তানিস্লা(ভ) লেমের নভেলা (১৯৬১) আর তার (ইংরেজী অনুবাদও) তারকোভস্কির মুভি (১৯৭২, রাশিয়ান, ইংরেজীসাবটাইটেল) এবং জর্জ ক্লুনি যেটায় ক্রিস কেলভিন হয়েছিল (ডিরেক্টর কে মনে নেই, ২০০২/৩) সবই সতন্ত্র। জোয়ানকিলমার্টন- স্টিভ কক্সের ইংরেজী অনুবাদ এবং প্রথম মুভিটি (হ্যাঁ, তারকোভস্কির সুবিখ্যাত ওয়ান্স ইন এ জেনেরেশন মুভিসোলারিসও) লেমের বহুৎ বিরক্তির উদ্রেক করেছিল। লেম এমনিতেই মনে হয় এক খিঁটখিঁটে বুড়ো যাকে সহজে খুশী করা যায়না।
আমি যেটা পড়েছি সেটা প্রফেসর বিল জনসনের পোলিশ থেকে ইংরেজী অনুবাদ (২০১৭)। ততদিনে লেম মারা গেছেন (২০০৬) ; প্রসঙ্গত এই বছর ২০২১ পোলান্ডে ‘স্তানিস্লা(ভ) লেম বছর’ হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে- তাঁর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে। এইঅনুবাদ তাঁর স্ত্রী-পুত্রের আশির্বাদ পেয়েছে। তা লেম ছিলেন নাস্তিক এবং কখনও অ্যাগনস্টিক। তিনি এই দুশ পাতারও কম নভেলাটিবোধহয় একটা ফার্স্ট- কনট্যাক্ট সাই ফাই হিসেবে লিখেছেন। গল্পটা স্পয়েল করতে চাইনা (@অরন্য, আপনার জন্য)মানুষবেসিক্যালি এলিয়েনদের তুলনায় কত ছেলেমানুষ কিন্তু অর্বাচীন, অহঙ্কারী গান্*ু। কেলভিন আর হারির প্রেম অফসুট।
অন্যদিকে তারকোভস্কি তো তারকোভস্কিই। তিনি বানাবেন ক্লাসিক। সাই ফাইএর মত ‘সুপারফিসিয়াল’ জিনিসে তিনি কেনসন্তুষ্ট হবেন? মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন, কেলভিন আর হারির অমর প্রেম, প্রেমের/ প্রকৃতির পথে কিভাবে মনুষ্যত্বের জয় সম্ভব (তারকোভস্কিঅর্থোডক্স খ্রীষ্টান) এইগুলো দেখি; আর তাই বুঝি @সের সন্দ হয় এটা আদৌ সাই ফাই কিনা! এমনকি লেম নিজেই কোন একজায়গায় বলেছেন, তারকোভস্কি সোলারিস বানাননি, বানিয়েছেন “ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট”।
প্রোফেসর শঙ্কু ও মোংরু
গিরিডি
সাতাশে মে, বিকেল চারটে।
বোলিভিয়া থেকে ফিরে আসার পরে কয়েকদিন গবেষণার কাজ থেকে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আমি কখনই বিজ্ঞানের কোনও নির্দিষ্ট শাখায় আমার গবেষণাকে আবদ্ধ রাখি না।
আজ সকাল থেকেই বিভিন্ন প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটা তুলনামূলক পেপার বানাবার চিন্তা মাথায় ঘুরছে। কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সবই মজুদ আছে। যেহেতু আমি খুব বেশি জটিলতায় বিশ্বাসী নই, তাই আমার কাজও হবে সহজ এবং সরল।
গিরিডির পথে ঘাটে যে সব জন্তু দেখা যায়, তারাই হবে আমার গবেষণার মূল উপাদান। পাখিদের নিয়ে আগে কাজ করেছি। তাই এবারের গবেষণায় পাখীদের বাদ রাখছি। পাড়ায় একটি কুকুর আছে, নাম কালু। ভাবছি কালুকে দিয়েই কাজ শুরু করব।
এ বাড়ির সর্বক্ষণের দেখাশোনার লোক প্রহ্লাদ ছুটি থেকে ফিরে এসেছে। কালু এ বাড়ির দিকে এলে ওকে খেতে দেবার জন্য প্রহ্লাদকে বলে রেখেছি।
এ মুহূর্তে যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার তা হলো কালুকে স্টাডি করা।
অবিনাশবাবু অবিশ্যি কুকুর খুব একটা পছন্দ করেন না, তাই কালু এদিকে থাকলে ভদ্রলোকের এখানে আড্ডা দিতে আসা যে কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে তা বুঝতে পারছি।
দেখা যাক কী হয়।
গিরিডি
ঊনত্রিশে মে, ভোর চারটে।
গত দুরাত ধরে এক নাগাড়ে কাজ করে "ব্রেনোগ্রাফ" যন্ত্র তৈর করে ফেললাম। কালুর চিন্তা ভাবনাকে একটা মনিটরে প্রতিফলিত করাই এই যন্ত্রের কাজ।
টেকনোলজির সরলতা বজায় রাখতে এই যন্ত্রকে আমি তিনটি ভাগে ভাগ করেছি। একটি অংশ থাকবে কালুর মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত। অবিশ্যি এর জন্য কালুর তেমন কিছু অসুবিধা হওয়া উচিৎ নয়, কারণ কালুর গলায় একটা চামড়ার বাকল- এর সঙ্গে যন্ত্রের এই অংশটি - যার থেকে থেকে দুটো অ্যান্টেনার মতো তার বেরিয়ে আসবে। এই তারদুটোর একটা ছুঁয়ে থাকবে ওর মাথার পেছন দিকটা, অন্য তারটা ছুঁয়ে থাকবে ওর শিরদাঁড়ার যে কোনও অংশ।
দ্বিতীয় অংশটা একটা মনিটর , যেটা আমি আমার আদ্যিকালের পুরোন টিভিটাকে সারিয়ে সুরিয়ে কাজ চালানোর মতো করে নিয়েছি। সবশেষে তিন নম্বর অংশটা থাকবে আমার হাতে, এটিও দেখতে হবে রিমোট কন্ট্রোলের মতো। এটা দিয়ে আমি কালুর বুদ্ধিমত্তার ফ্রিকোয়েন্সি মাপতে পারব।
সবচেয়ে সুবিধের ব্যাপার হলো যে এই যন্ত্রের তিনটে অংশই পরষ্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন। কাজেই কালু এই যন্ত্র পরে থাকলে তার চলাফেরায় কোনও বাধা থাকছে না।
ভোর হয়ে গেছে। এবার একটু বিশ্রাম নিতে হবে।
গিরিডি
ঊনত্রিশে মে, সন্ধে সাতটা।
এইমাত্র অবিনাশবাবু চলে গেলেন। গত কয়েক দিন এদিকে আসেন নি, ঘাটশিলায় ভাগ্নের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন। আজ গিরিডি ফিরেই বিকেলে চা খেতে এসেছিলেন এখানে।
আগামী গবেষণার প্রসঙ্গ উঠতেই ভদ্রলোক বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠলেন, যদিও কুকুর নিয়ে কাজ করব শোনামাত্র ওঁর উৎসাহে ভাটা পড়ে গেল।
ভদ্রলোককে বললাম যে আজ দুপুরে কালুকে নিয়ে আমার প্রথম পরীক্ষা সফল হয়েছে।
প্রহ্লাদকে আগেই বলা ছিল, তাই খাবারের লোভে কালু রোজই দুপুরের দিকে এদিকে আসে। প্রহ্লাদকে সে এখন ভয় পায় না, আমার সঙ্গেও তার বেশ পরিচয় হয়ে গেছে। আজ কালু আসতেই প্রহ্লাদের বদলে আমি তাকে খেতে দিলাম। খাবার বলতে ঢ্যাঁড়শ ভাজা, ডালভাত আর ঝিঙে চচ্চড়ি। কালু খেতে শুরু করবার পর তার পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে গলায় বাকলটা পরিয়ে অ্যান্টেনাদুটো মোটামুটি ফিক্স করে দিলাম। কালু কোনও আপত্তি করে নি। এবার তাকে আমি ওখানে ছেড়ে দিয়ে ল্যাবরেটরিতে গিয়ে মনিটর চালিয়ে দিলাম।
রিমোট কন্ট্রোলটা আমার হাতেই ছিল। সামান্য নাড়াচাড়া করে সঠিক ফ্রিকোয়েন্সিতে পৌঁছতেই কালুর মনের ভাব মনিটরে ধরা পড়ল। আমি আমার বহু পুরোনো প্রায় অব্যবহৃত ট্রান্সলেটোমিটার জুড়ে দিলাম মনিটরের সঙ্গে। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে কালুর মনের কথা অনুবাদ হয়ে গেল মানুষের ভাষায়, যাকে বাংলা করলে দাঁড়ায়, "এরা কি রোজই ডাল ভাত খায়?"
কুকুর যে অনেকটা মানুষের মতোই চিন্তাভাবনা করতে পারে তা আগেই জানতাম, তবে পরীক্ষার এই অভাবনীয় সাফল্যের পরে সেই ধারণা আরও বদ্ধমূল হলো।
ভাবছি কালকে মাংস রাঁধতে বলব প্রহ্লাদকে।
অবিনাশবাবু অবিশ্যি এখন আর এদিকে আসবেন বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে এই গবেষণা এত ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠেছে, যে আমি লৌকিকতার দিকটা আপাতত দূরে সরিয়ে রাখছি।
এক্সপেরিমেন্টের প্রতিটি রেজাল্ট আমাকে টুকে রাখতে হবে।
কালু আজ আর আসবে না। তবে কালকের এক্সপেরিমেন্টের জন্য প্রস্তুতির দরকার। রাতে উশ্রীর দিকটায় পায়চারি করতে যাবো। সঙ্গে নেবো নিউটনকে।
গিরিডি
একত্রিশে মে, বিকেল চারটে।
গতকাল কাজের চাপে ডায়েরি লেখা হয় নি, কারণ কালুকে স্টাডি করে সমস্ত তথ্য লিপিবদ্ধ করেছি। আমার ব্রেনোগ্রাফ যন্ত্র সাধারণত সব সময়েই "অন" করা থাকে। তবে কালু আমার বাড়ি থেকে পঞ্চাশ গজের বেশি দূরে চলে গেলে সিগনালগুলো ক্রমশঃ অস্পষ্ট হয়ে যায়।
তাতে অবিশ্যি কাজের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। আমি পশুপাখিদের অবাধ বিচরণে বিশ্বাসী, তাই কালু যতক্ষণ বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে থাকে ওর মনের সমস্ত চিন্তা ভাবনা রেকর্ড হয়ে যায় এই যন্ত্রে।
এ কদিনের স্টাডিতে একটা জিনিস পর্যবেক্ষণ করলাম যে, কুকুর অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে কালু কিন্তু সর্বক্ষণই খাবারের চিন্তা করে না। খিদে পেলে যদিও এই চিন্তাগুলো তার মনে আসে, কিন্তু অন্যান্য সময় তাকে সম্পূর্ণ অন্য জিনিস নিয়ে ভাবতে দেখা গেল।
যেমন কাল বিকেলেই পাড়ার ছেলেরা ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলো, খুব সম্ভবত সুতো কেটে গিয়ে ঘুড়িটা আমার বাগানের উত্তর-পশ্চিম কোণের আমগাছের মগডালে আটকেছে। ছেলেরা খুব হৈ হৈ করছে, কালুও নীচে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন সময়ে ব্রেনোগ্রাফের মনিটরে কালুর মনের কথা ভেসে উঠল, "পারবে না, পারবে না, অনেক উঁচু পারবে না"।
এই যে দূরত্ব আন্দাজ করতে পারা, কালুর এই মানবসুলভ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আমাকে আশ্চর্য করে দিলো। বুঝতে পারলাম, একটা রাস্তার কুকুর হওয়া সত্ত্বেও কালুর মাথায় যেটা আছে, সেটা হচ্ছে "হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স"।
আরও একটা উল্লেখ করবার মতো ঘটনা হচ্ছে যে কালু নিউটনকে কখনও বিরক্ত করে না। নিউটনও বুঝে ফেলেছে যে গবেষণার কাজের জন্য কালুকে আমার কতটা প্রয়োজন, তাই সে কালুকে মেনে নিয়েছে।
অবিনাশবাবুও এ কদিন এদিকে আসেন নি। তবে আজ দুপুরে খেয়ে দেয়ে উঠেই এক অদ্ভূত ব্যাপার হলো। আমি ল্যাবরেটরীতে টেবিলটা গুছোচ্ছি, হঠাৎ শুনি অবিনাশবাবু বাইরে থেকে চেঁচাচ্ছেন, "ও মশাই ঘোড়া পুষবেন নাকি"?
এমনিতে উনি সরাসরি আমার ল্যাবরেটরী বা বৈঠকখানায় উঠে আসেন, বুঝলাম বাড়িতে কুকুর আছে ভেবে সেই ভয়ে উনি ভেতরে ঢুকছেন না। জানলা দিয়ে বাইরে ঝুঁকে দেখলামুনি রোদ্দুরে ছাতা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। জানালাম যে উনি স্বচ্ছন্দে ওপরে আসতে পারেন, কুকুর এখন বাড়িতে নেই।
তাতে যে অবিনাশবাবু একটু আশ্বস্ত হলে সেটা ওঁর ছাতা বন্ধ করা দেখেই বোঝা গেল। তবুও উনি আর একবার ওখান থেকেই বললেন, "ঘোড়া পুষবেন নাকি? টাট্টু?"
- টাট্টু! কার ঘোড়া?
আমি অবাক হয়েছি বুঝে উনি আমগাছের পেছনে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, "কার ঘোড়া তাতো জানি না মশাই, সেই কখন থেকে পিছু ধরেছে, আমি আপনার এখানে এলাম, তা ঐ টাট্টুও এসে থামল। পুষবেন নাকি?"
টেবিল থেকে চশমাটা তুলে এনে দেখলাম সত্যিই একটা ছোটো মাপের ঘোড়া আমগাছের নীচে ঝোপ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকটায় এখন ছায়া, তবে এই দোতলার জানলা থেকে দেখে মনে হলো ঘোড়াটার গায়ের রং খুব গাঢ়।
এর মধ্যে অবিনাশবাবু ওপরে এসে গিয়েছেন। ওঁকে বসতে দিয়ে, জানলার বাইরে তাকিয়ে এবারে যা দেখলাম তা বিশআস করা প্রায় অসম্ভব।
ঘোড়াটা ছায়া থেকে সরে এসে এখন আমার জানলার ঠিক নীচে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বড়ো বড়ো চোখে ওপরে এই জানলার দিকেই চেয়ে আছে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তার গায়ের রং। এমন ঘোড়া আমি আগে কখনও দেখি নি। এ ঘোড়ার গায়ের রং সবুজ।
অবিনাশবাবুকে ব্যাপারটা বলতে উনি অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে। তারপর নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে জানলা দিয়ে মাথা বের করে ঝুঁকে অনেকক্ষণ ধরে দেখে বললেন, "সবুজ কোথায় মশাই? লালচে বলুন, আহা অনেকটা কমলা কমলা মতো, ঠিক না"?
এবার প্রহ্লাদকে ডাকা হলো। সে এক ঝলক দেখে নিয়েই বলল যে ঘোড়াটা সবুজ এবং সবুজ ঘোড়া সে ও আগে কখনও দেখে নি।
এদিকে কাছেই সহিস হীরালালের একটা আস্তাবল আছে। প্রহ্লাদের ধারণা ঘোড়াটা সেখান থেকেই বেরিয়ে এসেছে। কাজেই সে হীরালালকে খবর দিতে গেল।
আমি অবিনাশবাবুকে বসিয়ে রেখে বিভিন্ন রঙের বিন্দু দেওয়া প্যাটার্ন দেখাতে দেখাতে বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক বর্ণান্ধ। তবে এটা জানতে পেরে উনি যে খুব একটা বিচলিত হয়েছেন, তা নয়।
ভদ্রলোক চলে যাবার পরেও দেখলাম ঘোড়াটা নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রহ্লাদ এখনও ফেরে নি। ডায়েরি লেখা শেষ করে এবার আমার ইমেইলগুলো দেখব।
গিরিডি
পয়লা জুন, সকাল দশটা।
এর মধ্যে কয়েকটা ঘটনা ঘটেছে যেগুলো লিখে রাখা দরকার।
কালুকে নিয়ে আমার প্রথম স্তরের পরীক্ষা নিরীক্ষা আপাততঃ শেষ। আজ ভোরে আমি ওর গলা থেকে ব্রেনোগ্রাফ খুলে নিলাম। ও এখন নিজের মতো থাকুক, তবে বাড়িতে ওর ঢুকবার কোনও বাধা নেই।
গতকাল হীরালালের আস্তাবল থেকে ফিরে প্রহ্লাদ জানালো যে সেখান থেকে কোনও ঘোড়া খোওয়া যায় নি। অর্থাৎ এই সবুজ ঘোড়াটি অন্য কোনও জায়গা থেকে এসেছে। কোথা থেকে এলো সে নিয়ে খোঁজ খবর করা দরকার এবং সেই কাজের ভার আমি প্রহ্লাদের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছি।
অবিনাশবাবু গতকাল সন্ধেবেলা আবার এসেছিলেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে ঘোড়াটির রং সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বুঝলাম তিনি এ ব্যাপারে আদৌ আশ্চর্য হন নি। বললেন, "রাণা প্রতাপের ঘোড়া ঐতকের গায়ের রং তো নীল ছিল বলে শুনিচি, তা সবুজ হলে ক্ষতি কী? কত কিছুই তো আমরা নিজের চোখে দেখিনি, নিজের কানে শুনিনি, তাই বলে কি সেসব জিনিস নেই?"
ঘোড়াটা আপাতত আমার বাগানেই আছে। পশুর মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণার কাজে ওকে লাগাতে পারলে ভালই হয়, তবে তার আগে ওকে দূর থেকে স্টাডি করা বেশি দরকার। ওর একটা নামও দেওয়া হয়েছে কালকে । খুব ছোটোবেলা এই গিরিডিতেই আমার চেনা বুড়ো সহিস বনোয়ারীলালের একটা টাট্টু ছিল। তার নাম ছিল মোংরু। আজ বনোয়ারীলাল বা তার সেই ঘোড়া কেউই বেঁচে নেই। তবু সেই পুরোনো নাম, আর ঘোড়াটা মঙ্গলবার এসেছে, এই দুটো মিলিয়ে আমি এর নামও মোংরু রাখলাম।
রাত্রে ওকে খেতে দেওয়া হয়েছিল ঘাস, বিচালি, খড়। কিন্তু মোংরু কিছুই খায় নি, তবে জল খেয়েছে। আজ ভোরে পায়চারি করতে বেরোবার সময়ে ওকে দেখলাম কিছুটা দূর থেকে। উচ্চতায় ও সাড়ে তিন ফুটের বেশি নয়, সারা গায়ের ওপর ঘন সবুজ রোঁয়া, দুটো চোখের নীচেই সামান্য সাদা দাগ, আর ঘাড় ঘুরিয়ে সে এদিক ওদিক দেখেই চলেছে।
গতকাল উলানবাতর থেকে আমার বিজ্ঞানী বন্ধু গুয়ুক ইমেইল পাঠিয়েছে। মঙ্গোলিয়ায় এবছর যে বিজ্ঞানী সম্মেলন হচ্ছে সেখান থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সে। সম্মেলন সামনের সপ্তাহে। যেতে হলে এখনই প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা করতে হবে। সম্মেলনে গেলে যাতায়াত মিলিয়ে সব শুদ্ধ দশদিনের ধাক্কা। এই কটা দিন মোংরুকে নিয়ে আমার এই সম্ভাবনাময় গবেষণার কাজে সত্যিই বাধা পড়বে।
এখনও কিছু মনস্থির করি নি। ভাল করে ভেবে আজ বিকেলে গুয়ুককে আমার উত্তর জানিয়ে দেবো।
নিউটন দুধরুটি খেতে চাইছে, এখন উঠি।
গিরিডি
পয়লা জুন, সন্ধে আটটা।
বিকেলে ইমেইলে দেখলাম গুয়ুক আমার মঙ্গোলিয়া সফরের জন্য রীতিমতো প্রস্তুত। গুয়ুককে কী উত্তর দেবো ভাবছি, এমন সময়ে প্রহ্লাদ এসে জানালো যে মোংরুর আগের ঠিকানা সম্বন্ধে কোনও খবরই পাওয়া যায় নি। তাই আপাতত ওকে এখানে রাখাই ঠিক হলো।
মঙ্গোলিয়া থেকে ফিরে এসে মোংরুকে নিয়ে কিছু কাজ করব বলে ভেবে রেখেছি।
নীচে নেমে দেখলাম মোংরু বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমি তার কাছে গেলেও সে কোনও আপত্তি করল না। আমরা পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলাম। মোংরুর ঘাড়ের ও লেজের লম্বা চুলগুলো খুব উজ্জ্বল, সূর্যের আলোয় তা চিকচিক করে ওঠে। আরও একটা লক্ষ্য করবার মত জিনিস মোংরুর চোখদুটো। সে সব সময় ঘুরে ফিরে সব কিছু দেখে, ঘাড় ঘুরিয়ে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকায়। সেই দৃষ্টির মধ্যে বুদ্ধির ছাপ দেখতে পাই আমি।
অনেকটা নিজের মনেই বলে ফেলেছিলাম, "মোংরু, তোমাকে তো রেখে যাচ্ছি, মঙ্গোলিয়া যেতে হবে, তবে দিন দশেকের ভেতরেই ফিরে আসব, সাবধানে থেকো।"
কথাত বলেই তার দিকে ফিরে দেখি সে মাথাটা একটু নাড়ল, সম্মতি জানানোর জন্য মানুষ যেভাবে মাথা নাড়ে, হুবহু সেরকম। আর এও লক্ষ্য করলাম যে তার মুখে খেলে গেল হালকা হাসির রেখা।
ঠিক শব্দ করে হাসি নয়, তবে মুখ টিপে হাসলে যেরকম দেখায় অনেকটা সেরকম।
মানুষ ছাড়া অন্য কোনও প্রাণী যে হাসতে পারে তা আমার জানা নেই, অবশ্য কিছু পাখি নিয়ে গবেষণা কবার সময় কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছে। সেসব পাখিদেরকে "বিশেষভাবে বুদ্ধিমান" বলা গেলেও যেতে পারে। কিন্তু মোংরুর অভিব্যক্তি আমাকে আরও একবার আশ্চর্য করল। বুঝলাম চিন্তা নেই, সম্মেলন থেকে ঘুরে এসে ওকে নিয়ে গবেষণা করা যাবে।
গুয়ুককে আমার যাবার দিনক্ষণ জানিয়ে দিয়েছি। কালুও ওপরে যে পেপারটা বানিয়েছি সেটা সঙ্গে নিয়ে যাবো ভাবছি। সেই সঙ্গে ডেমন্সট্রেশনের জন্য কালুকে সঙ্গে নিলে আরও ভাল হতো। কিন্তু কুকুর নিয়ে অতটা পথ যাতায়াতের অনেত অসুবিধা, কালুরও কষ্ট হবে, এসব মাথায় রেখেই কালুকে সঙ্গে নিচ্ছি না।
আমার ব্যক্তিগত জিনিস আর কাগজপত্র একটা ব্যাগেই ভরে যাবে।
বছরের এই সময়টায় মঙ্গোলিয়ার আবহাওয়া মনোরম, গরম পোশাকের তেমন দরকার পড়ে না, যদিও রাতের দিকে তাপমাত্রা বেশ নীচে নেমে যায়। কিন্তু আমার কাছে নিজস্ব আবিষ্কারের কিছু হালকা পোশাক আছে যা পরলে অতিরিক্ত গরম পোশাকের প্রয়োজন হয় না।
হাতে আছে মাত্র কয়েকটা দিন। এর মধ্যে কাগজগুলো গুছিয়ে নিতে হবে।
গিরিডি
দোসরা জুন, দুপুর আড়াইটে।
মোংরুর সঙ্গে এখন বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
গতকাল রাতে ঊশ্রীর ধারে বেড়াতে যাবার সময় সে আমার সঙ্গ নেয়। আমি একটু বেশি হাঁটব বলে অভ্রখনির দিক বরাবর চলতে শুরু করি। ওদিকটায় পথে ছড়িয়ে আছে অজস্র অভ্রের কুচি, যা চাঁদের আলোয় চিকচিক করে উঠছে। একটা বড়োসড়ো অভ্রের পুরু পাত নজরে পড়ল যাতে রয়েছে অসংখ্য পাতলা পাতলা স্বচ্ছ অভ্রের পাত। নীচু হয়ে টুকরোটা কুড়িয়ে নিতেই মোংরু সেই পাতটাকে খুব মন দিয়ে দেখতে লাগল। ওর আগ্রহ দেখে ওটা ওর সামনে নামিয়ে রাখলাম। মোংরু তার সামনের ডান পা দিয়ে ওটাকে বেশ অনেকক্ষণ নেড়েচেড়ে উল্টেপাল্টে দেখে পথের একপাশে সরিয়ে রাখল।
পরশু রওনা হচ্ছি উলানবাতর। পুরোনো বন্ধু গ্রেনফেলও আসছে এই সম্মেলনে। এবার ঠিক করে রেখেছি দর্শকের ভূমিকাই নেব, কারণ গ্রেনফেল ও আমি ছাড়া বাকি বিজ্ঞানীরা অ্যাস্ট্রনমির ওপর কথা বলবে। এ মুহূর্তে অ্যাস্ট্রনমির ওপর আমার কোনও পেপার তৈরি নেই, যা ছিল সবই আগে কোথাও না কোথাও পড়া হয়েছে বা পাবলিশ হয়ে গেছে।
গ্রেনফেলের ইচ্ছা সম্মেলনের শেষে গোবি মরুভূমিতে বেড়াতে যাবার। গুয়ুকের এব্যাপারে আপত্তি নেই। সাহারা, কালাহারি বা আমাদের থর মরুভূমির মতো গোবি কিন্তু প্রচণ্ড গরম নয়। বরং ঠিক উল্টো।
গোবিতে আছে উঁচু উঁচু বরফের পাহাড়, ঝর্ণা, ঝোপ, জঙ্গল, বালি, স্তেপ-তৃণভূমি এবং সেই সঙ্গে অজস্র পশুপাখি।
গুয়ুক গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবে, কিন্তু গ্রেনফেলের ইচ্ছে দুইকুঁজবিশিষ্ট উটের পিঠে চেপে গোবি ভ্রমন।
কাগজপত্র গোছনোর কাজ শেষ। মোংরুকে রেখে যাচ্ছি তাই চিন্তা হচ্ছে; অবিশ্যি প্রহ্লাদ ওর দেখশোনা করবে।
ইর্কুৎস্ক
চৌঠা জুন, সকাল আটটা।
পূর্ব-সাইবেরিয়ার ইর্কুৎস্ক এয়ারপোর্টে বসে ডায়েরি লিখছি।
ঘন্টাখানেক মধ্যেই ফ্লাইট ছাড়বে মঙ্গোলিয়ার রাজধানীউলানবাতরের উদ্দশ্যে। এখানে আকাশ পরিস্কার, ঝকঝকে। একটুআগে গ্রেনফেলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে ও একই প্লেনে যাচ্ছে। গ্রেনফেল পরিচয় করিয়ে দিলো এক রাশিয়ান মহাকাশচারীর সঙ্গে। প্রায় সাত ফুট লম্বা সেই ভদ্রলোকটির নাম ঋবাকভ, যদিও গ্রেনফেলতাকে ক্রমাগত "রোবোকপ" বলে ডেকে চলেছে। তাতে অবিশ্যিঋবাকভ কোনও আপত্তি করছে না, বরং বেশ ঠাট্টার মেজাজেই আছেদেখছি দুজনে।
শান্ত প্রকৃতির ঋবাকভ ইংরিজি জানে বেশ ভালই, তাই আমরাইংরিজিতেই কথা বলছি। সে জানালো, যে মহাকাশ ঘুরে এসেছেদুবার। মূলতঃ এই সম্মেলনে যাবার একটাই উদ্দেশ্য তার, আর সেটাহচ্ছে আমাদের গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের অন্য কোনও গ্রহে প্রাণ আছেকি না সেই নিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনা করা।
আজ দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যাব উলানবাতর। গ্রেনফেল আর ঋবাকভডাকছে চা খেতে। হাতলহীন বাটির মতো পেয়ালায় হাল্কা লিকারেরগ্রীন টি।
উলানবাতর
চৌঠা জুন, বিকেল পাঁচটা।
"হোটেল উলানবাতর" এর ঊননব্বই ও একশো তিন নম্বর ঘরে রয়েছিগ্রেনফেল ও আমি। ঋবাকভ থাকছে তার এক মোঙ্গল বন্ধুর বাড়িতে। দুপুরে পৌঁছনোর পরে এয়ারপোর্টে এসেছিল গুয়ুক। আমাদেরতিনজনের সঙ্গেই তার পরিচয় আছে।
হোটেলে চেক-ইন করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমরা বেরিয়ে পড়লামগুয়ুকের সঙ্গে, তার বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণে। খাবার বলতেছিলো ভাপানো মোমো এবং চা। ঘরের কোণে প্রকাণ্ড সামোভারেসর্বক্ষণ গরম হচ্ছে চা। এই সামোভার জিনিসটা আসলে বিশালএকটা কেটলি, যেটার বাইরে অপূর্ব সব নকশা-কারুকাজ করা থাকে। এ জিনিস আগে রুশ দেশেও দেখেছি, মঙ্গোলিয়াতেও যে সামোভারেরপ্রচলন আছে তা খুবই স্বাভাবিক।
ঋবাকভ একটা ঘটনা শোনালো। তার দ্বিতীয় মহাকাশসফরের সময়েতাকে থাকতে হয়েছিল একটা স্পেস স্টেশনে টানা চার মাস। সেইসময়ে তার কিছু অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হয়, এবং সেই অভিজ্ঞতারভিত্তিতেই তার ধারণা তৈরি হয়েছে যে এই গ্যালাক্সির অন্য কোনওগ্রহে বা উপগ্রহে শুধু প্রাণই নয়, বুদ্ধিমান প্রাণীর সন্ধান মেলাওআশ্চর্য নয়। যদিও পৃথিবীতে ফিরে আসবার পরে তার সেই সবঅভিজ্ঞতার বর্ণনা কেউ শুনতে রাজি হয় নি, বরং দীর্ঘ মহাকাশবাসেরএকঘেয়েমি কাটানোর জন্য সে নিজেই ঐ সব গল্প বানিয়েছে বলেইসন্দেহ করেছে অন্য বিজ্ঞানীরা। তবুও ঋবাকভ আশাবাদী।
আগামীকাল বিকেলে শুরু হচ্ছে সম্মেলন। আবহাওয়ার পূর্বাভাসবলছে কাল সারাদিন আকাশ থাকবে রৌদ্রোজ্জ্বল।
উলানবাতর
পাঁচুই জুন, রাত এগারোটা।
সম্মেলন থেকে এইমাত্র হোটেলে ফিরলাম। গতকাল বিকেল থেকেএতগুলো ঘটনা ঘটে গেছে যেগুলো গুছিয়ে লিখে ফেলা দরকার।
কাল নৈশভোজের পরে গ্রনফেল ও আমি হোটেলের সামনে পায়চারিকরতে বেরিয়েছি, গ্রেনফেলের মাথায় ঘুরছে শুধু গোবিতে বেড়াতেযাবার প্ল্যান, সে অনর্গল বলে চলেছে তার দেশ বিদেশের মরুভূমিদেখার গল্প। এই সময়ে রাস্তা পুরোপুরি ফাঁকা। শুধু এই সময় কেন, রাস্তাঘাট অধিকাংশ সময়েই জনবিরল। মঙ্গোলিয়া বিরাট আয়তনেরদেশ হলেও তার জনসংখ্যা মোটামুটি দুই মিলিয়নের মতো।
গ্রেনফেল নিজের গল্পে নিজেই মেতে ছিল, হঠাৎ আমার মনে হলোপেছনে পায়ের শব্দ, কেউ আসছে। আমি পেছন ফিরে দেখলাম কিন্তুকাউকে দেখতে পেলাম না। আমরা চলেছি ফুটপাথের ধার ঘেঁষে। একপাশে রাস্তা, অন্যপাশে ঝোপ, ফুল গাছ। আশেপাশে বেশি বাড়িনেই। বেশ কিছুটা চলার পরে ফের সেই পায়ের শব্দ, ঠিক পেছনে নয়, এবার যেন আমাদের বাঁ-পাশের ঝোপের ভেতর দিয়ে কেউ চলেছে। গ্রেনফেলকে বলতে সে গল্প থামিয়ে শুনবার চেষ্টা করল, কিন্তু ততক্ষণেশব্দটা মিলিয়ে গেছে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেইউল্টোমুখো হয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল হোটেলে ফিরে। রাত তখন প্রায় সাড়েএগারোটা। সবে শুতে যাবো, ফোন এলো রিসেপশন থেকে। একভদ্রলোক নাকি ফোনে অনেকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন যখনআমরা হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। তিনি এখন আবার ফোন করেছেন, যদিও এখন খুবই দেরি হয়ে গেছে, তবুও উনি দুমিনিটের বেশি সময়নেবেন না। ভদ্রলোকের নাম ঋবাকভ।
অগত্যা লাইনটা কানেক্ট করতে বললাম। ঋবাকভ খুব উত্তেজিত, সেআমার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করে কিছু একটা বলতে চায় এবংসেটা সম্মেলনে যাবার আগেই।
সম্মেলন যেহেতু বিকেলে শুরু হবার কথা, তাই ঠিক করলাম সকালেসে হোটেলে আসবে, একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করতে করতে কথা বলাযাবে।
আজ সকাল আটটা নাগাদ আমার রুম থেকে বেরিয়ে সবে নীচেনেমেছি, হোটেলের লাউঞ্জে দেখি ঋবাকভ ঢুকছে। আমাকে দেখেইবললো, "চলো চলো বাইরে গিয়ে কথা হবে"। বাইরে বেরোতেই দেখিতার ট্যাক্সি তখনও দাঁড়িয়ে। তার সঙ্গে ট্যাক্সিতে করে বেশ কয়েককিলোমিটার দূরে "চিঙ্গিজ খান হোটেল" সংলগ্ন রেস্টুরেন্টে ঢুকলামআমরা।
ঋবাকভ সরাসরি তার বক্তব্যে চলে এলো। স্পেস স্টেশনের চারমাসেরঅভিজ্ঞতায় সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে পৃথীবি ছাড়াও অন্যত্রপ্রাণের স্পন্দন আছে।
কী মুশকিল! শুধু এইটুকু বলবার জন্য আমাকে অসময়ে ফোন করাএবং সাত সকালে হোটেল থেকে তুলে আনার কী প্রয়োজন?
"শুধু এইটুকু নয়"! ঋবাকভ বলে চলল, "গতকাল সন্ধ্যায় আমিএমন কিছু প্রমাণ পেয়েছি যাতে আমার সন্দেহ আরও ঘণীভূতহয়েছে।"
আমি কিছু বলছি না দেখে ঋবাকভ মুষড়ে পড়ল। বলল, "যে কারণেতোমাকে ডেকে আনা, আজ সম্মেলনে অনেক বিজ্ঞানী আসবে যারাবহির্বিশ্বে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিতে চায়, কিন্তু তাদেরমাঝখানে দাঁড়িয়েই আজ আমার অভিজ্ঞতার কথা বলব, অনেকেইআমার কথা শুনে হেসে উঠতে পারে, কিন্তু আমি শুধু তোমার সমর্থনচাই"।
হঠাৎ আমাকে কেন?
ঋবাকভ বলল, "তুমি সিরিয়াস প্রকৃতির লোক, সারা দুনিয়ায় তোমারনানারকম গবেষণার কথা, তোমার সাফল্যের কথা সুবিদিত। তোমারসমর্থন পেলে হয়ত ওরা আমার কথা মন দিয়ে শুনবে।"
তাকে এই বলে আশ্বস্ত করলাম, যত অবাস্তবই শুনতে হোক না কেন, যুক্তিগ্রাহ্য যদি হয় তবে তার অভিজ্ঞতাকে উড়িয়ে দেবার কোনও প্রশইওঠে না।
আজ বিকেলে সম্মেলনের গোড়ার দিকে নানান বিজ্ঞানী বলে গেলেনতাঁদের গবেষণার সাফল্যের কথা। গ্রেনফেল দেখলাম প্রায় ঘুমিয়েপড়েছে। আজ সারাটা দিন সে ঘুরে বেড়িয়েছে নানান জায়গায়, তিরন্দাজি এবং ঘোড়দৌড়ের কীসব প্রতিযোগিতা আছে সামনেরসপ্তাহে, সেগুলো দেখবার লোভ সে সামলাতে পারছে না। ইতোমধ্যেএক স্বনামধন্য "জকি"র সঙ্গে নাকি আলাপও সেরে এসেছে। এসবখবর সে আমায় সম্মেলনে আসবার পথে বলতে বলতে এলো।
রাত সাড়ে নটা নাগাদ ঋবাকভ সুযোগ পেলো মঞ্চে উঠবার। অভ্যাগতদের অনেকেই দেখলাম ঋবাকভের মহাকাশ সফরের গল্পজানে। তাই যেই সে তার অভিজ্ঞতার বিবরণ দেওয়া সবে শুরু করেছে, অডিটোরিয়ামে শুরু হলো শোরগোল, অনেকেই ওকে থামিয়ে দিতেচায়, কেউ কেউ তো রীতিমতো হেসে উঠছে জোরে।
এবার আমি বাধ্য হয়েই মঞ্চে উঠে সকলকে অনুরোধ করলাম, যে সেযা বলছে সেটা তাকে অন্ততঃ বলতে দেওয়া হোক, তার বক্তব্য শুনবারপরে আমরা বিবেচনা করে দেখব সেটা কতটা যুক্তিগ্রাহ্য।
হয়ত আমার গাম্ভীর্য লক্ষ্য করেই, শ্রোতার আসনে বিজ্ঞানীরা চুপ হয়েবসলেন।
ঋবাকভ বলে চলল, "আজ আমি যে অভিজ্ঞতার কথা বলতে এসেছিসেটা মহাকাশের ঘটনা নয়, যদিও তার সঙ্গে সম্পর্কিত। সেটা ঘটেছেগতকাল সন্ধ্যায়। গতকাল সন্ধ্যায় আমি এই শহরের শেষপ্রান্তেযেখানে জনবসতি প্রায় নেই বললেই চলে, সেখানে একটা অদ্ভূত প্রাণীদেখি, যার সঙ্গে একটা ঘোড়ার খুবই সাদৃশ্য…" ঋবাকভের কথা শেষহলো না, গোটা অডিটোরিয়াম ফেটে পড়ল অট্টহাসিতে।
তৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়ল মোংরুর কথা। আমি জানি ঋবাকভেরকথা কাউকে শোনাতে যাওয়া বৃথা। রুমানিয়ার বিজ্ঞানী দান নিদেলকুতো হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবার মতো অবস্থায় কোনও মতেউঠে দাঁড়িয়ে বলল, "তা সেই ঘোড়াটিকে দেখবার সময় তোমার পেটেক পাত্র মদ ছিল জানতে পারি কি"?
আমি ঋবাকভকে সরিয়ে নিয়ে গেলাম সেখান থেকে। সে যে বানানোগল্প বলছে না, সেটা এখন আমার কাছে স্পষ্ট, কিন্তু এখানে সময় নষ্টকরে কোনও লাভ নেই।
হোটেলে ফেরার আগেই ওর সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে, কাল সকালেএই নিয়ে আমরা আলোচনায় বসব। কাল আমি সম্মেলনে যাচ্ছি না।মোংরু এখন গিরিডিতে কী করছে কে জানে!
উলানবাতর
ছঁউই জুন, দুপুর একটা
অসংখ্য বিচিত্র ঘটনা ঘটে গেছে আমার বিজ্ঞানী জীবনে, তবেসেগুলোর কোনওটার সঙ্গেই আজকের এই ঘটনাকে মেলাতে পারছিনা।
ঋবাকভের পুরো নাম, গ্রেগোরি ঋবাকভ। এই সম্মেলনে আরওএকজন আছে যার নামও গ্রেগোরি, সেইজন্য ওকে আমরা পদবি ধরেইডাকছি।
ঋবাকভ উঠেছে ওর বন্ধুর বাড়িতে, শহরের শেষপ্রান্তে। সেখানে যতদূরদেখা যায় শুধু ঝোপ এবং ফাঁকা জমি। সেখানেই সে দেখেছিল সেইঘোড়ার মতো প্রাণীটিকে। কালকেই সে আমাকে জানিয়েছিল, যে তারদেখা ঘোড়াটিও উচ্চতায় এক মিটারের কাছাকাছি। এক মিটার অর্থাৎ তিনফুটের সামান্য বেশি। এই ঘোড়াটির রং সবুজ।
গতকালের প্ল্যান অনুসারে আজ আমি সম্মেলনে যাই নি। কথামতোসকাল দশটায় হোটেল থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ঋবাকভের সঙ্গেদেখা করলাম তার বন্ধুর বাড়িতেই।
আজ বেশ গরম পড়েছে, তাপমাত্রা প্রায় তিরিশ ডিগ্রি। ঋবাকভতৈরিই ছিল। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম সেই রাস্তা ধরে, যেখানে সেঐ ঘোড়াটিকে দেখেছিল। প্রায় আধঘন্টা ধরে সিধে রাস্তা বরাবরহেঁটেও আশে পাশে কোথাও কোনও জনপ্রাণীরই দেখা মিলল না।এদিকে রোদের তেজও বাড়ছে, রাস্তাও ক্রমশঃ খারাপ হচ্ছে। আমরাফিরতি পথ ধরলাম। সঙ্গত কারণেই ঋবাকভ বিষন্ন, কিন্তু আমি যেতাকে বিশ্বাস করছি সেটুকু জেনে সে তখনও আশা হারায় নি।
প্রায় ফিরেই এসেছি, একটা শুকনো নালার ধারে দেখলাম ঘোড়াটাদাঁড়িয়ে। অবিকল মোংরু।
আমরা দুজনেই বাকরুদ্ধ। আমরা দুজনেই অপলক চোখে দেখছিঘোড়াটাকে। সেও আমাদের দুজনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেইচলেছে, সূর্যের কিরণে তার সর্বাঙ্গ চিকচিক করছে এবং স্পষ্ট দেখা যায়দুচোখের নীচে দুটো সাদা দাগ। অবিকল মোংরুর মতো।
বোধহয় নিজের অজান্তেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো "মোংরু"।
আর কী আশ্চর্য! কয়েক পা এগিয়ে আমাদের ঠিক সামনে এসে সেমাথা নাড়ল, সম্মতি জানানোর জন্য যেভাবে মাথা নাড়ে মানুষ।
আমর দুজনেই তাকে হাত দিয়ে ছুঁলাম, সে কোনও আপত্তি করল না।
এবারে কথা বলল ঋবাকভ।
- তুমি বিশ্বাস করবে কি না জানি না, স্পেস স্টেশন "সোলিয়ারিস" এ থাকাকালীন ঠিক এইরকম একটা জিনিসকে আমি মহাকাশে চলেযেতে দেখি। প্রথমে ভেবেছিলাম কোনও মহাকাশযান। কিন্তু খুব কাছদিয়ে যখন সে চলে যাচ্ছিল, তখন আমার শক্তিশালী টেলিস্কোপেদেখেছিলাম একটা চারপেয়ে জন্তু।
আমরা ঠিক করলাম এই ঘোড়াটাকে আপাততঃ ঋবাকভের বন্ধুরবাড়িতেই নিয়ে যাওয়া হোক, আর আমরা আমাদের উপযুক্তযুক্তিগুলো সাজিয়ে সম্মেলনের শেষদিন এই স্পেসিমেন সহ লাইভডেমনস্ট্রেশন দেবো।
মাঝখানে আছে তিনটে দিন। এই তিন দিনে এই দ্বিতীয় মোংরু সম্বন্ধেযত বেশি তথ্য সংগ্রহ করা যাবে, আমাদের যুক্তি ঠিক ততটাইজোরালো হয়ে উঠবে।
নতুন মোংরু আমাদের সঙ্গে আসতে কোনও আপত্তি করে নি। ভালইহয়েছে যে ঋবাকভ হোটেলে ওঠেনি, তাহলে ঘোড়াটাকে কাছে রাখারব্যবস্থা করা যেত না।
এই মুহূর্তে যে জিনিসটার অভাব অনুভব করছি, সেটা হচ্ছে আমারব্রেনোগ্রাফ যন্ত্রটা। ওটা থাকলে আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়েযেত।
তবু হাল ছাড়ছি না।
আজ বিকেলে আবার যাব ঋবাকভের ওখানে, কারণ আমাদের হাতেএখন সময় খুবই কম এবং প্রচুর কাজ এখনও বাকি।
উলানবাতর
ছঁউই জুন, বিকেল চারটে
একটু পরে বেরোব ঋবাকভের সঙ্গে দেখা করতে।
আজ হোটেলের রেস্টুরেন্টে লাঞ্চের সময় দেখা হয়ে গেল গ্রেনফেল ও গুয়ুকের সঙ্গে। সঙ্গে ছিল আরও এক জন - সেই নাম করা মোঙ্গলঘোড়সওয়ার যার নাম অম্রা।
ছোটো খাটো ছিপছিপে এই ঘোড়সওয়ারটির সঙ্গে গ্রেনফেলের বেশভালই আলাপ হয়েছে দেখলাম। অম্রা ইংরিজিতে তেমন সড়গড় নয়, ওর দোভাষীর দায়িত্ব নিয়েছে গুয়ুক।
ঋবাকভের "ঘোড়া দেখা"র গল্পটা ইতোমধ্যেই অম্রাকে বলে ফেলেছেএরা। তিনজনেই খুব হাসছে, যদিও অম্রা ঘোড়াটিকে চাক্ষুষ দেখতেউৎসাহী। সকালের ঘটনা এদের কাছে বলি নি, কারণ এখনও কাজপ্রায় কিছুই এগোয় নি আমাদের।
অম্রা শুধু ভাল "জকি" ই নয়, সে তির চালাতেও ওস্তাদ। সামনেরসপ্তাহে যে প্রতিযোগিতা হতে চলেছে, সেখানে সে আমাকেও আমন্ত্রণজানালো। আমি এখনও কোনও কথা দিই নি। গিরিডিতে ফিরে গিয়েমোংরুকে নিয়ে গবেষণার কাজ ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে।
তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে ওদের অনুমতি নিয়ে নিজের ঘরে ফিরেএলাম। ওরা এখনও আড্ডা চালিয়ে যাচ্ছে।
উলানবাতর
সাতুই জুন, বিকেল চারটে
দ্বিতীয় মোংরুর সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে ঋবাকভ ও আমিকয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে এসেছি।
প্রথমত, এই মোংরুকে ঘোড়ার মতো দেখতে হলেও সাধারণ ঘোড়ারসঙ্গে এর ব্যবহার ও বুদ্ধির কোনও তুলনাই চলে না। এ ছাড়া প্রথমমোংরুর সঙ্গে এর চেহারার কোনও পার্থক্য এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাইনি।
দ্বিতীয়ত, ঋবাকভের বদ্ধমূল ধারণা এই মোংরু পৃথিবীর বাইরে থেকেএসেছে।
শুধু তাইই নয়, গতকাল বেশ কয়েকটি পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যেসে তার সারা গায়ের সবুজ লোম ও চুল ব্যবহার করে উদ্ভিদের মতো। অর্থাৎ ফোটোসিন্থেসিস প্রক্রিয়ায় নিজের খাদ্য নিজেই তৈরি করে। পৃথিবীতে আজ অবধি ফোটোসিন্থেসিস করতে পারা প্রাণীর সন্ধান মেলে নি। এ জিনিস জীবন বিজ্ঞানের জগতে যুগান্তকারী ঘটনা!
ঋবাকভকে জানালাম যে এই মোংরুকে আমি গিরিডিতে নিয়ে যেতেচাই। সেখানে আরেকটি মোংরু আছে এবং দুটিকে পরীক্ষা করলেব্রেনোগ্রাফের সাহায্যে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসতেপারে।
সমস্ত আলোচনাই দ্বিতীয় মোংরুর সামনে হচ্ছিলো, সে এমনভাবেআমাদের কথা শোনে যেন সব বুঝতে পারছে।
গতকাল রাত্রে ঋবাকভ আমাকে হোটেলের সামনে ট্যাক্সি থেকেনামিয়ে দিয়ে চলে যাবার পরে লাউঞ্জে ঢুকছি, হঠাৎ শুনি কেউ আমারনাম ধরে ডাকছে।
ফিরে দেখলাম ভিজিটরদের সোফায় বসে আছে তিরন্দাজ-ঘোড়সওয়ার অম্রা। আজ তার সঙ্গে গুয়ুক নেই। আমি মোঙ্গলীয়ভাষা জানিনা, অম্রার ইংরিজিও ভাঙা ভাঙা। সে হাতের ইশারায়আমাকে তার সামনে বসতে বলল। হঠাৎ কোথা থেকে গ্রেনফেল এসেউপস্থিত।
গ্রেনফেল যা বলল তাতে বুঝলাম আমার অনুপস্থিতিতে ঋবাকভেরদেখা "ঘোড়া" নিয়ে এদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে এবং অম্রা এইঘোড়াটিকে দেখতে চায়। অম্রার স্থির ধারণা যে আমি ঋবাকভকেবুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালে সে অম্রাকে ঘোড়াটি দেখাবে। শুধু তাইইনয়, সে না দেখেই ঘোড়াটি কিনতে চায়।
আমি এতক্ষণ কোনও কথা বলিনি।
ওদেরকে জানিয়ে দিলাম যে ঘোড়াটিকে যদিও আমরা দেখেছি, কিন্তুতাকে বেচে দেবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমরা আমাদের গবেষণারজন্য আপাততঃ ঘোড়াটিকে স্টাডি করছি।
অম্রা প্রায় লাফিয়ে উঠল। সে গড়গড় করে অনেক কথা বলে গেলতার নিজের ভাষায়। কথাগুলো বুঝতে না পারলেও, সে যখন পকেটথেকে টাকা বের করছে, তখন আমি গ্রেনফেলকে বলতে বাধ্য হলামযে, ঘোড়াটিকে এই মুহূর্তে অম্রার হাতে তুলে দিতে আমি অক্ষম, এবংসেই কথাটা সে যেন অম্রাকে বুঝিয়ে বলে।
এর মধ্যে গুয়ুকও এসে পড়ল। আমাদের আলোচনা ক্রমশঃ তর্কেরদিকে মোড় নিচ্ছে দেখে আমি সরাসরি অম্রাকে জানালাম, যে আজযথেষ্ট রাত হয়েছে, আমি ক্লান্ত, অতএব আমার বিশ্রামের প্রয়োজন।
বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছি, গুয়ুক ছুটে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, "অম্রাএই তল্লাটের বেশ ক্ষমতাবান লোক, ওকে চটিও না!"
আরও একবার শুভরাত্রি জানিয়ে এগিয়ে গেলাম লিফটের দিকে, তখনও গুয়ুক বলে চলেছে, "এর ফল ভয়ঙ্কর হতে পারে, তুমি বিপদেপড়তে পারো"।
বিপদের ভয়ে বিজ্ঞানের গবেষণা থেকে দূরে সরে যাবো এমনপরিস্থিতিতে কখনও পড়ি নি। ঠিক করলাম আগামীকাল ঋবাকভকেসমস্ত ঘটনা জানাতে হবে। সেইমতো আজ সকালে ব্রেকফাস্টের পরঝড়ের বেগে ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছলাম ঋবাকভের ডেরায়। ট্যাক্সির ভাড়ামেটাচ্ছি, দেখি ঋবাকভ বেরিয়ে আসছে বাড়ির ভেতর থেকে, তারচোখে মুখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেইসে বলল - "মোংরু উধাও"!
- উধাও! কখন থেকে?
ঋবাকভ জানালো যে আমার সঙ্গে ফোনে কথা হবার পরেই সে বাড়িরপেছনের বাগানে মোংরুকে দেখতে যায়, কিন্তু মোংরু সেখানে ছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সে তাকে দেখতে পায় নি।
মোংরু ঐ বাগানে ছাড়া অবস্থাতেই থাকত। কাজেই সে নিজে নিজেইকোথাও চলে যেতে পারে, কিন্তু টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা হবারপর থেকেই ঋবাকভের সন্দেহ হয়েছে যে অম্রা ও তার দলবল হয়তমোংরুকে কিডন্যাপ করেছে।
যেহেতু মোংরুকে ছাড়া আমাদের গবেষণার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়াসম্ভব নয়, তাই ঠিক করলাম আমরা আজ সম্মেলনে যাব। গিয়ে দেখিগ্রেনফেল ও গুয়ুক দুজনেই অনুপস্থিত।
অস্ট্রিয়ার এক ছোকরা বিজ্ঞানী এরিক মাহরের আমাদের দিকে এগিয়েএসে বলল, "সেকী তোমরা এখানে? আমি তো ভেবেছি তোমরাওগুয়ুক গ্রেনফেলের সঙ্গে আজ গোবি তে বেড়াতে গেছ।"
এ খবরটা নতুন। ওরা কেউই আমাকে জানায় নি। যাই হোক সারাদিনসম্মেলনে কাটিয়ে একটু আগে হোটেলে ফিরেছি। সন্ধেবেলা ঋবাকভআসছে এখানে। গ্রেনফেল কখন ফিরবে সে খবর কেউ দিতে পারলনা। এমন কি রিসেপশনেও সে কোনও চিঠি রেখে যায় নি আমারজন্য। আগামীকাল সম্মেলনের শেষ দিন।
কালকের মধ্যে মোংরুকে খুঁজে না পেলে আমরা কিছু বলতে পারব নাসম্মেলনে। এসময়ে সবচেয়ে বেশি দরকার মাথা ঠাণ্ডা রাখা।
গিরিডি
দশই জুন, সকাল দশটা।
কিছুক্ষণ হলো গিরিডিতে ফিরে এসেছি। এর মধ্যে এত কিছু ঘটে গেছেযেগুলো যথাসম্ভব গুছিয়ে লিখে রাখার চেষ্টা করছি। তরশু সন্ধেবেলাহোটেলের বিল মিটিয়ে চেক-আউট করে আমার ব্যাগ নিয়ে ঋবাকভেরজন্য লাউঞ্জে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম।
আগে থেকেই ঠিক ছিল, কয়েকটা দিন ওর বাড়িতেই একসঙ্গে গবেষণাকরা যাবে, এতে সময় বাঁচবে। কিন্তু ঘন্টাখানেক পেরিয়ে যাবার পরওঋবাকভ আসছে না দেখে শেষটায় তার বন্ধুর বাড়িতে ফোন করে দেখিফোন বেজেই যাচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ঠিক করলাম ওরবাড়ি যাব। হোটেলের বাইরে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল। ট্যাক্সিতেউঠতেই ড্রাইভার প্রচণ্ড গতিতে ঋবাকভের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকেনিয়ে চলল আমায়। ড্রাইভার আমার কোনও কথা শুনছে না এবংট্যাক্সি এত জোরে চালাচ্ছে, যে রাস্তায় বেশি গাড়ি থাকলেঅ্যাকসিডেন্ট হতে বাধ্য। প্রায় বিশ মিনিট এভাবে চালাবার পরেট্যাক্সি এসে থামল একটা ফাঁকা জায়গায়।
এর মধ্যে আমরা উলানবাতর শহরের বাইরে চলে এসেছি। জায়গাটায়কোনও বাড়ি নেই, যতদূর দেখা যায় শুধু ফাঁকা জমি আর মাঝে মাঝেকয়েকটা গাছ। সূর্য অস্ত গেছে কিছুক্ষণ, তবুও যেটুকু আলোর রেশআছে তাতে দেখতে পেলাম কাছেই আরেকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে, সেটাট্যাক্সি নয়। এবার সেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো দুজন লোক। এদেরএকজনকে আমি বিলক্ষণ চিনি, সে হচ্ছে অম্রা, আর অন্যজন খুবসম্ভবত গাড়ির চালক।
সেই অন্যজন উচ্চতায় অন্ততঃ সাড়ে ছ ফুট এবং যথেষ্ট বলশালীচেহারা। গাড়ির পেছনের দরজা খুলে সে হুকুমের সুরে চেঁচিয়ে বল, "গেট ইন্টু দ্য কার"!
ব্যাগটুকু সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। এখানে প্রতিবাদ করাঅর্থহীন। আমার পাশেই হাত পা বাঁধা অবস্থায় বসে থাকতে দেখলামঋবাকভকে। সে যে স্বেচ্ছায় আসে নি সেটা তার ঠোঁটের কোণে রক্তদেখেই বোঝা যাচ্ছে।
আমাকে গাড়ির ভেতর ঠেলে দিয়ে পাশে এসে বসল অম্রা। গাড়িচলতে শুরু করল সম্পূর্ণ ধু ধু প্রান্তরে। এরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেআমাদের আমি জানি না। চারিদিকে অন্ধকার, শুধু হেডলাইটেরআলোয় রাস্তা দেখে গাড়ি চালাচ্ছে চালক।
কয়েক ঘন্টা চলবার পরে গাড়ির গতি দেখে বুঝলাম যে আমরাবাঁধানো রাস্তা ছেড়ে নরম জমির ওপর চলতে শুরু করেছি।
নিজের ভাষায় ড্রাইভারের সঙ্গে দু একটা কথা বলা ছাড়া অম্রাএতক্ষণ কোনও কথা বলেনি আমাদের সঙ্গে। ঋবাকভ জেগে আছে, কিন্তু নিশ্চুপ।
আরও বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি চলবার পরে আস্তে আস্তে বাইরেরঅন্ধকার কিছুটা কেটে গেল। আকাশে চাঁদ উঠেছে, আর তার আলোয়দেখা যাচ্ছে আমাদের চারিদিকে যতদূর দেখা যায় শুধু বালি আরকাঁটাঝোপ।
একটা ঢিবির কাছে এসে গাড়ি থামল। অম্রা দরজা খুলে বাইরেদাঁড়িয়ে আমাদেরও বেরিয়ে আসতে ইঙ্গিত করল।
আমরা বাইরে এসে দাঁড়াবার পরে অম্রার নির্দেশে চালক জানালোওরা আমাদের রেখে যাচ্ছে এখানে। সেই "আশ্চর্য ঘোড়া" কে যদিঅম্রার হাতে তুলে না দিই, তবে এই মরুভূমিতেই আমাদের মৃত্যুঅবধারিত।
আগামিকাল ওরা আসবে আমাদের উত্তর জানতে।
আমি বললাম, যে ঐ ঘোড়া কোথায় তা আমরাও জানি না। কিন্তুআমার কথার কোনও গুরুত্ব না দিয়ে ওরা গাড়িতে উঠে বসল, ইঞ্জিনেস্টার্ট দেবার পরে ড্রাইভার বলে উঠল, "আশেপাশে একশোকিলোমিটারের ব্যাসার্ধে কোনও মানুষ নেই, বাঁচতে হলে ঐ ঘোড়ারখবর কালকে দিও। আর কালকে খবর না দিলে, আর আমরা আসবনা।"
বালির ঝড় তুলে ইঞ্জিনের গোঁ গোঁ শব্দের সঙ্গে অম্রার বিশাল গাড়িমিলিয়ে গেল গোবি মরুভূমির মধ্যে।
এখন চারিদিক নিঃস্তব্ধ। চাঁদের আলোয় দূরে দেখা যাচ্ছে কয়েকটাপাহাড়। হাতপা বাঁধা অবস্থায় বালির ওপরে বসে পড়েছে ঋবাকভ। তাপমাত্রা ক্রমশঃ নীচের দিকে নামছে। মরুভূমির এই ই নিয়ম, দিন ও রাতের তাপমাত্রার মধ্যে বিশাল পার্থক্য থাকে। ঋবাকভের বাঁধন খুলেদিয়ে ভাবছি ঠাণ্ডার থেকেও বেশি চিন্তার কারণ এই মরুভূমি থেকেআমরা বের হবো কেমন করে?
বালির ওপর থেকে গাড়ির চাকার দাগ এর মধ্যেই মিলিয়ে গিয়েছে, কারণ বাতাসের ঝাপটায় প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে বালির ওপরেরপ্যাটার্ন।
ঋবাকভ এবার কথা বলল।
- আমরা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে। এই মরুভূমির মধ্যে তিলেতিলে মরতে হবে আমাদের।
আমার পকেটে আছে দিকনির্ণয়ক যন্ত্র। তাতে বলছে আমরাউলানবাতর থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে। সঙ্গে জল বাখাবার কোনওটাই নেই। বহুদূরে পশ্চিম দিকে অস্পষ্ট কিছু ঝোপ বাঘাস, যাকে বলে স্তেপ। কিন্তু পায়ে হেঁটে এই মরুভূমি পার হওয়াঅসম্ভব।
ঋবাকভ এবার কিছু খবর জানালো আমাকে। অম্রা নাকি তারঘোড়দৌড়ের জন্যে ঐ আশ্চর্য ঘোড়াটিকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। আপাত দৃষ্টিতে তেমন শক্তিশালী না দেখালেও সে নিশ্চিত যে ঐ ঘোড়া সবচেয়ে বেশি স্পীড তুলতে পারবে। ঘোড়দৌড়ের বাজিতে টাকাখাটানো তার পেশা এবং এসব কাজের জন্য অন্যায়ের আশ্রয় নিতেযে সে পেছপা হয় না, তা এতক্ষণে আমাদের আর অজানা নয়। ঘোড়দৌড় ছাড়াও তিরন্দাজিতে সে পটু, সেখানেও সে প্রচুর বাজিফেলে ঐ খেলা খেলে।
আমি বললাম, কিন্তু মোংরুর খবর তো আমরা জানি না।
ঋবাকভ বলল, সেটা অম্রাকে বিশ্বাস করানোর কোনও উপায় নেই। কিন্তু আমাদের বাঁচবার কোনও পথ তো দেখতে পাচ্ছি না।
আমরা বালির ওপরে কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না, আকাশে চাঁদেরআলোয় চারিদিক বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, এমন সময়ে একটা খশখশ শব্দ শুনে পেছন ফিরে দেখি মোংরু দাঁড়িয়ে। সে কীভাবে তখনওখানে এলো, সেসব প্রশ্ন মাথায় এলেও ঋবাকভ ও আমি একসঙ্গেইএকটা সিদ্ধান্ত নিলাম। মোংরুই আমাদের এই মরুভূমি থেকেলোকালয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
- ঘোড়ায় ওঠো শঙ্কু! এছাড়া আর উপায় নেই। আমাদের পালাতেহবে।
ঋবাকভের কথা শেষ হতে না হতেই দেখি মোংরু আমার পাশে এসেদাঁড়িয়েছে, আর সেই চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার মুখেমুচকি হাসি। আমি তার পিঠে চাপলে সে কোনও আপত্তি করল না। আমার পেছনে বসল ঋবাকভ।
তারপর শুধু দেখে গেলাম আমরা মোংরুর ক্ষমতা। আমাদেরদুজনকে পিঠে করে, ঝড়ের বেগে ছুটে চলল সে বালির ওপরে।ঋবাকভ আমাকে ধরে রেখেছে, আর আমি একহাতে সামলাচ্ছিআমার চশমা আর অন্য হাতে আঁকড়ে ধরে আছি মোংরুক। দীর্ঘ পথবালির ওপর দিয়ে দৌড়নোর পরে, আমরা ঢুকে পড়েছি দেড় মানুষ উঁচুঘাসের জঙ্গলে।
-স্তেপ!
চেঁচিয়ে উঠল ঋবাকভ। বন্য জন্তুর বাসস্থান, স্বাপদ সঙ্কুল, এমনকিবাঘ থাকলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
হয়তো আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই মোংরু বাড়িয়ে দিলোতার স্পীড। এত ঝাঁকুনি যে যেকোনও মুহূর্তে আমরা ছিটকে পড়তেপারি তার পিঠ থেকে।
এরপর মোংরু যা করল, তার কোনও জবাব নেই। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতেযখন প্রায় পড়ে যাচ্ছি আমরা, হঠাৎ দেখলাম আর কোনও ঝাঁকুনিনেই, পাশের ঘন ঝোপের লম্বা লম্বা ঘাস আর গায়ে ঘষা লাগছে না, আমরা সেই জমি থেকে আস্তে আস্তে উঠে গেছি বেশ উঁচুতে। শূন্যেউড়ে চলেছে মোংরু আর তার পিঠে চড়ে আমরা দেখছি লাল হয়েআসছে পূরের আকাশ। নীচে ছোটো হয়ে যাচ্ছে মরুভূমি, স্তেপ, সরুনদী আর উলানবাতর।
- পেগাসাস!
আবারও উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো ঋবাকভ। এতদিন শুধু গল্পের বইয়েইপড়েছি পক্ষীরাজ ঘোড়ার গল্প।
আমিও পক্ষীরাজ ঘোড়ার গল্প ঠাকুরমার ঝুলিতে পড়েছি সেকথাজানালাম ঋবাকভকে।
বিস্তীর্ণ সেই পথ আকাশে পার হয়ে মোংরু এবার নীচে নামতে শুরুকরল। নীচে প্রকাণ্ড একটা লেক। তার পাশেই নেমে এলাম মোংরুরপিঠে আমরা।
গত কয়েক ঘন্টায় যা ঘটেছে তা বিশ্বাস করা অসম্ভব হতো যদিনাপাশে তখনও দাঁড়িয়ে থাকত জ্বলজ্যান্ত মোংরু। পকেট থেকেদিকনির্ণয়ক যন্ত্র বের করে দেখলাম, আমরা বেশ কিছুক্ষণ আগেইমঙ্গোলিয়া ছাড়িয়ে এসেছি পেছনে। আর আমাদের সামনের লেকটিরনাম বৈকাল। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো মিষ্টি জলের লেক, গভীরতমওবটে। তার স্বচ্ছ জলের ওপরে পড়েছে আমাদের প্রতিবিম্ব এবং তলায়দেখা যাচ্ছে অজস্র নুড়ি। চারিদিকে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।ঋবাকভ, মোংরু ও আমি তিনজনেই খেলাম বৈকালের জল। আরচিন্তা নেই। আপাততঃ আমরা বিপদ থেকে মুক্ত। ঠিক করলামমোংরুকে এখানেই বিদায় দেওয়া হোক। যে অপরিসীম সাহায্য ও বন্ধুত্বের পরিচয় পেয়েছি তার কাছ থেকে, এর কোনও তুলনাই হয় না।
মোংরুকে বিদায় জানিয়ে আমরা চললাম লোকালয়ের সন্ধানে, ইর্কুৎস্কগামী ট্রেন ধরতে। ইর্কুৎস্ক থেকে বাকি পথটা ফিরে এলামনিরুপদ্রবে।
গিরিডির বাড়িতে ফিরেও প্রথম-মোংরুর দেখা পেলাম না। প্রহ্লাদবলল, আমি মঙ্গোলিয়া রওনা দেবার দিন সন্ধে থেকেই মোংরু উধাওহয়েছে।
আফশোস একটাই, ব্রেনোগ্রাফের সাহায্যে মোংরুর মনের কথালিপিবদ্ধ করা গেল না।
এবার একটু বিশ্রাম নিয়ে এ কদিনের জমে থাকা কাজগুলো একে একেসেরে ফেলব।
গিরিডি
এগারোই জুন, সকাল সাতটা।
ব্রেনোগ্রাফ নিয়ে আমার গবেষণা এখানেই আপাতত শেষ করবারসিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথমে কালু ও পরে মোংরুকে নিয়ে কাজ করাকালীনএত অজানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে, যেসবের স্বীকৃতি দেবার জন্যআজকের বিজ্ঞানীসমাজ প্রস্তুত নয় বলেই আমার বিশ্বাস।
গতকাল ইমেইল চেক করে দেখলাম ঋবাকভ নির্বিঘ্নে পৌঁছে গেছেমস্কোয়।
অন্যদিকে গ্রেনফেল ও গুয়ুক তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কথা স্বীকারকরে, ক্ষমা চেয়েছে। গোবিভ্রমনের শেষে হোটেলে ফিরে গ্রেনফেল নাকিজানতে পারে যে আমি ফিরে গেছি, আমার সঙ্গে বিদায় নেওয়া হলোনা বলে সে দুঃখ প্রকাশ করেছে। অম্রার হিংস্র আচরণ আশা করিতার কাছে এখনও অজানা।
আমি তাকে কুশল সংবাদ দিয়ে উত্তর দিয়ে দিলাম, আমাদেরমরুভূমির অভিজ্ঞতার বিন্দু বিসর্গও ওকে লিখি নি। গুয়ুককেওধন্যবাদ জানিয়ে একটা ছোটো চিঠি লিখে সবে উঠেছি, দেখিঅবিনাশবাবু এসে হাজির।
"আপনার টাট্টু তো উধাও হয়েছিল মশাই!"
এ খবর যে আমার অজানা নয় তা জানালাম অবিনাশবাবুকে।
"কিন্তু সে তো আবার ফিরে এসেছে, নীচে দেখলাম যেন আমগাছেরনীচে!"
- মোংরু ফিরে এসেছে?
আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে, ব্রেনোগ্রাফ হাতে প্রায় দৌড়ে নেমেগেলাম সিঁড়ি দিয়ে। এখন আর আমার কোনও দ্বিধা সন্দেহ নেই যেমঙ্গোলিয়ার সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে এই মোংরুই আমাদের রক্ষাকরেছে। আমগাছের নীচ থেকে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটের কোণায় সেই হাসি।
ব্রেনোগ্রাফ পরিয়ে দিলাম মোংরুর গলায়। তাকে ওখানে রেখে ফিরেএলাম ল্যাবরেটরিতে। ফ্রিকোয়েন্সি অল্প মডুলেট করতেই মনিটরেভেসে উঠল মোংরুর কথা।
কী অভাবনীয় এই অভিজ্ঞতা।
সে বলে চলেছে, আমাদেরই গ্যালাক্সির থেকে মাত্র অর্ধেকআলোকবর্ষ দূরে একটি গ্রহের তিনটি উপগ্রহ। তারই এক উপগ্রহেরবাসিন্দা এই অদ্ভূত বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী। প্রাণী হলেও এরা উদ্ভিদের মতোনিজের খাদ্য নিজেই তৈরি করে।
মোংরু বলে চলল তাদের উপগ্রহের কথা, আমাদের পৃথিবীকে খুঁজেপাবার গল্প, মহাকাশে স্পেস স্টেশনে ঋবাকভের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াও অবশেষে গিরিডিতে উশ্রীর ধারে তার ল্যান্ডিং।
আমাদের গ্রহকে খুব কাছ থেকে দেখবার জন্য সে চেয়েছিল একজনমানুষের সাহায্য। আমি মঙ্গোলিয়া যাচ্ছি জেনে সে আমার পিছু পিছুরওনা দেয়। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, প্রয়োজনে সে নিজেইনিজেকে বানিয়ে ফেলে মহাকাশযান।
মোংরু নিজেও একজন বৈজ্ঞানিক তার নিজের উপগ্রহে। পৃথিবীর সবঅভিজ্ঞতা ও আমাদের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের খবর নিয়ে সে ফিরে যাবেনিজের উপগ্রহে।
আমি নীচে নেমে এসে ব্রেনোগ্রাফ খুলে নিলাম। এই সব তথ্য আমিপাঠিয়ে দেবো ঋবাকভকে।
রাত্রে মোংরুর সঙ্গে ঊশ্রীর ধার ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেছলামঅভ্রখনি অঞ্চলে। মোংরু নেড়েচেড়ে দেখল কয়েকটা অভ্রের টুকরো।
রাত্রে আরেকবার ব্রেনোগ্রাফের মারফৎ সে জানিয়েছে, ফিরে যাবেরাত্রেই কোনও এক সময়ে। তাকে গুডনাইট জানিয়ে ঘুমোতে গেছি প্রায়মধ্য রাত্রে।
আজ ভোরে উঠে বুঝলাম মোংরু চলে গেছে। বাগানে আমগাছেরনীচটা খালি পড়ে আছে এখন।
চশমাটা খুঁজতে গিয়ে ল্যাবরেটরিতে ঢুকে দেখি টেবিলের ওপরে একটাচকচকে জিনিস। প্রায় দশ ইঞ্চি লম্বা ও ইঞ্চি ছয়েক উঁচু একটা ঘোড়ারমূর্তি। মূর্তিটা অবিকল মোংরুর মতো, তার ঠোঁটের কোণেও সেই হাসি, দক্ষিণের জানলা দিয়ে অশ্বত্থ গাছের পাতার রং প্রতিফলিত হচ্ছে সেইঅভ্রের মূর্তির ওপর। তাই এই মোংরুও সবুজ, অবিশ্যি অবিনাশবাবুদেখলে কোন রং বলে বসবেন, জানি না।
শেষ
রচনা - যোষিতা