এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  সমাজ  শনিবারবেলা

  • লেবারের বিদেশ যাত্রা - ৪

    মঞ্জীরা সাহা
    ধারাবাহিক | সমাজ | ৩১ জুলাই ২০২১ | ৩০৫৭ বার পঠিত
  • খন্যান থেকে ইরান (প্রথম পর্ব)

    থ্রি সেভেন এইট ফোর ওয়ান আপ হাওড়া বর্ধমান লোকাল ভায়া মেন বিকেল বিকেল পাঁচটা বেজে ত্রিশ মিনিটে আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। এক প্যাকেট পাঁচটাকা। তিন প্যাকেট দশ…। ডাঁসা ডাঁসা ডাঁসা পেয়ারা…। তিনটে মোসাম্বি দশ…। তিনটে মোসাম্বি দশ…। বড় বড় লেবু। রস ভর্তি। কেটে খেয়ে দেখে নিন। নানারকম গলার স্বর। হাওড়া জেলা ছেড়ে লাক্স কোজি লাক্স কোজি আন্ডার ওয়্যারের বিজ্ঞাপন শরীর জুড়ে দেখাতে দেখাতে অনেকক্ষণ আগেই ট্রেনটা হুগলি জেলায় ঢুকে পড়েছে। একটা স্টেশনে এসে থামল এইমাত্র। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের একখানা টিউব লাইট জ্বলছে-নিবছে-জ্বলছে-নিবছে। দপদপ করছে। ট্রেন থেকে যারা নামছে সেদিকে একবারও না তাকিয়ে ব্যাগটা কাঁধে ঠিকঠাক করে নিয়ে রুমাল বার করে ঘাম মুছতে মুছতে কেউ কলারটা ঘাড় থেকে একটু পিছনে সরিয়ে পা চালিয়ে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ছে। সন্ধে হয়েছে একটু আগেই। গাঢ় অন্ধকার হয়নি এখনও। বেশিরভাগ ডেলিপ্যাসেঞ্জার। এক নম্বর প্ল্যটফর্ম। প্ল্যাটফর্মের আলোটা কম। ভিড়টা বেরিয়ে যাচ্ছে গেট দিয়ে। বাঁ-পাশে বিরাট একটা ফ্লেক্স। হাতটা জোড়া করে নমস্কার করে আছে। হাতের উপর থেকে গলাটা ফাঁড়া। ফ্লেক্সে পলিটিকাল নেতার ছবি। ঝড়ে ফেঁড়ে গেছে। ভোট হয়ে গেছে। রেজাল্ট বেরিয়েছে। ওই ফাঁড়া ছবির ব্যক্তিটি হয়তো জিতেছে। বা, হেরেছে। বা, অন্য কেউ হেরেছে। ছবিটা থেকে গেছে ওভাবেই। টিউবের আলোতে দূর থেকে হলুদে কালো দিয়ে বোর্ডে লেখা স্টেশনের নামটা দেখা যাচ্ছে। খন্যান। ভিড়টা এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের যেদিক দিয়ে বেরোচ্ছে সেদিক দিয়ে বেরোতে হবে। জি টি রোডের দিকে। অটোর লাইন ওখানে। আঠারো ফুটের পিচের রাস্তা দিয়ে চলবে অটো। অটোতে স্টেশন থেকে তিন মিনিট। নামতে হবে হরিদাসপুর মসজিদ তলা। স্টপেজের নাম হরিদাসপুর জামে মসজিদ থেকে। রাস্তার উপরেই গন্তব্য বাড়িখানা। বাড়ির সামনে একটা পেয়ারা গাছ। বাড়িটা একতলা। পাকা বাড়ি। এখন বাড়ির পিছনটা অন্ধকার। আলো থাকলে দেখা যেত বিশাল সাইজের একটা বিল মতো। অনেকখানি ছড়ানো। পাশে খড়ের পালুই এদিক সেদিক। অনেকগুলো বাঁশঝাড়-তাল-সুপুরি-আমগাছ। পিছনে ধূ-ধূ-মাঠ। কিন্তু জলাধারের গর্ভে এত বর্ষাতেও জল নেই বেশি। নিচে কাদা। ওই কাদার নিচে আছে বালি। পঞ্চাশ বছর আগের কথা। ওগুলোকে বলা হত বালু খাদ। এখনও ওই নামটাই থেকে গেছে। খাদের চরিত্রটা কেবল বদলে গেছে। আশপাশের পলি এসে চাপা দিয়েছে বালিকে। তাই এখনও জল শুষে নেয় শরীর থেকে। এরকম এ গ্রামে আট-দশটা আছে। এই বালু খাদ থেকে সেসময় বালি তোলা হত। রোডের উপর দাঁড়িয়ে থাকত ট্রাক। ওই বালি ভরা হত ট্রাকে। বালি চলে যেত দূরে দূরে। বিক্রি হত। এ বাড়ির দুই প্রজন্ম আগের পুরুষ ওই ব্যবসাই করত। সরকার থেকে বালি তোলা নিষিদ্ধ হল। ব্যবসা ছেড়ে চাষবাস শুরু করল পরের পুরুষ। জমিজমা বিশেষ কিছু নেই। ওই যা পাঁচ-ছয় বিঘে। বাড়ির গোয়াল ঘরে জোড়া বলদ আর দাওয়ায় লাঙল। বছরে একবার ধান। তারপর আলু। যে ঘটনার জন্য এ বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করা তা ওই দাদু-বাবা কারুকে নিয়েই নয়। নতুন প্রজন্মের বড় ছেলেকে নিয়ে ঘটনাটা।


    খন্যানের বালু খাদ

    হাওড়া বর্ধমান মেন লাইনের খন্যান স্টেশনের টিকিট কাউন্টার থেকে মাসের প্রথমে-মাঝে-শেষে কত মান্থলি কাটা হয়। কয়েন নোটের সাথে মান্থলি থাকে পার্সে পার্সে। ব্যাগে জলের বোতল-মোবাইল-ছাতা-রুমাল। টিফিনকারিতে ভাত বা রুটি। ভোর থেকে ন’টা দশটা অবধি ভিড় ওঠে জেনারেল বা লেডিস কামরার গেট দিয়ে। পরপর ডাউন হাওড়া লোকাল বেরিয়ে যায় দু’নম্বর প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে। যে ছেলেকে নিয়ে ঘটনাটা নামটা শেখ মইনুদ্দিন। খন্যানের অন্য মইনুদ্দিনের নামে মান্থলি টিকিটে নামটা টাইপ হলেও এ মইনুদ্দিনের কোনওদিন মান্থলি কাটা হয়নি। কাজের জন্য ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করতে হয়নি। কিন্তু কাজের খোঁজ শুরু হয়েছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার পরেই। হরিদাসপুর হাই স্কুলে ক্লাস নাইন অবধি রেজাল্ট ছিল ভালো। র‍্যাংক ছিল প্রথম দশজনে। তিনছেলের বাবার আয় কমছিল দিনদিন। বাড়ির বড় দুই ছেলে লম্বায় বাড়ছিল দ্রুত। বাড়ছিল প্রাইভেট টিউশন পড়ার খরচ, হাত-খরচ, এতগুলো পেট চালানোর খরচ। সবে মিলে বাড়ছিল চাপ। এই বড় ছেলেটির পড়াশোনায় ঘাটতি পড়ছিল আয়ের খোঁজে। কোনওরকমে মাধ্যমিক পরীক্ষা। রেজাল্টটাও হল কিছুটা খারাপ। রেজাল্টের পরই যখন খন্যানের অন্য সব ছেলেমেয়ে ইস্কুলের অফিস রুমের সামনে এগারো ক্লাসে সায়েন্স-আর্টস-কমার্সে ভর্তির ফর্ম তুলছে, মইনুদ্দিন কাটছিল টিকিট। দূরপাল্লার ট্রেনে ওই পনেরো বছরের ছেলেটির নামে একখানা বার্থ রিজার্ভ হচ্ছিল। গন্তব্য-রাজ্য মধ্যপ্রদেশ। স্টেশনটা ইন্দোর। ইন্দোর স্টেশনে নেমে অটো করে দশ মিনিট গিয়ে হল থাকার জায়গা। জায়গাটা ইন্দোর শহরে হলেও জায়গাটার নাম বোম্বে বাজার। সেখান থেকে পাঁচ সাত মিনিট হাঁটা পথে সারাফা বাজারে সোনার ওয়ার্কশপ। ভোর থেকে উঠে রান্না-স্নান-খাওয়াদাওয়া সেরে সকাল ন’টার মধ্যে ওয়ার্কশপে হাজিরা। দুপুরবেলা আধাঘণ্টার খাওয়া দাওয়ার টাইম। সন্ধ্যে বেলা দশ মিনিট নাস্তা। টানা রাত সাড়ে বারোটা একটা অবধি কাজ। দিওয়ালি-ধনতেরাস-বিয়ে উপলক্ষে সেটা সারারাত। ভোরবেলা ছুটি। আবার সকাল ন’টার থেকে শুরু রোজকারমতো। নিঝুম রাতের বেলা হেঁটে হেঁটে ফেরা। বোম্বে বাজারে ফেরার রাস্তায় ওই অন্য রাজ্যে কাজে যাওয়া বাঙালি ছেলে দেখলে চুরি-ছিনতাই-গালাগাল ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। আর এই সোনার কারিগরদের আর একটা প্রাপ্তি প্রায় কমন। সামান্য কিছু ভুলভ্রান্তি বা এধার ওধার দেখলেই পিঠে পড়বে মার। অবাঙালি শেঠ মালিকদের হাতে বা লাঠিতে পেটানি। সঙ্গে অবাঙালি মুখের অন্য ভাষার গালাগাল। ওই টাইট রুটিনে সোনার কাজের কারিগরি শিখতে শিখতে মইনুদ্দিন হয়ে উঠল পাকা কারিগর। ওর হাতদুটো ওই সোনালি ধাতুতে কারুকার্য তুলতে হয়ে উঠল পারদর্শী। মইনুদ্দিনের পড়াশোনার বুদ্ধিটা মধ্যশিক্ষা পর্ষদের স্ট্যাম্পমারা রেজাল্টের ছাপা কাগজে ছাপ না ফেললেও বারবার সে বুদ্ধি ছাপ ফেলেছে ওর লেবার জীবনে।



    সোনার কারিগরি

    বোম্বে বাজারে থাকতে গিয়ে সারাফা বাজারে সোনার কাজ করতে করতে বেশ কিছু বন্ধু হয়। সিনেমার গল্প, হিরো-হিরোইনের গল্প, হিট গানের গল্প, প্রেমিকার গল্পের সাথে সাথে আর যে প্রসঙ্গটা ঘুরেফিরে আসত সেটা আর একটু বেশি ইনকাম। এক বন্ধুর দাদা তখন বিদেশ। যে এজেন্টের হাত ধরে সে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে সেই এজেন্ট হুগলি জেলারই মানুষ। পোলাবা থানা অঞ্চলে তার বাড়ি। তবে থাকে তখন দুবাই। গিয়াসউদ্দিন মোল্লা। যোগাযোগ করিয়ে দিল বন্ধুই। আলাপ হল। কাজ দেবে সে। এদেশে নয়। বিদেশে। ইনকাম বেশ খানিকটা বেশি। গন্তব্য হবে ইরান।

    শেখ মইনুদ্দিনের পাসপোর্ট ততদিনে রেডি। গিয়াসুদ্দিনের পাসপোর্ট দরকার। প্রথমে পাসপোর্টের ছবি দিলেই যথেষ্ট। তারপর হাতে পাসপোর্ট চাই তার। যে কোম্পানিতে ঢুকিয়ে দেবে নাম রেজিস্ট্রাশন করাতে লাগবে সেখানে।

    ইরানে তখন এক নতুন সোনার কারিগরির কোম্পানি তৈরি হবে। মালিক গিয়েছিল ইরান থেকে দুবাই। ছেলে দরকার। এরকম জায়গায় ছেলে সাপ্লাই করে হুগলির পোলবার এই গিয়াসুদ্দিন। কথা হল ছেলে দেবে আর যা যন্ত্রপাতি সোনার কাজে দরকার - সব দেবে। যন্ত্রপাতি পাঠাবে ট্রান্সপোর্টে। ছ’মাস ইরানে সে নিজে থেকে ছেলেদের সেট করে দেবে। ভালোমতো কাজ চালাতে দেখাশোনা করবে সে। কন্ট্রাক্ট হল। ইরানের কোম্পানির মালিকের থেকে চল্লিশ লাখ পেল গিয়াসউদ্দিন।

    সোনার কারিগর ছেলের খোঁজ চলছে তখন পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায়। গিয়াসুদ্দিন এবং গিয়াসুদ্দিনের আন্ডারে কাজ করা আরও চার পাঁচজন এজেন্ট খোঁজ করছে ইরানের সেই কোম্পানির জন্য সোনার কারিগরিতে এক্সপার্ট ছেলে।



    সোনালি ধাতুতে ওদের হাতে নকশা

    ছেলেদের তরফ থেকে লাগবে পাসপোর্ট আর লাগবে টাকা। ফ্লাইটে ইকোনমি ক্লাসে টিকিটের দাম দশ-বারো হাজার যাই হোক, দিতে হবে অনেক বেশি। সেই বাড়তি টাকা যাবে গিয়াসউদ্দিনের অ্যাকাউন্টে। ওটা ছেলেদের থেকে লাভ করা কমিশন। আবার ছেলে পাঠানোর কমিশন পাবে কোম্পানির থেকেও। লাভ দু’তরফ থেকে। মইনুদ্দিনকে প্রথম কিস্তিতে দিতে হবে পঁয়তাল্লিশ হাজার মতো। শেষে বাদবাকি অ্যামাউন্ট নিয়ে মোট ষাট হাজার।

    মইনুদ্দিনের বয়স তখন সবে কুড়ি পেরিয়েছে। পাতলা গোঁফের বদলে সামান্য সামান্য মোটা গোঁফ। ঠোঁটের নিচে থুতনিতে সামান্য কিছু দাড়ি। পাতলা সুন্দর চেহারার চোখদুটোতে তখন বিদেশ। আর মনে আরও একটু বেশি ইনকামের অনেকখানি আশা। দুমাস আগেই স্বর্ণ-ধান পেকেছে ওদের জমিতে। ধান কাটা হয়েছে। গোলা ভর্তি হয়েছে সেই ধান। পাঁচ বছর ইন্দোরে সোনার কাজে জমেছে পনেরো কুড়ি হাজার মত। লাগবে ষাট হাজার। তার সাথে খন্যান থেকে কলকাতা এয়ারপোর্ট পৌঁছানোর খরচ। আবার কলকাতা থেকে দিল্লি এয়ারপোর্ট ফ্লাইটে যেতে খরচ।  আর সাথে হাতখরচের টাকা নিয়ে মোট পঁচাত্তর হাজার প্রায়। সেই গোলা-ভরা স্বর্ণ ধান বিক্রি করে বাবা ছেলের হাতে দিল নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা। যাতে ছিল অনেকদিনের খন্যানের ওই একতলা বাড়ির ছাতের নিচে সংসার টানার উপাদান।

    টাকা আর পাসপোর্ট যথাসময়ে জমা পড়ল গিয়াসউদ্দিনের কাছে। তারপর আবার সব চুপচাপ। দু-আড়াই মাস গিয়াসউদ্দিনের আর কোনও ফোন নেই। যাওয়ার কোনও খবর নেই। ইন্দোরের সোনার কাজ ছেড়ে এসে মইনুদ্দিন তখন বেকার। জোড়া বলদ তার শরীরের শক্তি লাগিয়ে খন্যানের মাটি চষছে। ধান রোয়া চলছে মাঠে। ধান পাকছে। সে ধান কাটা পড়ছে। সেই আয়ে চলছে দিন।

    মইনুদ্দিনের মুখে এত অবধি শুনে মনে হল ঘটনার ক্লাইম্যাক্স বোধহয় আন্দাজ করতে পারছি। যাত্রা বোধহয় ভঙ্গ। যে নিয়ে যাবে তারই পাত্তা নেই। গিয়াসুদ্দিন দুবাইতে। টাকা আর পাসপোর্ট সবই বোধহয় গেল।

    এক মিনিট থেমেই মইনুদ্দিন আবার বলা শুরু করল ওর ক্ষীণ গলার স্বরে। আড়াই মাস পর ফোন এল গিয়াসউদ্দিন মোল্লার এজেন্টের। বলল, তোমাদের কাজের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। টিকিট-ভিসা রেডি। যেতে হবে ইরানের চাবাহার। আগে যেভাবে কথা হয়েছিল -  দিল্লি এয়ারপোর্ট হয়ে যেতে হবে - পরিকল্পনায় সব মিলে যেতে থাকল। আমার অনুমান ব্যর্থ হল।



    যাত্রা শুরু

    সালটা ২০১৮। মইনুদ্দিনছাড়া আরও এগারোজন ছেলে। হাওড়ার রোবিন কোলে, পূর্ব বর্দ্ধমানের ইমানুল শেখ, উত্তর ২৪ পরগনার গগন মালিক আরও কয়েকজন। ব্যাগপত্র গুছিয়ে সবাই নানা জেলার নানারকম বাড়ি থেকে দমদম এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিল।

    রাত তিনটে। ঝলমল করছে দিল্লি এয়ারপোর্ট। জাগ্রোস এয়ারলাইন্স-এর ফ্লাইট। দু’ঘণ্টা আগে রিপোর্টিং হয়ে গেছে। লাগেজ-চেকিং কমপ্লিট। গন্তব্য চাবাহার হলেও, ফ্লাইট তেহেরান অবধি। ভোর পাঁচটা। নামল গিয়ে প্রথমবারের মতো বিদেশের রুক্ষ মাটিতে। তেহেরান থেকে আবার যাত্রা শুরু। এবার আর ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেনি গিয়াসউদ্দিন। এবার বাস। ভাড়া কমে যাত্রা। সাতাশ ঘণ্টার বাস।

    নতুন দেশ। নতুন ভূ-প্রকৃতি। অন্যরকম তাপমাত্রা। বাস চলেছে ইরানের চাবাহারের দিকে। ১৪৫৫ কিলোমিটারের যাত্রাপথ। ডানে-বাঁয়ে একেবারে আলাদা দৃশ্য। বর্দ্ধমান, হাওড়া, হুগলি, দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনা, উত্তর চব্বিশ-পরগনার চেনা কলাবাগান-বাঁশঝাড়-কাঁঠালগাছ-আমবাগান-পুকুরপাড়ের কলমি-ফার্ন-মস-কচুরিপানার ঘন-কালো-গাঢ় সবুজ-হাল্কা কচিকলাপাতা সবুজ দেখা চোখগুলোর ডানে-বাঁয়ে কাচের বাইরে তখন কেবল অন্য একটা রঙ। ধূসর চারপাশ। চারপাশে কেবল পাথর আর পাথর। পাহাড়গুলো যেন কেমন মৃত। শরীরে কোনও প্রাণ নেই। কচি-কচি চারা, পাথর থেকে খোলা আকাশের দিকে বেড়ে উঠে সবুজ করে দেয়নি পাহাড়ের শরীরকে। রুক্ষ ধূসর বাদামি রং তাদের। চলেছে তো চলেছে। শ্যাওলা-পড়া বাড়ির দেওয়ালের বদলে পাথরের ইটে তৈরি বাড়ি। বেশিরভাগ ধ্বংসাবশেষ। কোনওটার ছাত আছে। কোনওটার ছাত নেই। ভাঙাচোরা দেওয়াল। মানুষের বাস নেই। কুকুর-বেড়াল-ছাগল-গরু নেই। মাঝে মাঝে খাঁ-খাঁ প্রান্তর। ঊষর ভূমি।

    সাতাশ ঘণ্টার কয়েক ঘণ্টা পার করে মাঝে এসে থামল বাস। বাসের দরজা খুলল। বেরোতেই লাগলো ছ্যাঁকা। চিড়বিড় করে উঠল চামড়া। তাপমাত্রা চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি চলছে। মাথার উপর সূর্য। কোথাও বিন্দুমাত্র মেঘ নেই। ছায়া নেই। চড়া রোদের শুষ্ক তাপ শুষে নিতে চাইছে ওই শরীরগুলোর জল। জলখাবার খাওয়া হবে। একটা শুকনো সব্জির সাথে রুটি।

    আবার স্টার্ট। আবার বাস চলল সাঁ-সাঁ করে দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের দিকে। সেইরকমই ঊষর প্রান্তর, প্রাণহীন পাথরের মাঝখান দিয়ে। এগারোজন সোনার কারিগরের শরীর তখন খুব ক্লান্ত। আর মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। রওনা দেওয়ার কিছুক্ষণ আগে যা জানা গেছে, সেটা জানা ছিল না গতকালকেও। বিদেশে কাজ করতে গেলে দরকার এমপ্লয়মেন্ট ভিসা। গিয়াসউদ্দিন বলেছিল সব করে দেবে। ভিসা রেডি। কী ভিসা সেটা বলেনি। যাওয়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে জানিয়েছে, যে ভিসা দিয়েছে ওদের হাতে - সেটা ট্যুরিস্ট ভিসা। এই ভিসার মেয়াদ মাত্র নব্বই দিন। কথা আছে থাকতে হবে অনেকগুলো মাস। বছরের পর বছর। না হলে লাভও হবেনা কিছুই। বাড়ির গোলা-ভরা ধান বেচে, চড়া সুদে ধার করা টাকা জমা দিয়ে, বন্ধন ব্যাঙ্কের লোন নিয়ে, পাড়ার স্বর্ণকারের দোকানে বাড়ির গয়না বন্ধক রেখে, এগারোটা মানুষ চলেছে জেলা-রাজ্য-দেশের সীমা পার করে মাঝে আরও একখানা দেশ পার করে অন্য একটা দেশে। চেনা মুখগুলো ছেড়ে অনেক দূর। যেখান থেকে ইচ্ছে হলেই বাসে ট্রেনে চেপে ফেরা যায়না আর। আশা একটু বেশি রোজগার। খাওয়া খরচ, হাত খরচের পর আরও কিছু টাকা। কিন্তু এমপ্লয়েমেন্ট ভিসা তৈরিই হয়নি ওদের। কেমন একটা খটকা লাগছে মনে। একটা অস্বস্তি। বাস ছুটে চলেছে তখন কঠিন পাথুরে চড়াই-উৎরাই ভূমির উপর দিয়ে ওমান উপসাগরের দিকে…


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ৩১ জুলাই ২০২১ | ৩০৫৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ০১ আগস্ট ২০২১ ০৯:৩৯496268
  • কিচ্ছু বলার নেই। পড়ছি

  • ফারুক আব্দুল্লাহ | 146.196.46.58 | ০১ আগস্ট ২০২১ ১৬:৩৭496276
  • খুব খুব ভালো লাগলো, এত নিখুঁত বর্নণা যেন সব কিছুই চোখের সামনে ভাসছে।

  • সায়ন্তন চৌধুরী | ০১ আগস্ট ২০২১ ১৭:৫৪496278
  • এক্সেলেন্ট লেখা।


    এই শ্রমিকদের পুরো যাত্রাপথটাই এমন বিপজ্জনক; মধ্যপ্রাচ্যে যেরকম পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয়, তাতে কারখানায় আগুন লেগে বা উঁচু হাইরাইজে কনস্ট্রাকশনের কাজ করতে গিয়ে প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে। সৌদি আরবে বোধহয় মানবাধিকারের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। আবার ওখান থেকে মুক্তি পেতে উত্তর আফ্রিকা হয়ে ইউরোপে, বিশেষত লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পার করে গ্রীসে ঢোকার রাস্তাও ভয়ানক; সেখানেও দালালদের সঙ্গে ঝামেলা বাঁধে। এরকম ঝামেলার পরিণতিতে বছরখানেক আগে লিবিয়ায় হিউম্যান ট্র্যাফিকারদের হাতে একটা ম্যাসাকারের খবর পড়ি।


    আবার গ্রীসের স্ট্রবেরি ক্ষেতে এই মজুরদের প্রায় ক্রীতদাসের মতো ব্যবহার করা হয়; সে আরেক কাহিনী। এই লেখাগুলো বাংলাতে হোক।

  • ঋক | 2402:3a80:a8a:942b:91f5:9f5e:76b1:de63 | ০১ আগস্ট ২০২১ ২১:০৩496282
  • খুব ভালো লাগলো, শেষ অব্দি কী হল কে জানে বেচারি মইনুদ্দিনের।

  • তপন চন্দ | 2409:4061:2d4f:564b:127a:1c5c:2193:f809 | ০২ আগস্ট ২০২১ ১৭:২৯496304
  • সকরুণ ঘটনা। চোখে জল এসে যায়।

  • পারমিতা | 1.23.214.154 | ০৩ আগস্ট ২০২১ ২০:৩৯496373
  • অভাব মানুষকে কিভাবে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন