁটে মুখ মুছল। বড় ভালো বলেছে, গুছিয়ে। বড়কত্তা হাঁপের টানের জন্য আসতে পারেনি তাকে পাঠিয়েছে। গ্রামে ঘরে বড় রায়কেই সবাই বেশী মানে। দু চারটে জমায়েতে এরকম বক্তিমে দিতে পারলে মেজরও বিচক্ষণ বলে সুনাম হতে দেরী হবেনা।

    মহেন পাল মিটি মিটি হাসছিল। মেজরায় থামতে চেঁচিয়ে বলল,
    -"তা বাপু সকাল থেকে তো শুনছি সব্বস্ব গেছে, সব্বস্ব গেছে। তা এই সব্বস্বটা কতটা? হ্যাঁরে শিবু কি কি ছিল তোর দিদিমাবুড়ির ঘরের সিন্দুকে? পুলিশে খবর দিলেও তো তার মাল উদ্ধার করতে আগে মালের একটা বিবরণ চাইবে।"
    এবার ভীড়ের সবাই সরব হল। কেউই এখনো জানেনা কত কি চুরি গেছে। কেউ কেউ অনুমানে একশো ভরি সোনা, রুপোর বাসন ইত্যাদি নানা হিসেব করছে বটে তবে একজন অন্যজনের কথা মোটেই বিশ্বাস করছেনা। একশো ভরি সোনা রামী বুড়ির সিন্দুকে, খোলা বাড়িতে নিত্য নানা লোকের আসাযাওয়া, তারমাঝে? ছেলেখেলা নাকি?
    শিবুকে খুবই বিব্রত দেখালো, সে নিজেও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে সকাল থেকে। কিন্তু বিটলে বুড়ি কিছু বললে তো! কর্তা ব্যক্তিরাও সমস্যাটা বুঝতে পারে। বুড়ির কাছ থেকে কথা বের করা যাচ্ছেনা, বেশী জিজ্ঞেস করলে না শোনার ভান করছে কি সত্যিই শুনতে পাচ্ছেনা সে পঞআনন্দই জানেন। কিন্তু চুরিটার একটা মীমাংসা দরকার। গোলযোগটা একটু থিতোলে খগেন মন্ডল উঠে দাঁড়াল,
    -"আমি বলি কি একবার নিধে খুড়োর সঙ্গে কথা বলে দেখলে হয়না। এলাকায় যাবতীয় চুরি আর চোরের খবর তার কাছে থাকে।"
    একটু কমবয়সীরা খুব জোরে জোরে সায় দিল, বয়স্করা সবাই অপ্রস্তুত হয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকালো। শুধু মহেন পাল হেসে চুপ করে রইল।
  • shrabani | 124.30.233.102 | ৩০ এপ্রিল ২০১০ ১৫:০১449796
  • খগেন মন্ডল তার মায়ের কাছে শোনা গয়নাগাঁটি বা ডিবের কথা কিছুর উল্লেখ করলনা ইচ্ছে করেই। মা বুড়ির কথা যে সব সত্যি তার কোনো ঠিক আছে নাকি, বুড়ো বয়সের ভীমরতিও হতে পারে। আর সেরমটা হলে খগেন বেকায়দায় পড়বে না পাঁচজনের কাছে!
    শেষমেশ কাত্তিক বোস আমতা আমতা করে বলল,
    -"তা বেশ তো, তা না হয়। তা নিধেখুড়ো কে দেখছিনা তো, আসেনি মনে হয় যেন।"
    নিধের নাতি তপাই অন্ধকারে নিম বটের তলায় দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছিল দু জন বন্ধুর সাথে। হঠাৎ শোরগোলে নিজের নাম শুনতে পেল। কারা যেন "এই তপাই, তপাই কে তো দেখছিলাম, কোথায় গেল ছোঁড়াটা" এইসব বলতে বলতে তার নামে হাঁক পাড়ছে। আধখাওয়া বিড়িটা একজনের হাতে ধরিয়ে পেটের ধোঁয়াটা জোরে ছেড়ে সে আটচালার আলোয় ঢুকল। তার দিকে চোখ পড়তেই খগেন চেঁচাল,
    -" অ্যাই তপা, কোথায় ছিলি রে হতভাগা, সব ডেকে ডেকে সারা? হ্যাঁরে নিধে খুড়ো এলনি ক্যানো রে?"
    তপাই মুখ মুছে ভয়ে ভয়ে কত্তাদের দিকে চেয়ে বলে,
    -"দাদামশাই তো বাতের ব্যাথায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে, আসতে পারলনি। বাবাও আসেনি দোকান থেকে এখনো তাই আমি এলুম।"
    খগেন খেঁকিয়ে উঠল,
    -"এলুম তো কোথায় গিয়ে বসেছিলি যে খুঁজতে হল এত? আর আজ সকালে তো তোর দাদু উঠে বসেছিল, বেরিয়ে উঠোনে এল আমার সামনে। এরমধ্যে এক্কেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল?"

    মহেন পাল কান খাড়া করে খগেনদের কথা শুনছিল, এবারে একটু হেসে বলল,
    -"ছেড়ে দাও ওসব কথা। খগেন তবে মন্দ বলেনি। নিধেকে বলা হোক খোঁজ খবর করতে। আর সকলে একটু সজাগ থাকো। এখনই রাতপাহারার দরকার নেই, তবে আর চুরি যদি হয় ছেলে ছোকরাদের দল বেঁধে পালা করে রাতপাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গাঁয়ে রাস্তাঘাটে নতুন লোক দেখলে চোখে চোখে রাখ। আর থানায়ও নাহয় কাল শিবু একটা নালিশ করে আসুক। যদি বাইরের চোর হয়, চুরির মাল পাচার করতে যায়, আমরা কিছুই করতে পারবনা। এক পুলিশ যদি কিছু করতে পারে।"

    মহেন পাল আর নিধে চোরের মধ্যে কিছু একটা ব্যাপার আছে গাঁয়ের অনেকে বুঝলেও ঠিক কি সেটা অনেকেই জানেনা। যৌবনে পাল বুড়ো খুব ডাকাবুকো ছিল, কুস্তি করা চেহারা। নিধের বাপ দুলিরাম ছিঁচকে চোর ছিল গাঁয়ের, ঘটিটা বাটিটা চুরি করে বেড়াতো। নিধে তখন ছোট, সবে চুরিবিদ্যা শুরু করেছে, হাত পাকেনি, ধরা পড়ে মারধোরও খায়। একবার পালেদের গোয়াল থেকে দুধেলা বুধি গাই চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে মহেন পালের হাতে বেদম মার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

    এরপরে অনেকদিন সে পালেদের বাড়ির দিকে যায়নি। মহেন পালের বিয়ের পরের দিন নতুন বৌ গয়নাগাঁটি খুলে দেরাজের ওপর রেখে পুকুরে চান করতে গেছিল। ঘরটা একটু একটেরে ছিল, বাগানের সেইদিকে যেদিকে ঘন ঝোপঝাড়,ছাইগাদা, ওদিকপানে কেউ বড় একটা যেতনা। একটাই জানালা ঘরের, সেটাও বাগানের দিকে। বউয়ের গয়নাগাঁটির খবর শুনে নিধের মাথার পোকা নড়ে গেল। সে ঝোপের আড়ালে তক্কে তক্কে বসে রইল। যেই মহেনের বৌ গয়নাগাঁটি খুলে রেখে ঘরের সামনের দোর দিয়ে বেরিয়েছে সেও দ্রুত গিয়ে বাগানের দিকের জানালার শিক আলগা করে ফেলেছে।
    এদিকে মহেন পালও ঠিক সেই সময় কালরাত্রিতে লুকিয়ে লুকিয়ে সবার চোখ এড়িয়ে বৌয়ের সঙ্গে প্রেমালাপ করার আশায় ঐ দিকে গেছে। জানালায় গিয়ে দেখে এই কান্ড! বৌ বেপাত্তা, তার জায়গায় ঘরে নিধিরাম!

    ব্যস, চোর হাতে নাতে বামাল সমেত পাকড়াও। মহেন লোক ডাকতে পারেনি নিজেরও ধরা পড়ার ভয়ে। একে তো তার পরিকল্পনা জলে গেল, তার ওপরে নিধের এতবড় দু:সাহস। দেখেশুনে মহেন তো রেগে দ্বিগুণ আগুন!
    রোগাপটকা নিধেকে ধরে এমন কিছু বাছা বাছা কুস্তির প্যাঁচ আর টিপুনি দেয় যে কিছুকাল নিধে আর কোমর সোজা করে চলতে পারেনি। জিজ্ঞেস করলে বলত গরু বাঁধা খোঁটায় পা জড়িয়ে মাঠে পড়ে গেছে। আসল ব্যাপারটা কেউ জানতে পারেনি, নিধের বাপও নয়। তবে পরবর্তী কালে চুরিবিদ্যেয় পাকাপোক্ত হয়েও নিধে কোনোদিন সাহস করে পালবাড়ির দিকে নজর দেয়নি। কেউই প্রায় জানেনা যে মহেন পালকে নিধিরাম এখনো এই বয়সেও সযতনে এড়িয়ে চলে!
  • Samik | 219.64.11.35 | ৩০ এপ্রিল ২০১০ ১৫:৪৪449797
  • টেস্টিং।
  • Nina | 64.56.33.254 | ৩০ এপ্রিল ২০১০ ২২:৩৮449798
  • পুরোদস্তুর জমাটি গল্প--পড়া শেষ হলেই মনে মধ্যে শুধু উসখুস ---তারপর--তারপর কি হল---
  • shrabani | 124.124.86.102 | ০৩ মে ২০১০ ১৫:১৩449799
  • হারান অনেকক্ষন ধরে উসখুস করছিল। আর থাকতে না পেরে পাশে বসা অমিয়কে একটা ধাক্কা দিল আস্তে করে। অমিয় একমনে সবার কথাবার্তা শুনছিল। নাড়া খেয়ে একটু ঝাঁঝিয়ে উঠল বন্ধুর ওপর,
    -"কিরে ঠেলা মারছিস কেন?"
    হারান এবার বলে,
    -"শুনলি না পালদাদু কি বলল?"
    অমিয় পালেদেরই ছেলে, মহেন পাল তার সম্পর্কে ঠাকুরদা হয়।
    -"কোনটার কথা বলছিস? বুড়ো তো অনেক কিছু বলল।"
    -"ঐ যে গাঁয়ে নতুন লোক দেখার কথা। এরমধ্যে ভুলে গেলি আমার দোকানে আশু দাদুর সঙ্গে বসে বসে যে লোকটা চা খাচ্ছিল তার কথা? তুইতো বলছিলি যা দিনকাল নতুন লোক দেখলে সাবধান হওয়া ভালো।"
    অমিয় একটু ভাবল।
    -" সে তো ঠিক কথা। লোকটাকে দেখে তখন সুবিধের মনে হয়নি। কিন্তু ধর, লোকটা যদি পথ চলতি হয়। তোর দোকানে তো এরকম অনেকে আসে, বড় রাস্তার ধারে চায়ের দোকান।"
    হারান অমিয়কে খুব মানে, স্কুলে পড়াশোনায় ভালো ছিল, একটা পাস দিয়ে বাপের ধান চালের ব্যবসায় ঢুকে পড়ে। কিন্তু বুদ্ধিসুদ্ধি ভালই আছে। সে অমিয়র মুখের ওপর সচরাচর কিছু বলেনা তবু আজ একটু আস্তে গুনগুন করে বলে ওঠে,
    -"কিন্তু পথ চলতি লোকেরা চা খেয়ে তাড়াতাড়ি কাজে বা ঘরের দিকে রওনা হবে। অতক্ষণ আশু চাটুজ্যের মতো কথা না কওয়া বুড়োর কাছে বসে বসে বকবক করে যাবে কেন?"
    অমিয় যুক্তিটা ফেলতে পারেনা তবু তার ঠিক সাহস হয়না কথাটা সব বড়দের মাঝে বলতে। সবাই যদি ভালো করে লোকটার চেহারা বর্ণনা করতে বলে তাও কি ওরা ঠিক পারবে! সন্ধ্যের আবছা আলোআঁধারে সারা গামুখ চাদরে ঢাকা, ভালো করে দেখেছে কতটুকু? শেষমেশ দুজনে ঠিক করে কাউকে কিছু না বলে দুজনে একটু সতর্ক থাকবে। হারান যদি আবার দোকানে এরকম কাউকে দেখে তাহলে কথা টথা বলে লোকটির বৃত্তান্ত জানার চেষ্টা করবে।

    জমায়েত হালকা হয়ে আসছিল, রাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাটাও জমিয়ে পড়ছিল। সবাই এক এক করে বাড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছিল। অমিয় আর হারান একসঙ্গে কিছুটা এল বোসেদের পুকুর পাড় অবধি। ওখান থেকে ওদের পথ আলাদা আলাদা। দুজনে দুদিকে যাওয়ার আগে একটু দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করতে থাকল। শেষে অমিয় গেল নিজের বাড়ির দিকে। কিছুটা রাস্তা চলার পর হারানের হঠাৎ মনে পড়ল বিশুকে বলে আসেনি ক্যাশবাক্সো থেকে টাকা নিয়ে বাড়িতে দিয়ে দিতে। রোজ রাতে সে অল্প কিছু খুচরো ছাড়া বাকি টাকা বাড়ি নিয়ে গিয়ে রাখে। খরচখরচা বাদ দিয়ে কিছু টাকা একত্তর হলে হলে দুগ্গা পোস্টাপিসে জমা করে দেয়। দোকান তার বাড়ি যাওয়ার রাস্তাতেই পড়বে। ভাবল ক্যাশবাক্সো থেকে টাকা নিয়ে নেবে আর একবার দেখেও নেবে বিশু ঠিকঠাক সব বন্ধঝন্ধ করেছে কিনা। দোকানের দ্বিতীয় চাবিটা তার কাছেই ছিল।
    আড্ডা মারতে মারতে খেয়াল করেনি রাস্তায় লোক আর নেইই বলতে গেলে, সব চলে গেছে। অমাবস্যার অন্ধকার ঘুটঘুট্টি রাস্তাঘাট, কিছু ভালো করে দেখা যায়না। হাতে টর্চ ছিল কিন্তু সেটা দুদিন ধরে মিনমিন করে জ্বলে আজ জবাব দিয়েছে, ব্যাটারী বদলাবে করে করেও ভুলে গেছে। দুরে ধোপাদের উঠোনে একটা টেমি জ্বলছে।
    হারান এমনে সাহসীও নয় আবার ভীতুও বলা চলেনা। তবু আজ একটু কেমন গাটা ছমছম করছিল।
    কোনোরকমে পা চালিয়ে দৌড়ে দোকানের দাওয়াটায় উঠলো। একটু এগিয়ে ঝাঁপটা খুলতেই পিছন থেকে মাথায় কিসের একটা যেন বাড়ি পড়ল!
  • shrabani | 124.124.86.102 | ০৩ মে ২০১০ ১৫:৩৭449800
  • রাত প্রায় এগারোটার সময় হারানের বোন দুগ্গা লন্ঠন হাতে করে বেরোলো। শীতে সারা পাড়া নিশ্চূপ। শুধু পাশের বাড়িতে হরি রায় শোবার আগে বিছানায় বসে একটানা কেশে যাচ্ছে। তার বউ চাপাগলায় রোজকার মতই বিলাপ করছিল সারাদিন খেটেখুটে শোবার সময় এই জ্বালাতনের জন্য।
    প্রতি শীতেই হরি রায় রাতে এই সময় বিদঘুটে ভাবে কাশে ঘন্টাখানেক। যদিও সকাল থেকে সারাদিন সে দিব্যি ঠিক থাকে।

    রাস্তার দিকে ওদের শোবার ঘর, জানালা বন্ধ। দুগ্গা প্রথমে আস্তে করে জানালায় টোকা মারল, কিন্তু কাশির শব্দ সেই শব্দকে ছাপিয়ে গেল। এবার সে জোরে জোরে ধাক্কা মারে। "কে রে, কে রে জানলায়" , কাশি ভুলে হরি চিল্লিয়ে ওঠে।
    -"আমি কাকা, আমি দুগ্গা। একটু খোলো না বলছি।"
    জানালা খুলে যায়,
    -"কি রে এত রাতে কি হল?"
    -"কাকা, দাদা সন্ধ্যে থে বারোয়ারীতলায় গেছিল, বিশে দোকানের চাবি দিয়ে বলে গেলে। তা এতখানি রাত হোলো, এখনও তো ফিরলনা।"
    -"সেকিরে? আমিও তো ছিলুম বারোয়ারীতলায়। সে তো রাত নটা নাগাদই সব খালি হয়ে গেসল। এখনও ফেরেনি, কারো ঘরে বসে যায় নি তো?"
    দুগ্গা একটু ভাবল,
    -"এত রাতে আবার কার ঘরে কে জেগে বসে থাকে গাঁয়ে? আমি আর বউ এখনো হাঁড়ি নিয়ে বসে আছি, দাদা নটা বাজলেই খেতে দাও খেতে দাও করে।"
    হরিও কি বলবে ভেবে পায়না। তাও বলে,
    -"চল বেরোই, বারোয়ারীতলার দিকটা খুঁজে দেখি।"
    দুগ্গা একটু ইতস্তত করে,
    -"কাকা, তোমার এই শরীলে বেরোবে এত ঠান্ডায়?"
    ঘরের থেকে হরির বউ খরখর করে ওঠে,
    -"চুপ কর তো দুগ্গি। আজ এত বছর ধরে দেখছি এই ঢঙের কাশি। মানসের বিপদ আপদে অত ঠান্ডামান্ডা দেখলে চলে নাকি!
    মেয়েটা একা, এত রাত্তির, তুমি ভালো করে আলোয়ান জড়িয়ে মাথা চাপা দিয়ে হ্যারিকেনটা নিয়ে যাও দিকিনি।"
    তৈরী হয়ে বেরোতে বেরোতে আরো দুচারজন লোক জুটে গেল। রাত গভীর হয়নি, ওদের কথাবার্তার ফাঁকে এদিক সেদিক পাড়ার আরো বাড়ির লোক জেগে গেছিল। দুটো টর্চ আর লন্ঠন নিয়ে জনা পাঁচেক লোক আর দুগ্গা মোয়ানের পথে শর্টকাট রাস্তা ধরে বারোয়ারীতলায় গেল।

    কেউ কোথাও নেই, দু চারটে কুকুর একটু দুরে সাঁতের দোকানের দাওয়ায় ঘুমিয়েছিল। মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে জেগে উঠে তারস্বরে কোরাস ঘেউউউ রাগ ভাঁজতে শুরু করে দিল। কে একজন বললে একবার অমিয়র ওখানে দেখার কথা, তার সাথেই হারানকে দেখা গিয়েছিল সন্ধ্যেতে।
    ইচ্ছে না থাকলেও দুগ্গাকে ঠেকায় পড়ে সায় দিতে হল। তার দাদার সঙ্গে অমিয়র বন্ধুত্ব সে খুব একটা ভালো চোখে দেখেনা। তার অবিশ্যি কারণও আছে।

    অমিয়র ছোট থেকেই হারানের বন্ধু হিসেবে ওদের বাড়ীতে যাতায়াত ছিল। দুগ্গা ছোট থেকে দাদার ফাইফরমাশ খাটত এদের পায়ে পায়ে ঘুরে। বড় হয়ে শাড়ী ধরা ইস্তক সে অবশ্য অমিয়র সামনে বিশেষ আসতনা। তবু এক আধবার আসতে যেতে চোখাচোখি হয়ে গেছিল। অমিয় তখন পড়া ছেড়ে ব্যবসায় ঢুকেছে সবে। বাড়িতে ঘটকী আসছে সম্বন্ধ নিয়ে। হারানদের অবস্থা তখন খুবই খারাপ, হারানের চাকরিবাকরি নেই, বাপ মৃত্যুশয্যায়। অমিয়ই প্রস্তাবটা দেয় হারানকে, দুগ্গাকে তার মনে ধরেছে, হারান গিয়ে তার বাপের সঙ্গে কথা বলুক, সে বাপ মাকে বোঝাবে। হারানদের বাড়ীর সবাই খুব খুশী, এ প্রায় লটারী পাওয়ার মতো ব্যাপার। কিন্তু কার্যত ব্যাপারটা এত সোজা হয়না, পালকত্তা হারানকে বাছা বাছা গালাগাল, যেমন বামুনের চাঁদ ধরা ইত্যাদি সহ দিয়ে ঘর থেকে প্রায় দুদ্দুর করে তাড়িয়ে দেয় এবং সত্বর একটি ভালো পাত্রী এবং মোটা পণ দেখে ছেলের বিয়ে দিয়ে দেয়। অমিয়ও বাপের সুপুত্তুরের মত টোপর পড়ে পিঁড়িতে বসে পড়ে ও পরদিন থেকে বিয়েতে পাওয়া নতুন সাইকেলে সারা গাঁ টহল দিতে থাকে শুধু হারানদের পাড়াকে সযত্নে এড়িয়ে চলে।

    এরপরে পাকেচক্রে দুগ্গার আর বিয়েই হয়না, দু চারটে সম্বন্ধ যে আসেনি তা নয় তবে সে কেমন যেন গরজই করেনি। হারান বরাবরের একটু দুর্বল প্রকৃতির, বাবা এর কিছুদিন পরে মারা যেতে দুগ্গাই সংসারটার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিল। পালেদের বাড়ীতে সেই থেকে তাদের সঙ্গে যাতায়াত বা কোনো সম্পর্কই নেই। ইদানীং হারান শহর থেকে ফিরে দোকান দেওয়ার পরে অমিয়র সঙ্গে তার পুরনো বন্ধুত্বটা ঝালাই হলেও দুজনের একে অপরের বাড়ী আসাযাওয়া এখনো নেই। তাই হারান অমিয়র বাড়ী এত রাত অবধি বসে থাকবে এটা হয়না তা দুগ্গা জানে তবু সকলের সাথে সেও চলল।

    দলটা চলল পালপাড়ার দিকে। অমিয়দের ওখানে দরজা ধাক্কা দিতে তারা তো উঠলই, আশেপাশের লোকও উঠে পড়ল। এমনিতেই চুরির পরে গাঁয়ে লোক একটু সজাগ ছিল। অমিয় তো অবাক, তারা দুজনে একইসঙ্গে যে যার বাড়ির দিকে গেছিল। এই প্রথম দুগ্গার মুখে ভয়ের ছায়া, কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা।
    -"তোমরা দোকান হয়ে এসেছ? এমন তো নয় বাড়ি যাওয়ার পথে দোকানে গেছে।"
    অমিয়ই বলল কথাটা প্রথমে। কিন্তু দোকানে এতক্ষণ ধরে কি করবে? এই ঠান্ডায় পথে শেয়াল কুকুর পর্যন্ত নেই যেখানে সেখানে দোকানে কোন খদ্দের আসবে বলে বসে থাকবে! দলে আরও লোক জুটে গেল, অমিয়ও চলল সাথে। দোকানের দাওয়ায় একসাথে আলো পড়ল অনেকগুলো আর সেই আলোয় সবাই দেখল হারান মাটিতে পড়ে আছে। দরজা হাট করে খোলা। একদল গিয়ে হারানকে ধরল, অন্যরা টর্চ নিয়ে আশেপাশে খুঁজে দেখতে থাকল কেউ কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা। জলের ছিটে টিটে দিয়ে কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান তো ফিরল হারানের কিন্তু কেমন যেন হাবলের মতো চেয়ে রইল, মুখ দিয়ে রা সরেনা।
    দুগ্গা এমনিতে কাঠখোট্টা ধরণের মেয়ে, সংসারের ভার সামলাচ্ছে অনেকদিন শক্ত হাতে, কোনো কিছুতে সহজে বিচলিত হয়না। তবু আজ ভাইকে এ অবস্থায় দেখে একেবারে কাঁদকাঁদ হয়ে পড়ল। দোকানের ক্যাশবাক্সর ফঙফঙে তালাটা ভাঙা। ভেতরে কিছু খুচরো পয়সা পড়ে আছে। হারানকে জিজ্ঞাসা করে কোনো হদিশ পাওয়া গেলনা বাক্সে কত কি ছিল। দরজার চাবি তালায় ঝুলছে। অমিয়রা এদিক ওদিক ঘুরে এল স্কুল পজ্জন্ত, কিছু নজরে পড়লনা। দরজা বন্ধ করে চাবি তালা লাগিয়ে হারানকে নিয়ে বাড়ি ফিরল সবাই। দুগ্গা একটু আপত্তি করছিল, দোকানে মালপত্তর অনেক আছে, চোর যদি ফিরে আসে। সে নিজেই দোকানে শোবে।
    সবাই এক বাক্যে নাকচ করে দিল এ প্রস্তাব, এতো সহজ চোর নয়, দু:সাহসী। হারানকে ছাড়েনি আর দুগ্গা তো যতই হোক মেয়েমানুষ। গায়ের জোরে পেরে উঠবে কেন, চোর যদি আবার ফিরে আসে। অতএব বাবা পঞ্চানন্দর ভরসায় দোকান ছেড়ে সবাই চলল। কাল সকালে যা হয় ব্যবস্থা করা যাবে!
  • Nina | 64.56.33.254 | ০৩ মে ২০১০ ২০:৪৮449801
  • উরিব্বাস! তবে যে বল্লে এটা রহস্য গপ্প নয়?! কতক্ষণ আর কতক্ষণ পরে , পরেরটা :-((

  • Nina | 64.56.33.254 | ০৫ মে ২০১০ ০০:৪১449802
  • ও শ্রাবণি , কোথায় গেলে-----
  • aranya | 144.160.226.53 | ০৫ মে ২০১০ ০২:১৬449804
  • বেশ জমাটি হচ্ছে, শীর্ষেন্দুর কিশোর উপন্যাস-গুলোর মত।
  • rabaahuta | 203.99.212.53 | ০৫ মে ২০১০ ১৩:০১449805
  • :-|
  • de | 59.163.30.2 | ০৫ মে ২০১০ ১৪:২৬449806
  • শ্রাবণী,
    নেশা ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেলে!
  • Nina | 76.124.208.64 | ০৬ মে ২০১০ ০২:২৪449807
  • বসে আছি পথ চেয়ে--------
  • shrabani | 124.30.233.102 | ০৬ মে ২০১০ ১১:৩৩449808
  • থানায় আজ একদমই ভীড়ভাড় নেই। সকালের রোদ এসে পড়েছে সামনের বারান্দায়। সেখানে কাঠের বেঞ্চির ওপর বসে বসে দুই কনস্টেবল খৈনি ঠুকতে ঠুকতে সুখ দু:খের গল্প করছিল। রামভজন বিহার মুলুকের আর তার সঙ্গী মানিকের বাড়ি এদিকে কাছেই। দুজনের খুব ভাব, রামভজন মানিককে কুস্তির প্যাঁচ শেখাবে কথা দিয়েছে, শুধু ঠিকমত একটা জায়গা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা যেখানে সে তার কসরত দেখাতে পারে। এখানকার মাঠটাট গুলোতে শক্ত এঁটেল মাটি ভরা। বালি ফেলে ফেলে নরম জমি বানাতে হবে তবেই কুস্তি করা যাবে। আজ সকালেও দুজনে এই নিয়েই দু:খু করছিল। এই পোড়া বাংলাদেশে এসে রামভজনের অত বড় ওস্তাদি বিদ্যেটাই নষ্ট হতে বসেছে। সেরকম চোরডাকুও নেই এতল্লাটে যে তাদের মেরে একটু মহড়া দিয়ে নেবে। যত সব ছিঁচকে কাঠি কাঠি চেহারার চোরের দল। তাদের ওদিকে এক একটা ডাকুই কমকরে বিশমণী।

    শিবু যখন সনাতন আর রঘুকে নিয়ে থানায় পৌঁছল তখন ঘন্টা দারোগা সবে জলখাবার খেয়ে থানায় এসে বসে চা খাচ্ছে। ঘন্টা দারোগার নাম ঘন্টেশ্বর বা ঘন্টাকর্ণ ঐ জাতীয় কিছু হবে। তার বাড়িতে এক জাঁদরেল পিসী আছে। পিসী যখন "ঘন্টা" বলে হাঁক দেয় সেই ডাক বাসার দেওয়াল ভেদ করে থানায় সবার বুক কাঁপিয়ে দেয়। দারোগা ছেড়ে বোধহয় চোরেরাও ভয় পায় ঐ ডাককে। এমনিতে ঘন্টা দারোগার মধ্যে একজন ভালো দারোগা হবার সব গুণই আছে। চেহারা যথেষ্ট গাঁট্টাগোঁট্টা, উদ্যমী, ভীতু নয়, একমাত্র পিসী আর বৌকে ছাড়া কাউকে ভয় করেনা। কেস টেস এলে অত্যন্ত যত্নসহকারে তল্লাশ করে, খুব ঘোরাঘুরিও করে কিন্তু অপরাধী কেন জানি ঠিক নাগালে আসেনা! উপরওয়ালারাও তার উদ্যমটা দেখেনা ঐ কেস শেষ হল কিনা, অপরাধী ধরা পড়ল কিনা, সেইসব দেখতেই ব্যস্ত। আর সেজন্যে বছরের পর বছর ঘন্টা দারোগা একই জায়গায় রয়ে যায়, তার পদোন্নতি আর হয়না। এমনিতে এই জায়গাটা মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। চোরেদের ও গ্রামবাসীদের মধ্যে সুন্দর বোঝাপড়া, চুরিটুরির রিপোর্ট করতে থানায় কেউ বড় একটা আসেনা। পদোন্নতির ব্যাপারটা বাদ দিলে ঘন্টা মোটমুটি সুখেই আছে এখানে।

    শিবুদের দেখে দারোগা বেশ খুশীই হলে। খুব আপ্যায়ন করে বসালে সবাইকে। শিবুরাই বরং এট্টু ইতস্তত করছিল। যেমনই হোক তবু থানার আলো আঁধারির ভেতর জ্যান্ত দারোগা বলে কথা, একটু যেন গা ছমছম করে। ভয়টাকে কাটিয়ে শিবুই প্রথম মুখ খুলল, নালিশটা প্রধানত তো তারই।
    -"দারোগাবাবু, পর্শু রাতে আমাদের বাড়িতে একটা চুরি হয়ে গেছে, তারই রিপোর্ট লেখাতে এসেছি।"
    ঘন্টা একটু লাফিয়ে উঠল,
    -"চুরি? তা থানায় এসেছিস মানে বড় চুরি। আ: কতদিন যে চোর দেখিনি। তা চোরটাকে ধরেছিস তো? আছে কোথায় সে? সঙ্গে নিয়ে এলে পারতিস, গারদটা এখন অনেক পাকাপোক্ত, সারানো হল কিনা গেলমাসে। আগে দুএকবার চোর ভেগেছিল বটে তবে সে তখন গারদে কিছু ফাঁক ছিল তাই। এখন আর সেসব ভয় নেই।"
    শিবুরা মুখ তাকাতাকি করল। তারপরে সবিনয়ে বলল,
    -"মানে চোরটাকে ঠিক ধরা যায়নি তবে সবাই চেষ্টায় আছে, ধরতে পারলেই নিয়ে থানায় আসবে। তা গাঁয়ের মাথারা তাই আপনার কাছে পাঠালো। আপনার এত অভিজ্ঞতা, এই চোর ধরার ব্যাপারটাতে যদি একটু সঙ্গে থেকে পরামর্শ দেন, তাহলে কাজের সুবিধে হয়, এই আর কি।"
    ধরা যায়নি শুনে ঘন্টা যেন একটু মিইয়ে গেল তবে সেটা ঠিক প্রকাশ করল না।
    -"হুঁ, ব্যাপারটা ঠিক কি হয়েছিল বল দিকি।"
    ওরা বিস্তারিত বলল, তার সঙ্গে শেষে কাল হারানের দোকানের চুরির কথাটাও জুড়ে দিল। এবার আর দারোগার হতাশা চাপা রইল না। সে বিলাপ করতে শুরু করল,
    -"ওরে বাবা, পরপর দুটো চুরি, মানে আবার দুটো ঢ্যারা পড়ে যাবে আমার নামের পাশে। পুলিশ সাহেব আরো রেগে যাবে শুনে। এবারেও আর প্রোমোশনটা হতে দিলিনি তোরা।"

    শিবুরা অধোবদনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। রাম আর মাণিক দারোগাবাবুর দুইদিকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভঙ্গী করে দাঁড়িয়ে রইল। সারা থানায় একটা শোকাকুল ভাব। শেষমেশ দারোগাই সবার আগে সামলে নিলেন। রামভজনকে বললে,
    -"কি আর করা, সবই আমার ভাগ্য। যা রাম, নিয়ে আয় ঐ নালিশ লেখার খাতাটা। আর শিবু তুই একটু আস্তে আস্তে বল বাবা আমাকে পুরো ব্যাপারটা।"
    নালিশ লিখেটিখে সইসাবুদ হয়ে গেলে শিবুরা ওখান থেকে মানেমানে কেটে পড়লে। দারোগা আর তার চেলারা তখনও হাহাকার করে যাচ্ছে!
  • shrabani | 124.30.233.102 | ০৬ মে ২০১০ ১১:৪১449809
  • আজও সকালে হারান দোকানে এসে বসেছে যদিও বাড়ীতে সবাই বারন করেছিল। দুগ্গা নিজেই আসছিল বিশেকে নিয়ে। কিন্তু যতই হোক রাস্তার ধারে দোকান, নানারকমের লোকের আনাগোণা, মেয়েছেলে দোকানে বসলে পাড়ার লোকে কি বলবে!
    এসব দুগ্গাকে বললে সে ক্ষেপে যাবে তাই কথা না বাড়িয়ে হারান বিশের সাথে আস্তে আস্তে দোকানে এসে বসল। শরীরে চোট তার তেমন কিছুনা, মাথার পিছন দিকটা শুধু ফুলে আছে একটু। নীলু ডাক্তার কাল রাতেই ওষুধ দিয়েছিল, ব্যাথাটা তেমন নেই। তবু কেমন একটা বেভুল লাগছে, কি ভাবে কি হল কাল সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা।

    আশু চাটুজ্যে এসে যথারীতি তার জায়গায় বসে আছে। বিশে চায়ের যোগাড় করতে করতে নজর রাখছে তার দোকানের বিক্রীর দিকে, ভুলটুল না করে বসে। বাড়ী থেকে নজর রাখতে বলে দিয়েছে ওকে। একজন দুজন করে খদ্দের আসছে। গাঁয়ের চেনারা এসে সওদা করার সাথে সাথে তার খোঁজ নিচ্ছে। বাইরের লোকে এখনো খবর শোনেনি তবে গাঁয়ে রটে গেছে। বাগেদের দুখী এল গুড় আর চা কিনতে। ধারে চাইতেই বিশে ঐদিক থেকে ইশারা করতে থাকল ধার না দিতে, দুখীদের অনেক বাকী পড়ে আছে।
    দুখী খুব মায়া ভরা গলায় একটু সুর টেনে বলে,
    -"মাগো, তোমার মতো মনিষ্যি র এমন খেতিটা কে কল্লে গো, একরাতেই চ্যায়রা টা যেন অদ্ধেক হয়ে গেছে। এযে চোখে দেখা যায়নি গো দাদা, দেশটার কি হোলো!"
    হারানের বেভুল মাথা এত দরদের কথায় আরো ভ্যাবাচাকা খেয়ে কেমন সম্মোহিতের মত বিশের ইশারায় দৃকপাত না করে দুখীকে মাল দিয়ে দিল। দুখীও মাল হাতে পেয়েই দৌড় মারে।
    বিশে মহারোষে একফাঁকে এসে ধমকে গেল,
    -"দিদি মানা করেছে না ঐ হিরুইনকে বাকীতে দিতে। ও সুর করে চাইল আর তুমিও দিয়ে দিলে?"
    হারানের আজ আর তক্ক করতে ভালো লাগছিলনা। সে চুপ করে রইল।

    একবার বারোয়ারী কালী পুজোয় গাঁয়ের ছেলেছোকরাদের শখ হল যাত্রা করবে। দত্তদের ছোট তরফের অমুল্য দত্ত যাত্রা সিনেমার পোকা, অল্প বয়সে পড়াশুনা ডকে তুলে কলকাতায় গেছিল সিনেমায় কাজ করতে। কিছুকাল এদিক ওদিক ঠোক্কর খেয়ে আবার গাঁয়ে ফিরে আসে। বাপ তেজ্যপুত্র করতে গেসল, অন্য ভায়েরা আর গাঁয়ের পাঁচজনে কোনোরকমে ঠেকায়। এখন বয়স হয়ে গেছে, চাষবাসে ঘোর সংসারী তবু মাথার পোকা এখনও সারেনি। ছেলেরা তাকেই ধরল, সেও আনন্দের সঙ্গে সব ভার নিল। পালাটালা ঠিক হল, বই এসে গেল, রিহার্সাল শুরু হয়ে গেল জোর কদমে। যতই এগোচ্ছিল ততই মহিলা চরিত্র নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিতে থাকল। প্রথমত ছেলেদের মহিলা চরিত্রে পার্ট করতে যদিও রাজী করানো গেল, তারা মেয়েদের মত ভাবভঙ্গীতে রীতিমত আনাড়ী। শিখতেও চায়না কারন বন্ধুমহলে পরে তাই নিয়ে মজা করা হয়। এই এক কারণে ঠিক জমছিল না পালাটা। অনেক শলাপরামর্শের পরে ঠিক হল অন্তত রাজকুমারীর চরিত্রে যদি একজন মেয়ে পাওয়া যায়। থিয়েটারের মেয়ে বাইরে থেকে ভাড়া করে আনা খরচ সাপেক্ষ, তারওপর কর্তারা মত দিলনা। কি জাতের মেয়ে সব ভাড়া খাটে কে জানে! বাড়ীর মেয়েরা তো প্রশ্নেরই বাইরে।

    দুখী গাঁয়ের ভাষায় ছোটজাতের হলেও খুবই জাঁদরেল মেয়ে। শ্বশুরবাড়ীতে বর মদ খেয়ে মারত আর শাশুড়ী অত্যাচার করত বলে শেষে একদিন দুজনকেই উনুনের চ্যালাকাঠ দিয়ে বেদম ঠেঙিয়ে বাড়ী পালিয়ে আসে। সেই থেকে সে বাপের বাড়ীতে। মা ছাড়া তার আর কেউ নেই, মা মেয়ে মাঠে আর লোকের বাড়ীতে কাজ করে দুটো পেট চালিয়ে নেয়। একা স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েছেলে, দু একজন লোকে মন্দ প্রস্তাব দিতে গিয়ে প্রায় মার খেয়ে ফিরে এসেছে। সবাই সেইথেকে দুখীকে বেশ সমঝে চলে।

    দুখী দত্তদের বাড়ী খামারে কাজ করত, ফাঁকে ফাঁকে আর পাঁচজনের মতো সেও ওদের বৈঠকখানায় যাত্রার রিহার্সাল দেখত আড়াল থেকে, দাড়িগোঁফওলা ছেলেদের মেয়ের পার্ট করতে দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ত। অমূল্য দত্তকে সে বাবা বলে ডাকে। গন্ডগোলের ব্যাপারটা কানে যেতে কি ভেবে সে নিজেই একদিন প্রস্তাব দেয় সে রাজকুমারীর পার্ট করবে বলে। অন্য কেউ হলে হেসে উড়িয়ে দিত কিন্তু দত্তমশাই নিজেকে কোনো বড় পরিচালকের চেয়ে কম মনে করেন না তাই প্রচুর লোকের ওজর আপত্তি সত্বেও তিনি গোঁ ধরে দুখীকে রাজকুমারীর রোলে নামালেন। দত্ত অনেক পরিশ্রম করে শিখিয়েছিল, দুখী মন দিয়ে শিখেওছিল। মোটামুটি পালার দিন সব ঠিকঠাকই উতরে গেছিল, পাউডার টাউডারে, আসরের উঙ্কÄল আলোয় দুখীর কালোকিষ্টি রঙও ম্যানেজ হয়ে যায়। শুধু মাঝেসাঝে ডায়ালগ উচ্চারনে একটু গড়বড় হয়ে যায়। এই যেমন যখন সভায় রাজা রাজকুমারীর প্রেমিককে প্রাণদন্ড দিয়েছেন, তখন রাজকুমারী আলুথালু বেশে দৌড়তে দৌড়তে এসে সভার মাঝে লুটিয়ে পড়ে বলে,
    "ওকে নয় ওকে নয় মোকে মারুন মোহারাজ"।
    বড় করুণ দৃশ্য, কিন্তু ঐ "মোকে" আর "মোহারাজ" শুনেই চারিদিকে চাপা খুকখুক। এরকম কিছু কিছু গন্ডগোল ছাড়া বাকী সব ঠিকই ছিল।

    পালার পরে সব আবার যেই কে সেই। কেন যেন এরপরে আবার পালা করার উৎসাহ দেখা যায়নি, না পরিচালকের না অভিনেতাদের মধ্যে। দুখী আবার তার মাঠের কাজে ফিরে গেছে তবে গাঁয়ের ফাজিল কুচোকাচারা তাকে দেখলেই দুর থেকে "হিরুইন, হিরুইন" বলে পেছনে লাগে। দুখী তাতে রাগ করেনা, বরং ব্যাপারটা নিয়ে তার একটু চাপা গর্বই আছে আর তার কথাবার্তা এখনো মাঝে মাঝেই একটু সুরে টানা শোনায়, ডান হাতটাও প্রায়সই কথা বলতে গিয়ে ওপরে উঠে যায় ডায়ালগ বলার ধরণে!
  • shrabani | 124.30.233.102 | ০৬ মে ২০১০ ১১:৪৬449810
  • কালকের ধকলের পরে একটু ঝিমিয়েই বসেছিল হারান। চুপচাপ যন্ত্রের মতো খালি খদ্দেরকে মাল দিয়ে যাচ্ছিল। এদিক ওদিক খুব একটা নজর করছিল না। একজন এসে আড়াইশ বিস্কুট চাইল। পয়সা নিতে হাত বাড়াতে হাতে একটা আস্ত পঞ্চাশ টাকার নোট পড়তেই মুখ তুলে খদ্দেরের দিকে তাকাল। এখানে কেউ এত টাকা নগদ নিয়ে সওদা করতে বড় একটা আসেনা, মাসকাবারীর হিসেব করতে হলে অবিশ্যি আলাদা কথা। তাকিয়ে যে মুখ দেখল সে তার অচেনা। এ দিকে কোনোদিন দেখেছে বলে মনে পড়েনা। কালো রোগা ঢ্যাঙা সিড়িঙ্গে মার্কা চেহারা, গাল দুটো ভেতরে ঢোকা। পরণের ধুতি আধময়লা, জামার ওপর একটা পুরনো ছাইরঙা সোয়েটার। ছোটছোট চোখদুটো বনবন ঘুরছে, দেখলেই অসম্ভব ধূর্ত মনে হয়। হারান একগাদা খুচরো ধীরে ধীরে গুনতে গুনতে সামনে দাঁড়ানো লোকটার কথা ভাবতে লাগল, কাল সন্ধ্যায় ওর দোকানে চা খাচ্ছিল আশু চাটুজ্যের পাশে বসে সেই লোকটা নয় তো! কাল বেশ কিছু মাসকাবারী হিসেবের টাকা পেয়েছিল। এই পঞ্চাশ টাকার নোটটা ওরই ক্যাশবাক্সো থেকে আসেনি তো!

    মাথার বেভুল ভাবটা গিয়ে চনমনে ভাব ফিরে এল। যদি সে লোক নাও হয় তবু কালকের পরে কোনো ভিনদেশী কে না বাজিয়ে ছাড়া ঠিক হবেনা। মুখটা হাসি হাসি করে পয়সা ফেরত দিতে গিয়ে বলল,
    -"একটু গুণে নিন দাদা, খুচরো পয়সা অনেকগুলো, গোণায় ভুল হতে পারে।"
    লোকটা একটু হকচকিয়ে পয়সা হাতে নিয়ে এক নজর দেখেই পকেটে পুরে ফেলল। গুনলো না, তার মানে কষ্টের পয়সা নয়! যাবার উদ্যোগ করছে দেখে হারান আবার শুরু করল,
    -"দাদাকে তো এদিকে আগে দেখিনি, কুটুম নাকি?"

    এদিক সেদিকে দু তিনজন নতুন খদ্দের, হারানের গলা শুনে তারাও তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে। চারদিক দেখে লোকটা একটু হতাশ মতো হয়ে শেষমেশ দাওয়ার ওপরের ভাঙা মোড়াটার ওপর বসে পড়ল। তারপরে বিশের দিকে তাকিয়ে বলে,
    -"ভাই চা আছে নাকি, দাও তো একটা কাপ। এই বিস্কুট দিয়ে খাবো। সকাল থেকে এখনো পেটে কিছু পড়েনি। তার আগে এক গ্লাস জল পাওয়া গেলে ভালো হত।"
    বিশে একটা প্লাস্টিকের গেলাসে জল এনে দিয়ে লোকটার সামনে চায়ের কাপ রাখল। সবাই উৎসুক হয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে। এক ঢোকে জলটা শেষ করে জামার হাতায় মুখ মুছে চায়ের কাপটা টেনে নিল। ঠোঙা থেকে দুখানা বিস্কুট নিয়ে চায়ে ডুবিয়ে খেল। তারপরে সুরুৎ করে চায়ে একটা চুমুক দিয়ে আ: করে আওয়াজ করল। শ্রোতারা এবার ধৈর্য্য হারিয়ে উসখুস করতে লাগল। হারান নিজের জায়গায় বসে একদৃষ্টিতে লোকটার রকমসকম দেখছিল। প্রাথমিক হকচকানি ধরা পড়া ভাবটা কাটিয়ে লোকটা এখন নাটক করছে। গন্ডগোল কিছু একটা আছে তার মন বলছিল। একজন আর থাকতে না পেরে বলে উঠল,
    -"তা কত্তার নিবাস কোথায়? আসছেন কোত্থেকে?"
    এর জবাবে লোকটা একটু মিচকের মতো এক চোখ অদ্ধেক বুজিয়ে বলল,
    -"আসছি চাঁদ থেকে, নিবাসও ঐ চাঁদে।"
    ধুস! লোকেরা এবার পুরোপুরি উৎসাহ হারিয়ে যাদের কেনাকাটা বাকি ছিল তারা হারানের কাছে গেল, যাদের মিটে গিয়েছিল তারা রাস্তায় নামল।
  • shrabani | 124.30.233.102 | ০৬ মে ২০১০ ১১:৫৪449811
  • তাই দেখে লোকটা একবার হারানের দিকে আড়চোখে দেখল, হারানও মাল বেচতে বেচতে লোকটার দিকেই নজর রেখেছিল। চোখাচোখি হতেই অপ্রস্তুত হয়ে লোকটা আতা বিচির মতো কালো কালো দাঁত বার করে হেসে বলে,
    -"ঐ দ্যাখো, তোমাদের গাঁয়ে রহস্য করে কথা বলার জো নেই নাকি? আরে চাঁদ মানে চাঁদপুর গো চাঁদপুর। আমি চাঁদপুরের ললিত সামন্তর কাঠগোলার ম্যানেজার। কাঠ কেনাকেনির সুবিধে দেখতে এদিকের সব গাঁ ঘুরে বেড়াচ্ছি।"
    -"নামটি কি দাদার?" হারান শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল।
    -"অ্যাঁ, মানে আমার নাম। তা নাম হল গিয়ে গোকুল, গোকুল গুঁই।" দোকান খালি হয়ে এল প্রায়, লোকটা তখনও মোড়ায় বসে। বেলা হয়ে এসেছিল, হারান নিজের জায়গা থেকে উঠে এল। বিশে চায়ের বাসন ধুতে পুকুরে গেছে। দাওয়ার ওপর আশু চাটুজ্যে নিজের জায়গায় বসে তখনও। তার মানে এখনও নাওয়া খাওয়ার সময় হয়নি। হারান নিশ্চিন্তে লোকটির একটু কাছ ঘেঁসে এসে বলে,
    -"তা আপনি কাল রাতে ছিলেন কোথায়, চাঁদপুর তো দুর পড়ে এখান থেকে? খাওয়া দাওয়াই বা কোথায় করেন?"

    -"আরে ভায়া, আমি কি আর এই একটা গাঁয়েই ঘুরছি, নানান দিকে যাচ্ছি তো, তা প্রায় সাতদিন হল বেরিয়েছি। ঐ রাতে একটা যে কোনো ব্যবস্থা করে নিই, খাওয়াও হয়ে যায় রাস্তার ধারে ভাতের দোকান পেলে ভাত নাহলে এই মুড়ি চিঁড়ে। আমার খাওয়াদাওয়ার খুব একটা ঝঞ্ঝাট নেই, বুঝলে কিনা। তা তোমার নামটি কি?"
    হারান একটু ধন্দে পড়ল, এমনিতে লোকটা যা বলছে তা অবিশ্বাস করার মত কিছু নয় যদি না কালকে সন্ধ্যের লোকটাই এই লোকটা হয়।

    বিশে ফিরতে ফিরতে গোকুল তখন জমে গেছে, নানা গল্পগাছা শুরু করেছে।
    -"এই কাল সাঁঝরাতে জোড়হাট থেকে কাসুন্দির দিকে যাচ্ছি। ঐখানে আমাদের এক মহাজন থাকে, ভেবেছিলুম রাতটা সেখেনেই কাটিয়ে দেব। কাসুন্দি গাঁয়ে ঢোকার আগে শ্মশান পড়ে। তা রাত বেশী হয়নি, রাস্তায় লোক চলাচলও করছিল, তাই সেরম একটা ভয় করেনি। নিজের খেয়ালে হাঁটছিলুম কাজের কথা চিন্তা করতে করতে। হঠাৎ দেখি শ্মশান যেখানে শেষ হয়েছে, রাস্তার একধারে বাঁশঝাড় আর একধারে খালি মাঠ। এক লম্বা বাঁশ রাস্তায় নুয়ে পড়ে আছে। পিছনে একটা চাষাভুষো মতন লোক ছিল। আমি তো বাঁশ ডিঙোতে প্রায় যাচ্ছিলুম আর কি, লোকটা এসে আমার হাত ধরল। "করো কি কর্তা, প্রাণে বাঁচবেনি যে"।"
    হারান কিছু বুঝতে না পেরে হাঁ করে থাকে , বিশুরও চোখ গোলগোল। গোকুল সামন্ত ওদের অবস্থা দেখে হাসে,

    -"বুঝলেনি তো? পেত্নীতে বাঁশ পেতে রেখেছে। যেই আমি বাঁশের উপর দিয়ে ডিঙোতে যাব, বাঁশ তুলে নেবে আর তার সঙ্গে আমাকেও তুলে আছড়ে মারবে, তারপরে ঘাড় মটকে রক্ত খাবে। লোকটা আমার হাত ধরে রাস্তা থেকে নামিয়ে দিল, মাঠের ধারের কাদায় নেমে জায়গাটা পার করলুম আমরা। খুব জোর বেঁচে গেছি। শুনলুম এরকম ওখানে হামেশাই দেখা যায়। ওদিককার লোকে জানে, পেরিয়ে যায় ঠিকঠাক, এই আমার মতো ভিনগাঁয়ের লোকে এলে বিপদ হয়।"
    লোকটির গল্প বলার ধরণটি ভালো, হারান তার কিছু আগের সন্দেহের কথা ভুলে গিয়ে গোগ্রাসে ওর গল্প গিলতে থাকে। সময়ের খেয়াল থাকেনা কারোরই। হঠাৎ একটা হালকা শব্দ শুনে হুঁশ হয়, তাকিয়ে দেখে আশু চাটুজ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে বাড়ি যাবার জন্য।

    তাই দেখে বিশে উঠে পড়ে গোছাতে থাকে, তাদেরও নাওয়ার খাওয়ার সময় হয়েছে। হারানের বড় ইচ্ছে হচ্ছিল গোকুলকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে দুটি ভাত খাওয়ায়। কিন্তু বউয়ের আর বোনের মুখ মনে করে ইচ্ছে টাকে সামলায়। গোকুল গুঁইও উঠে পড়ে। এরপরেই সেই অবাক ব্যাপারটা ঘটে। চাটুজ্যে বুড়ো দাওয়া থেকে নামতে গিয়ে হঠাৎ কি মনে করে এদিকে এসে গোকুলের সামনে দাঁড়ায়। সে এহেন ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলনা, একটু হকচকিয়ে পিছিয়ে যায়। হারান বুড়োকে কখনও এভাবে কারুর সামনে নিজে থেকে এসে দাঁড়াতে দেখেনি। দোকানে কত লোকই তো আসে চেনা অচেনা, বুড়ো খেয়ালই করেনা। তাই ওরা হাঁ করে দেখে হাতের কাজ থামিয়ে। বুড়ো কিছুই করেনা গোকুলকে ভালো করে আপাদমস্তক দেখে ঘুরে দাওয়া দিয়ে নেমে যায় নিজের পথে রোজের মত। শুধু যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলতে থাকে "হলধর, হলধর"।

    খুব ধীরে বললেও হারান পরিস্কার শুনতে পায় আর সেই মুহূর্তে ওর দৃষ্টি পড়ে গোকুল গুঁইয়ের দিকে।দেখে গোকুলের মুখে যেন কে ছাই ঢেলে দিয়েছে এমন ফ্যাকাশে পানা হয়ে গেছে মুখটা। সে তাড়াতাড়ি দাওয়া থেকে নেমে বড় রাস্তা ধরে উল্টোপথে হনহন হাঁটা দেয় হারানদের কাউকে কিছু না বলেই।

  • rabaahuta | 203.99.212.53 | ০৬ মে ২০১০ ১৩:০৯449812
  • উত্তাল।
    ঘন্টাদারোগা আর গোকুল গুঁই ওরফে হলধরকে পুরো দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে।
  • sda | 117.194.197.75 | ০৬ মে ২০১০ ১৮:৪৭449813
  • দারোগার ব্যাপারটায় শীর্ষেন্দুর ছাপ স্পষ্ট। তবে মোটের উপর দারুন। পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
  • Samik | 219.64.11.35 | ০৬ মে ২০১০ ২১:১৩449815
  • গোকুল গুঁই এক জায়গায় গোকুল সামন্ত হয়ে গেছে। ওটা সেকেন্ড এডিশনে শুধরে নেবেন 'খন।

    মাইরি, নয়ডা জ্বলজ্বল করছে। সেই তেকোনার ভাঙা পেম সিরিজের পর আবার রুদ্ধশ্বাসে কিছু পড়ছি।

    ফাটাফাটি। অসা। একঘর। অ্যাটাচ্‌ড বাথ।

    শ্রাবণীর দ্যাশ-গাঁয়ে আমি থাকতাম এককালে। ঠিকঠাক ছবি ফিরে পাচ্ছি। একেবারে অ্যাকিউরেট।
  • Nina | 64.56.33.254 | ০৬ মে ২০১০ ২৩:০৫449816
  • যাস্ট সুপার! অপেক্ষাটা সুদে আসলে পূর্ণ হয়। আবার বসে রইলুম হাঁ করে---(ভাগ্যিস এখানে মশা-মাছি নেই)

  • shrabani | 124.124.244.109 | ০৭ মে ২০১০ ১৮:০৭449817
  • শীত গ্রীষ্ম যাই হোক না কেন খেয়েদেয়ে মহেন পাল একটি দিবানিদ্রা দ্যায়। তারপরে বেরোয় বৈকালিক ভ্রমনে, এক এক দিন গাঁয়ের এক এক দিকে। কোনোদিন ইচ্ছে হলে ঘুরে টুরে সন্ধ্যেয় বারোয়ারীতলায় যায়, কখনো সোজা বাড়ি ফিরে আসে। কাপড়জামা পড়ে গায়ে কোট চড়িয়ে মাথায় মাফলার বেঁধে উঠোনের চেয়ারটায় এসে বসল। গিন্নী বাতের ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে এক হাতে ভারী কাঁসার গ্লাসে দুধ নিয়ে এসে ধরল। দুধের গ্লাসে চুমুক দিয়ে একটু চিন্তান্বিত মুখে তাকালো পালকত্তা,
    -"ব্যাথাটা বেড়েছে, নীলুকে একবার বলে আসি ওষুধটা বদলে দিতে। কোবরেজী তেলটা মালিশ করেছিলে?"
    -"আর ব্যাথা, এ যন্তন্না মলে তবেই ঘুচবে। বলি কি বড়খোকা সেবার হরিদ্বার থে যে লাঠিটা নিয়ে এসছেল সেটা নিয়ে বেরূ। চোরডাকাত ঢুকেছে গাঁয়ে। তুমি তো কোথায় কোথায় সব ঘুরে বেড়াও, একটা লাঠি সঙ্গে থাকলে তবু বল ভরসা।"
    পালগিন্নী ডাক দিতে নাতবৌ এল তেল চুকচুকে একটা বার্নিশ করা পিতলের বাঁটের লাঠি আর চাদর নিয়ে।

    এখনও রোদ পড়েনি, ঠান্ডাও একটু কম লাগছে। শীতের দিনে রোদ পড়লেই আঁধার নেমে আসে। হাঁটতে হাঁটতে বারোয়ারীতলায় এল। নিমাই সবে দোকান খুলেছে, ঝাঁপটা আদ্ধেক খোলা। কেউ কোত্থাও নেই, আটচালায় দুটো ঘেয়ো কুকুর মারামারি করছে। পাল কত্তা একটু দাঁড়িয়ে কি ভেবে এবার পঞ্চানন্দতলার দিকে পা বাড়াল। হারানের ব্যাপারটা সকালে শুনেছে, একবার নিজের চোখে গিয়ে দেখতে হচ্ছে। হারানের দোকানে পৌঁছে দেখে একপাশে উনুনে চায়ের জল বসিয়েছে হারানের কর্মচারী বিশে ছোঁড়াটা। হারান দোকান সবে খুলে ভেতরে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছিল। শীতের দুপুরে ঘুমিয়ে গা ম্যাজম্যাজ করছে। মহেন পাল দাওয়ায় উঠে হাঁক দিল,
    -"হারান, হারান আছিস নাকি?"
    গলা শুনে হারান বেরিয়ে এল।
    -"আরে পালদাদু যে, এস এস। এই বিশে,মোড়াটা এগিয়ে দে দাদুকে।"
    মোড়ায় বসে মহেন লক্ষ্য করল আশু চাটুজ্যে কে।
    -" আশুদা রোজ তোর এখেনে এসে বসে, তা কথা কিছু বলে টলে মাঝেসাঝে নাকি সেই মৌনীবাবা?"
    হারান মহেন পালের সামনে চাটাইতে বসে পড়ল।
    -"না: দাদু, কখনও কিছু বলতে শুনিনি। আর সেজন্যই তো ধন্দ টা লাগল আজ সকালে।"
    পালমশাই ঠিক বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। হারান তখন গোড়া থেকে সকালের বৃত্তান্ত শোনাল, গতকাল সন্ধ্যের লোকটার কথাও উল্লেখ করল। সব শুনে মহেন পাল বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। ভ্রু দুটো কুঁচকে অনেকক্ষণ কি ভাবল, তারপরে ঘাড় নেড়ে বলল,
    -"না: হলধর বলে এ গাঁয়ে কেউ কখনো ছিল বলে মনে পড়ছেনা তো। কোনো এরকম ঘটনাও মনে পড়ছেনা। তুই ঠিক শুনেছিলি তো?"
    -"হ্যাঁ দাদু নিয্যস। আর চাটুজ্জ্যে দাদু ঐ নাম করতে লোকটার মুখ এক্কেরে ছাইপানা হয়ে গেসল।"
    বিশে এক কাপ চা নিয়ে এসে দিল পালমশায়কে। এমনিতে চা খায়না কিন্তু আজ অন্যমনস্কভাবে কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিল। হারান চুপ করে রইল। তবে সব কিছু মহেন পালের মত বিচক্ষণ ব্যক্তিকে বলে নিজেকে তার অনেক হালকা লাগছিল। চা টা শেষ করে কি ভেবে মহেন একবার আশু চাটুজ্জ্যের কাছে গেল।
    -"দাদা, কেমন আছ? শরীরগতিক কেমন?"
    চাটুজ্জ্যে উত্তর করেনা, চা খেয়ে যায়। মহেন পাল গতিক দেখে আর বেশী বাক্যব্যয় না করে বলে,
    -"আশুদা, হলধর কে? সকালে দোকানে যে লোকটাকে দেখেছিলে তার নাম কি হলধর? কাল সন্ধ্যেয় যে তোমার পাশে বসে চা খাচ্ছিল এখানে সে কে?"
    বুড়ো তাও নিরুত্তর। পাঁচ ছ বার চেষ্টা করে মহেন হাল ছেড়ে দেয়। দোকানে লোকজন আসতে শুরু করেছে। কানে গেলে লোকের কৌতূহল বাড়বে, সবাই নানা প্রশ্ন করবে। এসব ব্যাপার বেশী জানাজানি না হওয়াই ভালো, বদলোক সাবধান হয়ে যাবে। সে হারানকে এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে বারণ করে ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ল।
  • shrabani | 124.124.244.109 | ০৭ মে ২০১০ ১৮:১০449818
  • অমাবস্যা কেটে গিয়ে নিধিরামের বাতের ব্যাথা আজ অনেকটা কম ছিল। সকালেও চা জলখাবার খেয়ে নিজে নিজেই বাড়ির বাইরে গোয়ালঘরের সামনের ধারিতে মাদুরের ওপর বসেছিল যতক্ষণ না চান খাওয়ার সময় হয়েছে। এখন বিকেলে ঘুমিয়ে টুমিয়ে উঠে আবার সেখানেই বসেছে। কাল নাতি এসে বারোয়ারীতলার সব কথা বলেছে। সব শুনে নিধিরাম একটু আশচর্য হয়েছে দুটো কারনে। প্রথম হল মহেন পাল তার সাথে পরামর্শ করার কথা বলেছে আর দ্বিতীয় হল গাঁয়ে বেশ বড় আর মাঝারি দুটো চুরি হল অথচ তার কাছে এর কোনো খবর নেই।

    আজই সকালে তপাইকে দিয়ে সে গোবিন্দকে ডেকে পাঠিয়েছিল। গোবিন্দ তার সুযোগ্য চেলা, আশেপাশের পাঁচগাঁয়ের বেশ নামকরা চোর, তার অনেক শাগরেদ আছে এদিক ওদিক ছড়িয়ে। গোবিন্দ দিব্যি করে বলে গেল এ এদিককার চোরেদের কারুর কাজ নয়। বাইরে থেকে কেউ এসে একাজ করেছে। সাধারণত এরকমটা হয়না। পরগণায় চোরেদের এলাকা ভাগ আছে। নিধিরামের কাছে খবর বুড়ির টাকাপয়সা সব পোস্টাপিসে, গয়না খুব বেশী নেই এবং বুড়ি সারারাত প্রায় জেগেই থাকে। তাই চেনা চোরেরা ওদিকে নজর দেয় না। হারানের দোকানও বেশীদিনের নয়, টাকাপয়সা হারান দোকানে রাখেনা এ সবাই জানে।
    মধু দিয়ে তৈরী আদা চা দিয়ে গেল নাতি, তাতে আয়েস করে চুমুক দিতে দিতে এইসব ভাবছিল নিধিরাম। পায়ের শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখে মহেন পাল আসছে তার দিকে। চায়ের কাপটা পাশে রেখে সে একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে, আশ্চর্য হওয়ার আরো বাকী ছিল তাহলে! এতটা বয়স হল তবু এখনো মহেন পালকে দেখলে প্রথম চটকায় একটু বুক কাঁপে, কিছুক্ষণ সময় লাগে ধাতস্থ হতে। পালমশাই কাছে এসে বড় মধুর স্বরে বলেন,
    -"কি রে নিধে, ব্যাথা কেমন? কাল তপাই বলল তুই নাকি শয্যাশায়ী, তাই খোঁজ নিতে এলুম একবার।"
    নিধিরাম কি করবে কি বলবে ভেবে না পেয়ে হাঁকডাক শুরু করে দিল।
    -"এস দাদা এস। ও তপাই, দাদুকে আসন পেতে দে। বৌমা, পাল দাদার জন্যে চা পাঠাও। নাকি দাদা দুধ খাবেন?"
    পালমশাই হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয়। তারপরে তপাইয়ের আনা আসনে জম্পেশ করে গেঁড়ে বসে নিধের সামনে।
    -"চা দুধ কিছু আনতে হবেনা। আমি এখন কিছুই খাবনা। তুই আছিস কেমন সেটাই জানতে এসেছিলাম।"
    নিধে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয় তারপরে নিজের রোগের কথা বলতে থাকে। মহেন পালও যেন রোজই এসে নিধের সাথে অন্তরঙ্গ আলাপ করে এমন ভাব করে চাষবাস ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গে কথা বলতে থাকে। দুই প্রাচীন কে বসে কথা বলতে দেখে ওপাড়ার অনেকেই আসাযাওয়ার মাঝে দুদন্ড দাঁড়িয়ে দুকথা বলে যাচ্ছিল। নিধিরামের বৌমা জোর করে তাদের দুধেলা গাইয়ের ঘন টাটকা দোয়া গরম দুধ মহেনকে খাওয়ালে।

    এইভাবে খানিকটা সময় কাটার পরে যখন পালবুড়ো দেখে নিধিরাম অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে তার সাথে তখন সে আসল কথাটা তোলে।
    -"গাঁয়ে হঠাৎ যে বড়সড় চোর দেখা দিয়েছে, এ সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়েছিস কিছু?"
    নিধে জানত এ প্রসঙ্গ আসবেই, তাই তৈরীই ছিল। সে গোবিন্দর কাছে যা যা জেনেছে বলল। দুজনেই খুব জোরে জোরে মাথা নেড়ে একমত হল যে যা হয়েছে তাতে গাঁয়ের সুরক্ষা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে হচ্ছে। সুয্যি ডুবে গিয়ে বিকেল হয়ে এল। মহেন উঠতে গেল, হঠাৎ করে তার হারানের বলা লোকটার কথা মনে পড়ে গেল।
    একটু গলা নামিয়ে বলল,
    -"একটা কাজ করতে হবে নিধে, তোর চেলাচামুন্ডাদের বল একজন কালো রোগা মাঝবয়সী খেঁকুড়ে চেহারা, কুতকুত চোখের ভিনদেশী লোক এ তল্লাটে ঘুরছে। একটু চোখ কান খুলে এরকম লোকের খোঁজ করতে হবে। খোঁজ পেলে তার ওপর নজর রাখতে হবে। নাম গোকুল গুঁইও হতে পারে আবার অন্য কিছুও হতে পারে। আর একটা কথা হলধর নামে কেউ কখনো এ গাঁয়ে ছিল বা এসেছিল কারো বাড়ি, তোর কিছু মনে পড়ে?"
    নিধিরাম বলল,
    -"এই কাজ তোমার হয়ে যাবে দাদা, চিন্তা নেই। এরকম কোনো লোক আশেপাশের পাঁচটা গাঁয়ে যেখানেই থাকুক আমার লোকেরা খুঁজে বার করবে। কিন্তু হলধর বলে কারুর কথা তো এ মুহূর্তে মনে পড়ছেনা। ভেবে দেখব যদি কিছু মনে পড়ে।"

    একটু পরে দুজনে যখন দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিল তখন দুজনেরই ঠোঁটে বেশ প্রীতির হাসি, এতদিনকার বরফ যেন গলেছে মনে হল দু তরফেই।
  • san | 203.91.201.56 | ০৭ মে ২০১০ ১৮:১৩449820
  • কি ভালই না লাগছে পড়তে !
  • shrabani | 124.124.244.109 | ০৭ মে ২০১০ ১৮:১৩449819
  • নিধের ওখান থেকে বেরিয়ে মহেন পাল বাড়ির দিকে হাঁটা দিল তবে আর সদর রাস্তা দিয়ে নয়, মাইতিপাড়ার ভেতর শর্টকাট দিয়ে। আজকে অনেক দেরী হয়ে গেছে, বারোয়ারীতলার দিকে গেলে পাঁচজনে আটকে বসিয়ে দেবে, একথা ওকথায় দেরী হয়ে যাবে। মহেন পালের খাওয়ার সময়ের নড়চড় হবার নয়, শীত গ্রীষ্ম সে রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ে, ওঠে খুব ভোর ভোর। রামী বুড়ির বাড়ির সামনে এসে দেখল গোয়ালে ধোঁয়া দেওয়া হয়েছে, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বুড়ি কাকে কি সব বলছে চিৎকার করে করে। পালকত্তা দাঁড়ালনা, চাটুজ্যে বাড়ির দিকে চলল। শিবুদের বাড়ী থেকে চাটুজ্যেদের বাড়ি যেতে একটা পথচলা রাস্তা বাঁশবাগান আর ঝোপজালির মধ্যে দিয়ে, অন্ধকারে বেশ গা ছমছম করে। মহেন অবশ্য এ বয়সেও অসম সাহসী, ভয় পেলনা তবু লাঠিটা বাগিয়ে ধরে রইল।

    পথটা এসে উঠেছে চাটুজ্যেদের মন্দিরের পেছন দিকে। সেখানে মনসা গাছের ঝোপ, কতগুলো জবা আর কলকে গাছের ঝাড়, একটা চাঁপা গাছও আছে। শীতকালে যদিও সাপখোপের উপদ্রব কম তবুও সাবধানের মার নেই বলে হাতের লাঠিটা ঠকঠক করতে করতে জায়গাটা পেরিয়ে মন্দিরের সামনের দিকে যাচ্ছিল মহেন। হঠাৎ কেমন মনে হল চাঁপা গাছের আড়ালে কে একটা সরে গেল। যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে "কে রে, কে রে" করতেই একটা লোক সামনে এল। অন্ধকারে ঠিক ঠাহর হচ্ছিল না, আবছা দেখল চাদর গায়ে, মাথায় একটা গামছা মাফলারের মত করে বাঁধা, কোমরেও কাপড়ের ওপর একটা গামছা বাঁধা। পালমশাইয়ের খুব আফশোষ হল, লাঠিটা গিন্নী মনে করিয়ে দিল আর সঙ্গে একটা টর্চ দিতে খেয়াল হল না। লোকটা হাতজোড় করে সামনে এসেছে,
    -"কি ব্যাপার, ওখানে কি করছ নুকিয়ে? কে তুমি বটে?"
    -"আজ্ঞে বাবু, আমি এদের রাঁধুনী, বিরিঞ্চি। রান্না দুয়ারে বিড়ি খাওয়া মানা তাই এই আড়ালে এসে একটু বিড়ি খাচ্ছিলুম।"
    পালমশায় একটু ভাবল। হতেও পারে, চাটুজ্জ্যেদের বড় সংসার, বরাবরই রাঁধুনী চাকর থাকে। কোমরের গামছা দেখে সেরকমই মনে হচ্ছে। এমনিতে সন্দেহ করার কিছু নেই, এই চুরি গুলোর জন্যই এখন এরকম লাগছে। ভাবলে একবার হাঁক দিয়ে কাউকে ডেকে ঝালিয়ে নেবে ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক সেইসময়ই মন্দিরের আরতি শুরু হল, ঝাঁঝ ঘন্টার বিকট আওয়াজ সহযোগে। মহেন পাল একটু বিরক্ত হয়ে সেদিকে যেতে গিয়ে দেখল বিরিঞ্চি সেখান থেকে চলে গেছে।

    সামনে মন্দিরে এসে দেখল বাড়ির অনেকে আছে, মহেনকে দেখে চাটুজ্জ্যের বড় ছেলে খাতির করে সামনে বসাল। অনেককাল বাদে এদের মন্দিরের আরতি দেখল মহেন। ছোটোবেলায় প্রতি বৈশাখ মাসে রোজ তারা গাঁয়ের সব বাচ্চারা এখানে আসত ফলকড়ের প্রসাদ পেতে। দোলে ঝুলনে এখনো উৎসব হয় তবে সেই আগের মত সারা গাঁয়ের তিনদিন ধরে নেমন্তন্ন থাকেনা। গাঁয়ের মাথাদের অবশ্য ডাকে এরা একদিন, তাকেও। সে এসেছেও কখনো সখনো তবে সেসব সেভাবে মনে পড়েনা যেভাবে ছোটোবেলা ফলকড়ের জন্য প্রতীক্ষায় থাকা, রোজ আসা এসব মনে পড়ে।

    একটু পরে আরতি শেষ হলে স্নানজল আর বাতাসা দিয়ে গেল ঠাকুর মশাই তাকে। সামনের চাতালে বসে চাটুজ্জ্যেদের দু তিন জনের সাথে কথা হতে হতে গাঁয়ের চুরির কথা উঠল। মহেন চাটুজ্জ্যেদের বড় ছেলে পরেশকে জিজ্ঞেস করল ওদের রাঁধুনীর কথা। সে একটু অবাক হল,
    -"কেন খুড়ো কি হয়েছে?"
    -"না কিছুনা, আমি আসার পথে ঐ খিড়কীর দিকে একজনকে দেখলাম, অচেনা। বুঝছই তো, আজকাল অচেনা দেখলেই তত্বতল্লাশ করতে হচ্ছে। তা সে বল্লে যে সে তোমাদের রাঁধুনী।"
    পরেশ একটু আশ্বস্ত হল,
    -"ও: তাই বলুন। আমি ভাবলাম কি না কি।"
    -"তা কদ্দিন কাজ করছে ও, বিশ্বাসী তো"
    -"তা হবে মাস দু তিন। উড়িষ্যার লোক, রান্না মোটামুটি চলে যায়, বাড়ির মেয়েরাই ওসব দেখে। আমরা ঠিক জানিনা।"
    একথা সেকথার পর পালমশাই উঠে পড়ল ওখান থেকে।

  • Nina | 64.56.33.254 | ০৭ মে ২০১০ ২০:৪৩449821
  • weekend টা ভাল আটবে--আরও এগোবে এই দারুণ লেখাটা এই আশায় রইলাম----

  • ranjan roy | 122.168.11.188 | ০৮ মে ২০১০ ০০:৪২449822
  • শ্রাবণী যে জগতের ছবি আঁকছেন --- বঙ্গের গেরাম, তা আমার নাগালের বাইরে, অদেখা।
    এমন জীবন্ত করে তুলেছেন যে--। পটভূমি, চরিত্র, পরিবেশ--- রঙও দেখতে পারছি, গন্ধ ও নাকে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। বা:!!!
  • rabaahuta | 203.99.212.53 | ১১ মে ২০১০ ১২:৩৬449823
  • :-|
  • Nina | 64.56.33.254 | ১২ মে ২০১০ ০০:২৩449824
  • :-(( কি হল? ও শ্রাবণী----
  • rabaahuta | 203.99.212.53 | ১২ মে ২০১০ ১২:১১449826
  • :-|
    (এটার মানে চোখ গোল গোল করে গম্ভীরমুখে অপেক্ষা করছি)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন