এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ছেঁড়াকাঁথা

  • ছেঁয়াবাজীর ছলনা  - ১২

    লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ছেঁড়াকাঁথা | ২০ নভেম্বর ২০২২ | ৮৭২ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • দাদু আমায় নিয়ে যে ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এল সেখানেই আমি তিনক্লাস থেকে দশক্লাস অবধি পড়েছি। সে ইস্কুলের  ঠিক পাশেই ছিল একটা ভাগাড়৷ জায়গাটা টিনের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, আশেপাশের গাছগুলোতে বসে থাকত অজস্র শকুন৷ একটা বসতবাড়ীও ছিল কাছেই৷ দু চারটে শকুন সেই বাড়ীটার বারান্দায় বা ছাদেও বসত আর আমরা অবাক হয়ে বলাবলি করতাম ঐ বাড়ীর লোকেরা থাকে কেমন করে ওখানে? আর কীভাবেই বা ওরকম একটা জায়গায় জমি কিনে বাড়ী বানাবার কথা ভাবতে পারল!! কোন্নগর, আমাদের ছোট্ট মফস্বলে তখনও কিছু বাড়ীতে খাটা পায়খানা ছিল, আর পৌরসভা সেইসব বাড়ী থেকে টিনের ট্যাঙ্কার ধরণের গাড়ি করে পুরীষ সংগ্রহ করে এনে ঐ ভাগাড়ে ফেলত৷ এছাড়াও সারা কোন্নগরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে  মৃত জন্তুজানোয়ারও এনে ফেলা হত ওখানে৷ আমাদের ছিল মর্নিং স্কুল৷ সাড়ে দশটায় যখন স্কুল ছুটি হত, তখনই বর্জ্য সংগ্রহ করে গাড়িগুলো ফেরত আসত৷ তাদের কারো কারো আবার ঢাকনি ভেঙে যাওয়ায় মুখটা খোলা৷ হরিদ্রাবর্ণের বিভিন্ন শেড ও বিভিন্ন ঘনত্বের তরল, অর্ধতরল গড়িয়ে আসার দৃশ্য খুবই সুলভ ছিল৷

    প্রথমদিন ঐ স্কুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা ভয়ংকর৷ আকাশ বাতাস আমোদিত করা সেই গন্ধের থাপ্পড় যে না খেয়েছে, সে বুঝবে না সে কি বীভৎস!  এরকম গন্ধকেই নিশ্চয়ই শাস্ত্রে টাস্ত্রে পুতিগন্ধ বলে৷ এক দেড়মাস পর থেকে অবশ্য উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে হাওয়া না দিলে গন্ধ আর তেমন করে টের পেতাম না৷ স্কুলের এক দিদিমণি  প্রায়ই বলতেন স্বর্গে তাঁর জন্য স্পেশাল ব্যবস্থা হচ্ছে --- স্রেফ মরার অপেক্ষা৷ এতদীর্ঘ নরকবাসের পর স্বর্গ ছাড়া আর কোথায়ওই তিনি যেতে পারেন না৷ ঐ ভাগাড়ের গন্ধটা আজও ছাড়তে চায় না আমাকে৷ মাঝে মাঝেই নাকে ফিরে আসে৷ কি যেন একটা অসুখ আছে না হঠাৎ হঠাৎ নাকে কোনও একটা গন্ধ এসে লাগে, যেটা হয়ত তখন সেখানে পাওয়ার কথাই না৷ কথা হল স্কুল কর্তৃপক্ষ ঐখানেই বা স্কুলটা স্থাপন করেছিলেন কেন কে জানে! ঐ ভাগাড় উঠিয়ে দেওয়ার জন্যও তাঁরা বিশেষ চেষ্টা করেন নি কখনওই৷ একই স্কুল বাড়ীতে সকালে একটি মেয়েদের ও একটি ছেলেদের প্রাইমারি স্কুল, মেয়ে দের একটি জুনিয়র হাই স্কুল (অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত) ও একটি হাই স্কুল হত৷ দুপুরে ছেলেদের একটি হাই স্কুল হত৷ তো এই এতগুলি স্কুল মিলিয়ে প্রতিদিন ছাত্রছাত্রীসংখ্যা কখনওই ৭০০ থেকে ৭৫০ র কম হত না৷

    এই ৭০০-৭৫০ ছেলেমেয়ে প্রতিদিন বিদ্যালাভের সাথে সাথে গন্ধ সম্পর্কে সহনশীল হতেও শিখত৷ এই স্কুলগুলো অবশ্য কোন্নগরের ভাল স্কুলের তালিকায় ছিল না৷ বিশেষত সকালের স্কুলগুলোতে প্রচুর প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের পড়ুয়া থাকত৷ স্কুল ড্রপ-আউটের সংখ্যাও যথেষ্ট৷ তবে ড্রপ-আউটের ফলেও ছাত্রীসংখ্যা খুব একটা কমত না, কারণ অন্যান্য ভাল স্কুলগুলোতে একই ক্লাসে একাধিকবার অকৃতকার্য হওয়া ছাত্রীরা প্রায়ই এসে ক্লাস ভরিয়ে তুলত৷ তার ফলে কোন্নগরের সাধারণ লোকের এই স্কুলগুলো সম্পর্কে একটা তাচ্ছিল্যের মনোভাবই ছিল৷ শুধু বাইরের লোক নয়, মাস্টারমশাই দিদিমণিরাও একইরকম তাচ্ছিল্যের মনোভাব দেখাতেন৷ সম্ভবত: এইজন্যই ভাগাড় ওঠানোর চেষ্টা তেমনভাবে করা হয় নি৷ বরং সময়ের সাথে সাথে স্কুলটা  আরও ভালভাবে 'ভাগাড়পাড়ার স্কুল' নামে পরিচিতি লাভ করেছে৷তা এই ভাগাড়পাড়ার স্কুলের একদিকে ভাগাড়ের পাশেই মেথরপট্টি। সেখান থেকে কোনও ছাত্রী আমাদের স্কুলে কোনোদিনই আসে নি। কেউ কোনোদিন ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেছিল কিনা জানি না। ৮০ সাল নাগাদ ঐ মেথরপট্টির ভেতরেই একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় বানিয়ে দেয় কোন্নগর মিউনিসিপালিটি।

    এই ভাগাড়পাড়া স্কুলের আরেকটা চলতি নাম ছিল মাস্টারপাড়া স্কুল। কারণ স্কুলের পেছন দিকের পল্লীটার নাম 'মাস্টারপাড়া'। সেই মাস্টারপাড়ার মাস্টারমশাইদের বাড়ী থেকেও অবশ্য  কেউ কখনও  পড়তে আসে নি আমাদের স্কুলে৷ স্কুলগুলো মূলতঃ তৈরী হয়েছিল ১৯৫০-৫২ নাগাদ বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব্ববঙ্গ) থেকে আসা উদ্বাস্তুদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার জন্য, স্থানীয় অন্যান্য স্কুলগুলোর ওপরে চাপ কমাতে। আরেকটা উদ্দেশ্য হল কিছু, তা যতই সামান্য হোক, কর্মসংস্থানের উদ্যোগ। 'কোন্নগর কল্যাণ পরিষদ' নাম দিয়ে একটা  রেজিস্টার্ড সোসাইটি তৈরী করেন কিছু খদ্দরধারী কিঞ্চিৎ অবস্থাপন্ন উদ্বাস্তু। স্কুলের জমির মাঝামাঝি একটা পাকা বাড়ী। তার নীচের তলায় বিভিন্ন সেকশানের টিচার্স কমন রুম বাদ দিয়ে ক্লাসরুম হল দুটো। দোতলায় আরো খান তিনেক। সামনে মাঠের বাঁ দিকে পাকা ঘর, মাথায় এসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া দুটো ঘর, মেঝেটা পয়েন্টিং করা। তারপর ছিটে বেড়ার দেওয়াল, টালির চাল আর মাটির মেঝেওলা আরো দুটো ঘর। স্কুলের পেছনে ইঁটের দেওয়াল, টালির চাল আর পাকা মেঝেওলা টানা ক্লাসরুম পরপর ছয় সাতটা, বাঁদিকে এল শেপে আরো দুটো।

    ওই অংশে যেতে গেলে একটা সরু পাকারাস্তা পেরিয়ে যেতে হত। এ রাস্তা মাস্টারপাড়ার কমন রাস্তা, লোক আর সাইকেল মোটামুটি চলে, রিকশা কালেভদ্রে। ঐ যে টানা ক্লাসরুম, তার পাশেই একটা জল টলটলে মস্ত পুকুর।কোথাও কোনো বাউন্ডারি ওয়াল বা গেট ফেটের বালাই নেই। ভাগাড়ের সামনে দিয়ে এসে একটু এগিয়ে স্কুলের মাঠে ঢোকার সরু পায়েচলা পথ৷ দুপাশে নানারকম জংলি গাছে ভরা অঞ্চল৷ রাস্তার ওপারে মস্তবড় কচুরিপানাভরা পুকুর, প্রায় সারাবছর অর্ধেকের বেশী অংশ মাঠ হয়ে থাকে, বর্ষাকালে পুরোটা জলে ভরে যায়৷ কোন্নগরের তাবৎ ধোপা সেখানে সারাবছর কাপড় কাচে আর মাঠে ছড়িয়ে মেলে দেয়৷ ঐ মাঠের মধ্য দিয়ে শর্টকাট মারলে ভাগাড়ের প্রত্যক্ষদর্শন এড়ানো যায়৷ অবশ্য মনসাতলার মোড় থেকে সোজা গিয়ে মনসাতলা ব্যায়াম সমিতির পাশ দিয়ে ঢুকে পুকুরপাড়ের সরু ইঁটের রাস্তা ধরে এলেও ভাগাড় এড়িয়ে ইস্কুলের  ডানপাশে পৌঁছানো যায়। তা সে যারা বাটামোড়-জি টি রোডের দিক থেকে আসত তাদের পক্ষে সুবিধে৷ আমরা যারা স্টেশানের বা কালীতলার দিক থেকে যেতাম তারা তো মনসাতলার মোড়ের নেতাজী স্ট্যাচুর পাশের রাস্তা দিয়ে ঢুকে পড়তাম৷

    রাস্তাটায় কয়েকটা একতলা দোতলা বাড়ী দুপাশে, তার মধ্যে একটা ড: পি কে রায়ের; যাঁর দুই ছেলেই ডাক্তার৷ তারপরেই ঐ অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু তিনতলা বাড়ীটা, সাথে লাগোয়া আলকাতরা বানাবার ফ্যাকটরি| দু চারটে আলকাতরার ড্রাম রাস্তার পাশেও থাকত টাকত| এরপরেই রাস্তার ডানদিকে মেথরপট্টি, আর বাঁদিকে একটা মস্ত খেলার মাঠ; ১৫ই আগস্ট ওখানে সারাদিনব্যপী ফুটবল ম্যাচ হত আর শীতকালে  চারদিন যাত্রা হত, মাঝেসাঝে বাইরে থেকে কোনও গ্রুপ থিয়েটারের দল এলে তাও। এই মাঠটার কোণাকুণি গেলেই নেমে পড়া যেত ঐ কচুরীপানাভরা পুকুরের পাশের শুকিয়ে ওঠা জমিতে| কোণাকুণি না গিয়ে সোজা রাস্তায় গেলে, মাঠ শেষ হয়ে বুনোফুলের ঝোপ আসবে বাঁ পাশে আর ডানপাশে ভাগাড়, ভাগাড়ের কোণাথেকে বাঁ দিকে বেঁকে এগিয়ে গেলে ডানেবাঁয়ে  বুনোফুলের ঝোপ আর ধোপার পুকুর সাঙ্গে সঙ্গে যাবে যতক্ষণ না আসবে স্কুলে ঢোকার সেই সরু গলিটা| সে গলির দুপাশেও বুনোঝোপ, কিন্তু সে একটুখানি -- এই ১২-১৪ পা হাঁটলেই স্কুলের মস্ত মাঠ, আর মাঠ শেষ হলেই স্কুলের মূল বিল্ডিং, একতলার লিন্টেলের ওপরে হলদে রঙের মধ্যে কালো রং দিয়ে বড় বড় করে লেখা 'রাজেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়'|

    ডানদিকে আরেকটা মাঠ, মাঝখানে একটা মস্ত শিমূলগাছ। তারপর যতদূর চোখ যায় বুনোঝোপ আর ভাগাড়, শুধু মাঝে চোখটা অল্প বাধা পায় ঐ বাড়ীটায় যার বারান্দায় সবুজ রঙের দেওয়াল আর ছাদে, বারান্দার রেলিঙে বসা কয়েকটা শকুন। ’রাজেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়' হল ছেলেদের স্কুল, পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত, দুপুর এগারোটায় ক্লাস শুরু হয়| তাইজন্য আমাদের স্কুল শেষ হয় সকাল সাড়ে দশটায়, যাতে মেয়েদের স্কুলের সমস্ত কিছু গুটিয়ে ফেলা যায়, সব দিদিমণি ও মেয়েরা বেরিয়ে যেতে পারে| এইজন্য আমাদের স্কুলে কোনওদিন কোনও ক্লাসেই ছুটির পর অতিরিক্ত ক্লাস হয় নি, হওয়ার জায়গাই নেই তো। আমাদের স্কুলের নাম ‘বালিকা শিক্ষা সদন জুনিয়র হাই' আর পরে নবম শ্রেণীতে শুধুই ‘বালিকা শিক্ষা সদন'| কিন্তু স্কুলের নাম তো লেখা রয়েছে 'রাজেন্দ্র স্মৃতি, তাহলে মেয়েদের স্কুলের নাম কোথায়? নেই নেই, কোনও বোর্ডে বা দেওয়ালের গায়ে নেই লেখা – আছে শুধু হলদে রঙের মাসিক বেতনের রসিদ বইয়ের পাতাগুলোর মাথায়্ মাথায়, রিপোর্ট কার্ডে, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা, পুরস্কার বিতরণী কিম্বা সরস্বতী পুজোর আমন্ত্রণ পত্রে, আর কোত্থাও নেই।

    ‘কোন স্কুলে পড়ো?'র উত্তরে তাই ‘বালিকা শিক্ষা সদন' বললে কেউ বুঝতেই পারে না সে স্কুলটা কোথায়। তারপর যদি বল ‘কোন্নগর কল্যাণ পরিষদ' তখন  কেউ কেউ বুঝে ফেলে বলে ওঠে ওহোহো ভাগাড়পাড়া স্কুল। কেউ যদি তাও না বোঝে তখন তাকে বল 'মাস্টারপাড়া স্কুল' তখন সেও এক্কেবারে বুঝে ফেলবে ওঃ ভাগাড়পাড়া স্কুল, আরে আগে বলবি তো। তাই ‘রাজেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়'কে কেউ রাজেন্দ্র স্মৃতি, কেউ মাস্টারপাড়া আবার কেউবা ভাগাড়পাড়া ছেলেদের স্কুল বলে ডাকে, ‘বালিকা শিক্ষা সদ্ন'দের সব্বাই কিন্তু ভাগাড়পাড়া স্কুল বলেই ডাকে।আমি এই স্কুলটায় এসে ভর্তি হলাম বছরের প্রায় মধ্যিখানে। কেজি-টু থেকে ক্লাস-ট্যু পর্যন্ত  কলকাতার সেই ঝকঝকে গম্ভীর স্কুলে  ধপধপে সাদা ইউনিফর্মের মাঝে থাকত টুকটুকে লাল বেল্ট, মাথায় লাল ফিতে, খেলার ক্লাসের দিন সাদা ব্লাউজের ওপরে লাল টুকটুকে টিউনিক। ক্লাস ফোরে উঠলে লাল-নীল-হলদে-সবুজ রঙের যে কোনও একটা রঙের টাই, যে মেয়ে যে হাউসের সদস্য, সে সেই রঙের টাই পরবে। আমার খুব লোভ ছিল নীল আর হলদে টাইয়ের ওপর।

    ঐ স্কুলে তো আমার আর ক্লাস ফোরে পড়াও হয় নি, এই ‘হাউস' জিনিষটা যে কী সেকথা আজও জানা হয় নি। এখানে ড্রেসটাও খারাপ নয়, মেরুণ রঙের স্কার্ট আর সাদা ব্লাউজ।  কিন্তু ক্লাসের কারুর পোষাকই তেমন কড়া ইস্ত্রী করা নয়, তারজন্য মিসরা কেউ বকছেনও না। অ্যাল! এখানে 'মিস' বলে নাতো, ‘দিদিমণি' বলে। ‘দিদিমণি' ডাকটা যেন কেমন কেমন।  একটা আধা অন্ধকার, পাঁচ ছয়টা কালচে রঙের কাঠের আলমারীওয়ালা একটা ঘরে গিয়ে আমি ভর্তি হয়ে গেলাম। সবুজ পাড় সাদা শাড়ী পরা, কাঁচাপাকা চুলওয়ালা ছোট্টখাট চেহারার সাধনাদি, সাধনা বিশ্বাস প্রাইমারি সেকশানের বড়দি আমাকে ক্লাস থ্রীতে নিয়ে নিলেন। আমার মা মাস কয় হল রঙীন শাড়ী সব বিলিয়ে দিয়ে  সাদা শাড়ী পরতে শুরু করেছে, আমি সবে বুঝতে শুরু করেছি লাল ছাড়া অন্য পাড়ের সাদা শাড়ীর শূন্যতা। সাধনাদিকে দেখে সেই সদ্যলব্ধ জ্ঞানের প্রয়োগ করে মনটা কেমন একটা হয়ে গেল, ঠিক খারাপ নয়, খানিকটা যেন স্বস্তির, আমার মা ছাড়াও আরো কাউকে কাউকে তাহলে এমন সাদাটে বিচ্ছিরি লাগে দেখতে।

    আরো কিছুদিন পরে জেনেছিলাম সাধনাদি চিরকুমারী, সাদার শূন্যতা তাঁর জীবনে আরোপিত নয়, স্বেচ্ছাকৃত।  সেই সত্তর দশকের শুরুর দিকে বেশীরভাগ চিরকুমারীরাই কেন যেন সাদা শাড়ী পরতেন, অনেকেই হালকা রঙের পাড়ওয়ালা। কিন্তু তাঁদের তো কেউ জীবন থেকে লাল রঙ ঘষে তুলে দেয় নি, তবু কেন? এর উত্তরও আমার আজও  জানা হয় নি|ভর্তি হওয়ার দিন আর কোনও ক্লাসটাস করতে হল না, বিকেলে দাদু গিয়ে স্টেশানের কাছের ‘প্রশান্ত পুস্তকালয়' থেকে বুকলিস্ট মিলিয়ে বই খাতা আর একটা কমলা রঙের আর্টেক্স কলম  কিনে নিয়ে এল। আমি এর আগে কখনও কলমে লিখি নি, কিন্তু এই স্কুলে নাকি ক্লাস থ্রী থেকেই কলমে লেখার নিয়ম। সন্ধ্যেবেলা দাদু সব বইগুলোতে মলাট দিয়ে কলম, কালির শিশি আর একটা পাতলা ড্রপার নিয়ে কলমে কী করে কালি ভরতে হয় সেটা আমাকে শেখাতে বসল। বেশ মজার ব্যবস্থা কিন্তু, কালি কেমন চোঁ করে ড্রপারে উঠে আসে, আবার কান পাতলে শোনা যায় আস্তে আস্তে শোঁ-ও-ও শব্দ| কিন্তু কলমটা দেখতে যত সুন্দর ওটা দিয়ে লেখা দেখি ঠিক ততটাই কঠিন|

    লেখাগুলো কেমন যেন ধ্যাবড়ামত হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই আমার হাতের লেখা ভীষণ খারাপ, এ পর্যন্ত প্রত্যেক ছুটিতেই আমাকে ৩০ পাতা বাংলা আর ৩০ পাতা করে ইংরিজি হাতের লেখা লিখতে হয়েছে, আমার জন্য ইস্কুল থেকে অতিরিক্ত কার্সিভ রাইটিঙের বই কেনাত, কিন্তু তাও আমার লেখা তেমন পদের হয় নি| কালি-কলম দিয়ে লেখায় সে আরও বিশ্রী দেখতে লাগতে লাগল। কলকাতার ইস্কুলে অঙ্কের খাতায় ছোট ছোট খোপ কাটা, একেকটা খোপে একেকটা সংখ্যা লিখতে হত। এখানে অঙ্কের খাতা একদম সাদা প্লেন, সংখ্যাগুলো এবড়ো খেবড়ো হয়ে যেদিকে খুশী চলে যায়।  ছোটমামা হাসতে হাসতে বলল আরশোলার পায়ে কালি লাগিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে খাতার ওপরে।  পরের দিন সকাল সাড়ে পাঁচটায় দিদা ঠেলেঠুলে তুলে দিল, স্কুল শুরু হবে নাকি সোয়া ছটায়, তার আগেই পৌঁছাতে হবে।  মুখ ধুয়ে দুধ আর দুটো টোস্ট খেয়ে দাদুর সাথে চললাম স্কুলে আমার পুরো নামলেখা গাঢ় নীল স্যুটকেসটা নিয়ে। ক্লাস সিক্স অবধি মনে হয় ব্যবহার করেছি ওটা।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২০ নভেম্বর ২০২২ | ৮৭২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • যোষিতা | ২০ নভেম্বর ২০২২ ২৩:৪৭513962
  • এই লেখাটা এই মেয়েটা ভেলভেলেটায় ছিল
  • | ২০ নভেম্বর ২০২২ ২৩:৫৮513963
  • না না 'ভাগাড়পাড়া স্কুল থেকে বলছি' তে ছিল।  smiley​​
    এখন থেকে ওইটা আসবে কেটেজুড়ে। ওটা শেষ হলে বাকীটা। 
  • যোষিতা | ২১ নভেম্বর ২০২২ ০০:২৬513964
  • ঠিক, ঠিক।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন