এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  প্রথম পাঠ

  • চতুর্থ বিপ্লব! দীর্ঘজীবী হোক

    ঋত
    পড়াবই | প্রথম পাঠ | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৪১৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)

  • নভেম্বর বা মে নয়। ২৫ ডিসেম্বর, বড়দিন, আপনাদের একখানি বিপ্লবের গল্প শোনাতে চাই। এই বিপ্লব জড়িত তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে। শিল্পবিপ্লবের কেন্দ্রে যেমন ছিল ‘শিল্প’, তথ্যবিপ্লবের কেন্দ্রেও তেমনই রয়েছে ‘তথ্য’ বা ইনফরমেশন। প্রশ্ন অতঃপর, ‘ইনফরমেশন এথিক্স’ বিষয়টি কী? খুব সোজা করে বললে, ইনফরমেশন এথিক্স হল এথিক্স বা নীতিবিদ্যার সেই শাখা, যার আলোচনার কেন্দ্রে ‘তথ্য’ বা ইনফরমেশন। এবং, তার সঙ্গে নীতিবিদ্যা বা এথিক্স নিয়ে আলোচনা। কথা হচ্ছে লুসিয়ানো ফ্লোরিদির বই দ্য ফোর্থ রেভোলিউশন: হাউ দ্য ইনফোস্পেয়ার ইজ় রিশেপিং হিউম্যান রিয়্যালিটি  নিয়ে।

    বর্তমান যুগকে কম্পিউটার এবং বার্তা প্রযুক্তির দশক বললে অত্যুক্তি হয় না। ফলে সমকালীন দার্শনিক চিন্তা কম্পিউটার বিজ্ঞানের অগ্রগতির দ্বারা অনেকাংশেই যে প্রভাবিত, তা নিয়ে দ্বিমত নেই।

    শুরুতেই স্পষ্ট করা দরকার, চতুর্থ বিপ্লব বলতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন এথিক্সের অধ্যাপক লুসিয়ানো ফ্লোরিদি কী বুঝেছেন। চতুর্থ হলে, তার আগের তিনটি বিপ্লবই বা কী— সে প্রশ্নও তো আসে। কিন্তু প্রদীপ জ্বালার আগে যেমন সলতে পাকাতে হয়, তেমন ফোর্থ রেভোলিউশন নিয়ে আলোচনা করার আগে কিছু ‘টার্নিমিনোলজি’ এবং ‘কনসেপ্ট’ নিয়ে কথা সেরে নিতে হবে।

    ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ অ্যালন ম্যাথিসন ট্যুরিং-এর প্রবন্ধ ‘কম্পিউটিং মেশিনারি অ্যান্ড ইন্ট্যালিজেন্স’[1]-কেই আধুনিক কম্পিউটারের অন্যতম ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়। অ্যালান ট্যুরিং[2] একটি কল্পপরীক্ষণের কথা বলেছিলেন, যা কিনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংক্রান্ত-তত্ত্বে ‘ট্যুরিং পরীক্ষা’ নামে পরিচিত। অনেকেই মনে করেন, ট্যুরিং এর পরীক্ষাটি আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত। প্রশ্ন ছিল ট্যুরিং-এর: কী ভাবে জানা যায়, আমাদের সঙ্গী মানুষটি চিন্তা করছেন কি না? স্বভাবতই তার আচরণ দেখে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে, অর্থাৎ আলোচনায় অংশ নেওয়ার প্রক্রিয়া থেকে। ধরা যাক, কোনও এক ব্যক্তি একটি বন্ধ ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন ঘরের অন্দরে স্থিত দু’জনের সঙ্গে। তিনি বাইরে থেকে কিছু প্রশ্ন করলে অন্দর থেকে আসছে উত্তর। আবার অন্দর থেকেও তাঁকে কিছু প্রশ্ন করা হচ্ছে এবং উত্তর জেনে কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছেন— প্রশ্নের পিঠে উত্তর, আবার উত্তরের পিঠে প্রশ্ন— এ ভাবেই চলছে কথালাপ। ঘরের বাইরের ব্যক্তিটি কিন্তু জানেন না, ঘরের ভিতরে যে দু’জন আছেন— একজন তাঁরই মতো রক্তমাংসের মানুষ হ’লেও অপর জন কম্পিউটার। বেশ কিছু ক্ষণ কথাবার্তা চলার পরেও যদি ঘরের বাইরের ব্যক্তিটি কম্পিউটারের উত্তর থেকে মানুষের উত্তর পৃথক করতে না পারেন, তা হলে বলতেই হবে যে কম্পিউটার মানুষের মতোই চিন্তা করতে পারে, কথাবার্তা বুঝতে পারে। বস্তুত, ট্যুরিং যখন এমন ভাবছেন, তখন আমেরিকার গণিতজ্ঞ আলোন্সো চার্চও প্রায় কাছাকাছি বিষয় ভাবছিলেন। যে কারণে একে ‘চার্চ-ট্যুরিং থিসিস’ও বলা হয় (এই রচনায় এর বেশি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে না।**

    বস্তুত,  ট্যুরিং ও চার্চ যন্ত্রের একটি পারিভাষিক সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। যে কোনও অমূর্ত কাঠামো যেখানে নির্দ্দিষ্ট উপাত্ত থেকে সীমিত সংখ্যক ধাপে বিশেষ বিশেষ নিয়ম মেনে সুনির্দ্দিষ্ট একটি মাত্র উত্তরে পৌঁছনো যায়, সেই কাঠামোকেই তাঁরা যন্ত্র বলেছিলেন। এই অর্থে মানুষের মস্তিষ্কও একটি বাস্তব ট্যুরিং যন্ত্র, আবার ইলেকট্রনিক কোষে তৈরি কম্পিউটারও একটি বাস্তব ‘ট্যুরিং মেশিন’। ট্যুরিংয়ের যে অবদান, তাকেই ফ্লোরিদি ‘চতুর্থ বিপ্লব’ বলে দাগিয়ে দিতে চান।

    লুসিয়ানো ফ্লোরিদি মনে করছেন, বিগত বছরগুলোতে নীতিবিদ্যার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে নৈতিক গ্রাহক রূপে না-মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷ যেমন কান্ট পরবর্তী যুগে পিটার সিঙ্গারের মতো কিছু ব্যক্তি উপযোগবাদ তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে নৈতিক গ্রাহক রূপে জীবজন্তুদের নৈতিক দাবি থাকতে পারে কি না, তা দেখার চেষ্টা করেছেন৷[3] আবার নৈতিক গ্রাহক রূপে উদ্ভিদদের কোনও নৈতিক দাবি থাকতে পারে কি না, তাডিপ ইকোলজিতত্ত্বের মাধ্যমে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে৷[4] সুতরাং, নৈতিক গ্রাহকদের নিয়ে যে ইতিমধ্যেই আলোচনা হয়েছে, সে কথা স্বীকার করতে হয়৷ তাই সঙ্গত কারণে ফ্লোরিদি মনে করেছেন, নৈতিক গ্রাহকদের শ্রেণির সম্প্রসারণ নিয়ে যত চিন্তাভাবনা হয়েছে, নৈতিক কর্তার শ্রেণিকে নিয়ে তত আলোচনা আমাদের চোখে পড়ে না৷ এ বিষয়ে ভাবনাচিন্তা সবে শুরু৷ এই রচনার প্রতিপাদ্য বিষয়ে পৌঁছনোর জন্য এই ভাবনাচিন্তা সম্পর্কে সংক্ষেপে আরও কিছু আভাস দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।




    ফ্লোরিদির মতে, তথ্য নীতিবিদ্যা অনুযায়ী আমরা আসলে এক তথ্যলোকে বা ইনফোস্ফিয়ার-এ বাস করি (দ্বিতীয় অধ্যায় দ্রষ্টব্য)৷  ফ্লোরিদি বলবেন, এই দুনিয়ায় সব কিছুই তাই তথ্যের নিরিখে ব্যাখ্যাত হয়৷ প্রাথমিক ভাবে আমাদের মনে হয়, তথ্য দুপ্রকার— জৈব তথ্য ও অজৈব তথ্য৷ এঁরা বলছেন, ‘তথ্যএতই গুরুত্বপূর্ণ যে, বস্তুত‌ তা আমাদের চেতনা কিংবা আত্মপরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞান স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়৷ সুতরাং, যা কিনা তথ্য সম্বন্ধীয়, তা-ই নীতিবিদ্যার, বিশেষত তথ্য-নীতিবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷

    কিছু তথ্য নৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ গ্রহণ করার দরুন নৈতিক গ্রাহক বলে বিবেচিত হয়৷ আবার কিছু তথ্য নৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার জন্য নৈতিক কর্তা বলে বিবেচিত হয়৷ ফ্লোরিদির মতে, নীতিবিদ্যার আর এক নতুন শাখা ইনফরমেশন এথিক্স, যে তত্ত্বগত নীতিবিদ্যা কম্পিউটার এথিক্সকে আধিবিদ্যক ভিত্তি প্রদান করে৷[5]

    জীবজগৎ বা ন্যাচারাল এনভায়রনমেন্ট-এর চৌহদ্দি পেরিয়ে নৈতিকতার পরিসরের সম্প্রসারণ তথ্য-নীতিবিদ্যার উদ্ভবের ফলেই সম্ভব হয়েছে৷ তথ্য-নীতিবিদ্যার বক্তব্য মেনে নিলে আমাদের বলতে হয় তথ্য এবং সম্প্রচার প্রযুক্তির ফলে সৃষ্ট কর্তারা নৈতিক ভাবে কাজ করতে সক্ষম৷ যে সব ইঞ্জিনিয়ার এই যন্ত্র বা অ্যালগরিদম তৈরি করেছেন, তাঁদের উপর নির্ভর না করেই কিন্তু এই কর্তারা কাজ করতে পারে৷ সুতরাং, ‘কৃত্রিম ভালো’, ‘কৃত্রিম মন্দকোনও কাজের জন্য এই কর্তাদের অবশ্যই দায়ী করা যেতে পারে৷ এই ধরনের কর্তাদের এ হেন কাজ ব্যাখ্যা করার জন্যই তথ্য নীতিবিদেরা মন-হীন নৈতিকতা বামাইন্ডলেস মর‍্যালিটিআরোপ করেছেন৷[6] ব্যক্তির গোপনীয়তা (প্রাইভেসি), সাইবার অপরাধ, সাইবার নজরদারি এবং ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি— এ সবই কম্পিউটার এথিক্সের আলোচনার বিষয়৷ সুতরাং, নৈতিক মাত্রা ছাড়া এই প্রবন্ধের মূল প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া অসম্ভব৷
    এই প্রবন্ধে আমরা লুসিয়ানো ফ্লোরিদির অনুসরণে দেখবার চেষ্টা করব, কেন তথ্যের আলোচনায় নীতিবিদ্যার সাবেক তত্ত্বগুলো কাজে লাগে না। ফ্লোরিদি নিজের তত্ত্ব নিয়ে অগ্রসর হওয়ার আগে পূর্বপক্ষের তত্ত্বগুলোর ত্রুটি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, কেন তথ্যের আলোচনায় নীতিবিদ্যার সাবেক তত্ত্বগুলো কাজে লাগানো অসম্ভব।

    ভার্চু এথিক্স, উপযোগবাদ, কনট্রাক্টচুয়ালিজম, ডিঅন্টোলজিজমের সমালোচনায় ফ্লোরিদি বলছেন, এই তত্ত্বগুলো সবই কর্তাসম্পর্কীয় (Agented-oriented), বিষয়ীগত (Subjective)[7] সুতরাং যা অনিবার্য ভাবে মানবকেন্দ্রিক (Anthropocentric),[8] যা শুধুমাত্র কর্তারূপে মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু, ফ্লোরিদির মত, আমরা বর্তমানে তথ্য এবং সংযোগ মাধ্যম প্রযুক্তির ফলে যে বিশ্বে বাস করছি, সেখানেতথ্যবিষয়টা আর বৃত্তের বাইরের স্তরে থাকছে না। চলে আসছে কেন্দ্রে। অথচ, নীতিবিদ্যার সাবেক তত্ত্বগুলো ভীষণ ভাবেই জীবকেন্দ্রিক। ব্যক্তির ক্রিয়া অথবা ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র নিয়েই যারা আলোচনায় বিশ্বাসী। মানুষের কাজের যে নৈতিক মূল্য, তা এই তত্ত্বগুলো নানা উপায়ে নিরূপণ করে।[9] তাঁর মতে উপযোগবাদ কিংবা কনট্র্যাকচুয়ালিজমতত্ত্বে এই নৈতিক মূল্য একটা অভিজ্ঞতা সাপেক্ষ পরতসিদ্ধ অবস্থান থেকে দেখা হয়। অন্য দিকে, ডিঅন্টোলজিজমে তা অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ পূর্বতসিদ্ধ অবস্থান থেকে বিচার করা হয়।[10] শুধুমাত্র, কান্ট যে ধরনের কনট্র্যাকচুয়ালিজম করেছেন, তাতে গ্রাহককে কিছুটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নৈতিকতার আলোচনায়। ফ্লোরিদি মনে করছেন, এটা এই আলোচনায় তৃতীয় প্রেক্ষিত সংযোজন করতে পারে।[11] সংবাদমাধ্যমের নীতিবিদ্যা, বায়োএথিক্স, পরিবেশ নীতিবিদ্যা এমননন স্ট্যান্ডার্ডকর্মপন্থা গ্রহণ করে, যেখানে নৈতিকগ্রাহক যে সব সময়ই মানুষ হবেন এমন নয়, না-মানুষও নৈতিকগ্রাহক হতে পারেন।[12]
    ফ্লোরিদির তথ্যনীতিবিদ্যা তিনটি ধারণার উপর ভিত্তি করে আবর্তিত হয়েছে—     



    1.  তথ্যের সত্তা বা অস্তিত্বের স্বীকৃতি (information ontology)
    2.  কর্তা/গ্রাহকের জুটি (the agent/patient pair)
    3.  এবং তথ্যলোকের উপস্থিতি (the infosphere).[13]

    শুরুতেই ফ্লোরিদি তথ্যের পৃথক অস্তিত্বের কথা বলছেন এবং এই কারণে তিনি একটি সত্তাতাত্ত্বিক অবস্থান থেকে তথ্যের পৃথক উপস্থিতির প্রমাণ দাখিল করছেন। ফ্লোরিদি মনে করছেন, এই বিশ্বলোকের চরিত্র বোঝার ক্ষেত্রে অন্য ব্যাখ্যা ব্যতিরেকে আমরা রাসায়নিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই গ্রহের সম্পূর্ণ একটি ব্যাখ্যা হাজির করতে পারি। যেখানে এই গ্রহের যে বিষয়ের দিকেই তাকাই না কেন, তার কোনও না কোনও রাসায়নিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। যেমন আমরা যদিমানুষএই ধারণাটিকে বিশ্লেষণ করি, তা হলে দেখব অন্য অনেক রাসায়নিক পদার্থের সঙ্গে মানবশরীরে উপস্থিত গুরুত্বপূর্ণ একটি দ্রব্য জল, অর্থাৎ মানবশরীরে ৪৫-৭৫ শতাংশ জল থাকে।[14] কিন্তু আমরা যদি, সেইমানুষকে তথ্যের সত্তাতাত্ত্বিক অবস্থান থেকে দেখি, তা হলে বলতে পারি, ‘মানুষ হল তথ্যের আধার।[15] অর্থাৎ, শরীরের জিনে তথ্য লেখা রয়েছে, নিউরোনের মধ্যে দিয়ে তথ্য চলাচল করে, বাহ্যিক অনেক তথ্য পঞ্চেন্দ্রিয় গ্রহণ করে। এই রকম আরও অনেক কিছুই বলা যায়। ফলে তথ্যের সত্তাতাত্ত্বিক অবস্থান থেকে দেখলে বিশ্বলোক এবং তার মধ্যে স্থিত যে কোনও বস্তুর এমন ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব, যেখানে আলোচনার কেন্দ্রে থাকে তথ্য। তাই তথ্যের পৃথক সত্তা স্বীকার করতে হয় এবং তার জন্য পৃথক নীতিবিদ্যার কথা ভাবা জরুরি।




    ফ্লোরিদির মতেInformation Ethics is an ontocentric, patient-oriented, ecological macroethics.”[16] তথ্যনীতিবিদ্যা মনে করে প্রত্যেক দ্রব্য (অর্থাৎ তথ্য)-এর মধ্যে দিয়েই সত্তার আপন স্বরূপ বিকশিত হয়। এই তথ্যের অস্তিত্ব রয়েছে এবং সত্তা রয়েছে। অর্থাৎ, প্রকৃতির আর পাঁচটা সত্তাবান পদার্থের মতো তথ্যেরও তার নিজের মতো করে, নিজের স্বভাবে অস্তিত্বশীল হওয়ার অধিকার রয়েছে। সুতরাং, তার জন্য একটি নীতিমালা থাকাটা জরুরি। এই ভাবেই ফ্লোরিদি মানবকেন্দ্রিকতাকে (অ্যানথ্রোপপসেন্ট্রিজম) আলোচনার কেন্দ্র থেকে সরিয়ে বস্তুকেন্দ্রিকতা (অন্টোসেন্ট্রিজিম)-কে নিয়ে এলেন কেন্দ্রে, যে বস্তুকেন্দ্রিকতা বলছে, জীবনের থেকেও মৌলিক হল সত্তা, এবং ক্লেশের থেকেও বুনিয়াদি হলএনট্রপিবা অবক্ষয়। এখানে অবক্ষয় বা এনট্রপি বলতে ফ্লোরিদি মনে করছেন, যে কোনও ধরনের বিকৃতি (কোরাপশন), ধ্বংসসাধন (ডেসট্রাকশন), অপবিত্রকরণ (পলিউশন) এবং নিঃশেষিতকরণের বিরুদ্ধ নৈতিক অবস্থান। ফ্লোরিদি মনে করছেন, তথ্যনীতিবিদ্যা মনে করে সত্তা হিসেবে তথ্যের নিজস্ব অর্হণ (ওয়ার্দিনেস) রয়েছে। তাই প্রত্যেক তথ্যনির্ভর বস্তু (যেমন সংবাদ)-এর স্বীয় স্বভাবে বিকশিত হওয়ার স্পিনোজীয় অধিকার রয়েছে, এবং কনসট্রাকশনিস্টদের মতো উন্নতি লাভ করার অধিকারও থাকছে।[17]

    ফ্লোরিদির তথ্যনীতিবিদ্যা নৈতিক ভাবে উচিত এবং অনুচিতের এক প্রকার সংজ্ঞা নিরূপণ করে দেয়। তথ্য বা সংবাদের ক্ষেত্রেও এই নীতি প্রযোজ্য। এর জন্য ফ্লোরিদি চারটি নৈতিক নিয়মের কথা বলেন
    ) তথ্যলোকে এনট্রপি বা অবক্ষয় কখনওই ঘটানো যাবে না (নাল ল’)
    ) তথ্যলোকে এনট্রপি বা অবক্ষয় রুখতে হবে
    ) এনট্রপি বা অবক্ষয় তথ্যলোক থেকে দূর করতে হবে।
    ) তথ্যযুক্ত পদার্থ-সহ সমগ্র তথ্যলোকের বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে হবে। তাদের বৈশিষ্টকে রক্ষা করতে হবে এবং উন্নতিসাধন করতে হবে।[18]

    এই যে বদলে যাওয়া নৈতিকতার চরিত্র, তাকেই ফ্লোরিদি বলেছেন ‘ফোর্থ রেভোলিউশন’[19] যেখানে নৈতিকতার কেন্দ্র থেকে মানুষের স্থানচ্যুতি ঘটছে। ফ্লোরিদি মনে করছেন, বর্তমান যুগের এই যে বদলে যাওয়া ছবি, তার আভাস মিলেছিল অ্যালান ম্যাথিসন ট্যুরিং-এর হাত ধরে।

    এর আগের তিনটি বিপ্লব বা রেভোলিউশনের প্রথমটি (কোপার্নিকান রেভোলিউশন)-তে দেখা গিয়েছে বিশ্বচরাচরের কেন্দ্র থেকে সরে যায় মানুষ— জিও সেন্ট্রিক থেকে হেলিও সেন্ট্রিক হয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধারণা। দ্বিতীয়টি, ফ্লোরিদির মতে ডারউইনিজম। যেখানে চার্লস ডারউইন দেখিয়েছিলেন  যে, সকল প্রকার প্রজাতিই কিছু সাধারণ পূর্বপুরুষ হতে উদ্ভূত হয়েছে এবং বিবর্তনের এই নানান শাখা-প্রশাখায় ভাগ হওয়ার বিন্যাসকে তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচন হিসাবে অভিহিত করেন। অর্থাৎ, জীবজগতের কেন্দ্র থেকে মানুষের স্থানচ্যুতি ঘটে। তৃতীয় দশা, কার্তেশীয় স-চেতন মনের ধারণা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় সিগমুন্ড ফ্রয়েডের এই বক্তব্যে যে মনের সবটুকুই স-চেতন নয়, সেখানেও আছে নানা গলিঘুঁজি, অন্দরকন্দর।  মানব-মনকে স-চেতন, অর্ধচেতন এবং অবচেতনএই তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন ফ্রয়েড। ফলে, মানব মননই একমাত্র স-চেতন যে নয়, এটা প্রমাণ করে দেন ফ্রয়েড। এর ফলের‌্যাশনাল ওয়ার্ল্ডথেকেও মানুষের স্থানচ্যুতি ঘটে। অতঃপর, ফ্লোরিদির মতে, আসে বিপ্লবের চতুর্থ স্তর। সেটাই হল ট্যুরিং-এর ধারণার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে নৈতিকতার কেন্দ্র থেকে মানবজাতির সরে যাওয়া। সেখানে জরুরি হয়ে ওঠে তথ্যের রক্ষাকবচ।

    বইটির দশটি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘টাইম: হাইপারহিসট্রি’। ফ্লোরিদি দেখিয়েছেন, কী ভাবে ‘প্রি-হিস্ট্রি’ (যখন লিপির আবিষ্কার হয়নি, অর্থাৎ ‘তথ্য’ বলতে শুধুই ছিল শ্রবণ), থেকে ‘হিস্ট্রি’ (লিপির আবিষ্কারের পর) থেকে ‘হাইপার হিস্ট্রি’ (ইনফরমেশন প্রযুক্তির যুগ, যেখানে মানুষকেও যন্ত্রের নির্দেশ মানতে হয়, যেমন ধরুন ক্যাপচা পরীক্ষার ক্ষেত্রে)-তে অবতীর্ণ হল। এবং, ‘সময়’ বিষয়টির ধারণা কী ভাবে সাবেক ধারণার থেকে বদলে গেল।

    দ্বিতীয় অধ্যায় ‘স্পেস: ইনফোস্ফিয়ার’। ফ্লোরিদি বায়োস্ফিয়ারের মতোই কল্পনা করেছেন ইনফোস্ফিয়ারকে। মানুষ আরও অনেক কিছুর সঙ্গে বসত করে এই ‘তথ্যলোকে’। অর্থাৎ, শুধু বায়োস্ফিয়ার নয়, তার থেকেও বৃহত্তর পরিসর এই ‘তথ্যলোক’। ফ্লোরিদির যুক্তি এই। উপরে এ নিয়ে কিঞ্চিৎ বিস্তারে আলোচনা হয়েছে। 

    এর পর এসেছে কী ভাবে আত্মপরিচয়ের ধারণার বদল হচ্ছে, সে প্রসঙ্গে আলোচনা। ফ্লোরিদি দেখিয়েছেন, ক্রমেই ‘অনলাইন’ এবং ‘অফলাইন’-এর বিভাজন মুছে গিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘অনলাইফ’। বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে ‘প্রাইভেসি’, ‘ইনটেলিজেন্স’, ‘এজেন্সি’, ‘পলিটিক্স’ ‘এনভায়রনমেন্ট’ এবং ‘এথিক্স’-এর আলোচনা। এক কথায় চেনা-জানা ধারণাগুলো কী ভাবে বর্তমানে বদলে বদলে যাচ্ছে, তার এক ব্যাখ্যা মেলে বইটি থেকে।



    দ্য ফোর্থ রেভোলিউশন: হাউ দ্য ইনফোস্ফিয়ার ইজ রিশেপিং হিউম্যান রিয়্যালিটি
    লুসিয়ানো ফ্লোরিদি
    অক্সফোর্ড
    2014





    ** অমিতা, চট্টোপাধ্যায়, (প্রকাশিতব্য), 'যান্ত্রিক ও মানসিক',
    এবার কথা প্রাণে প্রাণে,
    কলকাতা:একলব্য
    [1] Turing, A. M. (1950). "Computing Machinery and Intelligence." Mind 59 , no. 236: 433--460.
    [3] Singer Peter, Practical Ethics, 1979, second edition 1993: Cambridge: Cambridge University Press
    [4] See http://www.uky.edu/Ag/Forestry/conbio/Deep_ecology.pdf for primary reference , also see Katz, E., A. Light, et al  (2000). Beneath the Surface: Critical Essays in the Philosophy of Deep Ecology, MIT Press, Cambridge Mass
    [5] Floridi Luciano (2003), ibid
    [6] Floridi L, (2016) 'Faultless responsibility: on the nature and allocation of moral responsibility for distributed moral actions'.Phil. Trans. R. Soc. A 374: 20160112.
    http://dx.doi.org/10.1098/rsta.2016.0112
    [7] Floridi, L. (1999). Information ethics: On the philosophical foundation of computer ethics,
    Ethics and Information Technology 1: 33. URL=https://link.springer.com/article/10.1023/A:1010018611096
    [8] ibid
    [9] Ibid
    [10] ibid
    [11] Floridi L. (2008). Foundations of Information Ethics, in Kenneth Einar Himma and Herman T. Tavani eds. The handbook of Information and Computer Ethics, New Jersey: Wiley
    [12] ibid
    [13] Floridi L. (2008). Ibid.
    [14] Floridi, L (2004), Information, in Luciano Floridi eds, The Blackwell guide to the Philosophy of Computing and Information, Malden: Blackwell Publishing. pp 40-61
    [15] Ibid
    [16] Floridi, L. (Forthcoming).  Global Information Ethics: The Importance of Being Environmentally Earnest, accepted for publication in International Journal of Technology and Human Interaction, IGI Publishing, URL= http://www.philosophyofinformation.net/wp-content/uploads/sites/67/2014/05/gie.pdf
    [17] Floridi, L. (1999). Ibid.
    [18] Floridi, L. (1999). Ibid. p 17
    [19] Floridi, L. (2016). The 4th Revolution: How the infosphere is reshaping Human Reality, Oxford: Oxford University Press


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৪১৭ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ২৭ ডিসেম্বর ২০২২ ১১:২৩514861
  • অসাধারণ এবং জরুরি প্রবন্ধ। 
    আমার মত non-,technical গোলা  লোকের জন্যেও।
  • Sara Man | ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ ১৪:১৬514872
  • ভালো লাগল পড়ে। সবটা যে পুরোটা বুঝেছি তাও নয়। যেমন নীতি-কর্তা কে? এবং কর্তা-গ্রাহক জুটি বিষয়টি পরিষ্কার বুঝতে পারিনি। 
  • ঋত | 2409:4042:98:ef1:2646:c8aa:109b:f9d1 | ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ ১৯:৫৫514876
  • ধন্যবাদ। পরে এই বিষয়গুলো নিয়ে লেখার কথা মাথায় রাখব। তবে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়েও কি আপনার কমেন্টের সদুত্তত দিতে পারলাম? কে জানে!
  • ঋত | 2409:4042:98:ef1:2646:c8aa:109b:f9d1 | ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ ২০:০০514877
  • *সদুত্তর* টাইপো। সরি। 
  • ঋত | 2409:4042:98:ef1:2646:c8aa:109b:f9d1 | ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ ২০:০২514878
  • ধন্যবাদ রঞ্জনবাবু। এই প্রেরণাগুলোর জন্যই পরের লেখার জন্য ল্যাপটপ খুলি...
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন