এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  সমাজ

  • ...গেয়ে ধান কাটে চাষা...(২)

    অনিমেষ চট্টোপাধ্যায়
    আলোচনা | সমাজ | ০৮ নভেম্বর ২০২১ | ২২৭৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • পর্ব ১ | পর্ব ২
    (১) এ প্রবন্ধ কোনো ভাষাবিদের ভাষাতত্ত্বের ওপর লেখা নয়। এ প্রবন্ধ সামাজিক সমস্যা ও দ্বন্দ্বের অনুসন্ধান। বাঙলা ভাষার দুনিয়ায় জাতপাতের ভেদ, ধর্মে ধর্মে বিভেদ - সাম্প্রদায়িকতার বীজ অথবা ঔপনিবেশিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ কেমন করে ইতিহাসের গর্ভে অঙ্কুরিত হয়েছিল - এ প্রবন্ধ তার অন্বেষণ। (২) এই প্রবন্ধের দু’টি ভাগ। প্রথম ভাগে ছিল, আমাদের দেশ কবে থেকে বাঙলা-দেশ বলে পরিচিত হল, আমাদের ভাষা কবে থেকে বাঙলা বা সাবেকি বাঙ্গালা বলে পরিচিত হল এবং কারা কবে থেকে বাঙালি বলে পরিচিত হতে লাগল। আর এই দ্বিতীয় ভাগে, বাঙলা গদ্যের জন্মকথা ও তার বড় হওয়া। দু’টি ভাগের লক্ষ্য - আমাদের ভাষা-ইতিহাস চর্চার বিবর্তন।


    (২)

    বাঙলা গদ্যের ঠিকুজী কুষ্ঠি
    বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে কিছুদিন আগে পর্যন্ত লেখা থাকত, ‘শ্রীরামপুর মিশনারি আর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মুন্সিদের হাত দিয়েই বাঙলা গদ্যের জন্ম’। যে সন্দেহটা আমাদের মত সাধারণ লোকের মনে জাগে – তাহলে চিঠিপত্র কিভাবে লেখা হত? ছাপাখানার আবির্ভাবের আগে গল্প-কাহিনী ছন্দেই লিখতে হত, শুধুমাত্র মনে রাখার জন্যে। কারণ বাক্যের পর বাক্য গদ্য মুখস্থ রাখা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আর হাতে লেখা পুঁথির কপি সুলভ্য ছিল না। সহজ কাজও ছিল না। কিন্তু মানুষ কথা বলত গদ্যেই। তাই চিঠিও গদ্যের মাধ্যমে হবার সম্ভবনাই বেশি। আধুনিক ইংরেজি ভাষার সূত্রপাতও ব্যবসায়ীদের চিঠির আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে হয়েছিল। এই স্বাভাবিক ইতিহাসের ধারাকে আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসের লেখকরা অগ্রাহ্য করেছিলেন। যদিও সাহিত্যের ইতিহাস-চর্চার প্রথম যুগের গবেষকরা পুরনো গদ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রথমে কৈলাস চন্দ্র ঘোষ (১৮৮৫), তারপর দীনেশ চন্দ্র সেন (১৮৯৬), সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৯১৬), সুশীলকুমার দে (১৯১৯) এবং শিবরতন মিত্র (১৯২০)। এঁরা সবাই – ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অনেক আগে থেকেই যে বাঙলা গদ্য বিকশিত হয়েছিল – সে বিষয়ে বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কিন্তু দীনেশ চন্দ্র সেন ছাড়া সব সাহিত্যের ইতিহাসকাররা এই তথ্যকে অগ্রাহ্য করেছেন কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। কলোনিয়াল আদিখ্যেতা হলেও হতে পারে।

    বাঙলা গদ্যের সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন, এখনো পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে, তা ১৬শ শতাব্দীর একটি চিঠিতে (১৫৫৫)। আসামের রাজা চুকাম্ফা স্বর্গদেবকে লিখেছিলেন কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণ। চিঠির ভাষা–
    ‘লেখনং কার্যঞ্চ। এথা আমরা কুশল। তোমার কুশল নিরন্তর বাঞ্ছা করি। অখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রাপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত রহে। তোমার আমার কর্ত্তব্যে বার্দ্ধতাক পাই পুষ্পিত ফলিত হইবেক। ... সত্যানন্দ কর্ম্মী রামেশ্বর শর্মা কালকেকু ও ধুম সর্দ্দার উদ্ভন্ড চাউনিয়া শ্যম্রাই ইমরাক পাঠাইতেছি তামরার মুখে। সকল সমাচার চিতাপ বিদায় দিবা। অপর উকিল সঙ্গে ঘুড়ি ধনু, চেঙ্গল মৎস্য ... সমাচার বুঝি কহি পাঠাইবেক’।

    এ চিঠি ছিল এক উচ্চবংশীয় হিন্দু রাজার – আর এক উচ্চবংশীয় হিন্দু রাজাকে। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এতে বেশিরভাগ তৎসম ও তদ্ভব, কিছু দেশি। তবে ‘সর্দার’ বা ‘উকিলের’ মত আরবি-ফারসি শব্দও আছে। এরকম বেশ অনেক চিঠি পাওয়া গেছে। যেগুলি রাজা বা রাজকার্যের সঙ্গে যুক্ত। এই সমস্ত চিঠি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপনের দেড়শ’ বছর আগের। সাহিত্যেও কিন্তু কিছু নমুনা পাওয়া গেছে। রুপ গোস্বামীর কারিকা থেকে একটা ছোট্ট অংশ তুলে দিচ্ছি (১৬৩১)–
    “শ্রীপঞ্চমীতে তিনদিন থাকিতে [শ্রীমতী] বাপের বাড়ি জানঃ।। মাঘ ফাল্গুন চৈত্রের ফুলদোল পর্য্যন্ত বাপের ঘরে থাকিয়া হুলিখেলা খেলেন। জতদিন হুলিখেলা তত [দিন] গোচারণ নাঞ্চিঃ।। হুলিখেলার ছলে মধ্যাহ্নে কৃষ্ণমিলনঃ।। বৈসাখ মাষে সসুর ঘরকে আইসেন।”

    একদম আধুনিক বাঙলার মতো ছোট ছোট বাক্য। সরল গঠন। এইটাই বৈষ্ণব সাহিত্যের গুণ ছিল। তখনো বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধারার উচ্চবর্ণর প্রভাব আসেনি। এমনকি সাবেকি ‘সসুর’ জাতীয় আজ-অপ্রচলিত তদ্ভব শব্দের ব্যবহার পাচ্ছি। সে যুগ ছিল বৈষ্ণব সাহিত্যের জোয়ারের যুগ। বঙ্গদেশ তখন মোঘল রাজত্বের সুবাহ। আরো একটি নমুনা পাওয়া গেছে। সেটিও এই ধারার। নরোত্তমদাসের দেহকড়চ (১৬৭৫)–
    “ভবনগর হইতে রতি চলিল। স্থানে স্থানে রতি বিমোচন। কাইক রতি শ্রীমতীর ভূত আত্মা। বাজিক রতি জিব আত্মা। মানসিক রতি শ্রীমতীর পরম আত্মা। প্রতিপদ দিনে রতি ভবনগরে। দুতিআঞ্চ রতি কন্ঠনগরে ... সপ্তমিতে রতি প্রেমপদ্য উপরে।”

    এই লেখাটিরও বাক্য ছোট। কিন্তু যেটা উল্লেখ করার মত নজর কাড়া, সেটা হল বেশিরভাগ বাক্য ক্রিয়াপদহীন – যদিও অতি সরল। অপর লক্ষণীয় দিক হল, আরবি-ফার্সি শব্দের ব্যবহার নেই। বৈষ্ণব সাহিত্যের এটা বিশেষ স্টাইল বলা যেতে পারে। এ তো গেল মধ্যযুগের ইতিহাসের নিদর্শন, তথ্য। কোম্পানির ব্যবসার আমলে, ১৭শ – ১৮শ শতকে বাঙলা গদ্য কেমন ছিল? এই সময়ের ব্যবসায়িক লেন-দেনের চিঠির কথা বলছি।
    সাধারণ ব্যবসায়ীদের চিঠির ভাষার মাধ্যমে বাঙলা গদ্য কিভাবে গড়ে উঠেছিল? কারণ এই চিঠিগুলি স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিদিন লেখা হত। তাই ছিল গদ্যের ভাষার, ব্যবহারের মাধ্যমে গড়ে ওঠার আসল ইতিহাস। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে এই অংশটির শেষ টানব।
    প্রথমে এক তাঁত-ব্যবসায়ী – শ্রীহরিমোহন শর্মার প্রতিবাদ আর্জির চিঠি (১৭৮৬)–
    “শ্রীযুক্ত ওলন্দাজ কোম্পানীতে আড়ঙ্গ বিরভূমের গঞ্জে খরিদের দাদনী আমি লইয়া টাকা আড়ঙ্গ চালানী করিয়াছি আপরেল মাহাতে এবং মোকাম মজকুরের গোমস্তা কাপড় খরিদ করিতেছিল এবং কাপড় কথক কথক আমদানী হইয়াছে এবং হইতেছিল ... সংপ্রীতি মেঃ গেল সাহেবের তরফ পেয়াদা আসিয়া খামখা জবরদস্তী ও মারপিট করিয়া ঘাট হইতে ধোবা লোককে ধরিয়া লইয়া গেলো ... আমার কমবেষ ৪০০০ চারি হাজার থান কাপড় ধোবার ঘাটে দাস্ত বেগর পচিতে লাগিল অতএব আরজ ইহার তদারক মেহেরবানী করিয়া করিতে হুকুম হয়
    পূর্ব্ব এই সকল দৌরাত্তী কারণ মহাজনান আরজি দিয়াছিল তাহার জবাব মেলে নাই অতেব আরজ সাহেব আমাদিগের মালিক জাহাতে ত্বরায় আড়ঙ্গ খোলসা হয় এমত করিতে হুকুম হয়” –

    এই আর্জি পত্রটির কয়েকটি শব্দ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথমত, সব ক্রিয়াপদ শুদ্ধ। বাক্যগুলিকে তাই শুদ্ধ বাঙলা বলতে হবে। দ্বিতীয়ত, এতে প্রচুর আরবি-ফার্সি শব্দ আছে। আর সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং, শেষ লাইনে মহাজনরা (বহুবচন) – এই ‘রা’ এর বদলে ফার্সি ‘আন’ বিভক্তির ব্যবহার। সে আমলে বহুবচনে ফার্সি ‘আন’ বিভক্তির প্রচলন বাঙলায় প্রচুর ছিল।
    দ্বিতীয়টি এক মজার বিজ্ঞপ্তি/বিজ্ঞাপন–
    “বিক্রী হইবেক
    একটা বড় সুবুদ্ধী সিংহ মাদি বাচ্চা আরাবী মুলুকের ইহার কির্ম্মত সিক্‌কা ২০০০ তঙ্কা যে কেহ খরিদ করিতে চাহে মেং দৃং এন কোং সাহেবকে জিজ্ঞাসিলে পাইবেক”

    এখানেও ক্রিয়াপদ শুদ্ধ। কিন্তু আরবি ফার্সি শব্দের ব্যবহার আজকের বাঙলার তুলনায় অনেক বেশি।
    আরো এক উল্লেখযোগ্য বিষয়, অন্তঃস্থ ‘ব’এর ব্যবহার – waist coat, wavell এই জাতীয় শব্দ বাঙলায় লেখা হত বেস্ট কোট বা ওবেল হিসেবে (অন্তঃস্থ ‘ব’ এখন আধুনিক বাঙলায় সম্পূর্ণ অকেজো)।
    এইভাবে বাঙলা লিখিত গদ্য নিজের নিয়মে গড়ে উঠছিল। নিজের নিয়মে যে ভাষা মানুষের সামাজিক আদানপ্রদানের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে, তাকেই স্বাভাবিক বিকাশ বলে। স্বাভাবিক নিয়মে কেউ সংস্কৃত-ঘেঁষা শব্দ ব্যবহার করবে, আবার অন্য কেউ সাধারণ হাট-বাজারের চলতি শব্দ ব্যবহার করবে।
    এসবই হয়েছে ১৬শ শতাব্দী থেকে ১৮শ শতাব্দীর মধ্যে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার( ১৮০০) আগেই।

    কলোনিয়াল হস্তক্ষেপ ও উচ্চবর্ণের উন্নাসিকতার পুনঃপ্রবেশ

    কৃত্রিম ও আকস্মিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু হল, যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ ওপরওলারা বাঙলা গদ্যের শব্দ ব্যবহারে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করলেন।
    বাঙলা হরফ তৈরি করে বাঙলা ছাপা প্রথম পাওয়া যায় হ্যালহেডের বাঙলা ব্যাকরণ বইয়ের উদ্ধৃতি অংশে(১৭৭৬)। এরপর মেয়র্স কোটের (১৭২৬-১৭৭৩) আইনের বাঙলা তর্জমা এবং পরবর্তী সুপ্রিম কোর্টের প্রতিষ্ঠার (১৭৮৪-১৮৬১, এই প্রথম সুপ্রিম কোর্টের নাম ছিল - supreme court of juridicature) পর আইনের অনুবাদ দিয়ে বাঙলা ছাপা বইয়ের জন্ম হয়। প্রসঙ্গত, একটি পপুলার ভুল ধারণা আছে, যে প্রথম বাঙলা বই ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে বেরিয়েছিল। আসলে প্রথম বাঙলা বই বেরিয়েছিল ১৭৮৪ সালে। এটি ইংরেজি আইনের বাঙলা অনুবাদ। অনুবাদক হিসেবে নাম ছিল জোনাথান ডানকান।

    ওয়ারেন হেস্টিংস তখন গর্ভনর জেনারেল। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সমস্ত ইংলিশ ল-কে বাঙলায় অনুবাদ করার দরকার আছে। এছাড়াও হেস্টিংস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসারদের বাঙলা শেখা জরুরি মনে করতেন। তাই তিনি হ্যালহেডকে দিয়ে প্রথমে হিন্দু আইনের ইংরেজি করান (gentoo codes)। পরে বাঙলা গ্রামার বা ব্যাকরণের টেক্সট বই লেখান। ১৮০১ সালের মধ্যে অন্তত পঁচিশটি বিভিন্ন আইনের বইয়ের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ আমলে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার আগে, বাঙলা গদ্যের বিকাশে এই অনুবাদগুলির খুব বড় ভূমিকা আছে। এই অনুবাদের বইগুলি আগামী চার-পাঁচ দশকের বাঙলা গদ্যের ধারাকে তৈরি করে দিয়েছিল। প্রচলিত বাঙলা গদ্যের ইতিহাসে এই অধ্যায়ের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।
    হেস্টিংস অন্তত চার-পাঁচজন অনুবাদক নিয়োগ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন জোনাথান ডানকান ও হেনরি পিটস ফরস্টার। এঁদের ওপরে প্রবল প্রভাব ছিল ন্যাথেনিয়েল হ্যালহেডের (grammer of bengalee-র রচয়িতা)। এঁরা সবাই প্রায় একসঙ্গে বিলেত থেকে এসেছিলেন ১৭৭২ থেকে ’৭৬ এর মধ্যে। হ্যালহেড বিলেত থেকে আসার ছয় বছরের মধ্যে বাঙলা গ্রামারের বই লেখেন।

    তখনকার কলোলিয়াল নিয়ম অনুযায়ী, এরকম উঁচু পদে একমাত্র ইংরেজদেরই নিয়োগের অনুমতি ছিল। ফলে অনুবাদক হিসেবে ডানকান বা ফরস্টার-কে নিয়োগ করা হয়েছিল। এখানে প্রশ্ন আসে, একজন মানুষ যতই উচ্চমেধার হন না কেন, পাঁচ বছরের মধ্যে গ্রামার বই লেখার মত পারদর্শী কি করে হন? একইভাবে, ডানকান বা ফরস্টার কলকাতায় পৌঁছবার কয়েকবছরের মধ্যেই অনুবাদের কাজ শুরু করেন। এঁরা ভাষাবিদ ছিলেন না। অথচ এরকম অসম্ভব কাজ করেছিলেন কি করে?
    বাস্তবে হ্যালহেড, ডানকান বা ফরস্টার কেউই নিজেরা অনুবাদ করেননি। এঁরা সবাই কাজ চালানো বাঙলা এবং অল্প সংস্কৃত বা ফার্সি জানতেন। কিন্তু দক্ষতা ছিল না। তাঁরা অনুবাদ করিয়েছিলেন পণ্ডিত বা মুন্সিদের দিয়ে। এই মুন্সিদের নিয়োগ করা বে-আইনি ছিল না। ইংরেজ অফিসিয়াল অনুবাদকরা কোম্পানির থেকে আলাদা টাকা পেতেন মুন্সি নিয়োগের জন্যে। সামগ্রিক পরিচালনার দায়িত্ব অবশ্য থাকত ইংরেজ ‘অনুবাদকের’ ওপর। পরিষ্কার রাজশক্তির অন্যায় দম্ভের প্রকাশ।

    এই অজানা, অনামী মুন্সি বা পণ্ডিতরাই অনুবাদে আসল ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই সমস্ত আইনের পুস্তিকাগুলো যে পণ্ডিতদের অনুবাদ, তার বড় প্রমাণ – সব পৃষ্ঠার ওপরে ‘শ্রীশ্রীদূর্গা সহায়’, ’শ্রীশ্রীহরি’ ইত্যাদি স্মরণিকা পাওয়া গেছে। কিন্তু নিজেদের অধিকারের বলে ইংরেজ ওপরওলারা অনুবাদের ধরণ, শব্দের ব্যবহার ঠিক করে দিতেন। আর সেখানেই সমস্যার জন্ম শুরু। হ্যালহেডের প্রভাব ও আধিপত্য এইসব ইংরেজ ‘অনুবাদক-অফিসার’দের ওপর প্রচণ্ড ছিল। আর এই হ্যালহেডই প্রথম থেকে প্রচলিত বাঙলা-আরবি-ফার্সি বাদ দিয়ে সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারের পক্ষে ছিলেন। কঠোরভাবে নির্দেশ ছিল আরবি-ফার্সি চলিত (অসাধু) বাঙলা বাদ দিয়ে সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারের জন্যে। ফলে, এই সময় থেকে এই অনুবাদগুলির মাধ্যমে আরবি-ফার্সি শব্দ বাদ পড়া শুরু হল এবং সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার বাড়তে লাগল।
    প্রচলিত শব্দ কিভাবে পালটানো হচ্ছিল, তার দু’-একটা উদাহরণ দিচ্ছি–
    ফিরিলেন - প্রত্যাবর্তন করিলেন
    পাঠাইলেন - প্রেরণ করিলেন
    ঢুকিলেন - প্রবেশ করিলেন
    কাঁদিলেন - ক্রন্দন করিলেন
    বসিলেন - উপবেশন করিলেন

    সাধারণ বাঙলা ক্রিয়া-বিভক্তিকে, তৎসম-সংস্কৃতে পরিবর্তন করার চেষ্টা। ফলে একটি শব্দের জায়গায় অনাবশ্যক দু’টি শব্দের ব্যবহার। উপরন্তু, ভাষা প্রাণহীন আড়ষ্ট হয়ে গেছে।
    ফরস্টার, কেরি – দু’জনেই অভিধানে মূলশব্দ ছাড়াও বহু সমাসবদ্ধ শব্দ রেখেছিলেন – যা অভিধানের স্বাভাবিক নিয়মে চলে না। উইলিয়াম কেরি যেমন, ‘নিয়ামকত্ব, নিয়ামকত্বরূপে, নিয়মোল্লঙ্ঘজন্য, নিয়মোল্লঙ্ঘনজন্যে...’ (নিয়ম দিয়ে ১১৪টি শব্দ) এরকম অনাবশ্যক সমাসবদ্ধ শব্দ অভিধানে রেখেছিলেন, অভিধান রচনার নিয়ম ভেঙ্গে।

    হ্যালহেডের অফিসিয়াল ক্ষমতা তখন অনেক। আদালতের আইনের অনুবাদ অথবা অন্য কোনো চিঠি বা আর্জির অনুবাদ হ্যালহেড “true translation” লিখে সই করলে তবেই অফিসিয়ালি সেই অনুবাদ গৃহীত হত। এইসব অনুবাদ ছিল বিভিন্ন আইনের বঙ্গানুবাদ, কোর্টের ব্যবহারের জন্যে, সাহিত্যের অনুবাদ নয়। সুতরাং অফিসিয়াল এ্যাটেস্টেশন জরুরি ছিল। এছাড়া অন্যতম প্রধান ইংরেজ ‘অনুবাদক চার্লস ফরস্টার (মোট পঁচিশটি এইরকম আইনি বইয়ের বাঙলা অনুবাদের মধ্যে চোদ্দটি ফরস্টারের নামে প্রকাশিত হয়েছিল) নিজেই আরবি-ফার্সি শব্দের বিপক্ষে ছিলেন এবং সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারের সম্পূর্ণ পক্ষে ছিলেন।
    ভাবতে বেশ অবাক এবং বিরক্ত লাগে, যে বাঙলা ভাষায় খুব কম দখল বা নামমাত্র কাজ চালানো জ্ঞানের অধিকারী হয়েও এই অনুবাদক-ইংরেজরা অনুবাদে কি ধরনের শব্দ ব্যবহার হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতেন। একেই বলে বিদেশি রাজার কলোনিয়াল সাংস্কৃতিক গা-জোয়ারি। আজকের সমাজতত্ত্বের ভাষায় colonial cultural hegemony।

    প্রশ্ন উঠে আসে, হঠাৎ এইসব সবজান্তা ইংরেজ অফিসাররা সংস্কৃত-প্রেমিক হয়েছিলেন কেন? এর উত্তর খুঁজতে হবে সে সময়ের ইউরোপীয় ইন্দোলজিস্টদের ইন্টেলেকচুয়াল মান ও অবস্থানের ওপর এবং ইন্দোলজির জন্মদাতা উইলিয়াম জোন্সের তত্ত্বের মধ্যে।
    উইলিয়াম জোন্স (William jones) তাঁর proto Indo-European language-এর তত্ত্ব প্রথম প্রকাশ করেন ১৭৮৬ সালে। কলকাতায় আসা ও সংস্কৃত-বাঙলা শিখতে (মূলত সংস্কৃত) শুরু করার তিন বছরের মধ্যে। তিনি সংস্কৃত-গ্রিক-লাতিন-জার্মান-কেলটিক-পারসীক (ফার্সি) ভাষার বিভিন্ন শব্দের মধ্যে মিলগুলি নিখুঁত ভাবে দেখিয়ে দেন। ফলশ্রুতি হিসেবে তিনি বলেন – এইসব ভাষা কোন এক সুদূর অতীতে এক আদি মাতৃভাষা থেকে জন্ম নিয়েছিল। সেই বিলুপ্ত প্রাচীন আদি ভাষাকে জোন্স proto Indo-European language নাম দিয়েছিলেন। এরপর ঝড়ের মতন এই তত্ত্ব ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে পপুলার হয়। কিন্তু এই বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষার শব্দের সঙ্গে মিল বা সিমিলারিটি জোন্স প্রথম আবিষ্কার করেননি। একটা ভাষা শেখার তিন বছরের মধ্যে এরকম যুগান্তকারী তত্ত্বর বিকাশ ঘটানো সম্ভবও নয়। বিভিন্ন ভাষার শব্দের এই মিল বিভিন্ন খ্রিস্টান মিশনারিরা প্রথম লক্ষ্য করেছিলেন। অনেক আগে এক জার্মান মিশনারি হাইনরিখ রথ (Heinrikh Roth) সংস্কৃতে পারদর্শী হয়ে এই জার্মান ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতের মিল লক্ষ্য করেছিলেন এবং বেশ কিছু প্রবন্ধ জার্মান ভাষায় লিখেছিলেন। রথ, জাহাঙ্গিরের আমলে ভারতে এসেছিলেন। পলাশীর যুদ্ধের পরে বেশ কয়েকজন মিশনারি এই মিল নিয়ে লেখালিখি শুরু করেছিলেন। তাদের একজন ফরাসি ক্যাথলিক মিশনারি গাস্তর কোর্দু (Gastor Coeurdoux) স্পষ্ট ভাবে মিলগুলি দেখিয়েছিলেন। অর্থাৎ proto Indo-European language-এর ধারণা ইউরোপীয় মিশনারিদের মধ্যে চালু ছিল।

    হ্যালহেড, ফরস্টার বা পরবর্তী বিখ্যাত অনুবাদক উইলিয়াম কেরি, জোন্সের এই তত্ত্ব উপস্থাপনার আগে থেকেই এই শব্দের মিল সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন। ফলে হ্যালহেড থেকে ফরস্টার সবাই ইউরোপীয় সভ্যতার স্বর্ণযুগের মহান ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতের সাযুজ্য-মিল পেয়ে সংস্কৃতের প্রতি আত্মীয়তা খুঁজে পেয়েছিলেন। মানসিকভাবে দুর্বলও হয়েছিলেন। অথচ উপরওলাদের নির্দেশ অনুযায়ী, বাঙলা ভাষাকে প্রতিদিন কাজের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করতেই হবে। তাই তাঁরা সাধারণ জনতার (বাঙলা) ভাষাকে সংস্কৃতের পবিত্র জলে চুবিয়ে ভদ্র করতে চেয়েছিলেন। এই হল ইন্দোলজিস্ট-প্রভাবিত ‘অনুবাদক’দের সংস্কৃত-প্রীতির মূল কারণ। সাধারণ মানুষের কেজো বাঙলা ভাষাকে সংস্কৃতের আতসকাঁচের মধ্যে দিয়ে ইউরোপের কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা।

    জোন্স আরো একটি ইতিহাসের তত্ত্ব পেশ করেছিলেন। তাঁর মতে, এই আদি proto Indo-European ও তার থেকে জন্ম নেওয়া ভাষাগুলো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছিল কিভাবে? এর উত্তর তিনি খুঁজেছিলেন এক আদি জাতির (race) অস্তিত্বের মধ্যে। যারা মধ্য ইউরোপের ককেশিয় অঞ্চল থেকে ইউরোপ ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদেরই একভাগ ভারতে এসেছিল এবং তাদের ভাষা ছিল বৈদিক সংস্কৃত (পাণিনির ভাষায় ছান্দোস ভাষা)। বাস্তবে এই জাতির তত্ত্ব (racial theory) ভারতীয় সমাজকে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছিল। একটি সংস্কৃত সভ্যতার ধারক জাতি আর একটি সংস্কৃত না জানা জাতি (ম্লেচ্ছ)।
    এই তত্ত্বগুলি ফিললজি (শব্দবিদ্যা), প্রাচীন ইতিহাস ও অ্যান্থ্রোপলজি বা নৃতত্ত্বের দুনিয়ার। সম্পূর্ণ অ্যাকাডেমিক দুনিয়ার। কিন্তু ইংরেজ কলোনিয়াল শাসক এই থিয়োরিকে উপনিবেশ বা কলোনিয়াল শাসনের সমর্থনে রাজনীতির মেঠো রাস্তায় ব্যবহার করলেন।
    “পুরাকালে চার/পাঁচ হাজার বছর আগে এই মধ্য ইউরোপ ককেশিয় মানুষরা বৈদিক সভ্যতাকে ভারতে এনে ভারতকে মহান করেছিলেন। আবার আধুনিককালে সে একই ইউরোপের (ইংরেজ) মানুষ আর একবার আধুনিক সভ্যতাকে ইংরেজ শাসনের মাধ্যমে ভারতে নিয়ে এল। বর্বরতা ও অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্যে।”
    একেই বলে cultural theoretical justification of colonialism।

    উচ্চবর্ণের সংস্কৃতবাগীশদের মহাভোজ ও বাঙলা ভাষার দ্বিজত্বপ্রাপ্তি

    এ পর্যন্ত সমস্যাটা ইংরেজ শাসক-কলোনিয়ালিস্টদের মাসল-ফোলানো দাদাগিরিতে আবদ্ধ ছিল। সমস্যাটা দেশীয় সামাজিক আকার ধারণ করল, যখন উচ্চবর্ণের সংস্কৃত পণ্ডিতরা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত (১৮০০) হওয়ার পর সেখানে পণ্ডিত হিসেবে নিয়োজিত হলেন। এবারে স্বনামে, আগের মতো বেনামে নয়। বাঙলা ভাষাকে আরবি-ফার্সি সংক্রমণ থেকে উদ্ধার শুরু হল। আরো একটি পুরনো শব্দকে ফিরিয়ে আনা হল। বাঙলা ভাষা থেকে ‘যবন’ শব্দ উচ্ছেদ। তখন ‘যবন’ শব্দটি সমাজে ভিন্ন মানে গ্রহণ করেছে। যবন মানে মুসলমান, এটা পপুলার হয়ে গেছে। ফলে যবনের প্রভাব বা যাবনিক শব্দ থেকে বাঙলা ভাষাকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা যে মুসলমান প্রভাব থেকে বার করে আনা – এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। তার সঙ্গে সংস্কৃতের (ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি) ক্রোড়ে ফিরিয়ে আনা।

    পারসিক অভিধান সম্পাদনা করার সময়, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার লিখেছিলেন, “এইক্ষণে অনেক সাধুভাষা লুপ্তপ্রায় হইয়াছে এবং চিরদিন অনালোচনাতে বিস্মৃতিকূপে মগ্ন হইয়াছে যদ্যপি তাহার উদ্ধার করা অতি দুঃসাধ্য তথাপি আমি বহু পরিশ্রমে বিদেশিয় ভাষাস্থলে স্বদেশীয় সাধুভাষা পুনঃ সংস্থাপন করিবার কারণ এই পারসীক অভিধান সংগ্রহ করিলাম।”
    আজকে দাঁড়িয়ে বেশ হাস্যকর লাগে। এক পণ্ডিত মানুষ পারসিক ডিকশনারি সম্পাদনা করছেন কেন? না স্বদেশী ভাষাকে (পারসিক ভাষা নয়) সাধু করবার জন্যে!!
    আর বঙ্গাভিধানের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “সাধুভাষাতে অনেক ইতর যবন ভাষার প্রবেশ হইয়াছে তথাপি বিজ্ঞ লোকেরা বিবেচনাপূর্ব্বক কেবল সংস্কৃতানুযায়ী ভাষা লিখিতে ও তদ্দ্বারা কথোপকথন করিতে চেষ্টা করিলে নির্ব্বাহ করিতে পারেন। ইহাই উচিত হয় যে সাধু লোক সাধুভাষার দ্বারাই সাধুতা প্রকাশ করেন অসাধুভাষা ব্যবহার করিয়া অসাধুর ন্যায় হাস্যাস্পদ হয়েন।”

    চরম নিদর্শন পাওয়া গেল কলেজের হেড পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের লেখায়। প্রাইমারি স্কুলের লেভেলের বাল্যবিবাহিতা স্ত্রী স্বামীকে কি সম্বোধন করে পত্র শুরু করবে, তার একটি নমুনা, ‘শিরোনামা ঐহিক পারত্রিক ভবার্ণব নাবিক শ্রীযুক্ত প্রাণেশ্বর মধ্যম ভট্টাচার্য মহাশয় পদপল্লবাশ্রয়-প্রদানেষু’ (শিশুবোধক বই থেকে)। ওই একই প্রাইমারি লেভেলের পাঠ্যপুস্তক প্রবোধচন্দ্রিকা থেকে আর একটি উদাহরণ- ‘কোকিল কলালাপ বাচাল যে মলয়াচলানিন সে উচ্ছ্বলচ্ছ্বীকরাত্যাচ্ছ নির্ঝরান্তঃকণাচ্ছন্ন হইয়া আসিতেছে’।

    ইংরেজ অফিসিয়াল ‘অনুবাদকরা’ না হয় ইন্দোলজিস্টদের প্রতি মোহগ্রস্থ ছিলেন তাঁদের নিজেদের জাতির (race) ইতিহাসের প্রতি আনুগত্যের জন্যে। কিন্তু বাঙালি পণ্ডিতরা এরকম সংস্কৃত-রসে চোবানো বাঙলা লিখতে শুরু করলেন কেন?
    প্রথমত, উপরওলাদের খুশি করার জন্যে। দ্বিতীয়ত, এই পণ্ডিতরা নিজেদের প্রাচীন কনৌজি বেদ-বেদান্ত পারদর্শীদের উত্তরপুরুষ ভাবতেন। সংস্কৃতই যেন তাদের নিজস্ব এবং একই সঙ্গে পবিত্র ভাষা। সুতরাং বেশি বেশি করে বাঙলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দের অনুপ্রবেশকে শুদ্ধিকরণের অংশ হিসেবে ভাবতে শুরু করলেন। তৃতীয়ত, উইলিয়াম জোন্সের প্রাচীন আদি জাতির তত্ত্ব (ancient original race) এঁদের হাতে চাঁদ এনে দিয়েছিল। নিজেদের ‘সুসভ্য’ ইংরেজ জাতির (race) জ্ঞাতি ভাবতে শুরু করেছিলেন।
    সব মিলিয়ে বাঙলা ভাষার গলায় পৈতে পরিয়ে জাতে তোলার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। একেই বলে বাঙলা ভাষার সংস্কৃতায়ণ।

    নতুন করে জাতি-তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে উঁচু জাত (সংস্কৃত ভাষার অধিকারী) আর অনধিকারী নিচু জাতের (যবন-মুসলমান সহ) সাংস্কৃতিক ভাগাভাগির ইতিহাসের দ্বন্দ্ব নতুনভাবে শুরু হল। ভাষাকে শুদ্ধ করতে গিয়ে বাঙলাকে রক্ত-মাংস-প্রাণহীন ভাষায় পরিণত করা শুরু হল।
    তাঁরা যেটা জানতেন না, যে ভাষা সমৃদ্ধ হয় বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ সংগ্রহ করে। সংস্কৃতও সেইভাবে সমৃদ্ধ হয়েছিল। দু’-একটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে–
    পুস্তক, পুঁথি - পারসীক ভাষা থেকে
    লিঙ্গ, গঙ্গা, উদক, পুষ্প - অস্ট্রিক ভাষা থেকে
    ঠাকুর, পূজা - দ্রাবিড় থেকে

    আর বাঙলায় হাজার হাজার। কালি, কলম, কাগজ, দোয়াত, বই (সবগুলি আরবি-জাত শব্দ) থেকে শুরু করে অনেক শব্দ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় পঁচিশ হাজার আরবি, ফার্সি ও তুর্কি শব্দ বাঙলায় পেয়েছিলেন। কমতে কমতে, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস যখন বাঙলা অভিধান সম্পাদনা করলেন, তখন তাতে মাত্র আড়াই হাজার আরবি-ফার্সি শব্দ প্রবেশ-লাভ করল।
    কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে – তাঁবু, শিকার, শনাক্ত, দরকার, হাওয়া, সেতার, ছবি, চরখা, হাজার, শিশি – এ রকম বহু শব্দ তাদের মাতৃভাষার অংশ হিসেবে অক্লেশে ব্যবহৃত হতে থাকল।
    আবার বাঙলা, আরবি-ফার্সি বা তুর্কি শব্দের মিলনে তৈরি হয়েছে অসংখ্য শব্দ। জাহাজ, শাক-সবজি, জামাকাপড়, শলা-পরামর্শ, নস্যদান, গল্প-গুজব। এরকম বহু শব্দ।

    উনবিংশ শতাব্দীর পণ্ডিতদের আর একটি সাধারণ ভুল ধারণা ছিল, যে সংস্কৃতের গর্ভ থেকে বাঙলা জন্মেছে। আসলে বাঙলা জন্মেছে অর্ধমাগধী অবহঠট (অপভ্রংশ) থেকে। প্রাকৃতের একটি শাখা মাগধী অবহঠট, তার পরে অর্ধমাগধী। সেখান থেকে বাঙলা জন্মেছে। সংস্কৃতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রধানত ধাতুরূপের ক্ষেত্রে। সম্পর্কটা প্রপিতামহের সঙ্গে সম্পর্কের মত, ক্ষীণ। সংস্কৃত অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে মৃত ভাষায় পরিণত হয়েছিল। সাধারণ কথোপকথনে ব্যবহার হত না। অশোকের শিলালিপি ও প্রথম দিকের বৌদ্ধশাস্ত্র বা জৈনশাস্ত্রের ভাষা সংস্কৃত ছিল না। আদি বৌদ্ধ ও জৈন শাস্ত্রগুলি পালিতে লেখা হয়েছিল। পালিকে আদি প্রাকৃত ভাষা বলা হয়। যদিও এ ভাষা বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষার মতো ইন্দো-ইরানিয় ভাষাগোষ্ঠীর অংশ। বৌদ্ধ বা জৈন শাস্ত্র শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের উদ্দেশে রচিত হয়নি। আর অশোকের শিলালিপি সংস্কৃতে নয়, মাগধি প্রাকৃত ভাষায় লেখা। কারণ অশোকের এই শিলালিপিগুলি সাধারণ প্রজাদের মধ্যে প্রচারের উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয়েছিল। এর থেকে বোঝা যায়, আড়াই হাজার বছর আগেই সাধারণ মানুষের ভাষা সংস্কৃত ছিল না, তাঁদের ভাষা ছিল বিভিন্ন প্রাকৃত ভাষা।

    আরো পরে, খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক থেকে যেসব নাটক লেখা হয়েছিল, সেগুলি খেয়াল করে পড়লে বোঝা যায়, সংস্কৃত নাটকের স্বর্ণ যুগে মহিলা চরিত্র, ভৃত্য, প্রতিহারী ইত্যাদি চরিত্রগুলি সংস্কৃত ভাষা বোঝে না। তাদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ বা নৃপতি চরিত্রগুলি প্রাকৃতে কথা বলছে। এসব নাটক আজ থেকে মোটামুটি হাজার-দেড়েক বছর আগে লেখা হয়েছিল।
    সংস্কৃত ছিল একটি কেতাবি ভাষা, যেটা খুব কম সংখ্যক উচ্চবর্ণের মানুষরা শুধু শাস্ত্র বা সাহিত্য চর্চার জন্যে ব্যবহার করতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, এরকম একটা কেতাবি ভাষা যা বহু আগে মৃত ভাষায় পরিণত হয়েছে, সেই ভাষা থেকে নতুন জীবন্ত চলমান ভাষার জন্ম সম্ভব কি? ভাষাবিদদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। কিছু ভাষাবিদ মনে করেন, প্রাকৃতই প্রকৃত আদি ভাষা। সংস্কৃত তার একটা শাখা।

    বাক্যগঠনের দিকে নজর দিলে, বাঙলার সঙ্গে সংস্কৃতের পার্থক্য ভালো বোঝা যায়। যেমন একটি সরল সংস্কৃত বাক্য, ‘মনুষঃ মৎসাং খাদতি’। শব্দগুলো যেকোনো বিন্যাসে সাজালেও অর্থ বা মানে একই থাকবে। কিন্তু বাঙলায় ‘মানুষ মাছ খায়’, এই বাক্যের শব্দ বিন্যাস পাল্টানো যাবে না (মাছ মানুষ খায়’ – লিখলে অর্থ একদম পালটে যাবে)। কারণ সংস্কৃত, বিভক্তি নির্ভর ভাষা। বাঙলায় বিভক্তির ব্যবহার অনেক সময় দরকার হয় না। কিন্তু কর্তা, ক্রিয়া, কর্ম – এইভাবে সাজাতে হয়। আবার বাঙলায় টি, টা, জন এইসবের ব্যবহার খুব জরুরি। যেমন ‘দু’জন ছেলে’, ‘দু’টো গরু’, ‘দু’খানা বই’। এসব সংস্কৃতে জরুরি নয়। বাঙলায় বিশেষণে লিঙ্গ ছিল না। ‘সুন্দর মহিলা’, সঠিক বাঙলা ছিল। সংস্কৃতে ‘সুন্দরী’ বলতে হবে। আবার ধ্বনিবাচক বিশেষণের ব্যবহার, যেমন ‘পইপই’, ‘পতপত’, ‘খাঁখাঁ’ ইত্যাদির ব্যবহার বাঙলায় খুব উল্লেখযোগ্য। সংস্কৃতে এই জাতীয় শব্দের ব্যবহার নেই।

    ভাষাবিদরা মনে করেন, এ সমস্ত বাঙলা ভাষার বিশেষত্ব এসেছে কোল-মুন্ডারি, দ্রাবিড় ও তিব্বতী-বার্মিজ থেকে। আসলে, উচ্চবর্ণের মানুষরা যাই বলুক না কেন, বাঙলা ভাষা, বাঙালির মতই এই অন্তজ্য সমাজের প্রান্তে বাস করা মানুষদের ভাষা হিসাবে গড়ে উঠেছে।
    সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এই জন্যেই বলেছেন, ‘বাঙলার বিশুদ্ধ রূপটি হচ্ছে এর তদ্ভব রূপটি। এটি বৈদিক থেকে উদ্ভুত, কিন্তু অন্‌-আর্য্য দ্রাবিড় ঢঙে এর বাক্য গঠন’।

    কিন্তু ১৮শ শতকের সেই প্রথম যুগে, উঁচুজাতের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতরা তখন ইংরেজ শাসকের প্রসাদধন্য, সমর্থনপুষ্ট। তাঁরা সমাজের ইন্টেলেকচুয়াল দণ্ডের অধিকারী হয়ে বাঙলা কেতাবি ভাষাকে অনড় স্থবির সঙ্গস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের মনোপলিতে পরিণত করলেন।
    অনেক পরে, কিছুটা বিরক্ত হয়ে, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন–
    “কুক্ষণে এদেশে বিলেত থেকে নোতুন করে আর্য্য শব্দের আমদানি হয়েছিল; মাক্স মুলারের লেখা পড়ে, আর নব্য হিন্দুয়ানীর দলের বিজ্ঞানের আর ইতিহাসের বদহজমের ফলে, একটা নোতুন গোঁড়ামি এসে ঘাড়ে চেপেছে, সেটার নাম হচ্ছে ‘আর্য্যামি’। এই গোড়ামির মূলসুত্র হচ্ছে, যা কিছু ভালো তা প্রাচীন আর্য্যদের মধ্যে ছিল। আর যা কিছু খারাপ, সমস্তই আর্য্যেতর-অনার্য্য’। ...
    ভাষাতত্ত্বেও উৎকট আর্য্যামি বিত্তমান। বাঙলা ভাষাটা যে অনার্য্য ভাষার ছাঁচে ঢালা, সেটা ক্রমে ক্রমে লোকে মানবে। আর্য্যামি যতদিন বাধা দিতে থাকবে, ততদিন বাঙলার ঠিক স্বরূপটি আমাদের বের করা কঠিন হবে। ...
    বাঙলার প্রাকৃত তদ্ভব রূপটিই আসল রূপ। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের হাতে পড়ে ভোল ফিরিয়ে বসল, বাঙলা ব্যাকরণ বলে লোকে সংস্কৃত ব্যাকরণের সন্ধি আর কৃৎ তদ্ধিত শব্দসিদ্ধি পড়তে লাগল। সেদিন একটা বিরাট বাঙলা ব্যাকরণ দেখে আগ্রহে পাতা ওল্টাতে দেখি, বাঙলা নয়, আগাগোড়া একটা সংস্কৃত ব্যাকরণ। লেখক প্রত্যয়াদি দু’ভাগে ভাগ করেছেন। সাধু অর্থাৎ সংস্কৃত আর অসাধু। তিনি যা অসাধু মনে করেছেন, সংকুচিত ভাবে আলগোছে, তাই যে খাঁটি বাঙলা, সেদিকে তাঁর খেয়াল ছিল না। ... ”

    সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এই সংস্কৃতায়ণের নাম দিয়েছিলেন raze for Sanskritization.
    প্রবন্ধের প্রথম অংশ শেষ করেছিলুম দীনেশচন্দ্র সেনের দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়ে। দ্বিতীয় অংশের শেষে এসে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের দীর্ঘ উদ্ধৃতির দ্বারস্থ হচ্ছি।

    শেষ কথা

    সাধারণ মানুষের রোজকারের বেঁচে থাকার ভাষাকে সহজে নিজের ইচ্ছেয় পালটানো যায় না। সে তার নিজের নিয়মে প্রাসাদের কোনো এক ফাটল দিয়ে পাতা মেলে মাথা তুলবেই।
    এই সংস্কৃত-নির্ভর গদ্যের গণ্ডি ও পণ্ডিত দারোগাদের পাহারার বাইরে বাঙলা গদ্যকে নিয়ে আসার প্রথম প্রচেষ্টা এসেছিল অপ্রত্যাশিত অংশ থেকে। ইংরেজ খ্রিস্টান মিশনারিদের কাছ থেকে। প্রথম লেখিকার নাম হানা ক্যাথরিন ম্যালেনস্‌। বাবা মিশনারি কাজে বাঙলায় এসেছিলেন। হানা বাঙলা শিখেছিলেন চাকরদের কাছ থেকে, পরে অক্ষরজ্ঞান হয় বাইবেল স্কুলে। তিনি একটি উপন্যাস ধরনের বই লিখেছিলেন, ধর্ম প্রচারের জন্যে। বইটির নাম ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’। তিনশ’ পাতার বই। ১৮৫২ সালে প্রকাশিত হয়। গোটা বইটা অনাবশ্যক সংস্কৃত তৎসম শব্দ বর্জিত ছিল। অতি সাধারণ চলতি তদ্ভব আর বাঙলা শব্দের ব্যবহার দিয়েই গল্পের জাল বুনেছিলেন। এই বই নাকি বাঙলার অজ পাড়াগাঁয়ে পপুলার হয়েছিল। কিন্তু বাঙলার বিদ্ব্যৎসমাজ এ লেখা গ্রহণ করেনি। শিক্ষিত মহলে, বইটা বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যায়। একশ’ বছর পরে ন্যাশনাল লাইব্রেরির চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বইটা খুঁজে বার করেন ১৯৫৬ সালে।

    এরপর টেকচাঁদ ঠাকুরের (প্যারীচাঁদ মিত্র) ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮)। ওই একই সময়ে আর এক মিশনারি, জন মুড্রজ, প্রত্যন্ত অজ পাড়াগাঁয়ের চাষিদের মাঝে ধর্মপ্রচার করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, যে এই সংস্কৃত-কন্টকিত বাঙলা টেক্সট বই সাধারণ মানুষের জন্য নয়। তিনি বিদ্যাসাগর মশায়ের কাছে এই নিয়ে ক্ষোভও জানিয়েছিলেন।
    সাহিত্যের আঙ্গিনায় দ্বিতীয় প্রাণের বিকাশ ঘটেছিল গ্রামাঞ্চলে। পাঁচালি, কিস্‌সা ও ইসলামী প্রচার-পুস্তিকার মাধ্যমে। এই লোকসাহিত্যের ভাষায় আরবি-ফার্সি-উর্দুর ব্যবহার ১৮শ শতকের স্টাইলে ফিরে এসেছিল। বর্তমানে এই লোকসাহিত্য পুঁথিসাহিত্য নামে পরিচিত। মিশনারি জেমস লং এই ভাষাকে হঠাৎ দোভাষী বাঙলা বলে নতুন নামকরণ করেন ১৮৫৬ সালে।
    এইসব গারদ থেকে বেরিয়ে আসার কাহিনী অন্য আর একবার আমাদের আলোচনায় আনব।





    কিছু কৈফিয়ত-
    ১) এ লেখার সময়কাল শেষ হয়েছে ১৮১০-২০র সময়ে। তাই আর্যভাষা, আর্যসভ্যতা – এসব শব্দ আমি ব্যবহার করিনি, যদিও ভাষাবিদদের যে সব উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছি, তার মধ্যে এই শব্দগুলি আছে। আর্যজাতি, অনুপ্রবেশ, ভাষা ও তার তত্ত্ব ম্যাক্সমুলার প্রথম পেশ করেছিলেন ১৮৫৩ সালে।
    ২) পুরনো পারস্যের ভাষাকে আলাদা করে বোঝাবার জন্যে আমি ‘পারসিক’ শব্দ ব্যবহার করেছি। আর পরবর্তী সময়ের ইরাণীয় ভাষাকে ফার্সি বলে সম্বোধন করেছি।
    ৩) মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার প্রতিভাবান সাহিত্যিক ছিলেন। পাঠ্যপুস্তকে সংস্কৃত চাপানো নিয়ে তাঁর সমালোচনা করেছি। কিন্তু তাঁর করা বিদ্যাপতির পুরুষ-সিংহর অনুবাদ বেশ উঁচুমাপের।
    ৪) মহঃ শহীদুল্লাহ বাঙলার উৎপত্তি নিয়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেনের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেন। উনি বলেছেন মাগধী ছাড়াও আরো একটা অবহঠট উপশাখা ছিল। তার থেকে বাঙলা জন্ম নিয়েছে। উনি সেই উপশাখার নামকরণ করেছিলেন গৌড়ীয় মাগধি।

    তথ্যসূত্র-
    ১) সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়The Origin and Development of Bengali Language
    বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা
    বাঙ্গলা ভাষা প্রসঙ্গ
    ২) দীনেশচন্দ্র সেন বঙ্গভাষা ও সাহিত্য
    বঙ্গভাষার ওপর মুসলমানের প্রভাব
    History of Bengali language and literature
    ৩) সুকুমার সেন ভাষার ইতিবৃত্ত
    ইসলামিক বাঙলা সাহিত্য
    ৪) আনিসুজ্জমান আঠারো শতকের বাঙলা চিঠি
    পুরনো বাঙলা গদ্য
    ৫) মহঃ শহীদুল্লাহ বাঙ্গালাভাষার ইতিবৃত্ত
    ৬) গোলাম মুরশেদ আঠারো শতকের গদ্য
    ঔপনিবেশিক আমলের বাংলা গদ্য
    হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি
    ৭) অতুল সুর বাঙলা ও বাঙালী
    ৮) মহম্মদ আমীর হোসেনবাঙালির ভাষা, অনুষ্টুপ শারদীয় ১৯৯৯
    বাঙ্গালী-পরিচয় ও পরিচিতির বিবর্তন, অনুষ্টুপ শারদীয় ১৯৯৮
    ৯) কবিকঙ্কণ চন্ডী মুকুন্দরাম
    ১০) হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষ।
    ১১) Parna Sengupta Pedagogy for Religion
    ১২) সুজিত ঘোষ আ মরি বাঙলা ভাষা


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    পর্ব ১ | পর্ব ২
  • আলোচনা | ০৮ নভেম্বর ২০২১ | ২২৭৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বাসুদেব গুপ্তা | 115.96.143.100 | ০৮ নভেম্বর ২০২১ ০৯:৪৮500906
  • এই গড্ডালিকাপ্রবাহে ভাসমান রাসভকুলপতিদিগের নাদব্রহ্মের মাঝে এই লেখা খুব ভালো লাগলো।  অনেক কিছু জানা গেল। যত জানলাম তার চেয়ে বেশী খটকা লাগলো। সেগুলো খটখট করবে যতদিন না এই লেখার পরের কিস্তি আসবে।  ১) সংস্কৃত শব্দ ঢোকা খারাপ? আরবী ফারসি শব্দ ভালো? জোর তো অনেকদিন আরবী ফারসির ছিল। তখন তো বাংলায় সে সব শব্দ ঢুকে গেছে। ইংরেজ আমলে সংস্কৃতত্ব বাড়ানোর এত চেষ্টার কি কোন কারণ ছিল? নাকি এটাও সামাজিক Processএর একটা প্রকাশমাত্র?  ভাষা নদীতে যে যা পারে ঢালে কিন্তু নদী নিজে বেছে নেয় কি নেবে আর কাকে ফেলবে?  সকল লিখনপদ্ধতির একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে  লেখক বা কথক তা বেছে নেয় যখন যেমনটি।  ২) বাংলা ভাষার নমুনাগুলো অনেকটা ওড়িয়ার মত শোনাচ্ছে।  এক Pan bengal  ভাষা কিভাবে ভাগ হয়ে দুটো আলাদা নদী হয়ে যায় অবাক লাগে। ওড়িয়া ভাষায় বা আরো অনেক ভারতীয় ভাষা যেমন মালয়ালাম কিন্তু অনেক বেশী তৎসম শব্দ ব্যবহার করে। সেখানেও কি ইংরেজ পাদ্রীরা সংস্কৃত জোর করে ঢুকিয়েছিল?   আশা করি লেখক পাঠকের অজ্ঞতাকে ক্ষমা করে দেবেন। লেখাটা যে অশিক্ষিত মনেও প্রশ্ন তুলেছে সেটাতেই লেখাটির মহত্ব।  
     
  • দীপ | 2402:3a80:a43:1f53:ba02:f01e:8924:684f | ০৮ নভেম্বর ২০২১ ১২:০২500916
  • বর্তমান বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষা থেকে ধারাবাহিক বিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে। অবশ্যই বাংলা একটি স্বতন্ত্র ভাষা, কিন্তু সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে তার যোগ অতি নিবিড়! বাংলা ভাষার আশি শতাংশ শব্দ তৎসম বা তদ্ভব শব্দ। একে অস্বীকার করা মূঢ়তা মাত্র!
  • দীপ | 2402:3a80:a43:1f53:ba02:f01e:8924:684f | ০৮ নভেম্বর ২০২১ ১২:১৫500917
  • এই চলার পথে অবশ্যই সে অন্যান্য শব্দভাণ্ডার থেকে আরো অনেক সমৃদ্ধ করেছে, কিন্তু তার মূল উৎস রয়েছে সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে। মুজতবা আলী সাহেব খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন, "বাংলা সাহিত্যের মূল খাদ্য সংস্কৃত ভাষা। যদি সংস্কৃত চর্চা আমরা বন্ধ করি, তবে বাংলাভাষার মূল খাদ্য থেকে আমরা বঞ্চিত হব।" আর ঠিক সেটাই হয়েছে! 
     
    প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভবতোষ দত্ত কমিশন ও অশোক মিত্র কমিশন, উভয়েই মাধ্যমিক স্তরে সংস্কৃত ভাষাকে তৃতীয় ভাষা বা ঐচ্ছিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছিলেন। যদিও এই সুপারিশগুলো কোনোটাই মানা হয়নি!
  • দীপ | 2401:4900:3a0e:5bd:7cc1:3e19:940d:edf0 | ০৮ নভেম্বর ২০২১ ১২:৫৪500918
  • অষ্টাদশ শতকের শেষে ও উনবিংশ শতকের শুরুতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের বাংলা গদ্য চূড়ান্ত আড়ষ্ট, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু পরবর্তীকালে এই গদ্য বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের হাতে সাবলীল, মাধুর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। 
    বঙ্কিমের উপন্যাস, মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য, রবীন্দ্রনাথের অসামান্য সৃষ্টি, বুদ্ধদেব বসুর কাব্যনাট্য- সব‌ই কিন্তু তৎসমবহুল বাংলা ভাষায় রচিত!
  • দীপ | 2401:4900:3a0e:5bd:7cc1:3e19:940d:edf0 | ০৮ নভেম্বর ২০২১ ১৩:০৪500919
  • "বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
    করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
    দীন যে, দীনের বন্ধু! উজ্জ্বল জগতে
    হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
    কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
    যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
    সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
    গিরীশ। কি সেবা তার সে সুখ সদনে !
    দানে বারি নদীরূপা বিমলা কিঙ্করী।
    যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
    দীর্ঘশিরঃ তরুদল, দাসরূপ ধরি।
    পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে,
    দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
    নিশায় সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে।"
                                                         (মধুসূদন)
     
    তৎসমবহুল বাংলা ভাষা!
  • দীপ | 2401:4900:3a0e:5bd:7cc1:3e19:940d:edf0 | ০৮ নভেম্বর ২০২১ ১৩:২১500920
  • আজি কি তোমার মধুর মূরতি
     
        ​​ হেরিনু শারদ প্রভাতে!
     
    হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
     
        ​​ ঝলিছে অমল শোভাতে।
     
    পারে না বহিতে নদী জলধার,
     
    মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর--
     
    ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল
     
        ​​ তোমার কাননসভাতে!
     
    মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী,
     
        ​​ শরৎকালের প্রভাতে।
     
     জননী, তোমার শুভ আহ্বান
     
        ​​ গিয়েছে নিখিল ভুবনে--
     
    নূতন ধান্যে হবে নবান্ন
     
        ​​ তোমার ভবনে ভবনে।
     
    অবসর আর নাহিকো তোমার--
     
    আঁটি আঁটি ধান চলে ভারে ভার,
     
    গ্রামপথে-পথে গন্ধ তাহার
     
        ​​ ভরিয়া উঠিছে পবনে।
     
    জননী, তোমার আহ্বান লিপি
     
        ​​ পাঠায়ে দিয়েছ ভুবনে।
     
     তুলি মেঘভার আকাশ তোমার
     
        ​​ করেছ সুনীলবরনী।
     
    শিশির ছিটায়ে করেছ শীতল
     
        ​​ তোমার শ্যামল ধরণী।
     
    স্থলে জলে আর গগনে গগনে
     
    বাঁশি বাজে যেন মধুর লগনে,
     
    আসে দলে দলে তব দ্বারতলে
     
        ​​ দিশি দিশি হতে তরণী।
     
    আকাশ করেছ সুনীল অমল,
     
        ​​ স্নিগ্ধশীতল ধরণী।
     
     বহিছে প্রথম শিশিরসমীর
     
        ​​ ক্লান্ত শরীর জুড়ায়ে--
     
    কুটিরে কুটিরে নব নব আশা
     
        ​​ নবীন জীবন উড়ায়ে।
     
    দিকে দিকে মাতা কত আয়োজন,
     
    হাসিভরা মুখ তব পরিজন
     
    ভাণ্ডারে তব সুখ নব নব
     
        ​​ মুঠা মুঠা লয় কুড়ায়ে।
     
    ছুটেছে সমীর আঁচলে তাহার
     
        ​​ নবীন জীবন উড়ায়ে।
     
     আয় আয় আয়, আছ যে যেথায়
     
        ​​ আয় তোরা সব ছুটিয়া--
     
    ভান্ডারদ্বার খুলেছে জননী,
     
        ​​ অন্ন যেতেছে লুটিয়া।
     
    ও পার হইতে আয় খেয়া দিয়ে,
     
    ও পাড়া হইতে আয় মায়ে ঝিয়ে,
     
    কে কাঁদে ক্ষুধায় জননী শুধায়--
     
        ​​ আয় তোরা সবে জুটিয়া।
     
    ভাণ্ডারদ্বার খুলেছে জননী,
     
        ​​ অন্ন যেতেছে লুটিয়া।
     
     মাতার কণ্ঠে শেফালিমাল্য
     
        ​​ গন্ধে ভরিছে অবনী।
     
    জলহারা মেঘ আঁচলে খচিত
     
        ​​ শুভ্র যেন সে নবনী।
     
    পরেছে কিরীট কনককিরণে,
     
    মধুর মহিমা হরিতে হিরণে
     
    কুসুমভূষণজড়িত চরণে
     
        ​​ দাঁড়ায়েছে মোর জননী।
     
    আলোকে শিশিরে কুসুমে ধান্যে
     
          হাসিছে নিখিল অবনী।
     
           (রবীন্দ্রনাথ)
    তৎসমবহুল বাংলা ভাষা!
  • বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায় | 103.75.162.206 | ০৮ নভেম্বর ২০২১ ১৬:০৭500924
  • প্রথমটাও পড়েছি ৷ দ্বিতীয় পর্বটাও পড়লাম ৷ এক কথায় অনবদ্য লেখা ও বিশ্লেষণ ! অনেক নুতন কিছু শিখলাম ৷ গবেষণার মান বেশ উঁচু — প্রযুক্তিবিদের কাছে অনন্য ৷
  • এলেবেলে | ০৮ নভেম্বর ২০২১ ১৯:০৬500925
  • প্রথম পর্বটা আগেই পড়েছিলাম, আজ দ্বিতীয় পর্বটা পড়লাম। লেখক একেবারে ঠিকঠাক জায়গায় আক্রমণ হেনেছেন যদিও সম্ভবত বিতর্ক এড়াতে লেখাটা ১৮২০-তেই থামিয়ে দিয়েছেন। আসলে কিন্তু এই সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়া ১৮৬০ অবধি যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। এর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেন বঙ্কিম এবং পরে রবীন্দ্রনাথ। যদিও তাঁরা উনিশ শতকে চলিত ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কুণ্ঠিত হন কিন্তু লেখাতে সংস্কৃতগন্ধী বাংলার ঝোঁক কমে আসে। তবে এ বিষয়ে নিঃসন্দেহে সেরা বিপ্লবীর নাম বিবেকানন্দ যিনি ডেঁটে চলিত বুলিকে তাঁর লেখায় স্থান দেন। বিশেষত কেবল গদ্যমাধুর্যের জন্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বার দশেক পড়া যায়। আমি অবশ্য সচেতনভাবে এই তালিকা থেকে হুতোম ও আলালকে বাদ রাখছি।
     
    যেহেতু আপনি এটা নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন, সে কারণে এই লেখাটার খানিক ফাঁক ভরাট করার জন্য কিছু উদ্ধৃতি এখানে রেখে দিচ্ছি। তাহলে আপনার লেখাটি আরও বেশি পরিপূর্ণ ও অর্থবহ বলে আমার ধারণা। এ ব্যাপারে আমার তেমন খাটনি নেই, খানিক কপি-পেস্ট করলেই চলে যাবে কারণ এই অধমের লেখা 'বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন' নামক একটা আস্ত অধ্যায় থেকে উদ্ধৃতিগুলো নেওয়া হবে।  
     
    ১. হ্যালহেড - কবে বাংলা শিখলেন, কার কাছে শিখলেন, কত বছর শিখলেন কেউ জানে না। অথচ তিনি একটি গোটা ব্যাকরণ বই লিখে ফেললেন এবং সেই নিয়ে কেউ প্রশ্ন পর্যন্ত করে না। এই হ্যালহেড A Grammar of the Bengal Language গ্রন্থে লিখছেন --- Hitherto we have seen the formation and construction of the Bengal language in all its genuine simplicity; when it could borrow Shanscrit terms for every circumstance without the danger of becoming un-intelligible, and when tyranny had not yet attempted to impose its fetters on the freedom of composition.
    ...how far the Modern Bengalees have been forced to debase the purity of their native dialect, by the necessity of addressing themselves to their Mahommedan Rulers ... [who] obliged the natives to procure a Persian translation to all the papers which they might have occasion to present. This practice familiarised to their ears such of the Persian terms as more immediately concerned their several affairs; and by long habit, they learnt to assimilate them to their own language, by applying the Bengal inflexions and terminations.

    অর্থাৎ মুসলমান শাসনের আগে, বাংলা ভাষায় প্রয়োজনমাফিক সংস্কৃত শব্দসম্ভার আহরণ করা হত বলে বাংলা ভাষার প্রকৃতি অকৃত্রিম সরল ছিল কিন্তু মুসলমান শাসনকর্তাদের অত্যাচারের ফলে সমস্ত বিষয়ে রাজভাষা ফারসির ব্যবহার বাধ্যতামূলক হওয়ার কারণে, চলিত বাংলা ভাষার শুদ্ধতা নষ্ট হয়ে গেছে এবং অভ্যাসের দোষে বহু ফারসি শব্দ বাংলা ভাষার আবশ্যিক অঙ্গ হয়ে গেছে।

     

    কাজেই সেসব বাদ দেওয়া শুরু হল। শুরু করলেন ফরষ্টা কেরি। এই কেরি ১৭৯৩ সালে জাহাজে কলকাতা আসার সময় বাংলা শিখতে শুরু করলেন। তার আট বছরের মধ্যে লিখে ফেললেন আস্ত একটা বাংলা ব্যাকরণ। সেই নিয়ে কেউ প্রশ্ন পর্যন্ত করে না।
     
    ২. সজনীকান্ত দাস লিখেছেন
    ১৭৭৮ খ্রীষ্টাব্দে হালহেড এবং পরবর্তী কালে হেন্রি পিট্ ফরষ্টা উইলিয়ম কেরী বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতজননীর সন্তান ধরিয়া আরবী পারসীর অনধিকার প্রবেশের বিরুদ্ধে রীতিমত ওকালতি করিয়াছেন এবং প্রকৃতপক্ষে এই তিন ইংলণ্ডী পণ্ডিতের যত্ন চেষ্টায় অতি অল্প দিনের মধ্যে বাংলা ভাষা সংস্কৃত হইয়া উঠিয়াছে ১৭৭৮ খ্রীষ্টাব্দে এই আরবী-পারসী-নিসূদন-যজ্ঞের সূত্রপাত এবং ১৮৩৮ খ্রীষ্টাব্দে আইনের সাহায্যে কোম্পানীর সদর মফস্বল আদালতসমূহে আরবী পারসীর পরিবর্তে বাংলা ইংরেজী প্রবর্তনে এই যজ্ঞের পূর্ণাহুতি বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মও এই বৎসরে। এই যজ্ঞের ইতিহাস অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক, আরবী পারসীকে অশুদ্ধ ধরিয়া শুদ্ধ পদ প্রচারের জন্য সেকালে কয়েকটি ব্যাকরণ অভিধানও রচিত প্রচারিত হইয়াছিল, সাহেবেরা সুবিধা পাইলেই আরবী-পারসীর বিরোধিতা করিয়া বাংলা সংস্কৃতকে প্রাধান্য দিতেন, ফলে দশ পনর বৎসরের মধ্যেই বাংলা-গদ্যের আকৃতি প্রকৃতি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়াছিল
     
    ৩. অথচ সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের হিসেব অনুযায়ী অতীতের জনপ্রিয় বাংলা কথ্য কাহিনিগুলির কেবল এক-তৃতীয়াংশ তৎসম শব্দ, বাকি তদ্ভব
     
    ৪. এই বিষয়ে দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন

    ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত-মণ্ডলীদূর দূরকরিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন, বঙ্গভাষা তেমনই সুধী-সমাজের অপাংক্তেয় ছিল তেমন ঘৃণা, অনাদর উপেক্ষার পাত্র ছিল

    কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবারীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল

    মুসলমান বিজয় বাঙ্গলাভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল গৌড়দেশ মুসলমানগণের অধিকৃত হইয়া গেল, তাঁহারা ইরান, তুরা যে দেশ হইতেই আসুন না কেন, বঙ্গদেশ বিজয় করিয়া বাঙ্গালী সাজিলেন আজ হিন্দুর নিকট বাঙ্গলাদেশ যেমন মাতৃভৃমি, সেদিন হইতে মুসলমানের নিকট বাঙ্গলাদেশ তেমনই মাতৃভুমি হইল তাঁহারা বাণিজ্যের অছিলায় এদেশ হইতে রত্নাহরণ করিতে আসেন নাই, তাঁহারা এদেশে আসিয়া দস্তুর মত এদেশ-বাসী হইয়া পড়িলেন হিন্দুর নিকট বাঙ্গলাভাষা যেমন আপনার, মুসলমানদের নিকট উহা তদপেক্ষা বেশী আপনার হইয়া পড়িল
    অতঃপর তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এই কথা লিখে,
    হেন প্রতিকূল ব্রাহ্মণ-সমাজ কি হিন্দুরাজত্ব থাকিলে বাঙ্গলাভাষাকে রাজসভার সদর দরজায় ঢুকিতে দিতেন? সুতরাং কথা মুক্তকঠে বলা যাইতে পারে যে, মুসলমান সম্রাটেরা বাঙ্গলাভাষাকে রাজ দরবারে স্থান দিয়া ইহাকে ভদ্র সাহিত্যের উপযোগী করিয়া নূতন ভাবে সৃষ্টি করিয়াছিলেন
     
    ৫. পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার --- তেমনি শাস্ত্রসিদ্ধান্ত লৌকিক ভাষাতে থাকে না যেমন রূপালঙ্কারবতী সাধ্বী স্ত্রীর হৃদয়ার্থবোদ্ধা সুচতুর পুরুষেরা দিগম্বরী অসতী নারীর সন্দর্শনে পরাঙ্মুখ হন তেমনি সালঙ্কারা শাস্ত্রার্থবতী সাধু ভাষার হৃদয়ার্থবোদ্ধা সৎ পুরুষেরা নগ্ন উচ্ছৃঙ্খলা লৌকিক ভাষা শ্রবণ মানেই পরাঙ্মুখ হন।
     
    ৬. রামমোহন রায় --- যাঁহাদের সংস্কৃতে বুৎপত্তি কিঞ্চিতো থাকিবেক আর যাহারা বুৎপন্ন লোকদের সহিত সহবাস দ্বারা সাধু ভাষা কহেন আর শুনেন তাঁহাদের অল্প শ্রমেই ইহাতে অধিকার জন্মিবেক।
     
    ৭. ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় --- ... ভদ্র লোকের মধ্যে অনেক লোক স্বজাতীয় ভাষায় অন্য জাতীয় ভাষা মিশ্রিত করিয়া কহিয়া থাকেন ... ইহাতে বোধহয় সংস্কৃত শাস্ত্র ইহারা পড়েন নাই এবং পণ্ডিতের সহিত আলাপও করেন নাই তাহা হইলে এতাদৃশ বাক্য ব্যবহার করিতেন না স্বজাতীয় এক অভিপ্রায়ের অধিকভাষা থাকিতে যাবনিক ভাষা ব্যবহার করেন না
     
    ৮. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর --- ...সংস্কৃতভাষানুশীলনের এক অতি প্রধান ফল এই যে, ইদানীন্তন কালে ভারতবর্ষে হিন্দী, বাঙ্গালা প্রভৃতি যে সকল ভাষা কথোপকথনে লৌকিক ব্যবহার প্রচলিত আছে, সে সমুদয় অতি হীন অবস্থায় রহিয়াছে। ইহা একপ্রকার বিধিনির্বন্ধস্বরূপ হইয়া উঠিয়াছে যে, ভুরি পরিমাণে সংস্কৃত কথা লইয়া সকল ভাষায় সন্নিবেশিত না করিলে তাহাদের সমৃদ্ধি শ্রীবৃদ্ধি করা যাইবেক না কিন্তু, সংস্কৃতভাষায় সম্পূর্ণরূপ বুৎপত্তিলাভ ব্যতিরেকে, তৎসম্পাদন কোনও মতে সম্ভাবিত নহে
     
    ৯. শিবনাথ শাস্ত্রীর তীব্র সমালোচনা --- একদিকে পণ্ডিতবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অপরদিকে খ্যাতনাম অক্ষয়কুমার দত্ত, এই উভয় যুগপ্রবর্তক মহাপুরুষের প্রভাবে বঙ্গভাষা যখন নবজীবন লাভ করিল, তখন তাহা সংস্কৃত-বহুল হইয়া দাঁড়াইল। বিদ্যাসাগর মহাশয় অক্ষয়বাবু উভয়ে সংস্কৃত-ভাষাভিজ্ঞ সংস্কৃত-ভাষানুরাগী লোক ছিলেন; সুতরাং তাঁহারা বাঙ্গালাকে যে পরিচ্ছদ পরাইলেন তাহা সংস্কৃতের অলঙ্কারে পরিপূর্ণ হইল। অনেকে এরূপ ভাষাতে প্রীতিলাভ করিলেন বটে, কিন্তু অধিকাংশ লোকের নিকট, বিশেষতঃ সংস্কৃতানভিজ্ঞ শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের নিকট, ইহা অস্বাভাবিক, কঠিন দুর্বোধ্য বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। সে সময়ে পাঁচজন ইংরাজীশিক্ষিত লোক কলিকাতার কোনও বৈঠকখানাতে একত্র বসিলেই এই সংস্কৃতবহুল ভাষা লইয়া অনেক হাসাহাসি হইত।
     
    ১০. বিদ্যাসাগরের আরেক স্নেহভাজন হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বিরোধিতা --- কথাটি এই যে, যাঁহারা পর্যন্ত বাংলাভাষায় লেখনী ধারণ করিয়াছেন, তাঁহার কেহই বাংলাভাষা ভালো করিয়া শিক্ষা করেন নাই। হয় ইংরেজি পড়িয়াছেন, না-হয় সংস্কৃত পড়িয়াছেন, পড়িয়াই অনুবাদ করিয়াছেন। কতকগুলি অপ্রচলিত সংস্কৃত নূতন গড়া চোয়ালভাঙা কথা চলিত করিয়া দিয়াছেন। নিজে ভাবিয়া কেহ বই লেখেন নাই, সুতরাং নিজের ভাষায় কী আছে না আছে তাহাতে তাঁহাদের নজরও পড়ে নাই।
    ...
    এই শ্রেণীর লেখকের হস্তে বাংলাভাষার উন্নতির ভার অর্পিত হইল। লিখিত ভাষা ক্রমেই সাধারণের দুর্বোধ দুষ্পাঠ্য হইয়া উঠিল। অথচ এডুকেশন ডেস্প্যাচের কল্যাণে সমস্ত বঙ্গবাসী বালক এই প্রকারের পুস্তক পড়িয়া বাংলাভাষা শিখিতে আরম্ভ করিল। বাংলাভাষার পরিপুষ্টির দফা একেবারে রফা হইয়া গেল।
     
    ১১. বঙ্কিমচন্দ্র --- গদ্য গ্রন্থাদিতে সাধুভাষা ভিন্ন আর কিছু ব্যবহার হইত না। তখন পুস্তকপ্রণয়ন সংস্কৃত ব্যবসায়ীদিগের হাতে ছিল। অন্যের বোধ ছিল যে, যে সংস্কৃত না জানে, বাঙ্গালা গ্রন্থ প্রণয়নে তাহার কোন অধিকার নাই, সে বাঙ্গালা লিখিতে পারেই না। যাঁহারা ইংরেজিতে পণ্ডিত, তাঁহারা বাঙ্গালা লিখিতে পড়িতে না জানা গৌরবের মধ্যে গণ্য করিতেন। সুতরাং বাঙ্গালায় রচনা ফোঁটা-কাটা অনুস্বারবাদীদিগের একচেটিয়া মহল ছিল। সংস্কৃতেই তাঁহাদিগের গৌরব। তাঁহারা ভাবিতেন, সংস্কৃতেই তবে বুঝি বাঙ্গালা ভাষার গৌরব; যেমন গ্রাম্য বাঙ্গালী স্ত্রীলোক মনে করে যে, শোভা বাড়ুক না বাড়ুক, ওজনে ভারি সোনা অঙ্গে পরিলেই অলঙ্কার পরার গৌরব হইল, এই গ্রন্থকর্তারা তেমনি জানিতেন, ভাষা সুন্দর হউক বা না হউক, দুর্বোধ্য সংস্কৃতবাহুল্য থাকিলেই রচনার গৌরব হইল।
     
    ১২. এবং রবীন্দ্রনাথ --- বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান যখন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, পরস্পরের সুখ-দুঃখ নানা সূত্রে বিজড়িত, একের গৃহে অগ্নি লাগিলে অন্যকে যখন জল আনিতে ছুটাছুটি করিতে হয়, তখন শিশুকাল হইতে সকল বিষয়েই পরস্পরের সম্পূর্ণ পরিচয় থাকা চাই। বাঙালি হিন্দুর ছেলে যদি তাহার প্রতিবেশী মুসলমানের শাস্ত্র ইতিহাস এবং মুসলমানের ছেলে তাহার প্রতিবেশী হিন্দু শাস্ত্র ইতিহাস অবিকৃতভাবে না জানে তবে সেই অসম্পূর্ণ শিক্ষার দ্বারা তাহারা কেহই আপন জীবনের কর্তব্য ভালো করিয়া পালন করিতে পারিবে না।

    ... বাংলা বিদ্যালয়ে হিন্দু ছেলের পাঠ্যপুস্তকে তাহার স্বদেশীয় নিকটতম প্রতিবেশী মুসলমানদের কোনো কথা না থাকা অন্যায় এবং অসংগত।

    ইংরাজি শিক্ষার যেরূপ প্রচলন হইয়াছে, তাহাতে ইংরাজের ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, আচার-বিচার আমাদের কাছে লেশমাত্র অগোচর থাকে না; অথচ তাহারা বহুদূরদেশী এবং মুসলমানরা আমাদের স্বদেশীয়, এবং মুসলমানদের সহিত বহুদিন হইতে আমাদের রীতিনীতি পরিচ্ছদ ভাষা শিল্পের আদান-প্রদান চলিয়া আসিয়াছে। অদ্য নূতন ইংরাজি শিক্ষার প্রভাবে আত্মীয়ের মধ্যে প্রতিবেশীর মধ্যে ব্যবধান দাঁড়াইয়া গেলে পরম দুঃখের কারণ হইবে। বাঙালি মুসলমানের সহিত বাঙালি হিন্দুর রক্তের সম্বন্ধ আছে, কথা আমরা যেন কখনো না ভুলি
     
    কাজেই এটা শুধু বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়নই নয়, বাংলা ভাষাকে নিয়ে ব্রিটিশের বিভাজনের রাজনীতিও বটে। প্রথমে সাহেবদের হাত ধরে এর সূত্রপাত, পরে সুবোদের সাহায্যে তার বিস্তার। যার ফল এখনও আমরা ভুগে চলেছি।
     
  • Ranjan Roy | ০৯ নভেম্বর ২০২১ ২২:৪৯500954
  • " তবে এ বিষয়ে নিঃসন্দেহে সেরা বিপ্লবীর নাম বিবেকানন্দ যিনি ডেঁটে চলিত বুলিকে তাঁর লেখায় স্থান দেন। বিশেষত কেবল গদ্যমাধুর্যের জন্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বার দশেক পড়া যায়। "
    --110% সহমত হলাম এলেবেলের সঙ্গে। আমি মূলতঃ 'গদ্যমাধুর্যের জন্য"ই   প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য পড়েছি।    এইরকম ভালো লেগেছিল প্রথম বার রবীন্দ্রনাথের 'শেষের কবিতা'র গদ্য পড়ে।
  • অরিজিৎ চৌধুরী | 2402:3a80:6c0:2aeb:6435:c74b:dc10:2742 | ১৪ নভেম্বর ২০২১ ১৬:৪৪501165
  • অত্যন্ত ভালো লেখা। যুক্তিবিন্যাস তথ্য ও উদ্ধৃতির সমর্থনে অতি শক্তিমান।  বাংলাভাষা সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত- এই কারণে পূর্ব পাকিস্তানে জোর করে উর্দু চাপানোর চেষ্টা এবং তার ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানে দ্বিতীয় দেশভাগ। এ লেখা পড়লে সেই ইতিহাস উপহাসের মত লাগে।
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন