এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  সমাজ  শনিবারবেলা

  • লেবারের বিদেশ যাত্রা ৯

    মঞ্জীরা সাহা
    ধারাবাহিক | সমাজ | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ২৬৫৮ বার পঠিত
  • কোথায় যান কাজ করতে? উত্তরে বললেন, লেবারি করতে যাই। সেকি এখানে নাকি! সে তো বিদেশ!
    রাজ্যের বর্ডার পেরিয়ে পেরিয়ে ওরা যখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে দিল্লী মুম্বাই কেরালা ত্রিপুরা লেবার হয়ে চলে যায় সেই দুরের রাজ্যটা ওদের কথায় ‘বিদেশ’।
    ২০২০ র মার্চ থেকে দেশ জুড়ে হঠাৎ লকডাউন। শয়ে শয়ে কিলোমিটার হাঁটতে থাকা লেবারদের আটকে দেওয়া হচ্ছিল রাজ্যের বর্ডারে বর্ডারে। পাহারা দেওয়া বাহিনী তখন রাজ্যগুলির বর্ডারে অতি সক্রিয়। নিয়ম ভেঙে কে ফিরতে চাইছে তার নিজের রাজ্যে নিজের গ্রামে? পড়ল লাঠির বাড়ি । ফিরিয়ে দেওয়া হল উল্টো পথে। বা বিধান হল আরও কোনও শাস্তির। রাজ্যের বর্ডার যেন তখন দেশের বর্ডার। নিজের দেশটাই যেন তখন বিদেশ।
    আরও একদল যায়। ধানি জমি বসত বাড়ি বন্দক দিয়ে বেচে চড়া সুদে টাকা ধার করে। আসল বা নকল পাসপোর্ট তৈরি করে লেবার পাঠানোর এজেন্ট। ওরা যায় সত্যিকারের বিদেশ।
    পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলা থেকে দেশ বিদেশে লেবার হয়ে যাওয়া আসা আটকে পড়া বাঁচা মরার কথা নিয়েই শুরু হচ্ছে ধারাবাহিক ‘লেবারের বিদেশ যাত্রা’।


    খাজা’র ডেস্টিনেশন… (তৃতীয় পর্ব)

    এইবারডা টেনে এনে এয়ারপোর্টের মধ্যেই বার করে দিল ওরা।
    ছাড়া পেল খাজা। ওই গন্ধ, ওই চিটচিটে ময়লা, ওই পাঁচশ’ ছয়শ’ লোকের গাদাগাদি ভিড়-চিৎকার-চ্যাঁচামেচি থেকে ছাড়া পেল। ওই ঠাসাঠাসি ভিড় থেকে বাইরে নিয়ে এল পুলিশ। খাজা তিন দিন টানা বসে থেকেছে। খাজাকে বুটের লাথি খেতে হয়নি আর। খাবার খেতে হয়নি। বিনা খাবারে ও থেকে গেছে তিন দিন। ঝুলতে হয়নি উপর থেকে। চিৎকার করেনি খাজা। জানতে চায়নি কেন, কী কারণে বন্দি আছে ও? জানতে চায়নি, কবে ছাড়া পাবে ওই জেলখানা থেকে। চুপচাপ খাজা চুপচাপ-ভাবেই ওই বদ্ধ ঘরের ভেতর গাদা গাদা লোকের সাথে গাদাগাদি-ঠাসাঠাসি করে থেকে গেছে। বলেছে, আমার নসিবটা ভালো সেলো। তাই আমারে আর পেটায়নি। তিন দিন বসে থেকে তারপর ছাড়া দেয়েসে।

    এয়ারপোর্টের খোলা জায়গাটায় তখন খাজা দাঁড়িয়ে। বলতে বলতে গামছাটা আরও একবার পেঁচিয়ে নিয়েছে ঘাড়ে। লাল চলটা ওঠা চেয়ারে আবার বসে নিয়েছে। খাজার জেলখানায় ঢোকার আগের মতই, কোয়ালামপুর এয়ারপোর্টে, জেলখানার বাইরে, সেই ঝলমলে আলো জ্বলছে। লাগেজ চেক চলছে। তুলে নিচ্ছে যে যার লাল-নীল-সবুজ ট্রলিব্যাগ-হ্যান্ডব্যাগ-রুকস্যাক-টয়লেট বক্স। বেরিয়ে যাচ্ছে যে যার গন্তব্যে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ট্যাক্সি, প্রাইভেট কার। স্টার্ট দিচ্ছে কোনওটা। কেউ বাই বাই করছে হাত তুলে। খাজার হাত খালি। না আছে ব্যাগ, না মোবাইল, না টাকা, না ডলার। হাত দু’টো দু’পাশে। দাঁড়িয়ে আছে হাঁ করে। ভুবনেশ্বরের হোটেলে পরা, তিন দিন আগের জামা-প্যান্ট ময়লা হয়েছে। জেলখানার মেঝের ময়লা লেগেছে তিন দিনের স্নান-না-করা চ্যাটচ্যাটে শরীরে। এই এক্ষুণি যেমন থুতনির নীচে, ভাঙা চোয়ালে, কম কম কাঁচা-পাকা দাড়ি – নিশ্চয়ই সেরকম ঠিক তখন। সেই বাড়ি থেকে আনা জামা-কাপড় সমেত ব্যাগখানা কোথায়? পেতে বোধহয় অপেক্ষা করতে হবে। আর কী কী কারণে, কিসের কিসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে – জানা নেই। ছাড়া পেল। ছাড়াটা কোথায় পেল! খাজার কাছে এবার পুরো এয়ারপোর্টটাই যেন জেলখানা। ঢোকার আগে জেলখানার ভেতর-বাইরেটা ছিল আলাদা। এখন যেন পুরোটাই এক। এখান থেকে আর কোথাও, কোনও দিকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনও রাস্তা খোলা নেই খাজার কাছে। খাজাকে যে কোন কোম্পানির কোন কাজের জন্য কোন লোকের ভরসায় নাড়ু দালাল পাঠিয়েছিল – এই তিন রাতে লকআপের ভেতর বসে বসে একই কথা সারাক্ষণ ভেবে ভেবেও উত্তরটা আন্দাজ করে উঠতে পারেনি। এবার কী করবে? সুদে ধার করা টাকায় রাজ্য পেরিয়ে, দেশ পেরিয়ে তিন দিন আগে এসেছিল কাজের জন্য। এখন বেকার।

    এবার আবার আশ্চর্য! খাজার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল ফেরার টিকিট। সঙ্গে পাসপোর্ট আর ভিসা।
    সেকি! টিকিট হল কোথা থেকে?
    জিজ্ঞাসা করলাম অবাক হয়ে। এরকম অদ্ভুত ঘটনায় খাজা কতটা চমকেছিল জানি না, কিন্তু এই শ্রোতাটির কাছে এই লেবারের বিদেশযাত্রার ঘটনাগুলো একে একে চমকের পর চমক হয়ে হাজির হচ্ছিল। কে যে টিকিটখানা দিয়েছিল, তা আর বলতে পারেনি স্পষ্ট করে। যতটুকু বুঝেছিলাম, এই টিকিট-কাগজপত্র-ব্যাগ-মোবাইল ইমিগ্রেশন অফিস থেকেই কেউ একটা ধরিয়ে দিয়েছিল ।

    ‘এইসব হল নসিব’।
    ‘লটারি লটারি। হে হে হে হে লটারি কাটলে যেমন হয়! কপাল ভালো তো লেগে গেল! নাইলে গেল মায়ের ভোগে। হে হে হে হে… সেইর’ম। বিদেশে লেবারি করতে যাওয়া আর লটারি কাটা একই হে হে হে হে…’। খাজার কথার মাঝেই পাশ থেকে একজন বিড়ির ধোঁয়ায় কালো কালো দাঁতগুলো বার করে হাসতে হাসতে বলে উঠল।

    খাজা সেদিকে কান না দিয়ে বলতে থাকল, নাড়ু জানতো, যদি এয়ারপোর্ট থেকে বেরায়ে যেতে পারে, তাহলে তার নসিব ভালো। নিজেই দালাল খুঁজে নেবে ওইদেশে। যদি দালাল পেলো, তো কাজ পেলো। পেতেও পারে, আবারডা নাও পারে। নসিব ভালো থাকলে, ওই বিদেশে গিয়ে কাজ পাবে। নাইলে ফিরে আসবে। ওই দেশেও এইরমডা অনেক এজেন্ট আছে, যারা লেবারির কাজের লোক খোঁজে। তারা লেবারদের থেকে পয়সা খায়, আবার সেই দেশের কোম্পানিডার থেকেও পয়সা খায়। এই এইখানকার মতোই। নাড়ু ওই কায়দায় ওই দেশে লেবারডা পাঠায়। কোনও কোম্পানির সাথে যোগ নেয় নাড়ুর। ও ছেলে পাঠায় শুধু। ও প্রত্যেকেডার থেকে এক লাখ চল্লিশ পেল গিয়ে হাতে। তার থেকে ওই যা টিকিটডার দাম ওর কেবল খরচ। বাকিডা ঢুকল ওর পকেটে। আর যদি নসিব খারাপ, তাইলে ওইদেশে জেলখানায় পুরে দেবে। তিন দিন জেল খাটবে। ও জানে তিনদিন জেল খেটে ফিরতি প্লেনে চলে আসবে। একশ’-ডেড়শ’ জনে ওইর’ম একজনডা ছাড়া পায়। বাকিরে আমার মতো জেলখানায় ঢোকায়। এইবারডা ফেরার টিকিট দেয়ে দেয় সাথে। সেইডাতো আমি জানতাম না। সেই টিকিটে কী লেখা পড়তে পারিনি। তাই বুঝিনি। সবাই বলল, ফেরার টিকিট সেলো। তাই আসতে পেরেছিস। নাইলে ওই দেশেই জেলের ঘানি টানতি’।

    সেই পাশের যুবকটি, এ-কথার মাঝখানে হঠাৎ খাজাকে থামিয়ে বলে বসল, না না! ওই যে তিরিশ হাজার টাকা নিয়েছিল, ওইতেই টিকেট করে দিয়েছিল তোদের। নাড়ু ফিরতি টিকিট দেয়নি তোদের। এইর’ম যারা মালয়েশিয়ায় লেবারের কাজে যায়, তাদের অনেকের মুখে শুনেছি – লেবারদের থেকে ওই দেশের এয়ারপোর্টে তিরিশ হাজার টাকা নেয়। সেই টাকায় তিন দিন জেলে রেখে ফেরার টিকিট কাটিয়ে দেয় ইমিগ্রেশন অফিসের লোক। যারা ওই টাকা দিতে পারে না, তারা আরও বেশি দিন জেল খাটে। যতদিনে বাড়ি থেকে ফেরার টিকিটের দাম পাঠাবে, তবে গিয়ে ওরা মানুষটাকে প্লেনে তুলে ফিরত পাঠাবে।

    এবার সেই আগের যুবক বেশ জোরে জোরে বলল, ঘুষ ঘুষ। ওই টাকাটা বিদেশের ইমিগ্রেশন অফিসার ঘুষ নেয়। আর টিকিটটা এইখানকার দালাল সঙ্গে দিয়ে দেয়। খাজার বেলা কেসটা ছিল অন্য। অফিসারটা পালটিয়ে গেছিল।
    বলেই কিছুটা হাসি। যেন কি একটা মজার ঘটনার বিবরণ দেওয়া চলছে।
    মানে যেই অফিসারটা ঘুষ খেয়েছিল সেইটা আলাদা। সেইটা যদি ডিউটিতে থাকত খাজাকে ছেড়ে দিত। বাইরে বেরতে দিত। কিন্তু পরে অন্য অফিসার ডিউটিতে আসে। ব্যস, সেইটা খাজাকে জেলে লাত্থি মেরে জেলে পুরে দিল। এইর’ম হয় ওইখানে। টাইমিং এর ব্যাপার এইসব।

    খাজার সেই ভুবনেশ্বরের হোটেলে রুমে থাকতে হঠাৎ অচেনা কিছু লোকের থেকে কতগুলো টাকা পাওয়া, কোয়ালালামপুরে পৌঁছানোর পর একে একে নানা রকম রহস্যে মোড়া ঘটনা। কার টাকা, কিসের টাকা, কেনই বা দিতে হল! তারপর জেলে ঢুকে যাওয়া। এই এতরকম ঘটনার বিবরণ-কারণ ব্যাখ্যা চলছে নানারকম কণ্ঠস্বরে। সেই রহস্যে মোড়া ঘটনাগুলো যার জীবনের উপর দিয়ে ঘটে গেছে, তার সেসব রহস্য উদ্ঘাটনের খুব একটা চেষ্টা নেই। খুব উত্তেজিত নয় গলাখানা। গলার স্বর উঁচুতেও উঠছে না সেভাবে। আশপাশের সবাই খাজার বলা কথাগুলোকে ভুল প্রমাণ করতে উদ্গ্রীব। সবাই খাজার দিকে তাকিয়ে নিজের মত করে খাজার জীবনের রহস্য উদ্ঘাটনের অদম্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকে অন্যের উপর জেতার চেষ্টা করছে। খাজা সবার মাঝখানে ওই চলটা-ওঠা প্লাস্টিকের চেয়ারে গো-হারা হেরে বসে আছে। বড়বড়িয়ার মুসলিম পাড়ায় বসে এই বিদেশযাত্রী লেবারের যাত্রাপথের এতরকম ঘটনা শোনার পরেও বুঝিনি গল্পের আরও খানিক বাকি। বিদেশ থেকে ফেরার ঘটনায় আরও যে কিছু রহস্য থাকতে পারে, আন্দাজ হয়নি।

    খাজা নামল এসে ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্ট। সেই বড়বড়িয়া থাকতে টাকা দেওয়া শুরু। ভুবনেশ্বরের হোটেল-ভাড়া, খাওয়া-দাওয়ায় টাকা খরচ। তারপরের বাকি লেনদেন জানা। খাজার পকেট এখন খালি। এবার ফিরতে হবে ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্ট থেকে ভুবনেশ্বর রেল-স্টেশন। সেখান থেকে হাওড়া-শিয়ালদা হয়ে গেদে লোকাল ধরে রাণাঘাট-আরংঘাটা হয়ে বড়বড়িয়া।

    এয়ারপোর্ট থেকে বেরোয়নি তখনও। আবার একবার খপাৎ করে ধরল এসে ভুবনেশ্বরের পুলিশ। আবার একবার ইমিগ্রেশন অফিসারদের সঙ্গে দেখা। এবার বিদেশের নয়, এদেশের।
    দেশি ইমিগ্রেশন অফিসারদের বক্তব্য হোক বা বিদেশি, খাজার গলায় দু’দলের বক্তব্য প্রায় একইরকম শোনালো।
    রাত তখন এগারোটা হবে। ভুবনেশ্বরপুর এয়ারপোর্টে এসে নামলাম।
    পাশ থেকে একজন বলে উঠল, ভুবনেশ্বর! সেই আবার বলে ভুবনেশ্বরপুর! উড়িষ্যার ভুবনেশ্বর। বার বার ভু-ল বকে, হে হে হে হে…।
    এখানে আবার আমার পাসপোর্ট-ভিসা এটকে দিল। আমাকে টেনতে টেনতে নেয়ে গেল এইবারডা বড় একখানা হল ঘরে। সেইখানে ইমিগেশন অফিসার, বিএসএফ, পুলিশ সব ভত্তি। বলল, তুরা চুরাই ভিসায় বিদেশ গেসিলি। কুন কাজে গেসিলি। কুন কোম্পানি! কিস্যু বলতে পারিস না তুরা। কুনও কুম্পানির কাগজ নেই সাথে। তুরা ওইভাবেই যাস আর থেকে যাস ওইদেশে। আর ফিরিসনা। আমি বললাম, আমি চুরি করে যাই নে। আমরা এক লাখ চল্লিশ হাজার ট্যাকা দিয়ে ওদেশে গেছি। সে সব শোনে না। আমাকেও ছাড়েনা কিসুতেই।

    যে এক লাখ চল্লিশের কথা খাজা দেশের ইমিগ্রেশন অফিসার, বিএসএফ, উড়িষ্যার পুলিশের কাছে তুলে ধরছিল, সে টাকার কথা বলা যে অর্থহীন – সেটা বোঝার ক্ষমতা খাজার নেই। টাকাটা ও দিয়েছিল বড়বড়িয়ার কোনও এক দালালকে। তার না আছে রসিদ, না কোনও প্রমাণ। এই প্রমাণহীন টাকা দেওয়ার গল্প যে খাজাকে এয়ারপোর্টের পুলিশের খপ্পর থেকে বাঁচাতে পারে না, সেটা আজ অবধি বুঝে উঠতে পারেনি। তাই আজও মনে করে, সেই অত বড় এক টাকার অঙ্কের কথা শুনে তাদের ছেড়ে দেওয়াই উচিত ছিল।
    সেই টেবিলের সামনে থেকে আমাকে একজন নেয়ে গেল সাইডে। বলল, এরা তুরে ভয় দেখাস্যে। এরা তুরে জেলে পুরবে না। ভয় করিস না। আমি আছি, আমি তুরে ভিসা পাসপোর্ট সব দিয়ে দেব। দে বারশ’ টাকা। তুর ভয় নাই।
    আমি হাউমাউ করে কান্দছি তখন। পায়ে গিয়ে পড়লাম তার।
    কার?
    সে জানি না। ওই এয়ারপোর্টেরই লোক। ওই ইমিগেশোন অফিসেরই লোগ, নাইলে ওইখানকার পুলিশের বাবু সে। তারে কেন্দে কেন্দে পায়ে জড়িয়ে ধরে বললাম, বাবু কিস্যু নাই পকেটে। কেমন করে দেব! যা সেলো, সব দেয়ে দেয়েছি মালয়েশিয়ায়। এখন পকেট ফাঁকা। দেখেন দেখেন! তিন দিন জেলে বসা। নাওয়া-খাওয়া নেই। ট্যাকাও নেই একটাও। কি দেবো আপনেকে? কান্দছি কেবল দেখে দয়া হল তার।

    এ ব্যাটাও ঘুষ খেতে এসেছিল। ভাবল দাও মেরে দি’ একখানা। পাশ থেকে একজনের হাসি হাসি মুখে এ কথাগুলোয় একটুও কান না দিয়ে খাজা বলে চলল, দয়া হল বাবুর। আমি বললাম, বিশ্বাস করেন বাবু। আমি ঠিক আপনের বারশ’ ট্যাকা দেয়ে যাবো। আপনি আজ দেয়ে দেন ট্যাকাটা। আমি যদি এই ভুবনেশ্বরপুরে আবার আসি, ঠিক মেটায়ে দেব আপনের ধার।

    সেই টাকা চাওয়া মানুষটি বিশ্বাস অবিশ্বাস কী করেছিল জানি না, তবে খাজা বিশ্বাস করেছিল, যে নাকি মিনিট দশেক আগে লুকিয়ে লুকিয়ে টাকা চাইতে পারে, তার মনে দয়ার সঞ্চারও হতে পারে। দয়া করে সে তার নিজের পকেট থেকেই বারশ’ টাকা বার করে দিয়ে খাজার পাসপোর্ট ছাড়িয়ে আনল। সে টাকা কার হাতে দিল, আদৌ দেওয়ার দরকার হয় কি না, জানার দরকার হয় নি খাজার। তবে এটা ঠিক, খাজার হাতে সে ধরিয়েছিল একখানা একশ’ টাকার নোট। বলেছিল, যা বাড়ি যা। ভুবনেশ্বর থেকে বড়বড়িয়া অবধি কত টাকার কোন টিকিটে বা বিনা টিকিতে কোন কোন স্টেশন হয়ে খাজা ফিরে এসেছিল, তা আর স্পষ্ট করে বর্ণনা করতে পারেনি। শুধু বলেছিল, এইবারডা ওই বাবুর দয়ায় ফিরে এলাম। ফেরার সময় বলে এলাম, আপনের ঋণ আমি ঠিক একদিন শোধ দেয়ে যাবো।
    ঋণ যে কত এবং কিসের তা বুঝেছিল খাজা। আমার পক্ষে তা বোঝা সম্ভব হল না।

    এরপরের গল্পটুকু তিনজনের। যত দিন পার হ’ল, গল্পে তিনজনে মধ্যে একজনের ভূমিকা বড় আকার নিতে থাকল। সে সেই বড়বড়িয়ার সুদখোর। যত দিন যায়, খাজার বাড়িতে তার আনাগোনা বাড়তে থাকে। আর খাজার আনাগোনা বেড়ে যায় নাড়ু দালালের বাড়ি। কেন, কী কারণে নাড়ু দালাল তাকে তিন দিনের বিদেশের জেলখানা ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে এল, তা জোর দিয়ে গলা তুলে জিজ্ঞাসা করতে পারেনি খাজা। কলার তুলে বলতে পারেনি, এইবারডা দেখে নেবো! শান্ত স্বভাবের খাজা শান্ত ভাবেই বার কয়েক জিজ্ঞাসা করেছিল। তাতে টাকা ফেরত না পেলেও আশ্বাস পেল আবার। আশ্বাস – আবার একবার বিদেশ যাত্রার। নাড়ু বলেছিল, চিন্তা করিস না। এই বার যা হয়েছে হয়েছে। এইর’ম হয় কারুর কারুর। এইসব বিদেশ-বিভুঁই-এর ব্যাপার-স্যাপার। সব কি আর আমাদের হাতে থাকে! এইর’ম হয়। তোকে আবার বিদেশ পাঠাবো। তোর আর এইবার টাকা দিতে লাগবে না। টাকা তো তুই দিয়েইছিলি। তুই আমার খরচে যাবি। ফ্রি-তে নিয়ে যাবো তোকে এইবার। তুই মাত্র কুড়ি হাজার দিবি আমাকে। তোর পাসপোর্ট দিয়ে যা। সব রেডি হয়ে গেলে খবর দেবো।

    খাজা বলল, ভাবলাম সব তো গেছে, এইবারডা দেখি আর একবার। শেষ চেষ্টাডা করে দেখি। সেই আবার ধার করলাম কুড়ি হাজার। দেলাম ওরে পাসপোর্ট আর ট্যাকা। এইবারডা আর ডাকল না আমাকে।
    সেকি! আর পাঠালই না আপনাদের? কিছু বললেন না?
    পাশ থেকে একজন বলে উঠল, একজন কয়বার যেতে পারে কারুর বাড়ি বলেন! কয়বার গিয়ে বলতে পারে এক কথা? রোজ বলতে বলতে ফেড-আপ হয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
    কয়বারডা গেছি। দেখা করে না। ফোন করলে ফোন তোলে না। পথম পথম দেখা হলে বলত, দাঁড়া, ব্যস্ত হোস কেন? খবর দেবো বলেছি দেবো। মেজাজ দেখাতো। কয়বার যাবো? আর যাই না।
    আপনার এই টাকাটাও মার চলে গেল।
    আগের একলাখ চল্লিশ আর এইবার শুধু কুড়ি। টুটাল একলাখ ষাট। সঙ্গে পাসপোর্টডাও নেয়ে নিল। সে পাসপোর্ট এখন কোথায় কী জানি!
    সেকি? পাসপোর্টটাও আর ফেরত দেয়নি?
    কে দেবে? ওর বাড়ি গেলে বাড়ির লোকে বলে বাড়ি নেই। অফিসডায় তালা ঝোলসে। কি জানি, এইখানে থাকে, নাকি কলকেতায় চলে গেসে। ফোনডাও আর হয় না। সিম পালটেয়ে দেয়েছে বুধহয়।
    পুলিশের কাছে যান নি?

    এ কথায় খাজা চুপ হয়ে গেল।
    পাশ থেকে আবার সেই যুবক বলল, এইখানে পুলিসের কাছে গেলে খাজাও ফেঁসে যেত। সুদের টাকার ভয় আছে না। বলত সুদের টাকা মিটিয়ে দে। এইর’ম অনেক কেস আছে এখানে। ও পুলিসে ওইসব শুনবে না।

    কী বলব শেষটায়! আশপাশ থেকে অনেকে অনেক কিছু বলে চলেছে। এখনও ব্যাখ্যা চলছে নানাভাবে। খাজার কথা শেষ। খাজা আবার চুপ। নোটের খাতা বন্ধ করছি। ছাতা-পার্স ভরছি ব্যাগে। এ সময়ে হঠাৎ একটা অন্য গলার স্বরে একখানা প্রশ্ন এল আমার দিকে। প্রশ্নটা মেয়েদের গলার স্বরে। মাথায় ঘোমটা। গলাটা সরু। ভাঙা ভাঙা। খাজার বৌ সাবিনা কখন যেন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিচু টালির বারান্দায় মাথাটা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সেখান থেকেই জিজ্ঞাসা করল, দিদি, কী হবে এসব লিখে? আমদের কোনও লাভ হবে?

    এতক্ষণ যারা খাজার দিকে তাকিয়ে, খাজার কথার উপর দিয়ে কথা বলে চলেছিল, তারা থেমে গেল। খাজার থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে নিল একবার। সবাই চুপ। যেন আমার উত্তরের অপেক্ষার সেকেন্ড-মিনিট গোনা চলছে এখানে। হঠাৎ যেন একটা পরীক্ষার বেল পড়েছে। পরীক্ষক এখানে অনেকজন। তারা সবাই তাকিয়ে আছে একদিকে। পরীক্ষার্থী আমি একলা। হাঁ করে বসে আছি। কী বলব আমি এ প্রশ্নের উত্তরে!

    মনের মধ্যে একটা উত্তর ঘুরপাক খাচ্ছে। মুখ দিয়ে বেরোতে চাইছে না সে উত্তরখানা। বলতে পারছি না, এসব লিখে কিছু হবে না সাবিনা। এসব নিয়ে লেখা হবে। লেখা নিয়ে আলোচনা হবে। আহা-উহু হবে। টক শো হবে। সেমিনার হবে। কিন্তু খাজা মণ্ডলদের কিচ্ছু হবে না। কিচ্ছু হওয়ার নয় কোনওদিন। এই বড়বড়িয়ায় সুদখোরেরা থাকবে, নাড়ু দালাল থাকবে, পুলিশ থাকবে। থানা থাকবে। জেলখানা থাকবে। অনেক অনেক খাজা মণ্ডল থাকবে। পুরো রাণাঘাট টু ব্লকে থাকবে। অন্য অন্য ব্লকে থাকবে। অন্য জেলায় থাকবে। এ রাজ্যে থাকবে। অন্য অন্য রাজ্যে থাকবে। সুন্দর সুন্দর রঙ করা লেবার কমিশনের অফিস থাকবে। শ্রম-আইন থাকবে।

    আবার দালালের খোঁজ পড়বে লেবারের। লেবারের খোঁজ পড়বে দালালের। দালালের বানানো আইনে লেবার চলে যাবে আবার। আবার। বারবার। অন্য অন্য রাজ্যে। এদেশে-ওদেশে-সেদেশে…



    কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
    আমিরুল মন্ডল, কনভেইনার, সুরক্ষামঞ্চ (বড়বড়িয়া)
    কুতুব বিশ্বাস, বড়বড়িয়া
    এছাড়া
    বড়বড়িয়া মুসলিমপাড়ার গ্রামবাসী


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ২৬৫৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Eman Bhasha | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৪:১২497954
  • বড়ো কাজের লেখা।
    এইসব বিষয়ে বাজারি প্রচার মাধ্যম চুপ।
    গুরুচণ্ডালী ও লেখিকাকে ধন্যবাদ।
  • Ramit Chatterjee | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৮:৩৬497969
  • অসাধারণ লেখা। এগুলো কিছুতেই মেন স্ট্রিম মিডিয়ায় আসে না। এগুলো সব প্রদীপ এর তলার অন্ধকার।
  • | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৯:৩৪497971
  • অসম্ভব জরুরী ডকুমেন্টেশান। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন