এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  গপ্পো

  • রাজরক্ত (রহস্য গল্প) : ১৪শ পর্ব

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | গপ্পো | ২৯ আগস্ট ২০২১ | ১১১৩ বার পঠিত | রেটিং ৩ (১ জন)
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮
    ১০ই এপ্রিল, সোমবার, রাত আটটা। সৌরভ

    ঘটনা এখন এক্সপ্রেস নয়, রাজধানীর স্পীডে দৌড়ুচ্ছে। দু’দিনের পর আজ ফুরসৎ পেলাম, তাই লিখে রাখছি।

    আগেই বলেছি, গতকাল আমাদের বুড়ার যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে বোম্বাগড়ের যুবরাজের শ্রাদ্ধ।

    আমি সকালেই কথামত তৈরি হলাম। কিন্তু বস্‌ বললেন – এখন যাব না। খেয়েদেয়ে বিকেলের দিকে রওনা দেব। যাতে রাত ন’টা নাগাদ পৌঁছে যেতে পারি।

    -- সেকী! রাত ন’টা? শ্রাদ্ধ তো শেষ হয়ে যাবে। আপনি যে বললেন--!

    -- ধ্যেৎ! বুড়ারে যাব বলেছি, শ্রাদ্ধে যাব তো বলিনি! তুই তো জানিস, এই শ্রাদ্ধে আমরা নিমন্ত্রিত নই?

    স্যারের হেঁয়ালি বোঝা ভার। কিন্তু তার আগে ইন্দ্রকুমারীর স্টেটমেন্ট দেখলে হয় না?

    -- না, তার আগে একটা কাজ আছে। আমরা এখন এসপি সাহেবের সঙ্গে বিলাসপুরের বোম্বাগড় প্যালেসে যাব। ওই শনিচরি পড়াওয়ের দু’নম্বর গলিতে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকিস না। আজ শ্রাদ্ধ শেষ হয়ে গেলে কাল বা পরশুর মধ্যে রাজপরিবার বিলাসপুর ফিরে আসবে। তারপর কুমার বীরেন্দ্রপ্রতাপ মানে ছোটভাই গদিতে বসবেন। তাঁর রাজ্যাভিষেকের তোড়জোড় শুরু হবে। তখন কী ছাই সার্চ করা যাবে। তাই আজ ওরা যখন বুড়ারে শ্রাদ্ধশান্তিতে ব্যস্ত, আমরা রাজবাড়িতে যুবরাজের ঘর শান্তিরামের ঘর সার্চ করব।

    -- এটা কি আইন অনুযায়ী ভ্যালিড? আফটার অল, রাজপরিবারের কারও বিরুদ্ধে এফ আই আর হয়নি, হয়েছে দিদিদের নামে। আর সেশন্স কোর্টে জমা করা চার্জশীটেও শুধু দিদিদেরই নাম, তাহলে?

    -- তুই না নাইট স্কুলে এলএলবি পড়তে ভর্তি হয়ে যা! তাহলে বুদ্ধি কিছু খুলবে। আরে, যুবরাজ খুন হয়েছেন, শান্তিরাম নামের কোন ফ্রড বা ইম্পার্সোনেশনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাই ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে ওই দুজনের ঘর খানাতল্লাসি করা যাবেনা? তদন্তের স্বার্থে? যদি কোন সূত্র মেলে!

    আর ছোটকুমার তাঁর এজাহারে দুইবোনের খুন করার মোটিভ হিসেবে দশ বছর আগে বিলাসপুরে বাচ্চা কোলে নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগ এনেছেন। ওঁরা দু’জন ওখানে যাবার কথা স্বীকার করেছেন কিন্তু ব্ল্যাকমেইল নয়। বরং ওঁদের নাকি ঘাড়ধাক্কা দেওয়া হয়েছিল। তাই এসপির নির্দেশে ক্রাইম ব্র্যাঞ্চের পুলিশ কাল অভিযুক্ত দুইবোনকে ওখানে নিয়ে যাবে। স্টোরি রিকন্সট্রাক্ট করতে, দেখতে হবে কারা সত্যি বলছে। সেই সময় আমরা ওখানে যাব। পুলিশের আড়ে আমাদের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেশন! বাইরে থেকে কেউ কিছু ধরতে পারবে না। শ্রীবাস্তব সাহেবের পুরো সাপোর্ট পেয়েছি। তাড়াতাড়ি চল, সময় হয়ে গেছে।

    বোম্বাগড় প্যালেস, বেলা সাড়ে এগারটা।

    উরিত্তারা! কী যে হচ্ছে এখানে , ঠিক যেন সিনেমার শ্যুটিং। বেশ কিছু পুলিশ। দিদিরা নেমেছেন কালোগাড়ি থেকে, যেন বন্দীদের নিয়ে আসা হচ্ছে, তবে হাতকড়ি লাগানো হয়নি। প্যালেসের গেট ও উঁচু দেয়ালের বাইরে পাবলিকের ভীড় উপচে পড়ছে, আউটডোরে শ্যুটিং এর সময় যেমন হয় আরকি!

    ভেতরে ক্রাইম ব্র্যাঞ্চের একজন সিনিয়র অফিসার তদারকি করছেন। দুই দিদি দেখাচ্ছেন -- ওঁরা কোথায় অপেক্ষা করছিলেন, দরবার কোথায় হচ্ছিল, ছোড়দি কীভাবে এন্ট্রি নিলেন, কীভাবে বেরিয়ে এলেন।

    আর একজন ধুতি কুর্তা পরা প্রৌঢ়, সম্ভবতঃ এদের দেওয়ানজী, কখনও মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছেন, কখনও ক্রাইম ব্র্যাঞ্চের অফিসারের কাছে ফিসফিস করছেন।

    এসব দশবছর আগের কথা, এতদিন পরেও মনে আছে? নাকি কিঞ্চিৎ মনের মাধুরী মিশিয়ে বলছেন? তুমি সৌরভ, ব্যাটা এসব কী বুঝবে? হাফসোল খেয়েছ কখনও? নাঃ খাইনি, ইচ্ছেও নেই। কিন্তু সেই ঘটনাটা? কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে? সেও তো প্রায় আট আটটা বছর। তুমি তো ভোলনি! তাহলে? আরে সেটা কোন নরম সরম হাফসোল ছিল না, পুরো হাতে হ্যারিকেন কেস হয়েছিল। যাকগে, মরুকগে! মানছি, চাইলেই সব ভোলা যায় না।

    কাঁধে টোকা।

    -- চল, ওদের কাজ ওরা করুক। আমাদের কাজ আমরা।

    ভেতরে একটা কামরায় গিয়ে দেখি এসপি সাহেব আর একজন- কাঁধে তিনটে স্টার, শার্প চেহারার একটু অল্পবয়েসি অফিসার একজন বুড়ো দেহাতি মানুষকে জেরা করছেন। তার নাম বোধহয় হরিরাম। সে নাকি রাজাসায়েবের সময় থেকে আছে। তাঁর চলে যাওয়ার পর যুবরাজ সায়েবের ব্যক্তিগত দেখাশুনো করত।

    শ্রীবাস্তবজির নির্দেশে ইয়ং অফিসারটি হরিরামকে একটা সেলোফেনের প্যাকেটে মোড়া জিনিস দেখায়। তাতে একটি স্টিকার লাগানো — একজিবিট ১। বুড়ো মানুষটা প্যাকেটটাকে একটু উঁচুতে টিউব লাইটের আলোর সামনে তুলে ধরে।

    এবার আমিও দেখতে পাই — সেই খুনে ব্যবহৃত ছোরাটি, কালো রক্তের দাগ শুকিয়ে আছে।

    -- চিনথস এলা? এটা চিনিস?

    হরিরাম ধীরে ধীরে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।

    -- কাকর হাবে? এটা কার?

    -- বড়ে মালিককে।

    -- কৌন তোর বড়ে মালিক, রাজা সাব?

    -- নোহে, যুবরাজ সাব।

    ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় যে ছোরাটা যুবরাজ সাহেবেরই। রাজকুমার কলেজের দিনে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে কোথাও কিনে ছিলেন। ওটা ওনার শখের জিনিস। বাঁটের কাছে বেশ কারুকাজ করা। ছিন্নমস্তা দেবীর পূজোয় রাজরক্ত কয়েক ফোঁটা দিয়ে দেবীর পূর্ণাহুতি দেওয়ার প্রথা। তাই উনি গত মাসের ২৭ তারিখে ওটা সঙ্গে করে বুড়ারে নিয়ে গেছলেন, প্রতিবছর নিয়ে যান ।

    আমরা যুবরাজ সাহেবের কামরায় যাই। হরিরাম পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখেছে। দেয়ালের কাছে বইয়ের আলমারিতে অনেক ইংরেজি বই। শেক্সপিয়রের কলেক্টেড ওয়ার্কস, ডিকেন্স, এই নামগুলো আমার চেনা। আর একটা হল প্যালগ্রেভ’স গোল্ডেন ট্রেজারি। কবিতার সংকলন। আমি ইংরেজি কবিতায় রস পাইনে, হিন্দি কবিতায় পাই। বিছানার পাশের ছোট টেবিল কাম র‍্যাকে গতমাসের খবরের কাগজ, আর কিছু বই। স্যার তুলে নেন একটা—‘পাওয়ার অফ দ্য সার্পেন্ট’; আমি পাতা ওল্টাই একটি হিন্দি বইয়ের – ‘কুলকুন্ডলিনী শক্তি কেইসে জাগ্রত করে’? স্যারের দিকে তাকাই। কোসলে স্যারের হাতে একটি অন্য বই! ‘হাউ টু গেট ব্যাক সেকচুয়াল পাওয়ার’। বইটা আমারও চোখে পড়েছিল, কিন্তু আমি এড়িয়ে গেছি। স্যার যে কী করছেন? পাতার পর পাতা ওলটাচ্ছেন , কখনও দু’একটা জায়গা নিবিষ্ট মনে পড়ছেন।

    শ্রীবাস্তব স্যারও ব্যাপারটা খেয়াল করেছেন। একবার বললেন—কী হোল? এবার চলুন।

    যেন ঘোরের থেকে জেগে উঠলেন কোসলে। একটু লাজুক হেসে বললেন—আপনারা এগোন, আমি আসছি। হরিরামকে আমার কাছে ছেড়ে যান।

    -- সাহেবকে ওষুধ কে খাওয়াত, তুমি?

    -- নাহি সাহব, উ তো শান্তিরাম হাবে।

    -- সব গেলাস টেলাসগুলো একদম সাফসুতরো। কে ধুয়েছে , তুমি?

    -- জী সরকার।

    -- আচ্ছা, শান্তিরামের ঘরটা কোথায়?

    -- পাশের ঘরটা, আমি বুড়ো হয়েছি। রাতে কোন অসুবিধে হলে যুবরাজ সাহেব ঘন্টি বাজান, ও চলে আসে।

    -- আচ্ছা, চল। ওর ঘরটা খুলে দাও, একটু দেখব।

    হরিরাম চাবি হাতে এগিয়ে গেল। পেছনে আমরা। কিন্তু স্যার ওই সেক্সের বইটা র‍্যাকে ফেরত না রেখে নির্বিকার মুখে নিজের হ্যান্ডব্যাগে পুরলেন। রিটায়ার করে বুড়ো বয়সে ভীমরতি! ঘরে গিয়ে সেক্সের বই পড়বেন?

    শান্তিরামের ঘরটা বেশ সাজান গোছান। একদিকে পুজোর জায়গা। কাঠের ছোট্ট আসনে ছিন্নমস্তা দেবীর ফটো এবং পাশে তিরুপতির বালাজী বিগ্রহের ছবি। কিছু শুকনো ফুল।

    কোসলে স্যার খুব মন দিয়ে ছবিটি দেখলেন।। শুধু ‘ঠাকুর নমো’ করাটাই বাকি ছিল। ঘরের এককোনায় একটা ইঁদুর মারার বিষের প্যাকেট, একটা পুরনো বাটি ও চামচ। স্যার বাটি-চামচ শুঁকে দেখলেন। ভাল করে পরিস্কার করা হয়েছে। তারপর র‍্যাট পয়জনের প্যাকেট খুলে দেখলেন, ভেতরের বড় বড় বড়িগুলো বেশ কিছু ব্যবহার হয়েছে।

    -- হরিরাম, এখানে বুঝি খুব ইঁদুরের উপদ্রব?

    -- ইঁদুর? নাতো ! সব এত সাফসুতরো, কোন খাবার জিনিস, চালের ব্স্তা এসব কিছুই নেই। তো ইঁদুর কেন আসবে?

    -- তাহলে শান্তিরাম ওর ঘরে ইঁদুর মারার বিষ রেখেছে কেন?

    -- বিষ? ওগুলো তো চিটি অউ দীমক মারনে কী দাওয়াই। ওগুলোয় পিঁপড়ে আর উইপোকা সাফ হয়ে যায় ।

    -- কোথায় সাফ হয়ে যায়?

    -- কেন, যুবরাজ সাহেবের ঘরে। ওনার বইপত্তর অনেক। পন্ডিত আদমি। বই পড়েন, গান শোনেন। বইয়ে যাতে চিটি অউ দীমক না লাগে তার জন্যে শান্তিরাম ওনার ঘরে দাওয়াই ছিটিয়ে দেয়। পোকা মরে যায়।

    স্যার নিজের ব্যাগ থেকে একটা সেলোফেনের প্যাকেট বের করে তাতে ইঁদুরের ওষূধ পুরে বললেন — হরিরাম, এটা আমি সরকারি কাজে নিয়ে যাচ্ছি। তোর ছোটে মালিক বা শান্তিরাম ফিরলে বলে দিস। কবে ফিরবে ওরা বুড়ার থেকে?

    -- কল ইয়া পরোদিন। তেরহী আজ হাবে না? ওকর বাদ।

    হরিরাম কি জানেনা যে শান্তিরাম ওঁরাওয়ের তিনদিন ধরে কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না? বোধহয় না, কারণ ও শান্তিরামের ঘর গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। টান মেরে খুলে ফেলে ময়লা মশারি, বালিশের আধময়লা ওয়াড় আর চাদর। সব মাটিতে ডাঁই করে ফেলে গাঁটরি বাঁধে। কাচতে নিয়ে যাবে। যুবরাজ সাহেবের ‘নিজি সহায়ক’ শান্তিরাম বুড়ো হরিরামের চোখে একজন গুরুত্বপূর্ণ লোক বটে। কিন্তু হ্যাঁচকা মেরে চাদর টেনে নেওয়ায় বালিশের নীচের থেকে মাটিতে পড়ে গেছে একটা রেক্সিনে বাঁধানো রুলটানা খাতা। হরিরাম খেয়াল করেনি।

    কোসলে স্যার তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকেন। মুখে মেঘ ঘনিয়েছে। এবার কোন কথা না বলে ওটাকে ব্যাগে ঢুকিয়ে আমাকে বলেন — চল, একটু ফরেনসিক অফিস যেতে হবে।

    ফরেনসিক অফিস, বেলা ১.১০

    বিলাসপুর শহরের বাইরে অরপা নদীর পারে কোলফিল্ডের দেওয়া দুটো দুই বেডরুম অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে ছোটখাট ফরেনসিক অফিস। একটায় ফরেনসিক অফিসারের কোয়ার্টার, অন্যটায় অফিস কাম ল্যাব। তবে ল্যাবটি ছোট, এদের কিছু কাজ কোলফিল্ডের ল্যাবে হয়, বেশিরভাগ রায়পুরের স্টেট ল্যাবে।

    ফরেনসিক অফিসার শিপ্রা সাইনি আমাদের দেখে হৈ হৈ করে উঠল।

    -- অহো ভাগ্য, আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম বলুন তো?

    স্যার মুচকি হেসে বলেন — কার আবার, তোর বরের।

    -- গলত, সরাসর গলত অ্যান্সার। হমারা পতিদেব দো দিন সে পাতিয়ালা গয়ে, উনকী মাতাশ্রী কী তবিয়ত ঠিক নহীঁ হ্যায়।

    -- তাহলে আর কার? তোর নিজের।

    -- ফির গলত; নীঁদ সে উঠকর পহলা দর্শন হুই এক চিকেন রোস্ট কী।

    ঘুম ভেঙে উঠে প্রথম দর্শন হোল এক চিকেন রোস্টের; বেশ বড়। খাওয়ার টেবিলে ঢাকা দিয়ে রাখা। কাজের মেয়েটি যাবার সময় গরম করে গেছে। আর এখন লাঞ্চের সময়। অতবড় রোস্ট একা সাবড়ানো আমার কম্ম নয়। আপনারাও বসে যান।

    আমি পুলকিত হই। কিন্তু আমার আশায় জল ঢেলে স্যার বলে ওঠেন — সরি! ফির কভী। আজ একটুও সময় নেই। একঘন্টার মধ্যে আমাদের দু’জনকে বুড়ার রওনা হতে হবে।

    শিপ্রার চোখ চকচক করে। বলে - আমাকে আধঘন্টা প্যাকিং এর টাইম দিন। সেই মার্ডার কেসটা তো?

    -- সরি, ভুল বুঝেছিস। ওই কেসটাই, কিন্তু এযাত্রা তোকে নিয়ে যাচ্ছি না। আসলে তোর এখানে দুটো কাজ আছে।

    শিপ্রার মুখে মেঘ ঘনায়। প্রাণহীন স্বরে বলে – বলুন কী কাজ?

    ডিএসপি কোসলের এখন কাউকে প্যাম্পার করার সময় নেই। ওর ভাবান্তর উনি দেখেও দেখলেন না। শান্তিরামের বিছানা থেকে পাওয়া নোটবুকটা ব্যাগ থেকে বের করে ওর সামনে রেখে বলেন — এটা দেখ, কী ভাষায় লেখা?

    শিপ্রা চোখ সরু করে দেখতে থাকে। আমি উঁকি মেরে চেঁচিয়ে উঠি — আরে এটা তো জিলিপি।

    মানে? স্যার বেশ বিরক্ত।

    -- এটা তেলুগু বা তামিল।

    -- তুই তেলুগু বা তামিল জানিস?

    -- না মানে রায়পুরের অমরদীপ টকীজে রোববার রোববার তেলুগু ফিল্ম দেখানো হত। আমার তেলুগু বন্ধুদের সঙ্গে থেকে একটু একটু আন্দাজ পেতাম। তেলুগু সাইনবোর্ডকে আমরা বলতাম জিলিপি আর তামিলকে কাঁকড়া।

    -- ধেত্তেরি! আমার এসব ফালতু গোল গোল বাতেঁ শোনার সময় নেই। দেখ শিপ্রা, তেলুগু পড়তে পারে কেউ আছে? তোমার জানাশুনো?

    -- হ্যাঁ স্যার, আমার টাইপিস্ট সাবিত্রী চারলু। ওর মাদার টাং তেলুগু।

    -- বেশ, ওকে এর ফার্স্ট পেজ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করবে – পড়তে পারছে কিনা। যদি পারে ওকে অন্য কাজ থেকে সরিয়ে তোমার চেম্বারে বসিয়ে এই নোটবুক পুরো ইংরেজি বা হিন্দিতে অনুবাদ করাবে। গুগল ট্রান্সলেটর চলবে না। হাতে লেখা ৩৭ পাতা, সন্ধ্যের মধ্যে হয়ে যাওয়া উচিত। তারপর মূল নোটবুক ও অনুবাদের প্রিন্ট আউট তোমার পার্সনাল ফাইল ক্যাবিনেটে তালাচাবি দিয়ে রাখবে। কাল দিনের বেলায় সৌরভ এসে নিয়ে যাবে। আর প্রিন্ট আউট বের করা হলে তোমার অফিস কম্পিউটারে ওয়ার্ড ফাইলটা ডিলিট করে দেবে। চারলু ম্যাডামকে বলবে এটা অত্যন্ত সিক্রেট ফাইল, কাজের পর যেন ভুলে যায়, কোথাও গল্প না করে।

    শিপ্রা একটু ধাতস্থ হয়েছে। স্বাভাবিক গলায় বলল — ঠিক আছে স্যার। সেকন্ড টাস্ক?

    -- আমাদের হাতে সময় কম। হাফ অ্যান আওয়ার! এখন এই কামরায় অফিসের অন্য কেউ যেন না আসে।

    রাণী ইন্দ্রকুমারীর এজাহার। তুমি কম্পিউটারে খোল। আর সৌরভ তোর নোটস।

    আমি কিছু রেলেভ্যান্ট প্রশ্ন করব। তোমরা দুজন তোমাদের রেস্পেক্টিভ ফাইল দেখে উত্তর দেবে। তোমাদের কাছে বা ইন্দ্রকুমারীর বয়ানে যদি এর উত্তর না থাকে সেটাও বলবে। সেই আনসল্ভড ইস্যু গুলো সৌরভ আলাদা করে নোট করবে। আপাততঃ এই। আমি চাইছি বেলা দুটোর মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে সোজা বুড়ারের জন্য রওনা হতে। রাত সাড়ে আটটা ন’টার মধ্যে পৌঁছুতে চাই।

    আমরা সিরিয়াস, আমরা অল অ্যাটেনশন। আমার সামনে নিজের চারপাতা নোটস, শিপ্রা খুলেছে ওর ল্যাপি।

    স্যার যথারীতি পায়চারি শুরু করেছেন, ছোট্ট অফিসের এ’মুড়ো থেকে ও’মুড়ো। এক দু’বার টেবিলের কোণায় ধাক্কা খেয়েও নির্বিকার। রিটায়ার হুয়ে হ্যায়, পর জোশ মেঁ কোই কমীঁ নহীঁ। আর মাঝে মাঝে বুলেটের মত ছিটকে আসছে কিছু প্রশ্ন, আর আমরা দু’জন চমকে চমকে উঠছি।

    -- ছোট রাণী ইন্দ্রকুমারীর বয়েস কত হবে? কোন পরিবারের?

    -- তিরিশ। ছত্তিশগড়ের সারংগড় এলাকার কোন ক্ষত্রিয় ফ্যামিলিতে।

    -- পড়াশুনো?

    -- গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া স্কুল, ইতিহাসে স্নাতক।

    -- কুমারসাহেবের বয়েস?

    -- তেত্রিশ।

    -- বিয়ে কবে হয়েছে?

    -- ছ’বছর আগে।

    -- বাল-বাচ্চে?

    -- এক বাবা, পাঁচ সালকে।

    -- বাচ্চাটা এখানে মায়ের সঙ্গে এসেছে?

    (ওরে বাবা! কোসলে কি নানহা পাঁচ বছরের খোকা রাজপুত্তুরকেও জেরা করতে চান?)

    -- না, ওকে সারংগড়ে ওর নানীর কাছে রেখে আসা হয়েছে।

    -- বাচ্চাটার নাম কী?

    -- কুমার তেজেন্দ্রপ্রতাপ।

    -- আচ্ছা, ইন্দ্রকুমারীর কোন ভাই বোন আছে?

    এবার আমি বোল্ড আউট, এরকম কোন তথ্য ওনার এজাহারে নেই।

    কিন্তু আমাকে অবাক করে শিপ্রা বলে ওঠে - আছে, ওরা পিঠোপিঠি দু’বোন। বড় বোনের নাম দেবেন্দ্রকুমারী।

    বিশ হাজার ভোল্টের শক! কোসলে স্যারের ক্রুদ্ধ মুখ আমার দিকে ঘোরে। আমি প্যানিক হয়ে পাতা ওলটাই; নাঃ এরকম কোন তথ্য সত্যিই এজাহারে নেই। শিপ্রা কিন্তু কিন্তু করে খোলসা করে — এটা ওনাকে দেওয়া সেট কোশ্চেনের মধ্যে ছিল না। আমি পরে আলাপের মধ্যে দিয়ে জেনেছি। কিন্তু ততক্ষণে স্টেটমেন্ট সাইন করা হয়ে গেছে। কাজেই অ্যাড করা সম্ভব হয়নি।

    -- ওকে; আমরা চলে গেলে শিপ্রা একটু এসপি অফিসে গিয়ে দুটো জিনিস জোগাড় করবে। দুই রাজকুমারীর স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট অনুযায়ী ডেট অফ বার্থ আর ইন্দ্রকুমারীর ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশনের কপি। ওনাদের বাচ্চার বার্থ সার্টিফিকেটের কপি। এবং দুই বোনের প্যান কার্ডের কপি। ও হ্যাঁ, এসপি অফিস থেকে দেবেন্দ্রকুমারীর বর্তমান ঠিকানা আলোয়ারে পুলিস ওয়্যারলেসের মাধ্যমে আর্জেন্ট খবর দিতে হবে যে বোম্বাগড়ের যুবরাজ সাহেবের আকস্মিক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর পর সমস্ত পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম ৯ই এপ্রিল সম্পন্ন হচ্ছে। তারপর মৃতের বিধবা হিসেবে তাঁর মাসিক ভাতার সমীক্ষা এবং পুনর্নির্ধারণ তিনদিন পরে পরিহার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এর অফিসে পরিবারের সমস্ত সদস্যদের উপস্থিতিতে হবে। কাজেই উনি যেন পত্রপাঠ বিলাসপুরে চলে আসেন।

    এই মেসেজটি যেন রাজস্থানের আলোয়ার ডিস্ট্রিক্টের এসপি অফিস থেকে কোন ইন্সপেক্টর র‍্যাঙ্কের অফিসার গিয়ে দেখা করে মৌখিক সূচনা দেয়। কোন কাগজ দেয়ার দরকার নেই।

    এরপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসের চেহারা পালটে গেল।

    -- নাঃ , দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজ এই পর্য্যন্ত। তোমায় অনেক কাজ দিয়ে গেলাম শিপ্রা; এগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জানি, তুমি পারবে। সৌরভকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি এই জন্যে যে ও একটা অপদার্থ, ওর অনেক কিছু শেখার বাকি। আমি শ্রীবাস্তবজীর সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। তুমি ওনার অফিস থেকে ফুল কো-অপারেশন পাবে।

    রাত আটটা, মারুতি জিপসীতে

    শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী। আকাশে ভাঙা কাঁসার থালার মত চাঁদ। জঙ্গলের রাস্তা ধরে আমরা অমরকন্টকের পাহাড় পেরিয়ে এখন রাজেন্দ্রগ্রাম ছাড়িয়ে গেছি। কোতমা কলিয়ারিতে ডিস্ট্রিক্ট পুলিশের অ্যাডভান্স পার্টি আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। বুড়ার এখন আরও আধঘন্টা। তিনটে গাড়ির কনভয়। আমাদের সাদারঙের মারুতি জিপসিতে এসপি অফিসের লালবাতি লাগানো। পেছনে দুটো কালো ডগগা ভরে একডজন সশস্ত্র পুলিশ। আমাদের গাড়িতে বস ও আমি ছাড়া রয়েছে আরও একজন। বিলাসপুরের বিখ্যাত লাইসেন্সড শিকারী ইকবাল ভাই। অদ্ভুত লোক। শিকার আর বন্দুকের নেশায় ব্যাংকের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বন্দুক ও পিস্তলের দোকান খুলেছেন। অমরকন্টক থেকে বুড়ার অব্দি জঙ্গল তাঁর হাতের তালুর মত চেনা। উনি নাকি অন্ধকারেও দেখতে পান। এখন তো শুক্লপক্ষের রাত, আলোছায়ার খেলায় বনের মায়া মানুষকে পথ ভোলায়। ওনাকে ওঁর বাড়ি থেকে তুলে নিয়েছেন আমাদের স্যার। কিন্তু কেন?

    স্যার বললেন — সেদিন ফেরার সময় দেবীজির মন্দিরের পুজারী মহারাজকে কথা দিয়েছিলাম না যে ওই ব্রহ্মরাক্ষস বা ঘড়িয়াল কুমীরটা মানুষখেকো হয়ে উঠছে, এখানকার লোক ভয় পায়। আমি বনবিভাগের লাইসেন্সড শিকারী নিয়ে আসব? তো আজ এক পন্থ, দো কাম। ওই ঘড়িয়ালের দু’চোখের মাঝখানে গুলি করতে ইকবাল ভাইয়ের হাত কাঁপবে না। ও ব্রহ্মরাক্ষসকে ভয় পায় না। শুধু মামদোভূতকে পায়।

    ওদের দুজনের হাহা হাসির চোটে রাস্তার পাশের গাছ থেকে রাতচরা পাখির দল ডানা ঝাপটে উড়ে গেল।

    রাস্তায় একটা সাইনবোর্ডের পাশে একজোড়া সবুজ চোখ। অন্ধকারে বেশ জ্বলজ্বলে। আমাদের গাড়ি কাছে যেতেই উধাও। ইকবাল ভাই আমাকে আশ্বস্ত করেন—ও কিছুনা, কোটরী। রাত্তিরে মহুয়া খেতে এসেছে। এদিকে মহুয়ার গাছ অনেক।

    আমি জানি কোটরী মানে ছোট চিতল হরিণ। এরা কৃষকের ধানের ক্ষেতে হানা দেয়। গরমকালে জঙ্গলের জলের উৎস শুকিয়ে গেলে লোকালয়ের কাছে পুকুরে চলে আসে। মানুষকে ভয় পায় না। সাদা ছিটে ভর্তি শরীর। বড় মিষ্টি দেখতে।

    কিন্তু এখন সামনে লোকালয়ের আলো দেখা যাচ্ছে। বোধহয় বুড়ার এসে গেছে।

    আমরা নামার পর লোকজন ছড়িয়ে পড়ে। একদল যায় মন্দিরের কাছে, একদল রাজোয়ারায়। বাকিরা মন্দিরের কাছে ওই পুকুরের কাছাকাছি। আমরা গিয়ে জানতে পারলাম শ্রাদ্ধের কাজ সময়মত বেলা দুটোয় শেষ হয়েছে। তারপর গোটা গ্রামের লোকজন পেটপুরে খেয়েছে। সেসব শেষ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। এখনও রাজোয়ারার পাশের মাঠে সামিয়ানা খোলা হয়নি। কিছু এঁটো শালপাতা ইতঃস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

    রাজোয়ারায় গিয়ে জানতে পারলাম কুমারসাহেব সারাদিন উপোস করেছিলেন। এখন শ্রান্ত শুয়ে পড়েছেন। কাল সকালে আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন। ওনার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। আমাদের তিনজনের থাকার ব্যবস্থা রাজবাড়ির গেস্ট হাউসে হয়েছে। কোন অসুবিধে হবে না।

    আবার সেই গেস্ট হাউস! যে ঘরে দুই দিদি ছিলেন সেখানে এবার আমার আর স্যারের খাট, বিছানা করা রয়েছে এবং মশারি টাঙানো। আর যে সিঙ্গল বেডের কামরায় আমি ছিলাম সেখানে ইকবাল ভাই।

    আমি জীপ থেকে আমার জামাকাপড়ের ব্যাগ নামাতে যাচ্ছিলাম, স্যার ইশারায় বারণ করলেন। লোকটার মাথায় আবার পোকা নড়ছে বোধহয়।

    -- শোন, বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নে, আর হালকা খাবার খাবি, দুটো রুটি, একটু ডাল। আর স্যালাড। আজ আমাদের নিশি জাগরণ।

    তারপর গুনগুন করতে লাগলেন “সিতারেঁ, তুম তো সো জাও, পরেশাঁ রাত সারি হ্যায়”।

    শুয়ে পড়ো গো তারার দল, আজ আমার রাতভোর যন্ত্রণার দিন।

    ইকবাল বানুর গজল, অনেক শুনেছি। কিন্তু বস এত বেসুরো কেন?

    কেয়ারটেকারকে বলি আমরা মন্দিরে প্রণাম করতে যাচ্ছি আর কামরায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কী আশ্চর্য, এবারে বড় কামরাটার তালা বদলে গেছে। গত মাসের ২৭ তারিখে এই কামরায় দুই দিদি যখন ছিলেন তখন তালাটা আটকে আটকে যাচ্ছিল, শেষে শান্তিরাম ডুপ্লিকেট চাবি এনে খুলল। স্পষ্ট মনে আছে সেটা অন্য একটা নতুন তালা ছিল। কারণ ও তালা লাগাচ্ছিল বাঁহাতে, আর ওর বুড়ো আঙুলের গায়ে ছিল আর একটা কুট্টিভাই আঙুল।

    এটা তো সেই পুরনো তালা! কিন্তু আজকে চাবি আটকাচ্ছে না।

    আমরা আমাদের জীপ নিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে একটা খোলা মাঠের মধ্যে হাজির হই। এখানে দুটো তাঁবু পড়েছে। শাহডোলের বড় থানা থেকে আটজন এবং স্থানীয় বুড়ার থানা থেকে চারজন পুলিশের দল দিনরাত বুড়ারের বর্ডার এবং গাঁয়ের চারপাশে নজর রাখছে। কাল সকাল থেকে ওদের কাজ শেষ। কুমারসাহেব ও রাণীসাহেবা বিলাসপুর ফিরে যাবেন। সাতদিন পরে পূজোটুজো করে ছোটকুমারের রাজ্যাভিষেক। দাদার মৃত্যুতে যতই মনখারাপ হোক। বিধিবৎ কিছু অনুষ্ঠান তো করতেই হবে।

    কিন্তু কোসলে স্যার অনড়, এই রাত্তিরে গস্ত এবং দিনের নজরদারি অন্ততঃ আরও সাতদিন চলুক। যুবরাজ নিহত, ওঁর সহচর শান্তিরাম পলাতক বা নিখোঁজ। এই সময় কোন নতুন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাকে আটকানো আমাদের, মানে পুলিশের কর্তব্য।

    একটা বোঁটকা গন্ধ। অন্ধকারে একজন লোক একটা ছাগলছানার গলায় দড়ি বেঁধে আমাদের খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ইকবাল ভাই গাঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ান। ছানাটাকে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে একটু বিড়বিড় করেন। তারপর বলেন — চলবে। তুমি পুকুরপাড়ের দিকে এগোও, খুব কাছে যেও না। আমি গিয়ে দেখে জায়গাটা ঠিক করছি।

    স্যার তাঁবুর মধ্যে একটা কাঠের চেয়ারে বসে থাকা বুড়ার থানার থানেদারকে জিজ্ঞেস করলেন — এক্সিবিট নম্বর ২ কোথায় রাখা আছে?

    -- হাসপাতালের মর্গে, পুলিশ পাহারা রয়েছে।

    -- খারাপ হয়নি?

    -- সামান্য পচন ধরেছিল, ডাক্তার চৌহান দাওয়াদারু করেছেন, শেষে ফরমালিন দিয়ে রাখা হয়েছে। ফটো নেওয়া হয়েছে। মতলব, এসপি সাহাব ফোন মেঁ জো জো নির্দেশ দিয়ে থে, ও সবকা বিধিবৎ পালন কিয়া গয়া।

    তারপর আমরা জীপসিতে চড়ে মন্দিরে গিয়ে পূজারী শ্যামানন্দ মহারাজের সঙ্গে দেখা করলাম। উনি বেশ উদ্বিগ্ন, চেহারাটা বসে গেছে। স্যার বললেন – আশীর্বাদ দীজিয়ে মহারাজ। দেবীজি কী আশীর্বাদ সে সব ঠিক ঠাক নিপটে গা। আপ চিন্তা ন করেঁ।

    উনি আমাদের মাথায় প্রসাদী বেলপাতা ও ফুল ছুঁইয়ে অল্প ক’টি নকুলদানা দিলেন। কিন্তু চেহারায় বড্ড অসুস্থ ভাব। বোধহয় সারাদিনের শ্রাদ্ধ ইত্যাদি অনুষ্ঠানের ধকল। আমরা রওনা দেব, এই সময় উনি আবার হাত তুলে দাঁড়াতে বললেন।

    -- কী ব্যাপার?

    -- সাহেব, আপনি তো আমার অনুরোধ রেখে আজ ওই কুমীররূপী ব্রহ্মরাক্ষসকে মারার জন্যে বিলাসপুরের বড় শিকারী নিয়ে এসেছেন। কিন্তু আর একটা নিবেদন আছে। আপনারা কবে বিলাসপুর যাচ্ছেন? আমাকেও নিয়ে চলুন। আমার শরীরটা কদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। বারবার দাস্ত অউর উলটি হো রহী হ্যায়। ইঁহাকে দাওয়াই কাম নহী আয়া। একবার কোই বড়া ডাক্তার দিখানা হ্যায়। আমার ইচ্ছে কুমারসাহেবের রাজ্যাভিষেকের আগে যেন সুস্থ হয়ে উঠি।

    -- ঠিক আছে। তৈরি হয়ে থাকুন। আপনাকে নিয়ে তবেঁ বিলাসপুর ফিরব।

    ইকবাল ভাইয়ের নির্দেশে পুকুরের পাড় থেকে অন্ততঃ পঞ্চাশ গজ দূরে একটা ডালপালাওলা কোসম গাছের পাশে খুঁটি পুঁতে ছাগলছানাকে বাঁধা হল। ওর সামনে কিছু বট পাতা নাকি কিসের পাতা, রাত্তিরে বোঝা দায়। ও দু-একবার ম্যা ম্যা করে চুপচাপ পাতা চিবুতে লাগল। ইকবাল ভাই ফের বিড়বিড় করে কিছু মন্তর পড়ে বলল – আমি এখন গাছটার নীচু ডালে উঠে বসব। আপনারা সবাই চলে যান। ঘন্টা-দু’ঘন্টা লাগবে, তার বেশি না। তিনটে গুলির শব্দ শুনলে তখন আসবেন।

    আমি আর স্যার যাই হাসপাতালের মর্গে, একজিবিট নম্বর ২ এর ফর্মালিন দেওয়া চেহারাটা দেখতে।

    এত রাত্তিরে করিডরে দিয়ে মিছিল করে আমরা চলেছি, সামনে ডোম কিসুন গাড়া, তারপরে ডাক্তার চৌহান, তারপরে বুড়ার থানার ইন্সপেক্টর, শেষে আমরা দু’জন।

    মর্গের দরজাটা খুলতেই একটা বোটকা গন্ধ আর হিমশীতল হাওয়া। তারপর খোলা হোল এগজিবিট নমর ২ এর স্টিকার লাগানো ড্রয়ার।

    একটা হাত, কাঁধের কাছ থেকে যেন কাঠের মিলের করাত দিয়ে কাটা। পেছন থেকে ডাক্তার কিছু বলে চলেছেন-লেফট হ্যান্ড, ব্যাডলি ম্যাঙ্গল্ড। ইন্ডেক্স অ্যান্ড মিডল ফিঙ্গার মিসিং। বাট থাম্ব অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ দ্য পিংকি ওয়ান আর আইডেন্টিফায়েবল।

    স্যার বলতে লাগলেন — আজ সকালেই এসপি অফিসে বুড়ার থানা থেকে ফোনটা এসেছিল। একটা কুমীরে চিবোনো হাত সকালে দীঘির পাড়ের কাছে ভাসছিল। সঙ্গে কিছু পলিথিনের চিবোনো টুকরো। তখনই ডিসিশন নিই, আর দেরি করা যাবেনা। নইলে আরও নিরীহ গ্রামবাসী এই মানুষখেকোর পেটে যাবে। এছাড়া এটাকে বিলাসপুরে নিয়ে গিয়ে ব্লাড গ্রুপ, অন্য আইডি মার্ক এসব পরীক্ষা করে দেখতে হবে । যদি কোনভাবে চেনা যায়।

    আমি কিছু বলতে যাই, কিন্তু কথা আটকে যায়।

    স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বাঁহাতটায় ছ’টা আঙুল, ছোট্ট একটা আঙুল বুড়ো আঙুলের গায়ে এমনভাবে জুড়ে রয়েছে যেন যমজভাই। হ্যাঁ, এই হাতটাই ২৭ তারিখ সন্ধ্যায় দিদিদের কামরায় নতুন তালা লাগাচ্ছিল। আর তার অনামিকায় ছিল সাদা পাথরওলা একটি আঙটি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮
  • ধারাবাহিক | ২৯ আগস্ট ২০২১ | ১১১৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • গবু | 223.223.141.6 | ৩০ আগস্ট ২০২১ ০০:৫৯497364
  • এইতো, পানসি একদম তেড়ে ছুটছে, বেলঘরিয়া এলো বলে!
  • :|: | 174.255.131.176 | ৩০ আগস্ট ২০২১ ০৩:৪৬497365
  • মানে, নকল শান্তিরামেরও সমুখে শান্তি পারাবার? 
  • :|: | 174.255.131.176 | ৩০ আগস্ট ২০২১ ০৩:৪৮497366
  • সামান্য অনুযোগ: ছাগোলটার সামনে কিছু কাঁটাল পাতা রাখলে পারতেন। পুরানো গুরুর ছোঁয়া থাকত! 
  • Ranjan Roy | ৩০ আগস্ট ২০২১ ০৬:০৯497367
  • এইত্তো,  আমিও তাই ভেবেছিলাম।  প্রথমে কাঁঠালপাতাই লিখেছিলাম।  তারপর রাজু মৌলভী, হীরাভ সব মনে পড়ে কুলকুলিয়ে হাসি পেল। তখন বদলে দিলাম।  কারণ হাসি ভীষণ সংক্রামক । 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন