এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  সমাজ

  • এক ব্যর্থ স্কলারশিপের গল্প

    স্বাতী রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | সমাজ | ১৭ এপ্রিল ২০২২ | ২৫১২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৪ জন)
  • এই গল্পে জানার থেকে না-জানার অন্ধকার বেশি। আর কোথা থেকে যে শুরু করব তাও জানি না। এর শুরু কি সেই ষষ্ঠদশ শতকের অ্যান্টোনিও মহোদয়কে দিয়ে, যিনি পর্তুগালের রাজার হুকুমে ভারতে পাড়ি দিয়েছিলেন? পর্তুগীজ সামাজ্য বিস্তারের রাজকীয় স্বপ্নে বিভোর হয়ে আলবুকার্কের নেতৃত্বে যুদ্ধে মেতে উঠেছিলেন? না, থাক, মানুষ-মারা যুদ্ধবাজদের কথা অন্যসময়। আজ একটু অন্য রকম যুদ্ধের গল্প হোক।
     
    আমাদের গল্পের যবনিকা যখন উঠছে, তখন অ্যান্টোনিওর বংশধরদের রক্তের অন্তর্গত যুদ্ধের কল্লোল স্তিমিত। অবস্থার প্যাঁচে পড়ে। পর্তুগীজ প্রভুত্বের দিন শেষ ভারতে। এ দেশে তখন ব্রিটিশরাজ কায়েম হয়েছে। আর আগের দোর্দন্ডপ্রতাপ প্রভুরা এখন সব খুইয়ে ইংরেজদের তাঁবেদারি করছেন। আর পর্তুগীজ পদবিখানা এখনও বজায় থাকলে কী হয়, তিনশ বছরের বেশি ভারতবাস এঁদের রক্তের ইউরোপীয়ান বিশুদ্ধতা ঘুচিয়ে দিয়েছে। জন্ম দিয়েছে এক মিশ্ররক্তের জাতের। সেই আমলের ভাষায়, ইউরেশিয়ান। মান্যিগন্যি ইংরেজদের চোখের কাঁটাও বটে, আবার অন্য একদিক দিয়ে বড় ভরসার জায়গাও বটে। এঁরাই তো সচল রাখেন রেলওয়ে, পোস্টের মত সব অত্যাবশ্যক সার্ভিস। খেটে খাওয়ার কাজে এঁদের জুড়ি নেই। এই রকমই একজন রেলওয়ে কর্মী ছিলেন জন রিচার্ড ডি আব্রু।
     
    ততদিনে অ্যান্টোনিওর বংশের লোকজন ভারতময় ছড়িয়ে পড়েছে। একটি শাখা এসে খুঁটি গেঁড়েছে কলকাতায়। সেই বংশে জন রিচার্ডের জন্ম, ১৮২৬ সালের কলকাতায় । জন বিয়ে করেন আমেলিয়া মারি ব্লন্ডকে। ন’টি সন্তানের জন্ম দিয়ে আমেলিয়া মারা যান। ১৮৬৫ সাল। এলেন বারবারার বয়স তখন মাত্র দুই এর আশেপাশে।
     
    এলেন জন্মেছেন ১৮৬৩ সালে, ঢাকায়। সেখানে তখন জমজমাট ইউরেশিয়ান কলোনি। তবে ঠিক কী সূত্রে অ্যামেলিয়া তখন ঢাকায় ছিলেন তার হদিশ পাইনি। এরপর একটা বড় ফাঁক -  এলেনের এরপরের খবর আসছে কানপুর থেকে। কানপুর তখন ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের এক জমজমাট রেলশহর, বেশ বড়সড় এক রেল কলোনিও আছে সেখানে। এলেন সেখানে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন।  ১৮৭৯ সালের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পাসের তালিকায় দ্বিতীয় বিভাগে জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম। গোটা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে এর আগে মাত্র দুটি কন্যা এই কৃতিত্বের ভাগীদার। চন্দ্রমুখী আর কাদম্বিনী। এলেন যে স্কুলের থেকে পরীক্ষা দিলেন, তার নাম কানপুর গার্লস স্কুল। এই স্কুল নিয়ে এই ফাঁকে দুকথা বলে নিই। এটা তৈরির কৃতিত্ব এক আমেরিকান মিশনারি মহিলার। ইসাবেলা থোবার্ন। আমেরিকার উইমেন্স ফরেন মিসনারি সোসাইটির তরফ থেকে তিনি ভারতে আসেন ১৮৭০ সালে। তখন ভারতে মেথডিক্যাল চার্চের কাজকর্মের একটা বড় কেন্দ্র হল লক্ষ্ণৌ। সেখানেই কাজ শুরু করলেন ইসাবেলা। কিন্তু তখন কাজ বলতে জেনানা মিশনের কাজ। তাতে মন উঠল না মেমসাহেবের। তাঁর মনে হল ইংরেজি যাদের কথ্যভাষা, সেই ইউরোপিয়ান ও ইউরেশিয়ান মেয়েদের শিক্ষার  জন্য কিছু করা দরকার। তারা যাতে পরবর্তী জীবনেও মিশনের কাজ চালিয়ে যেতে পারে। ব্যস খুলে ফেললেন স্কুল। ছ’জন বালিকা নিয়ে যাত্রা শুরু, তার দুজন আবার ইউরেশিয়ান। কিছু পরে আরেকটি ইংলিশ গার্লস স্কুল খোলা হল কানপুরে। প্রথম ক’বছর ইসাবেলাই লক্ষ্ণৌ-কানপুর যাতায়াত করে দুটো স্কুলই চালাতেন। তারপর কানপুরের স্কুলের দায়িত্ব নেন মিস ইস্টন। এঁর আমলেই, এলেনের দৌলতে কানপুর গার্লস স্কুলের নাম উঠল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায়। অনেক মিশনারিদের লেখাতেই অবশ্য পড়ছি যে উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে মেয়েদের মধ্যে এলেনই প্রথম এন্ট্রান্স পাস করেছেন বলে। তখনকার অফিসিয়াল রেকর্ড অনুসারে সেটাই সত্য যদিও। দেরাদুনের চন্দ্রমুখী সবার হয়ে দুয়ার খোলালেন, তবু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাফিলতিতে তাঁর জীবদ্দশায় সামান্য স্বীকৃতিটুকু পেলেন না। আমরা অবশ্য চন্দ্রমুখীকেই পথিকৃত হিসেবে জানব।
     
    এলেন যখন স্কুলে পড়ছেন, ততদিনে মেয়েদের সেবাময়ীর ভূমিকাটি বেশ দৃঢ়প্রোথিত হয়ে গেছে। মেয়ে-শিক্ষিকা চাই, মেয়ে স্বাস্থ্যকর্মী চাই। আমাদের মেয়েরা শিক্ষিকা হোক, নার্স হোক। শিক্ষাদানের মাধ্যমে, শুশ্রূষাদানের মাধ্যমে সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়া – এই তো আদর্শ মেয়েদের কাজ। মেথডিস্ট চার্চের মিশনারি মহিলাদের মুখে মুখে এই কথা ঘোরে। এলেনও নিশ্চয় শুনেছেন। কতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন? তা বোঝার কোন উপায় নেই কোন। তেমনই আমরা জানতে পারব না এলেন কেন উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হলেন।  কেন আর দশটা ইউরেশিয়ান মেয়ের মত একটু পড়তে শেখা, একটু সেলাই-ফোঁড়াই , একটু নাচতে শেখা এই যা সব নিয়ে সাধারণ ইউরেশিয়ান মেয়েরা সন্তুষ্ট থাকত,এলেন কেন তার সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে তাকাতে চাইলেন?    
    তখনকার সাধারণ চাকুরিজীবি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বাড়িতে কি খুব পড়াশোনার চর্চা ছিল, বিশেষত মেয়েদের মধ্যে? ১৮৮২ সালের তথ্য থেকে পাই তার থেকে দেখা যায় যে ইউরোপিয়ান আর ইউরেশিয়ানদের মধ্যে, অন্তত কলকাতায়, প্রাইমারি বিভাগে মেয়েদের ভর্তির হার ছেলেদের প্রায় দ্বিগুণ। খুবই আশ্চর্য তথ্য। তবে মিডল স্কুলে গিয়েই এই অনুপাত উলটে যাচ্ছে। বিভিন্ন আংলো-ইন্ডিয়ান স্মৃতিকথার টুকরো-টাকরা যা হাতে এসেছে, তার থেকে এও ধারণা করা যায় যে ইউরেশিয়ান মেয়েদের অক্ষরজ্ঞান দরকার এই অবধি ঠিক আছে, তবে তার থেকে খুব বেশি শিক্ষার দরকার বলে কেউ ভাবেন নি সেই সময়। ওই প্রাইমারি স্কুলই ঢের। অবশ্য এই জনগোষ্ঠীর ছেলেরাও যে খুব বেশি দূর পড়াশোনা করতেন এমন তো নয়। আলাদা করে শ্রেণিবিভাগ করা থাকত না বলে একদম সঠিক করে বলা শক্ত, তবে এলেন যে বছর এন্ট্রান্স বা এফ এ পাস করেছেন সেই সেই বছরের তার সহপাঠীদের তালিকায় কিন্তু সাহেবি নামের ছাত্রের সংখ্যা নেহাতই হাতে গোণা। 
     
    ইন্ডিয়ান রেলওয়ে অবশ্য তখন ছেলে-মেয়ে উভয়ের শিক্ষার জন্যেই কিছু কিছু স্কুলকে অনুদান দিত। আর এমনিতে মোটামুটি কিছুটা পড়াশোনা করলে আর খেটে খেতে জানলে সাধারণতঃ ইউরেশিয়ান ছেলেদের তখন চাকরির অভাব হত না। কিন্তু মেয়েদের জন্য উনবিংশ শতকের শেষের দিকে সদ্য চাকরির বাজার খুললেও, সে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি তখনও। একেবারে হতদরিদ্র ইউরেশিয়ান বাড়ির মেয়েদের কথা আলাদা, তাঁদের জন্য রয়েছে ব্রিটিশরাজের ছোঁট-বড়-মাঝারি সাহেবদের বাড়ির ‘ডোমেস্টিক সার্ভিস’। কিন্তু তা বাদে বাকি ইউরেশিয়ান মেয়েদের তখনও টিঁকে থাকার, আরও একটু উন্নত জীবন পাওয়ার একমাত্র উপায় বিবাহ। আর কে না জানে বিয়ে করে সংসার চালাতে আর যাই হোক বই-পড়া বিদ্যের দাম নেই। মানে লোকে তেমনই ভাবে।  এই সব মিলিয়ে রেলওয়ে কলোনির মেয়েদের মধ্যে পড়াশোনা তখনও তেমন একটা দাঁত ফোটাতে পারেনি।   

    এলেনের পারিবারিক পরিবেশের খবরও তেমন মেলে না। তাই বলা মুশকিল সতেরটি সন্তান নিয়ে জন রিচার্ড ঠিক কেমন সংসার পেতেছিলেন কানপুরে? এলেনের দিদি-বোনেরা ঠিক কেমন ছিলেন, তাঁরা কতটা মোটিভেট করেছিলেন এলেনকে এই সবই অজানা। খুব সম্ভবত এলেনকে নিজেই নিজের পথ কেটে তৈরি করতে হয়েছিল। কতটা পরিশ্রমের ছিল সে কাজ? তবে তাঁদের পরিবারেরই আরেকজন, খুব সম্ভবত তিনি এলেনের খুড়তুতো ভাই, স্বনামখ্যাত জীববিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ডি আব্রু প্রথমে স্কুলের শিক্ষক আর পরে নাগপুরের সেন্ট্রাল মিউজিয়ামের কিউরেটর হয়েছিলেন। তাই ভাবতে ভাল লাগে যে হয়ত তাঁদের পরিবারে কিছুটা হলেও পড়াশোনার ধারা ছিল যা তাঁকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। তবে সবই অনুমান।      
     
    এসব কোন ভাবনাই এলেনকে দমাতে পারে না। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করেই এলেন থামলেন না। আরও পড়বেন তিনি। কিন্তু কানপুরে তো আর মেয়েদের পড়ার ব্যবস্থা নেই। অতএব আসতে হল কলকাতায়। বেথুন কলেজে। সেখানে এলেনের এক ক্লাস আগে পড়ছেন কাদম্বিনী। কাদম্বিনী ১৮৮০ সালে ফার্স্ট আর্টস বা এফ এ পাশ করলেন, আর ১৮৮১ সালে এলেন। এদিকে সে বছরই ( ১৮৮১ সালে) অবলা দাশ নামের একটি কন্যাও এন্ট্রান্স পাস করেছে।
     
    এরপর এলেনের জীবন যে খাতে বইল, তাতে একটা বড় ভূমিকা কালের। মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের কিছুটা উপায় হওয়ার পরে বাংলার বিদ্যোৎসাহীদের এবার নজর পড়েছে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার দিকে।  ক’বছর আগে থেকেই ইউরোপে মেয়েদের চিকিৎসাবিদ্যা শেখার বেশ চল হয়েছে। সেই দেখে এদেশেও কিছু প্রগতিশীল মানুষ খুব উৎসাহিত। ১৮৮২ সালের  জুলাই  মাসের বামাবোধিনী জানাচ্ছে, বাখরগঞ্জ হিতৈষণী, শ্রীহট্ট সম্মিলনী, বিক্রমপুর সম্মিলনী,  ফরিদপুর সুহৃৎসভা এবং পশ্চিম ঢাকা হিতকরী সভা মিলে বাংলাদেশের  শিক্ষাবিভাগের সভাপতি ক্রফট সাহেবের কাছে স্ত্রী-শিক্ষার উন্নতির জন্য আবেদন জানাচ্ছেন, সেখানে অন্যতম দাবী হল কলকাতা মেডিকেল কলেজে মেয়েদের ডাক্তারি শেখার ব্যবস্থা করা। সরকারেরও এই কাজে উৎসাহ আছে। কিন্তু কলেজ কাউন্সিলের সেই প্রস্তাবে ঘোর আপত্তি।
     
    অথচ মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজ আগেই মেয়েদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে। ইংরেজ দুহিতা Mrs. Mary Scharlieb, আর ইউরেশিয়ান Miss Dora White, Miss Beale ও Miss Mitchelle  ১৮৭৫ সালে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছেন আর ১৮৭৮ সালে সসম্মানে পাস করে বেরিয়েছেন। সেখানেও কাজটা খুব যে সহজ ছিল তা না। মেয়েদের পড়ার ব্যাপারে সরকারী হুকুম যদিও বা মিলেছিল, এবং অবশ্যই কিছু প্রফেসরদের সমর্থনও তাঁরা পেয়েছিলেন, তবু আবার অন্য একদল প্রফেসরদের অসহযোগিতা সহ্য করতে হয়েছিল মেয়েদের। মেরির আত্মকথাতে পাই যে উইমেন্স হাসপাতালের সুপারিনটেন্ডেন্ট ডঃ ব্র্যানফুট তাঁদের বলেছিলেন, সরকার তাঁদের ওঁর কাছে পাঠিয়েছেন আর সরকারী কর্মচারী হিসেবে সে হুকুম মানতে তিনি বাধ্য। তাই তাঁদের হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়ান তিনি ঠেকাতে পারবেন না। কিন্তু তিনি তাঁদের কিছু পড়াবেনও না। এই হল তখনকার ছবি। ভারতের বলে শুধু নয় কিন্তু, খোদ ইংল্যন্ডেই অনেক বিরোধিতা সয়ে মেয়েদের মেডিক্যাল শিক্ষার কলেজ খোলা হয়েছে মাত্রই ১৮৭৫ সালে, যে বছর মেরিরাও এখানে কলেজে ঢুকলেন। একমাত্র আমেরিকাই একটু যা এগিয়ে। সেখানে ১৮৪৯ সালে এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল এম ডি হয়েছেন।  
     
    মেরি তাঁর আত্মকথাতে বলেছেন যে তাঁরা এলএমএস ডিগ্রি পেয়েছিলেন, কিন্তু সরকারী নথি অনুসারে তাঁরা সেকেন্ড ডিপার্টমেন্টের ছাত্র ছিলেন, সেই পড়া অ্যাপোথেকারি গ্রেডের জন্য।  LMS পড়ার নূন্যতম যোগ্যতা হল ম্যাট্রিকুলেশন পাস। এই চার কন্যা কেউ তা ছিলেন না।  সরকারি মতে  Mrs. Alice Van Ingen হলেন  মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজের প্রথম LMS ডিগ্রিধারী।  মেরি এবং অ্যালিস দুজনেই অবশ্য পরে যথাক্রমে লন্ডন এবং ব্রাসেলস থেকে উচ্চতর পাঠ নিয়ে চিকিৎসার কাজে নিজেদের ডুবিয়ে দেন। অ্যালিস কিছুদিন কলকাতাতেও ছিলেন সরকারি মেয়েদের হাসপাতালের দায়িত্ব নিয়ে। পরে ইনি খুব সম্ভবত শ্রীলঙ্কায় চলে যান। মেরি ১৮৮৪ সালে মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজের মেয়েদের বিভাগের ধাত্রীবিদ্যার লেকচারার হিসেবে যোগ দেন এবং ১৮৮৭ সালের গোড়া অবধি সেখানেই পড়াতেন। তারপর তিনি ইংল্যন্ডে চলে যান ও সেখানে প্র্যাকটিস করেন।
     
    আমাদের গল্পে ফিরি। মাদ্রাজে মেয়েরা মেডিক্যাল কলেজে ডিগ্রির পড়ার জন্য ঢুকতে পারলেও, কলকাতার ডিগ্রি কোর্সে তখনও মেয়েদের প্রবেশ নাস্তি। মেয়েরা মিডওয়াইফারি বা ধাত্রীবিদ্যা জানবে, যাতে দরকারে অদরকারে প্রসূতিকে সাহায্য করতে পারে,  কিন্তু তার বেশি আবার কি দরকার?  আর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ডিগ্রি পেতে হলে ফার্স্ট আর্টস পাস করে তবেই ভর্তি হওয়া যাবে। আর সব থেকে বড় কথা কলেজ কর্তৃপক্ষের গোঁড়ামি। মেয়েরা আবার ডাক্তারি করতে পারবে নাকি? আর কে-ই বা দেখাতে যাবে তাঁদের? তারা ছেলেদের সঙ্গে একসঙ্গে অ্যানাটমির ক্লাস করবে? শব-ব্যবচ্ছেদ করবে মেয়েরা? ধুর ধুর এও আবার হয় নাকি!  কোন যুক্তি,কোন উদাহরণই তাঁদের নিজেদের অবস্থান থেকে টলাতে পারে না। এই হল ‘What Bengal thinks today, India thinks tomorrow’ র নমুনা। বিদ্যোৎসাহীদের আরও রোখ চেপে গেল। মেয়েরা যে সুযোগ পেলে শুধু ধাই না, পুরো একটা গোটা ডাক্তার হতে পারে সেটা প্রমাণ করতেই হবে।
     
    ততদিনে চন্দ্রমুখী, কাদম্বিনী, এলেন প্রমুখের একে একে এন্ট্রান্স, এফ এ পাস হয়ে গেছে। কিন্তু কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে মেয়েদের ভর্তি নিয়ে যুদ্ধ চলছে । কাদম্বিনী এফ এ পাশ করার পরেই আবার একদফা কথা উঠেছিল। সে চেষ্টা বিফল হয়েছে। কাদম্বিনী স্নাতক স্তরে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছেন।  অনেক চেষ্টা করেও যখন কলকাতায় মেয়েদের পড়ানোর ব্যস্থা করানো গেল না, তখন ঠিক হল মেয়েদের মাদ্রাজে পাঠিয়েই ডাক্তারি পড়িয়ে আনা হবে। তখনকার দিনের পক্ষে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এলেন আর অবলা এই গুরুদায়িত্ব নিলেন। তাঁদের দেওয়া হল বেথুন স্কলারশিপ। মাসে ২৫ টাকা। ১৮৮২ সালের অক্টোবরে দুজনে গিয়ে ভর্তি হলেন মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজে। এন্ট্রান্স পাস অবলা ভর্তি হলেন চার বছরের এল এম এস কোর্সে। আর এলেন এম বি কোর্সে। তাঁদের থাকার অসুবিধা দূর করতে এক দিনেমার মিশনারি নিজের বাড়ি ছেড়ে দিলেন তাঁদের।
     
    দুই কন্যাকে নিয়েই শিক্ষকদের কোন অভিযোগ নেই। মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজের ১৮৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষের রিপোর্ট থেকে পাওয়া যাচ্ছে যে অবলা সেই বছর মিডওয়াইফরির সেরা ছাত্রী হিসেবে ভারতলক্ষ্মী মেডেল পেয়েছেন। সেই রিপোর্টে এও পাচ্ছি যে Miss A. Das, who passed the first L.M. and S. examination successfully last year, will probably present herself next year for the second L.M.and S. examination. কিন্তু তার পরের বছরের রিপোর্টে আর অবলার কোন উল্লেখ নেই। অবলা শেষ অবধি এল এম এস ডিগ্রি পেয়েছিলেন কি পান নি সে নিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বন্দ্ব আছে। কেউ বলেন তিনি ডিগ্রি পেয়েছিলেন- এমনকি মাদ্রাজ মেদিকেল কলেজের ওয়েবসাইটও অবলাকে তাঁদের কলেজের ডিগ্রিধারীই বলে। আবার অনেকেই বলেন তিনি অসুস্থতার জন্য পড়া শেষ করতে পারেননি। তবে তিনি যে কোনদিন মেডিক্যাল প্রাকটিসের দিকে যাননি সেটা সবাই জানেন। ১৮৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি জগদীশচন্দ্র বসুকে বিয়ে করেন। পরের জীবনে তিনি অন্য কারণে খ্যাত হন। একটা জিনিস লক্ষ্য করার যে  দুর্গামোহন দাশের দুই কন্যার মধ্যে বড় সরলার বিয়ে হয় তাঁর এন্ট্রান্স পরীক্ষার ঠিক আগে আর অবলার এই ঘটনা। এই ঘটনাই কি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়  না যে এমনকি তথাকথিত ’এলিট’ বাঙ্গালী বাড়িতেওঁ নারীশিক্ষার জায়গাটা, বিশেষত প্রফেশনাল বিষয়ে নারীশিক্ষার জায়গাটা ঠিক কেমন ছিল? আর মেয়েরাও সেটা কেমন সুন্দর অন্তঃস্থ করে নিয়েছিলেন! 
     
    এলেন পড়া চালাচ্ছিলেন। M.B. and C.M. ডিগ্রির পড়া তখন পাঁচ বছরের। ১৮৮৬-৮৭ শিক্ষাবর্ষের রিপোর্টে লেখা আছে যে পরের মাসে অক্টোবর ১৮৮৭ তে এলেন  সেকেন্ড এম বি পরীক্ষায় বসবেন। ’৮৬-৮৭ সালে এলেনও মিডওয়াইফেরির সেরা ছাত্রী হিসেবে ভারতলক্ষ্মী মেডেল পেলেন। তারপর ইতিহাস চুপ। এলেন কি পাস করলেন? এম বি ডিগ্রি কী এল তার হাতের মুঠোয়? সেই খবর আর জোগাড় করতে পারি নি। তার পারিবারিক স্মৃতিকথায় তাঁকে ডাক্তার বলা হয়েছে,তাই ধরে নিচ্ছি যে তিনি এম বি পরীক্ষায় পাস করেছেন। তবে তার স্বপক্ষে কোন প্রাথমিক নথি জোগাড় করতে পারিনি।   
     
    অবশ্য  ১৮৮৬ সালে কাদম্বিনী কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়েছেন। যদিও প্রচুর বিতর্ক ছিল তাঁর এই ফলকে ঘিরে।   আনন্দীবাইও এই বছরেই তার ডিগ্রি পেয়ে গেছেন। আরও  আরও মেয়েরা ভর্তি হচ্ছেন মেডিক্যাল কলেজে। কাজেই হয়ত  বাঙালির কাছে তাঁর গুরুত্ব কমে গেছে। অবশ্য আগেও কি আর বাঙ্গালিরা এই ইংরেজি-ভাষী কন্যাকে নিজেদের কাছের লোক ভেবেছে, সে যতই তার বংশের ভারতে স্থিতি তিনশ বছরেরও বেশি হোক না। এলেনও কি আর নিজেকে ভারতীয় ভাবতেন? সে কথাও জানার তেমন উপায় নেই। যেমন আমরা জানতে পারব না যে এলেনের কেন ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছা হয়েছিল। স্কুলে পড়ার সময় তিনি নিশ্চয় বেরিলির ক্লারা সোয়াইন নামের আমেরিকান মিশনারি ডাক্তারের কথা শুনেছিলেন। তিনিই কী এলেনের অনুপ্রেরণা ছিলেন? তবে অনুপ্রেরণা যিনিই হন, সে আমলের এক রেলওয়ে কলোনির ইউরেশিয়ান মেয়ের পক্ষে নার্স হওয়ার স্বপ্ন না, একেবারে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন বেশ খানিকটা অন্যরকম বইকি!      
     
    এরপর এলেনের সম্বন্ধে খুব কম খবরই জানা যায়। শোনা গেছে যে ১৮৯১ সালে তিনি চেন্নাইতে নিজের ক্লিনিক খোলেন। প্রথমে ব্রডওয়েতে আর তারপর ট্রিপলিকেন এলাকায়। এইসময় নাগাদই তিনি মাদ্রাজের ড্যানিশ মিশনের সঙ্গে যুক্ত হন। বলা শক্ত যে এই ক্লিনিক তাঁর ব্যক্তিগত নাকি তিনি ড্যানিশ মিশনের কর্মী হিসেবে এই ক্লিনিক চালাতেন। ১৮৯২ সালে ড্যানিশ মিশনের মুখপত্রে এলেনের একটি লেখা বেরোয়, যাতে প্রথম ভারতীয় সন্তানজন্মের পদ্ধতির কথা পশ্চিমের দুনিয়ায় পৌঁছায়। ১৮৯৪ সালে এলেন বিয়ে করেন  ড্যানিশ মিশনেরই বিপত্নীক মিশনারি মর্টেন এন্ডারসেনকে। এরপর এলেনের জীবন কাটে মিশনারির স্ত্রী হিসেবে, মিশনের বিভিন্ন কাজে তিনি খুবই তৎপর ছিলেন। পরে মর্টেন মিশন ত্যাগ করার পরে, তাঁরা তামিলনাড়ুর ড্যানিশপেটে শেষ অবধি স্থিতু হন। তার পরিবারের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় যে তিনি নিজের সংসার সামলানোর পাশে পাশে চারপাশের নিতান্ত দরিদ্র প্রতিবেশিদের চিকিৎসার কাজেও পিছপা ছিলেন না। 
     
    তবে আরও একটা বিষয় ভাবলে একটু অবাক হতে হয়। মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজের থেকে অ্যাপোথেকারি পাশ করে বেরোন অন্য সব মেয়েরা যেখানে মাসে দুশ-তিনশ টাকার চাকরিতে যোগ দিচ্ছে, সেখানে এলেন এম বি পাশ করেও বেছে নিলেন মিশনারির স্ত্রীর জীবন। ঘোর দারিদ্র্যময় বলে যদি তাকে দাগিয়ে নাও দিই, কঠোর জীবনযাপন তো বটেই। অথচ স্বেচ্ছাতেই নিশ্চয় বেছে নিয়েছিলেন! এইখানেই এলেন অন্য অনেকের থেকে আলাদা হয়ে যান।  এলেনকে বোঝার চেষ্টা ধামাচাপা দিয়ে রাখি - সাধারণ বিলাসী ভাবনার চৌহদ্দীতে তাকে আঁটানোর চেষ্টায় থই পাই না মোটে।
     
    অনেক  আশা করে এলেন আর অবলাকে বেথুন স্কলারশিপ দেওয়া হয়েছিল। ভাবা হয়েছিল এঁরা ডাক্তার হয়ে ফিরে এসে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মানুষের উপকারে লাগবেন। সেই আশা অবশ্য পূরণ হয়নি। অবলা সব ছেড়েই দিলেন আর এলেন যদি বা চিকিৎসাবিদ্যা কাজে লাগালেন, তবু তা সরাসরি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির কোন কাজেই লাগল না। সে না আসুক গে।  চকমকি ঠুকলে আগুনের স্ফুলিঙ্গ যে ঠিক কোথায় উড়ে গিয়ে পড়বে তা কি আর কেউ বলতে পারে? শুধু জানে যেখানেই গিয়ে পড়বে সেখানেই আলো দেবে। টুকরো টুকরো আলোতে পথ দেখে এগোবে আরও কত মেয়ে। আলোর কি আর দেশি-বিদেশি হয়!   

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৭ এপ্রিল ২০২২ | ২৫১২ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মন্দিরা | 122.161.49.172 | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ০৯:২৮506494
  • অপূর্ব লিখেছ স্বাতী। তোমার এ কাজের পেছনে যে অন্বেষণ তা আমাকে আরো মুগ্ধ করেছে। অবলার সঙ্গে এলেনের বন্ধুত্বের রেশটুকুও কি ছিল না? চিঠি বিনিময়ের কোন নথি? বাংলায় অবলা বসুর সহধর্মিণী রূপটিকে এত বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়েছে যে তাঁর ডাক্তারি শিক্ষার অমর্যাদার কথা সমাজ প্রায় ভুলেই গেছে। অনেক শুভেচ্ছা রইল।
  • মন্দিরা | 122.161.49.172 | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ০৯:২৮506493
  • অপূর্ব লিখেছ স্বাতী। তোমার এ কাজের পেছনে যে অন্বেষণ তা আমাকে আরো মুগ্ধ করেছে। অবলার সঙ্গে এলেনের বন্ধুত্বের রেশটুকুও কি ছিল না? চিঠি বিনিময়ের কোন নথি? বাংলায় অবলা বসুর সহধর্মিণী রূপটিকে এত বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়েছে যে তাঁর ডাক্তারি শিক্ষার অমর্যাদার কথা সমাজ প্রায় ভুলেই গেছে। অনেক শুভেচ্ছা রইল।
  • Prativa Sarker | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ১২:৩০506502
  • অবলা বসু সম্পর্কে অনেক তথ্য পাই আচার্য পি সি রায় পড়তে গিয়ে। সত্যি খুব গুছিয়ে সংসার করেছেন, সাইকেল চড়া শিখেছেন স্বামী ও তার বন্ধুর সঙ্গে, নারীশিক্ষার জন্য কাজ করেছেন, মুক্তমনা অবলা। কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যা তাকে আর টানল না কেন। তবে কি বাবার একান্ত আগ্রহে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন?  নাকি তুঁহারি গরবে গরবিনী হাম? 
    আমরা আধুনিকারাই যা স্ববিরোধে ভুগি। অত বছর আগে... 
  • স্বাতী রায় | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ১৩:২৩506504
  • @মন্দিরা অবলা আর এলেনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল কিনা সেই প্রশ্ন আমারও মনে এসেছিল। কিন্তু কিচ্ছু পাই নি। এঁরা যে কেউ কেন একটু নিজেদের কথা লিখে রাখেননি। অন্তত প্রথম বাঙ্গালী মেয়ের পড়ার সুবাদে প্রবাস যাত্রা এই ভেবেও তো লিখতে পারতেন। ছেলেরা তো কত লিখতেন ! তখনকার ম্যাগাজিনগুলোর অবশ্য সব তো হদিশ পাওয়া যায় না,তাই কত কিছুই অজানা থেকে যায়!  আর অবলা তাঁর কলকাতা কেন্দ্রিক এলিট পরিবারের দৌলতে এবং তার সমাজসেবা মূলক কাজের জন্য তবুও  আমাদের চেনা,  এলেনের সম্বন্ধে তো কোন হদিশই মেলে না। এক শুধু ওঁর বিদেশে চলে যাওয়া পরের পরের প্রজন্মের স্মৃতি থেকে যে সামান্য টুকু হদিশ মেলে। উনি মিশনারি হিসেবে বেশ সক্রিয় ছিলেন, গোটা দুই কনফারেন্সের ছবি পেয়েছি  তাই জানি না হয়ত ড্যানিশ ভাষা জানলে আরও কিছু উদ্ধার করতে পারতাম।  ইন ফ্যাক্ট এলেনের প্রকাশিত পেপার নিয়ে কিছু সমালোচনা পড়েছি যে খ্রিস্টানদের চোখে দেখা বাহ্যিক সমালোচনা বলে, কালচারাল গ্যাপ পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতে না পারা নিয়ে আক্ষেপ পড়েছি। মূল লেখাটা পড়ার খুব ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু কোথাও পেলাম না। এঁরা নিজেরা যদি একটুখানিও লিখে রেখে যেতেন!     
  • | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ১৩:৩৯506505
  • আসলে প্রত্যেকটা মেয়েরই আত্মজীবনী লিখে রাখা উচিৎ, সে লোকে যতউ ছেঁড়াকাঁথা বলে বিদ্রুপ করুক না কেন। এঁদের দুজনেরই ডাক্তারি পড়তে যাওয়া আর শেষপর্যন্ত প্র‍্যাকটিস না করা দেকগে একটু হতাশ লাগল। এখনো এই ২০২২ এও কত মেয়ে বিভিন্ন বিশেষ স্ট্রীমে পড়ে তারপর কিছুই করে না।  রিসোর্সের কি অপচয়! 
    এঁরা নিজেদের কথা লিখে গেলে জানতাম সত্যিই অপচয় না কোন কারণে বাধ্য হয়েছিলেন।
  • স্বাতী রায় | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ১৩:৪৮506506
  • @প্রতিভা দি, রবীন্দ্রনাথ - জগদীশ চন্দ্র বসুর চিঠিপত্রেও কিছুটা অবলাকে পাওয়া যায়। পরে তো দীর্ঘ সময় ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি ছিলেন। ওঁকে নিয়ে আরও একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য হল  এদেশে মেয়েদের মধ্যে গার্ল গাইড জনপ্রিয় করার জন্য ১৯২০ নাগাদ অবলা সহ চার জনকে গার্ল গাইডের কমিশনার করা হয়। অবলা ব্রাহ্ম বালিকাতে গার্ল গাইড চালু করেন। পরে অনেক মেয়েদের স্কুলেই গার্ল গাইড ছড়িয়ে পরে। ১৯২৮ সাল নাগাদ যখন দেশে স্বাজাত্যাভিমান তুঙ্গে,তখন গার্ল গাইডের রাজার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার শপথ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কল্পনা দত্তের জীবনীতেও এই কথা পাই।  তখন ব্রাহ্ম বালিকার মেয়েরা বিদ্রোহ করে যে তারা এই শপথ নেবে না। ব্রাহ্ম বালিকার মত তখনকার ইংরেজ-ঘেঁষা স্কুলের পক্ষে এ এক অভাবনীয় ঘটনা!  এই গল্প পড়েছি গার্ল গাইডের ইতিহাসে।  তবে তুমি ঠিকই বলেছ,স্বামীগর্বের গন্ডিতে আমরা দেড়শ বছর পরেই আটকে যাই,তো এ তো কোন কালের কথা। অবলাকে নিয়েও আমার খুব কৌতূহল। বুঝতে চাই যে নারী শিক্ষায় ওঁর নিজস্ব ভাবনা,নিজস্ব অবদান টুকু। কিন্তু মেটেরিয়াল বড় কম।    
  • স্বাতী রায় | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ১৩:৫৫506507
  • @দ  একদম ঠিক। সব মেয়ের লিখে রাখা উচিত। ...এলেন কিন্তু চিকিৎসা বিদ্যা র প্রয়োগ চালিয়ে গিয়েছিলেন। প্রচলিত নিয়মে চাকরি করেন নি বটে, বা ফরমালি ক্লিনিক খোলেন নি,  কিন্তু আশে পাশের লোকের জন্য সার্ভিস দিয়েছেন।  আমার তো সেই জায়গা টাতেই স্ট্রাইকিং লেগেছে। কিভাবে পারলেন লোভকে জয় করতে?এটা কি স্বামীকে অনুগমন করার জন্য নাকি স্বাধীন ইচ্ছে? বিয়ে করার জন্য কতটা সামাজিক চাপ ছিল ? কতটা মিশনারি স্কুলের শিক্ষার প্রভাব ছিল? অনেক প্রশ্ন মনে।  
  • দীপঙ্কর চৌধুরী | 223.233.68.137 | ১৮ এপ্রিল ২০২২ ০৯:৫৮506631
  • অসাধারণ একটি নিবন্ধ! পরিশ্রমের ছাপ লেখাটির সর্বাঙ্গে। অতীব সুখপাঠ।
    এঁর সম্পর্কে কিছুই জানতাম না আগে।। 
  • r2h | 134.238.18.211 | ১৮ এপ্রিল ২০২২ ১২:৩৭506640
    •  | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ১৩:৩৯506505
    • আসলে প্রত্যেকটা মেয়েরই আত্মজীবনী লিখে রাখা উচিৎ
    এটা আমারও মনে হয়; ভাগাড়পাড়া যখন প্রথম শুরু হয়েছিল, তখন এই লাইনে একটু কথা হয়েছিল বোধহয়।
    • স্বাতী রায় | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ১৩:৫৫506507
    • আমার তো সেই জায়গা টাতেই স্ট্রাইকিং লেগেছে। কিভাবে পারলেন লোভকে জয় করতে? 
    এতে অবশ্য আমি অবাক হচ্ছি না, তাঁর চিন্তাভাবনা বা প্রায়োরিটি আর পাঁচজনের মত ছিল না, এটা তো স্পষ্টই, আর তাছাড়া এই কয়েক দশক আগেও জাগতিক বিত্ত বিষয়ে অনেক লোকের ধারনাই একটু অন্যরকম ছিল।

    তবে, সমাজ সংসারের প্রায়োরিটিতে পেশা বা বৃত্তি ছেড়ে দেওয়া, এইটা একটা, কী বলবো, ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। কানেটিকাটে আমাদের প্রতিবেশী দম্পতি ছিলেন, অমায়িক, উদার, উত্তর ভারতীয়, বংশানুক্রমে উচ্চবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত, প্রিভিলেজড। ভদ্রমহিলা স্বাধীন, অ্যাপারেন্টলি। একসময় জানতে পারলাম ভদ্রমহিলা অংকোলজিস্ট। ডাক্তারি পাশ করার পরপরই বিয়ে, আমেরিকায় আসা, সন্তান। কোনদিন প্র‌্যাকটিস করেননি। এবং তা নিয়ে তাঁর ক্ষোভও আছে। ভদ্রলোক ব্যস্ত, হয়তো প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ। খুবই অবাক হয়েছিলাম, কী করে হয়?

    কিন্তু হয় তো, হামেশাই হয়।
     
  • স্বাতী রায় | 117.194.37.118 | ১৮ এপ্রিল ২০২২ ১৫:৫৯506655
  • ঠিকই। হামেশা হয়। সেই সময়েও হত  এখনও হয়।  আমাদের কষ্ট লাগে কিন্তু ব্যাপারটা বেশ নর্মালাইজড। 
     
    আর আমার নিজের এলেনের কথা পড়তে গিয়ে কেমন মনে হয়েছে , জাগতিক বিত্ত নিয়ে ধারণা অন্য করে দেওয়ার মূলে ওঁর ওই মিশনারি এডুকেশন। একটু আইডিয়ালিস্ট বাচ্চাদের মাথায় তাঁরা খুব সাক্সেসফুলি ধর্মপ্রচারের গুরুত্ব ঢুকিয়ে দিতেন এবং সার্ভিসের মাধ্যমে মন জয় করে নেটিভদের যিশুর ছত্রছায়ায় এনে দেওয়ার শিক্ষা দিতেন। এইটাই এলেনের জন্য কাজ করেছে হয়ত। মর্টেনের মধ্যে তিনি নিজের যোগ্য দোসর পেয়েছেন। তাই পরিণত বয়সের বিয়ে। তখন তো তিনি প্রায় তিরিশের কাছাকাছি। সেই আদর্শের টানেই লোভ জয় করা সহজ হয়েছে। মিশনের কাজে এলেন খুবই অ্যাক্টিভ ছিলেন। ইনফ্যাক্ট ওঁর পারিবারিক সোর্স ব্যতীত  অন্য যে দুটি ছবি পেয়েছি সে দুটিই ওঁর মিশনারি কনফারেনসের সহযোগীদের সঙ্গে ছবি। সংসার করেছেন সে তো সত্যি কিন্তু হয়ত আদর্শ ইক্যুয়ালি ইম্পর্ট্যান্ট ছিল। তবে ওই আর কি,সবই তো অনুমান।      
     
  • শক্তি | 2405:201:8005:9805:44c5:7eaf:f78e:12a8 | ১৯ এপ্রিল ২০২২ ০৫:৫৯506677
  • স্বাতীর মূল‍্যবান পরিশ্রমসাধ‍্য লেখাটি পড়ে অনেক কিছু জানলাম।
  • Kuntala Lahiri-Dutt | ১৯ এপ্রিল ২০২২ ১৯:০০506705
  • অসাধারণ লাগলো, স্বাতী আপনার এই লেখাটি পড়ে. 
  • সুচরিতা | 27.58.60.210 | ০৪ মে ২০২২ ১৬:৫৪507224
  • অসাধারণ!   কত কি জানলাম। মনটা খারাপ হল।  আবার দেখলাম শেষে লিখেছেন- যেখানেই গিয়ে পড়বে সেখানেই আলো দেবে। খুব ভাল লাগল লেখাটা।
  • দময়ন্তী দাশগুপ্ত | 2405:201:8014:c875:a5e2:a02:eaaa:d528 | ১৯ আগস্ট ২০২২ ১২:৩৭511180
  • অবলা বসু অসুস্থ হওয়ার জন্য শেষ পরীক্ষা দিতে পারেননি। তবে মিডওয়াইফারিতে ভারতীলক্ষ্মী গোল্ড মেডাল পেয়েছিলেন৷ পড়তে গিয়েছিলেন মূলতঃ বাবার আগ্রহে। বিয়ের পরে কেন পড়লেন না সেটা হয়তো নিজের আগ্রহ ছিল না বা পরিস্থিতি। তবে ফার্স্ট এল এম এস পাশ করা বউকে যিনি ' বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিমণ্ডিতা' নন বলে মনে করেন এবং বিজ্ঞান না জানা নিবেদিতাকে নিজের সহকারী করেন, তাঁর কাছে থেকে যে লেখাপড়া আর হবে না সেটাই স্বাভাবিক। 
    আমি অবলা বসুকে নিয়ে দুটি কাজ করেছি। আর একটি বড় কাজ কিছুকালের মধ্যে প্রকাশিত হবে।
  • দময়ন্তী দাশগুপ্ত | 2405:201:8014:c875:a5e2:a02:eaaa:d528 | ১৯ আগস্ট ২০২২ ১২:৪৩511181
  • তবে অবলাকে সাম্মানিক এল এম এস ডিগ্রি দেওয়া হয়েছিল। সেটা মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজের ওয়েবসাইট এবং তাঁর সাম্মানিক সার্টিফিকেট দেখে বলা যায়।
  • dc | 2401:4900:1f2b:6b45:f4cc:c20e:f34e:ac04 | ১৯ আগস্ট ২০২২ ২০:৩২511189
  • এলেন এর গল্প পড়তে দারুন ভাল্লাগলো।  
  • Debashis Das | 2401:4900:1c00:408e:3146:7715:56fa:e3b2 | ২১ আগস্ট ২০২২ ১১:৪১511232
  • স্বাতী- খুব ভালো লাগলো আপনার এই তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটি। বিশেষ করে অবলার বিষয়ে জানার ইচ্ছে অনেক বাড়িয়ে তুলল। তিনি তো 'অবলা' ছিলেন না তবু রূপকথার রাজকন্যার মত তার ইতিহাস গড়ার কাহিনীও কেন 'বিবাহের পরে সুখে দিনাতিপাত' গোছের 'প্রায় সাধারণ' হয়ে গেল? ডাক্তারি ডিগ্রী পেলেন কিনা? পেলেও নিজেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন কেন? ইতিহাস এসমস্ত বিষয়ে নীরব। তবে প্রশ্ন তো থেকেই যায়। সেই সময় এই গরিব দেশে এরকম সুযোগের বা স্কলারশিপের হেলায়(?) অপচয় সত্যই ভাবায়। কেউ কেউ এ বিষয়ে  গবেষণা করছেন জানতে পারলাম। যদি গবেষণালব্ধ কিছু তথ্য এখানে শেয়ার করা যায় তবে হয়ত এই অন্ধকার অধ্যায়ে আরো কিছুটা আলোকপাত হবে।   
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন