এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • ধর্মাধর্ম - দ্বিতীয় পর্ব - চতুর্থ ভাগ

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ১৩ মে ২০২২ | ১৪৮৯ বার পঠিত | রেটিং ৪ (২ জন)
  • দ্বিতীয় পর্ব - ১২,০০০ থেকে ৬০০ বি.সি.ই – চতুর্থ ভাগ
     
    ২.৪.১ সমসাময়িক ভারতের অন্যান্য প্রান্ত
    সিন্ধু সভ্যতার সময়কাল নিওলিথিক এবং চ্যালকোলিথিক যুগ। পরবর্তী প্রসঙ্গে যাবার আগে, এই দুই যুগের বৈশিষ্ট্যগুলি আরেকবার মনে করিয়ে দিই। নিওলিথিক হচ্ছে সেই যুগ, যখন যথেষ্ট কৃষি এবং পশুপালন শুরু হয়ে গেছে ও পাথরের আরো সূক্ষ্ম বা তীক্ষ্ণ উন্নত যন্ত্রপাতি এবং অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। তার পরবর্তী চ্যালকোলিথিক যুগে তামা এবং সংকর ধাতু ব্রোঞ্জের প্রচলন শুরু হয়ে গেছে, কৃষি ও পশুপালন আরো ব্যাপ্ত হয়েছে। ব্রোঞ্জ ও তামার ব্যবহার শুরু হলেও, কাঠ, বাঁশ ও পাথরের যন্ত্রপাতি বা অস্ত্র তখনও বহুল প্রচলিত রয়েছে। 

    সিন্ধুর নগরকেন্দ্রিক বাণিজ্যিক সভ্যতা উন্নতির শিখর স্পর্শ করলেও, ভারতের অন্যত্র তাদের অনুকরণে বা অনুসরণে শহর গড়ে ওঠার হিড়িক পড়ে যায়নি। তখনও দেশের অন্যান্য প্রান্তের জনজীবন প্রধানতঃ কৃষি, পশুপালন এবং শিকারী-সংগ্রাহী আরণ্যক সমাজেই বিভক্ত ছিল। উত্তরপশ্চিম ভারতের সভ্যতার আঁচ তাদের খুব বেশি কিছু প্রভাবিত করতে পারেনি। যেটুকু পরিবর্তন তাদের হয়েছিল তার কারণ তামা ও ব্রোঞ্জের  ব্যবহার।

    মোটামুটি তিনহাজার বি.সি.ই থেকেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নিওলিথিক এবং তার পরবর্তী কালে চ্যালকোলিথিক সমাজের উদ্ভব শুরু হয়ে গিয়েছিল। যার প্রত্ন নিদর্শন ভারতের প্রায় সর্বত্র পাওয়া গেছে এবং পাওয়া যাচ্ছে। কাশ্মীরের বুরযাহোম এবং গুফক্রালে, ওই উপত্যকার লোয়েস মাটিতে গর্ত করে থাকত যে মানুষরা, তাদের কাছেও কিছু কার্নেলিয়ান[1] পুঁতি এবং শিং-ওয়ালা পশুচিত্রিত মাটিরপাত্র পাওয়া গেছে। এর থেকে তাদের সঙ্গে যে সিন্ধু সভ্যতার যোগাযোগ ছিল সে প্রমাণ পাওয়া যায়। অবিশ্যি তার মানে এই নয় যে তারা সিন্ধুসভ্যতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল, এই সামগ্রীগুলি তারা বণিকদের থেকেই হয়তো সংগ্রহ করেছিল। তাদের সমাধিগুলি হত ঘরের আশেপাশেই এবং মৃতের সঙ্গে তারা সাধারণতঃ কুকুরকেও সমাধি দিত। এমন সমাধির নিদর্শন অবশ্য ভারতের অন্যত্রও পাওয়া গেছে। বুরযাহোমে সমাধির ধারে একটা পাথর – মেনহির খাড়া করা ছিল। এর আগে কোন সমাধিতেই এমন নিদর্শন কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে এর পরবর্তী সময়ে ভারতের বহু অঞ্চলেই সমাধির পাশে মেনহিরের ব্যবহার প্রচলিত হয়ে উঠেছিল।

    একই ধরনের আবাস ছিল উত্তরাঞ্চলের আলমোড়ায় এবং উত্তরপশ্চিমের সুদূর সোয়াৎ[2] উপত্যকায়। সেখানকার গান্ধার সমাধিগুলিতে মোটামুটি দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষ দিকে ঘোড়ার এবং প্রথম সহস্রাব্দের শুরুতে লোহা ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। উত্তর ভারত থেকে আফগানিস্তান বা মধ্য এশিয়া যাওয়ার পথেই পড়ত এই সোয়াৎ উপত্যকা।

    গাঙ্গেয় উপত্যকায় অনেক বেশি সংখ্যক উপনিবেশের নিদর্শন মিলেছে। এখানকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ বসবাস করত। প্রত্নবিদেরা এক একটি সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করতে পারেন, তাদের মৃৎপাত্রের ধরন দেখে। মৃৎপাত্রের ধরন অনুযায়ী তাঁরা সেই সেই সংস্কৃতির নাম দিয়ে থাকেন। যেমন ওসিপি - OCP (Ochre Colored Pottery – গিরি রঙের পাত্র), পিজিডব্লিউ - PGW (Painted Grey Ware – ধূসর রং করা পাত্র), বিপিডব্লিউ - BPW (Black Polished Ware – কালো পালিশকরা পাত্র), এনবিপিডব্লিউ – NBPW (Northern Black Polished Ware),  ইত্যাদি।

    গাঙ্গেয় সমভূমির পশ্চিমদিকের অত্রাঞ্জিখেরা, লাল কিলা এবং হুলায় ওসিপি ধরনের পাত্র পাওয়া গেছে। যার সঙ্গে খুব ক্ষীণ হলেও হরপ্পার পাত্রের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও হুলার প্রত্নখননের প্রাচীনতর স্তর থেকে হরপ্পার অনেক পাত্র পাওয়া গেছে। হরিয়ানা এবং পাঞ্জাবের বেশ কিছু অঞ্চলে, হরপ্পার পাত্রের সঙ্গে পিজিডব্লিউ পাত্রও পাওয়া গেছে। অতএব অনুমান করা যায়, এই অঞ্চলগুলিতে হরপ্পা-সংস্কৃতির সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিতি থাকলেও তারা নিজস্ব সংস্কৃতিও অনুসরণ করত। পিজিডব্লিউ পাত্রের উপনিবেশ আরও পাওয়া গেছে, রোপার (পাঞ্জাব), ভগবানপুরা (হরিয়ানা), হস্তিনাপুর, অহিচ্ছত্র এবং জাখেরায় (উত্তরপ্রদেশ)।

    গাঙ্গেয় সমভূমির আরও পূর্বদিকের উপনিবেশগুলিতে তামার কাজে যথেষ্ট দক্ষতা ছিল – বর্শার ফলা, হারপুন, ছেনি, পাতলা তলোয়ার এবং কিছু নর-পশুমূর্তি পাওয়া গেছে। এই মূর্তিগুলি মাটির নিচে যেন সংরক্ষণ করা হয়েছিল। এই ধরনের সামগ্রী পাওয়া গেছে ছোটনাগপুর এবং আরও পূর্বদিকের অঞ্চলগুলিতে।

    মধ্য গাঙ্গেয় সমভূমির প্রচুর অঞ্চলে অনেক উপনিবেশের নিদর্শন পাওয়া গেছে। যেমন পিপরাওয়া, গানোরিয়া, সোগাউরা, নারহান, খাইরাডি এবং মির্জাপুরের আশেপাশে বেশ কয়েকটি অঞ্চল। এলাহাবাদের দক্ষিণে বেলান উপত্যকা অথবা চোপানি-মাণ্ডো, কোলডিহোয়া - এই সব অঞ্চলে গম ও যবের পাশাপাশি ধানও চাষ হতো, আজ থেকে মোটামুটি আট হাজার বছর আগে থেকে। গঙ্গা এবং সরযূর সঙ্গমের কাছে চিরাণ্ডে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগেকার উপনিবেশের নিদর্শন পাওয়া গেছে, যার অস্তিত্ব ছিল খ্রীষ্টাব্দের পরেও। বাঁশের কঞ্চি আর সরু কাঠের কাঠামোর ওপর মাটি, গোবর আর খড়ের কুচি মেশানো পলেস্তারা করে তারা ঘর[3] বানাতো। তারা পাথরের কুড়ুল, ছোট ছোট পাথরের ফলা, হাড়ের যন্ত্র–পাতি, পাথরের হামান-দিস্তে, যাঁতা ব্যবহার করত। পোড়া মাটির বাসন পত্র, মূর্তি বানাত। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কাজে তামা এবং আরও পরে লোহাও ব্যবহার করত। গাঙ্গেয় সমভূমিতে চিরাণ্ড এমন একটি জায়গা, যেখানে সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাস স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করা যায়।

    গাঙ্গেয় সমভূমির আরেকটি বিশেষত্ব ছিল তাদের এনবিপিডব্লিউ পাত্র এবং স্থানীয় হিমাটাইট মাটি থেকে উচ্চ-তাপমাত্রায় লোহা নিষ্কাশনের উপায় আবিষ্কার। সম্ভবতঃ এখানেই লোহার প্রথম সামগ্রী বানানো হয়ে, নদী পথে দেশের নানা দিকে বাণিজ্য শুরু হয়েছিল।

    আরো পূর্বের বঙ্গদেশে ভাগিরথীর পশ্চিমে দামোদর এবং অজয় উপত্যকায় এবং আরো কিছু জায়গায় উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। তার কারণ সম্ভবতঃ উর্বর জমি এবং ছোটনাগপুরের তামার খনি। এমনই কিছু জায়গা যেমন পাণ্ডু রাজার ঢিবি, মহিষাদল, মঙ্গলকোট ইত্যাদি। এই উপনিবেশ নিওলিথিক যুগের আগেই শুরু হয়েছিল এবং পরবর্তী কালে তারা তামার ব্যবহারও শিখে গিয়েছিল। আরও পূর্বে আসামের দাওজালি হেডিং, গারো হিলসের কিছু জায়গায় এবং কাছাড় অঞ্চলেও বেশ কিছু নিওলিথিক উপনিবেশ ছিল।

    মধ্য প্রদেশের মালোয়া, কায়াথ এবং নওদাতোলি সংস্কৃতি বহু বছরের প্রাচীন। এই অঞ্চলের সঙ্গেও হরপ্পা সংস্কৃতির যোগাযোগ ছিল। নাওদাতোলিতে নর্মদা পার হয়ে মাহেশ্বর, এবং তার আরও নিচে সাবাতপুর, পীঠানগর, মান্দাসৌরেও নিওলিথিক উপনিবেশের নিদর্শন পাওয়া গেছে। পরবর্তী সময়ে এই পথেই হোসাঙ্গাবাদ হয়ে দক্ষিণে যাওয়ার রাস্তা গড়ে উঠেছিল।

    উত্তর মহারাষ্ট্রের দাইমাবাদ এবং জরওয়ের সঙ্গে সিন্ধু-সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। ইনামগাঁওয়ে গভীর প্রত্নখননে কৃষি এবং পশুপালনের নিদর্শন পাওয়া গেছে। বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্যে তারা বাঁধ বানিয়েছিল। এবং শুধুমাত্র বৃষ্টির ভরসায় না থেকে, বাঁধের জলেও যব এবং জোয়ার বা বজরার চাষ করত। বাঁশের কঞ্চি বা কাঠের কাঠামোতে কাদামাটি মিশ্রণের পলেস্তারা করা গ্রামের বাড়িগুলি হত গোলাকার বা বর্গাকার। আশেপাশের জঙ্গলের হিংস্র পশুদের আক্রমণ ঠেকাতে গ্রামের চারপাশে তারা মাটির দেওয়াল তুলেছিল। পোড়ামাটির তৈরি বেশ কিছু মুণ্ডহীন কিন্তু গুরুস্তনী নারী মূর্তি পাওয়া গেছে। সাধারণতঃ ঘরের মেঝেয় গর্ত খুঁড়ে মৃতদের সমাধি দেওয়া হত, সমাধিতে কিছু সামগ্রীও রাখা হত। আশ্চর্যের বিষয় হল কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাধির মৃতদের পায়ের পাতা ইচ্ছে করেই কেটে দেওয়া হত। মহারাষ্ট্রের বেশ কিছু জায়গায়, যেমন জুনাপানি, মহুরঝারির বেশ কিছু সমাধিতে পাথর সাজিয়ে স্মারক (Menhir) রাখা হত।

    দক্ষিণের গোদাবরী, কৃষ্ণা, পেন্নার, তুঙ্গভদ্রা এবং কাবেরী উপত্যকায় বেশ কিছু উপনিবেশের নিদর্শন পাওয়া গেছে যেগুলি আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগেকার। যেমন হাল্লুর, কুপগাল, মাস্কি (কর্ণাটক), নাগার্জুনাকোণ্ডায় (অন্ধ্রপ্রদেশ) ছিল কৃষি সমাজ। পিকলিহাল (কর্ণাটক), উটনুর (অন্ধ্রপ্রদেশ) এবং কুপগালের মতো উষর জায়গায় পশুপালনের নিদর্শন পাওয়া গেছে। অন্ধ্রপ্রদেশের বুদিহালেও পশুপালনের গ্রাম ছিল, সেখানে একটি কসাইখানা পাওয়া গেছে। প্রথম দিকে গরু, বাছুর, ছাগল, ভেড়া পালন করলেও পরের দিকে তারা মোষপালনও শুরু করেছিল। ভারতে মহিষপালনের সূচনা সম্ভবতঃ এখানেই শুরু হয়েছিল। এখানকার মানুষরা প্রথমদিকে জোয়ার এবং বাজরার চাষ করত, পরের দিকে অপেক্ষাকৃত ভেজা জমিতে ধান চাষও শুরু করেছিল। মাটির পাত্র বানাতে কুমারের-চাকের (potter’s wheel) ব্যবহারও শুরু করেছিল।

    খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষ পর্যন্ত দক্ষিণের উপনিবেশগুলিতে তামা বা ব্রোঞ্জের ব্যবহার খুবই কম পাওয়া গেছে। পরবর্তী কালে পাইয়ামপল্লি (তামিলনাড়ু), হাল্লুর এবং টি.নারসিপুরে তামা ও ব্রোঞ্জের প্রচুর শিল্প ও বাসন সামগ্রী, পুঁতি, পোড়ামাটির মূর্তি এবং কুমোর-চাকে বানানো পাত্র পাওয়া গেছে। একই ধরনের প্রগতি দেখতে পাওয়া যায় সাংগানকাল্লু (কর্ণাটক)-তে। বরং হাল্লুর এবং কুমারানহাল্লিতে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষ দিকে লোহার ব্যবহারও শুরু হয়ে গিয়েছিল।

    ২.৪.২ পরিস্থিতির পর্যালোচনা

    আগের অধ্যায়টুকু পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অবশিষ্ট ভারতের কোথাও কোথাও কয়েকটি মাটির পাত্রের টুকরো আর কিছু কার্নেলিয়ান পুঁতি ছাড়া সিন্ধু সভ্যতার তেমন উল্লেখযোগ্য প্রভাব নেই। এবং প্রতিটি অঞ্চলেই সভ্যতার প্রগতি চলছিল স্বাভাবিক ঢিমেতালে। একটু উণিশ-বিশ থাকলেও, সর্বত্রই সেই প্রগতির গতি প্রায় একই রকম।

    অবশিষ্ট ভারতে সিন্ধু সভ্যতার উজ্জ্বল উন্নতির কোন প্রভাব তো ছিলই না, উপরন্তু আমার বিশ্বাস সমসাময়িক মানুষ মানসিক দিক থেকেও অনেকটাই পিছিয়ে এসেছিল আতঙ্কে এবং আশঙ্কায়। নচেৎ সিন্ধু ও হাকরা অববাহিকার সমস্ত শহরগুলি পরিত্যক্ত হওয়ার পিছনে যথেষ্ট যুক্তি থাকলেও, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাটের নিরাপদ শহরগুলি এবং সমুদ্রবন্দর লোথাল ও ধোলাভিরা পরিত্যক্ত হল কেন? সেখান থেকে ছোট ভাবে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া যেত না? বা পরবর্তীকালে আবার শুরু করা যেত না? রাজস্থানের তামা, টিন, সোনা, রূপোর উৎসগুলি তো বন্ধ হয়ে যায়নি। এই শহরগুলির মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। সোয়াৎ উপত্যকার সঙ্গে উত্তরপশ্চিম ভারতের যোগাযোগও যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি, সে কথাও জানতে পারবো পরবর্তী অধ্যায়ে। সেই পথে আগের মতোই আনা যেত লাপিজ-লাজুলি, কার্নেলিয়ান অথবা টারকোয়েজ। আর দক্ষ শিল্পীরাও ছিল আশেপাশের এলাকার গ্রামে এবং জনপদে। কিন্তু সেরকম কিছু হল না। বরং সিন্ধু-সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত সব কটি নিরাপদ ভারতীয় শহরকেও তুলে দেওয়া হল প্রকৃতির হাতে। অথচ তাদের আশেপাশেই বেশ কিছু জনপদ ও গ্রাম ছিল, যারা এই শহরের মানুষদের খাদ্য সংস্থান করত। তারা খুব ভালো করেই জানত শহর ছেড়ে সব মানুষরা চলে যাচ্ছে। কিন্তু তারা কেউই ওই শূণ্য শহরের স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতেও গেল না। কেন? তারা কী তবে ভুলতেই চেয়েছিল এবং সত্যিই একদিন ভুলে গেল, কেন?

    আমার ধারণা, সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুক্ত সকল মানুষই দেব-দেবীদের অভিশাপের কথা ভেবে ভয় পেয়েছিল। অর্থাৎ তাদের কাছে অভিশপ্ত হয়ে গিয়েছিল সমগ্র সিন্ধু সভ্যতার সমাজ এবং সংস্কৃতি। যার সংস্পর্শে কেউ থাকতেও চায়নি কিংবা ফিরেও আসতে চায়নি। বরং ভুলে যেতে চেয়েছিল এবং সেই কারণেই এদেশের অনেকটাই পিছিয়ে থাকা মানুষদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে তারা আবার মিশে গিয়েছিল।

    এই অনীহার পিছনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ অবশ্যই ছিল – সেটি হল মেসোপটেমিয়ার আক্কাদিয়ান সাম্রাজ্যের অবসান (২০৮৩ বিসিই)। এই সাম্রাজ্যই সিন্ধু সভ্যতার সব থেকে বড়ো পৃষ্ঠপোষক ছিল। অতএব এই সময়ে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলিতে সিন্ধুসভ্যতার প্রোডাক্টের চাহিদা আর তেমন উৎসাহব্যঞ্জক রইল না।

    এই দ্বিতীয় পর্বের প্রাককথায় বলেছিলাম, প্রতিটি উত্তরণ হল সভ্যতার অসীম সিঁড়ির এক একটি ধাপ। আমাদের সমাজের বেশ কিছু মানুষ এই পর্যায়ে এসে সভ্যতার অনেকগুলি ধাপ খুব দ্রুত পার হতে পেরেছিল, কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও রপ্তানির বাজার মন্দা হওয়ার কারণে, তারাই আবার বেশ খানিকটা পিছিয়ে দিল আমাদের সভ্যতার অগ্রগতি।   

    আর ঠিক এই সময়েই মানুষের নতুন এক গোষ্ঠী ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করল।  

    ২.৪.৩ আর্যদের ভারতে আগমন

    ভারতীয় ইতিহাসে আর্যদের মতো বিতর্কিত বিষয় আর বোধ হয় নেই। তারা কী ভারতেরই লোক, নাকি বহিরাগত। যদি বহিরাগত হয়, তাহলে তারা ঠিক কবে এসেছিল? আসার পথে তারাই সিন্ধু সভ্যতার মানুষদের কচুকাটা করে রেখে আসেনি তো? কারণ আর্যরাই ভারতে প্রথম ঘোড়া এনেছিল এবং ভারতে আসার আগেই তারা লোহার অস্ত্র ব্যবহার করত। নাকি আসলে তারাই সিন্ধুসভ্যতা গড়ে তুলেছিল? আর্য বলতে কী কোন বিশেষ ভাষা বোঝায় নাকি তারা একটা জাতি? তারা কী ভারত আক্রমণ করে, যুদ্ধ জয় করে ভারতে ঢুকেছিল? নাকি লক্ষ লক্ষ বছরের পরম্পরা অনুসরণ করে ছোট ছোট দলে ভারতে এসে উপনিবেশ গড়ে তুলছিল?

    এত বিদগ্ধ বিতর্কের মধ্যে না গিয়ে, এটুকু ধরে নেওয়া খুব একটা অযৌক্তিক হবে না, যে ভাষায় বেদ রচিত হয়েছিল, এবং সেই ভাষায় যারা কথা বলত তারাই আর্য। আর্যরা ভারতে এসেছিল অন্যান্য অজস্র গোষ্ঠীর মতোই, তাদের ভাষা ভারতের সমসাময়িক অধিবাসীদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং অবশ্যই বিশিষ্ট। মূলতঃ এই ধারণা নিয়েই আর্যদের ভারতে আসার পর্বটাকে একটু পর্যালোচনা করা যাক।

    বিশেষজ্ঞরা বলেন, আর্যদের আদি নিবাস ছিল মধ্য এশিয়ায়[4], হয়তো আজকের কাজাকাস্তান, কিরঘিজস্থান বা তাজিকিস্তান অঞ্চলে। আর্যরা উচ্চস্তরের কোন মানব প্রজাতি নয়, তারাও অন্যান্য হোমো স্যাপিয়েন্সদের মতোই শিকারী-সংগ্রাহী যাযাবর জীবনেই অভ্যস্ত ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অন্য মানুষরাও যেমন নতুন এলাকার সন্ধানে, দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ত, আর্যরাও তার ব্যতিক্রম নয়। বহু শতাব্দী পরের কোন এক সময়ে তাদের মধ্যে দুটি দল মধ্য এশিয়ার দেশ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। একটি দল চলে গিয়েছিল অ্যানাতোলিয়া, তুর্কির দিকে। আরেকটি দল এসেছিল ইরানের দিকে। আরও কয়েক শতাব্দী পরে ইরানে আসা দলটির একটি শাখা রওনা হয়েছিল ভারতের দিকে। ভারতের দিকে যখন তারা রওনা হয়েছিল, তারা তখন ছিল মূলতঃ যাযাবর পশুপালক (pastoral) গোষ্ঠী।

    বৈদিক-ভাষার সঙ্গে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রাচীন ইরানী ভাষার খুব মিল, কারণ শুরুতে তারা একই গোষ্ঠীর মানুষ ছিল। আবার পশ্চিম এশিয়ার, বিশেষতঃ উত্তর সিরিয়ার ভাষার সঙ্গেও এই ভাষার বেশ কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মোটামুটি ১৪০০ বি.সি.ইতে উত্তর সিরিয়ার দুটি সাম্রাজ্য হিটাইট এবং মিতান্নিস-এর মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির সাক্ষী হিসেবে তারা কয়েকজন দেবতার নাম উল্লেখ করেছিল, যেমন ইন্দারা, মিত্রসিল, নাসাতিয়ানা, এবং উরুবনসিল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই চারজন দেবতার মধ্যে অন্ততঃ তিনজন আর্যদেরও দেবতা ইন্দ্র, মিত্র[5] এবং বরুণ। আগেই বলেছি বহু শতাব্দী আগে আর্যদের অন্য একটি শাখা তুর্কির দিকে গিয়েছিল, তার পাশের দেশই সিরিয়া। অতএব আমাদের আর্যরা যে সিরিয়ার আর্যদের জ্ঞাতি, সেটা এই দেবতাদের নামের মিল থেকে আরও নিশ্চিত হওয়া যায়।

    বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রাচীন ইরানী ভাষা থেকেই বৈদিক ভাষার উদ্ভব। কারণ প্রায় সমসাময়িক কালে প্রাচীন ইরানী ভাষার “আবেস্তা” এবং আমাদের আর্যদের “ঋগ্বেদ”-এর মধ্যে আশ্চর্য সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় – শুধু ভাষাতেই নয়, বিষয়েও। আবেস্তা হল মহান জরথুস্ত্র (Zarathustra) বা জরোয়াস্তার (Zoroaster) ধর্মগ্রন্থ। নিজেদের গোষ্ঠী পরিচয়ে আবেস্তায় বলা আছে তারা “আইরিয়া”, আর ঋগ্বেদে সেই পরিচয় হল আর্য (সঠিক উচ্চারণ আরইয়া)।  দুই ভাষার সব থেকে বেশি অমিল শুধু “হ” এবং “স” অক্ষরের। আবেস্তার হওমা, দাহ, হেপ্তহিন্দু, অহুর, ঋগ্বেদে সোমা, দাস, সপ্তসিন্ধু, অসুর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, ঋগ্বেদের দেবতা এবং অসুরের ধারণা, আবেস্তার ধারণার ঠিক উলটো। যেমন আবেস্তায় ইন্দ্র হল “দয়েব” মানে দৈত্য, কিন্তু ঋগ্বেদে তিনি প্রধান দেবতা - দেব। অহুর মাজদাকে আবেস্তায় পরমেশ্বর মনে করা হয়, অথচ ঋগ্বেদে অসুর মানে দেবতাদের শত্রুপক্ষ।

    বিশেষজ্ঞরা এর থেকে অনুমান করেন, প্রাচীন ইরানী এবং এই বৈদিকভাষীরা আগে যদিও একই গোষ্ঠীর মানুষ ছিল, কিন্তু পরে তাদের মধ্যে তীব্র বিবাদ এবং মতভেদ হয়েছিল এবং সেই কারণেই তারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার বিদ্বেষেই, আইরিয়ার দৈত্য হয়েছেন আর্যদের দেবতা, আর আইরিয়াদের দেবতাকে আর্যরা অসুর বানিয়েছে। এই সময়ে, বৈদিক আর্যরা বাস করত ইন্দো-ইরান সীমান্তের কাছে, এখনকার আফগানিস্তানের হরক্সবতী (সরস্বতী) নদীর উপত্যকায়। সেখান থেকেই তারা হেপ্তহিন্দু (সপ্তসিন্ধু) উপত্যকার দিকে যাত্রা শুরু করেছিল।

    প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকেও এই ঘটনার কিছু সূত্র পাওয়া গেছে, ওই অঞ্চলের হরপ্পা সংস্কৃতির কিছু জনপদে। ওই সীমান্তবর্তী কয়েকটি জনপদে বেশ কিছু ঘোড়ার হাড়ের জীবাশ্ম এবং পোড়ামাটির অশ্ব-মূর্তি পাওয়া গেছে। এমন ঘোড়ার মূর্তি, মোটিফ বা তার হাড়ের জীবাশ্ম সিন্ধু সভ্যতার অন্য আর কোথাও পাওয়া যায়নি। ঘোড়া যদি আর্যদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়, ঋগ্বেদের ধর্মীয় প্রথায় যার উল্লেখ বারবার আছে, তাহলে ওই জনপদের মানুষ প্রথম ঘোড়া দেখেছিল এবং আর্যদের সঙ্গে তাদের প্রথম পরিচয়ও হয়েছিল। এই নিদর্শনের সময়কাল ২০০০ বি.সি.ই-র শুরুর দিকে অর্থাৎ হরপ্পা সভ্যতার সূর্য যখন অস্তগামী। অতএব তখনও আর্যরা মূল সিন্ধু উপত্যকা এবং মূল ভারত ভূখণ্ড থেকে বহুদূরে।

    কয়েকশ বছর ধরে ঋগ্বেদ যাঁরা রচনা করছিলেন, তাঁদের ভৌগোলিক বর্ণনা থেকেও আর্যদের যাত্রাপথ সম্পর্কে বেশ একটা ধারণা করে নেওয়া যায়। পূর্ব আফগানিস্তান, সোয়াৎ উপত্যকা এবং তার পরের পরপর নদীগুলি। সিন্ধু, চিনাব, রাভি, শতদ্রু, বিয়াস, ঝিলাম, গঙ্গা – ঋগ্বেদের সপ্তসিন্ধু। এখানেও লক্ষ্য করার বিষয়, তারা হাকরা নদী দেখতে পায়নি, অথচ সিন্ধু সভ্যতা যখন মধ্য গগনে, তখন হাকরা নদী সিন্ধুর পরেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অর্থাৎ আর্যরা ভারতের পশ্চিম সীমান্তে যখন ঢুকছিল তার বহুদিন আগেই ২০০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি হাকরা শুকিয়ে গেছে। অতএব আর্যদের ভারতে পদার্পণ মোটামুটি ১৫০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি কোন সময়ে। তার প্রায় আড়াইশ বছর আগে ১৭৫০ বি.সি.ইতে সিন্ধু সভ্যতার সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। ভারতে আসার পথে জঙ্গলে ঢাকা পড়ে যাওয়া সিন্ধুসভ্যতার পরিত্যক্ত শহর বা জনপদগুলিও তাদের চোখে পড়েনি। অনেক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া গেলেও, ঋগ্বেদে এমন ঘটনার কোথাও কোন উল্লেখ পাওয়া যায়নি। অতএব তুমুল যুদ্ধ করে আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার মানুষদের নির্বংশ করেছে – এমন কখনোই ঘটেনি।   

    ২.৪.৪ আর্য উপনিবেশ

    আগেই বলেছি, আর্যরা মূলতঃ ছিল পশুপালক (pastoralist) গোষ্ঠী। গরু, বাছুর, ছাগল, ভেড়ার পাল এবং অবশ্যই ঘোড়ার দল নিয়ে, সবুজ তৃণক্ষেত্রের সন্ধানে, তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়াত। আর যেখানেই চাষযোগ্য জমি পেত, চাষ করে ফসল ঘরে তুলত। তবে নিবিড়ভাবে চাষ করার অভিজ্ঞতা এবং ধৈর্য তাদের বোধহয় ছিল না। প্রথম দিকে তারা ছোট ছোট দলে ভারতবর্ষে ঢুকছিল এবং প্রথমতঃ উত্তর-পশ্চিম উপত্যকায় তারা বসবাস শুরু করেছিল। কিন্তু পিছনে আসতে থাকা দল এবং তাদের পশু সংখ্যার চাপে তারা আরও পূর্বদিকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং পরে গাঙ্গেয় সমভূমির দিকে এগোতে শুরু করেছিল। এই সময় থেকে পরবর্তী পাঁচশ বছরে ভারতের কোথাও, বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিমেও, তাদের অস্তিত্বের তাৎপর্যপূর্ণ নিদর্শন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা খুঁজে পাননি। ভারতে তাদের এই উপনিবেশ গড়ে তোলার সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায় তাদের পরবর্তী রচনাগুলি থেকে।

    বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে রচনা করা ঋগ্বেদের সূক্তগুলি, খ্রীষ্টপূর্ব মোটামুটি প্রথম সহস্রাব্দের শুরুর দিকে সংকলন করা হয়েছিল। সেই সংকলনই চলে আসছে আজ পর্যন্ত। কিন্তু তার পরবর্তী বেদসমূহের, যেমন সাম, যজুঃ এবং অথর্ব-র রচনাকাল মোটামুটি ৫০০ বি.সি.ই-র মধ্যেই। বেদের সংহিতা পর্ব হল মন্ত্রের সংকলন, ব্রাহ্মণ পর্ব হল যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যাখ্যা। বেদের আরও দুটি পর্ব - উপনিষদ এবং আরণ্যক মূলতঃ দার্শনিক তত্ত্ব। বেদের সঙ্কলনে আরও একটি পর্ব প্রায়ই যোগ করা হয় সেটি হল সূত্র। সূত্রের তিনটি বিভাগ, গৃহ্যসূত্র, শ্রৌতসূত্র এবং ধর্মসূত্র। গৃহস্থের বিধি-বিধান ও প্রথার বর্ণনা নিয়ে গৃহ্যসূত্র, শ্রৌতসূত্র হল গোষ্ঠীগত বিধি-বিধান আর ধর্মসূত্র হল বর্ণভেদ আর সামাজিক কর্তব্যের বিধি-বিধান। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, এদেশে উপনিবেশ গড়ে তোলার মাত্র কয়েকশ বছরের মধ্যেই আর্যরা ঋগ্বেদের আদর্শ এবং উদ্দেশ্য থেকে অনেকটাই সরে গিয়ে বাস্তব পরিস্থিতির ভিত্তিতেই পরবর্তী বেদগুলি রচনা করেছিল।

    শুধু আদর্শ এবং উদ্দেশ্যই নয়, ঋগ্বেদের ভাষা থেকে পরবর্তী সব রচনার ভাষাও অনেকটা বদলে গিয়েছিল। তার কারণ এদেশের পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং সমাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞ হওয়া এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠা। আর্যরা এদেশে আসার আগে অনেক বিষয়েই অনভিজ্ঞ ছিল, যেমন লাঙল এবং বলদ দিয়ে চাষ করার প্রথা। গম এবং যবের মতো আরেকটি প্রধান শস্য ধানের সঙ্গেও তাদের পরিচয় ছিল না। বন্য প্রাণীদের মধ্যে সিংহের সঙ্গে তাদের পরিচয় থাকলেও, বাঘ, গণ্ডার কিংবা হাতি তাদের কাছে নতুন। কয়েকশ বছর ধরে তারা এদেশের কৃষি প্রযুক্তি শিখেছে। অনার্যদের নানান পেশার দক্ষতা ও কর্মকুশলতা শিখেছে। এদেশের নতুন প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সড়গড় হয়েছে। অতএব পরবর্তী রচনাগুলির ভাষায় অনেক পরিবর্তন এবং পরিমার্জন করতে হচ্ছিল। অনার্য বহু পরিভাষা এবং শব্দ গ্রহণ করে এবং পরিমার্জিত হয়ে এই ভাষাই হয়ে উঠল সংস্কৃত – যে ভাষার সংস্কার করা হয়েছে। অতএব এখন থেকে আর্যদের ভাষা আর বৈদিক ভাষা নয়, সংস্কৃত। যে ভাষা নিয়ে তারা ইন্দো-ইরান সীমান্ত থেকে ভারতের দিকে রওনা হয়েছিল, সে ভাষা থেকে সংস্কৃত অনেকটাই আলাদা।

    মোটামুটি ৫০০ বি.সি.ইতে পাণিণি অষ্টাধ্যায়ী সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। তাঁর এই অভূতপূর্ব ব্যাকরণ যে নতুন ভাষাকে সুশৃঙ্খল একটা আকার এবং নিয়মে বাঁধার জন্যেই রচিত হয়েছিল, সেকথা নিঃসন্দেহে বলা চলে। এই ব্যাকরণ আর্যদের তো বটেই অনার্যদের পক্ষেও সংস্কৃতভাষা শেখা ও বোঝার সুবিধে করে দিয়েছিল। যার ফলে পরবর্তী সময়ে সমাজের উচ্চস্তরের সুশিক্ষিত মানুষরা সংস্কৃত ভাষাতেই কথা বলত। যেমন আজও ভারতের সমস্ত এলিট সমাজ একত্র হলে, ইংরিজিতেই কথা বলে, তাদের মাতৃভাষা তামিল, তেলুগু, বাংলা, অহমিয়া কিংবা গুজরাটি, যাই হোক না কেন। একই ভাবে সাধারণ দৈনন্দিন জীবনে তারা প্রাকৃত ভাষায় কথা বলত। এই প্রাকৃত ভাষাও সংস্কৃত, কিন্তু তার মধ্যে অনার্য শব্দ এবং বাগ্‌ধারার বহুল ব্যবহার হত, বলাই বাহুল্য। আর্য এবং অনার্য মানুষের মধ্যে যোগাযোগের ভাষাই ছিল প্রাকৃত। সংস্কৃত ভাষা একদিকে উচ্চশ্রেণীর মানুষদের মধ্যে যেমন ঐক্য এনে দিয়েছিল, তেমনি সাধারণ অনার্য তো বটেই এমনকি সাধারণ আর্যদেরও দূরে ঠেলে দিয়েছিল। কারণ খেটে খাওয়া অধিকাংশ সাধারণ মানুষের পক্ষে জটিল সংস্কৃত ভাষা শেখার মতো সময় ও ধৈর্য কোনটাই ছিল না।

    প্রচলিত প্রাকৃত এবং অনার্য ভাষার মিশ্রণে গড়ে ওঠা সংস্কৃত ভাষা, বৈদিক ভাষা থেকে এতটাই দূরে সরে গেল, যে আরও পরবর্তীকালে, কয়েকশ বছরের ব্যবধানে, বড়ো বড়ো পণ্ডিতদের রচিত ব্যাখ্যা ছাড়া, সাধারণের পক্ষে বেদসমূহ বোধগম্য হত না। এই ব্যাখ্যাগুলির মধ্যে বিখ্যাত হল পণ্ডিত যাস্ক-র “নিরুক্ত” এবং সায়নাচার্যের “সায়ন-ভাষ্য”। তাঁদের ব্যাখ্যা এবং টীকা ছাড়া বেদের – বিশেষ করে ঋগ্বেদের অর্থোদ্ধার অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।
     
    খুব স্বাভাবিকভাবেই এদেশে ধীরে ধীরে ঢুকতে থাকা আর্য দলগুলির সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের বিবাদ এবং দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। সে সব ঘটনার কথা এবং মন্তব্য ঋগ্বেদেও পাওয়া যায়। আবেস্তায় “দাহ” ও “দহ্যু” শব্দদুটির মানে, অন্য লোক। ঋগ্বেদেও স্থানীয় মানুষদের ক্ষেত্রে শব্দদুটি ব্যবহৃত হয়েছে, দাস এবং দস্যু হিসেবে। সে সময় স্থানীয় অনার্য বাসিন্দারা কৃষি, বাণিজ্য এবং পশুপালনে যথেষ্ট সম্পন্ন ছিল, সেকারণেই তারা ছিল আর্যদের ঈর্ষার পাত্র। আবার আর্যদের নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেও একদিকে পশু লুঠ করা খুব কৃতিত্ব এবং অন্যদিকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখা হত। অর্থাৎ যে দলনেতা অন্যদল থেকে পশু লুঠ করে আনতে পারত, নিজের দলে সে হত নায়ক। অন্য দিকে পরাজিত পশু হারানো আর্যগোষ্ঠী তাদের গাল দিয়ে বলত “পনি”।

    ঋগ্বেদে বেশ কিছু আর্যগোষ্ঠী এবং তাদের মধ্যে এমন অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা বলা আছে। যেমন পশ্চিম পাঞ্জাবে স্থিতু হওয়া ভরত-গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন সুদাস, তাঁর প্রধান দুই পুরোহিত ছিলেন বিশ্বামিত্র এবং বশিষ্ঠ। আর্যদের দশটি গোষ্ঠী একত্র হয়ে ভরতগোষ্ঠীকে আক্রমণ করেছিল রাভি নদীর ধারে, সেই যুদ্ধে সুদাস জয়ী হয়েছিলেন। পশুসম্পদ বাড়ানোর এই লড়াই আর্যরা নিজেদের মধ্যেও যেমন করত, তেমনই করত, দাস অর্থাৎ স্থানীয় লোকদের সঙ্গেও।

    পরবর্তী সময়ে আর্যদের পাঞ্চাল গোষ্ঠী গাঙ্গেয় সমভূমিতে পৌঁছে কুরুগোষ্ঠীর সঙ্গে জোট বেঁধে বেশ বড় এলাকায় প্রভূত প্রতিপত্তি স্থাপন করতে পেরেছিল। তাদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও তারা প্রথম সহস্রাব্দের শুরুর দিকে বেশ কয়েকমাস ধরে লাগাতার গাভীলুণ্ঠনের অভিযান করেছিল। মহাভারতে তার উল্লেখ আছে এবং কুরু ও পাঞ্চাল মহাভারতের অন্যতম প্রধান দুই আর্যগোষ্ঠী। আর্যদের কাছে গাভী ছিল মহামূল্যবান পশুসম্পদ, গাভীর সংখ্যা দিয়েই কোন গোষ্ঠীর ঐশ্বর্যের বিচার হত। গোহত্যা ছিল বিরল, বিশেষ অনুষ্ঠান এবং বিশিষ্ট অতিথির সম্মানেই গোহত্যা করা হত, যার জন্যে সম্মানীয় অতিথিকে “গোঘ্ন” বলা হত – যাঁর জন্যে গরু হত্যা করা যায়। অন্যদের গাভীসম্পদ লুঠ করাকে পবিত্র কর্তব্য, “গবিষ্ঠি” বলা হত।

    এই দুই গোষ্ঠীর প্রতিপত্তি ও প্রভাবে এই অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দারাও যথেষ্ট ভাল সংস্কৃত শিখে নিয়েছিল এবং সঠিক বলতেও পারত। এই অঞ্চলের পশ্চিমের এবং পূর্বের বাসিন্দাদের বলা হত “ম্লেচ্ছ”- কারণ তারা সঠিক উচ্চারণে সংস্কৃত বলতে পারত না। সংস্কৃতে এই তিনটি শব্দ - “দাস”, “দস্যু” এবং “ম্লেচ্ছ”-র - পরবর্তী কালে, মোটামুটি খ্রী.পূ. অষ্টম-সপ্তম শতাব্দীতে - অর্থ সম্পূর্ণ বদলে যায়। সমাজের নিম্নতম শ্রেণী হয়ে যায়, “দাস”। উপদ্রব সৃষ্টিকারী সমাজের বাইরের লোক হয়ে ওঠে “দস্যু”। আর বেদ ও আর্যদের সামাজিক বিধি না মানা, সমাজের বাইরের লোকেরা হয়ে উঠল “ম্লেচ্ছ” – মানে অপবিত্র।

    এর থেকে বোঝা যায়, ততদিনে আর্যরা ওই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষদের ভালো ভাবেই আয়ত্ত্ব ও অধীনস্থ করতে পেরেছিল। স্থানীয় মানুষদের ওপর তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে পেরেছিল এবং যার ফলে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। যার জন্যে নিরীহ অনার্য “দাস” মানুষেরা হয়ে উঠল ভৃত্যশ্রেণী এবং “দস্যু” ও “ম্লেচ্ছ”রা হয়ে উঠল ঘৃণা ও বিদ্বেষের পাত্র। অন্যদিকে লড়াকু এবং দুর্দমনীয় বিরোধী অনার্য মানুষেরা তাদের কাছে হয়ে উঠল দৈত্য এবং রাক্ষস। ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পড়তে যাদের সঙ্গে আর্যদের অনেকবারই লড়াই করতে হয়েছিল, এবং আর্যরা বহুবার পরাস্তও হয়েছিল। যদিচ শেষমেষ জিত হয়েছিল আর্যদেরই এবং সমগ্র উত্তর ভারতে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করে, বৈদিক সংস্কৃতি এবং সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল।

    ২.৪.৫ বৈদিক সংস্কৃতি

    বৈদিক সংস্কৃতি বা ধর্ম সম্পূর্ণ বেদ-কেন্দ্রিক। বলা হয় বেদের মন্ত্রগুলি অপৌরুষেয় অর্থাৎ ঐশ্বরিক – কোন জাগতিক মানুষের রচনা নয়। ঈশ্বরের আশীর্বাদ ধন্য কোন কোন ঋষি এই মন্ত্রগুলির দ্রষ্টা - তাঁদের অন্তরে অনুভব করেছিলেন, স্রষ্টা নন। অতএব সেকালের ঋষিদের কাছে এই মন্ত্রগুলির সঠিক মর্যাদায় সংরক্ষণ ছিল অত্যন্ত জরুরি কর্তব্য। সে সময় যেহেতু লিপি ছিল না, অতএব লিখিত সংরক্ষণেরও কোন উপায় ছিল না। সুতরাং বেদের মন্ত্রগুলি এক প্রজন্মের থেকে নির্ভুল শুনে পরবর্তী প্রজন্মকে নির্ভুল মনে রাখতে হত। এই কারণে বেদের অন্য নাম “শ্রুতি”। শুনে শুনে মনে রাখা অর্থাৎ মুখস্থ করার সুবিধের জন্যে মন্ত্রগুলি ছন্দ বা সুরে গাওয়া হত, প্রত্যেকটি মন্ত্রের নিজস্ব ছন্দও ছিল নির্দিষ্ট। আজও স্কুলের পড়া মুখস্থ করার সময়, আমরা দেখি পদ্য বা ছড়া মুখস্থ করা অনেক সহজ কিন্তু নীরস গদ্যে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ মুখস্থ করা দুঃসাধ্য।

    এই মন্ত্রগুলি নির্ভুল মনে রাখার দক্ষতা গোষ্ঠীর সকলের পক্ষে কখনই ছিল না, গোষ্ঠীর কতিপয় মানুষ যাঁরা এই মন্ত্রগুলি বহন করতে পারতেন, তাঁরাই মহর্ষি এবং ঋষি, তাঁরাই পুরোহিত এবং পরবর্তী সময়ে, অতীব সম্মানীয় ব্রাহ্মণ। রণদক্ষ ও পরের পশু লুণ্ঠনকারী বীর যোদ্ধা গোষ্ঠীপতি হলেও, পুরোহিত তাঁর অধীনে নয় বরং তিনিই পুরোহিতের অধীন। প্রথম দিকে বৈদিক সংস্কৃতির এটাই ছিল মূল ধারা। পরবর্তী কালে বৈদিক সমাজেও এর প্রভাব থাকবে, কিন্তু সে প্রসঙ্গ আসবে পরে।
       
    বৈদিক সংস্কৃতিতে অন্যতম প্রধান অনুষ্ঠান ছিল যজ্ঞ। যজ্ঞে একাধিক পুরোহিত থাকা আবশ্যিক ছিল। যে কোন যজ্ঞ অনুষ্ঠানে বেদের মন্ত্রগুলি অত্যন্ত নিষ্ঠায়, সঠিক উচ্চারণে এবং সঠিক ছন্দে অবশ্যই পাঠ করতে হত। আরো সঠিক বললে, বেদের মন্ত্রগুলি গম্ভীর স্বরে এবং নির্দিষ্ট সুরে গাইতেও হত। অগ্নিস্থাপন ছিল যজ্ঞের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। ঋগ্বেদের আগ্নেয় সূক্তের প্রথম মণ্ডলের প্রথম মন্ত্রটির দ্রষ্টা ছিলেন, মহর্ষি বিশ্বামিত্রের পুত্র ঋষি মধুচ্ছন্দ। সেই মন্ত্রটি হল,
    “ওঁ অগ্নিমীডে[6] পুরোহিতংযজ্ঞস্যদেবমৃত্বিজং। হোতারংরত্নধাতমং।” [ সন্ধি ও সমাস ভেঙে নিলে, সূক্তটি বুঝতে কিছুটা সুবিধে হবে, যেমন - ওঁ অগ্নিম্‌ ঈডে পুরোহিতম্‌, যজ্ঞস্য দেবম্‌, ঋত্বিজম্‌ হোতারম্‌, রত্নধাতমম্‌।] সরলার্থ, (আমি এই যজ্ঞে আবাহন করে) অগ্নির অর্চনা করছি। তিনিই (অগ্নিই) এই যজ্ঞের পুরোহিত। (তিনিই এই) যজ্ঞের দেবতা, (তিনিই) হোতাদের মধ্যে ঋত্বিক। তিনিই সর্ব(রত্ন)ফল[7]দাতা।

    কথিত আছে, মনে মনে সূর্যকে স্মরণ করে, মহর্ষিরা এই মন্ত্র উচ্চারণ করলেই যজ্ঞের অরণিতে নিজে নিজেই অগ্নিসঞ্চার হয়ে যেত। আর তা নাহলে বোঝা যেত ঋষির মন্ত্র উচ্চারণে কোন ত্রুটি আছে, অথবা যজমান –অর্থাৎ যাঁর জন্যে যজ্ঞের আয়োজন তাঁর কোন পাপ বা অপরাধ ঘটে গেছে।

    সে যাই হোক, যজ্ঞ যেহেতু বৈদিক ধর্মের প্রধানতম অনুষ্ঠান, অতএব তার প্রতিটি পদে নিয়ম, বিধি-বিধানের শৃঙ্খল ছিল কঠোর। যে কোন যজ্ঞের অনুষ্ঠান হত ত্রিবেদী – অর্থাৎ তিনটি বেদের মন্ত্র উচ্চারণে যজ্ঞ সম্পন্ন করা হত, ত্রিবেদ পাঠের জন্যে তিনজন পুরোহিত আবশ্যিক। ঋক পুরোহিত যজ্ঞের দেবতাদের স্তব বা প্রার্থনা করে আবাহন করতেন, আবাহন শেষে ঋক, যজুঃ এবং সাম পুরোহিতরা যজ্ঞে আহুতি দিতেন। আর পুরো অনুষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণ করতেন অথর্ব পুরোহিত।
     
    একমাত্র অশ্বমেধ যজ্ঞ ছাড়া সব যজ্ঞেই অগ্নি ছিল আবশ্যিক। যে কোন যজ্ঞে তিনটি অগ্নির প্রয়োজন হত –গার্হপত্য, আহ্বনীয় ও দক্ষিণাগ্নি। গৃহে গার্হপত্য অগ্নি সর্বদা জ্বালিয়ে রাখার নিয়ম। যজ্ঞের সময় এই গার্হপত্য-অগ্নি থেকে যজ্ঞের অগ্নি আহুত অর্থাৎ গৃহীত হত বলেই আহ্বনীয় অগ্নিতে প্রধান হোমের অনুষ্ঠান করা হয়ে থাকে। দক্ষিণাগ্নিও গার্হপত্য অগ্নি থেকে গ্রহণ করা হত এবং যজ্ঞের সময় যজ্ঞবেদীর দক্ষিণ দিকে স্থাপনা করা হত। যে ব্রাহ্মণের গৃহের গার্হপত্য অগ্নি থেকে যজ্ঞের আগুনগুলি সংগ্রহ করা হত, তাঁদের অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণ বলা হত, যজ্ঞে তাঁর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
     
    বহু বছর আগে থেকেই মানুষ দৈনন্দিন কাজে আগুনকে আয়ত্বে এনে ফেলেছিল ঠিকই, কিন্তু একবার নিভে গেলে আগুন জ্বালিয়ে তোলা ব্যাপারটা মোটেই সহজ ছিল না। চকমকি পাথর-ঘষা স্ফুলিঙ্গ থেকে শুকনো পাতায় আগুন ধরাতে যথেষ্ট দক্ষতা এবং ধৈর্যের প্রয়োজন হত, বিশেষ করে বর্ষার সময়। সেই কারণে যে কোন গ্রামেই সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে সর্বদাই আগুন সংরক্ষণ করা হত। আগুন সংরক্ষণ যথেষ্ট বিপজ্জনক, কারণ অসাবধানে ভয়ানক অগ্নিকাণ্ড ঘটে যেতে পারত। সেই কারণেই বাড়ির বিশেষ কোন নিরাপদ ঘরে, খুব ছোট প্রদীপ বা ছোট্ট উনুন সর্বদা জ্বালিয়ে রাখা হত। অনার্য গ্রামেও আগুন সংরক্ষণের এমন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।  এই সংরক্ষিত আগুনকেই সংস্কৃতে নাম দেওয়া হয়েছিল গার্হপত্য অগ্নি –গৃহপতির অগ্নি। মন্ত্রবলে আগুন জ্বালানোর ঝুঁকি না নিয়ে, সেই আগুনেই সর্বদা যজ্ঞে অগ্নি সংযোগ করা হত।

    কয়েকটি উল্লেখযোগ্য যজ্ঞের মধ্যে একটি অগ্নিহোত্র যজ্ঞ। যিনি যজ্ঞের জন্যে অগ্নি সংরক্ষণ করতেন, সেই অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণকে দিনে দুবার-সকালে ও সন্ধ্যায় অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করতে হত। সংরক্ষিত আগুনের সীমিত দহনকে নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্যেই দুবেলা নিয়মিত লক্ষ্য রাখাই ছিল এই যজ্ঞের মুখ্য উদ্দেশ্য। এরপর ছিল দশপৌর্ণমাস যজ্ঞ, প্রত্যেক পূর্ণিমা এবং অমাবস্যায় এই যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা হত। চাতুর্মাস্য যজ্ঞ, প্রত্যেক প্রধান ঋতু, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত ও বসন্তর শুরুতে এই যজ্ঞ করা হত। বসন্ত কালে আরেকটি যজ্ঞ করা হত তার নাম অগ্নিষ্টোভ যজ্ঞ এবং নতুন শস্য বা ফসল তোলার পর অগ্রহায়ণ যজ্ঞ করা হত। এই যজ্ঞে উৎপন্ন শস্য নিবেদন বা আহুতি দেওয়া হত। প্রবজ্ঞ যজ্ঞ – এই যজ্ঞ অশ্বিনীকুমার দেবতাদের যজ্ঞ, অগ্নিতে ছাগলের দুধ আহুতি দেওয়া হত। কোন রাজা যুদ্ধ জয় করে ফিরে এলে বাজপেয় যজ্ঞ করার নিয়ম ছিল। এরকম আরেকটি যজ্ঞ ছিল রাজসূয় যজ্ঞ। এই যজ্ঞ করতেন প্রবল ক্ষমতাশালী রাজারা, প্রতিবেশী এবং সকল অধীনস্থ রাজাদের নিমন্ত্রণ করে এই যজ্ঞের আয়োজন ছিল এলাহী ব্যাপার।
     
    সে যুগে অশ্বমেধ যজ্ঞ করাটা খুব বড়ো একটা সম্মান ও প্রতিপত্তির বিষয় ছিল। এই যজ্ঞ সেই সব মহারাজারাই করতেন, যাঁদের প্রতিবেশী রাজ্যের রাজাদের ওপরেও অবিসম্বাদিত আধিপত্য থাকত। নির্দিষ্ট শুভদিনে একটি ঘোড়াকে সামনে রেখে সশস্ত্র সেনাবাহিনীর দল বের হয়ে পড়ত। তারা বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেড়াত এবং বশীভূত রাজাদের থেকে প্রভূত সম্পদ দান হিসেবে আহরণ করত। কোন রাজা ওই ঘোড়াকে আটকালে বা কোন দান না দিলে, সেনাবাহিনী ওই রাজাকে পরাস্ত করত এবং ওই রাজ্য থেকে সম্পদ আহরণ (লুঠ) করে নিয়ে আসত। সেনাবাহিনী সেই রাজাকে পরাস্ত করতে না পারলে, অশ্বমেধ যজ্ঞকারী মহারাজা আরো বড়ো সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে ওই বিরোধী রাজার চূড়ান্ত সর্বনাশের ব্যবস্থা করতেন। সেই আতঙ্কেই প্রায় সমস্ত ছোট ছোট রাজ্যের রাজারা ঝামেলা এবং বিপদ এড়াতে দান দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করতেন। নানান দিকের নানান রাজ্য ঘুরে ঘোড়া আবার স্বরাজ্যে ফিরে এলে, সেই ঘোড়াকে মেধ অর্থাৎ বলি দিয়ে বিপুল ব্যয়বহুল যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা হত।

    বৈদিক সংস্কৃতিতে দেবতার সংখ্যা নেহাত কম নয়। বেদের দেবতাদের তিনটি কোটি বা শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে, যেমন
    ১) পৃথ্বীস্থান-দেবতা অর্থাৎ পার্থিব দেবতাদের মধ্যে প্রধান হলেন, অগ্নি, পৃথ্বী, সোম এবং বৃহষ্পতি। অগ্নি ঋগ্বেদের অন্যতম প্রধান দেবতা, তাঁর উদ্দেশে প্রায় দুশটি মন্ত্র আছে। আবার অন্য অনেক দেবতাদের সঙ্গেও অগ্নির স্তব আছে। পৃথ্বীর উদ্দেশে একটি মাত্র মন্ত্র পাওয়া যায়। সোমদেবের উদ্দেশে প্রায় একশ চোদ্দটি মন্ত্র পাওয়া যায়। সোমদেব বলতে চন্দ্র এবং সোমলতার কথাও বলা হয়েছে। সোমলতারও আরেক নাম অংশু। বলা হয় সোমলতা দ্যুলোকে ছিল এবং পৃথিবীতে এনেছিল কোন পাখি। আবার সোম যখন চন্দ্র তিনি দুই হাতে অস্ত্রচালনা করতে পারেন এবং যুদ্ধের সময় তিনি সর্বদাই ইন্দ্রের সঙ্গে একই রথে থাকেন। ঋগ্বেদে বৃহষ্পতির উদ্দেশে এগারোটি মন্ত্র আছে। বৃহষ্পতিকে অনেক পণ্ডিত অগ্নিরই আরেক রূপ বলে থাকেন।
     
    ২) অন্তরীক্ষস্থান-দেবতা অর্থাৎ আকাশের দেবতাদের প্রধান হলেন ইন্দ্র, পর্জন্য, রুদ্র এবং মরুৎ। ঋগ্বেদে ইন্দ্র হলেন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দেবতা, তাঁর নামে প্রায় আড়াইশটি মন্ত্র আছে। তিনি হিরণ্যবর্ণ। তাঁর রথ সোনার তৈরি এবং সে রথ মনের থেকেও দ্রুতগামী। সকল দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্রই সব থেকে বেশি সোমপান করতেন। ইন্দ্র ছিলেন মহাযোদ্ধা, তিনি বৃত্র, ত্বষ্টা, সুশনা, নমুচি, শম্বর প্রমুখ অনেক দৈত্য এবং রাক্ষসদের হত্যা করেছিলেন। পর্জন্য হলেন বৃষ্টির দেবতা, তাঁর উদ্দেশে মাত্র তিনটি মন্ত্র পাওয়া যায়। রুদ্রর উদ্দেশেও মাত্র তিনটি মন্ত্র পাওয়া যায়। রুদ্র একদিকে বিনাশ করেন আবার অন্যদিকে ভক্তদের বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। মরুতের উদ্দেশে তেত্রিশটি মন্ত্র পাওয়া যায়। মরুতও বৃষ্টি, মেঘ ও বজ্রের দেবতা।
     
    ৩) দ্বৌস্থান-দেবতা অর্থাৎ স্বর্গের দেবতাদের মধ্যে প্রধান হলেন বরুণ, সবিত্র, বিষ্ণু, পূষণ। বরুণের উদ্দেশে বারোটি মন্ত্র আছে। তাঁর সহস্র চোখ। বরুণের অসীম শক্তি – তিনিই আকাশের বিস্তার দিয়েছেন, অশ্বের শক্তি দিয়েছেন, গাভীতে দুধ দিয়েছেন, দ্যুলোকে সূর্য দিয়েছেন এবং পাহাড়ে সোম(লতা) দিয়েছেন। তিনি স্বর্গ থেকে সকলের পাপ-পুণ্য, দোষ-গুণের হিসাব রাখেন এবং পাপীদের পাশবদ্ধ করেন। সবিত্রের উদ্দেশে এগারোটি মন্ত্র আছে। উদীয়মান সূর্যই সবিত্র, তিনি সকল অন্ধকার দূর করেন। ঋগ্বেদের ছটি মন্ত্র বিষ্ণুকে উৎসর্গ করা হয়েছে। সূর্যকিরণের সঙ্গেই বিষ্ণুর প্রকাশ। সর্বদাই অমৃতধারা উৎসারিত হয় যে চিরন্তন বিষ্ণুলোকে, ভক্তরা সেখানেই যাওয়ার কামনা করেন। আটটি মন্ত্র আছে পূষণের উদ্দেশে। পূষণও উদীয়মান সূর্যের সঙ্গে প্রকাশিত হন। পূষণ সকল জীব ও জড়ের দেবতা।

    ২.৪.৬ ব্রাহ্মণ্য সমাজ

    পশ্চিম থেকে পূর্বে গাঙ্গেয় সমভূমি বরাবর উপনিবেশ গড়তে আর্যদের খুব একটা অসুবিধে হয়নি। কারণ সে সময়ে লড়াই করে বাধা দেওয়ার মতো শক্তি স্থানীয় অধিবাসীদের ছিল না। বহুদিন আগে থেকেই কৃষি নির্ভর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায়, তাদের শিকারী-সংগ্রাহী মানুষদের মতো লড়াকু স্বভাব আর ছিল না। উপরন্তু আর্যরা এল ঘোড়া ছুটিয়ে বজ্রের মতো ধারালো এবং সাংঘাতিক কঠিন লোহার অস্ত্র – বর্শা, তীর-ধনুক নিয়ে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তরোয়াল এবং খড়্গ নিয়ে - লড়াই করতে। তাদের সঙ্গে অসম যুদ্ধে প্রাণ হারানো বা আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাদের অন্য কোন উপায় রইল না। পালিয়েই বা যাবে কোথায়, গভীর অরণ্যে গিয়ে তারা করবে কী? তাদের পক্ষে শিকারী-সংগ্রাহী জীবনে আবার ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। সম্ভব ছিল না, যে কোন অরণ্যকে রাতারাতি আবাদী জমি করে তোলা। অতএব আর্যদের অধীনতা মেনে নিতে তারা বাধ্য হল। তাদের বশ্যতায় আর্যদেরও সুবিধা হল খুব। এত জমি চাষ-আবাদ করার মতো তাদের জনবল কোথায় এবং যেটুকু জনবল আছে তাদের এত জমি চাষ করার দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতাই বা কোথায়?
     
    এই সময়েই নতুন সমাজ গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। এবং এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৈদিক সমাজ এবং বৈদিক আদর্শ থেকে আর্যদের অনেকটাই সরে আসত হল। এতদিন তাদের গোষ্ঠীর মধ্যে খুব একটা বৈষম্য ছিল না। গোষ্ঠীপতি বা পুরোহিতের স্থান অনেক বেশি সম্মানীয় হলেও গোষ্ঠী বা পরিবারের সদস্যদের মর্যাদা এবং অধিকার মোটামুটি সমানই ছিল। এখন গোষ্ঠীর সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে লক্ষ্য দিতে হল বৃহত্তর সমাজ গড়ায়। যে সমাজে মোটামুটি সকলের স্থান, মর্যাদা এবং কাজ বা দায়িত্বের সীমানাও স্থির করে দেওয়া হল। আমার মনে হয়, শুধু ভারতের অনার্য অধিবাসীরা নয়, আর্যরাও এরকম সামাজিক সীমাবদ্ধতা এর আগে কোনদিন দেখেনি। সমাজের শ্রেণীভেদ অনার্যদের মধ্যেও ছিল, সেকথা আগেই বলেছি। কিন্তু সে ছিল অর্থনৈতিক শ্রেণীভেদ - ধনী, মধ্যবিত্ত, বণিক এবং দরিদ্র – কিন্তু সে বিভেদ সমাজপতিদের আরোপিত বিধি নিষেধের বিভাজন নয়।
     
    অভূতপূর্ব এই সামাজিক বিন্যাসের শীর্ষে রইল ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণের সংজ্ঞা হল – যিনি ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ পরমজ্ঞান লাভ করেছেন। ব্রাহ্মণদের প্রধান কর্তব্য হল, পৌরোহিত্য অথবা যাজন এবং অধ্যাপনা। পরবর্তী সামাজিক অবস্থানে রইল ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয়দের কর্তব্য-ধর্মযুদ্ধ করা। নিজের এলাকার অধিকার নিরাপদ আয়ত্ত্বে রাখা। প্রয়োজনে এবং যথেষ্ট শক্তিশালী হলে অন্য এলাকা জয় করা। সুযোগ পেলেই পরস্বাপহরণ এবং পশ্বপহরণ। অতএব একজন ক্ষত্রিয়ই হতে পারেন একটি দলের বা গোষ্ঠীর দলপতি বা রাজা – যিনি অবশ্যই ক্ষত্রিয়র সমস্ত কর্তব্য পালন করবেন এবং প্রজাদের ন্যায়-অন্যায় বিচার করবেন। রাজাকে সহায়তা এবং পরামর্শ দেবেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত।
    মহাভারতের এমনই একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলে, বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে,
    কোন এক সময় অজুর্নের সঙ্গে যুদ্ধে গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ পরাস্ত হন, তার পরে তাঁদের মধ্যে অবিশ্যি সখ্যতা গড়ে ওঠে। সেই গন্ধর্বরাজ এবং অর্জুনের কথোপকথনের কিছুটা এখানে তুলে ধরছি,   
    “অর্জুন বললেন, “হে গন্ধর্বরাজ, আমি তোমাকে ব্রহ্মাস্ত্র দান করে, তার প্রতিদানে তোমার গন্ধর্বজ অশ্ব গ্রহণ করব। কিন্তু আমার মনের একান্ত ইচ্ছা, আমাদের সখ্যতা যেন চিরস্থায়ী হয়। হে বন্ধু, যে কারণে আমরা তোমাদের ভয় পাই, আমরা বেদবিদ্‌ সাধু চরিত্রের লোক হওয়া সত্ত্বেও, রাত্রিকালে নদীতীরে আসার জন্যে,  তুমি আমাদের যেভাবে অপমান ও তিরষ্কার করলে, তার কারণ কী? একথা আমাদের খুলে বল।”
    গন্ধর্বরাজ বললেন, “হে অর্জুন, তোমরা অন্ধকারে অগ্নিহীন হয়ে হঠাৎ উপস্থিত হয়েছ, তোমাদের সঙ্গে কোন ব্রাহ্মণও নেই, সেই জন্যেই আমি তোমাদের অপমান ও তিরষ্কার করেছিলাম। তা না হলে, যক্ষ, রাক্ষস, গন্ধর্ব, পিশাচ, উরগ এবং দানবেরাও কুরুবংশের কীর্তি কীর্তন করে থাকে। নারদ প্রমুখ দেবর্ষিদের মুখেও তোমার পূর্বপুরুষদের গুণের বর্ণনা শুনেছি। ত্রিলোক বিখ্যাত দ্রোণ, যাঁর কাছে তোমরা বেদ ও ধনুর্বেদ শিখেছ, তিনিও আমার অত্যন্ত পরিচিত। দেবপ্রধান ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্র ও দুই অশ্বিনীকুমার এবং নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডু তোমাদের পিতা – তাঁদের সকলকেই আমি জানি। তোমরা অতি সচ্চরিত্র, মহাত্মা ও মহাবীর; তোমাদের সঙ্কল্প এবং অধ্যবসায়ের কথা জেনেও, আমি তোমাদের অপমান ও তিরষ্কার করেছিলাম। হে অর্জুন, আমি তখন সস্ত্রীক ছিলাম এবং রাত্রে আমাদের শক্তি দ্বিগুণ বেড়ে ওঠে। যে কোন বীরপুরুষ স্ত্রীর সামনে অপমানিত হলে, ক্ষমা করতে পারে না। এই কারণেই আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলাম। হে বীর, তুমি আমাকে যুদ্ধে পরাজিত করেছ ঠিকই, কিন্তু যে কারণে তুমি জয়ী হয়েছ, সে কথা বলছি শোন।
    ব্রহ্মচর্য সবার থেকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তুমি সেই ধর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছ বলেই, তুমি আমাকে পরাজিত করতে পারলে। যে ক্ষত্রিয় কামনার বশ, সে রাত্রে যুদ্ধ করলে কখনো নিজের প্রাণ রক্ষা করতে পারে না। হে তাপত্য[8], যিনি সনাতন বেদশাস্ত্র পাঠ করে, পুরোহিতের উপর সমস্ত কাজের দায়িত্ব দিয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন, তিনি সমস্ত নিশাচরকে অবশ্যই পরাস্ত করতে পারেন। ইহলোকে যে যে বিষয়ে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব লাভের সম্ভাবনা, সেই সকল বিষয়ে ইন্দ্রিয়দমনশীল পুরোহিতের নিয়োগ অবশ্য কর্তব্য। ষড়ঙ্গ[9]বেদজ্ঞানী, অতি পবিত্র, সত্যবাদী, ধর্মাত্মা ও সুধীর ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠ রাজাদের পুরোহিত হয়ে থাকেন। রাজারা পুরোহিতের সাহায্য নিলে বহুকাল নিশ্চিন্তে রাজ্যপালন করতে পারেন”। [আদি পর্ব/১৭০ অধ্যায়]
    অতএব ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মতো বিচক্ষণ রাজা এবং ভীম ও অর্জুনের মতো মহা পরাক্রমী বীর ক্ষত্রিয়দেরকেও উপদেষ্টা পুরোহিতের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল, তিনি ঋষি আয়োদধৌম্য।   

    ক্ষত্রিয়র নিচে সামাজিক অবস্থান হল বৈশ্যদের। বৈশ্যদের কর্তব্য হল কাজ করা, সে কাজের কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই। কৃষক, বণিক, বিভিন্ন পেশার মানুষ, সূত্রধর, কর্মকার, কুম্ভকার, স্বর্ণকার। তাদের দায়িত্ব সমাজের সকলের অন্নসংস্থান করা, প্রয়োজনীয় সামগ্রী বানানো, অলংকার, বিলাসদ্রব্য তৈরি করা। উদ্বৃত্ত সামগ্রী বাণিজ্য করে রাজ্যের এবং রাজার অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করা।
     
    সমাজের নিম্নতম স্তরে রইল শূদ্র। শূদ্রদের কর্তব্য সমাজের ঊর্ধতন তিন শ্রেণীর সেবা করা। তারা যে শূদ্রদের তুলনায় অনেকটাই উচ্চশ্রেণীর মানুষ, সমাজে সেই ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের উপনয়নের অধিকার দেওয়া হল।

    চলবে...
    (দ্বিতীয় পর্বের পঞ্চম অধ্যায় আসবে ২০/০৫/২২ তারিখে)
     
    গ্রন্থ ঋণঃ
    ১) The penguin history of Early India – Romila Thapar
    ২) বাঙ্গালীর ইতিহাস (প্রথম পর্ব) –ডঃ নীহাররঞ্জন রায়।
    ৪) বেদ ও ভারতের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য – স্বামী সমর্পণানন্দ, রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়, বেলুড়মঠ।
    ৩) The wonder that was India – A. L. Basham.
    ৪) মহাভারত (মূল সংস্কৃত থেকে বঙ্গানুবাদ)–মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ।

    [1] কার্নেলিয়ান (carnelian) সিলিকা গোষ্ঠীর উজ্জ্বল লাল কিংবা কমলা রঙের মূল্যবান খনিজ পাথর। বিশ্বের বহুদেশেই ভীষণ জনপ্রিয় এই পাথরের কাজেও সিন্ধুসভ্যতার অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল।

    [2] সোয়াৎ উপত্যকা (Swat valley) সম্প্রতি বিখ্যাত হয়েছে অসমসাহসী ও লড়াকু একটি কিশোরী মেয়ের জন্যে, যাঁর নাম মালালা ইউসুফজাই। তাঁর জন্ম স্থান উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াৎ জেলায়।  

    [3] এই ধরনের ঘর বানানোর প্রযুক্তিকে ইংরিজিতে Wattle and daub বলে। বিশেষজ্ঞর বলেন প্রায় ৬০০০ হাজার বছর আগে থেকে শুরু হয়ে, আজও বিশ্বের বহু সমাজে এই প্রযুক্তি প্রচলিত রয়েছে।

    [4] এই লেখার ১.৭.১ অধ্যায়ে লিখেছিলাম, হোমো স্যাপিয়েন্সদের কিছু গোষ্ঠী প্রায় ২৫,০০০ হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়ার দিকে গিয়েছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে কয়েক হাজার বছর পরে তারাই আবার দক্ষিণদিকে রওনা দিয়েছিল, নতুন এলাকার খোঁজে।  

    [5] মিত্র ঋগ্বেদীয় দেবতা – ভোরের আলো, এবং নবীন সূর্যের নাম মিত্র।

    [6] সাধারণতঃ এই মন্ত্রটিতে “ঈডে”-র জায়গায় “ঈলে” পাঠ দেখা যায়, আমি মহারাজ স্বামী সমর্পণানন্দর পাঠ ও ব্যাখ্যা অনুসরণ করেছি। দুটি শব্দেরই অর্থ অবিশ্যি একই, বন্দনা বা অর্চনা করা। 

    [7] এই “রত্ন” শব্দের ব্যাখ্যা বিগত হাজার বছরে বহু ধরনের করা হয়েছে। রত্ন বলতে আমরা দামি পাথর যেমন মণি-রত্ন বা শ্রেষ্ঠ বস্তু বা ব্যক্তি, যেমন কবিরত্ন বুঝি। বেদের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার সায়নাচার্য এই অর্থগুলির সঙ্গে বলেছেন, যজ্ঞের উদ্দেশ্য তো শুধু মণিরত্ন লাভ করা নয়, প্রচুর শস্য-সম্পদ, সুস্থ সন্তান, যুদ্ধ জয়, এমনকি শান্তিও হতে পারে। অতএব “রত্ন” অর্থে এখানে “ফল” বা সাফল্য।  

    [8] তাপত্য অর্থাৎ তপতীর সন্তান। তপতী সূর্য কন্যা, তিনি পাণ্ডবদের পূর্বপুরুষ মহান রাজা সম্বরণের পত্নী ছিলেন। অতএব পাণ্ডবদের তিনি প্রবৃদ্ধাপিতামহী।   

    [9] বেদের জ্ঞানকে ছটি অঙ্গে ভাগ করা হয়েছে – শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ। এই ষড়ঙ্গ জ্ঞানই সম্পূর্ণ বেদজ্ঞান।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৩ মে ২০২২ | ১৪৮৯ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • হীরেন সিংহরায় | ১৩ মে ২০২২ ০২:১৭507560
  • প্রান ভরিয়ে তৃষা হারিয়ে মোরে আরো আরো দাও জ্ঞান! 
     
     
    ধন্য হলাম 
  • Amit | 103.6.116.9 | ১৩ মে ২০২২ ০৬:৩৯507564
  • খুব ভালো লেখা। আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। দু একটা প্রশ্ন আছে যদি সময় পান। আমি রামায়ণ ​​​​​​​বা ​​​​​​​মহাভারতের ​​​​​​​বা বেদ -কোনোটারই মূল ​​​​​​​ভার্সন ​​​​​​​গুলো ​​​​​​​পড়িনি , জাস্ট কিছু ​​​​​​​রেফারেন্স ​​​​​​​লেখাপত্তর মাত্র । ​​​​​​​গুরুতেই ​​​​​​​আগে অনেকে ​​​​​​​​​​​​​​লিখতেন-যেমন ডিডি দা । ​​​​​​​সেগুলো ​​​​​​​পড়েও ​​​​​​​খুব ভালো ​​​​​​​লেগেছিলো । 
     
    ১। বেদ এর সময়কার যেসব দেবদেবী , আজকে প্রায় তাদের কারোর মন্দির খুঁজে পাওয়া যায়না। তাহলে মন্দির কনসেপ্ট টা কি আর্য্যদের সময় ছিলই  না ? নাকি ওটা অনার্য্য দের সাথে এসিমিলেশন এর পরে এসেছে ?
     
    ২। ব্রম্মা -বিষ্ণু-মহেশ্বর এই কনসেপ্ট টা কোথা থাকে এলো ? আর্যরা নিজেদের দেবতা দের ওপরে এদেরকে বসালো কেন ? কিছু লেখায় পড়েছি শিব অনার্য দেবতা ? তাহলে অনার্য দেবতা কে ইন্দ্র ইত্যাদি র ওপরে দেখানো টা কালচারাল ডমিনেশন কে কিভাবে প্রমাণিত করে ? 
     
    ৩। রামায়ণ বা মহাভারতের টাইম লাইন কিভাবে ধরেছেন ? মহাভারত যেমন অনেকটাই উত্তর ভারতের গল্প। সেখানে রামায়ণ অনেকটা পুব দিকে সরে এসেছে। আর্যরা পশ্চিম থেকে এলে রামায়ণ পরে লেখার কথা , কিন্তু গল্পের বুনোটে রামায়নকে এক যুগ আগে দেখানো হয়েছে। ব্রাম্মন আধিপত্য ও রামায়ণে বেশি যেটা পরে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। 
     
    এখানেই ডিডি দা লিখেছিলেন রামায়ণ বা মহাভারত দুটোই সম্ভবত গুপ্তযুগে লেখা হওয়ার সম্ভাবনা। সেটা র টাইম লাইন ৩০০-৫০০ এডি। সেটা হলে সেগুলোর কথাকে বা যুদ্ধের বর্ণনা কে আর্য্য যুগের রিপ্রেসেন্টেটিভ ধরা যায়কি ? আর সেগুলো যদি আরো আগের পিরিয়ড এ হয় আপনার মতে তার জন্যে আপনি কি কি রেফারেন্স ধরেছেন একটু জানাবেন ?
     
    লোহা বা তামা নিয়েও দু একটা প্রশ্ন আছে। করছি পরে। 
     
     
  • Kishore Ghosal | ১৩ মে ২০২২ ২৩:১৯507590
  • @হীরেন স্যার, আজকাল বাংলায় "অনুপ্রেরণা" শব্দটা রীতিমতো বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, আপনি বিদেশে থাকেন, হয়তো সম্যক অবহিত নন। তাই - আপনার অনুপ্রেরণায় বলতে পারলে ভাল হতো, কিন্তু তা না বলে - বলি, আপনার প্রোৎসাহে লেখাটা মনে হচ্ছে সঠিক লক্ষ্যেই এগোচ্ছে।  
  • Kishore Ghosal | ১৩ মে ২০২২ ২৩:৩৩507591
  • @ অমিতবাবু, আপনার তিনটি প্রশ্নই মোক্ষম এবং বিশ্বাস করুন, এগুলির উত্তর দেওয়ার জন্যেই আমি এই লেখাটা শুরু করেছি। তবে এখনই আপনার প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিতে গেলে, ঐতিহাসিক ঘটনার পারম্পর্য বিঘ্নিত হবে। তাতে প্রত্যেকটি ঘটনা কী ভাবে ও কেন ঘটেছিল, এবং তার ফলে আমাদের এখনকার  ধর্ম  বিশ্বাসে  আমরা  ঠিক কবে পৌঁছলাম, সেটা বোঝা যাবে না।
     
    কাজেই প্লিজ, একটু ধৈর্য নিয়ে সঙ্গে থাকুন, পড়তে থাকুন, আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর, আশা করি, আমি দিতে পারবো।     
  • হীরেন সিংহরায় | ১৩ মে ২০২২ ২৩:৩৬507592
  • কিশোর 
     
    পুরনো গল্প মনে পডলো । তরুন তারাশংকর বীরভূমের লালপুর গ্রামে বসে লিখে যাচ্ছেন দুরু দুরু বলে লেখা পাঠাচ্ছেন। উত্তর পান না । একদিন পেলেন এক লাইনের চিঠি - প্রখ্যাত সম্পাদক দিকপাল পবিত্র গাংগুলির কাছ থেকে । 
     
    আপনি এতদিন চুপ করিয়া ছিলেন কেন?
     
    আপনাকে সেই কথা বলছি।
     
    আমার বাল্যকালে এমন বই পেলে সমৃদ্ধ হতাম। কিছুই না জেনে স্কুল শেষ করেছি। শিখতে জানতে চাই। 
  • হীরেন সিংহরায় | ১৩ মে ২০২২ ২৩:৩৮507593
  • লালপুর নয় লাভপুর গ্রাম 
     
    দুরু দুরু বলে নয় বক্ষে হবে 
     
    মারজনা চাই 
  • Kishore Ghosal | ১৪ মে ২০২২ ০০:০৪507596
  • @ অমিতবাবু, রামায়ণ, মহাভারত, বেদের মূল ভার্সান আমিও পড়িনি। আমার তো মনে হয়, ভাগ্যিস পড়িনি। ব্যাখ্যাকার ও টীকাকারের টিপ্পনি ছাড়া - এই গ্রন্থগুলি পড়ে সম্যক উপলব্ধি আজকের যুগে খুব কম লোকই করতে পারেন। এবং যাঁরা পারেন, কোন না কোন প্রাতিষ্ঠানিক  মতাদর্শের খপ্পরে তাঁদের চিন্তাভাবনাগুলো বাঁধা পড়ে যায়। 
     
    খুব সামান্য উদাহরণ দিই, ছোট্ট গ্রন্থ "শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা"-র  ব্যাখ্যা ও টীকা সহ অজস্র অনুবাদ প্রকাশ পেয়েছে।  তার মধ্যে বাংলায় অন্তত পাঁচটি, ইংরিজিতে দুটি এবং হিন্দিতে একটি অনুবাদ গ্রন্থ পড়ে - আমার এমনই ধারণা হয়েছে, যে সকলেই দুর্দান্ত পণ্ডিত,   কিন্তু সকলেই কোন না কোন ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ  এবং তাঁদের  প্রয়াস থাকে নিজ নিজ ভাবাদর্শের সমর্থনেই ব্যাখ্যাগুলিকে প্রতিষ্ঠা করার। 
     
    সেদিক থেকে  বাংলায় শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন সিংহ -র  মহাভারত, এবং  শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের রামায়ণ যথেষ্ট নিরপেক্ষ বলেই আমার মনে হয়েছে। অনর্থক ব্যাখ্যা দিয়ে পাঠককে গভীর তত্ত্ব বোঝানোর তেমন কোন চেষ্টা ওঁনারা করেননি।                
  • Kishore Ghosal | ১৪ মে ২০২২ ০০:১৪507597
  • @ হীরেনস্যার, আপনার জবাব নেই। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, তারাশংকরের মতো সহজিয়া - মাটির গন্ধমাখা  গদ্যকার ও গীতিকার বাংলা সাহিত্যে আর দুটি নেই।  তাঁর প্রসঙ্গ জুড়ে দিলেন আমার সঙ্গে!!! 
  • Ayantika | 2400:1a00:b040:f2da:1c32:453c:3a4d:3e69 | ১৪ মে ২০২২ ১৪:৫৩507617
  • একটাই শব্দ উপযুক্ত লাগছে - unputdownable - (সত্যজিৎ রায় এর প্রতি কৃতজ্ঞ শব্দটির সাথে পরিচয় করানোর জন্য :))
  • Indra Mukherjee | ১৪ মে ২০২২ ২০:৪৫507632
  • এত বিতর্কিত বিষয়! কাকে মেনে নি ? Aryan immigration theory র মত অন্য কোনো subject এ এত মারপিট হয় নি বোধহয় ।
  • Kishore Ghosal | ১৫ মে ২০২২ ১১:৩১507655
  • @ অয়ন্তিকা ম্যাডাম, আপনার এমন প্রশংসার মর্যাদা যেন শেষ অব্দি রাখতে পারি। অনেক ধন্যবাদ। 
     
    @ ইন্দ্র বাবু, কে বা কারা খাঁটি আর্য এবং কারাই বা ভেজাল আর্য এই বিষয়ে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিশ্বের বহু দেশে - বিশেষ করে ইওরোপে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল - যার নিকৃষ্ট ফসল সম্ভবতঃ জার্মানি ও হের হিটলার!  এ ইতিহাস হীরেনস্যার বিস্তারিত বলতে পারবেন। 
    আপাততঃ সে বিতর্কের অবসান হয়েছে।  জানিনা ভবিষ্যতে আরও নতুন কোন তত্ত্বের উদ্ভব হবে কিনা। 
  • হীরেন সিংহরায় | ১৫ মে ২০২২ ১৬:৫৪507672
  • কিশোর 
     
    কোন বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন ? মনে আছে - ইন টু হোয়াট ডেনজারস  উড ইউ লিড মি  ক্যাসিয়াস ( কিশোর ) দ্যাট ইউ উড হ্যাভ মি সিক ইন টু মাইসেলফ ফর দ্যাট হুইচ ইজ নট ইন মি  ( জুলিয়াস সিজার প্রথম অংক প্রথম দৃশ্য ) ?  
     
    প্রথমেই বলে রাখি  ইহুদি বিদ্বেষ বা নিধন যেমন নাৎসি আবিষ্কার নয় , আর্য মহত্ত্ব বা তাঁদের সুপারম্যানের তকমা দেওয়ার কাজটি অনেকদিন আগেই সুসম্পন্ন করেছেন ইউরোপীয় গুণী ব্যক্তিগণ।  এই ধরুন ফরাসি চিন্তক আরথার গবিনো ( ১৮১৬-১৮৮২) তিনি আর্যদের মহা উন্নত একটি বিশেষ জাতির আখ্যা দিয়েছিলেন – সুপারম্যান জার্মান নৃতাত্ত্বিক ফিশার  আফ্রিকার কালো মানুষের মাথার খুলি পরীক্ষা করে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হন ১৯০৪ সালে হিটলার তখনো স্কুলের ছাত্র। জার্মান কাইজারের আমলে এই আর্য মহিমা কথা বাজারে চালু ছিল । অতএব তাদের নিয়ে  বাগাড়ম্বর শুরু করার কৃতিত্ব হিটলার এবং নাৎসি দলকে দেওয়া সমীচীন নয় । এঁরা এই থিওরিটি ব্যবহার করেছেন শুধু তাই নয় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হতেই একটি ফিল্ম ক্রুকে তিব্বতে পাঠানো হয় এ বিষয়টি নিয়ে একটি প্রামাণ্য তথ্যচিত্র বানাতে ! আমার গল্প লম্বা করছি না,অভয় দিলে পরে করব । 
  • Kishore Ghosal | ১৫ মে ২০২২ ২১:৪৭507693
  • স্যার, আপনার কথা শুনবো বলেই বসে আছি। 
    সম্ভবতঃ আমাদের মহান ভারতবিদ মক্ষমূলারও (Maxmuller) সে বিশ্বাসের বাইরে নন। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন