এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • রহস্য গল্প: আবার ফিরে আসা

    shrabani
    অন্যান্য | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ | ৭৭৮২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • shrabani | 124.30.233.104 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১৫:৩০408321
  • লিখতে শুরু করেছিলাম কারুর কথাতে, কিন্তু শেষ হচ্ছেনা। তাই যা লিখেছি এখানে দিয়ে দিচ্ছি, পড়তে পড়তে হয়ত শেষটা লিখে ফেলব!
  • shrabani | 124.30.233.104 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১৫:৩৪408349
  • --------------------------------------------
    কাল রাতে দু পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়ে ভোরের দিকটা বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। নাহলে চৈত্রের শেষে এদিকে গরমই পড়ে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে পাঁচটা বাজে। হরির এখনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা। অন্যদিন এতক্ষণ এসে সে চায়ের যোগাড়ে লেগে যায়। বিজয় শুয়ে শুয়েই জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে চোখ রাখে। আজ রাস্তায় লোক সমাগম এখনো বেশী নয়, হয়ত কালকের বৃষ্টির জন্য।
    কয়েক মিনিট এভাবে কাটিয়ে উঠে পড়ল বিজয়। মুখ হাত ধুয়ে এসে নিজেই স্টোভ জ্বালিয়ে চায়ের জল বসাল। হরিটার হলটা কি, এরকম দেরী তো করেনা! চা নিয়ে বাইরের বারান্দায় আরামকেদারাটায় বসেছে, হরির সহকারী পোকা এল।
    -"একি বাবু, আপনি চা করে নেছেন? আমারে তো হরিদা পাঠাল আপনারে চা করে দিতে।"
    পোকার কেউ কোথাও নেই। কিভাবে যেন এসে এই মুকুন্দপুর থানায় জুটেছে। কনস্টেবলদের সঙ্গে থাকে, ওদের ফাইফরমাস খাটে, এখান ওখান করে দুবেলা খাওয়া পরা জুটে যায়। চটপটে আছে, হরির কাছে রান্নাবান্নাও শিখে নিয়েছে। কিন্তু লেখাপড়া শেখার দিকে মন নেই। বিজয় মুকুন্দপুর থানায় এসে প্রথম দিকে পোকাকে একটু আধটু লেখাপড়া শেখাবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পেরে ওঠেনি। শেষে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। বিজয় খালি চায়ের কাপটা ওর হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
    -"হরির আবার এই সাতসকালে কি কাজ পড়ল রে? তোকে এখানে পাঠিয়ে সে কোথায় গেল?"
    -" তারে তো বাবু, বড়বাবু ডেকে পাঠেছেন। সদর থে কে যেন এয়েছে।"
    বিজয় একটু অবাক হল, এত ভোরে সদর থেকে আবার কে এল! পোকাকে আর কিছু না বলে সে উঠল তৈরী হয়ে থানায় যাবে বলে। পোকা লেগে পড়ল ঘরের সাফসাফাই করতে, এটা তার নিত্যকর্ম।

    বিজয় মুকুন্দপুর থানায় এসেছে প্রায় বছরদুয়েক হল। সে এখানকার ছোটবাবু। থানার ভারপ্রাপ্ত বড়বাবু, আর আছে জমাদার তারিণীবাবু, এরা বিজয়ের থেকে বয়সে অনেকটাই বড়, সংসারী মানুষ। এছাড়া হরি, বিশু ও আরও কয়েকজন কনস্টেবল আছে। অল্পদিনের মধ্যেই বিজয়ের বেশ নামডাক হয়েছে করিৎকর্মা অফিসার হিসেবে। বড়বাবু ও তারিণীবাবুর অত্যন্ত স্নেহভাজন সে। বাকী সহকর্মীরাও তাদের এই অল্পবয়সী, দৃঢ়চেতা, স্বল্পভাষী অফিসারটিকে খুব ভালবাসে। বড়বাবু তাকে সবকথাই বলেন, সব ব্যাপারে তার মতামত নেন। আজ যে সদর থেকে কেউ আসতে পারে এ ব্যাপারে তাকে তো কাল রাতেও কিছু বলেননি! এইসব ভাবনার মধ্যেই বিজয় থানার দিকে রওনা দিল। রাস্তার ওপারে থানা আর এপারে বাবুদের কোয়ার্টার। এক দুই করে রোজের হাটের হাটুরেরা যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। এছাড়াও নদীর ঘাটে, গঞ্জে যেতে হলে এই রাস্তা দিয়েই যেতে হয়, লোক চলাচল শুরু হয়ে গেছে।

  • shrabani | 124.30.233.104 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১৫:৪০408360
  • -------------------
    থানায় পৌঁছে বিজয় দেখল অন্যরা কেউ তখনও এসে পৌঁছয় নি। রাত্রে যে দুজন কনস্টেবলের ডিউটি ছিল তারাই বসে বসে ঢুলছে। ঝাড়ুদার জগু শুধু একটা ঝাঁটা আর বালতি নিয়ে থানার সামনের চত্বরটা পরিস্কার করছে। বিজয়কে দেখে সে বালতি রেখে একটা বিশাল সেলাম ঠুকল। বিজয় ঢুকে নিজের চেয়ারে বসতেই কনস্টেবল দুজন জেগে গেল। একজন ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি টেবিল থেকে জলের ঘটিটা তুলে নিয়ে বিজয়ের জন্য খাবার জল আনতে দৌড়ল। অন্যজন কি করবে ভেবে না পেয়ে একটা ঝাড়ন নিয়ে টেবিল চেয়ার ঝাড়তে মুছতে আরম্ভ করে দিল। বিজয় ওদের হাবভাব দেখে হাসি চেপে গম্ভীর ভাবে টেবিলের ওপরে রাখা খাতাপত্র খুলে বসল। বেশ খানিকটা সময় কাটবার পরে খাতাপত্র থেকে মুখ তুলে দেখে দুই মূর্তিমান দরজার দুপাশে দাঁড়িয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
    -"কি কিছু বলবি নাকি রে?"
    -"বাবু, এখনও হরিদা আর বিশু এলনি। আমাদের তো ডিউটি হয়ে গেছে, সাতটা বেজে গেছে। একটু ঘরের পানে যেতুম বাবু।"
    বিজয়ের ও খেয়াল হয়,
    -"আরে তাইতো। সকালে হরি আর বিশুর থাকার কথা। অন্যদিন ওরা ছটার মধ্যে এসে পড়ে। আজ সব গেল কোথায়?"
    দুই কনস্টেবল মাথা নাড়ায়। তারা কিছু জানেনা। বিজয় ওদের যেতে বলে, সারারাত আছে বেচারারা।
    সেই সময়ই তারিণীবাবু ঢোকেন। তারিণীবাবুর পরিবার এমনিতে দুরে গ্রামের বাড়ীতে থাকে। ইদানীং ওর স্ত্রী ছোটমেয়েটাকে নিয়ে এসেছেন মুকুন্দপুরে ডাক্তার দেখাতে। তাই উনি সকালে একটু বেলা করেই আসেন। বিজয় ওকে ঢুকতে দেখে বলে,
    -"তারিণীদা, বড়বাবুর কাছে কে এসেছে জানেন নাকি? হরি, বিশু সব ভোর থেকে সেখানেই ডিউটি দিচ্ছে, থানায় কেউ নেই।"
    তারিণী একটু মুচকি হাসে। বড়বাবু এমনিতে ভালমানুষ কিন্তু বড়গিন্নীর বেজায় দাপট। তার চোটে বড়বাবু নিজেও তটস্থ থাকেন সর্বদা। তবে একটাই ভরসা, গিন্নী সবসময় থাকেননা এখানে। তিনি থাকলে বিশু বা হরিকে সর্বক্ষণ ওনার ফরমাস খাটতে হয়, থানার কাজে তাদের পাওয়া যায়না। প্রত্যেকেই এ নিয়ে আলোচনা করে। বিজয় এসব জানে, তবে খুব একটা মাথা ঘামায়না। বিজয়ের কথার উত্তরে তারিণীবাবু বলে,
    -"কারুর আসার কথা ছিল নাকি? আমি তো কই জানিনা। তুমি কার কাছে শুনলে?"
    পোকা ঢুকল বিজয়ের জলখাবার নিয়ে। বিজয় তাকে দেখিয়ে বলল,
    -"এইতো শ্রীমান পোকা বলল। হ্যাঁরে পোকা, বড়বাবুর ওখানে কখন লোক এসেছেরে? তোকে কেই বা বলল, হরি?"
    পোকা বিজয়ের সঙ্গে যতটা স্বচ্ছন্দ তারিণীবাবুর সঙ্গে অতটা নয়। একটু আমতা আমতা করে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
    -"হরিদাই তো। আমারে ঘুম থে তুলে বলল আপনের কোয়াটারে যেতে, সে বড়বাবুর ঘরে যাচ্ছে।"
    তারিণী পোকার কথায় খুব বেশী গুরুত্ব দেয়না, বলে,
    -"ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুই যা এখান থেকে।" পোকা ছাড়া পেয়ে দৌড় দেয়।
    তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিজয় কিছু বলতে যাবে, এমন সময় দুরে দেখে বড়বাবু আসছেন, সঙ্গে একটি লোক। বড়বাবু অফিসে ঢুকে ওদের দুজনকে দেখে একটু যেন খুশী হন। সঙ্গের লোকটিকে একটি চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলে, নিজের সীটে গিয়ে বসে বলেন,
    -"এই যে বিজয় তুমি এসে গেছ, তারিণীও। সরকারমশায়, এই হল বিজয়, আমার জুনিয়র আর তারিণী, এই থানার জমাদারবাবু। আমি বিজয়ের কথাই বলছিলাম আপনাকে। খুব বুদ্ধিমান ছেলে, ও আপনাদের রহস্যের সমাধান করে দেবে।"
    রহস্য শুনে বিজয় লোকটির দিকে ভাল করে দেখে। দোহারা চেহারা, বয়স ষাটের ঘরে হবে। চুলগুলি সব সাদা। পরনে ধুতি আর শার্ট, চোখে চশমা, সব মিলিয়ে বেশ সাধারণ ভালমানুষ গোছের। এরকম লোক কোনো রহস্যজালে জড়িয়ে পড়েছে বলে দেখে মনে হয়না। বড়বাবু তার দুই সহকর্মীর বিস্ময়ের ভাবটা আঁচ করতে পেরে বলে ওঠেন,
    -"তোমাদের গোটা ব্যাপারটা বলছি খুলে তবে তার আগে এঁর পরিচয়টা দিই। ইনি হলেন চাঁদপুরের জমিদারের সরকারমশায় ভূপতিবাবু। "

  • shrabani | 124.30.233.104 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১৫:৫০408371
  • -------------------------------
    চাঁদপুর হল জেলাশহরের লাগোয়া হিরন নদীর ধারে একটা ছোটো গ্রাম। হিরন আপাতদৃষ্টিতে একটি ছোটো সরু শাখানদী হলেও বর্ষার সময় এর চেহারাই পাল্টে যায়। প্রায় প্রতিবছরই এই নদীতে বন্যা হয়, আশেপাশের গ্রামকে ডুবিয়ে দেয়। এই কারনেই চাঁদপুরের বসতি তেমন ঘন নয়। মাত্র কয়েক ঘরের বাস। জমিদার মহেন্দ্র চৌধুরীর অনেক পুরুষের বাস এই গ্রামে। নামে জমিদার হলেও জমির থেকে বেশী আয় এদের সদরের ব্যবসা বাণিজ্যে। জেলাশহর ও কলকাতায় তার বাড়ী আছে, তবে পাকাপাকি বাস করেন ঐ চাঁদপুরেই। সপ্তাহখানেক আগে জমিদারদের গৃহদেবতার মন্দিরে চুরি হয়ে গেছে। বিগ্রহের সমস্ত গয়নাগাঁটি, রুপোর বাসন ও অন্যান্য সামগ্রী মায় নারায়ণের বিগ্রহটিকেও উঠিয়ে নিয়ে যায় চোরেরা। কোনো কারণে শেষমেষ বিগ্রহকে কিছুদুরে বাগানের ধারে ফেলে দিয়ে গেছে।

    সকালে এসে পুরোহিত মশায়ই প্রথমে দেখেন মন্দিরের দরজা হাট করে খোলা, ভেতরে বিগ্রহ নেই, সব লন্ডভন্ড। ওনার চিৎকারে তখন বাকী লোক দৌড়ে আসে। সারাগাঁয়ে খবর রটে যায়। কিভাবে যেন আসা যাওয়ার পথে বাগানের একপাশে পড়ে থাকা বিগ্রহ কার নজরে আসে। সদরে থানায় খবর দেওয়া হয়। পুলিশ এসে তদন্ত করে, এদিক ওদিক অনেক ছোটাছুটিও করে তবে চোর বা চোরাই মালের কোনো কিনারা হয়নি এখনো পর্যন্ত। বড়বাবুর সঙ্গে মহেন্দ্রবাবুর অনেককালের পরিচয়, সেই যখন বড়বাবু জেলা সদরের থানায় ছিলেন তখন থেকে। এখনও মাঝেসাঝে দেখাসাক্ষাত চিঠিতে কুশলাদি খবর নেওয়াটেওয়া হয়। একসপ্তাহ হয়ে গেল, চুরির কোনো কিনারা হচ্ছেনা দেখে মহেন্দ্রবাবু বড়বাবুর পরামর্শ চেয়ে পাঠিয়েছেন সরকারমশায়ের হাতে চিঠি লিখে। সরকারমশায় কাল রাতে এসে পৌঁছন আবার এখনই চলে যাবেন।

    বিজয় সব শুনে একটু হতাশ হল। মন্দিরে চুরি ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়, প্রায়ই এদিক সেদিকে হয়ে থাকে। সে নিজেও এক আধটা এরকম কেসের তদন্ত করেছে। সাধারনত পুরোহিত বা মন্দিরের কোনো কর্মচারী, পুরনো বা নতুন, অথবা বাড়ির কোনো কর্মচারী বা তাদের আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে খবর যোগাড় করে চোরেরা। এরকম চোরেদের দল থাকে। এসব চোরাই মাল কেনা বেচারও ঠেক থাকে জেলায় বা কলকাতায়। সদরের কর্তারাই এসব হাল হদিশ বেশী জানবে, তারা মফস্বলের ছোটো থানার পুলিশেরা আর এ ব্যাপারে কি করতে পারে!
    এখন মুশকিল হচ্ছে বড়বাবুকে এসব কথা বলা যাবেনা, একে জমিদার তায় বন্ধুলোক। তারওপর আবার সদরের বাঘা পুলিশেরা কিছু বার করতে পারেনি এখনও, তাদের ডাক পড়েছে। উনি এর একটা হেস্তনেস্ত না করলে শান্তিতে টিকতে দেবেননা কাউকেই।
    তারিণীবাবু বোধহয় ওর মনের কথাটা বুঝতে পারছিল। সে ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বলে বড়বাবুকে বলে,
    -"কিন্তু স্যর, যেখানে সদরের থানায় কেস, তাদের অনুমতি ছাড়া আমাদের হাত দেওয়া কি উচিত হবে?"
    বড়বাবু একগাল হেসে যেন সমাধান নিয়েই বসে আছেন এমনভাবে বললেন,
    -"আরে সে কথা কি আমি ভাবিনি নাকি? সেজন্যেই তো বিজয় প্লেন ড্রেসে যাবে। সরকারমশায় আর মহেন্দ্রবাবু ছাড়া কেউ জানবেনা যে ও পুলিশের লোক। বাকীরা জানবে ও গোয়েন্দা,মহেন্দ্রবাবু কলকাতা থেকে আনিয়েছেন।"
    বিজয় চোখের সামনে দেখতে পেল বিপদের খাঁড়া ঝুলছে! তারিণীবাবুও হতাশ হয়ে হার মানার ভঙ্গীতে হাত উল্টিয়ে সরে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন। ভূপতি এতক্ষণ চুপচাপ সবার কথা শুনছিলেন, এবার মুখ খোলেন,
    "তাহলে দারোগাবাবু, বেলা হচ্ছে আমায় তো এবার উঠতে হবে, ওদিকে নাহলে বাবু আবার ভাববেন।"
    বড়বাবু হাঁ হাঁ করে ওঠেন,
    -'আরে তাই তো, তাই তো। তাহলে বিজয়, তুমি তৈরী হয়ে নাও। তোমার কাছে এ কেস এমন কিছু নয়। এর থেকে বড় বড় রহস্যর তুমি দুদিনে মীমাংসা করে দিয়েছ, আর এতো সামান্য চুরির মামলা।"
    বিজয় দেখে আর কোনো রাস্তা নেই, একটু ভেবে নিয়ে সে বলে,
    -"তাহলে স্যর আমি কিন্তু সহকারী হিসেবে হরিকে নিয়ে যাব।" বড়বাবু সাথে সাথেই বলে ওঠেন,
    -"সে তোমার যাকে খুশী নিয়ে যাও। মহেন্দ্রবাবু এই প্রথম আমার কাছে কোনো কাজে সাহায্য চেয়েছেন, তুমি শুধু আমার মুখ রেখ বিজয়। তোমার ওপরে আমার অনেক আশা।"
  • shrabani | 124.30.233.104 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১৫:৫৪408382
  • বিজয় আর কথা না বাড়িয়ে হরিকে ডেকে তৈরী হতে বললে। নিজেও বাসার দিকে গেল, দরকারী কিছু জিনিসপত্র জামাকাপড় ব্যাগে ভরে নিতে। সদরে যাবার জন্যে সকাল দুপুর দুবেলা দুটি বাস পাওয়া যায় মুকুন্দপুর থেকে। সেই বাসে গিয়ে সদরের ঠিক আগে বড়তলাতে নেমে গরুরগাড়ী বা পাল্কিতে পৌনে এক ঘন্টার পথ চাঁদপুর। হেঁটেও যাওয়া যায় তবে রাস্তা খুব একটা ভাল নয়। অবশ্য চাঁদপুর থেকে ভেতর দিয়ে কম সময়ে সদরে যাবার রাস্তা আছে, কিন্তু সে রাস্তা বাসের পথে পড়েনা।
    সকালের বাস অনেক আগেই ছেড়ে গেছে, ওরা দুপুরের বাসে যাবে। হরির নির্দেশে পোকা ডাল ভাত রান্না করে ফেলেছিল। সেই খেয়ে বেলা বারোটার সময় রওনা দিল ওরা। বেরনোর আগে তারিণী বিজয়কে একদিকে নিয়ে গিয়ে বলল,
    -"ভায়া, সেরকম দরকার হলে হরিকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দিও। এমন কিছু দুর তো নয়। আমি বা আমরা হাজির হয়ে যাব। আর সদরে থানায় আমার এক সম্পর্কের ভায়রা আছে, নীলমনি পাত্র। তার নামে একটা চিঠি লিখে দিলাম। দরকার হলে তাকে এই চিঠি দেখিও। সে সেরকম বড় অফিসার না হলেও খুব বুদ্ধিমান, তার পরামর্শ তোমার কাজে লাগতে পারে।"
    বিজয় তারিণীর দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিঠিখানা হাতে নিল। তবে তার মনে হলনা এই সামান্য চুরির কেসে তার অত লোকের সাহায্যের দরকার হবে। তবু সদরের পুলিশ প্রথম তদন্ত করেছে, তাদের মতামত জানাটা দরকার। বিজয় যত্ন করে পকেটে রাখল চিঠিটা।

    বড়তলা পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। বাসস্ট্যান্ডে গরুর গাড়ী ছিল সরকারমশায়ের জন্য। তিনজনে তাতে চড়ে বসল, বাহারী ছইওলা গাড়ী। সামনে গাড়োয়ানের জায়গা আর যাত্রীদের বসার জায়গার মধ্যে পর্দা দিয়ে আলাদা করা আছে। এতক্ষণ ভীড় বাসে বিজয় ইচ্ছে থাকলেও সরকার মশায়ের সাথে চুরির ব্যাপারে কথা বলতে পারেনি। গরুর গাড়ীতে বসে ও এবার সরকারমশায়কে ধরল।
    -"সরকারমশায়, এর আগে কোনোদিন মন্দিরে কিছু হয়েছে, ছোটখাট কোনো চুরিটুরি?"
    -"না বাবু, আমি এবাড়ীতে প্রায় পঁয়তিরিশ বছর ধরে আছি। কত্তাবাবুর বাবার আমল থেকে। মন্দিরে সেরকম কোনো চুরি হয়েছে দেখিনি। মন্দির তো বাড়ীর চৌহদ্দির মধ্যেই। গেটে দারোয়ান থাকে, উঁচু পাঁচিল। মন্দিরের লোহার দরজা, বিলিতী তালা।"
    -"চাবি কার কার কাছে থাকে? সেদিন কি তালা ভাঙা ছিল না খোলা?"
    -"বাবুর ঘরে দেওয়ালে লোহার পেরেকে সব চাবি টাঙানো থাকে। পুরুত মশাই সকালে এসে চাবি চেয়ে নিয়ে গিয়ে মন্দির খোলেন। এছাড়া বোধহয় সব তালারই আরেক সেট চাবি বাবুর লোহার সিন্দুকে থাকে, আমি ঠিক জানিনি। তালা বাবু খোলা ছিল ভাঙা নয়। ও তালা কেউ ভাঙতে গেলে এত আওয়াজ হত যে গোটা গাঁ জেগে যেত।"
    -"চাবি জায়গায় ছিল?"
    -"আমার ঠিক খেয়াল নেই বাবু, কত্তাবাবু এসব বলতে পারবেন।"
    -"ঠিক আছে। আপনি আমাকে একটু এই জমিদারবাড়ী সম্বন্ধে বলুন। কে কে থাকে সেখানে, এদের জমিজমা ব্যবসাপত্র, এইসব আরকি। এছাড়া এর আগে এমন কোনো কিছু ঘটনা ঘটেছে কি যা নিয়ে আপনার খটকা লেগেছে? একটু মনে করে বলুন তো?"
    বিজয় দেখেছে তদন্তে অনেক সময় ছোটখাট ব্যাপারও অনেক গভীর সুত্র দিয়ে যায়। সরকারমশায় লোকটি দেখেশুনে খুবই সাধারণ মনে হচ্ছে। বড়বাবুর মুখে যা শুনেছে তাতে চৌধুরীদের বিষয় ব্যবসা তো ভালই আছে মনে হচ্ছে। ইনি সেসব দেখাশোনা করেন কি করে? না কি এই গোবেচারা ভঙ্গীটা একটা মুখোশ!

    সরকারমশায় একবার বিজয়ের দিকে আর একবার হরির দিকে তাকায়। হরির মুখ বেজার। বিজয় বুঝতে পারে কারনটা আর কিছুই নয়, গাড়ীর বেদম ঝাঁকুনি। রাস্তা খুবই খারাপ, চৌধুরীরা বড়লোক হতে পারে তবে গাঁয়ের রাস্তাঘাটের উন্নতিতে তেমন নজর আছে বলে মন হচ্ছে না।

  • shrabani | 124.30.233.104 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১৭:৩৭408393
  • ----------------------------
    সরকার বাবু ওদের এবার চৌধুরীবাড়ী সম্পর্কে বলতে শুরু করে।
    চৌধুরীরা প্রায় কয়েকশ বছর ধরে এই চাঁদপুরের বাসিন্দা। তবে ওদের এখনকার যে বাড়ী তা এভাবে তৈরী করে মহেন্দ্রবাবুর ঠাকুর্দা জিতেন্দ্র চৌধুরী। ওদের আদি ভিটে হিরনের ধারেই ছিল, বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে। অর্ধেক গেছে হিরনের গর্ভে, বাকী ধংসস্তুপের ওপরে পলি পড়ে জঙ্গল হয়ে গেছে। ঐ জঙ্গলকে এদিকের লোকে তাই আদিভিটের জঙ্গল বলে ডাকে। মহেন্দ্রবাবুর ঠাকুরদার ঠাকুরদার আমলেই পুরনো বাড়ী নষ্ট হয়ে যায়। তিনি তখন নদী থেকে দুরে এসে এই নতুন বাড়ীর পত্তন করেন। পরে জিতেন্দ্রর বাবা ও মূলত: জিতেন্দ্রই এখনকার বাড়ী করেন। জমিজায়গা এককালে অনেকই ছিল, তবে ঐ বন্যার কারনে চাষবাস থেকে তেমন আয় হচ্ছিল না। অবস্থা বেশ পড়তির দিকেই ছিল। এইসময় পরিবারের হাল ধরেন জিতেন্দ্র। উনি অত্যন্ত দুরদর্শী ছিলেন।
    বেশ কিছু জমিজায়গা বেচে দেন, গয়নাগাটিও। পয়সাকড়ি যা হাতে আসে তা দিয়ে কোম্পানীর কাগজ কেনেন, ব্যবসায় লাগান। প্রথম প্রথম অন্যের ব্যবসায় লাগান পরে লাভ বুঝে নিজেই ব্যবসা খুলে বসেন। সেইসময় থেকেই আবার চৌধুরীবাড়ীর হাল ফেরে। জিতেন্দ্রর শ্বশুরবাড়ী ছিল কলকাতায়, সেখানেও কিছু সম্পত্তি পান উনি।

    মহেন্দ্রর বাবা ছিলেন জিতেন্দ্রর একমাত্র সন্তান। মহেন্দ্ররা একভাই, একবোন। সরকার মশায় শুধু চাঁদপুরের বাড়ি জমিজায়গার দেখাশোনা করেন। কলকাতার বিষয় আশয় দেখার জন্য অন্য লোক আছে। সদরের ব্যবসা দেখে মহিমবাবু আর মহেন্দ্রবাবু নিজে।
    মহেন্দ্রবাবুর দুই ছেলে ছিল। বড়জন অনেকদিন আগে অসুখে মারা গেছে। ছোটছেলের বয়স এই বছর চব্বিশ হবে, সে এখানে থাকেনা, কলকাতায় থেকে আইন পড়ে, ছুটিছাটায় আসে। বাড়িতে কর্তাগিন্নী থাকেন, এছাড়া কর্তার বিধবা বোন ভারতীদেবী ও তার ছেলে হারাধন থাকে। গিন্নীর এক ভাইপো গিরীশও এখানে থেকে সদরের স্কুলে মাস্টারী করে। এছাড়া কাজের লোকেরা আছে, রাঁধুনী, মালী, দারোয়ান। সরকারমশায় চৌধুরী বাড়ীতে থাকেননা। তার বাড়ী গ্রামেই, পরিবারে স্ত্রী ও একটি মেয়ে আছে। মন্দিরের পুরোহিত চন্ডী বামুনও গ্রামেই থাকে। তারাও অনেক পুরুষ ধরে চৌধুরীদের গৃহদেবতার পুরোহিত। চৌধুরীরাই জমিজায়গা দিয়ে তাদের এ গ্রামে বসিয়েছে। কাজের লোকেরাও সবাই পুরোনো, অনেককাল ধরে রয়েছে এ বাড়ীতে। দুচারজন মুনিষ আর ঠিকে লোক সব কাছাকাছি থেকেই আসে। নতুন অচেনা লোক কেউ নয়। কর্তাবাবুর খাস চাকর রঘু, কর্তাবাবুরই বয়সী হবে। ছোটো থেকেই এ বাড়ীতে আছে। সে আর গিন্নীমা ছাড়া কর্তাবাবুর ঘরে কেউ ডাক না পড়লে ঢোকেনা। বাইরের লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাত কর্তাবাবু একতলায় বৈঠকখানাতেই সারেন। মূল বাড়ীর তিনতলায় মহেন্দ্রবাবুর পুরো পরিবারের বাস। দোতলায় একদিকে ভারতী দেবীরা আর গিরীশ থাকে, অন্য দিকে কুটুমদের জন্য ব্যবস্থা। একতলায় একদিকে বৈঠকখানা আর কুটুমদের থাকার ব্যবস্থা, অন্যদিকে ভাঁড়ার রান্নাঘর আর চাকরবাকরদের থাকার ব্যবস্থা। বাইরের মহলে সদর, কাছারী। বাগানের একদিকে মন্দির আর অতিথিনিবাস। গেটের পাশে দারোয়ান মিশরিলালের ঘর।

  • shrabani | 124.30.233.104 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১৭:৪২408404
  • এইসব কথাবার্তার মধ্যেই বিজয় দেখতে পেল তারা ক্ষেতটেত পার হয়ে একটা গ্রামে ঢুকে পড়েছে। সে সরকারমশায়ের দিকে তাকাতেই উনি প্রশ্নটা অনুমান করে নিয়ে বললেন,
    -"বাবু আমরা এখন চাঁদপুরে ঢুকছি। আর ঐ রাস্তা দিয়ে গেলে আপনি হিরনের ধারে পৌঁছে যাবেন। জমিদারবাড়ীটা উল্টোপানে, একেবারে গ্রামের শেষে, নদী থেকে দুরে।"
    সন্ধ্যে হয় হয়। একটা বড় পুকুরের ধার দিয়ে গাড়ী যাওয়ার সময় পুকুরঘাটে উপস্থিত বউ ঝিরা ঘোমটার ফাঁক দিয়ে তাকায়, তবে জমিদারবাড়ীর চেনা গাড়ী দেখেই বোধহয় কৌতুহল হারিয়ে নিজেদের নিত্য বৈকালিক পাটে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
    গ্রামকে বাঁ দিকে রেখে বিজয়দের গাড়ী ডানদিকে ঢোকে একটা চওড়া মোরামের রাস্তায়, দুধারে বড় বড় গাছগাছালির সারি। একটু গিয়েই বিশাল লোহার গেট। গাড়ী দেখে একটি খোট্টা দারোয়ান এসে গেট খুলে দেয়। গাড়ী একটু ভেতরে গিয়ে বাড়ীর সামনে থেমে যায়।
    -"এবার নামতে হবে, বাড়ী এসে গেছে।"
    বিজয় আর হরি নামে। গাড়োয়ান গাড়ী থেকে ওদের ব্যাগগুলো নামায়, তারপরে গাড়ী নিয়ে চলে যায় ঘুরে বাড়ির পেছনদিকে। গাছ আর দেড়মানুষ উঁচু পাঁচিলের জন্য গেটের বাইরে থেকে বাড়ীটা ঠাহর হয়না। এখন বিজয় ভাল করে চারদিক দেখে। চারিদিকে বাগান ঘেরা, সামনেই বাঁধানো চত্বর, সিঁড়ি দিয়ে উঠে সোজা দালান, থামের আড়ালে ভেতর বাড়িতে যাবার রাস্তা। দালানের দুপাশে দুটো করে মোট চারটে কামরা। একটায় কাছারি, টেবিল চেয়ার গদি পাতা আছে, আর দুটো বস্তায় ঠাসা, বোধহয় ধান চাল আনাজ রাখা আছে। একটা কামরা বন্ধ। ভেতরে বোধহয় উঠোন পেরিয়ে মূল তিনতলা ভিতর বাড়ি। ডান দিকে কোনাকুনি একটা ছোট্ট একতলা বাড়ি আর তার লাগোয়া মন্দির। মন্দিরের পেছনে একটা বড় পুকুর দেখা যাচ্ছে। একতলা বাড়িটির দিকে দেখিয়ে সরকারমশায় বলল,
    -"ঐ আমাদের অতিথিশালা বাবু। আমি কাউকে ডাকছি, ঘর খুলে দিক, আপনারা বিশ্রাম নিন।"
    বলতে না বলতেই ভিতর থেকে একটি বয়স্ক চাকরমতন লোক প্রায় দৌড়ে এল।
    -"সরকার মশাই এসে গ্যাছেন। বাবু বৈঠকখানায় আপনের জন্যে অপিক্ষে করে আছেন যে। যান আগে গে দেখা করুন।"
    বিজয়ের পুলিশী চোখ রকমসকম দেখে বুঝল এই কর্তার খাস চাকর রঘু। যেভাবে কতৃত্বের সুরে সরকারমশায়ের সঙ্গে কথা বলছে তাতে তার পরিচয় বোঝা যায়। সরকারমশায়ও একটু যেন তটস্থ হয়ে ওঠেন, কি করবেন ভেবে পাননা। বিজয় ওনার অবস্থাটা বুঝে হাল্কাভাবে বলে,
    -"চলুন সরকারমশায়, মহেন্দ্রবাবুর সঙ্গে আগে দেখা করে আসি। আর তুমি রঘু আমার এই সঙ্গীটিকে অতিথিশালায় ঘরটর দেখিয়ে দাও, ও গুছিয়ে নিয়ে বিশ্রাম করুক একটু। অনেকটা পথ এসেছি আমরা।"
    রঘু একটু হকচকিয়ে যায় বিজয়ের এরকম সরাসরি নির্দেশে, তার বোধহয় খুব বেশী লোকের হুকুম শোনার অভ্যেস নেই। সে সরকারবাবুর দিকে তাকায়। এবারে সরকারবাবুও একটু সাহসী হয়ে গা ঝাড়া দিয়ে বলেন,
    -"তাই কর রঘু। এরা কলকাতা থেকে এসেছেন বাবুর নিমন্ত্রণে। এনাকে নিয়ে গিয়ে একটু ঘরটর দেখিয়ে দাও, আর জলখাবারের ব্যবস্থা কর। আমি ততক্ষণ এই বাবুকে নিয়ে কত্তার কাছে যাচ্ছি।"

  • shrabani | 124.30.233.104 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১৭:৪৮408415
  • রঘু আর দ্বিরুক্তি না করে হরিকে নিয়ে যায় অতিথিশালার দিকে, তবে তার মুখ দেখে মনে হয়না সে খুব একটা ভাল মনে কাজটা করছে, গজগজ করতে করতে যায়।
    বিজয়কে নিয়ে সরকারমশায় ভেতরবাড়ীর দিকে পা রাখে। ঢুকেই বৈঠকখানা, ঘরটি বেশ বড়সড়, আধুনিক আর পুরনো আসবাব দিয়ে সাজানো, দেওয়ালে নানা ছবি দেবদেবী, নৈসর্গচিত্র। একপাশে একটি বিশাল গদিওয়ালা আরামকেদারায় বসে গড়গড়া টানছেন এক ভদ্রলোক। বিজয়রা ঢুকতেই তিনি গড়গড়া সরিয়ে সোজা হয়ে বসে সরকারমশায়ের দিকে তাকালেন।
    -"কি ভূপতি, তোমার তো সকালের বাসে আসার কথা ছিল। এত দেরী করলে কেন?"
    সরকার মশায় সোজা উত্তর না দিয়ে বিজয়ের দিকে দেখাল। ঘরের ভেতর শেষ বিকেলে আবছা অন্ধকারে মহেন্দ্রবাবু বোধহয় বিজয়কে খেয়াল করেননি প্রথমে। এবারে সরকারের দৃষ্টি অনুসরণ করে বিজয়ের দিকে তাকালেন, চোখে জিজ্ঞাসা। সরকার কত্তার কাছাকাছি গিয়ে একটু গলা নামিয়ে চুপিচুপি বললেন,
    -"বাবু, ইনি মুকুন্দপুর থানার ছোটবাবু। আপনার বন্ধু বড়বাবু পাঠিয়েছেন এঁকে আমাদের মামলায় সাহায্য করতে। সব কথা এই চিঠিতে লিখে দিয়েছেন।"
    পকেট থেকে বড়বাবুর চিঠি বার করে দেন।
    মহেন্দ্রবাবু জানালার একধারে সরে গিয়ে বাইরের আলোয় ধরে চিঠিটা পড়তে শুরু করেন। একটু পড়েই চোখ তুলে বলেন,
    -"বসুন আপনি বিজয়বাবু। ভূপতি ঘরে আলো দিতে বল। এ আলোতে ভাল পড়া যাচ্ছেনা। ততক্ষণ আমি একটু এঁর সঙ্গে কথা বলি।"
    সরকারমশায় বেরিয়ে যান আলোর কথা বলতে। বিজয় একটা চেয়ারে বসে জমিদারবাবুর মুখোমুখি। মহেন্দ্রবাবু জমিদার হলেও চেহারাখানা খুবই সাধারণ। খুব একটা লম্বা চওড়া নয়, তবে রং ফরসা। মাথায় চুল প্রায় সবই সাদা, সামনের দিকটা টাক পড়ে গেছে। চেহারার মধ্যে সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হল ওনার চোখ। অত্যন্ত তীক্ষ্ম চোখের দৃষ্টি, যেন মানুষের ভিতর অবধি দেখে নিচ্ছেন। উনি চুপ করে আছেন দেখে বিজয়ই শুরু করল,
    -" বড়বাবু চিঠিতে মনেহয় সবই লিখেছেন, তবুও আমি বলছি। যেহেতু আপনার মন্দির চুরির কেসটা সদরের থানার কাছে আছে, আমরা সরকারী ভাবে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারিনা। তাই আমি এখানে বেসরকারী ভাবে তদন্ত করে আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করব। আমি যেকদিন এখানে থাকব আমার আসল পরিচয়টা গোপন রাখবেন। আপনি আর সরকারমশায় ছাড়া আর কেউ যেন না জানে আমি পুলিশের লোক। তবে তদন্তের কাজে আমাকে লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, খোঁজখবর করতে হবে, একেবারে অন্য কিছু পরিচয় দিলে লোকে সন্দেহ করবে। তাই আমরা ঠিক করেছি আপনি সকলকে জানাবেন যে আপনি একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা এনেছেন এই চুরির রহস্য সমাধান করার জন্য।"

    মহেন্দ্রবাবু মন দিয়ে বিজয়ের কথা শুনছিলেন। সে থামতে কি যেন জিজ্ঞেস করতে যাবেন, এমন সময় একজন চাকর ঢুকল দুইটি উঙ্কÄল হ্যাজাকবাতি নিয়ে। সারা ঘর আলোকিত হয়ে গেল। চাকরটি বেরিয়ে যেতেই রঘু ঢুকল একটি বড় পাথরের গ্লাসে কোনো পানীয় নিয়ে। একটি গোল টেবিল টেনে কত্তার চেয়ারের পাশে এনে তার ওপরে গ্লাসটি রাখল,
    -"বাবু, গিন্নীমা দুধ পাঠালেন। খেয়ে নিয়ে কথা বলুন।"
    -"তুই রাখ আর রেখে যা এঘর থেকে। আমি না ডাকলে আর এদিকে আসিসনা। "
    তারপরে কি মনে করে বিজয়কে বললেন,
    -"এই দেখুন, আপনার তো হাত মুখ ধোয়া কিছুই হয়নি। এক কাজ করুন আপনি ঘরে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে চা টা খেয়ে তারপরে আসুন, ধীরে সুস্থে কথা বলা যাবে। রঘু এদের সব ব্যবস্থা হয়েছে?"
    রঘু একটু মিনমিন করে বলে,
    -"হ্যাঁ অতিথশালায় ঘর খুলে পরিস্কার টরিস্কার করে দেছে। আমারে তো কেউ বলেনি অতিথ আসছে। আগে থে জানলে লোক দিয়ে সব ঠিক করে রাখতুম।"
    তার নালিশের ভঙ্গীতে খুব একটা মাথা ঘামাননা কর্তামশায়, মনেহয় রঘুর এ ধরনের নালিশ শুনতে তিনি অভ্যস্ত। বিজয় আর দেরী না করে উঠে পড়ে।
  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১১:৪৬408426
  • ----------------------------------
    অতিথিশালায় গিয়ে দেখে ওদের ঘরটি বেশ বড়, দুটি পরিপাটি বিছানা করা আছে। টেবিল চেয়ার দেরাজ দিয়ে গোছানো, হ্যারিকেনের আলো রেখে গেছে চাকর। বারান্দা দিয়ে একটু গেলেই স্নানঘর। বিজয় হাতমুখ ধুয়ে এল। হরি বারান্দায় ঘুরছিল, বিজয়কে এসে ঘরে বসতে দেখে এল।
    -"বাবু ঐ পাশের ঘরটাতেও এক ভদ্দরলোক আছেন। এখুনি হেঁটে এল বাইর থে। এখন মন্দিরে গিয়ে বসে আছে।"
    বিজয় কিছু না বলে পোষাক পালটাল। চাকর ঢুকল ওদের জন্য চা জলখাবার নিয়ে। খিদে পেয়েছিল এতটা পথ এসে আর গাড়ীর ঝাঁকুনিতে, ওরা আর কথা না বলে খেতে বসে গেল। চাকরটি ওদের জন্যে পট থেকে চা ঢালছিল। মাঝবয়সী হবে, বিজয় একটা লুচিতে কামড় দিয়ে চাকরটার উদ্দেশ্যে বলল,
    -"তোমার নামটি কি হে?"
    -"এজ্ঞে বাবু, বাঁটু"।
    -"কতদিন আছ এ বাড়ীতে?"
    -"তা পেরায় দেড়কুড়ি বছর হবে বাবু।"
    -"তাহলে তো অনেকদিন হল। তোমার বাড়ী কোথায়?"
    -"বাড়ী ছিল হিরনের ওপারে, বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে সে আজ প্রায় পনের বছর। এখন কত্তাবাবু একটু জমি দেছেন এই গাঁয়ে, সেখানে ঘর তুলে পরিবারকে রেখেছি।"
    -"তা তুমি কি রাতে এই বাড়ীতে থাক না নিজের বাড়ী চলে যাও?"
    -"আমি বাবু রাতে খাওয়াদাওয়ার পর নিজের বাড়ী চলে যাই। তবে যখন লোক বেশী হয় পুজোটুজোর সময় দরকারে থেকেও যাই।"
    -"এ বাড়ীতে রাত্রে কে কে থাকে? এই কাজের লোকেরা?"
    -"থাকে বলতে বাবু রঘুদা। তার পরিবার পরিজন কেউ কোথাও নেই, বউ মরে গেছে অনেককাল। এছাড়া গেটে মিশিরজী থাকে। বামুনঠাকুর আর হারুও থাকে। আর নিত্য ঝি থাকে গিন্নীমার ঘরে, সে অনেককালের গিন্নীমার বাপের বাড়ি থে আসা ঝি। আমি চলে যাই। রান্নাঘরের দুলুর মাও রাতে বাড়ী চলে যায়।"
    -"যেদিন মন্দিরে চুরি হয়, তুমি কখন জানতে পার?"
    এবারে বাঁটু একটু অবাক হয়, বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
    -"চুরি বাবু? ও, তা সেদিনও আমি নিজের ঘরেই চলে গেছলাম। ভোরবেলা যখন এসেছি দেখি মন্দিরের সামনে পুরুতমশাই রঘুদা মিশিরজী সব জটলা করছে। কাছে গিয়ে শুনি এই ব্যাপার। তখনও বাবুরা আসেনি,তারপরে বাবুরা উঠে এলেন, গাঁয়ের লোকেরা এসে পড়ল।"
    -"মন্দিরের কাজকম্ম এমনিতে কে করে বাঁটু?"
    -"এজ্ঞে,ঠাকুরের পাট পুরুতমশাই করেন। কখোনো বড় পুজোটুজো থাকলে উনি ছেলেরে নিয়ে আসেন। বারের দালান ধোয়া মোছা এসব ঠিকে ঝি করে।"
    -"বাড়ির লোক, গিন্নীমা কর্তাবাবু এরা নিয়মিত আসেন মন্দিরে?"
    -"তা আসেন বাবু। এবাড়ির নিয়ম বাড়ির বার যাবার আগে মন্দিরে মাথা ঠেকিয়ে তবে যাওয়া। কত্তারা, ছেলেরা সেইমতো আসেন, গিন্নীরা পুজো, সন্ধ্যে আরতির সময় এসে বসেন"।
    -"সে রাতে বাড়িতে কারা কারা ছিল?"
    -"কাজের লোক বাবু যাদের কথা কইলাম তারা ছেল। বাড়িতে কত্তাবাবু, গিন্নীমা, দিদিঠাকরোন, ভাগ্নেবাবু আর গিরীশবাবু ছেলেন। এছাড়া এইখানে অতিথঘরে বন্ধুবাবু ছেলেন। ও: আর সেদিন সকালে দাদাবাবুও এসছেলেন কলকাতা থে। উনিও ছিলেন তেতলায় উনার ঘরে।"
    -"দাদাবাবু মানে মহেন্দ্রবাবুর ছেলে?"
    -"হ্যাঁ বাবু।"
    -"ও:। আর এই বন্ধুবাবু কে? উনিই কি পাশের ঘরে আছেন?"
    -"উনি খুব নেকাপড়া জানা লোক। বাবুর অনেককালের বন্ধু। মাঝে মাঝে আসেন। কি সব নেকাপড়ার কাজে প্রায় মাসখানেক হোলো এসে আছেন।"
    বিজয়ের খাওয়া হয়ে গেছিল। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে টর্চ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
    -"হরি, তুই থাক। আমি একটু মহেন্দ্রবাবুর কাছ থেকে ঘুরে আসি।"

    বাঁটু এঁটো বাসন কাপপ্লেট গুছিয়ে তুলছিল। বিজয় বাইরে এসে দেখল অন্ধকার হয়ে গেছে, ঢং ঢং ঘন্টার আওয়াজের সাথে মন্দিরে আরতি শুরু হল। বাইরে দালানে বেশ কয়েকটি মহিলা দাঁড়িয়ে আরতি দেখছে। অন্ধকারে ঠিক তাদের চেনা গেলনা। কাল দিনের আলোয় মন্দিরটা দেখতে হবে।
  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১১:৫৫408322
  • বিজয় বাড়ির ভেতরে ঢুকে বৈঠকখানার দিকে এগিয়ে গেল।
    মহেন্দ্রবাবু একা ছিলেন না। তার সামনে একটু দুরে মাথা নীচু করে একটি কুড়ি একুশ বছরের সুঠামদেহী ছেলে দাঁড়িয়েছিল। উনি তাকে কিছু একটা নিয়ে বকাবকি করছিলেন।
    -"পাশটাও দিলিনে,মুখ্যু হয়ে রইলি, না নিতে পারবি ব্যবসার ভার না নিজে কিছু করতে পারবি। এখন আবার এইসব বদখেয়াল চেপেছে মাথায়, অ্যাঁ?"
    বিজয়কে ঢুকতে দেখে চুপ করে গিয়ে ছেলেটিকে যেতে বললেন। সেও গুটি গুটি পায়ে বিজয়ের দিকে দৃকপাত না করে বেরিয়ে গেল।
    বিজয় বসতে মহেন্দ্রবাবু বললেন,
    -"আমার ভাগ্নে, হারা, হারাধন। পড়াশোনায় মন নেই, স্কুলের পরীক্ষাটা পর্যন্ত দিলেনা। ব্যায়াম কুস্তি এইসব নিয়েই আছে। গাঁয়ের ছেলেদের নিয়ে কিসব ক্লাব খুলেছে। এখন তার জন্যে জমি চাই, খেলার মাঠ হবে, ঘর তুলতে হবে। যত্তসব বাজে খেয়াল!
    যাক জলযোগ হয়েছে আপনার? আপনাদের বড়বাবুর চিঠিতে আপনার অনেক কীর্তির কথা পড়লাম। আপনাকে দেখে তো খুব অল্পবয়স মনে হয়, বেশীদিন পুলিশের চাকরী হয়নি। এরমধ্যেই ওপরওয়ালাদের সুনজরে পড়ে গেছেন মানে বেশ করিতকর্মা মনে হচ্ছে!"
    কথাটা শুনতে কেমন লাগলেও উনি বোধহয় খোলামনেই বললেন, একটু মজার সঙ্গে। উত্তরে বিজয় বলল,
    -"আমাকে আপনি করে বলবেননা। বিশেষ করে আমি যখন এখানে পুলিশ অফিসারের ডিউটিতে আসিনি, বড়বাবুর বন্ধু হিসেবে আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।"
    -"সে নাহয় হবে, তবে আমার কাছে তো তুমি পুলিশ অফিসারই। পুরো ব্যাপারটা কি তুমি শুনেছ না আমি বলব?"
    -"শুনেছি সরকারমশায়ের কাছে, তবে আর একবার শুনতে চাই আপনার কাছে।"

    মহেন্দ্রবাবু যা বললেন মোটামুটি পুরোটাই সরকার মশায়ের কাছে শোনা হয়ে গেছিল বিজয়ের। এবার ও যেসব ব্যাপারে ওর অল্পস্বল্প খটকা আছে তা নিয়ে কথা শুরু করল। মহেন্দ্রবাবু মন দিয়ে ওর প্রশ্ন শুনতে ও উত্তর দিতে লাগলেন।
    -"মন্দিরের চাবি শুনেছি ভাঙা হয়নি, তালা খোলা হয়েছে চাবি দিয়ে। "
    -"ঠিক, ওপর নীচে শিকলে আর কড়ায় তিনখানা বিলিতী তালা লাগানো থাকে। তিনটিরই চাবি একটা আঙটার মধ্যে করে আমার শোবার ঘরের দেওয়ালের পেরেকে টাঙানো থাকে। সেই চাবি দিয়েই তালা খোলা হয়েছে।"
    -"তার মানে মন্দিরের চুরির আগে চোর আপনার ঘর থেকে চাবি চুরি করেছে। আপনি শেষ কবে ঐ চাবির গোছা দেখেছেন?"
    -"সেটাই তো আশ্চর্যের দারোগা। চন্ডী বামুন সন্ধ্যে আরতির পরে শীতল দিয়ে, ঠাকুর শয়ান করিয়ে নিজে আমাকে এই বৈঠকখানায় এসে চাবি দিয়ে গেছে। সাধারনত তাই হয়, রোজ সে নিজে আমাকে বা আমার স্ত্রীর হাতে চাবি দিয়ে যায়। চাকরবাকরের হাতেও দেয়না। আমি ওপরে উঠে চাবি জায়গায় রাখি। রাতের খাওয়া আমি ঘরেই সারি, অল্প খই দুধ আর মিষ্টি খাই, রঘু নিয়ে আসে। সেদিন খেয়ে দেয়ে দরজা দিয়ে শুয়ে পড়েছি। দরজার বাইরেই বারান্দায় চৌকি পেতে রঘু শোয়। তেতলার সিঁড়ির দরজা রাতে আমি আর আমার স্ত্রী ঘরে গেলে রঘু খিল দিয়ে বন্ধ করে। সেদিন সিঁড়ির দরজা ঘরের দরজা দুইই বন্ধ ছিল সকালে। তবু চুরির কথা শুনে দেওয়ালের চাবির জায়গার দিকে তাকিয়ে দেখি চাবি নেই। নীচে খোলা তালার গায়ে চাবি লাগানো ছিল। এ এক ভুতুড়ে কান্ড!
    ঐ সদরের পুলিশ শেষমেষ রঘুকেই ধরে নিয়ে গেল, আমার চল্লিশ বছরের পুরনো লোক, সে নাকি চাবি সরিয়েছে। পুলিশসাহেব কে বলে নিজে জামিন থেকে রঘুকে ছাড়িয়ে আনি। সেদিন থেকেই ওদের ওপর ভরসা আমার চলে যায়।"
    উত্তেজিত হয়ে পড়েন মহেন্দ্রবাবু। বিজয় এ নিয়ে আর কিছু বলেনা তবে এটা অনুমান করতে পারে যে এ অবস্থায় পুলিশের রঘুর ওপরে সন্দেহ টা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। সে বলে,
    -"আমি আপনার ঘরটা আর বাড়ির অন্যান্য দিকটা একটু ঘুরে দেখতে চাই। মন্দির আর বাগান কাল সকালে দেখব। ও হ্যাঁ, কি কি জিনিস চুরি গেছে তার একটা তালিকা পেলে ভাল হয়।"
    -"সে তো তোমায় দেখতেই হবে। চল আমিই নিয়ে যাই আমার ঘরে। তালিকা বোধহয় ভূপতির কাছে আছে।"

    রঘুকে ডেকে ভূপতির কাছ থেকে চুরি যাওয়া জিনিসের তালিকা আনতে বললেন। এরপর উনি উঠে দাঁড়ালেন, সাথে সাথে বিজয়ও। উঠতে গিয়েই বিজয়ের চোখ পড়ল দালানের দিকে, একটা ছায়া সরে গেল যেন, শাড়ীর আঁচলের মত কি যেন?
  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১২:০২408333
  • দুজনে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় এলেন। উঠেই বারান্দা, তিনদিকে গুটিচারেক ঘর, লাগোয়া স্নানঘর, একদিক ফাঁকা। একটা জিনিস বিজয় দেখছে এ বাড়ীর গড়ন বেশ আধুনিক বিলিতী ধাঁচের। মহেন্দ্রবাবু ঘর গুলির দিকে দেখিয়ে বললেন,
    -"এটিতে আমার বোন ভারতী থাকে, তার পাশের ঘরে হারাধন। ঐদিকের কোণের ঘরে গিরীশ, আমার শালার ছেলে থাকে। আর এই ঘরটি ফাঁকাই থাকে, কুটুম এলে ব্যবহার করা হয়।"
    কোণের ঘরটিতে আলো জ্বলছিল, বাকী ঘরগুলি অন্ধকার। বারান্দায় সিঁড়িতে দেওয়াল লন্ঠন আলোকিত করে রেখেছে। বিজয়রা তিনতলায় উঠল। তিনতলাও প্রায় দোতলার অনুরুপ। মাঝের ঘরদুটিতে কত্তা আর গিন্নী থাকেন। কোণেরটি ওদের ছেলের জন্য। আর অন্য ঘরটি বন্ধ থাকে, দরকারে খোলা হয়। প্রতিটি ঘরের সঙ্গেই পিছন দিকে আলাদা আলাদা বারান্দা আছে।

    কর্তার ঘরে ঢুকেই বিজয় দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে খুঁজে নেয় চাবি রাখার জায়গাটি। সেখানে বাহারী আংটায় অনেক গুলি চাবির রিঙ ঝুলছে। ঘরটি বেশ বড়, তবে খাট টেবিল চেয়ার দেরাজ ও একটি বেশ বড় সিন্দুক ছাড়া আর কোনো আসবাবপত্র নেই। নিত্য ব্যবহারের কাপড়জামার রাখার জন্য দেওয়াল আলনা আছে।
    বিজয় ঘুরে ঘুরে ঘরটি দেখল তারপরে ভিতরের বারান্দায় গেল। পাশেই গিন্নীর ঘরের বারান্দা। সেখানে একটা বড় আমগাছের ডাল এসে উঠেছে। সে ঘরে এসে কর্তাকে জিজ্ঞেস করে,
    -"আচ্ছা, বারান্দার দিকের দরজাও কি বন্ধ থাকে?"
    কর্তা একটু ভাবনায় পড়ে,
    -"না, বারান্দার দিকের দরজা গরমের দিনে আমরা কেউই বন্ধ করিনা। সেদিনও ছিলনা। তবে তিনতলার বারান্দায় কে চড়বে, আর কিভাবে?
    -"কোনো মেরামতির কাজ টাজ হলে মিস্ত্রী কি করে চড়ে, ভারা বেঁধে?"
    -"সে তো বটেই। সাধারণ ছুটছাট কাজে বাঁশের সিঁড়িও ব্যবহার করে।"
    বিজয় আর কিছু বলেনা। রঘু আসে সরকারমশায়ের দেওয়া তালিকা নিয়ে। কত্তাবাবু খাটে বসে রঘুকে ইশারায় যেতে বলেন। বিজয় চেয়ারে বসে টেবিলে রাখা আলোয় তালিকাটি দেখতে থাকে।
    দেখা শেষ হলে সে কাগজটি মুড়ে পকেটে রেখে সোজাসুজি চৌধুরীমশায়ের দিকে তাকায়। সে দৃষ্টিতে চৌধুরীমশায় একটু যেন অস্বস্তি বোধ করেন আর সেটা কাটাতেই বলে ওঠেন,
    -"কি বুঝছ দারোগা, কিছু আন্দাজ করতে পারছ এ সম্বন্ধে? "
    -"না চৌধুরীমশায়, আমি আসল কথাটাই বুঝতে পারছিনা। বিশেষকরে এই তালিকা দেখার পর থেকে তো পুরো ব্যাপারটা আরো অস্বচ্ছ লাগছে।"
    মহেন্দ্রবাবু একটু অবাক হয়ে বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
    -"অস্বচ্ছ? কেন এর মধ্যে তো কিছু গন্ডগোল দেখিনা আমি, সবই তো ঠিক ঠাক নথি করা হয়েছে। তোমার হঠাৎ এরকম মনে হচ্ছে কেন?"
    -"চৌধুরীমশায়, এই তালিকা অনুযায়ী যা চুরি হয়েছে তা হল মূলত: রুপোর ও কাঁসার কিছু বাসনপত্র, ঘন্টা, ঘট। এছাড়া গয়নার মধ্যে সোনার দুটি ছোট বালা, বাঁশি আর একটি মুক্তোর হার। বাকী টুকটাক রুপোর গয়না। জিনিসগুলোর দাম অবশ্যই কম নয় তবে এমন কিছু বেশীও নয় যার উদ্ধারের জন্য আপনি এত উতলা হয়ে পড়েছেন যে এক সপ্তাহেই সদরের থানার ওপর ভরসা হারিয়ে ফেলেছেন।
    হ্যাঁ, বিগ্রহও যদি শেষমেষ চোরেরা নিয়ে যেত, তাহলে আপনার বিচলিত হওয়ার একটা কারণ ছিল। আপনার মত ধনবানের পক্ষে এই তালিকাভুক্ত জিনিসগুলির মূল্য বেশী নয়, আপনি যে কোন মুহুর্তে আবার এসব কিনতে পারেন। মোটকথা আমাদের হিসেবে এই চুরি অত্যন্ত মামুলী চুরি, রহস্য নয়।
    হয় আপনার এমন কিছু চুরি গেছে যা অত্যন্ত মুল্যবান এবং এই তালিকায় তার উল্লেখ নেই নয়তো এই চুরির মধ্যে অন্য কিছু ব্যাপার আছে। আমি তখনই তদন্ত করতে পারব যখন আপনি আমাকে কোনো কিছু না লুকিয়ে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলবেন।"
  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১২:১২408341
  • বিজয়ের দৃঢ় বক্তব্য শুনে মহেন্দ্রবাবু হতবাক। কিছুক্ষণ কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকলেন, তারপর উঠে দুবার পায়চারি করলেন। একটু পরে যেন মনস্থির করে গলা পরিস্কার করে বলতে শুরু করেন,
    -"আমিই ভুল করেছিলাম। তোমাকে এত ছেলেমানুষ দেখে আসল কথাটা বলব কিনা বুঝতে পারছিলাম না। এখন দেখছি তোমার বড়বাবু ঠিকই লিখেছে, তুমি বেশ বুদ্ধিমান। তুমি ধরেছ ঠিকই, যা চুরি হয়েছে তা এমনি দেখতে গেলে খুব বেশী নয়, আমি তা আবার কিনে দিতে পারি শুধু ঐ হারটা ছাড়া। তালিকা দেখে মনে হচ্ছে ও একটা সাধারন মুক্তোর হার। আসলে তা নয়। সোনা আর মুক্তো দিয়ে গড়া, লকেটটি হীরের। বাজারে ওর দাম তো অনেক হবেই তবে ওর মূল্য আমাদের কাছে পয়সার হিসেবে নয়। বহু পুরুষ ধরে আমরা ঐ হারের মালিক, ঐ হার আমাদের বংশের সৌভাগ্যের প্রতীক। আমাদের বিশ্বাস যে ঐ হার হাতছাড়া হলে পরিবারে দুর্যোগ আসবে। আর তা প্রমানও হয়ে গেছে।
    আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদার আমলে বন্যায় আমাদের বাড়িঘর সব কিছু নদীতে তলিয়ে যায় আর কিছু মাটি চাপা পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। সেই সময় বাড়ির তখনকার কর্তা পুরনো ভিটের মায়া ত্যাগ করে এইখানে এসে ঘর বাঁধে। তখন আমাদের ব্যবসাপাতি ছিলনা, জমিজায়গার আয়ই প্রচুর। বন্যার সময় এই হারটি হারিয়ে যায়। সিন্দুকে থাকত, বন্যায় সে সিন্দুক ভেসে যায়। এরপরে আমাদের পরিবারের অবস্থা পড়ে যেতে থাকে, জমি অনেক নদী খেয়ে নেয়, চাষবাস নষ্ট হয়। আমার ঠাকুরদা জিতেন্দ্র চৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত উদ্যোগী পুরুষ। সবাই জানে তিনিই ব্যবসা বাণিজ্যের দিকে গিয়ে আবার অবস্থা ফেরান। যা সবাই জানেনা যে তাঁর উদ্যোগে, তাঁর ভাড়া করা অভিজ্ঞ জেলে ও সাঁতারু ডুবুরীরা দীর্ঘ দিন ধরে নদীতে খুঁজে খুঁজে সেই সিন্দুক উদ্ধার করে, টাকাপয়সা তো পাওয়া যায়না তবে এই হার পাওয়া যায়।

    আমি আর কিছু চাইনা শুধু চাই তুমি এই হার উদ্ধার করে দাও। বাজারে চলে গেলে কি ঐ হার আর অক্ষত পাব, লোকে মুক্ত হীরে খুলে নিয়ে সোনা গালিয়ে দেবে। আমি ঐ হার অক্ষত চাই, বাজারে যাবার আগেই ওটা খুঁজে বার কর।"
    বিজয় পুরো ঘটনাটা নিয়ে একটু চিন্তা করল, তারপর বলল,
    -"এই হারটার সম্বন্ধে আপনার বাড়ির লোকেরা ছাড়া আর কে কে জানে? এত মূল্যবান যখন আপনি ওটা নিজের সিন্দুকে না রেখে ঠাকুরঘরে খোলা ফেলে রেখেছিলেন কেন?"
    -"আলাদা করে হার নিয়ে আমরা বাড়িতেও আলোচনা করিনা। বাড়ির লোকেরা জানে হার শুভ এই পর্যন্ত। সেরকম অনেকেই জানে, কাজের লোকেরা, ভূপতি এরা।জিতেন্দ্র চৌধুরীই হারটা পুনরুদ্ধার করার পর ওটা ঠাকুরঘরে নারায়ণের গলায় রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তখন থেকে ওটা ঠাকুরের গলায়ই পরানো থাকে।সেই নিয়মই চলে আসছে। উনি হয়ত ভেবেছিলেন ঠাকুরের গলা থেকে হার খুলে নেবার কারো সাহস হবেনা। এতকাল তো এভাবেই আছে।"
    -"ঠিক আছে। আমি কাল সকালে বাড়ির সকলের সঙ্গে কথা বলব, আপনি সবাইকে তৈরী রাখবেন। বৈঠকখানা ঘরেই যদি বসি, অসুবিধে নেই তো? তার আগে আমি মন্দির বাগান, যে জায়গায় বিগ্রহমূর্তি পড়ে ছিল সব একবার দেখব।"
    -"না অসুবিধে কি? ভূপতি সকালে তোমাকে সব জায়গাগুলো দেখিয়ে দেবে।"
    -"আচ্ছা অতিথিশালায় যে ভদ্রলোক আছেন ওর পরিচয়টা কি? উনি কি চুরির সময় ছিলেন এবাড়ীতে? তাহলে তো ওনার সাথেও কথা বলতে হয়।"
    মহেন্দ্রবাবু একটু থমকে গেলেন,
    -"অতিথিশালায়? ও, তুমি শিবতোষের কথা বলছ! শিবতোষ আমার কলেজের বন্ধু। একটা কলেজে ইতিহাস পড়াত, কিছুদিন হল অবসর নিয়েছে। সেই কলেজের সময় থেকেই ওর আমার বাড়ীতে যাতায়াত, বলতে গেলে বাড়ীর লোকের মতই হয়ে গেছিল। স্ত্রী মারা গেছে বেশ কবছর হল। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, ঝাড়া হাতপা মানুষ। আগেও ছুটিছাটায় আসত। এবারে এসে প্রায় মাসখানেক হল আছে। ওকে বলেছি আমাদের পরিবারের ইতিহাসটা একটু ঘেঁটে দেখতে, পারলে লিখে ফেলতে। সেই কাজেই লেগেছে আজকাল। "

    রাত হয়েছিল। বিজয় এবার উঠল। কর্তামশায় দরজা অবধি এগিয়ে এলেন।বারান্দায় চৌকীতে বসে রঘু ঝিমোচ্ছিল। বিজয় বেরোতেই সে ধড়ফড় করে উঠে মহেন্দ্রবাবুকে বলল,
    -"বাবু, আপনি এখন খাবেন তো? আমি যাচ্ছি আপনার খাবার আনতে।"

    বিজয় চুপচাপ সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকল, পিছনে রঘু। একতলায় নেমে রঘু উঠোন পেরিয়ে রান্নাদুয়ারের দিকে গেল, আর বিজয় বাহিরবাড়ীর দিকে। চারিদিক অন্ধকার, মন্দিরেরও দরজা বন্ধ। শুধু অতিথিশালার দুই কামরা থেকে হালকা আলোর আভাস। দুরে গেটের পাশে মিশিরলালের ঘর থেকে গুনগুন করে রামায়ণ পড়ার শব্দ আসছে।

  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১৫:১৫408342
  • ------------------------------------------------------
    বিজয় ঘরে ঢুকে বিছানায় লম্বা হল। হরি দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে ঢুলছিল, তড়াক করে উঠল এখন।
    -"বাবু কত রাত হয়েছে? এরা খেতে দেবে কখন! আমি গিয়ে বলব চাকরটাকে?"
    বিজয় চোখ বুজেই বলে,
    -"বেশী রাত হয়নি, তোকে চিন্তা করতে হবেনা। রান্না হলে ঠিক খাবার পাঠাবে ওরা। তুই কি করলি এতক্ষণ?"
    হরি বিশু এরা বিজয়ের সঙ্গে থেকে থেকে অনেক কিছু শিখে গেছে। বিশেষ করে বিজয়ের কাজের ধরনে ওরা আজকাল খুব উৎসাহ পায়, নিজেরাও নিজেদের মত করে ভাবনা চিন্তা করতে চেষ্টা করে।
    -"বাবু, মন্দিরটা দেখলাম। যাতায়াতের একটাই দরজা। তালাগুলো কি বড় বড়,ও ভাঙা মুশকিল হত। বাড়ির চারধারের পাঁচিল বেশ উঁচু আর খাড়াই। বাইরে থেকে পাঁচিল বেয়ে ঢুকতে গেলে বেশ ষন্ডামতন হতে হবে। আর একটা কথা, আমি ঐ দারোয়ান মিশিরের সাথে গপ্প করছিলুম। এমনিদিনে মিশিরজী সারারাত জেগে থাকে, গেটে তালা লাগিয়ে বাড়ির চারধার টহল দেয়। সেদিন রাতে মিশিরজীর শরীরটা ভাল লাগছিলনা, কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। তাই কিছুক্ষণ ঘুরেই ও ওর কুঠরিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙে সকালে পুরুতবামুনের ডাকে গেটের চাবি খুলতে।"
    বিজয় চুপচাপ শুনল হরির কথাগুলো। এখনও যা দেখেছে শুনেছে তা খুবই অল্প, তা থেকে কোনো সমাধানে আসা অনেক দুর। কাল অনেক কাজ। সদরের থানা থেকে যে তদন্তে আছে তার সাথে কথা বলা দরকার, কিন্তু অবস্থা এমন যে নিজের পরিচয় দিয়ে ওদের সাথে যোগাযোগ করা যাবেনা আর বাইরের লোক হিসেবে গেলে ওরা মুখ খুলবেনা। হঠাৎ মনে পড়ল তারিণীবাবুর আত্মীয়ের কথা, সঙ্গে সঙ্গে বিজয় উঠে বসল।
    -"হরি।"
    হরি আবার ঢুলতে আরম্ভ করেছিল। ডাক শুনে চোখ খুলল।
    -"কি বাবু?"
    -"হরি, কাল তোকে জেলা সদরের থানায় যেতে হবে। আমি একটা চিঠি দেব, সেটা নিয়ে তারিণীবাবুর আত্মীয় নীলমনি পাত্রর হাতে দিবি। খবরদার, কাউকে তোর আসল পরিচয় দিবিনা, বলবি চিঠি নিয়ে এসেছিস নীলমনিবাবুর আত্মীয়ের।"
    হরি একটা কাজ পেয়ে উৎসাহিত হয়ে পড়ল,
    -"বাবু, বেশটা বদলে যাব? নাম কি বলব?"
    বিজয় ওর অতিরিক্ত উৎসাহে জল ঢেলে দিয়ে বলে,
    -"ওসব কিছু করতে হবেনা। আর নামটাও সত্যিই বলবি কেউ জানতে চাইলে। শুধু পেশাটা গোপন করে যাবি।"
    হরি একটু হতাশ হল মনে হয়। বিজয় ব্যাগ খুলে কাগজ পেন বার করে নীলমনি বাবুকে চিঠি লিখতে বসল। তারিণীবাবুর লেখা চিঠির সঙ্গে নিজেও দুকলম লিখে দেবে। লেখা শেষ করেছে আর বাঁটু ঢুকল খাবারের থালা হাতে। টেবিলে খাবার সাজিয়ে আবার জল আনতে গেল। ওরা আর দেরী না করে হাত ধুয়ে খেতে শুরু করল। খাওয়া হয়ে গেলে বাঁটু সব পরিস্কার করে এঁটো বাসন নিয়ে চলে গেল। বিজয় হাত টাত ধুয়ে এসে বারান্দায় একটু পায়চারি করতে লাগল। হরি ঘরের ভেতর ওদের বিছানা করে মশারি টাঙাচ্ছিল।

    কয়েকদিন আগে বোধহয় পূর্ণিমা গেছে, এখনও বেশী রাতে দিকে চাঁদের আলোর বেশ জোর। চাঁদের আলোয় চারদিকটা বেশ মনোরম লাগছে, বাতাসও বইছে তাই বাইরে গরম একদম লাগছেনা। বিজয় প্রকৃতির রূপ দেখায় ব্যস্ত ছিল, হঠাৎ একটা অস্বস্তি হতে কি মনে করে ঘুরে দাঁড়াল। একটু দুরে একজন দাঁড়িয়ে তাকেই দেখছে। ভদ্রলোক মহেন্দ্রবাবুরই বয়সী হবেন, পরনে ধুতি, গায়ে ফতুয়া, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, রোগাটে গড়ন। বিজয় অনুমান করল ইনিই শিবতোষ, মহেন্দ্রবাবুর বন্ধু, ইতিহাসের অধ্যাপক। মুখ ঘোরাতেই একটু এগিয়ে এসে তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন ভদ্রলোক,
    -"অতিথিশালায় নতুন অতিথি দেখছি, আজই এলেন?"
    বিজয় দুহাত জড়ো করে নমস্কার করে,
    -"আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি বোধহয় আমার প্রতিবেশী?"
    -"ঠিক ধরেছেন। আমি শিবতোষ সরকার, মহেন্দ্র মানে জমিদারবাবুর বন্ধু।"
    -"জানি, মহেন্দ্রবাবু বলছিলেন যে অতিথিশালায় আপনিও আছেন। ওনার বন্ধু অধ্যাপক মানুষ, এই পরিবারের ইতিহাস নিয়ে লেখাপড়া করছেন।"
    -"সে কী? অ্যাঁ, আপনাকে এর মধ্যেই এসব বলা হয়ে গেছে মহেনের। লেখাপড়া কিছুই না, রিটায়ার করেছি, একলা মানুষ, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই। মহেনেরও বয়স হয়েছে, ওসব ইতিহাস টিতিহাস আমাকে এখানে ধরে রাখার জন্যে বলে, যাতে আমার না মনে হয় বড়লোক বন্ধুর ঘাড়ে বসে খাচ্ছি। তা আপনার পরিচয়টা?"
    বিজয় এই প্রথম পরিচয় গোপন করে কোনো তদন্ত করতে এসেছে। পুলিশ হিসেবে তদন্ত করতেই ও স্বচ্ছন্দ বোধ করে। লোকজন ঘাবড়ে গিয়ে অজান্তেই অনেক সূত্র হাতে ধরিয়ে দেয়। যাইহোক এক্ষেত্রে ও ঠিক করেছে, পুলিশী পরিচয় লুকোলেও গোয়েন্দার পরিচয় লুকোবেনা, যতটা সম্ভব নিজের পরিচয়ে থাকবে। তাই বলল,
    -"আপনি নিশ্চয় মন্দিরের চুরির ব্যাপারটা জানেন। আমি ঐ চুরির বেসরকারী ভাবে তদন্ত করতে এসেছি, মহেন্দ্রবাবুর এক বন্ধুর অনুরোধে। আমার নাম বিজয় ঘোষ।"
    শিবতোষ একটু তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,
    -"শেষমেষ প্রাইভেট ডিটেকটিভ! কেন,পুলিশ কিছু করতে পারছেনা? তা আপনার বাস কোথায় ঘোষমশায়, কলকাতায়?"
    বিজয় গ্রামের ছেলে হলেও পড়াশুনা করেছে কলকাতায়, শহরটা ভালই চেনা আছে। তাই বলল,
    -"বাসা কলকাতাতেই, তবে কাজে কর্মে এদিকসেদিক ঘুরে বেড়াতে হয়। এখন আসছি মুকুন্দপুর থেকে, ওখানে থানায় একটা তদন্তের কাজে এসেছিলাম। বড়বাবু মহেন্দ্রবাবুর বন্ধু। সরকারমশাইকে উনি তার কাছেই পাঠিয়েছিলেন পরামর্শের জন্য। তা বড়বাবুর সাথে আমারও চেনাজানা ছিল, উনিই বললেন সদরের পুলিশ তো দেখছেই তার সাথে আমিও যদি একটু দেখি।"
    -"আজকাল পুলিশ গোয়েন্দা সব একইরকম হয় দেখছি! তা তদন্তে কি পেলেন, অবশ্য বলতে আপত্তি না থাকলে?"
    -"এই তো সবে বিকেলে এসে পৌঁছেছি, এখনও সেভাবে কিছু শুরু করিনি। মহেন্দ্রবাবুর সাথেই যা কথা হয়েছে।"
    -"বেশ বেশ দেখুন চেষ্টা করে।"
    -"আপনি সেরাতে তো এখানেই ছিলেন শুনলাম। কিছু টের পাননি? এই বাড়িটা তো মন্দিরের একদম লাগোয়া।"
    -"না:, সেভাবে কিছু টের পাইনি। বয়স হলেও আমার ঘুমটুম খুবই ভাল। সারাদিন অনেক ঘোরাঘুরি করি, রাত্রে খাওয়ার পর এই বাগানে হাঁটাহাঁটি করি। বিছানায় পড়লে রাত কাবার হয়ে যায়। সেদিন ভোরে ঘুম ভেঙে যায় লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচিতে। বাইরে বেরিয়ে শুনি এই ব্যাপার।"
    বিজয় এবার প্রসঙ্গান্তরে যায়,
    -"আপনি সারাদিন ঘোরাঘুরি করেন বললেন সেটা কি কোন কাজে না এমনিই?"
    -"এমনিই বলতে পারেন। আসলে মহেন্দ্র তো আমাকে এখানে রাখার জন্য ওর বংশের ইতিহাস ঘাঁটতে বলেছিল। তা আমি দেখলাম খালি বসে না থেকে যদি পারি একটু এব্যাপারেই কাজ করি। তাই সকালের দিকে আমি ওদের পুরনো ভিটের ওখানে যাই।"
    -"পুরনো ভিটে? তা সে তো শুনেছি কিছুটা নদীতে আর বাকিটা মাটির তলায়, জঙ্গলের মধ্যে। সেখানে দেখার মত কিছু আছে নাকি?"
    -"ঠিকই শুনেছেন। তবে জঙ্গলের সেই জায়গাটা মহেন্দ্রর ঠাকুরদা কিছুটা সংস্কার করেন। খোঁড়াখুঁড়ি করে এখন কিছুটা মাটির ওপরে। অবশ্য মহেন্দ্রর বাপ ও নিয়ে তেমন মাথা ঘামাননি। আমার উৎসাহে মহেন্দ্র ওখানের গাছপালা কাটিয়ে পরিস্কার করিয়েছে। আপনি একবার গিয়ে দেখে আসুননা।"
    -"নিশ্চয়ই যাব। তবে জমিদারদের পুরনো ভিটে খুঁড়ে কি সেরকম কিছু ইতিহাস পাওয়া যায়?"
    বিজয় একটু হাল্কা সুরেই শেষ প্রশ্নটা করে। শিবতোষবাবু একটু যেন শক্ত হয়ে যান সুরটা বুঝে, তারপরে বলেন,
    -"অবিশ্বাসে পাথর আর মানলে ভগবান। ইতিহাস সবকিছুতেই পাওয়া যায় কিন্তু তা পড়ার ক্ষমতা সব লোকের থাকেনা। আচ্ছা, রাত অনেক হয়েছে, এবার আমি শুতে যাব। চলি, সকালে দেখা হবে।"
    বিজয়কে আর কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। বিজয় নিজেদের ঘরে গিয়ে দেখল হরি ঘুমে অচেতন, রাত অনেক হয়েছে তাই সেও শুয়ে পড়ল।

  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১৭:২৬408343
  • ভোরে ঘুম ভেঙে প্রথমে দু এক সেকেন্ড সময় নিল কোথায় আছে সেটা মনে করতে। মনে পড়তেই তড়াক করে উঠে পড়ল। হরির বিছানা গোছানো। সে বোধহয় বাইরে। বিজয় বাইরে এল। স্নানের ঘর থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখল হরি ওর বিছানা তুলছে।
    -"বাবু, বাঁটু চা দিতে এসেছিল, আপনি তখন ঘুমোচ্ছিলেন। আবার একটু পরে আসবে।"
    বিজয় ঘড়িতে দেখে সাড়ে পাঁচটা বাজে। এরা বেশ ভোর ভোর উঠে পড়ে তো! সে হরিকে বলে,
    -"তুই বরং চান টান করে তৈরী হয়ে নে। জলখাবার দিলে খেয়ে বেরিয়ে পড়িস সদরে। যেমনটা বলেছি তেমন করবি কিন্তু।"
    -"সে আমি বুঝে গিয়েছি বাবু। কিন্তু সদরে যেতে গেলে কি ঐ বড়তলা দিয়েই যেতে হবে? আর একটা সোজা রাস্তা আছে বোধহয়, কাউকে একটু জিজ্ঞেস করতে হবে।"
    বিজয় কি ভাবল। তারপরে ওকে বলল,
    -"তুই তৈরী হ। আমি সরকারমশায়কে বলে তোর যাবার ব্যবস্থা করছি।"
    হরি বেরিয়ে গেল পুকুরের দিকে। বাঁটু এল চা নিয়ে। বিজয় চা খেতে খেতে বাঁটুকে বলল,
    -"সরকার মশায় এলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বোলো। দরকার আছে। আর বাবু কি নীচে নেমেছেন?"
    বাঁটু জানাল মহেন্দ্রবাবু তখনও নীচে আসেননি। বিজয় চা খেয়ে মন্দিরের দিকে গেল। মন্দিরের দরজা খোলা, দালান সিঁড়ি সব ন্যাতা দিচ্ছে একটি বয়স্কা মেয়েছেলে, কাজের মেয়ে হবে, বিজয়কে দেখে ঘোমটাটা আরো টেনে দিল। মন্দিরের ভেতরটা একটু আবছা অন্ধকার মত। একজন বয়স্ক মানুষ ঠাকুরের বাসন টাসন কোশাকুশি সব জড় করছে, বোধহয় ধুতে যাবে। পোশাক দেখে বিজয় অনুমান করল এই হল মন্দিরের পুরোহিত। বিজয় একটু অপেক্ষা করে। পুরুতঠাকুর সব বাসন নিয়ে বাইরে আসে, দালানের একপাশে নুয়ে বাসন রাখতে রাখতে বলে ,
    -"আলোর মা, মোছা হয়ে গেলে বাসনগুলো আগে ধুয়ে এনে দাও। আমি ততক্ষণ ভিতরটা পরিস্কার করে নিই। দিদিঠাকরুন এক্ষুনি ফুল নিয়ে এসে পড়ল বলে।"
    আলোর মা কিছু না বলে ঘাড় নাড়ে। বামুন বোধহয় তার সাড়া না পেয়ে সেইদিকে তাকাতেই বিজয়কে দেখতে পায়, অচেনা লোক দেখে একটু বিস্ময়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় বিজয়ের দিকে।
    -"নমস্কার। আপনি এই মন্দিরের পুরোহিত তো? আমি কাল এসেছি, আপনাদের কর্তাবাবু ডেকে পাঠিয়েছিলেন। মন্দিরের চুরির ব্যাপারে তদন্ত করতে।"
    বামুনঠাকুর এবার আরও অবাক হয়ে যায়,
    -"মন্দিরের চুরির তদন্ত, সে তো পুলিশ! আপনি কি পুলিশের লোক বাবু?"
    -'আমি পুলিশের লোক নই, আমি গোয়েন্দা।"
    গোয়েন্দা শুনেই পুরোহিতের মাছি ঢুকে যাওয়ার হাঁ। আলোর মার মোছা হয়ে গিয়েছিল, সে এবার ন্যাতার বালতি একপাশে রেখে বাসন নিয়ে পুকুরের দিকে গেল। বিজয় গুছিয়ে বসল মন্দিরের সিঁড়িতে। পুরুতমশাই তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন, কি করবেন বুঝতে পারছেন না। বিজয় বলে,
    -"আমি বেশী সময় নেবনা, আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব এই চুরি নিয়ে, আপনি ভেবেচিন্তে ঠিকঠাক উত্তর দিতে চেষ্টা করবেন।"
    -"কিন্তু আমি তো! মানে আমার এখনও পূজোর পাট বাকী। পরে হলে হয়না?"
    -"পরে আবার হবে। এখন শুধু অল্প কিছু জিজ্ঞেস করব, আপনার পাটের ক্ষতি হবেনা।"
    পুরুত দেখল বিজয় নাছোড়, তাই আর আপত্তি না করে, মন্দিরের দরজার পাশে উঁচু বেদীর ওপর বসে।

  • Blank | 59.93.247.104 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ০০:৪১408344
  • তাপ্পর? শিগ্গির শেষ করো
  • Du | 71.170.156.40 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ০০:৪৭408345
  • দাঁড়াও, ঘন হচ্ছে আরও।
  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১০:০১408346
  • -"ঠিক আছে, আলোর মা বাসন ধুয়ে নিয়ে এলেই কিন্তু আমি কাজে লেগে যাব। ততক্ষণ আপনার যা জানার আছে জিগ্যেস করে নেন।"
    -"আচ্ছা পুরুতমশাই, আপনি চুরির আগের রাতে মন্দির বন্ধ করেন কখন? চাবি নিয়ে কাকে দেন, কোথায়?"
    পুরুতমশাই একটু ভেবে বলেন,
    -"রোজই এই সাতটা সাড়ে সাতটা নাগাদ ঠাকুরকে লুচি বাতাসার শীতল দেখিয়ে তারপরে শয়ান করিয়ে দিই। সেরাতেও ঐরকম সময়ই করেছিলাম, দেরী হবার মত কিছু তো হয়নি। তারপরে স্নানজল আর চাবি নিয়ে ভেতরবাড়ীতে যাই। বাবু বৈঠকখানাতেই ছিলেন, বাবুর বন্ধু শিবতোষবাবু আর ভূপতিও ছিল। আমি বাবুকে স্নানজল দিয়ে চাবি ওনার হাতে দিই।"
    -"সকালে কখন এসে দ্যাখেন মন্দিরে চুরি হয়ে গেছে? সেসময় আর কারা ছিল এখানে আপনার আশেপাশে?"
    -"আমি রোজ যেমন আসি তেমনিই এসেছি সেদিনও। প্রথমে মন্দিরে খেয়াল করিনি, সোজা পুকুরে গেছি হাত পা ধুতে। সেখান থেকে এসে দেখি মন্দিরের তালা খোলা, ভেতরে বিগ্রহ নেই, জিনিসপত্র ছড়ানো। বাইরে এসে চিৎকার করে মিশির কে ডাকি। তখন আর মাথার ঠিক নেই, কে কে সব আসে দৌড়ে দেখিনি। চোখে কেমন অন্ধকার দেখি আরো বিগ্রহ নেই দেখে।"
    -"তারপর?"
    -"তারপরে সবাই এসে হাঁকডাক শুরু করে দেয়। একটু পরে বাবু আসেন। আমায় ভেতরে গিয়ে দেখতে বলেন ঠিক কি কি গেছে। আমি গিয়ে এক এক করে দেখি। মূল ঠাকুর নারায়নের মূর্তি নেই, পাশে ছোট মা লক্ষ্মী আছেন। বাসন কোসন প্রদীপ পিলসুজ সব একদিকে জড়ো করে রাখা ছিল, সব গেছে। ঠাকুরের রুপোর বেদীটা সিমেন্ট দিয়ে গাঁথা ছিল। সেটা পয্যন্ত শাবলের চাড় দিয়ে ভেঙে তুলে নিয়ে গেছে।
    আমি দেখে দেখে আর মনে করে করে এক একটা বলতে থাকলুম আর ভূপতি লিখতে থাকল। এর মধ্যে কারা এসে খবর দিল মূর্তি পড়ে আছে বাইরের বাগানের ধারে। আমরা দৌড়লাম। গিয়ে দেখি বিগ্রহ আছেন, পরনে শুধু কাপড়খান, কোনো গয়নাগাটি হার, কানের কুন্ডল, হাতের বালা কিচ্ছুটি নেই। তুলে নিয়ে এলাম মন্দিরে।"
    -"রুপোর বেদী সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো ছিল কেন?"
    -"তা তো জানিনা। এ মন্দির জিতেন্দ্র চৌধুরীর সময় নতুন করে হয়, তখন থেকেই এমন।"

    বিজয় উঠে মন্দিরের ভিতর উঁকি মেরে দেখল। ঠাকুর এখন সিমেন্টের বেদীতে বসে আছে, ওপরটায় পাথর বসানো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাড়াহুড়ো করে তৈরী ব্যবস্থা, সিমেন্ট এখনো কাঁচা কাঁচা দেখতে লাগছে, চুনকাম হয়নি।

  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১০:০৮408347
  • -"আচ্ছা, বিগ্রহের গলার যে মুক্তোর হার ছিল তা শুনেছি এ পরিবারের অনেক কালের। এ ব্যাপারে আপনি কিছু জানেন। সেটা কি সব সময় পরানো থাকত?"
    -"বিগ্রহের গলায় বাবু দুটো হার পরানো থাকত সাধারণত:। একটা রুপোর আর একটা মুক্তোর হার। মুক্তোর চারটে ছড়া মাঝে মাঝে সোনার ওপর পাথর বসানো ডাঁটি আর লকেটটা সরু লম্বা মতো মাথার দিকটা কারুকার্য করা নানা রঙের পাথর দিয়ে, নীচের দিকটা খাঁজকাটা। হারটা বেশ লম্বা, মুর্তির পা অবধি ঠেকত।"
    -"এ ছাড়া আর কোনো দামী গয়না পরানো থাকতনা! তাহলে এই হারটি কেন ঠাকুরের গলায় সবসময় থাকত সে বিষয়ে কিছু জানেন?"
    পুরুতমশাই এ কথার জবাব চট করে দেননা। একটু ইতস্তত করতে থাকেন। বিজয় আবার জিজ্ঞেস করতে, একটু এদিক ওদিক দেখে নীচুস্বরে বলেন,

    -"সত্যি মিথ্যে জানিনা বাবু, আমি আমার বাবার কাছে শুনেছি। আমাদের বংশ অনেক বছর ধরে এদের পুরোহিত। আগেকার দিনে এইসব জমিদার বা রাজাদের বাড়ীতে দু:সময়ের কথা ভেবে সোনাদানা গয়নাগাঁটি এইসব ধন এক করে গোপনে কোথাও সঞ্চিত করে রাখা হত। সবাই জানতনা, বাড়ির কত্তা আর কোনো এক বিশ্বাসী লোক এর হদিশ জানত। সেইরকম এ বাড়ীতেও ছিল। বাবা তার বাবার কাছে শুনেছে, তিনিও আবার তাঁর বাবার থেকে। ঐ হারের লকেট সেই গুপ্তধনের চাবিকাঠি, বংশানুক্রমে এটি গৃহদেবতার হেফাজতে থাকে। যাতে লোকে বুঝতে না পারে তার জন্য হারের লকেট করে রাখা আছে।"

    বিজয়ের শুনে খুব একটা ভরসা হলনা, এরকম গুপ্তধনের গল্প প্রাচীন পরিবারে অনেক চালু থাকে, এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে কথা হচ্ছে কেউ বিশ্বাস করে এই হারের জন্য মন্দিরে চুরি করতেই পারে। তবে এতবড় কাজ সে তখনই করবে যখন গুপ্তধনের বাক্স বা সিন্দুক যাই থাক সেটাও তার হাতে আসবে।
    -"আচ্ছা পুরুত মশাই, এই গোপন ধন এখন কোথায় গচ্ছিত আছে বলে মনে হয় আপনার? আর আপনি ছাড়া এই চাবি সম্বন্ধে আর কারা কারা জানে?"
    -"বাবু আমি কাউরে বলিনি কখনো, এই আপনারে বললেম। আমার বাবার বারন ছিল। ভেবেছিলাম মরার আগে যদি প্রয়োজন হয় ছেলেরে বলে যাব, যাতে ঐ হারের বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়। বাবা বলতেন যতদূর সম্ভব সেই গুপ্তধনের বাক্স পুরনো ভিটেতেই রয়ে গেছে, অথবা বন্যায় কোথাও বয়েটয়ে গেছে। এই পরিবারের জিতেন্দ্র চৌধুরী অনেক খোঁড়াখুঁড়ি করেছিলেন, জলে ডাঙায় দুইতেই, কিন্তু যতদুর মনে হয় পাননি। অন্যান্য অনেক জিনিস পেয়েছিলেন কিন্তু গুপ্তধন পেয়েছেন বলে শুনিনি।"
    -"হতে পারে এরকম কোনো গুপ্তধন ছিলনা বা থাকলেও অনেক আগেই কর্তারা তা খরচ করে ফেলেছিলেন?"
    -"সেও হতে পারে বাবু। তবে একটা কথা, সে হলে জিতেন্দ্রবাবু তা জানতে পারেননি। বাবা ঠাকুর্দা বলতেন নিয়ম হল অবস্থা খারাপ হলেই ও ধনে হাত দিতে হয়, নচেৎ নয়। জিতেন্দ্রবাবুর বাপের সময় এ পরিবারের অবস্থা বেশ পড়ে গিয়েছিল। তখনই উনি খোঁজ করেছিলেন, পরে সামলে গেলে বোধহয় আর খোঁজেননি। তখনকার দিনের কত্তারা সব কড়া নিয়মের মানুষ ছিলেন বাবু, শুধু উড়িয়ে দেবার জন্য পরিবারের সঞ্চিত ধনে হাত দিতেননি।
    বাবু, আলোর মা আসছে বাসন ধুয়ে, এবার আমি উঠব।"
    -"হ্যাঁ ঠিক আছে। শুধু একটা কথা বলুন, জিতেন্দ্রর পরে আর কোনোদিনও এ নিয়ে কিছু খোঁজখবর হয়নি?"
    -"হলেও আমি শুনিনি। তবে একটা কথা, গত কিছুকাল যাবৎ বাবুর বন্ধু শিবতোষ বাবু পুরনো ভিটেতে খুব যানটান, বাবুরই কথায় নাকি। মাঝে মাঝে খোঁড়াখুঁড়িও হয়। ওর কথাতেই বাবু জঙ্গলে পুরনো ভিটের কিছুটা কাঁটাতার দিয়ে বেড়া দিয়ে দিয়েছে, চাবি দেওয়া থাকে। তবে কিছু পাওয়া গেছে বলে শুনিনি।"

    আলোর মা এসে পড়ায় আর কথা এগোয় না। পুরুত মশাই ধোয়া বাসনে গঙ্গাজল দিয়ে সেসব নিয়ে ভেতরে ঢোকেন।
  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১০:৫৫408348
  • বিজয় ওখান থেকে উঠে পড়ে ঘরের দিকে যায়, যেতে যেতে পাশের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে অধ্যাপক মহাশয় অনুপস্থিত। হয়ত বেড়াতে গেছেন বা স্নানটানে। হরি আসে তৈরী হয়ে সাথে সাথে বাঁটুও চা নিয়ে। চা খেতে খেতে বিজয় বাঁটুকে বলে, জলখাবার তৈরী হলেই যেন নিয়ে আসে, হরি একটু বেরোবে। বাঁটু ঘরটর একটু ঝাড়ামোছা করতে থাকে। বিজয় ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
    -"বাঁটু, অধ্যাপক মশায় চা টা খেয়েছেন?"
    বাঁটু ঝাড়া থামিয়ে একটু হতবাক,
    -"কে বাবু?"
    -"পাশের ঘরে যিনি আছেন, তার কথা বলছি। তিনি গেলেন কোথায় জান?"
    -"ও বন্ধুবাবু? তার বাবু খুব সকালে ওঠা অব্যেস। চা টা খেয়ে চানটান সেরে তিনি গাঁয়ের দিকে হাঁটতে যান। এই ফিরলেন বলে, জলখাওয়ার সময় হয়ে এল তো।"
    -"তা তিনি জঙ্গলে পুরনো ভিটেতে কখন যান?"
    বাঁটু আবার একটু ঘাবড়াল প্রশ্ন শুনে। তাকে আশ্বস্ত করতে বিজয় বলল,
    -"কাল রাতে উনি বলছিলেন যে উনি জঙ্গলে পুরনো ভিটেতে যান লেখালেখির কাজে, তাই শুধোচ্ছি।"
    এবার বাঁটু সহজ হল,
    -"ও সেই লেখালেখির কাজ? সে বাবু রোজ তো যাননা, কখনোসখনো। হয় জল খেয়ে যান নাহলে এক্কেরে দুকুরের খাওয়া সেরে যান। তবে সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসেন, জঙ্গল, সাপখোপের রাজত্বি।"
    -"তা একাই যান না আর কেউ থাকে সঙ্গে?"
    -"একাই যান বাবু, এক আধবার বাবুও গেছেন দেখিছি। ওখেনটা যখন পোস্কার করা হচ্ছিল পেরথম দিকে তখন সরকারবাবু আমাদেরও পাঠাতেন। এখন আর দরকার লাগেনি।"

    বিজয় আর কথা বাড়াল না। স্নানটান সেরে বসে আছে, সরকার মশায় এল। হরির যাওয়ার ব্যবথা হয়েছে। গরুর গাড়ী যাচ্ছে কিছু জিনিস আনতে, হরি তাতেই যাবে, কালকের গাড়োয়ানই নিয়ে যাবে। জলখাবার এলে ওরা খেয়ে নিল, হরি বেরিয়ে গেল আর বিজয় সরকারের সঙ্গে চলল বাড়ির দিকে বাকী সদস্যদের সঙ্গে মোলাকাত করতে।
    কালকের বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসালেন ওকে। রোদের আলোয় ঘরটাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। আজকে মহেন্দ্রবাবু ছিলেননা। বিজয়কে বসিয়ে ভূপতিবাবু খবর দিতে গেলেন। বিজয় বসে বসে বাইরের দিকে তাকাল। জানালা দিয়ে মন্দিরের একপাশটা দেখা যাচ্ছে। এক ভদ্রমহিলা সিল্কের থান পরে সাজিতে ফুল নিয়ে মন্দিরের দিকে গেলেন। ইনিই বোধহয় ভারতীদেবী। পায়ের আওয়াজ শুনে দরজার দিকে দেখল, একটি তরুন প্রবেশ করল। কালকে সন্ধ্যেয় যে ছেলেটিকে দেখেছিল সে নয়। এ বিজয়েরই বয়সী হবে, ধুতি আর রঙীন সার্ট পরনে। রোগাটে গড়ন, চোখে চশমা। স্নানটান করে তৈরী। সরকার পিছন পিছন এসে বলল,
    -"এই হল গিরীশ, গিন্নীমার ভাইপো। ওর ইস্কুলে যেতে হবে তাই ওর জিজ্ঞাসাবাদটা আগে সেরে নিন।"
    বিজয়ের ইঙ্গিতে ছেলেটি সামনে এসে চেয়ারে বসল। সরকার বেরিয়ে গেলেন ওদের একলা রেখে। বিজয় দেখল গিরীশ বেশ স্বচ্ছন্দ, জড়তা নেই একটুকুও। হয়ত ওর পুলিশী পরিচয় জানেনা তাই। বিজয় শুরু করল,

    -"আপনি তো সদরের স্কুলে পড়ান। কতদিন হল একাজ করছেন এবাড়ীতে থেকে?"
    -"আজ্ঞে, বেশীদিন নয় বছরখানেক হল।"
    -"তার আগে কোথায় ছিলেন? আপনার বাড়ী কোথায়? পড়াশুনা কোত্থেকে করেছেন?"
    -"আমাদের বাড়ী হাওড়া শহরে। হাওড়া কলেজে পড়তাম। আই এ পাশ করে বসেছিলাম, পিসেমশাই এই স্কুলের চাকরির খবরটা দিলেন। ওনার চেনাজানা ছিল। সদরেই থাকব ভেবেছিলাম, পিসী পিসে শুনল না। তাই এখানে থাকা। রোজ সাইকেলে যাই স্কুলে।"
    -"তা শহরের ছেলে আপনি। গাঁয়ে ভাল লাগে?"
    -"আগে লাগতনা, এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। আর বেটাছেলে, চাকরি করতে দুরে তো যেতেই হয়, সবসময় তো আর ঘরের কাছে চাকরী পাওয়া যায়না।"
    -"আচ্ছা এই একবছরের কথা ছেড়ে দিলে, আগে আপনার আসা যাওয়া ছিল নিশ্চয়ই পিসীর বাড়ি?"
    -"ছোটোবেলায় এসেছি গরমের ছুটিটুটিতে। পরে বড় হয়ে খুব বেশী আসা হয়নি। বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা সব আলাদা হয়ে যাই, জেঠা কাকারা। আমি মায়ের এক ছেলে। মাকে ছেড়ে কোথাও যেতাম না।"
    -"তা এখন যে মাকে ছেড়ে আছেন?"
    -" আসলে বাবা অসুস্থ ছিলেন। পারিবারিক সম্পত্তি আর ব্যবসার ভাগ সংসার চালাতেই বিক্রি হয়ে যায়, দেখার কেউ ছিলনা, আমি ছোট ছিলাম। বড় হয়ে পড়াশুনার পাট চুকিয়েই তাই আমায় রোজগারের জন্য বেরুতে হয়। কাছাকাছি অনেক চাকরির চেষ্টা করেছিলাম, সুবিধে হয়নি। তবে মা এখন অনেক সামলে নিয়েছেন। আমি মাসে দু একবার করে বাড়ি যাই।"
    -"আচ্ছা আপনার বিষয় কি? কি পড়ান আপনি ছেলেদের?"
    -"আমি প্রাইমারীর শিক্ষক, এক একটা ক্লাসে সবই পড়াতে হয়। আমার আর্টস ছিল কলেজে।"
    -"আমি চুরি নিয়ে তদন্তে এসেছি তা শুনেছেন বোধহয়। এ ব্যাপারে আপনি যা জানেন বলুন। মানে আপনি কখন জানলেন, কি মনে হল। কোনো কিছু আপনার নজরে পড়েছিল যা এর সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও হতে পারে ইত্যাদি।"
    গিরীশ এতক্ষণ সহজ ভাবে জবাব দিচ্ছিল, এবার একটু নড়েচড়ে বসল। একটু সময় নিয়ে আস্তে আস্তে ভেবে বলতে থাকল,
    -"সেদিন রাতে খাওয়াদাওয়া হয়ে প্রায় নটা নাগাদ আমি আমার ঘরে চলে যাই। একটু পরে হারাধন আসে আমার কাছে। এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে থাকে। ওরা একটা ক্লাব খুলতে চায় গ্রামে। আমি শহরে ক্লাব দেখেছি কিনা, সেখানে কি কি হয় এইসব জিজ্ঞেস করে। দশটা নাগাদ আমার ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতে থাকে, হারাধন বসে থাকতেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ও বোধহয় তখন চলে যায়। ভোরের দিকে মশার কামড়ে ঘুম ভেঙে যায়, মশারি টাঙানো হয়নি রাতে। আর ঘুমোই নি। একটু পরে মুখ হাত ধুয়ে এসে এমনিই শুয়ে থাকি। হঠাৎ চিৎকার শুনি, কারা যেন তিনতলার দরজা ধাক্কাচ্ছে, আর পিসেকে ডাকছে জোরে জোরে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়ে দেখি সরকারমশায় ও আরও দু চারজন। জিজ্ঞেস করে জানলুম এই কান্ড। নীচে এসে দেখি লোক জমে গেছে।"
    -"আচ্ছা আপনিতো খুব ভোরে উঠে গেছিলেন। আগে কোনো কিছু শোনেননি? মন্দিরের দিক থেকে পুরুত মশায়ের চেঁচামেচি? "
    -"না। আমার ঘরের জানালাটা পিছনের দিকে। মন্দির তো সামনের দিকে। ওদিকে চেঁচালে আমি শুনতে পাবার সম্ভাবনা কম।"
    -"আপনি বললেন তিনতলার সিঁড়ির দরজায় লোকে ধাক্কা দিচ্ছিল। তারমানে দোতলার সিঁড়ির দরজা খোলা ছিল? দোতলার অন্য লোকেরা কি আগেই উঠে নীচে পৌঁছেছিলেন?"
    -"সেটা তো আমি ঠিক খেয়াল করিনি। আসলে পিসে জানেনা দোতলার দরজা অনেক সময় বন্ধ হতনা। হারাধন দেরী করে ফিরত। আমি তাই বন্ধ করতে যেতাম না। হারাধনের মা ভারতীপিসীও তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে পড়তেন। দরজা কোনোদিন বন্ধ হত, বেশীরভাগই হতনা।"
    -"তারমানে সেদিন দোতলার দরজা খোলা থাকলেও, তিনতলার সিঁড়ির দরজা বন্ধ ছিল, তাই তো?"
    -"হ্যা,ঁ সবার ডাকাডাকিতে রঘুদা দরজা খুলে দিল।"
    -"আচ্ছা, আপনার পিসের ঘর থেকে মন্দিরের চাবি চুরি হয়। আপনি বলছেন তিনতলার দরজা ভোরে ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। আগের দিন রাত্রে বামুন নিজে হাতে মহেন্দ্রবাবুর হাতে চাবি দ্যায়। তিনতলায় ওঠবার অন্য কোন রাস্তা আছে?"
    গিরীশ একটু ভেবে নিয়ে ঘাড় নাড়ল।
    -"না নেই। মেরামতি, পরিস্কার করতে মজুররা বাঁশের সিঁড়ি বেঁধে তাই দিয়ে ওঠে। "
    এবার বিজয় একটু অন্য প্রশ্নর দিকে যায় যা সে ভেবে রেখেছে সকলকেই করবে। সে দেখতে চায় চাবি বা গুপ্তধন প্রসঙ্গে কেউ কিছু জানে নাকি!
    -"গিরীশবাবু, শিবতোষবাবু এখানে থেকে আপনার পিসের পরিবারের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করছেন। এসম্বন্ধে বাড়ির সকলের বা আপনার কি মনোভাব? পুরনো ভিটে দেখেছেন কোনোদিন?"
    -"আমি শুনেছি উনি পরিবারের ইতিহাস লিখছেন, পিসী বলেছে। সত্যি বলতে কি এ নিয়ে আমি খুব একটা ভাবিনি। এবাড়িতে অতিথি অভ্যাগত লেগেই আছে। আজ শিবতোষবাবু কাল অন্য কেউ, কোন না কোন ভাবে অতিথিশালা সব সময়ই ভর্তি। আর কেউ কি ভাবে তাও জানিনা, কথা ওঠেনি। তবে স্যর পিসের পুরনো বন্ধু, শুনেছি অনেককাল থেকেই এবাড়ীতে যাতায়াত। আর জঙ্গলের দিকে আমি এক আধবার বেড়াতে গেছি, পুরনো ভিটে দুর থেকে দেখেছি এই পর্যন্ত। আমি শহরে মানুষ, গাঁয়ের সাপখোপ পোকামাকড়ে আমার একটু ভয় আছে তাই বনেটনে ঘোরার অভ্যেস নেই।"
    -"আচ্ছা একটা হার চুরি গেছে ঠাকুরের, সেটা এ পরিবারে অনেকদিন ছিল, একরকমের পারিবারিক সৌভাগ্যের হার। এটা আপনার জানা ছিল।"
    -"না। আমি মন্দিরে নিয়ম করে তেমন যেতাম না। এই দুরে বাড়ি টাড়ি যাওয়ার আগে একবার গিয়ে মাথা ঠেকিয়ে নিতাম। আমি ঐ হার দেখেছি বলেই মনে পড়ছেনা, এ সম্বন্ধে কিছু শুনিওনি।"

    বিজয় গিরীশকে যেতে বলল।
  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১১:০১408350
  • সরকারমশায় দরজার পাশ দিয়ে মুখ বাড়ালেন,
    -"এবার কাকে পাঠাব স্যর?"
    বিজয় একটু ভেবে নিল। মহিলারা এখানে আসবেন কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। হারাধন আর রঘুর সঙ্গে কথা বলা জরুরী। তারপরে ভাবল জঙ্গলের দিকটা ঘুরে আসবে এই বেলা।
    -"গিন্নীমারা কি এখানে আসবেন সরকারমশায়?"
    -"গিন্নীমা তো পুজোর পর ওপরে উঠে গেলেন। দিদিমনি নিজের পাকঘরের দিকে গেলেন। তাকে জিজ্ঞেস করে জানাচ্ছি। ততক্ষণ কি হারাবাবু কে পাঠাব?"
    বিজয় সম্মতি জানাল। প্রায় সাথে সাথেই কালকের ছেলেটি এসে ঢুকল ঘরে। সুন্দর চেহারা, মুখটি শিশুর মত সরল। একটু ছটপটে, বসতে বললে বসলনা। শেষে বিজয় প্রায় ধমকেই বসাল।
    -"তুমি হারাধন, মহেন্দ্রবাবুর ভাগ্নে?"
    -"হ্যাঁ, আপনি গোয়েন্দা? কিছু বুঝলেন কে মন্দিরে চুরি করেছে?"
    -"না: এখনও বুঝিনি। তুমি কি কর? কতদিন আছ এখানে, তোমার মামাবাড়ীতে?'
    -"মানে সেরকম কিছু করি না। তবে আমার গায়ে খুব জোর। আমি হিরনে এক ডুবে এপার ওপার করতে পারি, সবরকম সাঁতার জানি। কুস্তি করতে গাছ বাইতেও আমার মত কেউ পারেনা এ গাঁয়ে। আমরা একটা ক্লাব খুলব, সেখানে গাঁয়ের ছেলেরা শরীর চর্চা করবে, খেলাধূলা করবে। আমি একটু আধটু গানও জানি।"
    -"আর লেখাপড়া?"
    -"ইস্কুলে পড়তাম, ম্যাট্রিকে ফেল করে আর পড়িনি। মামা সেই নিয়েই সবসময় বলে আবার পরীক্ষা দিতে, কিন্তু ও আমার ভাল লাগেনা।"
    -"তুমি চুরির আগের রাতে কখন শুতে যাও? সকালে কখনই বা জানতে পার চুরির কথা?"
    -"ঘড়ি দেখিনি। আমি গিরীশদার কাছে বসেছিলাম। ক্লাবে আর কি কি করা যায় এইসব নিয়ে ওর সাথে আলোচনা করব ভেবেছিলাম। তা গিরীশদা কিছুক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে গেল। তখন আমিও ঘরে চলে গেলুম। সকালে আমি তাড়াতাড়ি উঠি, ভেজানো ছোলাগুড় খেয়ে ডনবৈঠক দি বাগানে। সেদিন উঠে নীচে নেমেই দেখি পুরুতদাদু আর মিশিরজী মালি সব চেঁচাচ্ছে। আমি ভাবলুম কারু কিছু হয়েছে, সাপেটাপে কেটেছে। দৌড়ে গেলাম মন্দিরের কাছে।"
    -"দোতলার সিঁড়ির দরজা কি তুমি খুলে ছিলে, না সে রাতে খোলাই ছিল?"
    এবার একটু ঘাড় চুলকে নেয় হারাধন,
    -"আজ্ঞে ঠিক মনে পড়ছেনা। মনে হয় খুলেই নেমেছিলাম। সেরাতে আমার মা শেষে উঠেছিল। মার আগেই আমরা ঘরে চলে এসেছিলাম। মাকে জিজ্ঞেস করলে ঠিকঠাক বলে দেবে।"
    -"সে আমি জেনে নেব। তা সিঁড়ি ছাড়া তিনতলায় ওঠার আর কোনো রাস্তা তো নেই। এদিকে মহেন্দ্রবাবুর ঘর থেকে চাবি নিয়ে কেউ মন্দিরের তালা খুলেছে। তোমার কি মনে হয়? চাবি কি করে নিল চোরে?"
    এবার হারাধন একটু উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
    -"কে বলেছে আপনাকে, সিঁড়ি দিয়ে ছাড়া আর ওঠা যায়না তিনতলায়? চোরেরা তো আর সাধারণ লোকের মত সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরজায় কড়া নেড়ে চুরি করতে আসেনা। জলের পাইপ আছে না?"
    বিজয় সে চিন্তা করেছে, তবু হারাধনের যুক্তি শোনার জন্যই বলল,
    -"পাইপ যেদিকে সেদিকে খাড়াই দেওয়াল, কোনো বারান্দা পড়েনা। পাইপ বেয়ে উঠে তিনতলায় বা দোতলায় নামবে কেমন করে ?"
    -"ছাতে নামবে। ছাতের কার্নিশ ধরে বারান্দায়। হ্যাঁ, সাধারণ লোকে পারবেনা কিন্তু চোরেদের কাছে এ তুশ্চু ব্যাপার। একটু অভ্যেস করলেই পারা যায়।"
    -"তুমি পার?"
    হারাধন প্রশ্নটার গুরুত্ব ঠিকমত উপলব্ধি করতে পারেনা, সরলভাবেই বলে ওঠে,
    -"করিনি কোনোদিন, তবে চেষ্টা করলে নির্ঘাত পারব। মা তো সেই ভয়েই ফিরতে অনেক রাত হলেও দোতলার দরজা খুলেই রাখে। নীচে ভিতর বাড়ীর দরজা খোলার জন্যে হারুকে বলে রাখে।"
    -"ফিরতে দেরী কর কেন? মামা জানেনা?"
    -"না:, মামা জানলে বাড়ী থেকে দুর করে দেবে। আমার এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে ভাল লাগেনা। তাস টাসের আড্ডা বসে ছিরুর দোকানঘরে, সেখানেই দেরী হয়ে যায়। আমি গাঁয়ের সবার সাথে মিশি, আমার মামা জমিদার, আমি তো আর নই।"
    -"তোমাদের পুরনো ভিটেতে গুপ্তধন আছে, এ ব্যাপারে কিছু শুনেছ কোনোদিন?"
    -শুনেছি ছোটোবেলায়, তবে মা বলে ওসব বাজে কথা। থাকলে বেশ হত না? আমাদের ভাগ দিয়ে আমি ক্লাবটা বড় করতাম, বিলিতী খেলাধুলার জিনিস আনাতাম কলকাতা থেকে।"
    -"কেন তোমার মামা দিচ্ছেন না ক্লাবের খরচ?"
    -"না, মামা ক্লাবের নাম শুনলেই খেপে যায়, তবে মাকে রাজী করিয়ে নেব।"
    -"ঠিক আছে তুমি যাও, পরের জনকে পাঠিয়ে দিতে বল সরকারমশায়কে।"

  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১১:০৬408351
  • বিজয়কে অবাক করে দিয়ে ঘরে ঢোকেন হারাধনের মা। একটু আগে যে বেশে দেখেছে বিজয় সেই বেশেই আছেন। শুধু হাতে সাজি নেই। পাকা গমের মত গাত্রবর্ণ। চুল ছোটো করে ছাঁটা, নাহলে এখনো বেশ সুরুপা। মাথায় হালকা ঘোমটা, হয়ত উনি এবাড়ীর মেয়ে বলে অত পর্দা মানেন না। উনি আসতেই বিজয় উঠে দাঁড়াল। বিজয়কে বসতে বলে উনি একদিকে একটি গদিহীন কাঠের চেয়ারে বসে সোজা তাকালেন ওর দিকে।
    বিজয় এদিক ওদিক না গিয়ে সোজা বিষয়ে এল,
    -"আপনি হয়ত শুনেছেন আমি মন্দির চুরির তদন্ত করতে এসেছি। আপনি তো এবাড়ীর মেয়ে, এর আগে কোনোদিন এবাড়ীতে বা মন্দিরে এরকম কোনো চুরির ঘটনা ঘটেছে কি?"
    উনি একটু ভাবলেন,
    -"সেরকম কিছু আমার মনে পড়ছেনা। আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় পঁচিশ ছাব্বিশ বছর হল। তার আগে আঠের বছর এবাড়ীতে থেকেছি। স্বামী মারা যাবার পর গত আট বছর আছি। ছোটোখাটো ছিঁচকে চুরি হয়েছে, পুকুরঘাট, বাগান থেকে। বাড়ির ভেতর বা মন্দিরে চুরি দেখিনি বা শুনিনি কোনোদিন। এবাড়ীতে চোর ঢুকতে ভয় পায়। চিরকালই দারোয়ান, বন্দুক ছিল, লোকে জানে।"
    -"চুরি নিয়ে মোটামুটি সব কথা আমি শুনেছি। আপনি সেদিন বা তার আগে এমন কিছু বা কাউকে দেখেছেন বা শুনেছেন যা আপনার অন্যরকম লেগেছে? হয়ত চুরির সঙ্গে সম্পর্কিত নয় তবু কিছু? আপনি মন্দিরে নিয়মিত সকাল বিকেল যান, তাই আপনাকে শুধোচ্ছি।"
    -"ঠিক সেরকম কিছু তো মনে হচ্ছেনা। আমি সকালে ফুল তুলে দিই, তারপরে পুজো হয়ে গেলে ঘরে গিয়ে জল খাই। সন্ধ্যেয় আরতি হয়ে গেলে এসে কখনো দাদা একা থাকলে বৈঠকখানায় দাদার কাছে বসি, বিষয় আশয়ের কথাটথা হয়। তারপর রান্নাঘরের বন্দোবস্ত দেখি, বৌদি বাতের রুগী, খুব বেশী চলাফেরা করতে পারেনা। সব হয়ে গেলে দোতলায় নিজের ঘরে গিয়ে কাপড়চোপড় ছেড়ে রামায়ণ পড়ি। দুলুর মা বা নিত্য রাতের খাবার নিয়ে এলে উঠে খেয়ে নিই। তারপড়ে শুয়ে পড়ি।"
    -"বাড়ীর ছেলেদের খাবার ব্যবস্থা কি নীচে?"
    -"সাধারনত: রাতের খাওয়া ঝি চাকররা সবার ঘরেই দিয়ে যায়। পুজো পাব্বনে লোকজন বেশী হলে রান্নাঘরের লাগোয়া খাবার দালান আছে। সেখানে পিঁড়ে আছে, আবার বিলিতী টেবিল চেয়ারও আছে। দুপুরের খাবার সবাই সেখানেই খায় আমি আর বৌদি বাদে।"
    -"তাহলে চুরির দিন বা তার আগের কোনো কিছু আপনার মনে হচ্ছেনা যা গুরুত্বপুর্ণ হতে পারে?"
    -"ঠিক তা না। তবে দুদিন আগে ঠাকুরের গলার মুক্তোর হারটা খুলে পড়ে যায় সকালে যখন চন্ডীকাকা ফুলের মালা পরাতে যাবে তখন। আমরা একটু অবাক হই। চন্ডীকাকা হাতে নিয়ে দেখে হুক টা আলগা হয়ে গেছে, অথচ এমনিতে খুব মজবুত। দেখে মনে হচ্ছিল কেউ কিছু দিয়ে চাড় দিয়েছে। এই হার আমাদের বংশের প্রাচীন হার, মঙ্গলের বলে মানা হয় তাই মনটা খুঁতখুঁত করছিল। চন্ডীকাকা ওটাকে ঠিক করে আবার পরিয়ে দিলেন। আমরা কাউকে কিছু বলিনি তবে মনটা খারাপ হয়ে গেছিল। ঠিক তার পরদিনই চুরি হয়ে গেল।"
    -"আচ্ছা বামুনমশাই বলছিলেন আপনাদের পরিবারের গুপ্তধনের কথা, এ নিয়ে কিছু জানেন।"
    উনি হাসলেন।
    -"কানাঘুষোয় শুনেছি পুরনো ভিটেয় গুপ্তধন আছে, কর্তারা জানতেন। তবে আর কিছু জানিনা। মা বলতেন গুপ্তধন আগে হয়ত ছিল তবে এখন ওসব কিছু নেই। আমারও তাই মনে হয়।"
    -"আপাতত আমার আর কিছু জানার নেই, তবে দরকার হলে পরে আপনার সঙ্গে কথা বলব। আর মহেন্দ্র বাবুর স্ত্রীর সঙ্গে কি কথা বলা যায়?"
    -"বৌদি ওপরে উঠে গেছে, হাঁটাহাঁটি বেশী করতে পারেনা। তুমি না হয় বিকেলে দেখা কোরো, আরতির সময় নামবে।"
    এই বলে উনি উঠলেন। বিজয়ের ওনাকে মোটামুটি ভাল আর ভদ্র বলেই মনে হল, ছেলেটিও সহজ সাদাসিধে। কিন্তু হারাধন ব্যায়াম করা শক্তসামর্থ ছেলে। ওর কথা অনুযায়ীই তিনতলার বারান্দায় উঠে চাবি চুরি করা কঠিন নয়। তবে কি কেউ হারাধনের সাহায্য নিয়েছে চাবি চুরি করতে?

  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১১:৩২408352
  • এরপর এল রঘু , এসে মেঝেতে বসে পড়ল। এখন আর সেই কালকের রাগভাব নেই মনে হল বরং একটু কৌতুহল আছে চোখেমুখে। বিজয় শুরু করল,
    -"তুমি তো এবাড়ীতে অনেকদিন আছ, এবাড়ীর লোকেদের ভাল করে চেন, এদের সব কথা জান। উঁচু পাঁচিল, গেটে দারোয়ান, তা সঙ্কেÄও এরকম চুরি কি করে হয়ে গেল মনে হয় তোমার?"
    -"কি বলব বাবু মন্দিরে তো দুরের কথা, এই বাড়ীতেই চোর ঢুকতে সাহস করেনি এতকাল। কি করে যে এমনটি হল কে জানে!"
    -"তোমার কি মনে বাড়ির কাজের লোক বা যারা বাইরে থেকে আসে টাসে তাদের কারো হাত আছে এই চুরিতে?"
    -"কি করে বলব বাবু? সক্কলেই তো পুরনো লোক, চাষী থেকে মজুর থেকে চাকর বাকর সব। গাঁয়ে দেশে সবাই সবাইকে চেনে। বাইরের লোক আর কে আসে? আসলেও কাজে নয় কুটুম টুটুম। গাঁয়ের লোক একাজ করবেনি। বিশেষ করে এবাড়ীর দেবতাকে লোকে খুব জাগ্রত মানে। তাইতো সবাই বলছে চেষ্টা করেও বিগ্রহকে নিয়ে যেতে পারেনি চোরে, ঠাকুর হয়ত ভয় দেখিয়েছে।"
    বিজয় মনে মনে ভাবল ঠাকুর তো ভয় দেখিয়ে চোরটিকেও ধরে দিলে পারতেন! মুখে বলল,
    -"কিন্তু চুরি তো হয়েছে, তাই কেউ নিশ্চয়ই চোর। মন্দিরের চাবি তোমার কর্তাবাবুর ঘর থেকে চুরি হয়। তুমি তো ঘরের বাইরে শুয়ে থাক, দরজা বন্ধ থাকে। আমি জেনেছি সিঁড়ির দরজাও বন্ধ ছিল। তাহলে চাবি কি করে নিল? আগের রাতে কর্তা বাবু চাবি জায়গায় রেখেছিলেন তুমি দেখেছিলে?"
    রঘু একটু মাথা নামিয়ে চিন্তা করে নিল।
    -"এইটেই তো মহা রহিস্যি বাবু। আজপয্যন্ত চাবি রাখতে কত্তার কখনো ভুল হয়নি। আমাকে পুলিশে সুধিয়েছিল, তাদেরও বলেছিনু। কত্তা নিজে হাতে ওপরে উঠে দেওয়ালে চাবি রেখেছিল। আমি খাবার নিয়ে পিছন পিছন উঠেছিলাম, আমার খেয়াল আছে।"
    -"তাহলে কেউ কর্তার ঘরে ঢুকেছিল চাবি নিতে?"
    -"তাই ই হবে, তবে সকালে দরজা বন্ধ ছিল। সরকার মশাইয়ের ডাকে আমি উঠে সিঁড়ির দরজা খুলে দিই, তারপরে বাবুর দরজায় ধাক্কা দিই আমরা। বাবু দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন।"
    -"বাবুর ঘরে তো পিছনের বারান্দার দিকেও একটা দরজা আছে। সেটা খোলা ছিল না বন্ধ ছিল মনে আছে?"
    -"মনে নেই, তবে সে টা খোলাই থাকে। ঐ খাড়াই তিনতলা বেয়ে কে আর বারান্দা দিয়ে ঢুকবে? ও দরজা শুধু শীতের দিনে বন্ধ হয়, নাহলে নদীর হিম হাওয়া আসে।"
    হঠাৎ বিজয়ের কি মনে হল জিজ্ঞেস করল,
    -"রঘু, তুমি রাতে আফিম টাফিম খাও নাকি? সকালে অত ডাকাডাকি করে তুলতে হয়েছিল যে?"
    রঘু একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল,
    -"তা একটু খাই বাবু। বাবু খান অল্প ঘুমের জন্য, কবরেজমশাই দিয়েছেন, তার থেকে একটু প্রসাদ পাই। বয়স হয়েছে এমনিতে ঘুম আসেনা।"
    -"ঠিক আছে তুমি এখন যাও। সরকারমশায়কে বোলো আমি বাইরে বাগানে আছি।"

  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১১:৪৪408353
  • বিজয় বাইরে বাগানে গেল। গরমের সময় হলেও বাগানের ধারে ধারে বড় বড় গাছ জায়গাটাকে ঠান্ডা করে রেখেছে। দিনের বেলায় দেখা যাচ্ছে এলাকাটা অনেক বড়। সামনে যতটা জায়গা, পিছন দিকে তারও বেশী। পিছনে একটা বড় পুকুর, টলটলে জল, মাঝে পদ্মফুল ফুটে আছে। মন্দিরের দিকে একটা ঘাট, আবার বাড়ির খিড়কী দুয়ার থেকে আরেকটা ঘাট, সেখানে মেয়েরা কাজ করছে। এক দিকে একটু ঘেরা, মেয়েদের স্নানের জন্যে। পুকুরের ওপারে বাড়ি থেকে একটু আলাদা গিয়ে অনেকটা পরিস্কার জমি, ওখানে ধানের সময় খামার হয়। সেইদিকে পাঁচিলের গায়ে একটা দরজা, শিকল তুলে তালা দেওয়া আছে। আর সেখানে পড়ে আছে একটা বড় বাঁশের মই। বিজয় ভাল করে দেখল মইটা, নতুন নয়, দু চারজায়গায় খুলে খুলে গেছে, বেশ লম্বা তবে।
    বিজয় এদিক ওদিক ঘুরে গেটে এল। মিশিরের খুপরি ঘর থেকে ধোঁয়া উঠছে, হয়ত খানা পাকাচ্ছে। বিজয় গিয়ে একটু গলা তুলে ডাকল। দু তিনবার ডাকতেই বিশালদেহী মিশির বেরিয়ে এল গামছায় হাত মুছতে মুছতে। চুল ছোট করে ছাঁটা, পরনে খাটো ধুতি আর হাতকাটা ফতুয়া। প্রথমটায় একটু অবাক হলেও পরে বোধহয় ওর মনে পড়ল বিজয়কে কাল দেখেছে। তখন হাতজড়ো করে নমস্কার করল।
    -"মিশির, আমি এই চুরির ব্যাপারে এসেছি, তোমায় দু চারটে কথা জিজ্ঞেস করতাম।"
    -"হায় বাবু, কি করে যে হয়ে গেল চোরি! আমার কোনো দোষ নেই বাবু, আমি সেদিন কেন যে নিদ গেলাম। নাহলে কোন সালা আমি থাকতে এ বাড়ীতে ঢোকার সাহস পায়, দেখে নিতাম না সেটাকে।"
    মিশির তড়পাতে লাগল। বিজয় ওকে শান্ত করে বলল,
    -"রাতেরবেলা গেটে কখন তালা পড়ে? আর পিছন দিকে যে দরজা দেখলাম সেটা কি বন্ধই থাকে?"
    -"বাবু আমি রাতভর জাগিয়েই থাকি, তবু খাওয়াদাওয়ার পরে কাজের লোকেরা চলে গেলে তালা বন্ধ করে দিই। রোজ অলগ অলগ টাইমে, দশটা সাড়ে দশটা। পিছনের দরোজাটা তো যখন খামার হয়, মুনিষ মজুর লাগে শুধু তখোন খোলা হয়। তবে তখোনও সনঝেবেলায় আমি তালা লাগিয়ে দিই।"
    -"তাহলে এমনিতে সবাই এই গেট দিয়েই যাতায়াত করে। তোমার চোখ এড়িয়ে কেউ যেতে পারেনা।"
    -"হ্যাঁ বাবু। দিনের বেলায় আমি নিদ যাই, চানটানে যাই যখোন, তখোন ছাড়া সাঁঝের বেলা থেকে আমি একদম পাহারায় থাকি বাবু।"
    -"তা সেদিন তুমি যে ঘুমিয়ে পড়েছিলে, তোমার কি শরীর খারাপটারাপ ছিল? নাকি দিনে ঘুম হয়নি?"
    -"কি বলবো বাবু! আমি দিনে তো ঘুমিয়েছিলাম, সরীরও আমার কখনো খরাব হয়না। সেদিন তবে গরম ছিল বলে আমি একটু ঠান্ডাই বানিয়েছিলাম, সন্ধ্যেবেলায় তাই পিয়েছিলাম বাবু। তো সেতো আমি গরমকালে প্রায়ই খাই, ঘুম তো হয়না। পুলিশ খুব গালি দিল বাবু বলল নেশা করে পাহারা দিবি কি করে! কিন্তু বাবু বিশোয়াস করেন ওটুকু ভাঙে আমার নশা হয়না।"
    -"তা তুমি ঠান্ডাই একাই খাও না সঙ্গীসাথী থাকে?"
    -"সে বাবু কখোনো সখনো কেউ নিয়েও যায়, কামের লোকেরা, হারু বাঁটু রঘু এরা সব।"
    -"সেইদিন কেউ এসেছিল তোমার প্রসাদ খেতে?"
    শুনে মিশিরের জিভ বেরিয়ে গেল।
    -"রাম রাম বাবু, কি যে বলেন। পরসাদ হবে কেন, আমি কি ভগবান আছি? সেদিন বাবু বাঁটুও নিয়েছিল, হারুও।"

    বিজয় আর কিছু বললনা। কত্তা, চাকর আফিম খায়, দারোয়ান ভাঙ খায়, এ বাড়ীতে আগে কোনোদিন কেন চুরি হয়নি ভগবানই জানে!!

  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১১:৫৭408354
  • বেলা হয়ে আসছিল। বিজয় ঘরের দিকে গেল। খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। বাঁটু এসে তেল গামছা দিয়ে গেল। বিজয় স্নান করে এল। হরি এখনও ফিরলনা। ভেবেছিল খাওয়া দাওয়া সেরে পুরনো ভিটের দিকে যাবে হরিকে নিয়ে। খাওয়ার পরে একটু শুয়েছে এমন সময় হরি এসে ঢুকল।
    -"কিরে দেখা হল নীলমনি বাবুর সঙ্গে? এত দেরী হল যে, সদর তো এখান থেকে বেশী দুর নয় গাড়িতে?"
    -"হ্যাঁ বাবু। আমার কাজ তো তক্ষুনি হয়ে গেছল। ঐ গাড়িতে কি সব আনার ছিল এদের দোকান থেকে, তাই সময় লাগল।"
    -"দে চিঠি দে। আর তুই গিয়ে খেয়ে নে, একটু জঙ্গলে পুরনো ভিটের দিকে যাব।"
    -"চিঠি তো দেন নি উনি।"
    বিজয় একটু অবাক হল,
    -"উত্তর দেননি?"
    হরি এবার বিজয়ের কাছে এসে গলা নামিয়ে বলল,
    -"বাবু উনি বলেছেন আজ বৈকালে গাঁয়ে ছিরুর দোকানের পিছনের গুমটিতে অপেক্ষা করবেন। আপনাকে সেখানে দেখা করতে বলেছেন।"
    -"ও: তাই বল। এতো খুব ভাল কথা, একেবারে সামনাসামনি কথা হবে।"

    বাঁটুকে বলাই ছিল হরির খাবার রাখতে। হরি বাড়ির ভেতরে গিয়ে খেয়ে এল। এরপরে দুজনে বেরোল জঙ্গলের দিকে। চৌধুরী বাড়ি থেকে পুবদিক ধরে কিছুটা গেলেই জঙ্গলের শুরু। বিজয় সরকার মশায়ের কাছ থেকে মোটামুটি আদি ভিটের দিক টা জেনে নিয়েছিল। সেদিক ধরেই চলতে আরম্ভ করল। একটা পায়ে চলার পথ তাদের চলাটাকে সহজ করে দিল। ঐ রাস্তার আশেপাশে ঝোপঝাড়ের গভীরতা অনেক কম। প্রায় মিনিট পাঁচেক চলার পর ওরা এসে পৌঁছল চৌধুরীদের পুরনো ভিটের এলাকায়। চারিদিকের বেড়া দেখেই বোঝা যায়। একদিকে মাটি জড় করে করে ঢিবি হয়ে গেছে। জমি থেকে একটু নীচে কিছুটা এলাকা জুড়ে মাটি সরিয়ে ভাঙা বাড়ীর অংশ দেখা যাচ্ছে। মাটির খাঁজকাটা সিঁড়ি বেয়ে বিজয়রা নামল। এক একটা জায়গায় ইঁটের স্তুপ। মাঝে মাঝে থামের,পাঁচিলের ভগ্নাবশেষ উঁকি মারছে। একটা জায়গায় কয়েকটা উনুন মত দেখা গেল। হরি একটা লাঠি নিয়ে ঠকঠক শব্দ করছিল। বিজয় তাকাতেই বলল,
    -"বাঁটু বলছিল এখানে সাপের রাজত্ব। কার্বলিক অ্যাসিড দিলেও ফিরে ফিরে আসে।"

    বিজয় চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকল। হঠাৎ হরির ডাকে তাকিয়ে দেখে হরি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে মাটির থেকে একটা ধাতব বস্তু দেখা যাচ্ছে। একটু মাটি খুঁড়তেই একটা ধুপদানী বেরোল রুপোর। বিজয়ের কথায় হরি একটা সরু ডাল নিয়ে আশপাশের মাটি সরিয়ে সরিয়ে খুঁজতে থাকল আর কিছু পাওয়া যায় কিনা।
    বিকেল হয়ে এলে, আর কিছু পাওয়া গেলনা। বিজয়রা ফেরার রাস্তা ধরল। গাঁয়ে গিয়ে নীলমনির সঙ্গে দেখা করতে হবে।

    অতিথিশালায় ফিরে দেখল শিবতোষ বারান্দায় পায়চারি করছেন। বিজয়কে দেখে হাসলেন,
    -"কি, তদন্ত চলছে জোর মনে হচ্ছে? দুপুরে বিশ্রামও করেননি।"
    বিজয়ও হেসে বলে,
    -"হ্যাঁ, এই এদের পুরনো ভিটেটা দেখে এলাম জঙ্গলে গিয়ে। আপনার কাজের জায়গা"।
    ঝনঝন করে আওয়াজ হল, বাঁটু এদের জলখাবার ঘরে রেখে জল আনতে গেছিল। তার হাত থেকে জলের ঘটিটা পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি অপ্রস্তুত হয়ে একপাশে রাখা একটা কাপড় নিয়ে এসে মুছতে থাকল। শিবতোষবাবু সেদিকে তাকিয়ে একটু অসন্তোষ দেখালেন,
    -"এতগুলো লোক পুষে রেখেছে মহেন, সব একেবারে কাজের ধুচুনি।"
    বিজয় হাত মুখ ধুয়ে এসে জলখাবার খেয়ে নিল। বাঁটু ঢুকল চা নিয়ে। বিজয় ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
    -"সেদিন রাতে তুমি মিশিরের কাছ থেকে ঠান্ডাই এনেছিলে?"
    -"কোনদিন?"
    -"চুরির রাতে"।
    -"হবে বাবু, খেয়াল নেই। ঠান্ডাই মিশিরজী বানালেই আমরা নিয়ে আসি। খুব ভাল বানায়।"
    -"গেটের চাবি কার কাছে থাকে?"
    -"মিশিরজীর কোমরে গোঁজা থাকে বাবু।"
  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১২:১১408355
  • বিজয় বেরোল, গেট পেরিয়ে গাঁয়ের দিকে। রাস্তায় দেখল সরকারমশায় আসছে। তাকে জিজ্ঞেস করে বিজয় সোজা ছিরুর দোকানের পথ ধরল। দোকান বলতে একটা ছোট কঞ্চি আর মাটি দিয়ে ঘর আর সামনে চালা নামানো। সেখানে বাঁশের বেঞ্চি বানানো আছে, দু তিনজন বসে আছে। একপাশে চায়ের দোকান আর একপাশে মুদীখানা। আর একদিকে মেঝেতে চাটাই পাতা। মনে হয় তাসের আসর বসে। একজন লোক খালি গায় লুঙ্গি পরে এক বাক্স তাস নিয়ে ভাঁজছে। বিজয় নীলমনির কথা মত ঘুরে পিছনের দরজা দিয়ে দোকানঘরে ঢুকল। কেউ ওকে লক্ষ্য করলনা। ঘরে মুদীর জিনিসে ভর্তি, একটা সরু মত চৌকিতে মাদুর পাতা। ঘরে কেউ ছিলনা, বিজয় চৌকিটায় বসল। বাইরে এক আধজন করে খদ্দের আসছে, চায়ের ফরমাশ করছে। মিনিট দশেক বসার পর একজন ঢুকল। বছর তিরিশ বয়স হবে, পেটা চেহারা তবে বেঁটে। শ্যামলা মুখে একটি পুরুষ্টু কালো গোঁফ, পরনে ধুতি আর বুশসার্ট। হাসি হাসি মুখ করে বিজয়কে বলল,
    -"অনেকখন বসিয়ে রেখেছি আপনাকে, অপরাধ নেবেন না। তারিণীদার কাছে আগেও শুনেছি আপনার কথা। আমি নীলমনি।"
    বিজয়ের দেখেই পছন্দ হয়ে গেল এই সহাস্য যুবকটিকে। দুএকটা কথা দেওয়ানেওয়ার পরেই মনে হচ্ছিল দুজনে অনেককালের চেনা। নীলমনিদা আর তুমিতে এসে গেল দুজনেই। নীলমনির লোক ছিল বাইরে সাদা পোশাকে। সে দু কাপ চা দিয়ে গেল। বিজয় প্রথমে নীলমনিকে সে কিভাবে এই কেসে এল সেটা সংক্ষেপে বলল।
    নীলমনি সব শুনে হাসতে লাগল। তাই দেখে বিজয় একটু অবাক হয়ে কারন জানতে চাইল। উত্তর শুনে তো তার আক্কেল গুড়ুম!
    সদরের পুলিশ সবে তদন্ত শুরু করেছিল, কিন্তু তারা এমন সব কথা জেনে যাচ্ছিল যে মহেন্দ্রবাবু তাদের ওপর রেগে গিয়ে যাতা নালিশ করে এল পুলিশসাহেবকে। তাতে উৎসাহ হারিয়ে তারাও তদন্তে ঢিল দিয়ে দিল।
    -"কি এমন জেনেছিল পুলিশ যা মহেন্দ্রবাবুর পক্ষে আপত্তিজনক নীলমনিদা?"
    -"তুমি একবার সদরে গিয়ে ওদের ব্যবসার ম্যানেজার মহিমবাবুর সঙ্গে কথা বল। ব্যবসাপাতি ভাল চলছিলনা বাবুর। ফাটকার নেশা আগেও ছিল, ইদানীং বেশী হয়ে গিয়েছিল। প্রচুর লোকসান, ধারদেনা হয়ে গেছে এই চক্করে।"
    -"সেকী কথা?"
    -"হ্যাঁ। যদিও তার সাথে এ চুরির কোনো সম্পর্ক নেই, তবুও পুলিশ তদন্ত করলে তো সব দিকই দেখে। মহিমবাবু ছাড়া এখনো এ ব্যাপারে মনে হয় বাড়ির কেউ জানে টানেনা। জানাজানির ভয়ে উনি সদরের থানার থেকে কেস সরিয়ে তোমাদের দিয়েছেন।"
    -"আর এই চুরির ব্যাপারে আপনারা কতটা কি জানেন?"
    -"কোথা থেকে জানব বল? চাকরটা কে নিয়ে গেল দারোগাবাবু জিজ্ঞেসবাদের জন্য, তা সঙ্গে সঙ্গে বাবু গিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে এল। চাবি বাড়িরই কেউ চুরি করেছে। এছাড়া তোমায় আর একটা খবর দিই। দুদিন আগে অবধি খবর চোরাই মাল এখনো বাজারে আসেনি। আমাদের লোক আছে, বাজারে মাল বিক্রির জন্যে এলে আমরা খবর পাব। চৌধুরীবাড়ি আমরা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি সেদিনই, কিন্তু কিচ্ছু পাইনি। মাল যেন উবে গেল।"
    বিজয়ের পকেটে ধূপদানী। একবার ভাবল নীলমনিকে বলবে, তারপরে ঠিক করল এক্ষুনি নয়। কিছুক্ষন পরে দুজনে উঠে পড়ল। ঠিক হল বিজয় পরদিন সদরে যাবে, থানার বাইরে নীলমনি থাকবে, ওকে নিয়ে গিয়ে মহিমবাবুর আস্তানা দেখিয়ে দেবে।
  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১২:১৬408356
  • বিজয় অতিথিনিবাসে ফিরল যখন বাইরে অন্ধকার নেমে গেছে। মন্দিরে আরতির জোগাড় চলছে, শিবতোষবাবুর দরজা বন্ধ। ঘরে আলো ছিলনা। হরিও কোথায় গেছে। একটু পরে বাঁটু ঢুকল হ্যারিকেন হাতে। আলো রেখে দিয়েই চলে গেলনা। কাঁধের গামছাটা দিয়ে এটা ওটা ঝাড়তে লাগল। বিজয় একটা বই খুলে আলোর কাছে পড়তে চেষ্টা করছিল। মুখ না তুলেই বলল,
    -"কি বাঁটু কিছু বলার আছে নাকি?"
    বাঁটু একটু চমকে গেল। তারপরে আমতা আমতা করে বলল,
    -"না তা নয় বাবু। বাবু, আপনের সঙ্গে পুলিশের চেনাজানা আছে?"
    বিজয় এবার বই বন্ধ করে ওর দিকে দেখল,
    -"না আমি পুলিশের লোক নই। তবে চিনি কাউকে কাউকে। কেন বলতো?"
    -"মানে, আপনি বাবু দুকুরে ঐ পুরনো ভিটের দিকে গেলেন তাই কইছিলাম। আমাকে ঠান্ডাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন।"
    বিজয় একটু আশ্চর্য হল। ঠিক সম্পর্কটা বুঝতে পারছিলনা।
    -"তা আমি পুলিশ না হলেও গোয়েন্দা তো। বাবু চুরির তদন্ত করতে দিয়েছেন আমাকে। আমাকে সব জানতে হবে।"
    -"আপনি সব জেনে কি পুলিশের কাছে যাবেন না বাবুরে কইবেন?"
    বিজয় এবার নিশ্চিত হল বাঁটু কিছু জানে যা নিয়ে ওর সংশয় আছে। ও ওকে সাহস যোগাতে বলল,
    -"আমি সব জেনে তোমাদের কত্তাবাবুকে বলব। তিনিই তো আমাকে ডেকেছেন। পরে তার মনে হলে চোরকে পুলিশে দেবেন বা কি করবেন সে তার ব্যাপার।"
    বাঁটু আর কিছু বললনা, চুপ করে রইল। বিজয় বলল,
    -"তুমি কি আমাকে কিছু বলবে, ভয় না পেলে বলে ফেল। তেমন দরকারী না হলে আমি বাবুকে বললেও তোমার নাম নেবনা।"
    বাঁটু কি বলতে যাবে এমন সময় দরজার দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। দরজায় শিবতোষবাবু। উনি ওদের কথা শুনে থাকলেও তার আভাস দিলেননা,
    খুব স্বাভাবিক স্বরে বললেন,
    -"বাঁটু, আমার ঘরে আলো দিসনি এখনো। যা আলো নিয়ে আয়। আমি ততক্ষণ এই বাবুর কাছে বসছি।"
    বাঁটু "হ্যাঁ বাবু, আনছি" বলে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ল। বিজয় চেয়ার থেকে উঠে ওনাকে বসতে দিয়ে নিজে চৌকিতে বসল।
    -"এখানে আলো ছাড়া ঘরে বাইরে কোথাও থাকবেন না বিজয়বাবু। গরমের দিনে বিষধর সাপ বেরোয়।"
    -"সাপে কাটলে এখানে চিকিৎসার কি ব্যবথা?"
    -"কি আবার ব্যবস্থা? ওঝার ঝাড়ফুঁক। শিক্ষিত লোকেরা সদরের হেলথ সেন্টারে নিয়ে যায়, ওষুধ আর আয়ু থাকলে বেঁচে যায় নাহলে মরে।"
    -"আপনি এত ঘুরে বেড়ান, জঙ্গলে যান ভয় করেনা?"
    -"এবাড়ীর লোকের জন্য মহেন সাপের বিষের ওষুধ রাখে, আমিও রাখি কিছু কিছু সাধারণ সাপের বিষের ওষুধ।"
    -"ও বাবা, এখানে কাজ তো আপনাকে বেশ ঝুঁকি নিয়ে করতে হয়!"
    -"আপনারা যুবক, অল্প বয়স, আপনারা একথা বলছেন? বাঁচতে গেলে তো ঝুঁকি প্রতি পদক্ষেপেই নিতে হয়।"
    বিজয় এবার অন্য প্রসঙ্গে গেল। একটু গল্পের মেজাজে জিজ্ঞেস করল,
    -"আপনার বাড়ি কোথায় শিবতোষবাবু?"
    -"এই জেলাতেই, তবে এখান থেকে দুরে, হাওড়া জেলার সীমানাতে পড়ে আমার গ্রাম।"
    -"আপনার মহেন্দ্রবাবুর সঙ্গে কতদিনের আলাপ?"
    উনি একটু তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন বিজয়ের দিকে,
    -"কি ব্যাপার বলুন তো গোয়েন্দাসাহেব, আমার ঠিকুজি জানতে চাইছেন কেন? শেষটায় কি মন্দিরে চুরির দায়ে আমাকে ধরবেন নাকি?"
    বিজয় একটু হাসল,
    -"কি যে বলেন? আমি এমনিই গল্প করছিলাম। গোয়েন্দা আর পুলিশদের এটাই সমস্যা, তাদের কেউই বিশ্বাস করেনা। মনে হয় তাদের ঘরের লোকেরাও তাদের সঙ্গে সহজভাবে কথা বলেনা।"
    বিজয়ের মুখভঙ্গী দেখে অধ্যাপক হা হা করে হেসে উঠলেন।
    -"তা যা বলেছেন, এই যে আমি অধ্যাপক, আমার ঘরের লোক নালিশ করত আমি নাকি সবসময়ই সবাইকে ছাত্র মনে করে জ্ঞান দি। যাক আপনার প্রশ্নে আসি, মহেন আর আমি একসাথে হাওড়া কলেজে পড়তাম। পরে আমি ওখানেই অধ্যাপনা করি।"
    বিজয় একটু চিন্তা করল, হাওড়া কলেজটা সে যেন আগে কোথায় শুনেছে! তারপরেই মনে পড়ে গেল,
    -"আরে, হাওড়াতেই তো মহেন্দ্রবাবুর শ্বশুরবাড়ী, গিরীশও তো ঐ কলেজেই পড়েছে?"
    -"হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। মহেনের শ্বশুর ওখানকার এক গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন, কলেজের ট্রাস্টি বোর্ডেও ছিলেন। কলেজেই মহেনকে দেখে পছন্দ করেন মেয়ের জন্যে। গিরীশও আমার ছাত্র ছিল, খুবই সাধারণ ছেলে। তবে ইদানীং দেখছি ইতিহাসে নতুন করে আগ্রহ দেখা দিয়েছে। মাঝে মাঝেই এসে এটা ওটা জেনে যায়।"
    বাঁটু এল আলো নিয়ে, আর কথা এগলো না । অধ্যাপক মশাই ঘরে গেলেন। তাহলে শিবতোষবাবু গিরীশের অধ্যাপক ছিলেন, এ কথা গিরীশ কিন্তু উল্লেখ করেনি। সে এখানে মাঝে মাঝেই আসে শিবতোষবাবুর সাথে ইতিহাস চর্চা করতে!

  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১২:৩৪408357
  • একটু পরে হরি এল,
    -"বাবু মিশিরের ঠান্ডাই খেয়ে এলাম। সত্যি জবর বানায়। রঘুও নিয়ে গেল।"
    খেতে দেরী আছে, বিজয় মহেন্দ্রবাবুর খোঁজে ভিতর বাড়ির দিকে গেল। উনি বৈঠকখানায় বসেছিলেন। সামনে খাতাপত্র নিয়ে ভূপতিবাবু ও আরেকজন কর্মচারী। বিজয়কে দেখে বেশ খোশমেজাজে বললেন,
    -"কি বিজয়বাবু, কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো? খুব ঘুরছ শুনলাম, তা কিছু পেলে?"
    -"সেরকম কিছু পাইনি এখনো। সকালে সবার সঙ্গে কথা হয়েছে গিন্নীমা ছাড়া। ওনার সাথে কি দেখা করা যায়?"
    মহেন্দ্রবাবু ভূপতির দিকে তাকালেন। ভূপতি বললেন,
    -"বাবু সকালে আজ গিন্নীমা পুজোর পরেই ওপরে উঠে যান। তারপর তো আর নামেননি। পুন্নিমে গেল এইসবে এখনও ব্যথায় কাতর আছেন।"
    -"ও তাই তো। আমার গিন্নীর সাথে কথা বলে তোমার লাভ কিছু হবেনা। উনি সংসারে কম নিজের বাতের ব্যথা নিয়ে ব্যস্ত বেশী থাকেন। তবু যদি কথা বলতে চাও তো ওপরে চলে যাও। ভূপতি তুমি বরং দেখ নিত্য ঝি কোথায়, ওর সাথে পাঠিয়ে দাও বিজয়বাবুকে।"
    ভূপতি উঠে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বিজয়কে ডেকে নিলে, সিঁড়ি ওঠবার মুখে কালো মোটা বর্ষীয়সি এক ঝি দাঁড়িয়ে ছিল বেজার মুখে। বিজয় কোনো কথা না বলে তার পেছন পেছন উঠতে থাকল। আগের দিনে কর্তার ঘরে এসেছিল তার পাশেই গিন্নীর ঘর। নিত্য ওকে বাইরে দাঁড়িয়ে রেখে ভেতরে গিয়ে গিন্নীকে বলতে গেল। একটু পরেই ভেতরে ডাকল। এই ঘর ও কর্তার অনুরুপ বড়। তবে আসবাবপত্র অনেক বেশী। একদিকে দুটি চেয়ার টেবিল দিয়ে বসার ব্যবস্থা। খাটে একজন মহিলা বসেছিলেন, মাতৃমূর্তি, চওড়াপেড়ে শাড়ী, হাতে গলায় গয়নায় ঝলমল, ফরসা ও মোটাসোটা। বললেন,
    -"ওমা, এইটুকুন ছেলে নাকি গোয়েন্দা? তা বাবা আমি তোমাকে তুমিই বলব, তুমি বোধহয় আমার ছেলের একবয়সীই হবে। তা বল কি জানতে চাও? আমি তো বাতে প্রায় পঙ্গুই। বেশী নামিটামি না। আমি কিছুই জানিনা এসব চুরিটুরির।"
    বিজয়ের বেশ স্বচ্ছন্দ মনে হল। ইনি অত্যন্ত সাধাসিধে মহিলা, জমিদার গিন্নী সুলভ কোনো ব্যক্তিত্ব নেই। এর তুলনায় ভারতী দেবী অনেক বেশী রাশভারী। সে বলল,
    -"বেশীক্ষণ আপনাকে বিরক্ত করব না মা। শুধু একটা জিজ্ঞাস্য ছিল। সেরাতে আপনার পাশে কর্তার ঘর থেকে চাবি চুরি করতে কেউ এসেছিল। আপনি কোনো শব্দটব্দ কিছু শুনেছিলেন, কোনোভাবে কিছু অস্বাভাবিক আওয়াজ? একটু মনে করে দেখবেন।"
    গিন্নী একটু ভেবে বললেন,
    -"না বাবা সেরকম কিছু শুনলে তো এই নিত্যকে ডাকতাম। আমার ঘুম এমনিতে পাতলা। তারপর এই সব্ব অঙ্গে ব্যথা লেগেই থাকে, ভাল ঘুম হয়না। আমি কিছুই শুনিনি।"
    -"সে রাতে আপনার ছেলে ছিল এখানে?"
    -"হ্যাঁ খোকা তো তখন এক হপ্তা বাড়ী ছিল। পরদিনই ফেরার কথা ছিল, এই চুরির জন্য রয়ে গেল আরও একদিন। সে তো খুব রেগে যাচ্ছিল ঐ খোট্টা দারোয়ানটার উপরে। বাবাকে বলছিল আরো একজন কমবয়সী ভালো দেখে দারোয়ান রাখতে, এটা ভাঙ খায়।"
    -"সেও কিছু দেখেনি বা শোনেনি?"
    -"না বাবা। সেতো সারাদিন পুলিশদের সাথে ছিল, সব দেখছিল শুনছিল। ওর বাপকে একবার জিজ্ঞেস কর।"
    বিজয় এবার নিত্যের দিকে তাকাল,
    -"তুমিও কিছু টের পাওনি, চোর পাশের ঘরে এল?" নিত্যর হয়ে গিন্নী উত্তর করল,
    -"ভালো লোককে জিজ্ঞেস করছ বাবা, নিত্য বিছানায় পড়লেই অঘোর ঘুম। আমি রাতে ডেকে ডেকে ওকে ওঠাতে পারিনা।"
    নিত্য একটু লজ্জা পেয়ে, "হ্যাঁ কি কথার ছিরি! কুনদিন ডেকে পাওনি শুনি?" গজগজ করতে লাগল।
    বিজয় গিন্নীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নীচে গেল।

  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১২:৩৮408358
  • ----------------------------------
    পরদিন সকালে জলখাবার খেয়ে বিজয় সদরে গেল। সরকারমশায়কে বলে গাড়ীর ব্যবস্থা করেছিল। তবে কাউকে বলেনি কোথায় যাচ্ছে। যাবার সময় দেখল সরকারমশায় ও যাচ্ছে। জমি নিয়ে একটা মামলার ব্যাপারে ওদের উকিল ডেকে পাঠিয়েছে। যেতে যেতে কথার কথায় ও সরকারকে জিজ্ঞেস করল,
    -"এদের উকিল কে সরকারমশায়?"
    -"মনোহর উকিল বাবু। ওনার বাপ ঠাকুদ্দাও এদের উকিল ছিল।"
    -"মামলাপত্তর খুব বেশী হয় নাকি?"
    -"না তেমন কিছু নয়, কখনো সখনো। বাবু মামলা মকদ্দমা বিশেষ পছন্দ করেনা। যা গন্ডগোল আপসেই মিটিয়ে নেন বেশীরভাগ।"
    -"তা বাবুও তো একই ছেলে, ভাই ভাইয়ে মামলার ও অবকাশ নেই তাই মামলা কম, কি বলেন।"
    একথা শুনে সরকারবাবু একটু হাসলেন। বিজয় এমনিই বলেছিল কথাটা, সরকারের মুখ দেখে মনে হল কিছু ব্যাপার আছে। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
    -"বাবু, দিদিঠাকরুন ভাইয়ের থেকে কম নয় কোনোদিক থেকেই। এবংশে অনেককাল থেকে দানপত্র লেখাপড়া করে মেয়েদেরও জমিজায়গার ভাগ দেওয়ার নিয়ম। তাই দিদিও জমিজমার অর্ধেক মালিক। শ্বশুরবাড়ীতে ওর যা ছিল, স্বামীর অসুখেই তা চলে যায়। দেওর ভাসুর শরিক অনেক। শ্বশুর বেঁচে থাকতেই ওর স্বামী মারা যান। সকলের ভড়কানিতে অপয়া বউকে উনি কিছু দেননি, এমনকি নাতিটাকেও নয়। তাই দিদির আর তার ছেলের এখন এদিককার সম্পত্তিই ভরসা। বাবুর বাবা নাতিদেরও আলাদা করে কিসব দিয়ে টিয়ে যান, উকিলবাবু জানেন।"
    বিজয় কি ভেবে বলে,
    -"সরকারবাবু আমি আপনার সঙ্গে গিয়ে একটু উকিলবাবুর সঙ্গে দুটো কথা বলে তারপরে নিজের কাজে যাব। ফেরার সময় আপনি চলে যাবেন, আমি কিছু একটা করে চলে আসব।"

    সেই কথামত বিজয় মনোহর উকিলের সঙ্গে দেখা সেরে নীলমনির কাছে যায়। মহিমের সঙ্গে দেখা করে জানতে পারে নীলমনির কথাই ঠিক। মহেন্দ্রবাবুর ব্যবসা ভালো চলছেনা। দুপুর হয়ে গেলে নীলমনির বাসায় চানখাওয়া সেরে নেয়। একটু জিরিয়ে নিয়ে নীলমনির যোগাড় করা সাইকেলে চেপে ও চাঁদপুরের দিকে রওয়ানা দেয়। সাইকেলটা ওর কাছেই রেখে দিতে বলে নীলমনি যদ্দিন ওরা থাকবে। গেটের কাছে পৌঁছে বিজয় একটু অবাক হল, গেটটা হাট করে খোলা। সাধারনত গেটে চাবি না থাকলেও টানা থাকে দিনের বেলায়। মিশিরও নেই। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল ইতস্তত ছড়িয়ে লোকের জটলা। বিজয় সাইকেলটা একটা গাছে ঠেকিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। হারাধনের চোখ পড়ল ওর দিকে। উত্তেজিত ভাবে এগিয়ে এসে বলে,
    -"যাক বাবা আপনিও এসে গেছেন। মামা চিন্তা করছিল, আপনি জঙ্গলে যাননি তো?"
    বিজয় বলল,
    -"না আমি তো এই ফিরছি সদর থেকে, আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে। কেন কি হয়েছে।"
    -"বাঁটুকে সাপে কেটেছে, জঙ্গলে পুরনো ভিটের কাছে। কখন কেউ দেখেনি, সকালে বেরিয়ে গিয়েছিল। চাকরদের খাওয়ার সময় খোঁজ পড়েছিল, সবাই ভেবেছে বাড়ি গেছে বোধায়। ঘন্টাখানেক আগে ওর ছেলে আসতে তখন সবার খেয়াল হয়। তাহলে বাড়ী যায়নি তো কোথায় গেছে। খোঁজ, খোঁজ । এই একটু আগে পাওয়া গেছে, মরে কাঠ হয়ে আছে।"
  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১২:৩৯408359
  • বিজয় হতভম্ব হয়ে গেল। তখনি মনে পড়ল বাঁটুর কি যেন বলার ছিল ওকে। ইস কাল রাত্রে ওকে ডেকে কেন জানতে চেষ্টা করেনি। মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। হরি দুরে দাঁড়িয়ে ছিল, বিজয়কে আসতে দেখে ছুটে এল,
    -"বাবু সব শুনেছেন?"
    বিজয় ঘাড় নাড়ল।
    -"হরি।"
    -"হ্যাঁ বাবু?"
    -"ঐ সাইকেলটা নিয়ে সদরে যা, নীলমনিদার সঙ্গে দেখা করে সব কথা বলে বলবি, আমার সন্দেহ হচ্ছে এটা খুন। পুলিশ নিয়ে আসতে বলবি। আমি সাক্ষী দেব, বাঁটু কিছু জানতে পেরেছিল। ময়নাতদন্ত করা দরকার। শীগগির যা।"
    হরি বাবুকে চিনত, তাই আর বাক্যব্যয় না করে বেরিয়ে পড়ল। বাইরে অনেকে ছিল তবে কর্তাবাবু আর শিবতোষবাবু ছিলনা, তারা বৈঠকখানায় বসে খবরাখবর নিচ্ছিলেন। এছাড়া গিরীশও বোধহয় ফেরেনি স্কুল থেকে। বিজয় ভীড়ের মধ্যে সরকারবাবুকে দেখে তার কাছে গেল। উনি ওকে দেখে খুব দু:খের সঙ্গে বললেন,
    -"এ বাড়ির কেউ কোনোদিন সাপে কাটায় এভাবে মারা যায়নি। বাবুর কাছে ওষুধ থাকে। কাছেপিঠে লোকজন থাকলে দড়িটড়ি বেঁধে সদরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যেত।"
    -"সরকারমশায়, বাঁটুর লাশ কি এখনো সেখানেই?"
    -"হ্যাঁ বাবু। তবে লোক গেছে আনতে, দাহর যোগাড় হচ্ছে, সাপেকাটা লাশ বেশীক্ষণ রাখতে নেই।"
    -"এ বাড়ীতে আনবে না সোজা শ্মশানে নিয়ে যাবে?"
    -"না: ওর বাড়ীতে নিয়ে যাবে, বউ, মেয়ে শেষ দেখাটা দেখবে তো। আমিও সেখানে যাচ্ছি। আপনি যাবেন।"

  • shrabani | 124.30.233.104 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১২:৪২408361
  • বিজয় সরকারমশায়কে কিছু না বলে ওর সঙ্গে বাঁটুর বাড়ির দিকে রওনা দিল। সেখানে গিয়ে দেখে গোটা গাঁয়ের লোকের ভীড় বাড়ির উঠোনে। একটু পরে কিছু লোক বাঁটুর দেহ নিয়ে এল নতুন বাঁশের মাচায় করে। এনে উঠোনের একপাশে রাখল। ভেতর থেকে কান্নার রোল উঠল। বিজয় নিজেকে শক্ত করে সামনে এগিয়ে গিয়ে গলা তুলল,
    -" সবাই এই জায়গাটা খালি করে দিন, একটু দুরে সরে যান। লাশের কাছে থাকবেননা। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে, পুলিশ আসছে।"
    একটা সোরগোল উঠল, কেউ বিজয়কে চেনেনা কিন্তু তার রকম দেখে তাকে অমান্য করতে পারছেনা। তবে সবাই বেশ অসন্তুষ্ট। সরকারমশায় বিজয়কে কি বলতে আসে, বিজয় তার কথায় কান দেয়না। এই ভীড় গোলযোগের মাঝে সে অনড় হয়ে লাশ আগলে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রায় আধঘন্টা এভাবে কাটার পর দুরে দেখা যায় মহেন্দ্রবাবু আসছেন, লোকেরা তাকে খবর দিয়েছে। বিজয়ের কাছে এসে রাগত স্বরে বলেন,
    -"একী কান্ড বিজয়, তুমি এখানে এসে কি গোল পাকিয়েছ? আমার প্রজারা খেপে গেছে। তোমাকে চুরির তদন্ত করতে এনেছি আমি, সে ব্যাপারে কিছু না করে তুমি এসব কি করছ?"
    বিজয় দৃঢ় স্বরে বলল,
    -"আমি আপনারই চুরির তদন্ত করছি। পুলিশ আসছে, ময়নাতদন্ত হবে।"
    -"পুলিশ কেন? কে তাদের খবর দিল?"
    -"আমি দিয়েছি। আপনি বাধা দেবেননা, পুলিশ এল বলে।"
    মহেন্দ্রবাবু রাগে গরগর করতে লাগলেন তবে বিজয়ের রকম দেখে বোধহয় তাকে আর ঘাঁটালেন না। পুরো ভীড়টা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগল, এমনকি ভেতর বাড়ীর কান্নার রোলও স্তিমিত হয়ে এসেছিল।
    প্রায় ঘন্টাখানেক পরে হরি নীলমনি সহ পুলিশের একটি দল এল। নীলমনি পুলিশের দারোগাকে নিয়ে বিজয়ের কাছে এসে বলল,
    -"স্যর, এই হল বিজয়। বিজয় ইনি আমাদের থানার দারোগাবাবু। হরির মুখে শুনলাম বাঁটু চাকর খুন হয়েছে।"
    মহেন্দ্রবাবু দারোগাকে চিনতেন, ওদের কাছে এসে নীলমনির কথা শুনে বললেন,
    -"খুন হয়নি, জঙ্গলে গেছিল,সাপ কাটায় মরে গেছে। তো বিজয়বাবু এই ব্যাপার, তুমি পুলিশকে বলেছ বাঁটু খুন হয়েছে! কেন?"
    দারোগা আর নীলমনিও একটু অবাক হয়ে বিজয়ের দিকে তাকাল। বিজয় দারোগাকে বলল,
    -"বিশ্বাস করুন, আমার এরকম ভাবার কারন আছে। আমি সবকথা পরে বলছি, আপনি আগে দেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠান।"
    দারোগা অমরবাবু পোড়খাওয়া লোক। উনি মহেন্দ্রবাবুর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে, ওনাকে শান্ত করতে চেষ্টা করলেন।
    -"চৌধুরীবাবু, একটু ওদিকে গিয়ে চলুন বিজয়বাবুর কথাটা শোনা যাক। আমাকে নীলমনি ওর পরিচয় দিয়েছে, একজন দায়িত্ববান পুলিশের কর্মচারী। উনি খামকা এরকম কথা বলতে যাবেন কেন!"
    মহেন্দ্রবাবু শান্ত হলেন। ওরা চারজনে একটু একপাশে সরে গেল ভীড়ের থেকে দুরে। বিজয় বলল,
    -"কাল রাত্রে বাঁটু আমাকে কিছু বলতে চাইছিল মন্দিরের চুরি প্রসঙ্গে। লোকজন এসে পড়ায় বলতে পারেনি। আজ হয়ত বলত কিন্তু সকাল থেকে আমি সদরে। আমার সন্দেহ হচ্ছে বাঁটু যাতে আমাকে কথাটা বলতে না পারে তার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হল।"
    মহেন্দ্রবাবু বললেন,
    -"কিন্তু ওর পায়ে সাপে কাটার চিহ্ন পরিস্কার, দেহ নীল হয়ে গেছে!"
    -"হতে পারে ও সাপে কাটায় মারা গেছে। কিন্তু কেউ হয়ত তার আগে ওকে মেরেধরে অজ্ঞান করে জঙ্গলে ফেলে দিয়েছে। ওর জ্ঞান থাকলে আজ ওকে এভাবে বেঘোরে মরতে হত না। দারোগাবাবু আমার একান্ত অনুরোধ আপনি ময়নাতদন্তের আদেশ দিন। আমার মনে হচ্ছে আমি বাঁটুর কথায় গুরুত্ব দিয়ে ওর বক্তব্য সকালেই শুনে নিলে ও মরতনা, নিরাপদ থাকত। আমাকে জানতেই হবে বাঁটু কি ভাবে মারা গেল!"
    মহেন্দ্রবাবু একটা বিরক্তিসূচক আওয়াজ করলেন মুখে কিন্তু আর কিছু বললেন না।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন