এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ঘুড়ি

    Nirmalya Bachhar লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ৯২৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • আমার বাপ আমাকে একজোড়া ঘুড়ি আর একলাটাই ভর্তি সুতো কিনে দিয়েছিল ছেলেবেলায়। সেই যখন আমাদের মফঃস্বলী পাড়াগাঁ টাইপের বারাসাত, লোকের ভীড়ে উপচে পড়ে নি। রাস্তায় চলতে গেলে লোকের কাঁধে কাঁধ লেগে যেত না, আর ছাদে উঠে দূরে তাকালে, ছেলেবেলায় আঁকা গোল্লা গোল্লা ঝোপের পিছনে তালগাছের সারির পেছনে আকাশ শুরু হয়ে গেছে, দেখা যেত। এ  সেই তখনকার কথা। 
     
    বাপে ঘুড়ি তো কিনে দিল, কিন্তু উড্ডয়ণসূত্রটা জানা না থাকায় ঘুড়ি দশফুটের উপরে কিছুতেই আর উড়ল না। ঐ আমার প্রথম আর শেষ ঘুড়ি কেনা। ধুলোমাখা লাটাইখানা মাঝে মাঝে খাটের তলা, বাঙ্কের কোণা এরকম অদ্ভুত যায়গায় আবিষ্কার হয়ে আমাদের চমকে দিত। 
     
    তারপরে ম্যালা চন্দ্রভূক অমাবস্যা কেটে গেছে, আম্মো সত্যিকারের ঘুড়ি লাটাই ছেড়ে বাপের কাছে বসে পড়েছি জীবনানন্দের কবিতায় স্যুররিয়ালিজম কেমন আকাশে ওড়া ঘুড়ি আর লাটাইয়ের মত। তদ্দিনে বেশিরভাগ বাড়ির ছাত থেকে এ্যান্টেনারা উধাও হয়েছে, আমরাই খালি সাদাকালো টিভিতে ঝিরঝিরে ছবি সারাতে ছাতে উঠে এ্যান্টেনা ঘুরাতাম। এমনই এক বিকেলে ছাতে গিয়ে দেখি একটা মোমবাতি ঘুড়ি আমাদের এ্যান্টেনার কাঠিতে আটকে আঁকুবাঁকু করছে। তা সুতোটা খুলে ঘুড়িটা নিচে নাবিয়ে আনলুম। অনেকখানি জটপড়া মাঞ্জাদেওয়া সুতোও ছিল তার সাথে। অঙ্কে আমি ততোধিক কাঁচা, সুতারাং টপোলজির অমন একখান প্র‍্যাকটিক্যাল আঁক যে আমি কষতে পারবো না সে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই ঘুড়ি ও সুতো দুইই পড়ার টেবিল থেকে খাটের তলায় ক্রমশ সেঁদিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় এক কাণ্ড হল।
    আমার দিদা, অর্থাৎ মায়ের মায়ের দিকের লোকেরা বেশ দীর্ঘজীবি। সাতচল্লিশ আর একাত্তরের ঝামেলায় যারা কাটা পড়েছিল আর যারা নিখোঁজ হয়ে গেছিল তাদের হিসেব তো যমরাজও রাখেন নি, সুতারাং তাদের কথা বলতে পারি না। কিন্তু যারা বেঁচে ছিল তাদের জীবনীশক্তি ছিল প্রচুর। সুন্দরবনের বাদায় জলে কুমীর ড্যাঙায় বাঘ সামলেও তারা দিব্যি চাষবাস করে চালিয়ে যাচ্ছিল। 
     
    আমার দিদার মা বাবাও ঐরকম এক যায়গায় থাকতেন। আমাদের মত আলসে আর ডিপ্রেশানের রুগি ছিল না বলে বুড়ো দাদু (৯০) আর বড়মা (৮৪) দিব্যি টনকো ছিলেন। সত্যি বলতে কি চুরাশি বছর বয়সেও এদের একটাও চুল পাকে নি। দিব্যি দশ কিলোমিটার হেঁটে বাজার হাট করতে পারতেন। কিন্তু ডাকাতে কুপিয়ে গেলে বাঘা বাঘা লোকেও পটোলোৎপাটন করে থাকেন, তো এনারা তো অশীতিপর বৃদ্ধবৃদ্ধাদের দল। তো ডাকাতে রামদায়ের ঘায়ে বুড়ো দাদুর আধখানা হাত ঝুলে গেছিল, ডাকাতরাও তেমন করে বেঁধে রেখে যায় নি বুড়ো বুড়িকে। ফলে আঁচড়ে কামড়ে সেই বাঁধন ছিঁড়ে বেরোতে পেরেছিল দাদু। কোন রকমে চ্যাঁচামেচি করে লোকজন জড়ো করে তারা। পাড়াপড়শিই তাদের হাসপাতালে পৌঁছে দেয়। রামদা'এর আঘাতে যদিও বা বেঁচে যেত বুড়োবুড়ি, কিন্তু দিদা সুন্দরবনের চিকিৎসার উপরে রাখতে সাহস পেল না। তাই পত্রপাঠ তাদের বারাসাতে নিয়ে আসা হল। বাড়িতেই খান তিন চার ডাক্তার, ফলে সেবা শুশ্রুষায় বড়মা চটপট ভালো হয়ে উঠল। দাদুর অবশ্য বেশিদিন সামলাতে পারে নি ঐ ধাক্কা। শরীরটা দূর্বল হয়ে উঠেছিল, শেষ পর্যন্ত ক্যানসারে পেড়ে ফেলে। ডাকাতির আরো পাঁচ বছর পরে পচানব্বুই বছর বয়সে বড়মাকে রেখে বুড়ো বৈতরনী ক্রস করে যায়।
     
    বড়মা তার পরে শাটল কক্ হয়ে গেল। ছেলের বাড়ি, মেয়ের বাড়ি ঘুরে ঘুরে বেড়াতো। ছোট্টখাট্টো বুড়ো মানুষ বলে কেউ খুব একটা পাত্তা দিত না। আমি ছেলেবেলায় দেখেছি চুপটি করে ঘরে একটা বিছানায় বসে থাকত। কোমরে জোর লেগেছিল তাই কোমর তুলতে পারত না। কিন্তু হাত ধরে ধরে টুক টুক করে হাঁটতে পারত। কথায় বলে নাতির ছেলে পুতি, সে নাকি সুদের উপর সুদ, ভয়ানক মিষ্টি হয়। অথচ আমি মফঃস্বলী বক্কাবাজ ছোকরা। বাইরে নেহাৎ ক্যাবলা হলে কি হবে, বাড়িতে কাক চিল বসতে পারত না। কিন্তু বড়মাকে আমি ভয় পেতাম। ছানি কাটার অপরেশানে ভুল হওয়ায় একটা চোখ খারাপ হয়ে গেছিল বড়মার। সেই শূন্য চোখের কোটরে একটা ঝাপসা অন্ধকার চশমার পুরু কাঁচের মধ্যে দিয়ে দেখা যেত। আমার ভয় করত ঐ অন্ধকার দেখে। তারাশঙ্করের ডাইনির কথা মনে হত। বুড়ি অবশ্য আমাকে ভালোবাসার কসুর করত না। আমাদের বাড়িতে সকলেই প্রায় মাতৃমুখি। মানে আমাকে আর আমার বোনকে মায়ের মত দেখতে। মা-মাসী-মামারাও দিদার মত দেখতে। দিদা আবার বড়মার মত দেখতে। তাই আমাদের মুখেই হয়তো আদ্যিকালের আয়নায় নিজের মুখ দেখার আনন্দ পেত বুড়ি। আমি বুঝতে পারি নি কখনো। কিন্তু পাশে ডেকে বরাবর মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিত বড়মা। কক্ষনো একটাও গুরুজনসুলভ কথা বলে নি আমাকে।
     
    যাক গে, কি বলতে কি বলে ফেললাম। ঘুড়ির গল্পে ফিরে আসি। তা ঘুড়িটা আর সুতোটা বসার ঘরের তক্তপোশের তলায় ধুলো খাচ্ছিল। এমনই এক সময়, বড়মা এসে কিছুদিন সেই তক্তপোশে থাকতে শুরু করল। আমাদের ব্যস্তবাগীশ সংসার আর বড়মার শম্বুকগতির জীবন কেমন ইন্টারটোয়াইন্ড হয়ে গেল। 
     
    এমনই একদিন ইশকুল থেকে ফিরে খেলতে বেরুবো বলে টিফিন খাচ্ছি, হঠাৎ দেখি বুড়ি পাশে এসে বসল। আমার হাতে দিল সেই মাঞ্জা দেওয়া ঘুড়ির সুতো। ঐ এক চোখেই কত দুপুর কাটিয়ে সবকটা সুতোর প্যাঁচ ছাড়িয়ে সেগুলো পরিপাটি করে একটা কাগজে জড়ানো। আমার জটপড়া জীবনে এমন সরল সমাধান কখন আর দেখি নি।
     
    সেদিন খেলতে যাওয়া হল না, সুতোটা ঘুড়িতে আটকে ছাতেই গেলাম। বিকেলবেলা আমাদের বাড়ির দক্ষিন-পুব দিক দিয়ে একটা বেশ হাওয়া বইত। সেই হাওয়ায় সেদিন ঘুড়িটা উড়ে গেল। কি জানি হয়তো বুড়ির ভালোবাসা পেয়ে তারও মনটা উদাস হয়েছিল।
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • যদুবাবু | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:১৩498785
  • সেই অদ্ভুত ভালো লেখাটা ! এইটা আমার যে কী ভালো লাগে বলে বোঝাবার নয়। 
  • Tim | 2603:6010:a920:3c00:a849:1d16:4045:86be | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:৪৪498787
  • বাহ খুব সুন্দর লেখা
  • | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২১:৩৫498788
  • এই যাহ এটা পড়ে ভারী মন খারাপ হল।
  • Nirmalya Bachhar | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২২:০৫498789
  • @জেডি - থ্যাঙ্কিউ রে। এখানেও গুঁজে দিলুম
  • Nirmalya Bachhar | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২২:০৭498790
  • @টিম - অশেষ ধন্যবাদ
  • Nirmalya Bachhar | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২২:০৮498791
  • @দ- দি - আসলে বিশ্বকর্মা পুজো গেলেই আমার বড়মার কথা মনে পড়ে। ছেলেবেলার কিছু কিছু স্মৃতি খুব দাগ কেটে যায়। তার মধ্যে এটা একটা।
  • Nirmalya Nag | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০০:৫১498795
  • বাহ, সুন্দর মন ভাল করা একটা লেখা। আমার হাতে অবশ্য ঘুড়িরা ওড়েনি, নিহত হয়েছে। 
  • Nirmalya Bachhar | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৭:৩৭498820
  • @Nirmalya Nag আমিও জানতাম না। সামহাও একদিন উড়ে গেল অদ্ভুতভাবে
  • বিপ্লব রহমান | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:২৬498844
  • ঘুড়ির আকাশে আজকের সকালটা আরও সুন্দর হলো। 
     
    আরও লিখুন 
  • Nirmalya Bachhar | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১০:৫৫498857
  • @বিপ্লব - খুব খুশি হলাম। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন