এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  সিনেমা

  • বিচ্ছেদের ক্রন্দন- ‘মাম্মো’ ও দেশভাগ

    তুহিনাংশু মুখার্জি
    আলোচনা | সিনেমা | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ২১৯০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)

  • সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল-এ বুঁদ হয়ে থাকা বাঙালি, চলচ্চিত্র-সমালোচনার জগতে, সমান্তরাল ছবির পরিসরে শ্যাম বেনেগাল, কুমার সাহানি, মনি কৌল বা অদূর গোপালকৃষ্ণন-কে স্থান করে দেয় বটে – কিন্তু তাঁদের ছবির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ কিংবা মূল সুরগুলিকে আত্মস্থ করার নেশা তার খানিক পড়তির দিকে। যেমন, সত্যজিতের পথের পাঁচালির পূর্বে বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ উৎকর্ষের নিরিখে সত্যজিত কর্ষিত সোনার ফসলকে স্পর্শ করে না ঠিকই, কিন্তু সমাজ-বাস্তবতার যে চিত্র তা ফুটিয়ে তুলতে চায়, তা কিন্তু সত্যজিৎ -কর্তৃক বাংলা সিনেমার রক্তাল্প শরীরে জরুরি হিমোগ্লোবিন সঞ্চারেরও পূর্বের উদ্যোগ। সাম্প্রতিক কিছু দশকে, মূলত বিংশ শতকের অন্তিম দশক থেকে বিশ্বায়ন তথা পুঁজির উন্মাদ-নৃত্যের তালে-ছন্দে হিন্দি সিনেমা – তথা মূলধারার বলিউড – যেভাবে প্রলয়নৃত্য পরিবেশন করে আমাদের স্বমৈথুনপ্রেমী সভ্যতা উপহার দিয়েছে এবং দিয়ে চলেছে, তার দিগ্বিদিক-ভোলানো রোশনাই আমাদের ক্রমাগত ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে হিন্দি ভাষায় চলচ্চিত্র-পৃথিবীর কি অসামান্য সব সম্পদ আমাদের কাছে ছিল, যা আমরা ধারণ করতে পারতাম আমাদের শিরায় শিরায়। এরকমই এক জাদু-দণ্ডের মালিক ছিলেন শ্যাম বেনেগাল, যাঁর ‘অঙ্কুর’, ‘নিশান্ত’, ‘মন্থন’ – এই সমস্ত জাদুকার্য উপভোগ করাকে, আমাদের সাধারণ দর্শকদের, তেমনই অবশ্য-কর্তব্য বলে মনে করা উচিত ছিল, যেমন ৬০-এর দশকের কর্তব্য ছিল দেশভাগের প্রেক্ষাপটে আজাদগড় কলোনিতে নির্মিত শ্রী ঋত্বিক ঘটকের দেবীপ্রতিমা দর্শন করা। আমাদের আজকের আলোচনার আধার এরকমই অবশ্য-দ্রষ্টব্য একটি ছবি, যা ৯০-এর দশকে আমরা পাই শ্যাম বেনেগাল এর কাছ থেকে।

    ‘মাম্মো’ চলচ্চিত্রটি দেশভাগ এর মতন এক দগদগে ক্ষতের ছায়ায় আশ্রিত হলেও, উল্লেখ করা প্রয়োজন, যে কেবল সেই লাঞ্ছনা বা যন্ত্রণার ইতিহাসবোধ এই ছবির সম্পদ নয়। যে সময়পটে এই ছবির মূল কাহিনীর বিন্যাস, তার অসংখ্য অসুখ ফুটে ওঠে চিত্রনাট্যের মুন্সিয়ানায়। কিশোর রিয়াজ-এর দৈনন্দিনতার ফাঁকে-ফোকরে জরুরি অবস্থায় জর্জরিত ৭০ দশকের উত্তাল রাষ্ট্রের অসাম্য, দালালি, অবৈধ চক্র ইত্যাদি যেমন উঁকিঝুঁকি মারে, তেমনি উঠে আসে মানবিকতা, অমানবিকতা, ধর্ম এবং পরিচয়ের ইতিহাস। তবু এ সবকিছুকে ছাপিয়ে যে এক হতাশাচ্ছন্ন মায়া-অনুভূতি জাগিয়ে তোলে এই ছবির বিভিন্ন দৃশ্যপট, তার দায়ে প্রধানতম অভিযুক্ত ৪৭-এর সেই হৃদয়-চেরা কাঁটাতারের বেড়া, যা বিভাজিত করে বন্ধুত্ব, প্রেম, ভালোবাসা, সম্পর্ক, ভাতৃত্ব – এক লহমায় প্রায় সমস্ত কিছু।

    প্রায় ৩৩ অতিক্রান্ত রিয়াজের স্বপ্নে এই ছবির যাত্রা শুরু, যা সমসাময়িক সমাজের অবচেতনে লুকিয়ে পড়া নির্মম স্মৃতিগুলোকে যেন একপ্রকার স্বীকার করে নেয়, পরপর কতগুলি ছোট ছোট শটের মন্তাজে। ছবিতে যদিও তা কেবলই রিয়াজের প্রিয় মাম্মো নানীর স্মৃতি হিসাবে উঠে আসে, আসলে কি তা কেবলই ব্যক্তিগত? এই স্মৃতি কি উত্তর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের আরো শত-সহস্র মানুষের সম্পর্কের, বন্ধনের, আবেগের স্মৃতি নয়! উত্তর খুঁজে বেড়ায় দর্শক।
    কিছুক্ষণের ভেতর ছবি ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যায় – ২০ বছর আগে, উন্মোচিত হয় কিশোর রিয়াজের সাথে তার মাম্মো নানীর অল্প অল্প করে বোনা সম্পর্কের নকশিকাঁথা। ফরিদা জালাল-এর অসামান্য অভিনয় চরিত্রটিকে যেমন শৈল্পিক ন্যায় উপহার দেয়, তেমনই ইতিহাসের যে হৃদয়বিদারক সত্যিতে এই চরিত্রের অবস্থান, তাকে আরো দৃঢ়তা দেয় তাঁর কিছু নির্দিষ্ট ভঙ্গিমা বা বাচনভঙ্গি। ছবিতে রিয়াজের ঠাকুমার অনবদ্য উপস্থিতি তাঁকে সমকালের সংকটে, দ্বিধায়, কুণ্ঠায় জর্জরিত, অথচ এক অদ্ভুত মানবিক সত্ত্বায় উপনীত করে, যার সাথে জাত-বর্ণ-নির্বিশেষে আমাদের মধ্যবিত্ততা একাত্মবোধ করে। ঠাকুমা ও তার বোনের সাথে কিশোরের প্রাথমিক সংলাপেই ফুটে ওঠে মাটির টান, ফেলে আসা ঠিকানার প্ৰতি বেদনা। এই বেদনাই তো ঋত্বিক ঘটকের সেই গোপন যন্ত্রণার বেদনা – যা ঈশ্বর চক্রবর্তী আর হরপ্রসাদের সংলাপে আমরা অনুভব করি সুবর্ণরেখা ছবিতে। তবে এই ছবিতে শ্যাম বেনেগাল সচেতনভাবে যে সিদ্ধান্তটি নেন এবং যথার্থ শিল্পী হিসাবেই নেন – তা ছবিটিকে দেশভাগকেন্দ্রিক অন্যান্য ছবিগুলির থেকে স্বাতন্ত্র্য দেয়। মূলত তিনি নিবিষ্ট-চেতনার আলোয় ৭০-এর দশকের সেই গা-ছমছমে সময়ে, একজন প্ৰান্তিক মানুষের অবস্থানকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। কারণ তাঁর অসামান্য শৈল্পিক মেধা জানত, যে শতাব্দীর শেষে যখন মানুষ একটি নতুন ভোরের খোঁজে আকুল, তখন ৪৫ বছর আগের এক রাজনৈতিক অবিচক্ষণতা মানুষকে আর নতুন করে বিব্রত করতে পারে না। একমাত্র মানবিক সম্পর্ক, স্মৃতি এবং সমকালের সমাজচিত্রের মধ্যে দিয়ে উস্কে দেওয়া সম্ভব সেই দগদগে ঘায়ের ছোপ ছোপ স্মৃতি। কাজেই, আমরা ছবিকে ক্রমশই রিয়াজের সাথে সাথে এগোতে দেখি, ঠাকুমার বোনের উপস্থিতি তার বয়ঃসন্ধির ব্যক্তিগত পরিসরকে ভয় দেখায়, বন্ধুমহলে সে মাম্মো নানীর পরিচয় গোপন করে যায়, নানাভাবে জানান দেয় তার অভিযোগ, শেষমেশ ক্লাস কেটে, নকল গোঁফ এঁকে, হিচককের ‘সাইকো’ দেখার গল্প তাকে স্বীকার করতে হয় নানীর কাছে। এরকম অত্যন্ত সুমিষ্ট, সাধারণ কিছু এপিসোড গল্পটিকে একটি সম্পর্কের গল্পে নিয়ে যেতে চায়, যে সম্পর্ককে ব্যবহার করে পরিচালক দর্শককে ছবির অন্তিম ভাগে দেবেন সপাট একটা ধাক্কা।

    গার্হস্থ্য হিংসা, থানার বাইরে অবৈধ পরিচয়পত্রের কারবারি, রাস্তার দেওয়ালে ‘গরম হাওয়া’-র পোস্টার সময়কে প্রকাশ করতে চায়। উঠে আসে মাম্মো চরিত্রের পাশাপাশি সচ্ছল, অর্থবান, সুবিধাবাদী এক মুসলিম দম্পতি – যারা সাতের দশকে দক্ষিণ-বাম উভয় হস্তে উপার্জন করে ফুলে-ফেঁপে ওঠা উচ্চবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্তর প্রতিনিধিত্ব করে। কিশোর রিয়াজ তাদের অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করে সরাসরি মুখের ওপর, যেমন করে তার মাম্মো নানী। আমার মনে হয়, তা-ও সচেতনভাবে সেই উত্তাল মুক্তির দশকের ক্রোমোজোমে লুকানো বিদ্রোহ-চেতনাকে মনে করায়। বাবার আসল পরিচয় জেনে ফেলে রিয়াজ রেগে যায় তার ঠাকুমার ওপর, যে অছিলায় আরো ঘনিষ্ট হয়ে পড়ে মাম্মো আর রিয়াজ। এই ছবির আরো একটি দিক দর্শককে আকর্ষণ করে, যা হল এক ধরণের ধার্মিকতার খোঁজ। তা কেবল মাম্মো চরিত্রের মুখে আল্লার কথা আমরা বারবার শুনি বলেই নয়, বরং ক্রমশই গল্পের সাথে সাথে আমরা আমাদের সমাজব্যবস্থায় প্রান্তিক মানুষের জীবনে, বা বলা যেতে পারে সার্বিকভাবে আমাদের জীবনে, ধর্মের অবস্থানটি সনাক্ত করতে পারি – যা পূর্ণতা পায় ছবির এক বিশেষ মুহুর্তে মাম্মোকে খুঁজতে তাঁর প্রিয় রিয়াজ আর তার ঠাকুমার অন্বেষণে। জন্মদিনের পার্টি নিয়ে রিয়াজের ক্ষোভ প্রকাশ পেতে দেখি আমরা, সমাজের উচুতলার প্রতি একটি ১৪-১৫ বছরের ছেলের রাগ, যা প্রায় সরাসরি রিয়াজের মুখ থেকে সংলাপ হিসাবে ছিটকে বেরোয় সমাজের দেওয়ালে দেওয়ালে, তার পরে কি আর সন্দেহ থাকতে পারে যে খালিদ মোহাম্মদ, জাইদি এবং জাভেদ সিদ্দিকীর মিলিত প্রয়াসের এই কাহিনীতে পরিচালক সমকালের গাঢ় রাগকে কিভাবে খুঁজে পেতে চেয়েছেন? মাম্মো নানীর মুখে তার গলায় আটকে থাকা অতীতের স্মৃতিকথা শুনতে শুনতে কিশোর রিয়াজ সংকল্প নেয় – লেখক হিসেবে সে এই কাহিনীকে রূপ দেবে বইয়ের পাতায়। এই ঘটনার ঠিক পূর্বেই থিয়েটারে বসে এম.এস. সথ্যুর ‘গরম হাওয়া’ দেখতে দেখতে মাম্মোর কান্না আমাদের যেমন ফরিদা জালাল নামক এক অসামান্য অভিনেত্রীকে চেনায়, তেমনি ভাবায়, যে সত্যিকারের সিনেমা-মাধ্যম সমাজের জন্য কি না করতে পারে, যদি চায়!

    “হাজারবার থমকে যাই আমি।
    হাজারবার হাঁটি। এই মাটিতে”
    এরকম বেশ কিছু দৃশ্য আর গজলের কিছু কাপলেট নিয়ে ছবিটি যখন একটি মানবিক রূপ নেয়, গল্পের ঠাসবুনোটে বাঁধা পড়ি আমরা দর্শক, নাপাম বোমার মত ছবির ওপর নেমে আসে দেশভাগ – যেমন ৪৭-এর সদ্যোজাত শিশু-রাষ্ট্রের উল্লাস নৃত্য, ঢোল, করতাল-এর জল্লাদমঞ্চ নেমে এসেছিল সেই রাষ্ট্রেরই কিছু প্রান্তিক অসহায় মানুষের জীবনে। স্বাধীনতার উচ্ছাস ঢেকে রেখেছিল সহস্র চোখের জল-পানি আর গায়ের রক্ত-ঘাম যেমন ৭৪ বছর পর তা ঢেকে রাখা হয় পরিচয়পত্রের মোড়কে। আমরা দেখি পরিচিতিহীন, আশ্রয়হীন একটি মানুষের পরিচিতি আবিষ্কারের জন্য অসাধু পথের খোঁজ, দালালচক্র, সর্ষের মধ্যে ভূত.. এইসব। আসলে হরপ্রসাদের কথাই তো ঠিক, বাস্তব বলুন, ইতিহাস বলুন, সে তো ঋত্বিককেই সত্যদ্রষ্টা হিসাবে মেনে নিয়েছে। ভবিষ্যতের যে আকণ্ঠ ভোগ, তার ‘বীভৎস মজা’য় ভারত রাষ্ট্রের নাগরিক-জীবন দেশভাগ কে আদৌ কি মনে রাখে! এরা ‘দাঙ্গা দ্যাখে নাই, মন্বন্তর দ্যাখে নাই, দেশভাগ দ্যাখে নাই’। ‘মাম্মো’র মতন মানুষরা তো না মানুষ। তাদের ঘর-বাড়ি নেই, দেশের ঠিক নেই, পরিচিতি নেই। তারা বায়ুভুত, উদ্বাস্তু, আধুনিক রাষ্ট্রের চরমতম আক্রোশের কেন্দ্রবিন্দু, তাদের গলার কাঁটা, সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্তের মুখের খাবার, চাকরি, ঘর কেড়ে খাওয়া প্রেতাত্মা।

    ভুল বোঝাবুঝি, সম্পর্কের ওঠা-নামা, কটূক্তি – সব কিছুই তো মিটিয়ে নেওয়া যায়, যদি থাকে স্নেহ, ভালোবাসা, মানবিকতার সন্তাপে ভেজা মন। ক্ষণিকের বিচ্ছেদকে জোড়া লাগানো যায়, কিন্তু রাজনীতি, পুলিশ, নিয়ম, অনুশাসন, আধুনিক রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী পরিচিতি? মানবিকতা, ভালোবাসা, হৃদয় পারে কি সেই সব হিংস্রতার সাথে যুঝতে! উত্তর তো একবিংশ শতাব্দী আমাদের রোজই দিয়ে যাচ্ছে খবরের পাতায় পাতায়। কাজেই রিয়াজকে স্যুট পরে আর দেখা হয়না তার মাম্মো নানীর। তার অবস্থান, পরিচিতিকে শনাক্ত করতে নখ-দাঁত নিয়ে এগিয়ে আসে ৯০-এর দশকের জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের শাসনতান্ত্রিকতা। সেই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে পড়ে মাম্মোর সচেতন সপাট উক্তি – ‘এই মাটি তো আমার দেশ। এই মাটিই তো আমার বাড়ি’। মনে হয় সত্যিই তো! এই যে পরিচয়, কিসের পরিচয়! কেনই বা পরিচয়! সত্যিই কি এই দেশভাগ, এই বিভাজন – স্বাধীনতার জন্য? যদি তা হয়ও, তো কাদের সেই স্বাধীনতা? ভারত রাষ্ট্রের কোনো অখণ্ড ধারণা কি আদৌ ছিল এই ভূখণ্ডের সুবিশাল নিম্নবর্গের চেতনায়? তারাই তো ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিশ্বায়িত পৃথিবীতে ঔপনিবেশিক সুরারসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত তৃতীয় বিশ্বের শহুরেপনা কোনোদিন কি এসব ভাবতে চেয়েছে? তাদের ডান-বাম-মধ্য কোনো পন্থাই কি ‘মাম্মো’র মতন মানুষদের মাটির টান, জন্মভূমির প্রতি গাঢ় আবেগকে নিয়ে চিন্তা করতে প্রস্তুত? আর আজকের উগ্র স্বজাতি-বোধ যেখানে চক্ষুলজ্জার খাতিরেও আর সহিষ্ণু হতে রাজি নয়, ফিচে-র জাতিরাষ্ট্রের ভূত যেখানে পরিচয়ের বিভিন্ন সীমানা রচনায় ব্যস্ত, সেখানে এই সমস্ত প্রশ্ন তো নেহাতই অবান্তর! আসলে আমরা এই সামান্য সত্যিটাই তো এখনো স্বীকার করে উঠতে পারিনি মনে মনে, যে এই যে দেশভাগ, এই যে রাষ্ট্র বিভাজন – তা ধর্মকে ভিত্তি করে হয়েছে বটে, কিন্তু সেই ধর্ম দুই দেশের ভুঁইফোড় কিছু মানুষকে আদপেও আশ্রয় দিতে পারেনি। তারা থেকে গেছেন শাটল-ককের মতন, যাদের ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিব্যি খেলা করা যায়। তাদের নিজেদের কোন ইচ্ছে কিংবা একান্তই ব্যক্তিগত ভাষ্য থাকা সম্ভব – এই ধরণের ভাবনা আমাদের অভিধানে কখনো আমদানি করা যায়নি, বরং ফুকো-বর্ণিত সার্বজনীন বুদ্ধিজীবীর মতন কেউ কেউ আমরা টিভি-পর্দায়, সেমিনারে, মঞ্চে তাদের হয়ে গলা ফাটিয়ে গেছি তারস্বরে। আর সে-সবের অন্তরালে যেভাবে স্বামীর অবর্তমানে মাম্মোকে তার পাকিস্তানের ঠিকানা থেকে ঠেলে সরিয়ে বানিয়ে দেওয়া হয় ভূমিহীন, রাষ্ট্রহীন এক প্রাণী, সেভাবে এখানেও অনেক ‘মাম্মো’ দের নির্বাসন দেওয়া হয় এই অরণ্যে, সেই অরণ্যে –নাম নাই বা বললাম। আসলে এই গল্প নির্লজ্জ সুবিধাভোগের আর রাজনীতির দাবা খেলার, যা আমাদের সকলেরই জানা – শুধু প্রকাশ্যে গোপন করে রাখা!

    ছবির শেষ দৃশ্যে দর্শককে অবাক করে দিয়ে, শ্যাম বেনেগাল যে আশাবাদ-কে ফিরিয়ে আনেন পর্দায়, তা কি আদৌ বাস্তব? হয়তো না। ‘মাম্মো’রা চাইলেও এভাবে ফিরে আসতে পারে না। কোনো রাষ্ট্র কিংবা মহাদেশেই নয়। কিন্তু তা বলে শিল্পে তা হবে না কেন? বাস্তবতার চাপে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরতে তো বড় শিল্পীরা জন্মান না, যেমন জন্মান না ‘মন্থন’ এর ডাক্তার রাও-রা। তাই এই ছবির শেষে এসে এক দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটে সুমধুর মিলনে, যা হতে পারে হয়তো কল্পনা, তবুও জরুরি – যেমন জরুরি ভ্যান গঘের রঙ, এলুয়ারের অবাস্তবতা কিংবা জীবনানন্দের প্রকৃতি – কারণ এই মানবিকতার প্রত্যাশা, সম্পর্কের বিশ্বাস, অনুভূতিকে মোমবাতির কম্পমান শিখার মতন আগলে রাখা, আজকের এই নৈরাজ্যের আর নির্বীর্য পৃথিবীতে শিল্পের একান্ত কর্তব্য।

    -কারামাজভ, ধর্ম যা বলে, তা কি সত্যি? আমরা কি সত্যিই মৃত্যুর পর আবার জেগে উঠব? আবার দেখতে পাব একে অপরকে?
    -অবশ্যই। আমরা দেখতে পাব একে অপরকে। আমরা হাসতে হাসতে আনন্দের সাথে সবাই একে অপরকে বলব সেই সমস্ত কিছু, যা যা ঘটেছিল!

    ছবি শেষ হয়ে গেলেও, জগজিৎ সিংহের গজলটি হৃদয়ে আছাড় মারে বারবার।



    ছবির উৎস: Osianama, মূল ছবি, উইকি


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ২১৯০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সে | 2001:171b:c9a7:d3d1:2d24:d0f2:62ee:10a3 | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১০:৩০498653
  • বহুবছর আগে দেখা। স্পষ্ট মনে আছে সিনেমাটা। অসাধারণ।
  • santosh banerjee | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১১:১৯498654
  • অপুর্ব ছবি, মানসিক স্তরে তাড়না করে বেড়ায়। অনেক দিন এবং অনেক টা সময় ধরে ভাবায় । যেমন ভাবায় "মেঘে ঢাকা তারা", "সুবর্ন রেখা"...বা "কলকাতা ৭১", "কোরাস" পর্যায়ের ছবি গুলো।আমরা "গরম হাওয়া" বা "মামমু" কে মনে রাখি না তাই নয়, আমাদের মনে রাখতে দেয়া হয়না।অন্য ধারার কটা ছবি TV তে দেখা যায় বলুন তো? বেনীয়া ব্যাবসায়ী রাত এটা খুব ভালো বোঝে যে "মাম্যো" দেখালে পয়সা নেই, আর সরকারের রক্ত চক্ষু তো আছেই। খুব পরিকল্পনা করে রায় মশায়ের কিছু ছবি( যেখানে আই.টি সেল কোনো খবরদারি করবে না) দেখানো হয়। বলুন তো মৃনাল সেন বা ঋত্বিক ঘটকের ছবি ক'বার কোথায় দেখেছিলেন। আসলে আমরা সত্য কে, বাস্তব কে ভয় পাই, আর তার ই সুযোগ নেয় কিছু মানুষ। এইসব ছবি আমাদের ভাবায় যে। ভাবাভাবির প্রশ্ন ওঠে না। উপভোগ করো। ভাবতে গেলেই তো কাছা ধরে টান পড়বে কিছু বেল্যিক দের।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে প্রতিক্রিয়া দিন