এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  গপ্পো

  • জোম্বিদ্বীপের কথকতা (পর্ব ১)

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | গপ্পো | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ৯১০ বার পঠিত
  • | |
    জোম্বি দ্বীপের কথকতা

    প্রথম অধ্যায়

    [ সত্যিটা কী? চারদিকে যা দেখছি, যা শুনছি? কিন্তু চোখ তো মরুভূমিতে জল টলটল সরোবর দেখে, কান যে কখনও কখনও স্বপনপারের ডাক শোনে যা অন্য কেউ শুনতে পায় না। তবে কি বোধবুদ্ধি বা অনুভব? জেগে স্বপ্ন দেখছি, নাকি স্বপ্নে জেগে আছি? দুটোর মধ্যে তফাৎ কী? আছে, তফাৎ আছে। স্বপ্নে গেলাস গেলাস এক কুঁজো জল খাও ঢক ঢক করে খাও বা যেমনই ইচ্ছে, তেষ্টা মেটে না। তাহলে আমার যে সারাজীবন তেষ্টা মেটেনি, তবে আমি কি স্বপ্ন দেখছি? স্বপনে রয়েছি গো সখি, আমারে জাগায়ো না।

    স্বপ্নে বীর্যপতন হলেও সন্তানের জন্ম হয় না। বাজে যুক্তি।

    বাস্তবেও অনেকসময় বীর্যপতন হয়, সন্তান জন্মায় না।

    তেভাগার সময়ের কাকদ্বীপ। চন্দনপিঁড়ি গাঁয়ের চাষিবৌ অহল্যা, ভরা পোয়াতি। পুলিশ ও গুন্ডার সমবেত আক্রমণের মুখে পিছু হটেনি। ‘অহল্যা মা তোমার সন্তান জনম নিল না’। ও তো মরে গিয়ে শহীদ হল, কিন্তু আমরা? আমি কি বেঁচে আছি? কী করে বুঝব? কাত্যায়ন, তুমি নাড়ি দেখতে জান? দেখ তো, আমি বেঁচে আছি কিনা! ]

    ফ্লোরিডা টুডে, ২২ মে, ২০১৮

    “দক্ষিণ ফ্লোরিডার লেক ওয়ার্থ এবং টার্মিনাস এলাকার অধিবাসীদের সতর্ক করা হচ্ছে যে জোম্বি ক্রিয়াকলাপ ও আক্রমণের ফলে ৭৩৮০ ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়েছে। কখন স্বাভাবিক হবে বলা মুশকিল”।



    সাদা দেয়াল

    ধীরে ধীরে চোখ খুলল মধু। না, কোন ব্যথা তো নেই, শুধু একটা বোদা ভাব। একটু একটু করে চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার হচ্ছে। চোখে পড়ছে ছোট ঘর, হাল্কা নরমসরম আলো,অফ হোয়াইট সিলিং, পীচ সবুজ দেয়াল, হালকা নীল পরদা। ও শুয়ে আছে একটি খাটে, লোহার খাট, ধপধপে সাদা চাদর- যেমনটি একটা হাসপাতালে থাকে। তাহলে কি ও কোন হাসপাতালে আছে? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মাথার কাছে কোন ছোট র‍্যাক বা টেবিল নেই যাতে ওষুধের শিশি, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন লেখা কোন চার্ট এসব থাকে। নাঃ, বিছানার কাছে কোন পাইপ, হুক থেকে ঝোলান স্যালাইন বা গ্লুকোজের বোতল – ওসব কিস্যু নেই। তাহলে ? তাহলে ও এল কোথায়? আরে, হাসপাতাল হলে অন্ততঃ একজন নার্স বা নিদেনপক্ষে একজন ওয়ার্ডবয় তো দেখা যাবে।

    ঘাড় ফেরাতেই চোখে পড়ল আরও সারি সারি গোটা দশেক খাট। কিন্তু সব খালি। একটাও রুগি নেই। তাহলে কি এটা হাসপাতাল নয়? তবে? মধুর মাথা ঝিমঝিম করে।

    ও এখানে কতক্ষণ আছে? মানে কতদিন হল? আর এল কী করে? কে আনল? আজ কী তারিখ? কিছু বোঝার উপায় নেই; না আছে কোন খবরের কাগজ, না কোন লোক, কাকে জিগ্যেস করবে? দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডারও নেই। এটা কেমনধারা হাসপাতাল?

    মধু আগে কখনও হাসপাতালে যায় নি। তবে এত বড়টি হয়েছে, শুনে শুনে খানিকটে আবছামত ধারণা হয়েছে। বাবা যখন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, অনেকদিন ছিল, তখন ও অনেক ছোট। তাই ওকে যেতে দেওয়া হয় নি। খালি একটা কাঁচে ঢাকা গাড়ি করে বাবাকে যখন বাড়ি নিয়ে এসেছিল সেটা ওর মনে আছে। মা খুব একটা কাঁদেনি। থম মেরে বসেছিল। সবাই ফিসফিস করছিল কী করে কাঁদানো যায়!

    ও বুঝতে পারছিল না মাকে কেন কাঁদতে হবে? বাবার ঘুম ভেঙে যাবে না? শেষে বড়পিসি এসে মায়ের হাত জোর করে টেনে ধরে হাতের শাঁখা-চুড়ি খুলে নিয়ে বাড়ির উঠোনে আছড়ে আছড়ে ভাঙল। তখন মা ডুকরে উঠল। কিন্তু যখন পাড়ার সবাই মিলে বাবাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল তখন মা মুখের চেহারা শক্ত করে বলল—মধুরে ছাইড়্যা দ্যান। অ ছুটু, অরে শ্মশানে যাইতে অইব না।

    মা? মা এখন কোথায়? মাকে কেন দেখা যাচ্ছে না? একটা অজানা শিরশিরানি ভয় আস্তে আস্তে ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকে। কিছু মনে পড়ছে না। ওর কী হয়েছিল? মাথা ঝাঁকিয়ে ও আবার ভাবার চেষ্টা করে।

    হ্যাঁ, এবার একটু একটু মনে পড়ছে। কিছু টুকরো টুকরো ছাড়া ছাড়া ছবির মত।

    ওর পুরনো বাইকটা নিয়ে রোজকার মত কাজে বেরিয়েছিল। ডেলিভারি ব্যাগটা পিঠে স্ট্র্যাপ দিয়ে আঁটা। ঘেমো গরমওলা এক বিচ্ছিরি দিন। ওর জামা ঘামে ভিজে পিঠে সেঁটে গেছে। হ্যাঁ, ওর গাড়ির স্পীড অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশিই ছিল, তার যথেষ্ট কারণ।

    কিন্ত একী? একদল স্কুল ফেরত কলকল করা কচিকাঁচার দল একেবারে সোজা রাস্তার মাঝখান দিয়ে পার হচ্ছে। ও ব্রেক চেপে গিয়ার বদলে সামলে নিল। আবার গতি বাড়াল, কিন্তু ওদের এই মফঃস্বলী শহরে রাস্তাগুলো তেমন সুবিধের নয়। মাত্র বর্ষা বিদায় নিয়েছে। খানাখন্দগুলোর মেরামতি এখনও শুরু হয় নি। ও স্টেশন পাড়ার মার্কেট কমপ্লেক্স পেরিয়ে গিয়ে বাঁদিকে বাইক ঘুরিয়েছে কি সামনে এক বয়স্ক মহিলা, হাতে বাজারের ভরা থলি। কোত্থেকে যে উদয় হলেন, একেবারে ওর মার্ডগার্ডের সামনে। ও প্রাণপণে স্টিয়ারিং ঘোরায়। একটা চিৎকার! পিঠের দিকে একটা তীব্র যন্ত্রণা! ব্যস, সব অন্ধকার।

    আরও কিছু টুকরো টুকরো ছবি।

    হ্যাঁ, এবার ভালই মনে পড়ছে। মনে পড়েছে ও কে, কী করে সব।

    ও হল মধুসুদন দেবাঙ্গন—একটা রোগাপটকা বছর কুড়ির ছেলে; ছত্তিশগড়ের হাওড়া-মুম্বাই লাইনের চাঁপা জংশনের কাছে ক্রিশ্চান পাড়ার দিকে একটি অ্যাসবেস্টসের ছাদওলা এককামরার কোয়ার্টারে বিধবা মায়ের সঙ্গে থাকে।

    পাড়াটাতে একটা প্রটেস্ট্যান্ট চার্চ; সেখান থেকে মাঝে মধ্যে আটা, পুরনো গরম কাপড়, জ্যাকেট এসব পেয়েছে। কয়েকবার ফাদারের উপরোধে সানডে বাইবেল ক্লাসে গিয়েছে। কিন্তু নিয়ম করে প্রতি রবিবার চার্চে যাওয়ার বান্দা ও নয়। ফলে ক্রীশ্চান হতে হতে হয় নি। কিন্তু ফাদার আশা ছাড়েননি। তাই ওর মা চার্চের কুষ্ঠ হাসপাতালে আয়ার কাজ পেয়ে গেল। ও পেল বছরে একজোড়া জুতো ও শীতের জামাকাপড়।

    এরপরে একদিন এলেন ওর স্কুলের অংকের স্যার – রামচন্দ্র দুবেজী।

    বললেন — কী ব্যাপার মধু? কীসব শুনছি? তুমি নাকি মধুসূদন দেবাঙ্গন থেকে মধু ড্যানিয়েল হয়েছ?

    ও লজ্জা পায়, চোখ নামায়। খেয়াল করেছে যে স্যারের কথায় হাসির আভাস, কিন্তু চোখ হাসছে না। ও জানিয়ে দেয় যে কথাটা সত্যি নয়, ও ড্যানিয়েল হয়নি।

    - কেন হওনি? তোমাদের ওরা দানছত্রের গমের বস্তা আর সায়েবদের ফেলে দেয়া ইউএসএ ছাপমারা পুরনো জ্যাকেট দেয়নি? তাহলে?

    - স্যার, আসলে ওদের গানটান, গিটার, অর্গান ভালই লাগত। কিন্তু ওখানে বড্ড কথায় কথায় পাপ। আমরা পাপী, পাপে জন্মেছি, আমাদের পরিত্রাতা যীশু মসীহ – এইসব। আমার মা-বাবাকে পাপী ভাবতে ভাল লাগেনি স্যার, তাই একদিন চলে এলাম।

    দুবে স্যারের চোখ জ্বলে ওঠে।

    - ঠিক করেছ, ম্লেচ্ছদের কথায় আর ভিক্ষের চালডাল পেয়ে নিজের বাপ-পিতামোর ধর্ম বিসর্জন দাওনি। তুমি হলে বীরের জাত, বীরের পরিবার।

    -মানে? আমার বাবা তো চাঁপা রেলস্টেশনের হামাল, মানে কুলি ছিল। কোন যুদ্ধটুদ্ধ করেনি তো!

    - আলবাৎ করেছেন। তোমার পিতামহ প্রপিতামহ সবাই। শোন, ভাল করে ইতিহাস পড়। আগে কয়েক’শ বছরের যবনদের শাসন, তারপর দু’শ বছরের ম্লেচ্ছ। কত অত্যাচার! কত লোক ভয়ে নিজের ধর্ম বদলে ফেলল। কিন্তু তোমাদের বংশ ঝড়ের মধ্যে প্রদীপের শিখা নিভতে দেয় নি।

    তুমি কাল থেকে রোজ সকালে হাতমুখ ধুয়ে শুদ্ধ হয়ে আমাদের মাঠে এস। ডিসিপ্লিন শিখবে, চরিত্র নির্মাণ হবে। এখন তোমার গড়ে ওঠার সময়। চতুরাশ্রমের প্রথম হল ব্রহ্মচর্য। গার্হস্থ্য জীবনের আগে সমস্ত মেয়েদের ভগিনী ভাবতে হয়। এই ম্লেচ্ছপাড়ায় ইন্দ্রিয়সংযম বড় কঠিন। বেশি বলার দরকার কি, তুমি নিয়মিত আসা শুরু কর।

    মধু যেতে লাগল। প্রথম প্রথম ভয় ভয় করছিল, পরে ভাল লাগছিল। খালি ড্রিল, আর কসরত নয়, অনেক নতুন নতুন খেলা শিখছিল। যেমন কবাড্ডি বা খো-খো খেলায় ওরা ‘আউট’ বা ‘ইন’ বলে না, বলে ‘বিষ’ আর ‘অমৃত’। বিষে তুমি আউট, আর অমৃতের ছোঁয়ায় তুমি বেঁচে ওঠ।

    আর শিখল রাষ্ট্র একজন দেবতা। নমো রাষ্ট্রদেবায়!

    রাষ্ট্রের হিত সর্বোপরি, ব্যক্তির স্বার্থ সবসময় রাষ্ট্রহিতের জন্যে বলি দিতে হবে। আরও বুঝল যে সদাবৎসল মাতৃভূমির রক্ষায় সর্বস্বপণ করতে হবে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, আংশিকভাবে। ম্লেচ্ছ ও যবনের মিলিত চক্রান্তে, দুদিকের দুটো যবনভূমি মিলে, তিনটুকরো। আগের অখন্ড ভারতে ফিরতে হবে।

    একবার চাঁপা থেকে বিলাসপুরের শিবিরে ওরা সবাই গেল। এর আগে ও যতবার লোক্যাল ট্রেনে বিলাসপুর গিয়েছে, কখনও টিকিট কাটে নি। চেকারদের ফাঁকি দেওয়ার খেলাটায় কী মজা!

    কিন্তু রামচন্দ্রস্যার সতর্ক করে দিলেন। রাষ্ট্রের ক্ষতি করা চলবে না। সবাইকে টিকিট কাটতে হবে। তবে মধু ও আরও কয়েকজনের টিকিট উনিই কিনে দিলেন।

    কিছুদিনের মধ্যে মধুর আত্মদর্শন হল। বুঝতে পারল যে ও হল আসলে উড়নচন্ডে; কোন ডিসিপ্লিন মেনে চলা ওর ধাতে নেই। এছাড়া এখানেও ওর মনে হানা দিল এক পাপবোধ। একদিন ওর ল্যাঙ্গোটিয়া ইয়ার স্ট্যানলির বোনকে কোয়ার্টারের পেছনে কুয়োর পাড়ে চুমো খেয়ে ছিল। ভেবেটেবে নয়, কেমন করে যেন ঘটে গেল। জেনির চেহারায় গোলাপি আভা ফুটে উঠেছিল। সেই মেয়েটাকে এখন ‘ভগিনী’ ভাবতে হবে? আরও পাপ আছে। মাঝে মাঝে ওরা স্ট্যানলির বাবার সিগ্রেটের প্যাকেট থেকে একটা দুটো সরিয়ে রেলপুলের পাশে গিয়ে ফোঁকে। তাহলে কি চরিত্র বিগড়ে যাচ্ছে? চুরি এবং নেশা করা! কিন্তু মধু দুম করে মিথ্যে বলতে পারেনা। দুবে স্যারকে যে ও শ্রদ্ধা করে!

    এই গোঁজামিল সামলাতে না পেরে ও আখড়ায় যাওয়া ছেড়ে দিল। তারপর গ্রহের ফেরে স্ট্যানলির বাবা রায়পুর লাইনের গতোরা স্টেশনে বদলি হয়ে গেলেন। জেনি স্ট্যানলি দ্রুত ‘আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড’ হয়ে গেল।

    ইস, এটাই যদি এক বছর আগে হত। তাহলে হয়ত মধুকে আখড়া ছাড়তে হত না।

    যাইহোক, ও এখন এক স্মল-টাউন বয় যে নিজের চাকরিটাকে — যাতে মাত্র দু’মাস আগে জয়েন করেছে — প্রাণপণে বাঁচাতে চাইছে। চাকরিটা ঠিক বলার মত নয়, বিশেষ করে মাইনেপত্তর। দেখতে গেলে ওর যা ডিউটি সেটা কুড়ি বছরের জোয়ান ছেলের খুব একটা ভাল লাগার কথা নয়। কাজটা হল পাঁচ কিলোমিটার দুরত্বের মধ্যে বাড়িতে বাড়িতে ডাক বা কিছু কনসাইনমেন্টের প্যাকেট পৌঁছে দেওয়া। অর্থাৎ ফিলোমেল ক্যুরিয়ের সার্ভিস।

    কী আশ্চর্য! এই একঘেয়ে কাজটাও ওর ভাল লেগে গেছে। কেন? ও নিজেও ঠিক জানে না।

    কিন্তু মালিক, ঝিটুমল সিন্ধি, একটুও খুশি নয়। এই ক্যুরিয়ার সার্ভিসটা চাঁপা শহরে বছর খানিক আগে শুরু হয়েছে। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে - এইসব কেরেস্তান ছোকরাদের নেওয়াই ভুল। এরা সব আলসে আর আড্ডাবাজ। একেই ব্যবসার হাল খাস্তা, তায় এইসব ডেলিভারি বয় হল বোঝার উপর শাকের আঁটি। আরও তিনজন কর্মচারি আছে বটে, কিন্তু মালিকের হিসেবে মধু হল সবচেয়ে ওঁচা। ও গোড়ার দিকে কয়েকবার বলেছে যে ও কেরেস্তান নয়। কিন্তু মালিকের চোখে অবিশ্বাস, তাই আজকাল আর কিছু বলে না।

    - তোর মত গবেটকে কেন যে মরতে কাজে লাগালাম! দু’মাসেই এতগুলো কমপ্লেন? চারটে ভুল ঠিকানায় ডেলিভারি তো তিনটের অ্যাকনলেজমেন্ট হারিয়ে ফেলা? আর দু’বার বাড়তি চার্জ ঠোকা!

    - বস, ওটা আমার দোষ ছিল না। সেন্ডার আপিস থেকেই প্যাকেটের গায়ে ভুল লেবেল লাগানো ছিল, তো আমি কী করব?

    - আচ্ছা, তুমি সাধুপুরুষ? ঠিকানায় একটু এদিক ওদিক, কিন্তু টেলিফোন নম্বর? সেটা দিয়েও তো ভেরিফাই করা যেত, তা তুমি করবে না। তোমার সম্মানে লাগে! আর অ্যাকনলেজমেন্ট হারিয়ে ফেলা? ওটা নিয়ে কী বলবে শুনি? আসলে তুমি হচ্ছ কুঁড়ের হদ্দ। এবার আমাকে রেহাই দাও। ফিরে যাও তোমাদের ওই চায়ের দোকানের ঠেকে; গিয়ে রাজা-উজির মারতে থাক। এর বেশি তোমার এলেম নেই। তোমার মত ছেলেদের ভরসায় থাকলে আমার ব্যবসা লাটে উঠল বলে। পাক্কা উঠবে, আজ নয় কাল।

    --বস, এটা একটু বেশি হয়ে গেল। আমি কি কিছুই করি নি? ছ’জন নতুন ক্লায়েন্ট এ্নেছি, মাত্র দু’মাসে—ভেবে দেখুন।

    --মাত্তর ছ’জন, তার এত চোপা! আরে ওদের মধ্যে দু’জন তো এমনিতেই এসে যেত। কারণ, ওদের আগের বাঁধা ক্যুরিয়ার কোম্পানি এ শহর থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছে। তাছাড়া ওদের চার্জও একটু হাই ছিল। এতে তোর কিসের কেরামতি?

    --না বস, আরও অনেক সার্ভিস দেনেওলা আছে। ওরা এসেছে আমার জন্যে। ওদের হেড বেয়ারারা আমার চায়ের দোকানের বন্ধু।

    --বাতেলাবাজি ছাড়, ঢের হয়েছে। এবার যেদিন কোন কমপ্লেন আসবে সেদিনই তোর হিসেব করে দেব। এই তোর লাস্ট লাইফ লাইন, বুঝলি?

    মধু আর কথা বাড়ায় নি। একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে না খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। মা খাবার নিয়ে সাধলে কাঠ কাঠ ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছিল—শরীর ভাল নেই।

    সেদিন রাত্তিরে ঘুম হয় নি। চাকরি গেলে খাবে কী? বাড়িভাড়া আর ইলেক্ট্রিসিটি বিল কী করে চোকাবে? মার পেনশানের ক’টা টাকায় তো নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।

    ও ক্রিকেট ভাল খেলত; ছোটবেলা থেকেই। রেলের মাঠে প্র্যাকটিস করত, ক্লাব কোচিংয়েও নিয়মিত যেত। সবাই ধরে নিয়েছিল যে স্পোর্টস কোটায় রেলের চাকরি ওর কপালে নাচছে। কিন্তু সেটা যে তুর্কি নাচ হবে তা বুঝতে দুটো বছর লেগে গেল। অনেক সুকতলা খসিয়ে দেখল সবসময় আড়াল থেকে একজন নেপো এসে দই খেয়ে যায়। তবে ওর কপালের পুরোটাই তেঁতুলগোলা নয়। ওর ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ফোন করে দেওয়ায় দু’মাস আগে এই চাকরিটা পেয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই ব্যাটা যাই যাই করছে।

    সে যাই হোক, ওর কষ্টের আসল কারণ একটু আলাদা। এটা ওর কাছে আচমকা ধরা পড়ল আর ও অবাক হয়ে গেল। বুঝতে পারল যে এই কাজটাকে ও খুব ভালবাসে; রোজ অপেক্ষা করে থাকে কখন তৈরি হয়ে ব্যাগ পিঠে বাইকে চড়ে বসবে। রোজ কড়া নাড়বে কোন নতুন দরজায়, চোখে প্রশ্ন নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে কোন নতুন মুখঃ ঝোড়ো কাকের মত চেহারার কোন বিরক্তবাবু, দয়ালু মুখের বয়স্ক মাসিমা, রাগী তরুণ বা নিষ্পাপ মুখশ্রীর কিশোরী—অজস্র মুখের মিছিল। ঘর থেকে বেরনোর সময় ও কল্পনা করে আজ প্রথম বাড়িতে দরজাটা কে খুলবে। অধিকাংশ দিন পায় একেবারে কেজো ঠান্ডা ব্যবহার। কিন্তু কেউ কেউ, হাজারে একজন, হেসে কথা বলে, একগ্লাস জল দেয়; আর সেই প্রসন্ন মুখ আদমের না হয়ে ঈভের স্বগোত্রের হলে? গোটা দিনটার মানে বদলে যায়। মালিকের খোঁচা দিয়ে কথা বলা গায়ে লাগে না।

    এখন এই হাড়কেপ্পন ভোঁদাগোছের বস ওকে দরজা দেখিয়ে দেবে বলে প্রায় স্থির করে ফেলেছে। একের পর এক বিষাক্ত লেগ কাটার। অপেক্ষা করছে কখন বল ব্যাটের কানায় লেগে স্লিপ বা কিপারের হাতে যায়। ঘোর অন্যায়! মাতা মেরি নিশ্চয় দেখছেন। তবে ওকেও এখন থেকে খুব সাবধানে ব্যাট করতে হবে। আর কোন কমপ্লেন হলে চলবে না। চৌকস হতে হবে।

    দিনটা ভালই শুরু হয়েছিল। প্রথম ঘন্টাতেই দুটো ডেলিভারি, বেশ সাবধানে । আর দু’জায়গাতেই হাসিমুখে ‘থ্যাংক ইউ’ পেল। আর কী আশ্চর্য, ধন্যবাদদাতাদের একজন স্কুলের মেয়ে, অবাঙালী। ওর বার্থডে ড্রেস –বিদেশি ব্র্যান্ডের- -অ্যামাজনের সৌজন্যে মধু গিয়ে ডেলিভারি দিল। মেয়েটি চিনেমাটির প্লেটে করে দুটো লাড্ডু ও একগ্লাস জল দিয়ে বলল—লীজিয়ে ভাইয়া! বার্থ ডে কী মিঠাই।

    মধুর খুব লজ্জা করছিল। তাড়াহুড়ো করে শেষ করতে গিয়ে বিষম খেয়েটেয়ে একসা।

    তখন থেকেই ওর মনটা একদম হলিউড-জলিগুড হয়ে গেছল।

    এতক্ষণে সব স্পষ্ট মনে পড়ছে। ওই ফিল-গুড মন নিয়ে অ্যাক্সিলেটরে চাপ বাড়িয়ে শার্প টার্ন নেওয়ার সময় কোথথেকে যে ওই থলিহাতে মাসিমা একেবারে ফ্রন্ট হুইলের সামনে এসে পড়লেন! ও ঠিকই কাটিয়ে ছিল, কিন্তু হলিউড-জলিগুড মন খেয়াল করেনি যে একটা মালভরতি ট্রাক বিপজ্জনক ভাবে ওকে ওভারটেক করছে।

    ও এবার পুরোপুরি জেগে উঠেছে। মাথাটা ফেটে যাচ্ছে, অনেক প্রশ্ন ভিড় করে আসছে, কোনটার উত্তর ওর জানা নেই।

    কতক্ষণ ঘুমিয়েছে? কে নিয়ে এসেছে? মা কোথায়? ওর কী হয়েছে? অ্যাকসিডেন্ট? এটা কীরকম হাসপাতাল? এখানকার খরচা কে মেটাবে?

    মাথার ভেতরে জমে থাকা ঘন কুয়াশা আস্তে আস্তে পাতলা হচ্ছে; কিন্তু বড্ড ধীর লয়ে। ও খাট ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করল, পারল না। হতাশ হয়ে দেখল ওর হাত-পা কেমন যেন বিছানার সঙ্গে সেঁটে আছে। এবার ও সত্যি সত্যি ভয় পেল। এর মানে কী?

    মরিয়া হয়ে চিৎকার ! মানে চিৎকারের চেষ্টা আর কি। কিছু একটা হল। ওর অস্পষ্ট চাপা শব্দের অভিঘাতে ওই শান্ত নিঃশব্দ শূন্যতার মাঝে কোন ঢেউ ঊঠল। কোথাও একটা দরজা খুলল। এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস। তারপর একটা মিষ্টি কন্ঠস্বর ওকে এই বলে আশ্বস্ত করতে চাইল যে ওকে এখন এই অবস্থায় থাকতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে ওর ভালোর জন্যেই এটা করা হয়েছে।

    কিন্তু এই কথা শুনে ওর মন শান্ত হল না। ও এই অর্থহীন দুনিয়ার মানে বুঝতে চায়। তাই প্রশ্ন করতেই হবে।

    -এ জায়গাটার নাম কী?

    উত্তর এল প্রায় প্রতিধ্বনির মত।

    -কোন নাম নেই।

    -উফ্‌! আজকে কত তারিখ? কী বার? এখন সকাল না বিকেল?

    - এখানে এইসব প্রশ্ন অর্থহীন।

    -কী যা তা! আরে ক’টা বাজে তো বলবে?

    -বললাম তো, এখানে সময় অনন্ত।

    -জীশাস, আর ইয়ু ম্যাড? দেয়ালঘড়ি্র কাঁটা দুটো দেখে বল ক’টা বাজে ।

    -এখানে দেয়ালে কোন ঘড়ি থাকে না, নিজেই দেখে নাও।

    ও চমকে ঘাড় ঘোরায়। হা হা করছে নিঃস্ব দেওয়াল। কোন ঘড়ির চিহ্ন মাত্র নেই।

    মধু নিজের চেতনাকে সুস্থ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

    -লাস্ট কোশ্চেন। আমাকে এখানে কে নিয়ে এল?

    -তোমারই অতীতের কর্মফল।

    আবার কুয়াশার মেঘ । ধোঁয়া ধোঁয়া। এক ঘন অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে ও শুনতে পেল একসঙ্গে অনেকগুলো দেয়ালঘড়ির বেজে ওঠার মিঠে শব্দ। বারোটা বাজছে।

    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | |
  • ধারাবাহিক | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ৯১০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 68.184.245.97 | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:০৮498216
  • ইন্টারেস্টিং!
  • বিপ্লব রহমান | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৮:৪৫498243
  • গেল কই? স্বর্গের হাসপাতালে? বেশ রহস্য রোমাঞ্চ প্যাকেজ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন